এই তো বেশ কিছুদিন আগের কথা, সম্ভ্রান্ত বাড়িতে রান্নার বামুন বলতেই ছিলো উড়িয়া বামুন। বিশেষ পালা-পার্বনে'ও বাড়িতে মিষ্টি তৈরীর সময় আসতেন উড়িয়া হালুইকর। কেমন হয় যদি আপনার হাতে চলে আসে এমনসব ঐতিহ্যবাহী উড়িয়া রান্নার একেবারে খাঁটি পাকপ্রনালী!! এমন'ই সেরা পাঁচটি মিষ্টির রেসিপি রইলো আজ...
ছেনা পোডো
আপনারা যারা উড়িষ্যায় এসেছেন সবাই নিশ্চয়ইএই মিষ্টি সঙ্গে পরিচিত।
দেখতে খুব কঠিন মনে হলেও ঘরে তৈরি করা কিন্তু খুবই সোজা।
এই বিখ্যাত মিষ্টি তৈরি করতে কি কি লাগে জেনে নিই।
প্রথমে দু লিটার দুধকে ভালো করে ছানা করে নিন।
বর্তমান এই ছানাটাকে একটি ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিন। কাপড়ে ঝুলিয়ে জল ঝরানোর কোনো আবশ্যকতা নেই। আমাদের ছানাতে একটু জল থাকলেই ছেনা পোড ভালোভাবে তৈরি হবে।
৩ বা ৪ বড় চামচ সুজি ।
হাতের কাছে কিছু শাল পাতা বা কলাপাতা রাখুন।
ছানার জলটা ফেলে দেবেন না । এই জল টা ছানা পোড তৈরি করার জন্য আমাদের পরে দরকার হবে।
হাফ কাপ চিনি নিয়ে ভালো করে গুড়ো করে রাখুন।
এলাচ গুঁড়ো করে রাখুন।
আসুন এবার এ মিষ্টি তৈরি করার পদ্ধতিটা জেনে নি।
প্রথমে একটি বড় পাত্র ছানাটা নিন ।
এতে চিনি , এলাচ গুঁড়ো ও বড় চামাচ এর দু চামচ ছানা র জল নিয়ে আস্তে আস্তে মাখুন। সুজি মেশান। এবার আর একটু ছানার জল দিন, মাখুন।
মাখার সময় বেশি মোলায়েম করে মাখার দরকার নেই।
ছানা যত দানাদার হবে ছানাপোড় র টেক্সচার তত ভালো হবে।
এবার একটি অ্যালুমিনিয়াম এর
টিফিন বাটিতে কলাপাতা বা শাল পাতা বিছিয়ে তার উপরে ঘি মাখিয়ে নিন।
ছানার মিশ্রণটি কলাপাতার উপরে ঢালুন।
এবার একটি প্রেসার কুকারে নুন বিছিয়ে নেই।
নুন এর উপর একটি স্ট্যান্ড দিয়ে এই টিফিন বাটিটাকে বসান।
গ্যাসের আঁচ কম করুন
হুইসিলটাকে বের করে দিয়ে প্রেসার কুকারে ঢাকনাটা উপরে চাপা দিয়ে দিন।
৪৫ থেকে ৫০ মিনিট ছানাটাকে ধীরে ধীরে পুড় তে দিন।
একটা কাঠি ঢুকিয়ে দেখে নিন কাঠি বেরোনোর সময় পরিষ্কারভাবে বেরোচ্ছে কিনা।
যদি কিছু কাঠিতে না লেগে থাকে তাহলে বুঝবেন আপনার ছানা পোড একদম রেডি।
খীর পোডো পিঠা
উড়িষ্যার একটি বিখ্যাত পিঠে যেটা কি ছপ্পন ভোগের একটি ভোগ যা জগরনাথের কে প্রসাদ রূপে অর্পণ করা হয়।
এই পিঠা তৈরির জন্য লাগবে:
এক কাপ গোবিন্দ ভোগ চাল
চার থেকে পাঁচ কাপ দুধ
নারকেল কুচি ( আধ বাটি)
নারকেল কোরা বড় চামচের তিন চামচ।
একমুঠো কাজু কিসমিস
আধ কাপ চিনি
ছোট চামচের এক চামচ নুন
কলা পাতা
২ থেকে ৩ চামচ ঘি
কিভাবে বানাবেন
প্রথমে গোবিন্দ ভোগ চালটাকে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন ।
* ভেজানো চাল পরিমাণ মত দুধ দিয়ে ভালো করে বাটুন ।
*এবার একটা তলা মোটা কড়াইতে বড় চামচ এর এক চামচ ঘি দিয়ে দিন।
*ঘি গরম হলে এতে কাজু কিসমিস দিন , ও বাকি দুধটা ফুটতে দিন।
* দুধ ফুটে উঠলে এর মধ্যে চিনি মেশান।
* চিনি দুধে মিশে গেলে এর মধ্যে নারকেল করা নারকেল কুচি দিয়ে একটু নাড়ুন।
*এবার আপনার বেটে রাখা চাল এর মধ্যে দিন এক চিমটি নুন দিন খুব কম আঁচ এ আস্তে আস্তে নাড়তে থাকুন ।
* কোন মতেই খুন্তি নাড়া বন্ধ করা যাবে না , তাহলে তলায় লেগে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে।
*এবার দেখবেন আস্তে আস্তে কড়াই থেকে জিনিসটা ছেড়ে আসছে
* তার মানে আপনার পাক দেয়া শেষ ।
*গ্যাসের ফ্লেম বন্ধ করে দিন।
*এবার আরেকটা তলা মোটা ননস্টিক কড়াই নিন
* কড়াই তে কলাপাতা সাজিয়ে দিয়ে তার উপরে একটু ঘি এর হাত বুলিয়ে নিন।
*এবার চালের মিশ্রণটিকে এই কলা পাতার উপরে ঢেলে উপর এর দিক টাকে জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে আস্তে আস্তে সমান করে নিন। ( মিশ্রণটি খুব গরম থাকে তাই জলএ হাত ডুবিয়ে সমান করলে হাত পোড়ার চান্স কম থাকে)
* ননস্টিক কড়াই গ্যাস এ বসান।
* গ্যাস এর আঁচ একদম কম করে মিশ্রণটি একটি কাঁচের ঢাকনা বা আপনার মন পছন্দ কোন ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন।
*আস্তে আস্তে নিচেরটা পুড়তে থাকবে , কম আঁচ এ এটি হতে 40 থেকে 45 সময় নেয়।
*একটি কাঠি ঢুকিয়ে দেখে নিতে পারেন।
*একপিট হয়ে গেলে( ঠান্ডা হয়ে গেলে) আরেকপিঠ সাবধানে উল্টে দিয়ে আর 15 মিনিট কম আঁচ এ রান্না করুন।
* এই পিঠে খুবই নরম ও সুস্বাদু হয় খেতে।
*পিঠাটি একদম ঠান্ডা হয়ে গেলে গ্যাস থেকে নামান ও পরিবেশন করুন।
অটা মালপোয়া
এই সুস্বাদু ও রসালো মালপোয়া সাধারণত আমি রথের দিন জগন্নাথ ঠাকুর কে ভোগ দিয়ে থাকি।
কী কী লাগবে:
দেড় কাপ আটা ১৫০ গ্রাম
আধ কাপ সূজি ৫০ গ্রাম
বড় চামচের চার চামচ মিল্ক পাউডার।
দু কাপ কিংবা (তার থেকে আরেকটু বেশি) ফোটানো দুধ।
চিনির রসের জন্য এক থেকে দেড় কাপ চিনি
অল্প ঘি
ছোট চামচ এর এক চামচ পান মৌরি
অল্প একটু এলাচ গুঁড়
সাজানোর জন্য কাজু পেস্তা কুচানো
ভাজার জন্য পরিমাণ মতন রিফাইন বা সাদা তেল
কিভাবে বানাবেন
* প্রথমে আটটার মধ্যে সরু দানা সুজি মিল্ক পাউডার পান মৌরি এলাচ গুঁড়ো ও দুধ দিয়ে একটি তরল মিশ্রণ তৈরি করুন।
মিশ্রণ বেশি মোটা হলে মালপোয়া গুলো লুচির মতন ফুলে ওঠে তাই মিশ্রণটি না পাতলা না খুব ঘন হবে
*এবার এই মিশ্রণটিকে ভালো করে গোলানো হয়ে গেলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ঢেকে রুম টেম্পারেচারে রেখে দিন
* যদি দেখেন মিশ্রণটি খুব বেশি ঘন হয়ে গেছে তাহলে আপনি আর একটু দুধ মিশিয়ে এটাকে ঠিক করে নিন।
* .গ্যাস এ চিনি ও জল মিশিয়ে বসিয়ে একটি পাতলা একতারের সীরা বানান ।
*.বর্তমান একটি ননস্টিক কড়াই বা যে কোনো তলা মোটা
কড়াইতে রিফাইন ও ঘি দিন ।
* তেল গরম হয়ে গেলে মাঝারি আঁচ এ , মিশ্রণ থেকে এক একটি হাতা নিয়ে এক এক করে মালপোয়া গুলো সোনালী করে ভেজে তুলুন ।
* একটি পাত্রে মালপোয়া গুলো সাজিয়ে উপর থেকে চিনি র রস ঢেলে দিন
* মালপোয়া গুলোকে চিনির রসে কিছুক্ষণ ভিজতে দিন
*এরপর উপর থেকে কাজু কিসমিস পেস্তা কুচি কুচি করে কেটে সাজিয়ে জগন্নাথ দেব কে এই মালপোয়া প্রসাদ অর্পণ করুন।
কাকরা পিঠা
উড়িষ্যার একটি খুব সহজ সুন্দর সুস্বাদু ও খুব কম সময় তৈরি হয়ে যায় এমনি একটি পিঠা র নাম হল সুজি কাকরা।
আসুন জেনে নিই এই পিঠার জন্য আমাদের কী কী লাগবে
এক কাপ পাতলা দানা সুজি
দু কাপ জল
নুন ও পরিমাণমতো চিনি
ঘি
ভাজার জন্য সাদা তেল ।
পুর তৈরির জন্য এখানে লাগছে এক বাটি নারকেল কোরা
দুবরো চামচ জল ঝরানো ছানা
এলাচ গুড়া ও চাইলে আপনি এর ভিতরে কাজু কিসমিস ও দিতে পারেন।
কিভাবে বানাবেন
প্রথমে একটি তলা মোটা কড়াই তে নারকেলের কোরা, জল। ঝরানো ছানা ,
এলাচ গুঁড়ো , চিনি ( কিংবা গুড়) কাজু কিসমিস দিয়ে তৈরি করে
ঠান্ডা করে রাখুন।
আরেকটি কড়াই তে যে কাপে সুজি মেপে নিয়েছিলেন সেই কাপে মেপে দু কাপ জল দিন।
হাফ চামচ নুন মেশান। এক চা চামচ ঘি দিন।
জল ফুটে উঠলে বড় চামচের তিন চামচ চিনি দিন।
আস্তে আস্তে সুজি দিয়ে মিশ্রণটিকে নাড়তে থাকুন।
একটি মণ্ড মতন তৈরি হয় কড়াই থেকে ছেড়ে আসলে , গ্যাসের আঁচ বন্ধ করুন
মিশ্রণটিকে একটি থালায় ঢেলে
ভালো করে মাখুন
আর এই মিশ্রণ থেকে ছোট ছোট গোলা নিয়ে , মাঝারি আকারের বলের মতন বানান।
বলের মধ্যেখানে নারকেলের পুর দিয়ে।, হাত দিয়ে একটু চেপে চেপে পিঠে গুলোকে একের পর এক তৈরি করে সরিয়ে রাখুন।
আরেকটা করাইতে তেলে অল্প একটু ঘি মিশিয়ে গরম করতে দিন
আপনার তৈরি করে রাখা পুর ভরা সুজির বল গুলোকে মাঝারি আঁচ এ সোনালী করে ভেজে তুলে রাখুন
তৈরি হলো আপনার উড়িষ্যার বিখ্যাত সুজি কাকরা।
এন্দুরী পিঠা বা হলাদি পত্র পিঠা
উড়িষ্যার একটি বিখ্যাত পিঠা হলো এই হলদি পত্র পিঠা বা এন্ন্ডুরি পিঠা।
প্রথমlঅষ্টমীর দিন উড়িষ্যার ঘরে ঘরে এই পিঠে তৈরি হয়।
এবং সেই সময় বাজারে প্রচুর পরিমাণে হলুদ পাতা পাওয়া যায়।
হলুদ পাতা না পেলে আপনি কলাপাতা সাইজ করে ছোট ছোট করে কেটে এই পিঠে তৈরি করতে পারেন।
আসুন জেনে নি এই পিঠা র জন্য কী কী লাগবে
* ৪০০ গ্রাম আতপ চাল
ধুয়ে ৩-৪ ঘন্টা ভিজিয়ে মিক্সিতে গুঁড়ো করে নিন
*৩০০ গ্রাম খোসা ছাড়ানো বিউলির ডাল
*১ চ। চামচ নুন
*হলুদ পাতা ভালো করে ধুয়ে সাইজ মতন কেটে নিন হলুদ পাতা না থাকলে কলা পাতাও নিতে পারেন
* গুড় কাজু কিসমিস দিয়ে নারকেলের পরিমাণ মতন পুর তৈরি করে রাখুন।
কিভাবে বানাবেন
প্রথমে বিউলির ডাল সারা রাত ভিজিয়ে জল ঝরিয়ে ভালো করে বাটুন।
এই মিশ্রণে আগের থেকে ভিজিয়ে গুড়ো করে রাখা চালের গুঁড়ো মেশান
এবার চাল এবং বিউলির ডাল ভালো করে ফেটিয়ে নিন , (বেশি জল ব্যবহার করবেন না বিউলির ডাল বাটতে যতটুকু জল দরকার তার থেকে বেশি জল না মেশানোই ভালো)
বর্তমান এই মিশ্রণটিকে ৭ ৮ ঘণ্টা ভালো করে ফাটিয়ে ঢেকে ফরমেনটেশন হওয়ার জন্য রেখে দিন। পিঠা তৈরি করার আগে এই মিশ্রণে এক চামচ নুন মিশিয়ে আবার ভালো করে ফেটিয়ে নিন ।
নারকেলের পুরটা তৈরি করে নিন।
স্টিমারে জল দিয়ে গরম হতে দিন।
এবার হাতের তালুতে একটি করে হলুদ পাতা বা কলাপাতা রাখুন
বড় চামচের দু'চামচ বিউলি ও চালের মিশ্রণ দিন
মিশ্রণটিকে একটু ছড়িয়ে নিয়ে তার ভিতরে বড চামচ এর দু চামচ নারকেলের পুর দিন।
এবার পাতা টিকে বন্ধ করে দিন।
এই ভাবে এক এক করে সব পিঠা গুলোকে তৈরি করে নিন।
আরে এবার পিঠেগুলোকে 10 থেকে 15 মিনিটের জন্য স্টিম করে নিন।
আপনার সুস্বাদু হলদি পত্র পিঠা বা এন্ডুরি পিঠা এবার পরিবেশনের জুন তৈরি ।
হলুদ পাতার সুগন্ধে পিঠে
গুলো সুগন্ধিত হয়ে উঠবে।
Comments