top of page

শতবর্ষের রক্তকরবীতে দেবব্রত বিশ্বাস ও শম্ভু মিত্র শ্রদ্ধা ও প্রণামে সমীর চট্টোপাধ্যায়

rojkarananya

শম্ভু মিত্র দেবব্রত বিশ্বাসের থেকে চার বছরের ছোট। দুজন দুজনকে চিনতেন। জানতেন। বুঝতেন কিনা জানি না! তবে ভালো তো বাসতেনই। কারণ, দুজনের সাদৃশ্য যে অনেকক্ষেত্রেই। দুজনেই বাংলা সংস্কৃতির মহীরুহ। দুজনেরই কর্ম প্রবাহে গণনাট্য সংঘের শোণিতধারা বহমান। দুজনের জন্মদিন-ই যে একই দিনে। অর্থাৎ ২২ শে অগস্ট। এই দুজনই জড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর সঙ্গে। এ বছর রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর একশ বছর।

‘রক্তকরবী’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রূপক-সাংকেতিক নাটক। মানুষের প্রবল লোভ কীভাবে জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক যন্ত্রে ও উৎপাদনের উপকরণে পরিণত করেছে এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কী রূপ ধারণ করছে তারই রূপায়ণ এই নাটকের অবয়বে। নাটকটি বাংলা ১৩৩০ সনে রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ইংরিজির ১৯২৩-এ। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়।

খনি শ্রমিকরা মানুষ নয়। তারা স্বর্ণলাভের যন্ত্রমাত্র। এখানে মনুষ্যত্ব, মানবতা যন্ত্রবন্ধনে পীড়িত ও অবমাননায় পতিত। জীবনের প্রকাশ যক্ষপুরীতে নেই। জীবনের প্রকাশের সম্পূর্ণরূপ-প্রেম ও সৌন্দর্য, 'নন্দিনী' চরিত্রে বিদ্যমান। নন্দিনী সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। এক মুহূর্তে মুক্ত জীবনানন্দের স্পর্শে যেন সবাই চঞ্চল হয়ে উঠল।


রক্তকরবী আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৃদয়ে লালন করা এক স্বপ্ন। কেউ কেউ এই নাটকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার ছায়া খুঁজেছেন। নানা প্রশ্ন, নানা যুক্তি নিয়ে এই  নাটকটি রচনার পর থেকে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে। বেড়েছে জনপ্রিয়তাও। আজ পর্যন্ত প্রায় একশ বছর পার হলেও রক্তকরবী নিয়ে আজও প্রাজ্ঞজনের বিশ্লেষণের কোনও শেষ নেই। রক্তকরবী নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে। বিশ্লেষকদের একটি অংশ এ নাটকে রবীন্দ্রনাথে ঠাকুরের সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রভাব পড়েছে বলেও যুক্তি দেখিয়েছেন। তবে রূপকাশ্রয়ী এ নাটকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রবীন্দ্র মানসে একটি স্বপ্ন খুব উজ্জ্বল যেখানে আঁধার ভেঙে এক উজ্জ্বল আলো সন্ধানের স্পৃহা অতি সুস্পষ্ট। কিন্তু সেই আঁধার ভাঙার জন্য যে বিপ্লব প্রয়োজন, তার ধরনটা একেবারেই আলাদা। আপাতদৃষ্টিতে এ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করলে মার্কসীয় দর্শনের সঙ্গে এ নাটকের অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব, শোষণ, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা সবই আছে রক্তকরবীতে। তবে মুক্তির যে পথ রবীন্দ্রনাথ এখানে দেখিয়েছেন, সেখানে মার্কসীয় বিপ্লব থেকে খানিক আলাদা এক বিপ্লবের ঈঙ্গিত। কার্ল মার্কস যে শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলেছেন সেই শ্রেণির কথা এখানে স্পষ্ট আছে। মুক্তির পথ হিসেবে দেখানো হয়েছে শোষক এবং শোষিত উভয়ের মধ্যে আলোর প্রদীপ জ্বালানো। সে আলোর আরেক রূপ নন্দিনী, সে আলোর উপমা রক্তকরবী ফুল এবং সে আলোর যোদ্ধা রঞ্জন বিশু কিংবা কিশোর। রক্তকরবী এক বিপ্লব যা শিল্প এবং সৃষ্টি দিয়ে রাজা নয়, রাজনীতির পরিবর্তন আনে। যা অর্থনৈতিক মুক্তির চেয়ে সৃজনের আলোর মুক্তির পথ দেখায়।


বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে ‘রক্তকরবী’ নাটকের মঞ্চ প্রযোজনা বহুচর্চিত অধ্যায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করতে পারেননি, নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি প্রযোজনা করতে চেয়েও শেষমেশ করে উঠতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে এ নাটকের একটিমাত্র অভিনয়ের খবর পাওয়া যায়। ১৯৩৪ সালের ৬ এপ্রিল ‘দি টেগোর ড্রামাটিক গ্রুপ’-এর উদ্যোগে কলকাতার নাট্যনিকেতনে। অনেক পরে ১৯৫৪ সালে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’-ই এই নাটকের প্রথম স্মরণীয় মঞ্চায়ন। শ্রেষ্ঠতম প্রযোজনা বটে। তবে বহুরূপীর সেই বিখ্যাত প্রযোজনার বেশ কয়েক বছর আগে ১৯৪৭ সালে রক্তকরবী প্রযোজনা করেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। মানে জর্জ বিশ্বাস। সেই নাটকে রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শম্ভু মিত্র।


১৯৫৪ সালে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় শিয়ালদহের ই. বি. আর ম্যানসন ইনস্টিটিউটে ‘রক্তকরবী’ প্রযোজিত হয়। যে প্রযোজনা রবীন্দ্র-নাটককে বাংলা রঙ্গমঞ্চে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি বাংলা থিয়েটারের গতিপথও বদলে দেয়। রাজার চরিত্রে শম্ভু মিত্র ছাড়াও অভিনয় করেছিলেন তৃপ্তি মিত্র (নন্দিনী), শোভন মজুমদার (বিশু পাগল), অমর গঙ্গোপাধ্যায় (সর্দার), কুমার রায় (গোঁসাই)। মঞ্চপরিকল্পনায় ছিলেন খালেদ চৌধুরী এবং আলোক নির্দেশনায় তাপস সেন। বহুরূপীর প্রযোজনা ‘রক্তকরবী’-কে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, যে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলা থিয়েটার ‘রক্তকরবী’র প্রযোজনায় হাতই দেয়নি।


শিশিরকুমারের পরিকল্পনা থেকে শম্ভু মিত্রের প্রযোজনা, এই কুড়ি বছর সময়ের মধ্যে বেশ কিছু রবীন্দ্র অনুসারী সংগঠন ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনা করেছিল। তবে সাধারণ মানুষ তো বটেই, বাংলার নাট্যমোদী মানুষের অনেকে তার স্বাদ অনুভব করতে পারেননি। বা খুব উচ্চমানের প্রযোজনাও হয়নি। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে ‘রক্তকরবী’র প্রযোজনায় অংশগ্রহণ করেন দেবব্রত বিশ্বাস। ‘গীতবিতান’ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায়তনের প্রযোজনায় নাটকটিতে তিনি বিশু পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তার কিছুদিন পরে তিনি নিজেই ‘রক্তকরবী’ পরিচালনার কাজে হাত দেন। প্রযোজনায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মহিলা সংগঠন ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’। অভিনীত হয়েছিল শ্রীরঙ্গম মঞ্চে। অভিনয়ে ছিলেন শম্ভু মিত্র (রাজা), কণিকা মজুমদার (নন্দিনী), দেবব্রত বিশ্বাস (বিশু পাগল), তৃপ্তি মিত্র (চন্দ্রা), কালী ব্যানার্জি (সর্দার), সজল রায়চৌধুরী (গোঁসাই) এবং কয়েকজন ট্রাম শ্রমিক। মঞ্চ পরিকল্পনায় ছিলেন সূর্য রায় এবং খালেদ চৌধুরী। মঞ্চে রাজাকে আড়াল করার জন্য একটা বিরাট জাল তৈরি করে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার ভিতরে একটা ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছিল। কলাকুশলীদের প্রায় প্রত্যেকেই তখন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। প্রযোজনাটি উচ্চমানের হয়েছিল তো বটেই, পাশাপাশি তার দরজা খোলা ছিল সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের জন্য।


রবীন্দ্রনাথের নাটকের অভিনয় হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির মহিলা সংগঠন, গণনাট্যের শিল্পী আর ট্রাম শ্রমিকদের যুগলবন্দিতে। যে নাটকে যক্ষপুরীর শ্রমিকরা সমস্ত বন্ধন ভেঙে রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নেপথ্যে শোনা যায় কৃষক রমণীর সোনার ফসল ঘরে তোলার ডাক। স্বয়ং রাজা যিনি এক যন্ত্র সভ্যতার নায়ক, তিনি তার ‘সিস্টেম’-এর জাল ভেঙে শ্রমিকদের সংগ্রামে যোগ দেন। সেই নাটক অভিনয়ের প্রথমবারের সাক্ষী হচ্ছেন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। পরিচালনা করছেন রবীন্দ্রসংগীতের ‘ব্রাত্যজন’ দেবব্রত বিশ্বাস আর ‘রাজা’র চরিত্রে অভিনয়ে শম্ভু মিত্র। সময়কালটাও ছিল অদ্ভুত! মাত্র কয়েকমাস আগে দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই স্বাধীনতার রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে অনেকের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনার মাস খানেক পরেই কমিউনিস্ট পার্টি ‘ঝুটা স্বাধীনতা’ ঘোষণা করে।

যে পথ নির্মাণের কাজ দেবব্রত বিশ্বাসের পরিচালনায় শুরু হয়েছিল, আচমকা তার ব্যাটনটা হাত থেকে ফসকে গেল। এ বিষয় নিয়ে কোনও সংশয় নেই যে, বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’র জনপ্রিয়তা আর মঞ্চনৈপুণ্য দেবব্রত বিশ্বাসের প্রযোজনার তুলনায় অনেক গুণে এগিয়ে ছিল। কিন্তু প্রশ্নটা সাফল্যের নয়, প্রশ্নটা সাধারণ মানুষের মাঝে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কারের। অন্যদিকে শম্ভু মিত্র গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের দল ‘বহুরূপী’ তৈরি করলেন। ১৯৫৪ সালে প্রযোজনা করলেন ‘রক্তকরবী’। রবীন্দ্রনাথকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করল বাংলা নাট্যমহল। ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইল শম্ভু মিত্রের নাম। সত্যিই এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালেই। অভিনয়ে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র তো ছিলেনই, মঞ্চ পরিকল্পনায় খালেদ চৌধুরী দুটি প্রযোজনাতেই ছিলেন। রাজার জালের দৃশ্যের মঞ্চসজ্জা দুটি অভিনয়ে একই রকম ছিল।

আজকের দিনে ১৯১১ তে জন্মেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। তাঁর জন্মের কয়েক দিন আগে ইংল্যান্ডের রাজা হন পঞ্চম জর্জ। ইংরেজদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অতিভক্তি বশত তাঁর বাবা-মা আদর করে দেবব্রতকে ডাকতেন জর্জ নামে। দেবব্রত বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত এই জর্জ থেকে ‘জর্জ দা’ নামেই সংগীত সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন।  দেবব্রত বিশ্বাসের বাবা ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্ম। সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রাগানের প্রতি তাঁর ছিল ঘোর অমত। তবে ব্রাহ্ম হওয়ায় বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় প্রার্থনা হিসেবে মায়ের সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাস গাইতেন ব্রহ্মসংগীত। এই প্রার্থনা থেকেই তাঁর গাওয়ার শুরু। এ ছাড়া মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে আরও কিছু গান শিখে নিয়েছিলেন তিনি। ময়মনসিংহ ব্রাহ্মসমাজের মাঘোৎসবের গানের দলে প্রতি বছর মায়ের সঙ্গে থাকতেন তিনিও। বাড়িতে হারমোনিয়াম, অর্গান ছিল। বলা যায়, শৈশব থেকেই তিনি পেয়েছিলেন সংগীত-সহায়ক পরিবেশ। আজ তিনি ১১২ বছর পূর্ণ করলেন।


অন্যদিকে শম্ভু মিত্র জন্মগ্রহণ করেন, ১৯১৫ তে। আজকের দিনেই। কলকাতায় জন্ম। পড়াশোনার শুরু বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। এখানে পড়ার সময় থেকেই অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি তাঁর আগ্রহ তৈরি হতে শুরু করে। ছাত্রজীবনে তিনি নাটক করেছেন কখনও স্কুলে, কখনও বকুলবাগানের ‘গোল মাঠে’। এই ভাবেই নাট্যমঞ্চে তাঁর প্রথম পদার্পণ। অন্য যে আগ্রহটি ছেলেবেলায় ক্রমশ তাঁর মনের মধ্যে চেপে বসেছিল, তা আবৃত্তি। প্রতিবেশী প্রবোধ মিত্রকে শম্ভু ‘বড়দা’ বলে ডাকতেন। তিনিও অল্প বয়সে তাঁকে আবৃত্তিতে উৎসাহী করে তুলেছিলেন। মুখস্থ করে ফেলার অভ্যেস ছিল তাঁর। পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করে নিজেকে তৈরি করার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তাঁর। নাটক, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি নানা বিষয়ের বই পড়তে শুরু করেন তিনি। সেখান থেকেই তিনি আজকের শম্ভু মিত্র। শম্ভু মিত্র, তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডিকে গেঁথে দেন মানুষের চিরন্তন সংগ্রাম ও এগিয়ে চলার ঐকান্তিকতার সঙ্গে। তিনি মানুষের উপর বিশ্বাস হারাননি কখনও। তিনিই তো ডাক দেন, “প্রস্তুত সবাই? হৈ-ঈ-ঈ-য়াঃ। কতো বাঁও জল দেখ। তল নাই? পাড়ি দেও, এ আন্ধারে চম্পক নগরী তবু পাড়ি দেয় শিবের সন্ধানে। পাড়ি দেও, পাড়ি দেও”...। সত্যের সন্ধানে শম্ভু মিত্র সারা জীবন পাড়ি দিয়েছিলেন, কারণ চাঁদের মতোই তাঁর চোখেও স্বপ্ন ছিল।

স্বপ্নের সদাগর নাট্যপুরুষ শম্ভু মিত্র ও সঙ্গীতপুরুষ দেবব্রত বিশ্বাসকে জন্মদিনে বিনম্র প্রণাম।

Opmerkingen


Rojkar Ananya New Logo copy.jpg

Your key stats for the last 30 days

Follow us on

fb png.png

©2023 to Debi Pranam. All Rights Reserved

bottom of page