মৃণাল সেন...
নীল আকাশের নীচে রাত ভোর দাঁড়িয়ে থাকা পদাতিক...
একশ বছরের তরুণ, যাকে খারিজ করা যায় না, সেই মহান পরিচালক। না, তেমন যুৎ সই কিছু হল কই! প্রায় নীরবে নিভৃতেই তো চলে গেল, জন্মদিনটা। শহরের দু’একজন যেটুকু এগিয়ে এলেন, তাতেই পূর্ণ হল একশ বছরের জন্মদিন। এমনটাই কি হওয়ার কথা ছিল? তাঁর ভাবনা, কৃষ্টি, সৃষ্টি কি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের একেবারে সমৃদ্ধ করেনি? করেনি কি বাংলার সংস্কৃতিকে আলোড়িত! জন্মশতবর্ষে বাংলা চলচ্চিত্রের অনন্য পরিচালক শ্রীযুক্ত মৃণাল সেনকে রোজকার অনন্যার পক্ষ থেকে প্রণাম জানাচ্ছেন সমীর চট্টোপাধ্যায়

সেই কবেকার কথা। ছোট্ট আমি’র তখন মায়ের হাত ধরে সিনেমা হলে ঢোকা। সিনেমার নাম ‘নীল আকাশের নিচে’। এর আগে অবশ্য গুপী গায়েনের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে আমার। হীরক রাজাকেও দেখে ফেলেছি। তখন তো এতটা বুঝতাম না, কিন্তু ‘নীল আকাশের নিচে’ আমার খুব ভালো লেগেছিল। শুনেছিলাম, এই ছবির পরিচালক মৃণাল সেন। সেই থেকে মৃণাল সেনের সঙ্গে পরিচয় আমার। এরপর দেখতাম, সিনেমার প্রসঙ্গ উঠলেই সবাই বলতেন, সত্যজিৎ-মৃণাল...! অর্থাৎ সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন। ঋত্বিক ঘটক, তপন সিনহারা অনেক পরে এসেছেন আমার জীবনে।
তিনি সিনেমা বানাতেন। নানান ভারতীয় ভাষায় ছবি করেছেন। মৃণালবাবুর শিরদাঁড়াটা বেশ দৃঢ়। কনফিডেন্স চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ত। তিনি বলতেন, ‘আমি দারিদ্র্য নিয়ে ছবি করি। আফ্রিকাতে গিয়ে সোয়াহিলি ভাষায় ছবি করতেও আমার কোনও অসুবিধে হবে না...।’ দারিদ্র্যকে ধরতে নগর উপকণ্ঠের অলিগলিতে মুখ বাড়িয়েছেন। ছুটে গেছেন গ্রামের পথে। ঘুরে বেরিয়েছেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকেই আমরা পেয়েছি গ্রামকে, গ্রামের মানুষজনকে। আমরা একাত্ম হয়েছি তাঁদের সঙ্গে। তাঁদের দারিদ্র্য, জীবনযাপন, সম্পর্কের ওঠা-পড়া আমাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়।

১৯২৩ সালের ১৪ মে। মৃণাল সেন পৃথিবীতে এলেন। বাংলাদেশের ফরিদপুরের একটি শহরে তাঁর জন্ম। এখানেই কেটেছে মৃণাল সেনের ছেলেবেলা। পড়াশোনা। উচ্চবিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে উচ্চ শিক্ষার জন্য সপরিবারে কলকাতায় পাড়ি দিলেন ওঁরা। সেই সময় দেশে ভাগাভাগি, ভাঙাভাঙির খেলা চলছে। ফিজিক্সের ছাত্র। স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর পড়াশোনা। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। সরাসরি রাজনীতি করলেন না। পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গেই কাজ করতে লাগলেন। কখনই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। চল্লিশের দশকে আইপিটিএর (ইন্ডিয়ান পিপ্লস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন)সদস্য হলেন। চলার পথটা খুব সহজ ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই, অনেক বাঁক পেরিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে, জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় থেকেই উপার্জনের উপায় খুঁজতে শুরু করেন। বেশ কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। করেছেন ওষুধ বিপননকারীর কাজ। সিনেমাশিল্পের সঙ্গে যোগ চলচ্চিত্রে শব্দকুশলী হিসেবে। তখন ছিল চাকরি। তারপর একদিন নিজেই দাঁড়ালেন ক্যামেরার পিছনে। ‘অ্যাকশান’, ‘কাট’ যে বলতেই হবে। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মৃণাল সেন ছবি করবেন। করবেনই তো! উনি তো আর অন্য কিছু করতে আসেননি। ১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘রাতভোর’ মুক্তি পেল। ছবিটি তেমন সাফল্য পায়নি।
তা হোক, জীবনের প্রথম ছবি বলে কথা! সব প্রথমের প্রতিই মানুষের একটা আলাদা টান থাকে। আবেগ, ভালোবাসা থাকে৷ নিজের প্রথম ছবি সম্পর্কে কথা বলতে ভালোবাসেন প্রায় প্রত্যেকেই৷ মৃণাল সেন কিন্তু সেদিক থেকে ব্যতিক্রম৷ তিনি তাঁর প্রথম ছবির স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে চান৷ কোনও জায়গায় তিনি এই ছবির কথা বলতেন না। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োতে হওয়া স্মরণসভায় উত্তমকুমার প্রসঙ্গে মৃণাল সেন অনেক কথা বললেও কখনওই ‘রাত-ভোর’ ছবিটির কথা উল্লেখ করেন নি। প্রসঙ্গত বলি, ‘রাত-ভোর’ ছবিতে উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন৷ কখনও কোনও ক্ষেত্রে এই ছবির কথা উঠলে তিনি খুব সহজেই বলতেন এখানে অনেক গণ্ডগোল আছে।

‘রাত-ভোর’…
‘রাত-ভোর’-এ ঠিক গণ্ডগোলটা কোথায়?
মৃণাল সেন বলতেন, ‘সিনেমার যে একটা টেকনিক্যাল দিক আছে এবং ছবি করতে গেলে সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার, তা আমার জানা ছিল না৷ আর গল্পটা বড়ো বেশি দুর্বল ছিল, বড়ো বেশি আবেগ সর্বস্ব৷ গল্পটা আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এ কথা বলা ঠিক হবে না৷ কেননা সাহিত্য আমার ভালোই পড়া ছিল৷ তবুও আমার মনে হয়েছিল এই গল্প থেকে ছবি হতে পারে৷ সুতরাং গণ্ডগোলটা ছিল আমারই। একটা বাজে গল্প আর ফিল্মের টেকনিক সম্পর্কে কোনও জ্ঞান না থাকায় ব্যাপারটা কোথাও দাঁড়ায়নি৷ আমি ছবিটার নামও উচ্চারণ করতে চাই না৷ আমার এতটাই খারাপ লাগে৷ ছবিটা করে আমি এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে ভাবতে শুরু করেছিলাম আমার সিনেমা ছেড়ে অন্য কিছু করা উচিত৷’
ছবির প্রযোজক ছিলেন সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দিক থেকে কিন্তু কোনও ত্রুটিই ছিল না। তিনি যা যা করার, সবটাই করেছিলেন। বাংলা ছবির বাণিজ্যের সেরা সময় পুজোতেই ছবির মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন৷ ধরেছিলেন ছবি মুক্তির সেই সময়ের সেরা চেন, রূপবাণী-অরুণা-ভারতী৷ ‘রাত-ভোর’ মুক্তি পেল, ২১ অক্টোবর, ১৯৫৫৷ এর ঠিক দু’মাস আগে মুক্তি পেয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। তখনও চলছিল৷ ‘রাত-ভোর’-এর সঙ্গে মুক্তি পেল, রাজ কাপুরের ‘শ্রী৪২০’৷ ভি শান্তারামের ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’, দিলীপকুমার অভিনীত ‘আজাদ’, দেবকীকুমার বসুর সুচিত্রা সেনের ‘ভালবাসা’৷ এরা প্রায় প্রত্যেকেই খানিক কল্কে পেলেও কেবল ‘রাত-ভোর’-এর শিকেটাই ছিঁড়ল না। ছবিটা সুপারফ্লপ হল৷ ছবির অভিনেতা উত্তমকুমারের সে বছর আটটি ছবি মুক্তি পেল। এরমধ্যে যথেষ্ট বাণিজ্যসফল ছবিও তো ছিল। তপন সিনহার ‘উপহার’, অগ্রদূতের ‘সবার উপরে’, চিত্ত বসুর ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’, সুবোধ মিত্রের ‘রাইকমল’, হরিদাস ভট্টাচার্যের ‘দেবত্র’, সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের ‘সাঁঝের প্রদীপ’, সুধীর মুখোপাধ্যায়ের ‘শাপমোচন’। এদের মধ্যে কয়েকটা ছবি তো ভালো পয়সা দিয়েছিলো। বক্স অফিস হিটও করেছে। কিন্তু এই ছবিটার ক্ষেত্রে যে কী ঘটল! মাত্র ২১ দিন চলেছিল ছবিটা৷ ১০ নভেম্বর, ১৯৫৫-তেই ‘রাত-ভোর’ উঠে যায়। আর কখনও ফিরে আসেনি। মৃণাল সেনের সৃজনশীল চন্দ্রের কলঙ্ক এই ‘রাত-ভোর’ ছবিটি।

এই ছবি নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে। আপনারা জানেন, মৃণাল সেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিলেন টেকনিশিয়ান হিসেবে। তারপরই পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি, ‘রাত-ভোর’।
১৯৫৪ সালে উত্তমকুমার নায়ক হিসেবে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত৷ আপনারা তো এর আগেই দেখলেন, এই ছবির মুক্তির বছর অর্থাৎ ১৯৫৫-তে কতগুলো হিট ছবি বেরল। যখন ‘রাত-ভোর’ ছবিতে উত্তমবাবু সাইন করছেন তখন তাঁর চারটি ছবি মুক্তি পেলেও, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৪-তে যখন ছবির শুটিং হচ্ছে, তখন নায়ক উত্তমের মুক্তি পেয়ে গেছে ১১ টা ছবি৷ যার মধ্যে আছে ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র মতো সুপারহিট ছবিও৷ ‘অগ্নিপরীক্ষা’-ই উত্তমকুমারকে বাংলা ছবির সুপারস্টার বানিয়ে ছিল৷ এই ছবিতে উত্তমকুমার পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা৷ পরিচালক মৃণাল সেন সেদিক থেকে খুব ভুল কিছু করেননি। উত্তমকুমার ততক্ষণে বাংলা ছবির দর্শকের কাছে যথেষ্ট পরিচিত নাম হয়ে গেছে। সুপারস্টারও হয়ে গিয়েছেন। অদ্ভুত ব্যাপার, সেই সময় উত্তমকুমার কিন্তু এই ছবির জন্য সেই পারিশ্রমিক নেননি। ‘রাত-ভোর’ ছবির সহকারী পুনু সেন জানাচ্ছেন, ‘রাত-ভোর’-এ উত্তমকুমারের পারিশ্রমিক ছিল মাত্র তিন হাজার টাকা৷
‘রাত-ভোর’ এক নজরে
১৯৫৫ সালে মৃণাল সেন তাঁর প্রথম ছবি ‘রাত-ভোর’ তৈরি করেন৷ এস বি প্রোডাকসন্সের ছবি। প্রচার পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগের দায়িত্বে ছিল ক্যাপস নামে একটি প্রচার সংস্থা৷ তাদেরই দায়িত্বে ছবিটির বুকলেট বা প্রচার পুস্তিকাটি তৈরি হয়েছিল যার প্রকাশক হিসেবে নাম ছিল এস বি প্রোডাকসন্স-এর৷ রমন ব্রাদার্স থেকে মুদ্রিত ডিমাই সাইজের বুকলেটটির প্রচ্ছদ রঙিন না করে সাদা-কালোয় ছাপা হয়েছিল৷ না, এটা অর্থাভাব বা অযত্নের কারণে তৈরি হয়নি। একটা ইন্টেলেকচুয়াল ভাবনা তো ছিলই। বুকলেটের প্রচ্ছদটিতে একটা ইঙ্গিত ছিল। ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, এটা দুঃখের অমানিশা অবসানে আসন্ন সুখ-শান্তিতে ভরা ভোর হয়ে আসার কথাই ঘোষণা করে৷ ছবিটি চলেনি। কিন্তু এই গল্পটা মৃণাল সেন পরে নানা ফিল্মে বলতে চেয়েছেন।
নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় (প্রথম দিন থেকেই মৃণাল সেনের বন্ধু,‘ন্যাপা দা’ নামে সকলেই চেনেন) বলেছিলেন, ‘তখন আমাদের আড্ডা ছিল হাজরার কাছে প্যারাডাইস ক্যাফে-তে৷ মৃণাল, ঋত্বিক, সলিল এরা সবাই নিয়মিত আসত৷ বংশী (চন্দ্র গুপ্ত) মাঝে-মধ্যে আসত৷ মৃণাল আর ঋত্বিক তো পকেটে সিনেমার চিত্রনাট্য আর বাজেট রেখেই দিত সব সময়৷ ভাবটা এমন, যেন যে-কোনও সময়ে একজন প্রযোজক এসে পড়তে পারে৷’ বোঝা যাচ্ছে, প্যারাডাইস ক্যাফে-ই ছিল ‘রাত-ভোর’ তৈরির আঁতুড়ঘর৷ এখন তা নেই। এক সময় ছিল। এই ১১৩/২ হাজরা রোডই ছিল মৃণাল সেনের প্রথম ছবি ‘রাত-ভোর’-এর প্রি-প্রোডাকশন সেন্টার৷
রমেশ সেন (যিনি পুনুদা নামে পরিচিত। পরবর্তীতে সত্যজিৎ রায়ের সহকারী৷ ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘আগন্তুক’ পর্যন্ত) বললেন, ‘ক্যালকাটা কেমিক্যালের পাশের বাড়ির দোতলায় থাকতেন মৃণালদা৷ সেখানেই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ন্যাপাদা৷ ছোট্টো ঘর৷ কোনওমতে থাকতেন৷ কিন্তু অনেক অভাবের মধ্যেই রসিকতা বোধটা ছিল প্রখর৷ ‘রাত-ভোর’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল ম্যুর অ্যাভিনিউ-এর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্টুডিয়োতে৷ সেট বানিয়ে শুট হয়েছিল৷’ সে স্টুডিও এখন নেই। মৃণাল সেন তাঁর প্রথম ছবিকে কমার্শিয়ালি সফল করার কথা কিন্তু ভেবেছিলেন। তিনি কাস্ট করেছিলেন উত্তমকুমার এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে। সঙ্গে নিয়েছিলেন দু’জন দক্ষ সহ অভিনেতা-অভিনেত্রী, ছবি বিশ্বাস এবং শোভা সেনকে৷ সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সলিল চৌধুরী। স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প৷ গল্পে সত্যি তেমন কোনও জোর ছিল না। চোদ্দো বছরের লোটন৷ গ্রামের কিশোর ছেলে৷ গ্রামের ছেলে শহরে আসছে৷ শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। এক মর্মান্তিক পরিণতিতে তার মৃত্যু হচ্ছে৷ কিশোর যন্ত্রণা নিয়ে আবেগঘন সিনেমা তৈরি করলে দর্শককে টানা যাবে ভেবেছিলেন প্রযোজক। কিন্তু যেমন ভাবা তেমনটা তো হয়নি। সেই সময়ের এক সংবাদপত্রে সমালোচক লিখছেন, ‘কাহিনিতে এমন কিছু নেই যা দিয়ে একটি সফল চিত্রনাট্য তৈরি হতে পারে, এই চিত্রনাট্যটি এতই দুর্বল যে সিনেমাতে কোনও কিছুই কাজ করেনি৷ ছবির প্রথমার্ধ্ব গ্রামে, এবং দ্বিতীয়ার্ধ্ব শহরে৷ কিন্তু একটিই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্প ঘুরে চলেছে৷ ছবির গল্প ভালো না হলেও চিত্রগ্রহণ এবং সঙ্গীত ভালো৷ শব্দগ্রহণ অত্যন্ত নিম্নমানের, ছবির অর্ধেক সংলাপ ভালো করে বোঝাই যায়নি৷ ছবির শেষে এটাও বোঝা যায়নি ছবির নাম কেন রাতভোর…৷’ ছবির চিত্রনাট্য তো লিখেছিলেন, মৃণাল সেন নিজেই।
নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু অন্য কথা বললেন। বললেন, ‘এই গল্পটাই কিন্তু মৃণাল একের পর এক ছবিতে পরবর্তী সময়ে বলতে চেয়েছে৷ গ্রাম এবং শহরের সামাজিক ফারাক, শ্রেণির ফারাক৷ হয়তো পরে যেভাবে বলতে পেরেছে, এই ছবিতে সেভাবে বলতে পারেনি, কিন্তু কী বলতে চায় ওর ছবির মাধ্যমে সেটা কিন্তু প্রথম দিন থেকেই ওর মধ্যে স্থির ছিল৷’
আসলে একটা ছবির সাফল্য ব্যর্থতা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। প্রোডাকশন হাউস বা প্রযোজক সংস্থার ইচ্ছে, মর্জির উপরও অনেক কিছু দাঁড়িয়ে থাকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিচালকের ইচ্ছের উপরও কাঁচি চালানো হয়। যদি ইন্ডাস্ট্রির আপনি মহাপরিচালক হন, ঝুলিতে খান কতক জাতীয় পুরস্কার একটা দুটো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকে, তাহলে পরিচালকের ভাবনার খানিক সম্মান আছে, নাহলে নিজের অল্প ভাবনার সঙ্গে প্রযোজকের বেশি ভাবনার মিশেলে ছবি করতে হবে। লোকেশন থেকে আর্টিস্ট নির্বাচন, গল্প চালনা থেকে সঙ্গীত পরিচালনা—সবটাতেই বাবুর মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাতে থাকতেই পারে খানিক কম্প্রোমাইজ, অনেক বেশি স্যাক্রিফাইজ। আর নতুন পরিচালক হলে তো কোনও কথাই নেই। ফলে ব্যর্থতার সব দোষ পরিচালকের অ্যাকাউণ্টে দিলে ভুল হবে। রামানন্দ সেনগুপ্ত (ছবির চিত্রগ্রাহক) এক জায়গায় বলেছেন, মৃণাল বলেছিলেন, ‘রাতভোর’ ছবিটা সস্তায় করতে হবে, নইলে ছবিটাই হবে না৷ এটা পরিচালকের সিদ্ধান্ত না প্রযোজকের, সেটা বলতে পারব না৷ কিন্তু মৃণালের কথায় আমি রাজি হয়ে গেলাম৷ ইস্ট ইন্ডিয়া স্টুডিয়ো-র সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল৷ ওদের মিচেল ক্যামেরা ছিল না৷ ফলে, এক্লেয়ার ক্যামেরায় কাজ করতে হল৷ এই ক্যামেরার সমস্যা হল থ্রু-ফিল্ম দেখতে হয়, ফলে সেটল করতে সময় লাগে বেশি৷ এটা হল আমার দিক থেকে সবচেয়ে মেজর কম্প্রোমাইজ৷ এর ফলে চেষ্টা সত্ত্বেও মনোমত কাজটা দিতে পেরেছি মনে হয়নি৷ ল্যাবরেটরির কাজও যে সব সময় পছন্দ হয়েছে তাও নয়৷ একটা জায়গায় গিয়ে থামতে হয়েছে৷ হ্যান্ডিক্যাপড অবস্থায় যে আমাদের প্রত্যেককে কাজ করতে হয়েছে সেটা পরিচালকও বুঝতে পেরেছিলেন৷ তাই মৃণালও আর ছবিটা নিয়ে পরবর্তীকালে বদার করেননি৷ ভুলে যেতে চেয়েছেন, এই ছবির ব্যর্থতায় মৃণালের কোনও দোষ নেই৷ কম্প্রোমাইজ তাঁকেও করতে হয়েছে৷ সবই কপাল৷ ছবিটা দেখেছিলাম মুক্তির পর৷
ছবিতে উত্তম ছিল৷ ও তো তখন স্টার হয়ে গিয়েছে৷ একটা ঘটনা মনে আছে৷ শুটিং চলাকালীন মৃণালের বাবার মৃত্যু হয়েছিল৷ তা সত্ত্বেও তিনি শুটিং করতে এসেছিলেন৷ উত্তম এই খবর পেয়ে মৃণালকে বললেন, ‘আপনি আজ এসেছেন কেন? আমার ডেট-এর জন্যে ভাববেন না৷ শুটিং বন্ধ রেখে বাড়ি যান৷’ ছবিতে সাবিত্রীও ছিলেন৷ সাবিত্রী তো প্রভাদেবীর মাপের অভিনেত্রী৷ ভালো করেছিল৷ ছবি বিশ্বাসও ছিলেন৷ তবে এটা মনে আছে, উত্তম, সাবিত্রী, ছবি বিশ্বাস- তাঁদের প্রত্যেককে প্রযোজক নিজেই জোগাড় করেছিলেন, এ ব্যাপারে পরিচালকের কোনও মতামত ছিল কি না, জানি না৷ যিনি প্রযোজনা করেছিলেন, তাঁর স্বামীর জাহাজ কোম্পানির মাল ভর্তি-খালাস করার ব্যবসা ছিল৷ তাঁর টাকাতেই সম্ভবত কাজটা হয়েছে৷ আরও একটু বেশি অর্থ যদি খরচ করতেন ছবিটার জন্যে, তা হলে ভালো হত৷ আমরাও ছবিটা বানিয়ে আনন্দ পেতাম৷

নীল আকাশের নীচে...
মৃণাল সেনের দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নীচে তাঁকে স্থানীয় পরিচিতি এনে দেয়।
কলকাতা শহরের লাইটহাউস এবং অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে (রাধা-পূর্ণ-প্রাচী) ‘নীল আকাশের নীচে’ হইহই করে চলছে। মুক্তি পেয়েছিল ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯। একটা রাজনীতি সচেতন সিনেমা, সে বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে তিব্বতে বাণিজ্য ঘিরে জওহরলাল নেহরু এবং চৌ-এন লাই দু’জনেরই সম্মতিক্রমে চিন-ভারতের মধ্যে পঞ্চশীল শান্তি চুক্তি হয়েছে৷ ঐতিহাসিকের মতে দলাই লামার তিব্বত থেকে চিনা আক্রমণের কারণে পালিয়ে আসা ইতিহাসে ‘অন্যতম নিষ্ক্রমণ’ হিসেবে চিহ্নিত৷ রাজনীতি সচেতন মৃণাল এই বিষয়গুলো অনুধাবন করতেন।
তিব্বতের বিদ্রোহ দমনের প্রেক্ষিতে এবং পঞ্চশীল-চুক্তির প্রেক্ষিতে চিনা সরকারের ঘটনা মৃণাল সেন বিলক্ষণ জানতেন৷ অতএব, ১৯৫৮ সালের কোনও এক সময় মহাদেবী ভার্মা-র চার পাতার ছোটো গল্প ‘চীনি ফেরিওয়ালা’ নির্ভর (মৃণাল সেন অবিশ্যি ‘গল্প’ শব্দটি ব্যবহার করেননি তাঁর এক সাক্ষাত্কারে৷ বলেছেন ‘মেমোয়ারস’ অর্থাত্, স্মৃতিকথা) ‘নীল আকাশের নীচে’-র চিত্রনাট্যটি খুব সচেতন হয়েই লিখছেন ধরে নিতে হবে৷ সেই হিসেবে ‘নীল আকাশের নীচে’ মৃণাল সেনের প্রথম প্রত্যক্ষ-রাজনৈতিক সিনেমা হিসেবে চিহ্নিত৷
১৯৩০ সালের কলকাতার প্রেক্ষিতে এই ছবির কাহিনি৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্প বা ১৯৫৭ সালে তৈরি তপন সিংহ’র ছবির সঙ্গে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায় এই কাহিনির সঙ্গে৷ চিন দেশ থেকে ওয়াংলু নামের এক চিনে ফেরিওয়ালা কলকাতায় আসছে শহরের রাস্তায়-রাস্তায়, বাড়ির দরজায়-দরজায় ফিরি করতে৷ মনে থাকবে, ‘কাবুলিওয়ালা’তে আফগান রহমত বিক্রি করত কাজু-পেস্তা-কিসমিস আখরোট। কলকাতার ছোট্টো মেয়ে মিনি-র মধ্যে রহমত খুঁজে পেয়েছিল তাঁর মেয়েকে। চিনি ওয়াংলু ফিরি করে চিনা সিল্কের কাপড়৷ আর ওয়াংলু খুঁজে পায় বিবাহিতা বাসন্তীর মধ্যে তার দিদিকে৷ দু’জনের মধ্যে একটা বন্ধন তৈরি হয়, যে-বন্ধনই ছবির কাহিনির মূল চালিকা শক্তি৷ ছবির শেষে জাহাজে চেপে দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিতে ওয়াংলু ফিরে যায় চিনে৷ সেই রহমতের মতই। এই সিনেমার সাবপ্লট হল বাসন্তীর স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে গোপনে জড়িত থাকা এবং এ কারণে ব্রিটিশ পুলিশের তাকে গ্রেপ্তার করা এবং পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া৷ কাহিনি শেষ হচ্ছে ১৯৩৮ সালে৷ জাপানের আক্রমণের কারণে বিশ্বের দরবারে চিনা জনসাধারণের আবেদনে এবং সাম্রাজ্যবাদের পররাজ্য লিপ্সার তীব্র নিন্দায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য দিয়ে৷ দেশের মানুষের ডাকে দেশকে স্বাধীন করার বাসনা নিয়ে ওয়াংলু দেশে ফেরত চলে যায়৷
‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিটি কি কেবলই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ছবি? ছবিতে সমান্তরাল ভাবে বলা হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং জাপানি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বক্তব্য৷ ১৯৩০ সালের প্রেক্ষিতের গল্প হলেও বলছেন কিন্তু মৃণাল সেন ১৯৫৯ সালে, যখন চিন সাম্রাজ্যবাদ আগ্রাসন চালাচ্ছে তিব্বতে৷ মৃণাল সেন চিন দেশের সেই ভূমিকা নিয়ে পরবর্তীকালে কিচ্ছুটি বলেননি। একেবারেই নিরুত্তর থেকেছেন৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাঁর এই ছবি নিষিদ্ধ করা হলে স্বয়ং জওহরলাল নেহরু মনে করেন ছবিটিকে চিনের ১৯৬২ সালের ভূমিকার প্রেক্ষিতে বিচার করা ঠিক নয়৷ তিনি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন৷ অথচ, চিন-ভারত এই যুদ্ধের কারণেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরমহলে সোভিয়েত পথ-চিনা পথের বিভাজনের ফলে দল ভেঙে যায়৷ চিনা পথের সমর্থকরা মনে করতেন চিন কখনওই ভারত আক্রমণ করেনি৷ মৃণাল সেনও তাই মনে করতেন৷
ছবিটির সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনীতি তা হলে কি সীমাবদ্ধ ১৯৩০ সাল পর্যন্তই? তার পর অবশ্য চিনের ভূমিকা নিয়ে মৃণাল সেন এই ছবিটির পরিপ্রেক্ষিতে আর কোনও কথা বলেননি৷ পরবর্তী সময়ে মৌন থাকা অর্থই মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির চিন-সম্পর্কে মতামতকেই সমর্থন করা৷ নৃপেন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘মৃণালদার ওপিনিয়ন ছিল চিন ভারত আক্রমণ করেনি৷ শুধু মৃণালদা নয়, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও সে সময় এই মতবাদেই বিশ্বাসী ছিল৷’ ‘নীল আকাশের নীচে’-র রাজনৈতিক মতবাদ তাই ১৯৩০-এই শুধু সীমাবদ্ধ নয়, ১৯৫৯ এবং তার পরবর্তী সময়েও তা বিস্তৃত৷ কারণ, ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে তিনি যখন এই ছবির চিত্রনাট্য লিখছেন, তখন তিনি চিন দেশের সমসাময়িক রাজনীতির প্রতি এতটাই শ্রদ্ধাশীল এবং বিশ্বাসী যে, সে-দেশের কুড়ি বছর আগের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এবং ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতটাকেই বড়ো করে তুলে ধরেছেন ছবিতে৷ তাকে সমান্তরালে রেখেছেন ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে৷ অর্থাৎ এ ছবিতে মৃণাল সেন যা করেছেন, তা তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেই করেছেন৷ এই বিশ্বাসেই তিনি আজীবন অটুট থেকেছেন৷ ছবিটি ভালো চলেছে সন্দেহ নেই। আজও মনে আছে ছবিটিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে এবং কণ্ঠে দু’টি গান৷ ‘ও নদীরে’ এবং ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’৷ মৃণাল সেনের ছবিতে গান? তিনি তো ছবিতে গান খুব একটা পছন্দ করতেন না। নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘গান ব্যবহার করা মৃণালদার পছন্দ ছিল না৷ লক্ষ্য করে দেখবে, গান দুটো যেন বিবেকের কণ্ঠস্বর, কাহিনির সঙ্গে কোনও যোগসূত্র নেই৷ মৃণালদা গদ্য করে গানের সারবস্তু লিখে দিয়েছিলেন, সেটাই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার গানে রূপান্তরিত করেছিলেন৷’ তাহলে এই গানদু’টি কি মৃণাল সেন প্রযোজকের চাপে ছবিতে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন? ছবির প্রযোজক ছিলেন স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ এটিই তাঁর প্রথম প্রযোজিত ছবি৷

১৯৫৭ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বোম্বাইতে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতকার৷ তিনি ঠিক করলেন বাংলা ছবি প্রযোজনা করবেন৷ পরিচালক হবেন সলিল চৌধুরী৷ স্ত্রী বেলার নাম যুক্ত করে তৈরি হল ‘হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশনস’৷ হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের সক্রিয় পরামর্শে ছবির গল্প ঠিক হল, ‘চীনে ফেরিওয়ালা’৷ লেখিকা মহাদেবী ভার্মা, হিন্দি ভাষার প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক এবং স্বাধীনতাসংগ্রামী৷ পরিচালক সলিল চৌধুরী চাইলেন ছবির চিত্রনাট্য লিখুন মৃণাল সেন৷ কিন্তু সে যাত্রায় শেষ অবধি ছবিটা হল না৷ এর বেশ কিছুদিন পর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আবার মৃণাল সেনকে বলেন, ছবিটি আপনিই পরিচালনা করুন৷ শর্ত একটাই, এই ছবির নায়ক হবেন উত্তমকুমার৷ আবার উত্তমকুমার? হেমন্তবাবু তাঁর শর্ত থেকে সরতে রাজি হচ্ছিলেন না৷ শেষ অবধি মৃণাল সেনকে বাঁচিয়ে দেন স্বয়ং উত্তমকুমারই৷ তিনি ব্যস্ততার কারণে ছবির নায়ক হতে রাজি হলেন না৷ শেষে মৃণাল সেনের ইচ্ছেতেই নায়ক হন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মৃণাল সেন চিত্রনাট্যটি আমূল সংশোধন করে ছবির কাজ শুরু করেন কলকাতাতেই৷ ‘নীল আকাশের নীচে’ সফল ব্যবসা করে৷ এরপর থেকে আর প্রযোজক পেতে অসুবিধা হয়নি মৃণালের৷ যদিও মৃণাল সেন বলেছেন, ‘এই ছবিটা এখন আর আমার ভালো লাগে না৷’ মুক্তির প্রায় দু’বছর পর কিছু আমলার বুদ্ধিতে ছবিটি নিষিদ্ধ হয়৷ চিন-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে৷ দু’বছর পর সুচেতা কৃপালিনীর সক্রিয়তায় তত্কায়লীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছবিটি দেখেন৷ তাঁর আদেশেই ছবিটিকে মুক্ত করা হয়৷
মৃণাল সেনই বলেছেন,‘প্রথমে আমাকে চিত্রনাট্য লিখতে বলা হয়েছিল৷ পরে পরিচালনার দায়িত্বও আমার উপর আসে৷ গল্পের নায়িকা একনিষ্ঠ কংগ্রেসি৷ খদ্দর ছাড়া কিছু পরেন না৷ তার সঙ্গে এই চিনে ফেরিওয়ালার দেখা৷ পাক্কা সেলসম্যান, বলিয়ে-কইয়ে৷ তখন ও রকম অনেক চিনে কলকাতায় দেখা যেত৷ এই ফেরিওয়ালা মহিলাকে কিছু গছাবেই৷ চাইনিজ সিল্ক বা ওই জাতীয় কিছু। মহিলা তাকে বোঝালেন, ‘দেখো, আমি বিদেশি কাপড় পরি না৷’ ফেরিওয়ালা প্রতিবাদ করে বলল, ‘কে বলে আমি বিদেশি? দেখো আমার চোখ নীল নয়, আমার নাক চ্যাপ্টা, টিকোলো নয়- আমি কেন বিদেশি হব৷’ অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই বিদেশি, অন্যেরা নয়৷ এখান থেকেই তাদের অন্তরঙ্গতা শুরু৷’ মৃণাল সেন স্বীকার করেন, ছবিটি সেন্টিমেন্টাল, ছবির কাঠামোতেও অনেক গণ্ডগোল আছে, কিন্তু এর রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে তিনি এখনও একমত৷ ‘আমি বলতে চেয়েছিলাম যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা৷ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মূলত এক৷ আমার এখনও মনে হয় আমার চিন্তাধারা ভুল ছিল না৷’
মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিতে তৎকালীন বাংলা সিনেমার মূল স্রোতের শিল্পীরাই সব অভিনয় করলেন৷ যেমন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জু দে, বিকাশ রায়, স্মৃতিরেখা বিশ্বাস, সুরুচি সেনগুপ্ত, মঞ্জু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ৷ একজন চিনা মানুষ এই ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন৷ তিনি লি চিউ ফং৷ ইনি ছিলেন তত্কামলীন কলকাতার চিনাপট্টি টেরেটি বাজারের বাসিন্দা৷ একে অবশ্য খুঁজে বার করেছিলেন মৃণাল সেনই৷ খুবই ছোটো এক ভূমিকায় ছিলেন লি চিউ ফং৷ সমস্যা হয়েছিল কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে কী করে মেক আপে চিনা ফেরিওয়ালা তৈরি করা যায়! তাই নিয়ে। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ থেকে জানতে পারি, ‘এই ব্যাপারে মৃণাল সেন তখন দারুণ খেটেছিলেন৷ শুধু আমার মেকআপের জন্যেই তিনি মাদ্রাজ অবধি ছুটেছিলেন৷ শেষ অবধি অবশ্য আমার মেকআপ করেছিলেন টালিগঞ্জের শক্তি সেনই৷’

ছবিতে ওয়াংলুর ফ্ল্যাশব্যাকে চিনা মুলুকের শানটুং গ্রাম, খরস্রোতা নদী, পিছনে পাহাড় ভারি চমৎকার লেগেছিল। ছবিতে প্রখ্যাত পরিচালক ইন্দর সেন ছিলেন সহকারী৷ সেটাই তাঁর সিনেমায় প্রথম কাজ৷ বললেন, ‘ছবির শুটিং হয়েছিল নিউ থিয়েটার্স-১ স্টুডিয়োতে৷ কিন্তু এই আউটডোরটা হয়েছিল উত্তরবঙ্গে৷ নদীটা তিস্তা৷’
মৃণাল সেনের চিত্রনাট্যটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এত পছন্দ হয়, যে শেষ পর্যন্ত মৃণাল সেনকেই তিনি কন্ট্রাক্ট সই করানোর জন্য বম্বে ডেকে পাঠান৷ তবে ছবির শুটিং চলাকালীন একটি দিনের জন্যেও হেমন্ত স্টুডিয়োতে আসেননি৷
প্যারাডাইস ক্যাফে-তে কালী বন্দোপাধ্যায় আসতেন নিয়মিত৷ মৃণাল সেন ওঁকেই ওয়াংলুর চরিত্রে নির্বাচন করেছিল৷ টেরিটি বাজারে নানকিং রেস্টুরেন্টের কাছে এক চিনে ভদ্রলোক থাকতেন৷ তিনি হলেন ওয়াংলু’র মডেল৷ তিনিও ফিরি করতেন এই শহরেই৷ মৃণালদা এবং কালী দু’জনেই চিনে কায়দাকানুন রীতি-নীতি সব তাঁর কাছ থেকেই শেখে৷ অসম্ভব পরিশ্রম করেছিল দু’জনেই এই ছবিটার জন্যে৷’ ইন্দর সেন জানাচ্ছেন, ‘এই প্রথম পুরুষ চরিত্রের জন্যে দু’জন মেকআপ আর্টিস্ট ব্যবহৃত হল টালিগঞ্জে৷ শক্তি সেন এবং অনন্ত দাস৷ দু’জনেই কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেকআপ করেছিলেন৷ স্টুডিয়োতে তখন অনেকেই কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘চিনে-কালী’ বলে ডাকত৷’
নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ‘কিছুতেই ছবির শুটিং-এর সময়ে একটা স্বদেশিদের মিছিলে পুলিশের লাঠি চালানোর দৃশ্যটা তুলতে পারা যাচ্ছে না৷ আমি ছবির পরিচালককে বললাম আমার হাতে একটা জাতীয় ফ্ল্যাগ দাও, আর ক্যামেরাকে বলো আমাকে ফলো করতে৷ ক্যামেরা চালু হয়ে গেল৷ আমি ফ্ল্যাগ নিয়ে দৌড়চ্ছি, আমাকে দেখে অন্যরাও আমার পিছনে দৌড়চ্ছে। তার পিছনে পুলিশ তাড়া করেছে৷ ব্যাস, এক শটে ওকে৷ পরে দেখি এই শটটাই বিভিন্ন ডকুমেন্টারিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের আসল ফুটেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ বোঝো কাণ্ড!’ শুটিংটা হয়েছিল ভবানীপুর লেডিজ পার্ক-এ৷ মৃণাল সেন ‘নীল আকাশের নীচে’ প্রসঙ্গে তথ্যচিত্র ‘সেলফ অ্যান্ড সিনেমা: মৃণাল সেন’-এ বলেছেন, ‘টেকনিক্যালি হোপলেস’৷ প্রসঙ্গত, এই তথ্যচিত্রটি পরিচালনা করেছেন নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়৷ তিনিই বলছিলেন, ‘ছবি তো রমরম করে চলছে৷ তখন আমরা পূর্ণ সিনেমার কাছেও আড্ডা মারতাম৷ মণীশ ঘটক, প্রেমেন্দ্র মিত্র-র পাশাপাশি এই আড্ডায় প্রযোজক বিজয় চট্টোপাধ্যায়ও আসতেন৷ এক দিন বিজয়বাবু বললেন, তিনি মৃণাল সেনকে দিয়ে পরের ছবিটা করাতে চান৷ খুব দ্রুত মৃণালদা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পরের ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ নিয়ে৷’
মুক্তিযুদ্ধ ও মৃণাল সেন
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ান মৃণাল সেন। ছুটেও গিয়েছিলেন বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত। কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে মৃণাল সেনের গভীর সম্পর্ক ছিল। মৃণাল সেন বলেছিলেন, তাঁর ছোট বোন রেবা ছিল তাঁদের পরিবারের সবচেয়ে আদরের। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সেই ছোট্ট বোনটি বাড়ির পুকুরের জলে ডুবে মারা যায়। তাঁকে সমাহিত করা হয় তাদের বাড়ির মাটিতেই। রেবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে তাঁদের গোটা পরিবার। ওই সময় কবি জসীমউদ্দীন রেবার উদ্দেশে একটি কবিতা লিখে তা তুলে দেন মৃণাল সেনের হাতে। একেবারে অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত।
সিনেমা তৈরির কারিগর মৃণাল সেন ১৮টি ছবির জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পেয়েছিলেন ১২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। বাংলা, হিন্দি, ওড়িশি ও তেলেগু ভাষায় ছবি করেছেন। তিনি ২৬টি ছবি তৈরি করেছেন। তৈরি করেছেন ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি আর চারটি প্রামাণ্য চিত্র। আবার মৃণাল সেনকে নিয়ে কলকাতায় তৈরি হয়েছে পাঁচটি তথ্যচিত্র।
মৃণাল সেনের নির্মিত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘কলকাতা ৭১’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘পদাতিক’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘মৃগয়া’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘তাহাদের কথা’, ‘কোরাস’, ‘ভুবন সোম’, ‘খারিজ’, ‘পরশুরাম’, ‘খন্দহর’ ইত্যাদি। তাঁর নির্মিত ছবি মস্কো, বার্লিন, কান, শিকাগো, মন্ট্রিল, ভেনিস, কায়রো, চেকোশ্লোভাকিয়া, স্পেন, ইতালি, তিউনিসিয়া ও কলম্বোর চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছে। তিনি ভারতের বিনোদন জগতের সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (২০০৫) পান। পান ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী (১৯৮১)। ফরাসি সরকারের দেওয়া ‘কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব আর্টস লেটারস’ সম্মানও পেয়েছেন মৃণাল সেন।
আমি দারিদ্র্য নিয়ে ছবি করি
সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটকের পাশাপাশি একমাত্র মৃণাল সেনই নানান ভারতীয় ভাষায় ছবি করেছেন। মৃণালবাবু বলতেন, ‘আমি দারিদ্র্য নিয়ে ছবি করি। আফ্রিকাতে গিয়ে সোয়াহিলি ভাষায় ছবি করতেও আমার কোনও অসুবিধে হবে না...।’ এই দারিদ্রকে ধরতে নগর উপকণ্ঠের অলিগলি ছাড়িয়ে বারবার গ্রামের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন মৃণাল। বাংলার গ্রাম তো বটেই, বাদ যায়নি অন্য প্রদেশও।
‘মাটির মনিষ’ করার জন্যে ওড়িশার গ্রামে, ‘ভুবন সোম’ করার সময়ে গুজরাতের গ্রামে, ‘ওকা উড়ি কথা’ বা ‘কফন’ করার সময়ে তেলেঙ্গানার গ্রামে গিয়েছিলেন মৃণাল সেন। তেলেঙ্গানায় তাঁকে সর্বক্ষণ সাহায্য করার জন্যে থাকতেন কৃষ্ণমূর্তি। ভদ্রলোককে একদিন চিত্রনাট্যের অংশ পড়ে শোনাচ্ছেন মৃণালবাবু, সেখানে একটা চরিত্র সম্পর্কে লেখা ছিল, লোকটা সারাদিন খায়-দায় আর মোষের মতো পড়ে-পড়ে ঘুমোয়। শুনেই কৃষ্ণমূর্তি খেপে আগুন, বললেন ‘আপনি শহরের লোক, গ্রামের কিস্যু জানেন না। এখানকার গ্রামের লোকেদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন তো, ওরা কখনও মোষকে অলস বা অকর্মা দেখেছে কি না। মোষ আমাদের সব রকম কাজের নিত্যসঙ্গী।’ চিত্রনাট্য বদলে ফেললেন মৃণাল সেন।
‘বাইশে শ্রাবণ’
তাঁর তৃতীয় ছবি বাইশে শ্রাবণ থেকে তিনি আর্ন্তজাতিক পরিচিতি পান। পঞ্চাশের দশকের শেষে তৈরি ‘বাইশে শ্রাবণ’ এক মাঝবয়সী মানুষের সঙ্গে তার থেকে বয়সে খুব ছোট একটি মেয়ের দাম্পত্য নিয়ে ছবি। কলকাতা থেকে অনেক দূরের একটা গ্রামে ওই ছোট্ট সংসারে একদিন ঘনিয়ে এল ১৯৪৩-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। কিন্তু দুর্ভিক্ষে কত লোক অনাহারে মারা গেল তা নিয়ে তাঁর ছবি নয়। তাঁর ছবি এই কর্কশ দুর্ভিক্ষ কখন কীভাবে ওই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কটাকে তিক্ত করে তুলল তা নিয়ে। পরস্পরের মধ্যে যেন তখন নরকের পরিবেশ, অবস্থার চাপে পারস্পরিক সম্ভ্রমটুকুও হারিয়ে ফেলল তারা। সময়টা ছিল বড় নিষ্ঠুর। নিয়ম ভেঙে চলচ্চিত্র নির্মাণেই যিনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন। তিনি পাল্টে দিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের ধারা ও গতি-প্রকৃতি।
১৯৪১, ৭ই আগস্ট। ১৩৪৮-এর ২২ শে শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেহাবসান হয়। ভিড়, ভীষণ ভিড়। বিরাট শোকযাত্রা। যেন মানুষের ঢল। মৃণাল সেনও ওই শোভাযাত্রায় ছিলেন। বেশ কিছুদূর শোকযাত্রার সঙ্গে পা মেলানোর পর ঠিক করেন, শোকযাত্রা শ্মশানে পৌঁছনোর আগেই তিনি শ্মশানে পৌঁছবেন। শোকযাত্রা শ্মশানে পৌঁছনোর আগেই তিনি শ্মশানে চলে যান। দেখেন অনেক লোকের মধ্যে একজন সুঠাম দেহী মধ্যবয়সী ব্যক্তি মৃত শিশুকে কোলে করে সৎকারের জন্য উপস্থিত হয়েছেন দাহ করবেন বলে। হঠাৎ পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে ওই শোকযাত্রা শ্মশানে পৌঁছায়। ওই ভিড়ে শিশু সমেত ভদ্রলোকটিও হারিয়ে গেলেন, চারিদিকে লোকারণ্য, দিশাহারা। পদপিষ্ট হয়েছেন কত লোক জানা নেই। তার ভেতর শিশু কোলে ওই লোকটাও আছে, হয়তো পদপিষ্ট হয়েছেন, কে জানে। মৃণাল সেনের লেখা থেকে পাচ্ছি, ‘years later, I called my third film Baise Sravana, the wedding day of middle aged man, married to a sweet sixteen, sweet but unlettered except the bare knowledge of a just Bengali Alphabet. She was a Woman of grace and was no villain. The film was just about the ups and down of the relationship, just that.’
বাদ সাধলো তারিখ। তারিখটা যে ২২শে শ্রাবণ। যদিও ওই তারিখে কতলোকের মৃত্যু হয়েছে তার ঠিক নেই। মৃণাল সেনের কথায় ‘But the simple reason they were married on the same date like the child was probably smashed in the stampede.’ সেন্সর বোর্ড এই তারিখটার পরিবর্তন চাইলেন। তারা বলল, ওই ছবির তারিখ এবং বিয়ের দিন ২১শে বা ২৩শে শ্রাবণ করুন। তারিখটা না বদলালে সেন্সর সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না। কারণ ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন। অতএব তারিখ পালটাতে হবে। মৃণাল সেন যথারীতি রাজি হননি। তিনি এই নির্দেশের বিরুদ্ধে সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেন। চেয়ারম্যানের নিযুক্ত কমিটি ছবিটি দেখেন এবং মৃণাল সেনের বক্তব্য শোনেন। ওঁর বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হয়ে ২২শে শ্রাবণ-কে সেন্সর সার্টিফিকেট দেয় সেন্সর বোর্ড।
২২শে শ্রাবণ একটি উল্লেখযোগ্য ছবি। দেশে বিদেশে বেশ নাম হয়। মৃণাল সেনও একজন গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা পেলেন। ২২শে শ্রাবণ তৈরি করে মৃণাল সেন খুশি হয়েছিলেন। তিনি এই ছবি সম্বন্ধে বলেছেন “I would not collect great personally I tell great.” ২২শে শ্রাবণ ছবিতে পরিচালক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন, যেগুলো ওঁর আগে এদেশের কোনও পরিচালক ছবিতে আনার চেষ্টাই করেননি। মৃণাল সেন এই ছবি সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘২২শে শ্রাবণে দেখবেন অল্প বয়সের একটি মেয়ের সঙ্গে মাঝবয়সী একজন পুরুষের বিয়ে হয়। পুরুষটি সুদর্শন নয়। মেয়েটির সঙ্গে পুরুষটির সম্পর্কের জন্য ইরোশন ঘটে সম্পর্ক, যখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তখন সেটা ঘটে যুদ্ধের ভেতর, দুর্ভিক্ষের সময়। যেখানে মেয়েটা বলে, না খেয়ে থাকাটা আমার কাছে বড় কথা নয়, আমি অনেকদিন না খেয়ে থেকেছি, যেটা আমাকে ভাবায়, আমাকে পীড়িত করে, তা হলো মানুষটা এখন পালটে গেছে। আমি আমার শুভদৃষ্টির সময় ভেঙে পড়িনি কিন্তু আজ আর সহ্য করতে পারছি না মানুষটাকে। ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে পড়ে একটি সত্য কথা বেরিয়ে পড়লো মেয়েটির মুখে। She has been denied of a woman existence. সেটা সে পরে বুঝতে পেরেছে।’’ ২২শে শ্রাবণ একটি প্রতিবাদী ছবি, নারীবাদী মৃণাল সেনের রাজনৈতিক মতাদর্শের ছবি। রাজনৈতিক চেতনার ছবি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে মৃণাল সেন পরবর্তীকালে যে রাজনৈতিক মতাদর্শকে ছবিতে ব্যবহার করেছেন তারই সূচনা হলো এই ২২শে শ্রাবণ ছবি দিয়েই।