top of page

ফিরে দেখা বঙ্গবিপ্লবী অগ্নিকন্যা

কুসুমকুমারী দেবী, সুশীলা মিত্র...লিখছেন নিখিল মিত্র ঠাকুর


কুসুমকুমারী দেবী


পরাধীন ভারতবর্ষের মেদিনীপুর শহরে রাস্তার ধারে একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে থাকতেন স্বামী পুত্রহীনা অতি

দরিদ্র এক নারী কুসুমকুমারী দেবী। তিনি শীল-নোড়া

দিয়ে কলাই বেটে বড়ি তৈরি করে তা বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে বেড়াতেন। এইভাবে তার যা রোজগার হতো তাতে কোনরকমে নিজের অন্নবস্ত্রের জোগাড় তিনি করতে পারতেন। অথচ এই কুসুমকুমারী দেবীই ছিলেন পাথরে অব্যক্ত সুন্দর স্থাপত্যের মতো অন্তরে অন্তরে সর্বশ্রেষ্ঠ এক দেশপ্রেমী নারী। ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মধ্যেও তিনি তার অস্বীকৃত দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির রেখে গেছেন।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতবর্ষে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে দেশপ্রেমে উদ্বেলিত অবিভক্ত বাংলাকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কুচক্রী লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই অসাধু প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অবিভক্ত বাংলা সহ সারা ভারতবর্ষ আন্দোলন মুখর হয়ে ওঠে। পরাধীন ভারতবর্ষে শুরু হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিযুগ।

এই অগ্নিযুগের এক অন্যতম অগ্নিশিখা বিপ্লবী ছিলেন পিতৃমাতৃহীন চরম দুঃখী ক্ষুদিরাম বোস তিনি তখন মেদিনীপুরে বড়দিদির বাড়িতে থাকেন। গুপ্ত সমিতির একনিষ্ঠ সদস্য হয়ে সারাদিন দেশের হয়ে কাজ করে বেড়ান। বাড়ি ফিরতে তার এক প্রহর রাত হয়ে যায়। বড়দিদি তাই ক্ষুদিরাম ও পুত্র ললিতের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে শুয়ে পড়তেন।

এক রাতে তাদের ঢাকা দেওয়া খাবার বিড়ালে খেয়ে নেয়। খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ললিত মোহন জোর করে ক্ষুদিরামকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে।

কুসুমকুমারী দেবী তখন বড়ি তৈরির জন্য শিল-নোড়া দিয়ে কালো কলাই বাটছিলেন। দরজা তার খোলাই ছিল। তিনি দেখতে পেলেন এত রাতে দুটি ছেলে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন কেন তারা এত রাতে রাস্তায় এসেছে। ললিতমোহন যদিও জানতেন এত রাতে অভাবী কুসুমকুমারীর কাছে দু'মুঠো খাবার পাওয়ার কোন আশা নেই তবুও তাকে তাদের দুর্দশার কথা বললেন।

কুসুমকুমারী দেবী তাদেরকে সামান্য কিছু খাবার খাওয়ার জন্য বাড়ির ভেতরে আসতে বললেন। ললিত মোহন বাড়ির ভিতরে যেতে চাইলেও ক্ষুদিরাম একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন। না যাওয়ার কারণ ললিত মোহন জিজ্ঞেস করলে ক্ষুদিরাম কুসুমকুম কুমারী দেবীর হাতে বিদেশি কাচের চুড়িগুলি ইঙ্গিতে দেখাতে থাকেন।

বুদ্ধিমতী কুসুমকুমারী দেবী বুঝতে পারেন স্বদেশী ক্ষুদিরাম তার হাতে বিদেশি কাঁচের চুরি থাকার জন্য তার বাড়িতে খাবার গ্রহণ করবে না। তাই তিনি একটি লোহার জাঁতি নিয়ে এসে ক্ষুদিরামের সামনে সমস্ত কাচের চুরি নষ্ট করে দিলেন। এরপর ক্ষুদিরাম কুসুমকুমারী দেবীর বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন।

এই ঘটনায় কুসুমকুমারী দেবীর হৃদয় স্বদেশপ্রেমে আলোকিত হয়ে পড়ল। এরপর থেকে তিনি বাড়িতে বাড়িতে বড়ি বিক্রি করার অছিলায় বাড়ির মহিলাদের স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করে যেতে থাকেন। বড়ি বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন করতেন তার সামান্য কিছু তার দৈনন্দিন খরচের জন্য রেখে বাকিটা স্বদেশীদের সংস্থায় দান করে দিতেন।

কুসুমকুমারী দেবীকে কোন বিপ্লবী স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষা দেননি। তিনি গুপ্ত সমিতির মতো কোন স্বদেশী সংগঠনের সদস্যা ছিলেন না। কোনদিন কোন খবরের কাগজ তার কথা লেখেনি। অথচ সেই সময় বাড়ির মহিলাদের বিপ্লবী কাজকর্ম সম্পর্কে সচেতন করা জরুরী ছিল। কেননা, এতে স্বাধীনতা আন্দোলন যেমন সর্বাত্মক হতে পারবে তেমনি বাড়ির মহিলারা সচেতন হলে বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা কমতে থাকবে। অসচেতন বাড়ির মহিলাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করা, স্বদেশী আন্দোলন সম্বন্ধে সচেতন করা, বিপ্লবীদের কাজকর্ম সম্বন্ধে সচেতন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোন রকম স্বীকৃতির আশা ছাড়াই নিরলস ভাবে করে গেছেন কুসুমকুমারী দেবী।

ইতিহাসের পাতায় স্থান না পাওয়া এইরকম আরও বহু কুসুমকুমারী দেবী সেই সময় নিরলস ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজ করে গেছেন। তাদের সেইসব অবদানের জোরেই আজ আমরা স্বাধীনতা ভোগ করে চলেছি। এই সব কুসুমকুমারী দেবীরা ছিলেন অগ্নিযুগের এক একজন অগ্নিকন্যা।


সুশীলা মিত্র ( ১৮৯৩- ১৯৭৮)


১৮৯৩ সালে অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লার আশিকাঠিতে‌ এক অভাবী নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে সুশীলা ঘোষের(মিত্র) জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন গুরুচরণ ঘোষ। তার মায়ের নাম জানা যায় না। বাবা গুরুচরণ ঘোষের কাছেই তার পড়াশোনার হাতেখড়ি ঘটে। এরপর তিনি স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে উৎসাহী সংস্থা ‘ত্রিপুরা হিতসাধনী সভা’র উদ্যোগে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।

পরিবারের আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির একমাত্র পথ

ছিল বিয়ে করা। সুশীলা মিত্রের জীবনে সেটাই ঘটলো।মাত্র ১১ বছর বয়সে তৎকালীন জমিদার বাড়ির ছেলে কুমুদিনীকান্ত মিত্রের সঙ্গে সুশীলা দেবীর বিয়ে হয়।  বিয়ের পর নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও তিনি পড়াশুনা অব্যাহত রাখেন।

সুশীলা দেবীর শ্বশুরমশায় ছিলেন ব্রিটিশ ভক্ত জমিদার। কিন্তু তার স্বামী ও দেবর ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সৈনিক। ব্রিটিশের অনুগত ভক্ত ওই জমিদার নিজের ছেলেদের এই স্বদেশ প্রীতি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারলেন না। ব্রিটিশদের করুণা পেতে তিনি বাধ্য হলেন তাঁর দুই পুত্রকে ত্যাজ্য করে দেন।

ত্যাজ্য পুত্র করে দেওয়াটা শাপেবর হল দুই ছেলের। ত্যাজ্য পুত্র করে দেওয়ার পর  সুশীলা মিত্র দু’টি শিশুসন্তান ও স্বামীসহ নোয়াখালী শহরে আশ্রয় নেন। সে সময় তাঁরা নানা দুঃখে-কষ্টে জীবনযাপন করেন। সুশীলার স্বামী ও তাঁর দেবর আগে থেকেই সশস্ত্র বিপ্লববাদী ‘যুগান্তর’ দলে যুক্ত ছিলেন। ত্যাজ্যপুত্র হওয়ার পর তাঁরা যুগান্তর দলে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকেন। এইসময় থেকে সুশীলা মিত্রও যুগান্তর দলের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।

১৯১৪-১৯১৫ সাল পর্যন্ত বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে আরো গতি আনার জন্য ইন্দো-জার্মান কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির একটি কেন্দ্র ছিলো সুশীলা মিত্রের বাড়ি। সুশীলা দেবী তাঁর প্রতিবেশিদের সমবেত করে ওই কমিটির বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, খাদ্য যোগান, অস্ত্রশস্ত্র রাখা, কাগজপত্র দেওয়া-নেওয়া প্রভৃতি কাজ করতে থাকেন। এই ধরনের কাজে তাঁকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করতেন মনোমোহন কাঞ্জিলালের স্ত্রী চারুবালা।

ওই সময় সুশীলা মিত্রের উদ্যোগে নোয়াখালীতে বিপ্লবী কমলকুমারী ঘোষ,জ্যোতি দেবী,শমীময়ী গুহ, হিরন্ময়ী গুহ প্রমুখ নারীদের নিয়ে একটি মহিলা সমিতি গড়ে ওঠে।  এই মহিলা সমিতির নাম ছিল 'নোয়াখালি সরোজনলিনী নারী মঙ্গল সমিতি’। তিনি নিজেই এই সমিতির সম্পাদিকার দায়িত্ব সামলেছেন। এই সমিতির কাজ ছিল গ্রামের সহায়-সম্বলহীন নির্যাতিত মেয়েদের সেবাদান ও তাদের আত্মনির্ভর করে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া। মহিলাদের এখানে হাতের কাজ, ধাত্রীবিদ্যা ইত্যাদি শেখানো হত। সুশীলা মিত্র স্থানীয় জমিদার কন্যা সুরুচি সেনকে অনুপ্রাণিত করে এই সমিতির পক্ষ থেকে মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।

এছাড়াও মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে সেইসময় যেসব মেয়েরা বিপ্লবী মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ তাদের ছোরা চালনা ও লাঠি খেলা শিক্ষা দেওয়া হতো। কিছুদিনের মধ্যে সুশীলা মিত্রের নেতৃত্বে এই মহিলা সমিতি পার্শ্ববর্তী অনেক জেলাতেও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আহ্বানে সুশীলা মিত্র তখন দেশের সেবায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। মহিলা সমিতির কর্মীরা সুশীলা মিত্রের নেতৃত্বে ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন অংশগ্রহণ করে। এই সময় সুশীলা মিত্রকে ইংরেজ পুলিশ দুই শিশুসন্তান সহ গ্রেফতার করে। প্রমাণের অভাবে ও শিশুসন্তান থাকার জন্য ইংরেজ পুলিশ তাকে খুব শীঘ্রই মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনেও সমিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ১৯৩০ সালে দুই শিশুসন্তান সহ কারাবাস থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পর তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নোয়াখালিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই অপরাধে পুলিশ আবারো তাঁকে গ্রেফতার করে। আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য ১৯৩২ এর ২৬ শে জানুয়ারি গ্রেফতার হওয়ার সময় বাড়িতে তিনি রেখে গিয়েছিলেন আড়াই মাস, তিন বছর ও পাঁচ বছরের তিনটি বাচ্চাকে। তবু তিনি বন্ডে সই করে মুক্তি পেতে আস্বীকার করে বলেছিলেন- “দেশের হাজার সন্তানের সঙ্গে আমার সন্তানরাও যদি বলি যায় তবে আমি গৌরব বোধ করব, চোখের জল ফেলব না”। এই সময় তিনি এক বছরের বেশি সময় জেলে ছিলেন।

মুক্তির পর তিনি বিপ্লববাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার কাজ করে যান। ১৯৪২ সালে সুশীলা মিত্র ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

১৯৪৩ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়ে তিনি নিজের হাতে গড়া সমিতির কর্মীদের নিয়ে দুর্গতদের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি তাঁর গাবুয়ার বাড়িতে দুঃস্থাশ্রম স্থাপন তৈরি করেন। এই আশ্রমে দুর্ভিক্ষ কবলিত বহু নারী ও শিশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়। এই সময়ে তিনি কলকাতার ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। তিনি আজীবন এই সমিতির সাথে যুক্ত ছিলেন।

কোনও অস্ত্র না ধারণ না করেও দেশের জন্য কত বড় আত্মত্যাগ করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বীরাঙ্গনা সুশীলা মিত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পলাতক বিপ্লবীদের নিয়মিত আশ্রয় দিতেন তিনি। তাঁর ছোট্ট কুঁড়ে ঘর যতই ছোট্ট হোক যুগান্তর দলের সত্যেন বসু,শচী বসুদের মতো বিপ্লবীদের জন্য জায়গার অভাব হত না। দিনের বেলায় যে বিপ্লবীরা শ্মশানে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন তাঁদের জন্য হতদরিদ্র মায়ের রান্নাঘর থেকে ঠিক পৌঁছে যেত খাবার। সুশীলা দেবী রাতে বাচ্চাদের সঙ্গেই বিপ্লবীদের শোবার ব্যবস্থা করতেন। ।

১৯৪৬ সালে নোয়াখালিতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সুশীলা মিত্র চৌমুহনী রিলিফ ক্যাম্পের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে দাঙ্গাবিধ্বস্ত নারী ও শিশুদের রক্ষা ও সেবাযত্ন করেন। এ দাঙ্গার সময় স্থানীয় জমিদার রাজেন্দ্রলাল রায় নিহত হলে গান্ধীজীর সহায়তায় পুলিশ নিয়ে সুশীলা মিত্র ওই বাড়ির বিপদগ্রস্ত মেয়েদের উদ্ধার করেন।

১৯৪৬ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ অর্জন করেন। দেশ বিভাগের পরে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। পশ্চিমবঙ্গে এসে তিনি শুরুতে কলকাতায় এবং পরবর্তী কালে হুগলীর কেন্নগড়ে বসবাস করতে থাকেন। এই বিপ্লবী অগ্নিকন্যা ১৯৭৮ সালের ২৬ আগস্ট ৮৪ বছর বয়সে মারা যান।

 
 
 

Comments


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page