top of page
Search

অনন্যা রবিবার

আলফ্রেড হিচককের ১২৫ তম জন্মদিনে

রহস্যের কারিগর

আলফ্রেড হিচকক ও তাঁর সাইকো

বিশ্বের একজন নামি পরিচালক হিচকক। তাঁর করা ৫৩টি ছবির বেশিরভাগ-ই দর্শককে আনন্দ দিয়েছে। আজও দেয়। ভূত বা রহস্যের মিশেলে অনেক ছবি আজও হয়। কিন্তু হিচককের মতো তেমন ছবি আর হয় কোথায়! তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন সমীর চট্টোপাধ্যায়


আজ ১৩ আগস্ট। গুণী পরিচালক আলফ্রেড হিচককের ১২৫ তম জন্মদিন। আলফ্রেড হিচকক নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয় নাম। উত্তেজনার নৌকায় ভর করে, রুদ্ধশ্বাসে আজও দর্শক উপভোগ করেন কিংবদন্তি ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক আলফ্রেড হিচককের তৈরি করা ছবিগুলো।

১৮৯৯ সালের এই দিনে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের এক ক্যাথলিক পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় পুত্র আলফ্রেডের শৈশব-কৈশোরের লেখাপড়া জিসুইত ক্লাসিক স্কুল এবং সেন্ট ইগনাতিয়াস কলেজ ও সালেসিয়ান কলেজে।

বয়স যখন মাত্র পাঁচ, তখন তিনি অদ্ভুত ও অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তার বাবা ছেলের দুষ্টুমির শাস্তি দিতে তাঁকে নিকটবর্তী থানায় পাঠিয়ে দেন, পুলিশের কাছে। তাঁকে পাঁচ মিনিট বন্দী করে রাখার জন্য। সেই মুহূর্তে ছেলের চারিত্রিক কী পরিবর্তন ঘটেছিল, জানি না, কিন্তু অল্প বয়সের এই অদ্ভুত পরিস্থিতিই হয়তো পরবর্তীকালে তাঁর সিনেমাজুড়ে আতঙ্ক, সাসপেন্স ব্যাপারগুলোকে বেশি আনতে আগ্রহী করে তোলে।


মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারান হিচকক। এর পরপরই তিনি লন্ডন কাউন্টি স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড নেভিগেশনে যান। সেন্ট ইগনাতিয়াস ছেড়ে। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ড্রাফটসম্যান এবং অ্যাডভারটাইজিং ডিজাইনার হিসেবে ক্যাবল কোম্পানি ‘হেনলি’তে কাজ করেন। সেইসঙ্গে চলতে থাকে তাঁর লেখালেখির কাজও। পরে চলচ্চিত্রকার হলেন তিনি। কিন্তু এসব লেখা নিঃসন্দেহে তাঁর সৃজনশীল মস্তিষ্ককে জুগিয়েছিল দারুণ শক্তি।

১৯১৯ সালে হেনলি টেলিগ্রাফ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার প্রথম সংকলনে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘গ্যাস’। গল্পটি ছিল এক অল্পবয়সী নারীকে কেন্দ্র করে। তার পরবর্তী লেখা ‘দ্য ওমেন পার্ট’, একই বছর প্রকাশিত হয় সেই পত্রিকায়। ‘সরডিড’, ‘এন্ড দেয়ার ওয়াজ নো রেইনবো’র মতো লেখাও তিনি লিখছেন। তাঁর সর্বশেষ লেখা ছিল ‘ফেডোরা’, যেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী কেমন হবে, তা নিয়ে।

১৯২০ সালে এসে আলফ্রেড হিচকক আগ্রহী হয়ে ওঠেন ফটোগ্রাফির প্রতি। চলচ্চিত্রের প্রতি আকর্ষণ সেই সময় থেকেই। তিনি লন্ডনে ফিল্ম প্রডাকশনে কাজ করা শুরু করেন। টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন ‘প্যারামাউন্ট পিকাঁচার’-এর লন্ডন শাখায়। এরপর তিনি কাজ করেন ইসলিংটন স্টুডিওতে। টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে করতে সেখানে থেকে সেই সময়ই চিত্রপরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।

১৯২২ সালে ‘নাম্বার থার্টিন’ নামে চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাঁর জীবনের প্রথম ছবিটি অসম্পূর্ণই থেকে যায়। এরপর একের পর এক তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যান। আর ছবিতে তিনি ফুটিয়ে তুলতে থাকেন তাঁর নান্দনিকতা ও চিন্তাভাবনাকে। ১৯২৫ সাল। নির্মাণ করছেন ‘দ্য প্লেজার গার্ডেন’। এটি ছিল তাঁর মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি। ছিল ব্রিটিশ-জার্মান প্রডাকশনের। ছবিটি দারুণ জনপ্রিয় হয়। এরপর হিচকককে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এগিয়ে গিয়েছেন সামনে। বিভিন্ন প্রোডাকশনের ব্যানারে একের পর এক ছবি তৈরি করে যাচ্ছেন। ১৯২৭ সালে মুক্তি পায় তাঁর ‘দ্য লজার’। ‘দ্য লেডি ভেনিশেস’ (১৯৩৮) ও ‘জ্যামাইকা ইন’ (১৯৩৯)-এর মতো ছবি নির্মাণের পর তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আটলান্টিকের ওপারে আমেরিকাতেও।

আলফ্রেড হিচকক ১৯৪০ সালে পুরো পরিবার নিয়ে হলিউডে যান। শুরু হয় তার হলিউডে চলচ্চিত্র জীবন। ডেভিডও সেলঝনিক প্রযোজনা করলেন।

[12/08, 10:06 pm] Susmita Mitra: পরিচালক হিচকক। ছবির নাম ‘রেবেকা’ মুক্তি পায় ১৯৪০ সালে। রেবেকা তখন অস্কারের আসরে বছরের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করল। এরপর হলিউডে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত একের পর এক ক্লাসিক ছবি। যাদের মধ্যে অন্যতম, ‘লাইফবোট’ (১৯৪৪), ‘স্পেলবাউন্ড’ (১৯৪৫), ‘নটোরিয়াস’ (১৯৪৬), ‘রোপ’ (১৯৪৮), ‘স্ট্রেনজার্স অন এ ট্রেইন’ (১৯৫১), ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’ (১৯৫৪), ‘রিয়ার উইন্ডো’ (১৯৫৪)।

১৯৫৮ আর ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় দুটি ছবি, যথাক্রমে ‘ভার্টিগো’ আর ‘নর্থ বাই নর্থ ওয়েস্ট’। এরপর আসে সেই বিখ্যাত ১৯৬০ সাল। হিচককের ফিল্মোগ্রাফি ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এসময় মুক্তি পেল ‘সাইকো’। ছবিটির ব্যবসায়িক সাফল্য ইতিহাস তৈরি করে দিয়েছিল। তার দর্শকপ্রিয়তাও ছিল চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক। হিচককের ‘সাইকো’র নির্মাণের ভিতরের কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ‘হিচকক’, যেখানে অ্যান্থনি হপকিন্স অভিনয় করেছেন হিচককের চরিত্রে।

সাইকোর পর ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় আরেক সাড়াজাগানো ছবি ‘দ্য বার্ডস’। ‘ফ্যামিলি প্লট’ (১৯৭৬) ছিল তাঁর পরিচালিত শেষ ছবি। হিচককের ফিল্মোগ্রাফিতে আরেকটি উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে আছে ১৯৫৫ সাল। এই সালেই প্রচারিত, আলফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস। এটি ছিল একটি টিভি শো। পর্ব ছিল ২৫ মিনিটের। ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু হওয়া এই সিরিজটি চলে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত।


১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ আলফ্রেড হিচকক আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট লাইফ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান। অনুষ্ঠানে তিনি একটা কথাই বলেন, চারজন মানুষের কথা। তাঁরা হচ্ছেন এডিটর, লেখক, তাঁর মেয়ে প্যাট এবং স্ত্রী আলমা রিভিলি। যাঁদের স্নেহ, ভালোবাসা ও উৎসাহ ছাড়া তিনি এতদূর আসতে পারতেন না।

‘এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি’ ম্যাগাজিনে বিশ্বের সেরা একশ সিনেমার মধ্যে তাঁর “সাইকো”, “ভারটিগো”, “নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট” ও “নটোরিয়াস” স্থান পায়। এছাড়া ব্রিটেনের বিখ্যাত এম্পায়ার ম্যাগাজিনের “গ্রেটেস্ট ডিরেক্টরস এভার” তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন হিচকক। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের হান্ড্রেড মোস্ট হার্ট পাউন্ডিং মুভিজ তালিকায় ৯টি সিনেমাই হিচককের। যার মধ্যে প্রথম স্থানটি অর্জন করেছে “সাইকো”।

তিনি গোল্ডেন গ্লোব, সিনেমা জাম্পো অ্যাওয়ার্ড, লরিয়াল অ্যাওয়ার্ড, ডিরেক্টরস গিল্ড অফ আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড, আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট অ্যাওয়ার্ড, একাডেমি অ্যাওয়ার্ড-এর সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।

সিনেমাজগতকে আলফ্রেড হিচককের দেওয়া সবচেয়ে বড় উপহার ছিল বড় পর্দায় প্রতিটি দৃশ্যকে এমনভাবে ধরতেন, তা যেন দর্শকের মনে সাসপেন্স বা উদ্বেগ সৃষ্টি করে। তাঁর সৃজনশীল ক্যামেরার কাজ ও দৃষ্টিকোণ, এডিটিংয়ের নিত্যনতুন ধারা তাঁর ছবিগুলোকে করেছে অনন্য। আর হারমান বার্নার্ডের মিউজিক হিচককের সেরা ছবিগুলোকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। আলফ্রেড হিচকক ‘অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার্স’-এর আর্ভিং জি থালবার্গ মেমোরিয়াল পুরস্কার পান। ১৯৮০ সালে তিনি নাইট উপাধিতে ভূষিত হন। এ বছরই অর্থাৎ ১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল বেল এয়ার, ক্যালিফোর্নিয়া, ইউএসতে হিচকক আমাদের ছেড়ে চলে যান একেবারে না ফেরার দেশে।

হিচককের অনেক ভালোলাগা ছবির অন্যতম সেরা ছবি, ‘সাইকো’। কেন এই ছবি সেরা, সে কথাই বলি এবার।

১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় রবার্ট ব্লকের ভৌতিক উপন্যাস ‘সাইকো’। ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে উইসকনসিনের প্লেইনফিল্ড থেকে দুই নারীকে হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া এড গেইনের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উপন্যাসটি লিখেছিলেন ব্লক। সমালোচকরা সাদরেই গ্রহণ করেছিল উপন্যাসটিকে। বিশেষত, নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল পজিটিভ রিভিউ। সমালোচকরা প্রশংসা করলেন ঠিকই, কিন্তু শুরুতে বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা লাভের মুখ দেখেননি ব্লক। বুকস্টোরগুলোতে বইটির কাটতি ছিল না তেমন কিছু। ব্লক যখন ‘সাইকো’-র স্ক্রিপ্ট নিয়ে হলিউডের প্রযোজকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলেন, তখনও বারবার প্রত্যাখ্যাতই হতে হচ্ছিল তাঁকে। আগ্রহী ছিলেন না কেউই তাঁর স্ক্রিপ্টটি কিনতে। ব্লক ভেবেই ফেললেন, কালের গর্ভে এ উপন্যাসও হারিয়ে যাবে।

না। তেমনটা হল না।

টাইমসে প্রকাশিত রিভিউটি চোখে পড়ল হিচককের। তিনি পড়ে ফেললেন মূল উপন্যাসটি। তারপরই তাঁর মাথায় খেলে গেল আশ্চর্য চিন্তা। হিচকক ঠিক করে ফেললেন, উপন্যাসের স্বত্ত্বটি কোনও প্রযোজকের হাতে পড়তে দেবেন না। কিনে নেবেন তিনি নিজেই। সেই ভাবনা থেকেই, নিজেই সাড়ে ৯ হাজার ডলার খরচ করে নিয়ে নিলেন ‘সাইকো’-র চলচ্চিত্র নির্মাণ স্বত্ত্ব।

হিচকক স্বত্ত্ব কিনে নেওয়ার পরও তাৎক্ষণিকভাবে উপন্যাসটির জনপ্রিয়তা বাড়ল না। বাড়তে দিলেন না হিচকক নিজেই। তিনি বুঝেছিলেন, এই কাহিনির প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে আছে এর সারপ্রাইজ এন্ডিংয়ের উপর। সেই সারপ্রাইজ এন্ডিংয়ের আভাস আগেভাগেই জেনে গেলে, ছবির সবটাই শেষ হয়ে যাবে। তাঁর যাবতীয় পরিশ্রম মাঠে মারা যাবে!

‘সাইকো’-র স্বত্ত্ব তিনি নিজের নামে কেনেননি। কিনেছিলেন ছদ্মনামে। এমনকি ব্লকও জানতেন না, কে এত ডলারের বিনিময়ে কিনে নিচ্ছেন তার উপন্যাসটির স্বত্ত্ব! অনেক ভাবনা-চিন্তা করে হিচকক, তাঁর দীর্ঘদিনের সহকারি পেগি রবার্টসনকে নির্দেশ দিলেন, প্রকাশকের কাছে বইটির যত কপি আছে, এবং বিভিন্ন বুকস্টোরেও যত কপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সব যেন কিনে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। সেই নির্দেশ অনুযায়ী, বাজার থেকে ‘সাইকো’-র প্রায় সব কপি তুলে ফেলার ব্যবস্থা করা হল। ‘সাইকো’ চলচ্চিত্র আকারে মুক্তির আগে, উপন্যাসটি খুব বেশি লোকের পক্ষে পড়া হয়ে ওঠল না। তাছাড়া ছবিটি নির্মাণকালে হিচকক প্রযোজনা সংস্থা প্যারামাউন্টের থেকেও যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল, মূল কাহিনিটি জেনে ফেললে প্যারামাউন্টের কর্মকর্তারা সেটি চেপে রাখতে পারবেন না। কাহিনির স্পর্শকাতর বিষয়বস্তু নিয়েও তারা আপত্তি তুলতে পারেন। তাই তিনি তাদেরকে জোসেফ স্টেফানোর তৈরি করা ছবির চিত্রনাট্যটি পর্যন্ত দেখাননি। প্রায় অন্ধের মতোই হিচককের উপর আস্থা রেখে ৮ লক্ষ ডলারের বাজেট অনুমোদন করে দেয় প্যারামাউন্ট কর্তৃপক্ষ।

‘মাস্টার অফ সাসপেন্স’ খ্যাত হিচকক তখন ছবিটির সঙ্গে যুক্ত করেন এডিটর জর্জ থমাইসিনি এবং কম্পোজার বার্নার্ড হারমানকে। সিনেমাটোগ্রাফির জন্য নিয়োগ করলেন জন এল রাসেলকে, যেন কম খরচে অথচ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুটিং শেষ করা যায়।

প্রধান চরিত্র নরমান বেটস-এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যান্টনি পারকিনস, যাকে পৃথিবীর সেরা খলনায়কদের তালিকায় প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। ছবির প্রধান নারী চরিত্র ম্যারিয়ন ক্রেইন-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জেনেট লেই। মূল অভিনয় হয়েছে বেটস মোটেল নামের একটি সরাইখানায়। যা স্টুডিওর সেটে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই মোটেলের মালিক বেট্‌স মানসিক বিকারগ্রস্ত একজন খুনী। তার হাতে ম্যারিয়ন ক্রেইন খুন হয়।

স্বর্ণকেশী মেরিয়ন ক্রেন একগাদা টাকা চুরি করে পালায়। পথে সে এক রাতের জন্য একটি মোটেলে ঠাঁই নেয়। মোটেলের কর্মকর্তা নর্মান বেটস কিছু একটা আন্দাজ করে। সে রাতে মোটেলে মেরিয়ন ছিল একমাত্র অতিথি। এদিকে নর্মানের মা মেরিয়নকে পছন্দ করে না। মেরিয়নের মতো একা মেয়েকে অতিথি হিসাবে সে চায় না। মেরিয়ন চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই মেরিয়নের বোন লীলা এবং গোপন প্রেমিক স্যাম লুমিস মোটেলে আসে মেরিয়নকে খুঁজতে। তাদের অনুসন্ধানেই বেরিয়ে আসে ভয়াবহ কাহিনি।

অপূর্ব কাস্ট ছিল ছবিটির। অ্যান্থনি পারকিন্স, জ্যানেট লে ছাড়াও লীলা ক্রেন চরিত্রে ভেরা মাইলস, স্যাম লুমিস চরিত্রে জন গ্যাভিন, মার্টিন বালসাম ব্যক্তিগত তদন্তকারী মিল্টন আরবোগাস্ট, ডেপুটি শেরিফ আল চেম্বার জন ম্যাকইনটায়ার, ডাঃ রিচমন্ড চরিত্রে সাইমন ওকল্যান্ড, টম ক্যাসিডি চরিত্রে ফ্রাঙ্ক অ্যালবার্টসন, ক্যারোলিন চরিত্রে প্যাট হিচকক, জর্জ লোয়ারির চরিত্রে ভন টেলর, মিসেস চেম্বার্সের চরিত্রে লুরেন টাটল, ক্যালিফোর্নিয়া চার্লি চরিত্রে জন অ্যান্ডারসন, হাইওয়ে পেট্রোল অফিসার হিসাবে মর্ট মিলসকে দেখতে পাই।

১৯৬০ –এ প্রোডাকশন কোড লাঘু হওয়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ধরণের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল তার একটি প্রধান উদাহরণ হল সাইকো। যৌনতা এবং সহিংসতার চিত্রণে নজিরবিহীন ছিল এটি। শুরুর দৃশ্য থেকে যেখানে স্যাম এবং মেরিয়নকে ব্রা পরা অবস্থায় দেখানো হয়েছে এবং ম্যারিয়নের সঙ্গে একই বিছানা ভাগাভাগি করা প্রেমিক হিসাবে দেখানো হয়েছে।  সেই সময়ের প্রোডাকশন কোড স্ট্যান্ডার্ডে, অবিবাহিত দম্পতিদের একই বিছানায় দেখানো নিষিদ্ধ ছিল। আন্তর্জাতিকভাবে, হিচকককে ফিল্মে ছোটখাটো পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বেশিরভাগ ঝরনা দৃশ্যে। ইউনাইটেড কিংডমে, ব্রিটিশ বোর্ড অফ ফিল্ম ক্লাসিফিকেশন (বিবিএফসি) ছুরিকাঘাতের শব্দ এবং দৃশ্যমান নগ্ন শটগুলির জন্য কাটার প্রয়োজনের কথা বলেন। নিউজিল্যান্ডে নরম্যানের হাত থেকে রক্ত ধোয়ার শটটিকে ঘৃণ্য হিসাবে দেখা হয়েছিল। সিঙ্গাপুরে, যদিও ঝরনা দৃশ্যটি অস্পৃশ্য ছিল। আর্বোগাস্টের হত্যা এবং নরম্যানের মায়ের মৃতদেহের একটি শটও সরানো হয়েছিল। আয়ারল্যান্ডে, সেন্সর গেরি ও’হারা ১৯৬০ সালে প্রাথমিক দেখার পরে এটি নিষিদ্ধ করেছিল। পরের বছর, একটি উচ্চ সম্পাদিত সংস্করণ আইরিশ সেন্সরে জমা দেওয়া হয়। চলচ্চিত্রটি ১৬ জুন ১৯৬০-এ নিউ ইয়র্ক সিটির ডিমিল থিয়েটারে এবং ব্যারোনেট থিয়েটারে মুক্তি পায়। এটাই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া প্রথম চলচ্চিত্র, যার ভিত্তিতে চলচ্চিত্রটি শুরু হওয়ার পর কেউ প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করবে না। ফিল্মের জন্য হিচককের ‘কোন বিলম্বে ভর্তি’ নীতিটি সেই সময়ের জন্য অস্বাভাবিক ছিল।  প্রথমে থিয়েটার মালিকরা এই ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন, ভেবেছিলেন তারা ব্যবসায় ক্ষতি করবে। তবে প্রথম দিনের পর ছবিটি দেখার অপেক্ষায় মানুষের দীর্ঘ লাইন উপভোগ করেন মালিকরা। সাইকো মুক্তির কিছুক্ষণ আগে , হিচকক ‘দ্য ডায়াবলিক পদ্ধতিতে’ একটি চলচ্চিত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নিউ ইয়র্ক প্রিমিয়ারের পরের সপ্তাহে বস্টনের প্যারামাউন্ট থিয়েটারে ছবিটি দেখানো হয়।  উডস থিয়েটার , শিকাগো এবং আর্কাডিয়া থিয়েটার, ফিলাডেলফিয়াতেও দেখানো হয়। ডিমিলে এবং ব্যারোনেটে মুক্তির নয় সপ্তাহ পর, ছবিটি আশেপাশের নিউ ইয়র্কের থিয়েটারে মুক্তি পায়। প্রথমবারের মতো একটি চলচ্চিত্র ব্রডওয়ে এবং আশেপাশের থিয়েটারে একযোগে প্রদর্শিত হয়েছিল। হিচকক এই ছবির বেশিরভাগ প্রচার নিজেই করেছিলেন। লেই এবং পারকিন্সকে প্লটটি প্রকাশ করার ভয়ে সাধারণ টেলিভিশন, রেডিও এবং প্রিন্ট সাক্ষাত্কার নিতে নিষেধ করেছিলেন।  এমনকি সমালোচকদেরও ব্যক্তিগত স্ক্রিনিং দেওয়া হয়নি। বরং সাধারণ জনগণের সঙ্গে ফিল্মটি দেখতে হয়েছিল, যা তাদের পর্যালোচনাকে প্রভাবিত করতে পারে। 

ফিল্মের মূল ট্রেলারে দেখানো হয়েছে একজন উচ্ছ্বল হিচকক দর্শককে সেটের সফরে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজেকে থামানোর আগে প্রায় প্লটের বিবরণ দিয়েছেন। এটি হারম্যানের সাইকো থিমের সাথে ‘ট্র্যাক’ করা হয়েছে। তবে হিচককের কমেডি দ্য ট্রাবল উইথ হ্যারির আনন্দময় সঙ্গীতও রয়েছে। হিচককের বেশিরভাগ সংলাপ পোস্ট-সিঙ্ক্রোনাইজড। চলচ্চিত্রটি শেষ হওয়ার পরে ট্রেলারটি তৈরি করা হয়েছিল।

ছবিটির প্রাথমিক পর্যালোচনা ছিল মিশ্র। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বোসলে ক্রাউদার লিখেছেন, ‘এই স্পষ্টতই কম বাজেটের কাজটিতে সূক্ষ্মতা বা ইদানিং পরিচিত হিচকক উল্লেখযোগ্য এবং রঙিন দৃশ্যের দিকে ঝুঁকছেন না’। ক্রাউদার ‘আচমকা ধাক্কার জন্য ধীরগতির সৃষ্টি’কে নির্ভরযোগ্যভাবে মেলোড্রামাটিক বলে অভিহিত করেছিলেন। হিচককের মনস্তাত্ত্বিক পয়েন্টগুলিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, যা ক্রাফট-ইবিং-এর গবেষণার কথা মনে করিয়ে দেয়। যদিও ছবিটি সমালোচকদের জন্য সন্তোষজনকভাবে শেষ হয়নি। তিনি কাস্টদের অভিনয়কে ‘ন্যায্য’ বলে প্রশংসা করেছেন।


নিউইয়র্কের অন্যান্য সংবাদপত্রের সমালোচকরা যেমন ডেইলি নিউজ, ডেইলি মিরর এবং ভিলেজ ভয়েস  ইতিবাচক ছিল। লিখেছিলেন, ‘অ্যান্টনি পারকিন্সের পারফরম্যান্স তার ক্যারিয়ারের সেরা... জ্যানেট লেই এর চেয়ে ভাল ছিল না’, ‘সুন্দরভাবে খেলেছে’। নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউনের রিভিউ থেকে একটি মিশ্র পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ‘পাগলতা যে ধরনের উন্মাদনা গ্রহণ করতে পারে তাতে মজা করা বেশ কঠিন ছিল [কিন্তু তা সত্ত্বেও] আপনার মনোযোগকে সাপের মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাখে’। ফিলিপ কে. স্কুয়ার আরেকটি মিশ্র পর্যালোচনায় মন্তব্য করেছেন যে, ছবিটি ছিল ‘তাঁর সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে পরিচালিত হতবাকদের মধ্যে একটি এবং তার সবচেয়ে অসম্মত’।  ১৯৬০ সালে ক্যাহিয়ার্স ডু সিনেমার বছরের সেরা ১০ চলচ্চিত্রের তালিকায় এই চলচ্চিত্রটি ৯ম স্থানে ছিল। এটি ফ্লোরিডাতেও সমাদৃত হয়েছিল, যেখানে মিয়ামি হেরাল্ডের জ্যাক অ্যান্ডারসন লিখেছিলেন, ‘সাসপেন্সের পাজি মাস্টার একটি সত্যিকারের ধাক্কা খেয়েছে।

জ্যানেটের সাথে তার প্রথম দৃশ্য থেকে সাইকো প্রতিটি স্নায়ুকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে লেই, তার শেষ বিভীষিকাময় মুহূর্ত পর্যন্ত তার অব্যক্ত অবস্থায় আছে।’ সেন্ট পিটার্সবার্গ টাইমস-এর রবীন ব্যারেট লিখেছেন, ‘এতে একটি সাধারণ হিচককের সমস্ত উপাদান রয়েছে, যদি হিচকককে যেকোনও উপায়ে ‘সাধারণ’ বলা যেতে পারে এবং এটি অবশ্যই তার তারিখের সেরা প্রচেষ্টা, তবে এটি তার থেকে ভিন্ন নয়। অতীতে করা হয়েছে।’ মিঃ এইচ একজন সমালোচক, যিনি শিকাগো ডেইলি ট্রিবিউন-এ Mae Tinee ছদ্মনাম ব্যবহার করে লিখেছেন যে, ‘ আমি নিশ্চিত যে বুদ্ধিমান মিস্টার হিচকক এটি তৈরি করতে মজা পেয়েছিলেন। তিনি একটি তীক্ষ্ণ দক্ষতার সাথে তার ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলেন। শক মান অর্জনের জন্য তাকানো চোখ, প্রবাহিত রক্ত, ছুরির আকস্মিক নিমজ্জন। শ্রোতারা স্নায়ু এবং উত্তেজনায় হাসিমুখে উচ্চ যাত্রার মতোই প্রতিক্রিয়া দেখায়।’  বাফেলোতে, বাফেলো ইভিনিং নিউজের জিনেট ইচেল মন্তব্য করেছেন, ‘আলফ্রেড হিচকক, রহস্যের মাস্টার, প্যারামাউন্ট থিয়েটারে তার কাঁপুনি-এন্ড-শক শো ‘সাইকো’তে ভয় এবং সাসপেন্স ইউজ করেছেন। তার গর্ব হল যে তিনি এটিকে বিভ্রান্ত করে দর্শকদের হতাশ করেন না। তার সূত্রগুলি সৎ এবং খুব কম লোকই ফলাফল অনুমান করে। তিনি বিশেষ করে একটি উপসংহারে বলেছিলেন যে পৃষ্ঠপোষকরা শেষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।’ সত্যি, এই ছবি তাঁর আগের পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের যেকোনও বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অনেক বেশি ভয়ঙ্কর এবং রহস্যময়। ডেট্রয়েট ফ্রি প্রেসের হেলেন বাওয়ার ছবিটি দেখে আতঙ্কিত হয়েছিলেন। ইউনাইটেড কিংডমে, ছবিটি লন্ডন প্লাজা সিনেমায় উপস্থিতির রেকর্ড ভেঙ্গেছে। যদিও প্রায় সমস্ত ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সমালোচকরা এটিকে খারাপ পর্যালোচনা করেছেন। হিচককের রুচি ও বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। সেই সঙ্গে একে তার সবচেয়ে খারাপ চলচ্চিত্র বলে অভিহিত করেছেন। তা সত্বেও মেটাক্রিটিক-এ, ১৮ জন সমালোচকের উপর ভিত্তি করে ফিল্মটির গড় স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৯৭, যা ‘সর্বজনীন প্রশংসা’ নির্দেশ করে। মুক্তির শুরুর সপ্তাহে, সাইকো ডিমিলে $46,500 এবং ব্যারোনেটে রেকর্ড $19,500 আয় করেছে।  পরের সপ্তাহে এর সম্প্রসারণের পর, এটি ৫ টি থিয়েটার থেকে $143,000 আয় করেছে। 

সাইকো জাপান এবং এশিয়ার বাকি অংশ, ফ্রান্স, ব্রিটেন, দক্ষিণ আমেরিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় বক্স-অফিসের রেকর্ড ভেঙেছে এবং অস্ট্রেলিয়ায় একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য একটি মাঝারি সাফল্য ছিল। স্পার্টাকাসের পরে ১৯৬০ সালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্রে পরিণত হয়। বক্স অফিসে $32 মিলিয়ন আয় করে,  যা উত্তর আমেরিকার থিয়েটার ভাড়ার প্রায় $9.1 মিলিয়ন আয় করে । 

সাইকো হিচককের কেরিয়ারের সবচেয়ে ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র।  হিচকক ব্যক্তিগতভাবে সাইকো থেকে $15 মিলিয়নের বেশি আয় করেছেন। তারপরে তিনি সাইকো এবং তার টিভি অ্যান্থোলজিতে এমসিএ-এর 150,000 শেয়ারের জন্য তার অধিকার অদলবদল করেন। যা তাঁকে এমসিএ ইনকর্পোরেটেডের তৃতীয় বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার তকমা দেয়।

১৯৯২ সালে, ইউনাইটেড স্টেটস লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস দ্বারা চলচ্চিত্রটিকে ‘সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা নান্দনিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে গণ্য করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে,  টিভি গাইড তাদের টিভিতে (এবং ভিডিও) ৫০টি সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় একে ৮ নম্বরে রাখে। সাইকো সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে স্বীকৃত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে। এটি তর্কযোগ্যভাবে হিচককের সব থেকে পরিচিত ছবি। হিচককের ছবির দৌলতেই ‘সাইকো’ কাহিনির জনপ্রিয়তা উঠেছিল তুঙ্গে। পরবর্তীতে ঔপন্যাসিক ব্লক মূল উপন্যাসের দুটি সিক্যুয়েল প্রকাশের সাহস পেয়েছিলেন।

১৯৮২ সালে প্রকাশ পায় ‘সাইকো টু’ এবং ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় ‘সাইকো হাউজ’। দুটোর কোনওটাই অবশ্য বেস্টসেলার হতে পারেনি। সেগুলো নিয়ে আর কেউ ছবিও করেন নি। ততক্ষণে তো হিচকক মরণের পারে।



গল্প ১

রেশমি কাবাব

দীপক বসু

নূরুল একটা লোহার শিক দিয়ে জ্বলন্ত উনুনের পোড়া কয়লাগুলোকে খুঁচিয়ে দিতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সেই আগুন। যেন মনে হোল বিশাল অজগরের মুখ-গহ্বরের রক্তাত জিহ্বা লকলকিয়ে উঠেছে।


জ্বলন্ত উনুনটাকে নূরুলের মহাশ্মশানের চিতার মত মনে হয়। মহাশ্মশানের চিতার আগুন যে রকম কোনদিন কখনও নেভে না ঠিক সেই রকম মধ্য কলকাতার এই হোটেল কাম রেস্তোরার উনুনের আগুন যেন অবিনশ্বর । ক্ষয় নেই । বিকেল পাঁচটার সময় যখন নূরুলের ডিউটি অফ হয়ে যায়, তখন সে পোড়া কয়লাগুলোকে খুঁচিয়ে নীচে ফেলে দিয়ে উনুনের ওপর একটা মস্ত বড় লোহার সরা চাপা দিয়ে রেখে যায়। সমস্ত রাত উনুনটা অভিমানী প্রেমিকের মত একবুক আগুন নিয়ে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। গুমরে গুমরে মরতে থাকে বিদেহী প্রেতাত্মার মত।


মমতাজ হোটেলের সঙ্গে নূরুলের পরিচয় দীর্ঘকালের। বলা যায় ছোটবেলা থেকেই যখন ওর বাপজান এখানে রান্নার কাজ করতো। তার বাপজান ছিলো একজন সৎ একনিষ্ঠ মানুষ। রান্নার হাত ও ছিলো চমৎকার।

হোটেলের খোদ মালিক তার হাতকে সোনা দিয়ে বাধিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বাপজান মারা যাওয়ার পরই নূরুলের এখানে চাকরি মিলেছে। সে এখন পদমর্যাদায় মমতাজ হোটেল কাম রেঁস্তোরার হেড-কারিগর। এক বছর আগে তার প্রমোশন হয়েছে। বেতন দশ হাজার টাকা। তার হাতে গড়া মোগলাই খানা খেয়ে হোটেলের কাস্টমাররা যখন প্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠে তখন নুরুলের সমস্ত মনটা খুশীতে উচ্ছল হয় । বাপজানের কথা তার মনে পড়ে যায় তখন । বাপজান বলত "মানুষের আত্মাকে খুশী করতে পারলে আল্লার দোয়া লাভ করা যায় ।" তাই সে প্রতিদিনই সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে খানা বানায়। তার একান্ত সযত্ন মেহনতের জন্যই হোটেলের শ্রীবৃদ্ধি হয় । ওর হাতে গড়া মোগলাই খানার জন্যই কাস্টমাররা ভিড় করে।

মমতাজ হোটেলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মালিকের ক্যাশবাক্স উপছে ওঠে পর্যাপ্ত অর্থে। যে অর্থে নূরুলের মেহনতের গন্ধ আছে। যে অর্থে তার অধিকার আছে, কিন্তু দাবী নেই। আশ পাশের হোটেলের মালিক তাকে ডবল মাইনে দিয়ে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু সে যায়নি। সে জানে লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু।


একবার সিরাজ হোটেলের খোদ মালিক গাড়ি করে এসে তাকে বলেছিল, “তুমি যা মাইনে চাও আমি তোমাকে তাই দেবো। আমার ওখানে কাজ করতে চলো।" পৃথিবীতে এখনও কিছু মানুষ আছে যারা স্বার্থপর নয়। লোভী নয়। অর্থের কাছে। যারা নিজেদের অস্তিত্বকে বিকিয়ে দেয় না। সেইরকম নূরুল একজন ।


সে বলেছিল, গোস্তাফি মাফ করবেন । আমি নিমকহারামের কাজ করতে পারব না। জ্বলন্ত উনুনের তাপে মাংস ভরতি পেতলের মস্ত বড় হাঁড়িটা এখন মাংস টগবগ করে ফুটছে এবং লাল হয়ে উঠেছে। এই মাংস দিয়েই নূরুল বানাবে রেশমি কাবাব। যা এখন মমতাজ হোটেলের সবচেয়ে মূল্যবান এবং আকর্ষণীয় খাদ্যবস্তু। এই মোগলাই খানা বানাবার আদব কায়দা সে তার বাপজানের কাছ থেকে শিখেছিল ।


উনুনের তাপে সে এখন ঘেমে উঠেছে। তার শরীরের সঙ্গে লেপটে থাকা নীল জামাটাও ভিজে গেছে ঘামে। জামাটার বুক পকেটের কাছে লেখা রয়েছে এম. এইচ.। অর্থাৎ সংক্ষেপে মমতাজ হোটেল । নূরুল বাড়ি থেকে ধুতি সার্ট পরে আসে। এখানে এসে এসব ছেড়ে হোটেলের ইউনিফর্ম পরে কাজ করতে হয় তাকে ।


বিরাট পেতলের হাঁড়ি থেকে নীলাভ ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। মাংসের গন্ধে ভুরভুর করছে কীচেন রুমটা। এক একটা উনুনে এক একরকম খাদ্যবস্তু তৈরী হচ্ছে। কোপ্তা, কালিয়া, বিরিয়ানি, রেশমি কাবাব এবং আরও অনেক কিছু। কাঁচেন রুমে কুড়িজন কারিগর আছে। সবাই এখন থানা বানাতে ব্যস্ত। ওরা ছাড়া হেল্পারও আছে জনা পঁচিশেক। যারা কারিগরদের ফাই ফরমাস খাটে । যে বিরিয়ানি বানায় সে হঠাৎ বলে উঠল, 'ওস্তাদ একটা সুখবর আছে ।


নূরুল ভ্রু কুঁচকে বলল, 'কিরকম' ?


ওপাশ থেকে কালিয়া ঠোঁটের আধপোড়া বিড়িটাকে জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গোঁফে তা দিয়ে হেঁকে উঠল, 'আগে বল আমাদের খাওয়াবে? 'ঠিক আছে খাওয়াবো। নুরুল মুচকি হেসে বলল । বিরিয়ানি বলল, 'তোমার হাজার টাকা মাইনে বেড়ে গেছে। আজ ম্যানেজার সাহেবের কাছ থেকে শুনতে পেলাম।


'সত্যি ? কলিয়া বলল, 'খোদা কসম'।


নূরুল গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মহাকালের হাতে অংকিত তার কপালের বলিরেখাগুলো যেন সটান হয়ে উঠল। গরীবের এককালীন হঠাৎ হাজার টাকা মাইনে বাড়লে মনে হয় যেন জীবনের অনেকটা সুখ হাতের মুঠোয় এসে গেল।


নূরুলের মাইনে বাড়লেও অন্য কারিগরদের মনে কিন্তু এতটুকু হিংসে নেই। কারণ তারা জানে নূরুলের যোগ্যতা তাদের চাইতে অনেক বেশী। শুধু রান্নার কারিগরি যোগ্যতা নয় চরিত্রের দিক থেকেও নূরুল একেবারে খাঁটি মানুষ। এতটুকু ভেজাল নেই তার চরিত্রের মধ্যে। অন্যান্য কারিগররা প্রায়ই রান্নার মশলা চুরি করে। কিন্তু নূরুল সে ব্যাপারে শত হস্ত দূরে। এমন কি কোন কিছু খেতে ইচ্ছে করলেও সে ম্যানেজারের অর্ডার নিয়ে আসে।


পবিত্র কোরাণে উল্লেখ আছে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ । মদ খেলে গুনাহ হয়। তাই নূরুল একদিনও মদ স্পর্শ করেনি। তার প্রথমা বিবি ফতেমা যেদিন তার সংসার ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল, সেদিন জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণায় আকন্ঠ মদ খেতে ইচ্ছে হয়েছিল । অপবিত্র করতে ইচ্ছে করেছিল নিজের শরীরটাকে । আত্মাকে । আর ঠিক তখন তার বাপজানের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। বাপজান বলেছিল, মদ খাওয়া পাপ। মদ খেলে কখনও খোদার অনুগ্রহ লাভ করা যায়। না। তাই সেদিন নুরুল তুচ্ছ মেয়েছেলের জন্য মদ খেয়ে তার অন্তরের আত্মাকে ক্ষতবিক্ষিত করতে পারেনি। শরীর ও মনটাকে সে ফুলের মতই সুন্দর ও পবিত্র রাখতে চায়।


হঠাৎ নূরুলের রেশমির কথা মনে পড়ে গেল । রেশমি তার দ্বিতীয় পক্ষের বিবি। ইরানী গোলাপের মত তার গায়ের রং। পানপাতার মত মুখের গড়ন। সে যখন ডাগর কালো চোখে সুর্মা দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায় নূরুলের মনে হয় হিন্দুদের দুর্গা প্রতিমা যেন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর সামনে নুরুলের নিজেকে বেমানান লাগে। রাতে বিছানায় শুয়ে নূরুল একবার বলেছিল, 'আচ্ছা আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি 'তাই না'?


- 'কেন' ? রেশমির ভ্রুলতা কুঁচকে উঠেছিল।


নূরুল বলেছিল, 'আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড় আর দেখতেও খারাপ"...ছিঃ ওকথা বোলো না। তুমি ছাড়া আমার আর এ পৃথিবীতে কে আছে বলো', বলে রেশমি নুরুলের গলা জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুম্বন করেছিল। যেন নূরুলের সমস্ত অস্তিত্বটাকেই গ্রাস করে ফেলেছিল ।


এখনও রেশমির সেই চুম্বনের স্বাদ নূরুলের ওষ্ঠে লেগে রয়েছে। ওকে সুখী করতে পারাই নূরুলের একমাত্র লক্ষ্য। তার মনে হয় রেশমি হীন জীবন ঠিক মৃত্যুরই সামিল। সমস্ত পৃথিবীটাই যেন মূল্যহীন । তাই নূরুলের মনে হয় এত সুখ তার কপালে সইলে হয়। কারণ সুখ তার ভাগ্যে বেশীদিন সয় না।


এর প্রথমা বিবি ফতেমা ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে অনেকদিন আগে পরপুরুষের সঙ্গে। সে নূরুলের ভালবাসাকে প্রচন্ড ঘৃনায় দু'পায়ে থেঁতলে চলে গিয়েছিল। আর নূরুল আকন্ঠ ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে গুমরে গুমরে মরছিল। পৃথিবীর প্রতি তার আর কোন আকর্ষণ ছিল না। সমস্ত দিন পরিশ্রম করে সে যখন তার ঘরে ফিরে আসত তখন মনটা ভীষণ হাহাকার করে উঠত ।


ফতেমা বিহীন শূণ্য ঘরটার দিকে তাকিয়ে তার চোখ ফেটে জল আসত । বেঁচে থাকাটা ওর কাছে অর্থহীন মনে হয়েছিল। নিঃসঙ্গতার জ্বালায় সে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছিল। পুরুষমানুষের যদি বিবি না থাকে তাহলে তার জীবনটাই ফালতু হয়ে যায়। যে কারণে ফতেমা চলে যাওয়ার পর তার নিজের ঘরটাকে কবরখানা মনে হোত। আর রাতে বিছানায় শুয়ে মনে হোত সে একটা কবরের লাশ।


আল্লা মনে হয় তার বুকফাটা কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। তাই তার বাপজানের পুরনো বন্ধু ইদ্রিস চাচার মেয়ে রেশমির সঙ্গে আবার তার শাদী হয়ে গেল। তার অন্ধকার মনের ঘরে আবার আলোর রোশনাই জ্বলে উঠল । হঠাৎ বিরিয়ানি বলল, 'ওস্তাদ মাংস যে পুড়ে যাচ্ছে।


নূরুল তাড়াতাড়ি এক মগ জল ঢেলে মাংসের হাঁড়ি উনুন থেকে নীচে মেঝেতে নামিয়ে রাখল। কিচেন রুমের সকলেই এখন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নূরুল এই মুহূর্তে দারুণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। শত হলেও সে এখানকার হেড কারিগর। সে পদমর্যাদায় এখানকার সকলের ওপরে। ওদের চাইতে তার মাইনে বেশি। কাজেই তার ভুল হওয়া উচিত নয়। কালিয়া হঠাৎ বলল, 'ওস্তাদ মনে হয় বিবির কথা ভাবছে।


বিরিয়ানি হিন্দী ফিল্মের গানের এককলি গেয়ে উঠল হেঁড়ে গলায় “ইয়াদ আ রহা হ্যায়..........।

কীচেন রুমে হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল। একটু পর আবার রেশমি কাবাব বানাতে বানাতে তার বিবির কথা মনে পড়ল। রেশমি এখন একলা ঘরে কি করছে। হয়ত সে চোখে সুরমা দিয়ে সেজে গুজে তার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে। রেশমি গরম সহ্য করতে পারে না। এবার মাইনে বাড়লে মালিকের কাছ থেকে ধার নিয়ে ঘরে এ.সি. বসাবে। নূরুল রেশমিকে নিয়ে বাইরে রেরোতে ভয় পায়। কারণ বাইরে বেরোলেই রেশমিকে দেখে সকলের চোখ টাটায়। নূরুলকে উদ্দেশ্য করে অনেকেই টিটকারি করে, ভুতের গলার মুক্তোর মালা। অবশ্য নূরুল সেকথা গায়ে তোলে না। তার বিবিতো তাকে কখনও অশ্রদ্ধা করে না।


বরং ভালবাসে। রেশমি তার ঘরে আছে বলেই এই পৃথিবীটাকে সুন্দর মনে হয় । রাত করে বাড়ি ফিরলে রেশমির রক্তাভ ঠোঁট প্রচন্ড অভিমানে স্ফুরিত হয়, আর সুর্মা দেওয়া চোখের পাতা অশ্রুতে ভিজে যায়। তাতেই মালুম হয় নূরুলের প্রতি তার টান কতখানি।


রেশমির চোখে জল দেখলে নূরুলের ভীষণ কষ্ট হয়। মনটা তার ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। সে ওর জন্য জান দিতে পারে। তাই সে রেশমির চোখের জলকে পৃথিবীর মাটিতে পড়তে দেয় না। জিভ দিয়ে শুষে নেয় সে তার চোখের জল। যেন রেশমির চোখের জল মাটিতে পড়লে বুঝি সমস্ত পৃথিবীটাই অপবিত্র হয়ে যাবে। খোদার কাছে গুণাহগার দিতে হবে ।


একসময় রেশমি কাবাব তৈরী হয়ে গেলে নূরুল তার ইউনিফর্ম ছেড়ে লুঙ্গি আর জামা পরল। সে ম্যানেজারের কাছ থেকে একটা রেশমি কাবাব চেয়ে নিল তার বিবির জন্য । তারপর রেশমি কাবাবের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে রেস্তোরা থেকে বেরিয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে সে তার বিবির জন্য নানারকম খাবার বাড়ীতে নিয়ে যায় ।


বাড়ীতে এসে নূরুল দেখল রেশমি যথারীতি চোখে সুরমা দিয়েছে। ঠোঁটে দিয়েছে লাল রঙের লিপস্টিক। কপালে কুমকুমের টিপ। মিষ্টি পান পাতার রসে তার ঠোঁট দুটো লাল টুকটুক করছে। ঈদে দেওয়া জরির পাড় বসানো লাল শাড়ীটাও পড়েছে। যে শাড়ীটা পড়লে ওকে দারুণ মানায়। যেন মনে হয় রূপালী পর্দার কোন হিন্দী ছবি থেকে উঠে এসেছে। কিন্তু কেন চোখদুটো তার ভেজা ভেজা। যেন রক্ত পরের পাপড়ির মত আকৃতি হয়েছে সেই চোখ। বোঝা যায় সে একটু আগে কেঁদেছে। এখনও তার চোখের আকাশে মেঘ জমে আছে। যে কোন মুহূর্তে আবার অশ্রু বৃষ্টি হতে পারে।


অন্য দিন রেশমির দুচোখ যাকে দেখেই খুশীর আলোয় ঝকমক করে, আজ তার চোখ যেন ঘোর অন্ধকার।

"তোমার কি হয়েছে ? নূরুল ওর কাছে গিয়ে বলল। আচ্ছা আমাদের কি ছেলেপুলে হবে না? তুমি কাজে চলে যাওয়ার পর আমার ভীষণ খারাপ লাগে। একলা বাড়ীতে থাকতে ভাল লাগে না'। তার কথাগুলো যেন ইস্পাতের তীক্ষ্ণ ছুরি হয়ে নূরুলের বুকটাকে ফালাফালা করে দিল। প্রথমা বিবি ফতেমাকে নূরুল সন্তান দিতে পারেনি। তাই সে চলে গেছে। সেই একই কারণে একদিন হয়ত রেশমিও চলে যাবে। নূরুল চিরকালের জন্য আবার একা হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে গামছায় বাঁধা রেশমি কাবাবটা যেন তার বুক থেকে উপড়ে নেওয়া রক্তাক্ত হৃদপিন্ডের মত মনে হল ।




গল্প ২

আশ্চর্য ব্যালকনি

মধুবন চক্রবর্তী

বোলপুর যাবার ট্রেনটা ছাড়বে সকাল দশটা বেজে চল্লিশ মিনিটে। একটু আগেই পৌঁছে গেছে মিনাক্ষী আশিসকে নিয়ে। আশিস মানে মীনাক্ষীর ছয় বছরের ছেলে। বেশ অনেকদিন পর এবার বসন্ত উৎসব দেখতে যাচ্ছে ওরা। শুধু মীনাক্ষী আর আশিস নয়।

সঙ্গে রাহুলও আছে। রাহুল ওর হাজবেন্ড।

প্রতিবছরই গ্রীষ্মের আর শীতের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান থাকে। যদিও কাজের চাপে মীনাক্ষীর অনেকসময় যাওয়া হয়ে ওঠেনা। আশিষের জন্যই খারাপ লাগে। ছেলেমানুষ। আশা করে থাকে বেড়াতে যাবে। গত বছর যেমন বেরোতে পারিনি। সারা রাজ্য জুড়ে এমন আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটে গেল বিভিন্ন ক্ষেত্রে। একটা নিউজ চ্যানেলের এক্সিকিউটিভ স্ক্রিপ্ট রাইটার হয়ে সেই সময়ে কিভাবে ছুটি নেয়?

শ্যামলদা বলেছিলেন, এই সময়টা ছুটি নিও না মীনাক্ষী'..অনেকগুলো শো করতে হবে পরপর।

তাই সেই সময় আশীষকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে আর যেতে পারিনি মীনাক্ষী। কিন্তু এবার শীতের ছুটিতে নাছোড়বান্দা আশীষকে নিয়ে আসতেই হল। যদিও বসন্ত উৎসব নিয়ে আশীষের কোন মাথাব্যথা নেই। আর শান্তিনিকেতন ওর ততটা আকর্ষণীয় স্থান হওয়ার কোথাও নয়। তবু বেড়াতে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। ক্লাস ওয়ানের আশীষ ওই আনন্দটুকু বোঝে।


অবশেষে শিয়ালদা থেকে দশটা চল্লিশের ট্রেনে উঠে পড়লাম। আমাদের ট্রেন রওনা দিল বোলপুরের পথে। গোটা জার্নিতেই আশিষের আনন্দের শেষ নেই। ওর ভালো নাম আশিষ হলেও, আমি ওকে আদর করে ভালোবেসে কটাই বলে ডাকি। ওর বাবা ডাকে কুট্টুস বলে। ট্রেনের মধ্যেই সে কি লাফানো। এক মুহূর্ত ট্রেনের সিটে বসে থাকতে চাইছে না। কতবার যে উঠেছে, দাঁড়িয়েছে আর লাফিয়েছে, তার ঠিক নেই শেষমেষ রাহুল ওকে নিয়ে ট্রেনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে একটু শান্ত হল।

চলন্ত মাঠ, ঘাট, গাছপালা দেখতে দেখতে একটু শান্ত হল, দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখানো তারপরে এটা ওটা খাওয়ানো।

এসব করেই কেটে গেল সোয়া দু'ঘণ্টা।

সাড়ে বারোটায় আমরা পৌঁছলাম বোলপুর।

বোলপুর স্টেশনে নেমেই হয়ে গেল তিনজনের একটা সেলফি। সাথে সাথে ফেসবুকে পোস্ট করে দিল রাহুল। আমাদের ওঠার কথা ছিল নিরালা লজে। রাহুলের এক বন্ধুর মারফত আগে থেকেই বুক করা ছিল ঘর। অবশেষে পৌঁছলাম নিরালায়। চমৎকার ঘর। লজের নাম নিরালা হলেও, 'আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ বীণ.. এই গানটি' সেখানে বসে গাওয়ার একেবারেই উপযুক্ত জায়গা নয়।

নিরিবিলি বা নির্জন এই শব্দগুলো নিরালা লজের সঙ্গে একেবারেই যায় না। যথেষ্ট সরগরম এই লজ। সবসময় কোলাহল, চিৎকার। একে তো বসন্ত উৎসব।

উৎসবের মরশুমে যথারীতি ভিড়।

হইহট্টগোল। কলকাতার বাইরে বিভিন্ন জেলা বা দেশবিদেশ থেকেও বহু মানুষ এই সময়টা বসন্তের গন্ধ নিতে আসে। অন্যদিকে নিরালার সব ঘর এখন হাউজফুল। জমজমাট। আমরা দুপুরে লাঞ্চ সেরে হোটেলের ঘরে ফিরে এলাম। ভাতঘুমের পর টোটো নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানো। বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাহুল বলল

"দেখো সামনের বাড়িটাতে রাত এগারোটাতেও এত লোকজন!

হাতে গলায় ময়েশ্চারাইজার মাখতে মাখতে মীনাক্ষী ব্যালকানিতে এসে রাহুলের পাশে দাঁড়ালো। সামনের বাড়িটার দিকে বেশ ভালো করে লক্ষ্য করল মীনাক্ষী। সত্যি তো, রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল বাড়ির ব্যাপার সাপার দেখে মনে হচ্ছে যেন সন্ধে ছটা সাড়ে ছটা। এখানে কি নাইট পার্টি হচ্ছে নাকি? রান্নার গন্ধে ভরে গেছে একেবারে আকাশ বাতাস। নানান স্বাদের যে রান্না হচ্ছে সে বলাই বাহুল্য। মদের গন্ধ তো আছেই, সেই সঙ্গে মাছ ভাজার গন্ধ বিশেষ করে ইলিশ মাছ। আশিষ ঘুমিয়ে পড়েছে। ডিনারের পর নিজেই বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তাছাড়া বাড়িতে থাকলে সাড়ে দশটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেস। ভোরবেলা স্কুলে যেতে হয় তো। আশীষ ঘুমিয়ে পড়লে, সেই সময়টা রাহুল আর মীনাক্ষী দুজনেই ব্যালকনিতে বসে কফি খায়। কফিটা অবশ্যই ইচ্ছে মতো। রাহুল কফি খেতে পছন্দ করে। কখনোও কোল্ড কফি কখনোও আবার হট। ইচ্ছামত আর কি। মীনাক্ষীর যদি কফি খেতে ইচ্ছে না হয় তাহলে আছে আইসক্রিম। অফিস থেকে ফেরার পথে আশীষের জন্য আর নিজের জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসে। সারাদিনের কথাবার্তা গুলো সব সময় হয়ে ওঠে না ব্যাস্ততায়। তাই, রাতের নিরিবিলি নির্জনতায় অনেক কথা বলা যায়। আমাদের বাড়ির বারান্দায় রোদ্দুর নয়, যখন চাঁদ আর জোনাকি খেলা করে,‌ অন্ধকারের।ভেতর দিয়ে একটা থাকতে পড়া আলোয় যখন ভেসে যায় বারান্দা, তখন মুখোমুখি বসি আমরা। অনেকটা সময় কাটাই। তারপর ঘুমোতে যাই। রাতের ববেলকানি অনেক কথা বলে, অনেক অজানা। দুজনের সেই অভ্যেসটাই রয়ে গেছে শান্তিনিকেতনে এসেও। নিরালা লজের রাতের বালকানিটাও আজ ওদেরই দখলে। ব্যালকানিতে এসেই সামনের বাড়ির কান্ড কারখানা দেখে ওদের দুজনেরই চক্ষু চড়কগাছ।

প্রায় এক ঘন্টা দেড় ঘন্টা কাটিয়ে দিল দুজনে। অথচ কোনও কথা বলতে পারল না চারিদিকে এত কথা, এত আওয়াজ এত হইহুল্লোড় এত হাসির আওয়াজ সেটা শুনতে শুনতে সময় কেটে গেল। দুজনেই নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল একে অপরের দিকে। সাড়ে বারোটা নাগাদ ওরা ভেতরে ঢুকে গেল।


চোখের সামনে ঘুরছে আর আমি রেকর্ড করবো না? তুমি বুঝতে পারছ না মীনাক্ষী রেকর্ড করে কোন চ্যানেলে দিলে কি হতে পারে!! হই হই করে বাড়বে viewership। পুরো বিষয়টাই অবিশ্বাস্য। আর এই অবিশ্বাস্য ঘটনাই ঘটছে আমাদের সঙ্গে। যা পুরোটাই বাস্তব। রাহুল এবার ভিডিও করতে শুরু করল। সামনের ওই বিশালাকায় বাড়িটায় ঠিক কি হচ্ছে সেটা ঠাওর করা যাচ্ছে না। ছায়ার মতো কারা জন্য সব হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাথায় উর্দি পড়া বাবুর্চিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে শরবতের পেয়ালা হাতে, ড্রিনকসের গ্লাস হাতে। বাড়ির ভেতরে প্রচুর লোকজন। কেউ তুলে নিচ্ছে শরবতের পেয়ালা। কেউ বা মদের গ্লাস। নেশায় বুদ হয়ে কেউ বাগানের গোলাপ ফুলের পাপড়ি তুলে নাকে শুকছে। কোনও মহিলার মাথায় পরিয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ একটা ঘরের দিকে নজর গেল রাহুলের। জুম করে দেখতে পেলো বিছানায় শুয়ে এক অপরূপ সুন্দরী। দেখে মনে হল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নজরে পড়ল দরজার ভেতরে কেউ একটা ঢুকলো। গোটা শরীরটা কালো চাদরে মোড়া। ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে ধীরে ধীরে কালো চাদরটা খুলে ফেলল সে। এরপর এক মুহুর্ত দেরি না করে নারীশরীরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আতঙ্কিত নারীটি দরজা খুলে বেরোনোর চেষ্টা করলে সেই পুরুষ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আবার টেনে নিয়ে বিছানায় ফেলে দিল। মেয়েটি তখন ছটফট করছে, চিৎকার করছে, হাজার কোলাহলের মধ্যেও মেয়েটির সেই আর্তচিৎকার রাহুল শুনতে পাচ্ছে, সব দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু কারোর কানে পৌঁছচ্ছে না। রাহুল ব্যালকনির দরজা খুলে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। পিছন থেকে মীনাক্ষী চিৎকার করতে লাগল,' রাহুল তুমি কোথায় যাচ্ছ কোথায় যাচ্ছ ?? এভাবে বেরিও না। আমরা একটা ট্র্যাপে পড়েছি। প্লিজ, শোনো।

রাহুল জোরে জোরে বলতে লাগলো

ওই মেয়েটিকে বাঁচাতে হবে। ওকে ধর্ষণ করে খুন করছে কেউ',.

কে খুন করছে কে?

তুমি কি দেখেছো বল।

হোটেলের সদর দরজা খোলা ছিল।

রাহুল অন্ধের মত দৌড়ে বেরিয়ে গেল

পেছনে মীনাক্ষী আর আশীষ।

হোটেলের রিসেপশনে কাউকে দেখতে পেল না মীনাক্ষী। বারবার চিৎকার করে বলতে লাগল হেল্প হেল্প।

অথচ সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত এই হোটেলের চারিদিকে মানুষ গিজগিজ করছিল। বসন্ত উৎসবের হিড়িকে কত ছেলে মেয়ে সবাই ভিড় করেছিল এখানে। এখন কেউ চিৎকারের সাড়া দিচ্ছে না। এমনকি সিকিউরিটি গার্ড পর্যন্ত নেই। কি হবে এখন? এদিকে আশীষ ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আশিসকে কোলে নিয়ে মীনাক্ষী অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে গেল। অনেকটা রাস্তা গিয়ে দেখল সামনের যে রাজকীয় বাড়িটা ওরা ব্যালকনি থেকে দেখছিল, সেই বাড়িটার কোনোও অস্তিত্বই নেই। কোথাও কোনো আলোর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। শুনশান ফাঁকা রাস্তা। নিকষ কালো অন্ধকারে চোখে পড়ছে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। অন্ধকার যে এত ভয়ঙ্কর হতে পরে জনভাবনার অতীত।

এই অন্ধকারের মধ্যেই হারিয়ে গেছে রাহুল।

কেন এভাবে উন্মাদের মতো দৌড়লো রাহুল? এই পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে রাহুল ঢুকে পড়েছে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে? মীনাক্ষী চিৎকার করে ডাকতে লাগলো

'রাহুল রাহুল কোথায় তুমি?

বাবা বাবা তুমি কোথায় গেলে

বাবা'.. হাঁটতে হাঁটতে ওরা সেই পোড়ো বাড়িটার দিকেই এগিয়ে গেল। বাড়িটাকে যেন একটা কুয়াশা ঘিরে রেখেছে।

এত যে গান কোলাহল,‌ ঘুঙূরের শব্দ, ঠুংরির মোহময় আবেশ নিমিষে কি করে বিলীন হয়ে যায়। সামনে এগিয়ে যেতেই পায়ে কি যেন ঠেকল মীনাক্ষীর। আলো-আঁধারিতে দেখতে পেল একটা হাত আর সেই হাতে মুঠো করা রয়েছে একটা এন্ড্রয়েড ফোন। যেখানে ভিডিওটা তখনো চলছে। ভয়াত্ত কন্ঠে চিৎকার করে উঠলো মীনাক্ষী। জোরে চেপে ধরল আশিষের হাত।

রাহুলের রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে মাটিতে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। হাতের তালুতে মুঠো করে রাখা সেই অ্যান্ড্রয়েড ফোন। অনেকক্ষণ ধরে যা ভিডিও করেছিল রাহুল হোটেলের ব্যালকনি থেকে। সেই ভিডিওটা এখনো চলছে। মীনাক্ষী স্পষ্ট দেখতে পেল একজন ধর্ষণ করছে আর মেয়েটি চিৎকার করছে।দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছে। শেষমেষ ছেলেটি মেয়েটিকে গলা টিপে হত্যা করল। সেই গোটা ফুটেজটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল মীনাক্ষী হতবাক হয়ে। তারপর ছেলেটি আস্তে আস্তে ক্যামেরার সামনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারল না। এসব কি দেখছি মীনাক্ষী? এ‌ তো রাহুল। ওখানে রাহুল কি করে পৌছলো?

ভয়ে আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গেল মীনাক্ষীর।

অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা হাত থেকে নিতে যাবে এমন সময় ওই হাতটাই মীনাক্ষীর গলা টিপে ধরল। চিৎকার করে বলল

'আশীষ তুমি হোটেলে চলে যাও

তুমি হোটেলে চলে যাও

আমি আসছি,‌ তুমি ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দাও। এখানে আর থেকো না'...

না মা আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না মা আমার গলার মধ্যে ক্রস চিহ্ন আছে..

বাবা বলেছিল ভয় পেলে এই লকেটে হাত দিয়ে থাকবে। আমি ধরে আছি। তোমার কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না। নিজের গলার হার টাকে ওর বাবার মৃতদেহের সামনে নিয়ে এলো সাথে সাথে হাতটা নিচে নেমে গেল। রাহুলের হাত থেকে ফোনটা ধীরে ধীরে।


সকাল হয়ে গেছে মীনাক্ষী আর আশিষ দুজনেই তৈরি। হোটেল থেকে এবার বেরিয়ে যাবে। পুলিশকে কল করা হয়েছে। রাহুলের ডেড বডি, শববাহী গাড়িতে তোলা হচ্ছে। গাড়িতে নিয়ে যাবার আগে লক্ষ্য করল রাহুলের গলায় দুটো গভীর ক্ষত। পৈশাচিকভাবে মারা হয়েছে রাহুলকে।

আশেপাশের অঞ্চলের লোকেরা জানালো রাহুলকে নাকি নেকড়ে বাঘে কামড়েছে।

নিরালা লজের পাশেই নাকি গভীর জঙ্গল। সেখানে বেশ কিছু হিংস্র জন্তু জানোয়ার থাকে যারা মাঝেমাঝে শিকারের লোভে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে।

পুলিশের তরফ থেকেও একই কথা বলা হল। যে অঞ্চলটাতে ওরা ছিল তার চারপাশে নাকি গভীর জঙ্গল। একসময় এখানে একটা রাজবাড়ি ছিল। সেই রাজবাড়ির রাজার মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল তারপর থেকে সেই রাজা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। মেয়েটি ছিল অন্তসত্তা।

পুলিশ যখন জিজ্ঞাসাবাদ করছিল মীনাক্ষী কে। মীনাক্ষী কোনও উত্তর দিতে পারছিল না। এক বোবা দৃষ্টি ওকে গ্রাস করেছিল।

পাশ থেকে আশিষ বলে উঠল

' বাবা ভিডিও করেছিল ভিডিও করতে করতে অন্ধকারে হারিয়ে গেল তারপর আমরা আর খুঁজে পেলাম না।

পুলিশ অফিসার জগমোহন সিং মীনাক্ষী কে উদ্দেশ্য করে বললেন

''ময়না তদন্ত হবে জানা যাবে কিভাবে মারা গেছে রাহুল। তবে আমাদের ধারণা কোনোও হিংস্র জন্তু ওকে আঘাত করেছিল।


শান্তিনিকেতন থেকে বিধ্বস্ত হয়ে দুজনেই ফিরে এসেছে। এত ছোট বয়সে এরকম এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার শিকার আশিষ।

কিন্তু ঘটনাচক্র আশীষ খুব ছোট হলেও অনেক বেশি মানসিকভাবে শক্ত।

তুলনায় মিনাখএকেবারেই ভেঙে পড়েছে

বললেই হয়। খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে বললেই হয় মা-বাবা এসেছে বাড়িতে এখন ওরা দুজনেই ওদের বাড়িতে থাকে কেমন যেন চুপ হয়ে গেছে কাজের লোক আসে কাজ করে চলে যায় যতটুকু কথা বলার ততটুকুই বলে।

কিছুই বুঝতে পারে না। মা অন্যরকম হয়ে গেছে। আশীষ স্কুলে যায় আসে।।মায়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু মা কোন উত্তর দেয় না। একদিন রাতে মায়ের সঙ্গে ব্যালকনিতে বসে আছে আশীষ। রাতের খাওয়া শেষ। মীনাক্ষী কোন কথা বলছে না চুপচাপ বসে আছে। আসিস বলে উঠলো 'এখানেই তো তোমরা বসে কফি খেতে

আজ বাবা নেই কিন্তু আমি তো আছি তোমার পাশে। আমার সঙ্গে কথা বল।

হঠাৎ ওদের বিল্ডিংয়ের সামনের অন্ধকারটা কিরকম জ্বলে উঠল। চারিদিকে আলোর রোশনাই, সেই কোলাহল। চিৎকার, মাছ ভাজার গন্ধ। হইহুল্লোড়।

আশীষ চিৎকার করে বলে ওঠে

' মা সেই রাজপ্রাসাদটা এখানেও চলে এসেছে...

মীনাক্ষী শুধু আশীষের হাতটা চেপে ধরে দুদিকে মাথা নাড়তে থাকে।

bottom of page