করোনা ভাইরাস
করোনা ভাইরাস কি?
গঠনগতভাবে করোনা ভাইরাস একটা বিশাল আরএনএ (RNA) ভাইরাসের পরিবার। “করোনা” শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো মুকুট। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের তলায় এই পরিবারের ভাইরাসকে অনেকটা রাজার মাথার মুকুটের মতন দেখায়, সেই থেকে এই নামকরণ (ছবি ১ দেখুন)। অন্যসকল ভাইরাসের মতো এরাও জীবনধারণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য কোন না কোন একটা প্রাণী বা উদ্ভিদ কোষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।
এই ভাইরাসের সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের স্পাইক বা কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হলো রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। জীবন্ত কোষের ভিতরে প্রবেশ করে ভাইরাসটা আরএনএ-র প্রতিলিপি তৈরি করে বংশ বিস্তার করে। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা ভাইরাসের অন্যান্য অংশকে ধরে রাখে। করোনাভাইরাস-এর মারাত্মক প্রকোপ এবং এবং তাকে কিকরে ঠেকিয়ে রাখা যায়, সেটা বুঝতে হলে এই তিনটে অংশের কথাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
যদিও করোনাভাইরাসের অনেক প্রজাতি আছে, তার মধ্যে মাত্র সাতটা প্রজাতি মানুষের দেহে রোগ সংক্রমণ করতে পারে [১]। এদের মধ্যে চারটে সারা বছর ধরে অত্যন্ত সাধারণ হাঁচি-কাশি সর্দির উপসর্গ সৃষ্টি করে। এরা হল, 229E (আলফা করোনাভাইরাস), NL63 (আলফা করোনাভাইরাস), OC43 (বিটা করোনাভাইরাস), HKU1 (বিটা করোনাভাইরাস)।
এছাড়া, মার্স কভ (MERS-CoV) – এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা থেকে ২০১২ সালে মিড্ল্ ইস্ট রেস্পিরেটারি সিন্ড্রোম বা মার্স (Middle East Respiratory Syndrome, or MERS) ছড়িয়েছিল। সার্স কভ (SARS-CoV)– এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা অতি তীব্র শ্বাস রোগ বা সার্স (severe acute respiratory syndrome, or SARS) ছড়িয়েছিল। প্রথম ২০০২ সালে চীন দেশে এই রোগ দেখা গিয়েছিল। মৃত্যুর হার প্রায় ১০০ রোগীপিছু ১০, তবুও এই রোগকে দ্রুত বাগে আনা গেছিলো কারণ মানুষ থেকে মানুষে তার সংক্রমণের হার ছিল কম। সব মিলিয়ে মোট ৮,০০০-এর কাছাকাছি রোগী এই রোগে আক্রান্ত হয় ও প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়। গবেষণায় প্রমাণ হয় যে একধরনের গন্ধগোকুল প্রজাতির প্রাণীর থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছিল। তৃতীয় আরেকটা টাইপ, সার্স কভ-২ (SARS-CoV-2) (severe acute respiratory syndrome coronavirus 2)-কেই নভেল করোনা ভাইরাস বলা হয়। এই সার্স কভ-২ মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ সংক্রামিত করে। এই ভাইরাসকে নভেল বা নতুন বলা হচ্ছে কারণ এই সংক্রামক ভাইরাসটা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটার আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি (2019-NCOV)। মানুষ থেকে মানুষে এর সংক্রমণের হার প্রচণ্ড বেশি। সারা পৃথিবীর প্রায় ১৬৬টা দেশ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত।
বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকারক করোনা ভাইরাস
কোভিড-১৯ (COVID-19) কি?
নতুন আবিষ্কৃত বা নভেল করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে মানুষের দেহে যে ছোঁয়াচে রোগ সৃষ্টি হয়, সেই রোগের নাম কোভিড-১৯ (COVID-19) বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ (coronavirus disease)। ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে চীনদেশের ইউহান প্রদেশে সর্বপ্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। ভাইরাস সংক্রমণ সব বয়েসের মানুষের মধ্যে হলেও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যারা বয়স্ক, তাদের এই রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ।
করোনাভাইরাস কি তার গঠন বদলাতে পারে অর্থাৎ এর কি মিউটেশান (Mutation) হতে পারে?
এই প্রশ্নটা জরুরি কারণ ভাইরাস-কে একটা অপরিবর্তনশীল বস্তু বলে ভাবলে চলবে না। যেকোনো আর.এন.এ (RNA) ভাইরাসের মতো সার্স কভ-২-ও খুব সহজেই তার গঠন বদলাতে পারে। অর্থাৎ, ভাইরাস যখন বংশ বিস্তার করে তখন যেমন খুশি নিজেদের জিনের সজ্জা বদলে ফেলতে পারে। এই জিনের পরিবর্তিত সজ্জা নিয়েই ভাইরাস এক মানব দেহ থেকে অন্য মানব দেহে সংক্রামিত হয়।
এখনও পর্যন্ত, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রায় ১০০বার মিউটেশান লক্ষ্য করা গেছে। বার বার মিউটেশানের ফলে ভাইরাস খুব সহজেই নতুন নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কিন্তু এই মিউটেশানের প্রভাবে কোভিড-১৯ যুক্ত রোগীর উপসর্গে কি পরিবর্তন হচ্ছে তা এখনি বলা সম্ভব নয়। তাঁর জন্য প্রচুর নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাসের জিনোম সিকয়েন্সিং করে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে হবে ।
কোভিড-১৯(COVID-19)-এর উপসর্গগুলি কি?
রোগের উপসর্গ মূলতঃ জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি। এছাড়া সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যাথা, ডায়েরিয়া-ও হতে পারে।
সাধারণ ফ্লু বা সর্দিজ্বরের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। আক্রান্ত হবার পর প্রথম দিকে উপসর্গ খুবই কম থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কখনও কখনও এর পরিণামে নিউমোনিয়া ও শেষে মাল্টি অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে (১৪%)। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির কোন উপসর্গই থাকে না বা তারা অসুস্থ বোধ করেন না। প্রায় ৮০% আক্রান্ত মানুষই সেরকম কোন চিকিৎসা ছাড়াই সেরে ওঠেন।
জ্বর হলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি বিষয়টা খতিয়ে দেখে প্রয়োজন বুঝলে পরীক্ষা করাতে বলবেন। প্রতি ছ’জন আক্রান্তের মধ্যে, একজনের শ্বাসকষ্টজনিত গুরুতর অবস্থা হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এবং যারা বয়স্ক ( বিশেষত যাদের উচ্চ-রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা বা ডায়াবেটিস রয়েছে) তাদের এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে ।
COVID-19 আটকানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের বহু দেশ দৈনন্দিন জীবনযাপন ও চলাফেরার উপর আমূল নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। কারণ হিসাবে কতগুলো কথা উঠে আসছে মিডিয়াতে, যেমন ‘এক্সপোনেন্সিয়াল’, ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’, ‘স্যোশাল আইসোলেশান’ – এত সাবধানতার কী প্রয়োজন আছে? এই শব্দগুলোরই বা মানে কী?
কোভিড-১৯(COVID-19) একটা ছোঁয়াচে রোগ। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু শরীরে ভাইরাস ঢোকা মানেই এমন নয় যে COVID-19 রোগের উপসর্গ সঙ্গে সঙ্গে ফুটতে আরম্ভ করবে। কারোর ক্ষেত্রে দিন দুয়েকের মধ্যেই উপসর্গ দেখা দেয়, কারোর ক্ষেত্রে আবার সপ্তাহ দুয়েক! এই সময়কে বিজ্ঞানের ভাষায় ইনকিউবেশান পিরিয়ড (Incubation period) বলে। এখনো পর্যন্ত দেখা গেছে নভেল করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশান পিরিয়ড গড়ে পাঁচদিনের মত। অর্থাৎ, এই ইনকিউবেশান পিরয়ডের মধ্যে সংক্রামিত কেউ না জেনেই আরও অনেককে সংক্রামিত করতে পারে। এক মাসের মধ্যে একজন কত জনকে সংক্রামিত করতে পারে? একটা সহজ অঙ্ক কষা যাক।
ধরা যাক, সমীরণ মাসের এক তারিখে করোনা ভাইরাসে সংক্রামিত হল। এর পরের পাঁচদিন অব্দি তার শরীরে COVID-19 এর কোন লক্ষণ ধরা পড়ে নি, কিন্তু সে অনেকের সাথে একসাথে আড্ডা দিয়েছে, একসাথে রেস্টুরান্টে খেতে গিয়েছে। আর এই মেলামেশার ফলে তার অজান্তেই দু-তিনজন সুস্থ মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। মাসের ছ’তারিখ নাগাদ যখন তার COVID-19-এর লক্ষণ ধরা পড়ল তখন থেকে সে অন্যদের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু ততক্ষণে কয়েকজনের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে ভাইরাস।
সমীরণ যে দু-তিনজনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে তারাও অন্যদের সাথে মেলামেশা করেছে! ধরা যাক তাদেরও COVID-19 এর উপসর্গ ধরা পড়তে দিন পাঁচেক সময় লেগেছে। তাহলে এই দুই-তিনজনের প্রত্যেকে আরও দু-তিনজন করে মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে! এবার যারা আক্রান্ত হল তাদের প্রত্যেকে আরো কিছু সুস্থ মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়াবে। এমন করে মোট আক্রান্তের সংখ্যাটা খুব তাড়াতাড়ি বাড়তে থাকবে। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসের ইনকিউবেশান পিরিয়ডের মধ্যে ধরা যাক গড়ে R0 (‘আর-নট’ বা ‘আর-জিরো’, reproduction number of the virus বোঝাতে) সংখ্যক লোককে সংক্রামিত করে। নভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা হল প্রায় আড়াই জন (মানে গড়ে আড়াই জন, এমন নয় যে তৃতীয় ব্যক্তির শরীরের অর্ধেক সংক্রামিত হয়েছে !)। ইনকিউবেশান পিরিয়ড পাঁচদিন ধরে নিলে প্রথম পাঁচদিনের শেষে, মানে মাসের ছ’তারিখ নাগাদ গড়ে R0 জন সংক্রামিত হল। এর পরের পাঁচ দিনে এই R0-এর প্রত্যেকে আরও R0 জনকে সংক্রামিত করল। অর্থাৎ, মাসের এগারো তারিখ নাগাদ ভাইরাস আক্রান্ত লোকের সংখ্যা হল R0২। নভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা হল গড়ে
২.৫২= ২.৫x২.৫ = ৬.২৫,
অর্থাৎ গড়ে প্রায় ছ’জন। মাসের ষোল তারিখ নাগাদ
২.৫৩ = ২.৫x২.৫x২.৫ = ১৫.৬২৫
অর্থাৎ, আরো প্রায় ষোল জন সংক্রামিত হল। এইভাবে মাসের শেষের পাঁচদিনের মধ্যে নতুন সংক্রামিত লোকের সংখ্যা হবে
২.৫৬ = ২.৫x২.৫x২.৫x২.৫x২.৫x২.৫ = ২৪৪
অর্থাৎ প্রায় আড়াইশোর কাছাকাছি। তাহলে এক মাসের মধ্যে মোট সংক্রমণের সংখ্যা হল প্রায় চারশো জনের মত!
পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশের করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা সময়ের সাথে এইভাবে হু হু করে বাড়ছে। এই ধরণের বৃদ্ধিকে এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি (exponential growth) বলে। উদাহরণস্বরূপ, ছবি ৩-এ সময়ের সাপেক্ষে কিছু দেশের করোনা সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগই এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি।
উপরের অঙ্কটা বুঝলে এটাও বোঝা যাবে কেন COVID-19 আমরা সাধারণ যে ফ্লু তে আক্রান্ত হই তার থেকে অনেক বিপজ্জনক। ফ্লু এর ক্ষেত্রে R0 হল ১ এর কাছাকছি, অর্থাৎ একজন সংক্রামিত ব্যক্তি গড়ে একজনকে সংক্রামিত করে। COVID-19 ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ২.৫, তাই অনেক তাড়াতাড়ি সংক্রমণ বাড়ছে।
এই এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধির কার্ভটাকে একটু চ্যাপ্টা করা (‘flatten the curve’), অর্থাৎ বৃদ্ধির হারটা কমিয়ে দেওয়াই এখন সব দেশের উদ্দেশ্য। না হলে এত আক্রান্ত লোকের চিকিৎসা করার মত সামর্থ্য প্রায় কোন দেশেরই নেই। COVID-19-এর কোন প্রতিষেধক টীকা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাহলে, উপায়? এখানেই স্যোশাল আইসোলেশান, অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়ার অপরিসীম গুরুত্ব।
একজন ভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তির থেকে কতজন সংক্রামিত হবে তা নির্ভর করবে সেই ব্যক্তি (আমাদের উদাহরণে সমীরণ) ইনকিউবেশান পিরিয়ডের মধ্যে কতজনের সাথে মেলামেশা করেছে।
সমীরণ ও তার থেকে ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদি যতটা সম্ভব নিজেদের অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতো, তাহলে ভাইরাসের সংক্রমণের হার কম হতো – অর্থাৎ R0 সংখ্যাটা কমে যেত। ধরা যাক, সরকারের নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির ফলে বেশীরভাগ রেস্টুরান্ট, অফিস-কাছারী বন্ধ, তাই এখন আর গড়ে ২.৫ নয়, বরং তার অর্ধেক লোক, গড়ে ১.২৫ জন একজনের থেকে সংক্রামিত হচ্ছে। অর্থাৎ, মাসের শেষ পাঁচদিনে মোট সংক্রমণের সংখ্যা হবে
১.২৫৬ = ১.২৫x১.২৫x১.২৫x১.২৫x১.২৫x১.২৫ = ৩.৮১৫
জনের মত! সারা মাসে মোট সংক্রমণের সংখ্যা ১ + ১.২৫ + ১.২৫২ + ১.২৫৩ + ১.২৫৪ + ১.২৫৫ + ১.২৫৬ = ১৫ জনের মত। আগে এই সংখ্যাটাই ছিল প্রায় চারশো, সেখান থেকে নেমে মাত্র পনেরো জনে এসে ঠেকেছে।
এই ধরণের ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে তাই আমাদের সামাজিক কর্তব্য হলো নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়া, যাতে ভাইরাস একজনের থেকে অনায়াসে অন্যজনের কাছে না পৌঁছতে পারে। এই দূরত্ব ততদিন বজায় রাখতে হবে, যতদিন না অবধি পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে, টীকার বা চিকিৎসার সাহায্যে, বা অন্যান্য কোন প্রাকৃতিক কারণে ভাইরাসের কার্যক্ষমতা কমে গেলে।
আপাতত করোনা ভাইরাসের মহামারীকে ঠেকানোর একমাত্র উপায় হ’ল, এর ছড়িয়ে পড়ার গতি কমিয়ে দেওয়া ও শেষ পর্যন্ত থামিয়ে দেওয়া।
শরীর খারাপ হলেই কি করোনা ভাইরাসের-এর জন্য পরীক্ষা করা জরুরি ?
আগেই বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গ মূলতঃ জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি। এছাড়া সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যাথা, ডায়েরিয়া-ও হতে পারে। সাধারণ ফ্লু বা সর্দিজ্বরের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। তাই এই উপসর্গগুলো থাকলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিৎ যে রোগীর করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করা প্রয়োজন কিনা। তবে পরীক্ষাগারের সংখ্যা যেহেতু সীমিত, এইসকল উপসর্গযুক্ত যেকোনো রোগীর-ই অযথা পরীক্ষার সংখ্যা কমানো উচিৎ। আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যদিও এই রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই (এই প্রতিবেদনটা লেখার দিন পর্যন্ত), তার মানে এই নয় যে পরীক্ষা করা অর্থহীন। পরীক্ষায় রোগ আছে প্রমাণিত হ’লে রোগীকে আলাদা করে রাখা যায় যাতে তার থেকে ভাইরাস অন্য সুস্থ মানুষের দেহে সংক্রামিত না হয়। এছাড়াও পরীক্ষা হলে তবে কোন দেশে কত আক্রান্তের সংখ্যা তার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া সম্ভব। আর তবেই ভাইরাসের প্রকৃতি ও ছড়িয়ে পড়ার গতি নির্ণয় করা যায়। বর্তমানে ভারতে ৫২টি ল্যাবরেটারীতে এই পরীক্ষা করা হচ্ছে
করোনা ভাইরাস-এর পরীক্ষা কিভাবে করা হয় ?
বস্তুত যেকোনো জায়গাতেই এই পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব। সাধারণতঃ রোগীর গলার ভিতরে একটি তুলোর ডেলা (cotton swab) প্রবেশ করিয়ে, সেটার সাহায্যে লালা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া র্যাপিড টেস্টে আন্টিবডির উপস্থিতি লক্ষ্য করার জন্য রক্ত পরীক্ষাও করা যেতে পারে। তবে সম্ভবতঃ শুধুমাত্র চীনেই সেই পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়াটা সহজ হলেও ল্যাবরেটারীতে তা পরীক্ষা করার পদ্ধতিটা বেশ জটিল। নমুনাটা দিয়ে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পলিমারেজ চেন রিয়েকশান (Reverse Transcriptase Polymerase Chain Reaction) করা হয়। যেকোনো পলিমারেজ চেন রিয়েকশান (PCR) কোষের ডিএনএ-তে (DNA) ঘটে। কিন্তু, যেহেতু করোনা ভাইরাস একটা আরএনএ (RNA) ভাইরাস, তাই পরীক্ষাটার প্রথম ধাপে রোগীর দেহ থেকে প্রাপ্ত নমুনায় ভাইরাস থাকলে তার আরএনএ প্রথমে DNA-তে রূপান্তরিত হয়। তারপর PCR পদ্ধতিতে DNA-র অগুন্তিবার রেপ্লিকেশান ঘটে যে প্রতিলিপি তৈরি হয়, তা থেকে নমুনাতে ভাইরাসের উপস্থিতি সহজেই বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে করোনা পসিটিভ বলা হয়। আর ভাইরাস না থাকলে কোন প্রতিলিপিই তৈরি হয় না। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে করোনা নেগেটিভ বলা হয়। ২৪ ঘন্টা লাগে টেস্টের রেসাল্ট আসতে। তবে প্রচুর নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে, সব ধাপগুলো একবারে করার সুযোগ না থাকায় অনেকসময় ৪৮-৭২ ঘন্টাও লাগতে পারে ।
কোভিড-১৯(COVID-19) ঠেকাতে বা করোনা ভাইরাসকে রুখতে কি কি সাবধানতা নেওয়া উচিৎ?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation) নভেল করোনা ভাইরাসের প্রকোপে উদ্ভব হওয়া পরিস্থিতিকে প্যান্ডেমিক বা অতিমারী হিসেবে ঘোষণা করেছে। ভারতেও ধীরে ধীরে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এই প্রতিবেদনটা লেখার দিন পর্যন্ত ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৮০। কর্ণাটক, দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করার কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু শুধুমাত্র প্রশাসন নয়, প্রত্যেক মানুষকে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবেই এই ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতি রোধ করা সম্ভব।
হাত সর্বদা পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পরপর সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুতে হবে। হাতের তালু, আঙ্গুল ও কব্জি পর্যন্ত ভাল করে সাবান দিয়ে ঘষে ধুতে হবে (অন্তত কুড়ি সেকেন্ড ধরে)। হাতে ময়লা দেখা না গেলেও বারবার হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে হাত ধুতে হবে অসুস্থ ব্যক্তির পরিচর্যার পর, হাঁচি বা কাশির পর, খাবার রান্না করার আগে, খাবার পরিবেশন করার আগে, বাথরুম ব্যবহারের পর এবং পশুপাখির পরিচর্যার পর।
হাত পরিষ্কার করার জন্য যে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে, তাতে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৭০% থেকে ৯৫% হওয়া প্রয়োজন।
হাঁচি-কাশি হলে, নাক দিয়ে সর্দি জল পড়লে মুখে মাস্ক পরতে হবে।
সারাদিন যথাসম্ভব নাকে মুখে হাত দেওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। হাত দিয়েই আমরা প্রধানত সব কাজ করি বলে সারাদিন অনেক কিছু স্পর্শ করি যার থেকে ভাইরাস হাতে লেগে যেতে পারে। তাই অপরিষ্কার হাত দিয়ে কখনো নাক–মুখ–চোখ স্পর্শ করা উচিৎনয়।
সর্দি-কাশি বা জ্বর হয়েছে এমন লোকজনের থেকে অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ আর সব ফ্লুর মতোই এই রোগও সর্দি-কাশির ড্রপলেট বা কণার মাধ্যমে অন্যকে সংক্রমিত করে। এছাড়া ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ-ও এড়িয়ে চলতে হবে। অসুস্থ পশুপাখির থেকে দূরে থাকতে হবে।
রুমাল বা টিস্যু পেপার হাতে না থাকলে, মুখে হাত চাপা দিয়ে হাঁচা বা কাশা উচিৎ নয় কারণ সেই হাতে অন্য কিছু স্পর্শ করার সম্ভাবনা থাকে। পরিবর্তে কনুই-এর কাছে বা কাঁধের কাছে মুখ গুঁজে হাঁচলে বা কাশলে সেই সম্ভাবনা কম।
হাঁচি বা কাশির সময়, টিস্যু পেপার ব্যবহার করার পর ওই টিস্যু পেপার যেখানে সেখানে না ফেলে, কোনও নির্দিষ্ট ঢাকনা দেওয়া ডাস্টবিনে ফেলতে হবে।
খাবার রান্নার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে তা সুসিদ্ধ হয়।
ভিড় থেকে দূরে থাকতে হবে। যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে লোকজমায়েত বন্ধ রাখতে হবে। সম্ভব হলে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করতে হবে।একেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বলে।
নিজেকে অসুস্থ মনে হলে ঘরে থাকতে হবে। বাইরে যাওয়া অত্যাবশ্যক হলে নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। তবে বেশী অসুস্থ বোধ করলে, জ্বর হলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজন বুঝলে পরীক্ষা করাতে বলবেন। অর্থাৎ নিজের উপসর্গ সম্পর্কে নিজে সচেতন হয়ে, প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখতেহবে ও বাড়িতেও অন্য সদস্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে (সেল্ফ আইসোলেশান) বা ডাক্তারের কাছে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে (সেল্ফ রিপোর্টিং)।
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় ভ্রমণের ক্ষেত্রে জরুরি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
কেউ কোন কারণে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এসেছে জানতে পারলে, তার কোন উপসর্গ না থাকলেও তাকে ১৪ দিনের জন্য অন্যদের থেকে আলাদা থাকতে হবে। একেই বলে সেল্ফ কোয়ারান্টিন।
কারোকে অভ্যর্থনা করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।কারও সঙ্গে হাত মেলানো (হ্যান্ড শেক) বা কোলাকুলি না করে নমস্কার করে অভিবাদন জানাতে হবে।
সার্স কভ-২ কোনো পৃষ্ঠতলে (surface) বা কোনো জিনিসের উপর কতক্ষণ বাঁচতে পারে?
কোভিড-১৯ (COVID-19) একটা সংক্রামক রোগ। এটি মানুষ থেকে মানুষে ড্রপলেট ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে ছড়ায়। অর্থাৎ, কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় যে অতি সূক্ষ্ জলের ফোঁটা বা এরোসল তৈরী হয় তার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। সেইজন্য এই নভেল করোনা ভাইরাস কোনো জিনিসের পৃষ্ঠতলে ঠিক কতক্ষণ বাঁচতে পারে সেইটা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ-এর একদল বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, এই ভাইরাসটা এরোসলে অর্থাৎ বাতাসে সূক্ষ্ম ড্রপলেট অবস্থায় প্রায় ৩ ঘন্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কার্ডবোর্ড-এর উপর ভাইরাসটা প্রায় ২৪ ঘন্টা এবং প্লাষ্টিক বা স্টেইনলেস স্টিল এর উপর প্রায় তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম ।
কেন সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া জরুরি?
আগেই বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের গঠন লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে প্রধানত তিনটে উপাদানে গঠিত এই নভেল করোনাভাইরাস। সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হ’ল রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। যখন কোনও জীবন্ত কোষের ভিতরে ভাইরাসটি ঢোকে, তখন সে বংশ বিস্তার করে আরএনএ-র প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যম। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা ভাইরাসের অন্যান্য অংশ-কে ধরে রাখে। এই লিপিড স্তরটাকে ভাঙ্গতে পারলে ভাইরাসটাকে মারা সম্ভব।
সাধারণত মাথাটা হাইড্রোফিলিক (hydrophilic), অর্থাৎ মাথাটার জলের অণুগুলোর প্রতি আকর্ষণ প্রবল। লেজটা আবার হাইড্রোফোবিক (hydrophobic), অর্থাৎ লেজটা জলকে একেবারেই পছন্দ করে না। এবার সাবান আর জল দিয়ে হাত ধুলে ভাইরাসের লিপিড স্তরের প্রতি জলে গোলা সাবানের অণুর লেজের আকর্ষণ প্রবল হয়। অন্য দিকে জলের অণু আবার সাবানের অণুর মাথাকে আকর্ষণ করে। এই টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে ভাইরাসের লিপিড স্তরটা ভেঙে যায়, ফলে ভাইরাসটা নিষ্ক্রিয় হয়ে মারা যায়।
কেন হ্যান্ড সানিটাইজারের থেকে সাবান বেশি কার্যকরী?
স্যানিটাইজারের মূল উপাদান হল অ্যালকোহল। অ্যালকোহল-ও করোনভাইরাস-এর লিপিড স্তরটা ভেঙে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু সাবানের মতো ভাইরাসের লিপিড স্তরের সঙ্গে অ্যালকোহলের দ্রুত বন্ধন গঠন হয় না, যার ফলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হতে সময় লাগে। তাই হ্যান্ড স্যানিটাইজারের থেকে সাবান ভাইরাস নষ্ট করতে বেশি কার্যকরী। সাবান ও জল ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে তখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিকল্প হতে পারে।
করোনা ভাইরাস কতরকমভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে?
কোন দেশে এই ভাইরাসটার সংক্রমণ ঘটার সময় প্রধানত চারটে পর্যায়ে ভাইরাসটা ছড়ায়।
পর্যায় ১.বিদেশ থেকে আগত রোগীর মাধ্যমে (Imported Cases) – যে সমস্ত দেশে আগেই সংক্রমণ ঘটেছে সেই অঞ্চল থেকে কেউ সংক্রমণের শিকার হয়ে নিজের দেশে ফিরলে, তাকে প্রথম পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়।
পর্যায় ২. আঞ্চলিক সংক্রমণ (Local Transmission) – বিদেশ থেকে আগত রোগীর সান্নিধ্যে এসে কেউ নিজে সংক্রামিত হলে তাকে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, একজন আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে অন্য সুস্থ মানুষের সংক্রমণের সম্ভাবনা যথাসম্ভব কমিয়ে আনা, যাতে সংক্রমণের শৃঙ্খলটাকে (transmission chain) কেটে দেওয়া যায়। ভারতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখন এই পর্যায়ে আছে এবং সকলে সামাজিক দূরত্ব (social distance) বজায় রাখলে তবেই সংক্রমণ এই পর্যায়ে রোখা যাবে।
পর্যায় ৩– পারস্পরিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সংক্রমণ (Community Transmission) – বিদেশ থেকে আগত রোগীর বা যেকোন করোনা আক্রান্ত রোগীর সান্নিধ্যে না এসেও কেউ যখন সংক্রামিত হয় তখন তাকে তৃতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। এই পর্যায়ের সংক্রমণ অনেক দ্রুত, অনেক বড় এলাকা জুড়ে হয়।
পর্যায় ৪– মহামারী (Epidemic) – এটা শেষ এবং সবথেকে খারাপ পর্যায় যখন সংক্রমণ অত্যন্ত দ্রুত মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই পর্যায়ের সংক্রমণ একবার হয়ে গেলে কবে, কিভাবে আটকানো যাবে, তা বলা অসম্ভব।
শিশুদেরও কি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে?
শিশু তথা কিশোরদের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। CDC (Center for Disease Control and Prevention), China থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে ০-৯ বছরের শিশু এবং ১০-১৯ বছর বয়েসীদের আক্রান্তের সংখ্যা যথাক্রমে ০.৯% এবং ১.২% মাত্র । আরেকটা সমীক্ষা অনুসারে, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে ০-১৪ বছরের বাচ্চাদের সংখ্যা ০.৯% যেখানে বড়দের (১৫-৪৯বছর) সংখ্যা ৫৭.৮% । কিন্তু কেবলমাত্র কোভিড-১৯ আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে প্রকাশিত আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রের ফলাফল অনুসারে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ছোট (<৫ বছর), বিশেষত নবজাতকদের মধ্যে শারীরিক আবস্থার সংকটজনক অবনতি হবার প্রবণতা কিছুটা বেশী । তাই শিশুদের ক্ষেত্রেও সমস্তরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত জরুরি।
তাপমাত্রা বাড়লে ভাইরাসের প্রকোপ কমবে বলে শোনা যাচ্ছে – এটা কতটা ভরসাযোগ্য?
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডঃ মেরু শীল জানাচ্ছেন, এরকম কোনো পরিষ্কার সম্ভাবনা এখনো দেখা যায়নি যাতে করে এটা বলা যায় যে পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা বাড়লে করোনা ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত কমে। বিজ্ঞানীদের হাতে এখনও এব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বা WHO-এর মতেও এই ভাইরাস উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু যুক্ত অঞ্চলেও ছড়াতে পারে।
লেখাটির জন্য তথ্য ও আলোচনার মাধ্যমে সহযোগিতা করেছেন সোমনাথ বক্সী (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়), সৌমেন মান্না (সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স), সায়ন্তন ব্যানার্জী (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা), আবীর দাস (আই.আই.টি. খড়গপুর) এবং কুণাল চক্রবর্ত্তী (এন.সি.বি.এস.)। ‘বিজ্ঞান’ সম্পাদকমন্ডলীর অন্য সদস্যদের সাহায্য নিয়ে লেখাটি সম্পাদনা করেছে স্বাগতা ঘোষ, বনানী মন্ডল, অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় ও রাজীবুল ইসলাম।
গ ল্প ১
বিদ্রোহী ও কয়েকটি স্বপ্নদৃশ্য
বিনোদ ঘোষাল
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
(কাজী নজরুল ইসলাম-এই নামটির আগে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয় তা হ’ল বিদ্রোহী। রবীন্দ্রনাথ যেমন বিশ্বকবি, কাজী নজরুল ইসলাম তেমনই বিদ্রোহী কবি। ২২ বছর বয়সে সহসাই এমন এক কবিতা লিখে ফেললেন তিনি যা আজও পাঠ করলে আপামর বাঙালি রোমাঞ্চিত হয়। বিদ্রোহী কবিতা বাংলা কঅ্যা সাহিত্যের জগতে আজও এক বিপ্লব, এক বিস্ময়।
এই রচনাটতে নজরুলের সেই বিদ্রোহী রচনার সময়টিকে একটি কাল্পনিক দৃশ্য রচনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও যাবতীয় তথ্যই প্রামাণ্য।)
শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে এই বছর। ঘরের দুটো জানলাই বন্ধ। কেরোসিন বাতিটার শিখা একেবারে নীল বিন্দু হয়ে জ্বলছে। রাত কত বোঝার উপায় নেই। ঘুম আসছে না নজরুলের। গায়ে চাপানো কম্বল সরিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। এপাশ ওপাশ করছে। রাত বারার সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতাটা বাড়তে বাড়তে এখন চুড়ান্ত পর্যায়ে। কী যেন একটা প্রবল বেগে বেরিয়ে আসতে চাইছে ভেতর থেকে। কী? বুঝতে পারছে না। আগে কোনওদিন এমন অনুভূতি হয়নি। তীব্র একটা আবেগ ওকে বারবার শিহরিত করছে। ভেতরে সাইক্লোনের মতো কতগুলো ভাবনা, শত সহস্র শব্দ চড়কিপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি ও একটা প্রলয় ঘটিয়ে ফেলবে। আচমকাই নিজেকে কেমন অন্যরকম মনে হচ্ছে নজরুলের। কিছু একটা...কিছু একটা ঘটতে চাইছে। ঘেমে স্নান হয়ে যাচ্ছে ও। নাহ...আর শুয়ে থাকা যাচ্ছে না। উঠে পড়ল। তক্তোপোষের নিচে রাখা বাতিটা টেনে নিয়ে এসে আলো বাড়াল। কপালে জমে ওঠা স্বেদবিন্দুগুলি চিকচিক করে উঠল নরম আগুনে আলোতে। হ্যারিকেনটা নিজের তক্তপোষের ওপর তুলে রাখল নজরুল। পাশের চৌকিতে মুজফফর অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। গোটা কলকাতা শহর যখন এই এই শীতের রাতে জুবুথুবু হয়ে ঘুমোচ্ছে, একটা কুকুরেরও ডাক নেই, এমনই নিস্তব্ধতায় এক বাইশ বছরের যুবক প্রবল ভাবাবেগে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সে কী করতে চাইছে নিজেও জানে না। কিন্তু কিছু একটা করতে হবে, ভেতর থেকে রাশি রাশি শব্দ সুনামির মতো আছড়ে পড়তে চাইছে বাইরে। এখনই তাদের মুক্তি দিতে হবে। নিজেকে আচমকা আকাশের মতো বিশাল, মুক্ত মনে হচ্ছে নজরুলের। মনে হচ্ছে যেন তার সম এই নক্ষত্রলোকে আর কেউ নেই। এ কেমন ভাবনা? বারবার চমকিত হচ্ছে ও। লেখার খাতাটা টেনে নিল ও। হাতের সামনে পেল একটা ক্ষয়ে আসা কাঠপেন্সিল। তাই দিয়েই দ্রুত লিখে ফেলল কয়েকটা লাইন-
বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
লাইনগুলো লিখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল নজরুলের। ওই নিভু নিভু আলোতে খসখস করে লিখে যেতে থাকল...।
...আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর –
চির-উন্নত মম শির!
নিজের লেখার মধ্যে বুঁদ গেল নজরুল। এই শব্দ এই ভাব এই ছন্দ কোথা থেকে আসছে কী ভাবে আসছে ও নিজেই বুঝতে পারছে না কিন্তু বুঝতে পারছে এক দৈব শক্তি আজ ওকে ভর করেছে এই লেখা কেউ যেন লিখিয়ে নিচ্ছে ওকে। পেন্সিল থামাতে পারছে না তার আগেই কাগজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে...
…আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;
আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর –
চির – উন্নত মম শির!
মাথার প্রতিটি কোষ ঝনঝন করছে। মহাকাশচ্যুত উল্কাখণ্ডে যেমন অগ্নিজ্যোতিষ্কের তাপ লেগে থাকে, সদ্য রচিত এই অক্ষরগুলির বুকেও যেন নজরুলের স্নায়ুর উন্মাদনা, অস্থিরতা লেগে রয়েছে।
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
ভেতর থেকে এমন প্লাবনের মতো কথাগুলো বেরিয়ে আসছে যে আঙুলে চেপে ধরা পেন্সিলটাকে ঘোড়ার মতো ছুটিয়েও তাল রাখতে পারছিল না নজরুল। এই শীতের রাতেও তার গোটা শরীর ঘামে জবজবে, কপালের রগ দপদপ করছে। চোখদুটি বিস্ফারিত বুক খুব দ্রুত ওঠানামা করছে। কবিতার প্রতিটি ছত্রে যেন আচমকা নিজেকে আবিষ্কার করার অভূতপূর্ব উচ্ছস্বিত এবং প্রচণ্ড আনন্দঘন অনুভূতি। ও যেন আচমকাই নিজেকে আবিস্কার করছে নিজেকে। নিজের হৃদয়-গহ্বরে লুকিয়ে রয়েছে এক অন্তহীন শক্তি সেখানে অপার সম্ভাবনা গলিত লাভার মতো টগবগ করে ফুটছে। নজরুল যেন নিজেকে নতুন করে চিনছে এখন। প্রচলতি রীতিনীতি ধ্যানধারণা আচারবিচার সমসত সামাজিক ধর্মীয় বিধিবিধানকে তছনছ করে দিয়ে নিজেকে মুক্ত, স্বাধীন বলে দীপ্তকন্ঠে ঘোষণা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আর সেই ধ্বনিপুঞ্জ সমুদ্রের তরঙ্গের মতো বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
লেখাটা শেষ করার পর পেনসিলটা সেই খাতার ওপর রাখল নজরুল। শরীর যেন পালকের মতো হাল্কা। ভেতরে অপরিসীম আনন্দ, কানায় কানায় ভরে উঠেছে শরীরের প্রতিটি কোষ। আহ! আআআহ! কী অপুর্ব এক স্বর্গীয় অনুভূতি আচ্ছন্ন করে তুলেছে। নজরুল বুঝতে পারছিল ওর এই লেখা এযাবত কালের সকল লেখার থেকে যোজন দূরের। এ একেবারে অন্যরকম। এমন লেখা ও নিজে কেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজপর্যন্ত লেখা হয়নি। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে পৃথিবী ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল ‘ শোনো শোনো সকলে আজ আমি যা রচনা করলাম তা চিরকালের জন্য। শরীর একই সঙ্গে শ্রান্ত এবং উল্লসিত। বিছানা ছেড়ে উঠল ও। জানলার কাছে গিয়ে পাল্লা খুলতেই দেখল ভোর হচ্ছে। নতুন এক দিনের নরম সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়ছে ওর শরীরে এই পৃথিবীতে।
মুজফফর সারা বছরই ঘুম থেকে ওঠেন সকাল সকাল। নজরুল অবশ্য বেলা আটটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ মুজফফর চোখ মেলে দেখলেন অদ্ভূত ব্যাপার। নজরুল তার তক্তপোষে চাদরমুড়ি দিয়ে বসে খুব মনযোগ দিয়ে কিছু একটা পড়ছে। খোলা জানলা গলে শীতের সকালের সোনালি সূর্যালোক এসে পড়েছে নজরুলের গায়ে। চোখ মুখ ঝলমল করছে নজরুলের।
মুজফফর উঠে বসে বললেন কী ব্যপার কাজী সাহেব আজ এত তাড়াতাড়ি উঠেছেন?
নজরুল তাকাল মুজফফরের দিকে। ওহ আপনি উঠেছেন সাংঘাতিক কান্ড হয়ে গেছে কাল রাতে। নজরুলের লাল ছিটেলাগা চোখদুটি রাত জাগার কারনে আরও লাল কিন্তু উত্তেজনায়, আনন্দে ঝকঝক করছে।
মুজফফর বুঝলেন নজরুল কিছু একটা লিখেছে। বললেন, রাতে ঘুমোননি মনে হচ্ছে।
আর ঘুম! কাল সারা রাত ধরে যা একটা ঘটনা ঘটিয়েছি, আপনি ভাবতে পারবেন না। এমন একটা কবিতা লিখেছি যা আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে লেখা হয়নি। আপনাকে শোনানর জন্য অপেক্ষা করছি। শুনুন বলে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না নজরুল। মুক্ত কন্ঠে মাথা ঝাঁকিয়ে পড়তে শুরু করল বিদ্রোহী।
মুজফফর চুপ করে শুনতে থাকলেন। মুজফফর নজরুলকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালবাসেন নজরুল মস্ত কবি হোক এই ইচ্ছেও তার প্রবল কিন্তু তিনি নিজে কাব্যরসিক নন, তার ক্ষেত্র রাজনীতি এবং সেই কথা তিনি নিজেও মুক্তকন্ঠে স্বিকার করেন ফলে কবিতাটি তিনি পুরোটা ম্ন দিয়ে শুনলেন বটে কিন্তু শেষ হওয়ার পর নজরুল যখন খুব আশা নিয়ে মুজফফরকে জিজ্ঞাসা করলেন কেমন হয়েছে বলুন, মুজফফরের মধ্যে বিশেষ কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। সামান্য মাথা নেড়ে বললেন, হুঁ ভালই তো।
এই সামান্য উত্তর আশা করেনি নজরুল। কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল মুজফফরের দিকে। ও ভাবতেও পারেনি এই কবিতা শোনার পর আহমদ সাহেব এমন ভাবলেশহীন মুখে নিজের প্রতিক্রিয়া দেবেন। ভালই তো! এটা কোনও উত্তর হল! নজরুল মনে মনে কষ্ট পেল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। চুপ করে গেল। মুজফফরও বুঝলেন নজরুল হয়তো আশা করেছিল তিনি শুনে খুবই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন কিন্তু উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ যে কোনও বিষয়তেই মুজফরের খুবই সংযত। এই ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হল না। নজরুল গুম হয়ে গেল।
বেলা একটু গড়াতেই এলেন আফজালুল সাহেব। উনি প্রায় দিনই আসেন। নজরুল ঘরে থাকলে কিছুক্ষণ গল্পগাছা করে যান। আজ ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই নজরুল হৈ হৈ করে বলে উঠল এই তো আফজল সাহেব আপনার কথাই ভাবছিলাম। কাল সারা রাত ধরে একটা কবিতা লিখেছি একবার শুনবেন।
সারা রাত ধরে লিখেছেন! দীর্ঘ কবিতা নাকি?
হুঁ শুধু দীর্ঘ নয়...বলতে বলতে থেমে গেল নজরুল আচ্ছা শুনে দেখুন কেমন লাগে।
মুজফফরও ঘরেই ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন নজরুল এই কবতাটি নিয়ে বিশেষ উত্তেজিত। আফজালুল বললেন, বেশ পড়ুন শুনি।
নজরুল সঙ্গে সঙ্গে খাতা খুল দরাজ গলায় পড়তে শুরু করে দিল-
বল বীর
বল উন্নত মম শির!
মুজফফর দেখলেন নজরুল যেমন তার একমাথা ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে হাত নেড়ে জোর গলায় পাঠ করছে আফজালুল সাহেবও সমান তালে মাথা নেড়ে কখনও আস্ফুটে আহা উহু শব্দ করে প্রশংসা করতে থাকলেন।
আবৃত্তি শেষ হতেই প্রবল উচ্ছ্বসিত হয়ে তক্তপোষে চাপড় দিয়ে সাব্বাশ...সাব্বাশ বলে উঠলেন আফজালুল সাহেব। আপনি কী লিখেছেন কাজী সাহেব! এ যে আপনার পুরনো সকল লেখাকে ছাপিয়ে গেছে! আহা অসামান্য অসামান্য!
এইবার প্রশংসা শুনে নজরুলের মুখে হাসি ফুটল। বলছেন?
বলছি মানে! এই লেখা মানে...কী বলব অতুলনীয়। আমাকে এখনই দিন মোসলেম ভারতে ছাপব।
বেশ কপি করে দিচ্ছি তাহলে।
হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি কপি করা শুরু করুন। আমি চা নিয়ে আসছি। বলে ঘরের কোনে রাখা চায়ের কেটলিটা নিয়ে আফজল উল উঠে গেলেন মোড়ের মাথার দোকান থেকে চা আনতে। নজরুল খাতা থেকে কবিতাটা দেখে নতুন কাগজে কপি করতে থাকল। মুজফফর উঠলেন এইবেলা ওর বেরোনো রয়েছে। কাজ রয়েছে কিছু।
চা নিয়ে ফেরার পর আফজালুল মুজফরের সঙ্গে কিছু গল্পগুজব করলেন নজরুল ততক্ষণে পুরোটা কপি করে আফজালুলকে দিয়ে দিল। আফজালুল আবার বললেন আপনি যা লিখেছেন দেখবেন বাংলাসাহিত্যমহলে হৈ হৈ পড়ে যাবে।
আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক ভাই ডাবজল।
হো হো করে হেসে উঠল তিনজনেই। নজরুল মাঝেমাঝেই আফজল উলকে মজা করে ডাবজল ডাকে।
আফজালুল হক চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মুজফফরও বেরোলেন। নজরুল ঘরে বসে রইল একা। আজ মন যেন পালকের মতো হাল্কা। কাল সারারাত না ঘুমোনোর কারণে চোখের পাতাদুটো সামান্য ভারি লাগছে, কিছুটা ক্লান্তি- কিন্তু এই সবকিছুকে ছাপিয়ে ঊঠছে আনন্দ। তীব্র একটা আনন্দের উচ্ছ্বাস। একটা বিশাল কিছু ঘটয়ে ফেলেছে সেটা মনের ভেতরেই টের পাচ্ছিল নজরুল। ওর এই কবিতা যে বাংলার সাহিত্য জগতে জায়গা করে নিতে এসেছে।
# # #
ঠিক দিন দুই পর দুপুরের দিকে তালতলার ঘরে হন্দদন্ত হয়ে ঢুকলেন নলিনীকান্ত। আজ তিনি এসেছেন বিশেষ কাজ। দিন কয়েক আগে তিনি গেছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের বাগবাজারের বাড়িতে। মাঝেমাঝেই সেখানে যান। গল্পগুজব হয়। আগের দিন গল্পের মাঝে ক্ষীরোদবাবু হঠাৎই বললেন, শুনেছি কাজী নজরুল ইসলাম তোমার বন্ধু বিশেষ। একদিন তাকে আমার কাছে আনতে পারো। আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি থাকে। একবার দেখতে ইচ্ছে হয়।
আপনি বলছেন যখন অবশ্যই নিয়ে আসব। কথা দিয়েছিলেন নলিনী। আজ সেই উদ্দেশ্যেই আসা।
কাজীভায়া আছ নাকি?
আরে নলিনীদা এসো এসো। সহাস্যে নলিনীকে বলল নজরুল। তোমার কথাই ভাবছিলাম একটু আগে।
বটে! হেতু কী?
হেতু খুবই গুরুতর। একটা কবিতা লিখেছি। শুনতে হবে।
বেশ শোনাও তবে। বলে তক্তপোষে জমিয়ে বসে পড়লেন নলিনী।
নজরুল খাতা খুলে বিদ্রোহী পড়তে শুরু করল আবার।
নলিনীও যথারীতি উচ্ছ্বসিত। কী লিখেছ ভায়া! আহা এ যে অতুলনীয়!
সত্যি বলছ!
অবশ্যই। অসাধারণ লেখা। আচ্ছা যা হোক তোমার কাছে যে কারণে এসেছি সেটা শোনো বলে ক্ষীরোদবাবুর বাড়িতে যাওয়ার কথাটা জানালেন।
আরে আমার কী সৌভাগ্য এখনই যাওয়া যাক নাকি?
অবশ্যই। তোমাকে নিয়ে যেতেই তো এসেছি।
চলো তাহলে।
এই কবিতাটাও সঙ্গে নিয়ে নাও। ক্ষীরোদবাবুকে শোনাবে।
বেশ বেশ, খুব ভাল হবে।
দুইজনে বেরিয়ে পড়ল বাগবাজারের দিকে।
# # #
ক্ষীরোদবাবুর বাড়িতে অনেকক্ষণ গল্প হল। উনিও নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা পাঠ শুনে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলেন নজরুলকে। আবেগে বৃদ্ধের চোখে জল এসে গেল। বার বার নজরুলকে আশীর্ব্বাদ করে বললেন তুমি বাংলা সাহিত্যকে উর্বর করতে এসেছ। অনেক ফসল তোমার হাত থেকে আসবে। এগিয়ে যাও।
আরও বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ওখান থেকে উঠল দুইজনে। রাস্তায় বেরিয়ে নলিনী বললেন, আমাকে কবিতাটা দাও নজরুল, আমি বিজলীতে ছাপাব।
শুনে হাত তালি দিয়ে হো হো করে হেসে নজরুল বলল সে উপায় আর নেই। দুইদিন আগে ডাবজল এসে বিদ্রোহী নিয়ে চলে গেছে।
মানে আফজল নিয়ে চলে গেল! তুমি দিয়ে দিলে! উফফ!
কী করব ও চাইল যে!
আরে মোসলেম ভারত কবে ছাপবে না ছাপবে কোনও ঠিক নেই। আমি বিজলীর এই সংখ্যাতেই ছাপিয়ে দিতাম।
নজরুলেরও ঐকান্তিক ইচ্ছে এই কবিতা খুব দ্রুত পাঠকের হাতে পৌঁছোক। তাহলে উপায়?
চলো দেখি মোসলেম ভারতে হামলা করা যাক। এই ক’দিন আগে ওরা তোমার কামাল পাশা নিয়েছে। এখন আবার বিদ্রোহী। সব ভাল লেখা কি ওরাই ছাপবে নাকি?
যদিও নলিনী খুব ভাল করেই জানেন প্রবাসীর যেমন রবীন্দ্রনাথ তেমন মোসলেম ভারতের নজরুল। আজ পর্যন্ত নজরুলের ভাললেখাগুলোর বেশিরভাগই মসলেম ভারত ছাপিয়েছে। আফজালুল বিদ্রোহী শুনেও আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করেননি। নিয়ে গেছে। কিন্তু এবার নলিনীর জেদ চেপে গেল। এই কবিতা উনি কিছুতেই হাতছাড়া করবেন না। নজরুলকে বললেন, তোমার হাতের কপিটা আমাকে দাও তো। আপাতত এটা নিয়ে রাখি তারপর আমি ব্যবস্থা করছি।
নজরুল বিনা বাক্যব্যয়ে নলিনীকে পকেটে রাখা কপিটা দিয়ে দিল।
চলো একবার মোসলেমএর আপিসে যাওয়া যাক। দেখি কী করা যায়।
নজরুলকে সঙ্গে নিয়েই নলিনী রওনা দিলেন মোসলেম ভারতের দপ্তরের দিকে।
# # #
আফজালুল সাহেব দপ্তরে নিজের চেয়ারেই বসেছিলেন নজরুলকে সঙ্গে নিয়ে নলিনীকে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখেই বুঝতে পারলেন আগমনের হেতু। হো হো করে হেসে বললেন, চিড়িয়া উড় গয়া।
নলিনী বুঝলেন বিজলীর মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে পেরে আফজালুল যারপরনাই খুশি। তিনি বিনয়ের সঙ্গে বললেন আফজলভাই কামাল পাশা তো নিয়েছ, বিদ্রোহীকে বিজলীর জন্য ছেড়ে দাও না ভাই।
আফজল বললেন আর উপায় নেই। আমি ওর গতি করে ফেলেছি। ছাপানো শুরু হয়ে গেছে। এই দেখো বলে একটা প্রিন্ট নলিনীর সামনে মেলে ধরলেন।
নলিনী ফর্মাগুলো উলটে দখতে থাকলেন। আফজালুল ততক্ষণে নজরুলের সঙ্গে গল্পে ডুবে গেছে। বিদ্রোহী নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। সঙ্গে চা।
নলিনী দেখলেন এই সুযোগ। আফজলের অজ্ঞাতসারে ওই ফর্মাকটায় ছাপা রচনাগুলোর শিরোনাম এবং লেখকের নাম টুকে নিলেন এক টুকরো কাগজে। তারপর গোপনে কাগজটা চালান করে দিল নিজের পকেটে। ততক্ষণে মনে মনে যা ফন্দি আঁটার তিনি এঁটে ফেলেছেন।
বিজলীর দপ্তরে পৌঁছেই তিনি আর এক মুহূর্ত দেরী করলেন না। প্রকাশিতব্য মোসলেম ভারতের একটি সমালোচনা লিখতে বসে গেলেন।
মসলেম ভারতের একতা বিশিষ্টতা এই যে, এতে বাজে মাল বড়ো একটা আমদানি করা হয় না। আমাদের বিশ্বাস ভালো প্রবন্ধাদি সংগ্রহের জন্যই ‘মোসলেম ভারত’ যথা সময়ে প্রকাশিত হয় না। এবারের ‘মোসলেম ভারতে’ শ্রীযুক্ত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চুরাশি লাখ’ সুন্দর নিবন্ধ। মোহম্মদ লুতফর রহমনের রাজনৈতিক অপরাধী তেজপূর্ণ সুন্দর প্রবন্ধ। কামালপাশা হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা। কবিতাটি যুদ্ধের মার্চে ছন্দে গাঁথা। এরূপ কবিতা বোধহয় বাঙলার কাব্যসাহিত্যে এই প্রথম। ‘বিদ্রোহী’ কাজী সাহেবের আর একটি কবিতা। কবিতাটি এত সুন্দর হয়েছে যে আমাদের স্থানাভাব হলেও তা বিজলীর পাঠকপাঠিকাদের উপহার দেবার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না।
এই পর্যন্ত লিখে একটা ড্যাস টেনে পরের দুই পৃষ্ঠায় বিদ্রোহী কবিতা দিয়ে তিনি সরাসরি পাঠিয়ে দিলেন ছাপাখানায়। মানে প্রকাশিতব্য মোসলেম ভারত পত্রিকার আলোচনার ছলে তিনি সেই প্রতিকায় ভবিষ্যতে প্রকাশ পাবে বিদ্রোহী কবিতাটি পুরোই বিজলীতে আগে ছাপিয়ে দিলেন। ফলে সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না।
বার নম্বর পৃষ্ঠায় নলিনীর আলোচনা আর তেরো ও চোদ্দ নম্বর পৃষ্ঠায় ডবল কলমে বড় বড় অক্ষরে কবিতা ছাপা হয়ে গেল।
# # #
প্রকাশ পেল বিদ্রোহী। প্রকাশ শব্দটা সঠিক নয়, বলা ভাল আছড়ে পড়ল বাঙলার উত্তপ্ত মাটিতে। ঝড়ের বেগে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহীর কথা। একটা বিজলীর সংখ্যা হাতে পাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেল সকলের মধ্যে। এ কী কবিতা? নাকি একটা আস্ত সাইক্লোন যা নিমেষে সবকিছুকে তছনছ করে উড়িয়ে নিয়ে যায়। যারা আগে হাবিলদার কবির কবিতা পড়েছিলেন, লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তারাও বিস্মিত। এমন লেখা আগে কখনও ওই তরুণ কবি লেখেনি। এই ভাষা এই ভাব, এই ব্যঞ্জনা...এ যে অবিশ্বাস্য! তোলপাড় হয়ে গেল গোটা বাংলায়। মুড়ি মুরকির মতো বিজলীর কপি শেষ হয়ে গেল। ওই সংখ্যাটি আবার নতুন করে ছাপাতে হল। মোট উনত্রিশ হাজার কপি পত্রিকা ছাপতে হল এমন ঘটনাও আগে কখনও ঘটেনি একটা কবিতার জন্য কোনও পত্রিকা সবথেকে আশ্চর্যের কথা ওই কবিতা যারা পড়লেন তাদের সকলেই যে সাহিত্যপ্রেমী তাও নয় কিন্তু যারা পড়লেন সকলেই মুগ্ধ। আসলে এই কবিতায় সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় রীতিনীতি, বিধিবিধানের বিরুদ্ধে, আইন কানুনের বিরুদ্ধে যে সোচ্চার প্রতিবাদ, যে অস্বীকার ছিল সেটাই আপামর মানুষের মনে আলোড়ন তুলল। বৃটিশশাসনে পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষ প্রতিক্ষণে যে দাসত্বের গ্লানী, অপমানের জ্বালায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছিল এই কবিতা যেন তাদের মনে আগুন জ্বালিয়ে দিল। শুকনো জঙ্গলের দাবানল যেভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সেইভাবে বিদ্রোহীর কথা ছড়িয়ে পড়ল। সকলের মুখেই এক আলোচনা, কে এই কবি? কী জ্বালাময়ী লেখা! আর যারা নজরুলকে চিনতেন তারাও তাজ্জব, ছেলেটা এ কী লিখেছে? কী করে লিখল! আগের লেখার সঙ্গে কোনও মিল নেই! চারিদিকে নজরুলের জয়জয়কার। নজরুলও তার সৃজনশীলতার প্রথম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটাতে পেরে, তার জীবনদর্শনের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা করতে পেরে যেন আবেগে আত্মহারা। বিজলীর আপিসে প্রতিদিন অসংখ্য চিঠি তাতে নজরুলকে অকুন্ঠ শুভেচ্ছার পাশাপাশি এই তরুণ কবির আরও নতুন লেখা চাই বলে দাবী। একটি কবিতা যে এতটা জনপ্রিয় হতে পারে তা কারও ধারণার বাইরে ছিল, বাংলার সাহিত্যমহলেও শুধু বিদ্রোহী নিয়ে আলোচনা হতে লাগল। নজরুলও উচ্ছ্বসিত। ওর এই কবিতাটি যে সম্পূর্ণ অন্যরকমের তা আগেই টের পেয়েছিল এবার স্বীকৃতি পেয়ে মনে জোর পেয়ে গেল আরও। ও বুঝতে পারছিল এই কবিতার এমন বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ শুধুমাত্র পরাধীনতার গ্লানীকে উস্কে দেওয়া নয়, অত্যাচারির খড়্গকৃপাণ যতদিন আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে ততদিন তিনি তার সংগ্রাম তার বিদ্রোহ চলবে সেই ঘোষণাও নয় এ আসলে সহসাই নিজেকে আবিস্কার করে ফেলে আত্মবিশ্বাসের শৃঙ্গে উত্তোরণ।
মুজফফর সাহেব কাব্য সাহিত্যের তেমন সমঝদার ছিলেন না, কিন্তু নজরুলের শুভাকাঙ্খী। কাজী সাহেবের এমন সাফল্যে তিনিও যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। তবে তিনি প্রখর বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ। তিনি নজরুলের কবিতাটি পরেও পড়েছেন। এই কবিতায় যে নজরুল মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেছে তা না বুঝলেও তিনি কবিতাটিতে নজরুলের পান্ডিত্যের যে আভাস পেয়েছিলেন তাতেই মুগ্ধ। নজরুলের সঙ্গে একই ঘরে থাকার কারণে তিনি জানতেন এই ভাষার ব্যবহার এই ব্যঞ্জনা নজরুল কোনও দেবতার আশীর্বাদে পায়নি। বিদ্রোহী একদিনের ফসল নয়, কলকাতায় ফেরার পর থেকেই নজরুল যে নিরন্তর চর্চা করে গেছে তারই ফসল বিদ্রোহী। তিনি দেখেছিলেন রাতের পর রাত জেগে নজরুল কবিতায় কুশলী শব্দ, ছন্দের প্রয়োগ নিয়ে অনুশীলনা করেছে, হিন্দু পুরাণ এবং মুসলিম অনুসঙ্গকে কীভাবে কবিতায় ব্যবহার করা যায় তাই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। উপমা, অলংকারের ব্যবহার শিখেছে। মুজফফর এই কঠোর অনুশীলনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সেই পরিশ্রমের পুরস্কার কাজী সাহেবকে পেতে দেখে তিনিও খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন করাচি থেকে যে হাবিলদার তরুণ কবি কলকাতায় পা রেখেছিলেন তিনি ছিলেন মুসলমান আর এখন বিদ্রোহী কবিতা যে রচনা করেছেন তিনি মানুষ। বিদ্রোহীর কথা আবেদন সাধারণ মানুষের আবেগকে নাড়া দিতে পেরেছিল তাই এই কবিতা এত দ্রুত এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই কবিতা আজীবনের, যার আবেদন বিশ্বজনীন।
গ ল্প ২
বিরূপশাম্ভবী
সন্মাত্রানন্দ
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
রাত শেষ হয়ে এল। কুলুঙ্গিতে প্রদীপের শিখা স্তিমিত, ম্লান। বিরূপাক্ষ ধীর পদক্ষেপে সাধনকুটিরের বাহিরে এলেন। খড়মের খট্খট্শব্দে রজনীর নৈঃশব্দ্য সামান্য বিচলিত হল। গৃহাঙ্গণের বিল্ববৃক্ষমূল অবধি এসে বিরূপাক্ষ ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাকালেন। নৈশ গগনের নক্ষত্রমণ্ডলী নির্বাপিত হয়ে আসছে। আসন্ন প্রভাতের ইঙ্গিতবাহী নদীর বাতাস গায়ে এসে লাগল। বিরূপাক্ষের স্বেদাক্ত শরীর যেন আরামে জুড়িয়ে গেল। এখনই শাম্ভবী বস্ত্র পরিধানকরতঃ বাহিরে আসবে। বিরূপাক্ষ তারই অপেক্ষা করছেন।
আজ সত্যই ক্রিয়াসিদ্ধি হয়েছে। দেবী পূজা গ্রহণ করেছেন, ক্রিয়াশেষে বিরূপাক্ষর স্পষ্ট অনুভব হল। এমন তৃপ্তি এর আগে তিনি কখনও পাননি। সকলই দেবীর কৃপা এবং শাম্ভবীর ক্রিয়াদক্ষতা। অতি অল্প সময়ে সে সমর্থা ভৈরবী হয়ে উঠেছে। তান্ত্রিক ক্রিয়ায় ভৈরবীই প্রধানা। বিরূপাক্ষর ভূমিকা সেখানে গৌণ।
দ্বারপথে মর্মরধ্বনি শ্রুত হল। লঘু পায়ে শাম্ভবী বিরূপাক্ষর সম্মুখে এসে দাঁড়াল। মন্দিরগাত্রে ক্ষোদিত ভাস্কর্যের মতো তার সুছাঁদ শরীরে অগুরুর মৃদু আঘ্রাণ। সীমন্তে সিন্দুর এই অস্পষ্ট আলোতেও জ্বল জ্বল করছে। নয়নকোণে কজ্জলরেখা বিমর্দিত। কপালে রক্তচন্দনের টিকা সামান্য স্থানচ্যুত হয়েছে।
শাম্ভবী যুক্তকরে নমস্কার জানালে বিরূপাক্ষও প্রতিনমস্কার জানালেন। তারপর তিনি শাম্ভবীকে বুকে টেনে নিলেন। নিশান্তের নীরবতা যেন কুলায়-প্রত্যাগত পাখির মতো মাটির উঠানের উপর এক লহমায় ডানা মুড়ে বসল।
কিছুক্ষণ পর বিরূপাক্ষ দেখলেন, শাম্ভবী তাঁর বুকের ভিতর নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছে। বিহ্বল বিরূপাক্ষ প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে, শাম্ভবী? কাঁদছ কেন?
ক্রন্দন ও আলিঙ্গন গাঢ়তর হল। অনেকক্ষণ পর বিরূপাক্ষর মনে হল, শাম্ভবী যেন কী একটি কথা বারবার বলে চলেছে। মন দিয়ে শুনতে শুনতে কথাগুলি তাঁর কাছে স্পষ্ট হল। শাম্ভবী বলছে, আজই শেষ...আজই শেষ রাত্রি...
শেষ? কেন? কী হয়েছে? একথা বলছ কেন?
শাম্ভবী এইবার বিরূপাক্ষর আলিঙ্গন হতে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে দলিতা ফণিনীর ন্যায় বলে উঠল, আজ রজনীতেই দ্বাদশ বর্ষ পূর্ণ হয়েছে। কী আশ্চর্য! আপনি সকলই বিস্মৃত হয়েছেন! কিছুই কি আপনার আর মনে নেই?
নদীর বাতাসে কতগুলি জীর্ণ পত্র উঠানের উপর ঝর ঝর করে ঝরে পড়ল। আধো-অন্ধকারে বিরূপাক্ষ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বারো বছর! সত্যই তো তাঁর খেয়াল ছিল না। বারো বছর এত শীঘ্র চলে গেছে!
অথচ মনে হয়, এই তো সেদিন। যুগপূর্বের সেই বিগত দিবসটির কথা বিরূপাক্ষর মনে স্মৃতির অতল হতে ক্রমশ স্ফুটতর হয়ে উঠতে লাগল...
২
দ্বাদশবর্ষপূর্বে এক মধ্যাহ্নবেলায় সরমা এই কুটিরদুয়ারে তাঁর দর্শনপ্রার্থিনী হয়েছিল। সমস্ত সকাল বিরূপাক্ষর দেবীপূজায় কাটে। কিঞ্চিৎ বিলম্বে সব সেরে দ্বারপ্রান্তে এসে বিরূপাক্ষ দেখলেন, সরমা একাকিনী নয়। সঙ্গে তার অবগুণ্ঠনবতী পুত্রবধূটিও রয়েছে। তারা উভয়ে বিরূপাক্ষকে প্রণাম জানাতেই বিরূপাক্ষ উদ্বিগ্নস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?
সরমা বলল, সেকথা আপনাকে একান্তে জানাতে হবে। এই বলে পুত্রবধূটির প্রতি সে তীক্ষ্ণস্বরে নির্দেশ দিল, বৌমা! তুমি একটু মায়ের কাছে গিয়ে বোসো তো! তোমাকে পরে ডাকছি।
বিরূপাক্ষ দ্রুত বিল্ববৃক্ষতলে সরে এসে সরমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?
সরমা বলল, কাল এক জ্যোতিষী আমাদের গৃহে এসেছিলেন।
কোনো আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত করেছেন?
হাঁ। আমার পুত্রবধূ শাম্ভবীর অকাল বৈধব্যযোগ!
কিন্তু আপনার পুত্র শ্রুতসেন, সে তো সম্পূর্ণ সুস্থ। আর এরা উভয়েই তো...
...আপনার নিকট দীক্ষিত। সেই জন্যই তো আপনার নিকটে আর বিলম্ব না করে এলাম। আপনি দীক্ষাদানের পর আমার পুত্র শ্রুতসেন আর আমার বধূমাতা শাম্ভবী উভয়েই...
কোনোরূপ সাংসারিক অশান্তি হয়েছে? কোনো বিপদ...?
না, না। বরং আপনার কাছ থেকে দীক্ষা নেবার পর আপনার কৃপায় আমাদের সংসারের শ্রীবৃদ্ধিই হয়েছে। বিবাহের এক বৎসরের মধ্যেই শাম্ভবী এক পুত্রসন্তানের জননী হয়েছে। সেদিক থেকে তারা সুখেই...
তাহলে সমস্যা কী?
সমস্যা বর্তমানে কিছু নাই। কিন্তু জ্যোতিষী বললেন—
কী বললেন?
বললেন, আমার বৌমা শাম্ভবীর এমন কিছু দেহলক্ষণ আছে, যাতে করে—
সে অকালে বিধবা হবে?
হাঁ। আমার একটিই পুত্র। সে আমাদের একমাত্র অবলম্বন, সে যদি...কী নিদারুণ সংবাদ!
বিরূপাক্ষর মনে বছরখানেক আগের কয়েকটি দৃশ্য চকিতে মনে পড়ে গিয়েছিল। বিবাহের অব্যবহিত পরেই শ্রুতসেন ও শাম্ভবী তাঁকে প্রণাম করতে এসেছিল। নবদম্পতী বিরূপাক্ষর পদপ্রান্তে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেছিল। উঠে দাঁড়ানোর সময় শাম্ভবীর মুখের ঘোমটা অসাবধানে সরে যায়। মুখ ও বাহু অনাবৃত হয়ে পড়ে। আর তখনই বিরূপাক্ষ লক্ষ করেছিলেন...কী অদ্ভুত! বিরূপাক্ষ নিতান্ত বিস্মিত হয়েছিলেন সেদিন। শাম্ভবী অতি দ্রুত বস্ত্র সংবরণ করে নিয়েছিল।
হ্যাঁ, বিরূপাক্ষ সেই এক মুহূর্তেই লক্ষ করেছিলেন, মেয়েটির ঊর্ধ্বাঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রোক্ত উপযুক্ত ভৈরবীর সমস্ত লক্ষণগুলি প্রকট। তিনি অবাক হয়ে ভেবেছিলেন, এ মেয়ের তো বীরভাবের সাধিকা হওয়ার কথা। এর সঙ্গে শ্রুতসেনের বিবাহ হল? শ্রুতসেন নিতান্তই পশুভাবসম্পন্ন। মেয়েটি সুখী হবে কী প্রকারে? যাই হোক, ভগবতী জগদম্বা যা করেন! পরে এরা দুজনেই বিরূপাক্ষর নিকট দীক্ষাপ্রার্থনা করে। বিরূপাক্ষও সানন্দে তাদের মন্ত্রদীক্ষা দিয়েছিলেন।
কী ভাবছেন?
সরমার প্রশ্নে বিরূপাক্ষর চিন্তায় ছেদ পড়ল। তিনি বললেন, আমি দেবীর সমীপে আপনার পুত্র ও পুত্রবধূর কল্যাণপ্রার্থনা করব। এ ছাড়া আমি আর কী করতে পারি? আচ্ছা, সেই জ্যোতিষী কি এই আসন্ন বিপদের কোনো প্রতিকারোপায় নির্দেশ করেননি? কোনো শান্তি-স্বস্তয়ন?
সেই জন্যেই আপনার কাছে আসা। প্রতিকার আছে। কিন্তু কীভাবে আমি আপনাকে তা—
নিঃসঙ্কোচে বলুন। আমার যা সাধ্য, আমি তা অবশ্যই করব।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সরমা দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল, জ্যোতিষী বলেছেন, যদি কোনো কৌল তান্ত্রিক শাম্ভবীকে পরকীয় শক্তি হিসাবে গ্রহণ করে বারো বছর সাধন করেন, তা হলে আমার পুত্রের এই ফাঁড়া কেটে যাবে।
কুটিরের অঙ্গনে বজ্রপাত হলেও বিরূপাক্ষ সম্ভবত এত বিস্ময়াহত হতেন না। এ বলে কী? নিজ পুত্রবধূকে কৌল সাধকের হাতে ছেড়ে দেবে? আর তার জন্য তাঁর কাছে এসেছে কেন? বিরূপাক্ষ দ্রুত চিন্তা করছিলেন।
আপনি নিজেও তো তন্ত্রসাধনা করে থাকেন... কিন্তু আপনার সাধনা একক সাধনা... তাই যদি...শাম্ভবীকে গ্রহণ করেন...
আপনি বলছেন কী? আমি তো কখনও একথা স্বপ্নেও ভাবিনি।
বিরূপাক্ষ পুনরায় আপন চিন্তার মধ্যে তলিয়ে গেলেন। প্রথম যৌবন গুরুগৃহে শাস্ত্রাধ্যয়ন করেই কেটেছে। যখন প্রভূত জ্ঞানসঞ্চয় শেষ হল, তখন যৌবন বিগত হয়েছে। সংহিতার পৃষ্ঠায় ডুবে থাকতে থাকতে বিবাহের চিন্তাও করা হয়নি। তিনি নিজে বীরভাবের অধিকারী, তাঁর গুরু একথা তাঁকে বলেছিলেন। কিন্তু বীরভাবের সাধনা একার সাধনা নয়; শক্তিগ্রহণ অনিবার্য। তিনি অকৃতদার, স্বকীয় শক্তি নাই। ইদানীং সেনরাজাদের আনুকূল্যে কৌল তান্ত্রিকগণ পরকীয় শক্তিও গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত নন—একথা তিনি শুনেছেন। তথাপি, স্বশিষ্যা শাম্ভবীকে শক্তিরূপে গ্রহণ করা...হাঁ, তাতে তিনি সাধক হিসাবে খুবই উপকৃত হবেন, শাম্ভবীর সেই সামর্থ্যও আছে। কিন্তু এ কী অভাবিত প্রস্তাব!
সরমা পুনর্বার আকুল প্রার্থনা জানালেন, যদি একবার আমার প্রস্তাব বিবেচনা করেন! এছাড়া আমার পুত্রের জীবন সংশয় হবে যে!
বিরূপাক্ষ ভাবলেন, এই মহিলা কী স্বার্থপর! পুত্রের জীবনের জন্য পুত্রবধূকে অন্যের হস্তে তুলে দিতেও পরাঙ্মুখ নয়!
তিনি কিছুটা আত্মস্থ হয়ে বললেন, আপনার এমন প্রস্তাব স্বীকার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
সরমা বিরূপাক্ষর পদপ্রান্তে পতিত হয়ে আকুল ক্রন্দন করতে লাগল। বিরূপাক্ষ তবুও কিছুতেই সম্মত হলেন না।
সেদিন তারা হতোদ্যম হয়ে চলে গেল। কিন্তু প্রতিদিন সরমা তাঁর কুটিরে একই প্রার্থনা নিয়ে উপস্থিত হতে লাগল। অবশেষে একদিন বিরূপাক্ষ বললেন, বেশ। কিন্তু এ সম্পর্কে ইতিকর্তব্য স্থির করার আগে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন।
কী কী বিষয়?
প্রথমত, শাম্ভবীর এ বিষয়ে সম্মতি আছে কিনা। দ্বিতীয়ত, শ্রুতসেনের এ বিষয়ে অনুমতি আছে কিনা। তৃতীয়ত এবং সর্বোপরি, স্বয়ং দেবীর এ বিষয়ে আমি কোনো প্রত্যাদেশ পাই কিনা।
তার পরদিনই শ্রুতসেন বিরূপাক্ষসকাশে উপস্থিত হল। লোকটি খর্বাকার, স্থূলোদর এবং চক্ষুতে সর্বদাই স্বার্থপরতামূলক অভিসন্ধি খেলা করছে।
বিরূপাক্ষ রুক্ষ স্বরে বললেন, তুমি সব শুনেছ? এ বিষয়ে তোমার কী মতামত?
মতামত আর কী, আচার্য! জ্যোতিষী স্পষ্ট বললেন, আমার মরণ অনিবার্য, যদি না আপনি শাম্ভবীকে গ্রহণ করেন। আর আপনি শাম্ভবীকে গ্রহণ করবেন, আপনারা দুইজনে সাধন করবেন—এ আমাদের বংশের অতুল সৌভাগ্য! আর বংশরক্ষার কথা যদি বলেন, সে তো শাম্ভবী আমাকে পুত্রসন্তান দিয়েইছে। এমনিতেও সে আমার প্রতি মুখ ফিরিয়ে থাকে। তবে জ্যোতিষী বলেছেন, আপনার সঙ্গে সাধনভজন করলেও সে তো কেবল মাসমধ্যে দুইদিন—কৃষ্ণপক্ষের দুই তিথি। তা বাদে আমি তো অন্য সব রজনীতে শাম্ভবীগমন করতে পারব...আমার দুয়ার খোলা...
বিরূপাক্ষ চক্ষু মুদ্রিত করে বলে উঠলেন, থাক, থাক। চুপ করো। লোকটার প্রতি ঘৃণায় বিরূপাক্ষর অন্তরাত্মা পর্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছিল।
এর সঙ্গে পূর্বজন্মের কোন পাপে শাম্ভবীর বিবাহ হয়েছে?
কিন্তু শাম্ভবী...সে কী বলে? কী তার মনোভাব? সেকথা না জানা পর্যন্ত তো কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।
কয়েকদিন পর নদীর ঘাট হতে বৈকালবেলায় কুটিরে ফিরে আসবার সময় গ্রামের এক জনবিরল পথে শাম্ভবীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। শাম্ভবী তাঁকে প্রণাম জানিয়েই দ্রুত পদে চলে যাচ্ছিল। বিরূপাক্ষ বললেন, শোনো—
শাম্ভবী লাজনম্র ভঙ্গিমায় বিরূপাক্ষর সম্মুখে এসে দাঁড়াল। বিরূপাক্ষ বললেন, তুমি কি কিছু ভেবেছ?
কিছুক্ষণ কোনো উত্তর নাই। অতিদূর কোনো নির্জন অরণ্য হতে ভেসে আসছিল অপরাহ্নের পাখির ডাক।
বলো, তুমি কি কিছু ভেবেছ?
আমি...আমি কিছু স্থির করতে পারছি না...আপনি...আপনি আপনার মা-কে বলুন। তিনিই আপনাকে যাতে সব ভাল হয়, তারই নির্দেশ দেবেন।
কিন্তু এতে যে তোমার সংসারসুখ পুড়ে যাবে!
সংসারসুখ? কথাটা উচ্চারণ করে শাম্ভবী বিষণ্ণ হাসি হাসল। নিজের মনেই নিতান্ত খিন্ন স্বরে বলতে লাগল, সংসারসুখ...সংসারসুখ! হুঃ, সংসারসুখ!
তারপর পুনরায় প্রণাম জানিয়ে সে নিজের পথে চলে গেল। বিরূপাক্ষ তার যাবার পথের দিকে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
৩
ইতিকর্তব্য স্থির না করতে পেরে দেবীর আদেশের জন্য বিরূপাক্ষ অন্নজল ত্যাগ করে প্রায়োপবেশনে ছিলেন। অবশেষে তিনি স্বপ্নাবস্থায় জগদম্বার প্রত্যাদেশ পান।
শ্রুতসেন প্রতি কৃষ্ণপক্ষের দুটি বিশেষ তিথিতে সন্ধ্যাবেলায় শাম্ভবীকে দিয়ে যেত। আবার প্রভাতবেলায় শাম্ভবী নিজেই গৃহে প্রত্যাবর্তন করত।
বিরূপাক্ষ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেন শাম্ভবীর দ্রুত পরিবর্তন। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে ক্রিয়াদক্ষা ভৈরবী হয়ে উঠতে তার বিলম্ব হল না। শাম্ভবীর বহিরঙ্গ লক্ষণগুলি পূর্বে বিরূপাক্ষ মিলিয়ে নিয়েছিলেন, ইদানীং অন্তরঙ্গ লক্ষণগুলিও মিলিয়ে নিলেন। সংস্কার কী আশ্চর্য জিনিস! অন্যের পক্ষে যা অসাধ্য, শাম্ভবীর কাছে তা অতি সহজ।
বস্তুত, কামশক্তিকে ঊর্ধ্বায়িত করে মাতৃচরণে নিবেদনই এই সাধনার সারাৎসার। দেহমিলন গৌণ উপায়মাত্র। সেই মিলনানন্দকে ঊর্ধ্বমুখে চালনা করাতেই প্রকৃত সিদ্ধি। রমণ বাহিরে নাই, রমণ অন্তরে।
দিনে দিনে শাম্ভবীর ভিতর একটা সহজ আনন্দ বিরূপাক্ষ লক্ষ করলেন। যেন একটি নদী এতদিন বাঁধ দেওয়া ছিল। বাঁধ ভেঙে অনর্গল প্রবাহে তার স্বচ্ছন্দ গতি যেন সঙ্গম-অভিমুখে অনির্বার বহে চলেছে।
বিরূপাক্ষরও মনে হল, জীবনে যে অপরিপূর্ণতা ছিল, শাম্ভবীকে লাভ করে তা দূর হয়ে যাচ্ছে। এখন এই জীবন সহজেই দেবীর চরণে সমর্পিত হতে পারবে।
একদিন ক্রিয়া-সমাপনান্তে বিরূপাক্ষ আর্দ্র বস্ত্রে শাম্ভবীর স্বেদাক্ত মুখমণ্ডল মুছিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, তোমাদের সংসারজীবন এখন স্বস্তিকর তো, শাম্ভবী?
না, আমার স্বামী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত, বিরক্ত।
কিন্তু কেন? তুমি তো তাদের নির্দেশেই...
প্রথমে তাঁরা তাই ভেবেছিলেন। এখন এতে আমার উৎসাহ দেখে আমার স্বামী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, বিচলিত। তাঁর এখন মনে হয়—
কী মনে হয়? তার মনে হয়, সে তোমার অধিকার হারাচ্ছে?
হাঁ। কিন্তু কী করব? পশুর সঙ্গে সহবাসে আমার রুচি হয় না।
শাম্ভবীর মুখ হাত দিয়ে চাপা দিয়ে বিরূপাক্ষ বললেন, থাক, শাম্ভবী। আর কিছু বোলো না।
নদীর দুরন্ত বাতাসে কক্ষের প্রদীপখানি নিভে গেল।
৪
চলচ্ছবির মতো বারোটি বছর চোখের সামনে আবর্তিত হয়ে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু আজ এতদিন পর মনে হচ্ছে, কেন শেষ হয়ে গেল? পূজাশেষের ফুলমালিকার মতো দিনগুলি কেন ভেসে গেল জোয়ারের জলে?
চলে যাবে, শাম্ভবী? আর আসবে না? কেন কী হল?
তিনি গতকাল বলেছেন, দ্বাদশ বর্ষ পূর্ণ হয়েছে। আর যেন আমি আপনার কাছে না আসি। আমাকে নিয়ে তিনি মগধে চলে যাবেন। আর এ গাঁয়ে ফিরবেন না।
এতদিন পরেও অধিকার করার বাসনা গেল না?
অধিকার! আমাকে অধিকার করবে? শাম্ভবী দৃপ্তা সিংহীর মতো দুলতে দুলতে বলল, আমাকে অধিকার করার শর্ত হল প্রেম! সে প্রেম তার নেই। সে কখনও আমাকে পাবে না।
তোমাকে ছেড়ে আমি কীভাবে থাকব, শাম্ভবী?
জানি না, জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। বলতে বলতে সে আবার বিরূপাক্ষর বুকের মধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তারপর অশ্রুজড়িত কণ্ঠে বলল, আমি এখানেই থাকব গো তোমার সঙ্গে। এই কুটিরে, এই বিল্ববৃক্ষতলে, এই নদীতীরে...আমিই থাকব...বলো, তুমি আর কোনো ভৈরবীগ্রহণ করবে না?
কখনও না, শাম্ভবী, কখনও না। তুমিই আমার একতমা।
সে চলে গেল। রাতের অন্ধকার যেদিকে ফুরায়, ভোরের ভৈরবী যেপথে বাজে, সেই দিকে, সেই পথে নদীর ছন্নবাতাসের ভিতর দিয়ে সে চলে গেল দূরে...ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হতে হতে আবছায়া হয়ে মিলিয়ে গেল।
৫
এখন এ ঘর ধুলামলিন। সমস্ত উঠান শুকনো পাতায় ভরে থাকে। ঘরের এক কোণে দেবীর পূজা অতি সংক্ষেপে নমো নমো করে শেষ হয়। একপাশে তালপাতার প্রাণহীন পুঁথিগুলোর উপর কুটিরের চাল চুঁইয়ে বৃষ্টির জল পড়ে দাগ ধরেছে। বিরূপাক্ষ বিশীর্ণ হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে নদীতীরে এসে বসেন। উদাস নদীবায় তাঁর পলিত কেশের ভিতর খেলা করে। পরনের রক্তাম্বর তাঁকে যেন ব্যঙ্গ করে। গলার রুদ্রাক্ষমালা বিদ্ধ করে তাঁর হৃদয়।
শাম্ভবী তার স্বামীপুত্রের সঙ্গে মগধ যাত্রা করেছে, তিনি শুনেছিলেন। সেও আজ তিন বৎসর হল। এর মধ্যে সরমাও মৃত্যুমুখে পতিত হল। গ্রামের লোকেরাই তার সৎকার করেছে। শ্রুতসেন আর এ গ্রামে ফিরে আসেনি।
এ জীবন নিতান্ত ব্যর্থ মনে হয় বিরূপাক্ষর। মাঝে মাঝে আশা জাগে, শাম্ভবী হয়ত আবার ফিরে আসবে। মাঝে মাঝে নিজেকে আশ্বাস দেন, সে এখানেই হয়ত আছে, এই কুটিরেই। হয়ত ওই বিল্বতলেই দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত ডাক দিলেই মরাইয়ের পাশ থেকে বেরিয়ে আসবে। ধ্যানকালে মুদিতনেত্রে কল্পনা করেন, জবাপুষ্পের উন্মুক্ত লাবণ্য নিয়ে সুন্দরী নগ্নিকা তাঁর সাধনভৈরবী তাঁরই আস্তীর্ণ ক্রোড়ের উপর এসে বসেছে।
নাহ, কল্পনা...সবই কল্পনা! সে আর নেই। কোথায় আছে এখন, কে জানে! কেমন আছে? দিনান্তের অতসীপুষ্পের মতন পরিম্লান হয়ে গেছে তার যৌবন? পৃথিবীর মতো বয়সিনী হয়ে গেছে শাম্ভবী?
কিছুদিন এইভাবে কাটবার পর বিরূপাক্ষ মনকে প্রবোধ দিতে আরম্ভ করলেন। বুঝলেন, এভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়া তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ভাবলেন, কেন আমি এত ভগ্নহৃদয় হয়ে পড়েছি? জীবনের প্রথম ভাগ আমি তো একাই অতিবাহিত করেছি। মধ্যে শাম্ভবী এসে সব ওলটপালট করে দিয়ে গেল। আবার আমি একাকীত্বের শক্তিতেই জীবনধারণ করব। বহুদিন দেবীপূজা করিনি। আজ আবার যত্নসহকারে মায়ের পূজা করব।
তিনি নদী হতে সুস্নাত হয়ে এলেন। উত্তম রক্তাম্বর ধারণ করলেন। সম্মুখবর্তী বনভূমি হতে আকন্দ, জবা, বিল্বপত্রাদি চয়ন করে আনলেন। পূজার দ্রব্যাদি স্বহস্তে মার্জন করে যথাস্থানে স্থাপন করলেন। রক্তচন্দন, সিন্দুর, অগুরু ক্ষুদ্রাকার পাত্রে পাত্রে সজ্জিত করে দীপ, ধূপ প্রজ্জ্বালিত করলেন। দেবীমূর্তিকে স্বহস্তে সাজালেন। তারপর পূজার আসনে বসে আচমন, ভূতশুদ্ধি, আসনশুদ্ধি, দ্বারপূজা, অঙ্গন্যাস, করন্যাস ইত্যাদি অনুষ্ঠানের পর দেবীকে আহ্বান করলেন। জলদ্গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করলেনঃ
ওঁ এহ্যেহি ভগবত্যম্ব ভক্তানুগ্রহবিগ্রহে।
যোগিনীভিঃ সমং দেবি রক্ষার্থং মম সর্বদা।। ...
অতঃপর তন্ত্রোক্ত মানসপূজায় মনোনিবেশ করলেন। মাতৃচরণে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। ভোগনিবেদন করলেন। একসময় পূজা শেষও হয়ে গেল।
পূজাসমাপনান্তে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম নিবেদনের পর উঠে দাঁড়ালেন। সহসা মনে হল, বড় দ্রুত সব যেন শেষ হয়ে গেল। মনে হল, দেবী এ পূজায় তৃপ্ত হননি। সকলই পণ্ডশ্রম—ভস্মে ঘৃতাহুতি! কী যেন নেই, কে যেন নেই! নিজের ভিতর থেকে একটা অকৃতার্থতার বোধ, একটা শূন্য হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। পূজা ফেলে বিরূপাক্ষ ঘরের দাওয়ায় এসে বসলেন। সুদূর আকাশে একটা বিবাগী শঙ্খচিল রৌদ্রের অত্যাচারে আর্ত বেদনায় কেন জানি অবিশ্রান্ত ডেকে চলেছে...
কয়েকবছর পর দিনানুদৈনিক এই যন্ত্রণার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে বিরূপাক্ষ একদিন রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি উমাপতিধরের জন্মভূমি সুবর্ণগ্রাম যাত্রা করলেন। দীর্ঘ নদীপথ বেয়ে এক পক্ষকাল পরে এক সন্ধ্যাবেলায় বিরূপাক্ষ সুবর্ণগ্রামে উপনীত হলেন।
নদীর ধারে বিশেষ পূর্ণিমা তিথি উপলক্ষে এক মেলা বসেছিল। কিছুক্ষণ পর আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠল। নদীতীরে নানা দিগদেশাগত কবিকুল সমবেত হয়েছিলেন। উমাপতিধর তখন এ গ্রামে আর বসবাস করতেন না। কিন্তু কবির আবির্ভাবভূমির মর্যাদায় মধ্যে মধ্যে সুবর্ণগ্রামে এইরকম কবিসমাবেশ সংঘটিত হত।
আকাশের চন্দ্রাতপের নীচে জ্যোৎস্নার আলোয় তরুণ কবিগণ একে একে কাব্যপাঠ করছেন। নানা রাগরঞ্জিত তাঁদের বসনভূষণ, সুললিত ছন্দোময় শ্লোকাবলী, অতি-অলঙ্কৃত গৌড়ী রীতি, বিশেষত রসসিক্ত প্রণয়কথা...মনে হল যেন, এ নদীতীরে দুঃখ বলে কোনো কিছুর কথা কেউ কখনও শোনেনি, আনন্দাশ্রু ছাড়া অন্য কোনোভাবে মানুষ কখনও অশ্রুপাত করেনি, জীবনের কঠোর বাস্তবতা হতে সে কবিতালোক বহু বহু যোজন দূরবর্তী।
বিরূপাক্ষ পণ্ডিত ব্যক্তি, কাব্যরসাস্বাদে বঞ্চিতও নন। বহুদিন পর কাব্যসুধাপানে মন যেন ক্ষণতরে মুক্তি পেল। রাত কেটে ভোর হল। শেষরাত্রিতে প্রায় সকলেই নদীতটে যত্রতত্র শয়ন করেছিলেন। বিরূপাক্ষও নদীর সিকতাভূমিতে এক স্থানে বিশ্রাম করছিলেন। দেখলেন, ছিন্ন মেঘ চাঁদের উপর দিয়ে কোথায় যেন ভেসে চলেছে, কখনও মনে হয়, চাঁদই সতত চলেছে মেঘলোকের ভিতর দিয়ে...জীবনের কতো বিচিত্র ছিন্নভিন্ন কাহিনি সেসব।
সুবর্ণগ্রাম থেকে ফিরছেন। তীরভূমি দুপাশে সরে যায় যায়...রৌদ্রালোক শ্বেতহংসের পালকের মতো স্রোতের উপর পড়ে থাকে...কোথাও নদীর উপর আনত হয়ে থাকে বেতসশাখা...আকাশপথ বেয়ে জলচর পাখি উড়ে যায় কোন সুদূরে। দেখতে দেখতে বিরূপাক্ষর মনে সেদিনের সেই আনন্দসন্ধ্যাটির কথা মনে পড়ছিল। বিক্রমণিপুর হতে আগত এক তরুণ কবি কবিতা পড়ছিলেন। ছন্দোবদ্ধ শব্দগুলি এখন আর মনে নেই, কিন্তু ভাবটা হচ্ছেঃ যে কটাক্ষ-ইঙ্গিতে তুমি আমাকে প্রথম দিন আহ্বান করেছিলে, হে তরুণী! তা আমি ভুলিনি। আজও তা আমার হৃদয়ের ভিতর নিহিত আছে। আজ তুমি কাছে নেই, দূরে গেছ, দূরে আছ। দূরে আছে তোমার সে দুই চোখ। কিন্তু সে চোখের মণির আলোক আজও আমার বুকের ভিতর দীপ্তি দেয়।
নিতান্তই লৌকিক প্রেমের কবিতা। নারীকে আশ্রয় করেই এসব কবিতার বিস্তার। সে জীবন বিরূপাক্ষর নয়। তবু তাঁর সাধনার মার্গও সাধনসঙ্গিনী ভৈরবী ব্যতিরেকে নিতান্তই নীরস, ব্যর্থ এক আখ্যান। বিরূপাক্ষর মনে হচ্ছিল, যত পথ শেষ হয়ে আসছে, বেদনাবোধ ততই হৃদয়কে পুনরায় অধিকার করে নিতে আসছে।
প্রাতঃকাল। নৌকা আর কিছু পরেই তীরে এসে ভিড়বে। নৌকার পাটাতনের উপর অর্ধশায়িত অবস্থায় বিরূপাক্ষ উৎসুক নেত্রে নদীর উপর দূর থেকে নিজগ্রামকে কেমন দেখায়, তাই দেখছিলেন। সহসা নিকটস্থ ঘাটে একটি দৃশ্য অবলোকন করে তিনি সচমকে সোজা হয়ে বসলেন।
এই ঘাটে এ কে স্নান করছে? এ যে শাম্ভবী! হ্যাঁ, শাম্ভবীই তো! সেই মেঘভার কুন্তলরাশি, সেই সিংহীর মতো কটিদেশ, গুরুভার শ্রোণী, সিক্ত বসনে আবৃত পূর্ণকলসের ন্যায় বর্তুলাকার স্তনযুগ্ম, সেই পদ্মিনীর মতো কমনীয় মুখমণ্ডলে আদীপ্ত, আয়ত দুটি নয়ন! শাম্ভবী! সে এখানে কী করে এল?
নৌকা ঘাটটির আরও সমীপবর্তী হলে বিরূপাক্ষর ভ্রম দূরীভূত হল। অবিকল শাম্ভবীরই মতো দেখতে এক যুবতী। কিন্তু শাম্ভবী নয়। সত্যিই তো। শাম্ভবী কী করে হবে? শাম্ভবীর বয়ঃক্রম কি আর একই স্থানে আটকে রয়েছে?
ঘরে ফিরে এলেন বিরূপাক্ষ। ভুলবার চেষ্টা করলেন। গৃহকর্মে মন লাগালেন। পুঁথিগুলির রক্ষণাবেক্ষণে মন দিলেন। ফুল তুলে এনে দেবীপূজার আয়োজন করলেন। মনে হল, দেবীর মুখ অপ্রসন্ন। কিছুতেই মন বসল না। মনের ভিতর বহু সতর্কতা সত্ত্বেও জেগে উঠতে লাগল নদীর ঘাটের সেই মেয়েটির মুখ।
কিছুদিন এইরূপ অব্যবস্থিত চিত্তেই কাটল। মনের ভিতর একটা ঝড় উঠেছে। নদীর বাতাসে তা শান্ত হয় না। নিদ্রায় তা নিমীলিত হয় না।
কয়েকদিন পর তিনি খোঁজ নিলেন। মেয়েটির নাম মালতী। সে পাশের গ্রামের বর্গক্ষত্রিয়দের মেয়ে। প্রায় অন্ত্যজ। বিরূপাক্ষ কন্যাটির পিতার সমীপে বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণ করলেন। মালতীর পিতা এ অকল্পনীয় প্রস্তাবে যেন হাতে চাঁদ পেল।
সমাজ তখন অত্যন্ত রক্ষণশীল। ব্রাহ্মণের সঙ্গে বর্গক্ষত্রিয়ের বিবাহ একেবারেই অনুমোদিত নয়। কিন্তু বিরূপাক্ষর অসামান্য সামাজিক প্রভাব ছিল। গ্রামের অন্যান্য ব্রাহ্মণদের সভায় তিনি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রোক্ত নিষাদ বিবাহের কথা উত্থাপন করে শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করলেন। তাঁকে প্রতিহত করবে, গ্রামের ব্রাহ্মণদের সে পাণ্ডিত্য বা সামাজিক প্রতিপত্তি কিছুই ছিল না। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা অস্বস্তিতে বিপ্রকুল বিরূপাক্ষর দাবী বাধ্য হয়েই মেনে নিলেন।
অতি পরিণত বয়সে জীবনে প্রথমবার বিরূপাক্ষ বিবাহের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। ঘরদোর মেরামত, অঙ্গন পরিষ্করণ, গৃহসজ্জা সকলই নিপুণভাবে আচরিত হতে লাগল।
তবু কেন জানি, হৃদয়বীণায় কী একটা মর্মন্তুদ রাগ বেজে চলে। সুর কেটে যায়। মনে হয়, কে যেন এ ঘরের আনাচে-কানাচে, প্রাঙ্গনে-কক্ষে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যে এই ঘরে এতদিন অদৃশ্য হয়ে ছিল, সে কি তবে বিরূপ হয়েছে? কী একটা অমঙ্গলের ছায়া যেন সেই ক্ষুদ্র কক্ষকে গ্রাস করে নিতে আসছে।
বিরূপাক্ষ বুঝে উঠতে পারেন না। জোর করে এসব দুশ্চিন্তা দূর করে দিতে চান। ক্রমে বিবাহের দিন এসে পড়ল। গোধূলিলগ্নে বিবাহ। দ্বিপ্রহরবেলায় বিরূপাক্ষ এক নিদারুণ সংবাদ পেলেন।
সকালে গাত্রহরিদ্রার অনুষ্ঠানের পর থেকেই মালতীর ভেদবমি শুরু হয়েছে। সময় যতই যেতে লাগল, কন্যার অবস্থা ততই খারাপ হতে লাগল। অপরাহ্নবেলায় সংবাদ এল, মালতী আর নাই।
উঠানের ঢেঁকিকাঠের উপর বসে বিরূপাক্ষ গ্রামের এক লোকের মুখে এই বার্তা শ্রবণ করলেন। তিনি কিছু বললেন না। নিঃশব্দে উঠান থেকে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে ভিতর হতে দ্বার অর্গলবদ্ধ করলেন।
ক্রমে অনেক লোক জড়ো হল। অনেকের অনেক ডাকাডাকিতেও ঘরের কপাট খুলল না। তিনদিন তিনরাত্রি পর বিরূপাক্ষ কক্ষ হতে যখন বহির্গত হলেন, তখন তাঁর ছিন্ন বাস, অবিন্যস্ত কেশ, জবাফুলের মতো আরক্ত আঘূর্ণিত চক্ষু, চোখের নীচে কাজলের মতো অন্ধকার, মুখের কথা অসংলগ্ন, অপ্রকৃতিস্থ—বিরূপাক্ষ সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গেছেন।
কারুর দিকে না তাকিয়ে স্খলিত পদবিক্ষেপে তিনি নদীর ঘাটের দিকে চললেন। একটা ব্যবসায়ীদের নৌকা সবেমাত্র গ্রামের ঘাট ছেড়ে যাত্রা শুরু করছিল। বিরূপাক্ষ সেই নৌকার গলুইয়ের উপর চেপে বসলেন। নৌকা ছেড়ে দিল।
বিরূপাক্ষ আর কোনোদিন এই গ্রামে ফিরে এলেন না। শুধু তাঁর জীর্ণ সাধনকুটিরটির প্রাঙ্গণ শুষ্ক বিল্বপত্রে ভরে যেতে লাগল আর নদীজলশব্দমুখর উত্তরবাহিনী বাতাসে উড়ে এসে পড়তে লাগল আটশো বছর আগেকার বন্য কুকশিমার ফুল।
গ ল্প ৩
অর্গাজম
কাবেরী রায়চৌধুরী
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
সন্ধে পূর্ব সময়টা আজও ভালো লাগে বেদবতী বর্মনের। দশতলার টেরেসে এই সময় সূর্য তার পূর্ব রূপ নিয়ে দেখা দেন। পশ্চিম থেকে উত্তর পূর্ব সমস্ত দিগন্ত রেখাই চোখে পড়ে এইখান থেকে।
শীত আসবো আসবো সময়। পরিপাটি হয়ে বসলেন এসে টেরেসের বেতের সোফায়। দার্জিলিং টি পানের অভ্যাস এই সময় প্রতিদিন। সহায়িকা মেয়েটি টি-পটে গরম জল, চা-পাতা ছাঁকনি, পোর্সেলিনের পেয়ালা-পিরিচ সব সাজিয়ে দিয়ে গেল। বললো, আজ কিন্তু এখনো পর্যন্ত একজনও এলোনা দিদি! চা ছাঁকতে ছাঁকতে তিনি ঘাড় নাড়লেন মাত্র।
-- কালকের যে মেয়েটা এসেছিল আমার কিন্তু বেশ ভালো লেগেছে। বলতে বলতে আকাশের দিকেই ফিরে চাইলো সে।
-- তুই চা খেয়িছস দীপা? তোর চা কই?
-- আজ খাব না গো। ভাল্লাগছে না। শরীলটা? ম্যাচম্যাচ? করছে। বমি বমি পাচ্ছে।
-- অম্বল হল? একটু জোয়ান আমলকি মুখে দে। গ্যাস হলেও চলে যাবে।
মাথা নাড়ল দীপা। আকাশটা দেখলে কেমন মন ভালো হয়ে যায়, না?
-- হ্যাঁ। আমার মন খারাপ হলেই আকাশ দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়।
-- আগে জানতাম না। তোমার কাছে আসার পর বুঝেছি। আচ্ছা, বাচ্চা গর্ভপাত করানো কি পাপ?
চায়ে চুমুক দিতে দিতে চমকে উঠেছেন বেদবতী। চোখে বিস্ময়। এক মুহূর্ত থমকে গেলেন। বললেন, কেন বল তো? হঠাৎ জিজ্ঞেস করছিস?
-- না, বললাম।
-- তোর কিছু-?
-- যদি হয়, তাই বললাম। আমি রাখবো না।
-- কেন? তোর তো ছিলেপুলে নেই?
-- না। আমি বুঝতে পারি না আমার বরকে আমি ভালোবাসি কী না!
দীপাকে আজ মাস ছয়েক ধরে দেখছেন বেদবতী। নম্র শান্ত স্বভাব। কম কথা বলে। কাজে রাখার পরে জেনেছিলেন শুধু স্বামী আর শ্বশুর নিয়ে সংসার তার। সেন্টার থেকে পাঠিয়েছে দীপাকে। এর বেশি খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনও তিনি বোধ করেননি। তাও গল্পে গল্পে বলেছিল। একটু অবাক হলেন বটে। বললেন, বিয়ের সময় পছন্দ করে দেখিসনি?
-- না। সম্বন্ধ এল। এক ছেলে। নেশা ভাঙ করে না, দেশে জায়গা জমি আছে, এখানে রিস্কা চালায় এই দেখেই বিয়ে দিয়ে দিল।
-- ও। বর আদর যত্ন করে না তোকে?
-- আমি বুঝতে পারি না!
-- কী? জ্বালাতন! হেসে ফেললেন বেদবতী। বললেন, বুঝবি আস্তে আস্তে। অত চিন্তা করিস না। বেল বাজছে। দেখে খুলিস। এখন তো কারুর আসার কথা নয়? অপরিচিত হলে আমায় ডাকবি আগে। যা।
প্রায় দৌড়েই গেল দীপা। ফিরেও এল দৌড়েই, ওই গল্প করার লোক গো! মুখটা আইহোল দিয়ে দেখেছি, চশমা পরা। চোর ডাকাত হবে না। বললো, পেপারে বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি। খুলবো?
-- খোল। এইখানে নিয়ে আয়। নাম জিজ্ঞেস কর।
ছ’ ফুটের ওপর লম্বা যে যুবককে নিয়ে টেরেসে এল দীপা তাকে দেখেই প্রাথমিক একটা আশ্চর্য আবেগ টের পেলেন বেদবতী। কেমন যেন একটা হঠাৎ দখিনের বাতাস ঘোর গ্রীষ্মে শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গেলে যেমন হয়, তেমন অনুভব!
বেদবতী কিছু বলার আগেই যুবকটি দু’হাত জোড় করে বললো, নমস্কার!
-- বসো। বসো। নমস্কার। বসো। নিজের হঠাৎ অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে নিয়েছেন দ্রুত বেদবতী। দীপার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘চা’। ‘আপনি ভাই চা খান তো’ নাকি ‘কফি’?
-- আমাকে তুমি বললেন প্রথমেই ওটাই তো ভাল ছিল! চশমার ওপার থেকে উজ্জ্বল একজোড়া চোখে আশ্চর্য আবেদন ছেলেটির। আমি আপনার থেকে কত বছরের ছোট জানেন?
বিস্ময় যেন কাটছেন না বেদবতীর, বললেন, কেমন করে জানবো?
-- আমার যখন তেরো ছিল তখন আপনার পঁয়ত্রিশ ছিল! হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছেন বেদবতী। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছেলেটি হাসলো; স্মিত, বললো, আমার নাম সান্ধ্যদীপ নন্দী।
-- মানে? মানে, আমি ঠিক...!
-- বুঝতে পারলেন না তো? বোঝার কথাই নয়! আমার মতো আপনার লক্ষ লক্ষ ফ্যান। আমি আপনাকে যেদিন প্রথম দেখি; দেখি না, সাক্ষাৎ, সাক্ষাৎ বলবো। সেই প্রথম সাক্ষাৎ-এর দিন আমার বয়স ছিল তেরো বছর দু’ মাস একদিন! আপনি আপনার লেখা কাব্যনাটক তিতির প্রতীক্ষা থেকে পাঠ করছিলেন রবীন্দ্রসদনে! মিউজিক সহ! হল প্রায় ভর্তি। আমাকে নিয়ে মা গিয়েছিল দেখতে এবং শুনতে। গেস্ট কার্ড ছিল আমাদের। সামনের সারিতে বসে-! যতটা অনাগ্রহ নিয়ে গিয়েছিলাম ততোটাই মেসমারাইজড! আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিলাম। আপনার হাতে দারুণ একটা গন্ধ!
সূর্য অস্তাচলে গেছে যেন কখন! পশ্চিম আকাশ-দিগন্ত কমলা-আবীরে স্নাত! সেই আভা বেদবতীর সমগ্র মুখমণ্ডল জুড়ে! কিছু শুনছেন কী না বোঝা দায়!
-- দিদি! চা! দীপা আরেক দফা গরম জল, চা-পাতা আর কুকিজ দিয়ে গেল।
সম্বিত ফিরে পেয়েছেন বেদবতী, বললেন, হ্যাঁ, রাখ, তুই কি এখন যাচ্ছিস?
-- সময় হয়ে গেছে। এইবার ব্যাগট্যাগ গুছোব। করতে করতেই সাতটা হয়ে যাবে। তুমি বলো যদি আরেকটু পরে যেতে পারি। চোখের ইশারায় সান্ধ্যদীপকে দেখিয়ে ইঙ্গিত করল, থাকবো?
-- না, তুই যেতে পারিস।
-- যাবার সময় বাবুলালকে বলে যাচ্ছি। বলে ঘরে ঢুকে গেল দীপা।
-- বাবুলাল বুঝি দারোয়ান? হেসে ফেললো সান্ধ্যদীপ। একটু বুঝি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন বেদবতী। বললেন, খুব কেয়ারিং। কথা বললেন বটে কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে অদ্ভুত একটা ঝিমধরা ভাব বুঝতে পারছেন।
-- আমি বানাবো চা-টা? আপনার হাত কাঁপছে। আমি ভালো চা বানাতে পারি। আমার বউ আর মা আমার হাতের চা খেয়ে বিছানা ছাড়ে!
একটা বেলুন সবে মাত্র স্বপ্ন ভরে উড়তে শুরু করেছিল পলকে তা মাটিতে নেমে এল বিস্ফোরণ নিয়ে আকস্মিক ভাবে অনুভব করলেন বেদবতী।
-- আপনার শরীর ভালো লাগছে না? চা ভেজাতে ভেজাতে উদ্বিগ্ন চোখে দেখছে সান্ধ্যদ্বীপ। হ্যালো! কী হল আপনার? ম্যাম!
এই এক রোগ! তার নিজের চেনাজানা মনটার বাইরে আরেকটা মনের খোঁজ পেয়েছেন তিনি বেশ কয়েক বছর আগে থেকে! এই মনটা তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। এই মনের দক্ষতা অস্বীকার করার মতো শক্তি তার নেই যে বুঝতে পারেন।
এক নিমেষে চিন্তার গভীরে ডুবে গেছেন। আবারও অজান্তেই মন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল! আবারও পরাজিত হয়ে ফিরে আসা বাস্তবে! এক লহমায় বিষণ্ণতা! খুব দ্রুত সামলে নিয়ে ফিরে এসেছেন বেদবতী নিজের কাছে, বললেন, প্রেশারটা মাঝে মাঝে গণ্ডগোল করে, মাথা ঘুরে ওঠে তখন। বোধ হয়, সেরকম হল। ও কিছু না। হাসার চেষ্টা করলেন।
সান্ধ্যদীপ হাঁ করে চেয়ে আছে। বললো, ও কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে দিলেন! মাঝেমাঝেই আপনার অসুস্থতার খবর পাই। আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আমি আপনার ফলোয়ার!
-- তাই বুঝি?
চা ছাঁকতে ছাঁকতে মৃদু হাসলো সান্ধ্যদীপ।
-- তোমার বউ আর মা দু’জনেই খুব লাকি। আজকালকার দিনে এমন ছেলে বিরলই বলবো। তোমার বউ আমার লেখাপত্র পড়ে?
-- না। ও ডাক্তার। ও ওর প্রফেশন সংক্রান্ত জার্নাল ছাড়া কিছু পারে না। আমার মা তো আপনার ডাই-হার্ড ফ্যান। চায়ে কাপ বেদবতীর হাতে তুলে দিতে দিতে বললো, মায়ের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা এই জন্য।
সন্ধ্যাতারা উঠেছে পশ্চিম দিগন্তে। আজ যেন সে অন্যদিনের তুলনায তীব্রতর উজ্জ্বল মনে হল বেদবতীর। আশ্চর্য লাগছে ছেলেটিকে। অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব আছে ছেলেটির মধ্যে। অদ্ভুত আকর্ষণীয়! কথায় কথায় সন্ধে পেরিয়ে গেছে যে ছেলেটি বুঝতেই দেয়নি!
-- আপনি কিন্তু এই সময়ে এইভাবে গায়ে হালকা গরম কিছু না দিয়ে বসবেন না। দেওয়ালীর পর থেকেই ঠান্ডাটা পড়েছে কিন্তু এইবার। একটা স্কার্ফ জড়িয়ে রাখবেন।
মুচড়ে উঠল যেন ভেতরটা, মনে হল বেদবতীর। তীব্র মোচড়টা টের পেলেন গভীর কোনো এক স্থানে। একেই কি তাহলে মধুর প্রদাহ বলে? কত কী লিখেছেন আজ পর্যন্ত! কত মানুষের কথা! অথচ নিজের অনুভবকে মহাবিশ্বের উপলব্ধি করে সৃষ্টি করতে পারেননি যেন বারবার মনে হয়। এই সেই অচেনা মনোজগৎ! ব্যাপ্ত ও বৃহত্তর এক জগৎ!
-- হ্যালো! ম্যাম! হে!
এ কী অপ্রস্তুত অবস্থা। বললেন, সান্ধ্যদীপ!
-- হ্যাঁ ম্যাম!
-- তুমি কি বিজ্ঞাপনটা পড়েই এলে? মানে-?
-- হ্যাঁ। বলতে পারেন সাহস পেলাম। আর সেই তেরো বছর বয়স থেকে যে ইচ্ছেটা একদিনের জন্যেও মন থেকে, মাথা থেকে যায়নি সেই ইচ্ছাটা এত বছর বাদে হয়তো বা পূর্ণ হবে ভেবে সোজা চলে এলাম।
কী স্পষ্ট দ্বিধাহীন উচ্চারণ সান্ধ্যদীপের! বিস্মিত বেদবতী। বলেই ফেললেন, কীরকম ইচ্ছা শুনি? বলা যায়?
-- নিশ্চই যায়। পায়ে ওপর পা তুলে দুটো হাত কোলের ওপর আড়াআড়ি রেখে বসলো সান্ধ্যদীপ। বসার ভীতে এক শান্ত সমাহিত ভাব। বললো, বলবো বলেই তো আসা। আপনার থেকে মাত্র এক হাত দূরত্বে বসে গল্প করছি এত সহজভাবে, ভাবতে পারিনি কোনোদিন! যেদিন কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম...? তাকে থামিয়ে দিলেন বেদবতী, বললেন, আমি তো আমার নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন দিইনি। তাহলে-?
-- আমার এক বান্ধবী আপনার বিজ্ঞাপন পড়ে বক্স নম্বরে জানিয়ে ছিল সে আপনার গল্প করার সঙ্গী হতে চায়। তাকে নম্বর দেওয়া হয় তখন। সেটাও আপনার পরিচিত ফোন নম্বর নয়। ও এসেছিল। আপনাকে দেখে ও চমকে গিয়েছিল যে আপনি গল্প করার সঙ্গী খুঁজছেন সাম্মানিকের বিনিময়ে কিন্তু আপনি ওকে সিলেক্ট করেননি। আমাকে মহা বিস্ময় নিয়ে বলেছিল জানেন? আর আমি বিস্মিত হতে গিয়ে পারিনি, মানে হইনি।
-- কেন? যারাই এসেছিল তারাই চমকে গয়েছিল আমাকে দেখে। তাদের চোখে রাইটার পোয়েট বেদবতী বর্মন গল্প করার জন্য লোক খুঁজছেন! আসলে ওই চমকে যাওয়া বা বিস্মিত হয়ে যাওয়াটাই আমার তাদের পছন্দ না করার কারণ।
-- আমি হইনি, বন্ধুর মুখে আপনার কথা শুনে। প্রাথমিক একটা ধাক্কা লাগলেও মনে হয়নি এটাই হওয়ার কথা ছিল। না হলে আমার ইচ্ছেটা পূর্ণ হবে কী করে? তেরো বছরের কিশোর থেকে গতকাল অবধি-! স্বপ্নটা লালনপালন করেছি! মহাবিশ্ব জানে! দ্য হোল ইউনিভার্স!... আপনি কিন্তু গায়ে কিছু জড়িয়ে এলেন না! প্লিজ ফর গড সেক।
-- থ্যাংকস। জড়াবো। বলে উঠে গিয়ে লাল-কালো সুতোয় কাজ করা কাশ্মীরি স্টোলটা গায়ে জড়িয়ে টেরেসে এলেন তখনই বেদবতী। বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভব। এই অনুভব লোকেই আজ পর্যন্ত ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে পারলেন না যেন তিনি!
-- বিউটিফুল লাগছে আপনাকে! আপনার বিউটিটা না অন্যরকম। কেমন স্নিগ্ধ অথচ উজ্জ্বল আলোর মতো!
-- থ্যাংক য়ু সান্ধ্যদীপ। তোমার নামটা ভারী চমৎকার। তুমি যেন কীসব বলছিলে-!
-- বলবো। যদি আপনার গল্প করার বন্ধু হতে পারি নিশ্চয়ই সবটুকু বলবো। না বলতে পারলে আবার জন্ম নিতে হবে-হাঃ হাঃ হাঃ উচ্চকিত হাসিতে উড়িয়ে দিল কথা সে। আজ শুধু এইটুকু জানুন অন্তত স্বপ্ন পূরণের পথে আমি। না হলে আপনারও তখন একটা ইচ্ছে হতো না। আর আমার বন্ধুও ডিসকয়ালিফায়েড হয়ে ফিরে আমাকে বলত না। পেপার কাটিং-টা ওই দেখিয়েছিল, ইনফ্যাক্ট। গালে হাত দিয়ে বিস্ময় চোখ নিয়ে দেখছেন বেদবতী। বললেন, ইন্টারেস্টিং!
-- কটা বাজে জানেন? নাইন থার্টি অলমোস্ট। আজ আমি যাব। আপনি ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়বেন। আই থিংক, আমি সিলেক্টেড। ভ্রু নাচিয়ে হাসলো সান্ধ্যদীপ।
ঠোঁট জুড়ে বঙ্কিম হাসির রেখা। বেদবতী ঘাড় নাড়লেন। গল্পে গল্পে সাড়ে নটা! কাল আসছো তো? তুমি কী করো জানা হলো না তো!
-- একটা ছোট্ট বিজনেস আছে। কারুর অধীনে কাজ করা পোষাবে না জানতাম, তাই। বলবো সব। আসবো ছটা নাগাদ। সানসেট দেখতে দেখতে চা খাব। বাই। টেক কেয়ার। দমকা বাতাসের মতো বেরিয়ে গেল সান্ধ্যদীপ। আর আশ্চর্যের অধিক হয়ে তাকিয়ে রইলেন বেদবতী।
এমনও হতে পারে! এমনও হয়? বুকের মধ্যে শান্ত অথচ উত্তাল ঝড় বেদবতীর। তাহলে কি সান্ধ্যদীপকেই খুঁজছিলেন তিনি? সান্ধ্যদীপের ছবিই মনের মধ্যে এঁকে রেখেছিলেন? বিভ্রান্ত বোধ করলেন। অস্থির লাগছে বড়। টেরেসে এসে পায়চারী করলেন খানিকক্ষণ। চেয়ারের ওপর পড়ে থাকা মোবাইলটা বাজছে দেখে হাতে নিতেই দেখলেন অচেনা নম্বর! সান্ধ্যদীপের ফোন...! হ্যালো? বলতেই ও প্রান্ত থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর, খেয়ে নিন। রাত করবেন না। আজ আপনার ঘুম আসবে না চট করে। কিন্তু ঘুমোতে হবে। বাই। গুডনাইট।
হালকা খাবারে এখন তার নিয়মিত অভ্যাস। চিকেন সুপ আর ব্রেড টোস্ট খেয়ে শুয়ে পড়লেন বেদবতী যেন কেউ তাকে নির্দেশ দিয়েছে, এবং তা পালন করতেই হবে তাকে। কত কতদিন বাদে এমন করে কেউ নির্দেশ করল!
বাতাসে উড়ে যাবে ঘর গেরস্থালী। দশতলার ঘর ঘুরে বাতাস লুটোপুটি খায়।
স্বপ্ন! স্বপ্ন আসলে কী? চিন্তা? এই যে ভেতর বাহিরে দুটি মন যা তার আয়ত্তাধীন নয়, তাদের বাস কোথায়? আবছায়া-ছায়া কতগুলো মুখ সরে সরে যাচ্ছে, আসছে একটা ঘোরের মধ্যে দেখতে পেলেন তিনি। আর মস্তিষ্ক জুড়ে কথারা ছোটাছুটি করছে। এই মুখ তার চেনা নয়। তাহলে তারা আসে কেন?
আচমকাই ঘুমের ঘোর কেটে গেল। সান্ধ্যদীপের বসে থাকা দেখতে পেলেন। প্রশ্ন! প্রশ্নের পর প্রশ্ন! অবাক করে দিয়েগেছে সে তাকে। তেরো বছরের বালকের মনে এতটাই রেখাপাত করেছিলেন তিনি! কেন এল সান্ধ্যদীপ? কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার পর থেকে পনেরো দিনের মধ্যে কত ছেলেমেয়ে যে এল! তাকে দেখবে ভাবতে পারেনি ছেলেমেয়েগুলো। তাই এতটাই নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল! প্রত্যেকের এক প্রশ্ন, আপনি! দিদি! আপনি গল্প করার জন্য বন্ধু-! তারপর আর কথা এগোতে পারেনি। কথায় কথা এগিযে নিয়ে যাবার মতো কারোকে পেলেনই না!
আজ মনের অগোচরেই খানিকটা বেশি সাজগোজ করে নিলেন বেদবতী। তারপর কী মনে হতে লিপিস্টিক মুছে দেখলেন। শুধুমাত্র ঘন করে আঁকা ভ্রু! আর তার নীচে অতল দুটো চোখ তার।
দীপা আজ এসেই জেনে নিয়েছে গল্প করার লোক মনোনীত হয়ে গছে। তাই আজ সান্ধ্য চায়ে সে হালকা জলখাবারও বানিয়েছে সে নিজেই।
সমস্ত গাছে গাছে, জলের ওপরে, পাহাড় চূড়োয় যখন সন্ধের আলো পড়ল তখনই এসে পড়ল সান্ধ্যদীপ। এ যেন আসা নয়। আগমন!
-- তারপর? বাহ! কিছু মনে না করলে বলি কী অপূর্ব লাগছে আপনাকে! জাম রঙের তাঁত! আপনার শরীরের রঙে সে মিশে গেছে! লিপস্টিক লাগিয়েও মুছে নিয়েছেন! কেন? অবশ্য লিপস্টিকের প্রয়োজন হয় না আপনার ভরাট ঠোঁট দুটোর।
কী অপ্রস্তুত! কী অপ্রস্তুত! কী দৃষ্টি ছেলেটার! লিপস্টিক মুছে দিয়েছেন তাও চোখ এড়ায়নি!
কথা বলতে বলতে ঘাড় এলিয়ে নির্ভার হয়ে বসলো সান্ধ্যদীপ। দৃষ্টি তার মুখের ওপর থেকে সরেনি।
-- কাল রাতে ঘুমোলেন?
-- সত্যি বলবো? না, অনেক চিন্তা মাথায়।
-- আপনার চিন্তা-ভাবনা তো সে অনেক উচ্চ মার্গের। তার নাগাল কি সাধারণ মানুষ পায়?
-- হয়তো। অথবা এতই সহজ যে সহজ কথাটিই মানুষ সবচেয়ে কম বোঝে!
-হয়তো!
চায়ের সরঞ্জাম, আর ফিশফ্রাই দিয়ে গেল দীপা। এক ঝলক ভালো করে পরিমাপ করল যে সান্ধ্যদীপকে সে, তা নজর এড়ায়নি বেদবতীর।
আজ যেন কথা বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না বেদবতী। চা প্রস্তুত করতে করতে সান্ধ্যদীপই বললো, খুব প্রিয়জন কারোকে মনে হলে অনেক সময় আমরা কথা খুঁজে পাই না। কী আশ্চর্য্য! ছেলেটা টেলিপ্যাথি জানে না কি? হতবাক বেদবতী।
চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে সান্ধ্যদীপ বললো, পৃথিবীতে কত অজানা ঘটে যায়! ঘটনা! তার এক্সপ্ল্যানেশন হয় না। এই যে সে ছেলেটার স্বপ্ন ছিল একদিন সে আপনার কাছাকাছি আসবে, এলো তো? আপনার মতো মানুষ গল্প করার লোক খুঁজচেন ভাবা যায়? যার একটা আঙুলের চুটকিতে হাজার নারী-পুরুষ অস্থির হয়ে যায়, সেই মানুষ খুঁজছে গল্প করার লোক! নাহলে আমার স্বপ্ন পূরণ হত কী করে?
অতলস্পর্শী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন বেদবতী।
-- তোমার স্ত্রী জানে যে, তুমি গল্প করতে আসছ?
-- না। মা জানে। মাযের অবস্থা জাস্ট তাকিয়ে দেখা যায় না। হা-হা-হা-। আমার বউ আমি কী করি, না করি, এসব নিয়ে বদার করে না জাস্ট।
-- ভালো তো।
-- ভালো কী না জানি না! ভালো বললেন কেন?
-- স্পেস দিচ্ছে। বেশিরভাগ সম্পর্কে স্পেস থাকে না বলে অশান্তি হয়।
-- আসলে ঠিক কতটা স্পেশ থাকলে সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত টিকে যায় তার পরিমাপ কে করবে বলুন?
-- আর যু হ্যাপি?
-- ইয়েস। পারমিতাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। সম্ভবত ওরও নেই।
-- এক্সট্রা ম্যারিট্যাল অ্যাফেযার সম্বন্ধে তোমার মতামত কী?
-- ম্যারেজ আর ভালোবাসা এক নয়। আপনি তো ভালোবাসা নিয়ে অনেক লিখেছেন। আপনিই বলুন না? এনি ডেফিনেশন?
-- বিয়ে পরবর্তী সময়ে কখনো আর কারোর প্রেমে পড়েছ?
-- না। আসলে সেই জায়গাটা একজন দখল করে আছে।
-- ওহ! তাহলে তাকে বিয়ে করলে না কেন?
-- তাকে বিযে করা যায় না বলে। সুনীলের নীরাকে কি বিয়ে করা যায়? সে তো মন ছুঁয়ে থেকেও অধরা! আমার রানিও অধরা!
-- ওহ! আসলে কী জানো এই বিষয়টাই জটিল। অধরা বস্তু ধরা দিলেই যেন তার সবখানি দেখা জানা হয়ে গেল। আর জেনে যাওয়া বিষয়ের ওপর আর কতটাই বা অনুরাগ থাকতে পারে?
-- তবে দখল করার পরে অধিকার বোধ চলে আসে একটা।
-- সেটা মাপের মধ্যে থাকলে পজিটিভ, নাহলে সর্বনাশ। এক্সট্রা ম্যারিট্যাল শব্দটার মধ্যেই কিন্তু অনেক কিছু রহস্য খেয়াল করে দেখো। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক! সম্পর্ক হলেই কি বিয়ে হয় না করা যায়? তার মানে বিয়ে গণ্ডীর মধ্যে এসেই সম্পর্ক গৃহবন্দী?
-- রাইট। আপনি কী মনে করেন?
-- আমার তো এ নিয়ে কত কাব্যনাটক! ব্যক্তিগতভাবে আমি এমনটা পছন্দ করিনি বলেই বারবার বিয়ে করেছি।
-- আমি আপনার কতটা গভীরে পৌছে গেলাম, দেখলেন?
-- তা কী অত সহজ সান্ধ্যপ্রদীপ?
-- নয় বলছেন? তাহলে আমি যে তেরো বছর বয়স থেকে আপনার মধ্যে যাপন করতে করতে আজকের আমি হয়ে উঠলাম! আপনার আর আমার মধ্যে দূরত্ব কোনোদিনই ছিল না। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে কেমন সাহিত্যের ভাষায় কথা বলছি দেখছেন? সে কি এমনি? হা-হা-হা-হা।
চায়ের পেয়ালা শেষ হয়ে গেছে, তলানীটুকু নিঙড়ে পান করল সান্ধ্যপ্রদীপ। তারপর বললো, আমার প্রথম কবিতা লেখা আপনাকে দেখার পর। আমার জীবনবোধ মানে তেরো বছর বয়সের সদ্য কিশোর তার চারপাশের বন্ধুদের তুলনায় অনেক পরিণত চিন্তার হয়ে গেল রাতারাতি। আমার প্রথম ম্যাস্টারবেসন আপনাকে কল্পনা করে। স্যরি। খারাপ ভাববেন না। আপনাকে অপমান করছি না। রিয়ালিটিটুকুই বলে ফেললাম।
সপাটে ধাক্কা খেলেন বেদবতী। এত স্পষ্ট সত্য বলতে কোথাও আটকালো না ছেলেটির! স্পষ্ট ও সত্য বলার জন্য বিখ্যাত তিনি। সাহসী বলে খ্যাত। তবু জীবনে সব সত্য কি ধারণ করা যায়? আশ্চর্য লাগছে। চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না তিনি।
-- আপনার অস্বস্তি হচ্ছে? আনইজি ফিল করছেন? আপনার কাছ থেকে তো এটা এক্সপেকটেড ছিল না। আপনি আমার কাছে পরিচিত ছকের বাইরে একজন মানুষ। তেরো বছরের কিশোর যে ম্যাস্টরবেট করে তা আপনি জানেন। অ্যাবনর্মাল কিছু নয়। আর সেটা কারোকে ইমাজিন করেই করে। আমি পাপ ভাবতাম। অন্যায় ভাবতাম। চাপা স্বভাবের ছিলাম তাই। লিভ ইট।
-- লিভ ইট কেন? নিজের কণ্ঠস্বর যেন নিজের কাছে অপরিচিত মনে হল বেদবতীর।
-- কারণ আপনি সত্যটা গ্রহণ করতে পারছেন না। আপনি অনেক সাহসী লেখা লিখলেও ব্যক্তিগত জীবনকে সম্ভ্রম দিতে চেয়েছেন। শুধু, আজ বুঝলাম। মানুষ এত দ্বিচারণ করে কেন বেদবতী?
মাথা ঝুঁকে আসছে বেদবতীর। নিজেকে পাঠ করার পরেও সম্পূর্ণ পাঠ করা হয়নি বুঝতে পারছেন।
-- যেদিন আপনাকে প্রথম দেখলাম সেই দিনটা যে কী ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়ে উঠেছিল আপনি কল্পনা করতে পারবেন না। সারারাত ঘুম নেই! শুধু আপনার মুখ! আপনার কথাবলা পশ্চার আমার মাথার ভেতরে! আমার স্কুলেও অনেক মেয়ে খুবই সুন্দরী। কিন্তু আপনি তো ভিসুভিয়াস! আপনার মুখ, শরীর আমাকে উত্তেজিত করছিল। ২৬ মার্চ; দিনটাও ভুলিনি দেখুন, আমার মন থকে পাপবোধ, অন্যায়বোধ একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল সুন্দরের কাছে। ওই দিনের আগে আমি ম্যাস্টরবেট করতাম না। সেলফ সিক্রেশন হয়ে যেত। এত সুন্দর একটা অনুভতি আপনি আমাকে গিফট করেছিলেন তার জন্য টিল ডেথ আমি কৃতজ্ঞ থাকবো। দ্যাট ডে আই বিকাম আ ম্যান। আমি আপনাকে আগলে রাখতাম! আচমকাই ইষৎ ডান দিকে ঘুরে পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারার দিকে তাকাল সে। কয়েকটি নিমেষ মাত্র! ফিরে তাকাল বেদবতীর দিকে, বললো, ধ্রুবতারাটা দেখছেন? ঠিক ওইরকম সত্যি! ধ্রুব সত্যি! ভাবছেন তো, বোকা বোকা ইডিয়টিক নাটক করছি?
-- মনে করছি না। আমি আসলে...। কথা হারিয়ে ফেললেন বেদবতী। এত সৎ সাহসী স্বীকারোক্তির সামনে তিনি এই প্রথম! অথচ জীবনকে তছনছ করে দেখার অভিজ্ঞতা তার জীবন জুড়ে!
-- বেদবতী! জানেন আপনাকে আমি আমার জগতে অন্য একটা নামে ডাকি সেই দিন থেকে! শুকতারা!
সমুদ্র মন্থন হচ্ছে যেন সমস্ত শরীর ঘুরে বেদবতীর। উথালপাথাল! এই মন্থন থেকে কী উঠে আসবে তিনি জানেন না! গরল অথবা অমৃত! নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছেন। তবু সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে!
-- তোমার লভ ম্যারেজ?
-- সেমি বলতে পারেন। মায়ের পছন্দ করা ছাত্রী, আমারও ভালো লেগে গেল। মায়ের স্কুলে পড়ত।
-- কী নাম?
-- দমযন্তী গর্গ। ওই পর্ব আমাদের কথায় আসবে না। সি ইজ আ পার্ট অব মাই লাইফ ওনলি। যেমন আমার দুটো হাত আছে সেইরকম। গ্যাংরিন না হলে কাটা যাবে না।
-- সুন্দর কথা বলো তুমি।
-- আপনার থেকে শেখা, ম্যাম! আপনার সমস্ত অনুষ্ঠানে আমি যেতাম এবং যাই। টেলিভিশনে দেখি। সব লেখা পড়ি।
-- থ্যাংকস।
উত্তেজিত হয়ে উঠল সান্ধ্যপ্রদীপ। না, নো-। থ্যাংকস দিয়ে ডিসটেন্স বাড়াবেন না প্লিজ। আপনি আমার হাত-পা বডি নন। আপনি আমার দুর্লভ স্বপ্ন যাকে রোজ জন্ম দিই আমি। নো, আমি নাটক করছি না। নাটকীয় লাগছে অতি মাত্রায় আমি জানি।
-- এত ভালোবাসা! এটা ইনফ্যাচুয়েশন! দেয়ার ইজ নো লভ অ্যাট অল ইন দিজ ওয়র্ল্ড! ওই যে স্বপ্ন বললে...! দূরত্ব আর অজানার একটা আকর্ষণ চিরন্তন। কাছে এলেই তা আগ্রহ হারায় দীপ।
-- এত বছর ধরে যদি একটা ইনফ্যাচুয়েশনকেই ভালোবাসতে পারি তাহলে ওটাই ভালোবাসা, শুকতারা।
-- আজ যদি বলি রাতটা থেকে যাও, পারবে?
-- পারবো। মাকে একটা কল করে শুধু জানিয়ে দেব।
-- বউকে?
-- ও এইসব ব্যাপারে অত বদার করে না। মা জানিয়ে দেবে। ও হায়ার ডিগ্রির জন্য সারাদিন বড়বড় মেডিকেল য়ুনিভার্সিটিলোতে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।
মাথা নাড়লেন বেদবতী, ও। তোমারও তো আশ্চর্য লেগেছিল যখন জানলে আমিই গল্প করার সঙ্গী খুঁজছি। আসলে জীবনে এত কিছু দেখা হয়ে যাবার পরে ও মনে হচ্ছিল কিছু বাকি আছে। এখনো হয়নি এগোনো! ঠোঁটের রেখায় রেখায় অদ্ভুত হাসির ছায়া বেদবতীর। দৃষ্টি গভীর অতলান্ত! আমার যুদ্ধের গল্পগুলো জানো? আমাকে সৃষ্টিকর্তা একজন সেনানী করে পাঠিয়েছেন। ব্যাটল কিন্তুই যার ঘরবাড়ি।
-- আমি কিচু জানি। হাওয়ায় ভাসে।
-- তার অর্ধেক মিথ্যে। আমাকে সিংহাসন থেকে টেনে নামানোর প্রয়াস।
-- আমি বুঝি।
-- গল্প করার সঙ্গী খুঁজছিলাম, তার গল্প শুনবো বলে। চেনা পরিচিত জগৎ থেকে নির্বাসন নইয়েছি। আমি মানুষের সঙ্গ চেয়েছি অথচ পেয়েছি মুখোশের সঙ্গ। আমার কথা বলবো বলে কারোকে খুঁজিনি। কিন্তু তোমার মতো আশ্চর্য মানুষের দেখা পাব ভাবিনি। যখন বেঁচে থাকার জন্য কারণগুলো মরে যায় অথবা হয়তো আর কারণগুলোই নেই হয়ে যায়, তখন মানুষ জীবন্মৃত হয়ে যায়! ডিপ্রেশন আসে। সুইসাইড করে। কোথাও পালাতে চায় অথচ কোথায় পালাবে? আমার বেঁচে থাকার জন্য কারণগুলো নেই হয়ে আসছিল। উপলব্ধি করছিলাম। অথচ মৃত্যু আমার কাম্য নয়। নিজেকে হতাশাগ্রস্থ মানুষ ভাবতেই পারি না!
-- আমরা কি আবার একবার গলা ভেজাতে পারি? চা চাই চা চাই? করচে কেউ! হাসলো সান্ধ্যপ্রদীপ।
-- দীপা চলে গেছে। তাহলে তোমাকেই-। এই যে দীপা, ও নিজেও ভালোবাসা অ-ভালোবাসার খোঁজে আছে জেনে যে অবাক হয়েছি আমি। স্বামীকে ভালোবাসে কী না বুঝতে পারছে না! কী জ্বালাতন বলো? কজন এভাবে ভাবতে পারে?
-- বাহ!
-- যতদিন না ও শিওর হচ্ছে এই ব্যাপারে বাচ্চা নেবে না। কী স্বাধীন স্বাভাবিক অথচ সামাজিকভাবে অস্বাভাবিক চিন্তা! তার মানে ওর জন্যেও নির্ধারিত আছে ব্যাটল্ ফিল্ড! নিজেকে চিনতে পারা চরম দুঃখ বয়ে আনে, জানবে।
-- জানি। আজ অবধি পেয়ে আসছি তাই। আপনাকে যখন নগ্ন করে দেখি, উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে সান্ধ্যপ্রদীপের, তখন বিষাদমাখা এক আনন্দ পাই। একদিকে পুলকিত অন্যদিকে বিষাদ! অর্গাজমের মতো! সেই তেরো বছর বয়স থেকে পেয়ে আসচি এই দুঃখ আর আনন্দ! নিজেকে চিনেছি। দমইয়ন্তীর সঙ্গে ইন্টারকোর্স হয় কিন্তু সঙ্গম হয় না!ইজাকুলেশন হয়, অর্গাজম হয় না।
লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন বেদবতী সাময়িক। এত সত্য যেন সহ্য করা যায় না। বললেন, চা খাবে বললে? বাঙালিদের এই এক দোষ সব খাই আমরা। চায়ে তো পিতে হ্যায়, হ্যায় না? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেললেন।
-- আপনাকে যত দেখি ততো অবাক হই, জানেন? তুমি আছো জেনে আমি অন্ধকার ভালো ভেবে যে অতীত আর যেই শীত ক্লান্তিহীন কাটায়েছিলাম,
তাই শুধু কাটায়েছি!
কাটায়ে জেনেছি এই-ই শূন্যতা, তবু হৃদয়ে কাচে ছিলো অন্য-কোনো নাম।
বলুন তো কে?
-- জীবনানন্দ ছাড়া জীবনকে আর এভাবে দেখেছে কে?
-- জল গরম করে আনি।
এই নিয়ে তৃতীয় পেয়ালা চা। মাথার ওপরে ভেসে যাচ্ছে মেঘ আর ক্ষীণ জ্যোৎস্না। অর্ডার দিয়ে আনানো খাবারগুলো চেয়ে আছে।
-- কথা বলার মানুষ খুঁজেছি যে কত! তিন তিনবার বিয়ে করলাম। শুধু কথা বলার জন্য বুঝলে? অতঃপর বুঝলাম ভাষা, কথা আসলে কিছুই নয়। আমরা কথা বলি এক মানুষ তার অর্থ করে আরেক! তুমি কি জানো আমরা কথা না বলেও কমিউনিকেট করতে পারি শুধুমাত্র ভাইব্রেশন দিয়ে
-- আমি জানি। আপনার সঙ্গে আমার কথা হয় এইভাবেই।
-- আর আমি গাছপালা পশুপাখিদের সে কথা বলি এইভাবে।
-- আপনার বিয়ে ভাঙার খবর জানার পর ডিপ্রেশন আসতো আমার মধ্যে! আপনাকে কেউ কষ্ট দিচ্ছে আমি সহ্য করতে পারি না!
-- সম্পর্ক যে আসলে কী! যাদের ভালোবেসে বিয়ে করলাম দেখলাম ভালোবাসাই নেই! ভালোবাসা আসলে যে কী বস্তু!
-- মাথায় শাড়ির আঁচলটা জড়িয়ে নিন। হিম পড়বে। আজ তো সারারাত গল্প করব। কালকের থেকে হয়তো আপনি আর আমার সে কথা নাও বলতে পারেন? মস্তিষ্কের কোনো এক গভীর অলিন্দে ঠিক এই চিন্তাটাই যে এসেছিল এক লহমার জন্য! সান্ধ্যপ্রদীপ তা জেনে গেল কী করে? ভয়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠল বুকের ভেতরে। তিনি বললেন, কেন বললে এমন কথা?
-- এতলো বছর ধরে আমি কিন্তু আপনার সেই যাপন করছি, ভুলে যাচ্ছেন! তেরো বছরের নিষ্পাপ কিশোর যাকে একমাত্র নিজের বলে মনে করে তার অজানা কিছু থাকে কি?
-- তুমি আমাকে পেতে চাও না? কণ্ঠস্বর ভেঙে চুরে গেল বেদবতীর। এ কথা তো তার নিজের কথা নয়! এই কথা বার বার শোনা কথা। পেতে চাওয়া! শেষ পর্যন্ত কী পাওয়া যায়?
কাবাবের একটা টুকরো জিভে ছুঁয়ে দিয়েছে তখন সান্ধ্যপ্রদীপ। উত্তর দিতে মুহূর্ত নষ্ট হলো না, বললো, আমার চেয়ে বেশি তোমাকে কে পেয়েছে? হে ম্যাম! পেতে চাওযা মানে কী? বিছানায় ন্যাংটো করে ইন্টারকোর্স করা? তারপর? শেষ? হুঁ? তারপর-?
সমুদ্র মন্থন হে। বেদবতী বললেন, তারপর সমস্ত বিছানা ও রাত্রি জুড়ে পরস্পর থেকে নিষ্ঠুর বিচ্ছিন্ন হওয়া এক বাস্তব যা দিনের পর দিন আমাদের দূরত্ব বাড়ায় শুধু! বাড়িযে চলে!
-- তাহলে কী পাওয়া হল?
-- শূন্যতা!
-- অথচ আমার মধ্যে শূন্যতা নেই! সেই তেরো বছর বয়স থেকেই পূর্ণ! জানতাম, একদিন তোমার মুখোমুখি হয়ে এই সত্যটা বলতে হবে। শুধু জানতাম না, কবে হবে। কীভাবে হবে? তোমাকে আমি কীভাবে রক্তমাংস আর স্বপ্ন দিযে তছনছ করে ভাঙি, গড়ি, তোমার মধ্যে আমার আমিত্ব ভেসে যায়, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
নাগরিক কোলাহল কখন যেন নিদ্রিত! রাতের গভীরতার মধ্যে ডুবে গেছে পৃথিবী! রাতচরা পাখিরা আকাশ জুড়ে। চাঁদের আলো ঝিম ধরে গেছে! সমস্ত টেরেস জুড়ে শুধু শরীরী নিঃশ্বাস!
পোশাকের আবরণ উন্মুক্ত হতে চাইছে শরীর। এখনো প্রবল শরীরবোধ আছে শরীরের প্রতিটি কোষে তার উত্তুঙ্গ গান! অথচ শরীর তো তার আর জাগতো না বহু বছর! যে সকল কারণের জন্য বেঁচে থাকা যায় তার অন্যতম ছিল শরীর! শরীর তো তার মৃতই কবে!
শরীরের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা অন্য মানুষ বলে উঠল, বেঁচে থাকার জন্য অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে আজকের এই রাত ইম্পরট্যান্ট।
বেশ কিছুটা সময নির্বাক রইল সময়! আকাশের দিকে চেয়ে শূন্য দৃষ্টি বেদবতী। টেরেসে পায়চারী করছে সান্ধ্যপ্রদীপ। মহাকাশের নীচে দুজন মানব-মানবী সম্পর্কের রহস্য খুঁজছে যে যার নিজের মতো করে।
শরীরের উত্তেজনা থেমে গেছে বেদবতীর। তাহলে এই কি ভালোবাসা? যেন একটি গভীর গাঢ় সম-স্নান সেরে উঠলেন এই মাহেন্দ্রক্ষণে, তেমনই অনুভব প্রবল হল। মনে হল, এমন পরিপূর্ণতা কি কোনোদিনও অনুভব করেছেন তিনি আগে কখনোও? কী এক অস্থিরতা ক্রমাগত ছুটিয়ে বেড়িয়েছে তাকে! অনবরত!
-- সুখ কী প্রদীপ? তোমার থেকে জানতে চাইছি, বলো। পায়চারী করা থামিয়ে বেদবতীর চেয়ারের পিছনে এসে দাঁড়াল সান্ধ্যপ্রদীপ। দুটো হাত দিয়ে চেয়ার ধরে এক মুহূর্ত না ভেবে বললো, গভীর মধ্যরাতে দুই নারী পুরুষ কেউ কারোকে না ছুঁযে শারীরিকভাবে স্পর্শ না করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারা। তারা জানে তারা দুজনে দুজনকে গভীরভাবে ছুঁয়ে আছে, সেই অনন্ত সময় ধরে। তাদের হারানোর কিছু নেই! ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছেন বেদবতী, হয়তো! হয়তো! হয়তো না, এটাই ঠিক।
-- আপনার মতে সুখ কী?
-- হয়তো বয়সটা তেরো ছিল-! সময়কে পেরিয়ে যেতে পারলে হয়তো দেখবো আসলে বয়সের ক্রমাংক শূন্য! ভালোবাসা সময় উত্তীর্ণ এক অনুভব, আজ বুঝতে পারছি। যখন আমি প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছিলাম, ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল ভালোবাসা, বিশ্বাস তলানীতে এসে ঠেকেছিল, শুধু মনে হত এর চেয়ে আমার মৃত্যু ভালো? কতবার আত্মহত্যা ইশারা করেছে জানো না! আত্মহত্যার পর আমার মৃতদেহটা দেখতে পেতাম। তারপরেও বেঁচে থাকার কারণ খুঁজেছি! আবার গান লিখেছি, কবিতা, নাটক, গল্প, কাঠ খোদাই করে মূর্তি গড়েছি আর বেঁচে থেকেছি। আর মনে হয়েছে, কেন বেঁচে আছি? হ্যাঁ? কেন? কেউ তো আমায় ভালোবাসে না! তাহলে? মুখ কী কোনোদিনও বুঝিনি! অথচ তখন একজন আমাকে গভীরভাবে ভালোবাসছে একা একাই! কী আশ্চর্য! একটু সময় নিলেন বেদবতী, চেয়ার ছেড়ে উঠে টেরেসে সযত্নে মালতি ফুলগাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন। কামিনী ফুটেছে গাছ জুড়ে। তার গাছে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ওরা জানে সব। ওদের সব বলতাম। মেয়েদের অর্গাজম দেরীতে হয়, জানো নিশ্চই? আমার আমার কোনেদিনও হয়নি! অর্গাজম কী আমি জানিই না! শুনেছি দেরীতে হয়। সময় লাগে। দারুণ একটা ফুলফিলমেন্টের অনুভব হয় সারা শরীর জুড়ে! স্বর্গীয় অনুভতি! কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন বেদবতী। এক ফালি চাঁদটা সম্পূর্ণ ঘুমন্ত এখন। যতদূর দেখা যায় গাঢ় তন্দ্রাছন্ন প্রকৃতি। নিজের চেয়ারে এসে পা মুড়ে বসলেন, বললেন, আজ আমার অর্গাজমের ফিলিংস হে, দীপ। জাস্ট আশ্চর্য একটা স্বর্গীয় আনন্দে মরে যেতে ইছে করছে। এটাই তো অর্গাজমের ফিলিংস! তাই, না? এটাই তো সুখ! এটাই তো সুখ। আহ! কী আনন্দ যে হচ্ছে আমার! কী আনন্দ!
-- এটাই সুখ। আমারও হয়। আমি এতটাই সম্পূর্ণভাবে তোমাতে... খ্যয়র ছোড়ো, ও সবকুছ কহনে কী বাত হি নহী!
-- একটা অর্গাজমের পর আর কিছু পাবার থাকে?
না বোধ হয়! শুধু অনন্ত সুখে ভেসে যাওয়া ছাড়া! তোমার স্ত্রী... ও কি সুখী?
-- সেখানেও তো তুমি। আমি তো তোমাকে ছাড়া আর কারোকে কিছু করিনি! আমাকে খারাপ ভাবলে ভাবতে পারো। ওর শরীরে আমি তো তোমাকেই পেয়ছি!
সেই কিশোরীবেলার মতো আশ্চর্য চোখে তাকালেন বেদবতী। যেন এমনটাও হয়? হয়?
উত্তেজিত হয়ে পায়চারী করলো কিছুক্ষণ সান্ধ্যপ্রদীপ। পায়চারী করতে করতেই বললো, তুমি কি আমাকে আসতে বারণ করে দেবে এরপর? দিলেও অসুবিধা নেই।
খুব ধীরে মাথা নাড়ছেন বেদবতী, না, না তো।
-- বললেন না?
-- আবার আপনি আজ্ঞে কেন?
-- ঠিক আছে। বললে না তো?
-- না। তবে কী জানো? আমি নিজেকে বড় একটা চিনি না বোধ হয়। একা থাকতে থাকতে, থাকতে থাকতে একাকীত্বই আমার প্রেম! আজ থেকে তুমি এলে। একাকীত্বর সে একটা সংঘাত হবে তোমার উপস্থিতির। তবে তুমি আসবে। আমি ডাকি আর না ডাকি তুমি তো সেই কোন্ এক অজানা কাল থেকে আমাকে সে নিয়ে বেড়াচ্ছ! আমরা তো এক পক্ষকাল জোছনার জন্য অপেক্ষা করি। তারপর সে আসে। আমরা কী আদরে বরণ করি তাকে! গায়ে মাখি। মুখে মাখি। জোছনার শরীরে মিশে যাই! সেও এক অর্গাজম বটে! তুমি তেমনই এসো। মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেও তুমি এসো। চলে যেওনা। শিশুর মতো হাসলেন বেদবতী। বললেন, কাল আরেকটা অন্য গল্প নিয়ে আসবে?
বেদবতীঃ চোখের ওপর পূর্ণ দৃষ্টিপাত করলো সান্ধ্যপ্রদীপ। নির্মিমেস তাকিয়ে খুব জোরে জোরে মাথ নাড়ছে। বললো, আরো সত্যি গল্প নিয়ে আসব। লভ যু। তোমার পায়ের তলায় বসে তোমার একটা ছবি আঁকবো কাল। ছবি আঁকতেও তোমার মুখ প্রেরণা ছিল! তোমার মুখ আঁকতে আঁকতে বিজ্ঞানের ছেলেটা ছবি আঁকতে ভালোবেসেছিল! এটাও সত্যি গল্প।
গ ল্প ৪
ছায়াময়ী
স্যার বললেন, ‘গাছতো শ্যাষ। যা দু চার খানা আছে, তাও মরা- আধ মরা’।
আমি ঘাড়ের রগ ত্যাড়া করে বললাম,-‘কিন্তু আমি তো ৫ টাকাই দিছি। সবাই যদি ৫ টাকায় ৩টা গাছ পায়, আমি কেন পাবো না?’
-‘তুই পাবি না তা তো বলা হয় নাই। পাবি, কিন্তু মোটা তাজা ভালো গাছগুলা আগে যারা আসছিলো, তারা নিয়া গেছে। এখন এইগুলা আছে, নিলে এই-ই নিতে হবে’।
আমি করুণ চোখে তাকিয়ে আছি। স্কুলের বারান্দায় ক’খানা রেইনট্রি আর কাঁঠাল গাছের চারা পড়ে আছে। এগুলো মোটামুটি চলে। কিন্তু আমার আগ্রহ লেবু গাছ নিয়ে। এখানে একটা মাত্র লেবু গাছের চারা আছে, কিন্তু তার মৃতপ্রায় অবস্থা। একখানা ডাল ভাঙ্গা। পাতাগুলোও শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাঁচবে না নিশ্চিত। কিংবা এখনই মরে গেছে।
আমার কপাল বরাবরই এমন। অলওয়েজ দ্যা লাস্ট ম্যান। সবাই চেটেপুটে খেয়ে যাওয়ার পরে আমার ভাগ্যে থাকে কাঁটাঘুঁটো। আমি তখন ক্লাস নাইন বা টেন-এ পড়ি। গভর্নমেন্ট থেকে প্রতি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য গাছের চারা দেয়া হয়েছে। ৫ টাকায় ৩টি চারা। সবাইকে নিতে হবে। সমস্যা হচ্ছে আমি দেরী করে এসেছি, আমার ভাগ্যে তাই এই মরা-আধমরা। আমি শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার বললেন, ‘এক কাজ কর, তুই ৩টার বদলে ৪টা চারা নিয়া যা। দুইটা রেইনট্রি, দুইটা কাঁঠাল’।
তিনি স্কুলের দপ্তরী জয়নালকে বললেন আমাকে চারটা গাছের চারা দিতে। জয়নাল এসে প্রথমে যেটা করলো, সেটা হলো, মরা কিংবা আধমরা লেবু গাছটা ছুড়ে ফেলে দিল মাঠের এককোনায়। সেখানে দঙ্গল হয়ে আছে আরও অনেক ভাঙ্গা এবং মরা গাছের চারা। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার লেবু গাছ-ই চাই। স্যার আর জয়নাল কে অবাক করে দিয়ে আমি সেই দঙ্গল থেকে মুমূর্ষু লেবু গাছটা তুলে নিলাম।
স্যারকে বললাম, ‘আমাকে আর একটা কাঁঠাল আর একটা রেইনট্রি দেন’।
স্যার অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বললেন না। আমি এক হাতে লেবু গাছের মৃতপ্রায় চারা আর অন্যহাতে রেইনট্রি আর কাঁঠাল চারা নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। পেছনে জয়নালের কোঁচকানো কপাল, আর স্যারের বিস্মিত দৃষ্টি ঠিক টের পাচ্ছি।
২
লেবু গাছটা লাগালাম রান্নাঘরের পাশে।
বাকী দুখানা পুকুর পাড়ে। তারপর দিব্যি ভুলে গেলাম। আমার এসএসসি পরীক্ষা হলো, রেজাল্ট দিল, কলেজে ভর্তি হলাম। হোস্টেলে থাকি। মাস-দু’মাসে দিন কয়েকের জন্য একবার বাড়ী যাওয়া হয়। গাছ লাগানোর প্রায় বছর চার-পাঁচ কেটে গেছে। পুকুর পাড়ে রেইনট্রি গাছটি দিব্যি লকলক করে বেড়ে উঠেছে। দেখলে মনেই হয় না, এটা আমি লাগিয়েছি! কাঁঠাল গাছটার কোন খবর নেই। কিন্তু চমকে দিয়েছে সেই মুমূর্ষু লেবুর চারা। রান্নাঘরের কোনায় সে দিব্যি গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। সবুজ কচকচে পাতায় বাড়ন্ত যৌবতী শরীর। সমস্যা হচ্ছে গায়ে গতরে এমন দস্যি মেয়ের মতন বেড়ে উঠলেও সে তার অত বড় ঝাঁকড়া গতরে একখানা লেবুও ধরতে পারে নি। এই নিয়ে আম্মার বিস্তর গালমন্দ। চোখের সামনে লেবু গাছ দেখলেই আপন মনে বকবক, ‘এত বড় শইলডা হইয়া কি লাভ, লেমু গাছ দিয়া কি আর তক্তা হয়? হেই তক্তা দিয়া কি পালঙ্ক হইব? এতো বড় গাছ রাইখা কি লাভ’?
ওই পর্যন্তই। আম্মা কিন্তু লেবু গাছ কাটেন না। লেবু গাছ আরও দীপ্তি নিয়ে, জায়গা নিয়ে দিনে দিনে বেড়ে ওঠে। তার ছায়ায় ঢেকে যায় অর্ধেক উঠান। সেবার বর্ষায় ফসল শুকানোর সুবিধার্থে রান্না ঘরটা সরাতে হলো। কারণ, এতে উঠান খানিকটা বড় হবে। ফসল রাখতে এবং শুকাতে তখন পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাবে। সমস্যা হচ্ছে লেবু গাছ। রান্নাঘর সরাতে উঠান যখন বড় হলো, লেবু গাছটা তখন যেন পড়ে গেলো উঠানের মাঝখানে। এবং তার ছায়ায় যেহেতু অর্ধেকটা উঠান ঢেকে থাকে, সেহেতু এবার তার চূড়ান্ত অপ্রয়োজনীয়তা প্রকট হয়ে উঠলো। আমার তখন সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। বাড়িতে এসেছি সবাইকে বলে যেতে।
খেতে বসে আম্মা হঠাৎ বললেন, ‘লেমু গাছটাতো আর রাখন যাইতাছে না রে। দুই চাইরডা লেমু হইলেও না হয় কথা আছিল। তারওপর পুরা উঠান দখল কইরা আছে’।
আমার তখন পরীক্ষা নিয়ে বিস্তর টেনশন। আমি ভাত মুখে গমগম করে আম্মাকে বললাম, ‘কাইটটা ফালাও। লেমু না হইলে অত্তবড় গাছ রাইখ্যা কি লাভ?’
পরদিন ভোরে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরুবো। খুব ভোরে পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে উঠানের উপর দিয়ে ঘরে ফিরছে। সূর্যটা কেবল তেরছা ভাবে জেগে উঠছে। ভোরের সেই সোনালী আলোয় আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লেবু গাছটার সারা শরীরে যেন ঝলমলে তারার মেলা বসেছে। কচি সবুজ পাতাগুলোয় সূর্যের সেই তেরছা আলো ঠিকরে পড়ছে। আমি সম্মোহিতের মতন তাকিয়ে রইলাম। এই সৌন্দর্য এই পৃথিবীর না, অন্য কোন পৃথিবীর। অন্য কোন গ্রহের। অপার্থিব।
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আম্মাকে বললাম, ‘গাছটা থাকুক। কাইটেন না’।
আমি হোস্টেলের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরুলাম। আমি জানি, আম্মা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেদিনের মতো। সেইদিনের জয়নাল দপ্তরী আর স্যারের মত।
আম্মার চোখেও বিস্মিত দৃষ্টি।
৩
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি।
আব্বা খুব ছোট্ট একটা চাকুরি করেন। তার পক্ষে একা সংসার, আমার ছোট দুই ভাই-বোনের পড়াশোনা এবং আমার খরচ চালানো দুরূহ ব্যাপার। আমি তাই টিউশন করে চেষ্টা করি নিজের খরচ চালানোর। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল দিচ্ছি। এই সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত। আব্বা স্ট্রোক করলেন। তার ডানপাশটা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা করানোর মতোও অবস্থা আমাদের নেই। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। তার চাকুরী নেই। আমাদের তখন অতল সমুদ্রে অকুল পাথার অবস্থা। আমি নানাভাবে চেষ্টা করছি টাকা উপার্জনের। ক্লাস পরীক্ষার খেয়াল নেই। তারপরও নিজের খরচ জুগিয়ে বাড়তি যে টাকাগুলো বাড়িতে পাঠাই তাতে তেমন কিছুই হয় না। আম্মাও নানাভাবে চেষ্টা করে চলেন।
শুরু হয় টিকে থাকার এক অদ্ভুত লড়াই।
সেবার বর্ষায় বাড়িতে গেছি। খুব ভোরে লঞ্চ থেকে নেমে বাড়ির উঠোনে পা রাখলাম। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সেই তেড়ছা সূর্যের সোনালী আলো। সেই আলোয় আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম, বিশাল শরীরের লেবুগাছটার শরীর জুড়ে থিকথিক করছে অসংখ্য লেবু। আমাদের গ্রামের ভাষায় বলে ‘কাগজি লেবু’।
লেবুর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জাত। সেই লেবুতে ছেয়ে আছে গাছের প্রতিটি অংশ। কি অপার্থিব এক গন্ধে ম’ ম’ করছে ভোরের শীতল বাতাস। আম্মা নামাজের সাদা শাড়ী পরা, তিনি আমার হাতের ব্যাগটা নিতে নিতে বললেন, ‘আল্লাহর কি কেরামতি, দেখছ বাজান? যেই লেমু গাছে এতো বছর একটা দানা পর্যন্ত হয় নাই, সেই গাছে কয়দিন আগে থেইকা কি কুদরতি ফল ফলছে। বেইচ্যাও কুলাইতে পারি না। পাশের বাড়ির হাচানরে দিয়া হাটে পাঠাই, সে প্রতি হাটে চাইর-পাঁচশ টাকার লেমু বেইচ্যা দেয়’।
আম্মার কথা আমার কানে ঢোকে না। আমার হতভম্ব ভাব কাটে না। আমি সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকি।
আমাদের সেই ভয়ঙ্কর দুর্দিনে সেই মুমূর্ষু লেবুর চারাটি দু হাত বাড়িয়ে বুক পেতে দেয়। অস্বাভাবিকভাবে প্রতি মৌসুমে দুইবার করে ফল দিতে থাকে সে। বাজারে তখন লেবুর চাহিদা অস্বাভাবিক রকম বেশি। দামও। আম্মা পাশের বাড়ির পিচ্চি ছেলে পুলেদের দিয়ে লেবু তুলে হাটে পাঠান। এক বিস্ময়কর বিকল্পে আমরা আমাদের টিকে থাকার যুদ্ধে জয়ী হবার স্বপ্ন দেখি। সেখানে ক্রমশই বিস্তৃত হতে থাকে এক মুমূর্ষু লেবু চারার বিশাল ছায়া। সেই ছায়া আমাদের ঢেকে রাখে। আমার খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করি। আরেকটা দিন বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। লেবু গাছটা তার ছায়া আরও গভীর করে, বিস্তৃত করে। তার শরীর জুড়ে ফুটতে থাকে থোকায় থোকায় ম’ ম’ গন্ধের লেবু!
৪
অনার্স শেষেই আমি মোটামুটি ভালো একটা পার্ট টাইম চাকুরি পেয়ে যাই। সেই ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত অবস্থা কাটতে শুরু করে। জীবন ক্রমশই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আম্মার ফোন পেয়ে এক কুয়াশার ভোরে আমি বাড়ি যাই। ভোরের সূর্যটা কুয়াশার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে। সেই অদ্ভুত আবছা আলোয় আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি উঠোনের লেবু গাছটির দিকে। সেই সবুজ সতেজ ঝলমলে গাছটির প্রতিটা পাতা যেন আগুনে ঝলসে গেছে। গাছের গা জুড়ে অজস্র পোকা। মরা আর পোকায় খাওয়া পাতাগুলো ডালে ডালে ঝুলছে। বীভৎস এক দৃশ্য। যেন বাস্তব কঙ্কাল।
আমি অবাক হয়ে আমার হাতের ব্যাগভর্তি বোনের নতুন জামা, মায়ের শাড়ী, ভাইয়ের শার্ট দেখি। আমার পকেটে চাকুরীর প্রথম মাসের বেতনের টাকা। লেবু গাছটা না হলেও আমরা এখন দিব্যি চলতে পারবো! আমার হঠাৎ মনে হতে থাকে, এটি কোন গাছ ছিল না। এটি অন্য কিছু ছিল। অন্য কিছু। ব্যাখ্যার অতীত কিছু। যিনি এই বিশ্বব্রহ্মমাণ্ড পরিচালনা করছেন তার নিখুঁত পাণ্ডুলিপির এক অদ্ভুত চরিত্র ছিল সেই মুমূর্ষু ছোট্ট লেবুর চারাটি। নিজের দায়িত্ব পালন শেষে সে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করেছে। সে তার দায়িত্ব পালন করতে এসেছিল। দায়িত্ব পালন শেষে সে ফিরে গেছে!
আমি বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে লেবু গাছটির সেই কঙ্কাল শরীরের দিকে তাকাই। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে থাকে। কুয়াশায় ঢাকা সেই ভোরের আকাশেও আমি কিছু খুঁজে পাই না। কেবল কি যেন এক রহস্যে ঢেকে আছে চারপাশ। এই রহস্যের কোন শেষ নেই। এই রহস্যের কোন শুরু নেই। এই রহস্য অনন্ত, সীমহীন।
আমার হঠাৎ মনে হয়, থাকুক কিছু রহস্য। থাকুক কিছু আবছায়া। রহস্যের অপর নামই সমর্পণ। আমরা রহস্যেই সমর্পিত হই। আমি আলতো হাতে লেবু গাছটার শরীর ছুঁয়ে দেই। যেন কিছু একটা টের পাই। যেন কিছু একটা ঘটে যায় আমার শরীর জুড়ে। অদ্ভুত কিছু। তীব্র কিছু। তীব্র কিছু একটা টের পাই। আমার শরীর জুড়ে।
আসলেই কি টের পাই? নাকি পাই না?
নাকি বিভ্রম? শুধুই বিভ্রম?
মা
তখন 'পানি'কে 'জল' বললেই পিঠের উপর দুমদাম পড়তো।
এটা আম্মার ধর্মীয় আদব লেহাজ শেখানোর অংশ ছিল। সাথে ছিল বাজখাই গলায় বকুনি, ‘মোসলমানের পোলা হইয়া পানিরে কস জল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। হাতের গেলাসের পানি ফেলা। এই পানি এহন আর হালাল নাই, ফেলা, ফেলা। বিসমিল্লাহ বইলা আবার পানি নে। তারপর মাটিতে বইসা আদবের সাথে তিন ঢোক দিয়া খা, তিন ঢোকে সব পানি খাবি। এক ঢোকে না। এক ঢোকে পানি খায় শয়তানে’।
আমি গ্লাসের পানি ফেলে দিয়ে আবার পানি নিয়ে মাটিতে বসে আদবের সাথে গ্লাসে চুমুক দিতে যাবো, অমনি আম্মার জোর চিৎকার, ‘পানি খাওনের দোয়া পড়ছস? জানোস দোয়া? দোয়া পড়, দোয়া পড়’।
- 'দোয়াতো ভুইলা গেছি আম্মা!’
- ‘কি! দোয়া ভুইলা গেছস! কই নিবি আমারে? কই? দোজখে? অক্ষণ দোয়া মুখস্ত কর, অক্ষণ, বল, অসাকা হুম রব্বাহুম শরাবান তহুরা। পড়, মুখস্ত কর, মুখস্ত কইরা তারপর এইখান থেইকা উঠবি’।
আমি গভীর মনোযোগ এবং খানিক আগে দোয়া ভুলে যাওয়ার ভয় নিয়ে দোয়া মুখস্ত করতে বসে গেলাম, 'অসাকা হুম রব্বা হুম শরাবন তহুরা'।
এই দৃশ্য কেবল আমার একার না। কমবেশি সেই সময়ের আমাদের সবারই। আমরা তখন ভুলেও পানিকে জল বলি না। বরং বিলের পানিতে ফুটফুটে শাপলা ফুলের মধ্যেও তখন হিন্দু শাপলা আর মুসলমান শাপলা খুঁজি! চিকন চাকন দেখতে কটকটা লাল রঙের শাপলাগুলো হলো হিন্দু শাপলা। আর ধবধবে সাদা রঙের মোটা তাজা শাপলাগুলো মুসলমান শাপলা। আমরা বেছে বেছে সাদা শাপলাগুলো তুলে আনি। সেকালে গ্রামের মানুষদের বিনা পয়সায় পেটে জামিন দেয়ার নানান রকম ফন্দি ফিকির খুঁজতে হতো। সেক্ষেত্রে তরকারি হিসেবে শাপলা ছিল অপ্রতিদ্বন্ধি। চিংড়ির সাথে শাপলার ঝোল কিংবা ভাজির স্বাদ এখনও চোখ বুজলেই জিভের ডগায় লেপটে থেকে চাগিয়ে ওঠে, আহা!
কে শিখিয়েছে, কিংবা কীভাবে শিখিয়েছে জানি না। তবে এই হিন্দু মুসলমান বিভাজন খুঁজতাম সবকিছুতেই। হিন্দুদের আমরা বলতাম 'নোমো'। এই নোমোদের সবকিছুই খারাপ। আমাদের কাছে 'নোমো' মানেই খারাপ। যেন একটা গালি! এরা পরিত্যাজ্য। কেবল চুল কাটাতে বিপুল নাপিত 'নোমো' হলেও তার কাছে যাওয়া যাবে, আর দা কুড়াল ধার দিতে শিতেশ কম্মকার!
আমরা বাচ্চারাও এই বিভাজন সবক্ষেত্রেই মেনে চলতাম। কঠোরভাবে মেনে চলতাম। এমনকি আর সব পিঁপড়ার মধ্যে থেকেও ছোট ছোট লাল পিঁপড়েগুলোকে বেছে বেছে আঙুলের ডগায় পিষে দিতাম। যা বাবা, 'একটা 'নোমো' পিঁপড়াতো গেল!
'নোমো'দের সব জিনিসকে খারাপ ভেবে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললেও চৈত্র মাস এলেই কেমন গাঁইগুঁই করা শুরু করতাম। আম্মা বা পাশের বাড়ির ফুপুর কাছে গিয়ে বলতাম, ‘আপনে যে কন হিন্দুদের সব কিছুই খারাপ, এই কথা কিন্তু সত্য না’।
- ‘কীভাবে সত্য না?’
- ‘এই যে দেখেন আদর্শ লিপি নামে যে বই আছে, সেই বই ভর্তি ভালো ভালো লেখা, এই বই কে লিখছে? লিখছে, সীতানাথ বসাক। সে কি হিন্দু? না মুসলমান? সে কিন্তু হিন্দু। দেখছেন কি ভালো ভালো কথা লেখছে!’
আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ কটমট করে বললেন, ‘আসল উদ্দেশ্য কী সেইটা বল’।
আমি উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেখানে বিশাল শিমুল গাছের মাথায় লাল শিমুল ফুলগুলো পরিণত হয়ে বড় বড় ফল হয়েছে। সেই শিমুল ফলের ভিতরেই শিমুল তুলা। বাজারে সেই শিমুল তুলার দাম মাশাল্লাহ ভালো। আমি কিছু তুলা এর মধ্যেই বিভিন্ন গাছ থেকে চুরিটুরি করে জমিয়ে রেখেছি। আরও কিছু তুলা জমাতে পারলেই কেল্লা ফতে। সময় আর বেশি বাকি নাই। আরতো মাত্র ক’টা দিন। তারপরেই...!
আম্মা আবার জিজ্ঞাস করেন, ‘কিরে, মতলব কী?’
আমি উদাস গলায় জবাব দেই, ‘মতলব কিছু না’।
আম্মা হঠাৎ কড়ে আঙুলে মাস গোনেন আশ্বিন, কার্তিক... চৈত্র... বৈশাখ...!
হ্যা, বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের মাস!
তারপর হঠাৎ শক্ত হাতে আমার কান চেপে ধরেন, ‘ওরে আল্লাহ! তুই এইবারও গোলোইয়ায় যাবি! গোলোইয়ায় যাবি! তোর সাহস তো কম না’!
আমি নির্বিকারভাবে বলি, ‘সবাইতো যায় আম্মা, আমি গেলে কী হইছে?’
আম্মা বলেন, ‘গুনা হইব বাজান, এই সব মেলা ফেলায় যাওন ভালো না। ওইখানে পূজা হইব, নাচ গান হইব, ওইখানে যায় না বাজান’।
কিন্তু আম্মা জানেন, তিনি ‘গোলোইয়ায়’ যাওয়া থেকে আমাকে ফেরাতে পারবেন না। আমি যাবোই। আমাদের অঞ্চলে তখন বাংলা নববর্ষে বিশাল বৈশাখী মেলা হতো। গৌরনদী অঞ্চলের এই বিশাল মেলাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো 'গোলোইয়া'। এই গোলোইয়া নিয়ে তখন আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সে কি উন্মাদনা! উত্তেজনা! কৌতূহল! সেই মেলায় যাত্রাপালা হয়, পালাগান হয়, পূজা হয়, কি সুন্দর সব প্রতিমা! কিন্তু হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার সেই মেলা তখন যেন আর আমার মতো মুসলমান পরিবারের কাছে বাঙালি সংস্কৃতি নয়, যেন শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির উপলক্ষ্য। আমাদের তাই সেখানে যাওয়া বারণ! আমি ঘরের কোণায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। আর জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, ইশ, কত মানুষ রঙবেরঙের জামা পরে গোলোইয়ায় যাচ্ছে! কতো কতো মানুষ গোলোইয়া থেকে ফিরছে, ইশ! তাদের হাতভর্তি কত কত খেলনা! কতো কতো জিলিপি, সন্দেশ, মুড়িমুড়কি, নাড়ু, বাতাসা, ইশ!
রঙের পসরা মেলে বসা সেই মেলা যেন বর্ণিল জীবনের সবটুকু রঙ। আমার মতো কিশোরের কাছে সেই রঙ তখন স্বপ্নের দেশ, রূপকথার জগত! সেখানে হিন্দু-মুসলমান, পাপ-পুণ্য কিংবা ন্যায়- অন্যায়ের বোধ তখন নিতান্তই গৌণ। আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি গোলোইয়া শুরুর মাস তিনেক আগে থেকেই। কী কী কিনবো মনে মনে তার তালিকা করি, উশখুশ করি, নানান ফন্দি ফিকির করি, প্ল্যান-পরিকল্পনা করি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে টাকা কই পাবো? টাকা? আম্মাতো যেতেই দিবেন না, টাকা দেয়া তো অনেক দূরের কথা! যেতে হলেও যেতে হবে আম্মাকে না বলে। পালিয়ে। কিন্তু টাকা কোথায় পাবো?
টাকার ব্যবস্থাও অবশ্য আমাদের আছে। আমরা গাছে গাছে পেকে যাওয়া শিমুল তুলো চুরি করে শিমুল তুলো জমাই। লুকিয়ে লুকিয়ে রোদে শুকাতে দেই। ভেজা তুলা কেউ কেনে না। প্রতিদিন আম্মার চোখ লুকিয়ে সেই তুলা রোদে শুকাই, আবার নিজের গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখি। দিনে দিনে একটু একটু করে ওজন বাড়ে। আজ-কাল-পরশু। প্রতিদিন ওজন মেপে দেখি, ইশ, যদি এক কেজি হইতো! তাহলে কত দাম পাবো? তিরিশ টাকা? নাকি চল্লিশ? ভাগ্য ভালো হলে পঞ্চাশও পেয়ে যেতে পারি!
পঞ্চাশ টাকায় কী কী পাওয়া যায়?
আমি সেবার এক কেজির মতো তুলার ব্যবস্থা করে ফেললাম! সত্যি সত্যি এক কেজি! রাতে আমার ঘুম হয় না, ছটফট লাগে, দমবন্ধ লাগে উত্তেজনায়, আনন্দে! টেনশনে, ইশ, এক কেজি! কী কী কিনবো? লাল নীল চরকি, লম্বা বাঁশি, চশমা, বাতাসা... আমার আর সময় কাটে না। রাত ভোর হয় না, ভোর হলে দুপুর হয় না। সন্ধ্যা হলে রাত হয় না। গোলোইয়ার দিন আর আসে না, আসে না।
গোলোইয়ার দিন দুপুরে শুকনো ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটা দেই। নদী পেরিয়ে গৌরনদী হেঁটে যেতে যেতে ঘণ্টাখানেক লাগবে। আমি জোর কদমে হাটি। গা বেয়ে ঘামের স্রোত নামে। কিন্তু বুকের ভেতর উচ্ছ্বাস! আর তো কিছুক্ষণ! তারপরই সেই গোলোইয়া, সেই মেলা! আমি মাথা নিচু করে হাতের তুলার বস্তাটা দেখি। বুকের ভেতর প্রজাপতিরা ডানা ঝাঁপটায়, নানান রঙের প্রজাপতি। লাল, নীল, হলুদ। ওরা বুকের ভেতর রঙ ছড়িয়ে পাখা ঝাঁপটায়।
আজ রঙের দিন!
খেয়া নৌকা নদী পার হবো। নৌকা ভর্তি গিজগিজে মানুষ। আমি কোন মতে গুটিসুটি মেরে নৌকার পাটাতনে উঠে পড়ি। তুলোর বস্তাটা বুকের সাথে চেপে ধরি। গোলোইয়ায় যাওয়া মানুষের ভিড়ে নৌকাটা টইটুম্বুর। তিল ঠাঁই আর নাহিরে অবস্থা। নৌকাটা হঠাৎ বা পাশে কাঁত হয়ে পড়ে। কাঁত হয়ে পড়ে। আমি প্রাণপণে পাটাতনের কাঠ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। টুপ করে পড়ে যাই জলের ভেতর। আমি এক না। আরও অনেকেই। কিন্তু তাদের আমি দেখি না। সেই বুক সমান জলে দাঁড়িয়ে আমি সেই তুলার বস্তাটা জলের ভেতর থেকে টেনে বের করি! অতো হালকা বস্তাটা জলের ভেতর এতো ভারী হয়ে আছে যে আমি আর টেনে তুলতে পারি না! আমার চোখের ভেতর জ্বালা করে ওঠে। টুপটুপ করে ক’ফোটা চোখের জল সেই নদীর পানিতে মিশে যায়।
কি অদ্ভুত! কান্নার জল নদীর জল থেকে আলাদা করা যায় না।
পরিশিষ্টঃ
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে।
সেই ভেজা তুলার বস্তা নিয়ে আমি বসে আছি সেই নদীর পাশেই ক্ষেতের মাঝে এক বাঁশবাগানের ভেতর। বাঁশবাগানের পাশের হিন্দু বাড়িটা থেকে উলুধ্বনির শব্দ আসছে! আমার ভয় লাগছে। চোখের কোলে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ। তবুও আমি সেই অন্ধকারে বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি আর কাঁদি! অন্ধকার আরও গভীর হয়, আমি কাঁদতেই থাকি! কাঁদতেই থাকি। হঠাৎ সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে কেরোসিনের কুপি হাতে কেউ একজন এগিয়ে আসেন। তার সিঁথিতে সিঁদুর। এক ‘নোমো’ মহিলা। তিনি এসে পরম মমতায় আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হইছে তোমার? কান্দ ক্যান?’
আমি জবাব দেই না। কাঁদতেই থাকি। তিনি তার কুপির আলোয় আমার পাশে পড়ে থাকা ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়া তুলোর বস্তাটা দেখেন। তাকে আমি কিছু বলি না। কিন্তু তিনি যেন সব বুঝে যান। তিনি চুপচাপ আমার পাশে এসে বসেন, ‘তোমাগো বাড়ি কই বাপ? কইত্থেইকা আইছ? মেলায় আইছিলা? বাড়িতে বইলা আসো নাই? খাইছ কিছু? আসো আমার লগে আসো, বাড়ির ভিতর আসো’।
আমি তার কোন প্রশ্নের জবাব দেই না। কিন্তু তার পিছু পিছু বাড়ির ভেতর যাই। আমার কেন যেন ভয় করে না। এতো দিন লালন করে আসা ‘নোমো’ দের প্রতি কোন বিতৃষ্ণাও কাজ করে না। আমার কেবল মনে হয়, এই মানুষটা আমার চেনা। বহু দিনের চেনা।
পরদিন ভোরে পাগলপ্রায় আম্মা এসে হাজির। তিনি কীভাবে খবর পেয়েছেন কে জানে! আমাকে জড়িয়ে ধরে উথাল পাথাল কান্না। সিঁথিতে সিঁদুর আঁকা সেই ‘নোমো’ মহিলাটিকে ধরেও। তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে আম্মা কাঁদেন! সেই কান্নায় ধুয়ে মুছে যায় এতো এতো বছর, এতো এতো দিন, এতো এতো মুহূর্ত ধরে গড়ে তোলা বিভেদের দেয়াল! হিন্দু আর মুসলমান! মিলেমিশে এক হয়ে যায় অদ্ভুত ভালোবাসায়, বিশ্বাসে, অনুভূতিতে, কান্নায়! আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখি। আমার হাতে তখন লাল-নীল-হলুদ রঙের চরকি, লম্বা বাঁশি, প্ল্যাস্টিকের চশমা, হাতের ভেতর পলিথিনে মোড়া নারকেলের নাড়ু, ধবধবে সাদা বাতাসা।
ওই সিঁদুর পড়া মহিলাটা আমাকে কিনে দিয়েছেন। আমি হঠাৎ আমার মায়ের সাথে আর ওই সিঁদুর পরা মানুষটার সাথে আর কোন তফাৎ খুঁজে পাই না। লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়াতেও না। লাল শাপলা আর সাদা শাপলাতেও না, জল আর পানিতেও না। আমি কোন তফাৎ খুঁজে পাই না।
তফাৎ খুঁজে পাই না এই মানুষ দুজনের মধ্যেও। সেই সিঁদুর পরা হিন্দু মমতাময়ী নারী আর আমার মায়ের ভেতর আলাদা করে কিছু খুঁজে পাই না আমি! কিচ্ছু না! শুধু খুঁজে পাই দুজন মানুষ! দুজন নারী।
দুজন মমতাময়ী মা।
ছায়াময়ী ও মা
সাদাত হোসাইন
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
গ ল্প ৫
আমার সকল নিয়ে বসে আছি
বাল্মীকি চট্টোপাধ্যায়
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
মোবাইলটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল। চারিদিকটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। বাতাসে বিষের কটু গন্ধ ! কী দেখল ও ! সতিই কী দেখল ! নাকি ভুল, সবই ভুল ! কিন্তু ভুল তো নয় ! সেই হোটেল, সেই খাট, সেই বাথরুম, সেই সুইমিং পুল ! এবং সে নিজে আর অর্ক। এতসব তো মিথ্যে নয় ! মিথ্যে তো নয় মধুপর্ণার পাঠানো লিঙ্ক আর নীচে পরিস্কার বাংলায় মেসেজ, ভাবতেই পারছি না এটা তুই । এটা কী করে করলি ঝিমলি ! তুই কী পাগল হয়ে গেছিস !
ঘরে এসি চলছে। তবুও দরদর করে ঘামছে ঝিমলি । মোবাইলটা কুড়োতে গিয়ে টের পেল, তার হাতে কোন সাড় নেই। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কী করবে এখন ! কাকে ডাকবে ? বাড়িতে কেউ নেই। শাশুড়ি বাগুইআটিতে ওর মেয়ে রিম্পির বাড়ি গেছে। অর্ক স্টুডিয়োয় । রূপা আজ কাজে আসেনি । পাঁচ বাড়িতে কাজ করে । ও কি জেনে গেছে ! বাবার মোবাইলে নেট নেই। ভাই কী দেখেছে ! রিম্পি ! হঠাৎ পেটটা গুড়্গুড় করে উঠল ঝিমলির। উঠতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা স্ক্রিনটা চৌচির হয়ে গেছে। মোবাইলে একটা সামান্য খোঁচা লাগলে পাগল হয়ে যায় ঝিমলি। লোকে বলে, পৃথিবী সবকিছু একদিকে আর ঝিমলির মোবাইল একদিকে। চুরচুর হয়ে যাওয়া স্ক্রিনটা আজ আর টাচ করল না ঝিমলি। অর্কর নাম্বারটা মুখস্ত। ফোন করল। বার সাতেক বাজার পর ধরল অর্ক। প্রচন্ড বিরক্ত । ‘বলেছি না, কাজের সময় ফোন করবি না। শুটিং করছি।’ বিদ্ধস্ত ঝিমলি ধরা গলায় বলল, ‘এটা, এটা তুই কী করলি...!’ কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা কেটে দিল অর্ক।
দরজায় ধুম ধুম করে শব্দ । চমকে উঠল ঝিমলি। চেঁচিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে ? দরজা ধাকাচ্ছিস কেন ? বাইরে থেকে অর্ক বলল, ‘শিগ্গিরি খোল। প্রচন্ড হিসি পেয়েছে। আর পারছি না।’ ঝিমলি বলল, ‘মানে কী ? আমি স্নান করছি। দরজা খুলব কী করে ?’ অর্ক বলল, ‘আরে শালা খোল। এবার প্যান্টে হয়ে যাবে।’
বাথটব থেকে উঠে তোয়ালেটা জড়িয়ে দরজাটা খুলল ঝিমলি। একগাল হাসি নিয়ে ঢুকল অর্ক। অবাক ঝিমলি, ‘কী হল !’ অর্ক বললে, ‘তোর স্নানের ছবি তুলব, এটা বললে তো আর খুলতিস না। তাই অ্যাক্টিং করলাম।’
হাইহাই করে উঠল ঝিমলি, ‘মানে কী ? অসম্ভব । বেরো, বেরো এখান থেকে।’ অর্ক বলল । ‘একজন ফোটোগ্রাফার হয়ে তোর ফিগারের মেয়ের ছবি না তুললে ভগবান পাপ দেবে।’ ঝিমলি ওকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল, ‘তোর নিজের ছবি তোল হারামজাদা । বেরো এখান থেকে । পাপী আত্মা কোথাকার !’
কিন্তু অর্ক বেরোল না। বেসিনের ওপর মোবাইলটা রেখে জোর করে জড়িয়ে ধরল ঝিমলিকে। তারপর আদরে আদরে ভরিয়ে তুলল ওর দেহ মন । গতকালই গোয়াতে হানিমুনে এসেছে ওরা। লাস্ট সাত বছরের প্রেম পর্বে। বেশ কয়েকবার সম্পর্ক হয়েছে ওদের। তাতে একটা অন্য উত্তেজনা ছিল। নিষিদ্ধ ফল খাবার আনন্দ। কিন্তু হানিমুনের অনুভূতিটা আলাদা। তার ভালবাসার জনকে সামাজিক শিলমোহরে নিশ্চিন্ত করে পাওয়া। লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। স্বপ্ন আর স্বর্গরাজ্যের সঙ্গমে ভাসছিল ঝিমলি। তাই বারবার বাধা দেওয়া সত্ত্বেও প্রতিরোধ বিফলেই গেল। অর্ক বিভিন্ন অবস্থায় ওর ছবি তুলল। স্নানের পর পাঁজাকোলা করে নিয়ে এল বিছানায়। মেতে উঠল আদিম আনন্দে। তারপরের দু’দিন দু’রাত্তির ঝিমলির বিভিন্ন অঙ্গ-ভঙ্গীমায় ভরে উঠল অর্কর মোবাইল। কখন যে ওদের একান্ত মুহুর্ত ধরা পড়ল ভিডিয়ো ক্যামেরায়, বুঝতেও পারল না ঝিমলি। শেষ রাতে ওর বুকের মাঝে মুখ গুঁজে, সর্বাঙ্গ দিয়ে অঙ্গ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল অর্ক, কলকাতায় ফিরেই সব ডিলিট। কামাবেশে অবশ ঝিমলি বলেছিল, সত্যি !’ অর্ক দেহ সঞ্চালনের তালে বলেছিল, ‘সত্যি সত্যি সত্যি।’
কাঁধের ওপর বুক রাখল বিদিশা । ‘বেয়ারা বডির ছবিগুলো একটা আলাদা ফোল্ডারে রাখবে । কিছু কিছু খচ্চর প্রোডিউসার দেখতে চায়। আর বাকিগুলো তিনটে ফোল্ডারে। শাড়ি, সালোয়ার, ওয়েস্টার্ন, সেমি হট।’
ল্যাপটপে সবে ডাউনলোডে চাপিয়েছে ছবিগুলো। প্রচুর টাইম লাগবে। তারপর এডিটিং, কালার
কারেকশন, বহু কাজ বাকি। বিদিশার কথায় একটু বিরক্ত হল অর্ক। একটা কথা বলতে গিয়ে টের পেল কাঁধের ওপর নরম উপস্থিত। মেকআপের মুস্তাক চলে গাছে। ওর ব্রাইডাল আছে। স্টুডিয়ো ফাঁকা। বিদিশাকে টেনে নিয়ে বলল, জানি, তোমার কোনটা কোন কাজে লাগে। তা, আমি কেন রইনু বাকি !’ কোলের ওপর গা এলিয়ে মেনি বেড়ালের মতো গরগর করে বলল বিদিশা, ‘আমি কি বারণ করেছি !’ অর্ক বলল, ‘করোনি, তবে ছেনালি করেছ । ছোটোবালার একটা ছড়া মনে পড়ল, মালতি বাঁশবাগানে চল
ও পাড়ার নন্দ তেলি, তাকে তুই এমনি দিলি
আর আমার বেলায় করলি কেন ছল ?
মালতি বাঁশবাগানে চল।’
অর্ককে আঁকড়ে ধরল বিদিশা। টানতে টানতে নিয়ে গেল মেকআপ রুমে। এক পাশের ছোট্ট ডিভানে জড়িয়ে গড়িয়ে পড়ল। বিদিশার ছোট্ট পোশাকে চড়াতে সময় লাগল না। অর্ক ছাড়াতে একটু যা। ওরা মিলে গেল। তখনি , ঠিক তখনই ডিভানের নীচে পড়ে থাকা অর্কর জিন্সের পকেট বেজে উঠল মোবাইলে, ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়...
খিলখিল করে হেসে উঠল বিদিশা। ‘কী ন্যাকা গো..., সরি, ন্যাকা মার্কা গান লাগিয়েছে। এটা নির্ঘাত অনুপম রায়ের গান ? প্যানপ্যান করছে’ বিদিশার মিউজকাল সেন্স দেখে সেন্সলেস হওয়ার যোগাড়। ফোনটা বাজছে, ‘আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি, পথে যে জন ভাসায়। আমার সকল নিয়ে...’
ঝুঁকে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে অর্ক। আবার ঝিমলি ! রাস্কেল একটা। ফোনটা অফ করে দিল। উঠে এল বিদিশার ওপর। ‘বউ ? মানে ঝিমলি ? আমি কিন্তু ওর থেকে অনেক হট অ্যান্ড ওয়াইল্ড ইন বেড।’ হাসতে হাসতে বলল বিদিশা। হাসল অবাক অর্ক, ‘তুমি ঝিমলিকে চেনো ! দু’পা দিয়ে অর্কর কোমর জড়িয়ে ধরল বিদিশা, ‘সবে চিনেছি।’ বলেই চমকে উঠল, ‘এই ঘরে ক্যামেরা নেই তো !’
রাত ন’টা। বিদিশা কিছুক্ষণ আগে বিদায় নিয়েছে। বিয়ের প্রস্তুতি, বিয়ে, হানিমুন মিলে অনেকগুলো দিন নষ্ট হয়েছে। প্রচুর কাজ জমে গেছে। মিস ও হয়েছে খান চারেক। গত তিনমাস ঝিমলিকে একটা টাকাও দেয়নি অর্ক। ক্যামেরা ইকুইপমেন্টস – এ কুড়ি হাজার টাকা ই এম আই । স্টুডিয়ো ভাড়া দশ হাজার, সব টানে ঝিমিলি। মাসে মাসে হাজার দশ বারো ফেরত দেয় অর্ক। সে টাকার থেকেও বিপদে আপদে পাঁচ সাত নিয়ে নেয়। মাইনের প্রায় সব টাকাই ঝিমলির বেরিয়ে যায় অর্কর পিছনে। ভরসা একটাই, আর দু’একটা বছর টানতে পারলেই অর্ক একটা বড় জায়গায় পৌঁছে যাবে। তখন ঝিমলিকে আর খরচা করতে হবে না। ঝিমলিকে একটা ফোন করতে হবে। বিয়ের জন্য পনেরো দিন ছুটি নিয়েছিল নতুন সংসার গোছাবে বলে। কাল জয়েন করবে। এখন নিশ্চই বাড়িতেই থাকবে। ফোন করল অর্ক। ঝিমলি ধরল না। অন্য কোনও ঘরে আছে হয়তো। তখনই ওর নিজের মোবাইল বেজে উঠল, রিম্পি কলিং। ‘হ্যাঁ বল।’ ওপ্রান্ত থেকে চিল চিৎকার করে উঠল রিম্পি, ‘দাদা ঝিমলিদি এটা কী করেছে ?’ আবাক অর্ক। ‘কী হয়েছে ? চেল্লাচ্ছিস কেন?’ রিম্পি বলল, ‘আবার জিজ্ঞেস করধিস কেন ? ছিঃ ছিঃ দাদা। তোর একবারও মনে হলনা আমাদের কথা ! আমার শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাব কী করে ! মা কোন মুখে রাস্তায় বেরোবে ! এত বেহায়া, নির্লজ্জ হতে পারল ঝিমলিদি !’ কেঁদে ফেলল রিম্পি । ‘আমার এখন সাত মাস চলছে। এখন বাড়ি থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেয়, কোথায় গিয়ে দাঁড়াব দাদা ! একবারও আমদের কথা ভাবলি না তোরা ! ঝিমলিদির একবারও মনে হল না, ওর মতো একটা অন্য কাস্টের মেয়েকে বিয়ে করা নিয়ে মাকে কত কষ্ট করতে হয়েছ ! ফ্যামিলির সবাইকে মানাতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে !’
বিস্মিত অর্ক, ‘কী হয়েছে বলবি তো বোন ! কাস্ট-এর কথা আসছে কেন ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না !’ হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে রিম্পি বলল, ‘আমি বলতে পারব বা দাদা, আমার রুচিতে বাঁধছে। আমার জিভ আড়ষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। তুই এক্ষুনি বাড়ি যা। মাকে সামলা।’ ফোনটা কেটে দিল রিম্পি । কিছুই মাথায় ঢুকল না অর্কর। আবারও ঝিমলিকে ফোন করল। ফোন বেজে গেল।
বাড়িতে ঢুকে একটু ঘাবড়ে গেল অর্ক। রাত এগারোটা। কিন্তু বাইরের দরজাটা খোলা। ডাইনিং রুম অন্ধকার। মায়ের ঘর দরজা বন্ধ। দু’চারবার ডাকল। সাড়া পেল না। এক কোণে ছোটোমামার খাট। ফাঁকা। দোতলায় উঠল। কেউ নেই। লাইট জ্বাললো। ব্যালকনিতে গেল। খালি। পাশের ঘরটা ওর স্টাডিরুম। সেখানেও ঝিমলি নেই। ক্যামেরার ব্যাগটা টেবিলে রাখল। ‘ঝিমলি । কোথায় তুই ?’ কোনও উত্তর নেই। তাহলে নিশ্চই ছাদে গেছে। শালা নিশাচর। রাতের পর রাত জেগে থাকে। ভোর রাতে ঘুমোয়। ফটাফট জামা কাপড় চেঞ্জ করল অর্ক। একটা ড্রিঙ্ক ঢালল। অনেকক্ষন ধরেই টয়লেট পেয়েছে। বাথরুম গিয়েই চমকে উঠল, ঝিমলি পড়ে আছে। অচৈতন্য।
চোখে মুখে জল দিয়েও চেতনা আনা গেল না ঝিমলির। চিৎকার করে মাকে ডাকল অর্ক। মা এল না। ঝিমলিকে টানতে টানতে শোওয়ার ঘরে নিয়ে এল অর্ক। কোন মতে খাটে তুলল। এখন কী করবে ? কাকে ডাকবে ? এখানে কারর সঙ্গেই তেমন করে মেশে না। শুধু মোমোর দোকানের সুবলের সঙ্গে আলাপ আছে। বাধ্য হয়ে তাকেই ফোন করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা টোটো নিয়ে চলে এল সুবল।
দু’দিন পরে নার্সিংহোম থেকে যখন ছাড়া পেল ঝিমলি, তখনও তার বিদ্ধস্ত অবস্থা। তিরিশটা ঘুমের ওষুদের ধাক্কা সঙ্গে, ঘেন্না, অপমান, অভিমানে অবিন্যস্ত মন। শরীর ভেঙে পড়ছে। বাবা মায়ের অমতে এক রকমের বিদ্রোহ করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অর্ককে। ভালবেসে। তার এই পরিণতি ! ছিঃ, ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে। ওর শরীরে সবকিছু সবাই জানে ! নার্সিংহোমে তাকে দেখতে নার্স, ওয়ার্ডবয়, দারোয়ান। সুইপারদের ভিড় প্রতিনিয়ত রক্ষক্ষরণ ঘটিয়েছে। যে আয়া মেয়েটি নাইটে ছিল, সে তো বলেই ফেলল, ‘স্বামী হোক বা বয়ফ্রেন্ড, কাউকে বিশ্বাস করবে না, সব ছেলেরাই শালা এরকম। আমার বরও আমার ল্যাংটা ছবি তুলতে চেয়েছিল । মেরেছি পাছায় লাথি। আমার পয়সায় সংসার চলে, আমার সঙ্গে মজাকি !’ ইকনমিক্সে অনার্স, আই বি এম মার্কেটিং কোম্পানির জুনিয়র এক্সিকিউটিভ ঝিমলি অপলক তাকিয়ে ছিল আয়া মেয়েটির দিকে। ঈর্ষা করেছিল ওর শিরদাঁড়ার। বেডে শুয়েও ঠান্ডা বয়ে যাওয়া টের পেয়েছিল নিজের শিরদাঁড়া বেয়ে।
একটা ট্যাক্সি ডাকতে পারেনি অর্ক। টোটো নিয়ে এসেছে। চোখে রোদ্দুরটা বড় জ্বালা ধরাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সবাই যেন ওকে গিলছে। টোটোর সামনের সিটে পাড়ার মোমোওয়ালা ছেলেটা বসে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও কেন টোটোতে ? ছেলেটা বলল, ‘দাদা, কোনও টেনশান করবেন না। আমরা আছি। কোনও হারামি যদি বউদিকে কিছু বলে তো শালা থোবড়া বিগড়ে দেব। ফুল পোটেকশান আমাদের। আর বউদি, তুমি যখন রাস্তায় বেরোবে, আমাকে একটা মিস কল মেরে দেবে। ব্যাস, তারপর আমাদের কেলাবের কেউ না কেউ তোমাকে ফলোআপ করবে’।
আর সহ্য করতে পারল না ঝিমলি। কেঁদে ফেলল, ‘অর্ক, কী বলছে এই ছেলেটা ! কেন বলছে !’ অর্ক বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। ও ওর মতো করে বলছে। অন্যভাবে নিস না। এই সুবলই সেদিন টোটো ডেকে নিয়ে এসেছিল। তোকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হেল্পফুল ছেলে।’ বাড়ির সামনে ওরা পৌঁছে দেখল সেখানে ছোটোখাট একটা জটলা। ঝিমলি নামতেই গুজগুজ ফুসফুস। ‘ও বাবা, এই মেয়েটা ! এমনিতে তো ভদ্র লাগে ! কেউ আর মেয়ে পেল না !’ টলতে টলতে বাড়ি ঢুকল ঝিমলি। ডায়নিং টেবিলে শাশুড়ি বসে আছে। ছোটোমামা নিজের খাটে শুয়ে। দোতলার সিঁড়িতে পা দিতেই শাশুড়ি বলল, ‘তুমি এখানে থেকো না ঝিমলি। জিনিসপত্র গুছিয়ে বাপে বাড়ি চলে যাও। এটা একটা ভদ্র পাড়া। তোমার শ্বশুর মশাই যথেষ্ট মানি লোক ছিলেন। আমরাও সম্মান নিয়ে থাকি।’ পা’টা টলছে ঝিমলির। সিঁড়িতেই বসে পড়ল ‘কী বলছ কি তুমি মা ? শাশুড়ি বলল, ‘আমাকে মা বলবে না। তোমার ওই নোংরা মুখ থেকে মা ডাক শুনতে আমার শরীর রি রি করে।’ মায়ের পাশে অর্ক এসে দাঁড়াল। ‘বাবু, তুই আজই ওকে চলে যেতে বল। যে-মেয়ে ফুলশয্যার রাতেই ছাদে গিয়ে সিগারেট ফোঁকে, সে কেমন মেয়ে আমার আগে বোঝা উচিত ছিল। বারবার বারণ করেছিলাম এই মেয়েকে ঘরে না তুলতে। আমার কথা শুনলিই না। এখন কী করে মুখ দেখাব ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ পাড়ার সব বউরা এসে বলছে, মাসিমা আপনার বউমার নাকি কী একটা ভিডিয়ো বেরিয়েছে ?’ অর্ক সিঁড়ির কাছে গিয়ে ঝিমলিকে ধরল ‘চল, ওপরে চল।’ অবাক হয়ে অর্কর দিকে তাকাল ঝিমলি। ‘মা কী বলছে, শুনতে পাচ্ছিস না তুই ! আমাকে চলে যেতে বলছে ! এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছে ! দোষ কী আমি একা করেছি ?’ শাশুড়ি বলল, ‘পুরুষ মানুষের একটু আধটু দোষ গ্রাহ্যি হয় না। তুমি ছেনালের মত ওই সব করলে ! ছিঃ ! তোমার মুখ দেখলে আমার বমি পাচ্ছে।’ ঝিমিলি বলল, ‘তুমি এসব কী বলছ ?’ ঝিমিলির হাত ধরে টেনে তুলল অর্ক, বলল, ‘আগে ওপরে চল। ঘরে চল।’
অর্কর হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে ঘরে চলে গেল ঝিমলি। ঝাঁপিয়ে পড়ল খাটে। গুমরে গুমরে কান্না বেরিয়ে এল। পাশে এসে বসল অর্ক। একটা সিগারেট ধরাল। ‘বুঝতেই তো পারছিস, মা একটা শক্পেয়েছে, সে জায়গা থেকেই সেই কথাগুলো বলছে । আমার মনে হয়, মাকে একটু সময় দেওয়া দরকার । আগেকার দিনের মানুষ তো !’ কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না ঝিমলির । কিন্তু ওই বিষ কথাগুলো সোনার পর অর্কর এই ব্যবহার, টোটোর সেই সুবলের চাওনি আর ডায়লগ, বাড়ির সামনের জটলা, নার্সিংহোমের ওই আয়া মেয়েটার ঋজু শিরদাঁড়া হঠাৎ করেই কেমন যেন কঠিন করে দিল ওকে।
‘তাহলে কী বলতে চাইছিস তুই ?’ বলল ঝিমলি। অর্ক, ‘বুঝতেই তো পারছিস, একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে। ব্যাপারটা একটি থিতু হতে দে।’ ঝিমলি উঠে বসল। ‘আমাকে কী করতে হবে ?’ অর্ক ওর দিকে সিগারেটটা বাড়িয়ে বলল, ‘ওই যে মা বলছিল, কয়েকদিন তোর বাবার ওখান গিয়ে থাক। তারপর সুযোগ বুঝে...’
সিগারেটটা থাবড়া মেরে ফেলে দিল ঝিমলি। ‘আচ্ছা অর্ক, মা কী কারণে আমাকে যেতে বলছে ?’ অবাক হয়ে অর্ক বল ‘ওই ভিডিয়োটা লিক হয়ে গেছে। সেটা থেকেই তো ঝামেলা।’ ঝিমলি বলল, ‘ভিডিয়োটাতে কী ছিল অর্ক ? কে তুলেছিল ? কার জন্য লিক হয়েছে ?
একটু থতমত খেয়ে গেল অর্ক। ‘মানছি, আমার দোষ। মোবাইলের দোকানের ছেলেটা যে লিক করে দেবে বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস কর, আমি ভেবেছিলাম এডিট করে তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব।’ ঝিমিলি বলল, ‘আমি তখনই সারপ্রাইজড হয়েছিলাম অর্ক, যখন তুই আমার ওইসব ছবি তোলার জন্য জোর করছিলি। তোর বিকৃত মানসিকতা দেখে অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু তোর জোরের কাছে, ভালবাসার কাছে, জীবনে প্রথমবার তোকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে নিমরাজি হয়ে গিয়েছিলাম। তোকে বিশ্বাস করেছিলাম। আমি দ্বিতীয়বার সারপ্রাইজড হলাম আজ , তোর দুমড়ানো মোচড়ানো শিরদাঁড়া দেখে। দোষ যদি হয়, তাহলে তো আমরা দু’জনেই করেছি। শাস্তিটা আমাকে একা পেতে হবে কেন ? মায়ের কথার কোনও প্রতিবাদ তো তোকে করতে শুনলাম না ! উলটে আমাকে বলছিস মায়ের কথা মেনে নিতে ! বাঃ অর্ক, বাঃ !’
অর্ক বলল, তুই আমার ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর। এতে তো আমারও মারাত্মক একটা ক্ষতি হল। আমার ক্লায়েন্টরা ভাবতেই পারে যে আমি ছবি লিক করে দিই। তার ওপর পাড়ায়, আত্মীয় স্বজনের কাছে আমাদের প্রেসটিজটা...’
প্রায় সাত বছর প্রেম করার পর অর্ককে বিয়ে করেছিল ঝিমলি। এবং বিয়ে করেছিল অর্কর জোরাজুরিতেই। ও নাকি একা আর থাকতে পারছে না। বাবা মায়ের কাছে সম্পূর্ণ গোপন করে চারবছর ধরে অর্কর জন্য মায়নের সব টাকা পয়সা খরচ করেছে ঝিমলি। বাবা মায়ের অমতে দুঁপাঁচ হাজার টাকা রোজগারের ছেলেকে বিয়ে করেছে। করেছে ভালবাসার টানে। প্রেমে ঝিমলির জীবনটা ছারখার করে ও ভাবছে ক্লায়েন্টের কথা ! ওর ক্ষতির কথা ! প্রেস্টিজের কথা! অর্ক বিছানা থেকে উঠে পড়ছে। একটা সুটকেস বের করে বলল, ‘তোর কী কী ঢোকাব ? অফিসের জামা কাপড় নিবি তো ! আর পারল না ঝিমলি। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এল। ‘তুইও আমাকে চলে যেতে বলছিস অর্ক ! আমি তো কিছুতেই চাইনি ঐ ছবিগুলি তুলতে। তুই জোর করে তুললি। তোর জন্য ভিডিয়ো লিক হল। আমি রাস্তায় কি করে বেরবো সেটা ভাবছিস না ! ট্রামে বাসে, অফিসে আমাকে নিয়ে কী চলবে রিয়েলাইজ করেছিস ! প্রতিনিয়ত আমাকে পুরুষের চোখে ধর্ষিত হতে হবে ! বুঝতে পারছিস না !’
অর্ক সুটকেস গোছাতে গোছাতে বলল, ‘না বোঝার কী আছে । তাই তো বললাম, কয়েকদিন বাবার ওখানে গিয়ে থাক। মিটে গেলে তখন কিছু একটা করা যাবে। এখন বুঝতে পারছি না আমাকে কী কী ফেস করতে হবে ! মাকেই বা সামলাবো কী করে ! একটা জঘন্য ঘটনা ঘটে গেল।’ ঝিমলি কঠিন গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, তোকে অনেক কিছু ফেস করতে হবে। অনেক কিছু । আমার থেকে বেশি। তা এই জঘন্য ঘটনাটা ঘটল কী করে অর্ক !’
অর্ক আরেকটা সিগারেট ধরাল। ‘দ্যাখ, অনেকক্ষণ ধরে সিন ক্রিয়েট করছিস। আমি যদি বলি, পুরুষ হিসাবে আমি ঐসব করতেই পারি। তুই কেন রাজি হলি ? ছেনাল মেয়েছেলের মতো পোজ কে দিয়েছিল, আমি ? সূঁচ নড়লে তো সুতো পরানো যায় না !’ বিস্ময়ের শেষ সীমায় ঝিমলি। মানে ? কী বলতে চাইছিস তুই ?’ অর্ক বললে, ‘তুই যদি সত্যি জোর করতিস, আমি হয়তো ছবি তুলতে পারতাম না, সিম্পল। বার কয়েক জোর করতাম, তারপর ছেড়ে দিতাম। একবার বলার পরেই তুই বাজারি মেয়েদের মতো পোজ মারলি। এতক্ষণ অনেক বড় বড় কথা বলেছিস। কম ছেলের সঙ্গে তো শুসনি। আমি জানিনা ভাবছিস ! বাপের বয়সি লোকদেরও ছাড়িসনি। বিয়ে করে উদ্ধার করেছি তোকে, ভূলে যাস না। নইলে শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খেত।’
কান্নার দমকটা বুক থেকে গলায় আটকে গেল। ড্রয়ার খুলে প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল ঝিমিলি। ‘নীচ থেকে তোর মায়ের পানের বাটাটা নিয়ে আসবি ? একটা পান খাব ! সুপুরি, জাঁতিটাও আনিস। আর সুবলের নাম্বারটা দে, টোটো আনতে বলব !’ ছুটে বেরিয়ে গেল অর্ক। দরজাটা বন্ধ করে একটা সালোয়ার কামিজ পরল ঝিমলি। বিয়েতে বাবার দেওয়া আলমারিটা খুলল। সংসার করবে বলে আলমাড়িটা চেয়েছিল। এখনও গোছানো হয়নি । গিফট-এর শাড়িগুলো ডাঁই করে রাখা আছে। প্যান কার্ড, আধার কার্ড, পার্সপোর্ট, অফিসের আইডেনটিটি কার্ড নিয়ে একটা ব্যাগে ভরল। হাজার দেড়েক টাকা ছিল, তাও নিল। ভাঙা মোবাইল, চার্জারটা ঢোকাল। চলে যাছে ঝিমলি, সাজাতে যাওয়া সংসার ছেড়ে। আর হয়তো এ বাড়িতে আসা হবে না।
টেবিলের ওপর বেশ কয়েকটা পান ভরা প্লাস্টিক পাউচ পড়েছিল। বউভাতের দিন এনে রেখেছিল পরে খাবে বলে। শুকিয়ে গেছে। ওর স্বপ্নের মতোই। পানটা ফেলে একটা পাউচ নিল ঝিমলি। দরজায় ধাক্কা পড়ল। মাকে বিজয়ের খবরটা দিয়ে ফিরছে অর্ক। দরজা খুলল ঝিমলি। পানের সরঞ্জাম নিয়ে ঢুকল অর্ক। দরজা বন্ধ করল ঝিমলি। খাটে বসে জাঁতি দিয়ে সুপুরি কেটে জর্দা দিয়ে একটা পান বানালো। খেল । সিগারেট ধরাল। ‘সুবলের নাম্বারটা দিবি ?’ বলল ঝিমলি। নিজের মোবাইল থেকে সুবলকে ফোন করল অর্ক। ঝিমলি বলল, ‘আধঘন্টা পর টোটো নিয়ে আসতে বলল, বাথরুমে গেল ঝিমলি। বাথরুম করে, মুখ ধুয়ে গামছায় মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল। খাটে শুয়ে ডাকল অর্ককে। ‘আবার করে তোকে পাব জানি না। আয় আমার কাছে। অর্ক ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝিমলির ওপর। খানিকক্ষন ঝাপটা ঝাপাটির পর দ্রুতহাতে’ অর্কর জামা প্যান্ট খুলল ঝিমলি। আদর করতে লাগল। উত্তেজিত, চরম উত্তেজিত অর্ক। উত্থিত অর্কর পৌরুষ। বিছানাতেই জাঁতিটা ছিল। নিল ঝিমলি।
অর্কর মোবাইল বাজল। মোমো সুবল কলিং।
মুখে ওরনা, কোমর থেকে নীচে পর্যন্ত গামছা বাঁধা অর্ককে ধরে ধরে নীচে নামালো ওরা। ওর গোঁঙানি ছটপটানি কেউ টের পেল না টোটো স্টার্ট দিল। থানার ডিউটি অফিসারকে রক্তমাখা পাউচটা দিল ঝিমলি। অর্কর পুরুষত্বের যন্ত্রটা কেন্নোর মতো গুটিয়ে আছে। টোটোতে কুঁকড়ে শুয়ে থাকা অর্ধচেতন অর্কর মতোই।
গ ল্প ৬
মনস্তাত্ত্বিক
হিমাদ্রিকশোর দাশগুপ্ত
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
রিক্সো থেকে নেমে নির্মাল্য দেখতে পেল শ্বশানে ঢোকার মুখেই মিউনিসিপালিটির শববাহী গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। আর তার কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান অর্থাৎ প্রশান্তর এস ইউ ভি গাড়িটা। অফিসের কাজে গত সাতদিন নির্মাল্য শহরের বাইরে থাকলেও বিজন, ধৃতিমান, রবির সাথে নিয়মিত ফোনে কথা হয়েছে নির্মাল্যর। তাদের থেকে নির্মাল্য জেনেছে যে রঞ্জনার হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপার থেকে যে সংক্রান্ত অন্য সব ব্যাপার তারা নানা ব্যবস্থার মধ্যেও সামনে আসছে প্রশান্ত। রঞ্জনা আর নবারুণের পারিবারিক বন্ধুর দায়িত্ব পালন করেছে প্রশান্ত। নির্মাল্য, বিজন, রবি, প্রশান্ত, নবারুণ দীর্ঘ দিনের বন্ধু হলেও নবারুণ ও রঞ্জনার সাথে প্রশান্তর ঘনিষ্ঠতাই সব থেকে বেশী।
শ্বশানের ভিতর ঢোকার মুখেই একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বিজন, রবি আর ধৃতিমান। নির্মাল্য তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ধৃতমান জানতে চাইল, ‘কিরে কখন ফিরলি?’
নির্মাল্য জবাব দিল, ‘এই একটু আগে। বাড়িতে ব্যাগটা ফেলেই ছুটে এলাম। তোরা বডি নিয়ে কখন এলি?’
রবি বলল, ‘মিনিট চল্লিশ আগে। হাসপাতাল থেকে বডি রিলিজ, শববাহি গাড়ির ব্যবস্থা সবই প্রশান্ত করেছে। একটা বডি ঢুকছে, সেটা বেরোলেই রঞ্জনারটা ঢুকবে। প্রশান্ত যাচ্ছে, এদিক থেকে সমস্যার কিছু নেই। তবে…’। এই বলে থামল রবি।
রবি জানতে চাইল, ‘তবে কী?’
রবি জবাব দিল, ‘মদ খেয়ে চুর হয়ে আছে নবারুণ’।
কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে গেল নির্মাল্য। বছর কুড়ি আগে একবার প্রচণ্ড মদ্যপান শুরু করেছিল নবারুণ। এমন কী রাস্তা ঘাটের অনেক সময় পরে থাকত নবারুণ। শেষ পর্যন্ত রঞ্জনাই তাকে সে পথ থেকে ফিরে আনে। তারপর মদ একদম ছেড়ে দিয়েছিল নবারুণ। এই কুড়ি বছরে মদ তো দূরে থাক একটা সিগারেট কেউ তাকে খেতে দেখেনি। সেই নবারুণ মদে চুর হয়ে স্ত্রীর মৃতদেহ দাহ করতে এসেছে! বিজন বলল, ‘এই বয়সে এসে পঁচিশ বছর ঘর সংসার করার পর রঞ্জনার মৃত্যুটা মনে হয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না নবারুণ। তার ওপর ওর ছেলে মেয়েও নেই যে ওকে সামলাবে। নবারুণটা একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে গেল।‘
ধৃতিমান বলল, ‘ওর পক্ষে যে রঞ্জনার মৃত্যুটা কতটা মারাত্মক তা বোঝাই যাচ্ছে। সকাল থেকে আমাদের কারো সাথে একটাও কথা বলেনি, এমন কী প্রশান্তর সাথেও নয়। যে রঞ্জনা একদিন ওকে মদ ছাড়িয়েছিল বহু কষ্ট করে তার মৃত্যু যন্ত্রণা ভোলার জন্য আজ তার মৃত্যুদেহ নিয়ে আকণ্ঠ মদ গিলে এসেছে সে। দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছে না। ভাগ্যিস প্রশান্ত সঙ্গে ছিল’।
বিজন এরপর নির্মাল্যকে বলল, ‘তুই নবারুণের কাছে গিয়ে দেখ। আমাদের মধ্যে তোর সঙ্গেই তো ওর একটু বেশী বন্ধুত্ব। দ্যাখ যদি ওঁকে সামলাতে পারিস। একটু কাঁদলেও হয়তো ও কিছুটা হালকা হতে পারবে। নবারুণ একেবারে থম মেরে গেছে।
বিজনদের কথা শুনে নির্মাল্য শ্বশানের ভিতর প্রবেশ করল। কিছুটা তফাতেই দাঁড়িয়ে আছে চুল্লি ঘরটা। তার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিছু শ্বশানযাত্রী। কোমরে গামছা বাঁধা। যে বাড়িটা এখন ঘরের ভিতর পুড়ছে তার লোকজন।
গেট দিয়ে শ্বশানের ভিতরে প্রবেশ করলেই ডান হাতে শ্বশানের অফিস ঘর। তার ঠিক সামনে শেডের নীচে একটা চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিল প্রশান্ত। তার এক হাতে চায়ের কাপ। অন্য হাতে কিং সাইজ সিগারেট। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে শ্বশানকর্মীরা। তারা মিউনিসিপালিটির কর্মী, শ্বশানের কাজের দায়িত্বে আছে। প্রশান্ত চেয়ারম্যান সাহেব বলে কথা। তার নামে বাঘে গরুতেও শহরে এক ঘাটে জল খায়। তাকে ঘিরে ভীড় তো হবেই। নির্মাল্যকে দেখতে পেয়ে প্রশান্ত চোখের ইশারা করল। প্রশান্ত দৃষ্টি অনুসরণ করে নির্মাল্য দেখতে পেল নবারুণকে। উল্টো দিকে একটা গাছের নীচে বেদির ওপর একলা বসে আছে নবারুণ। তার সামনেই একটু তফাতে মাটিতে বাখারির চালিতে শয়ান আছে রঞ্জনার মৃতদেহ।
নির্মাল্য এগিয়ে গেল নবারুণের কাছে। ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনে শুয়ে থাকা রঞ্জনার দিকে। নির্মাল্যও তাকাল মৃতদেহটার দিকে। মৃত্যুর আগে শেষ কটা মাস বেশ কষ্ট পেয়েছিল রঞ্জনা তার লিভার ক্যান্সারে। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন ঘুমোচ্ছে। এক সময় রঞ্জনার এই চোখ ঝলসানো রূপের জন্য নবারুণ বন্ধুদের কাছে বেশ ঈর্ষার পাত্র ছিল। সেই রূপ আরও যেন ফুটে বেরোচ্ছে! মনে হচ্ছে এখনই হয়তো সে উঠে মুক্তার মতো হেসে বলবে, ‘কি নির্মাল্যদা, কেমন আছেন?’। মৃত্যু হয়তো বা আলাদা একটা প্রশান্তি এনে দেয় মৃতমানুষের মুখ মণ্ডলে। চওড়া করে রঞ্জনার সিঁথিতে সিঁদুর পরানো হয়েছে স্নান করানোর পর। লোকে বলে সধবার মৃত্যু নাকি তার স্বর্গবাস হয়। হয়তো বা সে কারণেই তার সিঁথিতে সিঁদুরের আধিক্য।
এক টুকরো সাদা কাপড়ে ঢাকা রঞ্জনার দেহ পুড়ে যাবার অপেক্ষাতে।
দেহটার দিকে তাকিয়ে একবার হাত জোড় করে তাকে প্রণাম জানিয়ে নবারুণের পাশে বসল। নির্মাল্য হাত রাখল নবারুণের কাঁধে। সান্ত্বনার হাত।
নির্মাল্যর দিকে মুখ ঘোরালো নবারুণ। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র মদের গন্ধ এসে লাগল নির্মাল্যর নাকে। এই প্রথম মুখ খুলল নবারুণ। ঘোলাটে দৃষ্টিতে নির্মাল্যর দিকে তাকিয়ে নবারুণ বলল, রঞ্জনার সাথে আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে?’
একটু চুপ করে থেকে নির্মাল্য বলল, ‘হ্যাঁ। সেবার বই মেলাতে আমাদের দুজনেরই প্রথম বই বেরিয়েছিল। আমার উপন্যাস আর তোর কবিতার বই। হঠাৎ তোর সামনে একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়ে তোর বইটা খুলে বলল, ‘একটা অটোগ্রাফ দেবেন? আপনার কবিতা আমার খুব ভালো লাগে?’
কলম খুলে তুই জিজ্ঞেস করলি আপনার নাম কী?
সে জবাব দিল, ‘রঞ্জনা’।
নির্মাল্য জবাব শুনে জড়ানো গলাতে নবারুণ প্রথমে বলল, ‘ তোর মনে আছে দেখছি! পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে তাই না! তার কোনটা জানা যায় আবার কোনটা জানা যায় না’।
এ কথা বলার পর নবারুণ, রঞ্জনার মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বীর ভোগ্যা নারী। বীর ভোগ্যা রঞ্জনা’।
রঞ্জনার সাথে সম্পর্ক হবার পর নবারুণের বন্ধুরা যখন ব্যাপারটা নিয়ে ঈর্ষা প্রকাশ করত তখন নবারুণ মজা করে এ কথাটা বলত বন্ধুদের। যাক বহু বছর পর নবারুণের মুখে কথাটা শুনল নির্মাল্য- ‘বীর ভোগ্যা রঞ্জনা’।
কথাটা বলেই অবশ্য চুপ মেরে গেল নবারুণ। অন্য বন্ধুরাও চায়ের দোকান থেকে এসে পড়ল এরপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগের লাশটা পোড়ানো হল। রঞ্জনার লাশটা ধৃতিমান, রবিরা উঠিয়ে নিয়ে এগোলো চুল্লি ঘরের দিকে। নবারুণ এত মদ খেয়েছে যে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। চুল্লিতে রঞ্জনার দেহটা ঢোকাবার আগে নির্মাল্য কোন রকমে ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে হাজির হল সেখানে। পুরোহিতের দেওয়া চন্দন কাঠের টুকরোটা রঞ্জনার বুকের ওপর রাখার সময় নির্মাল্যর মনে হল নবারুণ যেন আবারও বিড় বিড় করে বলে উঠল ‘বীর ভোগ্যা রঞ্জনা’।
চুল্লির ভিতর ঢুকে গেল রঞ্জনার দেহ। নির্মাল্যরা, নবারুণকে বাইরে এনে আবার বসালো। নবারুণ বসার পরই কোমরের নীচ থেকে একটা মদের বোতল বাড় করল। সেটা দেখেই বিজন নবারুণকে বলে উঠল, ‘কী করছিস তুই! নিজেকে শেষ করবি নাকি। থাম এবার’।
কথাটা শুনে নবারুণ, বিজনের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অদ্ভূতভাবে একবার নিঃশব্দে হাসল। তারপর ঢকঢক করে মদটা গিলে ফেলল। এ যেন কুড়ি বছর আগের সেই হঠাৎ বেহেড মাতাল হয়ে যাওয়া নবারুণ। যাকে পথের ধার থেকে প্রশান্তর সাহায্যে বাড়ি নিয়ে যেত রঞ্জনা। প্রশান্ত অবশ্য তখন চেয়ারম্যান হয়নি। উঠতি নেতা ছিল। নির্মাল্যদের সাথে এই রবিবারের বিকালগুলোতে নিয়মিত আড্ডা দিত হরিদার চায়ের দোকানে।
প্রশান্তর তত্ত্বাবধানে দাহ কার্য সঠিকভাবেই সম্পন্ন হল। প্রশান্তর গাড়িতেই কোন রকমে নবারুণকে উঠিয়ে গাড়িতে উঠে বসল সবাই। একই পাড়াতেই সবার বাড়ি। নবারুণকে প্রথমে তার বাড়িতে নামিয়ে একে একে অন্যদের নামাবার পর গাড়ি নিয়ে চলে গেল প্রশান্ত।
২
বিকাল পাঁচটা নাগাদ হরিদার চায়ের দোকানে প্রতি রবিবারের মতোই গিয়ে হাজির হলো নির্মাল্য। গত তিরিশ বছর ধরে এটাই বন্ধুদের আড্ডাস্থল। কাজের চাপে এখন অবশ্য এখানে প্রতিদিন আসা হয় না কারোরই। তবে রবিবার বিকাল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত তাদের আড্ডা বসে এখানে। নবারুণও আসে। প্রশান্ত অবশ্য এখন আর আস্তে পারে না তার কাজের চাপে। তাছাড়া চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেওয়াটা এখন তার পক্ষে ঠিক শোভনীয় নয়। সে তাদের পার্টি অফিসে বসে।
নির্মাল্য, হরিদার চায়ের দোকানে উপস্থিত হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে বিজন, ধৃতিমান রবিও উপস্থিত হল। দোকান ঘরের বাইরে রাস্তার পাশে বেঞ্চে বসল সবাই। শীতের বেলা, রোদ মরে গেছে। সাড়ে পাঁচটাতেই অন্ধকার নামবে। হরিদা চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। নিঃশব্দে চা-পান করল সবাই। চা শেষ করে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ধৃতিমান নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, ‘প্রশান্ত কিন্তু সত্যিই অনেক কিছু করল! ওর এত কাজের চাপ, পার্টির চাপ, মিউনিসিপালিটির কাজের চাপ। তার মধ্যে থেকেও কত সময় দিল রঞ্জনার জন্য। হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে দাহকাজ সব দাঁড়িয়ে থেকে করল। নিজের ডিগনিটি ভুলে বেহেড মাতাল হয়ে যাওয়া নবারুণকে বাড়িতেও পৌঁছে দিল। ওকে তো পাবলিককে নিয়ে চলতে হয়। নিজের ইমেজের পরোয়াও করল না। আমরা আর কতটুকু করলাম? যা করার সব ওই তো করল’।
বিজন বলল, ‘ঠিক তাই। শুধু এখন নয়, প্রশান্ত আগেও রঞ্জনা আর নবারুণের পাশে দাঁড়িয়েছে। তোদের মনে আছে, নবারুণ আর রঞ্জনার বিয়ের তিন চার বছরের মধ্যেই যখন নবারুণ হঠাৎ মারাত্মক নেশা করতে শুরু করেছিল তখনও প্রশান্ত রঞ্জনার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকদিন ওরা দুজন রাতের বেলা এখান ওখান থেকে খুঁজে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেত নবারুণকে। স্ত্রী হিসাবে রঞ্জনা তো দায়িত্ব পালন করেছিলই কিন্তু নবারুণকে বুঝিয়ে শুনিয়ে মদ্যপান ছাড়ানোর পিছনে প্রশান্তরও ভূমিকা ছিলো। আমি তো এও শুনেছি যে প্রশান্ত নাকি একবার যে সময় নবারুণকে এ বলেও ভয় দেখিয়েছিল যে নবারুণ মদ খাওয়া না ছাড়লে সে তাকে জেলে ঢোকাবার ব্যবস্থা করবে’।
ধৃতিমান বলল, ‘বড় ভালো মেয়ে ছিল রঞ্জনা। শুধু সুন্দরী নয়, কেমন হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল। আমাদের বউগুলোর মতো গোমড়া হয়ে থাকতে দেখিনি। সবসময় ও হাসি মুখে আগলে রাখত নবারুণকে। এমন বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রঞ্জনার এভাবে চলে যাওয়া সত্যি বড় মর্মান্তিক। একলা হয়ে গেল নবারুণ। এই পঞ্চাশ বছর বয়সে নবারুণ নিশ্চয়ই আর বিয়ে করবে না’।
রবি বলল, ‘আজ নবারুণকে দেখে আমার অন্য আশঙ্কা হচ্ছে। যে নবারুণ গত কুড়ি বছর এক ফোঁটা মদ ছোঁয়নি সে কি আবার নতুন করে মদ ধরল রঞ্জনার চলে যাবার ব্যথা ভুলতে? ব্যাপারটা যদি সত্যি হয় তবে এখন কে সামলাবে ওকে? আমাদের কথা তো নবারুণ শুনবে না। রঞ্জনাও নেই। আর প্রশান্তরও এখন অত সময়ও নেই যে আগলে রাখবে নবারুণকে। এমন হবে না তো যে রাস্তার পাশে অথবা পানশালার সামনে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকবে নবারুণ?’
বিজন বলল, ‘আমার তো মনে হয় সেদিকেই ব্যাপারটা গড়াতে যাচ্ছে। আমি যখন শ্বশানে নবারুণকে মদ খেতে বারণ করলাম তখনও মদ গলায় ঢালবার আগে কেমন অদ্ভুত হাসল খেয়াল করেছিলি?’
নির্মাল্য বলল, ‘হ্যাঁ। আমি খেয়াল করেছি’।
বিজন বলল, ‘আমার যেন মনে হল যে ওভাবে যে হেসে বলতে চাইল, ‘খাব, বেশ করব। এবার থেকে রোজ খাব। আমাকে আর বাধা দেবার কেউ নেই। রঞ্জনা নেই’।
ধৃতিমান বলল, ‘ব্যাপারটা যদি সত্যি সে দিকেই গড়ায় তবে কী করা যাবে?’
রবি চিন্তান্বিত ভাবে বলল, আমাদের ছেলে মেয়েরা এখন বড় হয়েছে তারা দেখবে বাবার বন্ধু রাস্তাতে মাল টেনে পড়ে আছে। তার চেয়েও বড় কথা আমাদের চোখের সামনেই ও হয়তো শেষ হয়ে গেল দেখতে হবে। ওকে এই প্রথম অবস্থাতেই যদি ওকে কোন ভাবে মদ্যপান থেকে আটকানো যায় তাহলে হয়তো নবারুণও পরে আর নাও ধরতে পারে’।
ধৃতিমান বলল, ‘নবারুণকে কে বোঝাবে সেটা? আমাদের কারো কথা ও শুনবে ভেবেছিল। এমনিতেই ও বরাবর একটু অন্তর্মুখী প্রকৃতির। আর নিজের মনে যেটা ভাবে সেটাই করে’।
রবি বলল, ‘নির্মাল্যর কথা ও হয়তো শুনলেও শুনতে পারে। নবারুণ তো সব থেকে পুরানো বন্ধু নির্মাল্যই। দুজনে এক সময় একসাথে লেখালিখি করত। এক সাথে নানা অনুষ্ঠানে যেত। নির্মাল্য একবার চেষ্টা করে দেখতে পারে’।
নির্মাল্য বলল, ‘সে সব বহু যুগ আগের কথা। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছর পর থেকে আমার কাছ থেকেও নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছিল, লেখালিখিও বন্ধ করে দিল। এমন কী সে কেন হঠাৎ এমন করে মদ ধরেছিল সেটাও আমার কাছে অজানা। গত কুড়ি বছর ধরে এই চায়ের দোকানে তোদের মতো ওর সাথে আমার যতটুকু যোগাযোগ। তোরা যখন বলছিস তখন আমি ওর বাড়ি গিয়ে চেষ্টা করব ব্যাপারটা বোঝাতে’।
চায়ের দোকানে কথা বলতে বলতেই এরপর অন্ধকার নামতে শুরু করল। স্ট্রিট লাইট জ্বলে উঠল। হরিদা আর এক রাউন্ড চা দিয়ে যাবার পর যে চা শেষ করে ধৃতিমান বলল, ‘আমাকে এবার উঠতে হবে। দিনের বেলা তো শ্বশানেই কেটে গেল। কাল থেকে আবার অফিস। সপ্তাহর বাজারটা করে রাখতে হবে। তবে নবারুণের ব্যাপারটা মাথায় চিন্তা রয়ে গেল। রঞ্জনার পিছন পিছন মদ না তাকে আবার টেনে নিয়ে যায়!’
আড্ডাটা আর সেদিন তেমন হল না। ধৃতিমান চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যে রবি আর বিজনও নিজের কাজে বেড়িয়ে গেল। নির্মাল্য একলা বসে রইল। তবে সবাই যে নবারুণের মদ্যপানের ভবিষ্যৎ চিন্তা নিয়ে গেল তা বুঝতে অসুবিধা হল না নির্মাল্যর।
৩
নির্মাল্য বসে বসে ভাবতে লাগলো পুরানো দিনের কথা। নবারুণের কথা, রঞ্জনার কথা। কৈশোরে একই সাথে লেখালিখি শুরু করেছিল। নবারুণ বিয়ের কয়েকবছরের মাথায় কবিতা লেখা ছেড়ে মদ্যপান ধরেছিল। নির্মাল্য ভেবেছিল সব নেশার রোগ কেটে যাবার পর নবারুণ হয়তো আবার লেখার জগতে ফিরে আসবে, কিন্তু নবারুণ আর কলম ধরেনি। নির্মাল্য অবশ্য একটা সংবাদপত্রের অফিসে চাকরি করার পাশাপাশি এখনও লেখে। লেখক হিসেবে বেশ কিছুটা নামও হয়েছে তার। নবারুণ যদি আজ লেখার সাথে যুক্ত থাকতো তবে সে আরও কোন বড় জায়গাতে যেতে পারত বলে নির্মাল্যর ধারণা। একসময় যেখানেই গল্প পাঠ, কবিতা পাঠের আসর বসত সেখানেই তারা দুজনেই ছুটতো। বিশেষত এই শীতকালে নানা বইমেলা গল্প পাঠের, কবিতার আসরে যেত তার। রঞ্জনার সাথে নবারুণের পরিচয় হবার পর থেকে সে সব জায়গাতে রঞ্জনাও গিয়ে হাজির হত। তেমনই এক গল্প পাঠের আসরে রঞ্জনাকে লেখা কবিতা সম্মিলিত প্রথম প্রেমপত্রটা নির্মাল্যর হাত দিয়ে সবার অগোচরে রঞ্জনাকে পাঠিয়েছিল নির্মাল্য। বিয়ের আগে রঞ্জনাকে নিয়ে নবারুণ একবার ডায়মন্ড হারবারে বেড়াতে গেছিল, আর নির্মাল্য তাদের সাথে গেছিল ভ্যানগার্ড হিসাবে। অন্য বন্ধুরা ভেবেছিল নির্মাল্য আর নবারুণ মনে হয় কোন গল্প কবিতার অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। যৌবনের সোনালি স্মৃতি সব।
তবে অন্য বন্ধুদের মতো নবারুণের নতুন করে মদ্যপান শুরু করার ব্যাপারটা নির্মাল্যর মনেও একটা আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। পুরানো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে নির্মাল্যর মনে হল নবারুণ এখন কী করছে? তার নেশা কি কেটেছে? নাকি নেশার কাটার পর আবার সে মদ খেতে শুরু করেছে?
পরপর টানা কদিন অফিস নির্মাল্যকে ছুটি দিয়েছে। বাড়িতে তেমন কোন কাজ নেই। নির্মাল্য চায়ের দোকানে এসেছিল রাত আটটা পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার জন্যই। আড্ডাটা তেমন হলো না।
‘আচ্ছা, নবারুণের বাড়ি গেলে কেমন হয়? হয়তো সে এখন একাকিত্ব কাটাবার জন্য কোন সঙ্গী খুঁজছে। এ সময় তার কাছে কারো থাকা দরকার। তাছাড়া সম্ভব হলে তাকে বোঝানোও যাবে বন্ধুদের দুশ্চিন্তার কথা’।
-এ কথা ভেবে নিয়ে নির্মাল্য কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে পড়ল চায়ের দোকান থেকে। পায়ে হেঁটে সে পৌঁছে গেল নবারুণের বাড়ির সামনে। বেশ বড় বাড়ি। সামনে একটা ছোট বাগানও আছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত রঞ্জনাই ওই বাগানের পরিচর্যয়া করত।
গেট খুলে বাগান পেরিয়ে নবারুণের বারান্দায় উঠে দরজাতে টোকা দিল নির্মাল্য। প্রথমে কোন মতে এল না। তবে দরজার পাল্লাটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। ভিতরে আলো জ্বলছে। পাল্লা ঠেলে নবারুণের ড্রয়িং রুমে পা রেখে নির্মাল্য হাঁক দিল ‘নবারুণ? আমি নির্মাল্য এসেছি’।
বাড়ির ভিতরের কোন ঘর থেকে এবার নবারুণের গলা শোনা গেল ‘কে নির্মাল্য! দু-মিনিট বস, আমি আসছি’।
নির্মাল্য বলল, ‘আচ্ছা আয়’।
জবাব দিয়ে নির্মাল্য তাকানো ঘরটার চারদিকে। বহুদিন পর আজ নির্মাল্য পা রাখল নবারুণের এ ঘরে। পরিপাটি ভাবে সাজানো ঘরটাকে একপাশে দেওয়াল ঘেঁষা টেবিলের ওপর রাখা আছে রঞ্জনার ফ্রেমে বাঁধানো একটা বেশ বড় ছবি। রঞ্জনা যেন সেই ছবির ভিতর থেকে তাকিয়ে হাসছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা সোফা। আর সামনে কাচের টপওয়ালা একটা ছোট টি টেবিল। নির্মাল্য সোফায় বসতে যাচ্ছিল হঠাৎ তার চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা নীল কাপড়ের ওপর রাখা নীল কাপড়ে বাঁধাই করা একটা খাতা। পুরানো খাতাটা দেখেই নির্মাল্য খাতাটা চিনতে পারল। এই খেড়োর খাতার মতো কাপড় মোড়ানো খাতাটাতেই এক সময় কবিতা লিখত নবারুণ! নবারুণ কি আবার তবে কবিতা লিখছে?
নির্মাল্য উৎসাহিত হয়ে খাতাটা তুলে নিল। একটা পাতার ভেতর কলম গোঁজা। সেই পাতাটাই নির্মাল্য খুলল। না সেখানে কবিতা নয় নবারুণ সদ্য কিছু লিখেছে সেখানে। নির্মাল্যর চোখ আটকে গেল লেখাটাতে। নবারুণ লিখেছে।
‘রঞ্জনাকে দাহ করে শ্বশান থেকে ফিরলাম। জীবনের একটা নিষ্ঠুর অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল আজ। বহু বছর পর আজ আমাকে এতো মদ্যপান করতে দেখে আমার বন্ধুরা সবাই নিশ্চিত আতঙ্কিত, ব্যথিত। তারা হয়তো ভাবছে রঞ্জনার শোকে কাতর হয়ে আমি আবার কুড়ি বছর আগের সেদিনে ফিরে যাব যেদিন আমি মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতাম। বন্ধুরা জানে না আবার আজকের এই শেষ মদ্যপান আমার নিজের প্রতি নিজে কথা রাখা। হয়তো বা কোন অসহায় মানুষের উদযাপন। আমার বন্ধুরা কোন দিন জানবে না কেন আমি মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতাম। যেদিন আমি প্রশান্ত আর রঞ্জনাকে আমার বাড়িতে এক বিছানায় দেখি সেদিন আমি সহ্য করতে পারিনি সে দৃশ্য। প্রতিবাদ করে কোনও ফল হতো না। প্রশান্তর রাজনৈতিক ক্ষমতা আর রঞ্জনার স্পৃহার কাছে আমি তখন অসহায়। আমাকে ওরা শাসিয়ে ছিল প্রতিবাদ করলে বধু নির্যাতনের মামলাতে আমাকে ওরা ফাঁসাবে। ভয়, লজ্জাতে সে কথা বলতে পারিনি। বললে হয়তো যে কথা কেউ বিশ্বাস করত না। আমি মদ ধরলাম। শুরু করলাম প্রচণ্ড মদ খাওয়া। বাড়ি ঘৃণা হত বলে রাস্তাতে পড়ে থাকতাম। রঞ্জনা আর প্রশান্ত যে আমাকে রাস্তা থেকে তুলে আনত তার পিছনে কারণ ছিল। আমি বাড়িতে থাকা অবস্থায় প্রশান্ত আমার বাড়িতে রাত কাটালেও প্রতিবেশীরা সন্দেহ করবে না। আমার বন্ধুরা মনে করে আমাকে মদ্যপান ছাড়ানোর কৃতিত্ব রঞ্জনার। ব্যাপারটা তা নয়। আমার যে সময় হঠাৎ একদিন মনে হল, এ আমি কী করছি? কেন নিজেকে এমন ভাবে শেষ করছি? তাতে ভবিষ্যতে রঞ্জনারই সুবিধা হবে। না আমাকে বাঁচতে হবে। দেখে যেতে হবে রঞ্জনার মৃত্যু। যেদিন তা দেখবো সেদিন তা উদযাপনের জন্য শেষ বারের মতো মদ্যপান করব। আর তারপর থেকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে মদ ছেড়ে রঞ্জনার মৃত্যু কামনা করেছি এই কুড়ি বছর ধরে। হয়তো ব্যাপারটা কাকতালীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আজ রঞ্জনার মৃত্যু দেখলাম আমি। নিজের কাছে নিজের দেওয়া কথা রাখতে শেষ বারের জন্য আজ মদ খেলাম। রঞ্জনা এখন মৃত। এখন আর রঞ্জনার প্রতি ক্ষোভ, ঘৃণা নেই আমার। সে আর এখন, বীর ভোগ্যা রঞ্জনা নয়। আমার মতো নিরিহ মানুষের রঞ্জনা’।
নবারুণের পাশের শব্দ শুনতে পেয়ে এরপর তাড়াতাড়ি খাতাবন্ধ করে যেটা রেখেছিল নির্মাল্য। নবারুণ ঘরে ঢুকলো, তার হাতে একটা ফুলের মালা। সে বলল, ‘বাগান থেকে ফুলে তুলে মালা গাঁথলাম’। -কথাটা বলে যে এগিয়ে গিয়ে মালাটা যত্ন করে পিয়ে দিল রঞ্জনার ছবিতে। তারপর সে আবার ফিরে তাকাল নির্মাল্যর দিকে। না তার মুখে কোন ঘৃণা জেগে নেই সেটা বুঝতে পারল নির্মাল্য। নবারুণ তাকে বলল, ‘ভয় নেই তোদের। আমি আর মদ ছোঁবনা। ভাবছি আবার কবিতা লেখা শুরু করব’।
গ ল্প ৮
হোম সার্ভিস
সৈকত মুখোপাধ্যায়
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
জুনমাসের ষোল-তারিখে বিকেল চারটে নাগাদ ফ্রি-লান্স জার্নালিস্ট ঈশিতা সেন রথতলা-স্ট্রিটের রেডলাইট এরিয়ায় গিয়েছিল এক প্রস্টিটিউটের ইন্টারভিউ নিতে। তান্ডব গরম ছিল সেদিন। এ.সি. বাসটা থেকে নামা মাত্রই ঈশিতার মনে হল ওর মুখটা ঝলসে যাবে। ওড়না দিয়ে মাথা ঘাড় সব ঢেকে নিয়ে বাড়ির ছায়ায় ছায়ায় ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল ও।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পার হয়ে রথতলা স্ট্রিট ধরে কিছুটা এগোনোর পরে ঈশিতা দেখেছিল, রাস্তার কলের গোড়ায় জমে-থাকা এক আঁজলা জলে বুক পেতে শুয়ে হ্যা-হ্যা করে হাঁপাচ্ছে একটা নেড়িকুত্তা। তার উতলা দুই চোখে পরিষ্কার মৃত্যুভয় দেখতে পেয়েছিল ঈশিতা।
ঈশিতার বয়স বেশি না। দু-বছর আগে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে জার্নালিজম নিয়ে পাশ করেছে। বিশুদ্ধ এক জার্নালিস্ট হওয়াই ওর চিরকালের স্বপ্ন। তাই অন্য কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দেয়নি।
তবে ইতিমধ্যেই ঈশিতা বুঝতে পেরে গেছে যে, চাকরির দুনিয়ায় জার্নালিজমের পরীক্ষাটা চলে অনেকদিন ধরে, প্রতিদিনের কাজের মাধ্যমে। যত বেশি নামি পত্রিকায় তোমার লেখা ফিচার ছাপা হবে, অন্য ছেলেমেয়েদের তুলনায় যত বেশি ছাপা হবে তোমার লেখা, ততই উজ্জ্বল হবে বিগ-হাউসে তোমার একটা স্থায়ী চাকরির সম্ভাবনা।
সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে ঈশিতা, তবে এখনো অবধি খুব একটা কিছু করে উঠতে পারেনি। আসলে এডিটরদের চোখে পড়ার জন্যে একটু অন্যরকমের বিষয় নিয়ে লেখা, একটু অন্যধরণের মানুষের ইন্টারভিউয়ের প্রয়োজন। কানের দুলের নতুন ক্রেজ নিয়ে লিখে আর উঠতি বাঙলা-ব্যান্ডের সদস্যদের ইন্টারভিউ জোগাড় করে খুব বেশি দূর এগোনো যায় না।
আজকের ইন্টারভিউটা নিয়ে ঈশিতা কিছুটা আশাবাদী। সি.ইউ-তে ওর সিনিয়র ছিল ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ধ্রুব দত্ত। ধ্রুবদা এখন এমন একটা এন.জি.ও.র সঙ্গে যুক্ত রয়েছে যারা প্রস মেয়েদের জন্যে লিলুয়াতে একটা হোম চালায়। আঠেরো-বছর বয়স অবধি মেয়েগুলো ওখানে থেকে লেখাপড়া, হাতের কাজ, এইসব শেখে। তারপর তাদের মায়েদের কাছে ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়। যেসব মায়েরা চায় না তাদের মেয়েরাও এই লাইনে নামুক তাদের জন্যেই ধ্রুবদাদের এন.জি.ও-টা কাজ করে।
তো, এই রথতলার গণিকা চায়না সাহা, যার কাছে আজ যাচ্ছে ঈশিতা, তার মেয়েও ওই হোমে ছিল। সেই মেয়ে এখন এম.এ পড়ছে। চায়না সাহা সেইজন্যে ধ্রুবদাকে ভগবান মানেন। ধ্রুবদাই ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে ঈশিতাকে বলেছিল, “দ্যাখ, আমার রেফারেন্সে যাচ্ছিস বলে ওপেন-আপ করতেও পারে। নাহলে সব বীভৎসতার কথা তো ওরা কখনোই কারুর সামনে খুলে বলে না”।
ঈশিতা বলেছিল, “মেয়েদের কাছেও বলে না?”।
“আজ্ঞে না। ভদ্রলোকের মেয়েদের কাছে বলে না। ভালোই করে। তোদের পত্রিকার পাঠকেরা রবিবারের সাপ্লিমেন্টে সেসব ঘটনার কথা পড়লে আর মাংস-ভাত খেয়ে দুপুরে ঘুমোতে পারত না।
“যেমন?”।
দু-বছরেই ঈশিতার মধ্যে কেমন যেন একটা জার্নালিস্টসুলভ নাছোড়বান্দা ভাব এসে গেছে। কোনো কিছুরই পুরোটা না জেনে শান্তি পায় না। সেইজন্যেই আবার ধ্রুবদার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “বলো না। যেমন?”
“যেমন তুই যখনই জিজ্ঞেস করবি এই পেশায় এলেন কেন, একটাই স্টক-উত্তর পাবি। প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম। তারপর সেই প্রেমিক বিশ্বাসঘাতকতা করে মাসির কাছে বেচে দিল ... এইসব বুলশিট। খুব কম প্রস্টিটিউট তোকে বলবে যে, তাদের বাবা কিম্বা দাদারাই তাদের রেড-লাইট এরিয়ায় জন্যে পাঠিয়েছিল; ওদের রোজগারের একটা বড় ভাগ যে এখনো দেশের বাড়িতে পাঠাতে হয়, সেটাও বলবে না”।
ঈশিতা মনে-মনে স্বীকার করে নিয়েছিল, ধ্রুবদার কথাগুলো একদম ঠিক। আজকের ইন্টারভিউটার গ্রাউন্ড-ওয়ার্ক করতে গিয়ে ও ইউ-টিউবে ওরকম অনেকগুলো ইন্টারভিউ দেখেছে। মোটামুটি সবই ওই বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকের উপাখ্যান।
ঈশিতা ভাবে, এখন দেখা যাক এই মহিলা যদি ধ্রুবদার কল্যাণে একটু আউট-অফ-দা-বক্স কোনো স্টোরি দেন। ওরকম কিছু ঝাঁকিয়ে দেওয়ার মতন স্টোরি-এলিমেন্ট আজ খুব দরকার ঈশিতার। ‘দেশকাল’ পত্রিকার সাব-এডিটর সৌমেন মুখার্জী বলে দিয়েছেন, এরপর থেকে জোলো লেখা নিয়ে এলে আর ছাপবেন না।
কিন্তু না ছাপলেই বা কী করে চলবে?
মাস্টার্স পাশ করার পরেই ঈশিতা বাবার কাছ থেকে মাসে-মাসে টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ইউনিভার্সিটির হস্টেলটাও ছেড়ে দিতে হয়েছে ওকে। এখন ও গড়িয়ার কাছে একটা পিজি-তে থাকে। নিজের খরচার কিছুটা চালায় যাদবপুরের কয়েকটা মেয়েকে পড়িয়ে আর বেশিরভাগটা এইসব খেপ লেখার পারিশ্রমিকে। কিছু লেখা যদি সৌমেন স্যারের হাতে নিয়মিত গুঁজে দিতে না পারে, তাহলে কলকাতায় থাকার খরচ উঠবে কী করে? আবার আরামবাগে বাবার কাছে ফিরে যাবে নাকি?
মনে-মনেই বলল, নো, নেভার। তারপর নতুন উদ্যমে ঈশিতা হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো। দুটো ক্যাওড়া-টাইপের ছেলে ওকে দেখে হাত দেখিয়ে রাস্তা পার হয়ে এদিকে আসতে যাচ্ছিল। ঈশিতা গম্ভীরমুখে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে লাইনের মেয়ে নয়। ছেলে দুটো কথা না বাড়িয়ে চলে গেল।
ঈশিতা দেখছিল এখানে রাস্তার দুপাশের প্রায় সবকটা বাড়িরই একরকমের ডিজাইন। চৌকো একটা উঠোনকে ঘিরে ফ্লোরগুলো উঠেছে। প্রত্যেক তলায় টানা-বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালে উঠোন দেখা যায়। বাড়িগুলোর রাস্তার দিকে কোনো বারান্দা নেই; খড়খড়ি বসানো জানলা রয়েছে। রাস্তা আর উঠোনের মধ্যে বিশাল সদর দরজা – যেটা বন্ধ করে দিলে বাড়ির অন্দরের সঙ্গে বাইরের আর কোনো যোগাযোগ থাকে না।
অথচ বাড়িগুলো নাকি বেশ্যাবাড়ি, চালু কথায় ‘কোঠাবাড়ি’ হিসেবেই বানানো হয়েছিল। তাহলে এত আব্রু কেন? তখনকার দিনের রাজমিস্ত্রিরা কি অন্যরকমের বাড়ির নক্সা জানতো না? ঈশিতা ঠিক করলো, লেখার মধ্যে এই পয়েন্টটা রাখবে। কিছু পাঠক মাথা ঘামাতে ভালোবাসেন – তাঁরা খুশি হবেন।
চায়না সাহার ঘর খুঁজে পেতে খুব বেশি সময় লাগেনি ঈশিতার। কয়েকটা নাইটি পরা কমবয়সি মেয়ে বালতি হাতে জল আনতে যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করতেই বাড়িটা দেখিয়ে দিল।
এই পাড়ার অন্য বাড়িগুলোর মতন এই বাড়িটার বারান্দাতেও সেই একই রকমের ভাঙা কাঠের রেলিং, নারকোল দড়ির বাঁধন দিয়ে যাদের ফাঁক ভরিয়েছে। জানলায় মিসিং খড়খড়ি। সেই একই রকমের স্যাঁৎলা ধরা দেয়াল, দেয়ালের গায়ে ড্রেনপাইপের ফাটলে বটগাছ। বাড়তির মধ্যে এই বাড়িটার সদর দরজার মাথায় কুলুঙ্গির মধ্যে একটা রঙচটা রাধাকৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে। এইসব কুশ্রীতা কি রাতের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়? তাই হবে। কিম্বা কামপোকার কামড় খেয়ে এখানে যারা আসে, তাদের হয়তো অত সুশ্রী-কুশ্রী বিচারের মতন অবস্থা থাকে না।
চায়নাদিকে কিন্তু বেশ দেখতে, গায়ের রঙ যদিও চাপা। মাঝবয়সি মহিলা, ঢলঢলে গড়ন। সবুজ স্লিভলেস ব্লাউজ আর চন্দন-রঙের একটা আটপৌরে শাড়ি পরে যখন দরজা খুললেন তখন প্রথম কথাই যেটা ঈশিতার মাথায় এলো সেটা হচ্ছে এনার ঠোঁটদুটো একটু পানের রসে লাল হলে ভারি মানাতো।
বাইরের ওই ঝা-ঝা রোদ্দুর থেকে ছায়া-ছায়া, ভিজে-ভিজে ঘরটায় ঢুকতেই শরীর জুড়িয়ে গেল ঈশিতার। দিব্যি ঘরখানা। চারিদিকে একবার চট করে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল ও। পেস্তা কালারের এলা রঙ করা দেয়াল। ড্যাম্পের দাগ ফুটে উঠেছে যদিও এখানে-ওখানে। একটা আলমারি। আলনায় পরিপাটি করে ভাঁজ করে রাখা কাপড়চোপড়। বিছানায় টানটান করে পেতে রাখা লাল বেডকাভার আর দুটো বালিশ। অ্যাটাচড বাথরুম থেকে সিট্রানেলা-অয়েলের সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছিল।
ড্রেসিং-টেবিলের ওপরে রাখা সস্তার মদের বোতল আর গ্লাসদুটোকে একবার ওর মনে হল মানাচ্ছে না; আবার পরক্ষণেই হল খুবই মানাচ্ছে। একজন হাফ-গেরস্থর ঘর কেনই বা গেরস্থকে অনুসরণ করবে?
চায়নাদির চোখদুটো খুব বুদ্ধিদীপ্ত। প্রথমেই ঈশিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ে হয়েছে?”
ঈশিতা ঘাড় নাড়লো। না।
“ছেলে বন্ধু আছে তো?”
ঈশিতা একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ, আছে। কেন?”।
পুরুষমানুষের শরীরটা না বুঝলে তুমি আমাদের এই পেশার মেয়েদেরও বুঝতে পারবে না। বলো, কী বলবে”।
ঈশিতা একটু খাতির জমাবার জন্যে বলল, “আপনাকে দেখতে খুব সুন্দর”।
যে উত্তরটা এলো, সেটা ও প্রত্যাশা করেনি। চায়না সাহা শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিতে-নিতে বললেন, “গায়ে-গতরে আছি বলছ তো? ব্যাটাছেলেরা এইরকম চেহারাই পছন্দ করে। তবে এর জন্যে একটা ওষুধ খাই”।
ঈশিতা বাস্তবিকই অবাক হয়ে বলল, “ওষুধ খান!”।
“হ্যাঁ। স্টেরয়েড না কী যেন বলে। ওই মোড়ের সিগারেটের দোকানেই বিক্রি হয়। অনেকেই খায়। খেলে শরীরটা একটু ফুলে যায়। তবে হার্টের প্রবলেম হয় শুনেছি। সে হলে হবে, কী আর করবো?”।
হ্যাঁ, ধ্রুবদার ভাষায় ‘ওপেন আপ’ করেছিলেন সেই গণিকা। হ্যাঁ, ভদ্রঘরের মেয়ের সামনেই। চোদ্দ বছরের চায়না-কে তার মামা নিজে হাত ধরে এই রথতলার কোঠাবাড়িতে বিক্রি করে দিয়ে যায়। তারপরে যে পদ্ধতিতে সেই অপুষ্ট মেয়েকে খদ্দেরদের ভোগের উপযুক্ত বানানো হয়েছিল চায়না সাহা তাও বলেছিলেন ঈশিতাকে, তবে ঈশিতা ওখানে বসেই ঠিক করে নেয় যে এই অংশটুকু সে লেখার মধ্যে থেকে বাদ দিয়ে দেবে।
ঈশিতার বানিয়ে আনা প্রশ্নমালার মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল এইরকম – ‘আচ্ছা, অনেকে বলে, এই পেশাটার মধ্যে একটা নেশা আছে। এই প্রতিদিনের পুরুষসঙ্গ, এটা ছেড়ে নাকি আপনারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চান না’।
প্রশ্নটা শুনে চায়নাদি ঈশিতার দিকে করুণাঘন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলেন, “ওটা গেরস্থবাড়ির সেক্সের ধারনা। এখানে পুরুষ মানুষেরা অন্যরকমের খিদে নিয়ে আসে ভাই। সেই সেক্স অন্যরকম। ক্রিম না লাগালে আদরের জায়গা থেকে জল বেরোয় না, রক্ত বেরোয়। নিজের রক্ত দেখতে কেউ ভালোবাসে?”।
‘আদরের জায়গা’। চায়নাদি কথার মধ্যে যতবারই ভ্যাজাইনাকে আদরের জায়গা বলে রেফার করছিলেন, ততবারই ঈশিতার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠছিল। ঈশিতার নিজের সেক্স নিয়ে খুব একটা শুচিবাই নেই। ও সেই কলেজের প্রথম বছর থেকে যুবক-বন্ধুদের কাছাকাছি থেকেছে। কাজেই ওর নিজের শরীরের খিদে পেলে শরীরকে ও উপোসে রাখেনি।
কিন্তু সেই যুবকদের কাছে নয়। ঈশিতা সত্যিকারের সঙ্গমসুখ পেয়েছে এক প্রৌঢ় অধ্যাপকের আদরে, যার বয়স পঞ্চাশের ওপর। তিনি যে-বিস্ময়ে, যে কৃতজ্ঞতায় ঈশিতাকে বহুক্ষণ ধরে আদর করতেন, তাতেই ঈশিতা ভেসে যেত; সত্যিকারের ক্লাইম্যাক্সের অনেক আগেই। সেই প্রৌঢ় প্রেমিকের দৃষ্টিতেই ঈশিতা বুঝেছে নারী-শরীরটা শুধু লোভের নয়, কতখানি আদরের হতে পারে। ‘আদরের জায়গা’ শুনে বারবার সেই অধ্যাপকের কথা মনে পড়ছিল ঈশিতার। চায়নাদির কি কোনোদিন সেরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে? হয়েছে নিশ্চয়ই। জীবনে অন্তত একবার। নাহলে ওরকম বলবেন কেন?
“আপনি এখনো এত কষ্ট করছেন কেন? মেয়ে তো দাঁড়িয়ে গেছে” জিজ্ঞেস করেছিল ঈশিতা।
“দায় কি কম? মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। একটা ফ্ল্যাট কিনতে হবে। অনেক টাকার ব্যাপার। পারবো কিনা জানি না”।
ঈশিতা ওর ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছিল। মোবাইলের রেকর্ডার বন্ধ করে এবার উঠে দাঁড়ালো। রাত হওয়ার আগে এই জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে না পড়লে কপালে দুঃখ আছে। তবু ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করল, “কেন? পারবেন না মনে হচ্ছে কেন?”
“খদ্দেরপাতি তো দিন-কে-দিন কমে যাচ্ছে। কত মেয়ে এই পাড়া ছেড়ে পালাচ্ছে জানো?”।
ঈশিতা ওড়নাটা বুকের দিকে টেনে নামিয়ে বলল, “সেটা কেমন করে হয়? সবাই সাধু হয়ে গেল নাকি?”
চায়নাদি খিলখিল করে হেসে ফেললেন। বললেন, “সাধু কেন হবে? চুলকুনি বাড়ছে ছাড়া কমছে না। কিন্তু ওদিকে হোম সার্ভিস শুরু হয়ে গেছে যে। আমরা পঁচিশবছর আগে জানতাম, এই পেশায় কাজ করতে গেলে বাঁধা মহল্লায় ঘর ভাড়া নিতে হয়। এখন তো সেসব কিছু নেই। খদ্দেরের সঙ্গে হোটেলের ঘরে গিয়ে উঠছে। ঘর ফাঁকা থাকলে খদ্দেরের নিজের বাড়িতেই চলে যাচ্ছে। এমনকি গাড়ি চেপে ওই যে ‘লং-ড্রাইভ’ না কি যেন বলে, তার মধ্যেই ব্যবসা করে নিচ্ছে কত মেয়ে”।
ঈশিতা হঠাৎ জমে পাথর হয়ে গেল। এইদিকটা তো ও কখনো ভেবে দ্যাখেনি। হ্যাঁ, ঠিকই তো। বেশ্যাপাড়াগুলোর মৃত্যুঘন্টা তো বেজেই গেছে।
ওদিকে চায়না সাহা বলে চলেছিলেন – “আজকাল কে বেশ্যা আর কে ভদ্রঘরের বউ, বুঝতে পারবে না ভাই। আমাদের কাছে সব খবরই আসে তো। বাচ্চাকে স্কুলে ঢুকিয়ে, ছুটির আগেই একটা খেপ মেরে এলো। টাকা আছে না লাইনটায়... প্রচুর টাকা। বড়লোক কাস্টমারদের কাছে ঘরের বউদের ডিমান্ডও বেশি। আমাদের মতন ফুকো দিয়ে ফোলানো শরীর তো নয়; স্বামীর আদরযত্নে ডগমগে শরীর সব ওদের”।
বাইরে বেরিয়ে ঈশিতা দেখলো সন্ধে নেমে গেছে, কিন্তু রথতলা স্ট্রিটের বুকে তেমন লোকজন নেই।
সৌমেন স্যার নিজের ড্রইং-রুমে বসেছিলেন। ঈশিতা ঘরে ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ক্রিম-কালারের ডিসটেম্পারড দেয়ালে কয়েকটা চুপসানো বেলুন আর কাগজের শিকলি ঝুলছিল। ওনার ছেলের বার্থডে পার্টি ছিল কয়েকদিন আগে। ঈশিতা খবর পেয়েছিল, কিন্তু নিমন্ত্রণ পায়নি। সেই যোগ্যতা এখনো ও অর্জন করেনি।
আজ কি করবে?
বোঝাই যাচ্ছে ফ্ল্যাটে এই মুহূর্তে আর কেউ নেই। ঈশিতা জানতো, থাকবে না। থাকবে না বলেই সৌমেন স্যার আজকে ওকে লেখাটা নিয়ে বাড়িতে আসতে বলেছেন। এর আগে সবসময়ে অফিসেই দেখা করতে হয়েছে ওকে।
ঈশিতার হাত থেকে খামটা নিয়ে সাব-এডিটর সৌমেন মুখার্জী ভেতর থেকে চারপাতার ম্যাটারটা বার করে চোখ বোলালেন। মন দিয়ে পড়লেন। পড়তে পড়তে ওনার মুখে অল্প হাসি ফুটে উঠলো।
“গুড”, বললেন উনি। ম্যাটারটা খামে ঢুকিয়ে সেন্টার-টেবিলের ওপরে সযত্নে নামিয়ে রেখে আবার বললেন, “ভেরি গুড। অনেকগুলো আনএক্সপেক্টেড অ্যাংগেল রয়েছে লেখাটায়। এটা নিচ্ছি”।
তারপরে উনি নিজের সোফা ছেড়ে উঠে এসে ঈশিতার চেয়ারের পেছনদিক থেকে ঝুঁকে পড়লেন। বিনা ভূমিকায় ঈশিতার কামিজের গলার কাছ দিয়ে হাতটা ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, “তুই খুব সুন্দর রে মেয়ে। আজ একটু থাক না আমার সঙ্গে। ভয় নেই, বাড়ি পৌঁছে দেবো। থাকবি?”।
ঈশিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, শুকনো-গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”।
“খুব ইচ্ছে করছে। বুঝিসই তো”।
অন্যদিন হলে কী বলতো ঈশিতা জানে না। ল্যাডারের ওপরে ওঠার জন্যে নিজের মেধার মতন নিজের শরীরটাকেও সে হয়তো ব্যবহার করতে পারতো। কিন্তু গতকাল রথতলার চায়না সাহার শেষ কথাগুলো তার চিন্তাভাবনার জগতে একটা বড়রকমের ওলোটপালোট করে দিয়ে গেছে নিশ্চয়। নাহলে এক মুহূর্ত আগেও যা সে ভাবেনি, সেই কথাগুলো তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে কেন?
ঈশিতা সরাসরি সৌমেন মুখার্জীর চোখে চোখ রেখে বলল, “ইচ্ছে করলে বেশ্যাবাড়ি যান না কেন? ওই মেয়েগুলো তো তাহলে একটু খেয়েপরে বাঁচে”।
তারপর লেখাটাকে ওইখানেই ফেলে রেখে, সৌমেন স্যারের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রাস্তায় নেমে এসেছিল ঈশিতা।
গ ল্প ৭
এক সকালের আমন্ত্রণে
বিশ্বনাথ বসু
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
আজ আর পেরে উঠল না সৌর্য্য। পারমিতার সঙ্গে বনিবনাটা অনেকদিন ধরে ভিন্ন সুরে বেজে চলেছে। তবে শেষরাতে যেভাবে তা ডেসিবেল থেকে ডেসিবেল ছাড়িয়ে সপ্তম সুরে চড়ল, তখন আর থাকতে না পেরে সৌর্য্য বেরিয়ে পড়ল। পারমিতা বাধা দেয়নি। বাধা দেয়নি কারণ, কোথায় যেন দুজনের ব্যবধানকে আজ বড্ড প্রয়োজন পড়েছে দুজনের। সদ্য গজিয়ে ওঠা কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাটটার থেকে আজ আরেকটু বেশি ব্যবধান যেন দুজনকে ডাক পাঠাল। পারমিতার উত্তপ্ত কথার ওপরে জাস্ট ট্রাকপ্যান্ট আর গেঞ্জি, তাও আবার যেটা বাজার যাবার জন্য সৌর্য্য গলিয়ে নিল। আসলে সৌর্য্যর অত বাছবিচার নেই, তবে পারমিতা খুব পারফেক্ট বাড়ি গোছানোর বিষয়ে। তিন ভাগে ভাগ করা সৌর্য্যর পরিধান। সাবধান একটা থেকে একটা এদিক ওদিক হলে সাইরেন বেজে উঠবে। ‘যতই মানুষ করার চেষ্টা কর। বনমানুষ কি মানুষ হতে পারে’।
লিফটের বাটন প্রেস করার পরও একথার বিষয়টা রাগের মগজে উঁকি দিচ্ছিল। পাসপোর্টটাকে নিয়ে বেরোবে। একেবারে হেথা নয় হোথা নয়। যতদূর চোখ চায়। কিন্তু মগজের কোন একপাশ থেকে কেউ বলে উঠছে শান্তি শান্তি। সামনে ঘটা করে লিফট খুলে শান্তিমাসির মুখ। তার চোখে প্রশ্ন এতো সকালে আবার কোথায়? সেটা শব্দ যন্ত্রের সাহায্যে পাওয়ার আগে গম্ভীর মুখে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সৌর্য্য। লিফট নীচের তলায় নিম্নগামী হওয়ার সময়, একবার ভাবল প্রশান্তটাকে ডাকবে। গাড়ি করে দিয়ে আসুক। দমদম এয়ারপোর্ট যা বা হাওড়া স্টেশন। না ট্রেনের থেকে প্লেনেই ভালো। কারণ লোকাল সীমানার গণ্ডি তাড়াতাড়ি টপকানো যাবে। আর ট্রেন সৌর্য্য পছন্দ করলেও, যে কারণে পছন্দ করে, সেই কারণটি ভাবতেও ইচ্ছা করছে না। কারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য। প্রতিকূলে যাওয়া ঘরবাড়ি। পুকুরঘাট দেখার ইচ্ছা আজ আর নেই।
আর নামা বাকি নেই। খুলে গেল লিফটের দরজা। সামনে মিস্টার গোয়েলের ছোট ছেলে।– ‘গুড মর্নিং, পরে ‘অলগুড’। সৌর্য্য মাথা নাড়ল। সৌর্য্যকে সাইডে রেখে চড়ে পড়ল লিফটে। সৌর্য্যর একটু ভার কমল। ‘এতো সকালে আঙ্কেল’ জিজ্ঞাসা করলেই ফ্যাসাদ হোত। হতেই বা কতক্ষণ! খক খক করে কাঁপতে কাঁপতে কাস্টমসের এক্স অফিসার প্রণব সরকার বলে উঠল- ‘কী ব্যাপার কোনও এমারজেন্সি না হলে…’ বলেই খক খক কাশি শুরু। কোন দীর্ঘয়িত আলাপের সুযোগ না দিয়ে সৌর্য্য এগিয়ে গেলো। ‘খুব এমারজেন্সি’। পরের প্রশ্ন আসার আগে প্রণববাবুর কাশি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল সৌর্য্যর বর্তমান সিচ্যুয়েশনকে। ধুর গাড়ি চালানোর মতো মানসিক অবস্থাও নেই। প্রশান্তকেই বা এতো সকালে কষ্ট দেওয়া কেন? বেচারা হয়ত শেষ বেলায় ঘুমে আচ্ছন্ন। স্ত্রী, মেয়েকে নিয়ে জীবনের সর্বসুখ আহরণ করছে। তার মধ্যে আমি কেন? জীবনের এই সময়গুলোতে মনে হয়- আমি ব্যতিত সবাই সুখী ও শান্তিতে জীবনধারণ করছে। রাতজাগা চোখ কচলিয়ে স্যালুট করল সিকিউরিটি। আরেকটা মাথা হেলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। দেখ, সবার কেমন ঘুম আছে। আমি ছাড়া। ভাগ্যিস আর কারুর সামনাসামনি হয়নি। না জানি কি উত্তর দিত সৌর্য্য। যেদুটো মাথায় এসেছে তা ব্যাকডেটেট। গঙ্গাস্নান যাচ্ছি। বড়মাইমা মারা গেছে। দুটোই রেলিভেন্ট আর পুণ্য। ক্ষতির দুটোই তেমন চাপ না থাকলেও লোকে কথা বাড়ায় না।
কথা বাড়াল না হলুদ ট্যাক্সির ড্রাইভার। ‘যাবেন দাদা’ বলতেই বসার কথা বলল সে। এবারে যেন গরমের রেগুলারেটার তিরিক্ষি মেজাজে রয়েছে। নামার নাম নেই। সেটা বুঝতে দেরী হল না সৌর্য্যর। পারমিতার সঙ্গে কথার চাপান উতোর যতই চলুক। এসিটা জানতে দেয়নি। ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল কোথায়? ‘চলুন না’- একটু আমতা আমতা করে সৌর্য্য দমদম এয়ারপোর্ট বলে উঠল। আসলে অফিস আর চেনা গন্ডির বাইরে দমদম দিয়েই সব জায়গা ঠিক হয় কি না এফএম সিজির বেচুবাবুর। সকাল পাঁচটার দিকে তেমন লোক নেই, কয়েকটা গাড়ি বাইপাস কানেক্টার ধরে যাচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যসচেতন মানুয জোরে, আস্তে মাঝারি অনেক রকমের হাঁটাচলা করছে। আবার মনে মনে বলে ওঠে- ‘দ্যাখো সারা রাতের সুখনিদ্রার পর কেমন শরীরটা করছে’। অনেকে আবার সস্ত্রীকও আছে। আরও মোচর দিয়ে ওঠে ভিতরটা। গাড়ির সামনের দিকে তাকায়। সামনে গ্লাসে চোখ পড়তে ড্রাইভারের মুখটা দেখে। সদ্য পক্স থেকে ওঠা একটা মুখ। কালো দাগে ভর্তি। ‘হ্যাঁ দাদা একমাস সাত দিন পর গাড়িতে হাত দিয়েছি। আজ নিয়ে তিন দিন’। আর কথা না বাড়িয়ে। সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিল সৌর্য্য। বাইরে চোখ পড়তেই দেখল এক বয়স্ক মহিলা ফুল তুলছেন রাস্তায় গজিয়ে ওঠা গাছ থেকে।
গাছ থেকে ফুল পাড়তে মাকে দেখিনি কখনও। সারা বছর ধরে মায়ের ফুলের পরিচর্চা চলতেই থাকত। তবে না বলে কেউ ফুল ছিঁড়লে মায়ের গলা চরত। পাইপের তলায় বসে রাস্তার ধারে চান করছে লরি-ট্রাক ড্রাইভার। কিংবা মুটে মজুর বা রাস্তা তৈরির লোকেরা। বেশ লাগে না! কর্ম কান্ড শরীরের জমে থাকা ক্লেদগ্লানিকে ধুয়ে মুছে আবার নতুন করে সাজিয়ে তুলতে। এটুকুই তো ছেলেদের প্রসাধন। কনককাকু নাটকের রিহার্সালে বলেছিল, ‘ব্যাটাছেলে হবে ব্যাটাছেলের মতো। দাড়ি কাটবে, গায়ে সাবান দেবে, বুকে বগলে পাউডার ব্যাস’। ঘুণাক্ষরে কাউকে গলায় মুখে পাউডার ক্রিম মাখতে দেখলে ব্যাঁকা কেষ্ট বলে ভেংচি কাটতেন। সৌর্য্য যখনই ক্রিম মাখে বা ফেসিয়াল করার সময় সাদা ক্রিমের প্রলেপে নিজেকে দেখেছে, কনককাকু ভেংচিকাটা মুখ কল্পনা করে হেসে উঠেছে।
হেসে উঠল ট্যাক্সি ড্রাইভার। তারপরে ‘সরি বলল’। ‘হাসলেন কেন’ সৌর্য্যর প্রশ্নে উত্তরে একটা হোর্ডিং দেখালো। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার হোর্ডিং । ‘দাদা আয়ুবেদিক চিকিৎসা করে আমার এই রোগটা সারল। ভাড়াবাড়িতে থাকি। ডাক্তার দেখানো যাবে না। প্রথমে আমার মেয়ের, আমার, আমার বৌদির...’ বৌদি মানে দাদা-ভাই একসঙ্গে থাকে। সৌর্য্যর বড় ইচ্ছে ছিল। যাই হোক। মাঝপথে কথা থামিয়ে দিয়ে সৌর্য্য বলে উঠল ‘ডাক্তার দেখানো যাবে না কেন?’ ‘দাদা পাঁচজনের সঙ্গে থাকি। সবাই বলে ‘ঠাকুর এসেছে শরীরে। ঠাকুরের স্নান করা জল খেলে সেরে যাবে’। ‘কোথায় থাকেন?’ গল্পের একটু পর্দা সরালো সৌর্য্য। একচিলতে সময়ের সঙ্গে বিগত তিনঘণ্টার অবসাদকে লুকাতে পেরেছে এই আলাপচারিতা। ‘বেলেঘাটা’। ‘বেলেঘাটায় এখন মানুষ চিকিৎসা না করিয়ে স্নান জল খায়’ ‘তারপর শরীর সারে না। মাকে ফোন করলাম। দীঘার কাছে বাড়ি। মা বলল আমার এখানে আয় ডাক্তার দেখিয়ে দিচ্ছি। কাজ করতে পারি না। শরীর সারে না। পালালাম বাড়ি। ঘরের বাইরের কাউকে জানালাম না। সোজা দেশের বাড়ি। মা বেলায় কবরেজ দেখাল। ওষুধ বলতে- সকালে জিরে ভেজানো জল। দুপুরে আটটা তুলসি বাটা। রাতে পান পাতার ওপর পাঁচ ফোটা মধু ব্যাস’। এক সপ্তাহে একদম চাঙ্গা। তা একটা কথা কবরেজ যদি পয়সা নিয়ে লিখে পাঠিয়ে নিত। আমি কলকাতা থেকেই সুস্থ হয়ে যেতাম’। সৌর্য্য ভাবে আমাদের প্রাচীন চিকিৎসার এখনও এতো জোর আছে।
শরীরের জোর কমে আসছিল সৌর্য্যর। কোথাও এসিতে ঘণ্টা পাঁচেক না ঘুমালে হবে না। এর মধ্যে সব জানা হয়েছে ড্রাইভার শ্যামলবাবুর। এক ছেলে হিন্দু স্কুলে পড়ে। মেয়েটি কেজি ওয়ানে। এতো ফারাক কেন? জিজ্ঞাসা করেনি। হাল্কা কথা বললেই বুকের ভারটা যেন উঁকি দিচ্ছে। বরং একটা গেস্ট হাউস, হোটেলে নিয়ে যেতে বলল সৌর্য্য। সেইমতো শ্যামলবাবু মৌলালি, ওয়েলিংটন, ধর্মতলা নিয়ে গেল। হোটেল কোথাও খালি নেই। যেটাই খালি সেখানে কলকাতার লোকাল আইডি প্রুফ এক্সেপটেড নয়। যাহ বাবা, এতো জানা ছিল না সৌর্য্যর। হোটেলে ঢোকার মুখে বাংলাদেশ থেকে আগত চিকিৎসার জন্য মানুষের ভীড়। অসুস্থরা কেউ ধুঁকছেন। কেউ কাঁদছেন। দেখে মনটা একটু শান্ত হল সৌর্য্যর। সবার সমস্যা আছে। শুধু সে নয়। জীবনের ওলটপালট অবস্থায় সবাই রয়েছে। ঠিক যেমন তাকে দেখে কেউ বুঝতে পারেনা। সেও সামনের মানুষের মুখ চোখ ভেদ করে অন্তরে জমে থাকা কালিকে স্পর্শ করতে পারছে না।
কাজ করা শান্তি মাসি হয়তো কাল সারা রাত চোখ ভেজাতে পারেনি। কারণ বরটা মদ খেয়ে ফেরেনি। প্রণব বাবুর খকখক কাশি হয়তো এতক্ষণ চিরতরে থেমে গেছে। রাতজাগা সিকিউরিটি এখন আবার কোথায় কাজ করছে। রাস্তায় সস্ত্রীক শরীরচর্চার মানুষটির পাশে তার হয়তো সেকেন্ডজন। যারা ফুল তুলছিল ঠাকুরকে তুষ্ট করতে, কারণ স্বামী বা সন্তানের ক্যান্সার যন্ত্রণা যেন কম হয়। রাস্তার ধারে পাইপে স্নান করা মানুষগুলো যখন বাড়ি ফিরবে তখন তার ঘরটা কোন ফনী উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে হয়ত। এই শ্যামলবাবুর স্ত্রী হয়ত শ্যামলবাবুর সেবা করেনি। তাই সে মায়ের কাছে ছুটেছিল। হিন্দুস্কুলে পড়া ছেলেকে বোঝাতে পারেনি আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রের গুণ। সবাই বয়ে বেরাচ্ছে তার শেষ রাতের, দিনের, সপ্তাহের পক্ষ। মাস, বছরের অতীত। শুধু সৌর্য্য কেন? মনে মনে বলে।
মনে মনে বলে চলা কমপ্লেক্সের নামটা শ্যামলবাবুকে শব্দ দিয়ে ছুঁড়ে দেয়। শ্যামলবাবু বলে ওঠেন ‘সুইট নেস্ট কী? হোটেল না গেস্ট হাউস?’ কিছু বলে না সৌর্য্য। শ্যামলবাবুর বুঝতে দেরি হয় না। বিন্দু যতই সিন্ধুতে বিস্তার করুক। গাড়ি সেই বিন্দুতেই এসে দাঁড় করায়।
গ ল্প ৯
বিষ নীল
মহুয়া মল্লিক
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
(এক)
সেলসের লাইনে মাসের শেষে মারাত্মক চাপ যায় , অঙ্কুশকে কাল রাত জেগে কাজ করতে হয়েছে । ফাইন্যাল রিপোর্ট তৈরী করে শুতে শুতে তিনটে বেজে গেছে । ভাগ্যিস আজ রবিবার , তাই একটু গড়িয়ে নিতে পারবে । সকালের মিঠে রোদ জানলা গলে অঙ্কুশের মুখের উপর লুটোপুটি খেতেই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল । পর্দাটা টেনে দিয়ে আরেকপ্রস্থ ঘুমবার তোড়জোড় করতেই ফোনটা বেজে ওঠে , হ্যাঁ মায়ের ফোন ।
-কীরে বাপি আসছিস তো আজ ?
-আহ মা , কাল তো বললাম , প্রতি সপ্তাহে এভাবে চন্দ্রপুর ছুটে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না ।
-প্রতি সপ্তাহে কোথায় আসিস তুই ? দেড় মাস আসিসনি । আজ তোর ছোট বোনের পাকা দেখা , তুই না এলে তোর কাকা কাকিমার কি ভালো লাগবে বল ?
অঙ্কুশ দেখল মা নাছোড়বান্দার মতই ঘ্যানঘ্যান করে যাবে । তার যে সত্যি মারাত্মক কাজের চাপ চলছে মা এটা বুঝবে না । দশটা পাঁচটা অফিস আওয়ার্সের বাইরে দায়িত্ব শেষ , মা এমনটাই মনে করে । মা যদি এখন তার এই শোবার ঘরটা দেখতে পেত , কফি আর সিগারেটের চড়া গন্ধে ভরে আছে এখনো জায়গাটা । রাত জাগতে হলে বারবার কড়া কফি চাই অঙ্কুশের ।-
-হ্যাঁ রে বাপি ? লোকজনকে আমি কি বলব ? সবাই যে তোর অপেক্ষায় আছে । তোর পিসিরা , ফুল কাকুরা সবাই কালকেই চলে এসেছে ।
অঙ্কুশ এবার কড়া গলায় জানিয়ে দিল , ঝিমলির বিয়ের থেকে তার কাজটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । মা যে তাদের কর্পোরেট দুনিয়া সম্পর্কে অজ্ঞ সে কথাটাও জানাতে ভুলল না । মা কষ্ট পেয়ে ফোন কেটে দিয়েছে । এছাড়া উপায় ছিলনা অঙ্কুশের । সে বোঝাতে পারেনা চন্দ্রপুর আর তাকে টানেনা । আর তাছাড়া সারা সপ্তাহ অফিস করে এই রবিবারটাই তারা পায় নিজেদের মত কাটাবার জন্য । হ্যাঁ চন্দ্রা আর সে নিজের মত কাটায় রবিবারটা । আর তাছাড়া এইসব গ্যাদারিং মানেই তার বিয়ের কথা উঠবে , আর বিয়ে মানেই সেই অদেখা মেয়েটা বারবার চলে আসবে ।
মেয়েটাকে যদিও তার ভালো ভাবে মনে নেই । কোন ছোটবেলায় কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিল । নোংরা একটা ফ্রক , মাটি মাখা হাত পা । বাবার হাত ছাড়িয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ধীরে ধীরে , আর তারপরেই ......
চন্দ্রার মেসেজ ঢোকে এইসময় , মেসেজ ক্লিক করার আগে ওর ছবির দিকে তাকায় অঙ্কুশ । ঘনঘন ডিপি বদলানো ওর হবি । কে জানে ব্যাঙ্কে ক্যাশ কাউন্টার সামলিয়ে মেয়েটা এত সাজার সময় কখন পায় ! নতুন ছবিটা সম্ভবত কাল রাত্রের তোলা । রুম পার্টনারের সঙ্গে কাল ডিনারে যাবার কথা ছিল ওর । সেখানেই মকটেলের লম্বা গ্লাসে সিপ করতে করতে তাকিয়ে আছে সামনে , চোখ দুটোই ছবিতে ধরা পড়েছে , বাকি অংশটা ব্লার করা । গাঢ় লাইনার , স্মোকি আইশ্যাডোতে চোখ দুটো অন্যরকম লাগছে । চন্দ্রার চোখ এমনিতেই অদ্ভূত , ধূসর মণির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না । তবু ঐ চোখের এক অমোঘ আকর্ষণ , যা অঙ্কুশকে জগত ভুলিয়ে দেয় । অঙ্কুশের ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে , মেসেজটা দেখে রিপ্লাই দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বে ।
একটা পিকচার মেসেজ । এক জোড়া সাপ শুকনো পাতার উপর একে অপরকে জড়িয়ে শুয়ে আছে । এডিট করে সাপের দেহের বর্ণ সাদা কালো করা হয়েছে , আর পাতাগুলো সোনালি রঙের । না এত শিল্প বোঝে না অঙ্কুশ । সাপ দেখলেই তার শরীর শক্ত হয়ে যায় । অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফোনটা সুইচ অফ করে দেয় সে।
( দুই)
চন্দ্রার আজ মন ভালো নেই । অঙ্কুশকে ফোনে না পেয়ে প্রথমে চিন্তা হয়েছিল । ছেলেটা সারাটা দিন ঘুমিয়ে থাকলে তারা একসঙ্গে সময় কাটাবে কখন ? সে যে সারাটা সপ্তাহ তাকিয়ে থাকে এই বিশেষ দিনটার দিকে । দুপুর দুটো অবধি ছটফট করতে থাকে সে । তারপর শাওয়ার নিতে ঢোকে । শরীরে বৃষ্টি বিন্দুর মত জলকণারা ঝাঁপিয়ে নামে । চন্দ্রা দেখে রূপালী জলকণা তার শরীর ছুঁয়ে ছিটকে যাচ্ছে ধূসর হয়ে , একসময় তা হয়ে যাচ্ছে কালচে রঙের । চন্দ্রা সেদিকে তাকিয়ে হাসে । মনটা একটু ভালো হয়ে যায় । নিজের উপর আত্মবিশ্বাস আরো অটুট হয় ।
দরজায় দুমদাম করে আওয়াজ হয়, তিতির চিৎকার করে , “ কখন ঢুকেছিস , আমি খাবার বেড়ে বসে আছি সেই থেকে”।
জিভ কাটে চন্দ্রা । তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে । প্লেটে ধোঁয়া ওঠা ভাত , সব্জী ডাল , পোস্তর বড়া আর মাছ ভাজা । চোখ তুলে তাকায় চন্দ্রা । তিতির চোখ নাচিয়ে বলে , “ ইয়েস তোর ফেভারিট মেনু , তোর রোমিও তো কুম্ভকর্ণের মত ঘুমচ্ছে , তোর মন খারাপ ভেবে বানালাম । নে খেয়ে নে , পরে শোধ করে দিস”।
চন্দ্রার খিদে পেয়েছিল । অন্যদিন সে চলে যায় অঙ্কুশের কাছে । দুজনে মিলে রান্না করে , স্নান করে , ঘর গোছায় । চন্দ্রা অনেকদিন চেয়েছে ওর ফ্ল্যাটে উঠে যেতে । অঙ্কুশ আপত্তি করেছে । এই আপত্তির কারণটা যে কী , সে বোঝে না । অঙ্কুশ তো তাকে পাগলের মত ভালবাসে । তবে এক এক মুহূর্তে কেমন যেন গুঁটিয়ে যায় , তখন বড্ড অচেনা মনে হয় ওকে ।
“ তুই কি , খেয়ে বেরবি ?”
তিতিরের প্রশ্নের চট করে উত্তর দিতে পারেনা সে । তাদের সন্ধ্যে বেলায় মিট করার কথা। কিন্তু মন এর অস্থির হচ্ছে , খেয়ে উঠেই সে বেরিয়ে যাবার ইচ্ছা । মৃদু কন্ঠে বলে , “দেখি”।
অঙ্কুশের বাড়ির দরজা যে বন্ধ পাবে ভাবেনি চন্দ্রা । কোথায় গেল ছেলেটা ? এই দুবছরে এমন ঘটনা কোনদিন ঘটেনি । তাহলে কি চন্দ্রপুর চলে গেল সে ? সর্বনাশ ! অসহায়ের মত হাঁটু ভেঙে দরজার কাছে বসে পড়ে চন্দ্রা । মন কেন কু ডাকছে ? তবে কী ! না , না অঙ্কুশ তো শুধু তার , অঙ্কুশকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব । এক এক সময় মনে হয় , কোথায় কোন অন্ধকারের গর্ভে লুকিয়ে ছিল সে , শুধুমাত্র অঙ্কুশের জন্যই এই পৃথিবীতে এসেছে সে । সেই অঙ্কুশ কি একটু একটু করে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ? শরীর ক্রমশ ভারী আর ঠান্ডা হয়ে আসে । নিশ্চল একটা সরীসৃপের মত মুখ গুঁজে পড়ে থাকে চন্দ্রা দরজার বাইরে অঙ্কুশের অপেক্ষায় ।
(তিন)
মচমচ করে আওয়াজ ওঠে । অনেকটা পায়ের তলায় শুকনো পাতা গুঁড়িয়ে যাবার শব্দের মত । অঙ্কুশ সামনে তাকায় , আশে পাশে তাকায় । শুকনো পাতার মর্ম্মর ধ্বনি বাড়তেই থাকে । চারিদিকে বড় বড় গাছ , গাছেদের গুঁড়ি তাকে ঘিরে ধরেছে যেন । একসময় অঙ্কুশের চোখে পড়ে পাতার স্তুপে পা রেখে এগিয়ে আসছে সে । মুখে প্রসন্ন হাসি , চারটি বাহুর দুটিতে বীণা , এমন বীণা সে সরস্বতীর হাতে দেখেছে । একটি হস্ত বরাভয় প্রদর্শন করছে আরেকটি হাতে সাদা একটি সাপ ধরা । এছাড়া সারা শরীরে অলঙ্কারের মত জড়িয়ে আছে শ্বেত সর্প , সেই সর্প যেন অঙ্কুশের উপস্থিতি টের পেয়ে জিভটা চিরিক চিরিক করে বার কয়েক বার করে নিল । অঙ্কুশের নজর আটকেছিল বীণা দুটির অপূর্ব কারুকাজের দিকে । কিন্তু সাপ দেখেই একটু একটু করে শরীর শক্ত হয়ে আসছিল । সভয়ে দু পা পিছিয়ে আসতেই ঠাণ্ডা কিছুতে পা পড়তেই চমকে তাকায় অঙ্কুশ , একটা বিষাক্ত সাপের গায়ে পা দিয়ে ফেলেছে সে , ক্রুদ্ধ নাগিনী কন্যা ফোঁস করে ফুঁসে উঠেছে কি ওঠেনি , সেই তিনি বিদ্যুত গতিতে এগিয়ে এসে অঙ্কুশকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ক্রুদ্ধ নাগিনীর দিকে কয়েক পলক তাকাতেই সে ফণা নামিয়ে চলে যায় । অঙ্কুশ এবার একটু সহজ হয় , মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করতে চায় , “ কে তুমি ?”
ঘামে ভিজে যায় অঙ্কুশ । ধড়ফড় করে উঠে বসে । একটু জল পেলে ভালো হত । এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে । কে এই অদ্ভূত মহিলা ? বারেবারে তার স্বপ্নে আসে ? এবং এভাবেই বিপদসংকুল পরিবেশ থেকে তাকে উদ্ধার করে মিলিয়ে যায় । অবশ্য সবটাই স্বপ্নে । তবে আজকাল বড় অস্বস্তি হয় । ভাবছে শহরের নামজাদা সাইক্রিয়াটিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ।
“ এই নে দাদাভাই , জল”। ঝিমলি এক গ্লাস ঠান্ডা জল এগিয়ে দেয়।
ঝিমলি , ও এখানে কী করে এলো ? ওর না আজ পাকা দেখা ! ততক্ষণে ঝিমলি লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে । উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেছে ঘর । মনে পড়ে যায় সব অঙ্কুশের । মায়ের ডাক উপেক্ষা করতে পারেনি অঙ্কুশ , বেলা বাড়তেই ড্রাইভ করে চলে এসেছিল চন্দ্রপুর । ওকে দেখে সবাই ভীষণ খুশি । সব কিছু ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে , ওর ক্লান্ত মুখ দেখে কেউ আর বিয়ের কথা তোলার সাহস পায়নি । একদিকে ভালোই হয়েছে ।
“দাদাভাই , চল উঠোনে সবাই জমাটি আডডা বসিয়েছে । তুই গেলে আরো জমে যাবে”। মুখে চোখে জল ছিটিয়ে একটু আরাম হয় অঙ্কুশের । স্বপ্নের কথা সে ভুলে যায় দ্রুত । উঠোনে চায়ের কাপ হাতে জমাটি আসর বসে গেছে । অঙ্কুশ সেখানে পৌঁছানো মাত্র পিসিদের চোখে চোখে কথা হয়ে যায় । মাকে দেখতে পায়না সে । রান্নাঘরের দিকে তাকাতেই দেখে মা ব্যস্ত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে , পাশে একজন মেয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে । একটু পরে মায়ের গলা শোনা গেল , “ ঝিমলি , মুড়ির ঠোঙাগুলো নিয়ে যা তো”। আমতেল আর তেলেভাজা দিয়ে মায়ের হাতে মুড়ি মাখা , আহা সে কী স্বাদ । নড়েচড়ে বসে অঙ্কুশ ।
দীর্ঘদেহী মেয়েটা এগিয়ে আসে । ফর্সা ত্বক ফেটে যেন হলুদ আর তেল গড়িয়ে নামছে । এমন দ্যুতিময় ত্বক হতে পারে বাস্তবে কোনও মেয়ের ? ও যত এগিয়ে আসে অঙ্কুশের নাকেমুখে ঝাপটা মারে একটা পদ্মগন্ধ । মুড়ির ঠোঙাটা অঙ্কুশের হাতে তুলে দিতে দিতে মেয়েটা হাসে । মেয়েটার চোখও সেইসঙ্গে হেসে ওঠে । আরে এ তো সেই মেয়েটা , স্বপ্নে দেখা সেই চার হাতের মেয়েটা , কোথায় তার রূপোর বীণা ? খুঁটিয়ে দেখে মেয়েটাকে অঙ্কুশ । শরীরে সাপও তো নেই , একটা হাল্কা হলুদ রঙের শিফন শাড়ি জড়িয়ে আছে তনুদেহ । নিচু হয়ে মুড়ির ঠোঙা তুলে দেবার জন্য ব্লাউজের মধ্য থেকে লাফিয়ে নেমেছে রূপোর চেন আর পেন্ডেন্ট , পেন্ডেন্টটি সাপের মত , বাম অনামিকায় রূপোর একটা প্যাঁচানো সাপ আংটি । শরীরে আর কোথায় সর্প ধারণ করে রেখেছে এই মেয়ে কে জানে ! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটা মেয়েকে এভাবে দেখা যে ঠিক হচ্ছেনা বুঝতে পেরে চোখ সরিয়ে নেয় সে ।
“ এই পদ্মা , একজনকেই মুড়ি খাওয়ালে হবে ? আমাদেরও একটু দেখ বাবু”। ছোট পিসির দুষ্টুমি শুরু হয়ে গেছে । অঙ্কুশ ভাবতে থাকে কে এই পদ্মা ? আর এই মেয়েটাই তার স্বপ্নে ওমন অদ্ভূত দর্শনা হয়ে বারবার আসে কেন ?
রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে অঙ্কুশ । কাল আবার সকাল সকাল অতটা ড্রাইভ করে ফিরে যাওয়া । মা আসে একটা প্যাকেট হাতে , টুকিটাকি নাড়ু , নিমকি , আচার প্রতিবারই ঠেসে দেয় । সেসব অঙ্কুশের ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে জিজ্ঞেস করে , “ পদ্মাকে পছন্দ তো ? দেখ বাবা আর না করিস না , ওরা আমাদের ভরসায় অপেক্ষা করে আছে”।
অঙ্কুশ সেই মুহূর্তে ভুলে যায় চন্দ্রার মুখ , চন্দ্রার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত । মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দেয় । মা ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় । অঙ্কুশের চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে নিজের ছেলেবেলার একটা অসহায় চিত্র । ভয়ে কাঁপতে ভুলে গেছে ছোট্ট অঙ্কুশ । তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে একদল মানুষ । কিন্তু তাদের মুখও ভয়ে সাদা হয়ে গেছে , সবাই তারা মূক বধিরের মত দাঁড়িয়ে আছে । সেইসময় একটি ছোট্ট মেয়ে সেই জটলার মধ্য থেকে বাবার হাত ছাড়িয়ে তার কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে , তার বাবা হুঁশ ফিরতেই চিৎকার করে ওঠে , “ ওরে পদ্মা আর এগোসনে মা , বড় বিপদ যে সামনে”! মেয়েটি তবু এগিয়ে আসে অঙ্কুশের কাছে, তারপর দুলে দুলে বলতে থাকে আমি পদ্মা , আমি পদ্মাবতী । আর আশ্চর্য , তারপরেই ......
মা দৌড়ে এসে মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয় । ডুকরে কেঁদে উঠে বলে , “ সাক্ষাৎ সাবিত্রী , সত্যবানের প্রাণ বাঁচালি মা”। তারপর ঘোষণা করে ফেলে , “ এই মেয়েকেই আমি পুত্রবধূ করব , আমার ছেলেটাকে সারাজীবন আগলে রাখবে”। বিয়ে কী বোঝার বয়স হয়নি অঙ্কুশের , তবে এই নোংরা মেয়েটাকে মা জড়িয়ে ধরেছে দেখে বড্ড হিংসা হয়েছিল । সেই পদ্মা এত সুন্দরী হয়েছে ? আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে অঙ্কুশের । চোখ বন্ধ করে সে পদ্মাবতীর গায়ের গন্ধ ভাবার চেষ্টা করে । ওদিকে ফোনটা ভাইব্রেট হতে থাকে , নীল আলো ছড়িয়ে পড়ে । তবু চন্দ্রার পাঠানো নীল আলো অগ্রাহ্য করে অঙ্কুশ পাশ ফিরে শোয় । চোখ ভারী হয়ে আসে সঙ্গে সঙ্গে ।
(চার)
অঙ্কুশকে ঘিরে ধরেছে ছোট বড় অজস্র সাপ । তাকে ঘিরে কিলবিল করে যাচ্ছে ওরা , কেউ কেউ পা বেয়ে উপরে উঠে আসছে , অঙ্কুশ গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । ওর ভয়ার্ত চোখ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কাকে যেন খোঁজে । গলাটা পেঁচিয়ে ধরে একটা সাপ , আর একটা ততক্ষণে কোমরে সরসর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে । আতঙ্কে দুচোখের মণি ঠিকরে বেরিয়ে আসে তার । ঠিক সেই মুহূর্তে মা এসে পড়ে । অঙ্কুশকে নাগপাশে বন্দী দেখে মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে আসে , “ আমার অভিশাপে ছেলেটার মুক্তি নেই , সব আমার কপাল”। একটা গাছের গুঁড়িতে মা ক্রমাগত নিজের মাথাটা ঠুকতে শুরু করে । অসহায় অঙ্কুশ কিছুই করতে পারেনা , এই দৃশ্য দেখা ছাড়া । সেইসময় ঝড় ওঠে , অন্ধকার বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজি পাগলের মত দুলতে থাকে । শুকনো পাতার স্তুপ উড়তে থাকে , দু একটা পাখি নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায় অজানা ত্রাসে ।
পদ্মাবতী এসে দাঁড়ায় মায়ের পাশে । চার হাতে যথাক্রমে বীণা , সর্প আর জগতের উদ্দেশে বরাভয় । পরনে সবুজ একটা শাড়ি , আঁচল উড়ছে ঝড়ো হাওয়ায় । এ কি পদ্মাবতী ? নাকি তার মত অন্য কেউ ? মায়ের কানের কাছে মুখ রাখে পদ্মাবতী । ফিসফিস করে কী যেন বলে । মায়ের মুখেরর জমাট অন্ধকার দূর হয়ে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে । মা অঙ্কুশের কাছে চলে আসে , ছেলের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে এক অমোঘ মন্ত্র । অঙ্কুশ বিড়বিড় করে ওঠে , “ ওঁ ইলিমিত্তে তিলিমিত্তে ইলিতিলিমিত্তে দুম্বে দুম্বালীয়ে তর্কে তর্করণে মর্মে মর্মরণে কশ্মীরে কশ্মীরমুক্তে অঘে অঘনে অঘনাঘনে ইলি ইলীয়ে মিলীয়ে ইলিমিলীয়ে অক্যাইএ অপ্যাইএ শ্বেতে শ্বেততুণ্ডে অনঅনুরক্তে স্বাহা”।
অঙ্কুশকে ঠেলা দেয় চন্দ্রা , “ এই বিড়বিড় করছ কেন ? শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মাল্টিপ্লেক্সে ঘেমে জবজবে অঙ্কুশ ফ্যালফ্যাল করে বিরক্ত চন্দ্রাকে দেখে । চন্দ্রা জড়িয়ে বসেছিল তাকে , কখন যেন ওকে ছেড়ে সরে বসেছে । সন্দিগ্ধ ভাবে তাকিয়ে আছে অঙ্কুশের দিকে। এই অন্ধকারেও ওর চোখদুটো জ্বলে উঠল কয়েক পলকের জন্য । অন্যদিন হলে এই চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে যেত অঙ্কুশ , আজ অসীম সাহস ভর করেছে তাকে । কোনক্রমে বলে , “ আমি কোথায় ?” ভালো করে তাকিয়ে দেখে আশেপাশে মা বা পদ্মাবতী তো নেই । বরং পদ্মের গন্ধে ছেয়ে আছে চারপাশ । চন্দ্রা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে পড়ে , অঙ্কুশকে একবার তাকিয়ে বলে ওঠে , “ ডিসগাস্টিং , পাগলের ডাক্তার দেখাও”।
ব্যাক সিটে মাথাটা এলিয়ে দেয় অঙ্কুশ । কেন যে বারবার এমন স্বপ্ন দেখে সে । চন্দ্রপুর থেকে ফিরে এসে চন্দ্রাকে কদিন এড়িয়ে চলছিল কাজের বাহানায় । কিন্তু চন্দ্রা নাছোড় , আজ জোর করেই তাকে টেনে এনেছিল মাল্টিপ্লেক্সে । আজকাল চন্দ্রাকে সহ্য করতে পারেনা অঙ্কুশ । চন্দ্রা কাছে টানতে গেলে আতঙ্কে হিম হয়ে যায় , ওর চোখের দিকে তাকালে দমবন্ধ হয়ে আসে । চন্দ্রাও আজকাল কুটিল দৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকে । “ তোমার সঙ্গে কি সেই মেয়েটার এবারে দেখা হয়েছে ? আমাদের সম্পর্কের পরিণতি কী হবে অঙ্কুশ ?”
অঙ্কুশ পাশ কাটায় , “ কোন মেয়ের কথা বলছ তুমি ? আর এই সম্পর্কের পরিণতি নেই জেনেই তুমি এগিয়ে এসেছিলে কিন্তু”। চন্দ্রা সন্তুষ্ট হয়না এই উত্তরে । হিসহিস করে ক্রদ্ধ নাগিনীর মত সারা ঘরে ঘুরে বেড়ায় ।
আমাদের সমাজ যতই এগিয়ে যাক , ডিজিটাল ইন্ডিয়া কিন্তু এখনো সাইক্রিয়াটিস্ট বলতে পাগলের ডাক্তার বোঝে । কী কুক্ষণে যে চন্দ্রাকে ডক্টর দেবসেনার কথা বলে ফেলেছিল সে। প্রথমে তো শুনেই জিজ্ঞেস করেছিল , “ কী স্বপ্ন দেখ তুমি ? যে সাইক্রিয়াটিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করতে যেতে হবে ? তুমি আমার কাছে ঠিক কী লুকাচ্ছ বলতো ?”
স্বপ্নে দেখা সেই অদ্ভূত মেয়েটার কথা চন্দ্রাকে বলতে পারেনি সে । একসময় হলের আলো জ্বলে ওঠে । একে একে সবাই উঠে পড়ে । অঙ্কুশও তাদের পিছনে পিছনে হেঁটে আসে সিঁড়ি বেয়ে । পিছনে ছায়ারা দীর্ঘ হয় , সে হদিশ রাখেনা কেউ ।
(পাঁচ )
পদ্মা এসেছে আজ এ বাড়িতে । মাঝে মাঝেই আসে সে অঙ্কুশের মায়ের কাছে । আজ এসেছে জরুরি তলবে । অঙ্কুশের মা কেমন যেন অসহায়। পদ্মাকে চা জলখাবার সাজিয়ে দিচ্ছে অন্যদিনের মতই , কিন্তু কিছুই বলছে না । অঙ্কুশের মা খুব ভালো আলুর পরোটা বানায় , ছোটবেলা থেকে যখনই এ বাড়িতে এসেছে এটাই সে কাকিমার কাছে আবদার করে । আলুর পরোটা খেতে খেতে পদ্মা বলে , “ কী বলবে বলে তুমি ডেকেছিলে , এখনও তো সেটাই বললে না কাকিমা”। অঙ্কুশের মা ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে ইশারায় চুপ করতে বলে । চারিদিকে কাজের লোকের ভিড় , ওরা চলে যাক তারপর বলবে । ফিসফিস করে বলে , “ বলব বলেই তো তোকে ডেকেছি পদ্মা , তবে এত ভিড়ে কথা হবেনা , আজ রাতটুকু থেকে যা , কাজের লোকরা যে যার নিজের মত ফিরে যাক তারপর ……”।
“তাহলে আমার বাবাকে বরং একটা ফোন করে দাও । আর রাত্রে কিন্তু গোবিন্দ ভোগ চালের ভাত , ঘি , ডাল সিদ্ধ আর গোল গোল করে কাটা আলু ভাজা খাওয়াতে হবে”। পদ্মাবতীর মুখে লাবণ্য আর সারল্য মিলেমিশে রূপকথা রচনা করে । অঙ্কুশের মা মনেমনে বলে , পাগলী মেয়ে একটা । মেয়েটার এক মাথা চুলে আদর মাখাতে ইচ্ছা করে , দু পা এগিয়ে এসেও সভয়ে পিছিয়ে যায় । নিজেই জানেনা কীসের এই ভয় ? চোখের সামনে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে দেখা মেয়েটাকে কীসের ভয় ? ইদানিং পদ্মাবতীকে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে দেখে অঙ্কুশের মা ।
এত বড় বাড়িতে রাত্রে অঙ্কুশের মা , বিশ্বস্ত কাজের লোক আরতিদি আর নাইট গার্ড ছাড়া কেউ থাকেনা । একে একে সবাই চলে গেলে , পদ্মাকে নিয়ে তিনতলার শোবার ঘরে উঠে আসে অঙ্কুশের মা । আরতি দিকে বলে আসে , তাদের কথা শেষ হলে নেমে আসবে , খাবার জন্য ডাকতে যাবার দরকার নেই ।
দরজা বন্ধ করে পদ্মাবতীকে পুরনো আমলের পালঙ্কে বসায় । সামনেই বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না , সেখানে পদ্মাবতীর ছবি প্রতিফলিত হয় , সেদিকে দুদণ্ড তাকিয়ে অঙ্কুশের মা ধীরে ধীরে পদ্মাবতীর কাঁধ স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করে , “ কে তুমি ?”
পদ্মার চোখে মুখে কৌতুক খেলা করে , সে উত্তর দেয়না । ঠোঁটের কোণে মৃদু একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখে । অঙ্কুশের মা অস্থির হয়ে ওঠে , আবার প্রশ্ন করে , “ কে তুমি ?” নিরুত্তর থাকলে তাকে ঠ্যাঁটা মেয়ে ভাববে কাকিমা , পদ্মা বলে, “ আমাকে চেন না তুমি ? আমি তো পদ্মা”। পদ্ম গন্ধে ভরে যায় ঘর । অঙ্কুশের মা সভয়ে দু’পা পিছিয়ে যায় এবার , “ হ্যাঁ এই গন্ধটার কথাই বাপি বারেবারে বলে”।
ও তাহলে ছেলে , মায়ের মাথায় এসব ঢোকাচ্ছে । পদ্মাবতী আগের মতই মৃদু হাসতে হাসতে পা দোলাতে থাকে । তার নূপুরের রিনিঝিনি আওয়াজ দিক বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে । অঙ্কুশের মা এবার পদ্মাবতীর হাতের কব্জী চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে , “ ছোটবেলার কথা মনে আছে তোর ? সেই যেবারে বাপিকে গোখরো সাপে ছোবল দিয়ে শেষ করে দিচ্ছিল , তুই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে সাপের চোখে চোখ রেখে বললি , আমি পদ্মাবতী , ওমনি ঐ বিষধর সাপ ফণা নামিয়ে চলে গেল !”
“ তোমার ছেলের সঙ্গে সাপের দেখাশোনা আর নতুন কি ? আঁতুড়েই তো কাল কেউটে ঢুকেছিল , সময় মত না দেখলে ……তারপরেও একবার সাপের কামড় খেয়েছিল দু বছর বয়সে । ভাগ্যিস সময়মত এন্টিভেনাম পড়েছিল , বেঁচে গেল সে যাত্রা”।
“ কিন্তু গোখরোর উদ্যত ফণার সামনে থেকে তুই ঐটুকু মেয়ে ওকে ফিরিয়ে এনেছিলি কী করে ? ছেলের স্বপ্নে কেন বারবার আসিস ? চার হাত , শ্বেত সর্প , রূপোর বীণা কোথায় রেখে এসেছিস বল আমায় ?”
পদ্মাবতী উঠে দাঁড়ায় । হাওয়ায় উড়তে থাকে লম্বা চুল । অঙ্কুশের মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ায় । মনে নেই তোমার সেই অভিশাপের কথা ? শাপমুক্তির জন্য কুলোপুরোহিতের কাছে ছুটে যাবার কথা ?
অঙ্কুশের মায়ের সামনে অতীত ফিরে আসে । কালো অতীত , কালো রাত । বাড়িতে সন্ধ্যে বেলায় অতিথি আসায় , নিজেই গিয়েছিল খিড়কি পুকুরে চাল ধুতে , কাজের লোকদের তখন ছুটি হয়ে গিয়েছিল । নিজে অন্তসত্তা তখন , ভারী শরীর নিয়ে অন্ধকারে বেসামাল হয়ে সাপের মাথায় পা দিয়ে ফেলে , মুহূর্তে মাথা চৌচির হয়ে মারা যায় সাপটি । সে রাত্রেই স্বপ্ন দেখে , তারই মত অন্তসত্তা এক রমণী , তীব্র স্বরে অভিশাপ দিচ্ছে , “ তুই যেমন আমায় আজ শেষ করলি , তোর সবও এভাবেই শেষ হয়ে যাবে”। ধীরে ধীরে সেই রমণী বিষধর সাপে পরিণত হয়ে যায় । সে রাত্রে ধড়ফড় করে উঠে বসেছিল সে , ঘেমে নেয়ে গিয়েছিল ,” পাপ , ভীষণ পাপ করেছে সে , এক মাকেই খুন করেনি সে তার গর্ভস্থ প্রাণও নষ্ট করে ফেলেছে”। সারারাত ঘুমতে পারেনা । যদিও পরের দিন দিনের আলোয় এই আতঙ্ক কেটে যায় , রাতের দুঃস্বপ্ন মনেও থাকেনা নানান ব্যস্ততায় ।
হুঁশ ফেরে দু’দিন পরে । যেদিন সাপের কামড়ে নীল হয়ে যাওয়া স্বামীর মৃতদেহটা দেখে । শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে গেলে , ছুটে যায় কুলোপুরোহিতের কাছে । তিনি সব শোনেন , স্মরণ নিতে বলেন দেবী জাঙ্গুলীর । একমাত্র তিনিই রক্ষা করতে পারেন তাকে । দেবী স্বপ্নে আসেন , বিপদমুক্ত হলে মন্দির প্রতিষ্ঠার আদেশ দেন । সেই আদেশ ভুলে গেছিল কেমন করে ?
সব মনে পড়ে যায় অঙ্কুশের মায়ের । পদ্মাবতীর দিকে তাকায় , “ তুই এত জানলি কী করে ? আমি যা ভাবছি তুই কি তাই ?”
পদ্মাবতী হেসে ওঠে । “ তুমি মা আমি মেয়ে এর থেকে বড় পরিচয় আর কিছু নেই। আমি কথা দিচ্ছি আমি থাকতে তোমার ছেলের কোনো ক্ষতি হবেনা”। নিশ্চিত বোধ করে অঙ্কুশের মা , একটা শুভদিন দেখে তাড়াতাড়ি চার হাত এক করে দিতে হবে ।
(ছয়)
দেখ তো এইরকম দেখতে কিনা ? প্রফেসরের বাড়িয়ে দেওয়া ছবিটার দিকে তাকিয়েই চমকে ওঠে অঙ্কুশ । হ্যাঁ এই দেবীমূর্তিকেই তো সে বারেবারে স্বপ্নে দেখে, শুধু মুখটাই যা পদ্মাবতীর মত । ডক্টর দেবসেনা হাল্কা কিছু নার্ভের মেডিসিন দিয়ে বলেছিলেন , ঐ মেয়েটি আপনার সাবকন্সাস মাইন্ডে রয়ে গিয়েছিল তাই বারবার তাকে দেখেন , এটা নাথিং সিরিয়াস । অঙ্কুশ বলার চেষ্টা করেছিল , বড় হবার পর সে পদ্মাবতীকে দেখার বহু আগে থেকেই স্বপ্নে এ মুখ দেখে আসছে । ডক্টর ব্যাপারটা গুরুত্ব দেননি , বলেছিলেন এমন তো হতেই পারে আপনার কল্পনা আর বাস্তব এক্ষেত্রে মিলে গেছে। অহেতুক জটিল করে ভাবছেন কেন ? বরং তিনি চিন্তিত ছিলেন , এই মূর্তির বর্ণনা শুনে। এ নিছকই কল্পিত মূর্তি নয়। প্রফেসর হদিশ দিতে পারেন এই চার বাহু বিশিষ্ট মূর্তির , তাঁর কাছেই পাঠিয়েছিলেন অঙ্কুশকে ।
প্রফেসর তাকিয়ে থাকেন অঙ্কুশের মুখের দিকে । নিঃসন্দেহ হয়ে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করেন , এই মূর্তি দেবী জাঙ্গুলির । ব্জ্রযানী বৌদ্ধরা এই দেবীর সাধনা করত । সর্প দংশন থেকে রক্ষা এবং সর্প দংশন করলে সেই বিষ বিনষ্ট করে দিতেন জাঙ্গুলী । তাঁর নাম শুনলেও সাপ পালিয়ে যায় , এমনই বিশ্বাস ছিল বৌদ্ধদের । জাঙ্গুলী মূর্তির নানারকমের বর্ণনা পাওয়া যায় । গাত্র বর্ণ সাদা , হরিত বা পীত । তিনি একমুখী এবং চতুর্ভুজা , শ্বেত সর্পের অলংকারে ভূষিতা । দুটি প্রধান হস্তে ধারণ করেন বীণা , দ্বিতীয় দক্ষিণ হস্তে অভয়মুদ্রা প্রদর্শন করেন আর দ্বিতীয় বাম করে একটি শুক্ল সর্প ধারণ করেন ।
অঙ্কুশ চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ে স্বপ্নে দেখা নারীমূর্তির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে । প্রফেসর বলতে থাকেন একটা বিশেষ মন্ত্র । এই মন্ত্রটি একবার পাঠ করলে সাত বছর সাপের দর্শন মেলেনা । আত্মস্থ করে রাখলে সারাজীবনেও সাপ ধারেকাছে আসবেনা । মন্ত্রটি লিখে কবচ রূপে ধারণ করলেও একই ফল পাওয়া যায় । ওঁ ইলিমিত্তে তিলিমিত্তে ইলিতিলিমিত্তে……প্রফেসর মন্ত্রটি আওড়াতে থাকেন । অঙ্কুশ বলে ওঠে হ্যাঁ এই মন্ত্রই স্বপ্নে শুনেছি আমি । প্রফেসর শান্ত চোখে কয়েক পলক দেখেন অঙ্কুশকে , তারপর বলেন , দেবী জাঙ্গুলীকে হিন্দু দেবী মনসার সমগোত্রীয় মনে করা হয় ।
অঙ্কুশ শান্ত মনে ফিরে আসে । বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে চন্দ্রার সঙ্গে মুখোমুখি বসে ওকে সবটাই জানিয়েছে। মেয়েটা সেদিন আশ্চর্য শান্ত ছিল । শুধু যাবার আগে বলেছিল , সামনের রবিবার তোমায় আইবুড়ো ভাত খাওয়াব , এটুকু অনুরোধ অন্তত রাখবে ! অঙ্কুশ আপত্তি জানায়নি।
চন্দ্রা এসেছে আজ । টিফিন ক্যারিয়ারে সাজিয়ে এনেছে অঙ্কুশের প্রিয় পদ্গুলি । যত্ন করে সাজিয়ে খেতে দিয়েছে।
-এসব তুমি নিজে বানিয়েছ ?
-কিছুটা আমি , কিছুটা তিতির । দুজনে মিলে ইউটিউব দেখে ইলিশের প্রিপারেশান আর ধনিয়া চিকেনটা বানিয়েছি”।
-তুমি খাবেনা ?
-উঁহু , আইবুড়ো ভাত তো তোমার ।
অঙ্কুশ দেখে ধূসর মণি দুটি ঈষৎ বিষণ্ণ যেন । আসলে অঙ্কুশ খেয়াল করেনা ঐ মণিতে লুকানো আছে গতজন্মের বিষ , যা পায়েসের বাটিতে মিশে গেছে আজ । একটু একটু করে বিষাক্ত পায়েস অঙ্কুশ বিশ্বাসে মুখে তুলে নিচ্ছে । পায়েসের বাটিটা টেনে নেওয়া মাত্রই তার ফোনটা বেজে উঠল । চন্দ্রা লাফিয়ে উঠে ফোনটা সুইচ অফ করে দেয় ।
“কাকিমা , ও তো ফোন ধরছে না , এখন তো সুইচড অফ বলছে । আমার কিন্তু ভালো লাগছেনা মোটেই”।
-আমারও তো মনটা সকাল থেকেই অস্থির হয়ে আছে , তাই তোকে ডেকে পাঠালাম ।
-ড্রাইভার কে ফোন করো । আমাদের এখুনি বেরতে হবে।
অঙ্কুশের মা আর অপেক্ষা করেনা । নকুলকে ফোন করে ব্যাগ গুছিয়ে নেয় । অঙ্কুশের ফ্ল্যাটের এক সেট চাবি তার কাছে থাকে সেটাও ব্যাগে নিয়ে নেয় । বিপদের আঁচ পেয়ে আড়াই ঘণ্টার পথ নকুলদা প্রায় দু ঘণ্টায় উড়িয়ে এনেছে । কলিং বেল বাজিয়ে অহেতুক সময় নষ্ট না করে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে আসে ওরা ।
অঙ্কুশ কার্পেটের উপর লুটিয়ে আছে । মুখে গ্যাঁজলা । তার মানে বিষের কাজ শুরু হয়ে গেছে ! নাক টেনে বাতাসের গন্ধ নেয় পদ্মাবতী । প্রমাণ খোঁজে , ডাইনিং টেবিল পরিপাটি গোছান , কণা মাত্র চিহ্ন ছড়িয়ে নেই কোথাও । ফ্ল্যাটের অন্যান্যরাও ততক্ষণে চলে এসেছে , অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে দেওয়াও হয়েছে । পদ্মাবতী , অঙ্কুশের সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওর মাকে হাত তুলে বরাভয় দেয় , ভয় নেই আমি এসে গেছি , সব ঠিক হয়ে যাবে ।
সে রাত্রেই অঙ্কুশ বিপদ্মুক্ত হল । ছেলের কাছে মাকে রেখে পদ্মাবতী একাকী বেরিয়ে পড়ে , একটা কাজ তার এখনও বাকি ।
শেষে ……
চন্দ্রা ফোনটা পেয়ে বোকার মত নেমে এসেছিল নিচে । আশেপাশে কেউ নেই , কল ব্যাক করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল । নাম্বারটার অস্তিত্বই নেই । অথচ এই নাম্বার থেকেই একজন মহিলা ফোন করে ডেকেছিল , “ আমি সব জানি , অঙ্কুশকে তুমি মেরেছ , বাঁচতে চাইলে এখুনি নিচে নেমে এসো”-ঠিক এ কোথাগুলোই বলেছিল ঠান্ডা স্বরে । চন্দ্রা বার কয়েক এদিক ওদিক দেখে ফিরে যাওয়া ঠিক করল , লিফটের দিকে দু পা এগিয়েছে কী এগোয়নি একটা বেজি তার শরীরে ঝাঁপিয়ে পরে , মুহূর্তেই মধ্যে তার গলার নলি কেটে ছিন্নভিন্ন করে দেয় । একটি চিৎকার করার অবকাশও দেয়না তাকে । চোখ বুজে আসার আগে চন্দ্রা দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী , চার বাহু , শরীরে সর্প , এ তো দেবী জাঙ্গুলী ! দেবীর মুখে ক্রুর হাসি , হাসতে হাসতেই তিনি তাকে ছেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান ।
পরের দিন সমস্ত খবরের কাগজে এই মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ বেরয় । কেউ জানেনা মানবী নয় আসলে মৃত্যু হয়েছে এক সর্পকন্যার । আর এই মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুছে গেল এক অভিশাপের করাল ছায়া ।
গ ল্প ১০
সন্তরন
বৈশাখী ঠাকুর
অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
সন্দীপবাবুর দৃঢ় পণ ওনাকে মেদ ঝরাতেই হবে। রোগা হতেই হবে। তা ওনার মধ্যপ্রদেশ ইদানীং এতই স্ফীত হয়ে পড়েছে যে জনসমাজে বেরোতে লজ্জা লাগে নিজেরই। কোন জামাকাপড় পড়ে শান্তি নেই। গুঁজে সব ফিটফাট হয়ে বেরোনোর পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ওপরে ওঠা। তারপর একসময় বাধ্য হয়ে প্যান্টের ওপর শার্ট ফেলে দিতেই হয়। সব কাপড়ই যেন ভুঁড়িতে খেয়ে নেয়।
চিরকালই উনি স্বাস্থই সম্পদ একথা বিলক্ষন মেনে এসেছেন। তাই প্রয়োজনের বেশী ভাল মন্দ খেয়ে নিজের শরীর ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন অনবরত। হালে অফিসের কাজের দরুন কিছুদিন আরব দেশে ছিলেন। শেখেদের দেশ---খালি জলেরই যা অভাব ! না হলে ঐশ্বর্য বিত্তের শেষ নেই। যে হোটেলে থাকতেন সেখানে জলখবারের সাথে বিনামুল্যে ফলের রস –আখরোট- কাজু –কিসমিস -পেস্তা –মেওয়া এসবও সাজানো থাকত প্লেটে।বাঙ্গালির ছেলে ---কত আর এসব জিনিস খেয়েছেন । আর দেশে যা আকাশছোঁয়া দাম! পূজাপার্বণে ওই পায়েস চাটনিতেই যা টুকটাক মুখে আসত। কখনও সখনও নেমন্তন্ন বাড়িতে পোলাও রান্না হলে তাতে ফাঁকে ফোঁকরে কিছু কিছু কাজু কিশমিশ উঁকি মারত! সেগুলো এমনভাবে যদি মুখের সামনে সাজানো থাকে তাহলে কারই বা শখ হবে না এসব পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার! তা দুপুরেও অনেক সময় এই ড্রাই ফ্রুটস পেট পুরে খেয়ে উনি দিন কাটিয়েছেন।যতটা পুষ্টি শরীরকে দেওয়া যায় আর কি! তাই শুনে অবশ্য সন্দীপ বাবুর মা অবশ্য শয্যা নিয়েছিলেন। হাপুস নয়নে কেঁদে কেঁদে পাড়া পড়শী –আত্মিয়স্বজন সকলকে বলে বেড়িয়েছেন, ----- খোকা আমার ভাত খেতে পায়না গো! কি কষ্ট করেই না আছে। দুটো কাজু কিশমিশ পেস্তা বাদাম খেয়ে পড়ে থাকে! তা আত্মীয় স্বজন –পাড়াপড়শী সকলেই ওনার সমব্যাথী হয়েছেন!সত্যিই তো! কি কষ্টেই না খোকা আছে!দুটো ভাত পেটে না পড়লে বাঙালি ছেলেদের চলে!
তা সেই খোকা যখন শেষমেশ অফিসের কাজ শেষ করে দেশে ফিরলেন ---তার আপেলের মত লাল গাল--- চওড়া বুকের ছাতি--- স্ফীত পেট বাগিয়ে এগিয়ে চলেছেন -----এই চেহারা দেখে তখন তাঁকে বাঙ্গালির ঘরের ছেলের থেকে গদিতে বসা মাড়ওয়ারির ব্যাটা অনেক বেশী মনে হচ্ছিল।
তা হপ্তা খানেক বাদেই অবশ্য লালচে আভা মিলিয়ে গেল। রুপোলী পর্দা সম গ্ল্যামার উধাও।কলকাতার আবহাওয়ায় কেবল থলথলে দেহ আর স্ফীত মধ্যপ্রদেশ নিয়ে সন্দীপবাবু রয়েছেন। আড়ালে ছেলেছোকড়ারা জলহস্তী নাকি কোলাব্যাঙ –কি নামে যে ডাকছে কে জানে! তবে হবার মধ্যে যেটা হল চেহারা দেখে কোন রিক্সা ডাকলে সাড়া দেয় না। উন্নাসিকের মত সন্দীপবাবুকে রাস্তার কীট পতঙ্গ জ্ঞান করে সাঁ করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। কোন টোটোয় উঠলে ডবল ভাড়া চায় কারণ পাশের সীটে কারোর আর বসার অবকাশ থাকে না। অটোতেও অনুরূপ অবস্থা। বাসে লোকে গালমন্দ করে এতখানি জায়গা জুড়ে বসার জন্যে। -------একাই বসবেন ভেবেছেন বাসে! মামদোবাজি নাকি ! অতই যখন শখ নিজে একা গাড়ি করে যান। পাবলিক বাসে গেলে অত জায়গা নিয়ে বসলে চলবে না। কি ভাগ্যি বলে বসেনি পাবলিক বাসে গেলে বাড়িতে বসে অত খাওয়াদাওয়া করা চলবে না। হয়তো দুদিন বাদে তাই শুনতে হবে! তাছাড়া রাস্তা ঘাটে আরও কত শ্লেষ বাক্য –ব্যঙ্গোক্তি শোনেন তার ইয়ত্তা নেই। সন্দীপবাবুর জীবন যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠল।
এর একটা বিহিত না করলেই নয়।ওই বিরাট দেহের কারণেই ঠিক করলেন বাড়ির সামনে জিমে ভর্তি হবেন।কিন্তু জিমের সময় এমন সব দিল যে সন্দীপবাবুর সাথে ম্যাচ করল না। অফিস কাছারি কষ্ট করে হলেও তো করতে হবে! শরীর চর্চা করতে গিয়ে যদি চাকরি ক্ষুইয়ে বসেন তাহলে তো ভারী মুশকিল। সত্যিই ভীষণ মুশকিলে পড়লেন সন্দীপ বাবু। তখন ওনার পড়শি পাকড়াশি বাবু বুদ্ধি দিলেন , -----আপনি সাঁতার কাটুন সন্দীপবাবু। সাঁতারের চেয়ে ভাল ব্যায়াম আর হয় না। ভোর বেলা গঙ্গা স্নানও হবে। সাঁতার কাটলে হাত পা –সারা শরীরের ব্যায়াম হবে। দেখবেন চড়চড় করে আপনার ওজন কমে গেছে। কথাটা মনঃপুত হল বটে সন্দীপবাবুর কিন্তু মুশকিল হল তিনি সাঁতার জানেন না। সেটারও অবশ্য একটা উপায় বাতলে দিলেন পাকড়াশিবাবু। ওনার অফিস থেকে ফেরার পথে নির্দিষ্ট একটা বাস স্টপে নেমে ওখানকার সাঁতার শেখার ক্লাবে ভর্তি হতে পারেন।সেটা ওনার অফিস যাতায়াতের রাস্তাতেই পড়বে। তাহলে সব দিক দিয়েই সুবিধে হবে। তা শেষ পর্যন্ত তাই সাব্যস্ত হল। অফিসটাও নিশ্চিন্তে করে তারপর ফিরতি পথে সাঁতার শিখতে যাবেন।
প্রথম দিন ওই বিশাল চেহারায় শুধু একটা সাঁতারের হাফপ্যান্ট পড়ে ওই নীল জলের পুলে নামতে বেশ লজ্জা লজ্জাই করছিল সন্দীপবাবুর । চারিদিকে তন্বী সুন্দরী যুবতী।মেদহীন সুঠাম চেহারার ঋজু পুরুষ। তবে লজ্জা— ঘৃণা –ভয় –তিন থাকতে নয়। অত ভাবলে চলবে না। তাছাড়া চেহারা ঠিক করার জন্যই তো আসা নাকি!এই ভেবে অতঃপর উনি জলে নামলেন।
সবে প্রথম দিন । তাই একটু আধটু ব্রিদিং ছাড়া আর কিছু করানো হল না। পরদিন দু পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে বলা হল যাতে জলে ব্যালেন্সটা তৈরি হয়। তা সেদিনই আচমকা উনি নজর করলেন স্বল্প সাঁতার বস্ত্রে সেই যুবতীকে।প্রথম দেখাতেই যেন প্রেমে পড়ে গেলেন---যাকে বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট! মুখ ঘুড়িয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে পা হড়কে জলে পড়েই গেলেন। তেমন জলে সড়গড় নন—মনে ভয়ও আছে তাই নিশ্চিতরূপে কিঞ্চিত খাবিও খেলেন আর ওই বিশাল বপু জলে খাবি খাচ্ছে দেখে হাসির হুল্লোড় উঠল পুলে । দেখার মত দৃশ্যই বটে! বড়ই লজ্জা পেলেন সন্দীপবাবু। সচেতন হলেন এমন ভুল আর যেন না হয়। তবে সাঁতারে আসার আকর্ষণ বেড়ে গেল দ্বিগুন। প্রথম মাসে তেমন কিছু শেখাও হল না আর ফলে ওজনও কমল না তেমন। কিন্তু নিজেকে যাকে ভালভাবে উপস্থাপন করা যায় সে বিষয়ে এখন বড়ই তৎপর তিনি ।ফাঁক পেলে অফিসের জিমেও মাঝেমধ্যে ঢুঁ মারেন।
চাকরি –লেখাপড়া কোন কিছুতেই পেছিয়ে নেই তেমন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন যাদবপুর থেকে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে। জোকা থেকে এম বি এ ---- তাও করে নিয়েছেন বুদ্ধিমানের মতন। মোটা মাইনের চাকরি করেন।বিয়ের বাজারে ওনার মত ছেলের চাহিদা তুঙ্গে।তা উনিও সেটা বিলক্ষন বোঝেন এবং জানেন। কিন্তু ওই ইলিনার মন জয় করার ক্ষেত্রে ওই চেহারাই যা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ, এতদিনে নামধাম সব জেনেছেন সন্দীপবাবু। তবে কৌশলে।
প্রতিদিন সাঁতারে নামার আগে প্রত্যেককে একটা ট্রেতে নিজের নিজের কার্ড জমা দিতে হয় আর একটা খাতায় নিয়মিত সই করাই দস্তুর ।বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করে একটু দেরিতে ঢুকে সইটা খেয়াল করেছেন প্রথমে। তারপর নাম জানার পর পুল থেকে ওঠার সময় একটু আগে উঠে ট্রে ঘেঁটে নিজের কার্ড নেওয়ার ছলে ছবি মিলিয়ে তার নাম ফোন নাম্বারে সব স্মরণে রেখেছেন আয়াসে । আসতে যেতে চোখাচোখি হয় বটে তবে সাহস করে কথা বলেননি কখনও। বরঞ্চ একটু হালকা হাসি হেসে দেখেছেন তেমন সাড়া না দিলেও মুখটা অবহেলায় অন্যদিকে ঘুড়িয়ে নেয়নি অন্ততঃ ইলিনা । দিনে রাতে এখন ইলিনার মুখই দেখেন তিনি। শয়ন স্বপনে ওই একই ছবি।ইলিনাকে পাওয়াই এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য –আর সব তুচ্ছ। আর যেন উনি নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। তার অজান্তে কত না স্বপ্নের জাল উনি বুনে চলেছেন মনের মধ্যে যার হিসাব নেই। একদিন শেষে থাকতে না পেরে একটু দুঃসাহসী হয়ে ফোনটা করেই ফেললেন। -----ইয়ে , মানে ইলিনা বলছেন তো। -----হ্যাঁ , আমি ইলিনাই বটে কিন্তু আপনি কে? -----ইয়ে মানে আমি। আমি আর কি। পলকে যেন নিজের নামটা মনে করতে পারছিলেন না সন্দীপবাবু। তীব্র নার্ভাস। মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। -----আমি তো বুঝলাম কিন্তু আমির নামটা কি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না। -----চেনেন। আপনি আমাকে চেনেন। রোজই দেখা হয় আপনার সাথে। ----কোথায় দেখা হয় ? -----কেন জলে! -----জলে! আমি কোন জলচর প্রানী নই। আপনি কি নেশা ভাং করেছেন। লাল জল খেয়ে জলের স্বপ্ন দেখছেন। -----না না ফোনটা রাখবেন না।সন্দীপবাবু বুঝতে পারছিলেন কেসটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। ----- জলে মানে বলতে চেয়েছি সুইমিং ক্লাসে। -----তা সেখানে আমাকে অনেকেই প্রপোজ করেছে।তিন নম্বর ওয়েটিং লিস্ট চালু হয়েছে। সেখানে মাঝামাঝি আপনার নাম আছে। তা আপনি কোন জন যদি একটু বলেন। -----আমি হচ্ছি--- ।বলেই থেমে গেলেন সন্দীপবাবু। কিভাবে নিজের পরিচয় দেবেন। নিজের চাকরি-ডেসিগনেশান ---এসব আগ বাড়িয়ে বলতে কেমন একটা কুণ্ঠা বোধ হয়। !এগুলো দিয়ে যে নিজেকে বোঝান যাবে না এক্ষেত্রে!কিন্তু ইম্প্রেশান জমানোর একটা ব্যাপার আছে বইকি! তাই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করলেন। -----আমি সন্দীপ। -----নাম তো আসলে কারুরই জানা হয়ে ওঠে না।নাম বললেও আপনাকে বুঝতে পারব না। আপনাকে দেখতে কেমন? ঠিক এটাই ভয় পাচ্ছিলেন সন্দীপবাবু।তবু কৌতুক করেই চেষ্টা করলেন।এতক্ষনে একটু ধাতস্থও হয়েছেন কিনা । ------ আমি ভূত নই কিন্তু কিম্ভুত/ আমার বিশাল বপু—একটু অদ্ভুত/দুটো হাত দুটো পা –একদম স্বাভাবিক/ বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে মান রাখব ঠিক। ------ ওরে বাব্বা ! কবি দেখছি। তা আমিও বড় ফাজিল –হাসি ফিকফিক/ চেহারাও একেবারে লিকপিক এদিকে আপনি বি—শা—ল অদ্ভুত- কিম্ভুত / আমি বুঝেছি আপনি একেবারে হোঁদল কুতকুত।
বলেই হাসির রোল তুলে ফোনটা রেখে দিল ইলিনা।
সন্দীপবাবু কিন্তু বড় মনে ব্যাথা পেলেন। তিন দিন ঘর থেকে বেরোলেন না। কোন খাবার মুখে তুললেন না।বুকের ভেতর একটা অব্যাক্ত কষ্ট। অপমানের জ্বালা ওনাকে যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ওনার কোমল মনের প্রেমকে এইভাবে পদদলিত করে চলে যাওয়া---- এ যেন কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তিনি । একেই তো নিজের চেহারা নিয়ে হীন্যমন্যতায় ভোগেন। তারপর পছন্দের মানুষের থেকে এমন লাঞ্চনা –অবমাননা –কিছুতেই যেন হজম হল না।তারপর একদিন সাঁতারে গিয়ে পেছন থেকে হোঁদলকুতকুত বলে টীটকিনি শুনে বড়ই মানে লাগল। ভীষণভাবে ভাবে মুষড়ে পড়লেন। নিজেকে একদম গুটিয়ে নিলেন।