top of page

ফিরে দেখা বঙ্গবিপ্লবী অগ্নিকন্যা সুনীতি চৌধুরী 

লিখছেন নিখিল মিত্র ঠাকুর


সুনীতি চৌধুরী ( ১৯১৭- ১৯৮৮)

১৯১৭ সালের ২২শে মে অধুনা বাংলাদেশের ত্রিপুরা জেলার কুমিল্লায় সুনীতি চৌধুরীর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম উমাচরণ চৌধুরী ও মাতা ছিলেন  সুরসুন্দরী চৌধুরী। উমাচরণ চৌধুরী সরকারী চাকরি করতেন। তার আদি বাড়ি ছিল ত্রিপুরা জেলার নবীনগর থানার ইব্রাহিমপুর গ্রামে। সুনীতি চৌধুরীর

দুই বড়ো দাদা কুমিল্লা কলেজে পড়াকালীন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই সুনীতি চৌধুরী ছোট থেকে বৈপ্লবিক আবহে বড় হয়ে ওঠেন। তার মনে স্বদেশ প্রেম জাগ্রত হয়।

১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে কুমিল্লায় যে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল সেই বিক্ষোভে তার অন্তর আলোড়িত হয়। ১৯৩০ সালে কুমিল্লায় আইন অমান্য আন্দোলনে জনতার উপর ইংরেজ পুলিশের নির্মম অত্যাচারে তার মন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তিনি ভাবতে থাকেন ইংরেজদের বিতাড়িত করতে না পারলে দেশে শান্তি আসবে না।

সুনীতি চৌধুরী তখন কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের কর্মকান্ড তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। স্বামী বিবেকানন্দের মাতৃভূমির জন্য জীবন দানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়েন। এইসময়  স্কুলের বড়দিদি প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্মের সাথে তার পরিচয় ঘটে। প্রফুল্ল নলিনী দেবীও তাকে গভীরভাবে বিপ্লবী হয়ে উঠতে প্রেরণা দেয়। তার হাত ধরে সুনীতি চৌধুরী যুগান্তর দলে যোগদান করেন। সহপাঠী শান্তি ঘোষ তার উৎসাহ বর্ধিত করে।

তিনি লাঠি খেলা ও ছোরা খেলা শিখতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়ে মযনামতীর পার্বত্য অঞ্চলে ঘন জঙ্গলের মধ্যে বিপ্লবী অখিলচন্দ্র নন্দীর তত্ত্বাবধানে রিভলবার চালানো শিখতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি বিপ্লবাত্মক স্বদেশী পুস্তক পড়তে শুরু করেন। এই সমস্ত বই পড়ে তিনি গার্লিন হত্যা,সিম্পসন হত্যার কথা জানতে পারেন। মনে মনে এইরকম কিছু করার জন্য অধীর হয়ে ওঠেন। তিনি শান্তি ঘোষ ও প্রফুল্ল নলিনী ব্রহ্মের সাথে হাত মিলিয়ে কুমিল্লায় ছাত্রীসংঘ গড়ে তোলেন। এই ছাত্রীসংঘে প্রায় ৬০ জন ছাত্রী যোগদান করে। তিনি ছিলেন ছাত্রী সংঘের ক্যাপ্টেন।



নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস যখন কুমিল্লা শহরে বক্তৃতা দিতে আসেন তখন তাকে স্বাগত জানানোর জন্য মেয়েদের কুচকাওয়াজে সুনীতি চৌধুরী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সম্মেলনের শেষে প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম ও তিনি নেতাজীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং নেতাজীর কাছে সশস্ত্র বিপ্লবে মেয়েদের সক্রিয় অংশগ্রহণের অনুমতি চান। নেতাজী তখন সশস্ত্র বিপ্লবে অস্ত্র হাতে মেয়েদের সামনের সারিতে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।এতে করে ছাত্রীসংঘের সদস্যগণ আরো উৎসাহিত হয়ে পড়েন।

ছাত্রীসংঘের এইসব ছাত্রীদেরকে আগ্নেয়াস্ত্র লুকিয়ে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এইসময় তিন অগ্নিকন্যা প্রফুল্লনলিনী, সুনীতি,ও শান্তি অতিরিক্ত আরো কিছু দায়িত্ব চাইছিলেন। মূলত তারা পুরুষদের সমান অধিকার চাইছিলেন। পুরুষ বিপ্লবীদের কেউ কেউ মহিলাদের অস্ত্রধারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সুনীতি চৌধুরী তখন তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠেন। তিনি বলেন এই পরিস্থিতিতে অস্ত্র ধারণ করতে না দিলে এত আরম্ভর করে আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না।

এইসময় পলাতক বিপ্লবীদের অন্যতম একজন ছিলেন বীরেন ভট্টাচার্য। তিনি গোপনে ছাত্রীসংঘের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি প্রফুল্ল নলিনী ব্রহ্ম, সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষকে অসম সাহসীনি বলে ঘোষণা করেন। সবে তখন তিন জন অগ্নিকন্যার অস্ত্রশিক্ষা শেষ হয়েছে।

অবশেষে এসে গেল তাদের অতিরিক্ত কিছু করার সুযোগ। বিপ্লবী দলের নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিলেন শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলি করে হত্যা করবে এবং তাতে করে অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের দম্ভের ভিত কেঁপে যাবে।  সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে শান্তিদেবী ও সুনীতি দেবী স্কুলে একটা সাঁতার প্রতিযোগিতার আমন্ত্রণ কার্ড দেওয়ার অজুহাতে স্টিভেন্সের বাংলোয় গিয়ে তাকে হত্যা করবে।

১৯৩১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর সকালে শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী একটা ঘোড়ার গাড়ি চেপে ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সের বাংলোয় গিয়ে পৌঁছালেন। চাপরাসীর হাতে ইন্টারভিউয়ের একটা কার্ড ধরিয়ে দিলেন। কার্ড পেয়ে স্টিভেন্স বাইরে বেরিয়ে এলেন। সুনীতি চৌধুরী তাকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়লেন। সুনীতিদেবীর গুলি লাগলো স্টিভেন্সের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে শান্তিদেবীর গুলি স্টিভেন্সের শরীর ঝাঁঝড়া করে দেয়। ফলে ওখানেই তার মৃত্যু হয়। স্টিভেন্সের রক্তাত্ব প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

কিন্তু, তারা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন না।সুনীতি চৌধুরীকে মাটিতে ফেলে বেশ কয়েকজন চাপরাসী অঝোরে লাথি, চড়, ঘুসি মারছে। আর রিভলবারটা কেড়ে নিতে চাইছে। শান্তি দেবী রিভলবার বের করে গুলি চালাতে গেলে পিছন থেকে একজন বিভলবার সহ তার হাত চেপে ধরে। অন্য কয়েকজন তাকে জাপটে ধরে। চাপরাসীরা তাদের ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও চরম মারধর করতে থাকে।  এমন সময় ডি আই বি ইন্সপেক্টর এসে তাদের মারধর থেকে রক্ষা করে দুজনকে আলাদা করে দেন। গুপ্তকথা বের করার জন্য চলতে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা জেরা। কিন্তু,

কোন তথ্য পুলিশ বের করতে পারেনি।

প্রথমে তাদের দুজনকে কুমিল্লা জেলে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়।  এখানে আঙ্গুলের ডগায় পিন ফোটানো থেকে শুরু করে তল্লাশির নামে শীলতাহানী পর্যন্ত করা হয়েছে সুনীতি চৌধুরীর। পরের দিনেই প্রফুল্ল ব্রহ্ম ও ইন্দুমতী সিংহকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা জেলে নিয়ে আসা হয়। খুব দ্রুত সুনীতি চৌধুরীর উপর নারকীয় অত্যাচারের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিপ্লবীরা সুনীতির ছবি দিয়ে একটা বই ছেপে বিলি করতে থাকে। সেই বইয়ে সুনীতি দেবীর ছবির নিচে লেখা ছিল " রক্তে আমার লেগেছে আজ সর্বনাশের নেশা"। তাই

কয়েক দিনের মধ্যেই শান্তিদেবী ও সুনীতি চৌধুরীকে কুমিল্লা থেকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে চালান করে দেওয়া হয়।

১৯৩২ সালের ১৮ই জানুয়ারী তাদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। তারা ভীষণ উৎসাহিত ছিলেন যে বিচারে তাদের ফাঁসি হবে। ক্ষুদিরামের মতো হাসতে হাসতে দেশের জন্য জীবন দেবেন, যাতে দেশের মানুষ ভয় ভুলে সমবেতভাবে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু,শান্তি দেবী ও সুনীতি চৌধুরীর বয়স তখন সবে ১৪ থেকে ১৫ ব্ৎসর। তারা ছিলেন অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরতা ও এ দেশের সংঙ্ঘা অনুযায়ী নাবালিকা। তাই চাইলেও অত্যাচারী ইংরেজ শাসক তাদের ফাঁসির আদেশ শোনাতে পারলো না। ১৯৩২ সালের ২৭শে জানুয়ারী তাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ শোনানো হয়। দুই বিপ্লবী অগ্নিকন্যা তখন রায় শুনে কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়েন।

অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের বিভেদ নীতি অনুযায়ী শান্তিদেবীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ও সুনীতি চৌধুরীকে তৃতীয় শ্রেণীর বন্দী করে রাখা হয়। তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীকে জেলে যে নারকীয় জীবন কাটাতে হতো তা

কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে চিন্তা করাই সম্ভব ছিল না। তাছাড়াও মাঝে মাঝে একসাথে রাখা হলেও অধিকাংশ সময় আলাদা আলাদা জেলে তাদের স্থানান্তরিত করা হতো। তবে তারা যেখানেই যেতেন নিজেদের সুরেলা গলায় দেশাত্মবোধক গান গেয়ে সহবন্দীদের মন মাতিয়ে রাখতেন।

তাদেরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রেসিডেন্সি, মেদনীপুর, হিজলী, রাজসাহী প্রভ‌তি জেলে রাখা হতো। তারা একবার মেদনীপুর জেলে জেলার ও মেট্রনের অনাচারের বিরুদ্ধে অনশনে বসে ছিলেন। এর ফলে জেলারকে যেমন অন্য জেলে বদলি করা হয়েছিল তেমনি তাদেরকেও ভিন্ন ভিন্ন জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ইংরেজ পুলিশ শুধু সুনীতি চৌধুরীর উপর নির্মম অত্যাচার করে ক্ষান্ত হয়নি। সুনীতি চৌধুরীর বাবার পেনশান বন্ধ করে দেওয়া হয়। দাদাদের বিনা দোষে জেলে ভরে দেওয়া হয়। চরম অভাবের সময়ে আত্মীয়রা সাহায্য করতে এলে তাদের ভয় দেখানো হয়। তার ছোট্ট ভাই অর্থ রোজগারের জন্য নিদারুণ পরিশ্রম ও অনিয়ম করার ফলে যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সুনীতি চৌধুরী জেলের ভিতর থেকে সব খবর পান। তবু কোনদিন ইংরেজ পুলিশের কাছে মাথা নত করে কোন তথ্য তাদের জানান নি।

দীর্ঘ সাত বছর পর ১৯৩৯ সালে তিনি রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে এম বি বি এস পাশ  করেন এবং ডাক্তারি শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে প্রদ্যেত কুমার ঘোষের সাথে তার বিয়ে হয়।

 
 
 

Comments


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page