top of page
Search

প্রাক্তন

আবীর গুপ্ত


(এক)

বিপাশা বেড়াতে ভালোবাসে, অ্যাডভেঞ্চারও ভালবাসে, তাই দু তিন মাস অন্তর অন্তর বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে, অ্যাডভেঞ্চারের লোভে। বসে আছে ছিটকুল্ বলে একটা গ্রামে, নদীর পাশে একটা কাঠের বেঞ্চিতে। ছিটকুল গ্রামটা হিমাচল প্রদেশের কিন্নৌর জেলায় অবস্থিত। এই গ্রামের পর আর কোন গ্রাম নেই, চিনের সীমান্ত শুরু হয়ে যাচ্ছে। মাত্র চারটি দোকান, তার মধ্যে একটি ধাবা, যার সাইনবোর্ডে লেখা আছে “হিন্দুস্তান কি আখরি ধাবা”। এই চারটি দোকান ক্রস করে বেশ খানিকটা পায়ে চলা পথ অতিক্রম করে তারপর নদী। প্রচন্ড স্রোত, সমানে জলের কুলকুল আওয়াজ, তার সঙ্গে নাম-না-জানা পাখির ডাক। ওর কাঁধের ব্যাগপ্যাকে একটা ডি. এস. এল. আর. পেনট্যাক্স ক্যামেরা, যার বডিতে 100 থেকে 600 জুম লেন্স লাগানো । আরো একটা ক্যামেরা আছে, যেটা ওর সবচেয়ে প্রিয়, নিকন পি 900। পেনট্যাক্স ক্যামেরায় যা জুম হয় তার থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি জুম হয় এতে। এটি সেমি ডি এস এল আর ক্যামেরা যার জুমিং পাওয়ার 83 এক্স। ব্যাগ থেকে ছোট্ট নিকনের স্পোর্টসস্টার বার্ড ওয়াচিং বাইনোকুলারটা বার করে চোখে লাগালো, বহুদূরে গাছের মাথায় যে পাখিটা ডাকছে চিনতে পারল - এশিয়ান গোল্ডেন ওরিওল। পাখিটা পুরুষ পাখি । ব্যাগ থেকে থার্মোস্টিল ফ্লাস্কটা বার করে কাগজের কাপে চা ঢেলে চুমুক দিল। এখানে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা, হোটেল থেকে বলেছে আর কয়েকদিন পরেই নাকি বরফ পড়া শুরু হয়ে যাবে।

চা খেতে খেতে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, লোকজন অর্থাৎ টু্রিস্ট প্রায় নেই বললেই চলে। ধাবায় বসে দুজন লোকাল আর একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক চা খাচ্ছেন। সম্ভবত ওই টুরিস্ট ভদ্রলোকের স্ত্রী, পুত্র আর কন্যা দূরে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে কারণ বাচ্চা মেয়েটি বারবার “ড্যাডি ড্যাডি” করে ভদ্রলোককে ডাকছে কিন্তু খরস্রোতা নদীর জলের আওয়াজে উনি শুনতে পাচ্ছেন না। বিপাশার এরকম ধারণা হয়েছে এই কারণে যে ভদ্রলোক উল্টো দিকে তাকিয়ে একমনে কিছু একটা দেখছেন। উনি কি দেখছেন? বিপাশা ওই দিকে তাকিয়ে বহুদূরে তিন জন মানুষকে কথা বলতে দেখল। দুজন পুরুষ আর একজন মহিলা, ড্রেস দেখে এরকমই ওর মনে হল। কৌতুহলবশে বাইনোকুলারে চোখ লাগালো। মহিলা অল্পবয়সী আর বেশ অ্যাকট্রাক্টিভ, ড্রেসটা যা করেছে তা ছেলেদের মাথা ঘোরানো পক্ষে যথেষ্ট। এবারে ছেলে দুজনের দিকে নজর দিল। প্রথমজনের মুখ ওর দিকে ফেরানো, মাঝবয়সী আর মুখে দাড়িগোঁফ আর সানগ্লাস। বাকি অংশ উলেন গার্মেন্টসে ঢাকা। দ্বিতীয়জনের পিছনটা দেখতে পাচ্ছে কারণ মানুষটি ঐ দাড়ি-গোঁফ সানগ্লাস পরা লোকটির সঙ্গে কথা বলছে। হঠাৎ মানুষটি মাথা ঘোরালো, নদীর দিকে তাকালো। বিপাশা চমকে উঠল, বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেল – এ তো শ্রীকান্ত! মুহুর্তের মধ্যে ওর মন চলে গেল অতীতে, তিন বছর আগে। ধীরে ধীরে ওর মুখে নেমে এলো বিষাদের ছায়া – এই অতীত মোটেই সুখকর নয়।ও ভুলতে চায়, কিন্তু পারছে কোথায়?

(দুই)

বিপাশা গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিল কলকাতার এক নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে। পড়াশোনায় খুব যে ভালো তা নয়, আসলে ভালো অ্রাথলেট্। তাছাড়া সুন্দর দেখতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিল প্লেয়ারস কোটায়। এম. এস. সি. পড়বে বলে ভর্তিও হয়েছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু পোস্ট গ্রাজুয়েশনটা করার আগেই হঠাৎই মডেলিংয়ে সুযোগ পেয়ে গেল। আর সেখান থেকে সিনেমার পর্দায়। অতি দ্রুত উত্থান। ওর চরিত্র কিন্তু বদলালো না, একই রকম রইল। প্রতি মাসে অথবা প্রতি দু-মাসে একবার বেরিয়ে পরতো ঘুরতে। যেখানে ট্রেকিং আছে, অ্যাডভেঞ্চার আছে, সেই সব জায়গা ওকে আকর্ষণ করতো।ছাত্রাবস্থায় বাবা-মার দেওয়া হাত খরচের টাকায় যা করতে পারত না, মডেলিংয়ের টাকায় সেই সব ইচ্ছা পূরণ করা শুরু করল। বিশেষ করে বেড়ানোর ইচ্ছা।

মডেলিংয়ের অ্যাসাইনমেন্ট ওকে যেতে হল নর্থ বেঙ্গলের নেওরা ভ্যালিতে কোলাখাম বলে একটা গ্রামে। অত্যন্ত সুন্দর গ্রাম। ন্যাচারাল বিউটি ওকে মুগ্ধ করল। এখানেই চার কিলোমিটার দূরে একটা ওয়াটার ফলসয়ের সামনে শুটিং হচ্ছিল। দুপুর বেলায় লাঞ্চ সেরে একাই হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিল জঙ্গলের ভিতর। সেইখানে হঠাৎই দেখলো ওর বয়েসী অথবা ওর থেকে দুই এক বছরের বড়ো একটা ছেলে সিগারেট মুখে চারপাশ দেখতে দেখতে বেরিয়ে আসছে। ওকে দেখে একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলো-

- আপনি কি জঙ্গলের আরো ভিতরে যাবেন! আপনি একা না সঙ্গে লোকজন আছে?

বিপাশা একটু হেসে জবাব দিল –

- একাই এসেছি। আরো একটু ভিতরে ঢুকে ব্যাক করবো। আসলে জায়গাটা এত সুন্দর।

- বেশি ভিতরে যাবেন না, এখানে ভালুক আছে। আমি অবশ্য বেশি ভিতরে যাই নি, একজন লোকাল লোকের সঙ্গে দেখা হল, সে আমাকে যেতে নিষেধ করল। চলুন আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি, তারপর আপনাকে হোটেলে পৌঁছে আমার ছুটি।

বিপাশা প্রথমে ভেবেছিলো ওকে নিষেধ করবে তারপর কি ভেবে কিছু না বলে হাঁটা লাগালো। ছেলেটি কোন কথা না বলে চুপচাপ ওর পিছনে হেঁটে আসছিল। বেশ খানিকটা এগিয়ে পিছন ফিরে দেখল ছেলেটাও ওর পিছনে আসছে। ওকে পিছন দিকে তাকাতে দেখে ছেলেটি বলল –

- ম্যাডাম, আর না এগোনোই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

বিপাশা কোন কথা না বলে ব্যাক করে হাঁটা লাগালো। শ্যুটিং স্পট ওবধি ছেলেটি পিছনে ছিল। শুটিং স্পটে পৌছে বিপাশা বলল –

- থ্যাঙ্কস্। আমি বিপাশা। আসছি।

-অধম শ্রীকান্ত হাজরা। কোন দরকার হলে জানাবেন। আমি আপনার হোটেলেই উঠেছি।

এই হল ওদের দুজনের প্রথম আলাপ এর গল্প।

(তিন)

বিপাশার সঙ্গে শ্রীকান্ত ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকলো কারণ দুজনে একই হোটেলে উঠেছে। প্রতিদিনই সকালে মর্নিং ওয়াকে দেখা হয়, বিকালে বা সন্ধ্যার সময় যখন হোটেলে ফেরে দেখে শ্রীকান্ত ব্যালকনিতে বসে আছে। তারপর আড্ডা চলে ঘন্টার পর ঘন্টা। শ্রীকান্ত একটা নিউজ চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত। ও ক্রাইম রিপোর্টার। কথায় কথায় এটাও শ্রীকান্ত জানালো ওই চ্যানেলের অর্ধেক মালিক ও নিজেই। শ্রীকান্ত কোলাখামে মাসখানেক ধরে আছে, আরও নাকি মাসখানেক থাকবে। শুটিং শেষ হওয়ার পরে বিপাশা কলকাতা ফেরত এলেও ফোনে যোগাযোগ থাকলো। তারপর, কলকাতায় ফিরে শ্রীকান্ত বিপাশার সঙ্গে দেখা করতে চাইলো। বিপাশা ওর ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যেও সময় বার করে চলে গেল ঢাকুরিয়া লেকে। দীর্ঘ এক মাস বাদে দুজনের দেখা, দুজনেই কোলাখামের, নেওরা ভ্যালির সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলতে বলতে চলে গেল ওদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে। সে সময়, হঠাৎ-ই, শ্রীকান্ত বিপাশাকে প্রোপোজ্ করে বসল। বিপাশা এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। দু'দিন সময় চাইল। একটা কথা বিপাশার মনে ধরেছিল - শ্রীকান্তকে কাজের সূত্রে প্রতি মাসেই আট দশ দিনের জন্য নানা জায়গায় যেতে হয় যেগুলো অনেকের কাছেই দুর্গম জায়গা। শ্রীকান্তর ইচ্ছা, বিপাশাও সেই সমস্ত জায়গায় শ্রীকান্তর সঙ্গে থাকলে দুজনের বেড়ানো, অ্যাডভেঞ্চার যেমন হবে তেমনই শ্রীকান্তর কাজটাও সহজ হয়ে যাবে। কী কাজ? ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে খবর সংগ্রহের কাজ। বান্ধবী বা স্ত্রীর সঙ্গে অর্থাৎ বিপাশাকে ওর সঙ্গে দেখলে ওকে কেউ ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে সন্দেহ করতে পারবে না।

দুদিন বাদে বিপাশা ওকে ওর বাড়িতে ডিনারে ইনভাইট করলো। শ্রীকান্ত এলে ডিনারের পর বিপাশা ওর ডিসিশন জালাল। শ্রীকান্তকে বিয়ে করতে ওর আপত্তি নেই তবে সেটা আরো বেশ কিছুদিন বাদে। এ-কদিন ওরা এক সঙ্গে ঘুরবে, বেড়াবে, পরস্পরকে আরো ভালো করে চিনবে। যদি দুজনেই মনে করে ভবিষ্যতে ওরা একসঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বিবাহিত জীবন কাটাতে পারবে তবেই বিয়ে করবে। তা নাহলে, ভাল বন্ধু হিসাবেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। আসলে ওর বাবা-মার বিবাহিত জীবন সুখের নয়, পাঁচ বছর পর ওর বাবাকে ছেড়ে মা চলে যায় ওর বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে। ডিভোর্স হয়নি, ইনফ্যাক্ট মা করতে চায় নি। করতে চায় চায় নি বলাটা ঠিক হবে না, উনি পাঁচ-ছয় মাস ছোট্ট তিন বছরের বিপাশার খোঁজ খবর নিয়েছিলেন তারপর আর কোনরকম যোগাযোগ করেন নি। বিপাশার বাবা আবার বিয়ে করেন এবং বিপাশাকে পাঠিয়ে দেন কালিম্পংয়ের একটি রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে উনি ওর দায়িত্ব ঠিকই পালন করতেন। তাই, বাবা-মার ভালোবাসা কি তা ও জানে না।

(চার)

প্রতি মাসে দিন দশবারোর জন্য শ্রীকান্তকে নানা জায়গায় যেতে হত। কখনও নর্থ বেঙ্গলের বা নর্থইস্টয়ের নানান দুর্গম অঞ্চলে, কখনো বা হিমাচল প্রদেশের বর্ডার অঞ্চলে, এমনকি কাশ্মীর বা লেহ্ লাদাখেও। সবসময় বিপাশা ওর সঙ্গে যেত। প্রথম ওর সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল সিকিমের জুলুক গ্রামে। গ্রামটি রিমোট জায়গায় পাহাড়ের মাথায়। কোনো হোটেল নেই। একজন গ্রামবাসীর বাড়িতে হোম-স্টের ব্যবস্থা আছে। সেখানেই উঠেছিল। ওই বাড়িতে আরো বেশকিছু ঘরে প্রচুর ফরেনারের দেখা পেয়েছিল। সবাই টুরিস্ট। একটা ডাবল বেডেড রুম শ্রীকান্ত বুক করেছিল। বিপাশা বুঝতে পেরেছিল শ্রীকান্ত কী চায়। সেক্সের ব্যাপারে বিপাশার অভিজ্ঞতা যে নেই তা নয়। ১৬ বছর বয়সে ওর প্রথম প্রেমিক একটি নেপালি ছেলের সঙ্গে সহবাস করেছিল। তারপর, মডেলিং-এ যোগ দেওয়ার পর ওকে দু-তিনবার কাজ পাওয়ার জন্য দুজনকে খুশি করতে হয়েছে। কিন্তু, ও বিষয়টাকে এড়িয়ে চলে। দৈহিকভাবে কুমারী না হলেও মনের দিক থেকে কুমারী। তাই, শ্রীকান্তর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধা হল না। কিন্তু, জুলুকে সমস্যা হল। ও কোন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি, বিষয়টা বুঝতে পারেনি বলে। অনুমানও করে নি। তাই, জুলুক থেকে ফেরার পর কলকাতায় মডেলিংয়ের শুটিং এর সময় প্রথম অসুবিধা টের পেল। প্রেগনেন্সি টেস্ট করে বুঝতে পারল প্রেগন্যান্ট। এই সময় বাচ্চাকাচ্চা কেউই চায় না, বিপাশা তো নয়ই কারণ সে সময়ে ও একটা সিনেমায় প্রথম চান্স পেয়েছিল। তাই, অ্যাবরশন করাতে বাধ্য হল। প্রতি মাসে শ্রীকান্তর সঙ্গে ঘুরতে ওর খুবই ভালো লাগতো। প্রতি ক্ষেত্রেই ওর সবচাইতে বিরক্তিকর লাগতো যখন শ্রীকান্ত ওকে হোটেলে রেখে একাই ঘন্টা পাঁচ ছয়ের জন্য নিজের কাজের সূত্রে বেরিয়ে যেত। কখনও কখনও এমনও হয়েছে, ওকে পাহাড়ের মাথায় বা জঙ্গলের মধ্যে কোথাও বসিয়ে শ্রীকান্ত চলে গিয়ে ফিরেছে ২-৩ ঘন্টা বাদে। কিছু বলতে গেলে হেসে বলতো, ও নাকি বিপাশাকে কোন রিস্কের মধ্যে ফেলতে চায় না। ধীরে ধীরে বিপাশার কাছে এটা অভ্যাসের মধ্যে এসে গিয়েছিল। এই টুকু বাদ দিয়ে শ্রীকান্ত ছিল পারফেক্ট জেন্টলম্যান। ওর বিরুদ্ধে কোন মেয়ের কোন অভিযোগ থাকতেই পারে না। বয়ফ্রেন্ড হিসাবে এত কেয়ারী পুরুষ পাওয়া খুবই মুশকিল। এতকিছুর পরও সমস্যা হল। শেষবার কাশ্মীরের গুলমার্গয়ের গন্ডোলায়। কেবল্ কারে চেপে দুজনে পাহাড়ের মাথায় ওঠার পর যথারীতি ওকে ফেলে শ্রীকান্ত চলে গিয়েছিল। ওর ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে বিপাশা যখন চারপাশে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছিল তখনই চোখে পড়েছিল সেই দৃশ্য। শ্রীকান্ত সঙ্গে একটি মেয়েকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। দুজনের ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চুমু – দৃশ্যটা আজও ওকে ভয়ঙ্কর কষ্ট দেয়। সেই মুহূর্তে, সেখান থেকে ফিরতি কেবল্ কারে চেপে নীচে। তারপর, প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে হোটেল আর সেই রাতেই ফ্লাইটে দিল্লি হয়ে কলকাতা। তারপর, শ্রীকান্ত একবার ফোন করেছিল কিন্তু ও ফোন না ধরে হোয়াটস্ অ্যাপে সম্পর্ক রাখতে চায় না জানানোর পর ও আর কোনদিন ফোন করে নি।

(পাঁচ)

বিপাশার মন ফিরে এলো বর্তমানে। শ্রীকান্তর সঙ্গে থাকা ছেলেটি হাত টাত নেড়ে কিসব বোঝাচ্ছে। আঙুল দিয়ে নদীর উল্টোদিকের জঙ্গলে কিছু একটা দেখালো। তিনজনের মধ্যে কোন কিছু নিয়ে তর্কাতর্কি চলছে, ওদের হাবভাব দেখে সেরকমই মনে হলো। বিপাশার মনে হচ্ছিল শ্রীকান্তদের বাইনোকুলারে দেখা বন্ধ করে ওর সামনে থাকা সুন্দর প্রকৃতি, এতটাই সুন্দর যে ওর মনে হচ্ছিল কাশ্মীরের বিউটিও এর কাছে তুচ্ছ, এই সৌন্দর্য মন প্রাণ ভরে উপভোগ করবে। কিন্তু মেয়েলি কৌতূহল, তাই, ইতস্তত করেও বাইনোকুলার থেকে চোখ সরাতে পারল না। এবারে তিনজন হাঁটতে হাঁটতে যে জায়গায় গেল সেটা একেবারে নির্জন, তিন দিকে উঁচু আগাছায় ঢাকা পাথরের কৃত্রিম ওয়াল। যেদিকটা ফাঁকা সেদিক থেকেই একটা অ্যাঙ্গেলে বিপাশা বাইনোকুলার দিয়ে দেখছে। এই অ্যাঙ্গেলে, নদী আর বেঞ্চ ছাড়া আর কিছু পড়ে না। আর দূরত্বটা এতটাই বেশি যে অটোমেটিক্যালি এই অঞ্চলের সবচেয়ে নির্জন জায়গা ওটাই। ওরা তিনজনে একটা ঝোপের কাছে গেল। ঝোপের ভেতর থেকে শ্রীকান্ত লম্বা কী একটা টেনে বার করে ছেলেটির হাতে দিল। বিপাশার লম্বা জিনিসটাকে ভালো করে দেখে একটা বন্দুক জাতীয় কিছু বলে মনে হল। পুরোটা দেখা যাচ্ছে না, কারণ অর্ধেকটা মেয়েটার শরীরের পিছনে চলে গেছে। হঠাৎ মেয়েটা সরে গিয়ে ঝোপের ভেতর হাত ঢোকালো। এবারে ওই লম্বা বন্দুক জাতীয় জিনিসটাকে দেখা যাচ্ছে, ওর হাতল ট্রিগার সবই দেখা যাচ্ছে। এই বস্তুটির ছবি আর মডেল বিপাশা স্টুডিও পাড়ায় দেখেছে। সিনেমাতে ব্যবহার করা হয়। এটা এ কে ফরটিসেভেন রাইফেল। বিপাশার প্রাথমিকভাবে ধারনা হল এটা সিনেমায় যেমন ব্যবহার হয় সেরকম নকল বন্দুক। মেয়েটার হাতে দুটো রিভলভার। একটা নিজে জ্যাকেটের ভিতরে ঢুকালো অন্যটা ছেলেটাকে দিল। ছেলেটা সেটা জ্যাকেটের ভিতরে ঢুকালো। এবারে যেগুলো ঝোপ থেকে বার করলো সেগুলো একটু লম্বাটে বলের মত, প্যাঁচানো - সম্ভবত গ্রেনেড। বিপাশা, প্রাথমিক হতভম্ব ভাব কাটিয়ে হাতে নিকন পি-৯০০ ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে জুমিং করে ফটাফট ছবি তুলে যাচ্ছে। শ্রীকান্তর দুই হাতে দুটো রিভলবার, একটা কোমরে গুঁজে দ্বিতীয়টা জ্যাকেটের ভিতরে ঢোকালো। তিনজনেই ঝোপ থেকে দুটো করে গ্রেনেড বার করে জ্যাকেটে ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে ঝোপের আশপাশ থেকে বেশ কিছু ডালপালা এনে জায়গাটা ভালো করে ঢেকে ওখান থেকে চলে এল। ছেলেটা চলে গেল। শ্রীকান্ত মেয়েটার কোমর জড়িয়ে হাজবেন্ড ওয়াইফের স্টাইলে হাঁটতে-হাঁটতে এসে ধাবার বেঞ্চিতে বসে পড়ল। বিপাশার ততক্ষণে গোটা ২২-২৩ ছবি তোলা হয়ে গেছে। বিপাশা হতভম্ব হয়ে ভাবছে – শ্রীকান্তর যা পেশা তাতে একটা রিভলভার সঙ্গে রাখাটা জরুরি যদিও অতীতে কখনও তা ওকে রাখতে দেখেনি। তাহলে এত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ওরা কি করছে! কোথাও যুদ্ধ করতে যাচ্ছে!

(ছয়)

বিপাশা বেঞ্চে বসে ডিসিশন নিলে শ্রীকান্তকে শেষ অব্দি ফলো করে দেখবে ও কি করতে চাইছে। একজন ক্রাইম রিপোর্টারের এত অস্ত্রের প্রয়োজন হয় নাকি! সম্ভবত ওর অন্য কোন প্ল্যান আছে। সেটা খারাপ না ভালো তা জানা দরকার। যদি ভাল হয় তাহলে চুপচাপ ওকে জানতে বা বুঝতে না দিয়ে চলে যাবে। আর যদি খারাপ উদ্দেশ্য থেকে থাকে তাহলে সেই উদ্দেশ্যটাকে নষ্ট করে দিতে হবে। সেটা কীভাবে তা ও জানে না, তবে এটুকু বোঝে ওর যা বুদ্ধি আছে, তাতে বিপদে পড়লে বিপদ থেকে বুদ্ধি খাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে। তাছাড়া ওর একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে ও এখন তো সেলিব্রিটি। দু-দুটো সিনেমা রিলিজ্ করেছে যার একটাতে ও নায়িকা। বেঞ্চে বসে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দূরের গাছের মাথার পাখি দেখার ভান করলেও আঢ় চোখে কিন্তু ধাবায় বসা শ্রীকান্ত কি করছে তা দেখছিল। শ্রীকান্ত ওই মেয়েটির সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প করছিল। চায়ের দোকানে যে দুজন লোকাল মানুষ ছিলেন তারা উঠে চলে গেছেন। মাঝবয়সী ভদ্রলোকও চলে এসেছেন ফ্যামিলির কাছে। বেঞ্চে বসে স্ত্রী, পুত্র আর মেয়ের সঙ্গে গল্প করছেন। ওদের চা খাওয়া হয়ে গেলে ওরা উঠে দাঁড়ালো। শ্রীকান্ত পেমেন্ট করে মেয়েটিকে নিয়ে ধাবা থেকে বেরিয়ে চারপাশে দেখা শুরু করলো বিপাশা বাইনোকুলারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে সানগ্লাসটা পড়ে নিল। সানগ্লাস পড়া অবস্থায় দূর থেকে ওকে চেনা সম্ভব নয়। ওরা দুজনে জঙ্গলের দিকে হাঁটা লাগালো। বিপাশা যথেষ্টই হতভম্ব হয়ে গেল কারণ ওই ঘন জঙ্গলে ওরা কেন যাচ্ছে! এই দিকটা নদীর অন্য দিক। নদী অতিক্রম করে একটা পর্বতের সারি আর তারপরেই চিনের সীমান্ত। জঙ্গলের বিস্তার বিশাল। জঙ্গলের পর যে পর্বতের সারি রয়েছে তাতেও এই জঙ্গল বিস্তৃত। ভালুক, চিতাবাঘ, স্নো লেপার্ড, হাতি ছাড়াও এই জঙ্গলে অন্য হিংস্র প্রাণী আছে। ছিটকুলে আসার আগে ছিটকুলের আশেপাশের বন্যপ্রাণী সম্বন্ধে জানতে গিয়ে ইন্টারনেট থেকে এসব তথ্যই পেয়েছে।

বিপাশা মনে মনে ঠিক করেছে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ছবি তোলার ভান করতে করতে জঙ্গল অব্ধি যাবে, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। ও যেতে যেতে, যে বেঞ্চিতে মাঝবয়সী ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রী, পুত্র আর কন্যার সঙ্গে বসে আছেন, তার পাশ দিয়ে যাবার সময় “এই যে শুনছেন” কথাগুলো শুনে বেঞ্চির দিকে তাকালো। ভদ্রমহিলা ঈশারায় ওকে ডাকছেন। ভদ্রমহিলা কথাগুলো বলেছেন হিন্দিতে, তাই বিপাশার ধারনা হল ভদ্রমহিলা হিন্দিভাষী। ও কাছে যেতেই ভদ্রমহিলা হেসে পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন –

- আপনি কি টুরিস্ট? আসলে অনেক্ষণ থেকে দেখছি আপনি একা একা ঘুরছেন, বাইনোকুলারে চারপাশ দেখছেন, ক্যামেরায় ছবি তুলছেন, তাই জিজ্ঞাসা করলাম।

বিপাশা প্রথমে ভাবল এভয়েড্ করে চলে যাবে, তারপর মত বদলালো। হেসে জবাব দিল –

- হ্যাঁ, টুরিস্ট। একাই ঘুরতে বেরিয়েছি। অর্নিথোলজি আর ফটোগ্রাফি আমার হবি। তাছাড়া, অ্যাডভেঞ্চার ভালো লাগে। তাই, কাজের মাঝে, প্রতি দু-মাসে একবার ছুটি নিয়ে সব ভুলে বেরিয়ে পড়ি। দুর্গম স্থানে যেতে বেশি ভালো লাগে তাতে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দর সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার, অর্নিথোলজি, ফটোগ্রাফি - সবই করা যায়। আপনারা টুরিস্ট তো?

বিপাশা কথা বলতে বলতে আরো চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল ভদ্রলোক হাতের সেলফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ওর ছবি তুলে নিলেন। বিপাশা সাবধান হল। ওর ছবি কেন তোলা হল! মুখে কিছুই বলল না।

ভদ্রমহিলা হেসে বললেন –

- ঐ একরকম টুরিস্ট বলতে পারেন। বসুন না ভাই, একটু গল্প করা যাক। আমার স্বামী সরকারি চাকরি করেন, কাজের সূত্রে এখানে এসেছেন। জায়গাটা দারুণ সুন্দর, তাই আমরাও সঙ্গে এসেছি। ওঁর অফিসের কাজও হবে, আমাদেরও বেড়ানো হবে। তুমি কি করো ভাই? স্যরি, আপনি না বলে তুমি বলে ফেললাম।

- আমি অভিনেত্রী। আগে মডেলিং করতাম, এখন সিনেমায় ঢুকে পড়েছি। মাস তিনেক আগে “রাতের গাড়ি” নামে যে সিনেমাটা রিলিজ্ করেছে আমি তার নায়িকা।

ভদ্রলোক চুপ করে আছেন কিন্তু ভদ্রমহিলা বক্বক্ করেই চলেছেন। বিপাশা মাঝে মধ্যে দু একটা উত্তর দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু মন পড়ে আছে অন্যত্র। হঠাৎ একটা কথায় সম্বিত ফিরল, ভদ্রমহিলা ওকে ও কি কি ছবি তুলেছে তা দেখাতে বলছেন। ও নিকন পি-৯০০ ক্যামেরাটা বার করে ছবিগুলো দেখাতে শুরু করলো। শুধুই দৃশ্য আর নানা প্রজাতির পাখির ছবি।

(সাত)

বিপাশার মনে হল ভদ্রমহিলা ছবি দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। একটু ইতস্তত করে বললেন –

- আপনার ব্যাগে আরো একটা ক্যামেরা দেখলাম, ওটা কি ক্যামেরা?

-ওটা ডি. এস. এল. আর. ক্যামেরা। পেনট্যাক্স কে-১০০ ডি সুপার। ওটাতে ১০০-৬০০ মিলিমিটার জুম লেন্স লাগানো আছে।

- তাই নাকি, বাহ্! ওটাতে নিশ্চয়ই আরো ভালো ছবি ওঠে। ওটাতে তোলা ছবি দেখানো যাবে?

বিপাশা ক্যামেরাটা বার করে ছবিগুলো দেখানো শুরু করল। উনি মনোযোগ সহকারে প্রতিটি ছবি দেখে মন্তব্য করলেন –

- আপনি বেঞ্চে বসে গাদা গাদা ছবি তুললেন, অথচ এখানে সেগুলো দেখতে পাচ্ছি না কেন!

বিপাশা মুচকি হেসে জবাব দিল –

- ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ লাগালেই কি ছবি ওঠে নাকি! আমি সেসব ছবিই তুলি যাতে ওয়াইল্ড লাইফ যেমন পাখি বা বন্য জন্তুর ছবি পরিষ্কার আসছে। অনেকবার ক্যামেরা তাক করেছিলাম ঠিকই কিন্তু শাটার টিপি নি। আসলে ছবি তোলার সময় ব্যাটারিতে কতটা চার্জ আছে যেমন দেখতে হয় তেমনই এস.ডি. মেমারি কার্ডে কতটা জায়গা আছে সেটা দেখাও জরুরী। আমার কার্ডে যা জায়গা আছে তাতে আজে বাজে ছবি তুললে অসুবিধা আছে।

ভদ্রমহিলার মুখ দেখে মনে হলো উনি বিপাশার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ভদ্রলোক পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে ওদের কথা শুনছিলেন, হঠাৎ বললেন –

- ম্যাডাম আপনার সঙ্গে একটা জরুরী কথা আছে, আপনি বসুন, তারপর বলছি।

বিপাশা বেঞ্চের একধারে বসতেই উনি বললেন –

- আমার নাম সুবিমল রায়। আমি ক্রাইম ব্রাঞ্চ যুক্ত। এখানে একটা সমস্যার তদন্তের জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে। ভাবলাম, এখানে যখন আসতেই হচ্ছে তখন পরিবারও সঙ্গে নিয়ে আসি। আমার স্ত্রী, পুত্র-কন্যাকে নিয়ে চলে এলাম।

বিপাশা একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল –

- আপনার স্ত্রীও কি ক্রাইম ব্রাঞ্চের সঙ্গে যুক্ত?

- না না, ও হাউস ওয়াইফ্। তবে কলকাতায় বাড়িতে বসেও তো টুকটাক বিজনেস করা যায়, ও তাই করে। হ্যা, যা বলছিলাম। এখানে এসে একটা দলের সন্ধান পাই যারা চোরাচালান করছে অর্থাৎ স্মাগলার। আজ ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে এসে আপনাকে দেখে কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হল তাই আপনাকে ডেকে এত কথা জিজ্ঞাসা করছি। আপনি বাইনোকুলারে যে তিনজনকে সারাক্ষণ ওয়াচ করছিলেন, সম্ভবত ছবিও তুলেছেন, তাদের কাউকে কি চেনেন?

বিপাশা জোর গলায় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল –

- আপনারা আমার ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখেছেন, আমি ওদের কোন ছবি তুলিনি কারণ ওদের ছবি তোলার প্রবৃত্তি আমার নেই। ওদের একজনকে আমার চেনা মনে হয়েছিল তাই বাইনোকুলারে বারবার করে দেখছিলাম। এমন একজন যাকে আমি ঘৃণা করি, যে আমার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছে দু'বছর ধরে, যার জন্য আমি প্রেগন্যান্ট হয়েও পড়েছিলাম। আশা করি বোঝাতে পেরেছি। এই চ্যাপ্টারটা আমি শেষ করতে চাই। প্লিজ, এ বিষয়ে আমায় আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।

বিপাশা ভয়ঙ্কর রাগে ব্যাগ তুলে নিয়ে গট্ গট্ করে হাঁটা লাগালো, একটু দূরে গিয়ে হেসে ফেলল, অভিনয়টা দারুন হয়েছে।

(আট)

বিপাশা বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, ইতস্তত করছিল শ্রীকান্তর পিছু নিয়ে জঙ্গলে ঢুকবে কিনা বুঝতে পারছিল না। সুবিমল রায় সত্যি সত্যিই ক্রাইম ব্রাঞ্চের লোক কিনা তা নিয়ে বিপাশার সন্দেহ আছে। আবার, ক্রাইম ব্রাঞ্চের সঙ্গে যুক্তও থাকতে পারেন। যেটাই হোক, উনি যেভাবে চারপাশে নজর রাখছেন তাতে ওঁকে এড়িয়ে জঙ্গলে ঢোকা যাবে না। তার জায়গায়, ধাবায় বসে চা খাওয়া বেটার। ধাবাটায় বসার ব্যবস্থা মানে বেশ কয়েকটি লাল, নীল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার আর গোটা তিনেক বেঞ্চি। কয়েকটি টেবিলও আছে তবে সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। বিপাশা বেঞ্চে বসে পাশে ক্যামেরার ব্যাগটা রেখে চায়ের অর্ডার দিয়ে ধীরেসুস্থে চারপাশ দেখে নিয়ে ছোট্ট একটা সাদা প্যাকেট বার করলো ব্যাগের সাইড পকেট থেকে। মুচকি হেসে প্যাকেটটা প্যান্টের পকেটে রাখা মানিব্যাগ খুলে তার মধ্যে রাখা টাকার বান্ডিলের মধ্যে এমন ভাবে ঢোকালো যাতে কেউ মানিব্যাগ খুললেও ভিতরে প্যাকেটটা দেখতে পাবে না। এই প্যাকেটের মধ্যে আছে একটা এস.ডি. মেমারি কার্ড যাতে রয়েছে বেঞ্চে বসে তোলা শ্রীকান্তদের অজস্র ফটো। ও ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সাবধানতার জন্য বেঞ্চিতে বসে থাকাকালিনই ক্যামেরা থেকে খুলে ক্যামেরাতে সেকেন্ড একটি চার জিবি মেমারি কার্ড ঢুকিয়ে রেখেছিল। এতে আগে তোলা ভাগ্যিস কিছু ছবি ছিল, যা ওকে সুবিমল রায়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

এক কাপ চা নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকা যায়! তাও প্রায় আধঘন্টা বসে থেকেও যখন শ্রীকান্তদের দেখা পেল না তখন উঠে পড়ল। সুবিমল রায় বেঞ্চে স্ত্রী, পুত্র-কন্যার সঙ্গে এখনো বসে আছেন। যখন চায়ের দাম দিচ্ছে তখন ধাবার মালিক, বয়স্ক ভদ্রলোক, একটু ইতস্তত করে ওকে বললেন –

- ম্যাডাম একটু সাবধানে থাকবেন। এই জায়গাটা শান্তিপ্রিয় হলেও আজকাল কিছু আজেবাজে বাইরের লোককে দেখা যাচ্ছে। আপনি একা ঘুরতে বেরিয়েছেন তো তাই বললাম।

বিপাশা দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে ভাবছিল ও যে একা ঘুরতে বেরিয়েছে তা একমাত্র সুবিমল রায়কে বলেছে আর কাউকে বলেনি। এই ধাবার মালিক জানলেন কিভাবে! স্ট্রেঞ্জ!

বিপাশা দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল মার্কেটে। মার্কেট নামেই মার্কেট, মাত্র পাঁচ ছয়টা দোকান। ও ছিটকুলে উঠেছে একটা হোটেলে। হোটেলটা মাঝারি মানের। এই মার্কেটের পাশেই হোটেলটা। এখনো দু-একজন টুরিস্টের দেখা পাওয়া যাচ্ছে, এরপর আর টুরিস্ট পাওয়া যাবে না কারণ মাসখানেকের মধ্যেই ভয়ঙ্কর ঠান্ডা পড়ে যাবে। টেম্পারেচার এত নেমে যায় যে জল জমে বরফ হয়ে যায়, তাতে নাকি হোটেলের প্লাম্বিং লাইন খারাপ করে সব পাইপ ফাটিয়ে দেয়। তাই, হোটেল সে সময়ে বন্ধ থাকে। বিপাশা নিজের হোটেলে ফিরল, রিসেপসনিস্টের কাছে চাবি চাইল, উনি চাবি দিলেন, বিপাশা হেঁটে দোতলায় উঠে নিজের রুমের দরজা চাবি দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে আতঙ্কে শিউরে উঠলো।

(নয়)

রুমে ঢুকেই দু-সেট ডাবল্ সিটের সোফা, মাঝে সেন্টার টেবিল। তারপর একটা ডাবল বেডেড খাট। সোফায় দুজন বসে আছে, একজন মাঝবয়সী পুরুষ আর অন্যজন অল্পবয়সী মহিলা, দুজনের হাতেই রিভলভার, ওর দিকে তাক করা। মহিলা একটু জোরের সঙ্গেই বললেন –

- হ্যান্ডস্ আপ্। দুহাত তুলে সোফায় এসে বসুন। কোন চালাকি করলে গুলি চালাতে বাধ্য হব।

বিপাশা প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল, তারপর একটু ধাতস্থ হলে হাত তুলে সোফায় বসে জিজ্ঞাসা করল –

- পিঠের ব্যাগপ্যাকটা নামিয়ে, হাত নামিয়ে, কথা বলতে পারি?

- ঠিক আছে নামান, তবে বেচাল দেখলে কিন্তু –

- ম্যাডাম, আমি জানি গুলি করবেন। আমার কাছে কোন রকম অস্ত্র নেই আর আমি কুংফু ক্যারাটেও জানি না।

বিপাশা ব্যাগটা নামানোর পর ভদ্রলোক ব্যাগ খুলে প্রতিটি খোঁপ চেক করে শেষে ব্যাগটা বন্ধ করে বললেন –

- আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। যা যা জিজ্ঞাসা করবো তার সঠিক জবাব দেবেন।

- আপনারা কাঁরা, কি প্রয়োজনে এসেছেন না জানালে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে দিতে হতে পারে।

ভদ্রলোক এই কথার জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন –

- সুরিন্দর থাপাকে চেনেন? কতদিন ধরে চেনেন?

- সুরিন্দর থাপা! সে কে?

- আপনি সুরিন্দার থাপাকে চেনেন না! তাহলে নদীর ধারে বেঞ্চে বসে অত কথা কি বলছিলেন!

- উনি তো সুবিমল রায়। সঙ্গে ওর স্ত্রী আর পুত্র-কন্যা ছিল।

- উনি বুঝি ওর নাম সুবিমল রায় বলেছেন?

- হ্যা। উনি ক্রাইম ব্রাঞ্চের লোক, সস্ত্রীক পুত্র-কন্যা নিয়ে স্মাগলারয়ের পিছু ধাওয়া করে এসেছেন।

- তাই বুঝি। ওঁর নাম সুরিন্দর থাপা আর সঙ্গের মহিলা বাঙালি তবে ওর স্ত্রী নয়। ছেলে-মেয়ে দুটিও ভাড়া করা। ওঁরা আপনাকে কি জিজ্ঞাসা করছিলেন?

- আমি কী কী ছবি তুলেছি তা জোর জবরদস্তি করে আমার ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বার করে দেখলেন।

- কিছু পেলেন?

- না। তাতেই তো অসন্তুষ্ট হয়ে গেলেন। ওদের ধারণা আমি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি ছেলে আর একটি মেয়ের ছবি তুলেছি।

- তাহলে বাইনোকুলার লাগিয়ে ওদের দেখছিলেন কেন? হ্যাঁ, আমাদের পরিচয়টা দিয়ে দেওয়া ভালো তাহলে কথা বলতে সুবিধা হবে। আমরা দুজনেই সি. বি. আই. তে চাকরি করি। আমি রঞ্জন আর আমার সঙ্গে ও রিটা। আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে এখানে একটা স্মাগলিং গ্যাং অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে - সেটার খবর নেওয়ার জন্য। আপনার সুবিমল রায় একজন ঝানু স্মাগলার আর সেই গ্যাংয়ের লিডার হল ওই দাঁড়ি ওলা ছেলেটি যার ছবি আপনি তুলেছেন।

- আমি কারো ছবি তুলিনি। ওই ছেলেটিকে বারবার করে বাইনোকুলারে দেখে কনফার্ম হতে চাইছিলাম ওই ছেলেটিই আমার প্রাক্তন প্রেমিক শ্রীকান্ত কিনা।

- তা কি বুঝলেন, ছেলেটি শ্রীকান্ত তো?

- আমি কনফার্ম নই। আসলে শ্রীকান্ত আমার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছিল, আমি প্রেগন্যান্টও হয়ে পড়েছিলাম। আমি ওকে ঘৃণা করি। যদি কনফার্ম হতাম তাহলে তো গিয়ে দুটো থাপ্পড় না মারতে পারি, গালাগাল তো দিতে পারতাম। এখন আমি সেলিব্রিটি, ও আমার গায়ে হাত তুলতে সাহস পেত না। আপনারা যে সি. বি. আই. য়ের গোয়েন্দা তার প্রমাণ কি?

ভদ্রলোক নিজের আই. কার্ডটা বার করে দেখালেন। বিপাশা ঠিক বুঝতে পারল না আই. কার্ডটা আসল না নকল। একটু ইতস্তত করে ডিসিশন নিল সত্যিটা এখনই কাউকে বলবে না। দুজনে আরো অনেক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে গেল। বিপাশা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, বিছানায় শুয়ে পড়ল। কম্বলের তলায় কিছু একটা পিঠের নিচে ওর অসুবিধার সৃষ্টি করছে। হাত দিয়ে যেটা টেনে বার করলো সেটা একটা ওষুধের স্ট্রিপ, ওষুধটা একটা কন্ট্রাসেপটিভ, যা এই বিছানায় পাওয়া যথেষ্ট অস্বাভাবিক কারণ ওর নিজের কন্ট্রাসেপটিভ খাওয়ার দরকার হয় না।

(দশ)

স্ট্রিপটা থেকে একটা ট্যাবলেট খাওয়া হয়েছে। ও দ্রুত ভেবে যাচ্ছিল, ও কতক্ষণ বাইরে ছিল, সব মিলিয়ে প্রায় তিন ঘন্টা। এই দুজন অথবা তার আগে অন্য কেউ সম্ভবত দুজন এই ঘরে ঢুকে ছিল এবং এই বিছানায় শুয়েছিল। বেরোনোর আগে এই বিছানায় ও যখন শুয়েছিল ও নিশ্চিত তখন এই স্ট্রিপটা ছিল না কারণ কম্বল পায়ের নিচে ভাঁজ করে রাখা ছিল। ঘরে ঢুকে, লাগেজ রেখে, ধবধবে সাদা বিছানায় কম্বল টেনে গায়ে চাপা দিয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে তারপর বেরিয়েছিল। ওরা দুজন যাওয়ার আগে ওদের ফোন নম্বর দিয়ে জানিয়ে গেছে শ্রীকান্তর দেখা পেলে ওদের ফোন করে জানাতে। হঠাৎ, ওর ভীষন ঘেন্না লাগতে শুরু করলো, বিছানার চাদর আর কম্বলটা তুলে ছুড়ে এক কোণে ফেলে দিয়ে রিসেপশনে ফোন করে বিছানার চাদর আর কম্বলটা চেঞ্জ করে দিতে বললো। ধীরে ধীরে ওর মগজটা খুলছে, আর যত খুলছে তত বুঝতে পারছে অজান্তেই ও একটা ভয়ঙ্কর বিপদ জড়িয়ে পড়েছে।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে লাঞ্চ করে নিল। ঘরেই খাবার আনিয়ে নিল। তারপর কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিল লোকাল পুলিশ স্টেশনে যাবে কিন্তু পরে ডিসিসন চেঞ্জ করল। লোকাল পুলিশকে ইনফর্ম করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। চিন্তিত মুখে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল নদীর ধারে। এখন ধাবাটা খোলা থাকলেও কোন কাস্টমার নেই। মালিক রয়েছে দোকানে তবে একা নয়, একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। লোকটির মুখ দেখা যাচ্ছে না, বিপাশা শুধু ওর পিঠটাই দেখতে পাচ্ছে। চা খাওয়ার ইচ্ছা নেই, অথচ ধাবায় একবার ঢোকা দরকার। ধাবায় ঢুকে একটা লাল রংয়ের চেয়ার টেনে বসে মালিককে জিজ্ঞাসা করল –

- রাতে আপনার এখানে কটা অবধি খাবার পাওয়া যায়?

- সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা অবধি। তবে- ওই সময়ে চা আর টুকটাক কেক বিস্কুট জাতীয় জিনিস ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। তবে, অর্ডার দিলে বানিয়ে দেওয়া হয়।

- কি কি আইটেম অর্ডার দেওয়া যেতে পারে?

- রুটি, একমাত্র হাতরুটি পাবেন। এছাড়া সবজি, মাটনকারি, মাটনকিমা ছাড়া আর কিছু পাবেন না। বুঝতেই তো পারছেন, বাজারের অবস্থা ভালো নয়। কাস্টমার না থাকলে কি করব।

- ডিমের ওমলেট পাব? খাবার হোটেলে ডেলিভারি দেওয়া যাবে?

- হ্যাঁ। কিন্তু, আপনি যে হোটেলে উঠেছেন সেটা তো বেশ ভালো, ওদের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে না খেয়ে আমার এখান থেকে খাবার পাঠাতে বলছেন!

- ওদের খাবার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। আপনি রুটি, মাটনকারি আর ডিমের ওমলেট রাত সাড়ে সাতটার পর যদি পাঠিয়ে দেন ভালো হয়। সঙ্গে যেন স্যালাড থাকে।

- আমি ধাবা বন্ধ করে বাড়ি ফেরার সময় আপনাকে পৌঁছে দেব।

উঠে গিয়ে নদীর ধারে বেঞ্চে বসলো, চারপাশে কোন লোকজন নেই। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখতে পেল শ্রীকান্তকে, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। গট্ গট্ করে হেঁটে ধাবার পাশ দিয়ে চলে গেল। ধাবার লোকটিও দোকান থেকে বেরোলো।

(এগারো)

রাত আটটা বাজে। বিপাশা ক্যামেরা থেকে বার করে মানিব্যাগে রাখা এস.ডি. মেমারি কার্ডটা বার করে ছবিগুলো ল্যাপটপে ট্রানস্ফার করে ফেলেছে। সেলফোনের হটস্পট অন করা আছে। একটা ইমেইলও করে ফেলল। এমন সময় দরজায় মৃদু টক্ টক্ আওয়াজ শুনলো। দরজার বাইরে কলিংবেলের সুইচ দেখেছে আর সেটা কাজ করে কারণ রুম বয়রা যতবার আসে ওই বেল বাজায়। একটু অবাক যেমন হল তেমনই ভয়ও পেল। আবার নতুন উৎপাত নয়তো? দরজার কাছে গিয়ে ভিউফাইন্ডারে চোখ লাগালো। ধাবার মালিক, বয়স্ক ভদ্রলোক, একটা খাবারের প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বিপাশা দরজা খুলল, উনি প্যাকেটটা বিপাশাকে না দিয়ে দরজার পাশে থাকা টেবিলের উপর রেখে বললেন –

- ম্যাডাম, আপনি যা যা বলেছেন সব আছে। আপনি আমাকে টোটাল ২০০ টাকা দেবেন। কেমন খেলেন, আগামী কাল জেনে নেব।

বিপাশা টাকাটা দিতেই উনি হেসে বললেন – “গুডনাইট”। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর বিপাশা খাবারের প্যাকেটটা তুলে সেন্টার টেবিলে রাখার সময় একটা কথাই মনে হল, খাবার অনুযায়ী প্যাকেটটার যা ওজন হবার কথা তার তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি ভারী। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে খাবারের প্যাকেট টা খুলেই চমকে উঠলো, একটা বাদামী ছোট খাম। খামের উপর পরিষ্কার বাংলায় লেখা “আগে ভিতরে চিঠিটা পড়ে খাবার খাবেন। চিঠিটাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়বেন তা নাহলে বিপদ আছে”। বিপাশা একটু ইতস্তত করে ডিসিশন নিল চিঠিটা পড়ে দেখবে, এতে মনে হয় না কোন সমস্যা হতে পারে। লেখা আছে বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে চিঠিটা পড়তে। আসে পাশে তাকিয়ে দেখে নিল জানালা দিয়ে কোনরকমভাবে কেউ ওকে গুলি করতে পারে কিনা। সেই সমস্যা নেই কারণ এখান থেকে কোন জানালাই দেখা যাচ্ছে না। খামটা ছিড়ে ভিতর থেকে চিঠিটা বার করল, পরিষ্কার বাংলায় গোটা গোটা অক্ষরে হাতে লেখা চিঠি। চিঠিটা পড়া শুরু করল –

- ম্যাডাম, আপনি ভয়ঙ্কর এক বিপদের মধ্যে আছেন। এই ঘরের সর্বত্র ক্যামেরা লাগানো আছে। আসলে এই ঘরটা ওরা নিউলি ম্যারেড কাপল্ দেয়। তারপর তাদের অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ভিডিও ব্লু ফিল্ম হিসাবে বাজারে বিক্রি করে। এমনকি বাথরুমেও ভিডিও ক্যামেরা লাগানো আছে। আপনার দেহে কোথায় কটা আঁচিল আছে সেটাও ওরা জানে। আপনি রিভলভার চালাতে জানেন কিনা আমরা জানি না কিন্তু আপনার সেফটির কথা ভেবে খাবারের প্যাকেটের ভিতরে একটা মিষ্টি বাক্সে একটা ০.২২ ক্যালিভারের রিভলভার পাঠালাম। ওটা লোডেড। বাক্স খুলে রিভলভারটা বাবার করতে যাবেন না, তাহলে ওরা ক্যামেরার সাহায্যে জেনে যাবে। আপনি বাক্সটা ক্যামেরার ব্যাগ বা ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে খেতে বসুন। খাবার খেয়ে, জরুরি মালপত্র নিয়ে রাতেই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ুন। আপনার আরো দুদিনের টাকা এ্যাডভান্স দেওয়া আছে তাই মনে হয় না হোটেলওলা দেখতে পেলেও আপনাকে আটকাবে। হোটেলের বাইরে, বাঁদিকে, রাস্তার উপর একটা কালো রঙের মারুটি জেন রাখা আছে। গাড়ির নম্বর হল “HP 04D 3997”। চাবি লাগানো আছে। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে সোজা বেরিয়ে যান, বাকি ইনস্ট্রাকশন সময় মত পেয়ে যাবেন। চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলবেন।

-আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী”।

(বারো)

বিপাশা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, এই খেলায় ও অংশ নেবে, শেষ অবধি দেখবে। জড়িয়ে যখন পড়েছে তখন এড়িয়ে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। চিঠির নির্দেশমতো চিঠিটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে বাথরুমের কমোডে ফেলে ফ্লাশ টানার সময় ইচ্ছা করে “উঃ” বলে বসে পড়ল যেন কোমড়ে হ্যাঁচকা টান লেগেছে। বাথরুমের ভিতর হাত তুলে কখনো কোমড়ে হাত দিয়ে কোমর নাড়াতে নাড়াতে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে দেখতে অবশ্য খুঁজে পেল ক্যামেরার লেন্স। একটা নয় দুটো। একটা আয়নার উপরে ল্যাম্পশেডের ভিতরে আর অন্যটা বাথটাবের এক ধারে। ছোট্ট ক্যামেরা, না জানা থাকলে বোঝার কোন উপায় নেই। বাথরুমে বাইরে এসে খাবারের প্যাকেট থেকে মিষ্টির বাক্সটা কাঁধের ছোট্ট ব্যাগে ঢুকিয়ে খাবারটা খেয়ে নিল। বেশ টেস্টি। কিন্তু টেস্ট উপভোগ করে খাওয়ার মত মানসিক অবস্থা ওর ছিল না। খেতে খেতে এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুড়িয়ে আরো কয়েকটা ক্যামেরা খুঁজে পেয়েছে। একটা তো সিলিংয়ে লাগানো। এর মানে একটাই, চিঠিতে যা লেখা আছে তার প্রথম অংশটুকু সত্যি। বাকিটা সত্যি না মিথ্যা তা অবশ্য জানে না। তবে, একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে, ওর ক্ষতি করতে চাইলে খাবারের সঙ্গে লুকিয়ে রিভলভার পাঠাতো না। ধাবার মালিক তার মানে শ্রীকান্তদের বিরোধী পক্ষ। এখন কারা সমাজের শত্রু তা অবশ্য জানে না, শুধু একটাই বুঝতে পেরেছে, প্রাণ বাঁচাতে গেলে এক্ষুনি ওকে পালাতে হবে।

ঠিক রাত বারোটার সময় চুপি চুপি সমস্ত মালপত্র নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো। রিসেপশনে দুটি লোক সোফায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। কাঁচের সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, হ্যাচবোল্টটা টানা। নিঃশব্দে হ্যাচবোল্টটা খুলে ফেলল। দরজাটা টেনে একটু ফাঁক করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে অর্ধেকটা খুলল। দেখে নিল লোক দুটি কি করছে। একই রকমভাবে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। মালপত্র বলতে একটা ছোট ১৮ ইঞ্চির ভি.আই.পি. স্কাই ব্যাগ, ক্যামেরার ব্যাগ আর ছোট্ট কাঁধে ঝোলানো লেডিস ব্যাগ। বাইরে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে দরজাটা টেনে বন্ধ করে বাইরে যে হ্যাচবোল্টটা আছে সেটা টেনে বন্ধ করে দিল। এখন চট্ করে কেউ বের হতে পারবে না। বাঁদিকে রাস্তা দিয়ে একটু এগোতেই মারুটি জেনটাকে দেখতে পেল। গাড়ির নম্বর প্লেট এর লেখা ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না, কারণ রাস্তায় আলো নেই। স্মার্ট ফোনের আলোয় দেখলো নম্বরটা মিলে যাচ্ছে HP-04D- 3697। সামনের দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশের সিটে মালপত্র গুলো রেখে ঘুরে এসে ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে ড্রাইভারের সিটে বসে পড়ল। চাবিটা লাগানো আছে। স্টার্ট দিয়ে একটু এগোতেই পিছন থেকে কেউ বলল –

- ম্যাডাম, গাড়ি দাঁড় করাবেন না, সোজা এগিয়ে চলুন। আমি যেভাবে বলব সেভাবেই গাড়ি চালান। কোনো ভয় নেই। আমাদের পুরো ফোর্স পিছনে আছে।

(তেরো)

পুরো ফোর্স! এরা কারা! বিপাশা মনে মনে ভাবতে থাকলেও মুখে কিছু বলল না। পিছন থেকে দেওয়া নির্দেশমতো চলতে চলতে অবশেষে বুঝতে পারল পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে ঘুরে ওপর দিকে উঠছে, সম্ভবত কোন পাহাড়ের টপে উঠছে। অন্ধকারের মধ্যে হেডলাইটের আলোয় অত্যন্ত সাবধানে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে হচ্ছে কারণ একটু এদিক ওদিক হলেই সোজা খাদে গাড়ি গড়িয়ে পড়বে। অবশেষে, যেখানে গাড়ি থামানোর আদেশ এল সেটা একটা ফ্ল্যাট গ্রাউন্ড, সম্ভবত সিমেন্টে বাঁধানো। গাড়ি থামিয়ে উইন্ডস্ক্রিনের মধ্য দিয়ে সামনের বিশাল বাড়িটার গায়ে জ্বলতে থাকা আলোয় মনে হল ওটা একটা মনাস্ট্রি। তারপর, গেটের কারুকার্য দেখে বুঝতে পারলো, এটা সাংলার একটা মনাস্ট্রি, এখানে ও দুদিন আগেই ঘুরতে এসেছিল। গাড়ি থেকে নামতেই দুজন লামা আর চার জন মানুষ ওর দিকে এগিয়ে এলেন। একজন ভদ্রলোক দু-হাত জড়ো করে নমস্কার করে বললেন –

- আমি অনিল ঠাকুর। আপনার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বুঝতে পারছি আপনি ক্লান্ত। তার মধ্যে অন্ধকারে এতটা পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে আসা - নট আ ম্যাটার অফ জোক্। আসুন, ভিতরে আরাম করে বসে কফি খেতে খেতে কথা বলা যাবে।

যিনি নিজেকে “অনিল ঠাকুর” বললেন তাঁকে বিপাশা চেনে, হিন্দুস্তান কি আখরি ধাবার মালিক। বিপাশার মালপত্র একটা ঘরে দিয়ে গেছে। এটি মনাস্ট্রির নাকি গেস্টহাউস! ঘরের মধ্যে একটা খাট, খাটের উপর একটা বালিশ আর গোটা দুয়েক মোটা কম্বল ভাঁজ করে রাখা আছে। খাটের পাশে একটা চেয়ার আর দেয়ালের গায়ে ফায়ার প্লেস – ব্যাস, এ ছাড়া আর কিছু নেই। মিস্টার অনিল ঠাকুর চেয়ারে বসেছেন, বিপাশা খাটে। একজন অল্প বয়সী লামা আরো দুটো সস্তা পিভিসি চেয়ার দিয়ে গেল। দুজন অল্পবয়সী ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন, একজনের হাতে একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলটা খাটের পাশে রেখে দুজনেই চেয়ারে বসলেন। অনিল ঠাকুর হেসে বললেন –

- এখানে সব সেল্ফ সার্ভিস, নিজের কাজ নিজেদেরকেই করতে হয়। এখুনি কফি দেবে, কফি খেতে খেতে না হয় কথা বলা যাবে।

কফি দিয়ে গেছে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মিস্টার ঠাকুর বললেন –

- ম্যাডাম, আপনি নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন, আমরা কে বা কারা, আপনাকে এভাবে হোটেল ছেড়ে এখানে চলে আসতে বাধ্য করলাম। এই জায়গাটাই বা কোথায়!

বিপাশা হেসে জবাব দিল –

- এই জায়গাটা সম্বন্ধে জানি। এটি সাংলার বিখ্যাত একটি মনাস্ট্রি। আমি এখানে নিজের ইচ্ছায় এসেছি, কেউ আমাকে বাধ্য করেন নি। আর আপনারা কাঁরা সে সম্বন্ধে কিছুটা অনুমান করতে পেরেছি বলেই আপনাদের কথামতো চলে এসেছি। আমার ধারণা আপনারা কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের লোক। অ্যাম আই রাইট?

- এ্যাবসলিউটলি রাইট। এক্সিলেন্ট ডিডাকশন। কিভাবে বুঝলেন আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের লোক?

- আমার যারা ক্ষতি করতে চায় তারা নিশ্চয়ই আমাকে লুকিয়ে রিভলভার পাঠাবে না বা ঘরে লুকানো ক্যামেরা সম্বন্ধে জানাবে না। তাই, যখন বুঝলাম, তখন সোজা আপনাদের কথামতো কাজ করলাম।

(চৌদ্দ)

মিস্টার ঠাকুর হেসে বললেন –

- একদম ঠিক। এবার কাজের কথায় আসা যাক। আমরা সবাই সি.বি. আই.য়ের গোয়েন্দা দপ্তরের গোয়েন্দা। এই মুহূর্তে, সাংলা আর ছিটকুলে আমাদের তিরিশ জন বাছাই করা গোয়েন্দা রয়েছেন। আগামীকাল দুপুরে আরও পনেরো জন গোয়েন্দা এসে পৌঁছচ্ছেন। তাই, বুঝতেই পারছেন বিষয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি সিবিআই-এর চিফ্। আমি সাধারণত কোথাও যাই না, দিল্লিতে থেকেই পুরোটা অপারেট করি। কিন্তু, আমিও আসতে বাধ্য হয়েছি। আসলে, এই ঘটনার সূত্রপাত দু'বছর আগে। দিল্লিতে আমাদের কাছে খবর আসে সারা ভারতে একটা নতুন গজিয়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদি সংস্থা অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমরা আমাদের এক অতি দক্ষ গোয়েন্দাকে পশ্চিমবাংলায় পাঠাই এর তদন্তের জন্য কারণ ওই সন্ত্রাসবাদি সংস্থার হেড অর্থাৎ চিফ্ নাকি একজন বাঙালি। ঐ গোয়েন্দার তিন মাস বাদে হঠাৎ-ই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ওকে খুন করা হয়েছিল কারণ মৃত্যুর পর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী ওর পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে অ্যালকোহল পাওয়া গিয়েছিল অথচ ওই গোয়েন্দা কখনও ড্রিঙ্ক করতেন না। মৃত্যু হয়েছিল নর্থ বেঙ্গলে শিলিগুড়ি স্টেশনের কাছে। নর্থ বেঙ্গল পুলিশ মাতলামো করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে ফাইল বন্ধ করে দেয়। ও একটা রিপোর্ট পাঠাতে পেরেছিল তাতে জানতে পারি ওই সংস্থার চিফের নাম শ্রীকান্ত ক্রিস্টোফার হাজরা। ইয়ং বাঙালি খ্রিস্টান। এই সংস্থাটির জাল সারা ভারতে বিশেষত বর্ডার এরিয়াতে ছড়িয়ে আছে। সংস্থাটির কাজ, পৃথিবীর যেখানে যত সন্ত্রাসবাদি সংগঠন ভারতে সক্রিয় তাদের অস্ত্রশস্ত্র বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী মোটা টাকার বিনিময়ে সাপ্লাই করা। এবারে বাছাই করা চারজন গোয়েন্দাকে পাঠানো হল, তাদের রিপোর্টে দুটো নাম উঠে এল। প্রথমজন অবশ্যই শ্রীকান্ত ক্রিস্টোফার হাজরা। দ্বিতীয়জন, একজন মহিলা, ওঁর সঙ্গী, প্রেমিকা এবং সম্ভবত ওই সংস্থায় চিফের পরেই যার স্থান। এই মহিলা আর কেউ নন আপনি। আপনার পিছনে গোয়েন্দা লাগানো হল। সে সময়ে, একটা কনফিউশনে আমরা ছিলাম, কলকাতায় ফেরার পর আপনি মডেলিং আর অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন শ্রীকান্তর সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ প্রায় থাকে না। অথচ, যখন ও নানা রকম অ্যাসাইনমেন্টে বিভিন্ন রাজ্যের বর্ডার এরিয়াতে দুর্গম স্থানে যায় তখন আপনি সঙ্গে থাকেন। কেন! অস্ত্রশস্ত্র পাঁচারের সময় তো আপনি ওর সঙ্গে থাকেন না! তাহলে কি ওর এই পরিচয় আপনি জানেন না? আপনাকে কি ও ব্যবহার করছে? সর্বক্ষণ আপনাকে ওয়াচে রাখা হত। আপনি ওর সঙ্গে লিভ্ টুগেদার শুরু করেছিলেন। কিন্তু, আমাদের গোয়েন্দাদের খবর অনুযায়ী শ্রীকান্তর আপনি ছাড়াও আরো দু-একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। এক বছর আগে, কাশ্মীরের গুলমার্গ-য়ের গন্ডোলায় যে কাণ্ডটি ঘটেছিল, আপনি যা দেখেছিলেন, সেখানে উপস্থিত আমাদের এক গোয়েন্দাও তা দেখেছিলেন। আপনি রাগে, দুঃখে, অভিমানে কাশ্মীর ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়, শ্রীকান্তর সঙ্গেও সম্পর্ক রাখলেন না। আমরা কনফার্ম হলাম আপনি নির্দোষ। এরপর, শ্রীকান্তকে ভাল করে চিনতে পারলাম। প্রতিটি অ্যাসাইনমেন্টে যখন যেত, আগে আপনাকে নিয়ে যেত, আপনার পর একেকবারে এক একটি মেয়েকে নিয়ে যেত, একসঙ্গে থাকত। এটা করত লোককে, পুলিশকে, আমাদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। তারপর, কাজ মিটে গেলে, মেয়েটিকে হত্যা করত। কয়েকটি মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করা গেলেও বাকিদেরটা উদ্ধার করা যায়নি। সম্ভবত কোন পাহাড়ের খাদে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। এর মধ্যে আপনি সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছেন। মাস খানেক আগে আমাদের কাছে খবর আসে হিমাচল প্রদেশের বর্ডার এরিয়াতে চিনের সাহায্যে একদল সন্ত্রাসবাদি ভারতের ওপর এক চরম আঘাত হানার চেষ্টা করছে। বিষয়টা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আমি নিজে সব ছেড়ে চলে আসি এখানে আর ছিটকুলের ওই ধাবার মালিকের থেকে কয়েক মাসের নিজে দোকানটা নিয়ে ঘাঁটি গাড়ি। কারণ, এবারে আল-জাহিদ মুজাহিন নামের সন্ত্রাসবাদি সংস্থাটিকে সরাসরি সাহায্য করছে শ্রীকান্ত নিজে, যা এর আগে কখনও করেনি। আপনার ফটো অতীতে আমি দেখেছিলাম, তাই ছিটকুলে, আপনার বাইনোকুলারে দেখা আর ক্যামেরায় ছবি তোলা দেখে আপনাকে সন্দেহ হয়। তারপর, সুবিমল ওরফে মহাম্মদ শাহিদ আর আইরিন সুলতানা আপনাকে ধরে আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে আপনার ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখে। ওরা দুজনেই শ্রীকান্তর দলের লোক। ওরা যখন কোন অপারেশনে নামে, তখন ওদের প্রথম গ্রুপের পিছনে দু-দুটো ব্যাক আপ্ থাকে। যার প্রথমটা ছিল শাহিদ আর আইরিন। ওরা স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দিলেও স্বামী-স্ত্রী নয়। বাচ্চা দুটো ভাড়া করা। ওদের দুজনের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে খুনের লম্বা লিস্ট আছে। বেশ কয়েকটা করে খুন করেছে। আর দ্বিতীয় ব্যাক আপ্ হল আপনার হোটেলর রুমের উৎপাত। সুবিমল রায়ের সঙ্গে কথা বলে যখন ধাবায় এলেন তখন আপনাকে ইনডাইরেক্টলি সাবধান করে দিয়েছিলাম কারন আমি আপনাকে তখন চিনতে পেরেছিলাম। এই হলো পুরো ঘটনা।

(পনেরো)

বিপাশা মিস্টার ঠাকুরের কথা শেষ হলে হেসে বলল –

- দেখুন, আমাকে বাঁচানোর জন্য এত কষ্ট করে এখানে নিয়ে এসেছেন - এটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা একটু মুস্কিল হচ্ছে। খোলাখুলি কথা বলাটাই ভাল। আমাকে বাঁচিয়ে এখানে আনার উদ্দেশ্যটা কী? আমাকে দিয়ে কোন কাজ করাতে চাইছেন বলেই ধারণা। কাজটা কী?

মিস্টার ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন –

- একদম ঠিক ধরেছেন, না, আপনার সঙ্গে কাজ করে লাভ আছে। আপনি এতটা ইন্টেলিজেন্ট হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ দু-বছর শ্রীকান্তর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেও ওকে চিনতে পারলেন না!

- তখন আমি ওকে অন্ধের মত বিশ্বাস করতাম। এ প্রসঙ্গ থাক। আমাকে কী করতে হবে? আর কাজটা কেনই বা করব? আমার তাতে লাভ কী?

- ম্যাডাম, শ্রীকান্ত হাজরা কতটা ভয়ঙ্কর, নির্দয় মানুষ সেটা শুধু আমরা নয় আপনিও হয়তো বুঝতে পেরেছেন। এরা জীবনে কাউকে কোনদিন ভালোবাসতে শেখে নি। এরা হত্যা করে আনন্দ পায়। শ্রীকান্তর মতো ভয়ংকর মানুষ, যে নির্বিচারে মানুষ খুন করে, সেও একটি মেয়েকে ভালোবেসেছিল আর সেই মেয়েটি হলেন আপনি। যে কারণে ও আপনাকে খুন করেনি, দু'-বছর অবধি আপনাকে ওর বান্ধবীর মর্যাদা দিয়ে গেছে। আপনার প্রতি ওর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পুরো গ্যাংটাকে ধ্বংস করতে চাই। এটা আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর। দ্বিতীয় আর তৃতীয় প্রশ্নের একটাই উত্তর, আপনি যা করবেন, তা দেশের জন্য করবেন, দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য করবেন। আর্মিতে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা হাসতে হাসতে দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারেন। এত স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন –

বিপাশা ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল –

- আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। কাজটা আমি পারবো কিনা জানিনা, তবে করার চেষ্টা করব। কেন করব জানেন? দেশ সেবার থেকেও বড়ো একটা বিষয় আছে, আমার প্রাক্তন প্রেমিককে বুঝিয়ে দিতে চাই বিপাশা বসু কারো উপর নির্ভরশীল নয় আর পৃথিবীর যে কোন কাজ অনায়াসে করতে পারে যদি তা ইল্লিগাল বা আনএথিকাল না হয়। শ্রীকান্ত এখন কোথায় আছে? আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে যাব।

- আপনি যাওয়ামাত্র আপনাকে মেরে ফেলবে। আপনি কি ভাবছেন ওকে বুঝিয়ে বললে ও বাধ্য ছেলের মতো আপনার কথা শুনবে! আমাদের একটা প্ল্যান আছে। আমাদের হাতে এখনও সাত সাতটা দিন আছে। আপনি রিভলভার চালাতে জানেন?

- না।

- আপনার ফিগার অসাধারণ, অ্যাথলেটদের মতন। যতদূর আমাদের কাছে খবর আছে আপনি ক্যারাটে কুংফু কিছুই জানেন না। সেল্ফ ডিফেন্সের জন্য কিছু একটা জানা জরুরি ছিল। দেখা যাক কী করা যায়। আচ্ছা, ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো কোথায় পাঁচার করেছিলেন! আমরা তো সে সময় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

বিপাশা মানিব্যাগ অর্থাৎ পার্স থেকে কাগজে মোড়ানো এস.ডি. মেমারি কার্ডটা বার করে দিতেই উনি শিস্ দিয়ে উঠে বললেন –

- এক্সিলেন্ট। ছবিগুলো দেখা যাক।

(ষোলো)

ছবিগুলো পোর্টেবল প্রোজেক্টারে প্রোজেক্ট করে দেখা শুরু হল। শ্রীকান্ত বাদে বাকি ছেলেটি ও মেয়েটির ছবি দেখে ওঁরা সনাক্তও করে ফেললেন। ছেলেটি আল জাহিদ মুজাহিন সন্ত্রাসবাদি দলের ভারতীয় শাখার চিফ নাম মোঃ সেলিম, বাসস্থান দুবাই, ওখান থেকেই অপারেট করে। মাসখানেক আগে দু'মাসের ভিসা নিয়ে ভারতে এসেছে। সম্ভবত, ওরা কোনো বড়ো সন্ত্রাসবাদি হামলার চেষ্টা করছে যাতে সাহায্য করছে চিন আর শ্রীকান্ত। এটা উনি আগেই বলেছিলেন তাই বিপাশা মন দিয়ে শুনছিল না। শুধু মেয়েটির কথা শুনে চমকালো কারণ উনি বলছিলেন মেয়েটি ওর দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। মেয়েটি বাঙালি মুসলিম, নাম তিয়াশা। মেয়েটির মা কাশ্মীরি তাই অসাধারণ সুন্দরী। মেয়েটি বিপাশার চেনা কারণ এই মেয়েটিকে ভোলা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রীকান্তকে কাশ্মীরের গন্ডোলায় তিয়াশাকেই দুহাতে জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চুমু খেতে দেখেছিল। ছবি তুলেছে ঠিকই কিন্তু তোলার সময় চিনতে পারেনি। আজই প্রথম নিজের তোলা ছবিগুলো দেখলো। ভাগ্যিস, হোটেলে দেখে নি, তাহলে ওদের লুকানো ক্যামেরায় ধরা পড়ে যেত।

মনাস্ট্রির গেস্টহাউসে বিপাশাকে থাকতে হবে বেশ কয়েকদিন। ও হোটেলে উঠতে চাইলেও মিস্টার ঠাকুর রাজি হলেন না। যতটা সম্ভব ওর জন্য স্বাচ্ছন্দের ব্যবস্থা করা হল। প্রতিদিন সকালে ওকে নিয়ে যাওয়া হত গভীর জঙ্গলের ভিতর একটা লুকানো বাড়িতে। শু্টিং প্র্যাকটিস ছাড়াও ওকে শেখানো হতো সেল্ফ ডিফেন্সের নানান কায়দাকানুন। ওখানেই দুপুরে লাঞ্চ সেরে আবার প্র্যাকটিস যা চলত সন্ধ্যা সাতটা অবধি। তারপর, মনাস্ট্রিতে ফিরে বিপাশা কোনরকমে ডিনার সেরে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে গভীর ঘুমের জগতে চলে যেত।

বিপাশার শুটিং প্র্যাকটিস চলছিল প্রধানত দুটো রিভলভারে। একটা ০.২২ ক্যালিবারের মার্শাল আর অন্যটা ০.২৫ ক্যালিবারের কোল্ট রিভলভার। প্রথমটা ওর কাছে যেটা পাঠানো হয়েছিল সেটা আর দ্বিতীয়টা এখানে ওকে দেওয়া হয়েছিল। সপ্তম দিনে দুটোরই ব্যবহার করার লাইসেন্স ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মিস্টার ঠাকুর বললেন –

- মোটামুটি আপনাকে রেডি করা গেছে। শ্রীকান্ত এখন আছে নাকো লেকের কাছে একটা হোটেলে। আমাদের কাছে খবর আছে ও আগামীকাল সাংলায় ব্যাক করবে। এবারে আমাদের প্ল্যানটা বলা যাক। নিউজপেপার আর সমস্ত টিভি চ্যানেলে ৭ দিন আগে যেদিন আপনি হোটেল ছেড়ে পালান তার পরদিন রাতে ঘোষণা করা হয়েছিল আপনি মিসিং। তার দুদিন পর ঘোষণা করা হয় আপনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে আর আপনার জন্য মুক্তিপণ হিসেবে এক কোটি টাকা দাবি করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের সঙ্গে কিডন্যাপারদের কথাবার্তা চলছে। এরপর আগামীকাল দুপুরে আপনাকে রেপ্ করে কিডন্যাপাররা নাকো থেকে সাংলায় ফেরার রাস্তায় ফেলে পালাবে।

- কী! আমি রেপড্ হব!

- না- না, সবটাই অভিনয়। আপনাকে অভিনয় করতে হবে। আপনি তো ভালো অভিনেত্রী। এরপর শ্রীকান্তকে আকৃষ্ট করতে হবে। ব্যাস-

- আপনারা ওকে সোজাসুজি অ্যারেস্ট করছেন না কেন! সোজাসুজি গুলি চালিয়ে মেরে ফেলুন।

- সেটা করলে ঠিক দশদিন বাদে যে ভয়ঙ্কর অ্যাটাক ওরা করতে চলেছে, যে সন্ত্রাসের পরিকল্পনা ওরা করেছে, সেটা কি বন্ধ করা যাবে? আপনিই আমাদের শেষ ভরসা।

(সতেরো)

পুলিশের বা গোয়েন্দা দপ্তরের ড্রেসাররা কিরকম হয় তা বিপাশার জানা ছিল না। অভিনয় জগতে ড্রেসারদের প্রতিদিন দেখছে তাই ওর কোনোরকম টেনশন ছিল না। কিন্তু, মিস্টার ঠাকুরের সঙ্গের ড্রেসারের কান্ডকারখানা দেখে রীতিমত অবাক হয়ে গেল, এরা এত আনপ্রফেশনাল! রেপড্ মেয়ের পোষাক কিরকম হবে তার কোনো ধারনাই নেই! অবশেষে, ও নিজেই জোর করে নিজের মতো করে পোষাক ছিঁড়ে, মুরগির রক্ত জায়গায় জায়গায় লাগিয়ে, রাস্তার ধারে ঝোপের মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল, যখন খবর এলো শ্রীকান্তদের গাড়ি এসে গেছে, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওই জায়গায় এসে পড়বে। ওর বডি এমনভাবে প্লেস করা হয়েছে যাতে ওদের চোখে পড়তে বাধ্য।

বিপাশাকে এমন একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে যাতে ওর খুব অল্প সেন্স থাকলেও দেহ নাড়ানো বা কথা বলা সম্ভব নয়। ওকে বলা হয়েছে এই অবস্থা ঘন্টাখানেক থাকবে তারপর নর্মাল হয়ে যাবে। যতটুকু সেন্স আছে তাতে বুঝলো পাশে একটা গাড়ি দাঁড়ালো, একজন গাড়ি থেকে নেমে এসে ওকে দেখে কাকে যেন বলল – “বস মরে গেছে”। বিপাশা বহু চেষ্টা করে চোখটা একটু খুললো। সেই গলা শুনতে পেলো – “বস্, বেঁচে আছে, কী করব?” আরো দু'তিনটে মুখ মনে হল ওকে দেখছে। কেউ একজন আদেশ করলো – “ওকে গাড়িতে তোল, এখানে ফেলে রাখলে মরে যাবে”। পাশে অন্য কেউ বলল বলে মনে হল – “বস্, মনে হয় সেই কিডন্যাপড্ হওয়া মেয়েটা, রেপ করে ফেলে দিয়ে গেছে। আমাদের সামনে একটা বড়ো অ্যাসাইনমেন্ট আছে, এই অবস্থায় ওকে নিয়ে যাওয়া মানে ফালতু ঝামেলা, ওকে কোন হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে কেটে পড়লে হয় না?” একটা কড়া ধমক – “যা বলা হচ্ছে তাই কর, ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না, এটা আমি বুঝে নেব”।

ওর দেহটাকে গাড়িতে তোলা হল, মাথা একজনের কোলে আর পা আরেকজনের কোলে। এই দুজন যে শ্রীকান্ত নয় তা ও নিশ্চিত। একজনের হাতের আঙুল ওর দেহের গোপন অংশে ঘোরাফেরা করছে - ওর সেন্স ফিরছি। ও গুঙিয়ে উঠলো। শ্রীকান্তর ধমক শুনতে পেল – “এই হাত সরা, জানে মেরে দেব”। ও চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ল।

গাড়ি কখন থেমেছে ও জানে না কিন্তু ওকে যখন দু তিন জনে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সেন্স ফিরল কিংবা ঘুম ভেঙে গেল। ও গুঙিয়ে উঠলো – “ওঃ কি ব্যাথা, উঃ মাগো” বলে।

ওষুধের প্রভাবটা কাটে নি। আধা ঘুম আধা জাগড়নের মধ্য দিয়ে ওর মনে হচ্ছিল ওকে নিয়ে কোন বাড়িতে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা শুরু হল। তারপর, একটা ঘরে ঢুকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। কেউ একজন আদেশ করল –

- এখানে একজনকে পাহারায় থাকতে হবে। ডাক্তার ডাকা যাবে না। আমি আইরিনকে খবর দিচ্ছি, ও ফার্স্ট এইডটা জানে। কিছুদিন হসপিটালে নার্সের কাজও করেছে। ও সামাল দিয়ে দেবে। এর মধ্যে কোনও বেচাল যদি হয়, একদম খতম করে দেব। মনে থাকে যেন।

বিপাশা বিছানায়, হয়তো ওষুধের জন্যই, ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ জলের ঝাপটা আর ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভেঙে গেল। সামনে একজন মহিলার মুখ - চিনতে পারল, আইরিন সুলতানা। হঠাৎ গোঙাতে শুরু করল –

-ওঃ, ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। তিনজন সমানে, বারবার, আমি বোধহয় বাঁচবো না।

ভদ্রমহিলা বললেন –

- না না, বেঁচে যাবেন। আমি একটা ওষুধ দিচ্ছি, খেলে ব্যথা চলে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

(আঠারো)

অভিনয়কে জোরদার করার জন্য একটা স্ট্রং পেইন কিলার ট্যাবলেট ওকে খেতে হল। এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় ছিল না। একটা ইংরেজি সিনেমাতে একটি রেপড্ মেয়ের ভূমিকায় বো ডেরেকের অভিনয় দেখেছিল। বো ডেরেকের বিভিন্ন দৃশ্যগুলো মাথায় আসছিল, নিজের অভিনয়ের মধ্যে সেইগুলোই নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করল। বিছানায় পা ফাঁক করে শুয়ে মাঝে মধ্যে গোঙাচ্ছে, গায়ের উপর চাপানো কম্বল দুটোকে ঠান্ডার মধ্যেও মাঝে মধ্যে সরিয়ে দিচ্ছে। নিজের মনেই বিড় বিড় করছে – “আমি বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই”।

পুরো ২৪ ঘন্টা কেটে গেছে অথচ শ্রীকান্তর দেখা নেই। আইরিন নানারকম ওষুধ খেতে দিচ্ছে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিপাশার মনে হচ্ছিল মেয়েটার মনটা ভালো। কেন যে এরা সন্ত্রাসবাদি সংগঠনে যোগ দেয়! অবশেষে, প্রতীক্ষার অবসান হল। শ্রীকান্ত দুজনকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। শ্রীকান্ত আইরিনকে আর সঙ্গে আসা দুজন ছেলেকে চোখের ঈশারায় ঘরের বাইরে যেতে বলল। ওরা বেরিয়ে গেলে শ্রীকান্ত বিপাশার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল –

- কেমন আছ?

ঠিক এই প্রশ্নটাই বিপাশা এক্সপেক্ট করছিল। উত্তরও ভেবে রেখেছিল। বলল –

- অসহ্য যন্ত্রণা। তিনজনে বারবার – পেইনকিলার খেয়ে ব্যথাটা একটু কমেছে। কিন্তু, মনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে-

শ্রীকান্ত মৃদু হেসে বললো –

- তুমি অসম্ভব ভালো অভিনেত্রী। ভালো অভিনেত্রী জানতাম, কিন্তু এতটা ভালো তা আগে বুঝি নি। তুমি এখন মনে হয় নরমাল। যে ওষুধটা খেয়েছিলে বা খাওয়ানো হয়েছিল তার প্রভাব সম্ভবত কেটে গেছে।

- মানে! বুঝলাম না। তুমি কি বলতে চাইছ?

- রেপ করে যারা একটি মেয়েকে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে যায় তারা কোনদিন মেয়েটিকে ফেলে যাবার আগে আন্ডার গার্মেন্টস অর্থাৎ প্যান্টি পড়িয়ে ফেলে যায় না। আর কেউ খেয়াল না করলেও আমি করেছি। তোমার অভিনয়ও দুর্দান্ত ছিল। কেউই বুঝতে পারে নি। আমি এখন ভিলেন, সবার চোখে পৃথিবীর ঘৃণ্যতম মানুষ। তুমি এই মুহূর্তে সিনেমা জগতের উঠতি নায়িকা। দু-দুটো সিনেমায় নায়িকার ভূমিকায় নেমে অভিনয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছ। সিনেমা দুটো আমি দেখেছি - তোমার অভিনয় অসাধারণ হয়েছে। সম্ভবত তোমার প্রচুর লাভারও আছে। এই ভিলেনটাকে বিয়ে করবে? উত্তর এখনই চাই না, আমার অনেক অনেক কিছু বলার আছে। সব শুনে তারপরে না হয় উত্তরটা দিও।

বিপাশা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তাহলে রাস্তার ধারে ওর বডি দেখেই শ্রীকান্ত সব বুঝে গিয়েছিল! তারপরও, ওকে না মেরে ফেলে এখানে নিয়ে এসেছে! ওর এই ছলনার উদ্দেশ্য কি তা বোঝার ক্ষমতা শ্রীকান্তর যথেষ্টই আছে। তাহলে? আবার বিয়ের প্রস্তাবও দিচ্ছে! নিশ্চয়ই ভিতরে এমন কোন গোপনীয় বিষয় আছে যা শুধু ওর নয় কারোরই জানা নেই। সেটা কি? ওকে জানতেই হবে।

(উনিশ)

রাতে শ্রীকান্তর সঙ্গে এক সঙ্গে ডিনার করতে বসে বিপাশা ভাবছিল কিভাবে প্রসঙ্গে এসে শ্রীকান্তকে ওর মনের কথা বলতে বাধ্য করবে। খাবার সামান্যই - পাঁঠার মাংস, হাত রুটি আর স্যালাড। বিপাশা রুটি ছিড়তে ছিড়তে বলল –

- তোমার আইরিনের পাল্লায় পড়ে অনেকগুলো পেইনকিলার খেতে হয়েছে। এ্যান্টাসিড না খাওয়ার জন্য পেট ফুলে আছে। মাংসের ঝোলটা অনবদ্য হলেও গোটা দুয়েক বেশি রুটি খেতে পারব না।

শ্রীকান্ত হেসে বলল –

- আজকে তাহলে দুটো রুটিই খাও। আগামীকাল ডিনারে এটাই করতে বলব, তখন ঠিক করে খেও। এই এক বছরে তুমি আরো বেশি সুন্দরী আর স্লিম হয়েছ। শুধু বাংলা সিনেমা নয়, আমার ধারণা হিন্দি সিনেমাতেও তুমি সাকসেস পাবে। তোমার হিন্দী উচ্চারণটা অবশ্য আরও ভালো করতে হবে।

শ্রীকান্তর বলার ধরনে বিপাশা হেসে ফেলল। সঙ্গে এটাও বুঝলো, শ্রীকান্ত দুজনের মধ্যে ব্যবধানটা কমাতে চাইছে। বিপাশাও তো এটাই চাইছে। শ্রীকান্ত খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল –

- তোমার শ্যুটিং নেই? কবে কলকাতায় ফেরার প্ল্যান করেছ?

- এই মুহূর্তে শ্যুটিং নেই। একটা সিনেমার শ্যুটিং শেষ করে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। সাত দিন বাদে কলকাতায় ফেরার টিকিট, দিল্লি থেকে ফ্লাইটে।

- আমিও ভাবছি তোমার সঙ্গে কলকাতায় ফিরবো। আর সরকারি স্পাই হয়ে কাজ করতে ভালো লাগছে না। অনেক হয়েছে।

- সরকারি স্পাই! বুঝলাম না।

- বুঝিয়ে বলছি। এ খবর মাত্র দু'জন মানুষ জানে। আর কেউ জানে না। তোমাকে বলবো, তুমি হবে তৃতীয় ব্যক্তি।

- এত যখন গুরুত্বপূর্ণ তখন বলার কি দরকার আছে!

- না, বলার দরকার আছে, দুটো কারণে। প্রথম কারণটা হল তোমাকে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর দ্বিতীয় কারনটা হল আর আমি তোমাকে হারাতে চাই না। মন দিয়ে সবটা শুনবে, যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে বলা শেষ হলে জিজ্ঞাসা করবে। আমার ছোটবেলা থেকেই মনে ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে আই.পি.এস. অফিসার বা গোয়েন্দা হব। গ্র্যাজুয়েশনের পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন যখন করছি তখন নিউজপেপারে একটা বিজ্ঞাপন দেখি, সি. বি. আইতে চাকরির বিজ্ঞাপন। মিনিমাম যোগ্যতা গ্রাজুয়েশন। আমি এ্যাপ্লাই করে ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ইন্টারভিউয়ের চিঠি এল। দিল্লিতে যেতে হবে ইন্টারভিউ দিতে। যাওয়া আসার ট্রেন খরচ ওরা দেবে। চলে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। প্রায় ঘন্টাখানেক ইন্টারভিউ নেওয়ার পর জানানো হল পরদিন আবার আমার ইন্টারভিউ হবে। আমার অদ্ভুত লেগেছিল, আমাকে ছাড়া আর কাউকে ওরা কিন্তু পরদিন আসতে বললেন না। যাই হোক, পরদিন ইন্টারভিউ দিয়ে যখন বের হচ্ছি তখন একজন মাছ বয়সী কিংবা ৫৬/৫৭ বছর বয়স হবে, মুখে দাড়ি গোঁফ আছে, আমাকে বললেন –“আমি ঠাকুর, সি. বি. আইয়ের চিফ। তোমাকে পছন্দ হয়েছে। কবে জয়েন করতে চাও”। আমি একটু হতভম্ব হয়েই বলেছিলাম “আপনি যেদিন বলবেন”। উনি বলেছিলেন “তাহলে আগামীকাল জয়েন কর”।

আমাকে জয়েন করতে উনি বললেন ওঁর চেম্বারে, আলাদা ভাবে। জয়েন করার পর শুরু হল ট্রেনিং। ট্রেনিং শেষ হল ছয় মাস বাদে। বাকিদের ক্ষেত্রে সেটা দুমাস। কেন, সেটা পরে উনি জানালেন। আমাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করতে হবে। কেউ জানবে না, আমি কোথায় আছি। এখবর শুধু দুজন জানবে, উনি আর আমি নিজে। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার কাজ হবে একটা নতুন সংগঠন গড়ে তোলা। যেই সংগঠনের কাজ বিদেশ থেকে লুকিয়ে অস্ত্রশস্ত্র এনে সন্ত্রাসবাদীদের কাছে বিক্রি করা। সংগঠনের আসল উদ্দেশ্য হবে সন্ত্রাসবাদীদের বা যত সন্ত্রাসবাদি সংগঠন ভারতে সক্রিয় তাদের উদ্দেশ্য জানা বা কবে, কোথায়, কখন, অ্যাটাক করতে যাচ্ছে তার খবর সংগ্রহ করে ওঁকে জানানো যাতে উনি সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন। তুমি হলে তৃতীয় ব্যক্তি যাকে আমি আসল কথাটা জানালাম। সি. বি. আইতেও কেউ জানে না আমি ওদের গোয়েন্দা বিভাগের একজন গোয়েন্দা। ব্যাস, তারপর বহু চেষ্টায় যে কিভাবে এই সংগঠন গড়ে তুলেছি সেটা শুধু আমিই জানি। সবার কাছে আমি ভিলেন, সন্ত্রাসবাদি - এই হল আসল সত্য।

(কুড়ি)

বিপাশার হঠাৎ রাগ হল, ভয়ানক রাগ। রেগে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল –

- গন্ডোলায় পাহাড়ের মাথায় তিয়াশা বলে মেয়েটিকে ঠোঁটে ঠোঁট ঢুকিয়ে চুমু খাও নি? তারপর, অজস্র মেয়ের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক হয়নি? কাজ ফুরিয়ে গেলে তাদের মেরে ফেল নি?

শ্রীকান্ত একটু চুপ করে থেকে বলল –

- তোমার অভিযোগগুলোর মধ্যে কিছু সত্যি আছে। তিয়াশা বলে মেয়েটি একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং ওরা ওকে পাঠিয়েছে আমার দলে থেকে আমার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে আমার থেকে সুযোগ-সুবিধা বা খবর বার করার জন্য। এটা বহু দিন আগে, তোমার সঙ্গে পরিচয়ের আগেই জানতে পারি। তারপর থেকে প্রেমের অভিনয় চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর আমি যতদিন তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে শুই নি। তুমি সম্পর্ক ছাড়ার পর স্বীকার করছি আমি অনেক মেয়ের সঙ্গে নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, সম্পর্ক তৈরি করেছি। তুমিও তো মডেলিং আর সিনেমায় চান্স পাওয়ার জন্য অনেকের সঙ্গেই রাত্রি কাটিয়েছ। আমার সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীনও করেছ। যাই হোক, এবারে খুনের কথা। হ্যাঁ, তিনটি মেয়ে যারা আমার গুপ্ত কথা জেনে ফেলেছিল, তাদের বিরুদ্ধে দেশের স্বার্থে আমাকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। ওরা তিনজনেই হার্ডকোর টেররিস্ট ছিল। ব্যাস, যা বলার ছিল সব বলেছি। ওরা সবাই তোমাকে মিথ্যা কথা বলে ব্যবহার করতে চেয়েছে।

- তুমি তো বললে সি. বি. আই. তে মিস্টার ঠাকুর একমাত্র তোমার কথা জানেন। তাহলে উনি তা না বলে আমাকে অন্য কথা বললেন কেন! এমনকি তোমাকে দরকার পড়লে ইনডাইরেক্টলি মেরে ফেলতেও বলেছেন।

- মিস্টার ঠাকুর বলেছেন! উনি আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন। তুমি ঠিক বলছো তো? উনি মিস্টার ঠাকুরই তো?

- আমি তো ওঁকে চিনি না। হিন্দুস্তান কি আখরি ধাবায় দেখেছি। পরে আমাকে খাবার দিয়ে হোটেল ছেড়ে চলে যেতে বলাতে আমি হোটেল ছাড়ি। তারপর গাড়িতে সোজা সাংলার মনাস্ট্রি। ওখানে উনি নিজের পরিচয় দিলেন- “আমি অনিল ঠাকুর, সি. বি. আইয়ের চিফ্” বলে।

শ্রীকান্ত অদ্ভুতভাবে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলল –

- আর ইউ সিওর, উনি নিজের নাম অনিল ঠাকুর বলেছেন!

- হ্যাঁ, পরিষ্কার মনে আছে।

- স্ট্রেঞ্জ! ভেরি স্ট্রেঞ্জ। আমার কাছে ওঁর একটা ছবি আছে। দেখ তো তুমি যাঁকে দেখেছ সে এই লোকটি কিনা।

বিপাশা শ্রীকান্তর স্মার্টফোনে থাকা ছবিটা খুঁটিয়ে দেখে বলল –

- হ্যাঁ, এই লোকটাই। একদম হুবহু এক। শুধু, যতদূর মনে পড়ছে, তোমার ছবিতে মানুষটির কপালে কোন আঁচিল নেই, কিন্তু আমার সঙ্গে যতবার ওঁর দেখা হয়েছে ওঁর কপালে আঁচিল দেখেছি। আসলে কপালের মাঝামাঝি জায়গায় ছোট্ট আঁচিলটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কারণ সিনেমার লাইনে এগুলো খুব খুঁটিয়ে দেখা হয়।

- হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। কিছু গন্ডগোল আছে। কি গন্ডগোল সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না। ও-কে, তুমি যদি সুস্থ থাকো, তাহলে তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। যাবে?

- একটা শেষ প্রশ্ন। কোনো সন্ত্রাসবাদী হামলায় তুমি থাকো না, এবারে নিজেকে জড়ালে কেন?

- এটা এতটাই বড় মাপের হামলা হবে যে আমার মনে হলো সেটাকে আটকানোর জন্য আমার জড়িয়ে পড়া দরকার। ব্যাস, আর কথা নয়, রেডি হয়ে নাও।

(একুশ)

রাত প্রায় দশটা। শ্রীকান্ত নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করবে। বিপাশা জিন্সের প্যান্টের উপর যত রকম গরম সোয়েটার আর জ্যাকেট পরা যায় সবকিছু পড়ে এসেছে কারণ বাইরে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা। ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে পাহাড়ি এঁকা বেঁকা রাস্তায় যখন শ্রীকান্ত ড্রাইভ করছিল তখন বিপাশা প্রথম দিকে চোখ বুজে বসে ছিল। পরে যখন বুঝল স্টিয়ারিং অত্যন্ত দক্ষ হাতে রয়েছে তখন চোখ অন্ধকারের সৌন্দর্য উপভোগ করা শুরু করল। দক্ষ হাতে যেভাবে অন্ধকারের মধ্যেও গাড়ি চালিয়ে শ্রীকান্ত গন্তব্যস্থলে পৌঁছলো বিপাশার একটা কথাই মনে হল এই পথে শ্রীকান্ত বহুবার গাড়ি নিয়ে এসেছে। শ্রীকান্ত ওকে গাড়ি থেকে নামতে বলল। সামনে একটা বড়ো বাড়ি, অনেকটা কম্পাউন্ডে ঘেরা। শ্রীকান্ত বলল –

- আগে এটা একটা রিসোর্ট ছিল। আমি কিনে নিয়েছি। সিজন্ টাইমে ভাড়া দেওয়া হয় তবে সামনের অংশ। বাকি সময় আমার কাজে লাগে। এটাই আমার ঘাঁটি। চলো যাওয়া যাক। আমাদের জন্য রুম, ডিনার সবই রাখতে বলে দিয়েছি।

রিসোর্টের পিছন দিকের অংশে দুটো কটেজ ওদের জন্য রাখা ছিল। শ্রীকান্ত বিপাশাকে জিজ্ঞাসা করল –

- আমরা কি একটা কটেজে থাকব নাকি আলাদা দুটো কটেজই লাগবে?

- আজ আমি ভীষণ টায়ার্ড, মেন্টালি আর ফিজিকালি। এখন ঘুমাতে চাই। আগামীকাল সকালে কথা বলা যাবে। ও-হ্যাঁ, তুমি বললে ডিনার বলা আছে। আমি ডিনার করবো না, তোমায় তো বলেছি পেট ফুলে আছে। ও-কে, গুড নাইট।

বিপাশা নিজের কটেজে ঢুকে দেখল লাগেজ কেউ একজন এসে কটেজের ভিতর রেখে গেছে। ঘরে বড়ো বড়ো দুটো কাঁচে ঢাকা জানালা। পর্দা টেনে দিল। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে জানালার পর্দা অল্প একটু সরিয়ে বাইরে দেখা শুরু করল। দূরে একটা কটেজে আলো জ্বলছে। পর্দা টানা বলে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ একজন এসে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরেটা দেখা শুরু করল। ঘরের ভিতরে বিপাশা মোট পাঁচ জন কে দেখতে পেল। চারজন সোফায় বসে, একজন জানালার সামনে। আরো মানুষ থাকতে পারে। সোফায় বসা চারজন মানুষের মধ্যে একজন শ্রীকান্ত। আরেকজন বিপাশার চেনা, সুবিমল রায় ওরফে মহম্মদ শাহিদ্। বাকিদের ও চেনে না। সেন্টার টেবিলের উপর একটা ম্যাপ রাখা। শ্রীকান্ত ম্যাপের উপর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কি সব বলছে। বিপাশা দ্রুত ডিসিশন নিলে কি করবে। প্রথমে স্মার্টফোনে ইংরেজিতে “নাউ” লিখে সেটা হোয়াটস্ অ্যাপ্ করে পাঠালো সেই নম্বরে যেটা ওর ফোনে সেভ করা আছে “নাউ” বলেই। ব্যাস, প্রাথমিক কাজ শেষ। এরপর যেটা করল সেটা হল ব্যাগ হাতড়ে গোটা তিনেক ছোট জিনিস প্যান্টের পকেটে ঢোকালো। একটা ছোট্ট স্প্রেকেও প্যান্টের পকেটে নিল। একটা ০.২৫ ক্যালিবারের রিভলভার কোমড়ে গুঁজে, জ্যাকেটের পকেটে গোটা তিনেক কার্তুজের ভর্তি ব্যারেল নিয়ে নিল। অভ্যস্ত হাতে রিভলভারটা কোমড় থেকে বার করে চেক করে নিল সব ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর আবার কোমড়ে গুঁজে নিঃশব্দে কটেজের দরজা খুলে বাইরে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে বেরিয়ে এল। এত রাতে, এরকম গা হিম করা ঠান্ডায় বাইরে লনে কাউকে দেখতে পাবে না এটা ও জানত। কিন্তু, মনে মনে ভাবছিল সন্ত্রাসবাদীরা অত্যন্ত চালাক। কম্পাউন্ডের ভেতরে সশস্ত্র পাহারাদার থাকবে না, এটা হতেই পারে না।

(বাইশ)

বিপাশা প্রতিটি কটেজের জানালার পাশে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ভেতরে কেউ আছে কিনা। এটা ওর চতুর্থ কটেজ, একদম বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে। ভিতরে একটা আওয়াজ পাচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ আছে। জানালা দিয়ে ভিতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না কারণ ভিতরে কোন আলো জ্বলছে না। ওর পাশে ঝোপ, দাঁড়িয়ে আছে ঘাসের ওপর মাটিতে, সামনে ফুট তিনেক দূরে কাঁচের জানালা। পর্দা টানা থাকলেও একটা দিকে একটু ফাঁকা, পুরোটা টানা নেই। ভিতরে একটা নাইট ল্যাম্প জ্বলছে, মনে হচ্ছে ঘরের ভিতরে কেউ হাঁটাচলা করছে। জানালার কাঁচের কাছে না গেলে ভিতরের মানুষটা কে ঠিক বোঝা যাবে না। অথচ যেতে গেলে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে খোলা অংশে যেতে হয়। বহু দূরে একটা আলো থাকলেও এই জায়গাটা একটু অন্ধকারই। ও রিস্ক নিয়ে এগিয়ে গেল। জানালার কাঁচে চোখ লাগাতেই মানুষটাকে দেখতে পেল। অল্প নীল রংয়ের নাইট-ল্যাম্পের আলোয় ধার থেকে মানুষটাকে দেখতে পেল। ঠিক চিনতে পারল না। পিঠে একটা খোঁচা, কানের সামনে কেউ একজন ফিসফিস করে বলল –

- ম্যাডাম, দু হাত উপরে তুলে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ান, না হলে গুলি চালাতে বাধ্য হব।

বিপাশা দুই হাত তুলে ঘুরে দাড়ালো। অতি অল্প আলোতে দেখতে পেল একটি ছেলে ওর দিকে রিভলভার তাক করে আছে। ছেলেটির মুখ চেনা চেনা লাগছে, সম্ভবত যখন শ্রীকান্ত গাড়ি নিয়ে আসার সময় রাস্তার ধারে পড়ে থাকা বিপাশাকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিল তখন এই ছেলেটি ওই গাড়িতে ছিল। বিপাশা এক পা এগলো। ছেলেটি হিসহিসিয়ে উঠলো –

- এগোবেন না, এগোলেই গুলি' চালাবো। এখানে কি করছেন?

বিপাশা মনে মনে রেডি ছিল, এই পরিস্থিতিতে পড়লে কি উত্তর দেবে। কিন্তু, ওকে কিছুই করতে হলো না। ওর কিছু বলার আগেই একটা মৃদু “ব্লপ্” আওয়াজ, ছেলেটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বিপাশা মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেল কি হয়েছে, কেউ সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারে ওকে গুলি করেছে। অন্ধকারের মধ্য থেকে দুজন মানুষ বেরিয়ে এলেন, আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা। একজনের হাতে সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার আর অন্যজনের হাতে একটা এল. এম. জি.। রিভলভার হাতে মানুষটি বিপাশাকে জিজ্ঞাসা করলেন –

- ম্যাডাম, আপনি ঠিক আছেন তো?

- হ্যাঁ। এই ঘরে লোক আছে। কে সেটাই দেখতে এসেছিলাম।

- আমরা দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনি চাইলে নিজের ঘরে যেতে পারেন।

- আমি বরং ওইদিকে যাই। ওই দূরের কটেজটায় একটা মিটিং হচ্ছে।

- ও-কে। বেস্ট অফ লাক।

বিপাশা এগিয়ে কটেজের জানালার পাশে এল। এই ঘরেই শ্রীকান্তদের দেখেছিল। ভিতরে আলো জ্বলছে। পাঁচ জন মানুষ সোফায় বসে মাঝে সেন্টার টেবিলের উপর রাখা ম্যাপটাকে খুঁটিয়ে দেখছে। শ্রীকান্তই প্রধান বক্তা, আঙুল দিয়ে ম্যাপের নানান অংশ দেখিয়ে কিছু একটা বলছে। ওর পাশে কেউ একজন ফিস্ ফিস্ করে বলল–

- ম্যাডাম, আপনি একটু দূরে আড়ালে যান, গুলি গোলা চলতে পারে।

বিপাশা কোমড় থেকে রিভলভারটা বার করে হাতে নিল।

(তেইশ)

বিপাশা কিন্তু দূরে গেল না, একটু সরে দাঁড়িয়ে পাশে দুজনকে জায়গা করে দিল। দুজনের হাতেই লোডেড্ রিভলভার। বিপাশা খেয়াল করল, পাশের জানালার সামনেও দুজন দাঁড়িয়ে আর তাঁদের হাতের অস্ত্র রিভলভার নয় এল. এম. জি.। বিপাশা বুঝে গেল এখানে ওর না থাকলেও চলবে। এগিয়ে গেল একদম পিছনে কম্পাউন্ডের কর্নারে থাকা কটেজটির দিকে। এই কটেজে কোন আলো জ্বলছে না, সম্ভবত কেউ নেই। ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে অন্ধকারে কটেজের দরজার কাছে পৌঁছে গেল। এখন অবধি কোন বাধার সামনে পড়তে হয় নি। কটেজের সদর দরজায় তালা লাগানো। হ্যাচবোল্টের উপর মাঝারি মাপের তালা ঝুলছে। ভিতরে কেউ নেই। বিপাশার মনে একটা অস্বস্তি, একটা সন্দেহ দেখা দিচ্ছিল। দরজায় কান লাগিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো, নাঃ, কোন শব্দ নেই, শুধু একটা আওয়াজ মনে হচ্ছে কোন একটা ইলেকট্রনিক্স বা ইলেকট্রিক ইকুইপমেন্ট চলছে। এটা রেফ্রিজারেটরের আওয়াজ নয়। এই ঠান্ডায় কেউ ফ্যান চালাবে না। রুম হিটার? হতে পারে। রুম হিটারের মুভমেন্টের আওয়াজ হতে পারে। পুরো বডি যখন রোটেট করে চারপাশে হিট ছড়ায় তখন এই রকম শব্দ হওয়ার চান্স আছে। ঘরে কেউ নেই অথচ রুম হিটার চলছে! স্ট্রেঞ্জ! দ্রুত ডিসিশন নিল, তালা খুলে ঘরে ঢুকবে। পকেট হাতড়ে যেটা বার করলো সেটা একটা মাস্টার কি সেট। প্রথম চাবিটায় কাজ হল না। দ্বিতীয় চাবিটা কাজ করলো। তালাটা যতটা নিঃশব্দে সম্ভব খুলে দরজাটা অল্প একটু বাহাত দিয়ে ফাঁক করল। ডান হাতে রিভলভারটা বাগিয়ে চোখ রাখলো দুই দরজার পাল্লার সরু ফাঁকে। অনুমান একদম ঠিক। রুম হিটার চলছে, পুরো বডিটা ঘুরে ঘুরে হিট ছড়াচ্ছে সারা ঘরে। রুম হিটারের অত্যন্ত অল্প আলোয় মনে হলো বিছানায় কেউ একজন শুয়ে আছে।

আস্তে আস্তে দরজার পাল্লাটা ঠেলে ফাঁক একটু বড়ো করে কোনরকমে ভিতরে ঢুকে দরজার পাল্লাটা আবার ঠেলে বন্ধ করে দিল। তারপর, চুপ করে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে শুরু করল। অন্ধকারে কিছুক্ষণ থাকার পর চোখ একটু সেট হলে মনে হল ঘরে কেউ নেই। প্যান্টের পকেট থেকে স্মার্টফোনটা বার করে ফোনের টর্চটা জ্বেলে বিছানার উপর ফেলল। যে মানুষটা শুয়ে আছেন তাঁর হাত-পা বাঁধা, মানুষটি ওর চেনা। স্মার্টফোনের টর্চটা নিভিয়ে মানুষটির পাশে এসে দাঁড়ালো। কিভাবে মানুষটিকে এখান থেকে নিয়ে যাবে সেটাই ভাবছিল। পিছন থেকে একটা গলা ভেসে এল, লোকটি ফিসফিসিয়ে বলছে –

- ম্যাডাম, হাতের রিভলভারটা বিছানার উপর রেখে হাত তুলে ঘুরে দাঁড়ান। না হলে, গুলি করতে বাধ্য হব।

বিপাশা জানে তাড়াহুড়ো করে কোন লাভ নেই। এ ধরনের পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে ও জানে, ওকে সেসব নানাভাবে শেখানো হয়েছে। ধীরে-সুস্থে, রিভলভারটাকে বিছানার উপর এমন ভাবে রাখল যাতে দরকার মতো দ্রুত হাতে তুলে নেওয়া যায়। তারপর, ধীরে ধীরে হাত দুটো তুলে ঘুরে দাঁড়ালো। বাঁ হাতের স্মার্টফোনের টর্চ জ্বালানোর সুইচের থেকে আঙুল কিন্তু সরালো না। অন্ধকারে খুব অল্প আলোয় আবছা একটা অবয়ব দেখতে পেল। হঠাৎ স্মার্টফোনের টর্চের আলোটার সুইচ টিপে দিল। তীব্র আলোর ঝলক সামনে দাঁড়ানো লোকটির উপর পড়তেই, এক মুহূর্তের জন্য হলেও লোকটি থতমত খেয়ে গেল, ব্যাস, এটাই যথেষ্ট। দীর্ঘ ছয় মাস ধরে প্র্যাকটিস করার ফল, কুংফুর একটা কৌশল, একসঙ্গে ডান পা লোকটির কুঁচকিতে আর ডান হাতের মুঠি লোকটির থুতনিতে, লোকটি কাতরে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ততক্ষণে বিপাশা নিজের রিভলভারটা বিছানা থেকে তুলে নিয়েছে। লোকটির হাত থেকে খসে পড়া রিভলভারটাকে পা দিয়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল খাটের নিচে।

(চব্বিশ)

এই মুহূর্তে বিপাশার প্রথম ও প্রধান কাজ হল বিছানায় শোয়া মানুষটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া। এই মানুষটির জন্যই তো এত কিছু। কটেজের দরজা দ্রুত বন্ধ করে স্মার্টফোনে হোয়াটস্ অ্যাপ খুলে “নাউ” বলে সেভ করা নম্বরটা খুলে “ফাউন্ড, কাম ইমিডিয়েটলি” লিখে সঙ্গে লোকেশন শেয়ার করে পোস্ট করে দিল। তারপর, রিভলভার বাগিয়ে ঘরের নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসে রইল।

মিনিট পাঁচেক বাদে সদর দরজার সামনে একটা মৃদু পায়ের শব্দ, বিপাশার মনে হল দু থেকে তিনজন মানুষের পায়ের শব্দ। দ্রুত উঠে গিয়ে দরজার পাশের দেওয়ালের পিছনে দাঁড়ালো। দুবার দরজা নক্ করার শব্দ। ও দরজা না খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট তিনেক দু'পক্ষই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। বিপাশা তাও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতীক্ষা করছিল অপরপক্ষ কি করে তা দেখার জন্য। এটা শিখেছে ট্রেনিংয়ের সময়। অপরপক্ষ ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করল। হঠাৎ বেশ কয়েকটা “ব্লপ্ ব্লপ্” শব্দ। কাঠের দরজায় তীব্র কাঠ ফাঁটার আওয়াজ, ওরা তাহলে সাইলেন্সার লাগিয়ে রিভলভারে গুলি চালাচ্ছে। ও দরজার সামনে থাকলে গুলির আঘাতে মারা যেত অথবা সাংঘাতিকভাবে আহত হত। নিজের রিভলভারটা বাড়িয়ে ধরল। সেফটি লকটা খোলাই আছে। হঠাৎ বাইরে তীব্র এল. এম. জির আওয়াজ। বাইরে দু-তিনজন মানুষের আর্তনাদ। বুঝলো, এবারে আসল লোকেরা এসে গেছে। বাইরে কেউ একজন বলল –

- ম্যাডাম “রেড ম্যাকাও”, দরজা খুলতে পারেন।

বিপাশা এতক্ষণ এই “রেড ম্যাকাও শুনতে পায়নি বলে দরজা খোলে নি। দরজা খুলে দেখলো প্রায় ৭-৮ জন অস্ত্রধারী কম্যান্ডো, প্রত্যেকের পরণে কালো পোশাক। একজন অবশ্য কম্যান্ডো নন, কিন্তু বিপাশার পরিচিত। উনি একজনকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে সবটা দেখে হেসে বললেন –

- একটা ঘরে পাহারায় ছিল! আপনি ওর যা হাল করেছেন! মেনি মেনি থ্যাংকস। আপনি যা আমাদের জন্য করেছেন, আমরা কোনদিন ভুলতে পারব না। আমাদের চিফকে যে আবার আমরা জীবিত অবস্থায় পাব তা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবি নি। সত্যি কথা বলতে গেলে আমরা ওঁর আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। উনি কি সুস্থ আছেন? নাকি –

- জানি না। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছেন। সম্ভবত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। গুলির আওয়াজেও যখন ঘুম ভাঙলো না-

- ঠিক আছে, আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। চলুন, যাওয়া যাক।

বিছানায় শোওয়া মানুষটাকে তিনজন কম্যান্ডো যখন স্ট্রেচারের অভাবে বিছানাশুদ্ধু বাইরে বার করছেন তখনও তিনি ঘুমন্ত অবস্থায়। বিপাশা বুঝলো, অত্যন্ত স্ট্রং ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।

(পঁচিশ)

পরদিন ভোরে নটা নাগাদ একজন কম্যান্ডো এসে ওর কটেজ থেকে ডেকে নিয়ে গেল দূরের একটা কটেজে। কটেজের চারপাশে অন্তত ১২/১৪ জন কম্যান্ডো পাহারায় রয়েছে। এছাড়াও সিবিআইয়ের বেশ কয়েকজন গোয়েন্দাকেও দেখতে পেল। আগের দিন রাতে ও নিজের কটেজেই ফিরে গিয়েছিল। কটেজের ভিতর ঢুকতে যেতেই দু-তিনজন কমান্ডো ওকে আটকালো। ভিতর থেকে কেউ একজন ওকে ঢুকতে দিতে বললেন। ভিতরে ঢুকে দেখলো চেয়ারে গতকাল রাতে উদ্ধার হওয়া মানুষটি বসে আছেন। ওঁকে ঘিরে চারপাশে বিছানা আর চেয়ারে বসে আছেন অন্তত আট জন সশস্ত্র সিবিআইয়ের গোয়েন্দা। উনি বিপাশাকে একটা ফাঁকা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে বললেন –

- ওয়েল ডান। তুমি যে কাজটা করেছ সেটা আমাদের পক্ষে করা অসম্ভব ছিল। অসম্ভবকে সম্ভব করেছ তুমি।

বিপাশা হেসে একটু ইতস্তত করে সি.বি.আই. চিফ মিস্টার ঠাকুরকে বলল –

- আমি আমার যথাসাধ্য করেছি। আমি সবসময়েই বুঝতে পারতাম পিছনে আপনার লোকেরা আছেন। আসলে আপনাকে কিভাবে ওরা কব্জা করেছিল সেটা ঠিক জানি না। আমার কাছে এটুকু বলা হয়েছিল যে ওরা আপনাকে তুলে নিয়ে গেছে। আপনাকে উদ্ধার করার জন্য আমার সাহায্য দরকার। তারপর, বাকিটা আপনি নিশ্চয়ই সব জেনে গেছেন।

- আমার উইক পয়েন্ট হচ্ছে আমার জমজ ভাই। দিল্লিতে ওর হোটেলে নিমন্ত্রণ এড়াতে পারি নি। থাকে সিমলায়। দিল্লিতে ৪/৫ দিনের জন্য এসেছে জানিয়ে আমার সঙ্গে ডিনার করতে চাইল। ও যে সন্ত্রাসবাদীদের হাতের পুতুল তা তো তখন বুঝিনি। খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কব্জা করল। ওখান থেকে সেই রাতেই গাড়িতে আমাকে নিয়ে গেল সিমলায়। সারাক্ষণই ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখত। একারণে, কখন কোথায় আমাকে নিয়ে গেছে সঠিক বলতে পারব না। তবে, যতটুকু জানা গেছে, শ্রীকান্ত যখন যেখানে গেছে আগে বা পরে আমাকে সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ও বোধহয় অন্য কারো উপর ভরসা করতে পারে নি। আসলে আমাদের মধ্যে পরিচয় তো বহু বছরের তাই রিস্ক নিতে চায় নি।

- ও তো আপনাকে খুনও করে দিতে পারত, এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল কেন? উদ্দেশ্য কী ছিল?

- সেটা আমি ওকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু কোন উত্তর পাই নি। দুটো উত্তর আমার মনে হয়েছে। প্রথমটা হল আমার বিরুদ্ধে তীব্র রাগ থাকার কারণে ও এতদিন ধরে অত্যাচার চালিয়ে মনে মনে আনন্দ পাচ্ছিল। পরে সময় সুযোগ মত মেরে ফেলে আমার ভাইকে সিবিআই চিফ হিসাবে দিল্লিতে সিবিআই দপ্তরে বসাতো। তাতে পুরো সিবিআইয়ের কন্ট্রোল চলে আসতো ওর হাতে। আর দ্বিতীয়টা হল ও জানে আমি যতদিন ওর কব্জায় জীবিত অবস্থায় থাকব ততদিন সরকার ওর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এক ধরনের ব্ল্যাকমেল আর কি।

- শ্রীকান্তকে কোথায় রাখা হয়েছে? একবার কি কথা বলতে পারি?

- হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। তোমার প্রাক্তন প্রেমিক বলে কথা। শেষবারের মতো কথা বলে নাও, এরপর ওকে চালান করা হবে, ওর যা অপরাধ তাতে ফাঁসি তো অনিবার্য্য।

(ছাব্বিশ)

সশস্ত্র পাহরায় শ্রীকান্তকে রাখা হয়েছে। যে কটেজে ওকে রেখেছে তার চারপাশে অজস্র কম্যান্ডো আর সিবিআইয়ের গোয়েন্দা। কটেজের ভিতর একটা চেয়ারে ওকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। হাতে হ্যান্ডক্যাপ, দুপা আর দেহ চেয়ারের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা। বিপাশা একটা চেয়ার নিয়ে এসে শ্রীকান্তর সামনে বসে পড়ল। শ্রীকান্ত ওকে দেখে ম্লান হেসে জিজ্ঞাসা করল –

- শেষ দেখা দেখতে এসেছ?

বিপাশা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল –

- কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছি।

- আমারও কয়েকটা প্রশ্ন আছে।

- জানি। প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তারপর তোমার সব কৌতুহল মেটাবো। প্রথম প্রশ্ন, এখন অবধি কটা মেয়েকে ভোগ করে খুন করেছ? আমায় খুন করলে না কেন?

- সংখ্যাটা সঠিক বলতে পারব না। ১৪ বা ১৫। হয়তো এর থেকেও বেশি। তোমাকে খুন করি নি - আসলে বিছানায় তুমি এত চার্মিং - তারপর হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ব্যাস, এটাই কারণ।

- সি.বি.আই. চিফ মিস্টার ঠাকুরকে নিয়ে তোমার প্ল্যানটা কী ছিল?

- খুব সোজা। ওর জায়গায় ওর জমজ ভাই সুনিল ঠাকুরকে বসানো যাতে সি.বি.আইয়ের পুরো কর্মকান্ড আমি কন্ট্রোল করতে পারি। তারপর সময় বুঝে চিফ অনিল ঠাকুরকে হত্যা করা।

- তাহলে আমাকে নিয়ে ছিটকুলে অত নাটক করা, ধরে নিয়ে গিয়ে নকল চিফকে দিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করানো, মিথ্যে একটা গল্প বলা, এসবের কারণ কী?

- বলছি। আসলে ছিটকুলে তুমি যেমন আমায় প্রথম দেখে অবাক হয়েছিলে সেরকম আমিও তোমায় দেখে অবাক হয়েছিলাম। তারপর তোমার ছবি তোলা। আমার লোক যখন তোমার ক্যামেরা সার্চ করল ছবিগুলো পেল না। আমার মনে দুটো সন্দেহ হয়েছিল, প্রথমত তোমার পিছনে কেউ আছে। সেটা কারা? কলকাতার গোয়েন্দা দপ্তর? সি.আই.ডি.? নাকি সিবিআই? দ্বিতীয় সন্দেহ হল তোমার পিছনে কেউ নেই যা করছ আমার উপর ভয়ঙ্কর রাগে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য করছ। যেটাই হোক, দুটোই আমার পক্ষে ক্ষতিকারক। তাই, ছবি উদ্ধারের জন্য নকল চিফকে ময়দানে নামালাম। তোমার রুমের সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ থেকে কিছু পেলাম না। তোমার ঘর সার্চ করেও কিছু যে পাওয়া গেল না! ওই ছবিগুলো আমার বিরুদ্ধে অত্যন্ত জোরালো প্রমাণ। তাই, নাটক আর গল্প। আমি তোমার মত অভিনয় না জানলেও অভিনয়টা ভালোই পারি। এই পুরো গল্পের লেখক আর পরিচালক আমি।

- বাজে গল্প, দুর্বল পরিচালনা। ছবিগুলো কোথায়?

- সে কি আর আছে! নষ্ট করে দিয়েছি। যাই হোক, আমার ধারণা ভুল ছিল। তোমার পিছনে যে সিবিআই আছে তা বুঝতে পারি নি। পারলে হয়ত –

- বুঝতে পারলে আগের মেয়েগুলোর মত আমাকেও খুন করতে। তাইতো? যাক, এবারে তোমার কৌতুহল মেটাই। প্রথমে জানাই যে ছবিগুলো তোমার কাছে নকল চিফ মানে সুনীল ঠাকুরের মাধ্যমে পৌঁছেছিল তার এক কপি ইমেইল এবং গুগুল ড্রাইভ-য়ের মাধ্যমে হোটেলের রুমে বসেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সিবিআইয়ের কাছে। তাই, ওগুলো নকল চিফকে জেনে-বুঝেই দিয়ে দিয়েছিলাম। এবার তাহলে গল্পটা শুরু করি।

(সাতাশ)

বিপাশা শুরু করল –

- এই ঘটনার সূত্রপাত মোটামুটি মাস আটেক আগে। তোমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর সি.বি.আই. থেকে আমার উপর নজর রাখা হয়েছিল। ওঁদের সন্দেহ ছিল এই ছাড়াছাড়িটা একটা গট্ আপ্ কেস্। কোন বড়ো উদ্দেশ্যে এটাকে ঘটানো হয়েছে লোককে দেখানোর জন্য। যখন ওঁরা বুঝলেন তোমার সন্ত্রাসবাদি সংগঠনের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই, তখন বলিউডের একটি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার অজুহাতে ডেকে পাঠানো হল মুম্বাইতে মাস আটেক আগে। সেখান থেকে ফ্লাইটে দিল্লী। প্রাইম মিনিস্টার এবং মিস্টার ঠাকুরের সঙ্গে গোপনে একটা মিটিং হল। আমিও গিয়েছিলাম ছদ্মবেশে যাতে কেউ চিনতে না পারে আমাকে। কারণ, মিস্টার ঠাকুরের সন্দেহ ছিল সিবিআইতেও তোমার ইনফর্মার আছে। তুমি যে বহুদিন সিবিআইতে ছিলে সে খবর ওঁরাই আমাকে জানালেন। তোমার সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য তখন জানানো হল আমাকে। ওঁরা আমার সাহায্য চাইলে আমি রাজি হলাম। এরপর তৈরি হলো মাস্টার প্ল্যান। সেই প্ল্যানের অঙ্গ হিসাবে ওঁরা বলিউডের দ্বিতীয় সারির এক ফিল্ম ডাইরেক্টরকে রাজি করালেন কলকাতায় এসে লোকদেখানো কিছু সিন তোলার জন্য। একজন বয়স্ক গোয়েন্দাকে বানানো হল কোটিপতি ব্যবসায়ী যিনি বাংলা সিনেমায় টাকা ঢালতে চান। টালিগঞ্জ পাড়ায় একটা বড় ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হল। প্রোডিউসার এসে ওখানেই উঠলেন। শুরু হল লোক দেখানো শুটিং। তৈরি করা হল রিউমার। আমি প্রোডিউসারের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছি। সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে খবর ওঁরাই পৌঁছে দিলেন। মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমার ইন্টারভিউ নেওয়া হল। আমি স্বীকারও করলাম। এসবই করা হয়েছিল তোমাদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য। সিনেমার শুটিং নামেই হত, আসলে চলত আমার ট্রেনিং। কুংফু, ক্যারাটে থেকে সেল্ফ ডিফেন্সের নানান কৌশলের সঙ্গে রিভলভার চালানোয়, বন্দুক চালানোয় আমাকে এক্সপার্ট করে তোলার চেষ্টা করা হল। ট্রেনিং চলছিল, হঠাৎ সব গোলমাল পাঁকিয়ে গেল। মিস্টার ঠাকুরকে তোমরা কিডন্যাপ করলে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সিনেমার কাজ শেষ বলে জানানো হল। টিভিতে বেশ কয়েকটি চ্যানেলে ট্রেলারও রিলিজ্ করা হল। সাধারনত, একটা কাজ শেষ হওয়ার পর আমি ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি, এটা তুমি জান। আমরা জানতাম তোমার লোকেরা আমার উপর নজর রাখছে। সে কারণেই এত সব কিছু। আমাকে জানানো হল তোমাকে ছিটকুলে দেখা গেছে। ব্যাস, চলে এলাম ছিটকুলে। আমার জুতোয় লাগানো জিপিএস ট্র্যাকার থেকে ওঁরা আমার অবস্থান জেনে যেত। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমে মিস্টার ঠাকুরকে উদ্ধার করা, যদি অবশ্য উনি জীবিত থাকেন। ছিটকুলে, হিন্দুস্তান কি আখরি ধাবায় সুনীল ঠাকুরকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম উনি অনিল ঠাকুর নন। অভিনয় চালিয়ে গেলাম। বাকি সবটাই তুমি জান। সাংলায় মনাস্ট্রিতে অভিনয়টা ভালোই করেছিলাম, তাই না? এরপর, যে মুহূর্তে তুমি আমাকে তোমার সেলফোনে অনিল ঠাকুরের ছবি দেখালে আর বললে চিফ কখনো নিজের নাম “অনিল ঠাকুর” বলেন না তখনই তোমার প্ল্যান আমি বুঝতে পেরেছিলাম। নকল চিফের কপালে ফলস আঁচিল লাগিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলে লোকটি আসল নয়। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে কপালে আঁচিল দেখলেই আমি আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালাবো আর লোকটিকে মেরে ফেলব। একারণেই আমাকে রিভলভার চালানো শেখানোর দরকার হয়েছিল। এরপর, সুযোগ বুঝে আসল মিস্টার ঠাকুরের কপালে আঁচিল লাগিয়ে আমার সামনে হাজির করা হত যাতে আমার হাতেই খুন হন। ঠিক বলেছি তো?

- একদম ঠিক। কিন্তু, এতসব কেন করলে?

- সত্যি বলছি, তোমায় ভালোবাসি বলে। তোমায় যে অনেক অনেক ভালোবেসেছিলাম।

- স্ট্রেঞ্জ! তাহলে যখন বললাম বিয়ে করতে তখন রাজি হলে না কেন! আমি সব ছেড়ে সত্যি বলছি তোমার সঙ্গে অন্য কোথাও চলে যেতাম।

- কি করবো বল, আমি আমার নিজের দেশকে তোমার থেকেও যে বেশি ভালোবাসি।

বিপাশার চোখে হঠাৎ জল এসে গেল। ওর প্রাক্তন প্রেমিকের দিকে একবারও না তাকিয়ে গটগট করে কটেজ থেকে বেরিয়ে এল বাইরে, মুক্ত আকাশের নিচে। এখন ও মুক্ত। নতুন করে নতুন ভাবে ও বাঁচতে চায়, শুরু করতে চায় নতুন এক জীবন।


-----------

Comments


bottom of page