top of page
Search

রহস্য উপন্যাস - মাত্র চৌত্রিশ ঘন্টা

আবীর গুপ্ত


(এক)

প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাজের এখন একটু দুঃসময় চলছে। প্রফেশনাল গোয়েন্দা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেছে। এখন ভারতের অধিকাংশ মানুষই ওরনাম জানে। দুপুর তিনটে বাজে। রাজ টিভির সামনে বসে ছিল। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে ভারত এবং পাকিস্তানের প্রথম টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়েছে। আজ তার দ্বিতীয় দিন। ভারত টসে জিতে ব্যাটিং নেয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রথম দিনেই সবাই অলআউট হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছে যায়। শেষ দুই ব্যাটসম্যান প্রথম দিনটা ঠুকঠুক করে কাটিয়ে দিলেও দ্বিতীয় দিনের লাঞ্চের আগেই আউট হয়ে যায়। পাকিস্তান এখন ব্যাটিং করছে। বিছানায় শুয়ে টিভি দেখতে দেখতে ভাবছিল এভাবে আর বেশি দিন কাটানো যাবে না। ওর স্মার্ট ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। ফোনটা ধরতেই উল্টোদিক থেকে একজন হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন – “আপনি কি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাজ কথা বলছেন?” “ হ্যাঁ” বলামাত্র উল্টোদিকের ভদ্রলোক বললেন – “ আমি সিবিআই দপ্তর থেকে কথা বলছি। মিস্টার ঠাকুর, সিবিআই চিফ আপনার সাথে কথা বলতে চান। আপনি ফোনটা একটু হোল্ড করুন”। মিনিট খানেক বাদে মিস্টার ঠাকুর ফোনটা ধরলেন । সেই চেনা গলার আওয়াজ। মিস্টার ঠাকুর রাজের অত্যন্ত পরিচিত এবং বহুবার সিবিআই এর সাথে রাজ তদন্ত করেছে এবং বেশ কয়েকটি কেসে সিবিআইকে সাহায্যও করেছে। মিস্টার ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন –

- আপনার হাতে এখন কোন কেস আছে?

রাজ বলল –

- না। এখন ফ্রি টাইম কাটাচ্ছি।

- তাহলে দিল্লি চলে আসুন। আজকে রাতে আটটার সময় একটা ফ্লাইট আছে। টিকিট আমরা আপনার ইমেইলে ১৫ মিনিটের মধ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনার থাকার ব্যবস্থা এয়ারপোর্টের পাশেই একটি হোটেলে হয়েছে। আপনি মালপত্র রেখে সোজা চলে আসবেন প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে। সেখানে একটা মিটিং-এর ব্যবস্থা হয়েছে। মিটিংয়ে আমিও থাকব। বিষয়টা অত্যন্ত জরুরী, ফোনে বলা যাবে না। আপনার দিল্লি আসতে আড়াই ঘন্টার মত লাগবে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে বেরোতে আরো আধঘণ্টা। মোটামুটি রাত বারোটা নাগাদ প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে মিটিংটা রাখা হয়েছে এই সমস্ত ভেবেই। বাকি কথা মিটিং এর সময় হবে।

ফোনটা কেটে দেওয়ার পর রাজ ভাবছিল - সি.বি.আই. চিফ মিস্টার ঠাকুর নিজে ফোন করেছেন, রাত বারোটায় প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে মিটিং এর ব্যবস্থা হয়েছে - তার মানে বিষয়টা অত্যন্ত জরুরী। দেখা যাক।

রাত আটটার ইন্ডিগো ফ্লাইট দিল্লি পৌঁছল সঠিক টাইমে। এয়ারপোর্ট থেকে যখন রাজ বাইরে বেরোলো তখন সাড়ে দশটা বাজে। বাইরে গেটের কাছে একজন রাজের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। রাজ যেতেই তিনি রাজকে নিয়ে সোজা চলে গেলেন একটা গাড়ির কাছে। একটা বলেরো। রাজ গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট করে দিলেন । হোটেলটা এয়ারপোর্ট থেকে এক কিলোমিটার দূরে। মালপত্র রুমে রেখে বেরিয়ে পড়ল। ওই গাড়িতেই চলে এলো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। সিকিউরিটি রাজের নাম এবং ভিজিটিং কার্ড নিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দিল। দু মিনিটের মধ্যেই ভেতর থেকে একজন এসে রাজকে নিয়ে গেল। বিশাল এক ড্রইংরুম, একদিকে অন্তত ১৫ থেকে ১৬ জন বসতে পারেন এরকম সোফা সেটের ব্যবস্থা করা। ওই সোফাসেটের একদিকে মিস্টার ঠাকুর বসে আছেন। আরো দুজনকে রাজ বসে থাকতে দেখল। তাদের কাউকেই ও চেনে না। মিস্টার ঠাকুর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন –

- আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই। এঁদের দুজনের একজন আমাদের ভারত সরকারের টেররিজম্ রোখার জন্য যে সংস্থা রয়েছে তার চিফ, মিস্টার সুরিন্দর খান্না আর দ্বিতীয় জন মিস্টার রঞ্জন ভট্ট, আমাদের ভারত সরকারের গুপ্তচর বিভাগ টা সামলান। আমরা খবর পাঠিয়েছি প্রধানমন্ত্রী এখনই আসবেন আমাদের সাথে যোগ দিতে, তবে তার আগে আমি ছোট্ট করে আপনাকে ঘটনাটা কি সেটা বলতে চাই। তাহলে মিটিংটা করতে সুবিধা হবে।

রাজ চারপাশে ঝট করে একবার দেখে নিল, সারা দেয়াল জুড়ে অজস্র অয়েল পেইন্টিং। গম্ভীরমুখে মিস্টার ঠাকুরকে বলল –

- ওকে আপনি বলুন। কিন্তু, আমার একটা ছোট্ট প্রশ্ন আছে।

- কি প্রশ্ন?

- বিষয়টা কি ভারত পাকিস্তান যে টেস্ট চলছে - এর সাথে সম্পর্কিত?

উনি একটু হেসে বললেন –

- সব বলব। তাহলে শুরু করি। প্রধানমন্ত্রীর টেবিলের উপরে একটা গুরুত্বপূর্ণ পেপার একটা খামে করে রাখা ছিল। খামের মুখ খোলা ছিল। আমাদের গুপ্তচর বিভাগ থেকে এই খামটা ওঁকে দেওয়া হয়েছিল। তারপর, উনি খামটা খুলে ভিতরের কাগজটা দেখে আবার খামে ঢুকিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছিলেন। ঠিক সেই সময় ছয়জন মানুষ সেই ঘরে ঢোকে। তাঁরা কথাবার্তা বলতে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সাথে যখন কথাবার্তা চালাচ্ছেন এমন সময় একটা ফোন আসে। প্রধানমন্ত্রী উঠে যান ফোনটা ধরতে কারণ ফোনটা এসেছিল ল্যান্ডলাইনে। ফোনটা করা হয়েছিল অন্য একটা দেশ থেকে। সেই দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন একটা বিষয় জানানোর জন্য। ফোনটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই সময় ঘরে যে ছয়জনকে উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী যখন ফোন ধরার জন্য চেয়ার থেকে উঠছিলেন তখন তাকে বলে চলে যায়। উনি ফোনের কথা শেষ করে ফেরত এসে দেখেন তিনজন বসে আছেন। এই তিনজন মিনিট পাঁচেক বাদে ঘর থেকে চলে যান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর পর মিস্টার সুরিন্দর খান্না আসেন। প্রধানমন্ত্রী ওঁকে ঐ খামটা দিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিলেন। মিস্টার খান্না খামটা খুলে দেখলেন ভিতরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে ভরা আসল কাগজটা নেই তার জায়গায় অন্য একটি কাগজ রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে উনি গোয়েন্দা বিভাগ এবং আমাদের গুপ্তচর বিভাগ, সবাইকে বিষয়টা জানান। আমরা চলে আসি কিন্তু খুজে পাইনি কাগজটা। এই হচ্ছে পুরো ব্যাপার। আপনাকে ওই কাগজটা খুঁজে বার করে দিতে হবে। কাগজটা এতটাই জরুরী যে এই খেলা চলাকালীন এই কাগজ টা বার করে আমাদের হাতে না দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপনার সময়সীমা নির্দিষ্ট। আজকে খেলার দ্বিতীয় দিন শেষ হয়েছে। প্রথম টেস্ট পাঁচ দিনের টেস্ট। কাজেই আপনার হাতে সময় মাত্র তিন দিন অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টা। এই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে ওই খামটা খুঁজে দিতে হবে। সম্ভব?

(দুই)

প্রধানমন্ত্রী ঘরে এসে ঢুকলেন। সবাই উঠে দাঁড়ালেন। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। মিস্টার ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন –

- আপনি রাজকে সব বুঝিয়ে বলেছেন?

মিস্টার ঠাকুর জানালেন – হ্যাঁ।

প্রধানমন্ত্রী রাজকে জিজ্ঞাসা করলেন –

- আপনি পারবেন?

রাজ জবাব দিল –

- চেষ্টা করব। তবে আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে।

- কী প্রশ্ন?

- প্রথমত, কাগজটাতে কী লেখা আছে? এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খুঁজে বার করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে? দ্বিতীয়ত, ঘরে প্রথমে যে ছ-জন ঢুকেছিলেন তাঁদের নাম এবং পরিচয় জানা দরকার। তিন নম্বর, যে তিনজন চলে গেলেন আর বাকি তিনজন তারপরেও রইলেন, তাঁদের নাম দরকার। চার নম্বর, প্রধানমন্ত্রী যে ঘরে বসে ছিলেন সেই ঘরে একবার যাওয়া দরকার, ঘরটা দেখা দরকার। পঞ্চম প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রীর টেবিলের উপরে ল্যান্ডলাইন থাকার কথা, উনি চেয়ারে বসেই ফোনটা ধরবেন। ওঁকে কেন উঠে যেতে হল অন্য জায়গায়! সেই জায়গাটা কোথায় সেটাও জানো দরকার।

প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখে মনে হলো উনি রাজের এই প্রশ্নগুলো শুনে একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কারণ, এরপরে প্রধানমন্ত্রী একটু রুষ্ঠ হয়েই বললেন –

- খামটায় ভিতরে কাগজে কী ছিল সেটা জানানো সম্ভব নয়। ছয় জন মানুষের নাম এবং তার পরিচয়, সেটা হয়তো জানানো যেতে পারে কারণ এটা এত গোপনীয় যে আমরা কাউকে বলতে পারিনি। শুধু এই ঘরে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না। আপনি জানলেন। আপনাকে আমরা বিশ্বাস করে ওই ছয় জনের নাম বলতে পারি, কিন্তু এটা অবশ্যই দেখতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কোন সমস্যা তৈরি না হয়। কারণ এই ছ-জন অত্যন্ত বিখ্যাত মানুষ। ওঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলে আমাদের সরকার সমস্যায় পরতে পারে। এমনকী ওঁদের ঘরেও কোনরকম সার্চ করা যাবে না।

রাজ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল ও কি করবে। একটু হেসে বলল –

- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার আমাকে এখানে ডেকে আনার জন্য। কিন্তু, এই কেসটা সম্ভবত আমি নিতে পারবো না। যে কোন কেসে তার সফলতা নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর। তার মধ্যে প্রধান হল যিনি আমাকে কেসটা দিচ্ছেন তিনি আমাকে সব খুলে বলছেন কিনা। কেসটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আপনারা জানিয়েছেন এবং এটাও জানিয়েছেন যে আমাকে ওই কাগজটা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খুঁজে বার করে আপনাদের দিতে হবে অথচ কাগজটা কি না জানা থাকলে আমার পক্ষে খুঁজে বার করে আনা অসম্ভব। আমি হেরে যাব এটা মন থেকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে একটু অসুবিধা আছে। সরি স্যার, আমি কেসটা নিতে পারলাম না।

রাজ সবাইকে হাত জড়ো করে নমস্কার করে উঠে দাঁড়াল। প্রধানমন্ত্রী ভাবতেও পারেননি যে রাজের মুখ থেকে এরকম কথা শুনবেন। মিস্টার ঠাকুর হাতের ঈশারায় রাজকে বসতে বললেন। তারপর, প্রধানমন্ত্রীকে বললেন –

- স্যার, রাজকে সম্পূর্ণভাবে ভরসা করা যায় এবং আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি রাজের মতো গোয়েন্দা আমাদের দপ্তরেও নেই। যে কারণে আমি আপনাকে রাজের নাম সুপারিশ করি। পারলে রাজই পারবে। তবে ওর কতগুলো অদ্ভুত ভাবনা চিন্তা আছে। এবং সেই ভাবনা চিন্তার উপর নির্ভর করে ও কেস সলভ্ করে। এখন অব্দি আমি যতটুকু জানি ও কোন কেসে ব্যর্থ হয়নি। আমার অনুরোধ, আপনি বিষয়টা একটু বিবেচনা করে দেখুন। আমাদের হাতে সময় নেই এবং কাগজটাকে উদ্ধার না করতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন তারপর রাজের দিকে ফিরে বললেন –

- ও-কে, আমরা আপনাকে জানাবো। সত্যিই হয়তো আপনি ঠিকই বলেছেন। কাগজটাতে কি লেখা আছে না জানলে আপনার পক্ষে কাগজটা খুঁজে বার করা সম্ভব নয়। তাতে লেখা আছে - পাকিস্তানের একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আমাদের এখানে সন্ত্রাসবাদী হামলার ছক কষেছে। স্থান আর তারিখ এবং আনুমানিক সময় ওই লিস্টে রয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে সন্ত্রাসবাদীরা একটা বড়ো সড়ো হামলার চেষ্টা করবে। ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে খেলা চলাকালীন এমন সময়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে চাইছে যাতে ভয়ঙ্কর ক্ষয়ক্ষতি হয়। সঠিক সময়টা উল্লেখ নেই ঠিকই কিন্তু কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি করতে চাইছে তার একটা আভাস দেওয়া আছে। ওই কাগজটার মধ্যে ড্রয়িং করে ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠের কোথায় টাইম বোমা রাখার প্ল্যান করেছে তা দেওয়া আছে। দুর্ভাগ্যবশত, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে, আমার ডিসিশনের জন্য কোন কপি না রেখেই ওটা আমার কাছে পাঠানো হয়েছিল। হঠাৎই খামটা খুলে কাগজটা পড়ার পর আমার সেক্রেটারী আমাকে ফোন করে ছয় জন খেলার জগতের সাথে যুক্ত মানুষ দেখা করতে চাইছেন বলে জানান। এর মধ্যে তিনজন ভারতীয়, তিনজন পাকিস্তানি। বিষয়টা আর্জেন্ট বলাতে আমি ওঁদের আসতে বলি। এই তিনজন পাকিস্তানি হলেন ওদের ম্যানেজার আর ক্যাপ্টেন ও ভাইস ক্যাপ্টেন। ভারতীয় তিনজন হলেন ক্যাপ্টেন, ভাইস ক্যাপ্টেন আর দলের কোচ। দুজন পাকিস্তানি খেলোয়ার এবং ভারতীয় দলের কোচ শেষ অবধি ছিলেন। এই হলো পুরো ঘটনা।

(তিন)

রাজ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল –

- এই ছয়জনের সঙ্গে কথা বলা যাবে? আসলে কথা না বলতে পারলে এই কাজটা করা সম্ভব নয়। এটা তো বোঝাই যাচ্ছে, এই ছয়জনের মধ্যেই একজন অপরাধী। এখন, আপনি ফোন ধরতে উঠে যাওয়ার পর যে তিনজন তখনও আপনার অপেক্ষায় বসে ছিলেন, তাদের মধ্যেই কেউ অপরাধী - এটাই সবাই ধরে নেবে। কিন্তু, আমি সবার সঙ্গেই কথা বলতে চাই। হয়তো কথা বললে কোন না কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে। তাই, স্যার, আপনি যদি কথা বলবার অনুমতি দেন।

প্রধানমন্ত্রী একটু চুপ করে থেকে বাকিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন –

- আপনাদের কী মতামত?

কেউ কোন জবাব দিলেন না। অনেকক্ষণ বাদে মিস্টার ঠাকুর বললেন –

- রাজ হয়তো ঠিকই বলেছেন, ওঁদের সঙ্গে কথা বললে যদি কোন সূত্র পাওয়া যায়। কিন্তু, ডকুমেন্ট চুরির কথা বলা যাবে না। তাহলে সরাসরি ওঁদেরকে চোর বলা হয়। ওঁদের সঙ্গে কথা বলার জন্য অন্য কোনো অজুহাত খুঁজে বার করতে হবে।

রাজ একটু হেসে বলল –

- সে উপায়ও আছে। আমরা এটা তো বলতে পারি যে একটি সন্ত্রাসবাদি সংগঠন স্টেডিয়ামে হামলার ছক কষছে। তাই, দুই দলের প্লেয়ারদের সেফটির জন্য ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। হ্যাঁ, এটা ঠিক, পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদি সংগঠনটি জেনে যাবে যে ওদের হামলার খবর আমরা পেয়ে গেছি। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা যে ঘুমাচ্ছে না, সেটা ওরা বুঝবে। এতে লাভ-ক্ষতি দুটোই আছে। এবারে আপনারা বাকিটা ঠিক করুন।

রাজ ঘড়ি দেখছিল, রাত একটা বেজে গেছে। মিটিং কখন শেষ হবে বোঝা যাচ্ছে না। কেউ কোন কথা না বলে চুপ করে থাকাটাই ভালো মনে করে চুপ করে আছেন। শেষে, বেশ কিছুক্ষণ বাদে, প্রধানমন্ত্রী মৌনতা ভঙ্গ করে বললেন –

- অনেক রাত হয়ে গেছে। আর মিটিং লম্বা করার মানে হয় না। রাজ যা বলেছে, আপনাদের মুখ দেখে মনে হল তাতে আপনাদের সমর্থন রয়েছে। ঠিক আছে, তাহলে আমাদের সম্মান বাঁচিয়ে যা করার করুন। এই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণটা আটকাতেই হবে। আমরা প্রতিদিন, সম্ভব হলে রাত দশটা নাগাদ, মিট করব। কী প্রোগ্রেস হলো যেমন জানা যাবে তেমনই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও করা যাবে।

রাজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল –

- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। একটা কথা বলার ছিল। আমি বোধহয় প্রতিদিন মিট করতে পারব না। আসলে আমার প্রধান অস্ত্র মগজাস্ত্র। মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করে যদি দেহ সচল থাকে। প্রতিদিন যা দৌড়ঝাঁপ করতে হবে তারপর রাতে মিটিং অ্যাটেন্ড করা সম্ভব নয়। আমার সময়সীমা ৭২ ঘন্টা। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো ডকুমেন্টটাকে উদ্ধার করার। কিভাবে করব সেটা কারো সঙ্গে ডিসকাস করে করা সম্ভব নয় কারণ আমি একাই কাজ করতে ভালবাসি।

রাজ সবাইকে “গুড নাইট” জানিয়ে বেরিয়ে এল। প্রধানমন্ত্রী জীবনে প্রথম সম্ভবত কাউকে দেখলেন যে মুখের উপর ওঁকে না জানালো। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মিস্টার ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন –

- ও পারবে তো? এত স্ট্রেট ফরওয়ার্ড - আমাকে না বললো!

- পারলে রাজই পারবে। আমার ডিপার্টমেন্টের কেউ পারলে রাজের কথা বলতাম না। রাজের কথা শুনে মনে হল ও কোন সূত্র পেয়েছে। রাজকে ভালো মতন চিনি। নিশ্চিন্তে থাকুন, ও যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে। নিজের দেশকে ও হয়তো আমার আপনার থেকেও বেশি ভালোবাসে। আমাদের এমুহূর্তে ওর উপর ভরসা করা ছাড়া আর কোন উপায় আছে কি?

পর দিন সকালে সাতটায় অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লো, মাথাটা ভারী হয়ে আছে। আসলে ঘুমটা খুব প্রয়োজন ছিল, যেটা ঠিকমত হয়নি। রিসেপশনে বলা মাত্র চা এসে গেল। চা খাওয়ার পর বেরিয়ে পড়লো, গন্তব্যস্থল-ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম। ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠের সামনে অগুনতি দর্শকের ভিড়, হাতে টিকিট নিয়ে স্টেডিয়ামে ঢোকার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। রাজ ভিড় ঠেলে গেটের কাছে যেতেই দেখলো একজন ওর নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর আই.ডি.কার্ড ভালো করে চেক করে তবেই ওকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হল। রাজকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হল সেটা ড্রেসিংরুমের পাশে একটা ছোট্ট ঘর, ভিতরে সুরিন্দারখান্না আর রঞ্জন ভট্টকে বসে থাকতে দেখলো। সুরিন্দার খান্না রাজকে বললেন –

- প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে কথা হয়েছে, উনি সবার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদি হামলার কথা বলে সবার সাহায্য চেয়ে কথা বলতে বললেন। এই কারণে আমরা দুজনেই আপনার সঙ্গে থাকবো বলে ঠিক করেছি।

রাজ বুঝতে পারল প্রধানমন্ত্রী ওকে ভরসা করতে পারছেন না বলে সঙ্গে এই দু'জনকে লেজুড় হিসাবে জুড়ে দিয়েছেন। এতে ওর তদন্তের অসুবিধা হবে বুঝলেও সেই মুহূর্তে কিছু বলল না। কারণ, এখন এই ছয়জনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে এই দুজনের সাহায্য লাগবে। পাকিস্তানি ডেসিংরুমে পাকিস্তান দলের ম্যানেজার আর দলের ক্যাপ্টেনকে পেয়ে গেল। ম্যানেজার বয়স্ক, সিনিয়র সিটিজেন, ৬২/৬৩ বছর বয়স হবে। রাজ ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখে নিয়েছে উনি একসময় পাকিস্তান দলের শুধু ক্যাপ্টেনই ছিলেন না, পৃথিবী বিখ্যাত ফাস্ট বোলারও ছিলেন। ওঁর জনপ্রিয়তা এমনই, শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানের নির্বাচনে উনি নাকি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য লড়বেন। একটি রাজনৈতিক দলেও একারণে যোগ দিয়েছেন। ক্যাপ্টেন বেশ ভালো ব্যাটসম্যান। ভাইস ক্যাপ্টেন এলেন একটু বাদে। উনি দলের উইকেট কিপার কাম ব্যাটসম্যান। রিসেন্টলি খবরের শিরোনামে এসেছেন একজন পাকিস্তানী অ্যাক্ট্রেসকে বিয়ে করে। রাজের ক্যাপ্টেনকে দেখে মনে হল অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ। চোখ দুটো যেন জীবন্ত! রাজের মনে হল, এই মানুষটাকে ব্লাফ দিতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যাবে। এঁকে অত্যন্ত সাবধানে হ্যান্ডেল করতে হবে।

(চার)

পাকিস্তান দলের ম্যানেজার অত্যন্ত মিষ্টভাষী মানুষ। সুন্দর মিষ্টি করে বলে বুঝিয়ে দিলেন ওঁদের পক্ষে বেশিক্ষণ কথা বলা মুশকিল কারণ মাঠে নামার আগে একটা মানসিক শক্তি নিয়ে নামার দরকার আছে যেটা রাজেরা কথা বার্তা বলতে গেলে ব্যাহত হতে পারে। তবে, কথা দিলেন, তিনজনই খেলা শেষ হওয়ার পর যখন ড্রেসিংরুমে ফিরবেন তখন কথা বলবেন। রাজের মনে হল ক্যাপ্টেনের বোধহয় ম্যানেজারের এই সিদ্ধান্তে আপত্তি আছে। চোখের ভাষা তাই বলছে। মুখে অবশ্য কিছুই বললেন না।

ইন্ডিয়ার ড্রেসিংরুমের চেহারা দেখে রাজের প্রথমেই মনে হল এই টিম একেবারেই সঙ্ঘবদ্ধ নয়, যার ছাপ পড়েছে ড্রেসিংরুমে। দলের কোচ, ভারতীয় দলের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন এবং ওপেনিং ব্যাটসম্যান, এক কোণে দলের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলছেন। ক্যাপ্টেন, অত্যন্ত জনপ্রিয়, ডিপেন্ডেবল ব্যাটসম্যান, গালে হাত দিয়ে কোচের উপদেশ শুনছেন। ভাইস ক্যাপ্টেন একজন মিডিয়াম-ফাস্ট বোলার, একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাত ঘুরিয়ে বোধহয় শ্যাডো প্র্যাকটিস করছেন। মিস্টার খান্না কোচের পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে ওঁরা কেন এসেছেন জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মিনিট দশেক কথা বলা যাবে কিনা। কোচ এবং ক্যাপ্টেনের সম্মতি পেয়ে রাজকে বললেন শুরু করতে। রাজ একটু গুছিয়ে নিয়ে কোচকে জিজ্ঞাসা করল –

- বুঝতেই পারছেন বিষয়টা কতটা ডেলিকেট। একটা বোমা বা এক্সপ্লোসিভ এই স্টেডিয়ামেরই কোথাও একটা প্লেস করা হয়েছে, অথচ কোথায় আমরা জানি না। কত লোক যে মারা যেতে পারে। আপনি দু-দলের প্লেয়ারদের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু দেখেছেন?

- না। আমাদের দলের সম্বন্ধে নিশ্চিন্তে বলতে পারি যে আমাদের দলের সবাই দেশকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তবে, পাকিস্তান সম্বন্ধে বলতে পারব না। ওদের সবাইকেই আমার আইএসআইএর গুপ্তচর বলে মনে হয়।

রাজ ওঁর উত্তর শুনে হেসে ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞাসা করলো –

- আপনি বিপক্ষের প্লেয়ারদের মাঠে খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছেন, ওঁদের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে?

- না।

- ওঁদের মধ্যে কাউকে আপনার এবিষয়ে যোগাযোগ থাকতে পারে বলে মনে হয়?

- না, ঠিক বলতে পারব না।

- আচ্ছা, শুনলাম আপনি নাকি প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?

- হ্যাঁ। আমি একা নই, সঙ্গে কোচ এবং ভাইস ক্যাপ্টেনও ছিলেন।

- কোন বিশেষ কারণ ছিল?

- না। সেরকম কোন নির্দিষ্ট কারণ ছিল না। এটাকে আপনি সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার হিসেবে ধরতে পারেন।

- কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তো আলোচনা হয় নি?

- না।

- আপনাদের সঙ্গে কি পাকিস্তান দলের কেউ ছিলেন?

- হ্যাঁ। ওঁদের ম্যানেজার, ক্যাপ্টেন আর ভাইস ক্যাপ্টেন ছিলেন।

- ঐদিনকার ঘটনা যদি একটু খুলে বলেন। কতক্ষণ ছিলেন, কী কী ঘটেছিল এসব। কিছুই বাদ দেবেন না।

- এটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে কি সম্পর্কযুক্ত?

- হ্যাঁ, কিছুটা। প্লিজ, আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন।

- ও-কে, বলছি। আমরা তিনজন যখন প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে যাই, দেখি পাকিস্তানি দলের তিনজনও ওখানে রয়েছেন, ওঁরাও নাকি প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমরা আলাদা আলাদা ঢুকবো এটা ভালো দেখায় না। তাই, একসঙ্গেই ভিতরে ঢুকি। উনি যখন আমাদের সঙ্গে ড্রইংরুমে কথাবার্তা বলছিলেন তখন একটা ফোন আসে। উনি ফোনটা ধরতে উঠে চলে যান। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে উঠে পড়ি কারন পরদিন খেলার প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। আমার সঙ্গে ভাইস ক্যাপ্টেন আর পাকিস্তান দলের ম্যানেজারও বেরিয়ে আসেন। বাকি তিনজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আসবেন বলে থেকে যান। এই হল ঘটনা।

- একসঙ্গে ঢোকার প্রস্তাবটা কে প্রথম দিয়েছিলেন?

- পাকিস্তান দলের ক্যাপ্টেন।

উনি রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে সময় দেখতেই রাজ বুঝে গেল আর কথা বলা ঠিক হবে না। ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়ল।

(পাঁচ)

রাজ ড্রেসিং রুম থেকে বেরোনোর সময় মিস্টার ভট্টকে বলল –

- বম্ব স্কোয়াডগুলোতে ট্রেইন্ড কুকুর থাকে এক্সপ্লোসিভ খুঁজে বার করার জন্য। এই স্টেডিয়ামের কোথাও যদি এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে থাকে তাহলে সবচাইতে ভালো উপায় হচ্ছে ওই কুকুরদের ব্যবহার করা।

- গতকাল রাত থেকে ২০০ টা কুকুর লাগানো হয়েছে। এত ট্রেইন্ড ডগ পাওয়াও তো মুশকিল। আজ হয়তো আরও শ'খানেক কুকুর এসে যাবে। এখন অবধি কিছুই পাওয়া যায় নি।

- স্টেডিয়ামের একটা ম্যাপ দরকার। পাওয়া যাবে?

- হ্যাঁ। ইনফ্যাক্ট আপনার লাগতে পারে ভেবে আপনার জন্য এক কপি নিয়ে এসেছি।

রাজ স্টেডিয়ামের ম্যাপটা খুটিয়ে দেখছিল। সম্ভাব্য জায়গা, যেখানে সন্ত্রাসবাদীরা এক্সপ্লোসিভ লাগাতে পারে, সেগুলো চেষ্টা করছিল বার করতে। প্রথমেই মনে হোল ইলেকট্রিক্যাল রুমের কথা। এরপর স্টেডিয়ামে ওঠার সিঁড়ির নিচের অংশ। যদিও কতগুলো জায়গায় বেশ কয়েকটি খাবারের স্টল আছে, তাও ওর মনে হল জায়গাগুলো দেখা দরকার। এছাড়া স্টেডিয়ামের গ্যালারি। কিন্তু, ওর মন বলছিল অন্য কিছু। এই জায়গাগুলোতেই তো প্রথমেই খোঁজা হবে, তাই এমন জায়গায় রাখবে যেখানে খোঁজার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাববে না। মিস্টার খান্নাকে বলল –

- আমার মনে হচ্ছে গ্যালারি, সিঁড়িগুলোর নিচের অংশ আর ইলেকট্রিক্যাল রুম ভালো করে দেখা দরকার।

- গতকাল সারা রাত, এমনকী আপনি আসার আগে অবধি গ্যালারিগুলো কুকুরদের নিয়ে খোঁজা হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায় নি। সিঁড়িগুলোও দেখা হয়েছে। একই রেজাল্ট। এই মুহূর্তে ইলেকট্রিক্যাল রুমে সার্চিং চলছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রেজাল্ট জেনে যাব।

রাজ এটাই শুনবে বলে এক্সপেক্ট করেছিল। তার মানে ও যা ভাবছে সেটা ঠিক। ও নিশ্চিত, এক্সপ্লোসিভ সঠিক জায়গায় লেগে গেছে। এখন ওরা দিন আর সময়টা, ঠিক কি ঠিক করেছে এটা জানতে পারলে খুব সুবিধা হত। বিকালে পাকিস্তান দলের সঙ্গে কথা বলতেই হবে। ওঁরা কি টাইম কিল করার জন্য কথা বলতে চাইলো না, নাকি সত্যিই কথা বলার মতন মানসিক পরিস্থিতি ওঁদের ছিল না। প্রথমটি হলে চিন্তার বিষয়। সেক্ষেত্রে, ধরে নিতে হবে হয়তো আগামীকালই কোন একটা সময় সন্ত্রাসবাদীরা ঠিক করেছে। হঠাৎ, মিস্টার খান্নাকে জিজ্ঞাসা করল –

- কাগজটায় ওদের হামলার তারিখটা কবে লেখা ছিল? আগামীকাল? নাকি পঞ্চম দিন?

মিস্টার খান্না একটু ইতস্তত করে বললেন –

- লেখা ছিল টেস্টের পঞ্চম দিন। কিন্তু, সঙ্গে এটাও যোগ করা হয়েছিল, ঘটনাটি একদিন আগেও ঘটানোর চেষ্টা হতে পারে।

এক মুহূর্তের জন্য রাজ থমকে গেল, মুহুর্তের মধ্যে বুঝে গেল সন্ত্রাসবাদীদের প্ল্যান। ও যা ভাবছে তা সঠিক হয় – নাঃ, আর কোনভাবেই এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যাবে না। প্রথম কাজ এই দু'জনকে ঘাড় থেকে নামানো। আর দ্বিতীয় কাজ রাতে স্টেডিয়ামে যে কোন ছলছুতোয় ঢুকতে হবে। ওর থাকাটা খুবই প্রয়োজন। রাতে একা এলে সিকিউরিটি পার্সোনেল ওকে ঢুকতেই দেবে না। একটা উপায় অবশ্য আছে - দেখা যাক।

বিকাল বেলায় মিস্টার রঞ্জন ভট্ট জানালেন পুরো স্টেডিয়ামে তন্ন তন্ন করে বম্ব স্কোয়াডের কুকুর নিয়ে খুঁজেও কোন এক্সপ্লোসিভ পাওয়া যায় নি। হয় সন্ত্রাসবাদীরা এখনও ওটা কোথাও ফিট করে নি অথবা এমন কোন জায়গায় দেখেছে যেখানে কেউ কোনদিন খোঁজ করবে না অথবা ভাবতেই পারবে না ওখানে কেউ বোমা রাখতে পারে। মিস্টার ভট্টর লোকেরা নাকি স্টেডিয়ামের ভিতর আউটফিল্ডের মাটি খুঁড়ে দেখার কথা বলেছে। রাতে প্রাইম মিনিস্টারের বাড়িতে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। উনি রাজকে মিটিংয়ে থাকতে বলাতে রাজ জানিয়ে দিল ওর পক্ষে রাতে মিটিংয়ে থাকা সম্ভব হবে না।

সন্ধ্যা ছটা নাগাদ পাকিস্তান দলের ম্যানেজার, ক্যাপ্টেন ও ভাইস ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ এল। ও প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে চাইলে দলের ম্যানেজার জানালেন - ভাইস ক্যাপ্টেন ইয়ং, কী বলতে কী বলে বসবে, দলের সুনাম নষ্ট হবে। তাই, ক্যাপ্টেন ছাড়া আর কারো সঙ্গে আলাদা করে কথা বলা যাবে না। রাজ রাজি হয়ে গেল।

(ছয়)

পাকিস্তান দলের ম্যানেজার ড্রেসিংরুমে একাই ছিলেন। রাজ সোজাসুজি প্রসঙ্গে এল, জিজ্ঞাসা করল –

- সন্ত্রাসবাদীরা স্টেডিয়ামে কোন এক জায়গায় এক্সপ্লোসিভ ফিট করেছে। আগামী দু'দিনের মধ্যে খুঁজে বার করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই বিষয়ে আপনি আমাদের কোন সূত্র দিতে পারবেন?

- আমি! এ বিষয়ে আজ সকালে আপনাদের মুখে প্রথম শুনলাম। স্যরি, আমার কিছুই জানা নেই।

- একটা বিস্ফোরণ হলে বহু মানুষ মারা যাবেন, তাতে দু'দেশের, দুই দলের সমর্থকই মারা যাবেন। সে কারণে জিজ্ঞাসা করছিলাম।

- এই এক্সপ্লোসিভ খুঁজে বার করার দায়িত্ব ভারত সরকারের। যদি কিছু হয় সেটা তাঁদের অপদার্থতার জন্যই হবে। ওঁদের গোয়েন্দা সংস্থা, গুপ্তচর সংস্থা কি ঘুমাচ্ছে! যদি এতটাই বিষয়টা সিরিয়াস হয়, তাহলে খেলা বন্ধ করে দিন। আমরা সবাই নিজের দেশে চলে যাই। সবার এমন একটা হাবভাব যেন আমরাই বোমা ফিট করে রেখেছি।

রাজ খেয়াল করলো ভাইস ক্যাপ্টেন, একজন প্লেয়ারের সঙ্গে ঘরে ঢুকছে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে রাজ ম্যানেজারকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়ল। ভাইস ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলে কোন লাভ হবে না। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। মিস্টার ভট্ট বোধহয় রাজের মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন, রাজ কিছু বলার আগেই উনি ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিলেন। রাজ চাইছিল না এই দুজনের সামনে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলতে। তাই, ক্যাপ্টেনের ফোন নম্বর নিয়ে স্মোকিং করার বাহানায় ওখান থেকে বেরিয়ে চলে গেল একদম পিছনে টয়লেটের সামনে। ওখান থেকে ক্যাপ্টেনকে ফোন করল। প্রথমবারে উনি ফোন ধরলেন না। রাজ হোয়াটস অ্যাপে নিজের পরিচয় দিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চায় লিখে পাঠিয়ে দিল। ওটা যে উনি পড়েছেন নোটিফিকেশন দেখে বুঝে গেল। তারপরই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন ধরতেই ক্যাপ্টেন জানালেন মাঠে চলে যেতে, উনি সেখানে যাচ্ছেন। মাঠে ঢোকার সময় সিকিউরিটি আটকালো। রাজ যখন সিকিউরিটিকে বোঝাচ্ছে তখন ক্যাপ্টেন এলেন এবং সিকিউরিটিকে বলে রাজকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা ভিতরে গিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়লেন। রাজকে বললেন –

- হ্যাঁ, বলুন, কি জানতে চাইছেন। মিনিট পনেরোর বেশি সময় দিতে পারব না কারণ ম্যানেজার সাহেব একটা মিটিং ডেকেছেন।

রাজ প্রথমেই ধন্যবাদ জানিয়ে সোজাসুজি প্রসঙ্গে এল –

- সন্ত্রাসবাদি হামলার ব্যাপারে কোন তথ্য বা সূত্র দিতে পারবেন? আসলে এমন একটা পরিস্থিতি -

উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন –

- দেখুন, আমি ব্যক্তিগতভাবে যে কোনরকম সন্ত্রাসবাদী হামলাকে ঘৃণা করি। সেটা যে কোন দেশে, যে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের ওপর হোক না কেন। আমাদের দেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে আমার এই কথা তারা কেউই ভালো ভাবে নেবেন না। তাই, এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি আমি চাইনা কিছু নিরীহ মানুষ মারা যাক। আপনার নাম আমি শুনেছি। আসলে খুব অল্প মানুষই জানে, যেটা বলব সেটা মিডিয়াও জানে না, আমার বান্ধবী একজন বাঙালি অভিনেত্রী। তার কাছ থেকেই আপনার সব খবর পেয়েছি। আপনি অন্যান্য দেশে গিয়েও কেস সলভ্ করেছেন, এমনকী তিন-তিনবার বিরাট নেশার দ্রব্যের চোরাচালানকারীদের ধরেছেন। এই কেসও আপনাকেই সলভ্ করতে হবে। আমার চোখ-কান খোলা থাকে, হয়তো অনেক কিছুই জানি। আপনি তো জানেন “সর্ষের মধ্যেই ভূত” বলে একটা প্রবাদ আছে, এটাই আমার আপনাকে দেওয়া সূত্র। আপনি বুদ্ধিমান, এর বেশি বলতে পারব না।

উনি উঠে দাড়ালেন। রাজ হেসে ওঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে হাটা লাগালো, উনি যেদিকে যাচ্ছেন তার উল্টোদিকে। রাজের হঠাৎ মনে হল পাকিস্তানেও তাহলে এমন মানুষ আছেন যাঁরা পাকিস্তানের কাণ্ডকারখানায় বীতশ্রদ্ধ। উনি সত্যিই অত্যন্ত দামী একটা সূত্র দিয়েছেন। রাজের মনে যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটাই উনি সমর্থন করেছেন। অথবা, অত্যন্ত চালাক মানুষ এবং এই হামলার সঙ্গে ডাইরেক্টলি ইনভলভড্ বলে রাজকে ভুল পথে চালিত করতে চাইছেন। রাজকে অত্যন্ত সাবধানে এগোতে হবে, হাতে সময় মাত্র বারো ঘন্টা, আটচল্লিশ ঘন্টা নয়। এটা রাজের হিসাব। যা ঘটার আগামীকালই ঘটবে।

ফোন করলো মিস্টার ঠাকুরকে। ওর ফোন করার কারণ শুনে উনি একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন –

- আপনি অনৈতিক আর বেআইনি কাজ করবেন, রাতে চোরের মতন স্টেডিয়ামে ঢুকবেন আর আমাকে আপনাকে সাহায্য করতে হবে! বুঝতে পারছি সব - ঠিক আছে - আমি স্টেডিয়ামের ডেপুটি সিকিউরিটি চিফকে পাঠাবো সাহায্য করার জন্য। রাত ঠিক দশটায় আপনাকে হোটেল থেকে তুলে নেবে। বেস্ট অফ লাক।

(সাত)

রাজ রাত আটটা নাগাদ হোটেলে ফিরেই ডিনারের অর্ডার দিয়ে দিল। জামা কাপড় না খুলেই, স্টেডিয়ামের ম্যাপটা খুলে খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলো। একটা লাল পেন দিয়ে সম্ভাব্য দুটি জায়গায় মার্ক করল। এই মুহূর্তে এটা ছাড়া আর কিছু ওর মাথায় আসছে না। ডিনার সেরে সিগারেট মুখে সবার সঙ্গে সমস্ত কথোপকথন ভাবতে শুরু করলো। ইন্ডিয়ান টিমের কোচ, ক্যাপ্টেন, পাকিস্তান দলের ম্যানেজার আর ক্যাপ্টেনের কথাগুলো বারবার ভাবছিল - কেউ একজন সম্ভবত ভুল করে একটা দরকারি সূত্র দিয়েছেন। সেটা কী?

ঠিক দশটা নাগাদ ঘরের ইন্টারকম্ব ফোনটা বেজে উঠলো, রিসেপশন থেকে জানালো - নিচে যেতে, গাড়ি এসে গেছে।

রাজ নিচে রিসিপশনে আসতেই একটি অল্প বয়সী সুন্দরী, জিন্সের প্যান্ট আর শার্ট পরা মেয়ে সামনে এসে নমস্কার করে বলল –

- আমি রোমা চৌধুরী, ডেপুটি সিকিউরিটি চিফ। চিফ সিকিউরিটি অফিসার আর মিস্টার ঠাকুর পার্সোনালি ফোন করে আপনাকে হেল্প করতে বলেছেন। সম্ভবত, কাজগুলো কিছুটা বেআইনি হবে। আমার আবার এধরনের কাজ করতে বেশ ভালো লাগে। চলুন।

মেয়েটির বয়স রাজের মতই হবে, হয়তো দু-এক বছর এদিক ওদিক হতে পারে। আসলে মেয়েদের দেখে বয়স নির্ণয় করা বেশ কঠিন। কিন্তু, মিস্টার ঠাকুর একটা মেয়েকে পাঠালেন! পুরো প্ল্যানিং না ভেস্তে যায়।

গাড়িতে যেতে যেতে রোমা জিজ্ঞাসা করল –

- আপনি কি গেট দিয়ে সিকিউরিটিকে জানিয়ে ঢুকতে চাইছেন নাকি ওদেরকে এড়িয়ে ঢুকতে চাইছেন?

- এড়িয়ে ঢোকার পথ কি আছে?

- আছে একটা। তবে, আপনি কি পারবেন? আপনার সঙ্গে কোন আর্মস মানে অস্ত্র আছে?

রাজ হেসে জবাব দিল –

- আপনি এড়িয়ে ঢোকার জায়গাতেই চলুন। আজকেই একজন বলেছেন - সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে। সিকিউরিটির দ্বিতীয় প্রধান তো সঙ্গেই আছেন, তখন বাকিদের জানানোর প্রয়োজন কোথায়। আর হ্যাঁ, আমি বন্দুক পিস্তল চালাতে জানি না। আমার একটাই অস্ত্র – মগজাস্ত্র। আশা করি বোঝাতে পেরেছি।

- ও-কে, আমার সঙ্গে রিভলভার আছে। কার্তুজও অ্যাডিকোয়েট আছে। তাহলে নৈশ অভিযান শুরু করা যাক।

রোমার নির্দেশে স্টেডিয়ামের পিছনে যে জায়গায় গাড়ি দাড়ালো সেখানে স্টেডিয়ামের বাউন্ডারি ওয়াল ছাড়া আর কিছু নেই। বাউন্ডারি ওয়াল প্রায় ফুট দশেক উঁচু। রোমার নির্দেশে গাড়ি দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। রোমা তড়াক করে গাড়ি থেকে নেমে কোয়ালিসটার ছাদে উঠে পড়ে রাজকে বলল –

- চলে আসুন। পারবেন তো? আপনার ফিজিক্যাল ফিটনেস কেমন তা অবশ্য জানি না।

রাজ কোন উত্তর না দিয়ে গাড়ির ছাদে উঠতে উঠতে দেখলো রোমা ততক্ষনে দেওয়ালের উপর উঠে পড়েছে। মেয়েটি যত সহজে উঠেছে রাজের পক্ষে অবশ্য ততটা সহজ হল না। রাজ দেয়ালের উপর উঠে অবাক হয়ে গেল, দেখলো রোমা উল্টো দিকে নেমে একটা মই দেয়ালের গায়ে লাগিয়ে দিয়েছে। অবাক হয়ে নিচে নেমে শুনলো রোমা ফিসফিস করে বলছে –

- এই পথে মাঝে-মধ্যে চেকিংয়ের জন্য ঢুকি। ভেতর থেকে দেওয়ালে উঠার সময় মইটা দরকার হয়। কোথায় যাবেন, চলুন।

রাজ স্টেডিয়ামের ম্যাপটা খুলে রোমাকে দেখিয়ে বলল –

- এই ম্যাপ দেখে আমার মনে হয়েছে ক্লাব হাউসে বোমা রাখার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ, ক্লাব হাউসের মধ্যেই ভিআইপি গ্যালারি আর নিচে দুটো দলের ড্রেসিং রুম থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু। এমনকী ইলেকট্রিক্যাল রুমটাও এর লাগোয়া। তাছাড়া, দুপুরবেলায়, খেলা চলাকালীন বিস্ফোরণ ঘটলে পাকিস্তানি প্লেয়ারদের কিছু হবে না কারণ তারা তখন মাঠে থাকবে। ভারতীয় খেলোয়াড়রাও বেঁচে যাবে। বিস্ফোরণে মারা যাবে ভিআইপি সহ গুরুত্বপূর্ণ দর্শকরা। এর থেকে বড়ো আঘাত আর কী হতে পারে?

রোমা একবার রাজের দিকে তাকিয়ে বলল –

- চলুন যাওয়া যাক। ক্লাব হাউস আর ভিআইপি গ্যালারিতে খুঁজে দেখা যাক। বম্ব স্কোয়াডের কুকুর খুঁজেও কিছু পায়নি। তাও চেষ্টা করা। আপনি ঠিকই বলেছেন বলে মনে হচ্ছে।

ক্লাব হাউস আর ভিআইপি গ্যালারি দুজনে মিলে প্রায় ঘণ্টাখানেক খুঁজেও কিছু পেল না। রাজ দু'দলের ড্রেসিংরুম দেখতে চাইলে রোমা একটু ইতস্তত করে জানালো ড্রেসিং রুমে ঢোকা মুশকিল কারণ ওঁর কাছে চাবি নেই। দুটো ড্রেসিং রুমেই তালা লাগানো আছে। রাজ প্রায় জোর করেই ওকে নিয়ে প্রথমে পাকিস্তান দলের ড্রেসিং রুমের সামনে এল। রাজ রোমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে পকেট থেকে যেটা বার করলো সেটা দেখে রোমা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো –

- আপনি পেশাদার গোয়েন্দা! নাকি পেশাদার চোর!

রাজ মুচকি হেসে মাস্টার কি- টা নিয়ে তালা খোলায় মন দিল।

(আট)

পাকিস্তানি ড্রেসিং রুমে ঢুকে রাজ থমকে গেল। বিশাল ঘরের একদিকে সারি সারি বড়ো বড়ো লকার, প্রতিটি লকারের গায়ে কাগজে লেখা কোন লকার কোন প্লেয়ারের। অতীতেও দুবার এই ড্রেসিংরুমে তদন্তের জন্য লুকিয়ে রাজকে ঢুকতে হয়েছিল, তাই সবই ওর পরিচিত। তাছাড়া, সকালেও একবার এই ঘরে ঢুকেছিল দলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। কোথা থেকে শুরু করবে? প্রথমে ম্যানেজারের লকার খুললো হাতে গ্লাভস পরে নিয়ে মাস্টার-কি দিয়ে। তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছুই পেল না। বন্ধ করতে গিয়ে কী মনে হল ব্লেজারটা বার করে পকেট গুলো হাতড়াতে কিছু পাকিস্তানি রুপি অর্থাৎ টাকা পেল। নোটগুলোর মধ্যে একটা ভাঁজ করা কাগজ। কাগজটা খুলেই রাজ থমকে গেল, একটা কিছুর ফটোকপি। ভালো করে দেখে কাগজটা পকেটে ঢোকালো। রোমা পাশ থেকে দেখে জিজ্ঞাসা করল –

- এটা কী?

- আপাতত এটা যে দেখেছেন ভুলে যান। পরে সব বুঝিয়ে বলবো।

রাজ প্রতিটি লকার খুলে চেক করলো, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছুই পেল না। ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে যখন আবার তালাটা লাগাচ্ছে তখন রোমা জিজ্ঞাসা করলো –

- এবারে কোথায়?

- অপারেশন ইন্ডিয়ান ড্রেসিং রুম।

ইন্ডিয়ান ড্রেসিং রুমে রাজ সকাল থেকে দুবার ঢুকেছে। প্রথমেই ক্যাপ্টেন আর ভাইস ক্যাপ্টেনের লকার খুলে চেক করলো, কিছুই পেল না। এরপর, কোচের লকার। লকার খুলে সামনে থাকা ব্লেজারটা যখন সরাচ্ছে একটা খাম মাটিতে ছিটকে পড়ল। খামটা খুলে ভিতরে কাগজটা দেখলো, ফটোকপি। একটা কম্পিউটার প্রিন্ট আউটের ফটোকপি। নিচে একজনের সই ও সিলও আছে। নিচের দিকে একটা ইনিশিয়াল আছে নীল রঙের পেন দিয়ে করা। রাজ কাগজটা খামে ভরে বুক পকেটে ঢুকিয়ে লকারের ভিতরে থাকা বড়ো প্যাকেটটা দেখে শিস্ দিয়ে উঠলো। রোমাকে বলল –

- এইবার আপনার ঝামেলা শুরু হল। বম্ব স্কোয়াডকে খবর দিন। এক্সপ্লোসিভটা পাওয়া গেছে। এক্সপার্টরাই বলতে পারবে এটা কী ধরনের এক্সপ্লোসিভ। আপনার আজকে আর ঘুম টুম হবে না। সারা রাত জাগতে পারবেন তো? যা করবেন অত্যন্ত গোপনে করবেন। আশা করি কী বলতে চাইছি বুঝতে পেরেছেন।

দেখলো রোমা স্মার্টফোন বার করে কাঁকে যেন ফোন করছেন। রাজ নিজের স্মার্টফোনটা বার করে মিস্টার ঠাকুরকে যখন ফোন করছে ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটে বাজে।

মিস্টার ঠাকুর বেশ কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরে জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলেন –

- কী ব্যাপার! মাঝরাতে ফোন করেছেন! ঘুমাতেও দেবেন না!

- স্যরি স্যার। আজ রাতে আমাদের বোধহয় বিছানায় শোওয়া হবে না। এক্সপ্লোসিভটা পাওয়া গেছে। রোমা গোপনে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নিচ্ছেন। কিন্তু আপনাকেও বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে। কাউকে, এমনকী প্রাইম মিনিস্টারকেও বলা যাবে না। একটা সাহায্য চাই।

- এক্সপ্লোসিভটা পেয়েছ! সিওর?

- ইয়েস স্যার।

- রাজ আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব। আপনি আমার মুখ রক্ষা করেছেন, আমার সম্মান বাঁচিয়েছেন। বলুন, কী হেল্প চাই।

- প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে চাই। বিশেষ করে ওই সময়টার যখন ওর ঘরে ছ-জন মানুষ ঢুকেছিলেন।

- আমরা সবাই দেখেছি, ওতে কিছু নেই।

- তাও, দেখতে চাই।

- ও-কে, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আগামীকাল সকাল ন'টা নাগাদ চলে আসুন।

- স্যরি স্যার। আমাদের হাতে অত সময় নেই। আজই, এখুনি চাই। আমাকে এখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িও চাই। বিষয়টা অত্যন্ত জরুরী, দেরি করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

- ও-কে দেখছি কি করা যায়।

ফোনটা কেটে রাজ দেখলো রোমা তখনও ফোনে নানারকম ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছেন। রাজকে তাকাতে দেখে অপরপক্ষকে ফোনটা হোল্ড করতে বলে রাজকে বললেন –

- পাঁচ মিনিটের মধ্যে বম্ব স্কোয়াড কুকুর নিয়ে চলে আসছে। বেশি লোক নয়, মাত্র ছয় জন আর চারটে কুকুর। গেটের আর অন্য জায়গার সিকিউরিটিকে আমি ম্যানেজ করব। আপনি কি এখন প্রাইম মিনিস্টারের বাড়িতে যাবেন?

- হ্যাঁ। যাওয়া খুব দরকার।

- আপনি নিশ্চিন্তে যান, আমি এদিকটা সামলে নেব। আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব - আপনি শুধু দেশকে নয়, আমাকেও ভয়ঙ্কর সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।

রাজ হেসে ওখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরালো।

(নয়)

সিগারেট শেষ করে আবার ভিতরে ঢুকে দেখলো রোমা তখনও ফোনে নানারকম ইনস্ট্রাকশন দিয়েই চলেছেন। রাজ ঈশারায় ওঁকে সবগুলো লকারই খুলে দেখতে বললো। রোমা ফোনটা কেটে দিয়ে রাজকে বললেন –

- আমি সবগুলো লকারের চাবি আনতে বলেছি। আপনার মত আমাদের পেশাদার গোয়েন্দা কাম চোর তো নেই।

রাজ হেসে বললো –

- পুরোটা গোপন রাখবেন। কোন সমস্যা হলে আমাকে বা মিস্টার ঠাকুরকে ছাড়া আর কাউকে ফোন করবেন না। তাহলে, সব গন্ডগোল হয়ে যাবে। এই এক্সপ্লোসিভটার একটা ট্রিগার থাকার কথা। সেটাকে খুঁজে না পেলে কিন্তু অবশ্যই জানাবেন। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। গাড়ি আসছে।

রাজ স্টেডিয়ামের গেটের কাছে যেতেই সিকিউরিটির লোকেরা ওকে আটকালো। তারপর, রাজের পরিচয় পেয়ে ছেড়ে দিল। বুঝলো রোমা ফোন করে বলে দিয়েছেন। মেয়েটা দারুণ এফিসিয়েন্ট তো! এরকম একজন সহকর্মী থাকলে কাজ করে মজা আছে।

গেটের বাইরে আসতেই রাজের ফোন বেজে উঠলো, মিস্টার ঠাকুর ফোন করেছেন। ফোনটা ধরতেই মিস্টার ঠাকুরের নির্দেশ –

- গেটের বাইরে চলে আসুন।

- আমি গেটের বাইরেই আছি।

ফোনটা কাটার পর মিনিট দুয়েকের মধ্যে একটা স্করপিওকে গেটের কাছে আসতে দেখে রাজ এগিয়ে গেল। পিছনের জানালা দিয়ে যাঁকে মাথা বাড়িয়ে ওকে ডাকতে দেখলো তাঁকে রাজ একেবারে যে এক্সপেক্ট করেনি, তা নয়। ওর মনে হয়েছিল উনি নিজেই আসবেন। এই সঙ্কট মুহূর্তে ওঁর উপস্থিতি দরকার। ওঁর সঙ্গে দুজন আর্মড গোয়েন্দাকেও দেখতে পেল। রাজ হেসে গাড়িতে উঠে মিস্টার ঠাকুরকে বলল –

- স্যার, স্যরি। আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য। কিন্তু, উপায় ছিলনা। এই মুহূর্তে আপনি আর রোমা ছাড়া আর কাউকে ভরসা করতে পারছি না।

- মনে হচ্ছে কেসটা প্রায় সলভ করে ফেলেছেন। ঠিক তো?

- হ্যাঁ, সবটাই বুঝতে পেরেছি। এখন শুধু প্রমান দরকার। এই মুহূর্তে ফরেনসিক ল্যাবের সাহায্যের দরকার না হলেও পরে লাগবে। একটু ব্যবস্থা করে রাখবেন।

গাড়ি প্রাইম মিনিস্টারের বাসভবনের সামনে দাঁড়াতেই একজন কমান্ডো এগিয়ে এল। মিস্টার ঠাকুরকে দেখে সেলাম ঠুকে জানালো ভিতরে সব রেডি আছে।

রাজ সোজা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখার জন্য কম্পিউটারের সামনে বসে পড়লো। পাশে মিস্টার ঠাকুরও আছেন। সঙ্গে আসা দুজন গোয়েন্দা একটু দূরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি নজরে রাখছেন। ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেল অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াডের চিফ মিস্টার সুরিন্দর খান্না একটা খাম হাতে করে ভিতরে ঢুকে প্রাইম মিনিস্টারকে দিলেন। প্রাইম মিনিস্টার তখন নিজের চেয়ার টেবিলে বসে কী একটা লিখছিলেন। মিনিট দুয়েক কথা বললেন। কী কথা হল তা জানা যাবে না কারণ এতে সাউন্ড রেকর্ড হয় না। প্রাইম মিনিস্টার খামটা খুলে কাগজটা বার করে দেখে ঘাড় নাড়লেন। খামটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলেন। মিস্টার খান্না বেরিয়ে গেলেন। রাজ জিজ্ঞাসা করলো –

- ঘরে কটা ক্যামেরা লাগানো আছে?

যে লোকটি কম্পিউটার অপারেট করছিল সে বললো –

- দুটো। একটা প্রধানমন্ত্রীর বসার চেয়ারের পিছনে ঢোকার দরজার দিকে মুখ করে আর দ্বিতীয়টি ঢোকার দরজার উপর প্রধানমন্ত্রী বসার চেয়ারের দিকে মুখ করে।

রাজ আবার ফুটেজ চালু করতে বললো। ঘরের ভিতরে প্রাইম মিনিস্টার একা বসে আছেন। হঠাৎ উঠে গিয়ে ঘরের কোণে থাকা ফোনটা ধরলেন, টেবিলের উপর থাকা ফোনটা খারাপ বলে রাজকে বলা হয়েছিল। ফোনে কথা শেষ হওয়ার পর আবার নিজের সিটে ব্যাক করলেন। এর মিনিট দুয়েক বাদে, ছ-জন মানুষ ঘরে ঢুকে ওঁর উলটো দিকের চেয়ারে বসলেন। এঁরা পাকিস্তান আর ভারতীয় দলের খেলোয়াড়, কোচ আর ম্যানেজার। এরপর তিন চার মিনিট কথা হল। আবার প্রাইম মিনিস্টার উঠে গিয়ে ফোন ধরলেন। দুজন পাকিস্তানি প্লেয়ার এবং ভারতীয় দলের কোচ বসে রইলেন, কিন্তু বাকি তিনজন উঠে দাঁড়ালেন। প্রাইম মিনিস্টারকে ঈশারায় যাচ্ছেন বলে নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন। প্রাইম মিনিস্টার আবার ফোন রেখে নিজের চেয়ারে ফেরত এলেন। মিনিট দুয়েক কথা বলার পর বাকি তিনজন উঠে দাঁড়িয়ে প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে গেলেন। এরপর, প্রায় মিনিট পাঁচেক বাদে মিস্টার খান্না ঢুকলেন। প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে কী কথা হল বোঝা গেল না। উনি টেবিলের ড্রয়ার খুলে খামটা বার করে খান্নাকে দিলেন। উনি খামটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, দরজা অবধি গিয়ে দরজাটা অতিক্রম করেই ব্যাক করলেন। মুখটা আতঙ্কিত। খামের ভিতরের কাগজটা হাতে। হাতের কাগজটা সাদা, এ-ফোর কাগজটায় কোন কিছু লেখা নেই। তারপর, প্রাইম মিনিস্টার কিছু একটা বলাতে উনি দ্রুত ফোনের দিকে গেলেন।

(দশ)

রাজ খুঁটিয়ে ফুটেজটা দেখছিলো। বন্ধ করতে বলে জিজ্ঞাসা করলো –

- এটা তো প্রাইম মিনিস্টারের বসার চেয়ারের পিছনে যে ক্যামেরা লাগানো আছে তার ফুটেজ। দরজার উপর ক্যামেরার ফুটেজটা দেখবো।

এবারে দরজার উপর লাগানো ক্যামেরার ফুটেজ চালানো হল। সব কিছুই পিছন থেকে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে সামনে থেকে, ওঁর মুখের অভিব্যক্তি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ছ-জন মানুষ তিনজন তিনজন করে যখন বেরোচ্ছেন তখন তাঁদের মুখের অভিব্যক্তি দেখা গেল। দ্বিতীয়বারে মিস্টার খান্না যখন খাম হাতে বেরোচ্ছেন তখন তাঁর মুখ আর হাতে ধরা খাম দেখা গেল। উনি খামটা দরজার কাছে এসে খুলে কাগজটা বার করার চেষ্টা করছেন, কাগজটা তখনও ভিতরেই আছে। তারপর, দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়াতে কোন ফুটেজ নেই। এবারে, দ্রুত এক হাতে খাম আর অন্য হাতে সাদা এ-ফোর কাগজটা নিয়ে ঢুকছেন, পিছন থেকে ক্যামেরায় ছবি এসেছে। একদম পারফেক্ট। রাজ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো ফুটেজ বন্ধ করার জন্য।

রাজ মিস্টার ঠাকুরকে বললো –

- এই দুটো ক্যামেরা ছাড়া আর কোন ক্যামেরা লাগানো নেই এটা তো হতে পারে না। আমি বাকি ক্যামেরার ফুটেজ দেখবো। মিস্টার ঠাকুর বাসভবনের সিকিউরিটিকে ডেকে সে কথা বলাতে উনি ইতস্তত করে বললেন –

- স্যরি স্যার। আসলে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নতুন সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর প্রসেস চালু হয়েছে। এখনও বাকি গুলো লাগানো হয়ে ওঠেনি।

রাজ গম্ভীর গলায় বললো –

- আমি নিজে ঘরে ঢোকার দরজার দিকে যে টয়লেট আছে তার উপরে একদম কোনায় একটা ক্যামেরা দেখেছি।

- হ্যাঁ স্যার, মানছি। কিন্তু, ওটা পুরানো আমলের ক্যামেরা। ওটার ফুটেজ অবশ্য একটা পুরনো আমলের হার্ডডিস্কে স্টোর হয় বলে জানি, কিন্তু সেটা ঠিক আছে কিনা জানি না।

- ইমিডিয়েটলি দেখুন। ওই ফুটেজ আমি দেখতে চাই। এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলে বোঝানো যাবে না।

প্রায় ঘন্টা খানেকের দৌড়োদৌড়ি আর চেষ্টার পর ওই ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করা হল। পুরো সময়টা রাজ গম্ভীর মুখ করে কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে ছিল। মিস্টার ঠাকুরের সঙ্গে রাজ ফুটেজ দেখতে বসলো। পুরো ফুটেজ চুপ করে দেখে গেল। মিস্টার ঠাকুর ফুটেজ দেখতে দেখতে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। রাজ একসময় ফুটেজ বন্ধ করতে বললো।

মিস্টার ঠাকুর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর রাজকে জিজ্ঞাসা করলেন –

- আপনি তাহলে আগেই সব বুঝতে পেরেছিলেন! আমি ভাবতেই পারছি না।

- আপনি আজই সকাল ন'টা নাগাদ প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করুন। যারা ছিলাম তাঁরা ছাড়াও রোমা থাকবে আর কয়েকজন সশস্ত্র আপনার ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা থাকবেন। এছাড়া, ওই সময়ে উপস্থিত প্রত্যেকের সেল ফোন যেন বন্ধ থাকে। শুধুমাত্র আপনার আর আমারটা খোলা থাকবে। ঠিক নটার সময় আপনার লোকেরা যেন ভারতীয় দলের কোচের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়। সবচেয়ে ভালো হয়, উনি পদত্যাগ পত্র লিখে দেবেন। জনতাকে তো বলতে হবে কিছু একটা। ওঁকে যে লম্বা জেলের ঘানি টানতে হবে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে।

ঠিক নটার সময় রাজ গেটের সিকিউরিটি টপকে যখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের নিচের বসার ঘরে ঢুকলো তখন সবাই এসে গেছেন। শুধু প্রাইম মিনিস্টার আসেন নি। প্রাইম মিনিস্টার ঘরে ঢুকলেন ঠিক পাঁচ মিনিট বাদে। উনি চেয়ারে বসে সবাইকে বসতে বললেন। মিস্টার ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন –

- কী ব্যাপার! এরকম আর্জেন্ট মিটিং! তদন্তের প্রগ্রেস কী?

- যা বলার রাজ বলবেন। আমি রাজকে ওঁর যা বক্তব্য তা বলতে বলছি।

রাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললো –

- স্যার আপনারা আমায় বাহাত্তর ঘন্টা টাইম দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে আপনাদের শেষ মিটিং যখন শুরু হয়েছিল তারপর সময় হিসাব করলে মোটামুটি তেত্রিশ ঘন্টা হয়েছে। এই মিটিংটা দশটার মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তাই মাত্র চৌত্রিশ ঘণ্টায় কেস সলভ্ করলাম। অর্থাৎ, আপনাদের দেওয়া সময়ের অর্ধেকও আমার লাগেনি কেসটা সলভ্ করতে।

মিস্টার ভট্ট একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন –

- কোথায় কেস সলভ্ হয়েছে! এখনও তো আমরা সেই অন্ধকারেই আছি।

রাজ এবং মিস্টার ঠাকুরের ফোনে হোয়াটস্ অ্যাপ আর এসএমএস এল। রাজ নিজের ফোনের মেসেজটা দেখে বললো –

- হ্যাঁ, সব বলছি। এই মুহূর্তে ফোনে কনফার্মেশন এল। তাহলে শুরু করছি। আমাকে দুটো দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রথমটা হল ওই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টটা উদ্ধার করা আর দ্বিতীয়টি হলো এক্সপ্লোসিভটাকে উদ্ধার করে সন্ত্রাসবাদি হামলা রুখে দেওয়া। মিস্টার খান্না, আপনাকে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনি কি ওই ডকুমেন্টটার কোন ফটোকপি করেছিলেন?

মিস্টার খান্না একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন –

- আগেই তো বলেছি কোন ফটোকপি সেফটির কারণে রাখা হয় নি।

- ওতে এক্সপ্লোসিভ কোথায় রাখা হবে বলে দেখানো ছিল?

- স্টেডিয়ামের কোন এক জায়গায়। ড্রয়িংয়ে সেটা দেখানো আছে।

- তারিখ ও সময়টা কী ছিল?

- তারিখ মানে ফিফথ্ ডেতে বিস্ফোরণ ঘটানো হবে বলে বলা ছিল।

- আর ইউ শিওর?

- হ্যাঁ, ডেফিনেটলি। আমি নিজেই তো ওটা করে নিচে সই করে দিয়েছিলাম।

- আপনার গোয়েন্দারা ফিফথ্ ডে বলেছিলেন? নাকি ফোর্থথ্ ডে? মনে করে বলুন।

- ফিফথ্ ডে। এ রকম অবান্তর প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করছি কেন! স্ট্রেঞ্জ!

রাজ পকেট থেকে গ্লাভস্ বার করে হাতে পড়ে নিল। পকেট থেকে একটা খাম বার করে ভিতর থেকে একটা এ-ফোর কাগজ বার করে প্রাইম মিনিস্টার সহ বাকিদের দূর থেকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলো –

- স্যার, এটাই তো সেই ডকুমেন্ট যেটা আপনারা খুঁজছেন?

প্রাইম মিনিস্টার একটু ইতস্তত করে বললেন –

- হ্যাঁ। কিন্তু, দেখে মনে হচ্ছে এটা অরিজিনাল নয়, ফটোকপি। কাগজটা দেখি।

রাজ কাগজটা খামে ভরতে ভরতে বললো –

- হ্যাঁ, এটা ফটোকপি। নিচে যাঁর ইনিশিয়াল রয়েছে সেটা কিন্তু ফটোকপির উপর নীল রঙের কালির পেন দিয়ে লেখা ও অরিজিনাল। ইনিশিয়ালটা কাঁর জানেন? আমাদের ভারতীয় দলের মহামান্য কোচের। এই মুহূর্তে তিনি পদত্যাগ পত্র লিখে দিয়েছেন। এখন তিনি সিবিআইয়ের গোয়েন্দাদের হাতে বন্দি। তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তিনি মুখ খুলেছেন এবং এই ডকুমেন্টটা কীভাবে পেয়েছেন সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন। ও-হ্যাঁ, আপনাদের জানিয়ে রাখি গতকাল সারারাত ধরে আমি এবং ম্যাডাম রোমা গোপনে কাউকে না জানিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকি এবং এক্সপ্লোসিভ উদ্ধার করি মহামান্য কোচের লকার থেকে। বম্ব স্কোয়াড ওটাকে ডিফিউজ করে নিয়ে গেছে। পুরোটা অত্যন্ত গোপনে করা হয়েছে, তাই আপনারা কেউ জানেন না। ম্যাডাম রোমা এখানেই আছেন, বিশ্বাস না হলে ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এই খামটা ফরেনসিক ল্যাবে যাবে ফিঙ্গার প্রিন্ট বার করার জন্য। দুটো জিনিস পাই নি। টিএনটি এক্সপ্লোসিভের ট্রিগার আর অরিজিনাল ডকুমেন্টটা। মিস্টার খান্না, ওদুটো আপনার কাছে আছে, যদি দিয়ে দেন ভালো তা না হলে সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা আপনার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বাইরে অপেক্ষায় আছেন।

মিস্টার খান্না তড়াক করে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলেন –

- স্যার আপনার সামনে এই রাজ যা-তা সব বলছে আর আপনি শুনছেন! স্ট্রেঞ্জ! আমি এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাই না।

রাজ হাসতে হাসতে বললো –

- আপনার জন্য বাইরে ভ্যান অপেক্ষা করছে। লম্বা জেলের ঘানি টানতে হবে আপনাকে। আপনি একটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন। ঘরের ভিতরে দুটো সিসিটিভি ক্যামেরার খবর জানতেন, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে খামটা প্রাইম মিনিস্টারের হাত থেকে নিয়ে খোলার ভান করতে করতে দরজা অবধি গিয়ে তারপর দরজার বাইরে গিয়ে ভেতর থেকে ডকুমেন্টটাকে বার করে আপনার জামার বোতাম খুলে ভিতরে ঢুকিয়ে জামার ভিতর থেকে দ্বিতীয় একটা এ-ফোর কাগজ বার করে জামার বোতাম আটকে সেটা নিয়ে আতঙ্কিত করে ঘরে ঢুকে নাটক সৃষ্টি করলেন। আপনি জানতেন ঘরের বাইরে কোন সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, কিন্তু ভুল জানতেন। আমরা ফুটেজ আজ ভোর পাঁচটার সময় দেখেছি। একটা কপিও আনা হয়েছে। প্রয়োজনে দেখিয়ে দেব। এছাড়াও, পাকিস্তানি দলের ম্যানেজারের কাছে স্টেডিয়ামের নকশা পাওয়া গেছে। ওঁর কাছে গেল কীভাবে! ফরেনসিক রিপোর্টে ওতে দুজনের আঙ্গুলের ছাপ আছে। পাকিস্তান দলের ম্যানেজার এবং আপনার। আপনি ফেঁসে গেছেন। স্যার, আমার কথা শেষ হয়েছে। ওর আন্ডারে থাকা গুপ্তচরদের জেরা করলেই বিস্ফোরণের সঠিক সময় জানা যাবে। আমার ধারণা সময়টা হচ্ছে আজ দুপুর বারোটা বা ওর কাছাকাছি কোন সময়। এবারে, বাকিটা আপনাদের হাতে ছেড়ে দিলাম।

রাজ মিস্টার ঠাকুরকে নিয়ে যখন প্রাইম মিনিস্টার এর কাছে গেল, চলে যাচ্ছে জানাতে, উনি রাজের হাত দুটো ধরে থ্যাঙ্কস জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন –

- এখন কোথায় যাবেন?

- ঘুমাতে। বারো-চৌদ্দ ঘণ্টা ঘুম দরকার। সারা রাত জেগে।

- আমার নিজস্ব গোয়েন্দারা একেবারে অপদার্থ নয়। খবর পেয়েছিলাম স্টেডিয়ামের দেওয়াল টপকে দুজন চোর ঢুকেছে। এক্সিলেন্ট জব। আপনি বয়সে অনেক ছোট, তাই বলছি, আপনি বড্ড স্ট্রেট ফরোয়ার্ড, একটু ডিপ্লোম্যাটিক হতে চেষ্টা করুন।

রাস্তায় গাড়িতে যেতে যেতে মিটার ঠাকুর রাজকে জিজ্ঞাসা করলেন –

- রোমাকে কেমন লাগলো? ভীষন এফিসিয়েন্ট, তোমারই বয়সী। সিঙ্গল্, কোন বয়-ফ্রেন্ড নেই। আমাদের কাছে যা খবর তাতে আপনার প্রথম গার্লফ্রেন্ড খুন হওয়ার পর দ্বিতীয় গার্লফ্রেন্ডও এখন আপনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। আপনাদের জুটিটা কিন্তু দারুন হত। আপনি সিবিআইতে কিছুতেই জয়েন করবেন না, অথচ আপনাকে আমার দরকার। তাই –

- স্যরি স্যার। আপনি এসব অবাস্তব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।

- কী বললেন! প্রাইম মিনিস্টার কী বলেছেন মনে আছে তো? আপনাকে ডিপ্লোম্যাটিক হতে হবে।

গাড়ি হোটেলের সামনে এসে গেছে। রাজ দরজা খুলে নামতে নামতে হেসে উত্তর দিল –

- ঠিক স্যার। তবে, একটা কথা বলি – ডিপ্লোম্যাটিক ওয়েতে এই কেস হ্যান্ডেল করলে কেসটা মাত্র চৌত্রিশ ঘন্টায় সলভ্ করতে পারতাম না।

___________________________

Comments


bottom of page