কলকাতার জন্মদিন ঠিক কবে? তাই নিয়ে আছে বিস্তর বিতর্ক। আইনানুগ মতামতও আছে। তবু বাঙালি আবেগ ২৪ আগস্টকে মেনে নিয়েছেন প্রাণের শহর কলকাতার জন্মদিন বলে। ১৬৯০ সাল ধরলে কলকাতার বয়স হল, ৩৩১ বছর। এই সেই কলকাতা, যে কলকাতার মধ্যে আছে কত কত কলকাতা। এই কলকাতার মেরুদণ্ড পুলিশ প্রশাসন। কী ছিল তাঁদের ভুমিকা! তাঁদের বিবর্তন সম্পর্কে ইতিহাস কী বলে? তথাকথিত বিশ্বাসে কলকাতার এ হেন জন্মদিনের প্রাক্কালে সেই সত্যকে খোঁজার চেষ্টা করলেন শ্রাবন্তী সেন
সত্যের অন্বেষণ অর্থাৎ সত্যের খোঁজ করা। কিন্তু কিসের সত্য? সত্যান্বেষী বলতেই আমাদের যাঁর কথা মনে হয় সেই ব্যোমকেশ বক্সী বা সত্যের খোঁজে মগজ যাঁর অস্ত্র, সেই ফেলুদা, বইয়ের পাতা বা সেলুলয়েডের চিত্র থেকে বেড়িয়ে বাঙালি মননে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন তাঁদের স্রষ্টাদ্বয়ের স্বকীয় চরিত্রায়নে। কিন্তু বাস্তবের গোয়েন্দাদের কীর্তিকলাপ এঁদের থেকে কোনও অংশে কম রোমহর্ষক নয়। বরং বাস্তবের সাথে তাল রেখে তা অনেক বেশী জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ।
কলকাতার মানুষ যেমন গোয়েন্দা গল্প পড়তে পছন্দ করেন বয়েস, ধর্ম নির্বিশেষে, কলকাতার আসল গোয়েন্দা বিভাগও কিন্তু তাদের তুখোড়, ক্ষুরধার মগজাস্ত্রের জোড়ে সারা বিশ্বের কাছে মান্যতা পেয়ে এসেছে সেই কোন যুগ থেকে। একসময় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাথে তুলনা করা হত। আর হবে নাই বা কেন। নিজেদের সীমিত গন্ডির মধ্যেও শুধুমাত্র বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী ক্ষমতা দ্বারা একের পর এক দূরুহ কেসে অসাধ্য সাধন করেছেন বাস্তবের ফেলুদা, ব্যোমকেশরা।
জব চার্নক তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন কলকাতায় প্রথম পদার্পণ ঘটে ১৬৯০ সালে। আর কলকাতার প্রথম পুলিশি ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয় ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে, ‘ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড ইউনিট’ নামে, রাশিয়া ও ফ্রান্সের পুলিশ দপ্তরের সাথে প্রায়-সমসাময়িক একটা সময়ে, যা এশিয়ার প্রাচীনতম ও বিশ্বের অন্যতম পুরনো পুলিশ ব্যবস্থা বলা যায়। ধুতি, কোমরে বেল্ট দেওয়া ফতুয়া আর হাতে পাকানো লাঠি আর বর্শা। এই ছিল ‘ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড ইউনিট’–এর কোতোয়াল। ১৭২০ সালে এই ইউনিটের একটি প্রশাসনিক গঠনরূপ দেওয়ার প্রচেষ্টায় নাগরিক সুরক্ষা, রাজস্ব আদায় ও অপরাধ দমনের একজন প্রধান নিযুক্ত করা হয়। তার ভারতীয় সহকারীকে বলা হত ‘ব্ল্যাক ডেপুটি’ বা ‘ব্ল্যাক জমিদার’। প্রথম ব্ল্যাক জমিদার হলেন গোবিন্দরাম মিত্র, যিনি পরে চিৎপুর রোডের ধারে তৈরি করেন প্রায় ১৬৫ ফুট উচ্চতার এক বিশালাকায় নবরত্ন কালী মন্দির, দুটি পঞ্চরত্ন মন্দির ও একটি দোচালা শিব মন্দির। সাহেবরা এই মন্দিরের নাম দেয় ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’। কথিত আছে, এই মন্দির নাকি অক্টারলোনি মনুমেন্ট (শহিদ মিনার) এর চেয়েও উচ্চতায় বেশি ছিল আর নদীর ধারের অবস্থানের ফলে নৌকা বা জাহাজের নাবিক এটি দেখে দিক্ নির্ণয় করত।
প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ব্ল্যাক ডেপুটির অধীনে থাকত তিনজন নায়েব দেওয়ান, যার একজন ছিল গোটা পুলিশি ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে। বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত থানা আর তার থানাদার, নায়েক বা পাইকদের মাধ্যমে সেই অঞ্চলের শৃঙ্খলা রক্ষার কার্যসিদ্ধি করা হত।
১৭৭৪ সাল। ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল পদে আসীন হন। ক্ষমতা ও পয়সার জোরে তিনি তখন তাঁর নানান অসাধু ব্যবসায়িক লেনদেন চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টায়। ওয়ারেন হেস্টিংসের মত ঐ বছরই ভারতে আসেন কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের প্রথম জাজ্, এলাইজা ইমপে। হেস্টিংসের সাথে মিলে বর্ধমানের কোনও পুল মেরামতির সরকারী চুক্তি তাঁর আত্মীয়কে পাইয়ে দেওয়ার দুর্নীতি নিয়ে তদন্তমূলক প্রতিবেদন ছাপা হয় এক ইংরেজ প্রকাশক জেমস অগাস্টাস হিকি দ্বারা মুদ্রিত ‘দ্য বেঙ্গল গেজেট’-এ ১৭৮০ সালে। শুরু হয় সরকার পক্ষের সাথে আইনি লড়াই। টানা দু বছর সংঘাতের পর ব্রিটিশ সরকার এই সংবাদপত্র বন্ধ করতে বাধ্য করেন। এই ঘটনাটিকে সরকারবিরোধী খবর প্রকাশ করার অপরাধে জবরদস্তি সংবাদপত্রের কন্ঠ রোধের প্রথম নিদর্শন ধরা যেতে পারে।
কুখ্যাত জাজ্ এলাইজা ইম্পের সব থেকে চর্চিত কুকীর্তি হল মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি। জাল দলিল ও সইয়ের মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে দিয়ে এদেশে প্রথম ফাঁসির সাজায় দন্ডিত হন মহারাজা নন্দকুমার। পরবর্তীকালে, হেস্টিংস ও এলাইজা ইম্পেকে বিলেতে এর জন্যে শাস্তি প্রদান করা হয়। নন্দকুমারের ফাঁসিকে একটি ‘জুডিসিয়াল মার্ডার’-এর আখ্যা দেওয়া হয়। বলা বাহুল্য কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বা তদন্ত সংস্থার জন্ম হয়নি তখনও।
প্রায় এক শতাব্দী পর নানা প্রকার আধুনিকীকরণ, সাংগঠনিক পরিবর্তনের প্রস্তাব পেশ করে প্যাটন কমিটি, যার অধিকাংশই অনুমোদন করেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ। ফলস্বরূপ কলকাতা পুলিশ একটি স্বতন্ত্র কমিশনরেট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ১লা নভেম্বর ১৮৫৬। এস. ওয়াক্হপ্ হন তার প্রথম পুলিশ কমিশনার।
রোজ ব্রাউন মার্ডার কেস। কলকাতায় প্রথম প্রকাশ্য খুনের ঘটনা সম্ভবতঃ এইটিই। কর্তব্যরত এক কনস্টেবল কাকভোরে আর্মহার্স্ট স্ট্রীট থানা সংলগ্ন এলাকায় টহল দেওয়ার সময় আবিষ্কার করেন এক মহিলার ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। কলকাতায় পুলিশ কমিশনার তখন স্টুয়ার্ট হগ। অত্যন্ত দক্ষ এবং সম্মানীয় অফিসার এই হগ সাহেব, যাঁর নামে নিউ মার্কেটের আরেক নাম এস. এস. হগ মার্কেট। হগ সাহেব রোজ ব্রাউন মার্ডার কেসে তদন্তের ভার তুলে দেন রিচার্ড রীড নামে এক তরুণ প্রতিভাবান অফিসারের হাতে। সমাধান হয় খুনের, অচিরেই ধরা পড়ে অপরাধী। সেই বছরেই নভেম্বর মাসে হগ সাহেবের উদ্যোগে সূচনা হয় কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের। ক্ষুরধার বিশ্লেষণী ক্ষমতাধারী রিচার্ড রীড পরবর্তীকালে এই ডিপার্টমেন্টের প্রধান হন ১৮৭৩-এ।
এরপর আসা যাক সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেওয়া এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথায়, যার শিকরও এই শহরে। ঘটনার সূত্ত্রপাত যদিও হুগলি জেলায়, ১৮৫৮ সালে। হুগলির চিফ ম্যাজিস্ট্রেট তখন উইলিয়াম জেম্স হার্শেল। সরকারী কাগজ বা দলিলপত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের ডান হাতের আঙুল ও তালুর ছাপ নিতে শুরু করেন তাদের মনে ভয় ধরানোর উদ্দেশ্যে। নেহাতই খেয়ালের বশে শুরু করা এই অভ্যাস পরে হার্শেলের নেশায় পরিণত হয়। তবে শুধুমাত্র সংগ্রহের জন্যেই প্রথম প্রথম এই ছাপ নিতেন তিনি। অনেক পরে সংগৃহীত ছাপগুলি মিলিয়ে দেখার সময় উনি লক্ষ্য করেন প্রতিটি ছাপ একে অপরের থেকে আলাদা। এই ধারণাই আঙুল ছাপ থেকে মানুষ চেনা সম্ভব সেই তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করে।
এই তথ্যের ভিত্তিতেই ১৮৯৭ সালে পুলিশ অফিসার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি তাঁর দুই বাঙালি সহকারি, সাব ইন্সপেক্টর আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বোসের সাথে ফিঙ্গারপ্রিন্ট থেকে মানুষ চেনার এক যুগান্তকারী গাণিতিক প্রতিরূপ নির্ণয় করেন। একবছর পর এর ব্যবহার করেন হেনরি জলপাইগুড়ির কাঁঠালগুড়ি চা বাগানের এক ডাকাতি ও ম্যানেজারের খুনের মামলায়। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া আঙূলের ছাপ শনাক্ত করে মিলে যায় ভৃত্য কাঙালি চরণের সাথে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তখনও এই পদ্ধতি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মান্যতা না পাওয়ায় কাঙালি চরণ রেহাই পেয়ে যায়। সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দেওয়া এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট তত্ত্ব অচিরেই যেকোনো অপরাধমূলক তদন্তের অপরিহার্য হাতিয়ার হয়ে ওঠে এবং আজও, এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগেও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক ও বহুল ব্যবহৃত। এর পর পরই বিশ্বের প্রথম ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো স্থাপিত হয় কলকাতাতে। এখন হেন্রি ক্লাসিফিকেসন থিয়োরিকে হেনরি, বোস হক থিয়োরি আখ্যা দেওয়ার ন্যায্য দাবি উঠেছে অনেক মহল থেকে।
স্বাধীনতা উত্তর যুগেও কলকাতা পুলিশের গৌরবময় কীর্তির নিদর্শন অসংখ্য। আর শুরু থেকে এই ইতিহাস যথাযথ ভাবে প্রদর্শিত করা আছে কলকাতা পুলিশ মিউজিয়ামে। রাজা রামমোহন রায় বিলেত যাত্রার আগে তাঁর বসতবাটি নিলাম করে দেন ১৮২৯ সালে। পরে ১৮৭৪ সালে ইংরেজ সরকার বাড়িটি ভাড়া নিয়ে শুরু করেন সুকিয়া স্ট্রীট থানা। সুকিয়া স্ট্রীট থানা আর্মহার্স্ট স্ট্রীটে সরে গেলে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মিউজিয়ামটি। ইতিহাসের গন্ধ মাখা বাড়ি, কাঠের সিঁড়ি, উঁচু সিলিং, গ্রীক করিন্থিয়ান পিলার, আজ কলকাতা পুলিশের গর্বের ইতিহাস বহন করছে। সালের ক্রমানুসারে পুলিশ বিভাগের কার্যকলাপ, বিশেষ কীর্তি ও কৃতিত্ব, নানান দূরূহ তদন্তের সমাধানের খতিয়ান, ব্যবহৃত অস্ত্র ও তার বিবর্তন, অপরাধীদের সিঁদ কাঠি থেকে শুরু করে হরেক রকমের শস্ত্র, যুগান্তকারী সব কেস ও তার সমাধানের নথি সমস্ত সুন্দর ভাবে মেলে ধরা রয়েছে ঘরগুলিতে। বর্তমানে প্রযুক্তির প্রভূত সাহায্য পেলেও মগজাস্ত্রের বিকল্প নেই আজও। আর তাই বাস্তবের ফেলু মিত্তিররা তাঁদের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, নিরন্তর পরিশ্রম ও সাহসিকতা দিয়ে নগরবাসীর সুরক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
লেখকঃ গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
মতামত লেখকের নিজস্ব। এর কোনও উক্তি ও যুক্তির দায় পত্রিকার (রোজকার অনন্যা) সম্পাদক, সম্পাদকমন্ডলি ও প্রকাশকের নয়
Comments