ভারতের সবথেকে রহস্যজনক দুর্গ কেন বলা হয় রাজস্থানের ভানগড় কে?
- রোজকার অনন্যা
- Aug 16
- 4 min read
ভারতবর্ষ তার হাজার বছরের ঐতিহ্য, স্থাপত্যশিল্প, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের জন্য সুপরিচিত। এখানে প্রতিটি রাজ্যেই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য দুর্গ, প্রাসাদ ও প্রাচীন স্থাপত্য। তবে এইসব স্থাপনার মধ্যে কয়েকটি জায়গা এমনও আছে, যা শুধু ঐতিহাসিক নয়, বরং রহস্যে ঘেরা। রাজস্থানের ভানগড় দুর্গ তারই একটি অনন্য উদাহরণ। ভারতের সবচেয়ে ভৌতিক ও রহস্যময় স্থান হিসেবে ভানগড় দুর্গের খ্যাতি কেবল ভারতীয় পর্যটকদের নয়, বিদেশিদের কাছেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (ASI) দুর্গের প্রবেশপথে বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে সূর্যাস্তের পর ও সূর্যোদয়ের আগে দুর্গে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

এই সতর্কীকরণই ভানগড় দুর্গকে ঘিরে রহস্য আরও বাড়িয়ে তোলে। এই প্রবন্ধে আমরা ভানগড় দুর্গের ইতিহাস, কিংবদন্তি, ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব এবং বর্তমান পর্যটন-আকর্ষণ সবদিক বিশদে আলোচনা করব, যাতে স্পষ্ট বোঝা যায় কেন ভানগড় দুর্গকে ভারতের সবচেয়ে রহস্যজনক দুর্গ বলা হয়। ভানগড় দুর্গ অবস্থিত রাজস্থানের আলওয়ার জেলার আরাবল্লী পাহাড়শ্রেণীর কোলে, সরিস্কা টাইগার রিজার্ভের সংলগ্ন অঞ্চলে। দুর্গের চারপাশে ঘন জঙ্গল, উঁচু পাহাড় এবং নির্জনতা যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি অদ্ভুত এক ভয়ঙ্কর আবহ তৈরি করে। দুর্গ থেকে জয়পুর প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে, ফলে পর্যটকরা সহজেই গাড়ি ভাড়া করে এখানে পৌঁছে যান।
ভানগড় দুর্গ নির্মিত হয়েছিল ১৬শ শতকে, অম্বর রাজ্যের মান সিংহ প্রথমের নাতি রাজা মাধো সিংহ কর্তৃক। রাজা মাধো সিংহ ছিলেন মহারানা প্রতাপের সেনাপতি মান সিংহের ভাই। দুর্গটি বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল, যেখানে রাজপ্রাসাদ, মন্দির, বাজার, এবং সাধারণ মানুষের বসবাসের ঘরবাড়ি ছিল। শোনা যায়, প্রথম দিকে ভানগড় ছিল সমৃদ্ধ একটি নগরী। এখানে প্রায় দশ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। প্রাসাদ ও মন্দিরের স্থাপত্য আজও রাজস্থানের শিল্প-ঐতিহ্যের সাক্ষী। তবে হঠাৎ করেই ভানগড় নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং মানুষ একরাতে এই শহর ছেড়ে চলে যায় বলে মনে করা হয়। কীভাবে এই পতন ঘটল, সেই নিয়েই নানা রহস্যময় কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
১. তান্ত্রিক সিংহাইয়া এবং রাজকুমারী রত্নাবতী
ভানগড় দুর্গের সঙ্গে যুক্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবদন্তি হলো রাজকুমারী রত্নাবতী এবং তান্ত্রিক সিংহাইয়ার গল্প।
রত্নাবতী ছিলেন ভানগড় রাজ্যের রাজকুমারী এবং তার অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। দূর-দূরান্ত থেকে রাজকুমার এবং যুবকেরা তার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব পাঠাতেন। কিন্তু এক তান্ত্রিক সিংহাইয়া তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং তাকে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সিংহাইয়া ছিলেন কালোজাদুর গুরু। তিনি একবার রাজকুমারীর পরিচারিকার হাতে তেল মন্ত্র পড়ে পাঠিয়ে দেন, যাতে রাজকুমারী ব্যবহার করলে তার প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু রত্নাবতী কৌশলে তা বুঝতে পেরে তেল মাটিতে ফেলে দেন। ফলে মন্ত্র উল্টো হয়ে যায় এবং সেই তেল ছুঁয়ে সিংহাইয়া পাথরের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি ভানগড় নগরীকে অভিশাপ দেন—এই নগরী কখনও সমৃদ্ধ হবে না এবং একদিন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। লোকমুখে শোনা যায়, সিংহাইয়ার সেই অভিশাপই ভানগড় দুর্গের পতনের কারণ।
২. গুরু বালু নাথের অভিশাপ
অন্য একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, দুর্গ নির্মাণের সময় কাছাকাছি পাহাড়ে বসবাস করতেন এক সাধক গুরু বালু নাথ। তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যে দুর্গের ছায়া যেন কখনও তার আশ্রমে না পড়ে। প্রথমে রাজারা সেই নিয়ম মানলেও পরবর্তী রাজা বিশাল প্রাসাদ তৈরি করতে গিয়ে শর্ত ভঙ্গ করেন। দুর্গের ছায়া আশ্রমে পড়তেই গুরু বালু নাথ অভিশাপ দেন—ভানগড় ধ্বংস হবে। এই দুই কিংবদন্তিই ভানগড় দুর্গকে রহস্যময় করে তুলেছে। ভানগড় দুর্গকে ঘিরে অসংখ্য ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্প শোনা যায়।
অনেক পর্যটক দাবি করেছেন যে, সন্ধ্যার পর দুর্গের ভেতর থেকে চিৎকার, হাসির শব্দ, পায়ের আওয়াজ শোনা যায়।
কেউ কেউ নাকি ছায়ামূর্তি দেখেছেন, আবার কেউ হঠাৎ ঠাণ্ডা হাওয়া বা অস্বাভাবিক চাপ অনুভব করেছেন।
স্থানীয়দের মতে, যারা রাতের বেলা দুর্গে প্রবেশ করেছে, তারা আর ফিরে আসেনি বা ফিরে এসে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে।
যদিও এসব ঘটনার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই, তবু রহস্য এবং ভয়ের আবহ মানুষকে আকর্ষণ করে।

ভানগড় দুর্গ আজ ধ্বংসস্তূপ হলেও, এখানকার স্থাপত্যচিহ্নগুলো রাজস্থানের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষী। দুর্গের ভেতরে অসংখ্য মন্দির আছে, যেমন গোপীনাথ মন্দির, সোমেশ্বর মন্দির, কেশব রায় মন্দির ইত্যাদি। এছাড়াও বাজার, নর্তনশালা, প্রাসাদ সবকিছু আজ ভাঙাচোরা হলেও তাদের সৌন্দর্য এখনো চোখে পড়ে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, অথবা রাজনৈতিক অস্থিরতাই ভানগড় নগরীর পতনের আসল কারণ হতে পারে। তবে লোককথা এবং কিংবদন্তিই ভানগড়কে রহস্যময় করে তুলেছে। ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (ASI) ভানগড় দুর্গের প্রবেশপথে স্পষ্ট লিখে দিয়েছে সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের পর দুর্গে প্রবেশ নিষিদ্ধ।কারণ হিসেবে বলা হয়, অন্ধকারের পর দুর্গের ভেতরে বন্য প্রাণীর বিচরণ বেড়ে যায়। তবে অনেকেই মনে করেন, আসল কারণ ভৌতিক ঘটনাই।
ভানগড় দুর্গ পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে
আজ ভানগড় দুর্গ ভারতের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসেন। কেউ আসেন রহস্যের টানে, কেউ আসেন প্রাচীন স্থাপত্যের টানে। আশেপাশের গ্রামগুলোর মানুষ পর্যটনের জন্যই আজ উপার্জন করছে। ভৌতিক কাহিনীর জন্য অনেকেই ভানগড় দুর্গকে "Ghost Town of India" বা "Haunted Fort of India" বলে থাকেন। অনেক চলচ্চিত্র, টেলিভিশন শো এবং ইউটিউব ভিডিওতেও ভানগড় দুর্গের রহস্যকে কেন্দ্র করে কন্টেন্ট তৈরি হয়েছে।
ভানগড় দুর্গ কেন ভারতের সবচেয়ে রহস্যময় দুর্গ?
১. অভিশাপের কিংবদন্তি – রাজকুমারী রত্নাবতী ও তান্ত্রিক সিংহাইয়ার কাহিনি বা গুরু বালু নাথের অভিশাপ ভানগড় দুর্গকে রহস্যময় করে তুলেছে।
২. ASI-এর সতর্কীকরণ – সরকারের তরফে সূর্যাস্তের পর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা রহস্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
৩. ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্প – স্থানীয় ও পর্যটকদের অজস্র অভিজ্ঞতা দুর্গকে ‘হন্টেড’ হিসেবে পরিচিত করেছে।
৪. নির্জন পরিবেশ – দুর্গের চারপাশে পাহাড়, জঙ্গল ও নির্জনতা এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করে।
৫. অব্যাখ্যাত পতন – সমৃদ্ধ নগরী হঠাৎ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণ আজও স্পষ্ট নয়।
ভানগড় দুর্গ শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নয়, বরং এটি ভারতের রহস্যময় ঐতিহ্যের প্রতীক। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অভিশাপ, কিংবদন্তি, ভৌতিক অভিজ্ঞতা এবং প্রাচীন ইতিহাস।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হয়তো অনেক কাহিনি কল্পনা মাত্র, তবে মানুষের বিশ্বাস ও লোককথা ভানগড়কে ভারতের সবচেয়ে রহস্যময় দুর্গে পরিণত করেছে। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ভৌতিক গল্প, এবং রহস্য—সব মিলে ভানগড় দুর্গ ভারতের এক অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ, যা যুগে যুগে মানুষকে আকর্ষণ করবে।
Comments