প্রাচীন ইতিহাসের ছায়ায় ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি..
- রোজকার অনন্যা
- Aug 2
- 2 min read
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ঝাড়গ্রাম শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত নয়, এটি ইতিহাসেরও এক জীবন্ত সাক্ষ্য। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি এই শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ, যা আজও গর্বের সঙ্গে বহন করে রাজকীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ।

ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির ইতিহাস শুরু হয় ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে, যখন রঘুনাথ মল্ল দেব নামে এক রাজপুত্র তার সেনাদের নিয়ে এই অঞ্চলে আসেন এবং স্থানীয় উপজাতিদের থেকে অঞ্চলটি দখল করে নেন। এই রাজবংশ মূলত কুড়মি মাহাতো জনগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তার করে। ধীরে ধীরে তাঁরা স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জন করেন এবং জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন। বর্তমানে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির যেটি মূল ভবন, সেটি তৈরি হয় ১৯৩১ সালে। রাজা নারায়ণ মল্লদেব বাহাদুর ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে এই রাজবাড়ি নির্মাণ করান। ইউরোপীয় ও ভারতীয় স্থাপত্যের অপূর্ব মিশ্রণে গড়ে ওঠা এই রাজবাড়ি আজও বহন করছে রাজবংশের জৌলুস ও স্মৃতি।
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি একদিকে যেমন ইতিহাসের প্রমাণ বহন করে, তেমনই স্থাপত্যগত দিক থেকেও এটি চমৎকার। তিনতলা এই বিশাল প্রাসাদটি লালবাড়ি নামেও পরিচিত। রাজবাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে সাজানো বাগান, বিশাল বারান্দা, এবং ঠাকুরঘর। ভেতরে আছে প্রাচীন আসবাবপত্র, তৈলচিত্র, পুরোনো দিনের অস্ত্র ও রাজপরিবারের ব্যবহৃত সামগ্রী। রাজপরিবারের সদস্যরা এখনও এই রাজবাড়ির একটি অংশে বাস করেন। বাকি অংশ পর্যটকদের জন্য অতিথিশালায় রূপান্তরিত হয়েছে। আপনি চাইলে এখানে রাত্রি যাপনও করতে পারেন, যা এক রাজকীয় অভিজ্ঞতা।
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি শুধু একটি ঐতিহাসিক ভবন নয়, এর আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ একে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে। রাজবাড়ির চারপাশে ঘন জঙ্গল, শাল-পিয়াল গাছ, আর সবুজের ছায়ায় ঘেরা শান্ত পরিবেশ আপনাকে এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেবে।

রাজবাড়ির খুব কাছেই রয়েছে:
জুবিলি হিল: একটি ছোট পাহাড়, যেখানে উঠে যাওয়া যায় রাজবাড়ির পেছন দিক থেকে।
বেলপাতা ফরেস্ট রিজার্ভ: বন্যপ্রাণী ও পক্ষিপ্রেমীদের জন্য আদর্শ স্থান। এখানে দেখা মেলে হরিণ, বুনো শুকর, নানা প্রজাতির পাখি।
চিল্কিগড় কানাক দুর্গা মন্দির: ঝাড়গ্রাম থেকে ১৫ কিমি দূরে অবস্থিত এই মন্দির একটি প্রাচীন শক্তিপীঠ বলে মানা হয়।
ঝাড়গ্রাম ডিয়ার পার্ক: পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার আদর্শ স্থান।
গরুড়েশ্বর শিবমন্দির: প্রাচীন এক শিবমন্দির, ইতিহাস ও স্থাপত্যের মিলিত নিদর্শন।
শীতকালে বা বর্ষার পর এই অঞ্চল হয়ে ওঠে আরও মনোরম। জঙ্গলের সবুজ, আকাশে পাখিদের ওড়াউড়ি, আর নির্জন পরিবেশে রাজবাড়ির অবস্থান সবকিছু মিলে এক রূপকথার আবহ।
কীভাবে যাবেন কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম?
ঝাড়গ্রাম কলকাতা থেকে প্রায় ১৭৫ কিমি দূরে। যেতে পারেন রেলপথে বা সড়কপথে।
রেলপথে:
কলকাতার শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশন থেকে ঝাড়গ্রামগামী একাধিক ট্রেন পাওয়া যায়।
হাওড়া-ঝাড়গ্রাম লোকাল, ইস্পাত এক্সপ্রেস, রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস, পুরী-এক্সপ্রেস ইত্যাদি ট্রেন ঝাড়গ্রামে থামে।
ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে রাজবাড়ি গাড়িতে মাত্র ৫–১০ মিনিটের পথ।
সড়কপথে:
কলকাতা থেকে NH16 ধরে (বর্ধমান–খড়গপুর হয়ে) ঝাড়গ্রাম পৌঁছানো যায়।
প্রাইভেট গাড়ি বা বাসে যেতে সময় লাগে প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা।
থাকার ব্যবস্থা:
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতেই অতিথি থাকার ব্যবস্থা আছে (পূর্ব বুকিং প্রয়োজন)।
এছাড়া ঝাড়গ্রামে রাজ্য পর্যটনের হোটেল (WBTDC), প্রাইভেট হোটেল ও হোমস্টেও আছে।
রাজবাড়িতে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়
ঝাড়গ্রাম যাওয়ার জন্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়টি সবথেকে উপযোগী। শীতকালে এখানকার জঙ্গল এক অনন্য রূপে সেজে ওঠে। রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো ও কালীপুজো-র সময় গেলে দেখতে পাবেন রাজবংশের আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী পুজো – ঢাক, সিঁদুর খেলা, রীতিনীতির এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয় – এটি এক ঐতিহাসিক ধ্বনি, এক সাংস্কৃতিক অধ্যায়, এক প্রাকৃতিক শান্তির ঠিকানা। ইতিহাসপ্রেমী হোন বা প্রকৃতিপ্রেমী, ঝাড়গ্রাম আপনার হৃদয়ে জায়গা করে নেবেই। এক ছুটির দিনে, ইতিহাসের ছায়ায় ঘেরা এই রাজপ্রাসাদে এসে আপনি ফিরে পাবেন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা..
📸 টিপস:
ক্যামেরা অবশ্যই সঙ্গে নিন।
ভোরবেলা রাজবাড়ির সামনের বাগানে বসলে পাখির ডাক আর জঙ্গলের নীরবতা আপনাকে মুগ্ধ করবে।
Comments