লাল কুঠি, ক্রাইপার সাহেব ও হেওয়ার্ডস কাহিনী: এক প্রায় বিস্মৃত কোন্নগরের ইতিহাস!
- রোজকার অনন্যা
- Jun 7
- 2 min read
হুগলি নদীর ধারে কোন্নগর শহর যেন ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী। এই শহরের বুকে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে এক প্রাচীন বাড়ি যার নাম "লাল কুঠি"। তবে এই বাড়ি আর তার বাসিন্দাদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এমন কিছু গল্প, যা শুধু কোন্নগরের নয়, ভারতের শিল্প ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

ডেভিড ওয়াল্ডি: ক্লোরোফর্ম থেকে কারখানা
ডেভিড ওয়াল্ডি ছিলেন এক স্কটিশ রসায়নবিদ, যাঁর নাম ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে ক্লোরোফর্ম আবিষ্কারের প্রথমদিকের কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে। পরবর্তীকালে ব্রিটেনে প্রাপ্য স্বীকৃতি না পেয়ে তিনি ১৮৫৩ সালে ভারতে চলে আসেন। কলকাতার কাছে তিনি স্থাপন করেন 'D. Waldie & Co. Ltd.' ভারতের অন্যতম প্রাচীন রাসায়নিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যেখানে সালফিউরিক অ্যাসিড ও রেড লেড উৎপাদন শুরু হয়।
উইলিয়াম ক্রাইপার ও লাল কুঠির জন্ম:
১৮৮৫ সালে এই সংস্থায় যোগ দেন উইলিয়াম রিসডন ক্রাইপার, এক ইংরেজ ধাতুবিদ। Waldie-র মৃত্যুর পর ক্রাইপার কারখানাটি স্থানান্তর করেন কননগরে এবং ১৯০৪ সালে তৈরি করেন তাঁর নিজস্ব প্রাসাদতুল্য বাসভবন, লাল কুঠি। বিলিয়ার্ড রুম, গ্রন্থাগার, ব্যক্তিগত জেটি, টেনিস কোর্ট, এমনকি একটি রোলস-রয়েস, এই সবই ছিল তাঁর বিলাসবহুল জীবনের অংশ। তবে তিনি শুধু বিলাসে মগ্ন ছিলেন না, কননগরের রাস্তা, স্কুল, ব্রিজ নির্মাণে তাঁর অবদান আজও স্থানীয়রা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
এরিক হেওয়ার্ড ও বেঙ্গল ডিস্টিলারিজ:
ক্রাইপার সাহেবের ভাগ্নে এরিক হেওয়ার্ড ১৯০৪ সালে কননগরে আসেন এবং ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল ডিস্টিলারিজ কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তৈরি হয় বিশ্বখ্যাত 'Haywards' ব্র্যান্ডের মদ। তাঁর পুত্র স্যার অ্যান্থনি হেওয়ার্ড পরে এই ব্যবসার হাল ধরেন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেন ব্র্যান্ডটিকে।
আজকের কোন্নগর এবং স্মৃতিচিহ্ন:
ক্রাইপার সাহেবের মৃত্যুর পর কারখানা বহুবার মালিকানা পরিবর্তন করে। বর্তমানে এটি কলকাতার এক মারোয়ারি পরিবারের মালিকানাধীন এবং এখনও রাসায়নিক উৎপাদন হয়ে থাকে এখানে। লাল কুঠি আজও অক্ষত, তবে আর জনসাধারণের নাগালের বাইরে। বর্তমানে এটি কৃষি রাসায়ন কোম্পানির গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিও নদীপথে যাত্রাকালে এর লাল ইটের দেওয়াল আর রাজকীয় স্থাপত্য আজও চোখে পড়ে।
এরিক হেওয়ার্ডের উত্তরসূরি সায়মন হেওয়ার্ড বর্তমানে গোয়ায় একটি হেরিটেজ হোটেল চালান Vivenda dos Palhacos, যেখানে একটি ঘরের নাম রেখেছেন "Konnagar", পূর্বপুরুষের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে। কোন্নগরের এই ইতিহাস আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ছোট শহরের বুকেও লুকিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য, বিজ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতির বিস্ময়কর মেলবন্ধন।
Commenti