top of page

গঙ্গার বুকে ইতিহাসের পাতাল: চন্দননগরের পাতালবাড়ী..

চন্দননগরের ইতিহাসপ্রেমী মানুষদের কাছে একটি নাম যেন এক রহস্যভরা স্মৃতির অ্যালবাম- পাতালবাড়ি। গঙ্গার ধারে অবস্থিত এই হলুদ রঙের পুরোনো বাড়িটি একাধারে স্থাপত্যের বিস্ময়, সাহিত্য-ইতিহাসের নীরব সাক্ষী এবং বিপ্লবের আখড়া। এক সময়ের ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরের এক নির্জন কোণে গঙ্গার বুক ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাড়ির নিচের তলাটি আজও জলতলের নীচে। এখান থেকেই শুরু হয় এক অন্য জগতের কাহিনি।

এই পাতালবাড়ির ইতিহাস ছুঁয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। কিশোর রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন এর পাশেই তেলেনিপাড়ার বারুজ্যেদের বাগানবাড়িতে। পরে গিয়েছিলেন মোরান সাহেবের মাটির বাড়িতে, যেখানকার স্মৃতি ধরে রাখতেই শান্তিনিকেতনে তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত শ্যামলী বাড়িটি। আর জীবনসায়াহ্নে, ১৯৩৫ সালে, তিনি এসেছিলেন এই পাতালবাড়িতে। কথিত আছে, তাঁর প্রিয় মিষ্টি সূর্য মোদকের ‘জলভরা সন্দেশ’ তখনও এখানে এলে এনে দেওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথের আসা-যাওয়ার সূত্রেই ঠাকুরবাড়ির আরও অনেকে এ বাড়িতে পা রেখেছেন।


এই বাড়ির আরেক গর্ব- বিদ্যাসাগরের উপস্থিতি। বিধবা বিবাহের মতো যুগান্তকারী সংস্কার চালু করতে গিয়ে যখন কলকাতার ধর্মমাথারা বিরোধিতায় মুখর, তখন চন্দননগরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই মনীষী। এখান থেকেই তিনি স্থানীয়দের সহানুভূতি ও সমর্থন চাইতেন। আর ইতিহাস বলছে, হিন্দু সমাজে প্রথম বিধবা বিবাহ হয়েছিল এই চন্দননগরেরই খলিসানিতে- তাই এই বাড়ির অন্দরমহল হয়ে উঠেছিল এক সামাজিক বিপ্লবের নির্জন সাক্ষী।


অনেকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবীরা আত্মগোপনের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন এই পাতালবাড়ির নিচের ঘরগুলিতে। নিচে মাটির তলায় থাকা ঘর, রান্নাঘর এমনই স্থাপত্যে গড়া, যা বাইরের চোখে ধরা পড়ত না সহজে। পুরনো দিনের ‘সরকার-চুলা’ রয়েছে এখানে, যেখানে চিমনি ছাড়াই রান্নার ব্যবস্থা ছিল। এই রান্নাঘরের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে নানান গল্প- কেউ বলে, কেউ জানে, কিন্তু সবার কাছেই যেন রহস্যময়।


এক সময় এই বাড়ি ছিল ফ্রেঞ্চ নেভির বিশ্রামাগার। পরবর্তীতে যোগেন্দ্রনাথ খান এই বাড়ির মালিকানা পান, আর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সূত্রেই বাড়িটির সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আজ এই বাড়ি অসীম খান নামক ষাটোর্ধ্ব একজন মানুষ একাই আগলে রেখেছেন। গঙ্গার ভাঙনে একটি দিক অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত, তবুও অসীমবাবু অতিথিদের হাসিমুখে ঘুরিয়ে দেখান পাতালবাড়ির অলিন্দ, সিঁড়ি, মাটির নিচের ঘর, আর তার গায়ে লেগে থাকা সময়ের গন্ধ।

পাতালবাড়ি শুধু একটি পুরনো বাড়ি নয়। এটি এক ঐতিহাসিক সৌধ- যার দরজায় দরজায় গঙ্গার বাতাসে বয়ে আসে সাহিত্য, বিপ্লব, সমাজসংস্কারের কথা। ছাতিম, টগর, বট, অশ্বত্থ, আর গঙ্গার ধারের শান্ত ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই বাড়ি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বলে চলেছে এক অনন্য চন্দননগরের কথা। আধুনিকতার তোড়ে হারিয়ে যেতে বসা এমন ইতিহাসকে রক্ষা করা শুধুমাত্র সরকারের কাজ নয়, বরং আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। কারণ এ শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এ আমাদের আত্মপরিচয়ের অংশ।


যদি কখনও চন্দননগর যান, একবার গিয়েই দেখে আসুন পাতালবাড়ি। হয়তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা সেই দেওয়ালের ফাঁকে আপনি শুনতে পাবেন রবির কবিতার সুর অথবা বিদ্যাসাগরের কণ্ঠে সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার।

Comments


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page