পঞ্চরত্ন শৈলীর অনন্য নিদর্শন: ভুবনেশ্বরের রাজা-রানী মন্দির..
- রোজকার অনন্যা

- Jul 12
- 2 min read
ভারতের পুরাকীর্তি মানচিত্রে ওড়িশা এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বর পরিচিত 'মন্দিরনগরী' নামে। শত শত প্রাচীন মন্দিরের ভিড়ে একটি মন্দির স্থাপত্য ও শিল্পরসিকতার দিক থেকে আলাদা করে নজর কাড়ে রাজা-রানী মন্দির। এর নিখুঁত পঞ্চরত্ন শৈলী, অলংকরণের সূক্ষ্মতা ও স্থাপত্যের ভারসাম্য একে ভারতের মধ্যযুগীয় হিন্দু মন্দির স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন করে তুলেছে।

ভুবনেশ্বরের রাজা-রানী মন্দির নির্মিত হয়েছিল ১১শ শতকে, সম্ভবত সোমবংশীয় রাজা উদ্যোত কেশরীর রাজত্বকালে। এই মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছে শিব বা পার্বতীকে, যদিও মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, এই মন্দিরটি রাজা ও রানি একসঙ্গে ধ্যান-সাধনার জন্য ব্যবহার করতেন, তাই এর নাম ‘রাজা-রানী মন্দির’। যদিও এই নাম ইতিহাস নির্ভর নয়, তা সত্ত্বেও এর আভিজাত্য ও অলঙ্করণ এই নামের যথার্থতা প্রমাণ করে।
রাজা-রানী মন্দিরকে পঞ্চরত্ন শৈলীর অনন্য নিদর্শন বলা হয় কারণ এর মূল মন্দিরের চার কোণে চারটি ক্ষুদ্রতম মিনার (রত্ন) রয়েছে এবং কেন্দ্রস্থলে রয়েছে প্রধান ভিমবর্গ বা ‘বদ-দেউল’। এই ধরনের শৈলী পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার মধ্যযুগীয় মন্দিরে সচরাচর দেখা যায় না তাই একে ব্যতিক্রমী বলা চলে। বিমা (ভবন) ও জগমোহন (মণ্ডপ) দু’টি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত এই মন্দির। বিমার উপরে চারটি ছোট ছোট রত্নাকৃতি মিনার, যেন স্বর্গমার্গে এক সূক্ষ্ম ছন্দ সৃষ্টি করেছে। শিখরের ঘূর্ণায়মান রেখা ও অলঙ্করণের কৌশল একে দৃষ্টিনন্দন করে তোলে।
মন্দিরের বাহ্যিক দেওয়াল জুড়ে অসাধারণ সূক্ষ্মতায় খোদাই করা রয়েছে নানা পৌরাণিক দেবদেবীর মূর্তি, নর্তকীর ভঙ্গিমা, কল্পিত প্রাণী ও প্রকৃতিচিত্র। বিশেষ করে নারী ভাস্কর্যগুলির অভিব্যক্তি ও সৌন্দর্য দর্শককে বিস্মিত করে। দেব-দেবীর মুখে রাগ, হাসি, লজ্জা ও কৌতুক যেন স্থির পাথরের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করেছে শিল্পী। কাঠিন্যহীন সৌন্দর্যের এই অলঙ্করণ রত্নশিল্পের সূক্ষ্মতা নিয়ে আসে মনে। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, এই মন্দির ছিল 'তান্ত্রিক সাধনার কেন্দ্র'ও হতে পারে কারণ এখানে কামকলার দৃষ্টান্ত রয়েছে।

রাজা-রানী মন্দির শুধু ধর্মীয় স্থান নয় এটি মধ্যযুগীয় কেশরী রাজবংশের সাংস্কৃতিক উচ্চতার নিদর্শন। এখানে ধর্ম, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য একসূত্রে গাঁথা। এই মন্দিরের আশপাশে রাজনীতি, রাজপ্রাসাদ, শিল্প ও সাধনার বহু চিহ্ন মেলে, যা একে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। আজকের দিনে রাজা-রানী মন্দির শুধু পর্যটকদের নয়, শিল্প, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের কাছেও এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। পঞ্চরত্ন শৈলীর এই অতুলনীয় নিদর্শন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এক প্রেরণার উৎস। প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য-কুশলতা ও সূক্ষ্মতার নিদর্শন হিসেবে এই মন্দির যুগ যুগ ধরে অমলিন থাকবে।








Comments