খাজুরাহো মন্দির, ভাস্কর্যের ভাষায় এক বিস্ময়কর ভারতীয় অধ্যায়..
- রোজকার অনন্যা

- Jul 19
- 2 min read
ভারতের সংস্কৃতি, স্থাপত্য আর ইতিহাস মিলেমিশে তৈরি করেছে যে কয়েকটি অমূল্য ধন, তার মধ্যে অন্যতম হলো মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দির। খাজুরাহো শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, এটি হলো এক ইতিহাসের ভাষ্য, এক কল্পনাশীলতার উচ্চতা, এবং এক সৃষ্টিশীল শিল্পচেতনার নিখুঁত প্রতিফলন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে এই মন্দিরসমূহ একটি অমূল্য আকর্ষণ এবং ভারতীয় সভ্যতার অতুলনীয় প্রতীক।

মধ্যপ্রদেশের ছত্তরপুর জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম খাজুরাহো। ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে প্রায় ৬২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই স্থানটি, মূলত চন্দেলা রাজবংশের সময়কালে (প্রায় ৯৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দ) নির্মিত একগুচ্ছ হিন্দু ও জৈন মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। ইতিহাস বলছে, প্রায় ৮৫টি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল সেই সময়, যদিও বর্তমানে মাত্র ২৫টি মন্দিরই টিকে আছে। খাজুরাহোর মন্দিরগুলি ১৯৮৬ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
খাজুরাহো মন্দিরগুলির স্থাপত্য মূলত “নাগরী শৈলী”-তে নির্মিত। এই শৈলীর বৈশিষ্ট্য হলো উঁচু শিখরবিশিষ্ট কাঠামো, সুসজ্জিত ভিত্তি, ও অগণিত ভাস্কর্য-খচিত প্রাচীর। এই মন্দিরগুলি চুনাপাথর বা স্যান্ডস্টোন দিয়ে গঠিত এবং এক একটি মন্দির যেন একটি ভাস্কর্য-সজ্জিত মহাকাব্য। খাজুরাহোর মন্দিরগুলিতে দেখা যায় ভগবান শিব, বিষ্ণু, দেবী পার্বতী, সূর্যদেব, গণেশ প্রভৃতি হিন্দু দেব-দেবীদের পাশাপাশি জৈন তীর্থঙ্করদেরও অঙ্গসজ্জিত রূপ। তবে এই মন্দিরগুলির সবচেয়ে আলোচিত ও অনন্য দিক হলো এর ‘কামদেব’-নির্ভর ভাস্কর্য।

খাজুরাহো মন্দিরের সবচেয়ে আলোচিত ও বিস্ময়কর দিক হলো এর ‘কামশিল্প’ বা এরোটিক ভাস্কর্য। অনেকেই একে শুধুমাত্র যৌনতা ভিত্তিক ভাস্কর্য বলে ভুল ব্যাখ্যা করে থাকেন, কিন্তু খাজুরাহোর এই শিল্প আসলে তন্ত্রসাধনা ও জীবনের পরিপূর্ণতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার দরকার। মানবজীবনের প্রতিটি পর্যায় ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বর্গ লক্ষ্যের অন্যতম ‘কাম’-এর রূপ এখানে সৃষ্টিশীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। খাজুরাহোর এই শিল্প রোমান্টিকতা, সৌন্দর্য ও যৌনতার এক জটিল সংমিশ্রণ। এই ভাস্কর্যগুলি কোনো একক উদ্দেশ্যে নির্মিত নয়, বরং জীবনের পরিপূর্ণ রূপকে তুলে ধরার এক মাধ্যম। এখানে নারী-পুরুষের মিলনের দৃশ্য যেমন আছে, তেমনি আছে দৈনন্দিন জীবনের হাস্যরস, সংগীত, নৃত্য, পোশাক-পরিচ্ছদের নান্দনিক প্রকাশ।
খাজুরাহোতে প্রধানত তিনটি ভাগে মন্দিরগুলি বিভক্ত: পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ গোষ্ঠী।
1. পশ্চিম গোষ্ঠী: এই অংশে রয়েছে সবচেয়ে বেশি মন্দির, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো:
কান্দারিয়া মহাদেব মন্দির: শিবকে উৎসর্গীকৃত এই মন্দির খাজুরাহোর সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে অলঙ্কারময়।
লক্ষণ মন্দির: বিষ্ণুকে উৎসর্গীকৃত এবং প্রাচীনতম গুলির অন্যতম।
বিশ্বনাথ ও চিত্রগুপ্ত মন্দির: সূর্যদেব ও অন্যান্য দেবতাকে উৎসর্গীকৃত।
2. পূর্ব গোষ্ঠী: এখানে মূলত জৈন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির রয়েছে।
পার্শ্বনাথ, আদিনাথ, ঘন্তাই মন্দির – জৈন তীর্থঙ্করদের ভাস্কর্যে ভরপুর।
3. দক্ষিণ গোষ্ঠী: তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত হলেও গুরুত্ববহ।
দুলাদেও ও চতুরভুজ মন্দির – দক্ষিণ গোষ্ঠীর অন্যতম নিদর্শন।

খাজুরাহো মন্দির শুধু ইতিহাসের নিদর্শন নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে অনুষ্ঠিত হয় ‘খাজুরাহো নৃত্য উৎসব’, যেখানে দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। এই উৎসবে ভরতনাট্যম, ওডিসি, কথক, মণিপুরী, কুচিপুড়ি প্রভৃতি শাস্ত্রীয় নৃত্য পরিবেশিত হয়, যা খাজুরাহোর সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আরও একধাপ উজ্জ্বল করে তোলে।
খাজুরাহো আজ ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে (ASI) এই মন্দিরগুলির সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। খাজুরাহোতে এখন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হোটেল, গাইড সার্ভিস, ও পর্যটন তথ্য কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে, যা এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে আরও সহজগম্য করে তুলেছে।

খাজুরাহো শুধু স্থাপত্যের এক মাইলফলক নয়, এটি হলো এক শিল্প ও মানবজীবনের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপায়ণ। এখানে প্রেম, সৃষ্টিশীলতা, ধর্ম, রস, রীতি সব কিছুর মিলন ঘটেছে এক অবিশ্বাস্য সমন্বয়ে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, যখন ভারতীয় ঐতিহ্যকে নতুন করে আবিষ্কার ও সংরক্ষণ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তখন খাজুরাহোর মতো নিদর্শন আমাদের পথ দেখাতে পারে, আমাদের শেকড়ের সন্ধান দিতে পারে। খাজুরাহো মন্দির আমাদের শেখায় শিল্প যখন নিখুঁতভাবে মানুষের অনুভবকে ধারণ করে, তখন তা সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে চিরন্তন হয়ে ওঠে।








Comments