মোবাইল বা ল্যাপটপ ব্যবহার করলে চোখ থেকে জল পড়ছে? ড্রাই আই সিনড্রোম এ ভুগছেন না তো?
- রোজকার অনন্যা
- Jun 14
- 3 min read
আজকের দিনে আমরা প্রায় প্রতিটি কাজেই নির্ভর করছি ডিজিটাল ডিভাইসের উপর মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বা ডেস্কটপ। অফিসের দীর্ঘ সময়ের কাজ হোক, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানো চোখের উপর পড়ে তীব্র চাপ। আর এই ডিজিটাল নির্ভরশীলতার ফসল হিসেবে ক্রমবর্ধমান হারে দেখা দিচ্ছে একটি নীরব সমস্যা ড্রাই আই সিনড্রোম।

ড্রাই আই সিনড্রোম কী?
চোখে অশ্রু না থাকলে শুধু কাঁদা যায় না, দেখা যায় না, এই কথা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। ড্রাই আই সিনড্রোম (Dry Eye Syndrome) বা শুষ্ক চোখের রোগ তখনই হয়, যখন চোখ পর্যাপ্ত পরিমাণে অশ্রু তৈরি করতে পারে না বা তৈরি হওয়া অশ্রু পর্যাপ্ত লুব্রিকেশন দেয় না। এর ফলে চোখে দেখা দিতে পারে জ্বালা, চুলকানি, ঝাপসা দৃষ্টি, এমনকি অতিরিক্ত অশ্রুপাত যা আমাদের বিপরীত মনে হলেও আসলে শুষ্ক চোখেরই একটি প্রতিক্রিয়া।
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শ্রেয়সী রায় (AIIMS, Ophthalmology) বলেন,
“প্রতি বছরই ড্রাই আই সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ৩০ বছরের পর এই সমস্যা বেশি দেখা গেলেও এখন স্কুলপড়ুয়া শিশুরাও ডিভাইসের ব্যবহার বাড়ার কারণে আক্রান্ত হচ্ছে। চোখে স্বাভাবিক তেলাক্ততা না থাকলে দৃষ্টিশক্তির ওপরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।”
ড্রাই আই সিনড্রোম হঠাৎ করে হয় না, এর পেছনে থাকে বিভিন্ন অন্তর্নিহিত কারণ:
১. দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিন দেখা
ডিজিটাল ডিভাইসের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় আমরা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম চোখের পলক ফেলি। এর ফলে চোখের তলানি শুকিয়ে যেতে থাকে।
২. বয়সজনিত পরিবর্তন
৪০ বছর পার হওয়ার পর চোখের প্রাকৃতিক অশ্রু উৎপাদন ক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে। নারীদের মধ্যে মেনোপজের পর এই সমস্যা আরও বেশি দেখা যায়।
৩. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
অ্যান্টিহিস্টামিন, ডিপ্রেশন বা উচ্চ রক্তচাপের কিছু ওষুধ চোখের লুব্রিকেশন কমিয়ে দেয়।
৪. পরিবেশগত কারণ
শুষ্ক হাওয়া, ধুলোবালি, দূষণ, এসি-তে দীর্ঘ সময় থাকার ফলে চোখের ত্বক শুকিয়ে যায়।
৫. স্বাস্থ্যগত সমস্যা
ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাস ইত্যাদি রোগের সঙ্গে ড্রাই আইয়ের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

লক্ষণসমূহ
চোখে খচখচে বা বালির মত অনুভব হওয়া
চোখ লাল হওয়া, জ্বালা বা চুলকানি
চোখ ঘোলা বা ঝাপসা দেখা
বেশি সময় স্ক্রিন দেখার পর চোখে ক্লান্তি
বিদ্বেষপূর্ণভাবে অতিরিক্ত জল পড়া (রিফ্লেক্স টিয়ারিং)
চোখ থেকে জল পড়া মানেই চোখ ভালো কাজ করছে, এমন ভাবার ভুল থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই এটি চোখের শুষ্কতার প্রতিক্রিয়া যা চিকিৎসা ছাড়া বাড়তেই থাকে।
প্রতিরোধের উপায় ও যত্ন
ড্রাই আই থেকে মুক্তির প্রথম ধাপ হলো সচেতনতা। কয়েকটি সহজ নিয়ম মেনে চললে এই সমস্যা অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়।
✅ ২০-২০-২০ নিয়ম মেনে চলুন
প্রতি ২০ মিনিট পর, আপনার স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে ২০ ফুট দূরের কিছু দেখুন অন্তত ২০ সেকেন্ড।
✅ চোখের পলক ফেলুন সচেতনভাবে
স্ক্রিনে কাজ করার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়মিত চোখের পলক ফেলুন।
✅ কৃত্রিম অশ্রু ব্যবহার করুন
চোখের শুকনো ভাব দূর করতে ওভার-দ্য-কাউন্টার লুব্রিকেটিং ড্রপ ব্যবহার করতে পারেন। তবে নিয়মিত ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
✅ স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা ও রঙের তাপমাত্রা ঠিক করুন
ব্লু-লাইট ফিল্টার ব্যবহার করুন। রাতের দিকে “Night Mode” বা “Warm Tone” চালু রাখুন।
✅ চোখ ও শরীর হাইড্রেটেড রাখুন
প্রতিদিন কমপক্ষে ২.৫ থেকে ৩ লিটার জল পান করুন। এটি শুধু চোখ নয়, সারা শরীরের কোষকে সজীব রাখে।
✅ এসি বা ধুলোবালি থেকে চোখ রক্ষা করুন
চোখে সানগ্লাস বা প্রটেক্টিভ চশমা ব্যবহার করুন ধুলোবালি বা হাওয়ার মাঝে বেরোলে।
✅ নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা করুন
চোখের যেকোনো অস্বস্তি বা লক্ষণ উপেক্ষা না করে একজন চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসার পথ
১. প্রেসক্রিপশন ড্রপ বা ওষুধ
Inflammation বা অশ্রু নিঃসরণে সমস্যা হলে চিকিৎসক সাইক্লোসপোরিন বা লিফিটগ্রাস্ট নামক ওষুধ লিখে দিতে পারেন।
২. পাঙ্কটাল প্লাগ (Punctal Plug)
অশ্রু নালীতে অস্থায়ী বা স্থায়ী প্লাগ বসিয়ে অশ্রু বেরিয়ে যাওয়া বন্ধ করা হয়, যাতে চোখে তরল জমে থাকে।
৩. IPL Therapy বা লেজার থেরাপি
মডারেট থেকে সিভিয়ার ড্রাই আই-এর ক্ষেত্রে চশমা বা ড্রপের বাইরে বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার হয়।
৪. সার্জারি
চরম ক্ষেত্রে অশ্রু নালীর ব্লকেজ সারানোর জন্য অপারেশন দরকার হতে পারে।
ড্রাই আই সিনড্রোম হয়তো এক সময় "ছোটখাটো সমস্যা" বলে অবহেলিত ছিল, কিন্তু আজ এটি চোখের স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। সময়মতো সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে চোখের আরাম, দৃষ্টির স্বচ্ছতা ও দৈনন্দিন কাজের স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখা সম্ভব। যদি আপনার চোখে নিয়মিত শুষ্কতা, জ্বালা বা অতিরিক্ত জল পড়ার সমস্যা হয়, দেরি না করে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। চোখ আমাদের জানলার মতো তার যত্ন না নিলে ভিতরের আলোও নিভে যেতে পারে।
এই প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে রচিত। রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াই শ্রেয়।
-সুদেষ্ণা ঘোষ
Comments