top of page

পঞ্চমের সপ্তসুরে

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়



একটা কেমন স্তব্ধতা !

অন্ধকারে হাতড়ে মরি, শিল্পী তোমার শূণ্যতা

আকাশ ভরা তারার মাঝে, নায়ক তোমার পূর্ণতা ।

রাতের গায়ে দিন ঢলে যায়, গড়িয়ে চলে সময় টা

আনন্দের এই জীবন সফর, ব্যস্ত ইঁদুর-দৌড় টা ।

সাঁঝসবেরে, নীল আকাশে ভোকাট্টা সেই ঘুড়ি টা

কেমন জানি হাতড়ে মরি, সুপারস্টারের শূণ্যতা !

জীবন? সে তো অনেক দিল, কমিয়ে দিল আয়ু টা

শিল্পী ! তুমি ঘুমিয়ে থেকো, কাটাও সুখের স্বর্গ টা !

আকাশ যেন ঝলসে গেল, বদলে গেল দৃশ্য টা

একটা তারা খস্‌ল পড়ে, থম্‌‌কে গেল শহর টা !

কোথায় যেন হারিয়ে গেল, জ্বলজ্বলে সেই তারা টা

দম্‌কা বাতাস উড়িয়ে দিল, শুটিং স্টারের ফুলকি টা !

শূণ্য ঘরে, একা আমি থম্‌‌কে ঘড়ির কাঁটা টা

হঠাত ! যেন একলা ঘরে শিল্পী তোমার স্তব্ধতা !


নিঃশব্দ ছন্দপতন যেন । হারিয়ে গেল সপ্তসুরের অন্যতম সুর পঞ্চম। রাহুলদেব বর্মণের জন্মদিনে কবিতায় শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে এই ছিল আমার নিঃশব্দ এই স্মৃতিতর্পণ।


তখন আমার ভালোবাসার গান ভাসতে ভাসতে চলত স্টাডিরুমের সংলগ্ন একফালি বারান্দা দিয়ে। রাইকিশোরীর সুইট টিন পেরোচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে । ভালোবাসার বারান্দায় প্রথম কদমফুল ফুটতে দেখছি আনাচেকানাচে। আর তখন নতুন দূরদর্শন এসেছে ড্র‌ইংরুমের সুখি গৃহকোণে। সেখানে গুরুগম্ভীর সংবাদ পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে সাদায় কালোয় রবীন্দ্রসংগীত। আর মায়ের শোবার ঘরে ঢাউস রেডিওতে মায়ের বরাদ্দ নাটক আর আমাদের জন্য রোব্বারের গল্পদাদুর আসর । শনিবার স্কুল হাফছুটি হত। উইকএন্ডের সূচনালগ্নে জোরকদমে ট্রানসিষ্টর রেডিওতে প্রথম চিনতে শেখা আমার গানবাঙালির পঞ্চম দা কে ।

ভোরের আলোর পর্দা সরিয়ে, কচি রোদ্দুর গায়ে মেখে তরতর করে গান চলত আমার কৈশোরে । একটু থামত আবার ফিরে আসত । স্কুলব্যাগ গোছানোর ফাঁকে ফাঁকে আশপাশের বাড়ির থেকে কানে আসত আধুনিক গান।আমি তখন ক্ল্যাসিকাল গানের তালিম নিচ্ছি আর গীতবিতানের স্রোতে ভাসছি। অতএব আধুনিক গানের চর্চা? নো ওয়ে! অথচ বাবা-মা দিব্য গাইছেন "তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর" অথবা "আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে"। কিন্তু আমার গানের ওপর যত্ত শুল্ক আরোপ। ফতোয়া জারি। গীতবিতানের জানলা খুলে আবার ভাসত আমার গান । ভালোবাসার গান । পঞ্চকবির গান। সেখানে পঞ্চম, সপ্তম সবার নো এন্ট্রি। ক্রমে শুক্রবারের সন্ধ্যের অন্ধকারের পরত ছিঁড়েখুঁড়ে ভালোলাগার গান এসে পড়ত শনিবারের গানভাসি দুপুরবেলায়, শ্রাবন্তী মজুমদারের মনের মত গান, মনে রাখার কথায় । রাহুলদেবের গান বাজত সেখানে অনেক। এই ভাবে আমার স্বপ্নপথে ভালোবাসার গান এসেছিল সেদিন । আর কেন জানিনা অঙ্কখাতা হাতে আমি রাহুলদেব বর্মণের গান শুনতাম।সব অঙ্ক মিলে যেত সেই গানের জাদুতে। কেমন এক ফ্যান্টাসিময়তা! কোনোদিন ঐ অনুষ্ঠানে ওনার গান না শুনতে পেলে মুড অফ হয়ে যেত । কিছু যেন মিস করছি আমি।

একটু আফশোস হত একদিন । সেই অপূর্ণতা নিয়ে রাতে ঘুমিয়ে এই স্বপ্ন দেখেছিলাম ভালোবাসার গান নিয়ে ।


তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে দেখি গান আমার মনখারাপের উঠোন পেরিয়ে, স্বপ্নপথ বেয়ে সোজা আবার আমার পাশে লাইভ তিনি। বিয়ের পরদিন দেশপ্রিয় পার্কের শ্বশুরবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার স্বামী দেখালেন, ঐ দ্যাখো ওয়েডারবার্ণ রোডের ঐ বাড়িটায় তোমার রাহুলদেব এক সময় রেগুলার এক বন্ধুর বাড়িতে আসতেন। চোখ চকমক করে উঠল। আমার ভাসুরের সঙ্গে তীর্থপতি ইন্স্টিটিউশানে পড়তেন তিনি। আর পিসি শাশুড়ি বললেন, পঞ্চমকে তো আমরা কত্ত দেখেছি। পড়াশোনা একদম করতনা। বিকেল হলেই ছেলেরা ইনক্লুডিং আমার ভাসুর ঐ আড্ডাবাড়ির সামনে গিয়ে চীতকার করে ডাক দিতেন রাহুলদেবকে নিয়ে খেলতে যাবার জন্য। ভাবলাম, ইস্‌ এই বাড়িতে আরো আগে কেন আসিনি।


আমার মন তখনো আকুপাঁকু রোদজ্বলা দুপুরে... ইস্‌ ! যদি আমার পায়ের নূপুরের সুর তুলতে পারতাম তার জন্য! ঠিক তেমনই ভাবসাব মনে মনে। এখনো রঙীন পর্দায় গানছবিতে রাহুলের সেই সৃষ্টির জন্য পথ চেয়ে থাকি। ইয়াদো কি বরাত মুখে মুখে ফিরেছিল আমার ছোটবেলায়। তখন হিন্দী বুঝতাম কম। সেই ১৯৭৬ সালে রাহুলদেব শোলের সেই বিখ্যাত মেহেবুবা মেহেবুবা গানটি গেয়ে বেষ্ট পুরুষ কন্ঠের এওয়ার্ডটি পেলেন। এই গানটি বুঝি নিজের জন্যেই বানিয়েছিলেন তিনি আর কিংবদন্তী হয়ে র‌ইলেন। গান বানানোর সেই অদ্ভূত সমীকরণ আজো অধরা নতুন প্রজন্মের সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে। প্রতিনিয়ত চ্যানেল সার্ফিং হঠাত করে হয়ত ধরা দেয়, মনে করিয়ে দেয় সনম তেরী কসমের টাইটেল ট্র্যাক.. "কিতনে ভি তু করলে সিতম্‌'..১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি আর আমার বেথুন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার। সেবছরেই শীতে আমরা অজন্তা-ইলোরা গেছিলাম । বম্বে থেকে টানা বাসে পাহাড়ি পথে সেই গান সারা রাস্তা বেজেছিল। আর সিনেমাতেও কামল হাসানের সেই বাসের মধ্যেই গানদুষ্টুমি। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সবুজে নীলে আমার গানভাসি বেড়ানোর ছুটি তখন পঞ্চমময়তায় আবিষ্ট । তারপর ১৯৮৪ তে মাসুম। অনুপ ঘোষাল, আরতি মুখার্জি গাইলেন হিন্দী ছবিতে পঞ্চমের সুরে সেই অনবদ্য গান। আরো কত স্মৃতি এমন। হেমা মালিনী-রাজেশ খান্নার মেহবুবা দেখতে গেছিলাম জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি গিয়ে, দিদিরা নিয়ে গেছিল, মেনকা সিনেমা হলে। সেই আমার জ্ঞানত প্রেমের হিন্দী ছবি দেখা। আমি তখন ক্লাস সেভেন। প্রচন্ড বকুনি জুটল বাড়ি ফিরে। সব সুরের সঙ্গে পঞ্চম যেন হারিয়ে গেলেন কিছুদিনের জন্যে আমার জীবন থেকে।

তারপর শোলে, হাম কিসিসে কম নহি, কিনারা... সব সুপার ডুপার ফিট ফর্মুলা, হিট পঞ্চম। আবার নতুন করে পেলাম 1942এ লাভ স্টোরিতে। কিন্তু হারালাম সেইক্ষণেই আমার ভালোবাসার গানের মানুষকে, যিনি প্রকৃত বুঝতেন গানের কেমিষ্ট্রি। হিন্দীছবির সঙ্গে গান মেশানোর অ্যালগরিদমটা তদ্দিনে তাঁর রফ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ফুরিয়ে গেল জীবনটা। সাফল্যের লেখচিত্র শিখরে উঠেই নেমে গেল টুক করে। চিরকালের মত হারিয়ে গেলেন পঞ্চম।


রেডিওতে "ফিরে এসো অনুরাধা" শুনে মনে হত আমার জন্যেই লেখা। না না, শুধু আমার কেন, সব মেয়েদেরই বুঝি মনে হয় এখনও। "যেতে যেতে পথে হল দেরী'র সুরে যখন আঁধি ছবিতে "তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোয়ি' গানটি তৈরী হল তখন আমি যেন পাগল প্রায় সেই আঁধির ঝোড়ো হাওয়ায়। কিছুদিন পড়াশুনো ভুলে রেডিও খুলছি কেবলি। কোথায় পাব তারে? তখন এত গান শোনা যেতনা, এখন যেমন ইউটিউব, সিডি সব কিছুর কৃপায় কোনো গান‌ই অধরা নেই কারোর কাছে। আর আমাদের বুঝি সেইজন্যেই গানশোনার কান এবং অদ্ভূত এক ভালোলাগা তৈরী হয়ে গেছিল। কি আকুতি সেই প্রেমিক কন্ঠে তা আজো বসে ভাবি। অনেক রিমেক হচ্ছে, হয়েছে। ডিস্কোথেকে ওনার ট্র্যাকগুলো রিমিক্সিং হয়ে বাজতে দেখি।


মনে মনে হাসি, ভাবি সেই লাইনটা, "আমি গিয়ে দেখি, তুমি নেই একি'.......থাকলে তিনি হয়ত খুশিই হতেন মনে মনে বলি, "চলে যে গেছো তুমি, দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ওগো, চলে গেছো, চলে গেছো, বুকে কাঁটা লয়ে, ব্যথা তবু সয়ে...” আমরা বেঁচে আছি তোমার হয়ে পঞ্চম। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার যেন উজাড় করে কথা লিখেছিলেন সেদিন আর পঞ্চম তাঁর উদাত্ত কন্ঠে গেয়ে গেয়ে সুর করেছিলেন বুঝি! অবাক হ‌ই এই কথা-সুরের অভিনব মেলবন্ধন দেখে। সত্যি সত্যি তিনি দেবশিশুর মত শাপভ্রষ্ট না আশীর্বাদ ধন্য হয়ে নেমে এসেছিলেন সুরলোক থেকে। নয়ত এ সৃষ্টি কী আর হত?

কতজন তো গাইলেন মনে পড়ে রুবি রায় এতগুলো বছরে। কিন্তু সেই শুরুটার আবেগ? আর প্রতি ছত্রে ছত্রে দেখেছি বা "ডেকেছির" 'ছি' অক্ষরটা? এমন করে কেউ গেয়েছেন বলে আমার মনে হয়না। অথবা "সে কথা কী কোনোদিনো ভাবতে" র 'তে' র অনুরণন?

আমি কী আর দীপজ্বলা সন্ধ্যায়, আমার হৃদয়ের জানলায় বসে বসে শুনতে পাবো সেই পঞ্চমের সপ্তসুর? পাখি সে তো আসেও নি আমার কাছে আর আসবেও না কোনোদিন।

 
 
 

Commenti


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page