এ যাবৎ এই মানুষটিকে নিয়ে কম চর্চা হয়নি। দেশ-বিদেশের অসংখ্য গুণী পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ সত্যজিৎ সম্পর্কে সব বলে ফেলেছেন। নতুন কিছু বলার নেই হয়ত বা। কিন্তু বিশ্লেষণ, অনুভব—সে তো অনেক নতুনেরই জন্ম দেয়। তাই এই বড় মানুষদের চর্চা ও চর্যা চলতেই থাকে। তথ্য হয়ত জানা। ভাবনা ও বিশ্লেষণী ধারা বিবরণী ব্যক্তি বিশেষে পালটে যায়। হয়ে ওঠে নতুন আরেক ধারাভাষ্য। নতুন
আরেক সত্যজিৎ।
আমার সত্যজিৎ।
জন্ম শতবর্ষে
তাঁকে স্মরি বারবার।

ওঁর সঙ্গে আমার তেমন অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। উনি যখন এই জাগতিক পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তখনও আমি বানিজ্যিক কোনও পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হতে পারিনি। লিটল ম্যাগাজিন করি। সঙ্গে আঞ্চলিক সাময়িক পত্রের সম্পাদনায় সহযোগী। ফলে সেই সময়কার সংস্কৃতির দাদা ও জ্যাঠামশাইদের হাত ধরে সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে আসা। তেমনই এক সংস্কৃতির দাদা, অভিনেতৃ সংঘের অন্যতম সদস্য সমর মিত্রের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে আসা। অনেক লোকের মধ্যে আমি একজন। লোক নয়, রথী মহারথী। ঠিক উপলক্ষ কী ছিল, আজ আর মনে নেই। সেদিন কাছ থেকে দূরদর্শন ঘটেছিল। পরে যখন ওঁকে চিনেছি, খানিকটা জেনেছি তখন মনে হয়েছে উনি তো একজন সংস্কৃতির বনস্পতি।
যদি এক কথায় প্রশ্ন করা যায়, কে এই সত্যজিৎ রায়? অনেক পরিচিতিতে সমৃদ্ধ সত্যজিৎ রায়।চলচ্চিত্র পরিচালক, সঙ্গীতকার, চিত্রনাট্যকার, আলঙ্কারিক, কবি ও লেখক। সব ক্ষেত্রেই যথেষ্ট প্রশংসিত হলেও সত্যজিৎ রায়ের প্রথম এবং শেষ পরিচয় কিন্তু বাংলা সিনেমার পরিচালক হিসেবে। ভারতের একমাত্র অস্কারজয়ী তিনি। তিনি কী কী করেছেন, তা আমরা প্রায় সবাই-ই জানি। কখনওই তিনি বাণিজ্যকে সর্বস্ব করে সিনেমা তৈরি করেননি। তার সব ছবিতেই ধরা পরে রুচিশীল নান্দনিক ভাবনা।
তিনি মোট আটাশটি পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের ছবি করেছেন। তথ্যচিত্র বানিয়েছেন পাঁচটি।দূরদর্শনের জন্য তিনটি। এছাড়া অন্যের ছবিতে সত্যজিৎ রায় কখনও চিত্রনাট্যকার, কখনওবা ধারাভাষ্যকার হিসেবেও কাজ করেছেন। দুই বিশ্ববন্দিতের মধ্যে ছিল নিবিড় সুসম্পর্ক। রবি ঠাকুরের থেকে সত্যজিৎ রায় ষাট বছরের ছোট। গুরুদেবের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম দেখা। সত্যজিৎ তখন খুবই ছোটো। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতেই উত্তরায়ণে যাওয়া। সে সময় ছোট্ট সত্যজিতের ইচ্ছে হল, অটোগ্রাফ নেওয়ার। বালক সত্যজিৎ ওই বয়সেই জানতেন, রবীন্দ্রনাথ কে। তাই ওঁর অটোগ্রাফ সংগ্রহের খাতায় রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ নেওয়ার ইচ্ছে। বালক সত্যজিৎ রায়কে ‘মানিক’ নামেই চিনতেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবির সামনে কিছুটা ইতস্তত।অটোগ্রাফের খাতাটা নিয়ে দাঁড়ালেন। কবিগুরু দেখলেন। পরম স্নেহে কাছে টেনে নিলেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, খাতা নিয়ে সে কেন এসেছে? ছোট্টো মানিক খাতাটা এগিয়ে দিয়ে তাঁর ইচ্ছের কথাটা জানালেন। কবি তাঁর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর পরম স্নেহে বললেন, ‘এটা থাক আমার কাছে। কাল সকালে এসে নিয়ে যেও।’ বালক সত্যজিৎ মাথা ঝুঁকিয়ে চলে গেলেন।

কবিগুরুর আশীর্বাদ নিতে মানিক পরদিন এলেন উত্তরায়ণে। টেবিলের ওপর চিঠি-পত্র, খাতা-বইয়ের ডায়েরির পাহাড়। তার পেছনে বসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মানিককে দেখতে পেয়েই তাঁর ছোট্টো বেগুনি রঙের খাতাটি বের করে সত্যজিতকে দিলেন। মা সুপ্রভা রায়ের দিকে চেয়ে কবিগুরু বললেন, ‘এটার মানে ও আরেকটু বড়ো হলে বুঝবে।’ খাতা খুলে বালক সত্যজিৎ আট লাইনের একটি কবিতা দেখল। ভুবনজয় করা সেই কবিতা। বিশ্বকবির ঘর থেকে বেরিয়ে উত্তরায়ণের সামনের বিশাল আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে আবৃত্তি করছেন মানিক-
‘বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়েছে সিন্ধু।/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।’
সেই প্রথম সত্যজিতের জীবনে রবির ছটা পড়ল। অদ্ভুত বিষয় হল, সত্যজিৎ রায় যার জন্য জগত খ্যাত, সেই সিনেমা করার প্রেরণা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ। ‘পথের পাঁচালী’ সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি।‘পথের পাঁচালী’ রবীন্দ্র-উত্তর কথা সাহিত্যিক, ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগ্রজ বিভূতিভূষণের কাহিনি। অনেকে বলেন, বিভূতিভূষণের কাহিনিই নাকি সত্যজিতের প্রথম পছন্দ ছিল।কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে চলার পথ দেখিয়েছেন। ইতিহাস বলে সে কথা।
১৯৪৬ সাল। ডি.জে.কিমারে কাজ করছেন তখন। সেই সময়ই তিনি ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। কিন্তু কোনও কারণে সেই ছবি করা সম্ভব হল না। সেই সময় তাঁকে ভাবায় ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বইয়ের অলঙ্করণ। এরই ফলশ্রুতি ‘পথের পাঁচালী’ ছবি।
এই ছবি নিয়েও নানা সমালোচক নানা কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেন, বিভূতিভূষণের উপন্যাসটাই ‘পথের পাঁচালী’ ছবির প্রত্যক্ষ রুপ। অথচ উপন্যাসটা পড়লে অপু-দুর্গার যে অনাবিল স্বপ্নময়তা পাওয়া যায়, সেটা ছবিতে কিন্তু একদম নেই।
সত্যজিৎ সিনেমার প্রয়োজনে যেসব ঘটনা, চরিত্র রাখা প্রয়োজন মনে করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’তে সেটাই রয়েছে। প্রয়োজনে অনেক ঘটনা, চরিত্র সংযোজনও করেছেন তিনি। বাদও দিয়েছেন অনেকটা।‘পথের পাঁচালী’তে সত্যজিৎ মূল উপন্যাসের উনত্রিশ পরিচ্ছেদের কিছুটা পর্যন্ত নিয়েছেন। ছবিতে যতটা নেওয়া হয়েছে, বাদ গেছে তার অনেক বেশি। ইন্দিরা ও দুর্গার ট্র্যাজেডি ধরে অপুর মতো এই ছবিতে অপরাজিত সত্যজিৎও। বিশ্ব চলচ্চিত্রে অনেক বড় বড় পরিচালক এসেছেন, তাঁদের সৃষ্টি মানুষ মাথায় করে রেখেছেন। ফেদেরিকো দোমেনিকো মার্সেলো ফেলিনি, ডেভিড ফিঞ্চার, জেমস ক্যামেরন, পিটার জ্যাকসন, স্টিভেন স্পিলবার্গ, ক্রিস্টোফার নোলান। আপনারা যারা বার্গম্যানের ‘সেভেন্থ সিল’ ছবিটা দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে শেষ দৃশ্যের কথা। মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলার দৃশ্য কিংবা ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’র শুরুর দৃশ্যটিও যেমন ক্লাসিক, ঠিক তেমনই সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’-তে অপু-দুর্গার কাশফুলের বন পেরিয়ে রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার দৃশ্যও আজ ঐতিহাসিক, আইকনিক। কোনও কোনও জায়গায় যেন সত্যজিৎ কোথাও এগিয়ে। আপনাদের আবারও বলি, অনেক পণ্ডিত, ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু আমি আমার উপলব্ধিটা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি মাত্র। আমি পণ্ডিত নই। কিন্তু আমার দেখা, আমার সত্যজিৎ আমার মত। এতে কারোর পছন্দ নাও হতে পারে। নানা বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু কেন উনি সেরা পরিচালক, তা আমার চেতনায় যেভাবে ধরা পড়েছে, তাই-ই বলছি।

‘অপরাজিত’(১৯৫৬)ছবিতেও কিন্তু বিভূতি ভূষণের উপন্যাসের স্বপ্নময়তা নেই। চিহ্নিত হয়েছে সর্বজয়ার সঙ্গে অপুর মধুর অথচ নির্মম সম্পর্কের স্বরূপ। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে ‘অক্রুর সংবাদ’ থেকে ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের নবম পরিচ্ছেদের ঘটনাসমূহ-ই এই ছবিতে স্থান পেয়েছে। পরিমার্জিত হয়েছে, বোর্ডের পরীক্ষার অপু জেলার মধ্যে প্রথম (উপন্যাসে) হলেও সত্যজিৎ রায় দ্বিতীয় করেছেন। কলা নয়, ছবিতে অপু বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে গেল। সর্বজয়ার মৃত্যুর পর মনসাপোতা গ্রামে শ্রাদ্ধ করার পরিকল্পনা করলেও ছবিতে সে দাদুকে জানিয়েছে মাতৃশ্রাদ্ধ করবে কালীঘাটে। দুটো ছবিতেই বিভূতিভূষণ ও সত্যজিতের অপুর মধ্যে বড্ড দুরত্ব লক্ষ করা যায়। তবে হ্যাঁ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সত্যজিৎ রায় খুব জানতেন। কাছ থেকে চিনতেন। ভালো লাগত তাঁর উপন্যাস। তাই তো ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’-তে দুই স্রষ্টার সৃষ্টি ভাবনার খানিক দুরত্ব থাকলেও ‘অপুর সংসার’-এ দুজন যেন মিশে গেছেন এক মোহনায়।
সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’(১৯৫৯)-এ আমরা পেলাম বিভূতিভূষণের অপুকে। অপরাজিত উপন্যাসের শেষাংশ নিয়েই এর চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছিল। এখানেও সত্যজিৎ উপন্যাসের ঘটনাবলীকে অন্যভাবে সাজিয়েছেন। অপুকে তিনি সম্পূর্ণরূপে নগরকেন্দ্রিক করেছেন। ফলে মনসাপোতায় নয়, অর্পণা ও অপুর ঘর সংসারের ছবি দেখতে পাই মূলত কলকাতায়। উপন্যাসের পুলু, ছবিতে কিন্তু বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার। রাজশাহির জেলে থাকার ঘটনা যদি সত্যজিৎ এই ছবিতে রাখতেন, তবে বোধহয় অপুর কাছে পুলুর বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকটাই খাটো হত। অপুর স্কুলে কাজ করার প্রসঙ্গ তো একদমই নেই ছবিতে। তাঁর লেখা উপন্যাসের পাতাগুলোও একে একে মহাকালে বিসর্জন দিয়েছেন সত্যজিৎ| অপু অপর্ণার দাম্পত্য প্রেমের করুণ পরিণতি হলেও জীবনবোধে উজ্জ্বল এই ছবিটি। অপুর বিবাহপর্ব তো বাঙালি জীবনের শাশ্বত অঙ্গ।
রবীন্দ্রনাথ একসময় বলেছিলেন যে, চলচ্চিত্রের একটা নিজস্ব ভাষা দরকার। ‘পথের পাঁচালী’ ছবি থেকেই সেই ভাষা পেল বাংলা সিনেমা। চিত্রনাট্যে সাহিত্য গুণ থাকবে, আবার তা পড়ে সিনেমার স্বাদ পাওয়া যাবে। সত্যজিৎ রায় যখন চিত্রনাট্য রচনা করতেন, তখন সংলাপের পাশেই ছবি আঁকতেন, নোটেশন তৈরি করতেন। ছোট ছোট স্কেচ দিয়ে দৃশ্যপট তৈরি করতেন। খুব কম পরিচালকের চিত্রনাট্যে পাতায় এমনটা দেখা যায়। চিত্রনাট্য তৈরির সময়ই তিনি ছবি তৈরির প্রায় নব্বই ভাগ কাজ সেরে রাখতেন। সেটা চরিত্র, বিষয়, সঙ্গীত—সবক্ষেত্রেই তা হত।
বাংলা সিনেমার বেশিরভাগ পরিচালকদের শৈল্পিকভাবনা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে ভাবাতো। ওই পরিচালকদের শিল্পবোধের অভাব রবীন্দ্রনাথকে পীড়িত করেছিল। এই বিষয়ে নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির অনুজ মুরারী ভাদুড়িকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন তিনি। চিঠিতেই তিনি সিনেমার শিল্পরূপ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।বলেছিলেন, ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ। এই চলমান রূপের সৌন্দর্য ও মহিমা এমন করে পরিস্ফুট করা উচিত, যা কোনও বাক্যের সাহায্য ব্যতীত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে। সুরের চলমান ধারায় সঙ্গীত যেমন বিনা বাক্যেই আপন মাহাত্ম্য লাভ করতে পারে, তেমনই রূপের চলৎপ্রবাহ কেন একটা স্বতন্ত্র রসসৃষ্টিরূপে উন্মোচিত হবে না? হয় না কেবল সৃষ্টিকর্তার অভাব এবং অলস জনসাধারণের মূঢ়তায়, তারা আনন্দ পাবার অধিকারী নয় বলেই চমক পাবার নেশায় ডোবে। রবি ঠাকুরের এই ভাবনারই যেন প্রতিফলন দেখতে পেলাম ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের দীক্ষায় যেন দীক্ষিত হলেন সত্যজিৎ। রাবিন্দ্রিক শিল্পরূপের অত্যাধুনিক পথেই যেন সত্যজিৎ চালিত হলেন।

দেখবেন ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে দারিদ্রতা আছে। কিন্তু কখনওই তা দেখা বা ভাবের জগতে আচমকা আঘাত হানেনি। মানবিক বোধের সহ্যের শেষ সীমাও লঙ্ঘন করেনি। মানবিক রুচির দৈন্য প্রকাশ করেনি। শুধু ‘পথের পাঁচালী’ই বলি কেন, ওঁর সব ছবিতেই, সব কাজেই এই নান্দনিক বোধের প্রকাশ দেখতে পাই।
আরেকটা ছবির কথা প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়। ছবি ‘অশনি সংকেত’(১৯৭৩)। ছবির শুরুতেই প্রকৃতির আনন্দময়তার মধ্যে আকাশজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। সত্যজিৎ যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতাকে ধরতে বিভূতিভূষণের কাহিনিকে ধীরে ধীরে বিকশিত করেছেন। মূলত হাহাকারের তীব্রতাকে ধরতে তিনি রঙের ব্যবহার করেছেন। তাই তো গঙ্গা ও অনঙ্গ ছবির শেষ দৃশ্যে নিজস্ব নিরাপত্তা হারিয়ে মৃত্যু মিছিলের সামনে দাঁড়িয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘অপরাজিত’র মতো এই ছবিতেও সহজ সরল মানুষের দল সহজভাবে বাঁচার জন্যে পথে বেরিয়েছে।
আপনারা যারা ক্রিস্টোফার নোলান-এর ছবি দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ওঁর কাজ একটু অন্যরকম। সাধারণের বুঝতে একটু অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু একই সাথে এটাও বলতে হবে যে, ওঁর ছবিতে অসাধারণ গল্প শৈলী আর ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের মিশ্রণ তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। ভাবুন তো ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এর মতো এমন ছবি কটা হয়েছে? সত্যজিৎ রায়ের কাজ ও তাঁর ভাবনাও খুব সরল পথে হয়ত চলে না বা সাধারণের বুঝতে হয়ত কোথাও একটা অসুবিধে হয়, তথাপি বৌদ্ধিক ভাবনা ও শিক্ষিত দৃষ্টি নিক্ষেপে বোঝা যায়, তিনি আর পাঁচ জনের থেকে কোথায় আলাদা।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি কাহিনি নিয়ে সত্যজিৎ রায় তৈরি করলেন দুটি ছবি। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এই দুটি ছবির আসন পাকা হয়ে আছে। ‘জলসাঘর’(১৯৫৮)ও ‘অভিযান’(১৯৬২)।সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের কাহিনি ‘জলসাঘর’।
তারাশঙ্করের ‘জলসাঘর’ গল্পটি বাঙালি জমিদারদের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে লেখা। গল্পটি পরে সত্যজিৎ বাবুর খুব পছন্দ হয়ে যায়। চিত্রনাট্যও তৈরি করে ফেললেন। কিন্তু সমস্যা হল লকেশন নিয়ে। এ তো যে সে বাড়ি হলে চলবে না। ‘জলসাঘর’-এর আদলে কোনও রাজবাড়ি খুঁজে না পেলে শুটিং হবে কি করে? আর এ তো যে সে পরিচালক নয়! একটা সেট বানিয়ে, বা যেমন তেমন বা ওর কাছাকাছি কোনও বাড়িতেই চিত্রনাট্যের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে ছবিটা বানিয়ে ফেলবেন। তা তো হওয়ার নয়। পেতে গেলে তেমন কিছুই পেতে হবে। অবশেষে মুর্শিদাবাদের নিমতিতার অন্দরমহল দেখে পছন্দ করেছিলেন।

জীর্ণ প্রাসাদের শ্বেত পাথরের সিঁড়ি বেয়ে বৃদ্ধ জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের হাতের কারুকার্য মন্ডিত লাঠিটি গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে এক নব্য উঠতি বিত্তশালী মহিম গাঙ্গুলির বাড়ি থেকে ভেসে আসছে সারেঙ্গীর আওয়াজ।শেষে জলসাশেষে সবাই চলে যেতে একে একে যখন বাতি নিভছে আর অন্ধকার ঘনাচ্ছে তখন দেওয়াল জোড়া বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নায় বিশ্বম্ভর খুঁটিয়ে দেখছেন তাঁর শেষ হাসি হাসা মুখটা।তিনি নিঃস্ব হয়েছেন কিন্তু মহিম গাঙ্গুলির উঠতি বড়লোকি মেজাজকে ঢিট করেছেন।যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে পরিবর্তনশীল সমাজের বৈপরীত্যকে তুলে ধরার জন্য মুর্শিদাবাদের নিমতিতা জমিদারবাড়িকে বেছে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। এখানে সত্যজিৎ রায় ব্যতিক্রম।বাড়িটা বিরাট প্রাসাদের মতো।গঠনে দোতলা হলেও আকৃতিতে অনায়াসে এখনকার চারতলা বাড়ির সমান। বড় বড় থাম আর নক্সাকাটা জাফরি সমন্বিত পুরানো।
কেন সত্যজিৎ রায় এই বাড়ি বাঁচলেন। একসময় জাঁক-জমকপূর্ণ দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হতো এই জমিদার বাড়িতেই। প্রতি বছর উৎসবে যাত্রা থিয়েটারের আসর বসতো নিমতিতায়। কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পী ও সাহিত্যিকদের নিমন্ত্রণ থাকতো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসত পুজো দেখতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে তৎকালীন জমিদার মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ‘নিমতিতা হিন্দু থিয়েটার’ নামে এক নাটকের দল প্রতিষ্ঠা করেন। তৈরি করেন নাট্যমঞ্চও। নিমতিতা মঞ্চের প্রথম নাটক গিরিশচন্দ্রের ‘নল-দয়ময়ন্তী’।পরবর্তীকালে ‘শঙ্করাচার্য’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘চৈতন্যলীলা’. ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘সাজাহান’, ‘নর-নারায়ণ’, ‘ভীষ্ম’, ‘আলীবাবা’ প্রভৃতি প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে। এইসময় নিমতিতা বাংলার সংস্কৃতি ও নাট্যচর্চার এক নতুন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বাড়িটির উঠোনে প্রবেশ করতেই বনেদিয়ানার ছবি যেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে৷ কানে ভেসে আসে শঙ্খধ্বনি, উৎসব, পার্বণে লাল পেড়ে শাড়ি পরা রমণীদের কলকাকলি, আরামকেদারায় বসে রাশভারি গলায় গৃহকর্তার হুকুম জারি- সব, সব কিছু৷ কানে ভেসে এল সারেঙ্গীর আওয়াজ৷ চারিদিকে যেন হৈ হৈ রব৷পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে নিমেষের মধ্যে সে দৃশ্য মিলিয়ে গিয়ে সামনে পড়ে রইল একরাশ ধুলো আর ঝুলে ভরা বারান্দা৷ ঝকঝকে, সাজানো আসবাবপত্রগুলো মুহূর্তের মধ্যে কোথাও যেন উবে গেল৷
এক সময় অর্থাৎ গৌরসুন্দর চৌধুরীর সময় এই জমিদার বাড়িরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল৷ ইটালিয়ান ধাঁচে তৈরী এই বাড়ির ভিতর একসময় পাঁচটি উঠোন, দেড় শতাধিক কক্ষ, নাট মঞ্চ, ঠাকুর দালান ছিল। এখন বাড়িটা জনমানবশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একতলায় বিরাট বিরাট ফোকরগুলো দিয়ে বাইরের ঝাপসা আলো ভেতরে এসে পড়ে। সেদিকে তাকালে মনে হয়, কারা যেন ঘরগুলোর মধ্যে ওঁত পেতে বসে আছে যেকোনও মুহুর্তে তারা ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। ভাবতেও অবাক লাগে এক সময় কত প্রতিথযশা শিল্পীর পদধুলি পড়েছে এই বাড়িতে।গঙ্গাপদ বসু (জলসাঘর ছবিতে জমিদারের প্রতিবেশী মহিম গাঙ্গুলী), বেগম আখতার, উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানদের। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, কাজী নজরুল ইসলাম, অন্নদাশঙ্কর রায়, লীলা মজুমদারও এই বাড়িতে এসেছিলেন। নাচমহলে ঝাড় বাতিটি রাতটাকে দিন করত এক সময়, বাঈদের পায়ের নূপুর রনিত হত, আতরের সুগন্ধে চারদিক ম ম করত। রঙিন জলের ফোয়ারা উড়ত। এমন বাড়িই বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারের যে পছন্দ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিষয়টা জানতে পেরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ফোনেই সত্যজিৎ রায়কে বলেছিলেন, “আরে অদ্ভুত ব্যাপার। আমি নিজে নিমতিতায় কখনও যাইনি। কিন্তু বাঙালি জমিদারদের এক ইতিহাসে চৌধুরীদের কাহিনী পড়েছি। আমার গল্পের মূল চরিত্র তো গান-বাজনা পাগল ওই উপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীকে নিয়েই।”
এমনই দূরদৃষ্টি ছিল পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে ‘অভিযান’ ছবির মূলে আছে ট্যাক্সি চালকের দুঃসাহসিক অভিযান ও তার পরিণতি। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে বিভিন্ন পেশার পুরুষ নারীর প্রসঙ্গ। তবুও প্রতীকী ব্যাপারটা যেন ছবি দেখার শেষেও মনে গেঁথে থাকে। নরসিংহের ক্রাইসলার গাড়ি যেন রূপান্তরিত হয়েছে চরিত্রে, মানবিক সত্ত্বায়। সত্যজিৎ রায় কতটা সেন্স অব হিউমার ছিলেন, সেই কথা বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের দীর্ঘ দিনের সাথি, চিত্রগ্রাহক সৌমেন্দু রায় বলছেন, ‘‘অভিযান’ ছবির শ্যুটিং চলছে। আহত নরসিং মানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে হাওয়া করছেন ওয়াহিদা রহমান। হঠাৎ এক ফালি চুল ওয়াহিদার চোখ ঢেকে দিল। মানিকদা আমাকেই বললেন ওঁর মুখ থেকে চুল সরিয়ে দিতে। আমি সেটা করতেই মানিকদা ফ্লোরের বাকিদের উদ্দেশে বললেন, ‘রায়কে একটা চান্স দিলাম!’
ফ্লোরে ছবির কাজ এগোতে কেউ যদি সাহায্য করেন, তাহলে সেই মানুষটি যেন মানিকদার কাছে অন্ধের যষ্টির মতো হয়ে উঠতেন।’ অন্যকেও যেমন গুরুত্ব নিতে জানতেন, ঠিক তেমনই নিজেও সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতেন না।
আর তিনি তো জহুরি ছিলেন। কোথায় কোনটা লাগবে, কোন চরিত্রে কাকে মানাবে, এমনটা ওঁর থেকে আর কেইবা ভালো বুঝতো। ‘পরশপাথর’(১৯৫৭) ছবির মূল চরিত্র বাছলেন তুলসি চক্রবর্তীকে। উনি জানতেন তুলসিবাবু বাংলা ছবিতে উপেক্ষিত অভিনেতা হলেও উনি কত বড় ক্ষমতাশালি অভিনেতা ছিলেন। তুলসি বাবুও সে সুযোগ পেয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি কত বড় অভিনেতা। আপনারা দেখুন, সত্যজিৎ রায় ছবিকে কীভাবে ভাবতেন! কী অপূর্ব প্রয়োগ দক্ষতা! এই ‘পরশপাথর’ ছবিতে সত্যজিৎ তাঁর বাবার ননসেন্স ছড়াকে সুন্দরভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যার ফলে ছবির প্রধান চরিত্র পরেশবাবুর বলা এই ছড়াটি প্রবাদের মতো হয়ে গেছে...
“হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইট পাটকেল চিৎ পটাং
ধর্মতলা কর্মখালি
মুস্কিল আসান উড়েমালী।”
এদেশে সংস্কৃতি যে টাকা দিয়ে কেনা যায়, সেটা সত্যজিৎ রায় ব্যঙ্গের সঙ্গে পরিবেশন করেছেন। তাই এই ছবিতে বঙ্গ সংস্কৃতি ধারার প্রসঙ্গ শ্লেষে ব্যঞ্জিত।

পরশুরামের কাহিনির চিত্রায়ণ ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’(১৯৬৫)ছবি। মূলত ‘মহাপুরুষ’, অংশেই পরশুরামের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তথ্যচিত্রের ভঙ্গিতে সত্যজিৎ রায় এখানে প্রেমের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি বিরিঞ্চি বাবার আসল রূপও ধরা পড়েছে। তবে সবটাই যেন সাদামাটা ভাবে। ‘কাপুরুষ’ অংশটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাহিনি। এখানে তিনটি চরিত্রের জটিলতা ছবিটিকে অসাধারণ করেছে।
‘দেবী’(১৯৫০)ছবির কাহিনি সত্যজিৎ নিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। নিমতিতার রাজবাড়িতে এই ছবিরও শুটিং হয়েছিল। সত্যজিৎ এখানে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন।শৈল্পিক ভাষায়। ছবির প্রয়োজনে তিনি এখানে নিজের লেখা একটি গানও ব্যবহার করেছেন ‘এ বারে তোরে চিনেছি মা।’ ‘দেবী’ প্রসঙ্গে কথায় কথায় রায়দা বলেছিলেন, ‘‘দেবী’তে একটা দৃশ্যে ছবিদাকে পড়ে যেতে হবে। ছবিদার হাঁপানি ছিল। তাই ওইভাবে শট দিতে তাঁর আপত্তি ছিল। তিনি করলেন কী, শ্যুটিংয়ের দিন গোটা বুকে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে ফ্লোরে চলে এলেন! বললেন, ‘মিস্টার রায়, বুঝতেই পারছেন আমি তো এই শট দিতে পারব না।’ মানিকদা ছিলেন বুদ্ধিমান। বুঝতেই পেরেছিলেন ছবিদা মজা করছেন। তখন ছবিদাকে সুব্রতদা বললেন, ‘আপনি যতটা পারেন শটটা দিন, আমি ঠিক শট কেটে নেব।’ কিন্তু মানিকদাও নাছোড়বান্দা। ঠিক বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবস্থা করলেন। তারপর দুটো শটে ওকে হয়ে গেল। ছবিদা হেসে মানিকদাকে বললেন, ‘আমি নিজেকে চালাক ভাবতাম। কিন্তু আপনি যে আমার থেকে আরও বড় চালাক সেটা আজকে বুঝতে পারলাম।’
এই আমাদের সত্যজিৎ...।

‘তিনকন্যা’(১৯৬১) ছবিতে সত্যজিৎ রবীন্দ্র ভাবনার প্রতিফলন ঘটালেন।‘পোষ্টমাস্টার’, ‘মণিহারা’ ও ‘সমাপ্তি’র তিন নারী রতন, মণিমালিকা আর মৃন্ময়ীই তিন কন্যা। ‘পোষ্টমাস্টার’ পর্বে তো ছবির প্রয়োজনে একটি পাগল চরিত্র নিয়ে এসেছেন সত্যজিৎ রায়।প্রথম থেকেই ছবিতে রতনের সঙ্গে বাবুর সম্পর্কের স্বরূপ ইঙ্গিত করেছেন তিনি।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিতে সে যেন দাসী হয়ে গেছে। মণিহারার মণিমালাকে আপাত দৃষ্টিতে অলংকারলোভী মনে হলেও তার মধ্যে নান্দনিক বোধ আছে। সমাপ্তির মৃন্ময়ী তো নারীত্বের মধুর বিকাশ। কিশোরীর বোধ থেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসেও চঞ্চল থেকে মুক্ত হতে পারেনি সে। শেষে বিরহই তার মনে মধুরতা এনে দিয়েছে।
রবীন্দ্র কাহিনি অবলম্বনে সত্যজিতের আরও একটি ছবি ‘চারুলতা’(১৯৬৪)। ‘নষ্টনীড়’ গল্পে দেখা গেছে চারুর জীবন তৃষ্ণাকে আড়ালেই রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সত্যজিৎ তাকে সকলের সামনে তুলে ধরলেন। গল্পের শুরুতে দেখা গেছে চারু স্বামী সুখ বঞ্চিত, অবহেলিত নারী। ভূপতি কখনও বোঝেনি ভালোবাসারও একটা আলাদা দিক আছে। তাই চারুর কাছে অমল এত প্রিয়। সত্যজিৎ সাহিত্যের এইসব জায়গায় ভাষা দিয়েছেন। ফলত চারু ও অমলের সম্পর্ক দর্শকরা সরাসরি দেখেছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বোঝাতে সত্যজিত একটি নৈশ দৃশ্য এনেছেন। আবার চারু ও অমলের মনের মিল দেখানোর জন্যেই এসেছে বঙ্কিমপ্রীতি(আনন্দমঠ প্রসঙ্গ)। রবীন্দ্রনাথের মতো সত্যজিৎও ভূপতিকে চারু অমল সম্পর্কের এজেন্ট বানিয়েছেন।নারী চরিত্রের শৈশব কৈশোর, তারুণ্য সবই চারুর মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ। প্রেম, বিশ্বাস, নিষ্ঠুরতা, হতাশা সব মিলেমিশে সঙ্গীতের মতো হয়ে গেছে ‘চারুলতা’য়। সত্যজিতের ফিল্মি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের চারুলতা অনেক বেশি জীবন্ত হয়েছে। তাই বোধহয় ‘চারুলতা’ ছবির বিজ্ঞাপনে সত্যজিৎ লে-আউট করে লিখেছিলেন— ‘সত্যজিৎ রায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি’।
রবীন্দ্র কাহিনির আরও একটি সংযোজন ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৪)। ছবিটি স্বদেশী ভাবনার উপরেই চিত্রায়িত। স্বদেশী আন্দোলনের নেতিবাচক দিককে কোনওদিনই সমর্থন করেননি তিনি। ফলে ছবিটির শুরুই হয়েছে আগুন দিয়ে। শেষে বিমলার সিঁদুরের টিপ মুছে গেছে কপাল থেকে, রঙিন শাড়ি পাল্টে হয়েছে সাদা থান। নিখিলেশ কিন্তু তত্ত্ব ঝেড়ে ফেলে মানুষের মধ্যে থেকেই নিজেকে পার করেছে। সত্যজিৎ উপন্যাসকে টপকে নিখিলেশ– বিমলার ঘরে সন্দীপকে নিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ যুগের প্রয়োজনে নিয়ম ভেঙেছে সন্দীপ। তাই ঘরের বউকে বাইরে বের করিয়ে সত্যজিৎ ছবিটিরও নামকরণ করেছেন ‘ঘরে-বাইরে’।
যেখানে যা সুন্দর, তার সবটাতেই আছেন সত্যজিৎ। মিষ্টি ছোট গল্পকার ননামি মানে নরেন্দ্রনাথ মিত্র। ওঁর ক্লাসিক কাহিনি নিয়ে তৈরি সত্যজিতের সেই বিখ্যাত ছবি ‘মহানগর’(১৯৬৩)। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ মূল গল্প। আপনারা যারা মূল গল্পটি পড়েছেন তাঁরা জানেন, গল্পের মূল কাহিনি থেকে অনেকটাই সরে ছবি বানিয়েছিলেন তিনি। গল্পে সুব্রত(স্বামী) ছিল প্রধান চরিত্র। কিন্তু সত্যজিৎ করলেন আরতিকে (স্ত্রী)। ছবিটি কিন্তু মোটেও নারীমুক্তির নয়। বরঞ্চ বাড়ির সকলকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে চলার। তাই একটি সংকটেই শেষ পর্যন্ত আরতি সুব্রত পরস্পর পরস্পরের কাছে এসেছে। মহানগরের(কলকাতা) রাস্তায় দুজনেই বেরিয়েছে কাজের সন্ধানে।“গণশত্রু’র ডাক্তারের মতো আরতির ঋজুতা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। সত্যজিৎ রায় অসম্ভব নিয়মানুবর্তিতায় জীবন কাটিয়েছেন। চিরকাল নিজেও ঋজু থেকেছেন। তাই তাঁর ভাবনা, তাঁর কাজ অন্যরকম। শিক্ষনীয়। আদরের। এবং অবশ্যই সেরার সেরা।

‘চিড়িয়াখানা’(১৯৫৭) ছবিতে প্রচলিত ভাবনা থেকে সরে এলেন সত্যজিৎ রায়।শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা কাহিনি। ব্যোমকেশ বক্সির রহস্য উদঘাটন। এই ছবিতে সত্যজিতের নিজের লেখা একটা গান ‘ভালোবাসার তুমি কি জানো’ ব্যবহার করেছেন তিনি।
নিজের লেখা দুটো গোয়েন্দা কাহিনিতে কিন্তু সত্যজিৎ রায় আরও বেশি সার্থক। ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৮)। দুটি ছবির কাহিনিই গোয়েন্দা গল্প আকারে সন্দেশ-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ফেলু মিত্তির ব্যোমকেশের সার্থক উত্তরসুরি হলেও ফেলুদা জনপ্রিয়তার নিরিখে অনেকটা এগিয়ে। এই ছবি দুটিতে ফেলুদা ব্যোমকেশকে ছাড়িয়ে গেছে কোথায়! সোনার কেল্লা ছবিতে জাতিস্মর তত্ত্বকে টপকে মুখ্য হয়েছে গোয়েন্দার অনুসন্ধান। লালমোহনবাবু অনবদ্য সৃষ্টি সত্যজিৎ রায়ের। এই চরিত্রটি আলাদা মাত্রা এনেছে ছবিতে। একই সঙ্গে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে তো হেঁয়ালি, চুরি, গোয়েন্দাগিরি, খুন-খারাপি সব একাকার হয়ে গেছে। ভারতীয় সংস্কৃতি বিকৃত হচ্ছে। এই ব্যাপারটা সত্যজিৎ একেবারেই মেনে নেননি। তাই ধর্মের আড়ালে গড়ে ওঠা পাপকে ফেলুদা শাস্তি দিয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের একই ঘরানার ছবি মূলত তিনটি।’অরণ্যের দিনরাত্রি’(১৯৭০),’প্রতিদ্বন্দ্বী’(১৯৭০) ও ‘সীমাবদ্ধ ’ (১৯৭১)। প্রথম দুটির কাহিনীকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শেষেরটির শংকর। তিনটে ছবিই সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর নান্দনিক রূপ।
সমসাময়িক জীবন যন্ত্রণা, বিশেষ করে যুবক-যুবতিকে যেভাবে দ্বিধায় ফেলে দেয় তারই বলিষ্ঠ চিত্ররূপ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। উপন্যাস থেকে অনেকটাই সরে এসেছিলেন সত্যজিৎ সিনেমা তৈরির কারণে।সাহিত্য একটা ভুবন। কিন্ত সিনেমা, একেবারে অন্য আরেকটি ভুবন।গল্প চলচ্চিত্রের আধার হতে পারে! এর বেশি কিছু নয়। ভাবনা, দর্শন স্রষ্টা নিজের মতো করে চালিত করবেন। শিল্পের স্বার্থে। যিনি এই মিশেলটা ঠিক ঠিক করে করতে পারেন, তিনিই তো বড় শিল্পী। শ্রেষ্ঠ চিন্তক। এবং সেরার সেরা। উপন্যাসে যুবকদের নিরুদ্দেশ যাত্রাকে সত্যজিৎ চালিত করেছেন অভিষ্ট পথে। আসলে সত্যজিৎ নিজের মেধা দিয়ে সকলকে নিয়ে কাজ করতে ভালবাসতেন। ইউনিটে সবাইকে তার তার মতো করে স্বাধীনতা দিতেন। সৌমেন্দু রায় গল্প করছিলেন, ‘ইউনিটকে স্বাধীনতা দিতেও তাঁর জুড়ি ছিল না। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। পালামৌতে তখন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শ্যুটিং চলছে। প্যাকআপের পর সন্ধ্যায় সৌমিত্র, শুভেন্দু, রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জরা সাধারণত একসঙ্গে আড্ডা মারতেন। একটু আধটু পানাহারও চলত। একদিন সবাই সেরকম আড্ডায় মেতেছেন। একদিন সেখানে হঠাৎই মানিকদা এসে হাজির। সবাই ভয়ে গ্লাস নামিয়ে রেখেছেন। কিন্তু রবি ঘোষ ছিলেন মজার মানুষ। টুক করে গ্লাস তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘মানিকদা, আমরা একটু খাচ্ছি।’ মানিকদা হেসে বললেন, ‘বেশ। খাও। আমি তাহলে যাচ্ছি। তবে কাল কিন্তু এখানেই শ্যুটিং। ভুলে যেও না।’

মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন মানিকদা।
শ্যুটিং প্যাকআপের পরেও মানিকদার সঙ্গে প্রচুর আড্ডা হতো। ছবি নিয়ে কথা হতো। ভালো কোনও বিদেশি ছবি দেখলেই আমাদের সেটা দেখতে বলতেন। আউটডোরে রাতে শ্যুটিংয়ের পর দীর্ঘক্ষণ আমরা একসঙ্গে তাস খেলতাম। কিন্তু লক্ষ করতাম, একটা সময় পর উনি ঠিক উঠে চলে যেতেন। তাড়াতাড়ি ডিনার করে ঘরে গিয়ে চিত্রনাট্যে বুঁদ হয়ে থাকতেন।’ আসলে কতটুকু চলতে হয়, কীভাবে চলতে হয়, তা সত্যজিৎ রায় বেশ রপ্ত করেছিলেন।
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সিদ্ধার্থর লড়ে যাওয়ার গল্প। সত্যজিৎ চিরদিনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু কখনওই ধ্বংসাত্মক দিককে গ্রহণ করেননি। তার ইতিবাচক মন নকশাল আন্দোলনের ভাবাবেগকে স্পর্শ করলেও সত্যজিতের অপূর্ব মুন্সিয়ানায় কলকাতার সবকিছুই যেন রূপান্তরিত হয়েছে। সিদ্ধার্থর প্রতিদ্বন্দ্বী। আর এখানেই ছবিটির সার্থকতা। প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপরীত মেরু যেন সীমাবদ্ধ। কারণ এই ছবির নায়ক শ্যামলেন্দু জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্যে নিজের আদর্শকেও জলাঞ্জলি দিতে চেয়েছে। ন্যায়নীতি, আদর্শ বা আন্তরিকতা নয়, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মানুষের জীবন ভাবনা ছিল চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই শেষ দৃশ্যে শ্যামলেন্দু কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে সিঁড়ি উপরে ওঠার সময় একমাত্র সঙ্গী হয়েছে তারই পায়ের শব্দ। কী সুন্দর ব্যালান্সড কাজ। দুটি পরস্পর ভিন্নধর্মী ভাবনার ছবি, দর্শনের ছবি! অথচ কী সুন্দর ভাবে পরিচালনা করলেন। দুটি ছবিই স্বতন্ত্রে সেরা।
এই পর্বের আরও একটি ছবি ‘জনঅরণ্য’(১৯৭৫)। শংকরের কাহিনি নিয়ে সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি। এখানে যেন সত্যজিৎ নির্মম সমালোচকের ভূমিকায়। ক্ষয়ে যাওয়া কলকাতার নগর জীবনের ছবিকে তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করেছেন। সামনে রেখেছেন সোমনাথকে। এই ছবিতে দুর্ভিক্ষ, হাহাকার, উদ্বাস্তু সবই আছে। কিন্তু সত্যজিৎ দেখাতে চাইলেন কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে আমরা অসাঢ় হয়ে যাচ্ছি, তা ক্রমশই আমাদের জীবনে ভয়াবহতাই নিয়ে আসছে। সত্যজিৎ রায় ছবিতে যেন তারই প্রতিবাদ করলেন। এরই সঙ্গে দুটো ছবি করে নিলেন সত্যজিৎ। একটি মুন্সি প্রেমচাঁদের লেখা ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ী’ (১৯৭৭) এবং অন্যটি ইবসনের কাহিনি অবলম্বনে ‘গণশত্রু’ (১৯৮৯)| প্রথম ছবিটিতে অযোধ্যার ক্রমপতনকে ছবিতে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তাতে সত্যজিৎ ইতিহাসকে চেপে গেছেন বলেই সমালোচকরা মনে করেছেন। এই ছবিতে রাজ বীরত্বের থেকে পুরনো লখনউয়ের ছবি, চমৎকার মনে হয়েছে। দ্বিতীয় ছবিতে তিনি নিপুণভাবে ইবসনের বিদেশিয়ানা খসিয়ে দেশি ইমেজ তুলে ধরেছেন। কারণ মন্দিরের চরণামৃত খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ব্যাপারটা পশ্চিমবাংলারই কোনও গ্রামের ঘটনা। মনে হয়েছে সততার সঙ্গে নোংরা রাজনীতির দ্বন্দ্ব এই ছবিতে স্বচ্ছ। মানবিক অবক্ষয়, ধর্মীয় সংস্কার, বিজ্ঞান বিমুখতা সবকিছুতেই শেষ পর্যন্ত জয়ী ডাক্তার গুপ্ত। আসলে সত্যজিৎ স্বয়ং।

‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’(১৯৬৯) এবং ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০)র প্রতিটি ছবিই যেন দর্শকের মনে গাঁথা হয়ে থাকবে। প্রথমটির কাহিনিকার ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। পরেরটি সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। প্রথম ছবিতে সত্যজিৎ অনেক নতুন চরিত্র এনেছেন। আমলকির রাজা, হাল্লার মন্ত্রী, বরফি, ভুতের রাজা প্রমুখ। গুপী ও বাঘা তো এখানে নতুন রূপে উপস্থাপিত। ছবিতে গানের অসাধারণ ব্যবহার সমসাময়িক সমাজজীবনে নতুন মাত্রা এনেছে। সত্যজিৎ এখানে দশটা গান ব্যবহার করেছেন। সবই তাঁর নিজের লেখা। ফলে ভূতে-রূপে-সঙ্গীতে অসাধারণ ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। হীরক রাজার দেশে ছবিতে রাজা সপার্ষদ প্রমুখের অন্তরালে হীরক রাজার শয়তানি ধরা পড়েছে। কারণ তার গান,সমালোচনা, শিক্ষা, কৃষক, শ্রমিক শিল্পী শিক্ষক কাউকেই সে পছন্দ করে না। যে তার স্তুতি করে তাকেই সে ভালোবাসে। আসলে সত্যজিৎ এর, একটা সময়োপযোগী পলিটিক্যাল রূপকেই তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে উদয়ন পণ্ডিতের বিদ্রোহ ও জয়লাভকে দেখিয়েছেন। সত্যজিতের ইতিবাচক ভাবনারই ফল। বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রাখা। সত্যজিৎ বারোটা গান ব্যবহার করেছেন। সবই তার নিজের লেখা। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে তো বাঙালির জয়যাত্রার আবহসঙ্গীত।
নিজের কাহিনি নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘কাঞ্চনজঙঘা’(১৯৬২)। দার্জিলিংয়ের প্রকৃতিকে ভালোবাসার ছবি। পরিচ্ছন্ন ছিমছাম ছবি ‘কাঞ্চনজঙঘা’। লাবণ্যের লিপে ‘এ পরবাসে রবে কে’র প্রয়োগ সত্যি আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। নিজের সত্তা আবিষ্কারের মধ্যেই এই ছবির মহত্ত্ব ধরা পড়েছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার পরে নিজের কাহিনি নিয়ে সত্যজিতের পরের ছবি ‘নায়ক’(১৯৬৬)। অরিন্দম মুখার্জির বিখ্যাত চিত্রতারকা হয়ে যাওয়া ও তার থেকে মুক্তির সন্ধানই ছবির মূল সুর। সাংবাদিক অদিতিই এই ছবিতে অরিন্দমকে বাস্তবের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে। অদিতির সঙ্গে অনেকটাই যেন মিল আছে ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির টুটুলের। শুধু অরিন্দম নয়, মি.বোস, প্রমীলা বসুর চরিত্রের অভাববোধও ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ। ছবির মধ্যে একমাত্র অদিতিই আলাদা। তাই সহজেই বিভিন্ন স্টেশনে নেমে সে আর কারোর বিবেক জাগাতে মিশে গেছে ভিড়ে। অরিন্দম শুধুই চেয়ে থেকেছে।

এক বিদেশি সমালোচক একসময় সত্যজিৎকে বলেছিলেন বৃক্ষ। সত্যি সত্যজিৎ রায় ছিলেন বনস্পতি। তাঁর ছবির টেকনিশিয়ান, শিল্পীরা শাখা-প্রশাখা। সত্যজিৎ রায় শেষের দিকে তৈরি করলেন ‘শাখা–প্রশাখা’(১৯৯০)। পরিবার, মূল্যবোধ নিয়ে গড়া ছবির মধ্যে সেই অসাধারণত্ব না থাকলেও একটা নিপাট পরিচ্ছন্ন ছবি, সে বিষয় কোনও সন্দেহ নেই। মূল্যবোধের সংকট কিভাবে শাখায় শাখায় বিন্যস্ত, সত্যজিৎ যেন তারই মানবিক দলিল তৈরি করলেন। শেষ ছবি ‘আগন্তুক’(১৯৯১) তারই খানিক ছোঁয়া আছে। এটা সত্যজিতের নিজের লেখা গল্প অতিথির সার্থক চিত্ররূপ। সাহিত্যের ভাষা আর চলচ্চিত্রের ভাষা বোঝা যায়। অতিথির বাইরের জগতের আভাস ছবিতে সরাসরি দেখিয়েছেন সত্যজিৎ ‘অতিথি’তে। অপরিচিত আগন্তুককে (শেতলমামা) বিশেষ খারাপ ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু ছবিতে সে(মনোমোহন)সত্যিই মামা কি না, তার প্রমাণে জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে পরিবারের তরফ থেকে। সত্যজিৎ এই ছবিতে প্রথম দিকে সভ্য সমাজের নগ্নতাকে তুলে ধরলেও মানবিকতারই জয়গান করেছেন। নিজের সমস্ত টাকা-পয়সা ভাগ্নিকে দেওয়ার মধ্যেও রয়েছে আত্মিক বন্ধনের টান। আবার নতুন করে মামার নিরুদ্দেশ হওয়ার মধ্যেও রয়েছে দুরের হাতছানি, পথেই নিশ্চয়তা, বিশ্বমানবতার সন্ধান। ফিচার ছবির পাশাপাশি সত্যজিৎ পাঁচটি তথ্যচিত্র করেছেন। পাঁচটিরই চিত্রনাট্য পরিচালনা, সঙ্গীত ও ভাষ্যে তিনি নিজে। সেগুলি ‘রবীন্দ্রনাথ’(১৯৬১),“সিকিম”(১৯৭১), ইনার আই’ (১৯৭৪), ‘বালা’(১৯৭৬) ও ‘সুকুমার রায়’(১৯৮৭)| ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রে বিশ্বমানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথকেই ধরেছেন সত্যজিৎ। ‘সিকিম’ তথ্যচিত্রে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরার পাশাপাশি সত্যজিৎ কি সিকিমের অন্য কোনও অন্ধকার দিক তুলে ধরতে চেয়েছিলেন? ইনার আই তো বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন নিয়ে তৈরি। ‘বালা’ তথ্যচিত্র দক্ষিণী নৃত্যশিল্পী বালা সরস্বতীর নৃত্যশৈলীর ছবি। আর ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রে সুকুমারের জীবন ও শিল্পকর্ম বিশেষ স্থান পেয়েছে। এর পাশাপাশি সত্যজিৎ তিনটি দুরদর্শনের জন্য ছবি করেছেন। সেগুলি ‘টু’( ১৯৬৪), “পিকু”(১৯৮২)ও ‘সদগতি’ (১৯৮২)। প্রথম দুটির কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সত্যজিৎ স্বয়ং। ‘সদগতি’ মুন্সি প্রেমচাঁদের কাহিনি অবলম্বনে সত্যজিতের পরিচালনা ‘টু’ ছোটদের শৈশব বিষয়ক ছবি। ‘পিকু‘ ছবিতে বাবা–মায়ের প্রেমহীনতা এবং মায়ের সঙ্গে পরপুরুষের অবৈধ সম্পর্কের স্বরূপ ধরা পড়েছে। আর ‘সদগতি’ তো এক অন্ত্যজের শবদেহ সৎকারের কাহিনিরই প্রতিফলন।

এই আমাদের পরিচালক সত্যজিৎ রায়। আজ যদি পৃথিবীর সেরা দশ পরিচালকের নাম করি বা সেরা ছবির একটা তালিকা তৈরি করি তারমধ্যে নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায় থাকবেনই।
ধরুন এই মুহূর্তে পৃথিবীখ্যাত কয়েকটি ভালো ছবির নাম করি, যেমন ধরা যাক, স্টিভেন স্পিলবার্গ-এর ‘জস’, পিটার জ্যাকসন-এর ‘দ্য রিটার্ন অব দ্য কিং’, কোয়েন্টিন টারান্টিনোর ‘জ্যাঙ্গো আনচেইনড’, জেমস ক্যামেরন-এর ‘অ্যাভাটার’ মার্টিন স্করসেসের ‘রেজিং বুল’, রিচার্ড লিঙ্কলেটার-এর ‘হুডবয়’, ডেভিড ফিঞ্চার-এর ‘ফাইট ক্লাব’ উৎকর্ষতায় যে শীর্ষে অবস্থান করছে, সেখানে আমাদের সত্যজিৎ রায় ও তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ কিম্বা ‘জলসাঘর’ কি কোনও অংশে কম যায়। কিম্বা ‘হীরক রাজার দেশে’র মতো কটা ছবি আর তৈরি হয়েছে বলতে পারেন?
সম্পূর্ণ পড়তে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের অনলাইন সংস্করণ অথবা যেকোনো ম্যাগাজিন স্টলে যোগাযোগ করুন।
অনলাইন সংস্করণ সাবস্ক্রাইব করতে হলে ক্লিক করুন নীচের লিঙ্কেঃ
Comments