top of page
Search

রাঙিয়ে দিয়ে যাওযাও যাবার আগে...

আজ কৃষ্ণচুড়ার আবির মেখে আকাশও হোলি খেলছে। রঙে রাই কিশোরীর মন রঙিন। বাসন্তিক উত্তরীয় পরে শ্যাম কিশোরও যে তৈরি! শুরু হোক খেলা। সমীর চট্টোপাধ্যায়



ফাল্গুনী পূর্ণিমা মানে রং এর খেলা। পরস্পর পরস্পরের অঙ্গে আবির রাঙিয়ে আনন্দকে প্রকাশ করেন।

‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে, তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে, অশ্রুজলের করুণ রাগে ... মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে, তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও’

কিন্তু কেন এই উৎসব?

বিভিন্ন পুরণাদিতে ভিন্ন ভিন্নভাবে এই দোল উৎসবের কথা আছে।

বাংলা ব্যাকরণে ‘দোল’ শব্দের বিশেষ্য দোলন বা দোলানো ব্যবহার করা হইয়াছে।

হরিভক্তি গ্রন্থে শ্রীল সনাতন গোস্বামী পাদ দোল উৎসব প্রসঙ্গে এভাবেই বর্ণনা করেছেন।

চৈত্রে সিতৈকাদশ্যাঞ্চ দক্ষিণাভিমুখং প্রভুম্।

দোলয়া দোলং কুর্য্যাদ্গীতনৃত্যাদিনোৎসবম॥

অর্থাৎ চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষের একাদশীতে প্রভুকে দক্ষিণনাভিমুখে দোলায় বসিয়ে দোলাবে এবং গীত, নৃত্য বাদ্য সহ আনন্দ উৎসব করবে। এখানে ‘প্রভু’ শব্দকে পরমব্রহ্ম ভগবানকে বোঝানো হয়েছে। যার অনেক নাম। যেমন কৃষ্ণ, গোবিন্দ, মধুসুদন, জগন্নাথ। সাধারণ ভক্তগণ দোল উৎসব একদিনের উৎসব পালন করলেও বৈষ্ণব ভক্তগণ সারা মাস ধরে পালন করে থাকেন। ‘হরিভক্তি বিলাস’ বইতেই পাচ্ছি,

যৎ ফাল্গুনস্য রাকাদাবুত্তরা ফল্গুণী যদা।

তদা দোলাৎসবঃ কার্যস্ত্যচ্চ শ্রীপুরুষোত্তমে ॥

ফাল্গুন মাসের রাকা পূর্ণিমাতে যখন উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্র হয় তখন দোল উৎসব পালন হয়। দোল ও হোলি কি একই উৎসব? দোল উৎসবের সঙ্গে হলি উৎসবের সম্পর্ক কী? আসলে দোল ও হলি উৎসব পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। হরিভক্তি বিলাস-এ দোল উৎসব বিধি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, উৎসবার্থে বিশেষ নৈবেদ্য অর্পণ করবে। মহা আরতী করে শ্রীভগবানের উপরে ভাগে ভাগে বিচিত্র গন্ধ, চন্দন, আবিরাদি চুর্ণ নিক্ষেপ করবে। ওই সকল গন্ধাদি দ্রব্য দ্বারা বৈষ্ণবগণকে সন্তুষ্ট করে তাদের সঙ্গে নাচ ও গানে গানে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে প্রার্থনা সেরে দোল মঞ্চে নিয়ে গিয়ে সাবধানভাবে অলংকৃত উত্তম দোলায় উঠিয়ে দেবে।

প্রকৃতপক্ষে এই দোল বা হলি উৎসব কেবলমাত্র পরম প্রভু শ্রীভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই। আজ কেবল রং খেলা উৎসব পরিণত হয়েছে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বর্ণনা করেছেন,

‘আত্ম ইন্দ্রিয় প্রীতি বাঞ্চা তারে বলি কাম।

কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি বাঞ্চা ধরে প্রেম নাম।’



১৪০৭ শকাব্দে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে, ৮৯১ বঙ্গাব্দে, ফাল্গুন মাসের দোলপূর্ণিমার রাত্রির প্রথম মুহূর্তের শুভক্ষণে সন্ধ্যেবেলা চন্দ্র গ্রহণের জন্য দলে দলে নবদ্বীপবাসী হরিধ্বনি করতে করতে গঙ্গাস্নানে চলেছেন। তখন নবদ্বীপ আলো করিয়া শ্রীচৈতন্যর উদয় হয়েছে। তখন দৈবক্রমে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ সমস্ত দিক অন্ধকার আবৃত করেছে। ঠিক তখনই গৌরাঙ্গের আবির্ভাব হয়েছে। মহাজন গাইছেন,

‘নদীয়া উদয়গিরি পূর্ণচন্দ্র গৌর হরি,

কৃপা করি হইল উদয়।’

শ্রীচৈতন্য যিনি কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের প্রকৃত নায়ক, যিনি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আরাধ্য ও পথ প্রদর্শক তার আবির্ভাব তিথিই শ্রীশ্রী গৌরপূর্ণিমা যা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ সাড়ম্বরে উদযাপন করে থাকে।

বসন্তোৎসব সারা ভারতের উৎসব–উত্তর ভারতে ‘হোলি’, বিহার অঞ্চলে ‘ফাগুয়া’ ও বাংলায় ‘দোলযাত্রা’৷ আদিতে এই উৎসব ছিল মূলতঃ আর্যদের৷ প্রাচীন আর্যদের বাসভূমি ছিল মধ্য এশিয়ায়৷ এই অঞ্চলটা ছিল ভীষণ ঠাণ্ডা৷ সারা শীতকাল কেবল বরফ পড়তো। এটা ছিল আর্যদের দুঃসহ কষ্টের কাল৷ নিদারুণ ঠাণ্ডায় মানুষ জবু–থবু হয়ে মরার মত পড়ে থাকতো। কোনও কাজকর্ম করতে পারতো না৷ এই শীতকালটা যখন বিদায় নিত, আর্যরা তখন আনন্দে উৎসবে মেতে উঠতো৷ ‘উৎ’ মানে আনন্দে লাফিয়ে ওঠা আর ‘সব’ মানে ‘জন্মগ্রহণ করা’৷ আক্ষরিক অর্থেই বসন্তের আগমনে আর্যরা প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠতো। হৈ–হুল্লোড় ও কর্মচাঞ্চল্যে মেতে উঠতো৷

বসন্ত ঋতু আর্যদের উৎসবের ঋতু৷ এই উৎসবে তারা ভেড়াকে মনে করতো শীতের প্রতিনিধি (কারণ ভেড়ার লোম থেকেই হত শীতের কম্বল)। আর ভেড়ার পিঠে জবু–থবু হয়ে বসে থাকা বুড়ো–বুড়িকে মনে করতো তাদের দুঃসহ শীতের প্রতীক৷ তাই উৎসবের শুরুতেই পূর্ণিমার পূর্ব রাতে বুড়ো–বুড়িকে পুড়িয়ে দিয়ে তারা বলত, শীতকে পুড়িয়ে দিলুম৷ পরদিন পূর্ণিমা তিথিতে শুরু হত বসন্ত ঋতু। আর একে ঘিরে আর্যদের ‘বসন্তোৎসব’৷

যখন উত্তর–গোলার্ধে পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্র অথবা উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্র অবস্থান করছে, সেই সময় পূর্ণিমা তিথি পড়লে, সেই চান্দ্রমাসটার নাম রাখা হয় ‘ফাল্গুন’৷ শুধু তাই-ই নয়, সৌর মাসটারও নাম হয় ‘ফাল্গুন’৷ তাই বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে বসন্তোৎসবের নাম ‘ফাগুয়া’৷ উত্তর ভারতে বিশেষ করে পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে এই উৎসবকেই বলে ‘হোলি’ উৎসব৷

এই ‘হোলি’ নামের নেপথ্যে আছে সেই পৌরাণিক কাহিনী৷ যা আপনাদের অনেকেরই জানা। হিরণ্যকশিপু নামে সেই রাজা৷ তার বোন হোলিকা৷ নর–রাক্ষসী৷ পূর্ণিমার আগের রাতে অর্থাৎ চতুর্দশীর রাতে লোকেরা হোলিকা নর–রাক্ষসীকে পুড়িয়ে মেরেছিল৷ এই উপলক্ষ্যে সেদিন তারা আনন্দে যে উৎসব করেছিল তার নাম ‘হোলিকা–দহন’ উৎসব৷ সেই থেকে এই উৎসব চলে আসছে ‘হোলি উৎসব’ নামে৷ সারা ভারতেই এখন বসন্তোৎসবের সূচনা হয় আগের দিন রাতে খড়–পাতা দিয়ে গড়া দৈত্যের প্রতীক অথবা বুড়ীর ঘর পোড়ানোর মধ্য দিয়ে৷ এটা সেই মূল আর্য রীতিরই সংস্করণ৷ বাঙলায় একেই বলে ‘চাঁচর’। গ্রাম বাঙলায় বলে ‘ন্যাড়াপোড়া’৷

বাঙলায় এই উৎসবের সূচনা করেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রায় ৫০০ বছর আগে৷ তিনি বৃন্দাবন পরিক্রমাকালে ওখানে ‘হোলি উৎসব’ দেখেন৷ মহাপ্রভু বাঙলায় এসে বিধান দিলেন, এ দিনটায় ভক্তেরা কৃষ্ণমন্দিরে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে রঙ–আবির দেবে৷ তারপর সেই রঙ–আবির নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে খেলবে৷ আর যে যাকে রঙ দেবে, সে তাকে মালপো খাওয়াতে বাধ্য থাকবে৷ এ ভাবেই মহাপ্রভু বাঙলায় ‘শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা’ উৎসব প্রবর্তন করেছিলেন৷ ‘দোলযাত্রা’ কথাটার তাৎপর্য হ’ল, শীত চলে গেছে, মানুষ আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে। মনে নানান চিন্তা, নানান ভাবনা আসছে। নূতন নূতন কল্পনা জাগছে৷ শ্রীকৃষ্ণের কথা ভাবতে গিয়ে মন আনন্দে ভরে উঠছে।

‘আইস হরি, বংশীধারী খেলব হোলি তোমার সনে’। সে ভাবনায় মনে দোলা লেগেছে। মন আন্দোলিত হচ্ছে৷ ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল, স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল। দ্বার খোল, দ্বার খোল’।

ভক্তের মনও দুলছে, তা তো নয়, ভক্তের মনের দোলা ভক্তের প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের মনকেও দুলিয়ে দিচ্ছে। ‘আজ হোলি খেলব শ্যাম, তোমার সনে, একলা পেয়েছি তোমায় নিধুবনে’... ভগবানের মনে সাড়া তুলছে৷ এই হ’ল শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা৷ যেখানে ভক্ত স্বরূপ রাই কিশোরী যেন বলছে, ‘ও শ্যাম যখন তখন, খেল না খেলায় অমন, ধরিলে আর তোমায় ছাড়ব না’। আর তারপরই তো ‘কুসুম দোলায় দোলে শ্যামরাই, তমালশাখে দোলা ঝুলে ঝুলনে।’

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় মহাসমারোহে এই দোল উৎসব পালিত হ’ত৷ সেই সময় এই উৎসব ছিল কলকাতার রাজা–জমিদারদের পারিবারিক উৎসব। এর আকর্ষণ কিন্তু ছিল সার্বজনীন৷ প্রত্যেক জমিদার ও রাজবাড়ীর কৃষ্ণমন্দিরে বিগ্রহের গায়ে ফাগ–রঙ দিয়ে শুরু হত শুকনো ফাগ–রঙ বা রং মেশানো জল নিয়ে হোলি খেলা। সঙ্গে থাকতো ঢালাও মিষ্টিমুখের আয়োজন৷ এই উপলক্ষ্যে থাকতো নানা ধরনের লোক–বিনোদনের ব্যবস্থা। মেলা, যাত্রা, রকমারী নাচ–গান–বাজনা ইত্যাদি নানা আয়োজন। চলতো মাস জুড়ে৷ এই উৎসব এতই জনপ্রিয় ছিল যে, কোম্পানীর কর্মচারীদের জন্যে এই উপলক্ষ্যে পাঁচদিন ছুটি বরাদ্দ ছিল৷ মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর দোল উৎসব ছিল যথেষ্ট আকর্ষক৷

বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের ফাগুয়া উৎসব যেমন জন–জাতির উৎসব, বাঙলার দোলযাত্রা তেমনি জনজাতীয় উৎসব নয়–এটা এক ধরনের ধর্মীয় উৎসব৷ কিন্তু আজকাল বাঙলায় বসন্তোৎসবের ফাগ–রঙ–আবিরের খেলা ধর্মমতের আঙিনা পেরিয়ে মন রাঙানোর জাতীয় উৎসবের রূপ নিয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে এই জাতীয় বসন্তোৎসবের সূচনা করেন৷ কবি নিজে কয়েকবারই বসন্তোৎসবে উপস্থিত থেকে এই উৎসবের মাধুর্য্য তুঙ্গে তুলে দিয়েছেন৷ ‘রাঙা হাসি, রাশি রাশি অশোক পলাশে,/ রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে, / নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল’।

জাগতিক চাওয়া–পাওয়ার স্থূল বর্ণময়তা মনে আবিলতা এনে দেয়৷ মনের ষোল–আনা সরসতা, মাধুর্য্যপূর্ণ মনোভাব অক্ষুণ্ণ থাকে না৷ ভক্তমনের মাধুর্য্য, মসৃণতায় আবিলতা এসে যায়৷ পরমপুরুষ হ’ল, ‘রসো বৈ সঃ’–আনন্দময় রসঘন সত্তা৷ অণুমনে ষোল–আনা সরসতা থাকলে তবেই সেই রসঘন আনন্দময় সত্তার সাথে একাত্ম হওয়া যায়–যা ভক্তমনের একান্ত আকুতি৷ বসন্তোৎসবের মূল আধ্যাত্মিক তাৎপর্য–এখানেই৷

ঐতিহ্যগত ভাবে অহিন্দুদের মধ্যে যেমন জৈন, নেপালের বৌদ্ধদের মধ্যেও এই উৎসব দেখা যায়। শিখরাও এই উৎসব পালন করে, উনিশ শতক জুড়ে। শিখ ধর্মের ইতিহাসে একে ‘হোলা’ বলা হয় শিখদের শেষ ধর্মগুরু গুরু গোবিন্দ সিং হোলিকে পরিবর্তন করে তিনদিনের হোলা মহল্লা উৎসবে পরিনত করেছিলেন যেখানে মার্শাল আর্টও অন্তর্ভুক্ত হয়। মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সময়ও শিখ সাম্রাজ্যে হোলি খেলার উল্লেখ আছে। সেই উৎসবের সংস্কৃতি ভারত ও পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে বিস্তৃত হয়। ট্রিবিউন ইন্ডিয়ার একটা প্রতিবেদন অনুসারে শিখ দরবারের নথি বলছে ১৮৩৭ সালে লাহোরে ৩০০ পাউন্ডেরও বেশি রঙের ব্যবহার হয়েছিল। রঞ্জিত সিংয়ের উদ্যোগে লাহোর দূর্গে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রার ছবি আকা হয় এবং তৎকালীন ব্রিটিশ কর্মকর্তাগনও এই উৎসবে যোগদান করতেন। দোল বা হোলি উৎসবে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রবনতাও লক্ষ্য করা যায়। কারন বসন্তকালে গাছের ঝরা পাতা শুকনো ডাল জড়ো করে পোড়ানো হয় দোলের আগের দিন (নেড়াপোড়া, চাচড় বা হোলিকা উৎসব)। যার ফলে প্রাকৃতিক কিছু বর্জ্য পদার্থ জ্বালিয়ে পরিবেশ পরিস্কারও হয়।

বৈষ্ণব ধর্ম ছাড়াও শাক্ত ও শৈব ধর্মেও এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসব একদিকে যেমন প্রেমের উৎসব অপরদিকে তেমনই অশুভ শক্তির পরাজয়ের মাধ্যমে শুভ শক্তির সূচনা বা শত্রু নিধনের উৎসবও বলা যেতে পারে। এটা হিন্দু ধর্মের একটা সামাজিক মেলবন্ধনেরও উৎসব বটে।

হোলি বা দোল মূলত শ্রীকৃষ্ণের লীলা সমৃদ্ধ হলেও বৈষ্ণবতীর্থ কাটোয়ায় এই হোলির তাৎপর্য আলাদা। যেহেতু শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মতিথি এই দোলপূর্ণিমা, তাই এখানকার দোল মূলত গৌরাঙ্গকেন্দ্রিক। কাটোয়ার দোলের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য এখানকার দোল উৎসব তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। বৈষ্ণবধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও ছোট, বড় অনেক মন্দির আছে এখানে। মূলত রাধাকৃষ্ণ এখানে বিভিন্ন রূপে বিরাজ করেন। এখানকার রাধাকান্তদেবের মন্দির, ষড়ভুজা মন্দির, রাধামাধব মন্দির, সখীর আখড়া, আশ্রমে দোল পূর্ণিমার দিন হোলি উৎসব পালিত হয়। আগের দিন রাতে ন্যাড়া পোড়ানো ছাড়াও দোলের দিন ভোগপুজোও হয়ে থাকে।

কাটোয়ার কাছেই বিকি হাটে রয়েছে শুকদেব ব্রহ্মচারীর আশ্রম। হাজার হাজার ভক্ত ও অতিথিবৃন্দের বিনা খরচে খাওয়া এবং থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। দোল উপলক্ষে চার-পাঁচ দিনের মেলাও বসে এই আশ্রম চত্বরে। মন্দির চূড়ায় ধ্বজা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে এখানে দোল উৎসবের শুরু হয়। পরে বাজনা, আবির নিয়ে শহর পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে এখানে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।

দোল উৎসবের দ্বিতীয় পর্যায়ে হয় মহাপ্রভুর দোল। এই দিনটি শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মতিথি। কাটোয়ার বিভিন্ন মন্দিরে এই দিন চৈতন্যদেবের অভিষেক হয় এবং চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বিগ্রহ নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয়। এই শোভাযাত্রাটি শহর পরিক্রমা করে। বিকেলের দিকে গঙ্গার দিকে ম্যাড়া পোড়ানো হয়। পরের দিন হয়, হোলিখেলা। কাটোয়ার আপামর জনসাধারণ মহাপ্রভুর দোল উপলক্ষে দ্বিতীয় দিনে হোলি খেলায় সামিল হন। সকাল থেকে গোলা রং ও জল রং ব্যবহার করা হয়। বিকেলের দিকে চলে আবির খেলা। কীর্তন, ভাগবত পাঠ, ভক্তিগীতি, হরিনাম সঙ্কীর্তনের আসর বসে। বহু ভক্ত প্রসাদ পান। কাটোয়ার তাঁতিপাড়ায় প্রায় তিন শতাব্দী পুরনো চট্টরাজবাড়ি এবং ঠাকুরবাড়ির দু’টি রাধাগোবিন্দ মন্দিরে দোলপূর্ণিমার পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিনে উৎসব পালিত হয়। এই দুই বাড়ির ম্যাড়া পোড়ানো হয়, কারবালাতলার কাছে তিন রাস্তা সংযোগে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ দোলের দিন নাম সঙ্কীর্তন, ভোগপুজো, আরতি ছাড়াও বহু মানুষ ধনী, দরিদ্র, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রসাদ গ্রহণ করে।

‘বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।

মৌমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল। দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌।।'

রাঙা আকাশ, অশোক পলাশ ফুল আর মৌমাছ প্রজাপতির ওড়াওড়ি জানান দেয় বসন্তের আগমনের। সাথে উৎসবের আমেজ যোগ করে দেয় দোলযাত্রা। তাই আর ঘরে থাকা যায় কি? এমন আনন্দঘন দিনে একে অন্যের সঙ্গে সোহাগ-সম্প্রীতি গড়ে তুলবে, এই তো স্বাভাবিক। তাই রবীন্দ্রনাথ গানের কথায় ডাক দিচ্ছেন গৃহবাসীদের এই সৌন্দর্য অবলোকনের। গানের কথায় স্পষ্ট দোলের বৈশিষ্ট্য এবং বসন্তের আগমনী বার্তা। শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনের দ্বিতীয়ার্ধের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত এই শান্তিনিকেতনের আশ্রমে। এখানে বসেই বিশ্বকবি তার অসংখ্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করে গেছেন। প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনে নাচ-গান ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বরণ করে নেওয়া হতো বসন্তকে। পরপবর্তীতে দোলযাত্রা যেহেতু বসন্তে উদযাপিত হয়, তাই দোল ও বসন্তবরণ একইসাথে বসন্তোৎসব হিসেবে ধুমধাম করে উদযাপন করা শুরু হলো শান্তিনিকেতনে। ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উদ্বোধন করে যান এই উৎসবের। এছাড়া দোলের পূর্ব রাতে হোলিকাদহনের মতোই 'বহ্নি উৎসব' পালন করা হয়।

দেখতে দেখতে কতই তো বদলে গেল। এক সময় আনন্দের এই মিলনোৎসবে বিশেষ পানীয়ের বদলে জায়গা করে নিয়েছে ভাঙ মেশানো ঠাণ্ডাই শরবত। দোলের ফাগ খেলার পর মিষ্টিমুখ মানেই মঠ, ফুটকড়াই আর মুড়কি। চিনির তৈরি অনেকটা রথের মত দেখতে সুউচ্চ স্তম্ভের মত শক্ত রঙ্গিন মিষ্টি এই মঠ। ফুটকড়াই হল ভাজা ছোলা মটরের ওপর চিনির কোটিং দেওয়া আর তার সহযোগে গুড়ের মুড়কি। দোলের দিন এই ত্রয়ী মিষ্টির জায়গা পাকা।

এই মঠ আমাদের বাংলার শতবর্ষের প্রাচীন এক মিষ্টি। সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায় প্রায় শতবর্ষ আগে এক লেখায় তাঁদের গ্রামের দোলতলার মেলার বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “মেলার দোকানের বেশিরভাগ হচ্ছে মণিহারী আর খাবারের। খাবারের তালিকার মধ্যে ছিল, চিঁড়ে, মুড়কি, ছানা বর্জিত মণ্ডা, গোল্লা, রসকরা, তেলেভাজা, জিলিপি, মেঠাই, বাতাসা আর চিনির ও গুড়ের ছাঁচ। এই চিনির ছাঁচই হচ্ছে মঠ।”

ইতিহাস বলছে মঠ কিন্তু পর্তুগিজদের খাবার যার প্রথম আগমন হুগলির ব্যাণ্ডেল চার্চে। বড়দিনের সময় গির্জার আকারে ছাঁচে ঢালা কড়া চিনির রসের এই মিঠাইটিই নাকি ছিল পর্তুগিজদের প্রিয় মিষ্টি। গির্জায় যীশুর এই প্রসাদের আইডিয়া নিল বাংলার ময়রারা । বাতাসার মত পাক করে, নানারকমের রঙ মিশিয়ে বানাতে লাগল। একটা ফুটো পাত্র থেকে মাদুরের ওপর ফোঁটা ফোঁটা চিনির রস ফেলে কাঠের ছাঁচে সেই রস জমিয়ে মঠ তৈরী হল । বাংলার ময়রারা এই মিষ্টিকে গির্জা আকার দিয়ে নাম দিল মঠ। সুদূর পর্তুগালের ‘মঠ’ কেমন জড়িয়ে রয়ে গেল বাংলার দোলের সংস্কৃতির সঙ্গে।

নগর কলকাতায় কুলদেবতাকে কেন্দ্র করেই খুব জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে দোল উৎসব পালন হত বনেদি বাড়িগুলিতে। পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের সিন্নি, হরির লুঠ এবং এলাহি খানাপিনার আয়োজন থাকত ।

প্রখ্যাত কলকাতা গবেষক ডঃ অতুল সুরের মতে তখনকার লোক কোনও বর্ধিষ্ণু পরিবারের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রায়ই বলত ‘ওদের বাড়ি দোল-দুর্গোৎসব হয়’। তার মানে, দোলযাত্রা দুর্গোৎসবের মতই একটা বড় উৎসব ছিল। এর সমর্থন পাওয়া যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দের সরকারি ছুটির তালিকা থেকে। অন্যান্য পরবে সরকারি আপিস যেখানে দু-একদিন বন্ধ থাকত, দুর্গোৎসবে আটদিন ও দোলযাত্রায় বন্ধ থাকত পাঁচদিন। প্রতিপদের ভোরে মহা সমারোহে পালন করা হত দেবদোল। দেবতাকে আবির দিয়ে তবেই পরিবারের সকলে দোল খেলবে। এরপর বেলা বাড়তেই শুরু হত রঙ খেলা। কীর্তনের আসর বসত দোলের দিন সন্ধ্যাবেলা।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবংশ ব্রাহ্ম ধর্ম নিলেও তাঁদের বাড়িতে দোলের আয়োজন ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। কলকাতা গবেষকের কথায় ‘বেশ সমারোহের সঙ্গেই দোল উৎসব হত প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম হয়ে গেলেও ঠাকুরবাড়ির দোলে বেশ মাতামাতি হত।’ রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী ঠাকুরবাড়ির দোল সম্পর্কে জানিয়েছেন, ‘দোলপূর্ণিমারও একটি বিশেষ সাজ ছিল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের গন্ধমাখা মালা । দোলের দিন সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল আবিরের লাল রং সাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।’

দোলের দিন কলকাতায় রঙ খেলার ট্র্যাডিশান বহুদিনের। পুরনো কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারিবাড়ি আর তাদের কুল দেবতা শ্যামরায়ের মন্দির ছিল লালদিঘি তে। কেউ বলে একবার দোলের সময় রং খেলায় এই পুকুরের জল এতই লাল হয়ে যায় যে নাম হয় লালদিঘি। শোভাবাজার দেবপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেবের ছেলে রাজকৃষ্ণের পরিবারের গৃহদেবতা ‘গোপীনাথ জিউ’ এবং দত্তকপুত্র গোপীমোহনের পরিবারের গৃহদেবতা ‘গোবিন্দ জিউ’-কে ঘিরেই এই দুই শরিকের দোল-উত্‍সব আবর্তিত হয়। তবে ভিন্ন দিনে।

মহামিলনের জন্য‌ই বুঝি এমন ঢালাও আয়োজন চলে আসছে হিন্দুধর্মে। নয়ত ফাল্গুনে দোলযাত্রার মত উৎসব মণ্ডিত যাত্রা পালনে সামিল হন কেন হাজার হাজার মানুষ? রাধাকৃষ্ণ তো প্রতীক মাত্র । সারা ভারতবর্ষে তিথিক্ষণ মেনে কেন আমরা এখনো জমায়েত হ‌ই বসন্তোৎসব প্রাঙ্গণের দোলতলায়? কেন‌ই বা সুগন্ধি মুঠোমুঠো ফাগ আবীরে রাঙিয়ে দিই বন্ধুর মুখ? আর কেন‌ই বা রঙ দিয়ে মিষ্টিমুখ করায় আমার বন্ধু? রাধাকৃষ্ণ, ঝুলন সাজানো, এসব তো মানুষের মনগড়া । আসল তো মাঝেমাঝে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কটাকে ঝালিয়ে নেওয়া।

কৃষ্ণ স্বয়ং সেকথাও হয়ত বুঝেছিলেন। হঠাত হঠাত মথুরা থেকে বৃন্দাবন, সেখান থেকে দ্বারকা …তাঁর সামাজিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ব্যস্তসমস্ত কর্মসূচীর টানাপোড়েনে শ্রীরাধার সঙ্গে সম্পর্কটা যায় যায় হয়ে দাঁড়াতো। তাই তো এই উতসবের মধ্যে দিয়ে আবারো মধুর সম্পর্কটা টিঁকিয়ে রাখার চেষ্ট করে যাওয়া। একান্তে দিনকয়েক কাছের করে পাওয়া। দুজনের কত শৃঙ্গার, ভৃঙ্গারে গল্পমুখর দিনরাত এক হয়ে যাওয়া। রঙ খেলা তো আসলে অজুহাত। তাই নয় কি? ঋতুবৈচিত্রের ওঠাপড়ায় মন ভালো করে দেওয়া আর সর্বোপরি মানভঞ্জন করে একটা জম্পেশ পার্টি অর্গানাইজ করা। দেব ভি খুশ অর দেবী ভি!

আমাদের ধর্মে অনেকরকমের যাত্রা রয়েছে। স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, রাসযাত্রা, ঝুলনযাত্রা আর দোলযাত্রা। বৈষ্ণবমতে ফাল্গুণী পূর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা, শ্রাবণী পূর্ণিমায় ঝুলনযাত্রা আর কার্তিক পূর্ণিমায় রাসযাত্রা। সম্ভবতঃ শ্রীকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রায় দোলনায় দোলা দেওয়া থেকেই দোলের নামকরণ। দোল বা হিন্দোলনের অর্থ হল সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলনময় মানুষের জীবনে একচিলতে আনন্দ খুঁজে নেওয়া। পেন্ডুলামের মত চলমানতায় ভরা আমাদের জীবনে একবার দুঃখ আবার তারপরেই সুখ। কখনও বিরহ, কখনও মিলন। কখনও আনন্দ, কখনও বিষাদ। স্থির হয়ে থাকাটা জীবন নয়। এই দোলনার আসা ও যাওয়াটি রূপকমাত্র। তাই জন্যেই তো বলে “চক্রবত পরিবর্ততে সুখানি চ দুখানি চ।’

আসলে দোল হল জীবনের উৎসব। আমাদের জীবন সব সময় এক তালে, এক সুরে চলে না। সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি, উত্থান-পতন, হাত ধরাধরি করে চলে। জীবন পরিবর্তনশীল। আর দোল উৎসব সেই বার্তা বয়ে আনে, যা জীবনের দুঃখ-দৈন্য-ব্যথা-বেদনা ভুলে এগিয়ে যেতে উৎসাহ জোগায়। জীবন আনন্দরসে পূর্ণ করে তোলার আহ্বান জানায় দোল উৎসব।



Comments


bottom of page