পিআইসিইউ: আতঙ্ক নয়, নতুন জীবনের পথচলা !
- রোজকার অনন্যা

- 6 hours ago
- 3 min read

ডাঃ সহেলী দাশগুপ্ত
এমবিবিএস, এমডি (পেডিয়াট্রিক্স), এফআইএপি (পেডিয়াট্রিক ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন)
বিভাগীয় প্রধান, পেডিয়াট্রিক ক্রিটিক্যাল কেয়ার
পিয়ারলেস হসপিটাল, কলকাতা
মা–বাবাদের কাছে সন্তানের অসুস্থতার মুহূর্ত সবচেয়ে কঠিন সময়। বিশেষ করে নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া বা কোনও সংক্রমণের কারণে শিশুর শারীরিক অবস্থা যখন ক্রমশ খারাপ হয় এবং তাকে পেডিয়াট্রিক আইসিইউ বা পিআইসিইউ–তে ভর্তি করতে হয়, তখন আতঙ্ক আরও বাড়ে। অনেকেই মনে করেন, পিআইসিইউ–তে ভর্তি মানেই হয়তো জীবনের শেষ সীমা। কিন্তু বাস্তবে পিআইসিইউ হচ্ছে সেই জায়গা, যেখানে অসংখ্য গুরুতর অসুস্থ শিশু প্রতিদিন নতুন জীবন ফিরে পায়।
পিআইসিইউ-র পরিকাঠামো
পিআইসিইউ এমনভাবে তৈরি, যাতে যে কোনও ধরনের ক্রিটিক্যাল শিশু এখানে নিরাপদ থাকে। জন্মগত হৃদ্যন্ত্রের ছিদ্র যেমন এএসডি বা ভিএসডি, হার্টে সংক্রমণের কারণে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বা দুর্বলতা, হৃদ্যন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া—সব পরিস্থিতিতেই এখানে বিশেষজ্ঞ কার্ডিওলজি দলের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি প্রয়োজন হলে ডিভাইস ক্লোজারের মতো বিশেষ প্রক্রিয়ার জন্যও সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকে এই পরিসর।
শিশুর কিডনির সমস্যাও অনেক সময় দ্রুত জটিল হয়ে ওঠে। অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি, নেফ্রোটিক সিনড্রোম বা কিডনিতে সংক্রমণের মতো সমস্যায় শিশুকে পিআইসিইউতে এনে স্থিতিশীল করা হয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী এখানে শিশুর ডায়ালেসিসের ব্যবস্থাও থাকে।
শিশুর হজমতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে যখন পরিস্থিতি সংকটজনক হয়, যেমন ফরেন বডি গিলে ফেলা, পাকস্থলীতে রক্তপাত, আলসার বা পিত্তনালীতে স্টোন—তখনও পিআইসিইউ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। কোনও শিশুকে এন্ডোস্কোপি বা ইআরসিপি করার আগে তাকে স্থিতিশীল রাখা, রক্তপাত বন্ধ করা, প্রয়োজনমতো রক্ত দেওয়া—সবই এখানে করা হয়। প্রসিডিওরের পরও শিশুকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি, কারণ এ সময় যে কোনও জটিলতা দেখা দিতে পারে।
নিউরোলজি ও নিউরো–সার্জারির জরুরি ব্যাকআপ
খিঁচুনি, মেনিনজাইটিস, এনসেফেলাইটিস, মাথায় আঘাত, মস্তিষ্কে রক্ত জমে যাওয়া—এ ধরনের সমস্যায় শিশুর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে। পিআইসিইউ–তে পৌঁছানোর পর চিকিৎসকেরা প্রথমেই শিশুর গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ স্থিতিশীল করেন। গুরুতর ক্ষেত্রে নিউরো–সার্জারির প্রয়োজন হলে শিশুকে দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওটি থেকে ফিরে আসার পর প্রথম ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়, আর এই সময়ে পিআইসিইউ–র নিবিড় পর্যবেক্ষণ জীবনরক্ষাকারী হয়ে ওঠে।
গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে পিআইসিইউ–র ভূমিকা
চিকেনপক্সের জটিল রূপ, ডিসেমিনেটেড হারপিস, স্ক্রাব টাইফাস, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রমণে শিশুর শরীর দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে অনেক শিশুর প্লেটলেট বিপজ্জনকভাবে নেমে যায় এবং শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিলে ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হয়। ম্যালেরিয়া বা স্ক্রাব টাইফাসের ক্ষেত্রেও বহু সময় বিভিন্ন অঙ্গে সমস্যা দেখা দেয়, যা পিআইসিইউ ছাড়া সামলানো কঠিন। তাই সংক্রমণজনিত সব ধরনের ক্রিটিক্যাল কেয়ারের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গা হচ্ছে পিআইসিইউ।
আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির সঠিক সমন্বয়
শিশুর শ্বাসকষ্ট নিয়ন্ত্রণে এখন আর প্রথমেই ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হয় না। তার আগে সিপ্যাপ, বাইপ্যাপ বা হাই–ফ্লো নেজাল ক্যানুলার মতো নন–ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন ব্যবহার করা হয়। এতে অনেক শিশুকে ভেন্টিলেটর এড়ানো যায়, যা তাদের সুস্থতার পথে বড় সহায়ক।তবে যে মুহূর্তে শিশুর অবস্থার অবনতি ঘটলে, তখন উন্নত ভেন্টিলেটর সাপোর্ট সবসময় প্রস্তুত থাকে পিআইসিইউ–তে। এসএমএ–র মতো দুর্লভ রোগে আক্রান্ত শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাসের পেশি দুর্বল থাকায় তাদের ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এসব শিশুদের ক্ষেত্রে পিআইসিইউতে নন–ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন অনেকটাই বেশি এবং সেই ব্যাকআপ এখানে সবসময় প্রস্তুত থাকে।

টিমওয়ার্ক: পিআইসিইউ–র সবচেয়ে বড় শক্তি
পিআইসিইউ–তে কাজ করার জন্য শুধু পরিকাঠামো বা যন্ত্রপাতিই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন আন্তরিক, দক্ষ ও অভিজ্ঞ একদল চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর। প্রতিটি শিশুর জন্য প্রায় সবসময় একজন করে নার্স দায়িত্বে থাকেন, যিনি শিশুদের প্রতিটি মুহূর্ত নজরে রাখেন। চিকিৎসকেরাও সারাক্ষণ উপস্থিত থাকেন এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ দল— কার্ডিওলজি, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি, নেফ্রোলজি, ইনফেকশাস ডিজিজ বা নিউরোলজি তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেয়। এই সমন্বিত টিমওয়ার্কই পিআইসিইউ–র সাফল্যের মূল ভিত্তি।
রিহ্যাবিলিটেশন: সুস্থ জীবনে ফেরার সোপান
শিশু যখন ক্রমশ সুস্থ হতে থাকে, তখন রিহ্যাবিলিটেশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নিউরোলজি রোগীর ক্ষেত্রে হাত–পা দুর্বল হয়ে যাওয়া, মস্তিষ্কে রক্ত জমার পর পক্ষাঘাতের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞ পেডিয়াট্রিক ফিজিওথেরাপিস্টরা ধীরে ধীরে শিশুকে আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। নিউমোনিয়া বা গুরুতর ফুসফুসের সংক্রমণের পর চেস্ট ফিজিওথেরাপিও শিশুদের সুস্থ হতে সাহায্য করে।
মানসিক সুস্থতার যত্ন
পিআইসিইউ–তে শুধু শারীরিক নয়, শিশুর মানসিক আরামও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর ঘুম যাতে ভালো হয়, সেই জন্য সফট মিউজিক চালানো হয়। যেসব শিশু ভেন্টিলেটরে নেই এবং ধীরে ধীরে সুস্থতার পথে, তাদের মা–বাবাকে নিয়মিত দেখা করতে দেওয়া হয়। মানসিক সান্ত্বনা শিশুর দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। নার্সরা এখানে অনেকটা মায়ের মতোই সন্তানের পাশে দাঁড়ান, কারণ শিশুর ভয় দূর করা চিকিৎসারই একটি অঙ্গ।
ছুটি পাওয়ার পর ফলোআপ
পিআইসিইউ থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরও অন্তত তিন থেকে ছ’মাস চিকিৎসকের ফলোআপ অত্যন্ত প্রয়োজন। এই সময় নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে দেখা হয় শিশুর সুস্থতার ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কি না এবং কোনও নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে কি না। একই সঙ্গে বাড়িতে কীভাবে যত্ন নিতে হবে, সেটাও পরিবারের সদস্যদের বা মা–বাবাকে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
শেষ কথা
পিআইসিইউ মানে কোনও আতঙ্ক নয়। বরং আধুনিক প্রযুক্তি, অভিজ্ঞ চিকিৎসকদল, নার্সদের নিখুঁত পর্যবেক্ষণ এবং শিশুকেন্দ্রিকমানবিক যত্ন—এই সব মিলিয়েই পিআইসিইউ হয়ে ওঠে শিশুদের জীবনরক্ষার সবচেয়ে নিশ্চিত জায়গা। এখানেই প্রতিদিন বহু গুরুতর শিশুর নতুন জীবন শুরু হয়।








Comments