আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোন, কৃত্রিম মেধা মানুষের প্রয়োজনকে অনেক কমিয়ে দেবে। কী হবে তখন? প্রশ্ন তুলছেন সমীর চট্টোপাধ্যায়
আজকের তথ্যপ্রযুক্তি যে জায়গায় চলে যাচ্ছে সেখানে মানুষের মেধার খুব দরকার হবে না। এই টেকনো জমানায় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধি আপনার অনেক কাজ করে দেবে। শারীরিক অস্তিত্বহীন এই অ্যাসিস্ট্যান্ট শুধু গ্রাহকের কমান্ড মেনে কাজই করে না, আগে থেকে বলে রাখা হুইপ যথাসময়ে ঠিকভাবে করে রাখে। আবার সেই কাজ সুসম্পন্ন হয়ে গেলে অতীতের করে আসা কাজ সম্পর্কিত কিছু করতে হবে না কি না তাও প্রভুকে জিজ্ঞাসা করে নেয়। অর্থাৎ, গ্রাহকের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। সে যা করে, সবই তার নিজের বুদ্ধি বা মেধা খাটিয়ে। নিউরোন বা স্নায়ু দ্বারা গঠিত কোনও রক্তমাংসের ব্রেন নয়, প্রযুক্তি বা মাইক্রো চিপ দিয়ে তৈরি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) সাহায্যে।
এ আই নিয়ে বিজ্ঞানী, টেকনোক্র্যাটদের উন্নতর গবেষণা এবং সাফল্য সেই প্রযুক্তিকে আমাদের বর্তমান জীবনের সঙ্গে এক সারিতে জুড়ে দিয়েছে। ইন্টারনেট প্রজন্মের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সেই এ আই নির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহার ও কার্যকারিতা বেড়ে চলেছে। সে ইন্টারনেট সার্চ থেকে মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়াই হোক, বা টেক্সট ট্রান্সলেট থেকে সংবাদ পরিবেশন এবং সর্বোপরি রাস্তার সিগন্যালে ট্র্যাফিক পরিষেবা।
প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে মেশিনকে বুদ্ধিমান করে তোলাই হল আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধা। এটি এক ধরনের সফটওয়্যার টেকনোলজি, যা রোবট বা কম্পিউটারকে মানুষের মতো কাজ করায় এবং ভাবায়। যেমন, কারো কথা বুঝতে পারা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, দেখে চিনতে পারা ইত্যাদি ইত্যাদি। এককথায় মেশিন লার্নিং।
একটি প্রশ্ন উঠে আসে বারেবারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি কখনও মানুষের বুদ্ধিকেও ছাড়াতে পারে? এর উত্তরে অনেক নানা ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেছেন বিভিন্ন জ্ঞানী পণ্ডিতমহল। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, ‘আগত ভবিষ্যৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমাত্রা মানুষের দৌড়কে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবে।’ ইলন মাস্ক বলেছিলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধি মাত্রা মানুষের জন্য সেরা এবং ভয়ংকর উভয়ই হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে রয়েছে প্যাটার্ন রিকগনিশন, মেশিন লার্নিং, নিউরাল নেটওয়ার্ক, বিগ ডেটা, সেলফ অ্যালগরিদম-এর মতো প্রযুক্তি। AI হল একটি জটিল প্রযুক্তি যা মেশিনে একটি নির্দিষ্ট ডেটা প্রবেশ করানো এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। AI হল স্ব-শিক্ষার নিদর্শন তৈরি করা যা মেশিনগুলিকে মানুষের মতো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ডার্টমাউথ সম্মেলনে জন ম্যাকার্থি ১৯৫৬ সালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রথম চালু করেছিলেন। সম্প্রতি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সামরিক থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রয়োগের কারণে প্রাধান্য পেয়েছে।
ইতিহাস ফিস ফিস কথা কয়
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পথচলা শুরু ১৯৪০ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই সময় ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যালান টুরিং এবং নিউরোলজিস্ট গ্রে ওয়াল্টার বুদ্ধিমান মেশিন এবং তার বিভিন্ন সম্ভাবনা সম্পর্কে নানা ধারণা দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি কোড ভাঙাটা খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু কিছুতেই পারা যাচ্ছিল না তা। শেষ পর্যন্ত পারা গেল। পারলেন অ্যালান টুরিং। ব্রিটিশ সরকার আইন করে তাদের নাৎসি কোড ভাঙার তথ্য সারা পৃথিবীর কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিল।
কিংস কলেজ থেকে গণিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে অনার্সে উত্তীর্ণ হন টুরিং এবং ফেলোশিপও পান। তিনি মনে করতেন, যেকোনও গণনাযোগ্য গাণিতিক সমস্যাই সমাধানযোগ্য। যদি তা এলগরিদমে দেওয়া হয়। এই সমাধানের জন্য ‘ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিন’ নামে একটি ‘হাইপোথেটিক্যাল’ যন্ত্র তৈরি করেন টুরিং। এই মেশিনের আধুনিক রূপই হচ্ছে আজকের কম্পিউটার। প্রিন্সটন থেকে পিএইচডি করার সময় টুরিং ‘ক্রিপ্টোলজি’ নিয়েও পড়াশোনা করেন।
টুরিং তখন ব্রিটিশ কোড ব্রেকিং সংস্থায় কাজ করছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সে সময় ধ্বংসাত্মক আকার নিচ্ছে। আক্রান্ত পোল্যান্ড তখন বাধ্য হয়েই সাহায্যের আশায় উদ্ধার করা জার্মান এনিগমার তথ্যাবলি ব্রিটিশদের সরবরাহ করে। এনিগমা হলো একটি গোপন বার্তা প্রেরণকারী যন্ত্র। যার মাধ্যমে জার্মানরা রেডিও সঙ্কেত দিয়ে দুর্বোধ্য কোডে সৈন্যদের কাছে আক্রমণের নির্দেশিকা পাঠাত। কোডগুলি কিছুতেই ভাঙতে পারছিল না ব্রিটিশরা।
এনিগমার গোপন বার্তা উদ্ধারকাজে তখন ক্রিপ্টো বিশেষজ্ঞ টুরিংকে কোড ব্রেকিং কার্যালয়ে ডাকা হলো। এনিগমার কোড ভাঙার জন্য যে ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল যন্ত্রের প্রয়োজন ছিল, সেটা ‘বোম্বা’ নামের যন্ত্রটি পোলিশদের কাছ থেকেই পাওয়া। টুরিং ভাবলেন, ‘মানুষের দ্বারা এনিগমাকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বরং একটি যন্ত্রের পক্ষেই সেটি সম্ভব। টুরিং ও গর্ডন ওয়েলচের যৌথ চেষ্টায় ‘বোম্বা’কে ভিত্তি করে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক যন্ত্র তৈরি হল। নাম ‘বোম্বে’। এনিগমার সব কোডের ভেতর পরিচিত শব্দ খোঁজার চেষ্টা করত ‘বোম্বে’। এভাবেই জার্মান এনিগমার গোপন তথ্য উদ্ধার করে ক্রিপ্টোগ্রাফি জগতের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন টুরিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ‘বোম্বে’ একে একে জার্মান সেনাবাহিনীর সব এনক্রিপ্টেড তথ্য ভাঙতে শুরু করে। আটলান্টিকে নাৎসিদের হেরে যাওয়ার ঘটনাটিও ঘটে বোম্বের অভাবনীয় সাফল্যের কারণেই।
১৯৪৮ সালের দিকে ‘টুরিং টেস্ট ও যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ নিয়ে কাজ শুরু করেন টুরিং। এই টেস্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল অনুলিপিকরণ পরীক্ষা। অর্থাৎ ‘ইমিটেশন গেম’। পাশাপাশি দুটি রুম। একটিতে একজন মানুষ, আরেকটিতে রয়েছে একটি যন্ত্র। ঠিক করা হয়, বৌদ্ধিক বিভিন্ন প্রশ্ন লিখে পাঠালে এর জবাব ওই দুই রুম থেকেই লিখিতভাবে আসবে। কোনও শব্দ বা কণ্ঠের ব্যবহার করা যাবে না। যন্ত্রটির উত্তর মানুষের কাছাকাছি হলেই বুঝতে হবে তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে।
সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে মার্কিন কম্পিউটার ও কগনিটিভ বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। এমনকী এ আই প্রযুক্তির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দুনিয়ায় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আজ ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। ইন্টারনেট নির্ভর স্মার্ট ডিভাইসগুলোতে এ আইয়ের ব্যবহার রমরমা।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সর ভাগ ১। উইক এআই (Narrow AI)
এই ইন্টেলিজেন্স শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর কাজ করতে পারে। বর্তমানে আমরা এই ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করছি। ২। স্ট্রং এআই (Artificial General Intelligence)
মেশিন বা কম্পিউটার যখন মানুষের মতো কাজ করতে পারবে তখন তাকে বলা হবে স্ট্রং এআই। ৩। সিঙ্গুলারিটি (Super Intelligence)
এটা হল এমন একটা ইন্টেলিজেন্স যা কিনা সবচেয়ে প্রতিভাধর মানুষের ক্ষমতাকেও অতিক্রম করবে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, কৃত্রিম মেধার সুবাদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের থেকে ভালো পরিষেবা দিতে পারবে যন্ত্র। মানুষের অনেক কাজ করবে। আজকের প্রজন্ম স্মার্ট ফোনে এআই প্রযুক্তি নির্ভর গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা সিরি-কে ব্যবহার করছে। চ্যাটিং করতে হলে আর কষ্ট করে টাইপ করতে হচ্ছে না। মুখে বলে দিলেই অ্যাসিস্ট্যান্ট তা লেখায় রূপ দিয়ে দিচ্ছে। তা ইংরেজি, ফারসি বা বাংলা যে ভাষাতেই হোক না কেন। বন্ধুর নাম বলে ফোন করো বলতেই, তার সঙ্গে ফোন কানেক্ট করে দিচ্ছে। অ্যালেক্সা একটি গান শোনাও বললে সে জিজ্ঞাসা করছে কোন গান, কী গান, কার গাওয়া ইত্যাদি। তাই বলে শুধু স্মার্ট ফোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই এআইয়ের দাপট।
কৃত্রিম মেধার কাজ স্মার্ট গাড়ি ও ড্রোন
স্বয়ংক্রিয় তথা চালকহীন গাড়ির স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দিয়েছে এ আই। সেক্ষেত্রে নজির তৈরি করেছে মার্কিন গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা টেসলা। এ আই নির্ভর এই গাড়ি বুঝতে পারে কী করে, কখন ব্রেক মারতে হয়, কীভাবে বদলাতে হয় রাস্তার লেন এবং কীভাবে দুর্ঘটনা এড়াতে হয়। এছাড়া নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এই গাড়ি ঘুরতে এবং ম্যাপ ব্যবহারও করতে পারে। বর্তমানে আমেরিকাতে ৫০ হাজারেরও বেশি টেসলারের এই গাড়ি চলছে। আবার অ্যামাজন ও ওয়ালমার্টের মতো বহুজাতিক সংস্থা তাদের পণ্য গ্রাহকের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার কাজে ড্রোন ব্যবহার করছে। একইভাবে মাল পরিবহণের জন্য ব্রিটেনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাক পরিষেবার কাজ শুরু করেছে ব্রিটেনের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (ডিএফটি)।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট
আমরা ফেসবুক, ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রাম বা শেয়ার চ্যাটের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করলেও বুঝতে পারি না কীভাবে একের পর এক আপডেট আমাদের কাছে আসছে! তা সে পরিচিত ব্যক্তিকে খোঁজাই হোক বা ফ্রেন্ডস সাজেশন। একটা কিছু লাইক, শেয়ার করলেই সেই সম্পর্কিত আরেকটা নিমেষে হাজির হয়ে যায়। সবকিছুই গ্রাহকের অচিরে হচ্ছে কৃত্রিম মেধার দৌলতে। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, চাহিদা, মেলামেশা ইত্যাদি বুঝে ‘কাস্টমাইজড’ আপডেট পাঠাতে থাকে এ আই প্রযুক্তি।
মিউজিক ও মিডিয়া
কেউ যখন স্পটিফাই, নেটফ্লিক্স বা ইউটিউব ব্যবহার করে, গ্রাহকের জন্য পুরো সিদ্ধান্তই নেয় এ আই। একজন যদি মনে করে সে বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করছে বা তার নিয়ন্ত্রণে পুরো মিডিয়া চলছে, তা একেবারে ভুল। কারণ, একটি গান শুনতে শুনতে বা একজন শিল্পীকে খোঁজার সময় ‘রিলেটেড’ বা ‘সাজেস্টেড’ গান বা শিল্পী চলে আসে। একইভাবে আজকের জনপ্রিয় পাবজি, সিএস গো বা ফোর্টনাইট-এর মতো উন্নত ভিডিও গেমে এআই ব্যবহার সফল।
অনলাইন বিজ্ঞাপন
এআই প্রযুক্তির একটা বড় গ্রাহক অনলাইন বিজ্ঞাপন সেক্টর। এক্ষেত্রে এআই শুধু ইন্টারনেট সার্চকারী ব্যক্তিদের উপর নজর রেখে তথ্য তল্লাশি করে না, গ্রাহকদের পছন্দ-অপছন্দ বিচার করে সেইমতো তাঁদের সামনে বিজ্ঞাপন হাজির করে। ফলে বিশ্বব্যাপী অনলাইন বিজ্ঞাপনের ব্যবসা ২৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
নেভিগেশন এবং ট্র্যাভেল
ম্যাপের পুরোটাই এআই প্রযুক্তিচালিত। যখন গুগল, অ্যাপেল বা অন্য সংস্থার ম্যাপ ব্যবহার করে আমরা ক্যাব বুক করি, তখন এআই বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে রাস্তার সেই সময়ের যানজট বা ভাড়া সম্পর্কে আমাদের জানায়।
ব্যাঙ্ক পরিষেবা
বর্তমানে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার একটা বড় অংশ কৃত্রিম মেধা। কোনও একটা লেনদেন করলে আমরা তৎক্ষণাৎ যে এসএমএস বা ইমেল অ্যালার্ট পাই, তা এই এআই প্রযুক্তির সৌজন্যে। এইভাবে প্রতিটি গ্রাহকের লেনদেন, লগ্নি, প্রতারণারোধে নীরবে কাজ করছে এআই।
স্মার্ট হোম ডিভাইস
নিত্যদিনের ব্যবহার্য স্মার্ট হোম ডিভাইস বা যন্ত্রগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে এআই। আমাদের ব্যবহার, পছন্দ-অপছন্দ বুঝে সেই প্রযুক্তি নিজেই সংশ্লিষ্ট যন্ত্রের সেটিংস পরিবর্তন করছে এবং গ্রাহকদের নিরবিচ্ছিন্ন সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আগেই গুগলের ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট এসি, স্মার্ট মাইক্রোওয়েভের কথা উল্লেখ করা যায়।
নিরাপত্তা ও নজরদারি
এই মুহূর্তে সবথেকে বেশি কৃত্রিম মেধা ব্যবহার হচ্ছে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। ড্রোন তো ছেড়েই দেওয়া যাক। নজরদারির কাজে বিভিন্ন পয়েন্টে লাগানো হাজার হাজার ক্যামেরা থেকে লক্ষ লক্ষ তথ্য একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্লেষণ করা এআই ছাড়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এআই নির্ভর অবজেক্ট রিকগনিশন বা ফেস রিকগনিশনের মতো প্রযুক্তি প্রতিদিন উন্নত হচ্ছে।
বিজনেস ম্যানেজমেন্ট
আজকের জনপ্রিয় অনলাইনে কেনাকাটা বা ই-কমার্সে ব্যবহার হচ্ছে এআই। যার জেরে গ্রাহক ঠিক কী চইছে সেই পণ্য দ্রুত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। একঝাঁক পণ্য বা পরিষেবার মধ্যে থেকে বেছে বেছে গ্রাহকের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, চাহিদা, মেলামেশা ইত্যাদি বুঝে ‘কাস্টমাইজড’ আপডেট পাঠাতে থাকে এআই প্রযুক্তি।
বিতর্ক যেখানে
এত সুবিধার পরও এআই নিয়ে বিশ্বজোড়া বিতর্ক একটাই — আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ফলে বিভিন্ন সংস্থায় মানুষের কর্মসংস্থান কমে যাবে না তো? একটি সমীক্ষা অনুযায়ী আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ চাকরি সঙ্কটে। ম্যাককিন্সলে গ্লোবাল ইন্সস্টিটিউট তার সমীক্ষায় জানিয়েছে, অটোমেশন (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স+মেশিন) বা স্বয়ংক্রিয়তার ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৪০-৮০ কোটি মানুষ চাকরি হারাবে। প্রায় ৩০ কোটি ৭৫ লাখ মানুষকে বেছে নিতে হবে অন্যকাজ। একইভাবে ন’য়ের দশকের গোড়ার দিকে কম্পিউটার আগমনের সময় কাজ হারানোর ভয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছিল ‘কম্পিউটারফোবিয়া’। যদিও, এই ভয় ও উদ্বেগের মধ্যে সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, প্রযুক্তির বদল যত না কর্মসংস্থান নষ্ট করেছে, তার থেকে বেশি চাকরি সৃষ্টি করেছে। স্বয়ংক্রিয়তার ফলে যখন একটি নির্দিষ্ট কাজ দ্রুত, সহজ ও সস্তা হয়ে যায়, তখন সেই কাজের বাকি দিকগুলো সম্পন্ন করতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে আরো বেশি মানবসম্পদের।
সে কারণেই আরেক অংশের মতে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ফলে তৈরি হবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নতুন নতুন চাকরি। নিম্ন বা মধ্য দক্ষতার মতো ‘ব্লু বা হোয়াইট কলার জব’ শেষ হয়ে যাবে। তৈরি হবে উচ্চ দক্ষতার চাকরি। যার জন্য দরকার হবে উন্নততর প্রশিক্ষণ। ফলে, প্রোগ্রামিং, রোবোটিং, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হবে। সবাই যে চাকরি হারাবে তা কিন্তু নয়।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে চলা ড্রাইভারবিহীন গাড়ির ভবিষ্যৎ কী?
সানফ্রান্সিসকো শহরে চলছে ড্রাইভারহীন গাড়ি। চালকবিহীন রোবট্যাক্সি পরিষেবাগুলো এখন জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য চালু করা হয়েছে। যদিও বেশ সীমিত আকারে।
ক্রুজ মার্কিন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি জেনারেল মোটরসের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ওয়েমোর সঙ্গে। যেটা গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেটের মালিকানাধীন। ক্রুজের রোবট্যাক্সিগুলো গত জুন মাস থেকে ভাড়া খাটতে শুরু করেছে। এর ভাড়া উবার বা লিফটের থেকে একটু কম। ট্যাক্সির সামনে চালকের আসন খালি। স্টিয়ারিং হুইল একা একা ঘুরতে থাকে। গাড়ির ক্যামেরা, লেজার রশ্মির লিডার সিস্টেম এবং রাডার থেকে পাওয়া ডাটা ব্যবহার করে গাড়িটি চালায় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ এআই প্রযুক্তি।
অন্যান্য অনেক কোম্পানিও এ ধরনের চালকবিহীন গাড়ি চালু করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি নির্মাতা হুন্দাইয়ের সাপোর্ট নিয়ে কাজ করছে একটি কোম্পানি, নাম তার মোশনাল।
রাইড হেইলিং কোম্পানি উবার এবং লিফটের সাথে এর অংশীদারিত্ব রয়েছে। চলতি বছরেই লাস ভেগাসে তারা সীমিত আকারে এআই প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন ট্যাক্সি চালুর পরিকল্পনা করেছে।
এসব ট্যাক্সির ব্যবসায়িক দিক নিয়ে গবেষণা করেন যিনি, সেই হার্ভার্ড ল স্কুলের গবেষক অ্যাশলি নুনেস অবশ্য বলেন, (অটোনোমাস ট্যাক্সির) অর্থনীতি এখনও কল্পনার ওপর ভর করে চলছে। ইউনিভার্সিটি অব সানফ্রান্সিসকো স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক উইলিয়াম রিগস বলেন, রোবট্যাক্সির ব্যবসার সঠিক মডেলটি তৈরি করার কাজ বেশ ‘গুরুত্বপূর্ণ’ এবং এই মডেল তৈরি করা ‘প্রযুক্তির চেয়েও কঠিন’।
গত এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে অটোনোমাস ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রটিতে বারবার করে পরিবর্তন ঘটছে। আর এ পরিবর্তনের পেছনে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
ফিনিক্স শহরে ক্রুজ রাইড-হেইল ও ‘লাস্ট-মাইল’ অর্থাৎ ডেলিভারির শেষ ধাপে চালকবিহীন গাড়ির মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে মাল পৌঁছে দেয়ার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে, ওয়েমো দূরপাল্লার রুটের জন্য অটোনোমাস ট্রাক তৈরি করছে।
নুনেসের বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালে। কিন্তু তিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে সমস্যাগুলো দূর করা যায়নি। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, অটোনোমাস রাইড-হেইলিং সম্পর্কে অনেক আশার কথা বলা হলেও একে ব্যবসায়িক দিক থেকে এখনো লাভজনক করা যায়নি।
আমাদের মতো দেশে অবশ্য এখুনি আসার সম্ভাবনা কম।
চিন্তা করার ক্ষমতা হারাচ্ছে মানুষ!
হঠৎ যদি আপনার চিন্তা ভাবনা করার শক্তি হারিয়ে যায়! তবে কী হবে? বা ধরুন কোনও পরীক্ষায় উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা প্রশ্নগুলো বুঝতেই অক্ষম হচ্ছেন তবে কেমন মনে হবে? আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এমনটা কিন্তু হতে পারে! কেন মানুষের এই অবস্থা হতে চলেছে? জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা।
মার্কিন গবেষকরা জানিয়েছেন যে প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহারের ফলে মানুষের চিন্তাভাবনা ও বোঝার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এবং এক দশক বা তার কিছু সময় পরে মানুষের চিন্তা ভাবনা সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে।
আমেরিকার থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পিউ রিসার্চে এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় জানা যায় যে প্রযুক্তি নিজেই হয়ে উঠবে মানুষের মনের সবচেয়ে বড় শত্রু। মানুষ প্রযুক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়ার কারণেই এই ঘটনা ঘটবে।
গবেষণা প্রতিবেদনে গবেষকরা বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যা আজ মানুষের জন্য খুবই সুবিধাজনক বিষয় হিসেবে বিবেচিত এই এআই বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলেজেন্সই মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করবে।
পিউ রিসার্চের সমীক্ষা রিপোর্ট অনুসারে, মাত্র ১২ বছরের মধ্যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে খুব খারাপভাবে প্রভাবিত করবে এবং মানুষ যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম হবে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ মেশিন, সিস্টেম ও বটের ব্যবহার খুব দ্রুত বাড়বে। মানুষ তার ছোট-বড় জিনিসের জন্য তাদের ওপর নির্ভর করতে থাকবে এবং তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একেবারেই লোপ পেতে শুরু করবে।
স্বাস্থ্যসেবার পরিণতি
এখনকার দিনে কারও কোনও রোগ হলে সেটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য, তার জন্য কি ওষুধ প্রয়োজন, কীভাবে তার চিকিৎসা হওয়া উচিত সেই সব বিষয়গুলোর পিছনেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর অনেকটা ভূমিকা আছে। ভেবে দেখলে বিষয়টা অনেক পরিষ্কার হবে যে আগামীতে চিকিৎসকের তেমন ভুমিকা আর থাকবে না।
কি হতে পারে ভবিষ্যতে
১। Artificial intelligence in Bengali এর আসার ফলে সাধারণ মানুষের সবথেকে বেশী ক্ষতি হতে পারে। কারণ ভবিষ্যতে মানুষের বদলে হয়তো AI এর মাধ্যমে যে মেশিন বানানো হবে সেগুলো সব কাজ করবে। তাই তখন সাধারণ মানুষের কাজের কোনও দাম থাকবে না।
২। Artificial intelligence আসার ফলে আমরা মেশিনের উপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। আগে যখন কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হত, তখন ছাত্ররা বই থেকে তার উত্তর খুঁজে বের করত, তখন তাদের নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হত। কিন্তু এখন এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আসার পর কোনও উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা সবার আগে ফোন বা কম্পিউটারকে ব্যবহার করি। সেই উত্তর পেয়েও যায় ফলে এখানে আমাদের বুদ্ধি কোনও কাজেই লাগে না। দিনের পর দিন এরকম চলতে থাকায় একসময় মানব জাতি সম্পূর্ণ ভাবে মেশিনের উপরই নির্ভরশীল হয়ে যাবে না তো!
Comments