top of page

ভালোবাসার আর এক নাম শাড়ি... বিভিন্ন ধরনের প্রাদেশিক শাড়ি নিয়ে আলোচনায় মনোমিতা কুন্ডু...

"শাড়িতেই নারী" শুনতে একঘেয়ে লাগলেও একথা যে সর্বৈব সত্য তা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন! শাড়ি পড়তে ভালোবাসলেও দেশের বিভিন্নপ্রান্তের শাড়ির নাম এবং তা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য অনেকের কাছেই থাকেনা। আসমুদ্রহিমাচলের বিভিন্ন ধরনের শাড়ি নিয়ে আজ আমরা কথা বলবো।



প্রাদেশিক শাড়ি:


পশ্চিমবঙ্গ: জামদানী (মসলিন বা রেশম বা রেগুলার কটন বা সিল্ক), টাঙ্গাইল (সিল্ক বা কটন), বেগমপুরী, ধনেখালী, শান্তিপুরি (সিল্ক বা কটন), খেস, দোখনা, বালুচরি , স্বর্নচরি, প্রিন্টেড মূর্শীদাবাদি সিল্ক, বিষ্ণুপুরী সিল্ক, গাছি তসর, গরদ, মির্জাপুর সিল্ক, কাঁথাস্টিচ, পটচিত্র, মটকা, বাটিক।

সাথে বাংলাদেশের ঢাকাই জামদানি (মসলিন বা রেশম বা রেগুলার কটন বা সিল্ক), রাজশাহী সিল্ক।


ওড়িশা: সম্বলপুরি ইক্কত, বোমকাই, গঞ্জাম বমকাই, মনিবনধা, নুয়াপাটনা খান্ডুয়া , কোটপাড়, ডংরিয়া, বিচিত্রপুরী, পাশাপল্লী, পটচিত্র, ঢালাপাথার, হাবাসপুরি, গোপালপুর তসর, সাঁতালি শাড়ি, ফোড়া কুম্ভ, দোলাবেদী, ফিরবি বমকাই, বেরহামপুরী, সিমনই।


আসাম: মুগা, এড়ি, তস, পাট সিল্ক, মিশিং উইভ, বোরো উইভ, কেসা পাট, ননী কটন।


মনিপুর: মৈরাং ফি।


বিহার : বাওন বুটা, মধুবনী।


ঝাড়খন্ড : মধুবনী, ভাগলপুরী ঘিচা, দেশি তসর।


অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা: ধর্মাভরম, গাদওয়াল, পেদানা কলমকারী, পেন কলমকারী, মঙ্গলগিরি, ভেঙ্কটগিরি, পচমপল্লী (ডাবল ইক্কত, সিঙ্গল ইক্কত -টানা, ) পুটটা পাক্কা ইক্কত (সিঙ্গল ইক্কত -বানা,) নারায়নপেট, গোল্লাভামা, শ্রীকাকুলাম কটন বা পন্দ্রু কটন, উপারা, তেলিয়া রুমাল, রাজমুন্দ্রি কটন, বান্দার কটন, এছাড়াও মলখা, অহিংসা সিল্ক।




তামিলনাড়ু: করভাই কাঞ্জিভরম সিল্ক, কাঞ্চিপুরম সিল্ক, কাঞ্চিপুরম কটন , লক্ষাদীপম, আইরাম বুটটা ইত্যাদি ডিজাইন, চেটটিনার কটন, সুনগুড়ি মাদুরাই কটন, টোডা এমব্রয়ডারি, কোয়েমবাতুর সিল্ক, রাশিপুরম সিল্ক, তাঞ্জাভুর সিল্ক, তামিলনাড়ুতে সালেম সিল্ক, চিন্নাল্লাপাট্টি ইক্কত (কটন/ সিকো) তিরুভুবনম সিল্ক, আইয়াম্পেট্টাই, কান্দাঙ্গি শাড়ি।


কেরালা: কাসাভু বলরামপুরম , কাসরগড় শাড়ি, কুথামপল্লী সিল্ক, মুরাল পেন্টিং শাড়ি।


কর্ণাটক: মলকালমুরু, পত্তেদা অনছু, মাইসর সিল্ক, ইলকাল, কসুটি, হুবলি, গোমি তেনি, সুধা কারি, ব্যাঙ্গালোর সিল্ক, মাইসোর সিল্ক, লাম্বানি কাজ, ধোত্রা, উদুপি, যক্ষগণ।


কাশ্মির: পশমিনা কানি, সুজনি স্টিচ, আড়ি স্টিচ।


উত্তরপ্রদেশ: চিকনকারী, বেনারসি (বিভিন্ন প্রকার), বেনারস বালুচরি, তাঞ্চই, মুবারকপুর বেনারসি, ডুপিয়ন সিল্ক ।


মধ্যপ্রদেশ : চান্দেরি, মাহেশ্বরী, বাগ প্রিন্ট।


মহারাষ্ট্র : খুন, পৈঠানি , জিজামাতা, বিদর্ভ তসর কারভাটি কিনার, হিমরু, পুনেরি।


গোয়া: কুনবী।


ছত্রিশগড়: কোসা, ট্রাইবাল শাড়ি।


গুজরাট: রাজকোট পাটোলা, পাটান পাটোলা, ভুজরি, আজরাক প্রিন্ট, মডাল সিল্ক, গাজী সিল্ক, গুজরাট স্টিচ, আশাবলি, টাঙালিয়া, ঘারচোলা।


রাজস্থান: শিবরী , বা ট্রাডিশনাল লাহেরিয়া,বা বাঁধনী, কোটা, ব্লকপ্রিন্ট সাঙ্গনেরি, ডাবু প্রিন্ট, পিছওয়াই, বাগরু।


পাঞ্জাব: ফুলকারী।


এখানে লেখা শাড়ির মধ্যে নাগাল্যান্ড, অরুণাচল বা মেঘালয় বা হিমাচল ইত্যাদি জায়গার বুনন এর নাম আসেনি, কারণ ওগুলো সাধারণত শাড়ি হিসেবে আসেনা। এছাড়াও বুনন মেটেরিয়াল বা কাজের ভিত্তিতে আলাদা না করে একসাথেই লিখলাম। অনেক ক্ষেত্রে কম্বিনেশন ও হয় যেমন বিদর্ভ তসরে পটচিত্র বা সিল্কে ব্লকপ্রিন্ট অথবা কাঁথা। এছাড়া শিফন, জর্জেট , লিনেন আছে। দক্ষিণ ভারতের নানা জায়গায় ন হাতের শাড়ি আছে।


কটন কানজিভরম (প্লাস বুটটা মোটিফ):

প্লাস বুটির মোটিফ কিন্তু আসলে কাটটাম চেকস বোনবার সময় , ভুল করে তৈরি হওয়া এক মোটিফ যা পরবর্তীতে নিজেই আলাদা মোটিফ হিসেবে পরিচিত হয় ।


সিঙ্গলপ্লাই সিল্ক:


আমার ব্যক্তিগত মতামত, বাংলার পুরোনো শাড়ি গুলো হারিয়ে যাওয়ার একটা প্রধান কারণ শাড়ির মিহিবুনন। সুতি হোক বা সিল্ক মিহি সুতোর শাড়ি বুনতে বেশি সময় লাগে, আর বুননের সময় অনুযায়ী বাড়তে থাকে দাম। অথচ ফাইন সিঙ্গল প্লাই ফিনফিনে সিল্ক বেশি দামে কিনতে গেলে সাধারণ মানুষ ভাবেন যে তিনি বুঝি ঠকে গেলেন, তাই আজকাল সিঙ্গল প্লাই সিল্ক বিক্রি হতে বিশেষ দেখা যায়না। অথচ সিঙ্গল প্লাই সিল্ক আমার ব্যক্তিগত ভাবে বিশেষ পছন্দ। বেশ কয়েক বছর আগে শান্তিপুরের তাঁতিদের হাতে বাংলার প্রাচীন রাজশাহী সিল্ক থেকে ইন্সপায়ার্ড সিঙ্গল প্লাই সিল্ক রিভাইভালের কথা শুনেই বিশ্ববাংলায় দৌড়েছিলাম। তবে কেনার পরেও পরা হয়নি বহুদিন। শেষে এই নববর্ষের সন্ধ্যায় সেই শাড়ি পড়ার সৌভাগ্য হলো। এত মিহি আর নরম সিল্ক আমি কোনদিন পরিনি সত্যি। শাড়িটা এত নরম আর যেভাবে হাতের মুঠোয় এসে যায় যে পরতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। কিন্তু এই গরমে সিল্ক পরতে চাইলে এর থেকে ভালো কিছু হতেই পারেনা।

ধনেখালী:


যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করো, বাংলার কোন বুনন আমার সবথেকে প্রিয়, আমার উত্তর জামদানি বা বালুচরী হবেনা , আমার উত্তর হবে ধনেখালী। ধনেখালি কোনো রাজকীয় শাড়ি নয়, সাধারণ মানুষের জন্য বোনা শাড়ি। ছোটবেলায়, মধ্যবিত্ত পরিবারে আমাদের মায়েদের যে শাড়ি সবথেকে বেশি পরতে দেখেছি, তা হল ধনেখালি শাড়ি। এই মোটা সুতির শাড়ি আমাকে যেন মায়ের মমতায় জড়িয়ে রাখে। আমার কাছে ধনেখালি ভালোবাসার বুনন।

ধনেখালি শাড়ির মধ্যে মাছ অন্যতম জনপ্রিয় মোটিফ। আমি যে ধনেখালিটি পরেছি, সেখানে পাড়ে মাছের মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে একটু নতুন ভাবে। ইয়েলো অকার শাড়িতে ওয়াইন রঙা মাছের সারি, পাড়ের শেষ লাইনের একটু উপরে।


হ্যান্ডলুম:


হ্যান্ডলুম মানেই খুব দামি শাড়ি এমনটা নয়। এটা তেমনি একটা শাড়ি। কিছু ভালো হ্যান্ডলুম শাড়ির দাম আমাদের আপাত দৃষ্টিতে বেশি লাগার কারণ গুলো হলো, পিওর মেটেরিয়াল এর দাম এবং বুনতে সময় লাগার জন্য উইভার এর মজুরি । যদি হিসেব করে দেখেন তো দেখবেন, একটা শাড়ি বুনতে কত সময় লেগেছে, সেই সময়কে দিনে অন্তত সাড়ে তিনশ টাকা (জানিনা এই দৈনিক মজুরি টুকুও সাধারণ তাঁতিরা আদৌ পান কিনা, যদিও এটা আমি খুব কম করেই ধরে নিলাম, বিশেষজ্ঞ তাঁতি দের মজুরি আরো বেশি হবার কথা) দিয়ে গুন করে তার সাথে সুতোর দাম, রং করানোর খরচ, অন্যান্য খরচ ইত্যাদি যোগ করুন। বুঝে যাবেন, শাড়ির দাম বিক্রেতা আদৌ খুব বেশি রাখছেন নাকি স্বাভাবিক। আমি বিশেষজ্ঞ নই, তবে কেনার সময় কিছু স্বাভাবিক ব্যাপার একটু ভাবার চেষ্টা করি। এই ভাবে হিসেব করলে বহু জায়গায় হ্যান্ডলুম বলে বিক্রি হওয়া সিল্ক যে আদতে হ্যান্ডলুম ই না বা পিওর মেটেরিয়াল না , সেটাও আপনি বুঝে যাবেন। আজকাল বার্ন টেস্ট দিয়েও সবসময় সিল্ক বোঝা যাচ্ছেনা। আমি নিজেই দুবার বোকা বনে গেছি। কিন্তু হালকা সন্দেহ ছিল বলে পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি যে শুধু বার্ন টেস্ট না, সিল্ক এর শাড়ির ওজন এবং দাম হিসেব করেও ক্রসচেক করতে হয়।



টাঙ্গালিয়া:

গুজরাটের সৌরাস্ট্রের 700 বছরেরও পুরোনো GI tag প্রাপ্ত বুনন পদ্ধতি।খুব ই কম পরিমানে বোনা হয় । এই ডট এর মত সাদা নকশা গুলো তৈরি হয় হাতে। আর সময় লাগে অনেক। টানা র সুতোর সাথে অন্য রঙের সুতোর গিঁট দিয়ে ,তারপরে বুনে তৈরি হয় এই নকশা। আগে এই নকশা তৈরি হতো শালে। এখন শাড়ি ও হয়। এই শাড়ি গুলো পরিনা বেশি। একটু বের করে হাত বুলিয়ে রেখে দিই।


কাসারগর:

শাড়ির নাম কাসারগড় শাড়ি। কেরালার উত্তরের কাসারগড় গ্রামে বোনা হয় এই শাড়ি । শাড়ির বৈশিষ্ট্য মূলত তার স্থায়িত্ব আর পাড়ের সুন্দর নকশা। কেরালার শাড়ি হলেও শাড়িটি কর্নাটকের স্টাইলে ইনফ্লুয়েন্সড। তাই অনেকেই কাল কর্নাটকের অনেক শাড়ির নাম বলেছিলেন, তবে ডিজাইনে সাযুজ্য থাকলেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য র জন্য এই শাড়ি কর্নাটকের বাকি শাড়িগুলোর থেকে আলাদা। শাড়িটি GI tag পেয়েছে 2009 সালে । দাম আমাদের রাজ্যের সাধারণ সুতির শাড়ির মতোই, সুতোর কোয়ালিটি অনুযায়ী একটু হেরফের হয় দামে ।


মসলিন:

একটি আংটির মধ্যে দিয়ে গলে যেতো বাংলার মসলিন শাড়ি। মসলিন আসলে ভীষণ পাতলা ও মিহি একপ্রকার সুতির শাড়ি।এই শাড়িকে আলাদা ভাবে শুধু বাংলাদেশ বা শুধু পশ্চিমবঙ্গের শাড়ি বলা যায়না। এই শিল্পের সাথে জুড়ে আছে অবিভক্ত বাংলার নাম। বাংলার যে তুলো থেকে মসলিন তৈরি হতো তার নাম ফুটি কাপাস। বাংলার ইতিহাসে 1000 কাউন্ট পর্যন্ত মিহি মসলিন সুতির কথা জানা যায়। রাজা মহারাজার জন্য তৈরি হওয়া মসলিনকে 'মলমল-এ-খাস' ও বলা হতো। মসলিনের সুতো খুব মিহি হবার কারণে বুননের জন্য সময় অনেক বেশি লাগে, প্রায় 6 থেকে 7 মাস লাগে একটি শাড়ি বুনতে। ব্রিটিশ আমলে হারিয়ে যাওয়া মসলিন শিল্প আবার পুনর্জীবিত হয়েছে দুই বাংলার গবেষক আর শিল্পীদের হাত ধরে। বর্তমানে মূলত দক্ষিণ ভারতের সুভিন তুলো থেকে মসলিন বানানো হয়, আর প্রায় 500 কাউন্ট অবধি মিহি মসলিন আবার তৈরি হওয়া সম্ভব হয়েছে।


ইক্কত:

ইক্কত একটা টাই এন্ড ডাই এর মাধ্যমে ডিজাইন তৈরি করে বুনন পদ্ধতি। ইক্কত অনেক রকম হয়। সিঙ্গল , ডাবল , সিঙ্গল এর মধ্যেও টানায় ইক্কত বা বানায় ইক্কত দুরকম হয়। পচমপল্লী, সম্বলপুরী, পাটোলা সবই ইক্কত , । এবার আসি, শাড়ি গুলোর নামে, পচম পল্লী ইক্কত তৈরি হয় অন্ধ্র তে। কিন্তু এছাড়াও ইক্কত বহু জায়গায় হয়। এমনকি বাংলার একটি উইভিং ক্লাস্টার ও বহুদিন ধরে সিঙ্গল ইক্কত করেন। নাম বললাম না। উড়িষ্যার শাড়িতে ইক্কত এর ব্যবহার বহুল। যার মধ্যে খান্দুয়া আর সম্বলপুরী দুরকম শাড়ি আছে। পার্থক্য বুঝতে পারবেন জায়গা অনুযায়ী ডিজাইন এবং শাড়ির কোয়ালিটি সিল্ক বা কটন কোয়ালিটি আলাদা হয়। এবার আসি পাটোলা র কথায় পাটোলা ইক্কত হলেও বোনার পদ্ধতি একদম আলাদা। লুম ও অন্যান্য ইক্কত এর থেকে আলাদা। পাটোলা ও সিঙ্গল রাজকোট ও ডাবল পাটান পাটোলা হয়।


বালুচরি আজ বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে তৈরি হলেও এর জন্ম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ র নামাঙ্কিত মুর্শিদাবাদে। নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায় বেনারসের থেকে আসা তাঁতীরা বেগম দের জন্য সৃস্টি করলেন বালুচরি। এই শাড়িতে কোনো জরি ছিলোনা। সম্ভবত বালুচরি শাড়ি মুর্শিদাবাদের অপেক্ষাকৃত পাতলা সিল্কে বোনা হতো বলেই এতে জড়ির ব্যবহার প্রচলিত হয়নি। বলা হয় পরবর্তী কালে বালুচর গ্রাম বন্যায় ডুবে যাওয়ার পর শিল্পীরা চলে এসেছিলেন বিষ্ণুপুরে। বিষ্ণুপুরে নতুন করে শুরু হয় বালুচরি র বুনন, নতুন আঙ্গিকে। তবে মুর্শিদাবাদের বালুচরি র মতো জালা পদ্ধতিতে বোনা হতোনা বিষ্ণুপুরের বালুচরি। এটি জ্যাকার্ডে বোনা হতো। বিষ্ণুপুরের বালুচরিতেই প্রথম মোঘল কলকার বদলে ফুটে ওঠে রামায়ন মহাভারতের গল্প।

অন্য দিকে বেনারসের তাঁতী কাল্লু হাফিজের পরিবারের হাত ধরে আজও বেনারসে তৈরি হয়ে চলেছে মুর্শিদাবাদের নকশা আর সাবেকি জালা পদ্ধতিতে তৈরি বালুচরি র কাজ।

Comments


Rojkar Ananya New Logo copy.jpg

Your key stats for the last 30 days

Follow us on

fb png.png

©2023 to Debi Pranam. All Rights Reserved

bottom of page