top of page
Search

প্রবাসে পুজো আর একমুঠো নস্টালজিয়া, শারদ পূর্ণিমায় কোজাগরীর আহ্বানে, সত্যজিতের ছবির রাজনীতি..

প্রবাসে পুজো আর একমুঠো নস্টালজিয়া...

তাঁরা দেশের বাইরে থাকলেও পুজোর সময়টা মন পড়ে থাকে পাড়ার পুজোতেই। ভোররাতে উঠে মহালয়াতে চন্ডিপাঠ শোনা, ঠাকুর আনতে যাওয়া, কলা বৌ আসলে কার বৌ এই নিয়ে তর্ক বিতর্ক, পাটভাঙ্গা শাড়ি কিম্বা নতুন পাঞ্জাবি পড়ে অষ্টমিতে অঞ্জলি শেষে পাতপেড়ে ভোগ খাওয়া, ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে রাত জেগে প্যান্ডেল হপিং আর রোজরোজ চারবেলা ফাটিয়ে খাওয়াদাওয়া। এসব ছেড়ে থাকতে কার'ই বা ভালো লাগে! অগত্যা বিদেশেই একটুকরো নিজের পাড়া বানিয়ে নিজেদের মতো করে পুজো কাটানো। বোধন থেকে বিসর্জন সব'ই থাকে তাতে। আর পাতে কি থাকে রইলো তার ছোট্ট ঝলক। রাঁধলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বঙ্গতনয়ারা।


তীর্না বক্সী

লাক্সেমবার্গ


চিংড়ি মালাইকারি

কী কী লাগবে

চিংড়ি মাছ ৫০০ গ্রাম, নুন স্বাদ মতো, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো ১ চা চামচ, Shalimar's সাদা তেল ৪ টেবিল চামচ, ঘি ১-১ চা চামচ, শুকনো লঙ্কা ১ টা, তেজপাতা ১ টা, গোটা গরমমশলা (লবঙ্গ, দারচিনি, এলাচ), পেঁয়াজ বাটা ২ টেবিল চামচ, Shalimar's কাশ্মীরী লঙ্কা গুঁড়ো ১ চা চামচ, আদাবাটা ১ চা চামচ, চিনি স্বাদমতো, নারকেলের দুধ ১ কাপ, ফেটানো টকদই ১ টেবিল চামচ, Shalimar's গরমমশলা গুঁড়ো ১ চা চামচ।

কীভাবে বানাবেন

চিংড়ি মাছ নুন হলুদ মেখে ভেজে তুলে নিন। ওই তেলে একটু ঘি দিয়ে একে একে পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, নুন, হলুদ গুঁড়ো, চিনি, কাশ্মীরী লঙ্কা গুঁড়ো, টকদই দিয়ে কষুন। ভাজা চিংড়ি দিয়ে আরও কিছুক্ষণ কষে নারকেলের দুধ দিয়ে ফুটতে দিন। ঘি গরমমশলা গুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে পরিবেশন করুন গরম ভাতের সঙ্গে।

চিকেন রেজালা


কী কী লাগবে

মুরগীর মাংস ৫০০ গ্রাম, টকদই ২ টেবিল চামচ, আদা রসুন বাটা ১ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ বাটা ২ টেবিল চামচ, সাদা গোলমরিচ গুঁড়ো ১ চা চামচ, কাঁচালঙ্কা বাটা ১ চা চামচ, জায়ফল জয়িত্রী গুঁড়ো ১ চা চামচ, নুন স্বাদ মতো, Shalimar's সাদা তেল পরিমাণ মতো, কাজুবাদাম ৮-১০টা, পোস্ত ২ টেবিল চামচ, গোটা গরমমশলা (এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি), শুকনো লঙ্কা ২ টি, গোলাপ জল ১ চা চামচ, কেওরা জল ১ চা চামচ, বেরেস্তা পরিমাণ মতো।

কীভাবে বানাবেন

মাংস, টকদই, আদা রসুন বাটা, পেঁয়াজ বাটা, নুন, সাদা গোলমরিচ গুঁড়ো, কাঁচালঙ্কা বাটা, জায়ফল জয়িত্রী গুঁড়ো আর অল্প সাদা তেল একসঙ্গে মেখে ২-৩ ঘন্টা রাখুন। কড়াইতে তেল গরম করে শুকনো লঙ্কা আর গোট গরম মশলা ফোড়ন দিয়ে মেখে রাখা মাংস দিয়ে ঢেকে রান্না করুন। মাংস সেদ্ধ হলে পোস্ত আর কাজুবাদাম বাটা মেশান। নামানোর আগে গোলাপ জল আর কেওরা জল দিন। ওপরে বেরেস্তা ছড়িয়ে ইচ্ছে মতো সাজিয়ে পোলাও, নান বা পরোটার সঙ্গে পরিবেশন করুন।


দীপশিখা নাগ

সাউথ কোরিয়া

ডাবল ডিমের রোল

কী কী লাগবে

দেড় কাপ ময়দা, ৩ চা চামচ Shalimar's সাদা তেল, স্বাদ মতো নুন, ১ কাপ, জল, ১ টা মাঝারি মাপের গাজর কুচানো, ১ টা মাঝারি মাপের শশা কুচানো, ১ টা মাঝারি পেঁয়াজ কুচানো, ১ টা লেবুর চার ভাগের এক ভাগ, গোলমরিচ গুঁড়ো সামান্য, ৮ চামচ টমেটো সস, ২ চা চামচ হট চিলি সস্, ২ চামচ সুইট চিলি সস, ১ চামচ মাখন, ১ টা লম্বা কুচানো, ২ চামচ Shalimar's লঙ্কা গুঁড়ো, ৪ টে ডিম, বাটার পেপার।

কীভাবে বানাবেন

ময়দা, নুন, সাদা তেল ও পরিমাণ মতো জল একসাথে মেখে ঢেকে রাখুন ১ ঘন্টা। লেচি কেটে একটু মোটা করে বেলে পরোটাগুলো ভেজে তুলে নিন। নুন, লঙ্কা গুঁড়ো, ডিম একসাথে ফেটিয়ে প্যানে তেল দিয়ে ঢেলে ওপরে পরোটা চাপা দিয়ে উল্টে পাল্টে ভেজে তুলে নিন। এবার শশা কুচি, গাজর কুচি, পেঁয়াজ কুচি, কাঁচালঙ্কা কুচি, লেবুর রস, সবরকম সস ছড়িয়ে বাটার পেপার দিয়ে মুড়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।

ল্যাম্ব কারি

কী কী লাগবে

ল্যাম্ব ৫০০ গ্রাম, ২ টো বড় সাইজের হালু ৪ টুকরো করা, ২ টো পেঁয়াজ কুচানো, আদা-রসুন বাটা ৪ চা চামচ, ২ চা চামচ Shalimar's লঙ্কার গুঁড়ো, দেড়টা চামচ Shalimar's কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো, Shalimar's জিরে গুঁড়ো ১ টেবিল চামচ, Shalimar's ধনে গুঁড়ো ১ টেবিল চামচ, নুন স্বাদ মতো, Shalimar's সর্ষের তেল ৪ চা চামচ, সামান্য চিনি লবঙ্গ ৪ টে, দারচিনি ২ টো, এলাচ ৪ টে, তেজপতা ২ টো, গোলমরিচ ৮ টা, ঘি ১/ চামচ, গরম মশলা বাটা (লবঙ্গ ২ টো, দারচিনি ১ টা, এলাচ ২ টো, দই ১ কাপ।

কীভাবে বানাবেন

প্রথমে মাংস, নুন, হলুদ, লঙ্কাগুঁয়ে, কাশ্মীরি লঙ্কাগুঁড়ো, আদা রসুন বাটা, জিরে গুঁড়ো, ধন গুঁড়ো, সামান্য নুন। দিয়ে ফেটানো টক দই, ৩ চা চ্যাচে তেল দিয়ে ভালো করে ম্যারিনেট করে ঢাকা দিয়েফ্রজে আধ ঘন্টা রেখে দিতে হবে। তেল গরম করে ন হলুদ দিয়ে আলু ভেজে তুলে নিন। ওই তেলে তেজপাতা গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিয়ে মেখে রাখা মাংস দিয়ে কষুন। ভাজা আলু আর পরিমাণ মতো জল দিয়ে ফুটতে দিন। বেশ মাখামাখা হলে ঘি গরমমশল বাটা মিশিয়ে নামিয়ে নিন। পোলাও এর সাথে ভালো লাগবে।

অর্পিতা ঢোল

নিউজিল্যান্ড


ফিস ফ্রাই

কী কী লাগবে

বাসা অথবা ভেটকি ফিলে ১০ টুকরো, ব্রেড ক্রাম্ব পরিমাণ মতো, লেবুর রস ১ চা চামচ, নুন স্বাদ মতো, Shalimar's লঙ্কা গুঁড়ো ১ চা চামচ ধনেপাতা বাটা ১ চা চামচ, কাঁচালঙ্কা বাটা ১ চা চামচ, চাট মসলা ১ চা চামচ, ময়দা ২ টেবিল চামচ, কর্ণফ্লাওয়ার ২ টেবিল চামচ বেকিং পাউডার/ চা চামচ, ডিম ২ টি, আদা রসুন বাটা ১ চা চামচ, ভাজার জন্য Shalimar's সাদা তেল


কীভাবে বানাবেন

মাছের ফিলেগুলো নুন, লেবুর রস, ধনেপাতা বাটা, কাঁচালঙ্কা বাটা, লঙ্কা গুঁড়ো, চাটমশলা, আদা রসুন বাটা, নুন

একসাথে সেয়ে আসুন ১-২ ঘন্টা। একটি পাত্রে ব্রেড ক্রাম্ব রাখুন। অন্য একটি পাত্রে ডিম, ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার, বেকিং পাউডার ফেটিয়ে রাখুন। মায়ের কীভাবে বানাবেন মিলেগুলো ডিমের গোলায় ডুবিয়ে ব্রেড ক্রাম্ব এ গড়িয়ে নিন। একইভাবে ডাবল কোর্ট করে নিন। ডুবো তেলে সোনালী করে ভেজে সব ও সালাড সহ পরিবেশন করুন।

পাঁঠার মাংসের ঝোল

কী কী লাগবে

পাঁঠার মাংস ৫০০ গ্রাম, আলু ৬ টুকরো, টকদই ২ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ বাটা ৪ টেবিল চামচ, আদা রসুন বাটা ২ টেবিল চামচ, নুন স্বাদ মতো, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো ১ টেবিল চামচ, Shalimar's লঙ্কা গুঁড়ো ২ চা চামচ, Shalimar's জিরে গুঁড়ো ১ চা চামচ, গোটা জিরে তেজপাতা শুকনো লঙ্কা ফোড়নের জন্য, গরমমশলা বাটা ১ চা চামচ, Shalimar's সরষের তেল ১ কাপ, ঘি ২ চা চামচ।

কীভাবে বানাবেন

মাংস, পেঁয়াজ বাটা, আদা রসুন বাটা, টকদই, নুন, হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো মেখে রাখুন সারারাত। তেলে আলুগুলো নুন হলুদ দিয়ে ভেজে তুলে নিন। ফোড়ন দিয়ে মেখে রাখা মাংস দিয়ে কষুন। অল্প গরম জল আর ভাজা আলু দিয়ে ঢেকে রান্না করুন। যি গরমমশলা বাটা মিশিয়ে নামিয়ে লুচি, পরোটা বা ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।

বিদীশা মহাজন

মেলবোর্ন


মালপোয়া

কী কী লাগবে

ময়দা ১ কাপ, সুজি, কাপ, চিনি ১/ কাপ, ঘন দুধ ২০০ গ্রাম, সবুজ এলাচ গুঁড়ো। চা চামচ, মৌরি / চা চামচ, ঘি অথবা Shalimar's সাদা তেল ভাজার জন্য, ১ কাপ চিনি, ১ কাপ জল সাজানোর জন্য শুকনো গোলাপের পাপড়ি, বাদাম।


কীভাবে বানাবেন

দুধ জ্বাল দিয়ে তাতে একে একে সব উপকরণ মিশিয়ে ঘন্টাখানেক রাখুন। চিনি আর জল জ্বাল দিয়ে সিরা বানিয়ে রাখুন। তেল অথবা ঘি গরম করে মিশ্রন এক হাতা করে নিয়ে মালপোয়াগুলো ভেজে তুলে চিনির রসে ডুবিয়ে তুলে নিন। শুকনো গোলাপের পাপড়ি আর বাদাম ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।

বাসন্তী পোলাও

কী কী লাগবে

গোবিন্দভোগ চাল ১০০ গ্রাম, তেজপাতা ১টা, লবঙ্গ ৩-৪ টে দারচিনি ১ ইঞ্চি, এলাচ ৩ টে. কাজুবাদাম ১০-১২টা, কিশমিশ ১০- ১২ টা, গরম জল ২ কাপ, চিনি ৪ টেবিল চামচ, কেশর ১ চিমটে।


কীভাবে বানাবেন

চাল ভালভাবে ধুয়ে আধ ঘন্টার মত ভিজিয়ে রাখুন। একটি প্যানে ঘি গরম করে কাজুবাদাম, কিশমিশ বাদামি করে ভেজে তুলে রাখুন। এরপর ওই ঘিতে লবঙ্গ দারচিনি, এলাচ, তেজপাতা দিয়ে অল্প নেড়ে ভিজিয়ে জল ঝরানো চাল, নুন, চিনি, কেশর আর গরম। জল দিয়ে ঢেকে রান্না করুন। চাল সেদ্ধ হলে ভাজা কাজুবাদাম কিশমিশ মিশিয়ে নামিয়ে নিন। মাছের কোরমা কালিয়া অথবা কষা মাংস সবকিছুর সাথেই ভালো লাগবে।

প্রিয়াঙ্কা মন্ডল

ক্যালিফোর্নিয়া


ইলিশ পাতুরি

কী কী লাগবে

ইলিশ মাছ ৬ টুকরো, পোস্ত ১ চামচ, সাদা কালো সরষে ১ চামচ, নারকেল কোরা আধ কাপ কাঁচালঙ্কা ৫-৬ টা, নুন স্বাদ মতে, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো ১ চা চামচ, চিনি ১ চামচ, Shalimar's সরষের তেল ৪ টেবিল চামচ কালোজিরা ১ চা চামচ, কলাপাতা।


কীভাবে বানাবেন

পোস্ত, সরষে, নারকেল কোরা একসাথে মিহি করে বেটে নুন, চিনি, কালোজিরা, হলুদ গুঁড়ো, সরষের তেল একসঙ্গে মিশিয়ে একটি মিশ্রণ বানিয়ে রাখুন। কলাপাতায় তেল মাখিয়ে অল্প করে এই মিশ্রন, তার উপরে মাছ আবারও একটু মশলার মিশ্রন রেখে ওপরে একটা করে গোটা কাঁচালঙ্কা আর একটু তেল দিয়ে কলাপাতা মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে নিন। ননস্টিক প্যানে গরম তেলে উল্টে পাল্টে ভেজে তুলে নিলেই তৈরী।

কলাপাতায় ভাজা মৌরলা

কী কী লাগবে

মৌরলা মাছ ২০০ গ্রাম, নুন স্বাদ মতো, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো ১ চা চামচ, পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ, রসুন কুচি ১ চা চামচ, কাঁচালঙ্কা কুচি ১ চা চামচ, ধনেপাতা কুচি ১ টেবিল চামচ, Shalimar's লঙ্কা গুঁড়ো ১ চা চামচ, Shalimar's জিরে গুঁড়ো ১ চা চামচ, কুচোনো আলু ১ কাপ, কালোজিরা চা চামচ, কলাপাতা।


কীভাবে বানাবেন

একটি বড় পাত্রে একে একে সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে রাখুন। কলাপাতায় তেল মাখিয়ে মিশ্রন। সমানভাবে ছড়িয়ে তেল মাখানো ননস্টিক প্যানে বসিয়ে অল্প আঁচে রান্না করুন। একদিক হয়ে গেলে উল্টে দিন। বেশ লাল করে ভাজতে হবে। গরমভাতের সাথে ভালো লাগবে।

 

শারদ পূর্নিমায় কোজাগরীর আহ্বানে...

সুস্মিতা মিত্র

পুজোর প্রায় মাসখানেক আগে কোনো এক শনিবার স্কুলে যাওয়ার সময় শুনতাম, বাড়িতে ফিরে আজ বিকেলে আমরা পুজোর কেনাকাটা করতে যাবো। উত্তেজনায় পড়ালেখা মাথায় উঠতো। ততদিনে স্কুলের বন্ধুদের আলোচনা করে ট্রেন্ডিং জিনিসপত্রের লিস্ট'ও একেবারে তৈরী। ব্যস, আর কি! তারপর কেনাকাটা, স্টুডিও তে ছবি তোলা আর পছন্দের খাওয়া-দাওয়া। এ যেন সব পেয়েছির আসর। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শেষে পঞ্চমীর দিন নতুন জামা পড়ে স্কুল যেতাম সবাই, ওইদিন থেকে ছুটি পড়বে। লাল ফিতে দিয়ে বাধা দুটো ঝুটির বদলে রঙবেরঙের হেয়ারব্যান্ড ক্লিপ, সাদা মোজা কেডস জুতোর বদলে ম্যাচিং নতুন জুতো। এক ইঞ্চি এদিক ওদিক হলে বকুনির বন্যা বইয়ে, কান ধরে দাড় করিয়ে, বাড়িতে চিঠি পাঠানো দিদিমনিদের মুখেও হাসি হাসি ভাব। কারন সবারই তো ছুটি পড়বে, খুলবে সেই ভাইফোঁটার পর। সেদিনের মেজাজ টাই আলাদা।

রানাঘাটের মতো মফঃস্বলে দুর্গাপুজো নিয়ে এখনকার মতো অতটাও মাতামাতি ছিলো না তখন। মহালয়ার ভোরে চন্ডীপাঠ শোনা, পঞ্চমীতে ঠাকুর আনতে যাওয়া, অস্টমীতে পাড়ার পুজো মন্ডপে অঞ্জলী আর দশমীতে চূর্নীতে প্রতিমা বিসর্জন। বাকি সময়টা পুজো সংখ্যায় মুখ গুঁজে কাটিয়ে দেওয়া আর চারবেলা ভালোমন্দ খাওয়া। আমার কাছে পুজো মানে ছিলো এই। ওহ হ্যাঁ, আরেকটা জিনিস হতো দশমীর সকালে। গোবরজলে নিকোনো উঠোনে তুলসী তলায় যাত্রাঘট পাতা হতো। পেতলের কুলোয় ধান, দূর্বা, সোনা রূপো খন্ড, ফুল বেলপাতার উপর মঙ্গলঘট পেতে পাশের রেকাবীতে রাখা হতো আঁশ ওয়ালা মাছ; জোড়া ইলিশ বা পুঁটি আর ডাঁটাওয়ালা জলপদ্ম। সন্ধ্যার পর প্রতিমা জলে পড়লে বড়দের প্রনাম সেরে ঐ কুলোর ধান দূর্বা মাথায় ছুঁইয়ে মিষ্টিমুখ করানো হতো। পরদিন থেকে তোড়জোড় শুরু হতো কোজাগরীর।


ছোট থেকে একটা গল্প শুনে এসেছি, দশমীতে বিসর্জন শেষে মা দুর্গা কৈলাশে ফিরে গেলেও লক্ষী থেকে যান আগামী পূর্নিমা পর্যন্ত। বাড়ির সামনে কচুগাছের নীচে অপেক্ষা করেন পাঁচদিন। যে বাড়ির পরিবেশে, মানুষের স্বভাবে, চরিত্রে শ্রী থাকে সেখানে তিনি অচলা হয়ে থেকে যান। তো গ্রামের দিকে অর্থনৈতিক অবস্থা যাদের যেমন'ই হোক না কেন, কোজাগরী পূর্ণিমায় পুজো প্রায় সব বাড়িতেই বেশ জাঁকজমক ভাবে হয়। একদিনে সব করা সম্ভব নয় বলে এই পাঁচদিন ধরে অল্প অল্প করে সব বানিয়ে রাখা হয়। গুড়, চিনি, নারকেল, সাদা তিল, বাদাম এসবের নাড়ু, ঢেকি ছাটা চিড়ের মোয়া, খইয়ের উপরা, তক্তি, ছাঁপ সন্দেশ, কুচো গজা, শুকনো বোঁদে আরও কত কি!

পুজোর দিন বানানো হতো খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েস, লুচি, সুজি, নারকেল দেওয়া এলোঝেলো। খিড়কি থেকে রাস্তার পাশের দরজা, তুলসীতলা, রান্নাঘরের চালের জায়গা, কলতলা সর্বত্র চাল বাটায় আঁকা হতো ধানের ছড়া, ধানের গোলা, প্যাঁচা, লক্ষীর পা। কুলুঙ্গি তে সন্ধ্যের পর জ্বালা হতো ঘিয়ের প্রদীপ। কাঠের পাটা বা জলচৌকিতে পদ্ম আর ধানের শিষের আলপনা দিয়ে কলাপাতা পেতে বসানো হতো প্রতিমা। সামনে পাঁচ রকমের ফল, আখ, পান সুপুরি, কড়ি আর জলপদ্ম। কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে ঘুমোতে নেই। রাত জেগে উঠোনে অখন্ড প্রদীপ জ্বেলে দেবীর আগমনের অপেক্ষা করতে হয়। পেচকের পিঠে চড়ে মধ্যরাতে দেবী প্রতিটি গৃহে আসেন, আর ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেন 'কো জাগতী?' অর্থাৎ কে জেগে আছো? যারা জেগে থাকেন দেবী তার ঝাঁপি উজার করে দেন তাদের জন্য, সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে তাদের জীবন।


"নিশীথে বরদা লক্ষীঃ জাগরত্তীতিভাষিনী।

তষ্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।।"


পূর্ববঙ্গীয় রীতি মেনে নানাবিধ রূপে দেবীর আরাধনা করা হয়। সাধারণত মাটির তৈরী ছাঁচে বা কাঠামো তে মূর্তি তৈরি করে পুজো করা হয়। কোথাও আবার কলার বাকলকে গোল করে মুড়ে নারকেলের নতুন কাঠি গুঁজে তার গায়ে সিঁদুরের স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে তারমধ্যে পঞ্চশষ্য, গঙ্গা মাটি ভর্তি করে ওপরে সশীষ ডাব রেখে লাল চেলি দিয়ে ঢেকে দেবীরূপে কল্পনা করে পুজো করা হয়। কোনো বাড়িতে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি গয়না পড়িয়ে সাথে সপ্ততরী রেখে পুজো করা হয়। সপ্ততরীতে থাকে সোনা রূপোর টাকা, কাঁচা টাকা, চাল ডাল, হলুদ, কড়ি, হরিতকি ইত্যাদি। মা লক্ষীর মুখ অঙ্কিত ঘটে চাল অথবা গঙ্গাজল ভর্তি করেও অনেক বাড়িতে পুজো করা হয়।

এছাড়াও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় জয়া বিজয়া, লক্ষী, দুর্গাপরিবার, মহিষাসুর মর্দিনী ইত্যাদি চিত্রায়িত করা পটচিত্রের পুজো হয়। জেলা অনুযায়ী ভোগের ধরন ও হয় আলাদা। সাধারণত ১৪ পদের ভোগ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও অনেকে নিরামিষ এবং আমিষ এই দুই রকম অন্নভোগ দেন। লুচি, মোহনভোগ, পাঁচ ভাজা আর তিনরকম নৈবেদ্য সহ শীতলভোগ ও দেওয়া হয় অনেক বাড়িতে। জোড়া ইলিশ আনার নিয়ম থাকে অনেকের। সেক্ষেত্রে মাছের মাথায় ধান দূর্বা সিঁদুর ছুইয়ে একপাশে রাখা হয়। পুজো শেষে উপোস ভেঙ্গে ঐ মাছের ফোড়ন ছাড়া সর্ষে বাটা ঝোল ভাত খেয়ে উপোস ভাঙ্গতে হয়। এই রীতির উদ্দেশ্য এই যে সারাজীবন যেন সিঁদুর মাথায় মাছভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। পরোক্ষভাবে নিজের জন্য নয়, স্বামী সন্তানের আরোগ্য এবং পরমায়ূ কামনা।


সবশেষে বলি, শুধুমাত্র ধন সম্পদ লাভের আশায় নয়, মানুষের মূলধন তার চরিত্র; সেই মুক্তি ধন প্রাপ্তির আশায় শারদ লক্ষীর বন্দনা করুন। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু পবিত্র, যা কিছু শ্রীযুক্ত তার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কোজাগরী লক্ষী। ঘরবাড়ি পরিস্কার করে, শুদ্ধ বসনে, শুদ্ধ চিত্তে দেবীর আরাধনা করুন। আত্মগ্লানী, চরিত্রের কলুষতা, অন্যের প্রতি হিংসা রাগ বিদ্বেষ ত্যাগ করলেই মা লক্ষী আপনার অন্তরে বাস করবেন। আর আপনার চেতনাকে জাগ্রত করে উন্নতির শিখরে পৌছে দেবে দেবীর বাহন সদাজাগ্রত পেঁচক। সবাই ভালো থাকবেন। কোজাগরী পূর্ণিমা সবার জীবন সুখ সমৃদ্ধিতে আলোকিত করুক।

 

সত্যজিতের ছবির রাজনীতি

চণ্ডী মুখোপাধ্যায়


সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল। এই তিনজনেই চলচ্চিত্র জগতে আসেন প্রায় একই সময়ে। মৃণাল এবং ঋত্বিকের সঙ্গে প্রথম থেকেই সরাসরি রাজনীতির সম্পর্ক ছিল। এই দু'জন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন গণনাট্যের সঙ্গে। বাংলার বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে ভাল রকমের যোগাযোগ ছিল তাঁদের সময়টা পাঁচের দশকের শুরু। সত্যজিৎ তখন ক্ল্যারিয়ন নামের বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরি করছেন। সিগনেট বুক-এর বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকছেন। আর নিয়মিত সিনেমাচর্চা করছেন। আর এই সিনেমাচর্চায় তাঁর সঙ্গীরা হলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, রাম হালদার প্রমুখেরা। চল্লিশের শেষে আটচল্লিশ সাল নাগাদ কলকাতায় ফিল্ম সোসাইটি স্থাপন করলেন তিনি এবং তাঁর এইসব বন্ধুরা। খানিক পরে মৃণাল সেনও অবশ্য এই 'ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি' নামের ফিল্ম ক্লাবের সদস্য হন।


এসব অবশ্য সাতের দশকের শেষের কথা। ১৯৪৮-তে ফিল্ম সোসাইটি তৈরি হয় কলকাতায়, ভারতে বোম্বাইতে প্রথম ফিল্ম সোসাইটি পত্তন হবার বছর পাঁচেক পর। কলকাতায় ধর্মতলা স্ট্রিটে 'কমলালয়' নামে এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স ছিল। সেখানেই ছিল রাম হালদারের বইয়ের দোকান। আর এরই লাগোয়া তিনি এক রিফ্রেশমেন্ট কর্নার নামে চায়ের ঠেক রাখেন। তার এই চায়ের ঠেকে জমায়েত হতেন কলকাতার তাবৎ বাম বুদ্ধিজীবী। যার মধ্যে সাহিত্যিক, লেখক, গায়ক, চলচ্চিত্রকার কেউই প্রায় বাদ ছিলেন না। সত্যজিৎ নিয়মিত এই বইয়ের দোকানে আসতেন। রেকর্ড শুনতেন এবং কিনতেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি তখন অমোঘ টান সত্যজিতের। তখন অফিসের টিফিন সময়ে সত্যজিৎদের আড্ডা ছিল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের ইন্ডিয়া কফি হাউসে। বেশিরভাগ আড্ডাটা হত সিনেমা-কেন্দ্রিক। সত্যজিৎ-ই প্রথম কমলালয়ের স্টোর্সের বইয়ের দোকানে বিদেশ থেকে সিনেমার বই আনান। ততদিনে কলকাতায় ফিল্ম সোসাইটি ভালভাবেই চলছে। এই ফিল্ম সোসাইটির জন্যে সত্যজিৎ যে বইগুলো আনান, তার মধ্যে ছিল আইজেনস্টাইনের

'ফিল্ম সেন্স' এবং 'ফিল্ম ফর্ম' ও পুডভকিনের 'ফিল্ম টেকনিক'। এই তিনটি বইয়ের পিছনেই রয়েছে রাজনৈতিক

চেতনা। পরবর্তী কালে অবশ্য তিনি ক্লাবের সাউন্ড' নামের চলচ্চিত্র পত্রিকাটি নিয়মিত আনাতে থাকেন। এটি ব্রিটিশ পত্রিকা হলেও এর সঙ্গে প্রথম থেকেই জড়িয়ে ছিলেন ব্রিটেনের বাম চলচ্চিত্র বুদ্ধিজীবীরাই। সত্যজিতের সুপারিশেই তো ফিল্ম ক্লাবে দেখানোর জন্যে নিয়ে আসা হল আইজেনস্টাইনের সরাসরি রাজনৈতিক ছবি 'ব্যাটলশিপ পোটেমকিন।'

ঋত্বিক প্রথম থেকেই রাজনৈতিক ছবিই করতে নামেন। মৃণাল তাঁর সিনেমা জীবনের শুরুর একটা বড় সময়েই টালিগঞ্জের মূলধারার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে চান। চারের দশকের শেষে সত্যজিৎ রায় এবং হরিসাধন দাশগুপ্ত মিলে সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনা করতে থাকেন। সত্যজিৎ প্রথম ছবি হিসেবে বেছে নেন রবীন্দ্রনাথের 'ঘরেবাইরে'। হরিসাধন বিশ্বভারতীর কাছ থেকে 'ঘরেবাইরে'-র সিনেমাস্বত্ব কিনলে সত্যজিৎ তাঁর চিত্রনাট্য লেখেন। 'ঘরেবাইরে' কোনও অর্থেই অরাজনৈতিক উপন্যাস নয়। স্বাধীনতার বছর তিনেকের মধ্যেই সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন সত্যজিতের চিত্রনাট্যের বিষয় হয়ে ওঠে। সেইসময় শেষ অবধি অবশ্য ছবিটি হয়ে ওঠে না, যদি হত সত্যজিতের প্রথম ছবির ভিত হত রাজনৈতিক। পরে তাঁর চলচ্চিত্র-জীবনের শেষের পর্যায়ে তিনি 'ঘরেবাইরে' নির্মাণ করেন। কিন্তু তখন ভারবর্ষের তথা বাংলার আর্থসামাজিক পরিবেশ অনেক পাল্টে গেছে। আগের চিত্রনাট্যে নয়, এই ছবির জন্যে আবার নতুন করে চিত্রনাট্য লেখেন তিনি। কলকাতায় ফিল্ম সোসাইটি তৈরির এক'দু বছরের মধ্যেই সত্যজিতের জীবনে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ আসে। সিনেমাসূত্রে নয়, চাকরির সূত্রে। 'ডি জি কিমার থেকে' সত্যজিৎ-কে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়।

অবশ্য এই কোম্পানিতে তিনি একমাসেরবেশি থাকেন না। এই প্রসঙ্গে তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, 'তবে ছ'মাসের জন্য গেলেও ওখানে একমাসও থাকিনি। গিয়ে দেখি, ওদের অফিস আমাদের কলকাতার অফিসের চেয়েও অনেক ছোটো- সে এক হাস্যকর ব্যাপার ! সেখানকার আর্ট ডিরেক্টর-এক মি. বল-আমি সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে ডিসকভার করলাম, আমার কাজগুলোকে তিনি নিজের বলে চালাচ্ছেন। দেন আই হ্যাড এ ভায়োলেন্ট রায়ট উইথ হিম অ্যান্ড আই লেফট। তারপর আমি ফর্ম আছে, নিজে বেনসন বলে একটা সেখানে আসি। চার মাস ঐ বেনসনে কাজ করলাম। তারপর একমাস আমরা ঘুরেছিলাম- আমি আর আমার স্ত্রী। জাস্ট বিয়ে করার কিছুদিন পরেই গিয়েছিলাম তো- প্যারিস, সাতদিন ভেনিসে ছিলাম, সাতদিন সালসবুর্গে ছিলাম।' সত্যজিৎ বিজয়াকে বিয়ে করেন '৪৯ সালের অক্টোবরে এবং তাঁরা বিদেশ যান '৫০ সালের এপ্রিলে। সেখানে গিয়ে সত্যজিৎ প্রথম যে কাজটি করেন, তা হল একটি ফিল্ম ক্লাবের সদস্য হয়ে যান। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে পাঁচ মাসে সেখানে প্রায় দেড়শো বিদেশি ছবি দেখে ফেলেন। বেশিরভাগ ছবিই ছিল ইউরোপের। এর আগে হলিউডের অনেক ছবিই তিনি দেখে নিয়েছিলেন কলকাতাতেই। যুদ্ধের সময় ও পরে কলকাতায় প্রচুর মার্কিনি ছবি আসত। তবে ইউরোপের ছবি তেমন সুযোগ ছিল না। ফিল্ম ক্লাবের সুবাদে কিছু কিছু ইউরোপের ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। সেই অভাবটা পূরণ হল লন্ডনে এসে। এখানে যেসব ছবি দেখেন তিনি তার মধ্যে একটা ছবি-- ভিত্তোরিয়া ডি সিকা'র 'বাইসাইকেল থিভস'। অনেকে বলেন এই ছবি সত্যজিতের 'পথের পাঁচালী' নির্মাণের প্রধান অনুপ্রেরণা। এই ছবি থেকে সত্যজিৎ নাকি শুধু শিক্ষা নেন কীভাবে অপেশাদার অভিনেতা- অভিনেত্রীদের নিয়ে স্টুডিও এড়িয়ে' কীভাবে কম বাজেটে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব। শুধু তাই কি? চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেছিলেন তিনি অনেক। আগেই, সেই শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন সময় থেকেই। তারই সম্প্রসারণ ঘটে।

কলকাতায় ফিল্ম ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর। বিদেশ থেকে ফিরে সত্যজিৎ রায় তো চলচ্চিত্রকার। 'পথের পাঁচালী' ছবির কাজ। শুরু করছেন। যার চিত্রনাট্যের খসড়া শুর করেছিলেন তিনি বিদেশ থেকে ফেরার সময় জাহাজেই। কলকাতায় ফিরেই যোগাযোগ করলেন নিমাই ঘোষের সঙ্গে তাঁকে দিয়েই 'পথের পাঁচালী' ছবির ক্যামেরা করাবেন বলে ভেবেছেন তিনি। কথাবার্তা খানিক এগোয়। কিন্তু শেষ অবধি ব্যাপারটা হয় না। নিমাই ঘোষ বায় হয়ে পড়েন তাঁর নিজের ছবি 'ছিন্নমূল'-এ সত্যজিৎ 'পথের পাঁচালী' সুব্রত মিত্র-কে ক্যামেরাম্যান করে সত্যজিৎ 'পথের পাঁচালী'-র কাজ শুরু করলেন। দেখা যাচ্ছে, সত্যজিৎ যখন তাঁর প্রথম ছবি নির্মাণে নামছেন তখন তাঁর আশপাশের বন্ধুরা প্রায় সকলেই বাম মনোভাবাপন্ন। ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনটাও সেই থেকে আজ অবধি বামদের দখলে। তবে মৃণাল বা ঋত্বিক যেমন স্বাধীনতার পর থেকেই সোচ্চারভাবে। বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, সেইভাবে কখনওই সত্যজিৎ জড়ান না। বরং তিনি সোচ্চার রাজনীতির জগৎ থেকে ক্রমশ নিজেকে সরিয়েই রাখতে থাকেন। বরং বলা ভাল, সম্পূর্ণভাবে প্রায় আত্মনিবেশ করেন নিজের চলচ্চিত্র- ভাবনায়। তাঁর প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালী বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট' হিসেবে পুরস্কৃত হয়।


শোনা যায়, কান চলচ্চিত্র উৎসবে যেদিন দেখানো হয় সেদিন দর্শকের আসনে ছিলেন ফরাসি নবতরঙ্গের পঞ্চপাণ্ডব-- জঁ লুক গোদার, ফ্রাসোয়াঁ ক্রফো, ক্লদ শ্যাব্রল, এরিক রোমার এবং রিভেট। এঁদের মধ্যে গোদার ছবিটির খানিকটা দেখেই প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে যান। ছবিটি তাঁর ভাল লাগছিল না। কিন্তু ক্রফোর ব্যক্তিগতভাবে ছবিটি ভাল লাগে। পরে অবশ্য ক্রফোর অনুরোধেই গোদার পুরো ছবিটি দেখেন। তখনও যে তাঁর খুব-একটা পছন্দ হয়েছিল, তা নয়। গোদারের পছন্দ হওয়ার কথাও নয়। কেননা 'পথের পাঁচালী' ছবিতে সেই অর্থে কোনও রাজনীতি নেই। গোদার প্রথম থেকেই রাজনৈতিক সিনেমায় বিশ্বাসী। আর ছাড়া হলিউডি ঘরানাকে তীব্র অপছন্দ গোদারের। গোদার ছবিতে টানা ন্যারেশন ও গল্প বলায় বিশ্বাসী নন। সত্যজিতের ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন। তিনি টানা ন্যারেশন এবং ছবিতে গল্প বলায় বিশ্বাসী। ডি সিকা'র 'বাইসাইকেল থিভস' থেকে যা তিনি শিক্ষা নেন, তা হল কম বাজেট, স্টুডিওর বাইরে শুটিং এবং অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী। কিন্তু ছবির আঙ্গিকের ব্যাপারে তিনি প্রথম ছবি থেকেই তিনি ইউরোপীয় চিন্তায় নয় বরং হলিউডের দিকেই ঝুঁকলেন। আঙ্গিকগত কোনও কায়দাকানুন না-করে টানা গল্প বললেন। যার আদি-অন্ত মধ্য-নিজস্ব ক্রমেই আছে। কিন্তু গোদার যেরকম বলেন কী-- সেইরকম নয়। গোদার বলেন, তাঁর ছবিতে আদি, মধ্য, অন্ত-- আছে কিন্তু নট হওয়া ইন অর্ডার।

প্রশ্নেরও উত্তর দেন সত্যজিৎ, 'রাজনৈতিক চেতনা বলতে রাজনীতি যারা করে তাদের ব্যর্থতার চেতনাও হতে পারে- যা ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এখন। রাজনীতি সম্বন্ধে একটা ডিসিলিউশনমেন্ট ছাড়া আর কিছু 'পথের পাঁচালী'কে মানবিক ছবি বলে চিহ্নিত করল কান। কিন্তু মানবিকতা কি রাজনীতির অংশ নয়। সত্যজিতের রাজনৈতিক ভাবনাকে ধরতে হলে এইখান থেকেই শুরু করা দরকার। ১৯৬৯ সালে 'কলকাতা' পত্রিকাকে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কখনও সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছেন কিনা? কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর কি কোনও সম্পর্ক ছিল? সত্যজিতের উত্তর, 'না করিনি। তবে আমার অধিকাংশ বন্ধু বামপন্থী।' শিল্পীর রাজনৈতিক চেতনা থাকা উচিত কিনা? থাকলে কতদূর থাক উচিত? রাজনৈতিক চেতনা ছাড়া কি শিল্প সৃষ্টি সম্ভব? এই হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ইন জেনারাল, রাজনীতি বলতে আমরা যেটা বুঝি এবং রাজনীতি যারা করছে সে সব লোকের চেহারা আমরা প্রায়ই দেখি আর আমার মনে হয় আশেপাশে কী ঘটছে সে সম্বন্ধে ভীষনভাবে সচেতন দরকার।'

সেইসময় চল্লিশের শেষে এবং পঞ্চাশের শুরুতে রাজনীতির জগৎ থেকে নিজেকে দূরেই সরিয়ে রাখতে চাইছেন সত্যজিৎ। কেন রাজনীতি থেকে তিনি দূরে থাকতে চাইছেন, সেটাও স্পষ্ট করে দিচ্ছেন এই সাক্ষাৎকারে। আর এই সময়ই তো সিনেমার জগতে ঢুকে পড়তে চাইছেন তিনি। কিন্তু 'ঘরে বাইরে' ছবির জন্যে সেইসময় তিনি যে-চিত্রনাট্য লেখেন সেটা প্রকাশ্যে দেখা সুযোগ হয়নি কারুরই কিন্তু আন্দাজ করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় সেই চিত্রনাট্যে বাম রাজনীতি না-থাকলে স্বদেশিকতার রাজনীতি নিশ্চয়ই ছিল। 'পথের পাঁচালী'র প্রায় ৩০ বছর পরে সত্যজিৎ আবার ফিরে আসেন 'ঘরে বাইরে'-তে। ১৯৮৪। ইতিমধ্যে তিনি চারটে রবীন্দ্রকাহিনি নিয়ে ছবি করেফেলেছেন । যার মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিদেশি জিনিস বর্জন বা 'নষ্টনীড়' গল্প নয়ে 'চারুলতা'। চারু আর বিমলার প্রেমের ভুবনের মধ্যে অনেক মিল। দু'জনের দাম চারুলতা-ভূপতিকে আসে ঘিরে আছে এক রাজনীতির জগৎও। চারুর স্বামী ভূপতির কাছে 'রোমিও জুলিয়েট'-এর চেয়ে বড় ট্র্যাজিডি অন্যায়ভাবে দেশের মানুষের অপর ট্যাক্স বসানো। ভূপতি সে-কথা সোচ্চারেই বলেন, 'পলিটিকস ইজ ডিফারেন্ট-- পলিটিকস একটা জান্ত জিনিস- রিয়েল প্যালপেবল। একটা অন্যায় ট্যাক্স যখন বসছে- অবশ্য লিটন সাহেবের দৌলতে তা প্রায়ই ঘটছে-- তা সে যে ট্যাক্সই হোক না কেন, তখন তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এই গরিব দেশের লোকগুলো অ্যাফেকটেড হচ্ছে-- কষ্ট পাচ্ছে- সাফার করছে। এটা বড় ট্র্যাজেডি, না তোমার রোমিও-জুলিয়েট বড় ট্র্যাজেডি।' এই সংলাপ রবীন্দ্রনাথের 'নষ্টনীড়' গল্পে ছিল না। এই সংলাপ সত্যজিৎ নিজে লিখেছেন। তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে ভূপতির মুখে এ যেন সত্যজিতের নিজের স্টেটমেন্ট। ভূপতি 'সেন্টিনেল' নামে এক কাগজ বার করে। এবং সে-কাগজ রাজনৈতিক কাগজই। যার মোটো হল 'ট্রুথ সারভাইভ'। এই কাগজে রাজনীতি আছে- তাই ব্রিটেনে গ্ল্যাডস্টোন সাহেবের জয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বিজয়োৎসব করেন। রাজনীতি তাঁর প্রিয় প্যাশন। যদিও এই রাজনীতি কখনওই সত্যজিতের 'চারুলতা অবশ্যম্ভাবী।

সত্যজিতের চলচ্চিত্রজীবন ৩৭ বছরের। 'বিষয় হয়ে ওঠে না। নিঃসন্দেহে 'চারুলতা' বিষয় শেষ অবধি প্রেম-ই।

'ঘরেবাইরে' ছবির সন্দীপ তো সরাসরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে এই উপন্যাসটি লেখেন বঙ্গভঙ্গ- আন্দোলনের পরিপেক্ষিতে। প্রথম দিকে তিনি এই আন্দোলনের পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু এই আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে

পুড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের মত ছিল না। এই ব্যাপারে 'ঘরে বাইরে'-র নিখিলেশ যেন রবীন্দ্রনাথের অলটার ইগো। সত্যজিৎ ছবিতেও নিখিলে ঠিক আছে এসেছেন। কিন্তু ববীন্দ্রনাথের উপন্যাসে যে গ্রাম্য সমাজের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ে আসেন ত সত্যজিৎ নিয়ে আসেন। তিনি পুরো ছবিটাই নির্মাণ করেন নিখিলেশের অন্দরমহল ও সন্দীপের বাহির মহলে। আরও বলা ভাল সন্দীপ, বিমলা, নিখলেশের নিজস্ব জগতের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে' যেমন রাজনৈতিক উপন্যাস। সেই অর্থে কিন্তু সত্যজিতের 'ঘরেবাইরে' ছবিটি রাজনৈতিক ছবি নয়। সেই জন্যে অনের চরিত্রই বাদ দিয়েছেন সত্যজিৎ। সেটা কোনও অপরাধ নয়। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রে আসার জন্যে এটা প্রায়

১৯৫৫-১৯৯১। এই ৩৭ বছরে তিনি নির্মাণ করেছেন ২৮টি ফিচার, তিনটে ছোট ছবি এবং পাঁচটি তথ্যচিত্র। এই ৩৭ বছরে ভারতে তথা পৃথিবীতে ঘটে গেছে নানা রাজনৈতিক দুর্বিপাক। যা কিন্তু সময়ে সময়ে সত্যজিতের ছবিকে খুব সূক্ষ্মভাবে এসেছে। সত্যজিৎ রায় কখনওই সোচ্চার প্রতিবাদে বিশ্বাস করেন না। মৃণাল সেন যেমন তাঁর ছবিতে রাজনৈতিক পোস্টার-সোচ্চারতা নিয়ে আসেন। বা ঋত্বিক। সেই ধারায় কিন্তু সত্যজিৎ হাঁটেন না। তাঁর ছবিতে রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট অনেক শিল্পময়, অনেক নমনীয়। কিন্তু চলচ্চিত্র ভাষার দিক থেকে কখনওই আলগা নয়। এই ৩৭ বছরে পশ্চিমবঙ্গ, ভারত তথা পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটে গেছে নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কখনও কখনও ভুবন কাঁপানো রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৫৫ থেকে।


১৯৯১ সময়সীমার মধ্যে সারা পৃথিবীতে এবং সেইসঙ্গে ভারতেও এই সাঁইত্রিশ বছর ধরে চলেছে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রমান্বয়ে একের পর এক সমাজতন্ত্রের অপ্রতিহত প্রতিষ্ঠা, ভারতের স্বাধীনতা, সাম্যবাদী চিনের আবির্ভাব এবং নানা দেশে উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির জন্যে সংগ্রাম, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, মানুষের চন্দ্র-বিজয়, চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম, পশ্চিমবঙ্গে বাম তথা কমিউনিস্ট রাজ, নকশাল আন্দোলন-উত্তাল সত্তর এইরকম আরও অনেককিছুই। এদিকে এই সময়েই তো এল নানা জায়গায় বিশ্বাসভঙ্গের পালা, ইউরোপের দেশগুলোতে কমিউনিজমের একের পর এক পতন। বার্লিনের পাঁচিল ভাঙা হল, সোভিয়েট রাষ্ট্র হল টুকরো টুকরো। ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থা ক্রমশই খারাপ হল। সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাত ক্রমশই বাড়তে লাগল ভারতে।। পশ্চিমবঙ্গেও এই দূষণ থেকে বাদ গেল না। ঋত্বিক তাঁর ছবিতে উদ্বাস্তু সমস্যা এবং দেশভাগজনিত বিষয়ের ওপর যথেষ্ট জোর দিলেন। মৃণাল সেন একটা সময়ের পর তাঁর ছবিতে সরাসরি নিয়ে এলেন সমসাময়িক বিশ্বের নানা রাজনৈতিক বিষয়। যেমন বার্লিন প্রাচীর ভাঙা, সোভিয়েত রাষ্টের পতন, আর নকশাল আন্দোলন-কেন্দ্রিক সত্তরের সেই উত্তাল সময়ও তাঁর ছবির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠল।

যেমন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ জানিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের কথা। রাজনীতি যে তাঁর তেমন পছন্দ নয়, এ-কথা সত্যজিৎ নিজেই জানিয়েছেন প্যারিসের 'টেলিরামা' পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে, 'আমি রাজনীতি নিয়ে অকারণে কথা বলতে আমি পছন্দ করি না।' তিনি এ-কথাও জানান, 'ব্রাহ্ম বুদ্ধিজীবীরা এক সময় কমিউনিস্ট হয়ে গেলেও আমি কিন্তু তা হইনি। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন আমি কমিউনিস্ট কিনা? এর উত্তরে আমি বলি না, আমি একজন চিত্রপরিচালক: আমি ছবি তৈরি করি। এ কথা ঠিক আমার অনেক বন্ধুই মার্কসবাদী। আপনি হয়তো জানেন (পশ্চিম) বাংলায় বেশ কিছুকাল হল একটি কমিউনিস্ট সরকার রাজ্য চালাচ্ছে। আমি (কয়েকজন মন্ত্রীকে জানি, তাঁরা আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন এবং তাঁদের যথেষ্ট শুভবুদ্ধি আছে বলেই আমার মনে হয়েছে। ইউরোপে হঠাৎ কমিউনিস্ট সরকারগুলির পতনে আমি বিস্মিত হয়েছি। মনে হয়, এটা একটা সংক্রামক রোগের মতো। কিন্তু আমার মনে হয় ভেতরে ভেতরে মার্কসবাদের এক নতুন অধ্যায় শুরুও হয়েছে। হয়তো এই ভস্মরশ্মির মধ্যে থেকেই কমুনিজম আবার ফিরে আসবে।'

'প্রতিদ্বন্ধী'তে সিদ্ধার্থের ভাই কিন্তু নকশাল। সে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ নিয়েছে। সত্যজিৎ খুবই সূক্ষ্ম আঁচড়ে সেটা ছবির মধ্যে রেখে দিয়েছেন। জাস্ট রেফারেন্স। দেওয়ালে লেখা নকশাল আন্দোলনের নানা পোস্টার আর টুলুর চরিত্রচিত্রণের মধ্যেই তিনি উত্তাল সময়কে অত্যন্ত সার্থকভাবে ধরেন। ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়িতে যে-আন্দোলন শুরু হয় নানা জেলা পেরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে শহর কলকাতাতেও। এই আন্দোলনের যুবক সিদ্ধার্থের জীবন কাটছে। তাঁর ভাই টুলুবাস্তবের বিপ্লবে রয়েছে। দু'একটা সংলাপ বা একবার আহত পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছাড়া টুলুর বিপ্লবী কার্যকলাপ খুব-একটা আমরা দেখি না ছবিতে। কিন্তু সত্যজিৎ এরই মধ্যে প্রতিষ্টা করে দেন বিপ্লবী টুলুকে। এদিকে সিদ্ধার্থ হল ড্রিমার। সে কখনওই 'ডুয়ার' নয়। তাই সে স্বপ্নে চে গেভারা সাজে। সে বন্দুক দিয়ে খুন করে দিদির চরিত্রহীন বসকে। সে বহুতল বাড়ির ছাদে উঠে প্রেমিকার সঙ্গে গল্প করতে করতে অতি দূর থেকে বামদের ব্রিগেড মিটিং দেখে। এই সিদ্ধার্থ একবারই বাস্তবে জন্যে হাজার খানেক যুবকের সহ্য করতে না-পেরে সিদ্ধার্থ ইন্টারভিউরারদের ঘরে ঢুকে টেবিল উল্টে দিয়ে বলে, 'কি ভেবেছেন কি? আমরা জানোয়ার?' এই একবারই প্রত্যক্ষ প্রতিবাদে অংশ নেয় সিদ্ধার্থ।

এটা ঠিক রাজনৈতিক নয়। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সবমিলিয়ে 'প্রতিদ্বদ্ধী' কিন্তু রাজনৈতিক ছবিই। শেষ অবধি কিন্তু চাকরি নিয়ে বিপ্লবাক্রান্ত কলকাতা মহানগর ছেড়ে বালুরঘাট চলে যায় সে। সেখানে রোম্যান্টিক পাখির ডাকের পাশে, 'রাম নাম সৎ হ্যায়' ভেসে আসে। কার মৃত্যু?

বিপ্লবের না সিদ্ধার্থের বিপ্লব মননের?, বোঝা যায়, আমৃত্যু সরাসরি রাজনীতি না করলেও কমিউনিজমের প্রতি তিনি আস্থা হারাননি। সত্তর দশকে মৃণাল সেন যখন সোচ্চার ভাবে তাঁর ছবিতে নিয়ে আসছেন সমসাময়িক উত্তাল রাজনীতি, তখন সত্যজিৎ নির্মাণ করছেন পরপর তিনটি ছবি- 'প্রতিদ্বন্দ্বী', 'জনঅরণ্য' এবং 'সীমাবদ্ধ'। সেখানে সত্যজিৎ নিয়ে আসছেন সমসময়ের রাজনীতির প্রতিফলন। 'সীমাবদ্ধ' ছবিতে এসেছে ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি। যার ঈষৎ প্রকাশ পাই সত্যজিতের 'নায়ক' ছবিতেও। সেখানে নায়কের একদা বড় ট্রেড ইউনিইয়ন রাজনীতি করে। যে একবার নায়কে নিয়ে যায় ফ্যাক্টরির সামনে আন্দোলনরত শ্রমিকদের মাঝখানে। কিন্তু এই শ্রমিকদের মাঝখানে নিজেকে দাঁড় করাতে সে অস্বীকার করে। 'নায়ক' ছবির অরিন্দম মধ্যবিত্ত জীবন থেকেই মহানায়ক হয়ে 'স্টার' হয়। 'সীমাবদ্ধ' ছবির শ্যামলেন্দুও চাকরি জীবনেও 'টপে' যান। সেইজন্যে তাঁকে অন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতাও করতে হয়। যেমন তিনি প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। একটা চাকরির ট্রেড ইউনিয়ন নেতার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ফ্যাক্টরি স্ট্রাইক করিয়ে অমানুষিক প্রতীক্ষা।


এটা শেষ অবধি কোম্পানির বিশাল লোকসান বাঁচিয়ে দেন। কেননা, সেই সময় ফ্যাক্টরিতে প্রোডাকশন বন্ধ করা দরকার ছিল। কোম্পানি তাঁকে এই কাজের পুরস্কার হিসেবে তাকে কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে উন্নত করে। তবে তাঁর এই পদোন্নতিটা খুব ক্লিন নয়। এর মধ্যে থেকে এক ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়, যে রাজনীতি কাজ করে অন্তস্রোতে। কোনও সময়ই তিনি রাজনৈতিক আবহাওয়া নির্মাণ করার জন্যে সোচ্চার পথ নেন না। তার প্রমাণ করো উত্তাল সময়ের পরিপেক্ষিতে তৈরি 'জনঅরণ্য এবং 'প্রতিদ্বন্ধী' তাই বলে। কেউ কেউ 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' বা 'হীরক রাজার দেশ' ছবিকে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ছবি হিসেবে চিহ্নিত করেন। যেমন তাঁর জীবনের শেষ তিনটে ছবি 'গণশত্রু' 'শাখাপ্রশাখা' এবং 'আগন্তুক' ছবিতে রয়েছে সাম্প্রতিক দুর্নীতির রাজনীতি প্রসঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনার প্রকাশ। তবুও শেষ অবধি সত্যজিৎ বিশ্বাস করতেন ভারতে যথার্থ রাজনৈতিক ছবি করা সম্ভব নয়।




Comments


bottom of page