top of page

অতিথি আপ্যায়নে দেশী দাওয়াত, সাবেক কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের কয়েকটা বাড়ির কথা, চোখের রোগ? কীভাবে বুঝবেন ভাইরাল নাকি অ্যালার্জি?, মাটির গন্ধ আর প্রকৃতির ছোঁয়ায় ঘর সাজানো, রবিবারের গল্প: অনীশার খাতা

অতিথি আপ্যায়নে দেশি দাওয়াত

বাংলা সংস্কৃতিতে ‘অতিথি দেবো ভবঃ’ শুধু কথার কথা নয়, বরং আন্তরিকতার নিদর্শন। অতিথি এলে তাকে যত্ন করে খাওয়ানো, নিজের ঘরের সেরা রান্না তুলে ধরা বাঙালি ঘরের চিরন্তন রীতি। আর এই আপ্যায়নের প্রাণ থাকে সেইসব ঘরোয়া রান্নায় যেখানে মায়ের হাতের স্বাদ, মশলার মাপ, আর দেশি উপকরণ মিশে তৈরি হয় এক অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতা।

ree

এই সংকলনে আমরা তুলে ধরতে চলেছি সেসব বাঙালি রান্না, যা অতিথি এলে আমাদের প্রতিদিনের রান্নাঘরকে বিশেষ করে তোলে। মশলা কষানো মাংস, মাছের পাতুরি, পোলাও, চচ্চড়ি, দই-চিংড়ি কিংবা লুচি-আলুর দম যা দিয়ে সাজানো হয় একখানা জমজমাট দেশি দাওয়াত। প্রতিটি পদেই লুকিয়ে থাকে একেকটি গল্প, একেকটি আবেগ। এ কেবল রেসিপির পৃষ্ঠা নয়, বরং এ এক স্বাদ-ভ্রমণ যা আপনাকে নিয়ে যাবে বাঙালি রান্নার শিকড়ের খোঁজে। আপ্যায়নের প্রতিটি মুহূর্তে থাকুক আন্তরিকতা, আর পাতে থাকুক সেই ঘরোয়া ভালবাসা এই কামনাতেই শুরু করছি আমাদের "অতিথি আপ্যায়নে দেশি দাওয়াত"।

-সঞ্চিতা দাস

ree

মেথির পরোটা

কী কী লাগবে

  • আটা – ২ কাপ

  • মেথি পাতা (সিদ্ধ করে কুচানো) – ১ কাপ

  • আদা কুচি – ১ চা চামচ

  • লঙ্কা কুচি – ১ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices জিরে গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices হলুদ গুঁড়ো– ১ চিমটে

  • লবণ – স্বাদমতো

  • Shalimar's Sunflower তেল – ১ চা চামচ (মেখে দেওয়ার জন্য) + পরোটার জন্য


কীভাবে বানাবেন

১. আটা, মেথি পাতা, মসলা, নুন, তেল মিশিয়ে জল দিয়ে নরম করে মেখে ১৫ মিনিট ঢাকা দিন।

২. ছোট বল করে বেলে তাওয়ায় তেল দিয়ে সেঁকে নিন।

৩. গরম গরম পরিবেশন করুন টক দই বা আচার দিয়ে।


টিপ: বেশি ফ্লেভার চাইলে শুকনো মেথি পাতা অল্প ভেজে মিশিয়ে নিন।

ree

ডাল ফ্রাই

কী কী লাগবে

  • মসুর ডাল – ১ কাপ (ধুয়ে সিদ্ধ করা)

  • পেঁয়াজ কুচি – ১টি

  • টমেটো – ১টি (কুচি করা)

  • আদা-রসুন বাটা – ১ চা চামচ

  • শুকনো লঙ্কা – ১টি

  • তেজপাতা – ১টি

  • Shalimar's Chef Spices হলুদ গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices জিরে গুঁড়ো– ১/২ চা চামচ

  • লবণ – স্বাদমতো

  • ধনেপাতা – কিছুটা (সাজানোর জন্য)

  • Shalimar's soyabean তেল/ঘি – ১ টেবিল চামচ

ree

কীভাবে বানাবেন

  1. কড়াইয়ে তেল গরম করে জিরে, তেজপাতা ও শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন।

  2. পেঁয়াজ কুচি দিয়ে নরম হওয়া পর্যন্ত ভাজুন, তারপর দিন আদা-রসুন বাটা।

  3. টমেটো ও হলুদ দিয়ে কষান যতক্ষণ না তেল ছাড়ে।

  4. সিদ্ধ ডাল মিশিয়ে দিন। লবণ ও জল সামঞ্জস্য করুন।

  5. ২–৩ মিনিট ফুটিয়ে ওপরে ঘি ও ধনে পাতা ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।

  6. ভাত, রুটি বা জিরা রাইসের সঙ্গে দারুন মানায়!

ree

বেদানার পোলাও

কী কী লাগবে

  • বাসমতি চাল – ১ কাপ (ধুয়ে আধ ঘণ্টা ভিজিয়ে জল ঝরানো)

  • বেদানার দানা – ১/২ কাপ

  • পেঁয়াজ – ১টি (পাতলা করে কাটা)

  • আদা কুচি – ১ চা চামচ

  • কাঁচা লঙ্কা – ১টি (চেরা)

  • তেজপাতা – ১টি

  • দারচিনি – ১ টুকরো

  • এলাচ – ২টি

  • লবঙ্গ – ২টি

  • জিরে – ১/২ চা চামচ

  • ঘি/ Shalimar's Sunflower তেল– ২ টেবিল চামচ

  • চিনি – ১ চা চামচ

  • নুন – স্বাদমতো

  • গরম জল – ২ কাপ

ree

কীভাবে বানাবেন

  1. কড়াইয়ে ঘি গরম করে তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ ও জিরে ফোড়ন দিন।

  2. পেঁয়াজ, আদা ও কাঁচা লঙ্কা দিয়ে হালকা বাদামি করে ভাজুন।

  3. চাল দিয়ে ২ মিনিট নাড়াচাড়া করে দিন গরম জল, নুন ও চিনি।

  4. ঢাকা দিয়ে কম আঁচে ১২–১৫ মিনিট রান্না করুন যতক্ষণ না চাল সেদ্ধ হয়।

  5. শেষে বেদানার দানা মিশিয়ে দিন ও ঢাকা দিয়ে আরও ৫ মিনিট রেখে দিন।

এই পোলাও পরিবেশন করুন ডিম কারি, মুরগির কষা বা পনির মাখনাওয়ালার সঙ্গে। রঙে ও স্বাদে একেবারে জমজমাট।

ree

চিংড়ি ভুনা

কী কী লাগবে

  • মাঝারি সাইজের চিংড়ি – ৫০০ গ্রাম (সাফ করে নুন-হলুদ মেখে রাখা)

  • পেঁয়াজ – ২টি (মিহি কুচি)

  • আদা বাটা – ১ টেবিল চামচ

  • রসুন বাটা – ১ টেবিল চামচ

  • টমেটো – ১টি (কুচি করা)

  • শুকনো লঙ্কা – ১টি

  • দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ – ২টি করে

  • তেজপাতা – ১টি

  • Shalimar's Chef Spices হলুদ গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices লাল লঙ্কা গুঁড়ো – ১ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices ধনে গুঁড়ো – ১ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices গরম মসলা গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • চিনি – ১ চিমটে

  • নুন – স্বাদমতো

  • Shalimar's সরষের তেল – ৪ টেবিল চামচ

ree

কীভাবে বানাবেন

  1. চিংড়ি ভাজা: কড়াইয়ে সামান্য তেল গরম করে চিংড়ি গুলো হালকা ভেজে তুলে রাখুন।

  2. মশলা ভুনা: তেলে তেজপাতা, গরম মসলা ফোড়ন দিন। পেঁয়াজ দিয়ে নরম ও লালচে হওয়া পর্যন্ত ভাজুন। এরপর দিন আদা-রসুন বাটা, টমেটো, শুকনো লঙ্কা, চিনি, নুন এবং গুঁড়ো মশলাগুলো।

  3. কষানো: মশলাগুলো ভালোভাবে কষে তেল ছেড়ে দিলে ভাজা চিংড়ি দিন। মাঝারি আঁচে ৮–১০ মিনিট কষান।

  4. শেষ টাচ: গরম মসলা ছড়িয়ে দিন, ঢেকে ৫ মিনিট রেখে দিন। ঝরঝরে ভুনা রেডি।

পরোটা, রাধাবল্লভী, বা গরম ভাতের সঙ্গে চিংড়ি ভুনা পরিবেশন করুন। চাইলে উপরে কাঁচা ধনে পাতা ছড়াতে পারেন।

ree

কাতলা মাছের কালিয়া


কী কী লাগবে

  • কাতলা মাছ – ৪–৬ পিস (বড়, ভালো মানের)

  • টক দই – ১/৪ কাপ

  • পেঁয়াজ – ৩টি (কুচি)

  • আদা বাটা – ১ টেবিল চামচ

  • রসুন বাটা – ১ টেবিল চামচ

  • টমেটো – ১টি (কুচি)

  • শুকনো লঙ্কা – ১টি

  • তেজপাতা – ১টি

  • দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ – ২টি করে

  • Shalimar's Chef Spices হলুদ গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices লাল লঙ্কা গুঁড়ো – ১ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices ধনে গুঁড়ো – ১ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices জিরে গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices গরম মসলা গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • চিনি – ১ চিমটে

  • নুন – স্বাদমতো

  • Shalimar's সরষের তেল – পরিমাণমতো

  • কাঁচা ধনে পাতা – সাজানোর জন্য

ree

কীভাবে বানাবেন

  1. মাছ ভাজা: কাতলা মাছের টুকরোগুলোতে নুন ও হলুদ মাখিয়ে সরষের তেলে সোনালি করে ভেজে তুলে নিন।

  2. মশলা ভুনা: একই কড়াইয়ে তেল দিয়ে তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন।পেঁয়াজ দিয়ে লালচে করে ভেজে নিন।এরপর আদা-রসুন বাটা, টমেটো, চিনি, হলুদ, লঙ্কা, ধনে, জিরে গুঁড়ো দিয়ে ভালো করে কষান। মশলা তেল ছেড়ে দিলে টক দই দিয়ে ভালো করে কষে নিন।

  3. মাছ দেওয়া ও ফিনিশিং: কষানো মশলার মধ্যে ভাজা মাছ দিয়ে দিন। অল্প গরম জল দিন ঝোলের জন্য।ঢাকা দিয়ে ৫–৭ মিনিট ফুটিয়ে নিন। শেষে গরম মসলা ছড়িয়ে দিন।

সাদা ভাতই কাতলা কালিয়ার প্রকৃত সঙ্গী। পাশে কাঁচা পেঁয়াজ-লেবু থাকলে স্বাদ দ্বিগুণ।

ree

ভেটকি পাতুরি

কী কী লাগবে

  • ভেটকি মাছের ফিলে – ৪টি (প্রায় ১৫০ গ্রাম করে)

  • নারকেল কোরা – ১/২ কাপ

  • সরষে বাটা (সাদা ও কালো মিশিয়ে) – ৩ টেবিল চামচ

  • পোস্ত বাটা – ১ টেবিল চামচ (ঐচ্ছিক)

  • কাঁচা লঙ্কা বাটা – ২টি

  • কাঁচা লঙ্কা – ৪টি (লম্বা চেরা)

  • Shalimar's Chef Spices হলুদ গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • Shalimar's সরষের তেল – ৫ টেবিল চামচ

  • নুন – স্বাদমতো

  • কলা পাতা – ৪টি (ছোট করে কাটা, নরম করার জন্য একটু আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া)

ree

কীভাবে বানাবেন

  1. মশলা মিশ্রণ তৈরি করুন: নারকেল কোরা, সরষে বাটা, পোস্ত বাটা (যদি ব্যবহার করেন), কাঁচা লঙ্কা বাটা, হলুদ, নুন ও ৩ টেবিল চামচ সর্ষের তেল একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে একটি ঘন পেস্ট তৈরি করুন।

  2. মাছ মাখানো: প্রতিটি ভেটকি ফিলেতে সামান্য নুন ও হলুদ মেখে ৫ মিনিট রেখে দিন।এরপর প্রতিটি ফিলের দুই পাশে ভালো করে সর্ষে-নারকেলের মিশ্রণ মাখিয়ে দিন।

  3. প্যাকেট বানানো: কলা পাতার উপর একটি ফিলে রাখুন, তার উপর একটি কাঁচা লঙ্কা দিন, পাতাটি মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে প্যাকেট বানান।

  4. ভাপানো: স্টিমারে বা ঢাকনাওয়ালা কড়াইয়ে জল গরম করে তাতে স্ট্যান্ড বসিয়ে পাতুরিগুলো দিয়ে দিন।ঢেকে মাঝারি আঁচে ১৫–২০ মিনিট ভাপান।


গরম ভাতের সঙ্গে পাতুরি পরিবেশন করুন। পাতার মোড়ক খুলে ভেটকি আর সর্ষের ঘ্রাণে মন তৃপ্ত হবে। ভেটকি পাতুরি মানেই ঘরোয়া উৎসব, সর্ষে-নারকেলের ছোঁয়ায় এক বাঙালি আবেগ। সুন্দর পরিবেশনায় এই পদ আপনার অতিথিদের মন জয় করবেই!

ree

কষা মুরগি

কী কী লাগবে

  • মুরগির মাংস – ১ কেজি (সাফ করে ধোয়া)

  • পেঁয়াজ – ৪টি (পাতলা করে কুচি)

  • আদা বাটা – ১ টেবিল চামচ

  • রসুন বাটা – ১ টেবিল চামচ

  • টমেটো – ১টি (কুচি)

  • টক দই – ১/২ কাপ

  • তেজপাতা – ২টি

  • দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ – ২টি করে

  • শুকনো লঙ্কা – ১টি

  • Shalimar's Chef Spices হলুদ গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices লাল লঙ্কা গুঁড়ো – ১ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices ধনে গুঁড়ো – ১ চা চামচ

  • Shalimar's Chef Spices গরম মসলা গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

  • চিনি – ১ চা চামচ

  • নুন – স্বাদমতো

  • Shalimar's সরষের তেল – ৫ টেবিল চামচ

ree

কীভাবে বানাবেন

  1. মেরিনেশন: মুরগির মাংস টক দই, আদা-রসুন বাটা, হলুদ ও নুন দিয়ে মেখে ৩০ মিনিট রেখে দিন।

  2. মশলা কষানো: কড়াইয়ে সরষের তেল গরম করে তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন।পেঁয়াজ দিয়ে বাদামি করে ভাজুন, এরপর চিনি দিয়ে ক্যারামেলাইজ করুন।কুচানো টমেটো, লঙ্কা ও ধনে গুঁড়ো দিয়ে কষান যতক্ষণ না তেল ছাড়ে।

  3. মুরগি কষানো: মেরিনেট করা মাংস দিয়ে ভালোভাবে কষান অন্তত ২০–২৫ মিনিট। দরকারে অল্প অল্প করে গরম জল দিন। ঢেকে আরও ১৫ মিনিট রান্না করুন যতক্ষণ না মাংস নরম হয়।

  4. শেষ টাচ: গরম মসলা ছড়িয়ে ৫ মিনিট ঢেকে রাখুন। ঝরঝরে কষা মুরগি তৈরি!


গরম ভাত, পরোটা বা লাচ্ছা পরোটার সঙ্গে পরিবেশন করুন। পাশে পেঁয়াজ-লেবুর সালাড রাখলে জমে যাবে। এই কষা মুরগি শুধু একটা পদ নয়, এটি বাঙালির ঘরোয়া ভালোবাসা। মশলার ঘ্রাণে, ঝাঁঝালো স্বাদে আর আদরে তৈরি এই রান্না যে কোনো খাওয়াকে উৎসবে পরিণত করে!

ree

স্ট্রবেরি দিয়ে ইলিশের টক


কী কী লাগবে

  • ইলিশ মাছ – ৪ টুকরো (ভাল মানের)

  • স্ট্রবেরি – ৫–৬টি (পাকা, মিহি করে ব্লেন্ড করা বা কুচি)

  • Shalimar's সরষের তেল – ৩ টেবিল চামচ

  • শুকনো লঙ্কা – ১টি

  • কালোজিরে – ১/২ চা চামচ

  • কাঁচা লঙ্কা – ২টি (ফালি করে কাটা)

  • Shalimar's Chef Spices হলুদ গুঁড়ো – ১/৪ চা চামচ

  • নুন – স্বাদমতো

  • চিনি – ১ চা চামচ (স্ট্রবেরি খামচে হলে সামঞ্জস্য করতে)


কীভাবে বানাবেন

  1. মাছ ভাজা: ইলিশের টুকরোগুলোতে নুন ও সামান্য হলুদ মাখিয়ে সরষের তেলে হালকা করে ভেজে তুলে রাখুন।

  2. ফোড়ন ও স্ট্রবেরি যোগ: কড়াইয়ে সামান্য তেল দিয়ে শুকনো লঙ্কা ও কালোজিরে ফোড়ন দিন। কাঁচা লঙ্কা দিন। এবার ব্লেন্ড করা স্ট্রবেরি (বা কুচি) দিয়ে দিন।অল্প নুন, চিনি ও এক চিমটে হলুদ দিয়ে মাঝারি আঁচে ৪–৫ মিনিট নেড়ে দিন।

  3. মাছ ও ফিনিশিং: ভাজা ইলিশ টুকরো স্ট্রবেরির টকে দিয়ে ঢেকে দিন। ৫ মিনিটের বেশি নয় মাছ যাতে স্ট্রবেরির স্বাদ ভালোভাবে নেয়, সেটুকুই। মিষ্টি-টক-বালান্স ঠিকঠাক কিনা দেখে নিন।


গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন। চাইলে উপরে সামান্য কাঁচা লঙ্কা ও ধনে পাতা ছড়িয়ে দিন।

ree

আলুবোখরার চাটনি

কী কী লাগবে

  • শুকনো আলুবোখরা – ১০–১২টি (ভিজিয়ে রাখা)

  • আমসত্ত্ব – ২ টুকরো (ঐচ্ছিক, কুচি করে কাটা)

  • কিশমিশ – ১ চামচ

  • আদা কুচি – ১/২ চা চামচ

  • শুকনো লঙ্কা – ১টি

  • পাঁচফোড়ন – ১/২ চা চামচ

  • লবণ – স্বাদমতো

  • চিনি – ৪–৫ চামচ (স্বাদমতো সামঞ্জস্য করুন)

  • জল – ১ কাপ

  • Shalimar's সরষের তেল – ১ চা চামচ


কীভাবে বানাবেন

  1. কড়াইয়ে তেল গরম করে পাঁচফোড়ন ও শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন।

  2. তাতে দিন আদা কুচি ও ভেজানো আলুবোখরা। একটু নেড়ে কিশমিশ, আমসত্ত্ব দিন।

  3. জল দিয়ে দিন। ফুটে উঠলে চিনি ও লবণ দিন।

  4. ১০–১২ মিনিট মাঝারি আঁচে রান্না করুন যতক্ষণ না ঘন হয়ে আসছে।

  5. চাটনি ঘন হয়ে এলে নামিয়ে ঠান্ডা করুন।


সাদা ভাতের পরে পরিবেশন করুন। বিয়েবাড়ির থালার সেই শেষের স্বাদ ফিরে আসবে। আলুবোখরার চাটনি মানেই টক-মিষ্টি এক আবেগ, মুখশুদ্ধির থেকেও বেশি কিছু।

সাবেক কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের কয়েকটা বাড়ির কথা

গৌতম বসুমল্লিক

ree

এই শহরের বেশ পুরনো রাস্তাগুলোর একটা হল সাবেক কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, যা এখন বিধান সরণি নামে পরিচিত। কলকাতা পুরসভা তৈরি হওয়ার আগে 'লটারি কমিটি' নামে একটা সংস্থা লটারি করে টাকা তুলে শহরের রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুকুর তৈরি আরও সব কাজ করত। তারাই আরও অনেক রাস্তার সঙ্গে আন্দাজ ১৮২১-২৩ নাগাদ তৈরি করেছিল এই রাস্তাটা। সেই পর্বে দক্ষিণে পার্ক স্ট্রিট থেকে উত্তরে মারাঠা খাল পর্যন্ত 'সেন্ট্রাল রোড' নামে একটা দীর্ঘ রাস্তা তৈরি হয়েছিল পুরো শহরের মধ্যে দিয়ে। রাস্তা একটাই তবে তার চারটে অংশের আলাদা আলাদা নাম। এবং প্রতিটা রাস্তার পূর্ব দিকে একটা করে বড় পুকুর। প্রধানত স্থানীয় অধিবাসীদের পানীয় জলের চাহিদা মেটাবার জন্যেই খোঁড়া হয়েছিল ওই পুকুরগুলো।

ree

রাস্তার দক্ষিণে পার্ক স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা স্ট্রিট পর্যন্ত অংশের নাম ওয়েলেসলি স্ট্রিট (এখনকার নাম রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড আর ওই রাস্তার ধারের পুকুরের নাম ছিল ওয়েলেসলি স্কোয়ার, এখনকার নাম হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ার), ধর্মতলা স্ট্রিট থেকে বউবাজার স্ট্রিট পর্যন্ত অংশের নাম ওয়েলিংটন স্ট্রিট (এখনকার নাম নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট আর ওই রাস্তার ধারের পুকুরের নাম ছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ার, এখনকার নাম সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার), বউবাজার স্ট্রিট থেকে মেছুয়াবাজার স্ট্রিট পর্যন্ত অংশের নাম কলেজ স্ট্রিট (গোড়া থেকেই রাস্তার নাম দেওয়া হয়েছিল কলেজ স্ট্রিট। আজও পাল্টায়নি সে নাম আর ওই রাস্তার ধারের পুকুরের নাম ছিল কলেজ স্কোয়ার, এখনকার নাম বিদ্যাসাগর উদ্যান) এবং মেছুয়াবাজার স্ট্রিট থেকে একেবারে শ্যামবাজার পাঁচ-মাথার মোড় পেরিয়ে সার্কুলার খাল পর্যন্ত অংশের নাম কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট (এখনকার নাম বিধান সরণি আর ওই রাস্তার ধারের পুকুরের নাম ছিল কর্নওয়ালিশ স্কোয়ার, এখনকার নাম আজাদ হিন্দ বাগ)। এই চারটে রাস্তার মধ্যে দৈর্ঘ্যের দিক থেকে সবথেকে বড় রাস্তা কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট। বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতি-শিল্প-রাজনীতি-ধর্ম-সহ বহুবিধ কর্মকাণ্ডের সাক্ষী এই রাস্তা। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা এই রাস্তার উপরে অবস্থিত বিশেষ কয়েকটা বাড়ি-প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসের কথা আলোচনা করব।


প্রথমেই জানিয়ে রাখা যাক, এই রাস্তার সাবেক এবং বর্তমান নামকরণ সম্পর্কে। লটারি কমিটি যখন এই রাস্তা তৈরি করে তখন নাম দেওয়া হয়েছিলকর্নওয়ালিশ স্ট্রিট। নামকরণটা করা হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর জেনারেল মাকুইস কর্নওয়ালিশের নাম অনুসারে। লর্ড কর্নওয়ালিশ ভারতে আসেন ১৭৭৬ সাধারণাব্দে এবং পরবর্তী সাত বছর তিনি গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বেশকিছু শাসনতান্ত্রিক সংস্কার করেছিলেন যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

ree

গ্রাম থেকে নগরে বা পরে শহরে রূপান্তরিত হয়ে ওঠার বিভিন্ন পর্বে কলকাতার রাস্তাঘাট, পুকুর, বাড়ির পাশাপাশি, শহর সাজাবার জন্য এবং ভারতীয়দের মনে ব্রিটিশ 'রাজপুরুষ' সম্পর্কে সম্ভ্রম জাগানোর উদ্দেশ্য নিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রকাশ্য স্থানে ব্রিটিশদের মূর্তি বসানো আরম্ভ হয় এবং সেই কাজের সূচনা হয় লর্ড কর্নওয়ালিশের মূর্তি স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। ১৮০৩ সাধারণাব্দে প্রতিষ্ঠিত শ্বেত পাথরের ওই মূর্তি ইংল্যান্ডেই তৈরি করা হয়েছিল। ভাস্কর ছিলেন জন বেকন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হওয়ায় মূর্তি গড়বার কাজ শেষ করেন শিল্পীর দ্বিতীয় পুত্র জন বেকন জুনিয়র। প্রথমে ওই মূর্তি অস্থায়ীভাবে বসানো হয় ফোর্ট উইলিয়মে, পরে সেটাকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল কলকাতার টাউন হলে। বর্তমানে লর্ড কর্নওয়ালিশের ওই মূর্তি রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে। স্বাধীনতার পরে, ১৯৬৩ সাধারণাব্দে, লর্ড কর্নওয়ালিশের নামাঙ্কিত রাস্তা চিহ্নিত হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত বিধানচন্দ্র রায়ের নামে।


বাটা কোম্পানির বিরাট শোরুমের বাড়িটাই হল, এই রাস্তার ১ নম্বর বাড়ি। জুতো তৈরির ছোট ছোট কারখানা রয়েছে এখানে। বহুকাল আগে এখানে এক ইহুদি সাহেবের বাজার ছিল। সেইথেকে এখনও লোকে এটাকে ইহুদি মার্কেট বলে। কলেজ স্ট্রিটে একসময়ে অনেক জুতোর দোকান ছিল। পুরনো কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের গায়ে পর পর জুতোর দোকান। পুরনো মার্কেট ভেঙে নতুন বাজারবাড়ি তৈরি হওয়ার পর সামনের দিকে সে সব দোকান এখন আর দেখা যায় না। কমদামি জুতোর যে বাজার ছিল এখানে তার অনেকটাই তৈরি হত এই ইহুদি মার্কেট এবং কাছাকাছি আরও কয়েকটা ছোট ছোট জুতো তৈরির কারখানা থেকে। এখন অবশ্য শোনা যায়, ওই বাজারে বেশ মন্দা চলেছে।

ree

পরের লাল রঙের বাড়িটা হল, 'লাহাবাড়ি'। আরও স্পষ্ট করে বলতে হয় 'দুর্গাচরণ লাহার বাড়ি'। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, লাল রঙের বাড়ি তো কলকাতা শহরে অনেকই দেখা যায়। ব্রিটিশ আমলে পুরনো কলকাতায় অনেক সরকারি বাড়ি কিংবা দেবালয় ছিল লাল রঙের। তাহলে আলাদা করে লাল রঙের বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন কেন উঠবে? প্রশ্ন উঠবে তার কারণ হল, একসময়ে কলকাতার ওই লাল রঙের বাড়িগুলোর একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের লাহা পদবিধারীরা কলকাতায় একসময়ে অনেক বাড়ি কেনে বা তৈরি করে এবং তাদের অধিকাংশ বাড়িই লাল রঙের। তবে এই বাড়িটা লাহাদের তৈরি নয়। সে যুগের বিখ্যাত ব্যারিস্টার তারকনাথ পালিতের বাবা কালীকিংকর পালিত বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। ওই লাহাদের পূর্বপুরুষ মধুমঙ্গল লাহা কলকাতায় আসেন ব্যবসাসূত্রে। তাঁর ছেলে প্রাণকৃষ্ণের আমলে এই পরিবার খুবই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তাঁর চার ছেলের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্গাচরণ বিখ্যাত লোক ছিলেন। তিনি ১৮৮২ সাধারণাব্দে 'মহারাজা' খেতাব পান। ওই বছরেই তিনি বাড়িটা কালীকিংকর পালিতের কাছ থেকে কিনে নেন। ওই বাড়ির এক অংশে রয়েছে পাস্তুর ল্যাবরেটরি।


লাহাবাড়ি পেরিয়ে উত্তর দিক বরাবর আরও একটু এগিয়ে গেলে আরও একটা লাল রঙের বাড়ি দেখা যাবে। ৩ ও ৪ নম্বর ঠিকানা জুড়ে তৈরি এই বাড়িটাকে লোকে বলে দোয়ারি দত্তের বাড়ি। বাড়ির মালিকের নাম ছিল দ্বারকানাথ দত্ত। স্বারকানাথ অপভ্রংশে হয়ে গেছেন দোয়ারি। সুবর্ণবণিক সমাজভুক্ত এই দ্বারকানাথ দত্ত ছিলেন ব্যবসায়ী। ল্যায়ন্স রেজে 'ডি এন দত্ত অ্যান্ড নেফিউ' নামে ছিল তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। বিলেত থেকে আমদানি করা কাপড়ের ব্যবসায় তিনি খুবই বিত্তবান হয়ে ওঠেন। বাড়িতে এখনও দোল-দুর্গোৎসব হয়। বাড়ির ভেতরে ঢুকে সামনেই বিশাল উঠোন এবং তিন খিলান ও দু'দালানযুক্ত দুর্গাদালান। দুর্গাপুজোর সময়ে এই বাড়িতে কিন্তু দশভুজা মহিষমর্দিনী দুর্গার পুজো হয় না। এখানে শিবদুর্গা মূর্তিকে দুর্গা হিসেবে আরাধনা করা হয়।

ree

কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের পূর্বদিকের ফুটপাথ ধরে উত্তরমুখী আরও একটু এগিয়ে গেলে পড়বে ৭ নম্বর বাড়ি। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনের সময়ে ওই বাড়ি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ওই বাড়িতে থাকতেন রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা দেবীচৌধুরানি। স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে ওই বাড়িতে স্থাপিত হয়েছিল 'লক্ষ্মীভাণ্ডার' এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত 'ভাণ্ডার' পত্রিকার কার্যালয়ও ছিল ওই বাড়িতে। ওই বাড়ি ছাড়িয়ে আরও একটু এগিয়ে গেলে পড়বে ১০ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট। একদা ওই বাড়ির মালিক ছিলেন নবগোপাল মিত্র।


পূর্বদিকের ফুটপাথ ধরে উত্তরমুখী হাঁটলে, খানিকটা এগিয়ে ১৩ নম্বর বাড়ি। এই বাড়িটা অর্থাৎ, ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট শুধু এই রাস্ত্যই নয়, কলকাতা তথা ভারতের ইতিহাসেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবগোপাল মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, উমেশচন্দ্র দত্ত, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম। রাধারমণ মিত্র জানিয়েছেন, গোড়ায় ওই বাড়ির মালিক ছিলেন গোবিন্দ গুপ্ত, পরে ঠনঠনিয়া লাহা পরিবারের মধুমঙ্গল লাহার উত্তরপুরুষ রাসবিহারী ও বিপিনবিহারী লাহা নামে দুই ভাই বাড়িটা কিনে নেন। রাধারমণবাবুর লেখায় কোনও সাল-তারিখের উল্লেখ না-থাকায় কবে বাড়ি হাতবদল হয়েছিল তা জানা যায় না। শঙ্কর ঘোষ লেনে একটা পুরনো বাড়িতে কয়েকজন শিক্ষাব্রতীর উদ্যোগে ১৮৫৯-এ মেট্রোপলিটন ট্রেনিং স্কুল নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল।

ree

কিছু কাল পরে সেটির নাম হয় ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল। স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের বছর বিদ্যালয়ের কমিটিতে আসেন রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংবাদিক কৃষ্ণদাস পাল প্রমুখ এবং সভাপতি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই সদস্যদের মধ্যে মনোমালিন্যের কারণে ঠাকুরদাস চক্রবর্তী ও আরও কয়েকজন সদস্য ওই স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে ১৩ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের এই বাড়ি ভাড়া নিয়ে ক্যালকাটা ট্রেনিং অয়কাডেমি নামে পাল্টা একটি স্কুল তৈরি করেন। এই বাড়িতে ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি ছিল ১৮৫৯-৬০ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত। ১৮৭৩ সালের পথপঞ্জিতে তাই বাড়ির দখলদার হিসেবে লেখা আছে: 'Calcutta Training Academy: Thakoordoss Chuckerbutty, secretary,' (ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি: ঠাকুরদাস চক্রবর্তী সেক্রেটারি)।


জীবনস্মৃতি'তে নিজের বিদ্যালয়জীবনের কথায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'কান্নার জোরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে অকালে ভরতি হইলাম।' কিন্তু তিনি কী সত্যিই ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে সেদিন ভর্তি হয়েছিলেন? ঠাকুর পরিবারের হিসাবখাতা বিশ্লেষণ করে রবিজীবনী-র লেখক প্রশান্তকুমার পাল জানিয়েছেন, দাদা অর্থাৎ, সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বয়োজ্যেষ্ঠ ভাগিনেয় সত্য অর্থাৎ, সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথকে একসঙ্গেই বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছিল ১৮৬৫-র মার্চ মাসে। তবে সেটি ওরিয়েন্টাল সেমিনারি নয়, স্কুলটির নাম কলিকাতা (বা ক্যালকাটা) ট্রেনিং অ্যাকাডেমি। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ কোনওদিনই ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়েননি। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের এই বাড়িতে ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি ছিল ১৮৫৯-৬০ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত। অতএব, এই বাড়িতেই বালক রবীন্দ্রনাথ পড়তে আসতেন জোড়াসাঁকো থেকে। ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রনাথের প্রথম স্কুল হলেও সেখানে তিনি কিন্তু বেশি দিন পড়েননি। ১৮৬৫-র মার্চ মাসে সেখানে তিনি ভর্তি হন আর সেই বছরেরই নভেম্বর মাসে তাঁকে ভর্তি করা হল অন্য একটি স্কুলে। রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন নর্মাল স্কুল। ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি স্কুলটা কিন্তু এখনও আছে। ১৩ নম্বর বাড়ি থেকে ওই কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটেরই ৩০ নং বাড়িতে উঠে যায় এবং শেষে ১৮৯৫-এ সিমলা স্ট্রিটে (বর্তমান ঠিকানা ১৩ ডা. নারায়ণ রায় সরণি) চলে আসে।

ree

উনিশ শতকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরির কাজে এক নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন এই নৰগোপাল মিত্র। ন্যাশনাল পেপার, ন্যাশনাল সোসাইটি, ন্যাশনাল স্কুল প্রভৃতি নামে নানা সংগঠন তৈরি করেছিলেন। সবকিছুতে ন্যাশনাল যোগ করতেন বলে, লোকে তাঁকে আড়ালে ন্যাশনাল নবগোপাল বলে অভিহিত করত। থাকতেন পাশেই, ১০ নম্বর বাড়িতে। এই ১৩ নম্বর বাড়িতে তিনি ন্যাশনাল স্কুল নামে একটি বিদ্যালয় খুললেন। ১৮৭২-এর ১ এপ্রিল থেকে শুরু হল বিদ্যালয়ের কাজ। সঙ্গীত, ব্যায়াম, ড্রইং, বিজ্ঞান এমনকি বন্দুক ছোড়াও শেখানো হত সেখানে। ওই বছরেই সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখে সেখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে হিন্দু ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দেন রাজনারায়ণ বসু।

দেবেন্দ্রনাথ ছাড়াও রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতো বহু প্রথিতযশা ব্যক্তি সে দিন ওই বক্তৃতা শুনতে উপস্থিত ছিলেন বলে লিখেছেন রাজনারায়ণ বসু নিজেই।


ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি অন্যত্র চলে গেলে, ১৫ মে তারিখে তার জায়গায় আসে 'ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়'। কেউ কেউ বলেছেন, শিবনাধ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দুর্গামোহন দাস, উমেশচন্দ্র দত্তদের উদ্যোগে ১৮৯০-এর ৩১ জানুয়ারি, এই ১৩ নম্বর বাড়ির উলটো দিকের ব্রাহ্ম পাড়ায় বরদানাথ হালদারের বাড়িতে সূচনা হয়েছিল 'ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়'-এর। আবার কেউ কেউ বলেছেন, না, ৩১ জানুয়ারি নয়, ওই ১৫ মে তারিখে ১৩ নম্বর বাড়িতেই স্কুলের সূচনা। তবে যেখানেই সূচনা হোক, এই বাড়িতে শিক্ষালয় যে ছিল তার প্রমাণ হিসেবে ১৮৯৭ সালের পথপঞ্জিতে বাড়ির দখলদার হিসেবে লেখা হয়েছে, 'Brahmo Girls' School and Dr Mrs Gangooly,' 'ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়' পরে এই বাড়ি থেকে উঠে ৫৬ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিটের বাড়ি (বা মতান্তরে ৭০ নম্বর হ্যারিসন রোডের বাড়ি) হয়ে আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে। এখনও সেই বাড়িতেই রয়েছে স্কুলটি।


কালীপ্রসন্ন সিংহের ১৪৮ নম্বর বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের বাড়ি ভাড়া নিয়ে ১৮৯৮-এর ২৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত সঙ্গীত সমাজ। কিছুকাল পরে এক অপ্রীতিকর ঘটনার ফলে সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশ ভারত সঙ্গীত সমিতি নাম নিয়ে বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের বাড়িতেই থেকে যায়, অন্য দল প্রথমে ১৩ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট ও তার পরে ২০৯ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ নির্মাণ করে সেখানে উঠে যায় সঙ্গীত সমাজ। প্রতিষ্ঠাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ, রাধামাধব কর প্রমুখ বিশিষ্টজন যুক্ত ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সংগীত অনুষ্ঠানের পাশাপাশি উচ্চমানের নাটক অভিনয়ের জন্যও খ্যাতি ছিল সংগীত সমাজের।

ree

কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের পশ্চিম দিকে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ ভবনে সংলগ্ন অংশটা সেকালে পরিচিত ছিল ব্রাহ্মপাড়া নামে। এখানে বসবাসকারী আরও অনেক ব্রাহ্ম লোকজনের মধ্যে একজন হলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ব্রাহ্মপাড়া ছেড়ে ঠিক উলটো দিকে এই ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের বাড়িতে উঠে আসেন। সূচনালগ্ন থেকেই ব্রাহ্ম সমাজ মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি বিস্তারে উদ্যোগী ছিল। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য দ্বারকানাথ এই ব্যাপারে ছিলেন খুবই উৎসাহী। তিনি মেয়েদের উন্নতির জন্য লড়াই করতেন। এ জন্য তিনি 'অবলাবান্ধব' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করলে হিন্দু পরিবার থেকে যে সব ছেলেদের তাড়িয়ে দেওয়া হত, দ্বারকানাথ তাদের এনে নিজের বাড়িতে, অর্থাৎ এই ১৩ নম্বর বাড়িতে আশ্রয় দিতেন তাই হিন্দু ছেলেরা আড়ালে এই বাড়িকে 'অবলা ব্যারাক' বলত এবং আশ্রয়দাতা দ্বারকানাথকে 'অবলাবান্ধব' বলত। তেমনই একজন গৃহত্যাগী ব্রাহ্ম ছিলেন ময়ময়সিংহ। জেলার মসুয়া গ্রামের কালীনাথ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র কামদারঞ্জন রায়। জ্ঞাতিকাকা হরিকিশোর রায়চৌধুরীর দত্তক পুত্র হওয়ার পর তাঁর নাম হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন। সেইসময়ে দ্বারকানাথের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীকে বিয়ে করে এই অবলা ব্যারাকে বসবাস আরম্ভ করেন। উপেন্দ্রকিশোর-এবং দুই পুত্র সুকুমার (রায়) ও সুবিনয় জন্মেছেন এই বাড়িতেই।


বরিশালের চাঁদসি গ্রামের সাবেক বাসিন্দা ব্রজকিশোর বসু পারিবারিক বিরোধে স্বগ্রাম ছেড়ে ভাগলপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। পেশায় তিনি ছিলেন হেডমাস্টার। তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে কাদম্বিনী। ব্রজকিশোরের সঙ্গে কোনও কারণে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়েছিল। ভাগলপুরে কৃষ্ণধন ঘোষের ছোটদের স্কুলে কাদম্বিনীর পড়া শেষ হলে, দ্বারকানাথের উৎসাহেই তাঁকে কলকাতায় হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। মেধাবী কাদম্বিনী বসু সেখানকার পাঠ শেষ করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেথুন কলেজ থেকে চন্দ্রমুখী বসুর সঙ্গে যুগ্মভাবে স্নাতক হন। এই দুই সহপাঠীই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক। কাদম্বিনী বসু তারপর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন পাশ্চাত্য রীতির চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য এবং শেষ অবধি 'গ্রাজুয়েট অব বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ' শংসাপত্র পেয়ে এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসকের সম্মান অর্জন করেন। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির পর বিপত্নীক দ্বারকানাথ কাদম্বিনীকে বিয়ে করেন। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত জীবিত থাকলেও, ১৮৯৭ সালের পথপঞ্জিতে বাড়ির দখলদার হিসেবে, 'Dr Mrs Gangooly' অর্থাৎ, কাদম্বিনী গাঙ্গুলির নামের উল্লেখ তাঁর জনপ্রিয়তার পরিচয় দেয়। পরবর্তী কালে বাড়ির মালিকানা পালটেছে বেশ কয়েকবার। বছর দশেক আগে বাড়ির এক অংশ ভেঙে নির্মিত হয়েছে এক বাজার। অন্য অংশ ভাঙাচোরা অবস্থাতেই পড়ে ছিল অনেক কাল। সম্প্রতি আবার ভাঙা আরম্ভ হয়েছে। অচিরেই হয়তো এই বাড়ির জায়গায় মাথা তুলবে কোনও এক বহুতল বাজারবাড়ি। চিরতরে মুছে যাবে, উনিশ শতকের বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসের একটা অধ্যায়।

ree

এবারে সামনের ট্রামলাইন পেরিয়ে উলটো দিকের ফুটপাথে চলে আসা যাক। একটু এগিয়ে সামনে পড়ে ২০৬ নম্বর বাড়ি। লম্বা টানা গাড়ি-বারান্দাওয়ালা বাড়ির সারা গায়েই এখন শরিকি বিভাজনের ছাপ স্পষ্ট। বাড়ির বাইরের দিকে অগুন্তি ছোট ছোট দোকান। এই বাড়িতেই একদা ছিল, 'ভারত সংগীত সমাজ' নাট্যগৃহ। এখন অবশ্য নাটাগৃহ আর নেই বরং বারোয়ারি বাড়ি বললে ভুল হয় না। বিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতার সংস্কৃতি জগতে অন্যতম খ্যাতিমান ছিল এই প্রতিষ্ঠান। 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' খ্যাত কালীপ্রসন্ন সিংহের ১৪৮, বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের বাড়ি ভাড়া নিয়ে ১৮৯৮ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 'ভারত সংগীত সমাজ'। প্রতিষ্ঠাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও রাধামাধব কর, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, চারুচন্দ্র মিত্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ জড়িত ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কালীপ্রসন্নের সেই বাড়ি আজ আর নেই। সেটা ভেঙে নতুন বাড়ি উঠে গেছে বেশ অনেকদিন আগেই। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সংস্কৃত শিক্ষক রামকুমার ভট্টাচার্য বিদ্যারত্বও একসময়ে বাস করে গেছেন এখানে। সরকারি উদাসীন্য আর জনমানসের ইতিহাস চেতনার অভাবে শহর কলকাতা থেকে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যপূর্ণবাড়িঘর কিংবা মন্দির-মসজিদের মতো ধর্মীয় স্থাপত্যের সব নিদর্শন। এইরকম হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যপূর্ণ এক ভবন হল ২০৯ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের (অধুনা বিধান সরণি) 'ভারত সংগীত সমাজ' নাট্যগৃহ।


কিছুকাল পরে নানা কারণে বিরোধ বাধলে সমাজ প্রথমে উঠে আসে, ১৩, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে। তারপর ১৯০০ সালের গোড়ায় ১৩ নং বাড়ির ঠিক বিপরীতে, ওই রাস্তারই ২০৯ নং বাড়িতে নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে সমাজ পাকাপাকিভাবে সেখানেই উঠে আসে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, কোচবিহারের মহারাজার অর্থানুকূল্যে তৈরি ওই ভবনটি শুধু দর্শনীয় স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারীই ছিল না, বৈদ্যুতিক বাতি-সহ সে যুগের নিরিখে একঅত্যাধুনিক নাটাগৃহ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল।

ree

রবীন্দ্রনাথ যে শুধু সংগীত সমাজের সঙ্গে যুক্তই ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন এখানকার নাট্যশিক্ষক, পরিচালক এবং অভিনেতা। রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন', 'গোড়ায় গলদ', 'বৈকুণ্ঠের খাতা' সহ বেশ কয়েকটি নাটক এখানে অভিনীত হয়েছে যার অনেকগুলিতে রবীন্দ্রনাথ নিজে অভিনেতা রূপে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ওইসব নাটকে তাঁর অভিনয়ও ছিল অনবদ্য। বিশেষ করে 'বিসর্জন' নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের অভিনয় তো রীতিমত মিথ। নাট্যাভিনয় ছাড়াও সংগীতানুষ্ঠান, সংগীত বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনাচক্র, প্রবন্ধ পাঠ ইত্যাদির আসরও এখানে বসত। নিয়মিত। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ লেখকদের বিভিন্ন রচনায় এই নিয়ে বেশকিছু সরস বর্ণনা রয়েছে।


সামনের দিকে জামাকাপড়ওয়ালাদের ভিড়ে সদর দরজা খুঁজে পাওয়াই ভার। বাড়ির ভেতরে ঢুকলে দেখা যাবে, সঙ্কীর্ণ পরিসর। এটা যে বিশ শতকের গোড়ার দিকের কলকাতার অন্যতম সেরা প্রেক্ষাগৃহ ছিল, তা আর বোঝার উপায় নেই এখন। এই নাট্যগৃহ নিয়ে কিছু কিছু বর্ণনা থাকলেও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তেমন কিছু নেই। সংরক্ষণের অভাবে শতবর্ষ অতিক্রান্ত এই নাট্যগৃহটি আজ একেবারে জীর্ণ। উত্তর কলকাতার আর পাঁচটা বারোয়ারি বাড়ির থেকে এখন আর আলাদা করে একে চেনা যায় না। আক্ষরিক অর্থেই বাড়িটি এখন 'বারো ঘর এক উঠোন'-এ পর্যবসিত হয়েছে। এর অপূর্ব কারুকার্য খচিত রঙ্গমঞ্চটি আজ আর নেই। সেখানে বসেছে অফসেট প্রেস। এক মাঝারি পুস্তক প্রকাশকের অধিকারে রয়েছে বাড়ির অনেকটাই। বাইরের দিকের অবস্থা আরও খারাপ। বাড়ির খানিকটা অংশ ভেঙে হয়েছে পুনর্নির্মাণ।


'ভারত সংগীত সমাজ' ছাড়া বাড়িটা আরও কিছু কারণে বিখ্যাত। ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর, বঙ্গভঙ্গের দিন বিকালে বাগবাজারে পশুপতি বসুর বাড়িতে অনুষ্ঠিত সভায় 'স্বদেশি ফান্ড' গঠিত হয়। ওই ফান্ডে মোট সত্তর হাজার টাকা উঠেছিল, তার থেকে তিরিশ হাজার টাকা ব্যয় করে সংগীত সমাজের ওই বাড়িতে ১৯০৫-এর ১০ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল National Weaving School বা জাতীয় বয়ন বিদ্যালয়। সেখানে স্বদেশি আন্দোলনে যোগদানকারী ছাত্র-যুব সম্প্রদায়কে চরকা ও তাঁত চালাবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। এই বাড়িতেই পরবর্তী কালে বাস করে গেছেন 'বংশ পরিচয়' গ্রন্থের লেখক জ্ঞানেন্দ্র কুমার। এখান থেকেই তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ও মুদ্রিত হত 'প্রজাপতি', 'মজলিস' ও 'শ্রীরামপুর' নামের তিনখানি পত্রিকা।' সাবেক কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট বা আজকের বিধান সরণির দুইপাশ জুড়ে রয়েছে আরও অজস্র বাড়ি, যেগুলোর ইতিহাসও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সীমিত পরিসরে সমস্ত বাড়ির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই বাছাই করা কয়েকটা বাড়ির ইতিহাস নিয়ে এই নিবন্ধে আলোচনা করা হল।

চোখের রোগ: কিভাবে বুঝবেন ভাইরাল নাকি এলার্জি?

ree

বর্ষাকাল মানেই ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এবং সঙ্গে নানান রকম সংক্রমণ। এই সময়ে চোখের রোগ, বিশেষ করে কনজাংটিভাইটিস বা ‘চোখ উঠা’ অনেক বেশি দেখা যায়। তবে চোখের সমস্যা যে সবসময় ভাইরাল সংক্রমণই হবে এমন নয় অনেক সময় এটি এলার্জিজনিতও হতে পারে। কিন্তু কীভাবে বোঝা যাবে আপনার চোখের সমস্যা ভাইরাল নাকি এলার্জি? চলুন, বর্ষাকালীন চোখের সমস্যাগুলি নিয়ে বিস্তারিত জানি।


ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস কী?

ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস একটি ছোঁয়াচে রোগ যা অ্যাডেনোভাইরাস-এর কারণে বেশি দেখা যায়। এটি সাধারণত এক চোখে শুরু হয় এবং পরে অন্য চোখেও ছড়িয়ে পড়ে।


উপসর্গগুলো হলো:

লাল চোখ

চোখ জ্বালা বা ব্যথা

অতিরিক্ত জল পড়া

চোখের পাতা ফোলা

চোখে ঝাপসা দেখা

হালকা জ্বর বা গলা ব্যথা (অনেক সময়)

চিহ্নিত বিষয়:

এটি অত্যন্ত সংক্রামক। স্পর্শের মাধ্যমে একজনের থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়াতে পারে।

ree

এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস কী?

এটি সংক্রমণ নয়, বরং শরীরের অতিসংবেদনশীল প্রতিক্রিয়ার ফল। ধুলো, পরাগরেণু, পোষা প্রাণীর লোম, বা বর্ষাকালে বেড়ে যাওয়া ছাঁচ (mold) এই সমস্যার কারণ হতে পারে।


উপসর্গগুলো হলো:

দু’চোখেই একসঙ্গে সমস্যা শুরু হয়

প্রচণ্ড চুলকানি

চোখ লাল হওয়া

জল পড়া, তবে সাধারণত পাতলা

সাদা রঙের পাতলা স্রাব

হাঁচি বা সর্দিও হতে পারে

চিহ্নিত বিষয়:

এটি ছোঁয়াচে নয় এবং পরিবারের অন্যদের মধ্যে ছড়ায় না।

ree

প্রতিকার ও সতর্কতা


ভাইরাল কনজাংটিভাইটিসের জন্য:

চোখে বারবার জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন

চোখে হাত দেবেন না

অন্যের তোয়ালে, বালিশ, চশমা ব্যবহার করবেন না

ডাক্তারের পরামর্শে অ্যান্টিসেপটিক ড্রপ ব্যবহার করুন

শিশুদের স্কুলে না পাঠানো ভালো যতদিন না চোখ পুরোপুরি ভালো হয়

ree

এলার্জির জন্য:

ধুলো, ধোঁয়া বা এলার্জির উপাদান এড়িয়ে চলুন

চোখে ঘষবেন না

কোল্ড কম্প্রেস ব্যবহার করতে পারেন

অ্যান্টিহিস্টামিন বা এলার্জি নিরোধক ড্রপ ব্যবহার করুন ডাক্তারের পরামর্শে


বর্ষাকালে চোখের রোগ খুব সাধারণ, তবে অবহেলা করলে মারাত্মক হতে পারে। তাই উপসর্গ বুঝে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখবেন, চোখ আমাদের অমূল্য সম্পদ সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন। যদি চোখ লাল হয়ে যায় এবং ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সমস্যা চলতে থাকে, নিজে ওষুধ না নিয়ে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

ree

মাটির গন্ধ এবং প্রকৃতির ছোঁয়ায় ঘর সাজানো: এক নতুন জীবনদর্শন

ree

ঘর আমাদের নিরাপত্তার আশ্রয়, আমাদের স্বস্তি আর শান্তির ঠিকানা। কিন্তু ইট-পাথরের চার দেওয়ালের মাঝে যদি প্রকৃতির ছোঁয়া না থাকে, তবে সেই ঘর হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ, প্রাণহীন। মাটির গন্ধ, সবুজ গাছগাছালি, কাঠ বা বাঁশের ব্যবহার এসবই আমাদের মন ও শরীরের সঙ্গে এক গভীর বন্ধন তৈরি করে। আধুনিক জীবনের ক্লান্তি দূর করে আমাদের নিয়ে যায় এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে।


বর্তমান সময়ে "বায়োফিলিক ডিজাইন" (Biophilic Design) একটি জনপ্রিয় ধারায় পরিণত হয়েছে, যার মূল ভাবনা প্রকৃতিকে ঘরের অন্দরে আনা। মাটির ঘ্রাণ, পাথরের ছোঁয়া, কাঠের উষ্ণতা ও গাছের সবুজতায় সাজানো এই ঘর যেন নিজেই এক শান্তির আশ্রয়। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা মাটির ঘ্রাণ এ এক অসাধারণ অনুভূতি, যা আমাদের শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ঘরে যদি আমরা মাটির প্রদীপ, টেরাকোটা হ্যাঙ্গিংস, বা মাটির ফুলদানির মতো উপাদান রাখি, তবে সেই সুগন্ধ ও অনুভূতি বাস্তবে ধরা দেয়। আজকাল অনেকেই কাঁচা বা পোড়া মাটির পাত্র ব্যবহার করেন কেবল সৌন্দর্যের জন্যই নয়, বরং মাটির সঙ্গে নিজের শিকড়ের সম্পর্কটা জিইয়ে রাখার জন্য।


গাছপালা শুধু ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায় না, বরং এটি বাতাস পরিশোধন করে, মানসিক চাপ কমায়, এবং ঘরের পরিবেশে প্রাণ এনে দেয়

ree

। উইন্ডো সিলে ছোট ক্যাকটাস, বাতাস পরিশোধক মানিপ্ল্যান্ট, বা বড় পটেড পাম গাছ ঘরের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখে। ছাদের বারান্দা বা ব্যালকনিকে একটুকরো বাগান করে তোলা এখন অনেকের স্বপ্ন। ঘরের দেয়ালে যদি সবুজ লিভিং ওয়াল রাখা যায়, বা কাঠের ফ্রেমে বোনসাই টাঙানো যায়, তবে ঘরের মধ্যে এক প্রাকৃতিক জীবন্ততা ছড়িয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি কিছু শুকনো ফুল বা ঘাসের তোড়া (dry bouquet), বাশের হ্যাঙ্গিং, পাথরের শো-পিস ব্যবহার করলেও ঘর পায় এক অরগানিক চেহারা।


প্রাকৃতিক ঘর সাজাতে গেলে উপকরণ ও রংয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কাঠ, বাঁশ, কাঁচা মাটি, পাথর এই উপাদানগুলোর ব্যবহার ঘরের মধ্যে প্রাকৃতিক এক উষ্ণতা তৈরি করে। ঘরের দেয়াল ও ফার্নিচারের রং হওয়া উচিত ধুসর, খয়েরি, অলিভ সবুজ বা মাটি রঙের। এইসব আর্থি টোন ঘরের আবহকে আরও আরামদায়ক করে তোলে।

ree

প্রকৃতির ঘর মানেই প্রাকৃতিক আলো ও হাওয়ার যথাযথ প্রবাহ। বড় বড় জানালা, পাতলা সুতির পর্দা, কাঠের ঝালর all contribute to bringing nature indoors. ঘরে রোদের আলোর খেলা মানসিক প্রশান্তি বাড়ায়। মাটির গন্ধ আর প্রকৃতির ছোঁয়ায় সাজানো ঘর কেবল একটি রুচিশীল ইন্টেরিয়র স্টাইল নয়, বরং এটি একধরনের জীবনদর্শন। এটি আমাদের মনকে স্থির করে, পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম করে এবং আমাদের শিকড়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। নগরজীবনের কৃত্রিমতা আর ক্লান্তির ভিড়ে প্রকৃতি আমাদের যেটুকু শান্তি দেয়, সেটুকুই নিজের ঘরের অন্দরেও এনে ফেলা এখন সময়ের দাবি। তাই বাড়ি সাজান মাটির সুবাসে, প্রকৃতির ছোঁয়ায়, আর তৈরি করুন এক জীবন্ত, প্রশান্তিময় আশ্রয় আপনার নিজের মতো করে।

অনীশার খাতা

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

ree

সত্যি কথা বলতে কী, আমার আর আমার মায়ের সম্পর্কটা যে ঠিক কী ধরনের তা আমি নিজেই বুঝি না। কীভাবে বললে বোঝানো যাবে জানি না, আসলে আমার সঙ্গে আমার মায়ের তেমনভাবে বলার মতো যেন কোনও মিলই নেই। একমাত্র এই গুমরে থাকা স্বভাবটা ছাড়া আমাদের আর কোথাওই কোনও মিল নেই, তবু হাজার হোক রক্তের সম্পর্ক বলে কথা, বললেই তো আর এত বড় ব্যাপারটা রাতারাতি মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না কিন্তু আমাদের দুজনেরই এত ঘন ঘন কেন যে এত রাগ হয় কে জানে। আর যখন রাগ হয় মুখ দুটো দেখে মনে হয় চরাচর জুড়ে ফুঁসতে থাকা ঘনায়মান মেঘ। টসটস করছে, খসথস করছে। চারপাশটায় কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া, বাইরেটা থমথমে কিন্তু ভেতরে কোথাও অনেকদিন ধরে জমে উঠছে অনেককালের দীর্ঘশ্বাস।


তাছাড়া আমাদের মধ্যে ফারাকটা এতটাই প্রকট যে আমাদের দেখে যে কারুরই মনে হতে পারে আমরা দুজন যেন একেবারেই যাকে বলা যায় সুমেরু আর কুমেরু বা শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষ। আমার মা অসামান্য সুন্দরী, নিখুঁত চোখ নাক মুখ, নির্মেদ সুষম দেহবল্লরী, দুধে-হলুদে পেলব ত্বকে মাছি বসলেও পিছলে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। আমার মতো এক অষ্টাদশী কন্যার মা অথচ এখনও রূপ এতটুকুও টাল খায়নি। ওরা নড়াইলের বদ্যি বংশ, এদেশের বাপের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়, সেজকাকা বিলেতে থাকে এইসব নানান সাত-সতেরো ব্যাপার নিয়ে একধরনের নাছোড়বান্দা অহংবোধ তো আছেই, তার সঙ্গে শ্বশুরালয় মানে আমাদের এই বাড়ির সবকিছু নিয়েই তার বিরক্তি আর অভিযোগমালা যেন একজন্মে শেষ হওয়ার নয়।

ree

আর তার উলটো দিকে আমার কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। মার তুলনায় আমি মাথায় বেশ খাটো, চপচপে স্বাস্থ্য, মুখটা গোলাকার, ভোঁতা নাক, পুরু ঠোঁট, চোখের কোণে তেমন কোনও ধার নেই, মণিতে দ্যুতি। আমার গায়ের রং অনেকটাই ময়লাটে, চামড়া খসখসে তৈলাক্ত, গালে ব্রণর প্রকোপ অসহ্য, কোঁচকানো চুলগুলো স্প্রিংয়ের মতো বেয়াড়া আর মোটা। যতই আঁচড়াই না কেন রুক্ষ চুল বাগে আনা যায় না, যত দামি সাবান মাখি না কেন ত্বক বদলায় না, যতই পিম্পল ক্রিম লাগাই না কেন ব্রণ কমার বদলে বেড়েই যায়। তখন সব রাগ গিয়ে পড়ে লাল মাথা আগ্নেয়গিরির মতো গাল ফুঁড়ে ওঠা ওই ব্রণগুলোর উপর। অপরিনামদর্শী আঙুলগুলো দিয়ে ওগুলোকে গায়ের জোরে টিপে দিই, নখের মাথা দিয়ে খুঁটে ফেলি আর ওগুলো দাগ ছেড়ে যায়, স্থায়ী গর্ত রেখে যায়।


এতসব সত্ত্বেও হ্যাক থুঃ হয়তো বলা যেত না কিন্তু এই মহিলার পাশাপাশি একছাদের নিচে থাকার জন্য কিছু খেসারত তো দিতেই হবে। সামনে হয়তো কেউ কিছু বলে। না কিন্তু আমি জানি পেছনে ওরা ফিসফিস করে। অমন লাবণ্যময়ী মায়ের এমন হতকুচ্ছিত মেয়ে কী করে সম্ভব। এ আবার অ্যাডপ্ট করা বা কুড়িয়েটুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চা নয় তো। কী কুক্ষণের ফলন কে জানে। ওরা মুখ টিপে হাসে। হয়তো এমনিই হাসে, একেবারেই অন্য প্রসঙ্গে হাসে, নিজেদের মধ্যে হাসে কিন্তু আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, ভেতরটা আনচান করে ওঠে, সন্দেহে কানখাড়া। আত্মীয় প্রতিবেশী পরিচিত অপরিচিতের বিয়ে পইতে অন্নপ্রাশন বাড়ি বা নানান পাবলিক গ্যাদারিং-এ গেলে লোকজনকে চাপা স্বরে হাসতে বা কথা বলতে। দেখলে অসহায় লাগে, মনে হয় নির্ঘাত আমাদের নিয়েই কথা বলছে। হাড়পিত্তি জ্বলে যায়, মনে হয় বলি সবসময় অত দাঁত বার করার কী আছে? মনে হয় চিৎকার করে বলে উঠি অত ফিসফাসের কী আছে? যা বলার জোরে জোরেই বলুন না, সামনে এসে সোজাসুজি বলুন। আসলে আমাকে দেখতে একেবারে বাবা বসানো। আনুপাতিক হারে বলতে গেলে বলতে হয় আমার সবকিছুর শতকরা সাতাশি ভাগ জুড়ে রয়েছে আমার বাবা আর মা বাকি ডেরো।


তেরো আনলাকি নাম্বার, তাই এত বিপত্তি। যাইহোক, বাবার কথা যখন এলই তখন বলি মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বাবা মানুষটা পৃথিবীর সবচেয়ে করুণতম মানুষদের মধ্যে একজন। চাকরি করেন মোটামুটি ভালো পদেই। রাজ্য সরকারের এক আধারুগ্ন অথচ ব্যস্ত দফতরের তলার দিকের ব্যাঙ্কের অফিসার। অফিসে লোকে ওকে স্যর স্যর বলে, চেয়ারে বসলে অনেকে 'বস', কিন্তু বাড়িতে ফিরলে ছবিটা পুরো উল্টো। তখন তাকে দেখলে মনে হয় যেন গৃহকত্রীর বশংবদ ও অতি অনুগত এক ভৃত্য অথবা কোনও এক অপরাধী যে বিনা অনুমতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যক্তির জন্য কঠোরভাবে সংরক্ষিত অঞ্চলে ভুল করে প্রবেশ করে ফেলেছে। কৃতকৃতে দৃষ্টি, সব ব্যাপারেই সংকুচিত, বিনয়াবনত, কৃতার্থ।

ree

বাবাকে স্থূলকায়ই বলা যায়, একটু বেশিই নার্ভাস প্রকৃতির, তার উপর বড্ড ঘামে। অফিস থেকে ফিরে শীতকাল ছাড়া সারা বছরই খালি গায়েই থাকে, পরনে দড়ি বাঁধা চেক চেক ঢোলা পাজামা। লোমশ উর্ধ্বাংশ অনাবৃত, মুখে নিঃশর্ত প্রসন্নতা। ক্রমশ সামনের দিকে বেড়ে চলা পেটটার জন্য মা'র কাছে নিত্যদিন খোঁটা শুনছে, উনপঞ্চাশ ছুঁতে না ছুঁতেই চেহারাখানা দিনকে দিন যেরকম বেঢপ হয়ে উঠছে সেই নিয়ে টেরাবাঁকা নানা মন্তব্য শুনছে তবু কোনও হেলদোল নেই। থাকবে কী করে, তাহলে তো মা'র কথামতো সকালে উঠে জগিংয়ে বেরোতে হয় বা ছাদে গিয়ে পাশের বাড়ির ভট্টচাজকাকুর মতো নিয়মিত ফিজিকাল এক্সারসাইজ। আর সব ব্যাপারে এত কর্মঠ কিন্তু এই ব্যাপারে কেন যে লোকটার গায়ে এত জ্বর আসে কে জানে? কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, "ছেড়ে দাও না, প্লিজ। ভুঁড়িটা বাড়ির ধাত বুঝতে পারছ না, বংশের ধাত। এ কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়, কিছু করেই কিছু না...।" মা কটমট করে তাকায়, চোখের কোণে প্ল্যাটিনাম ব্লেডের ধার, "ঠিক আছে তাহলে বেরোবে না আমার সঙ্গে রাস্তায়, বেরোবে না।" বাবার তা-ই সই। লোকটা হাসে, অম্লান বদনে হাসে।


পর্দার আড়াল থেকে শুনে ফেলে আমার ভীষণ রাগ হয়। লোকটার জন্য ভয়ানক দুঃখ হয়। ওঁর প্রতি সমবেদনা বিষের মতো দৌড়ে যায় শিরায় শিরায়। এ কী ধরনের মহিলা? নিজের স্বামীকে এত বড় কথাটা বলতে পারল? যে লোকটা এত চরিত্রবান এত ভদ্র এত ভালো, স্ত্রীর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, স্ত্রীকে নয়নে হারায়, তাকে খুশি করার জন্য কী না করে। তাকে এত বড় কথা বলতে পারল। কী জঘন্য অপমানজনক কথা। ওঁর জায়গায় আমি থাকলে তো মুখের উপর যা-তা বলে দিতাম, বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ করে দিতাম। আর এই লোকটাই বা কী? কোন ধাতুতে তৈরি? এত বড় কথা শুনেও দাঁত বার করে হাসছে। এই লোকটার প্রশয়েই এত বেড়েছে, কিছু না বলে বলে মাথায় চড়ে বসেছে। সুন্দরী তো সুন্দরী, তাতে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? ধরাকে সরা জ্ঞান করছে?

ree

অথচ সেই মহিলাকে তুষ্ট করার জন্য বাবার চেষ্টার অন্ত নেই। এই তো কিছুদিন আগেই মায়ের জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতে টাউনে সদ্য চালু হওয়া দেশ বিখ্যাত জুয়েলারি কোম্পানির ব্রাঞ্চ শোরুম থেকে হিরের দুল কিনে এনে হাজির। লাখ টাকার কাছাকাছি দাম। তার কিছু মাস আগে যখন সরকারি মিটিং অ্যাটেন্ড করতে ফ্লাইটে গুয়াহাটি গিয়েছিল ওখান থেকে অতি দামি আলি অসমিয়া সিল্ক। অথচ সেই লোকটাকে অফিস থেকে ফিরে বেশিরভাগ দিনই চা-টা পর্যন্ত নিজে করে খেতে হয়। কাজের মাসির রেখে যাওয়া খাবার নিজেই মাইক্রোআভেনে গরম করে নিতে হয়। নিজের শখশৌখিনতা বলে কিছু নেই, শুধু মানুষটা একটু খেতে ভালোবাসে তাই ছুটির দিনে ভেটকির পাতুরি, চিতল মাছের কালিয়া ইত্যাদি তেমন বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছে হলে নিজেই কাঁধে গামছা চাপিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। ভাব দেখে মনে হয় বলতে চায় নিজের ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণ করতে খামোকা আর বউকে কষ্ট দেওয়া কেন বাপু? রান্নাঘরে বড্ড গরম, তেল কালি ধোঁয়া, বউয়ের রং পুড়ে যাবে বা গরম তেল ছিটকে যদি মুখে-চোখে এসে লাগে, তাহলে কী হবে!


দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় সুন্দরী বউয়ের মুখে একটু হাস দেখার জন্য লোকটা সবকিছু করতে পারে, সেভাবে বললে। তিনতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ মেরে মরে যেতে পর্যন্ত পারে। কিন্তু বউয়ের মুখে তো হাসির দেখা মেলে না। কেন হাসি নেই? কীসের অভাব যে মহিলা হাসে না? মাকে কি জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পাত্র হিসেবে ওর কি বাবাকে কোনওদিনই পছন্দ হয়নি, বাবা কি ওকে কাঙ্ক্ষিত যৌনসুখ দিতে পারেনি, বিয়ের আগে সুদর্শন কোনও প্রেমিক ছিল? নাকি ওর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সুমিমাসি যেটা বলেছিল সেটা সত্যি? আমার জন্মের বেশকিছু বছর পরে মা নাকি চেয়েছিল ওর একটা পুত্রসন্তান হোক কিন্তু সেক্ষেত্রে আমার প্রতিপালনে অবহেলা হবে সেই আশঙ্কায় নাকি বাবা রাজি হয়নি? সেই নিয়েই কি ওর আমাদের ওপর রাগ? আমার ভাই হলে সে মা'র মতো ফুটফুটে সুন্দর হতেও পারত, তার দিকে তাকিয়ে গর্বে মায়ের বুক ফুলে উঠত আর তার মুখের হাসি জেগে থাকত সবসময়ের জন্য।


যাক সে যা হয়নি, হয়তো ভালোর জন্যেই হয়নি। কিন্তু যত বড় হচ্ছি আমার ভেতর এমন সব অনুভূতি তৈরি হচ্ছে কেন? যত দিন যাচ্ছে আমি যেন মহিলাকে একেবারে সহ্য করতে পারছি না। দিন দিন যেন একে অপরের চক্ষুশূল হয়ে উঠছি? মহিলা ছোট থেকেই আমার প্রতি বড্ড বেশি নির্দয় আর ক্ষমাহীন। সেইসময় থেকে ওর ভয়ে সবসময়ে তটস্থ হয়ে থাকতাম। বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমায় ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করেছিল, ওসব স্কুলে না পড়লে নাকি আমিও এই ফ্যামিলির ধারায় বয়ে গিয়ে আনসফিস্টিকেটেড ভূত তৈরি হব। সেই নার্সারি ক্লাস থেকে ওর তত্ত্বাবধানে সেই যে শুরু হয়েছিল আমার প্রাণান্তকর কড়া রুটিন, ঘুম ভাঙার পর থেকে রাতে চোখ বোজার আগে পর্যন্ত আজও তাতে ছেদ পড়েনি। অবশ্য মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে সায়েন্স নেওয়ার পর এই শেষ দেড় বছর আমার পড়াশুনোর উপর ওর নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই কমে গেছে কিন্তু খবরদারি বিন্দুমাত্র কমেনি। জয়েন্ট এনট্রান্স লিস্টের প্রথম দিকে আমার নাম জ্বলজ্বল করতে না দেখার আগে পর্যন্ত তার নাকি শান্তি নেই। সে নির্ঘাত নিজের ইগো স্যাটিসফাই করার জন্য, আমাকে ভালোবেসে নিশ্চয়ই না।

ree

শুধু তাই না, আগে কিছু কিছু ব্যাপার অত মাথায় খেলত না কিন্তু আজকাল কিছু কিছু ব্যাপার আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির দীপঙ্কর ভটচাজকাকুর আচরণ আমার অনেকদিন থেকেই সন্দেহজনক লাগে। সাতসকালে উঠে দোতলার ছাদে শর্টস আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে তার যে অত শরীরচর্চার বহর সে কি মাকে দেখানোর জন্য? বিকেলবেলায় অফিস থেকে ফিরে গান নিয়ে বসলে তার কি বেছে বেছে শুধু গদগদ সব প্রেমের গানগুলোই মনে পড়ে আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে/আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশ বেণী যাবে যকে খুলিতে...'। আমরা কিছু বুঝিনা ভেবেছে, বাবা না হয় সরলসোজা মানুষ কিন্তু এসব শয়তানি আমি ধরতে পারব না, কী ভেবেছেটা কী? সেদিন গাইছিল 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে', গাওয়ার পর ব্যালকনিতে এসে মাকে বলেছিল কী বৌদি শুনলেন, কেমন লাগল?" মাও কম যায় না, স্মিত হেসে বলল, "বেশ ভালো।" কোনও মানে হয়। আর সেদিন তো লোকটা ছাদের রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে মাকে চন্দ্রমল্লিকা ফুল দিচ্ছিল "বউদি, সবাই বলে নাকি আমার হাতে লাগানো গাছে ফুল হয় না। কিন্তু এইবার তো দেখছি বেশ হয়েছে, সবচেয়ে বড় ফুলটা আপনাকে দিলাম। মাও কী যে নির্লজ্জ, ফুলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল। বাড়িতে আঠেরো বছরের একটা মেয়ে আছে, ভুলে গেছে নাকি? রাতে বাবাকে বললাম, সে লোক তো হেসেই উড়িয়ে দিল। তার কী কনফিডেন্স। "না না ও কিছু না, ও কিছু না। দীপঙ্কর তোর মায়ের ফ্যান, অনেককাল থেকেই দারুণ ফ্যান।" ব্যাপারটা যে অত সহজ নয়, কী করে যে এই লোকটাকে বোঝাই? ওই লোকটার চোখের চাউনি স্বাভাবিক নয়, কী করে যে প্রমাণ করি?


মা অবশ্য ইদানীং বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোয় না। বেরোলে আমি সঙ্গে থাকি আর অবধারিতভাবে দেখি রাস্তার দুধারে পুরুষগুলো সব আড়চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। বুড়ো বুড়ো থেকে শুরু করে মাঝবয়সি কমবয়সি সব আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমার দিকে নয়, সব চোখ মায়ের দিকে। এমনকি আমার বয়সি ছেলেগুলো পর্যন্ত ওর দিকে তাকাচ্ছে। সেদিন তো সুপার মার্কেটের মোড়ের মাথায় আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম আর এলিজিবল ছেলে কুন্তলটা পর্যন্ত ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যেতেই একঝটকায় চোখ সরিয়ে নিল। ওর চোখে পাপ ছিল, নাহলে ওরকম চোরের মতো চোখ সরিয়ে নেবে কেন? সব পুরুষের চোখেই পাপ থাকে। ওফ, ভাবতে পারা যায় না। রাগে পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে, মনে হয় গিয়ে চোখগুলো গেলে দিয়ে আসি। পুরুষ জাতটাই এইরকম, সব সমান। আমার বাবার মতো দু'একটা ব্যতিক্রম ছাড়া সব সমান।


এইসব নানাকারণে ব্যাপারটা অনেকদিন থেকেই ঠিক নেই। কিচ্ছু ভালোলাগে না। খুব একা, বঞ্চিত, অসহায় লাগে। শুধু মনে হয় কী করে ওই মহিলাকে শায়েস্তা করব, পদে পদে হেনস্তা করে ওর জীবন হেল করে তুলব যেমন করে ও আমার আর বাবার জীবনটা হেল করে তুলেছে। বাবাকে দিয়ে হবে না, সে মোহগ্রস্ত। নাহলে সেদিন দোতলার সিঁড়ি থেকে ওইভাবে পড়ে গেলাম। সে অভিনয় করে বা যা করেই হোক ওইরকম জোর শব্দে অতগুলো সিঁড়ি গড়িয়ে নিচে এসে পড়লাম, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ভান করে অতক্ষণ পড়ে থাকলাম অথচ ওদের দুজনার চোখে যে পরিমাণ আতঙ্ক দেখতে পাব আশা করেছিলাম তার দশভাগের একভাগও দেখতে পেলাম না। মা যদিও ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার মাথায় জলটল দিয়ে টেনে


তুলে যারপরনাই নাটকে আন্তরিকতা দেখাতে চাইল কিন্তু তাতে আমার চিঁড়ে ভেজার নয়। বাবাকে বারবার বললাম মা'র হাতের গ্লাস থেকে সিঁড়ির ধাপে ছলকে পড়া জল থেকে এই বিপত্তি কিন্তু সে লোক বলল ওটা নাকি জাস্ট একটা অ্যাক্সিডেন্ট, তার পিছনে কিছুতেই মায়ের দায়টা দেখতে চাইল না, মহিলাকে তেড়ে ধমকে চরম কিছু বলে বসল না।


এই কক'দিন আগে যে সারাদিন না খেয়ে থাকলাম, মা যতবার খাবার দিয়ে গেছে ততবার যে ওগুলো কমোডে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে উপোস করে থাকলাম, রাতে যখন খিদেয় মরে যাচ্ছি চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করছি মনে হল যেন কারওর সে নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। মা'র নয় নেই, কিন্তু বাবার...? সে তো চিৎকার করে এত বড় অন্যায়ের একটা কৈফিয়ত চাইতে পারত। টেবিল চাপড়ে বলতে পারত "মেয়ে খেয়েছে কি খায়নি সেটা দেখার দায়িত্ব কার? জবাব দাও। সারাদিন আমার মেয়ে না খেয়ে থাকল আর তুমি টেরটি পেলে না। কেমন মা তুমি। বাড়িতে কীসের জন্য আছ, একটা মাত্র মেয়ে তার যত্নআত্তিটুকুও ঠিকমতো হচ্ছে না। দুনিয়া রসাতলে যাক আগে আমার মেয়ে। নিজের দায়িত্ব পালন না করতে পারলে চলে যাও, বাড়ি ছেড়ে চলে যাও, জাস্ট গেট আউট।"


আর সেদিন তো সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সন্ধে সন্ধে হয়ে আসছে, বাবা তখন অফিস থেকে ফিরে সিঁড়ির নীচে স্কুটারটা রাখছে, হঠাৎ ওর চোখে পড়ে পিছনের বাগান থেকে বাড়ির একতলায় একটা সাপ ঢুকছে। বাবা বলল পাক্কা গোখরো, জাত সাপ, কামড় বসালেই সুনিশ্চিত মৃত্যু। বাবার চিৎকার শুনে মা টর্চ নিয়ে নেমে আসছে দেখে বাবা তো একেবারে বিচলিত হয়ে উঠল। সাপটা কোথায় ঢুকল সেটা না দেখে আগে ব্যস্ত হয়ে উঠল মাকে তেতলায় পাঠাতে। বলতে লাগল "তোমায় দেখতে হবে না, তুমি ওপরে যাও। যা দেখার আমি দেখছি, আমি আর মেয়ে দেখে নিচ্ছি। আমি গ্রামের ছেলে, এসব সাপ-খোপ আমার কাছে নতুন কিছু নয়, তুমি আগে ওপরে যাও, আমরা সামলে নিচ্ছি।"


তারপর সেই সাপের তো হদিশ পাওয়া গেল না। সে যে কোথা দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে বেরিয়ে গেল বোঝা গেল না। সে তো হতেই পারে, পিছনে বাগান থাকলে হতেই পারে কিন্তু আমার যেটা খটকা লাগল সেটা বাবার আচরণ। কী বলে সে মা-কে নিরাপদ রাখতে তিনন্তলায় পাঠিয়ে দিল আর আমাকে রেখে দিল নিজের সঙ্গে। আমার জীবনের কি কোনও দাম নেই, সুন্দরী বউই তার বাবাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করায় সে হেসে উঠে বলেছিল "ওরে পাগলি, তোকে কী করে বোকাই। তুই যে আমার মেয়ে, আমার রক্ত, আমি আর তুই তো একই কিন্তু ওকে যে আমি অন্য বাড়ি থেকে বিয়ে করে এনেছি তাই ওকে আগে নিরাপত্তা দেওয়াটা আমার দায়িত্ব, আমার কর্তব্য।" কী কথা। আর আমি যেন কেউ না, আমি যেন ফেলনা। আমি ওর রক্ত বলে সাপটা সামনে পেলে আমায় যেন ছেড়ে দিত। উফঃ। সাপটা আমায় কামড়াল না কেন? কাটলে আমার জ্বালা জুড়তো, বেঁচে যেতাম, এ জন্মের মতো বেঁচে যেতাম।


জানি জানি এ ব্যাপারে বাধা আমার কোনও উপকারে আসবে না। তার ভাবগতিক দেখে মনে হয় মা'র মতো একজন মহিলাকে পেয়ে তার জীবন ধন্য হয়ে গেছে কিন্তু আমার তো ঠিক তার উল্টো। ওই মহিলার জন্য আমার এই জীবন তো হেল হয়ে গেছে, পুরো নরক। তাই যা করার আমাকেই করতে হবে। মহিলাকে আমাকেই জব্দ করতে হবে, আমাকেই শাস্তি দিতে হবে। হবে মানে, ফিউচার টেনস নয়, প্রেজেন্ট টেনস, প্রেজেন্ট পারফেক্ট। আমি শুরু করে দিয়েছি, ওকে উৎপীড়নের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছি। শারীরিক নিপীড়নের চেয়ে মানসিক নিপীড়ন অনেক শক্তিশালী তাই সেই পথেই এগোনো শুরু করে দিয়েছি। ছাড়ব না, ও যেমন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ আমিও ওর জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হয়ে দেখা দেব। আমার গর্ভধারিণী হলে কী হবে, ওই মহিলা তো আমায় চেনে না, আমি যে কতটা ভয়ংকর হতে পারি তা আমিই জানি।


আমার মিশন অলরেডি সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করে দিয়েছে। মায়ের নাকি রাতের ঘুম উড়ে গেছে। আমার পড়াশুনো নিয়ে। দুশ্চিন্তায় নাকি ওর শেষ ছ'মাস ধরে ঘুমই আসছে না। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে-মেয়ে নাইনটি সিক্স পার্সেন্ট পেয়ে স্কুল বোর্ডের ফাইনাল পাস করল, ডিস্ট্রিক্টের মধ্যে র‍্যাঙ্ক করল তার ক্লাস ইলেভেনের পর থেকে ক্রমাগত এত অধঃপতন কী করে হচ্ছে? দিন দিন স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় পারফর্মেন্স এত খারাপ কী করে হচ্ছে, আচার-আচরণ স্বভাব-চরিত্র দিন দিন কী করে এত নিচের দিকে নামছে? পড়াশুনোয় এতটা অমনোযোগ, এতখানি ঢিলেমি, বলা নেই কওয়া নেই প্রাইভেট টিউশন কামাই, পদে পদে ওকে অপদস্থ করা, লোকের সামনে ওকে অপমান, ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে খিটিমিটি, বাড়িতে নিত্য অশান্তি, সারাদিন মোবাইল হাতে নিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট খুলে বসে থাকা আমি জানি এগুলো মা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। যত সহ্য করতে পারবে না তত অসহায় হবে, তত বিপন্ন, তত কোণঠাসা। আর তাতে ওর রাতের ঘুম কমবে, একদিন একেবারেই ঘুম চলে যাবে। যাবেই তো, যাওয়াই তো উচিত। আমার জীবনটাকে এইভাবে বরবাদ করে দেওয়ার প্রধান কারণ হয়ে সে কী করে ঘুমোতে পারে, নির্বিঘ্নে কী করে ঘুমোতে পারে?


প্রত্যেকটা দিন, প্রত্যেকটা মুহূর্ত মানসিক অশান্তিতে ভুগতে ভুগতে, অনিদ্রায় টেনশনে অবসাদে ওর চোখে-মুখে তার ছাপ পড়বে। চোখের তলায় কালি পড়বে, গায়ের রং চেপে যাবে, চুঁইয়ে পড়া গ্ল্যামার নষ্ট হবে, মুখে চোখের কোণে দেখা দেবে অজস্র বলিরেখা, পাক ধরবে চুলে আর আমার খুব আনন্দ হবে। তখন আসবে আমার শোধ নেওয়ার পালা। নিত্যদিন আমি ওরে মনে করিয়ে দেব দিন দিন তোমায় দেখতে কী বিশ্রীই না হয়ে যাচ্ছে? এককালে সোনার প্রতিমার মতো কী তোমার রূপ ছিল আর আজ কী হয়েছে। কী জগনা, কী কুৎসিত। আয়নায় দেখে নিজেই লজ্জা পাবে। তুমি আমার সঙ্গে রাস্তায় বেরোবে না, বাবার সঙ্গেও না। তুমি বাড়িতেই থাকবে, নিজের ঘরের মধ্যেই আটকা পড়বে, বন্দি। আমি অবশ্য তখন বাইরে আহা রে আন্না রে করব, কিন্তু ভিতরে ভিতরে হাততালি দেব, লাফার ঝাঁপার। আমায় বলেছিলে না মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া সরকার তখন দেখা যাবে কে মনোচিকিৎসকের কাছে যায়? আমার ময়ে মাও যেদিন সায়কায়াট্রিস্টের কাছে যাবে, মানে আমি যেতে বার করব সেদিন উচ্চৈঃস্বরে বলব, মাই মিশন ইজ সাকসেসফুল, পারফেক্টলি সাকসেসফুল।


আমি নিজেই জানি না আমি এ কোন দিকে এগোচ্ছি। মায়ের উপর নির্মম নিঃশব্দ অত্যাচার চালাতে গিয়ে এ কোন দিকে চলে আসছি। পড়াশুনোয় অনেক পিছিয়ে পড়েছি তো বটেই যেসব বন্ধু-বান্ধবীরা আমার চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল তারা ক্রমাগরে উপরে উঠে আসছে। যে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথস আমার এত প্রিয় ছিল সেইসব বইখাতা দেখলে আজকাল আমার কেমন যেন ভয় করছে। আমি পালাতে চাইছি আর দিন দিন আশ্রয় পাচ্ছি ইন্টারনেটের ভারচুয়াল দুনিয়ায়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের আমার দুটো অ্যাকাউন্টে পাঁচ হাজার পাঁচ হাজার আমার দশ হাজার ফ্রেন্ডস। তাদের বেশিরভাগই নানা বয়সের নানান রকম পুরুষ। ওদের সঙ্গে আমি দিনরাত চ্যাট করি, চুটিয়ে ফ্লার্ট করি। দামি ক্যামেরায় দারুণ দারুণ পোজে ছবি তুলে, মনের মতো' এডিট করে বিউটি এফেক্ট দিয়ে প্রোফাইল পিকচারে আপলোড করি। এমনিতে আমাকে দেখতে যেমনই হোক না কেন সে সব ছবিতে আমায় স্বপ্ন সুন্দরীর মতো লাগে। এক একটা ছবিতে হাজারের কাছাকাছি লাইক পড়ে, পাঁচশো-সাতশো কমেন্ট। পুরুষদের প্রশংসার চেয়ে সুখকর যেন নারীর জীবনে আর কিছু থাকতেই পারে না। যেসব মেয়েরা বলে পুরুষদের অ্যাটেনশন তাদের ভালোলাগে না তারা হয় অসুস্থ না হয় মিথ্যে কথা বলছে। আমার কাছে এখন পুরুষের অ্যাটেনশন পাওয়াটা নেশার মলে, এর চেয়ে বড় নেশা পৃথিবীতে আর কী আছে আমার জানা নেই।

ree

অ্যাটেনশন আরও অ্যাটেনশন চায়। রোজ রোজ খিদে বাড়িয়ে দিয়ে আরও বেশি আরও বেশির দিকে হাত বাড়ায়। কোনওদিন অ্যাটেনশন কম পড়লে তাই অস্থির অস্থির লাগে, পাগল পাগল। তাই মরিয়া হয়ে উঠি, কী করলে সবচেয়ে বেশি অ্যাটেনশন পাওয়া যায় সেই চেষ্টায় মেতে থাকি। ইদানীং আমি ভয়ানক সাহসী হয়ে উঠছি, চ্যাটে সাহসী কথাবার্তা তো বটেই আজকাল গল্প আমি ভীষণ বোল্ড সব ছবি পোস্ট করছি। মেক-আপ করছি, দক্ষ হাতে চোখ কাজলচর্চিত করছি, সংক্ষিপ্ত সব জামা-কাপড় পরছি, শরীরের নানান বিপদজনক সব ভাঁজ, বিভাজিকা প্রদর্শন করে করে ছবি তুলে পোস্ট করছি। ভয়ানক আকর্ষণীয়া আবেদনময়ী হয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন ধরনের পুরুষরা আছে ওপারে। ওরা ইনবক্সে নানারকম কমেন্ট করে, প্রস্তাব পাঠায়, কেউ কেউ বিচিত্র সব আহবান করে বসে। সেইসব কিছুতে আমি প্রতিক্রিয়া জানাই না কিন্তু মনে মনে ব্যাপারগুলোকে এনজয় করতে বাধা কোথায়। আমি তো সত্যি সত্যি গুদের আহ্বানে সাড়া দিতে যাচ্ছি না। হয়তো দিতেও পারতাম যদি বাস্তবেই আমি আমার ছবিগুলোর মতোই সুন্দরী হতাম। বাস্তবে দেখলে আমার সেইসব অনুরাগীদের নির্ঘাত মোহভঙ্গ হবে তাই আমি এই ভারচুয়াল জগতের বাইরে পা দিতে চাই না ভুলেও।


আসলে অতসব আমার ততটা উদ্দেশ্যও ছিল না, আমি মাকে হারাতে চেয়েছিলাম হারিয়ে দিয়েছি। যে করেই হোক এই ব্যাপারে অন্তত মাকে সোহারা হারিয়ে দিয়েছি। মা আর জীবনে কী করল। সারা জীবনে এই তো দু'চারটে পুরুষের বাইরে তেমন কারওর পাত্তাই পেল না কিন্তু আমার পুরুষ বন্ধু হাজার হাজার। তারা আমি কখন নেটওয়ার্ক অন করে বসব তার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকে। এই জগতে অন্তত ওই মহিলা কোনওদিন আমার ধারেকাছেও আসতে পারবে না। তাই আজকাল আমি মাকে দেখলে মাঝে মাঝে ফিক ফিক করে হাসি। কেন হাসছি মা ধরতে পারে না, বেচারি টেরও পায় না ঠিক কোন জায়গায় আমার কাছে ডাহা হেরে বসে আছে। যে যাই বলুক ম্যাডাম, জেতার আনন্দটাই আলাদা। জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে যে তৃপ্তি তার সঙ্গে তুলনা হয় না আর কিছুরই।


জিতেছি তো বুঝলাম কিন্তু তাতেও কি আমি ভালো কি আমি সুখে আছি? বিশ্বাস করুন সবাই, বিশ্বাস করুন আমার মনোচিকিৎসক শ্রীমতী শর্মিষ্ঠা দত্ত আমি মোটেও খুব একটা ভালো নেই। দিন দিন যেন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছি। মনের মধ্যেই কেমন একটা অচেনা অঞ্চলের দিকে চলে যাচ্ছি, কেমন যেন একটা অদ্ভুত ধোঁয়াশার আবর্তের মধ্যে এসে পড়েছি। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হাঁটছি যেন, পায়ের তলায় এখনও মাটি পাচ্ছি কিন্তু আর বেশিদিন মনে হচ্ছে পাব না। আজকাল পা বাড়াতে কেবলই খুব ভয় লাগছে, কী জানি যদি আর দু'এক পা পর থেকে পায়ের তলায় মাটি না পাই। এগোতে এগোতে পৌঁছে যাই কিনারায়, তার পরেই তো খাদ, অতল গভীর খাদ। সেখানে পা পড়লে তো তলিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। তখন তো হাজার চিৎকার, করলেও কেউ আসবে না। বাবা, মা, বন্ধু বান্ধবী কেউ না। তখন কী হবে, তখন আমার কী হবে ম্যাডাম?


না না, আমায় ভুল বুঝবেন না, আমি কিন্তু দ্বন্দ্বে ভুগছি না, বিবেকের তাড়নায় কষ্ট পাচ্ছি না, মোটেও ভয় পাচ্ছি না। আমি নিশ্চিত, আমি মহিলাকে পছন্দ করি না, যদিও ওই আমি ওকে কোনও মনে আর ভালো চোখে দেখতে পারব মহিলা আমার জন্য অনেক কিছু করেছে তবুও আমি নিশ্চিত না। হ্যাঁ আপনি বলতেই পারেন আমি একচেটিয়া মহিলাকে দোষারোপ করে যাচ্ছি, ওর দিক থেকে সমস্যাটা দেখতে চাইছি না। হয়তো সেটা পুরোপুরি ভুল না কিন্তু আমি আর কীই বা করতে পারতাম। এই মহিলার ছায়া আমায় আজীবন যে কীভাবে তাড়া করে নিয়ে বেড়িয়েছে, হয়তো বা মরা না পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে বেড়াবে, সেটা জানলে আপনি আমার সমস্যাটা ঠিকমতো বুঝতেও পারতেন। আমার যন্ত্রণার জায়গাটা ধরতে পারতেন।


যাগ গে ম্যাডাম, শরীরের যন্ত্রণা একরকম কিন্তু মনের যন্ত্রণা জিনিসটা এমনই পাতার পর পাতা লিখে গেলেও মনে হয় যেন কিছুই বলা হল না। আপনি আমার মা সম্পর্কে আমার কী কী মনে হয় লিখে রাখতে বলেছিলেন তাই লিখতে লিখতে এতসব কথা লিখে ফেললাম। মনে যা যা আসবে তাই তাই আপনার দেওয়া এই খাতায় লিখে আপনাকে দেখাতে বলেছিলেন বলে একটানা বসে লিখে গেলাম। আপনি আমার মনোচিকিৎসক, চিকিৎসকের কাছে কিছু লুকোতে নেই তাই অকপটে লিখে গেলাম। আপনি আমায় খারাপ ভাবতে পারেন কি ভালো সেইসব ভয় সংশয়মুক্ত হয়ে লিখেগেলাম। আশা করি আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না, ভুলেও আমার মায়ের কানে এসব কথা তুলবেন না। পড়েই খাতার স্পাইরাল বাইন্ডিং থেকে পাতাটা খুলে নিয়ে, ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন।


আর হ্যাঁ, আর একটা কথা, আপনি এই খাতাটা আমার হাতে তুলে দেওয়ার আগে তার উপরে লিখে দিয়েছিলেন অনীশার খাতা'। সেটা কেটে আমি মার্কার দিয়ে লিখে দিয়েছি 'অমানিশার খাতা'। এমনিতে আমার নাম অনীশা হলেও, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আমার নাম অমানিশা যার অর্থ আপনি বিলক্ষণ জানেন অমাবস্যার অন্ধকার। মনে হয় আমি ঠিকই করেছি, অনীশার ভিতরে যে অমানিশা বাস করে এই কথাগুলো ওই লিখেছে তাই এই খাতার নাম অমানিশার খাতা হওয়াই হয়তো ঠিক হবে। আশা করি, আপনার চিকিৎসায় থাকতে থাকতে একদিন অমানিশা চিরকালের মতো ফুরিয়ে যাবে বা তার পোড়া ছাইয়ের মধ্যে থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে আসবে অনীশা। তখন নিশ্চয়ই এই খাতাটার আর প্রয়োজন থাকবে না। আপনার চিকিৎসার সাফল্য কামনা করি। আপনি আমার প্রণাম জানবেন। শুভেচ্ছান্তে বিনত অমানিশা।


Comments


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page