top of page

দেশজুড়ে শক্তির আরাধনা এবং বিশেষ ভোগ, পাহাড়ী পথ থেকে শহুরে স্ট্রিট ফুডে মোমো, শতাব্দী প্রাচীন পুজোর বাসনপত্র ও বাংলার কাঁসা শিল্প, রবিবারের গল্প: ফেরা

দেশজুড়ে শক্তির আরাধনা এবং বিশেষ ভোগ

ree

আশ্বিনের পূর্ণিমা পেরিয়ে যখন অমাবস্যার ঘন কালো রাত নামে, তখনই বঙ্গজীবনের হৃদয়ে জ্বলে ওঠে এক অলৌকিক দীপ মা কালী। আলোর উৎসব দীপাবলি আর তারই মর্মে নিহিত দীপান্বিতা কালীপুজো, যা শুধু এক রাত্রির পূজা নয় এটি শক্তির, সাহসের, এবং শুভাশুভের চিরন্তন দ্বন্দ্বে আলোর বিজয়ের আরাধনা।


দেশজুড়ে শক্তিপূজার ঐতিহ্য:

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী থেকে শুরু হয় বাংলার উৎসব মরশুম, যার পরম পরিণতি এই দীপান্বিতা অমাবস্যায়। মা দুর্গা থেকে মা কালী, মা লক্ষ্মী থেকে মা জগদ্ধাত্রী প্রতিটি দেবীই এক এক রূপে আদ্যাশক্তি। তবে কালীই সেই মহাশক্তি যিনি সময়, মৃত্যু, ও ভয়কে অতিক্রম করেন। ভারত জুড়ে, বিশেষত পূর্বাঞ্চলে, কালীপুজো তাই হয়ে ওঠে শক্তির আরাধনার এক ঐতিহ্যবাহী প্রতীক।

ree

কলকাতার কালীমন্দিরে উৎসবের আমেজ:


দক্ষিণেশ্বর ভবতারিণী কালীমন্দির:

রানি রাসমণির প্রতিষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক মন্দিরে দীপাবলির রাতেই সবচেয়ে বেশি ভক্তসমাগম হয়। রাতভর চলে আরতি, ভক্তিগান, প্রদীপদান ও বিশেষ ভোগ খিচুড়ি, লুচি, আলুভাজা, ছোলার ডাল, মিষ্টান্ন ও নারকেল-নাড়ু। নদীর ঘাট জুড়ে দীপের আলোকরেখা যেন দেবী ভবতারিণীর পায়ের ধূলি।


কালিঘাট কালীমন্দির:

শাক্তপীঠগুলির অন্যতম এই মন্দিরে কালীপুজো মানেই ভক্তদের ঢল। দেবীর পূজায় ‘বলিদান’ প্রথা আজও প্রতীকীভাবে পালিত হয় কুমড়ো ও আখ দিয়ে। দেবীকে নিবেদন করা হয় ভোগের তেরো পদ, যার মধ্যে প্রধান ভোগখিচুড়ি, লাউঘণ্ট, ছানার তরকারি ও মিষ্টি চিঁড়ে।

ree

শোভাবাজার রাজবাড়ির কালীপুজো:

রাজা নবকৃষ্ণ দেবের আমল থেকেই এই রাজবাড়ির কালীপুজো ঐতিহ্যমণ্ডিত। এখানে দেবীর রূপ ভদ্রকালী, আর পুজো হয় শাক্ত ও বৈদিক উভয় মন্ত্রে। রাজবাড়ির নবমহলের ভিতর পঞ্চপ্রদীপের আলোয় দীপ্ত হয় দেবীর মুখমণ্ডল যা এক অপার্থিব দৃশ্য।


অদ্যাপীঠ, বারাসত:

স্বামী অদ্যাশক্তানন্দ ব্রহ্মচারী প্রতিষ্ঠিত এই পীঠে কালীমূর্তি অদ্যা মা নামে পূজিত। এখানে পূজার মূল ভাব শক্তি মানেই প্রেম। ফল-ফুলের সঙ্গে ভক্তরা মা-কে নিবেদন করেন ভাত-ডাল-সবজি-মিষ্টান্ন, যা পরে ‘প্রসাদ’ হিসেবে বিতরণ করা হয় হাজারো মানুষের মধ্যে।

ree

রামপ্রসাদী কালী, হালিশহর:

কবিয়াল রামপ্রসাদ সেনের আরাধ্যা মা, যিনি আজও পূজিত ‘রামপ্রসাদী কালী’ নামে। এখানে দেবীর মুখে চিরপ্রসন্ন হাসি ভয়াল নয়, মমতাময়ী। পূজার বিশেষ ভোগ চাল-ডাল, আলু-পোস্ত, মিষ্টি ও নারকেল লাড্ডু।


গ্রামবাংলায় শক্তিপূজার রূপ:

গ্রামবাংলার কালীপুজো শহরের থেকে আলাদা। সেখানে মণ্ডপ সাজে কাঁসার প্রদীপ, ধূপ-ধুনো, তালপাতার আলপনা আর তালপাতার বাঁশে গাঁথা প্রদীপে। অনেক জায়গায় আজও কালীপুজো মানেই রাত্রিকালীন যাত্রাপালা, পাঁঠা-ভোগ, আর ভোররাতের ‘মা ডাক’ "জাগো কালী, জাগো মা!"

ree

পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে সর্বত্র:

আসামের কামাখ্যা, ত্রিপুরার উদয়পুর, ওড়িশার শ্মশানতীর্থ সর্বত্রই আজ কালী আরাধনায় দীপ জ্বলে। দক্ষিণ ভারতে তাঁকে পূজা করা হয় ‘মীনাক্ষী’ বা ‘চামুন্ডেশ্বরী’ নামে। এমনকি মুম্বই, দিল্লি, ব্যাঙ্গালুরুতেও প্রবাসী বাঙালিদের হাতে আজ দীপান্বিতা কালীপুজো এক মিলনমেলা।


অমাবস্যার কালো রাত তাই শুধু অন্ধকার নয় এটি মায়ের আবির্ভাবের সময়। মা কালী যেন ভয়কে জয়ে, মৃত্যুকে জীবনে, আর অন্ধকারকে আলোয় রূপান্তরিত করেন। এই দীপান্বিতা কালীপুজো তাই আমাদের হৃদয়ে একটাই প্রার্থনা জাগায়

“অলক্ষ্মী যাও ছারেখারে, এস মা লক্ষ্মী ঘরে

অশুভের পরাজয়ে জাগুক শুভশক্তির আলো।”

ree

পাহাড়ি পথ থেকে শহুরে স্ট্রিটফুডে মোমো

টিম অনন্যা


আট থেকে আশি, মোমোর জনপ্রিয়তা বর্তমানে তুঙ্গে! এটি আজ শুধু একটি খাবার নয়, এক সুস্বাদু অনুভব, যা আজ শহরের অলিতে-গলিতে, অফিস পাড়া থেকে কলেজ ক্যান্টিনে, সর্বত্র এক জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুডে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মোমোর যাত্রা শুরু হয়েছিল পাহাড়ি পথ বেয়ে, তিব্বত ও নেপালের নির্জন গাঁথা থেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপ ও রসনার ভিন্নতা বদলে দিয়েছে তাকে, তবু তার অন্তরালের সেই গরম ভাপ আর মশলাদার পূরণের জাদু আজও অমলিন।

ree

এদেশে কোথা থেকে এলো মোমো?

মোমোর জন্মভূমি তিব্বত। কথিত আছে, তিব্বতী ভাষায় mog mog শব্দের অর্থ ‘স্টিমড রুটি’। তিব্বতের প্রাচীন বৌদ্ধ গৃহস্থালিতে মোমো ছিল পারিবারিক খাবার, সাধারণত মাংস বা সবজির পুর দিয়ে বানানো হত। পরবর্তীতে এই খাবার নেপাল, ভুটান, সিকিম, লাদাখ হয়ে ভারতের দার্জিলিং, কালিম্পং ও শিলিগুড়ির দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকেই শহর কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, সব শহরের রাস্তায় সে স্ট্রিটফুড রূপে রাজত্ব করতে শুরু করে। সময় বদলেছে, বদলেছে উপকরণ ও পরিবেশনের ধরণও। এখন শুধু ভেজ বা চিকেন নয়, মোমো যেন হয়ে উঠেছে ফিউশন খাদ্যসংস্কৃতির প্রতীক।


ভিন্ন স্বাদে মোমো:


ভেজ মোমো: বাঁধাকপি, গাজর, পেঁয়াজ, পনির, কর্ন এর পুর ভরা সঙ্গে সামান্য তেল মশলার সিজনিং।


চিকেন মোমো: মাংসের মিহি কিমা ও মশলার পুরভরা। সাধারণত সবথেকে বেশি জনপ্রিয়।


ফিশ মোমো: সামুদ্রিক মাছের পুর ভরা, সাধারণত স্টিমড বা ফ্রায়েড।


চিজ মোমো: গলানো চিজ ও কর্নের সংমিশ্রণ। অনেক সময় মাংসের কিমা ও অন্যান্য সবজি থাকে।


চকলেট মোমো: ডেজার্ট মোমোর রূপ। ভেতরে থাকে মেল্টেড চকলেট।


মশলা মোমো/তন্দুরি মোমো: গ্রিল করা মোমোতে মশলা মাখিয়ে গ্রিল করছ চাট মশলা আর ধনেপাতার চাটনি সহ পরিবেশন করা হয়।


স্টিমড মোমো: ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে তৈরি এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।


ফ্রাইড মোমো: ডিপ ফ্রাই করে সোনালি রঙের খাস্তা স্বাদ।


প্যান ফ্রাইড/ কুরকুরে মোমো: নিচে হালকা করে ভাজা, ওপরটা নরম থাকে।


সিজলিং মোমো: হট প্লেট-এ পরিবেশন করা হয়, সঙ্গে থাকে ঝাল সস।


স্যুপ মোমো: ঝোল সহ পরিবেশিত, সাধারণত নেপালী বা তিব্বতি খাবারে প্রচলিত।

ree

কলকাতা ও শিলিগুড়িতে মোমো এখন একটি অনিবার্য রাস্তার খাবার। কলেজ ক্যাম্পাস, পার্ক, অফিসপাড়া, সব জায়গায় দেখা মেলে মোমো স্টলের। সজল সস আর গরম ভাপ ওঠা মোমোর থালা যেন স্ট্রেস দূর করার ছোট্ট ছুটি। স্ট্রিট স্টাইলে তন্দুরি মোমো বা মায়োনিজ-মোমো, এমনকি তেবিলে পরিবেশিত কন্টিনেন্টাল সস-সহ চিজ বেকড মোমো, সবই শহুরে রসনার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। তিব্বতি ও নেপালি পরিবারে মোমো শুধুমাত্র খাবার নয়, এটি উৎসবেরও অংশ। পরিবারের সকলে মিলে মোমো তৈরি করে, একসঙ্গে খাওয়া হয়। এই ‘মোমো মেকিং’ আসলে এক সামাজিক আচার। এখন শহরাঞ্চলেও বন্ধুদের আড্ডা, টিউশন ফাঁকি, পার্টির নৈশভোজ, সব কিছুর কেন্দ্রে মোমো নিজের স্থান করে নিয়েছে।

ree

মোমো তার সরলতা, নরম আবরন, সুস্বাদু পুর আর ঝাঁঝালো সসের মাধ্যমে তৈরি করে এক চিরন্তন টান। পাহাড়ি উপত্যকা থেকে শহরের কোলাহল, মোমোর এই যাত্রা শুধু ভৌগোলিক নয়, তা সাংস্কৃতিকও। নানা রূপে, নানা স্বাদে মোমো যেন এখন এক আধুনিক ভারতীয় রূপকথা—যা কখনও তিব্বতের উপকথার মতো শান্ত, কখনও আবার মসলাদার শহুরে চমক।

শতাব্দী প্রাচীন পুজোর বাসনপত্র ও বাংলার কাঁসা শিল্প

টিম অনন্যা


বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলতে শুধু গান, নৃত্য বা সাহিত্যের কথাই নয়; বাংলার ঘরবাড়ি, পুজো-পার্বণ এবং দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য জিনিসপত্রও সেই ঐতিহ্যের অংশ। বিশেষ করে, দুর্গাপুজো, কালীপুজো, কোজাগরী তে ব্যবহৃত বাসনপত্র, যেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। তাতে বাংলার শিল্প ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গভীর ছাপ দেখা যায়। এই পাত্রগুলির মধ্যে কাঁসা শিল্পের ভূমিকা অতুলনীয়। চরক সংহিতায় বলা হয়েছে, ‘কানসিয়ম বুদ্ধিবর্ধকম’, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় “কাঁসায় বুদ্ধি বাড়ে”। এ কথা শুধু উপহাসযোগ্য শব্দ নয়; বাংলার প্রাচীন ঘরে-ঘরে কাঁসার বাসন ব্যবহারের বিজ্ঞানিক এবং স্বাস্থ্যগত কারণও রয়েছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী, খাদ্যবস্তু কাঁসার সংস্পর্শে এলে তা জীবাণুমুক্ত হয় এবং পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে কাঁসার বাসনে নিয়মিত খাদ্যগ্রহণ করলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং মানসিক ও শারীরিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এমনকি কাঁসার পাত্রে আট ঘণ্টার বেশি জমিয়ে রাখা জল মানবশরীরের পক্ষে অত্যন্ত উপযোগী।


বাংলার কাঁসা শিল্পের উৎপত্তি ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রায় অষ্টম শতাব্দী থেকে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে কাঁসা ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়। মূলত আঞ্চলিক শিল্পীরা হাতের কারুকাজে নানা ধরনের কাঁসার পাত্র তৈরি করতেন। শিল্পীদের নকশা, ধাতুর মান এবং কারুকাজের সূক্ষ্মতা এই শিল্পকে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের শিল্পের থেকে আলাদা করেছে। চাঁদপুর, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ও মালদার বিভিন্ন অঞ্চলে কাঁসার শিল্প এখনো জীবন্ত।কাঁসার পাত্রের নকশা প্রায়শই প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত। ফুল, পাতা, পাখি, মাছ, জোড়া হাতি, দেবতার চিত্র এসব কাঁসার পাত্রে খোদাই করা হয়। শুধু নকশা নয়, পাত্রের আকার ও ধরনও বিস্তৃত: হাঁড়ি, কড়াই, বিভিন্ন আকারের বাটি, হাতা-খুন্তি, থালা, কাপ, সবই কাঁসায় রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলার গ্রামীণ ঘরে এই সব কাঁসার পাত্র পুজোর সময় যেমন ভোগ বা খাদ্য পরিবেশনের কাজে ব্যবহৃত হয়, তেমনি এককালে সাধারণ বাড়ির দৈনন্দিন কাজেও ব্যবহৃত হত।

ree

তবে বাংলার প্রাচীন পুজোর সময় ব্যবহৃত বাসনপত্র কেবল খাবার পরিবেশনের জন্য নয়, বরং তা দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। পুজোর ভোগে খিচুড়ি, পোলাও, চালের পায়েস, দুধ, ফুল বেলপাতা, মিষ্টি সবই কাঁসার পাত্রে পরিবেশিত হয় এখনও। বিশেষ করে দুর্গাপুজো, কালীপুজো এবং সরস্বতী পুজোর সময় এই পাত্রের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাঁসা নির্মিত পাত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর স্বাস্থ্যকর দিক। খাদ্য বা জল কাঁসার সঙ্গে সংস্পর্শে এলে তা জীবাণুমুক্ত হয়। ফলে পুজোর ভোগের সময় ভক্তরা সুস্থ ও নিরাপদভাবে প্রসাদ গ্রহণ করতে পারতেন। পাশাপাশি, কাঁসা বাসন জলের স্বাদও উন্নত করে, দীর্ঘ সময় জমিয়ে রাখলে জল শরীরের জন্য উপকারী হয়ে ওঠে। এই কারণে পুজোর সময়, বিশেষ করে উৎসবের দিনগুলোতে কাঁসার বাসনের ব্যবহার স্বাভাবিক ছিল।


বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে কাঁসা পাত্রের নকশা এবং ব্যবহারের ধরন ভিন্ন। পূর্ববঙ্গের চাঁদপুর বা মেদিনীপুরের কাঁসার শিল্পী অত্যন্ত সূক্ষ্ম খোদাই কাজ করেন। ফুল ও পাখির নকশা এখানে প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়া অঞ্চলে নকশায় জ্যামিতিক প্যাটার্ন এবং জোড়া হাতির চিত্র ব্যবহৃত হয়। এসব কাঁসার পাত্র পুজোর সময় যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি তা উপহার হিসেবে দেওয়া-নেওয়া হত।


নকশার বৈচিত্র্যের সঙ্গে কাঁসার বাসনের ধরনও বিবিধ। ছোট আকারের ঢাকনা সহ জলের পাত্র, পুস্পপত্র, বারকোশ, বিভিন্ন ধরনের প্রদীপ, কর্পূরদানী, পায়েসের বাটি, মিষ্টির পাত্র সবই বিভিন্ন রূপে দেখা যায়। এই সমস্ত পাত্র শুধু সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার প্রতীক নয়, বরং খাদ্য সুরক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত কার্যকর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮তম ও ১৯শ শতাব্দীর বাংলার মন্দির এবং পুজোৎসবের সময় কাঁসার বাসনের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। সেই সময়ের অনেক পরিবার আজও প্রজন্মান্তরে কাঁসার থালা, পাত্র ও জলপাত্র সংরক্ষণ করে রেখেছে। পুজোর সময় এই পাত্রগুলি ব্যবহার করা মানে শুধু ঐতিহ্য সংরক্ষণ নয়, বরং প্রাচীন আচার, বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানকে সম্মিলিতভাবে অনুসরণ করা।

ree

প্রাচীন কাঁসার পাত্রের মধ্যে বিশেষ স্থান ছিল দেবতা প্রদানের জন্য ব্যবহৃত পাত্রের। এগুলির উচ্চতা, আকার, ও নকশা দেবতার আভিজাত্য ও ভক্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। যেমন, দুর্গাপুজোর সময় বড় থালা যাকে বলা হয় পরাত অথবা হাঁড়ি কাঁসা দিয়ে তৈরি করা হতো, যাতে বিস্তীর্ণ ভোগ একসঙ্গে পরিবেশিত হতে পারে। কাঁসার পাত্র শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, স্বাস্থ্যকরও বটে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী কাঁসার সংস্পর্শে খাদ্য জীবাণুমুক্ত হয়। কাঁসা পাত্রে রাখা জল দীর্ঘ সময়ের জন্য তাজা থাকে এবং শরীরের জন্য উপকারী। নিয়মিত কাঁসার পাত্রে জল বা খাদ্য গ্রহণ হজমশক্তি বৃদ্ধি করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং মানসিক ও শারীরিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। তাই, বাংলার প্রাচীন ঘরে কাঁসা পাত্র শুধু সাজসজ্জা নয়, বরং স্বাস্থ্যকর জীবনের অংশও ছিল।

ree

বিগত কয়েক দশকে শিল্পায়নের ফলে কাঁসার শিল্প কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। প্লাস্টিক ও স্টেইনলেস স্টীলের বিকল্প পাত্র কাঁসার স্থান দখল করেছে। তবু বাংলার অনেক পরিবার এখনও পুজোর সময় কাঁসার বাসন ব্যবহার করে। এছাড়া, আধুনিক শিল্পীরা কাঁসার নকশায় নতুনত্ব আনছেন, যেমন: জ্যামিতিক প্যাটার্ন, লেজার কাটিং এবং হস্তনির্মিত খোদাই। পুজোর সময় কাঁসার পাত্র ব্যবহার কেবল ঐতিহ্য নয়, স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্যও উপকারী। কাঁসার জল, খাদ্য পরিবেশন এবং ভোগের মাধ্যমে প্রাচীন বাঙালি জীবনধারার অংশ আজও নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দেয়।

ree

বাংলার শতাব্দী প্রাচীন পুজোর বাসনপত্র কেবল ব্যবহার্য বস্তু নয়; এগুলো বাংলার সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও স্বাস্থ্যকর ঐতিহ্যের প্রতীক। কাঁসার শিল্পের সূক্ষ্ম নকশা, আকার বৈচিত্র্য এবং স্বাস্থ্যগুণ এই শিল্পকে সময়ের সঙ্গে সাথে মূল্যবান করে তুলেছে। পুজোর ভোগে ব্যবহৃত কাঁসার বাসন কেবল আধ্যাত্মিক আনন্দ দেয়নি, বরং স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রতীক হিসেবেও কাজ করেছে। বাংলার কাঁসা শিল্প ও প্রাচীন পুজোর বাসনপত্র এই অঞ্চলীয় ঐতিহ্যের এক অপূর্ব অধ্যায়, যা প্রজন্মে প্রজন্মে সংরক্ষিত হয়ে আজও বাংলার ঘরে ঘরে জীবন্ত।

ফেরা

দেবদত্ত পুরোহিত


চাকরিতে অবসর গ্রহণের পরের দিনই সরকারি বাংলো ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে উঠে এলাম। আরও কিছুদিন থাকা যেত, কিন্তু আমি ভাবলাম সরকারি বাসস্থানে থাকলে অন্যদের কাজে কর্মে ব্যস্ত জীবন দেখে মনের মধ্যে নৈরাশ্যবাদ বাসা বাঁধতে পারে। তাই অবিলম্বে ছোট একটি ভাড়া বাড়িতে উঠে গেলাম।

ree

এই নতুন পাড়ায় আসার পর থেকেই বাড়ির কাছের ছোট ত্রিভুজাকৃতি “শ্রীলঙ্কা পার্ক”-এ কয়েকজন পেনশনভোগীদের আড্ডায় আমিও অবিলম্বে স্থান করে নিলাম। কী করে যে পার্কটির নাম “শ্রীলঙ্কা-পার্ক” হয়ে গেল আমি জানি না। কিন্তু এখন শুধু এ পাড়ায় নয় এই শহরের প্রায় সবাই জানে “লঙ্কা পার্কের” নাম— এমনকি পোস্ট অফিসের ঠিকানাতেও লেখে, “লঙ্কা পার্ক”। আসলে নাকি এই পার্কের (তখন পার্ক ছিল না) স্থানে একটি ভূগোলের “শ্রীলঙ্কা” দ্বীপ আকারের বড় পুকুর ছিল। কালক্রমে সেই পুকুর মজে-হজে গিয়ে এই পার্কের জমি তৈরি হয়ে গেল; পরে স্থানীয় মিউনিসিপালিটি এখানে শুধু বয়স্কদের জন্য একটি পার্ক বানিয়ে দিয়েছেন। যদিও কিছু বালখিল্য “শচীন তেন্ডুলকার” ব্যাট-বল হাতে নিয়ে হাজির হয়ে দারোয়ানের তাড়া খেয়ে চলে যায়। তবে পার্কের এক নির্জন কোনে “সিনিয়র”দের জন্য ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের ন্যায় সাজানো তিনটি বেঞ্চ সকলেই সম্ভ্রমের সঙ্গে ‘অনধিকার’ মেনে ছেড়ে দেয়। চকখড়ি দিয়ে আবার কে যেন অপটু হাতে লিখেও দিয়েছে— “দাদু-দিদা স্পেশাল”। সরকারি বাংলো এলাকায় এ সুবিধে ছিল না; খালি একচিলতে ঝুলানো বারান্দায় বসে নিচের রাস্তায় চলমান বিভিন্ন জাতের বাহনের মিছিল দেখাই ছিল একমাত্র নিশুল্ক মনোরঞ্জনের উপায়, তাই আজকাল রঙ-ধোওয়া বিকালেই এসে হাজির হই আমরা ক’জন এই লঙ্কা পার্কে। আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ বসন্ত-দা ওরফে বসন্ত সামন্ত সবার আগে এসে আসর সাজিয়ে বসেন। আশি ছুঁই ছুঁই অকৃতদার বসন্ত-দা রোজই আসরের জন্য ঝালমুড়ি, চানাচুর, মশলা-দেওয়া চিনে বাদাম ইত্যাদি নিয়ে আসেন। কেবল এক কাপ গরম গরম চায়েরই ছিল অভাব। আমরা আপত্তি করলে প্রাণখোলা হাসি হেসে বলেন, “আরে ভাই, পেনশনের টাকাগুলো খরচ না করলে মরার পর আবার যে সরকারের কাছেই ফেরত চলে যাবে।”

ree

আমাদের মধ্যে কনিষ্ঠ সুশোভন হালদার জানতে চাইল, “সেটা আবার কীভাবে হবে বসন্ত-দা?”


“আরে ভাই, আমার তো তিন কুলে বাতি দেবার কেউ নেই, টাকাগুলো ব্যাংকে পড়ে থাকলে আমার মরার পরে আনক্লেইমড ফান্ড হিসাবে সরকারের কাছে চলে যাবে না?” বলেই নিজের ঠাট্টায় হো হো করে হেসে উঠলেন।


এসব শুনতে আমাদের ভাল লাগে না— সবাই একসঙ্গে আপত্তি জানাই, “সে দিনের এখনও দেরি আছে দাদা, এখন থাক না ওসব।”


“বেশ, থাক তাহলে— তোমাদের যখন ভাল লাগছে না শুনতে”, বলে ঝালমুড়ি অথবা চানাচুরের প্যাকেট এগিয়ে দেন বসন্ত-দা। এহেন বসন্ত-দাকে এ-অঞ্চলের প্রায় সকলেই চেনেন, কেবল আমার মত নবাগতরাই ওঁর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না। পোস্ট-অফিসের পোস্টম্যানও বাড়ি খুঁজতে অসুবিধায় পড়লে বসন্ত-দার শরণাপন্ন হয়।


কারণ আমি চায়ের কেবল ভক্ত নই, নেশাগ্রস্তও, তাই আমি একটা নতুন ব্যবস্থা চালু করলাম। বসন্ত-দা তো এটা ওটা টুকটাক খাবার নিয়েই আসেন, আমরা একেক দিন ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে আসব— তাতে করে ‘টা’-এর সঙ্গে ‘চা’-এর অভাবও দূর হয়ে যাবে। প্রস্তাবটা সবার মনমত হল— সবাইকে ফ্লাস্ক কিনতে হবে না, একটা ফ্লাস্কই হাতে হাতে ঘুরতে থাকবে।


অন্য দিনের মত আজও পড়ন্ত বিকালে আমরা ক’জন জুটেছিলাম শ্রীলঙ্কা পার্কের নির্জন কোনে। কোনে হলেও ত্রিভুজাকৃতি পার্কের ‘ভার্টেক্স’ বা শীর্ষবিন্দুতে থাকায় আমাদের বেঞ্চগুলি থেকে শুধু পার্কেরই নয় দু’ধারের রাস্তারও পুরো দৃশ্য দেখা যেত। আসর বেশ জমে উঠেছিল, এমন সময় পার্কের লাগোয়া মেটে রঙের পুরানো আমলের দোতলা বাড়িটা থেকে এক সম্পূর্ণ শুভ্রকেশ, দীর্ঘদেহী অভিজাত সুপুরুষ, হাতে একটি সৌখিন ছড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে এলেন। আমাদের দিকে নজর পড়তেই ভদ্রলোক ছড়ি-সহ দু’হাত তুলে আমাদের প্রতি নমস্কার জানালেন। একগাল হেসে বসন্ত-দা সেদিকে চেয়ে মাথা হেলিয়ে ইশারা করলেন, “সব ভালো তো?”

ree

ভদ্রলোক স্মিত হেসে বিনীতভাবে হাত জোড় করে ঘাড় হেলিয়ে কুশল জানিয়ে রাস্তায় এগিয়ে চললেন। আগেও কয়েকবার দেখেছি ভদ্রলোককে এইভাবে চলে যেতে: পরনে কোঁচানো ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে একটি দামী পাহাড়ি ছড়ি। ছড়িটির ব্যবহারিক প্রয়োজন কম কিন্তু সৌখীন-মেজাজ আর আভিজাত্যের পরিচায়ক বেশি। প্রায় দু’ঘণ্টা পরে আমাদের আড্ডা যখন তুঙ্গে তখনই ভদ্রলোক ফিরে আসেন আর আমাদের অগোচরেই ওঁর বাড়িতে ফিরে যান। অতএব আমাদের মধ্যে অনেকেই রহস্যময় মানুষটির ফিরে আসাটা দেখতে পান না।


ভদ্রতার খাতিরে কখনও বসন্ত-দাকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। সবাই ভেবেছি একদিন বসন্ত-দা নিজেই এই রহস্যের পর্দা তুলবেন।


সেদিন সন্ধ্যায় কী একটা সামাজিক অনুষ্ঠান থাকায় তাড়াতাড়ি আড্ডা ভেঙে গেল। কেবল আমি আর বসন্ত-দা রয়ে গেলাম। কী হল জানি না, আমার মাথায় যেন ভূত চেপে গেল— ঠিক করলাম আজ বসন্ত-দার মুখ খুলিয়েই ছাড়ব। ওই রহস্যময় মানুষটি সম্বন্ধে কিছু জানতেই হবে। তাই আড্ডা শেষে সবাই বিদায় নেবার পরেও আমি এটা-ওটা কথা বলে টিকে রইলাম। শেষে সুযোগ বুঝে কথাটা পাড়লাম, “আচ্ছা দাদা, একটা কথা অনেকদিন ধরেই মনে পুষে রেখেছি অথচ আপনাকে জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারছি না।”

ree

স্বভাবসুলভ একগাল হেসে বললেন বসন্ত-দা, “কি এমন কথা যেটা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পাচ্ছ না আর তাতে মনে অস্বস্তি বোধ করছ? আমার জীবনটা তো পাড়ার লাইব্রেরির একটা খোলা বই ভাই, যে কেউ পড়ে নিতে পারে।”


আমি একটু গম্ভীর হয়ে বললাম, “না না দাদা, আপনার কথা নয়, আমি ভাবছিলাম ওই ভদ্রলোকের কথা”, বলে আমি আঙুল দিয়ে আলোকিত দোতলা বাড়িটা দেখিয়ে দিলাম।


আমার কথার তক্ষুনি কোন জবাব না দিয়ে বসন্ত-দা একটু যেন গম্ভীর আর ভাবাবিষ্ট হয়ে ওই বাড়িটার দিকেই তাকিয়ে রইলেন।


নিজেকে সামান্য অপরাধী মনে হতে লাগল। মনে হল, না জেনে হয়ত বসন্ত-দার মনের কোন গোপন স্থানে আঘাত করে ফেলেছি। ম্লানমুখে তাই বললাম, “না না, বসন্ত-দা কোন ব্যাপার নয়, অসুবিধা থাকলে আপনাকে কিছু ---”


আমাকে বলতে না দিয়ে বসন্ত-দা স্মিত হেসে খুব লঘুস্বরে বলে উঠলেন, “আরে না না ভাই তেমন কিছু ব্যাপার নয়; আমি ভাবছি কোথা থেকে শুরু করব, মানে, কোথা থেকে শুরু করলে তোমার মনে হবে না আমি কোন গল্প-উপন্যাসের কাহিনী শোনাচ্ছি।”


আমি ওর ইতস্তত ভাবের কারণ বুঝতে পেরে সামান্য হেসে বললাম, “দাদা, আপনার যেখান থেকে খুশি বলুন।”

ree

এবার বসন্ত-দা আর ইতস্তত করলেন না। শুরু করলেন, “এ পাড়ার আদি ও বনেদি পরিবার দত্ত চৌধুরী বংশের একমাত্র ওয়ারিশ জমিদার শঙ্কর নারায়ণ দত্ত চৌধুরী কেবল নামেই জমিদার রয়ে গেছেন, ঘাটে ঘটিও ডুবত না। তাই জমিদারী নাম বর্জন করে ছেলের নাম রেখেছিলেন অলিন্দ। জমিদারীর আয় না থাকলেও বাপ-ঠাকুরদার আমলের জমি-জমা থেকে আয় কম হত না। শঙ্কর নারায়ণের পরমাসুন্দরী স্ত্রী সুরবালা কম বয়সেই তখনকার দিনে দুরারোগ্য রোগে মারা যান। মাথায় অসম্ভব ব্যথা হত, পরে জানা গিয়েছিল ওঁর ঘাড়ের নিচে শিরদাঁড়ায় নাকি টিউমার হয়েছিল। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে উনি মারা যান। অলিন্দ তখন মাত্র সাত বছরের বালক।”


একটু থেমে আবার শুরু করলেন বসন্ত-দা, “অলিন্দ পড়াশুনোয় আর খেলা-ধুলোয় দুইতেই ছিল তুখোড়। স্কুলে ওর খেলার সাথী অনেক থাকলেও পাড়ায় কিন্তু ওর একমাত্র সাথী ছিল পাঁচ বছরের ছোট ‘খেয়া’— ওর ঠাকুরদার আমলের জমিদারীর সরকার অনিল সরখেল-এর নাতনি। দুই কিশোর-কিশোরীর স্নেহ-ভালবাসা ছিল অপরিসীম। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই ওরা ফুল-ফল কুড়োতে ছুটত দত্ত পুকুরে। এককালে এই দত্তপুকুর দত্ত চৌধুরী পরিবারেরই সম্পত্তি ছিল। বড় দীঘি আর চারপাশে নানা জাতের ফল ও ফুলের বাগান। দীঘির পাড়ে একটি বড় আমলকীর গাছ ছাড়াও ছিল আম, জাম, কয়েতবেল, কুল, নারকেল আর তালের গাছ। দুই কিশোর-কিশোরীর ‘নেশা’ যেন ছিল সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওখানে দৌড়ান আর ফল-ফুল দিয়ে কোঁচড় ভরা। কুড়ানো ফুল-ফল কিন্তু দুজনের কেউই বাড়ি নিয়ে যেত না—ফেরার পথে সেগুলো বিলিয়ে দিয়ে খালি হাতেই ফিরত। সব সময়েই ওদের একসঙ্গে দেখা যেত। সবাই তাই আদর করে ওদের ডাকতো, “খেয়া-অলি জুটি”। সেটাই ক্রমে ক্রমে লোকের মুখে হয়ে দাঁড়ালো “খেয়ালী”-জুটি।”


একনাগাড়ে অনেকক্ষণ বলে বসন্ত-দা এবার থামলেন। ওনার কাঁধের ব্যাগ থেকে ছোট জলের বোতলটি বের করে কয়েক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে আমাকেও ইশারা করলেন; আমি মাথা নেড়ে ‘না’ করলাম। আমার তখন জলের তৃষ্ণা ছেড়ে গল্পের নেশা ধরে গেছে। স্মিত হেসে পাঞ্জাবির আস্তিনে মুখ মুছে আবার শুরু করলেন, “স্কুলের পড়া শেষ হতেই শঙ্কর নারায়ণ ছেলেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিলেত পাঠিয়ে দিলেন। ওখানেই থাকাকালীন অলিন্দ ঠিক করলো সে বড় ডাক্তারি পড়বে আর তার মা যে রোগে মারা গেছেন সেই রোগেরই চিকিৎসক হবে। ওদিকে অলিন্দ বিলেত চলে যাওয়ার পর খেয়া যেন কেমন হয়ে গেল। তাকে কেউ আর বাইরেই দেখতে পেত না। শুধু খুব কাছের মানুষগুলি ওকে দেখতে পেল ওর বিয়ের রাতে। পরের দিন পরমাসুন্দরী খেয়া গ্রাম ছেড়ে স্বামীর ঘর করতে চলে গেল সুদূর নিউজিল্যান্ড।”


বসন্ত-দা এবার থেমে গেলেন, আর যেন কোন গল্পই বাকি নেই। আমি রাস্তার ল্যাম্প-পোস্টের স্বল্প আলোতে উন্মুখ হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।


নামি নিউরোসার্জন হয়ে ১৬ বছর পরে দেশে ফিরে এলো অলি। ততদিনে শঙ্কর নারায়ণ মারা গেছেন। দেশে এসেও কত যে মানুষকে বাঁচিয়েছেন তার সীমা-সংখ্যা নেই। প্রথমে কলকাতার বড় হাসপাতালে, পরে নিজেই নার্সিং হোম খুলে কম খরচে ওই রোগের চিকিৎসা আর প্রয়োজনে অপারেশন করত।


এতটা বলে বসন্ত-দা চুপ করে গেলেন, যেন আর কোন গল্পই নেই। আমিও ওঁর মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইলাম।


পরে আবার একটু জল খেয়ে শুরু করলেন, “সবই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন পরেশ দাস, যে ছিলেন ও বাড়ির আত্মা, সুরবালার মৃত্যুর পরও সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল যার জন্য, সেই পরেশ দাস অসুস্থ হয়ে পড়ল। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল ওর মাথার পিছনে একটি টিউমার বাসা বেঁধেছে। হয়েছিল অনেক দিনই, কিন্তু বলেনি। অলিন্দ হেসে বলল, “আরে ভয় কিসের, পরেশ-দা, অমন টিউমার আমি প্রতিদিন চারটে বের করে আনি; তোমারটা তো আমি দু’ঘণ্টার মধ্যে বের করে আনব।”

ree

বসন্ত-দা আবার চুপ করে গেলেন।


“তুমি তো জান কি সূক্ষ্ম কাজ এটি—একটি ছোট নার্ভ কেটে গেলে রুগী জীবনের মত পঙ্গু হয়ে যাবে।”


আমি সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে দিলাম।


“ভগবানের কি ইচ্ছা ছিল জানিনা, ঠিক ওই দিনই জীবনে প্রথমবার হাত কেঁপে গেল অলিন্দের। সহকারী ডাক্তার-নার্সরা দেখল, টিউমার ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও আর কিছু করতে পারল না অলিন্দ। পরেশ জীবনের মত পঙ্গু হয়ে গেল, আজও বিছানায় শুয়ে। অলিন্দই এখন ওর সেবা করে। তারপর দিন থেকে এত বড় সার্জেন আর ছুরি হাতে নেয়নি। পরিবর্তে হাতে তুলে নিলো পরেশের সেবা আর আঁকার ব্রাশ-তুলি।”


এবার বসন্ত-দা একেবারেই চুপ হয়ে গেলেন।

ree

অনেক পরে গভীর রাতের পাতা ঝরার স্বরে বললেন, “শুধু একবার ওর লাইব্রেরিতে উঁকি মারার সুযোগ এসেছিল আমার: সমস্ত দেওয়াল জুড়ে শুধু একটি মানুষের মুখ। সেই মানুষটির বাল্য, কৈশোর, যৌবন, পড়ন্ত-যৌবন, বার্ধক্যের মুখের ছবি। বয়সের সঙ্গে মানুষের মুখের কি পরিবর্তন হয় তার হুবহু বর্ণনা করে আঁকা ওই ছবিগুলো। ছবিগুলো ভিন্ন কিন্তু মুখটি একটি; একই মানুষের মুখ কিভাবে পরিবর্তিত হয় বয়সের সঙ্গে। অপূর্ব সুন্দর আর নিখুঁত সে সব ছবি। সে মুখটি কার জান?”


গল্পের মাঝেই বসন্ত-দার প্রশ্নে আমি অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আর আমার অজান্তেই বাঁয়ে-ডায়ে মাথা ঘোরালাম, “কার দাদা?”


মুহূর্ত-কাল থেমে বসন্ত-দা ম্লান হেসে বললেন, “সে মুখ, অলিন্দের বাল্য-কৈশোরের সাথী খেয়ার।”


আমি অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।


সন্ধ্যার ছায়া-ছায়া অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে জোনাকি-জ্বলা রাত হয়েছিল। আমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ ছিল না, আর এরপর অন্য গল্প জমবার কথাও হয় না। তাই ভাবছিলাম এবার উঠে পড়ব, ঠিক সেই সময় একটা বকের মত সাদা বড় গাড়ি যেন বড় ডানা মেলে এসে থামল রাস্তার উপর। আমরা দু’জনে একটু অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। এই রাস্তায় সাধারণত খুব বেশি গাড়ি চলাচল করে না, বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে। যে লোকটি চালাচ্ছিল সে বেরিয়ে এসে পিছনের দরজা খুলে ঘাড় বেঁকিয়ে কিছু বলতেই এক সাদা-কালো চুল মাথার মহিলা বেরিয়ে এলেন। ভদ্রমহিলা শাড়ি সামলে, মাথার এলো-মেলো চুলগুলোকে সামান্য বিন্যস্ত করে নিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে নিলেন। রাস্তার কম-পাওয়ারের হলদে আলোতে একবার চারদিক পরখ করে নিলেন। মনে হল কারও বাড়ি খুঁজছেন। এ অঞ্চলে তো বাড়ির নম্বর দেওয়া নেই, তাই বুঝি বুঝতে পারছেন না। রাস্তায় আর কোন লোক না থাকায় আমি ভাবছিলাম এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করব কিনা, কার বাড়ি খুঁজছেন। আমি না জানলেও বসন্ত-দা নিশ্চয়ই জানবেন। সেই সময়েই ড্রাইভার ভদ্রলোক আমাদের পানে এগিয়ে এসে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, এখানে দত্ত পুকুর বলে জায়গাটা কোথায় হবে, বলতে পারেন?”

ree

আমি লোকটিকে যখন জরিপ করছিলাম, ততক্ষণে বসন্ত-দা উঠে দাঁড়িয়েছেন, “দত্ত-পুকুরে কোথায় যাবেন ভাই?” ততক্ষণে ভদ্রমহিলাও এগিয়ে এসেছেন আমাদের পানে। রাস্তার আলো ওঁর পিছনে থাকায় মুখটা পরিষ্কার দেখা গেল না, কিন্তু এটুকু বুঝতে অসুবিধা হল না যে মহিলা বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের।


বসন্ত-দা এগিয়ে এসে চোখের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করে বলে উঠলেন, “দত্ত-পুকুর তো এখন নেই, মজে-হেজে গিয়ে ছোট একটি ডোবা মতন হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন মা, আমি বৃদ্ধ মানুষ, তাই রাস্তার আলোও কম দেখছি। তোমার মুখটি কিন্তু চেনা লাগছে। তুমি কি ‘খেয়ালী’র খেয়া? অলিন্দকে খুঁজছ?”


হঠাৎ যেন আকাশ ফেটে বজ পড়ল। রাস্তার ফিকে আলোতে ভদ্রমহিলা অপলক দৃষ্টিতে বসন্ত-দার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। পরে ক্ষীণ-কণ্ঠে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, কিন্তু—”


এবার বসন্ত-দা স্বভাবসিদ্ধ একগাল হেসে বললেন, “মা, আমাকে তুমি চিনতে পারবেন না, আমি কিন্তু তোমাকে চিনেছি।”


“কি করে চিনলেন? আমি তো পঁয়ত্রিশ বছর পরে এলাম দেশে।”


মুচকি হেসে বসন্ত-দা খুব ধীরে ধীরে বলে উঠলেন, “যে মানুষটা প্রতিদিন তোমাকে দেখে আর তার ঘরে সাজিয়ে রাখে তার আঁকা ছবিতে, সেখানেই তোমাকে দেখেছি খেয়া।”


“কে সে?” অবাক চোখে প্রশ্ন করলেন মহিলা।


“এই বিরাট পৃথিবীতে সে যে একটি মানুষই আছে, সে তোমার বাল্য-কৈশোরের সাথী: অলিন্দ। অলিন্দ দত্ত চৌধুরী।”


“অলিন্দ, অলিদা!! কোথায় কোথায় পাব তাকে? আমি যে তার খোঁজেই এসেছি?” কিছুটা আকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন মহিলা।


বসন্ত-দা স্মিত হেসে মাথা দুলিয়ে বললেন, “আমি জানি, তুমি ছাড়া আর কে করবে তার খোঁজ? সেও যে তোমারই ফেরার অপেক্ষায় জীবন কাটিয়ে দিল।”


তারপর হাত বাড়িয়ে মেটে রঙের দোতলা বাড়ির আলোকিত জানালার দিকে আঙুল দেখিয়ে বসন্ত-দা বললেন, “ওই দেখ, তোমার অলি ছবি আঁকছে, ওর ঘরেই তো আমি আজকের তোমাকে দেখেছি।”


বসন্ত-দার কথা শেষ হবার আগেই খেয়া দৌড়াতে আরম্ভ করেছিল মেটে রঙের দোতলা বাড়িটার দিকে। সেদিকে তাকিয়ে আমিও ম্লান হেসে বলে উঠলাম, “চলুন দাদা, এবার আমরাও যাই।”


“হ্যাঁ, চল ভাই, এতদিনে আমারও পথ দেখা শেষ হলো, আমি জানতাম খেয়া একদিন না একদিন ফিরবেই তার অলির কাছে।”


আমি আলোকিত দোতলা বাড়ির জানালার দিকে তাকাতে তাকাতে বসন্তদার হাত ধরে নির্জন পিচের রাস্তায় নেমে এলাম।

Comments


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page