ধন ত্রয়োদশী এবং পুরাণ কথা, পুজোর পরে ওজন কমান সহজেই, ঘরের কোণে গড়ে উঠুক নিজের ছোট্ট জগত, রবিবারের গল্প: ভয়
- রোজকার অনন্যা

- Oct 11
- 15 min read
Updated: Oct 12
ধন ত্রয়োদশী এবং পুরাণ কথা..

ধন ত্রয়োদশী হিন্দু ধর্মে দীপাবলির সূচনা দিন। অনেকেই একে ধনতেরাস নামেও চেনেন। সংস্কৃত শব্দে “ধন” অর্থ সম্পদ, আর “ত্রয়োদশী” মানে ত্রয়োদশী তিথি বা চাঁদের তেরোতম দিন। এই দিনটি কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীতে পালিত হয়। ভারতের প্রায় সর্বত্র, বিশেষত গৃহস্থ ও ব্যবসায়ীদের কাছে এ দিনটি অত্যন্ত শুভ দিন হিসেবে গণ্য। তবে এই ধন ত্রয়োদশীর মাহাত্ম্য শুধুমাত্র সম্পদ অর্জন বা কেনাকাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে আছে পুরাণসম্ভূত অনেক গভীর তাৎপর্য, দেবদেবীর কাহিনি, এবং সংস্কৃতির শিকড়ে প্রোথিত এক ঐতিহ্য। আজকের আলোচনায় আমরা দেখব ধন ত্রয়োদশী কীভাবে জন্ম নিল, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পুরাণ কাহিনি, ধর্মীয় আচার, এবং লোকবিশ্বাসের নানা রূপ।

ধন ত্রয়োদশীর উৎপত্তি
পুরাণ অনুসারে, ধন ত্রয়োদশীর সূচনা মহাভারতের পূর্বকাল থেকেই। বলা হয়, এই দিনে সমুদ্র মন্থনের সময় “ধনবন্তরী” দেবতা অমৃতের কলস হাতে উদ্ভূত হন। তিনি ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার, এবং দেব-অসুরদের চিকিৎসক। এই ধনবন্তরী দেবতার আবির্ভাবের দিনকেই পরবর্তীকালে “ধন ত্রয়োদশী” নামে পালন করা হয়। ‘ধন’ শব্দটি এখানে প্রতীকী—শুধু বস্তুগত সম্পদ নয়, বরং স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর প্রতীকও বটে। কারণ, ধনবন্তরী দেবতা নিজেই স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার দেবতা। তাঁর হাতে ছিল অমৃতপূর্ণ কলস, যার অর্থ, শরীর ও আত্মার পরিশুদ্ধি। তাই এ দিন শুধু সোনা বা রূপা কেনার জন্য নয়, নিজের স্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনায় পূজারও দিন।

সমুদ্র মন্থনের কাহিনি: দেবতা ও অসুররা যখন অমৃত প্রাপ্তির জন্য ক্ষীরসাগর মন্থন করছিলেন, তখন নানা দেবত্বপূর্ণ বস্তু একে একে প্রকাশ পেল—লক্ষ্মী দেবী, কামধেনু গাভী, ঐরাবত হাতি, চন্দ্র, কৌশিকী, এবং শেষে উদ্ভূত হলেন ধনবন্তরী দেবতা। তাঁর হাতে ছিল সোনার কলস, ভরা অমৃতে। বলা হয়, তিনি যখন প্রকাশিত হন, তখন সকল দেবতা তাঁকে প্রণাম করে বলেন—“আপনি আমাদের জীবনের রক্ষাকর্তা।” সেই থেকেই ধনবন্তরী দেবতার পূজা করা হয় এই দিনে। চিকিৎসক, আয়ুর্বেদাচার্য ও স্বাস্থ্যপথ অনুসারীদের কাছে এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ধন ত্রয়োদশীর দিন সকালে গৃহস্থেরা ঘরদোর পরিষ্কার করে, সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবী লক্ষ্মী ও ধনবন্তরীর পূজা করেন। অনেকেই এই দিনে নতুন পাত্র, সোনা-রূপা, বা গয়না ক্রয় করেন, কারণ বিশ্বাস করা হয়—এই দিনে কেনা জিনিস সারা বছর সৌভাগ্য বয়ে আনে।
একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে
“ধনতেরাসে খরিদা ধন, সারাবছর থাকে মনরঞ্জন।”
বাংলা সংস্কৃতিতেও এদিন ব্যবসায়ীরা তাদের খাতার পূজা করেন, নতুন হিসাবের শুরু করেন। অনেক জায়গায় ‘ধানের আঁটি’, ‘চাল’, বা ‘নতুন হাঁড়ি’ কেনার রেওয়াজ আছে যা সমৃদ্ধি ও শুভ সূচনার প্রতীক।

ধন ত্রয়োদশী ও দেবী লক্ষ্মী
যদিও ধন ত্রয়োদশীর সঙ্গে মূলত ধনবন্তরী দেবতার সম্পর্ক, তবুও ভারতে অধিকাংশ অঞ্চলে এই দিনটি দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে যুক্ত। কারণ, দীপাবলি উৎসবের সূচনা এই দিন থেকেই। বিশ্বাস করা হয়, ধন ত্রয়োদশী থেকে লক্ষ্মীপূজার শুরু হয় এবং চতুর্দশী ও অমাবস্যায় তা পূর্ণতা পায়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লেখ আছে, দেবী লক্ষ্মী এই দিনে ভক্তদের গৃহে প্রবেশ করেন এবং যাদের ঘরে আলোকসজ্জা থাকে, সেখানে তিনি স্থায়ী হন। তাই এদিন প্রদীপ জ্বালানো, দরজা ও জানালায় আলোর মালা ঝুলিয়ে দেওয়া অত্যন্ত শুভ বলে ধরা হয়।

পুরাণে ধন ত্রয়োদশীর আরেক কিংবদন্তি
এক রাজা ছিলেন, যার পুত্রের জন্মের সময় জ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, ষোড়শ দিনে সাপের দংশনে তার মৃত্যু হবে। রাজা শোকে কাতর হলেও, এক ঋষি তাঁকে উপদেশ দেন ছেলের ষোড়শ জন্মদিনে ঘরে অসংখ্য প্রদীপ জ্বেলে রাখতে ও সোনার গয়না ও রূপার মুদ্রা স্তূপ করে রাখতে। সেই নির্দেশ অনুযায়ী, রাজকুমারকে একটি সুন্দর কক্ষে বসানো হয়, চারদিকে প্রদীপ, সোনা, রূপা, গয়না। মৃত্যুর দেবতা যমরাজ সাপের রূপে আসেন, কিন্তু আলো ও সোনার ঝলকানিতে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যায়। রাজকুমারের জীবনে আর বিপদ আসে না। সেই দিনটি ছিল কার্তিক মাসের কৃষ্ণ ত্রয়োদশী। তখন থেকেই এই দিনটি “ধন ত্রয়োদশী” বা “যমদীপদান” হিসেবে পালিত হয়। এই কারণে অনেকে এদিন যমরাজের উদ্দেশ্যে দীপ জ্বালান বিশেষ করে বাড়ির দক্ষিণ দিকে। বিশ্বাস করা হয়, এতে অকালমৃত্যুর আশঙ্কা থাকে না।

ধন ত্রয়োদশী ও আধুনিক প্রেক্ষাপট
আজকের দিনে ধন ত্রয়োদশী মানেই অনেকের কাছে “শপিং উৎসব” গয়না, গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স, বা বাড়ির নতুন জিনিস কেনার দিন। তবে এর গভীরে যে স্বাস্থ্য, আলো, ও শুভ শক্তির প্রতীকী তাৎপর্য আছে, তা অনেকেই ভুলে যান।
বাজারে অফার, ডিসকাউন্ট, ও ব্র্যান্ড প্রমোশনের ভিড়ে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ মিশে যাচ্ছে নতুন ভোগবাদী আবহে। কিন্তু এখনও অনেক পরিবারে ধনবন্তরীর পূজা, প্রদীপ জ্বালানো, এবং যমদীপ দান অব্যাহত। এ যেন আধ্যাত্মিকতা ও আধুনিকতার এক সুন্দর সমন্বয়—যেখানে বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রাচীন ঐতিহ্য একসাথে মিশে যায় জীবনের রঙে।
আয়ুর্বেদের সঙ্গে ধনবন্তরীর যোগ
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ধনন্তরীকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তাঁর নামেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রধান গ্রন্থ “ধনন্তরী সংহিতা” রচিত। আয়ুর্বেদ অনুসারে শরীরের তিন দোষ বাত, পিত্ত, কফ সামঞ্জস্য বজায় রাখলে জীবন দীর্ঘ ও সুস্থ হয়। ধন ত্রয়োদশীর দিনে অনেক আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসক বিশেষ পূজা করেন, রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ প্রদান করেন, ও ধনন্তরীর আশীর্বাদ কামনা করেন। এই দিনটি যেন মানব জীবনের এক গভীর বার্তা বহন করে

“স্বাস্থ্যই প্রকৃত সম্পদ; রোগমুক্ত শরীরই সর্বোচ্চ ধন।”
ধন ত্রয়োদশী ও দীপাবলির সম্পর্ক
দীপাবলি বা দীপোৎসব মূলত পাঁচ দিনের উৎসব ধন ত্রয়োদশী, নরক চতুর্দশী, লক্ষ্মী পূজা (অমাবস্যা), গোবর্ধন পূজা ও ভাইদূজ। এই পাঁচ দিনের প্রথম দিনই ধন ত্রয়োদশী। তাই এটি দীপাবলির সূচনা নির্দেশ করে। এই দিনে ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালানো মানে অন্ধকার ও অশুভ শক্তিকে দূর করে আলোর ও জ্ঞানের আগমন ঘটানো। বাংলা সংস্কৃতিতে দীপাবলি মিলেমিশে যায় কালীপূজার সঙ্গে। তাই অনেকেই ধন ত্রয়োদশী থেকে কালীপূজার প্রস্তুতি শুরু করেন ঘরদোর পরিষ্কার, আলোকসজ্জা, নতুন সামগ্রী ক্রয় ইত্যাদি।

লোকবিশ্বাস ও গ্রামীণ প্রথা
বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলে ধন ত্রয়োদশী মানে কৃষকের ঘরে ‘ধান ওঠার আনন্দ’। অনেক গ্রামে এই দিন নতুন ফসলের ধান ঘরে আনার রীতি আছে। নারীসমাজ নতুন হাঁড়ি বা কলসি কেনেন, যা ধনের প্রতীক। কোথাও কোথাও ‘হাঁড়ি পূজা’ হয়, যেখানে মাটির হাঁড়ি ও চাল দিয়ে দেবীর আরাধনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই পূজায় গৃহে অন্ন, ধন ও শান্তি বৃদ্ধি পায়!
দর্শনীয় দিক: ধন ও ধর্মের সামঞ্জস্য
ধন ত্রয়োদশী আমাদের শেখায়—সম্পদ শুধু ভোগের জন্য নয়, সঠিক ব্যবহারে সেটাই ধর্ম। ধনন্তরী ও লক্ষ্মী দেবীউভয়েই আমাদের শিখিয়ে দেন, স্বাস্থ্য ও সম্পদ একে অপরের পরিপূরক। যদি ধন থাকে কিন্তু স্বাস্থ্য না থাকে, তবে জীবনের আনন্দ অর্থহীন। আবার যদি কেবল ত্যাগ ও দারিদ্র্য থাকে, তবে জীবনের পূর্ণতা অসম্পূর্ণ। তাই এই তিথির মূল শিক্ষা ধন ও ধর্মের সমন্বয়ে জীবনকে পরিপূর্ণ করা।

ধন ত্রয়োদশী কেবল এক উৎসব নয়, এক জীবনদর্শন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়
স্বাস্থ্যই সর্বোচ্চ ধন,
আলোই জীবনের আসল পরিচয়,
আর সৎ কর্মই প্রকৃত পূজা।
এই দিনে যখন আমরা প্রদীপ জ্বালাই, তখন আসলে আমরা নিজেদের অন্তরের অন্ধকার দূর করার সংকল্প গ্রহণ করি। যখন আমরা নতুন কিছু কিনি, তখন সেই নতুনত্বের মাধ্যমে জীবনে শুভ সূচনার প্রতীক সৃষ্টি করি।
ধন ত্রয়োদশীর এই ঐতিহ্য যুগে যুগে আমাদের মনে করিয়ে দেয়
“যেখানে স্বাস্থ্য, সেখানেই সম্পদ; যেখানে আলো, সেখানেই জীবন।”
পুজোর পরে ওজন কমান সহজেই
দুর্গাপূজা বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব, আর সেই সঙ্গে আনন্দ, ভোজন ও উল্লাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। প্রতিদিনের প্যান্ডেল হপিং, অরগানিক কেক থেকে শুরু করে ফুচকা-পাঁপড়, মোগলাই পরোটা, বীরিয়ানি, মিষ্টি, আইসক্রিমসবকিছুই যেন পুজোর আনন্দের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু পুজো শেষ হতেই আয়নায় মুখোমুখি হতে হয় এক বাস্তবতার “কিছুটা ভুঁড়ি বেড়েছে!”, “ড্রেসটা টাইট লাগছে!” এই অনুভূতিই যেন অনেকের মাথাব্যথার কারণ। তবে চিন্তা নেই! ওজন বাড়ানো যত সহজ, কমানোও সম্ভব যদি তা ধীরে, সঠিক উপায়ে, ও নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে করা যায়। আজ আমরা জানব, পুজোর পর কীভাবে সহজেই ওজন কমানো যায়, শরীরকে আবার ছন্দে ফিরিয়ে আনা যায়, এবং সেই সঙ্গে মনের উচ্ছ্বাসও বজায় রাখা যায়।

পুজোর পর শরীরের অবস্থা বোঝা দরকার
পুজোর সময়ের খাওয়া-দাওয়া মানে সাধারণত উচ্চ ক্যালোরির খাবার, তেল-ঘি-চিনি ভরা পদ, ঘুমের অভাব, এবং শরীরচর্চার অভাব। ফলে শরীরে জমে জল, চর্বি এবং টক্সিন। পুজোর পর শরীর ক্লান্ত লাগে, হজমশক্তি কমে যায়, ওজন বেড়ে যায় ২-৩ কিলো পর্যন্ত। তাই প্রথমেই বুঝে নিতে হবে—ওজন বাড়া মানে কেবল চর্বি নয়; তার মধ্যে জলধারণ ও গ্যাসের প্রভাবও রয়েছে। তাই অত দ্রুত ওজন কমানোর চেষ্টায় ঝুঁকি না নিয়ে, ধীরে-স্থিরভাবে শুরু করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ডিটক্স দিয়ে শুরু করুন
ডিটক্স মানে শরীরের ভেতরের টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ দূর করা। পুজোর পরের প্রথম ৩-৪ দিন আপনি যদি ডিটক্স ডায়েট অনুসরণ করেন, তাহলে শরীর আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে।
সহজ ডিটক্স পদ্ধতি:
সকালে খালি পেটে এক গ্লাস লেবু-গরম জল ও এক চামচ মধু খান।
সারাদিনে অন্তত ৩ লিটার জল পান করুন।
প্রাতঃরাশে ফলের স্মুদি বা পেঁপে/আপেল খান।
দুপুরে হালকা সবজি, ডাল, ব্রাউন রাইস।
রাতে স্যুপ বা স্যালাড।
চিনি, দুধ, ভাজা খাবার, এবং প্যাকেটজাত খাবার পুরোপুরি বাদ দিন অন্তত এক সপ্তাহ।
ঘুম ও বিশ্রাম ফিরিয়ে আনুন
পুজোর সময় দেরি করে ফেরা, কম ঘুম, এবং বাড়তি উত্তেজনা সব মিলিয়ে শরীরের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ঘুম কম হলে কর্টিসল হরমোন বেড়ে যায়, যা চর্বি জমার প্রধান কারণ। তাই প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম জরুরি। রাতে ঘুমানোর আগে মোবাইল দূরে রাখুন, হালকা সঙ্গীত শুনুন বা বই পড়ুন। ঘুমই আপনার মেটাবলিজমকে সক্রিয় রাখবে।

সুষম খাদ্যাভ্যাসে ফিরে যান
ওজন কমানোর প্রথম ধাপ হলো পরিমাণ ও সময় নিয়ন্ত্রণ। তিন বেলার বড় খাবারের বদলে ৫–৬ বেলা ছোট ছোট খাবার খান।
সকালের খাবার: ওটস, ডিমের সাদা অংশ, ফল
দুপুরের খাবার: ব্রাউন রাইস/চাপাটি, ডাল, সবজি, এক চামচ ঘি
বিকেলের নাস্তা: বাদাম বা গ্রিন টি
রাতের খাবার: স্যালাড, স্যুপ বা গ্রিলড ফিশ
মন রাখুন:
ভাজাভুজি নয়, বেকড বা স্টিমড খাবার বেছে নিন।
সাদা চাল, ময়দা ও চিনি কমিয়ে দিন।
দিনে অন্তত ৫ রকম ফল ও সবজি খান।
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন
খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে শরীরচর্চা না থাকলে ওজন কমা অসম্ভব। তবে জিমে না গেলেও সমস্যা নেই। প্রতিদিন ৩০–৪৫ মিনিট দ্রুত হাঁটা বা যোগাভ্যাস যথেষ্ট।
সহজ ব্যায়াম যা বাড়িতে করা যায়:
সার্কিট ট্রেনিং: স্কোয়াট, পুশআপ, প্ল্যাঙ্ক
যোগাসন: সূর্য নমস্কার, ত্রিকোণাসন, ভুজঙ্গাসন
নাচ বা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ: যা শরীরকে হালকা রাখে
এই ব্যায়ামগুলো আপনার মেটাবলিজম বাড়িয়ে দেয়, ফলে শরীর নিজেই ক্যালোরি বার্ন করতে থাকে।

সকালে ও সন্ধ্যায় মেটাবলিজম বুস্টার
সকালে:গরম জলে লেবু, আদা, দারুচিনি বা আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে খেলে মেটাবলিজম বেড়ে যায়।
সন্ধ্যায়:গ্রিন টি বা তুলসী-আদা চা হজমে সাহায্য করে, শরীরে জমে থাকা ফ্যাট ভাঙে।
পরিমাণ বুঝে খাওয়া শিখুন
আমরা প্রায়ই অভ্যাসবশত অতিরিক্ত খেয়ে ফেলি বিশেষত উৎসবের পর যখন মন চায় “আরেকটু মিষ্টি খাই!”। কিন্তু মনে রাখবেন, শরীরের প্রয়োজন মতোই খাওয়া উচিত। একটি নিয়ম মানুন “৮০ শতাংশ পেট ভরে খাওয়া। ”অর্থাৎ, একটু ক্ষুধা রেখে খাওয়া শেষ করুন। এতে হজম ভালো হয় ও অতিরিক্ত ক্যালোরি জমে না।

মিষ্টি ও চিনি কমিয়ে ফেলুন
পুজোর পর অনেকেরই মিষ্টির প্রতি আসক্তি তৈরি হয়। কিন্তু চিনিই শরীরের সবচেয়ে বড় শত্রু। অতিরিক্ত চিনি ইনসুলিনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা ফ্যাট জমায়।
বিকল্প উপায়:
মিষ্টির বদলে ফল খান
গুড়, খেজুর, বা স্টিভিয়া ব্যবহার করুন
ঠান্ডা পানীয় বা প্যাকেট জুস বাদ দিন
জল, জল, আর জল!
ওজন কমাতে জলের ভূমিকা অপরিসীম। জল শুধু শরীরের টক্সিন দূর করে না, বরং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
নিয়ম:
খাবারের ৩০ মিনিট আগে এক গ্লাস জল খান
দিনে অন্তত ৮–১০ গ্লাস জল পান করুন
সকালে খালি পেটে এক গ্লাস গরম জল অভ্যাস করুন
“চিট মিল” বুদ্ধি করে নিন
ওজন কমানো মানেই আনন্দ ত্যাগ নয়। সপ্তাহে একদিন “চিট মিল” রাখুন—যেদিন প্রিয় খাবার খান, তবে পরিমাণে সীমিত। এতে মানসিক চাপ কমে, ডায়েটও দীর্ঘস্থায়ী হয়। তবে খাওয়ার পরে একটু হাঁটুন, জল পান করুন, ও পরের দিন আবার নিয়মে ফিরুন।
ঘরোয়া কিছু কার্যকর টোটকা
জিরা জল: রাতে ১ চামচ জিরা ভিজিয়ে সকালে ফুটিয়ে পান করুন।
দারুচিনি-লেবু চা: ফ্যাট কমাতে ও রক্তে চিনি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
মেথি দানা জল: হজমশক্তি বাড়ায় ও ফ্যাট গলাতে সাহায্য করে।

মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করুন
ওজন কমানো শুধু শারীরিক নয়, মানসিক বিষয়ও বটে। যদি আপনি নিজেকে চাপের মধ্যে রাখেন “আমাকে তিনদিনে ২ কেজি কমাতে হবে” তাহলে সেটি উল্টো কাজ করবে। ধ্যান, সঙ্গীত, বা বই পড়া যা আপনার মনে শান্তি আনে, সেটি করুন। মানসিক প্রশান্তি শরীরের হরমোনকে স্থিতিশীল রাখে।
সামাজিক চাপ নয়, নিজের জন্য করুন
অনেকে ওজন কমান অন্যের চোখে সুন্দর দেখানোর জন্য। কিন্তু প্রকৃত প্রেরণা আসা উচিত নিজের ভিতর থেকে। ওজন কমানো মানে—নিজেকে সুস্থ, হালকা ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলা।
যখন আপনি নিজের পরিবর্তন অনুভব করবেন, তখনই সেটা টেকসই হবে।
ডায়েট চার্টের নমুনা
অনুপ্রেরণা ধরে রাখুন
ওজন কমানোর পথে মাঝেমধ্যে মন ভেঙে যেতে পারে। তখন মনে রাখুন
“আপনি পুজোর আনন্দ উপভোগ করেছেন, এখন নিজেকে উপহার দিন একটি সুস্থ শরীর।”
ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করুন
এক সপ্তাহে ৫০০ গ্রাম কমানো
প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা
মিষ্টি কমানো
এভাবে ধীরে ধীরে আপনি টের পাবেন, শরীর হালকা হচ্ছে, মুখে উজ্জ্বলতা বাড়ছে, আর মনও আনন্দে ভরছে।

পুজো মানে আনন্দ, আর তার পরের সময় মানে শরীর ও মনের পুনর্গঠন। ওজন কমানো মানে কষ্ট নয়, বরং নিজের প্রতি যত্ন। সঠিক খাদ্য, পর্যাপ্ত জল, নিয়মিত ব্যায়াম, আর ইতিবাচক মনোভাব এই চারটিই হল পুজোর পর সহজে ওজন কমানোর চাবিকাঠি। তাই উৎসবের আনন্দে বাড়তি কিছু ক্যালোরি নিয়ে ভয় পাবেন না। বরং ভালোবাসা, নিয়ম ও অধ্যবসায় দিয়ে তাকে গলিয়ে ফেলুন।
ঘরের কোণে গড়ে উঠুক নিজের ছোট্ট জগত!
এলিজা
আমাদের অনেককেই এখন আর সকাল আটটার বাস বা ট্রেন ধরার কথা ভাবতে হয় না। সময়ের সঙ্গে বদলেছে কাজের ধরন ও পরিসর। আর এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে হোম অফিস বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম কনসেপ্ট। কিন্তু হোম অফিস মানে কি শুধুই একটা ডেস্ক আর একটা চেয়ার? নাকি এমন একটি জায়গা, যেখানে চিন্তা, নৈঃশব্দ্য ও সৃষ্টিশীলতা একসাথে বেড়ে ওঠে? হোম অফিস হতে পারে আপনার নিজস্ব এক আশ্রয়, যেখানে আপনি কাজ করতে পারেন, স্বপ্ন দেখতে পারেন, আবার মাঝেমধ্যে একটুখানি চুপচাপ বসেও থাকতে পারেন।
স্থান: এমন একটা কোণ খুঁজুন, যেটা কথা বলে।
একটি ভালো হোম অফিস তৈরির প্রথম ধাপ সঠিক জায়গা নির্বাচন। খেয়াল রাখুন:
বাইরের আওয়াজ যেন কম আসে
বাড়ির অন্যান্য কাজকর্ম বা চলাচল যেন কম থাকে
জানালা থাকলে খুব ভালো, আলো ও হাওয়া দুটোই দরকার
এমন জায়গা বেছে নিন, যার অন্তত একপাশের দেয়াল আপনি নিজের মতো করে সাজাতে পারেন আমার মতে, হোম অফিস একধরনের ব্যক্তিগত ‘রিফিউজ’। এমন একটা আশ্রয়, যেখানে আপনি ফোকাস করতে পারেন, নিজের মতো কাজ করতে পারেন, আর মাঝে মাঝে নিজের কাছেও ফিরে যেতে পারেন।

আসবাব: আরাম, রুচি ও কার্যকারিতার মিলন
হোম অফিসে আসবাব বাছার সহজ নিয়ম, ফাংশন মিটস ফর্ম। মানে, যা দেখতে ভালো লাগে, আবার ব্যবহারযোগ্যও হয়।
ডেস্ক: মাঝারি আকারের, মজবুত কাঠের একটি ডেস্ক নেওয়া যেতে পারে, যাতে ল্যাপটপ, নোটপ্যাড, মোমবাতি, কফি মগ, জলের বোতল এবং একটি ছোট গাছ রাখা যায়। ইন-উড বা প্লাইউডের আধুনিক ডেস্কও হতে পারে ভাল বিকল্প।
চেয়ার: ব্যাক সাপোর্ট-সহ একটি আরগোনমিক চেয়ার নেওয়া ভালো, তবে তার মধ্যে যেন সফটনেস ও নান্দনিকতাও থাকে। কুশন-প্যাডেড বাঁশের হাই ব্যাক চেয়ারও একটা আকর্ষণীয় বিকল্প।
শেলফ বা ওয়াল ইউনিট: কাজের বই, কিছু প্রিন্ট, স্টেশনারি ও অনুপ্রেরণামূলক সামগ্রী রাখার জন্য ছোট তাক রাখা যেতে পারে। পুরনো কোনো তাককে নতুন করে ব্যবহার করাও চলতে পারে।
জায়গা কম হলে: একটি ফোল্ডিং ডেস্ক, বেডসাইড টেবিল, হালকা ওয়াল শেলফ বা হ্যাংগিং অর্গানাইজার ব্যবহার করে জায়গার সর্বোত্তম ব্যবহার করা সম্ভব।

রঙ ও টেক্সচার: স্পেস-এর সঙ্গে স্পিরিটের মেলবন্ধন
হোম অফিসের পরিবেশ বদলে দিতে পারে রঙ।
হালকা সবুজ, ধূসর বা মাটির রঙ, মন শান্ত রাখে। হালকা হলুদ বা অফ হোয়াইট, মন ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। তবে অফিসের রঙ যেন ঘরের বাকি রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
সাজানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন:
নিজের আঁকা একটি ছোট ক্যানভাস
একপাশে আলপনা প্রিন্টের ওয়াল
জানালায় জামদানি মোটিফের পাতলা পর্দা
ডেস্কে হ্যান্ড পেইন্টেড মাটির টব ও তাতে একটি সবুজ গাছ এই সবকিছু যেন আপনার ব্যক্তিগত গল্পের অংশ হয়ে ওঠে।

আলো ও প্রযুক্তি: আধুনিক আর শৈল্পিক ভারসাম্য
হোম অফিসে প্রযুক্তি থাকবে ঠিকই, তবে সেটি যেন চোখে পড়ে না। জায়গাটি যেন একসাথে শান্ত ও সক্রিয় থাকে।
ডেস্ক ল্যাম্প: নিজের কাজের ধরন ও ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী ল্যাম্প বেছে নিন। নানা ধরণের ল্যাম্প ও ল্যাম্পশেড এখন বাজারে সহজলভ্য।
ইন্টারনেট রাউটার: কাঠের বক্সে ঢেকে রাখা যায়, অথবা ডেস্কের নিচে সেমি-কভার্ড জায়গায় রাখা যেতে পারে।
কেবল অর্গানাইজার: টেবিলের নিচে বা ওপরে স্টাইলিশ কেবল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করুন। ইউএসবি পোর্টসহ ওয়াল সকেট থাকলে সুবিধা হয়।
আলো: দিনের বেলায় জানালা দিয়ে সূর্যের আলো আর সন্ধ্যায় ডেস্ক ল্যাম্পের আলো, এই আলোর ছন্দে তৈরি হয় কাজের মুড। সঙ্গে একটি সুগন্ধি ক্যান্ডেল জার রাখলে পরিবেশ আরও প্রশান্তিময় হয়।
স্পর্শ ও সুগন্ধ: হোম অফিস হোক জীবন্ত
গন্ধ: একটি ইনসেন্স স্টিক, এসেনশিয়াল অয়েল ডিফিউজার বা সুগন্ধি ক্যান্ডেল রাখতে পারেন, যেমন ল্যাভেন্ডার, লেমন গ্রাস বা ইউক্যালিপটাস।
নরম ছোঁয়া: নরম কুশন, মাদুর কাঠি বা জুটের ডেস্ক ম্যাট, মসৃণ সিরামিকের ছোট পেন হোল্ডার, সব কিছু যেন ছুঁয়ে দেখার মতো টানে।
স্মৃতি: প্রিয় মানুষের লেখা চিঠি, ছোট্ট মাটির ঘণ্টা, পুরনো ক্যামেরার শেল, পরিবারের কারও হাতে আঁকা ছবি বা ওয়াল হ্যাঙ্গিং, এসব রাখুন আপনার আশেপাশে।
এটা আপনার স্পেস, তাই আপনার গল্প বলুক
হোম অফিসকে সাজান এমনভাবে, যেখানে ঘড়ির কাঁটা শুধু সময় নয়, সৃজনের ছন্দ বলে। যেখানে ডেস্কের উপর রাখা গাছটার মতোই আপনি নিজেও একটু একটু করে বড় হন।যেখানে প্রতিটি বস্তু আপনাকে মনে করিয়ে দেয়, আপনি কে, আপনি কী করতে চান।
থিম অনুযায়ী সাজানোর কিছু ভাবনা:
বোহেমিয়ান: কুশনে হাতের কাজ, গালিচায় আফগানি প্রিন্ট, ম্যাকারেম, শুকনো ফুলের ডাল আর জুটের ছোঁয়া
মিনিমাল: সিম্পল, ইউজফুল, স্লিক আসবাব; ন্যূনতম রঙ ও সাজ
রিজিওনাল বাঙালি: কাঁসার জিনিস, কাঠের ফ্রেমে আলপনা, মাদুর কাঠি, পোড়ামাটির সামগ্রী
আধুনিক মেট্রো: ধাতব ফিনিশ, ব্রাস হ্যান্ডেল, কালার ব্লকিং
ইন্ডাস্ট্রিয়াল/রাস্টিক: এক্সপোজড ব্রিকস, রাফ কাঠ, ব্ল্যাক ফ্রেম

হোম অফিস মানে শুধু কাজের জায়গা নয়। এটা আপনার একটি স্যাংচুয়ারি, যেখানে আপনি নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন, নিজের মন ও স্বপ্নকে স্পর্শ করতে পারেন। হোম অফিস হোক আপনার মতো করে, আপনার বাজেট, আপনার ভাবনা আর আপনার স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে।
ভয়
বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
- মা-মা - দেখো,অর্নিজিৎ টেরেন্টুলা নিয়ে দারুণ একটা ছবি পোস্ট করেছে।
- তুই আবার মোবাইল ধরেছিস। হোমওয়ার্ক নিয়ে বস।
- মা দেখোনা ওয়ার্ল্ডের বিগেস্ট টেরেন্টুলা। গোলিয়েত বার্ড এটার। দুশোগ্রাম ওয়েট। এক হাত লম্বা। ভেনেজুয়েলায় দেখা যায়। ও মা এসোনা একবার।
- দাঁড়া, টিফিন রেডি করে আসছি।
দশ বছরের টুম্পি এফ বি তে শেয়ার করা ছবিগুলো ঝটপট চোখ বোলায়। অদ্ভুত সব নাম- রোসহেয়ার, ব্লিচ পোলমা, সেলমন পিঙ্ক। বরং ইন্ডিয়ানরাই ভালো। সবার শেষে অর্নামেন্স শব্দটা বেশ লাগে।
মা না আসায় টুম্পি বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরে যায়। ছোট্ট সাজানো ঘর যেন ডিজনিল্যান্ড। ডোনালডাক, মিকিমাউস, ডোরেমন- কি নেই। তবে এবারের হ্যাপি বার্থডে -তে পাওয়া ডান্সিং বার্বি টুম্পির সব থেকে বেশি পছন্দ।
টুম্পি জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। ওইতো ব্রাউন কালারের টেরেন্টুলাটা দিব্যি মানিপ্লান্টের সবুজ পাতায় মেরিটেশন করছে। সকালে পর্দা সরিয়ে ঐ জন্তুটি দেখে প্রথমটা আঁতকে উঠলেও পরোক্ষণে মায়ের মোবাইলে ছবি তুলে এফ বি তে পোস্ট করে। ব্যাস। যেন টেরেন্টুলা ফেস্টিভ্যাল। কেরল থেকে পুচুনমাসি, গুরগাঁও থেকে বব আঙ্কেল, কটক থেকে রানুদিদি। এরপর বন্ধুরা তো আছেই। টেরেন্টুলার হিস্ট্রি পড়তে পড়তে টুম্পির নিজের পড়া লাটে ওঠে।
সকালে এফ বি তে পোস্ট না করলে টুম্পি জানতেই পারতো না ওয়ার্ল্ডে নশো প্রজাতির টেরেন্টুলা আছে। শিকারের সময় পয়জনাস হেয়ার বুলেটের মতো নিক্ষেপ করে। তারপর অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন, তারপর ডেঞ্জারাস পেইন - সেলুসাইট্রিস - সেন্টিসেমিনার - বাপরে বাপ ! এ যেন মেডিকেলের ফার্স্ট সেমিস্টার।
টুম্পির ফিঙ্গার হাফিয়ে ওঠে। চিৎকার করে - মাম মাম তোমার টিফিন হল ? একবার এসোনা.....
চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মেঘনা টিফিন ট্রে এনে টুম্পির খাটে রাখে। মেয়ে মাকে গলা জড়িয়ে বলে - দেখো জয়দীপ স্যার কি পোস্ট করেছে। অ্যামাজনের এই ব্ল্যাক টেরেন্টুলা সাপের চেয়েও ডেঞ্জারাস। পাখি ইঁদুর খরগোশ সাপ ব্যাঙ সব খায়। এমনকি হরিণছানাও নিমেষে মেরে ফেলতে পারে।
মেঘনা মেয়েকে কোলে বসিয়ে মুচকি হেসে বলে - কিরে টেরেন্টুলা পুসবি ?
- ধ্যাত, মা তুমি সব ব্যাপারে ঠাট্টা করো নাতো। - বলে টুম্পি জানালায় যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে - মা, টেরেন্টুলা ভ্যানিস। কোথায় গেল বল তো?
মেঘনা এক পিস বাটার টোস্ট টুম্পির মুখে দিয়ে বলে - আপদ বিদেয় হয়েছে। সকাল থেকে যা কান্ড করছিস - কথা শেষ হয় না। হঠাৎ টুম্পি ভয় পেয়ে আঁতকে ওঠে -মা দেখো দেখো... টেরেন্টুলা যায় নি।
মেঘনা উঠে দেখে একটা বড় সবুজ গঙ্গা ফড়িং মাকড়সাটার লোমশ গায়ের মধ্যে আটকে আছে। সবুজ পাখা দুটো ফরফর করছে। টুম্পি মায়ের মোবাইল নিয়ে ভয়ে ভয়ে ছবি তোলে।এক দৃষ্টিতে অসহায় ফড়িংটাকে দেখে।
সন্ধ্যে ছটা। ডোরবেল বাজে। টুম্পি দরজা খুলে দেয়। জয়দীপ স্যার এসে ড্রইং রুমে বসে।বলে - কিরে তোর স্পেশাল গেস্ট কি করছে ?

টুম্পি বইয়ের ব্যাগ খুলতে খুলতে বলে - কে স্যার ?
- ওই যে তোর টেরেন্টুলা গেস্ট।
- একবার দেখে যান স্যার। বলে টুম্পি স্যারকে হাত ধরে ওর ঘরে নিয়ে যায়। অবাক কান্ড। টেরেন্টুলা সেই জায়গাতেই বসে। তবে আস্ত একটা গঙ্গাফড়িং ভ্যানিশ। জয়দীপ স্যার কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলে - ভেরি বিগ সাইজ। ডেঞ্জারাস।জানলা বন্ধ রাখিস।
আজ পড়াশোনায় মন নেই টুম্পির। মাকড়সা নিয়ে অনেকটা সময় কেটে যায়। স্যার মোবাইলে নানান মজার কথা শোনায়। ভেনেজুয়েলার এক ধরনের টেরেন্টুলা নেট তৈরি করে একটা আস্ত গাছকে ঢেকে ফেলতে পারে।
সুইডেনের সবুজ মাকড়সারা উড়তে পারে। আবার অ্যামাজনের ব্রাউন টেরেন্টুলা দুশো ফুট উপর থেকে লাফ মেরে শিকার করতে পারে।
টুম্পি অবাক হয়। দেশ-বিদেশের টেরেন্টুলার ইতিহাস ভূগোল সব জেনে বুঝতে পারে প্রাণীটি ডেঞ্জারাস। মনের গভীরে ভয় ক্রমশ দানা বাঁধে। প্রশ্ন করে - ওদের বিষে আমাদের কি হয় ? স্যার বিষের প্রতিক্রিয়ার সিমটমগুলো বুঝিয়ে চলে যায়। টুম্পির আর পড়তে ইচ্ছে করে না।
স্যার চলে যেতেই মাকে এনে টুম্পি আবার জানলার সামনে দাঁড়ায়। দেখে প্রাণীটি তখনও ঠায় বসে।
- কিরে এর মধ্যে ভয় পেয়ে গেলি। বেশতো ছবি তুলছিলি। কাল সকালে মালতি এলে বলবো ঝাঁটা দিয়ে মেরে দিতে।
- খবরদার না, আন্টির গায়ে বিষ লাগবে।
- ঠিক আছে কাল তুই স্কুল থেকে ফিরে দেখবি আর নেই।
- ওকে মেরোনা মা, এমনিই চলে যাবে। বলে টুম্পি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরতে গিয়ে হঠাৎ দূরে সরে দাঁড়ায়। বলে - ওমা, তোমার গালায় কাঁধে রেড স্পট কিসের ?
মেঘনা চমকে ওঠে। আয়নায় নিজেকে দেখে। মুহূর্তে লজ্জায় লজ্জা পেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে - ভেবেছিস টেরেন্টুলার বিষ ?
- না মা, আমি কিন্তু মজা করছি না। স্যার যা সিমটম বলেছে, তোমার স্কিনে সেই স্পট। জ্বর আছে ? দেখে দেখি, বলে টুম্পি মায়ের কপালে হাত দেয়।
মেঘনা মেয়েকে কি করে বোঝাবে এটা সোহাগী চিহ্ন। তাই টুম্পির চুলের বিলি কেটে বলে - সারাক্ষণ মাথায় টেরেন্টুলা ভূত। ম্যাথের হোমওয়ার্ক নিয়ে বস।
মা চলে যেতেই টুম্পি বইখাতা গুটিয়ে ম্যাথ পেপার নিয়ে বসে। সামনে ফাইনাল এগজাম। তারপর ক্লাস ফাইভ। নতুন বিল্ডিং। দাদা দিদিদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ।
রাতে ডিনারের টেবিলে যাওয়ার আগে অন্ধকারে টুম্পি টেরেন্টুলাকে আর দেখতে পেলো না। নির্ঘাত লুকিয়ে আছে।
- এই শুনছো, ভাত বাড়ছি এসো। এই টুম্পি, চলে আয়। সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। মেঘনার ডাকে টুম্পি, সর্নাভ দুজনের টেবিলে এসে বসে। মেঘনা প্লেট সাজাতে সাজাতে বলে - এবার কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে ফেন্সি ছাতা এনো।
টুম্পি বায়না ধরে - বাপি বাপি আমার জন্য ম্যাজিক কালার আনতে ভুলো না।
- ওকে টুম্পি।
মেঘনা চিলি চিকেন সার্প করতে করতে বলে - তা মেয়ে মাকে ফেলে কোথায় কোথায় যাবে শুনে ?
- মালবাজার দিনহাটা হলদিবাড়ি হয়ে শিলিগুড়ি - এই ট্যুরটা খুব ভাইটাল।
- কবে ফিরবে শুনি ?
- মেঘনার প্রশ্নে সঠিক উত্তর না দিয়ে বলে- তোমার পোস্টঅফিস কি আজও বন্ধ ?
- কেন গো ? আবার দুষ্টুমি ?একদম নয়। মানিয়ে উঠতে হবে। গুড বয় হয়ে শুয়ে পরো।
- সেভেন ডেইস ট্যুর,তোমার একটুও মায়াদয়া নেই ?
বাবার কথায় টুম্পি সাপোর্ট করে।
-ঠিক বলেছ বাবা। মা বলে কিনা টেরেন্টুলাকে ঝাঁটা পেটা করবে। একটুও মায়াদয়া নেই।
ছোট্ট টুম্পির কথা শুনে মেঘনা সর্নাভ হো করে হেসে ওঠে। মেঘনা বলে - পাকা বুড়ি একটা।
রাতে হোমওয়াক শেষ করে টুম্পি বইখাতা গোছায়। সকালে হিস্ট্রি জিওগ্রাফি, এগারোটায় ম্যাথ, ইভিনিং-এ বেঙ্গলী, তারপর কম্পিউটার। তাই সানডে এলেই টুম্পির মন খারাপ হয়ে যায়। এতক্ষণ টেরেন্টুলার বিষয়টা ভুলেই গেছিল। হঠাৎ জানালায় একটা শব্দ হতেই টুম্পির মনে পরে যায়। একটু এগিয়ে বাইরে তাকায়। আবছা আলোয় রুপালী সুতোর জালে গোটা জানলাটাকে ঘিরে ফেলেছে। টুম্পির দৃষ্টি স্থির। বিস্ময়ে হতবাক। নেটটা বানালো কখন ? ব্যাটা জিওমেট্রিতে পাকা।
ঘরের লাইট নিভিয়ে ইমারজেন্সির ফোকাস ফেলতেই রামধনুর বিচ্ছুরণ। রঙিন আলোর বর্ণমালায় টুম্পি টেরেন্টুলার মায়াজগতে প্রবেশ করে। কিন্তু ব্যাটা পাজি দুষ্টু গেল কোথায় ?
হঠাৎ নেট নড়ে ওঠে। আলোর ফোকাস ফেলতেই টেরেন্টুলা হিল হিল করে একেবারে নেটের মাঝখানে। টুম্পি ভয় পায়। চোখ সরায় না। দেখে,পায়ে পায়ে জানলার ফাঁকে এসে স্থির হয়। টুম্পি ছুটে মায়ের কাছে আসে। বলে - - জানো মা টেরেন্টুলা বিরাট নেট করেছে। আমিও ঘরে শোবো না। আমার ভয় করছে।
- ধুত বোকা মেয়ে ওকি ঘরে ঢুকবে ?
- না মা,যদি ঘরে ঢোকে। খুব ভয় করছে। আমি কিছুতেই ও ঘরে যাবো না।
সর্নাভ ল্যাপটপে কাজ করছিল। বিরক্ত হয়ে বলে -
-টুম্পি মাকে বিরক্ত করো না। যাও ঘরে যাও।
- বাপি সত্যি বলছি দেখবে চলো-
- আহ টুম্পি ! দিন দিন তোমার বায়না বাড়ছে।
ধমক খেয়ে টুম্পি মায়ের কোলে মুখ গুজে কেঁদে ওঠে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে - বাবা কাল মর্নিংয়ে বেরোবে। রাত হয়েছে। লক্ষীসোনা, যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো। টুম্পি তাও যায় না। অগত্যা মেঘনা টুম্পিকে কোলে নিয়ে ওর ঘরে আসে। জানালার পর্দা ভালো করে দিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালায়। বলে -
- সকাল হলেই ওকে বিদায় করবো। টুম্পিকে ভয় দেখানো ?
মা নিজের ঘরে যায়। টুম্পি চোখ বোজে। মনের মধ্যে ভয় ক্রমশ মাকড়সার জাল হয়ে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরে। বেডশীট টেনে গুরিসুড়ি দিয়ে চুপটি করে শুয়ে থাকে। আপন মনেই বলে - মা কেন আমার কাছে শোও না।
টুম্পি কুলকুল করে ঘামে। জামা ভিজে যায়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
হঠাৎ জানলায় খসখস শব্দ। টুম্পি লাফ মেরে উঠে লাইট জ্বালায়। পর্দা সরিয়ে দেখবে ? হাত-পা কাঁপছে। জল তেষ্টা পেয়েছে। বুকের মধ্যে ধপ্ ধপ্ করছে। গা গুলিয়ে ওঠে। ফুঁপিয়ে কাঁদে - অস্ফুট স্বরে বলে - আমার ভয় করছে মা। দুহাত দিয়ে চোখের জল মোছে। - মা আমিতো এখনো বড় হইনি। একা একা শুতে ভয় করে মা।
আবার শব্দ। টুম্পি চোখ মুছে ভয়ে ভয়ে পর্দা সরায়। দেখে টেরেন্টুলার লোমশ পা দুটো জানলার ফাঁক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছে। টুম্পি চিৎকার করে, কিন্তু আওয়াজ হয় না। ডায়নিং রুম পেরিয়ে মায়ের ঘরের দরজা ঠেলে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতর থেকে লক করা। চিৎকার করে মাকে ডাকে। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না। হাত পা কাঁপছে। মাথা ঘুরছে। দরজা ধরে নিচে বসে পরে। চোখ বন্ধ করে। হঠাৎ ভেতর থেকে একটা গোঙানির শব্দ ভেসে আসে। টুম্পি ভয়ে ভয়ে ভয়ে কি - হোলে চোখ রাখে। ঝাপসা অন্ধকারে অস্পষ্ট ছবিটা দেখে টুম্পি শিউরে ওঠে। চোখ সরিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। আবার দেখে। ব্রাউন কালারের একটা বিগ টেরেন্টুলা তার মাকে জাপটে ধরেছে। মা ভয়ে গোঙাচ্ছে। ছটফট করছে। অন্ধকারে লোমোস টেরেন্টুলা কিছুতেই মাকে ছাড়ছে না।
টুম্পি চোখ সরিয়ে ছুটে ডায়নিং টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে ঢক ঢক জল খায়। দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ বোজে। তবে কি ওয়াল্ডের বিগেস্ট টেরেন্টুলা মায়ের ঘরে ঢুকেছে ?








Comments