একদন্ত মহিমা: জন্মরহস্য ও গনেশ চতুর্থীর মাহাত্ম্য, রবিবারের গল্প: প্রেতাত্মার প্রতিহিংসা..
- রোজকার অনন্যা
- Aug 23
- 14 min read
Updated: Aug 24
একদন্ত মহিমা, জন্মরহস্য, বিবাহ ও গণেশ চতুর্থীর মাহাত্ম্য

ভারতীয় পুরাণে ভগবান গণেশকে “বিঘ্ননাশক”, “সিদ্ধিদাতা” এবং “বুদ্ধির দেবতা” রূপে পূজিত করা হয়। তিনি শিব-পার্বতীর পুত্র হলেও তাঁর পরিচয় বহুমাত্রিক, পুরাণ, তন্ত্র, লোকবিশ্বাস এবং আঞ্চলিক ঐতিহ্যে নানা ভঙ্গিতে তিনি পূজিত। কোনো দেবতার পূজা শুরুর আগে ‘শ্রীগণেশ’ করার প্রথা আজও প্রচলিত। তাই তাঁকে বলা হয় “আদ্যদেবতা”। গণেশের জন্মরহস্য, একদন্ত রূপ, তাঁর বিবাহ ও বিশেষ পূজা উৎসব হিসেবে গণেশ চতুর্থীর মাহাত্ম্য ভারতের ধর্ম-সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে আছে সহস্রাব্দকাল ধরে।
সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্মোৎসব রূপে পালিত হয় এই উৎসব। হিন্দু বিশ্বাসে এই দিনটি গণেশের জন্মদিন। গণেশ চতুর্থী সংক্রান্ত একটি কিংবদন্তি হিন্দুসমাজে প্রচলিত, একবার গণেশ চতুর্থীতে প্রতি বাড়িতে মোদক ভক্ষণ করে ভরা পেটে ইঁদুরে চেপে ফিরছিলেন গণেশ। পথে ইঁদুরের সামনে একটি সাপ এসে পড়লে সে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। এতে গণেশ পড়ে যান ও তার পেট ফেটে সব মোদক রাস্তায় পড়ে যায়। গণেশ উঠে সেগুলি কুড়িয়ে পেটের মধ্যে পুরে পেটের ফাটা জায়গাটি ওই সাপ দিয়ে বেঁধে দেন। আকাশ থেকে চন্দ্র তা দেখে হেসে ফেলেন। তাই গণেশ শাপ দেন যে চতুর্থীর দিন চাঁদ কেউ দেখবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য গণেশ অত্যন্ত মোদকপ্রিয় দেবতা। অন্যমতে, এই দিনে শিব গণেশকে লুকিয়ে কার্তিকেয়কে একটি ফল দিয়েছিলেন। চন্দ্র তা দেখে হেসে ফেলেন বলে শিব চন্দ্রকে অভিশাপ দেন।

ভারতীয় শিল্প ও চিত্রকলায় গণেশ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় মূর্তিকল্প। গণেশের নানা রূপের বর্ণনা যেমন পুরাণ ও ইতিহাসে পাওয়া গেছে, তেমনি তার বিচিত্র ও বহুমুখী মূর্তিও ভারতীয় উপমহাদেশে, এমনকি উপমহাদেশের বাইরেও নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। তার মূর্তিগুলি বিচিত্র ভাবে রঞ্জিত। কোথাও তিনি দণ্ডায়মান, কোথাও নৃত্যরত, কোথাও তিনি অসুরবধকারী বীর যুবা, কোথাও বা শিশুপুত্র বেশে মাতাপিতার ক্রোড়ে ক্রীড়ারত, আবার কোথাও নিছক পূজাভিলাষী হয়ে উপবিষ্ট।
গণেশের প্রথম দিকের মূর্তিগুলিতে দেখা যায়, গণেশ তার ভগ্ন দাঁতটি স্বহস্তে ধরে আছেন। গণেশ লম্বোদর গুপ্তযুগ থেকেই। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ মতে, তার উদরে সমগ্র জগৎসংসারের অবস্থান বলেই তিনি লম্বোদর। গণেশের হস্তসংখ্যা ও অস্ত্র নিয়ে নানা মতদ্বৈধ দেখা যায়। সচরাচর গণেশের চতুর্ভূজ মূর্তি অধিক পূজিত হলেও স্থানবিশেষে দ্বিভূজ থেকে ষড়ভূজ গণেশও দেখা যায়। গণেশের হাতে সাধারণভাবে পাশ-অঙ্কুশ, বরাভয় ও মোদকই দেখা যায়। তবে বাঙালি বিশ্বাসে গণেশ বিষ্ণুর মতো শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী। এই প্রসঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ কথিত পার্বতীর কৃষ্ণরূপী পুত্রলাভের উপাখ্যানটি স্মর্তব্য। গণেশের বাহন মুষিক বা ইঁদুর। ইঁদুর ধর্মের অবতার; মহাবল ও পূজাসিদ্ধির অনুকূল।
গণেশকে ‘একদন্ত’ নামে ডাকা হয় কারণ তাঁর একটি দাঁত ভাঙা। পুরাণে একাধিক কাহিনি আছে এ বিষয়ে:
1. পরশুরামের সঙ্গে সংঘর্ষ:
শিবের প্রিয় শিষ্য পরশুরাম কৈলাসে দর্শনে গেলে গণেশ তাঁকে প্রবেশ করতে দেননি, কারণ শিব-পার্বতী বিশ্রামে ছিলেন। ক্রুদ্ধ পরশুরাম গণেশের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরশুরামের কুঠারে আঘাতে গণেশের এক দাঁত ভেঙে যায়।
2. বেদলেখনের জন্য:
মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত রচনার সময় শর্ত রাখেন যতক্ষণ তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে শ্লোক উচ্চারণ করবেন, গণেশকেও বিরতিহীনভাবে তা লিখতে হবে। কলম না থাকায় গণেশ নিজের দাঁত ভেঙে তা দিয়ে লিখতে শুরু করেন। এজন্য তাঁর নাম হয় একদন্ত।
3. চন্দ্রদেবকে শিক্ষা:
গণেশকে একবার ইঁদুর বাহনে চড়ে গমনকালে দেখে চন্দ্রদেব হাসি-ঠাট্টা করেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে গণেশ তাঁর দাঁত ছুড়ে চন্দ্রকে আঘাত করেন। তখন থেকে তিনি একদন্ত নামে পরিচিত।

গণেশের জন্মরহস্য:
গণেশের জন্ম নিয়ে নানা পুরাণে নানা আখ্যান আছে। শিবের অনুপস্থিতিতে দেবী পার্বতী গৃহরক্ষা করার জন্য মল-উপলেপ থেকে এক পুত্র সৃষ্টি করেন। সেই পুত্রই গণেশ। যখন তিনি শিবকে প্রবেশ করতে দিলেন না, ক্রুদ্ধ শিব তাঁর মস্তক ছিন্ন করেন। পরে দেবী পার্বতীর অনুরোধে হাতির মাথা সংযুক্ত করে তাঁকে জীবিত করা হয়। আরেক আখ্যানে বলা হয়, মহিষাসুরের মতো অসুরদের বিনাশের জন্য দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকে গণেশের জন্ম। তাই তিনি সমস্ত দেবশক্তির ধারক। কিছু পুরাণ মতে, সরাসরি শিব-পার্বতীর যৌথ শক্তি থেকে গণেশ জন্ম নেন। প্রত্যেক আখ্যানে গণেশকে দেবশক্তির রূপ এবং ভক্তির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

গণেশের বিবাহ:
গণেশের বিবাহ সম্পর্কেও বিভিন্ন আঞ্চলিক কাহিনি প্রচলিত। ব্রহ্মার কন্যা সিদ্ধি ও বুদ্ধির সঙ্গে গণেশের বিবাহ হয়। তাঁদের সন্তান হিসেবে লাভ (লাভ্য অর্থাৎ লাভ) ও ক্ষেম (ক্ষেম্য অর্থাৎ মঙ্গল) এর নাম পাওয়া যায়। আবার কোথাও বলা হয়েছে, গণেশের স্ত্রী ঋদ্ধি (সমৃদ্ধি) ও সিদ্ধি (সাফল্য)। তাঁদের থেকে জন্ম নেয় শান্তি ও সৌভাগ্য। কিছু স্থানে গণেশকে অবিবাহিত, মাতৃভক্ত দেবতা হিসেবেও পূজা করা হয়। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তাঁকে অবিবাহিত বলেই মান্য করা হয়।

গণেশ চতুর্থী ভাদ্রপদ মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থীতে পালিত হয়। এই দিনেই গণেশের আবির্ভাব ঘটেছিল বলে বিশ্বাস।প্রাচীনকালে গৃহস্থদের আঙিনায় ছোট করে গণেশ পূজা হতো। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকেই দক্ষিণ ভারতে এই উৎসবের প্রচলন দেখা যায়। মধ্যযুগে গণেশকে রাষ্ট্রদেবতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়, বিশেষত মহারাষ্ট্রে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে লোকমান্য তিলক ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় গণেশ চতুর্থীকে জনসমাবেশ ও সামাজিক মিলনের উৎসবে পরিণত করেন। তখন থেকে এই উৎসব শুধু ধর্মীয় নয়, জাতীয় চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে।
পূজা আচার ও মাহাত্ম্য:
প্রতিমা স্থাপন : ভক্তরা মাটি দিয়ে গণেশ প্রতিমা গড়ে ঘরে বা মণ্ডপে স্থাপন করেন।
ষোড়শ উপচারে পূজা : গণেশকে ধূপ-দীপ, অর্ঘ্য, ফুল, দূর্বা ঘাস, মিষ্টি দিয়ে পূজা করা হয়।
চতুর্থীর ব্রতকথা : ভক্তরা উপবাস বা নিরামিষ আহার করেন এবং ব্রতকথা পাঠ করেন।
বিসর্জন : পূজা শেষে প্রতিমা নদী বা জলে বিসর্জন দেওয়া হয়, যা জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব ও পুনর্জন্মের প্রতীক।
গণেশ চতুর্থী শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, এটি পারিবারিক মিলন, সামাজিক সংহতি ও আনন্দের উৎসব।

গণেশ পূজায় বিশেষ নিবেদন:
মোদক : গণেশের প্রিয় মিষ্টান্ন। নারকেল-গুড়ের পুর ভরা ভাপে রান্না করা এই মিষ্টি মহারাষ্ট্রে অপরিহার্য।
লাড্ডু : বিশেষ করে তিলের লাড্ডু ও বেসনের লাড্ডু গণেশকে নিবেদন করা হয়।
দূর্বা ঘাস : গণেশকে দূর্বা অতি প্রিয়। পূজায় দূর্বা নিবেদন আবশ্যক।
পান, কলা, ফলমূল : প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়।
পেঁড়া, ক্ষীর, পুরণপোলি : আঞ্চলিক ভেদে গণেশের বিশেষ ভোগ।
বাড়িতে গণেশের পুজো করার নিয়মগুলি কী কী?
বাড়িতে যদি পুরনো গণেশের মূর্তি থেকে থাকে তা হলে সেটিকেও পুজো করা যায়। মন চাইলে বাজার থেকে নতুন মূর্তি এনেও পুজো দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে পুরনো মূর্তিটিকে বিসর্জন দিতে হবে। বাড়িতে একসঙ্গে দুটো গণেশের মূর্তি রাখা যাবে না। পুজোর কাজ শুরু করার পূর্বে স্নান করে শুদ্ধ বসন পরিধান আবশ্যিক। উপবাস রেখে পুজো করতে পারলে খুব ভাল হয়। না হলে এই দিন নিরামিষ আহার্য গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। প্রথমে করতে হবে প্রভু গণেশের প্রতিষ্ঠা। চতুর্থীর দিন সকালে উত্তর, পূর্ব বা উত্তর-পূর্ব দিকে প্রভু গণেশের মূর্তি স্থাপন করতে হবে। কাঠের ছোট চৌকি বা বেদিতে লাল কাপড় পেতে প্রভু গণেশের মূর্তিটি বসাতে হবে। গণেশের ডান ও বাঁ দিকে ঋদ্ধি-সিদ্ধির প্রতীক হিসাবে একটি করে সুপুরি রেখে দিন।

গণেশ কেবল একটি পুরাণকাহিনির চরিত্র নন, তিনি ভারতের সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে মিশে আছেন। একদন্ত রূপে তাঁর আত্মত্যাগ ও জ্ঞানলাভের প্রতীক; জন্মরহস্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় সৃষ্টিশক্তির বৈচিত্র্য; বিবাহকথা পরিবার ও সমৃদ্ধির প্রতীক; আর গণেশ চতুর্থী উৎসব মানুষকে একসূত্রে বাঁধে। আজও “শ্রীগণেশ” শব্দটি শুধু পূজা নয়, জীবনের প্রতিটি নতুন সূচনার সমার্থক।

পুষ্টিবিদের মতামত ছাড়া নিজে নিজে ডায়েট করছেন? অজান্তেই ডেকে আনছেন বিপদ! কেন প্রয়োজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, আলোচনায় পুষ্টিবিদ কোয়েল পাল চৌধুরী।
ওজন কমানোর জোয়ারে গা ভাসিয়ে আজকাল পুষ্টিবিদ সবাই! এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন এমন, অথবা কোনোরূপ পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়া নিজে নিজে যারা ডায়েট চার্ট বানিয়ে প্রয়োজনের কম খেতে শুরু করেন, তারা সন্মুখীন হতে পারেন বিভিন্ন গম্ভীর সমস্যার। বলা হয়, যা খাও তাই তুমি। তার মানে আপনি যা খান তা আপনার ত্বক এবং শরীরে প্রতিফলিত হয় সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে শরীর এবং সমস্যা অনুযায়ী সবার প্রয়োজন ও আলাদা। তাই শুধু মাত্র সঠিক খাবার খেয়ে সুস্থ থাকতে চাইলে চাই সঠিক পরামর্শ। রইলো বিশেষজ্ঞের সুচিন্তিত মতামত।

ডায়েট কথাটা বড্ড ভারীক্কি বা আধুনিক যুগে ফ্রেন্ডলি কিন্তু তার তাৎপর্য? চিকিৎসা শাস্ত্রে সৃষ্টিবিজ্ঞানের উজ্জ্বল উপস্থিতি, বা তা দৈনন্দিন জীবনে সম্পাদন করার উপায়? নৈব নৈব চ! মানুষ মেতে উঠেছে গুগল গন্ডগোল জোয়ারে গা ভাসিয়ে নানারকম বিদেশি খাবারের বা কায়দায় উন্মুক্ত করেছে তাদের পাক প্রণালী। তার জন্য হাসপাতালে বাড়ছে ভিড় কেননা কত মানুষ জিম বা ওয়েলনেস সেন্টার থেকে ভুলভাল বা মাত্রাতিরিক্ত সাপ্লিমেন্ট বা ইনজেকশন নিয়ে ডাক্তারি করছে দিকে দিকে অনেক বার্তা প্রচার করা সত্ত্বেও। হাতুড়ে ডাক্তারের জেরে শিক্ষিত সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হচ্ছে অপুষ্টির শিকার কঠিন পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর সাথে সাথে পুষ্টিবিজ্ঞানের বাস্তবিক রূপায়ণটাও বোঝানো দরকার। কেন এটি বিজ্ঞান? সেই অপকট সত্যটা উদ্ভাবন করার সময় এসেছে কারণ ভারত ছাড়া বিশ্বের মধ্যে নামাঙ্কিত অপুষ্টির দেশ হিসাবে। এটি সার্বজনীন সত্য যে মাতৃগর্ভ থেকে নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয় তবুও যদি মায়ের পুষ্টি স্থিতি না হতো অর্থাৎ মায়ের শরীরে পুষ্টিগত পদার্থ না গচ্ছিত থাকতো তবে বাচ্চার জন্ম দেওয়া সম্ভব হতো না একটি দুই থেকে তিন কেজি ঠিক হওয়া শিশুর প্রথম খাবার ই হলো মাতৃদুগ্ধ। যা মহৌষধি বললেও কম বলা হবে।
৬ মাসে অন্নপ্রাশন তারপরে শিশুর পূর্ণ বিকাশ সবকিছুই খাবারের মাধ্যমে মা সন্তান অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত জীবকেই জীবন দিচ্ছে এই পুষ্টি, যা জনজীবনের প্রথম থেকে শেষ দিন উক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু খাবারের বাদ বিচার তো মোটেই আমরা করি না কারণ হয়তো সহজলভ্য জিনিসের মূল্য এই জগতে কম। আবার অনেকে এটাও ভেবে ফেলে সহজেও সস্তায় পাওয়া খাদ্য উপাদানের পুষ্টিগত গুরুত্ব কম অনেকেই এই ধারণা পোষণ করেন ডায়েট অতি খরচ সাপেক্ষ বিষয়। আগেকার দিনের মানুষজন অনেক বেশি সতেজ রোগমুক্ত থাকতো তার কারণ পরিমিত শস্য শাকসবজি ফল জল সহজলভ্য ছিল। সঠিক দাম ও মান বজায় থাকতো। শৃঙ্খলা ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। যদি বিজ্ঞানের ভাষায় বলি ফুড এন্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি অনেক বেশি স্বচ্ছ এবং সমৃদ্ধ। পরিবেশ ও খাবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং জীবন-যাপন ছিল সরল ও মার্জিত তথ্য সাপেক্ষে বলা ভালো আগে মহামারী হত ঠিকই তবে তা বাইরে থেকে আসা জীবাণু বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে লাইফ স্টাইল ডিজিজ মত বা ফ্যাশন বা ফ্রিকশন তৈরি হয়েছে অনেক পরে যা মানবজাতির অবক্ষয়ের ফলে তৈরি হয়েছে এখন বৈচিত্র্যময় খাবার মুঠোফোনের একটা ক্লিকেই চলে আসে।

মানুষ ঘরের খাবার ছেড়ে ইন্টারনেটে দেখা জটিল খাবার সরলিকরণ করতে গিয়ে গলাদ্ধকরণ করে ফেলেছে। বাঙালি ছিল মাছে ভাতে আজ তার মাছে গন্ধ লাগে আর ভাতে ভাবে নাকি সুগার আছে। অনেক খাস গল্পের পরে হাসপাতালের প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই বলা ভালো বেশিরভাগ রোগী মালনিউট্রিশন এর শিকার। নয় পর্যাপ্ত খাবারের অভাব না হলে খাবারের প্রাচুর যে শরীর নাজেহাল ডায়াবেটিস কার্ডিও লিভার ডিপার্টমেন্টে লম্বা লাইন। রোগীর সাথে প্রাথমিক কথোপকথন ই উঠে আসে দিনের পর দিন খাবারকে অবহেলা করা ঠিক সময় না খাওয়ার বদভ্যাস কিংবা অতিরিক্ত তেল মসলা খাবার খাওয়ার সদিচ্ছা। ক্যান্সার রিসার্চ বলছে সতেজ স্বাস্থ্যকর খাদ্য উপাদানের অভাবে ম্যালিগন্যান্ট সেল বাসা বাঁধছে শরীরে। অতিরিক্ত প্যাকেট খাদ্য ২ মিনিটে তৈরি হওয়া চটজলদি খাবারের ফলে স্থগিত হয়ে যাচ্ছে শিশুর বিকাশ। বড় সার্জারির পরে রোগ সেরে উঠতে সময় লাগছে শুধুমাত্র পুষ্টির অভাবে। বলা বাহুল্য যাদের জন্ম থেকে পুষ্টি সঠিকভাবে সঞ্চারিত হয় স্বাস্থ্যের সু বিকাশ হয় তারা অনেক করোনা নামক মৃত্যু রূপী ভাইরাস এরো মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে বুঝতে হবে সমস্ত ওষুধ তথ্য মানবদেহে কার্যকরী তখনই হয় যখন পুষ্টি উপাদানগুলি সঠিক সমন্বয় থাকবে যাকে বিজ্ঞান খচিত নামে বলা হয় ফুড এন্ড ড্রাগ ইন্টারেকশন। দেখবেন প্রতিটি রোগের আলাদা আলাদা ডাক্তার থাকে যাদের সেই বিষয়ে স্পেশালিস্ট বলা হয়। তেমনই খাবার নিয়ে পড়াশোনা হয় বিএসসি এমএসসি পি এইচ ডি অর্থাৎ স্নাতক স্নাতক উত্তর গবেষণামূলক কাজ করে একজন ডায়েটিশিয়ান একজন রোগীকে দেখতে আসে কাজে ডিগ্রিমহীন বা ৬ মাসের সার্টিফিকেট কোর্স করা বা ওষুধের প্রেসক্রিপশনে এটা খাবেন আর ওটা খাবেন না লেখাকে প্রাধান্য দিলে আপনার স্বাস্থ্যেরই প্রাধান্য কমবে।

ডায়েট করা মানে না খেয়ে বা বিদেশি খাবার খেয়ে বা ১৮ ঘণ্টা উপোস করে থাকা নয়। সুষম খাদ্য বা ব্যালেন্স ড ডায়েট কে আত্মস্থ না করতে পারলে নানা রকম রোগ আপনাকে আত্মসাৎ করে ফেলবে। যে কোন মানুষের বয়স ওজন পেশা জীবনযাত্রা জিনগত রোগাবলীর বিচারের বৃত্তীয় ক্রিয়া মানসিক স্বাস্থ্য এমনকি অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে ডায়েট প্রেসক্রিপশন করা হয়। কাজটি যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনই অনেক কিছু ক্যালকুলেশন লাগে সবার ক্ষেত্রে একই ফর্মুলা ধার্য নয় একই খাবারের মেনু যথাযথ নয়। বায়োকেমিক্যাল এবং ক্লিনিকাল অবস্থা পরীক্ষা না করে আন্দাজে খাদ্য তালিকা করা অসম্ভব শুধু নয় অনৈতিক ও কারণ এটি মানব যন্ত্র যার মধ্যে ভুরিভুরি বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে অথচ বাঙালির ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়ার জন্য বাঙালি ডায়েট করছে। ঘুড়ি অর্থাৎ সেন্ট্রাল ওবিসিটি অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশ স্ফিত হওয়ার মূল কারণ খাদ্যের অনিয়ম। সঠিক পথে আনতে আজ dietian দের প্রয়োজন। বিদেশে অল্টারনেটিভ মেডিসিন এর হই হই। প্রাকৃতিক খাবারকে পন্থা করেই চলে চিকিৎসা অথচ আমাদের দেশ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা তবুও এর সদ্ব্যবহার হচ্ছে না প্রকৃতিকে সঙ্গী করে প্রকৃতি থেকে সহজে মেলা খাবারই চাঙ্গা করবে আমাদের শরীর ও মন। মেডিটেরিয়ান ডায়েট বাঙালির জন্য নয়, আকর্ষণীয় হলেও সহজপাচ্য হবে না বিষয়টা। কিটো ডায়েট করে ওজন ঝরাতে গেলে হবে আর এক বিপদ আপনার পুরনো স্বাভাবিক জৈবিক ক্রিয়া বা মেটাবলিজম ফেরানো দুষ্কর হবে। আপনি বুঝবেন না ইউটিউব দেখে কিটো ডায়েটে কত শতাংশ ফ্যাট দিতে হবে। ওষুধের যেমন ডোজ আছে তেমনি ডায়েটেরও মাপ আছে, মান্যতা আছে ক্যালরি কাউন্ট আছে মাত্রাতিরিক্ত হলে টক্সিসিটি কেউ আছে খাবারই প্রতিটি কলা কে শক্তি দিচ্ছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চালিত করছি উৎসেচক কে উজ্জীবিত করছে। মস্তিষ্ক সঞ্চালন করছে মানব শরীরকে পরিকাঠামো দিচ্ছে। কাজেই খাবারকে অবৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গ্রাহ্য করা যায় না বা নিজের মত করে প্রেসক্রিপশন করা যায় না রোগ হলে তা বিয়োগ করার জন্য ডায়েট যোগ করা প্রয়োজন।

সামাজিক মাধ্যমে নানান উপদেশ বড়দের বকুল আদেশ সহজলোক্য খাবারের অনাসৃষ্টি বাহ্যিক সৌন্দর্যের তাড়নায় রোগভোগ বাড়ছে আয়ু কমছে। হাইপার টেনশন ডায়বেটিস থাইরয়েড লিভারের সমস্যা, নানাবিধ রোগ শুধুমাত্র সঠিক খাদ্যাশেই সেরে যেতে পারে তার জন্য সারা জীবন ওষুধের সাহচর্য লাগে না আবার শরীরের উপর জোর করে নানান রকম ইন্টারমিডিয়েট ফাস্টিং চাপিয়ে দিয়ে দশটা মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট খেয়ে নিজেকে ফিট দেখাতে গিয়ে হিটের বিপরীত হয়ে যাচ্ছে জিমে গিয়ে অতিরিক্ত প্রোটিন বা কিডনি ফেলিওর এর কারণ হচ্ছে। আমরা যারা হাসপাতালে নিত্যদিন থাকি এইসব ঘটনা দিবারাত্র ক্রিটিকাল কেয়ারেও দেখতেই পাই। পুষ্টি কতটা জরুরি সেই নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে মানুষের মধ্যে এক বাক্য লাভ হওয়া দরকার রোগা মোটা নিয়ে হেলথ স্ট্যাটাস নির্ণয় করা যায় না সুপুষ্টি মানুষকে শারীরিক মানসিক ও সামাজিকভাবে সু বৃদ্ধি সমাপন করে আর তার কান্ডারী হল একজন ডিগ্রিধারী ডায়াটিশিয়ান। তাই নিজে নিজে নয়, যেকোনো সমস্যায় একজন সঠিক পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। ওষুধ নয়, খাবার খেয়ে সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

প্রেতাত্মার প্রতিহিংসা
শোভনলাল আধারকার
সে অনেক দিন আগেকার কথা।কিন্তু ঘটনাটা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে কেননা ওই দিনই শুরু হয়েছিল আমার আজকের জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন-অর্থাৎ আমার প্রথম চাকরিতে যোগদানের জন্য শুভ-যাত্রা। সেদিন ভোরবেলা থেকেই শুরু হয়েছিল মুষল ধারায় বৃষ্টি-যাকে বলে ‘আকাশ-ভাঙা’ বৃষ্টি।একঘণ্টা একনাগাড়ে মুশলধারায় বর্ষণের পরে বৃষ্টি সামান্য ধরল বটে কিন্তু প্যাচপ্যাচানি টাপুর-টুপুর চলতেই থাকল।বিকালে আবার এলো ঝেঁপে বৃষ্টি। আমার ট্রেন ছিল রাত ৯ টায়। ঠিক করেছিলাম সাড়ে-সাতটার মধ্যে নিশ্চয়ই বেরিয়ে পড়ব। মেজদা বলেছিল স্টেশনে পৌঁছে দেবে ওঁর গাড়িতে-কিন্তু বৃষ্টির দাপটে মেজদাও সাড়ে সাতটা পর্যন্ত বাড়ি ফিরলেন না। আমি টেনশনে মানসিক সন্তলন খোয়াবার শেষ অবস্থায় পৌঁছে বাড়ির কাছের ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডে ফোন করলাম-জবাব এলো-একটাও গাড়ি নেই স্ট্যান্ডে,এলে পাঠিয়ে দেবে। আর উপায়ান্তর না দেখে আমি একটা ছাতা নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম-যদি কোন "ফ্লাইং" ট্যাক্সি পেয়ে যাই অথবা কোন সহৃদয় ব্যক্তি দয়া করে কোন ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে বা স্টেশনের কাছাকাছি কোথায়ও ছেড়ে দেন; তারপর না হয় ভিজতে ভিজতেই দৌড়ে স্টেশনে পৌঁছে যাব।

কিন্তু অনেকক্ষণ রাস্তার মোড়ে দাঁড়াবার পরেও যখন কোন ট্যাক্সি বা গাড়ির দেখা মিলল না তখন মনে মনে প্ল্যান করতে লাগলাম-কি করে কলেজের কর্তাব্যক্তিদের টেলিগ্রাম করে দিয়ে সময় চেয়ে নিতে হবে, রাজি হলেও হতে পারে, নিজের মনকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম; মিথ্যে এই কারণে যে ওঁরা ইতিমধ্যে একবার আমাকে ‘জয়েন’ করার এক্সটেনশন দিয়েছেন। ওরা ত আমার জন্য জীবন-ভোর অপেক্ষা করে থাকবে না। মরীয়া হয়ে ছাতা বন্ধ করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলাম।

হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে জোরালো হেডলাইট জ্বেলে একটা গাড়ি এসে বিকট আওয়াজ তুলে ব্রেক কশে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে পড়ল।ছোটখাটো চেহারার ড্রাইভার ভদ্রলোক পিছনের দরজাটা খুলে দিয়ে ইশারা করলেন,’উঠে পড়’। আমি লক্ষ্য করলাম সামনের ড্রাইভারের পাশের সিটে একটা বড় কিট ব্যাগ বসান-কাজেই আমার ড্রাইভারের পাশে বসতে পারা সম্ভব ছিল না অথচ প্রাইভেট গাড়ির চালকের পিছনের সিটে বসা মানে ওঁকে অপমান করা। আমি আমার ছোট ব্যাগটি নিয়ে পিছনে উঠে বসতেই গাড়িটা ঊর্ধ্বশ্বাসে চালিয়ে দিল গাড়ির মালিক। বৃষ্টির তোড়ের মধ্যেও ভদ্রলোক তীব্র গতিতে চালাতে লাগলো।রাস্তায় জায়গায় জায়গায় জল জমে ছিল,তার উপর দিয়ে ওই গতিতে চালাবার ফলে কাদা জল ছিটকে গাড়ির সব কাঁচ একেবারে অস্বচ্ছ হয়ে গেল।কিভাবে যে ভদ্রলোক চালাচ্ছিলেন উনিই জানেন।আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে আলাপ জমাবার জন্যে বললাম, “অত জোরে যাবার দরকার নেই দাদা,এখনও সময় আছে; আপনি কি স্টেশনেই যাবেন?”
আমার কথার জবাব না দিয়ে কেবল সামান্য মাথা নাড়লেন। অন্ধকারে ওঁর মুখ দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু বাঁ-গাল জুড়ে একটা বিরাট কাটা চিহ্ন মুখটাকে ভয়াল করে তুলেছিল। একটু পরে বুঝলাম ওর বাঁ চোখটাও পাথরের।মুখের কাটা দাগ আর পাথরের চোখ মিলিয়ে মুখটা ভীষণ ভয়াবহ হয়ে উঠেছইল।যা হোক ওর মুখের থেকে ছোখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম।

জোর বৃষ্টিতে এত স্পীডে গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলা উচিত নয় ভেবে আমি চুপ করে বসে রইলাম।
ন’টা বাজার পনেরো মিনিট আগেই আমরা স্টেশনের ন’নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গেলাম।
-২-
আমি হাতে ব্যাগ আর বগলে ছাতা নিয়ে নেমে পড়লাম আর সঙ্গে সঙ্গে তীব্র গতিতে গাড়ি চালিয়ে বৃষ্টির অস্বচ্ছতার আড়ালে গাড়িটি কোনদিকে গেল বুঝতেই পারলাম না। আমাকে সামান্য ধন্যবাদটুকু জানাবার অবকাশও দিলেন না ভদ্রলোক।

যাহোক, প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দেখি আমার কম্পার্টমেন্ট একদম সামনে।মনে মনে ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিলাম আর অবাকও হলাম এই ভেবে যে আমার কম্পার্টমেন্ট নম্বর উনি জানলেন কি করে? আমার সুবিধার জন্য মেজদা ফাস্ট ক্লাসের টিকিট করে দিয়েছিল-‘জীবনে প্রথম চাকরি করতে যাচ্ছিস একটু ঠাটে যাওয়া দরকার’,হেসে বলেছিলেন মেজদা। আর ফাস্ট ক্লাসে চড়াও জীবনে এই প্রথম।এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কম্পার্টমেন্টে উঠে “বি” কেবিনে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়লাম।নিজের সিট কেন-সব সিটই খালি ছিল।ফার্স্টক্লাস নামেই, কেবিন এর অবস্থা খুবই খারাপ; বসার গদি ছেঁড়া,দরজাটাও ভাল করে বন্ধ হয়না,এমনকি ছিটকানিটাও ভাঙা। ভাবলাম,পাঁচ-ছ’ঘণ্টার ব্যাপার-বই,ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে কেটে যাবে সময়। যাহোক,গাড়ি নির্ধারিত সময়েই একটা জোরালো হুইসিল বাজিয়ে চলতে শুরু করল।
আমি বেশ গুছিয়ে পা তুলে আরাম করে বসলাম।ভিজে জুতো জোড়া খোলাতে পায়ে আরাম লাগল।

হঠাৎ “টিকিট প্লিজ” শব্দে চমকে ডানদিকে তাকালাম, অস্পষ্টভাবে মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, “একি! আপনি?” অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম-হুবহু সেই মুখ, যে ভদ্রলোক তাঁর গাড়িতে আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিলেন, সেই পাথরের চোখ আর বাঁ গালের বড় কাটা চিহ্নটা এখন আলোতে আরও স্পষ্ট !! মুখটা ট্রেনের স্বল্প আলোতে আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। মনে মনে ভাবলাম, হয়ত টিটি সাহেবই স্টেশনে আসার পথে আমাকে তার গাড়িতে ‘লিফট’ দিয়েছিলেন।
‘টি টি ই’ সাহেবের মুখে কিন্তু কোন অভিব্যক্তি দেখা গেলনা-কেবল হাত বাড়িয়ে টিকিটটা নিয়ে পরীক্ষা করে তৎক্ষণাৎ ফেরত দিয়ে চলে গেলেন।ওঁর যাবার পথের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল ভদ্রলোক বাঁ পায়ে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছেন।মনে হল ওনার ক্র্যাচ নিয়ে চলাই উচিল।

হঠাৎ আমার মনের পর্দায় একটা দৃশ্য ভেসে এলো-প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা।মেজদা তখন সদ্য গাড়ি কিনেছে,সব সময় চালাবার জন্য হাত নিসপিস করত।একদিন সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হল।আমার সংগে কথা বলতে বলতে বেশ জোরেই চালাচ্ছিল-বোধহয় খেয়াল ছিলনা,খেয়াল যখন হল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে-একটা খোঁড়া লোক লাঠি হাতে রাস্তা পার হচ্ছিল,মেজদা ব্রেক কশেছিল,কিন্তু গাড়ি থামাতে পারল না-সোজা গিয়ে মারল লোকটাকে-লোকটা ছিটকে পড়ল দশ হাত দূরে। একটু দূরে গিয়ে থামল মেজদার গাড়িও।লোকজন দৌড়ে এলো-ট্রাফিক পুলিশও হাজির হয়ে গেল।লোকটা নাকি হাসপাতালে মারা গিয়েছিল-মাথায় আঘাত লেগেছিল,বাঁ-চোয়াল কেটে কয়েকটা দাঁতও ঝরে গিয়েছিল।সরাসরি মার্ডার কেস: ‘রেকলেস এন্ড ডেঞ্জারাস ড্রাইভিং’।
তারপর অতি কষ্টে বাবার এক জানা শুনো এডভোকেটের দৌলতে আর অনেক খরচ করে সাক্ষী-সাবুত জোগাড় করে কোর্টে প্রমাণ করা হয়েছিল যে লোকটা মদ খেয়ে “গ্রিন লাইটে” রাস্তা ক্রস করছিল-ড্রাইভারের কোন দোষ ছিলনা, ইত্যাদি।

-৩-
ট্রেন ঠিক সময়েই চলতে শুরু করেছিল কিন্তু আধঘণ্টা জোরে চলার পর হঠাৎ গতি মন্থর হয়ে যেতে লাগল, শেষে একেবারেই থেমে গেল।ওদিকে বৃষ্টিরও বিরাম নেই।এক ‘নাম-না-জানা’ ছোট স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।স্টেশনে কোন আলোর বালাই ছিলনা,ঘাস বিছানো প্ল্যাটফর্মের এক সুদূর কোনে একটা অল্প পাওয়ারের আলো টিমটিম
করে জ্বলছিল।আমি জানালা পথে মুখ বাড়িয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম।কেউ কোথাও নেই-শুনশান জোনাকি-জ্বলা অন্ধকার-বৃষ্টির ফোটাগুলো অন্ধকারে আরও রহস্যময় দেখাচ্ছিল।বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার,জোনাকি জ্বলছে আর অসংখ্য ব্যাঙ ডাকছে।হঠাৎ গাড়ির ভিতরের একমাত্র লাইটটিও নিবে গিয়ে ভিতর বাহির সব অন্ধকারে একাকার হয়ে গেল।একা অন্ধকার কম্পার্টমেন্টে নাম-না-জানা এক ভয় হঠাৎ আমাকে পেয়ে বসল;কম্পার্টমেন্টের দরজার দিকে চোখ পড়ল-ছিটকিনিটাও ভাঙা বা চুরি হয়েছে। দরজাটা হাওয়ার দাপটে রসস্যজনকভাবে ‘ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ করছিল।দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলে বন্ধ করার প্রয়াস করতেই হঠাৎ যান্ত্রিক কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলাম,“দরজা খুলে বাইরে যাবার চেষ্টা করবেন না-জায়গাটা ভাল নয়। ঝড়ে গাছ পড়ে গেছে লাইনের উপর-গাড়ি ছাড়তে দেরী হবে,কিছু খাবার-দাবার চাইলে বলবেন”, যান্ত্রিক আওয়াজ,কিন্তু আওয়াজটা যেন শোনা শোনা মনে হচ্ছিল। জানালা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম-সেই খোঁড়া টি টি ই।এবার আমি রীতিমত ভয় পেয়ে ঘামতে লাগলাম। লোকটির গলার আওয়াজও কেমন যেন যান্ত্রিক আর অমানবিক আর কাটা গালের ভয়ঙ্কর দাগটা রীতিমত ভয়াল !
“প্র্যান্ট্রি-কারের লোক আসবে, খাবার অর্ডার নিয়ে যাবে।“শুনতে পেলাম।

ওর চলে যাবার পথের দিকে চেয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল আর কোন আওয়াজ বের হলো না।
আমার কম্পার্টমেন্টের আলো আর ফিরে এল না কিন্তু একটু পরে একটা হুইসিল দিয়ে গাড়ি ক্যাঁচর ক্যাঁচর আওয়াজ তুলে চলতে শুরু করল।আমি আশ্বস্ত হয়ে নড়ে চড়ে বসলাম।
স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে একটা সিগারেট ধরাবো কিনা ভাবছিলাম এমন সময় পকেটের মোবাইলটা তারস্বরে বেজে উঠলো।আমি পকেট থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম “হ্যালো”।

ওপার থেকে কান্নার শব্দে পরিষ্কার করে কিছু শুনতে পেলাম না, বার কতক তারস্বরে হ্যালো হ্যালো করার পর ক্ষীণ কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলাম “সর্বনাশ হয়ে গেছে রে“,মনে হল আমার পাশের বাড়ির বন্ধু উমেশের গলা।অতি কষ্টে ওর কথার অর্থ উদ্ধার করে আমার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল ট্রেনের মেঝেতে,তুলে নিয়ে আবার কানে লাগালাম,“তোর মেজদার এক ভীষণ কার অ্যাকসিডেন্ট—মেজদা আর বেঁচে নেইরে”।
“সর্বনাশ”! আমি সম্পূর্ণ কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে আচ্ছন্নের মত বসে রইলাম। কয়েক সেকেণ্ড পরে মনে শক্তি সঞ্চয় করে উমেশকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি করে হল রে অ্যাকসিডেন্ট?”
“হাসপাতালে মেজদা বলেছিল একটা ল্যাংড়া লোককে বাঁচাতে গিয়ে রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টে গিয়ে ধাক্কা মারে ওর গাড়ি, মাথার খুলিতে ভয়ানক আঘাত লেগেছিল”, বলল উমেশ।
আমার গলা দিয়ে আর কোন আওয়াজ বেরুল না। উমেশ নিজেই বলে চলল, “কিন্তু পুলিশ তন্ন তন্ন করে খোঁজ করেও কাছে কিনারে কোথায়ও কোন ল্যাংড়া মানুষের বডি খুঁজে পায়নি বা কোন হাসপাতাল বা মর্গ থেকে কোন আহত বা মৃত ল্যাংড়া মানুষের ‘রিপোর্ট’ পায়নি।
হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল আর আমার মনে হল যেন আমি সম্পূর্ণ একা অন্ধকার এক শ্মশানে বসে আছি সামনে মেজদার মৃতদেহ ! বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বাতাসের সোঁসোঁ শব্দে যেন অজানা কোন ভাসায় কিসের হাহাকার!

-৪-
আকাশের বুক চিরে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল আর কানফাটা ভয়াবহ বজ্রবিদ্যুত।গাড়িটাও যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিলো যেন পুরো আকাশটা এবার একসঙ্গে নিচে নেমে আসবে।
এবার আমার রীতিমত ভয় করতে লাগল, সারা শরীর দিয়ে আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় গরম ঘাম ঝরতে লাগল; পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা ময়াল সাপ ঘাড় থেকে নেমে আসছিল। মনে মনে ছায়াছবির মত ভাসতে লাগল
গত কয়েক ঘন্টায় ঘটে যাওয়া টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি: ল্যাংড়া ভিখারির অ্যাকসিডেন্ট, একচোখা গাল-কাটা ড্রাইভার, ঝড়-বৃষ্টির অন্ধকারে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালানো, ল্যাংড়া টি টি’র আবির্ভাব--।

শরীর-মন কিছুই যেন কাজ করছিলোনা; ঠিক সেই সময় দূর থেকে কারও ঠক ঠক করে ভারী জুতোর আওয়াজ শুনতে পেলাম-যেন দূর থেকে ভেসে আসছে সেই আওয়াজ।ক্রমে আওয়াজটা স্পষ্ট হতে হতে আমার কেবিনের কাছে-এসে থেমে গেল। ভাবলাম, প্যানট্রী কারের বেয়ারা বুঝি অর্ডার নিতে আসছে।কিন্তু চলার আওয়াজ শুনে আমার হাত-পা অবশ হতে আরম্ভ করল-পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম যেন একজন খোঁড়া লোক লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে আসছে। পায়ে যেন কোন শক্তি নেই তাই আমি সিটের উপর পাছা ঘসতে ঘসতে একেবারে জানালার কাছে চলে গেলাম,এমন সময় কেবিনের দরজায় আস্তে দু’বার টোকা পড়ল-ঠক ঠক।

ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো, গলা শুকিয়ে কাঠ; গলা দিয়ে কোনরকমে আওয়াজ বেরুল “খ-খ-খোলা আছে”। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম মুশল ধারায় বৃষ্টি আর বজ্র-বিদ্যুতের দাপাদাপি,অন্ধকারে লাইনের ধারের গাছগুলোর পাগলের মত মাথা ঝাঁকানো যেন এক ভয়ংকর প্রলয়ের ইঙ্গিত।
ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ করে স্লাইডিং দরজাটা সরে গিয়ে শুধু একটা লাঠি “ঠক” করে ভিতরে ঢুকল আর নাকি নাকি কণ্ঠের আওয়াজ এলো,“মেনু কার্ড স্যার”। আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম।দরজাটা আর একটু সরতেই দেখতে পেলাম মস্তকহীন একটা আস্ত কঙ্কাল,বাঁ-হাতে শক্ত করে ধর লম্বা লাঠিটা,আর ডান-হাতে ধরা আছে একটা নড়বড়ে মাথার খুলি। খুলির দুই চোখের কোটর থেকে রাস্তার ট্র্যাফিক লাইটের মত লাল আর সবুজ আলো জ্বলছিল-নিবছিল।আমার মুখ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বের হতে লাগল কিন্তু জ্ঞান হারাবার আগে আমি শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে এক লাফে ট্রেনের এমারজেন্সী ব্রেক এর চেনটা ধরে ঝুলে পড়লাম।
তারপরে কি হয়েছিল আমার একেবারেই মনে নেই।

Comments