সত্যজিতের ছবিতে দুর্গাপুজো, গেরস্থালির গপ্পো, গেড়িগুগলি আর জঙ্গলমহল, ওজন কমাতে খাবার, রবিবারের গল্প: উর্দি পুরাণ..
- রোজকার অনন্যা
- Sep 6
- 27 min read
ছবির মূল কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ ছিল সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে দুর্গাপুজো..
কমলেন্দু সরকার

ভাদুরিয়ার রাজা জগৎনারায়ণের বাসন্তীপুজোর জাঁকজমক দেখে তাহিরপুরের রাজা এবং পরবর্তী সময়ে গৌড়সম্রাট রাজা কংসনারায়ণ আয়োজন করলেন শরৎকালে আশ্বিনের দুর্গাপুজো। রামচন্দ্রও করেছিলেন অকালবোধন। তার কারণ, এইসময় দেবতারা ছ'মাস ঘুমোতে যান। তাই রাবণ বধের উদ্দেশ্যে দেবী দুর্গাকে জাগিয়ে তাঁর পুজো করলেন রামচন্দ্র। রাজা কংসনারায়ণও আশ্বিনে অকালবোধন করে বাঙালিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি ছিলেন সেইসময়কার বাঙালি হিন্দু সমাজের নেতা। রাজা কংসনারায়ণ বুঝেছিলেন, বাসন্তী দুর্গাপুজো যতই অনুকূল সময়ে হোক না কেন, শরতের অকালবোধনই জনপ্রিয় হবে। তাই হল। আজ তো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব আশ্বিনের দুর্গাপুজো। এই দুর্গাপুজো বা অকালবোধন ক্রমশ বাঙালির জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল, আজও আছে। ফলে, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সিনেমাতেও দুর্গাপুজো একটা জায়গা করে নিল। আমি সিনেমার কথাতেই যাব। যে-সব সিনেমার মেরুদণ্ডই হচ্ছে দুর্গাপুজো। কিংবা দুর্গাপুজো ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করে আছে। তবে আমার আলোচ্য বিষয় সত্যজিৎ রায়ের ছবি।

পঞ্চাশের দশকে যে-বাংলা ছবি সারা বিশ্বের মানচিত্রে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে জায়গা করে দিল, সেই 'পথের পাঁচালী'তে পরিচালক সত্যজিৎ রায় চমৎকার ব্যবহার করলেন দুর্গাপুজো। যদিও তিনি ব্রাহ্ম, পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করেন না। তা না করতেই পারেন। কিন্তু তার ছায়া ছবিতে পড়বে কেন। পড়েওনি, পড়তেও দেননি পরিচালক সত্যজিৎ রায়। পুজো যে নিছক কোনও ধর্ম নয়, ঈশ্বর বিশ্বাসের কথা বলে, তাও নয়। পুজো হল মিলন, ধনী দরিদ্রের ভেদাভেদ মুছিয়ে দেয়, মানুষ আনন্দে মেতে ওঠেন সমস্ত দুঃখ ভুলে, কোনও পরিবারে আবার দেবী দৈনন্দিন যাপনে জড়িয়ে পড়েন, ফলে দেখা যায় প্রভূত সমস্যা। সেইসব চিত্রই উঠে এসেছে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে।
যেই ঢাকের শব্দ এল অপু, দুর্গা-সহ নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের ছোটরা ছুটল, তখনই বুঝতে পারল তারা রায়বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু। ঢাকের শব্দে অপু, দুর্গা আর গ্রামবাসীর মন নেচে ওঠে, তেমনই প্রতিটি দর্শকেরও মন, চোখ ভরে ওঠে সব্রত মিত্রের ক্যামেরায় ধরা গ্রামের দৃশ্য, কাশবন, আদিগন্ত খোলা মাঠ দেখে। শরতের প্রকৃতির এক ভিন্ন রূপ আছে, যে-রূপ অধরা ছিল অপু-দুর্গার কাছে। সেই প্রকৃতির মাঝে উধাও ছুটে চলে ভাই-বোন। অপুর মাথায় অপটু হাতে তৈরি রাঙতার মুকুট। বারবার গোঁফ লাগানোর চেষ্টা। আগের দিন রাত্রে বিস্ফারিত চোখে দ্যাখে যাত্রা। ওই যাত্রা তার ভিতর ঘুরপাক খায়। তাই যখন অপু নকল গোঁফ লাগানোর চেষ্টা চালায় তখন শোনা যায় যাত্রার চিরাচরিত কনসার্ট। তারপর সে মুকুট পরে।

অপুর মধ্যে মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অপু যখন নিজেকে যাত্রার এক চরিত্র মনে করে সাজতে চেষ্টা করে তখন দিদি দুর্গাকে সাহায্য করার জন্য। ডাকে না। মাকে বলে মুকুটটি বেঁধে দেওয়ার কথা। পরে বোঝা গেল কারণটা। অপু মুকুটটি তৈরি করেছে দিদির সযত্নে রাখা রাংতা থেকে। এই ভাই-বোনের খুনসুটি এবং মা সর্বজয়ার আগমন। সবমিলিয়ে প্রকাশিত হয় অসাধারণ এক চিত্রমায়া, যা অভাবনীয়। এ-বুঝি সত্যজিৎ রায়ের পক্ষেই সম্ভব। দুর্গাপুজোর
রাতের যাত্রায় অপু নতুন এক শিল্পজগতের খোঁজ পায়। গ্রামের লোকসংস্কৃতিতে, লোকজীবনের ঐতিহ্য।
দুর্গাপুজো, যাত্রা, অপুর যাত্রার একটা চরিত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা তারপর দিদি দুর্গার হাতে ধরা পড়ে যাওয়া, গরু খোঁজার জন্য উন্মুক্ত প্রান্তরে দিদির পিছু দৌড় মানুষ প্রকৃতি এক হয়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরায়, ভাবনায়। অসাধারণ এক চিত্রকল্প নতুন সিনেমার ভাষা সৃষ্টি করে। বাল্যে অপুর দেখা যাত্রা পরবর্তী সময়ে 'অপরাজিত', 'অপুর সংসার'-এও তার প্রভাব দেখা যায়। সবমিলিয়ে সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী'র দুর্গাপুজো বাংলা ছবিতে এক নয়া সিনেমা ভাষা এবং দিগন্তের সৃষ্টি করে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার দুর্গাপুজো মানেই শরৎ কাল। আর শরতের প্রকৃতি সবচেয়ে সুন্দর থাকে। বিগত বর্ষার জলে প্রকৃতি ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে থাকে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে চলে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। চারিপাশের সবুজ আরও সবুজ। তারই মাঝে সাদা কাশের মিলন, সেইসব চিত্রকল্প পাওয়া যায় কেবল শরতেই। 'পথের পাঁচালী'-তে তাই পাই শরতের রূপমাধুরী। যা উঠে আসে সুব্রত মিত্রের ক্যামেরায়।

সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী'র শুরুতেই দেখি প্রতিমা তৈরি হচ্ছে। দেবীর মুখমণ্ডল সাদা। তার ওপর টাইটেল কার্ড পড়ে। ক্রমশ চক্ষুদান হয়। রং হয়। ডাকের সাজে সজ্জিতা দেবী দুর্গা। জমিদার কালীকিঙ্করের বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু ঢাকের শব্দে। কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ আসে। পঞ্চপ্রদীপ হাতে ব্রাহ্মণ পুরোহিত পুজো করছেন। দেখা যায়, বলি দেওয়ার জন্য একজন খাঁড়া প্রস্তুত। খাঁড়া নামিয়ে বলি দিতে উদ্যত। ক্যামেরা ওই ভয়ংকর দৃশ্য পেরিয়ে চলে আসে আকাশে। দেখা যায় আতসবাজির খেলা। উমানাথের কাঁধে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র। আর পাশে তার স্ত্রী দয়াময়ী। দুর্গাপুজো 'দেবী' ছবির কাঠামোটা তৈরি করে। দুর্গাপুজোর সম্প্রসারিত রূপ দেখতে পেলাম কালীকিঙ্কর যখন স্বপ্নে দেবীর ত্রিনয়ন দেখলেন। ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যাবে ওই ত্রিনয়নের আদল একেবারে বাড়িতে পূজিত দেবী দুর্গার মতো। যদিওবাড়িতে নিত্য পুজো হয় মা কালীর।
কালীকিঙ্কর যে-রাতে দেখেন দেবীর দু'টি চোখ মিলিয়ে গিয়ে ত্রিনয়ন এসে মিশে যাচ্ছে পুত্রবধূ দয়াময়ীর ভালে, সেই রাতেই দেখে গেছিল শোয়ার আগে কালীকিঙ্করের পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন দয়াময়ী। কালীকিঙ্কর বেশ আরামবোধ করছিলেন তেল মালিশে। তাছাড়াও দয়াময়ীর কাছে শুনতে চায়ছিলেন তিনি পুত্র উমানাথের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা। এখানে কোথাও যেন লুকিয়ে থাকা যৌন উত্তেজনার আভাস মেলে কালীকিঙ্করের কথায়। শ্বশুরমশাইয়ের কথায় বেশ লজ্জা পাচ্ছিলেন দয়াময়ী, তা বোঝা যাচ্ছিল বেশ। যাইহোক, কালীকিঙ্কর স্বপ্ন দেখার পর খড়মের খট খট শব্দ তুলে আসেন দয়াময়ীর ঘরের সামনে।

দেখা যায়, দয়াময়ী দরজা খুলে বাইরে আসতেই কালীকিঙ্কর জোড়হাতে বলেন, "এতদিন বলিসনি কেন মা?" বলে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন। বড় পুত্র হালকা করে প্রতিবাদ করলেও ধোপে টেকে না। আসলে, সামন্ত প্রভুরা ছিলেন তাঁরাই আইন। যেটা বলেন সেটাকেই মানতে হবে। ঘরে বাইরে সর্বত্র।
তাই জ্যেষ্ঠ পুত্র তারাপ্রসাদও বাধ্য হন সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে। সাধারণ এক গৃহবধূর মধ্যে দেবীত্ব আরোপ করা হয়। দয়াময়ী শুধু যে নিজে পাল্টালেন তা নয়, বাড়ির সকলের সঙ্গেই তাঁর দূরত্ব তৈরি হল। এমনকী বাচ্চাটির সঙ্গেও। গ্রামে গ্রামে রটে গেল দয়াময়ী সাধারণ কোনও নারী নন, দেবী! দয়াময়ীকে দেবীর আসনে বসিয়ে পুজো শুরু হল। পুজো শেষে দেবী দুর্গার বেদীতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন দয়াময়ী। ধুপ, ধুনোর ধোঁয়া, গন্ধের সঙ্গে তাঁকে গ্রাস করেছে কাঁসর, ঘণ্টার শব্দও। কালীকিঙ্কর কাছে এসে নীচু গলায় বললেন, "কী হল মা।" দয়াময়ীর কাছ থেকে কোনও সাড়াশব্দ না-পাওয়ায় তিনি বললেন, "মা, সমাধিস্থ হয়েছেন।"

পুনরায় সামন্ত প্রভুর অটল বিশ্বাস 'দয়াময়ী সমাধিস্থ' হয়েছেন। সেই বিশ্বাস থেকে কালীকিঙ্করকে টলানোর ক্ষমতা কারওরই নেই। হয়তো এর প্রতিবাদ করতে পারতেন আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত কনিষ্ঠ পুত্র এবং দয়াময়ীর স্বামী উমানাথ। কিন্তু তিনি তো অনুপস্থিত। পরবর্তী সময়ে খবর পেয়ে উমানাথ আসেন। ততদিনে দয়াময়ী আর দয়াময়ীও নেই। উমানাথ দেখেন, তাঁর দয়াময়ীর চোখ বসা, কাজল ধ্যাবড়ানো, আলুথালু বেশ। সমস্ত গয়না বার করে সাজছে। উমানাথের দিকে হার নিয়ে এসে দয়াময়ী বলেন, "পরিয়ে দাও তো।" উমানাথ বলেন, "কেন?" দয়াময়ী বলেন, "আমি যাব যে।" উমানাথ বলেন, "কোথায় যাবে দয়া?” দয়াময়ী বলেন, "পালিয়ে যাব। নইলে এরা মেরে ফেলবে!" যে-দয়াময়ীর একসময় ধারণা হয়েছিল, তিনি সত্যিই হয়তো 'দেবী'। কিন্তু পরে তিনি আত্মোপলব্ধি করেন, সবটাই মিথ্যা। হয়তো উমানাথের থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সামন্ত প্রভুর এক খেলা। না, দয়াময়ী আর পুতুল নাচের 'পুতুল' হয়ে থাকতে চাইলেন না। কিন্তু ভয় পেলেন শ্বশুর কালীকিঙ্করকে। কিন্তু দয়াময়ী মুক্তি চান এই 'দেবী দেবী খেলা'র হাত থেকে। তিনি কী পালাতে চাইলেন জমিদারবাড়ি থেকে। পরবর্তী সময়ে দয়াময়ীর কার্যকলাপ তারই ইঙ্গিত করে। পরিচালকও তারই ইঙ্গিত দিলেন দর্শকদের।

উমানাথকে নিয়েই পালিয়ে যেতে চান দয়াময়ী। উমানাথ তাঁকে আটকাতে চান। উমানাথের হাত ছাড়িয়ে বাড়ির বাইরে আসেন দয়াময়ী। তারপর দয়াময়ী মিলিয়ে যান কুয়াশামোড়া বিস্তীর্ণ এক মাঠে। শোনা যায়, উমানাথের কন্ঠ, "দয়া, দয়া...।" ছবির শেষে দেখা যায় শুরুর সেই দৃশ্য দেবী দুর্গার সাদা রং করা মুখ। যার চক্ষুদান হয়নি, তাই প্রাণ নেই মূর্তির, মৃত। বোঝা যায়, দেবীত্ব আরোপ করা দয়াময়ী আর নেই।
কিন্তু দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর দিন জন্ম হয়েছিল বাংলা সিনেমার এক তারকার। ঠাকুর জলে পড়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে হঠাৎই পড়ে যান শঙ্করদা। মারা যান। তাঁর থিয়েটার দলের হিরো অরিন্দম বলেন, "থ্রম্বোসিস।" বাংলা ছবির মহানায়ক অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের হয়তো আর মহানায়ক হওয়া হত না, যদি না 'নায়ক' ছবিতে দুর্গা প্রতিমা ভাসানের দৃশ্যটি থাকত। সত্যজিৎ রায়ের ছবির প্রতিটি দৃশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এসব কথা বলা বাতুলতা মাত্র। ছবির ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরতে হবে। মহানায়ক দিল্লি যাচ্ছেন জাতীয় পুরস্কার আনতে। প্রথমে ঠিক করেছিলেন যাবেন না কিন্তু বন্ধু কাম ম্যানেজার জ্যোতির কথামতো তাঁর সিদ্ধান্ত বদলেছেন অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়। ট্রেনের প্যান্ট্রিকারে মুখোমুখি অরিন্দম-অদিতি।

'নায়ক'-এ খুব ঘটা করে যে দুর্গাপুজো দেখানো হয়েছে তা নয়, কিন্তু দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গ না-থাকলে অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের নায়ক হওয়া হত না। ঘটনাটি পরিচালক দেখিয়েছেন ফ্ল্যাশব্যাকে। প্যান্ট্রিকারে অদিতির সামনে এসে বসেন অরিন্দম। তার আগের দিন রাত্রে একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেন তিনি। বসে অদিতিকে প্রশ্ন করেন, স্বপ্ন সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন কিনা। অদিতি উত্তর সবাই যেটুকু জানে, ততটুকুই জানি। এরপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন। অদিতি জিজ্ঞেস করেন, কাল রাতে কোনও স্বপ্নটন্ন দেখলেন নাকি? তখন অরিন্দম স্বপ্নের কথাটা বললেন, "দেখলাম টাকার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। শঙ্করদা আমাকে বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু বাঁচালেন না।" অদিতির প্রশ্ন, "শঙ্করদাটা কে? আত্মীয়?" অরিন্দম বলেন, "না, পাড়ার দাদা। বলত, আর যাই করো সিনেমায় নামবে না।" অদিতি বলেন, "খুব কড়া ছিলেন বুঝি?" অরিন্দম বলেন, "না, ওই সিনেমার ব্যাপারে। পাড়ায় একটা ক্লাব ছিল। থিয়েটার হত। শঙ্করদা ছিলেন কড়া ডিরেক্টর কিন্তু হিরোর পার্টটা আমার জন্য বাঁধা। সেবার পুজো এসে গেছে। নাটকের তোড়জোড় চলছে। সেইসময় জ্যোতি একটা খবর নিয়ে আসে। ওর টালিগঞ্জে যাতায়াত ছিল। হিরোর পার্ট। ছবি 'দেবী চৌধুরানি'। কেউ একজন আমার নামে চুকলি কেটেছিল শঙ্করদার কাছে।" একদিন শঙ্করদার পরিচালনায় নাটকের মহড়া চলছিল ক্লাবঘরে। অরিন্দম ঢুকতেই সবাইকে হটিয়ে দেন শঙ্করদা। মুখোমুখি অরিন্দম আর শঙ্করদা। অরিন্দমকে সরাসরি প্রশ্ন করেন তিনি, "কি, আমার নাটককে sabotage করার তাল করছ? মতলব কি তোমার? অরিন্দম বলেন, "আপনি মিথ্যে রাগ করছেন শঙ্করদা।"
শঙ্করদা, "মিথ্যে কিনা সেটা আমি বিচার করব। তারকা হওয়ার বাসনা হয়েছে। নাকি ল্যাজ বিশিষ্টধুমকেতু?" এরপর প্রচুর কথা হয় অরিন্দম আর শঙ্করদার মধ্যে। শঙ্করদা সিনেমা করা উচিত কি উচিত নয় তা নিয়ে কথা হয় দু'জনের ভিতর। একসময় শঙ্করদা ultimatum দেন অরিন্দমকে।

বলেন, "আমি বলছি হবে না।" অরিন্দমও মেনে নেন শঙ্করদার আদেশ। বলেন, "আপনি বললে নিশ্চয় হবে না। তবে নাটকটা ডুবিয়ে ফিল্ম করার কথা ভাবছিলাম না।" এরপরও প্রচুর কথাবার্তা হয় দু'জনের ভিতর। শঙ্করদা ভীষণভাবে সিনেমার বিরুদ্ধে। অথচ অরিন্দমের সিনেমা করার প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু তাঁর নাট্যগুরু শঙ্করদার মুখের ওপর কিছু বলার সাহস নেই। এবং বড়দের মুখের ওপর কথা বলা অরিন্দমের ভদ্রতায় বাধে। অরিন্দমের সিনেমা করার সেই স্পৃহার প্রকাশ পায় যখন শঙ্করদার চিতা প্রজ্বলিত। মুখোমুখি জ্যোতি এবং অরিন্দম।
তার আগে ফ্ল্যাশব্যাক ফেরা যাক। অরিন্দম বলছেন অদিতিকে, "এই হল শঙ্করদা। সেবার অষ্টমীর দিন থিয়েটার হল। দু'দিন পর ভাসান। আমাদের ক্লাবের প্রতিমা ছিল একেবারে সাবেকি স্টাইলের। শঙ্করদা বলতেন, 'ওই চালচিত্তির, ডাকের সাজ, ড্যাবডেবে চোখ না হলে ভক্তি আসে না।' অতবড় জোয়ান লোকটা চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল!... ছেলেবেলায় বাপ-মা'র মৃত্যু দেখেছি। তারপর আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেক মড়া কাঁধে করেছি। মৃত্যু সম্বন্ধে একটা callous ভাব এসেগিয়েছিল। কিন্তু শঙ্করদার মৃত্যুটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। যার মধ্যে এত লাইফ, তার প্রাণটা যায় কী করে! কিন্তু আশ্চর্য কি জানেন, শ্মশানে মড়া যখন পুড়ছে তখন feel করলাম মনের ভিতর একটা change আসছে।"
অরিন্দম বলে চলেছেন অদিতিকে। দেখা যায় অরিন্দম বলেন, "জ্যোতি?" জ্যোতি বলেন, "বল।" অরিন্দম, "বোস।" জ্যোতি বসার পর অরিন্দম বলেন, জ্যোতি, তোর পরজন্মে বিশ্বাস আছ?" জ্যোতি বলেন, "কার?" অরিন্দম, "মানুষের। এই ধর, তোরা" জ্যোতি বলেন, "আমি যে আমি বুঝছি কী করে। জ্যোতি বাড়ুজো তো আর জ্যোতি বাড়ুজো হয়ে জন্মাচ্ছে না! আর জাতিস্মরও সবাই হয় না। তাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা উঠছে কী করে!" অরিন্দম বলেন, "exactly." জ্যোতি বলেন, "মার্কস আর ফ্রয়েডের যুগ ভাই। no পরজন্ম, no providence, অরিন্দম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, "জানি, জানি, একটাই lifetime একটাই chance."

এরপর অরিন্দমের মনে প্রশ্ন জাগে অভিনেতারা কি সত্যিই পরিচালকদের হাতের পুতুল? জ্যোতিকে বলেন, "তোর কি বিশ্বাস ব্র্যান্ডো, বোগার্ট, পল মুনি, এঁরা সবাই হাতের পুতুল।" জ্যোতি বলেন, "মানুষ হয়ে মাসে হাতে ৩৩৩ টাকা। বছরে দশটাকা increment, একজন successful পুতুল হলে per picture হেসেখেলে ৩০০০০ টাকা। একজন successful পুতুল হওয়া অনেক ভাল। ওরা দুটো ছেলের test নিয়েছে। উত্তরইনি। তুই রাজি হলে ইজ্জতটা বাঁচে।" হঠাৎই অরিন্দম জ্যোতির কথার পিঠে বলে ওঠেন, "শঙ্করদা must be wrong শঙ্করদা must be wrong." কথাটি বলেই ঠোঁটের সিগারেটটি নিয়ে ছুড়ে ফেলেন অনতিদূরে শঙ্করদার জ্বলন্ত চিতা লক্ষ্য করে। তার পরমুহূর্তেই বলেন, "সত্যযুগ হলে ভয় পেতাম।" জ্যোতি, 'কিসের?" অরিন্দম স্মিত হাসিমুখে বলেন, "শঙ্করদার অভিশাপের।"
অরিন্দম-অদিতি মুখোমুখি। অরিন্দম বলছেন, "Decide করে ফেললাম on the spot." পাড়ার অভিনেতা থেকে মহানায়ক হওয়ার প্রথম ধাপে পা রাখলেন অরিন্দম। একজনের মৃত্যু, অন্যজনের নতুন জীবনে প্রবেশ। যাঁর মৃত্যু হল তাঁর নাম শঙ্কর বা যে-কোনও নাম হতে পারে। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন অরিন্দমের ইচ্ছার সামনে একটি প্রাচীর হয়ে অর্থাৎ বাধা। তাঁর মৃত্যু অরিন্দমের সামনে বাধার প্রাচীর হয়ে গেল হাটখোলা দরজা। তিনি ক্রমশ হয়ে উঠলেন বাংলা ছবির ম্যাটনি আইডল। অরিন্দমকে হয়তো তাড়া করে বেড়াত শঙ্করদার সাবধান বাণী। তারই প্রেক্ষিতে অরিন্দম বলেছিলেন জ্যোতিকে, "সত্যযুগ হলে ভয় পেতাম... শঙ্করদার অভিশাপের।" শঙ্করদার কথাগুলো কোনওভাবে পীড়িত করত অরিন্দমের চেতনে বা অবচেতনে। যা অদিতি বলেন অরিন্দমকে। তাই স্বপ্ন দেখে ভয় পান, চিন্তিত হন অরিন্দম। স্বপ্নের ভিতর অরিন্দম হাত বাড়ালেও হাত ধরেন না শঙ্করদা। তিনি ক্রমশ নিমজ্জিত হন টাকার পাঁকে। কিছুক্ষণ আগেই দেখা গেছিল অরিন্দম খেলাচ্ছলে হেঁটে বেড়াচ্ছেন টাকার পাহাড়ে মহানন্দে! তারপরই টেলিফোন বাজে। কংকাল হাতে টেলিফোন। তুলতে ভয় পান অরিন্দম। এই দৃশ্যে পূর্বে জ্যোতির মুখের দু'টি সংলাপ মনে পড়ে। একটি "এখন মার্কস আর ফ্রয়েডের যুগ ভায়া...।" আর ".. per picture হেসেখেলে ৩০০০০ টাকা।" পুরো ছবিটি দাঁড়িয়ে আছে দুর্গাপুজোর মধ্যে।

সত্যজিৎ রায়ের 'জয়বাবা ফেলুনাথ'-এও দুর্গাপুজোর ভূমিকা বিশাল। দুর্গাপুজো কেন্দ্র করে বেনারসের ঘোষাল বাড়িতে লোকসমাগম। পরিবারের একটি অ্যান্টিক গণেশমূর্তি ঘিরে জট পাকানো এবং জট খোলা। যে-জট খোলেন ফেলুদা। বাঙালির অন্যতম জনপ্রিয় গোয়েন্দা। ফেলুদার নিছকই বেড়াতে আসা বেনারস। বেড়াতে এসে গোয়েন্দাগিরিতে জড়িয়ে পড়া।
ছবির টাইটেল কার্ড শেষ। অসুরের ক্লোজআপ। ক্যামেরা আসে প্রতিমা গড়ার কারিগর শশী পালের মুখে। তার মুখে শোনা যায়, "তখন দেবতারা বললেন, সর্বনাশ, ওই অসুরের সঙ্গে তো পারা যাচ্ছে না।..." চুপচাপ বসে শুনছে রুকু। উমানাথ ঘোষালের পুত্র রুকু। বেনারসের ঘোষালবাড়ির ঠাকুরদালানে প্রতিমা গড়ছেন বৃদ্ধ শশী পাল। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি রুকু অর্থাৎ রুক্মিণীকুমারকে দুর্গার পৌরাণিক কাহিনি শোনাচ্ছেন, "... ব্রহ্মা একে এমন বর দিয়েছেন যে কোনও পুরুষ দেবতা একে বধ করতে পারবে না। তখন বিষ্ণুর মহাক্রোধ, বিষ্ণুর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, শিবের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো তেজ, সমস্ত দেবতাগণের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো তেজ, সেই সমস্ত তেজ থেকে সৃষ্টি হলেন এই দেবী দুর্গা। দুর্গার দশ হাত। দশ হাতে দশরকম অস্ত্র নিয়ে অস্ত্র নিয়ে বাহনের পিঠে চেপে দেবী যুদ্ধ করলেন মহিষাসুরের সঙ্গে।" রুকুর জিজ্ঞাস্য, "বাহন কি?া শশী পাল বললেন, "বাহন, সিংহ। গণেশের বাহন ইদুর, কার্তিকের বাহন ময়ূর, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা আর সরস্বতীর বাহন হল হাঁস শিশুমনের কৌতূহল তাই রুকু জিজ্ঞেস করে, "সব সত্যি?" তখন শশী পাল বলেন, "মিথ্যে বলি কি করে রুকুবাবু, মুনি ঋষিরা তো এইসব লিখে গেছে।" হঠাৎই রুকু ফিরে যায় নিজের জগতে। বলে, 'সব সত্যি। মহিষাসুর সত্যি, হনুমান সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, অরণ্যদের সত্যি। হঠাৎই গাড়ির হর্ন শুনে রুকু ছুটে যায়। শশী পালও উঠে পড়েন। উঁকি মেরে দেখে রুকু ছুটে যায় বিকাশের কাছে। বলে, "ডাকু গন্ডারিয়া।" কিছুক্ষণ পর দেখা যায় উমানাথ ঘোষাল আর মগনলাল মেঘরাজকে। ওঁরা দু'জন পূর্ব পরিচিত। মগনলাল বলেন, "তোমাকে কাল দেখলাম মছলিবাব্য দর্শনে। ভাবলাম একবার। দেখা করে আসি।" উমানাথ বলেন, "আমরা তো প্রতিবারই পুজোর সময় এখানে আসি। বাবা আছেন, ঠাকুরদা আজও বেঁচে আছেন।" মগনলাল বলেন, "আর তোমার গণেশ?" উমানাথ অবাক, "বাবা, ওটার কথা এখনও মনে আছে।" এই গণেশমূর্তিটি নিয়েই 'জয়বাবা ফেলুনাথ'।

প্রথমে মনে হয়, দুর্গাপুজো ছবির সমান্তরাল আরেকটি বিষয়। পরে সেই ধারণা চলে যায়। দ্বিতীয়বার দুর্গাপ্রতিমা বানানোর ব্যাপারটা দেখি চতুর্থীর দিন। সেদিন রং করছিলেন শশী পাল। ফেলুদা জিজ্ঞেস করলেন, "পরশু তো ষষ্ঠী, শেষ হয়ে যাবে?" ফেলুদার কথায় দু-একটি পাত্তা না-দিয়ে দায়সারা জবাব দেন শশী পাল। পরিচালক সত্যজিৎ রায় দুর্গাপুজো নিয়ে খুব বেশি আর নাড়াচাড়া করেননি, করার কথাও নয়। তবে দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে নিবিড় যোগ রাখেন পরিচালক। গণেশমূর্তিটি লুকিয়ে রাখা হয় সিংহের মুখের ভিতর। তবে পরবর্তী সময়ে সেটিও আর থাকে না। ফলে, দুর্গাপুজো এবং প্রতিমার গুরুত্ব হারায় ছবি থেকে। কিন্তু পুজো যখন শুরু হয়েছে তার তো একটা শেষ থাকবে। সেই ভাসান বা বিসর্জনের দিনটি চমৎকারভাবে আসে ছবিতে।

ফেলুদা যখন ঘোষালবাড়ির আশ্রিত বিকাশ সিংহকে ধরতে শ্রী রাম ভাণ্ডারে যান। বিকাশ তখন ঘোষালবাড়ির কর্তা অম্বিকাচরণ ঘোষালের নির্দেশমতো মিষ্টি কিনতে ওই রাম ভাণ্ডারে। ফেলুদা বলেন, "... এখন থাক, পরে হবে।" বিকাশকে নিয়ে যান মানমন্দিরে। সেখানেই চলে জিজ্ঞাসাবাদ। সেইসময় খুব হালকা করে শোনা যায় বিসর্জনের ঢাকের বাজনা। ঢাকের বাদ্যি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়। আর ঘোষালবাড়ির জন্য মিষ্টি কেনা, এই দু'টির জন্য বুঝতে অসুবিধা হয় না সেদিনই বিজয় দশমী বা বিসর্জন। প্রবাসী বাঙালির দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে সত্যজিত রায়ের 'জয়বাবা ফেলুনাথ' এককথায় অপূর্ব।

বাংলা সিনেমায় ছবির কারণে হোক বা অকারণে দুর্গাপুজো বারবার এসেছে। বাঙালির কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে জুড়েই দুর্গোৎসব। বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। দুর্গাপুজোও একটি বিষয়। সিনেমা বা সাহিত্যে, আলোকচিত্রে পটভূমি দুর্গাপুজো। বাঙালির জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে দুর্গাপুজোর সঙ্গে। বেশ কয়েকশো বছরের বাংলার সংস্কৃতিতে জড়িয়ে আছে দুর্গাপুজো। শারদোৎসব আর বাঙালির সম্পর্ক একেবারে অমলিন। কী সামাজিক কারণে, কী অর্থনৈতিক কারণে। তাই বারবার সাহিত্য, সিনেমায় লেখক, পরিচালকেরা আশ্রয় নিয়েছেন এই দুর্গাপুজোর। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও দুর্গাপুজোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। অবশ্যই ছবির প্রয়োজনে দুর্গাপুজো গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে সত্যজিৎ রায়ের কাছে, সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যে..
গেরস্থালির গপ্পো, গেড়ি-গুগলি আর জঙ্গলমহল
পাতা ঝরার মরশুম হোক কি বর্ষা, যেকোনও সময়েই জঙ্গলমহল পর্যটকদেরকে আকর্ষণ করে। শাল, শিমূলে ভরা এই অঞ্চল বিখ্যাত পর্যটন মানচিত্রে। শীত আর বর্ষা এই দুই মরশুমে এ অঞ্চলের রূপ দুরকম। বৃষ্টি ভেজা গাছের পাতা, তার মধ্যে থেকে এসে পড়া সূর্যের আলোতে মোহময়ী জঙ্গলমহল। মনে হবে যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে কেউ। তার মধ্যে ফুটে থাকে ছোট সাদা ফুলের কুঁড়ির মতো ছাতু। জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলোতে চোখ রাখলেই দেখা যায় সকাল বিকাল মহিলারা দল বেঁধে চলেছে জঙ্গলের উদ্যেশ্যে। শালপাতায় অথবা চুবড়ি ভরে তাঁরা তুলে আনবেন জলজ গেড়ি, গুগলি, শামুক। মুঠো ভরে কুড়িয়ে আনবেন মাটি মাখা ছাতু। সন্ধ্যে নামার আগে ঘরে ফিরতে হবে তাদের। আয়ের উৎস থেকে প্রোটিনের যোগান সব'ই এরা। বড্ড সাধারণ, ভালোবাসায় মোড়া এদের জীবন যাপন। রোজকার রোজনামচায় নিজেদের অনন্য সংলাপ।

এক সময় আদিবাসী অধ্যুষিত প্রত্যন্ত এলাকার গরিব মানুষ বা আদিবাসী পরিবারগুলির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই গেড়ি গুগলি খাওয়ার চল ছিল। শহুরে লোকেরা নাক সিঁটকে বলতেন এসব কে খায়!! তবে বর্তমানে মৎস বিভাগের উদ্যোগে নলবন সহ শহরের রেস্তোরাঁ গুলিতেও বাড়ছে গেঁড়ি, গুগলি, ঝিনুকের চাহিদা৷ গুগলির স্যুপ কিংবা ‘র মাজেল মিট’ চেটেপুটে খাচ্ছেন ভোজনরসিকেরা৷ বাস্তুতন্ত্রের পক্ষেও গেঁড়ি কতটা অপরিহার্য, তা জানেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেই গেঁড়িই এখন বিলুপ্তির পথে। রাসায়নিক সার ব্যবহার করার ফলে খুব একটা পাওয়া যায়না আর। এছাড়াও তাপপ্রবাহ এবং কীটনাশক এই জলজ প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি করে।
এবার শুধু কিন্তু মুখের স্বাদ নয়, গেঁড়ি গুগলি খাওয়ার উপকারীতা অনেক। প্রোটিন ও ভিটামিনে এ জিনিস ভরপুর। দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। গুগলিতে পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি এবং সোডিয়ামের মাত্রা কম থাকে যার ফলে এটি রক্ত চাপের মাত্রা বজায় রাখে, হার্ট ও কিডনির রোগের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় সেজন্য এটি মস্তিষ্কের বৃদ্ধি এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

জঙ্গলমহলের ছাতু:
জঙ্গল লাগোয়া গ্রাম গুলোতে চোখ রাখলেই দেখা যায় সকালে ও বিকালে মহিলারা দল বেঁধে চলেছে জঙ্গলের উদ্যেশ্যে। ছাতু কুড়াতে। বর্ষায় যেখানে বাঙালি পাতে হয় ইলিশ নয় খিচুড়ি, সেখানে জঙ্গলমহলে বর্ষা মানেই নানান ধরনের ছাতুর ছড়াছড়ি। বর্ষার শুরুতেই ফুটতে শুরু করে "কুড়কুড়ে" বা "পুটকা" ছাতু। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Astraeus Hygrometricus (Pors.) Morg. দেখতে গোল গোল মার্বেলের মতো। ফোটা ফুলের মতো সাদা ধবধবে। উপরের শক্ত খোলটা খাওয়ার সময় কুড়কুড় শব্দ হয় বলেই হয়তো এহেন নামকরণ। একে আবার পুটকা ছাতুও বলে। 'পুটকা' মানে ছোট। এর পুষ্টিগুণ প্রচুর। বিভিন্ন ধরনের ছাতু জঙ্গলমহলে পাওয়া যায়। যেমন "কুড়কুড়ে" ছাতু, "বালি" ছাতু, "উই" ছাতু, "কাড়ান" ছাতু, "মোঢাল" ছাতু, "পাতড়া" ছাতু, "খড়" ছাতু ইত্যাদি। বীরভূম, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের লাল বর্ণের ল্যাটেরাইট মাটিতে শাল গাছের তলায় জন্মানো এই ছাতুতে ফ্যাট থাকে কম, ফাইবার থাকে বেশি। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ছত্রাকটিতে রয়েছে অ্যাস্ট্রাকুরকুরোন ও অ্যাস্ট্রাকুরকুরোল নামে দুটি জৈব যৌগ। মানুষের লিভার, হৃৎপিণ্ডের প্রদাহ কমায় এই ছত্রাক। শুধু তাই নয়, লিভার ও ফুসফুসের ক্যান্সার কোষ মোকাবিলায় এই ছত্রাক বিশেষভাবে কার্যকরী। তবে শুধু স্বাস্থ্যকর দিকের কথা বললে বড্ড অন্যায় হবে।ঠিক মতো রাঁধতে পারলে, স্বাদেও মাছ মাংসের থেকে কোনো অংশে কম নয়। ছোট ডুমো করে কাটা আলু আর পেঁয়াজ আদা রসুন লঙ্কায় কষিয়ে রাঁধতে হবে শুধুমাত্র।

লাল পিঁপড়ার চাটনি:
বৈজ্ঞানিকভাবে ওকোফিলা স্মারাগডিনা নামে পরিচিত, কামড়ালেই ফুলে ওঠে, ত্বক লাল হয়, ব্যথাসহ ফোস্কা তৈরি হয়। ঐ লাল পিঁপড়া খুবই সাবধানে ডিম সহ তাদের বাসা থেকে সংগ্রহ করে ভালো মতো পরিষ্কার করা হয়। তাতে লবণ, আদা, সরষের তেল, রসুন এবং লঙ্কা মিশিয়ে বেটে চাটনি তৈরি করা হয়। প্রচন্ড ঝাঁঝালো এই ‘কাই’ চাটনি সাধারণত ভাত, রুটি বা পরোটার সঙ্গে খাওয়া হয়। পুষ্টিগুণের তালিকাও বিশাল এক্ষেত্রে। প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, দস্তা, ভিটামিন বি -১২, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম ইত্যাদির মতো পুষ্টির একটি ভাল উৎস এমনটাই বলেন বিশেষজ্ঞরা। এটি স্বাস্থ্যকর মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে তার ভূমিকার জন্যও মূল্যবান, সম্ভবত হতাশা, ক্লান্তি এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাসের মতো অবস্থার পরিচালনায় সহায়তা করে এই লাল পিঁপড়ের চাটনি।

শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে এই অঞ্চলে চাষবাস সীমিত। যখন শাকসবজি ফলে না, এইসব উপকরণেই ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেন এই এলাকার মানুষ। বেশ কিছু ফল ও এখানে পাবেন, যা অন্যত্র পাবেন না। বৈঁচি, কুসুম, বন খেজুর, কেঁদ, মহুল, ভুররু, শেঁওয়া কুল ইত্যাদি। জঙ্গলের এই মায়াভরা ভালোবাসা পেতে হলে আসতে হবে এখানেই। যেখানে প্রতি ঘরে, গেরস্থালিতে বোনা হয় স্বপ্ন, যেখানে তাঁরা প্রতিদিন সহজ ভাবে, সুন্দর এবং সাবলীল ভাবে বাচার স্বপ্ন দেখেন। সামান্য স্থানীয় উপকরণ আর নিজেদের যত্নের ছোঁয়ায় সাজিয়ে তোলেন প্রতিদিনের থালা। যার প্রতি কণায় পরমাণ্ণ। ভালোবাসা।
পুজোর আগেই ওজন কমান সুন্দর থাকুন
দুর্গাপূজা আর বেশি দূরে নয়। অনেকেই আছেন যারা পুজোর আগে নিজেদের ওজন কমাতে আগ্রহী। প্রথমে আমি কিছু যে সাধারণ টিপস দেব যার দ্বারা আপনারা দ্রুত আপনাদের ওজন কমাতে পারবেন।
প্রথমত সুষম খাবার খান :
প্রক্রিয়াজাত খাবার বর্জন করুন এবং তার পরিবর্তে আরও ফল, শাকসবজি, চর্বিহীন প্রোটিন এবং পুরো শস্য (whole grain) খাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করুন। এর ফলে কম ক্যালরি গ্রহণ করে যেমন একদিকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি লাভ করা যায় তেমনি অন্যদিকে খিদের অনুভূতিকে কম করা যায়।

পর্যাপ্ত জল খান:
খাবারের সাথে পর্যাপ্ত জল খেলে দ্রুত পেট ভরার অনুভূতি তৈরি, যা আমাদের খিদে এবং খাদ্য গ্রহণ কমাতে পারে। একটি 2019 মেটা-বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে উচ্চ-ক্যালোরিযুক্ত পানীয়গুলিকে জল দিয়ে প্রতিস্থাপন করা আপনার প্রতিদিনের জল খাওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর চেয়ে বেশি কার্যকর।
চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন
চিনিযুক্ত পানীয় যেমন জুস, সোডা, মিষ্টি কফি এবং চা এবং অ্যালকোহল প্রভৃতি আমাদের ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। তাই ওজন কমাবার জন্য এই জিনিসগুলোকে এড়িয়ে চলতেই হবে এবং এই খাবারগুলোকে এড়িয়ে চললে হার্টের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে ডায়াবেটিস ও প্রতিরোধ হবে ।
মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন
উচ্চ মানসিক চাপ হরমোনের ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে এবং শরীরে এমন হরমোন তৈরি করতে পারে যা খিদে বাড়ায়।এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো আপনারা যোগ ব্যায়াম করুন কারণ যোগব্যায়াম যোগব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং ওজন কমাতেও সাহায্য করতে পারে। গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন যে কম-ক্যালোরি খাবারের পাশাপাশি 8-সপ্তাহের স্ট্রেস-ম্যানেজমেন্ট কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে যাদের ওজন বেশি বা স্থূলতা রয়েছে এমন শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের বডি মাস ইনডেক্স (BMI) উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে , ।
ক্যালোরি হিসেব করে নিজের খাবার খান :
প্রত্যেকে নিজেদের ওজন উচ্চতা এবং শারীরিক কার্যকলাপের ভিত্তিতে ক্যালরির হিসেব করে নিন এবং সেই অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করুন, এটি একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

প্রচুর ফাইবার খাওয়া প্রয়োজন :
ওজন কমাবার জন্য প্রচুর পরিমাণে ফাইবার খাওয়া প্রয়োজন কারণ ফাইবার জাতীয় খাবার আমরা যত বেশি খাব তত আমরা তাড়াতাড়ি পেট ভরার অনুভূতি লাভ করতে পারি , তার ফলে আমাদের খাওয়ার পরিমাণ কম হয়।
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে: হোল গ্রেইন, যেমন পুরো-গমের পাস্তা, হোল গ্রেইন আটার রুটি রুটি, ওটস, বার্লি , ফল , বিভিন্ন ধরনের সবজি , মটর, মটরশুটি, ডাল , বাদাম এবং বিভিন্ন ধরনের বীজ।
অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করা :
মানুষের অন্ত্রে প্রায় 39 ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া সহ বিপুল সংখ্যক এবং বিভিন্ন ধরণের অণুজীব রয়েছে।কিছু খাবার অন্ত্রে ভাল ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়াতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:
বিভিন্ন ধরনের ফল, শাকসবজি এবং শস্য অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার বিশ্বস্ত উৎস । প্রত্যেকের একটা নিশ্চিত করা উচিত যাতে শাকসবজি এবং অন্যান্য উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবার তাদের মোট খাবারের 75 শতাংশ অন্তর্ভুক্ত করে।
প্রিবায়োটিক খাবার: এগুলো ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারী কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ও কার্যকলাপকে উদ্দীপিত করে। প্রিবায়োটিক ফাইবার অনেক ফল ও সবজিতে পাওয়া যায়, বিশেষ করে চিকোরি রুট, আর্টিকোক, পেঁয়াজ, রসুন, অ্যাসপারাগাস, লিকস, কলা এবং অ্যাভোকাডো। এটি ওটস এবং বার্লির মতো শস্যেও রয়েছে।

রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে কিনা দেখুন :
অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতি রাতে 5-6 ঘন্টার কম ঘুম স্থূলতার বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে অপর্যাপ্ত বা নিম্নমানের ঘুম সেই প্রক্রিয়াটিকে ধীর করে দেয় যেখানে শরীর ক্যালোরিকে শক্তিতে রূপান্তর করে, যাকে বলা হয় বিপাক (Metabolism)। যখন বিপাক ধীর গতি সম্পন্ন হয়, তখন শরীর চর্বি হিসাবে অব্যবহৃত শক্তি সঞ্চয় করে। এছাড়াও, দুর্বল ঘুম ইনসুলিন প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে এবং কর্টিসলের মাত্রা বাড়াতে পারে, যা চর্বি সঞ্চয়কেও বৃদ্ধি করে।কেউ কতক্ষণ ঘুমায় তা খিদে নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন লেপটিন এবং ঘেরলিনের নিয়ন্ত্রণকেও প্রভাবিত করে। লেপটিন মস্তিষ্কে পূর্ণতার সংকেত পাঠায়।
চর্বিহীন শরীর পেতে চাইলে নিয়মিত ব্যায়াম করা ভালো। কিন্তু ব্যস্ত রুটিনে তা কয়জন পারে! হয় বাড়ির কাজ বা অফিসের কাজে সময় লাগে। ব্যায়াম আলাদাভাবে করা হয় না। কিন্তু পুজো এলেই সবাই নিজেকে আরও সুন্দর, আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়। কিন্তু পুজোর আর মাত্র কয়েক দিন বাকি, এই কয়েক দিনে ওজন কমাতে পারেন কীভাবে? শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নিয়ম মেনে এসব খাবার খান।

প্রতিদিনের খাবার তালিকা কেমন হওয়া উচিত?
সকালে ঘুম থেকে উঠে মেথি বা জিরে ভেজানো জল!
সকাল নটার মধ্যেমধ্যে ব্রেকফাস্ট খান: নিয়ম করে সকাল নটার মধ্যেমধ্যে ব্রেকফাস্ট খান। দেরি করবেন না। জলখাবারে খান চিঁড়ে, ওটস, ডালিয়া এগুলো খান এগুলোতে রয়েছে ফাইবার যা স্বাস্থ্যের এবং ওজন কমাবার জন্য অত্যন্ত ভালো। এই খাবারগুলি আমাদের পেট ভরিয়ে রাখে অনেকক্ষণ। এর সঙ্গে 150 মিলিলিটার দুধ বা ১০০ গ্রাম টক দই। সাথে চিয়া সিডস, ফ্লেক্স সিডস, সানফ্লাওয়ার সিডস নিতে পারেন।
সকাল সাড়ে দশটা এগারোটা নাগাদ ফল খান।
দুপুর দেড়টার মধ্যে লাঞ্চ খান: ব্রাউন চালের ভাতের সঙ্গে ডাল, সবজি , মাছ /চিকেন /পনির / সয়াবিন খান সাথে থাকা উচিত ৭৫ গ্রাম টক দই এবং স্যালাড। সঙ্গে রাখুন পনির। বিকেল পাঁচটা নাগাদ নিন রোস্টেড মাখানা , সাথে এক কাপ গ্রিন টি চিনি ছাড়া। ডিনার সেরে নিন রাত ৮ টার মধ্যে: চিকেন স্যুপ/ভেজিটেবল /মাশরুম স্যুপ খান রাতে।

পুজোর আগে এই একমাস আপনার নিজের যত্ন নিন। প্রতিদিন নিয়ম করে ত্বকের যত্ন নিন। কয়েকটি সাধারণ নিয়ম মেনে চললেই হবে।খুব সাধারণ সিটিএম পদ্ধতি ব্যবহার করুন, আসলে এই সিটিএম পদ্ধতির সম্পূর্ণ কথা হল ক্লিনজিং-টোনিং-ময়শ্চারাইজিং (Cleansing Toning Moisturizing) । ত্বকের যত্নে বা রূপচর্চায় একদম প্রাথমিক বিষয়ই হল এটি। আপনি যদি নিয়মিত এই বিষয়টি মেনে চলতে পারেন, তাহলেই আপনি পেতে পারেন একটি নিখুঁত দাগ ছোপহীন ত্বক। তবে এই রুটিন দিনে অন্তত দুবার মেনে চলতে হবে আপনাকে।
উর্দি পুরাণ
বেদ বন্দ্যোপাধ্যায়
- মা বাবার'কি হয়েছে বলোতো ? সারাটা দিন তিনতলার গোলঘরে জানলার দিকে তাকিয়ে কি অতো ভাবে ?
- আমি তো তাই ভাবছি শেষ পর্যন্ত মাথাটাই না খারাপ হয়ে যায়।
- ধুত, কি যে বলো মা, জাদরেল পুলিশ অফিসার কিনা মেন্টাল পেশেন্ট ? একসময় বাবার ভয়েতে এক ঘাটে বাঘে-গরুতে জল খেয়েছে।
- তবুও, বাবা তো বাড়ি বসার লোক নয়। স্টেশন পাড়ায় অতবড় সূর্য সেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, পেনশন এ্যাসোসিয়েশনের কনভেনার। ভাই বোন রিলেটিভ সব বাদ দিয়ে শেষে কিনা গোলঘরে মৌনব্রত। তুমি একটু খোঁজ নাও মা কিছুতো একটা হয়েছে ।
- ভালোইতো ছিল বিতান। তুই মিশন স্কুলে ট্রান্সফার হয়ে এলি ব্যাস, তোকে দেখার পর...
- মানে ? কি বলছো তুমি ? তিনবছর চেষ্টা করে নর্থবেঙ্গল থেকে এখানে এলাম, তার আগে মিশনে মিশনে কম কষ্ট করিনি, আর আজ যখন বাড়ি এলাম বাবার এই বিহেবিহার।
- সেটা তো আমিও মানুষটাকে বুঝিয়েছি। রামকৃষ্ণ মিশনে স্কলারশীপ পেয়ে তোমার ছেলে যে সম্মান আমাদের ফিরিয়ে দিলো, তার কপালে কি এই ছিল ? বিতান তুই রাগ করিস না।
- রাগে নয় মা । আমি ভাবি আমি বাড়ি এলাম, আর বাবা আমার থেকে দূরে চলে গেল। এভাবে আমি এখানে থাকতে পারবোনা মা, আমি আবার চলে যাব, আমি ট্রানস্ফার নিয়ে নেবো।
মা ছেলের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে - রাগ করিসনা বিতান, মানুষটা সারা জীবন চোর ধরে, ডাকাত ধরে, পুলিশের ডিউটি করে গেছে। নিজের সুখ ভাবেনি। আর আজ তুই মুখ ফেরালে সংসারটা ভেসে যাবে। আমি তোর বাবাকে বাঁচাতে পারবো না। বলতে বলতে জয়াদেবী আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মোছে।
দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর পুলিশে কর্মরত শিহরণ বসু, এই একবছর হল রিটায়ার্ড করেছেন। কাঁধে উজ্জ্বল থ্রিস্টার রেড গ্রীন ব্যাচ, বুকে রাজ্যপালের দেওয়া বীরসৈনিক মেডেল, ফেয়ারওয়েল এর দিন, শিহরণ বসুর উর্দিতে শোভা পেয়েছে, ব্যাটালিয়নে শুধু নয়, গুন্ডাদমন শাখায় এমনকি অপরাধজগতেও তাকে জাদরেল পুলিশ অফিসার বলে সমীহ করতো।
তারই একমাত্র ছেলে বিতান বসু রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক। মা জয়া বসু উচ্চশিক্ষিত হাউস ওয়াইফ। স্বামীর ব্যস্ত জীবনে ছেলেকে হীরের টুকরো করার প্রধান কারিগর।
এহেন সুন্দর সংসার শিহরণবাবুর হঠাৎ করে ছেলের মুখোমুখি না হওয়া, গোলঘরে নিজেকে বন্দী করে রাখা, সত্যিই অস্বাভাবিক। অথচ এইতো সেদিনের কথা, তিন চারটে ব্যাগ ঝুলিয়ে বুলেট হাকিয়ে হরিবাবুর মাছের বাজারে এসে শিহরণবাবু হাঁক দিয়েছে - এই বিপুল বড় দুটো ইলিশ বের কর। ভেজে ছেলের কাছে পাঠাবো। আমি ওদিকটা দেখি অন্য কি মাছ আছে ।
- দিচ্ছি স্যার শাঁখাফালি করে রাখছি।

ইলিশ অর্ডার দিয়ে শিহরণবাবু রতনের থেকে এককেজি সোনালী ট্যাংরা, ডাবুর দোকান থেকে কালো গরুর ঘি, নগেন্দ্র বস্ত্রালয় থেকে দুটো ছহাতি বসিরহাটের গামছা- দু ব্যাগ বাজার নিয়ে যখন বাড়ির সামনে বুলেট দাঁড় করায় , পাশে ডাক্তার বাড়ির পারুল বৌদি বলে -ঠাকুর পো, ছেলের সম্বন্ধ আসছে বুঝি ?
উত্তরে ব্যালকনি থেকে পুলিশ গিন্নি বলে - আর বোলোনা পারুলদি, ঠাকুরপো রাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরে ছেলের কাছে যাবে। তাই ব্যাগ ভর্তি বাজার।
বৌ এর কথায় শিহরনবাবু লজ্জা পায়। মুচকি হেসে ব্যাগ নিয়ে ভিতরে ঢোকে।
কিন্তু ছমাস পর সেই লোকটির এই পরিবর্তনে মা ছেলে অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছে।
ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজলো। বিতান ডাক দেয় - মা ব্যাগ দাও, টোটো এসে গেছে।
-যাই বিতান, বলে জলের বোতল ভরে ছেলের ব্যাগে দেয়। এক মুহূর্তে কি ভেবে আবার ছুটে মায়ের কাছে আসে। বলে, মা আজ দুপুরে নার্ভের ডাক্তার কিংশুক গুপ্ত বাবাকে দেখতে আসবে। বাবা না নামলে ডাক্তার বাবুকে বাবার ঘরে নিয়ে যেও। আমি ফোনে বাকি কথা শুনে নেবো।
- দেখ বাবা, মানুষটা যদি আগের মত হয়। ভগবান আমার কি পরীক্ষায় ফেললো, ভয় হচ্ছে ডাক্তার দিয়ে কি এই রোগ সারবে ?
- মানে ! একটা মানুষ খাচ্ছে দাচ্ছে, কথা বলছে, কাগজ পড়ছে, অথচ নিচে নামবে না, কারো সাথে কথা বলবে না - এটা কি ধরনের রোগ ? আমার উপর রাগ থাকলে বলুক, কালই চলে যাবো।
- তুই রাগ করছিস কেন বিতান, সে কি বলেছে ? তুই সাবধানে যা,
বিতান দৌড়ে টোটোতে ওঠে। জয়া দেবী মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলে দুগ্গা দুগ্গা। টোটো চলে যায়।
পর্ব -২
- কি ব্যাপার জগন্নাথ বাবু, বালিখাদান বন্ধ হয়ে গেছে, তবু মগরা থেকে বালি যাচ্ছে কিভাবে?
- স্যার দামোদরের বালি এখানে স্টোর হয়। তারপর ট্রাক লোড করে বাইরে যায়।
পাশ থেকে শিবু হোমগার্ড ফোড়ন কাটে - হ্যাঁ স্যার, মানে মগরার নামডাক আছে, তাই মগরা ব্র্যান্ড।
শিহরণ বাবু টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে একঢোক জল খেয়ে গলাটা খেকিয়ে বলে ওঠে, বুঝলাম কিন্তু এই ব্যাপারটা এখন থেকে কৌশিক তুমি দেখবে। আর জগন্নাথবাবু আপনি ট্রাফিক ব্যবস্থা দেখুন। কথা শেষ করে শিহরনবাবু সিগারেট ধরায়। জগন্নাথবাবু একটু আমতা আমতা করে বলে, কিন্তু আমি গতমাসে বলেছিলেন বালির ব্যাপারটা
- মালকড়ি তারমানে ভালই আছে? আরে বাবা বলেছিলাম তো, কিন্তু ষাট-সত্তর হাজারে জলগরম হবে না।
- এভাবে আমাকে সরালে সেটিং নষ্ট হবে স্যার।
- আপনি কি চান আপনার নামে হায়ার অথরিটিকে কমপ্লেন করি? কথা না শুনলে ঝাড়গ্রাম ট্রানস্ফার করিয়ে দেবো।
- না,না, স্যার আপনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন...
- থানার ইনচার্জ আমি না আপনি?
শিহরণ বাবুর ধমকে জগন্নাথবাবু কেঁচো হয়ে যান। কৌশিক গোঁফের তল দিয়ে ফিক করে হাসে, আই সি হরিসাধন বলে ওঠে - স্যার ওয়াগন থেকে কয়লাচোর দুজনকে ধরেছি , লক আপে আছে।
- গুড কিন্তু কয়লা কতোটা পেলি ?
- তা ত্রিশ চল্লিশ বস্তা হবে।
- বেশ করেছিস। কয়লার বস্তা রেখে ওদের ছেড়ে দে।
হঠাৎ ঘরে ঢোকে সেকেন্ড অফিসার তপন হোড়। চারিদিকে একবার তাকিয়ে শিহরণ বাবুর কাছে এসে বলে কনফিডেনসিয়াল স্যার।
- ওকে বলো।

- স্যার ফ্লাডের জন্য দু ট্রাক কম্বল এসেছে ব্লকে, সেগুলো ভানুর গোডাউনে নামিয়েছি.
- শিহরণবাবু এক মুহূর্ত ভেবে নেয়, ঘরের সবাইকে বাইরে যেতে ইশারা করে। তারপর তপনবাবুকে বলেন
- আজকে ওয়েট কারো, আমাদের চোখে ধুলো দেওয়া?
- ওকে স্যার।কিন্তু স্যার দু নম্বরি ব্যাপার কিছু আছে?
- একটাই প্ল্যান, কম্বলের সাইট থেকে আট ইঞ্চি কাটপিস বের করে নেবো।
- রাতে রফিজুল গাড়ি নিয়ে রেডি থাকবে। সকাল হওয়ার আগেই বর্ধমান কার্জনগেটে বিনোদের গোডাউনে পৌঁছে দেবে। ওখানে ঝন্টু শেখ থাকবে।কিন্তু তার আগেই আমাদের অভিযান শুরু করতে হবে.
- স্যার ঐ কাটপিস কি কাজে লাগবে?
এবার শিহরণবাবু মুচকি হেসে বলেন - এই বুদ্ধি নিয়ে পুলিশের চাকরী করছো ? আরে গাধা ওগুলো এ-ওয়ান কোয়ালিটির মাফলার।
মিনিমাম হান্ড্রেড রুপিস। মানে হানড্রেড ইন্টু টেনথাউজেন্ট - টোটাল কতো,
- তা প্রায় লাখ খানেক ।
- গুড, ম্যাথে ভালোই ছিলে। কিন্তু সেটা আজ হবে না।
- ওকে স্যার.
- এক নাইটে পকেট গরম.
- আপনি জিনিয়াস স্যার।
হঠাৎ শিহরণবাবুর মোবাইল বেজে ওঠে, হ্যালো, কে বলছেন ? কে ? ফেকু ? বসন্ত বাউড়ীর লোক? কি হয়েছে ? পশ্চিম পাড়ার রেল কলোনিতে মার্ডার হয়েছে ? ঠিক আছে তোরা পাড়ায় থাক। আর বসন্তকে বল আমায় ফোন করতে ।
ফোন রেখে শিহরনবাবু জগন্নাথ বাবুর দিকে তাকায়। বলে - তুমি এখুনি চারটে ফোর্স নিয়ে সেন পাড়া থেকে ফেকুকে তুলে আনো।

- কিন্তু স্যার, ফেকু তো বসন্ত বাউড়ীর লোক।
- আগে ছাগলকে খোয়ারে ঢোকাই, তারপর মালিককে দৌড় করাবো।
- স্যার, বসন্তের শত্রু গোকুল আপনার কাছে এলো বলে। ওর লোক মার্ডার হয়েছে, ছেড়ে দেবে।
- ব্যাটা আসুক এক পার্টিতে থেকে খুনোখুনি? কথায় আছে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে বত্রিশ ঘা, এমন দমদম দাওয়াই দেবো, আসুক থানায়। দক্ষিণা নেব গঙ্গাজলও ছেটাবো।
কথা শেষ হতেই ফোন বেজে ওঠে, হ্যালো, না থানাতেই আছি,কত টাকা? কত টাকা? ষোলো হাজার, ঠিক আছে। বিতানকে বলো কোচিং, এ ভর্তি হতে। টাকাটা ফ্যাক্টর না। কি,? তোমার মায়ের পেসমেকারের ব্যাপার? হয়ে যাবে, এতো টেনশন নিচ্ছ কেন? অপারেশন আর মেশিন নিয়ে লাখ দেড়েক যথেষ্ট। ওটা এ মাসেই জোগাড় করে নেবো। না-না দুপুরে রেড আছে। তোমরা খেয়ে নাও। কথা শেষ করে শিহরণ বাবু ফোন রাখে। জগন্নাথ বাবু গদগদ হয়ে বলে, স্যার শুনেছি আপনার ছেলে ব্রিলিয়ান্ট, বরাবর ফার্স্ট হয়ে এসেছে। আপনার মতোই বড় অফিসার হবে।
না না ও টিচার হতে চায়। মিশনের পড়াশুনো, খাঁটি রত্ন তৈরি হয়েছে। অবশ্য তার পিছনে খরচ তো কম হয়নি। সারা জীবনের ডানহাত বাঁহাতের সবটাই ছেলের পিছনে গেছে।
কথা শেষ করে শিহরণ বাবু সিগারেট ধরায়। লম্বা একটা সুখ টান দিয়ে বাতাসে ধোঁয়া ছাড়ে। মুড ভালো দেখে জগন্নাথবাবু আমতা আমতা করে বলে, স্যার উপপ্রধানের কেসটা আবার কোর্টে উঠেছে। এবারও কি ড্রপ দেবো ?
- ওরা কি সেটেলমেন্ট করেছে? কত দেবে?
- চল্লিশ বলছে। কথা শুনে শিহরণবাবু নড়ে বসে।
- মানে, ইম্পসিবল। কুড়ি লাখের ঘাবলা, ওদের বলো ফরর্টি সিক্সটি। নয়তো নেক্সট ডেটে তুমি কোটে হাজির দাও, কেস যা সাজানো আছে, তাতে পাঁচবছর ঘানি টানবেই। আর যদি মেনে নেয়, তুমি অ্যাবসেন্ট থাকবে, তাতে বেল পেয়ে যাবে। রফা হলে ফাইল চেঞ্জ করে দেবো, তুমি কেসটা নলেজে রেখো।
- ওকে স্যার, সেটেল করে দিচ্ছি।
- তাহলে নেক্সটমাসে ছেলের বাইক কিনতে পারবে। আর শখ আহ্লাদ পরের পয়সাতেই করতে হয়।
জগন্নাথের মুখে হাসি রেখা ফুটে ওঠে। শিহরণ বাবু ওর কাধে হাত রেখে বলে- যাও কাজে মন দাও, বি সিরিয়াস। আর টমকে গাড়ি বের করতে বলো, কারখানার বস্তিতে যেতে হবে। রোজ জুয়ার ঠেক বসছে।
- ওকে স্যার বলে দিচ্ছি।
পর্ব -৩
সকাল থেকেই মিশন বিদ্যামন্দিরে সাজো সাজো রব। আজ বিবেকানন্দের জন্মদিন। খুব ভোরে বারোশো স্টুডেন্ট নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিতান বাবু বর্ণাঢ্য প্রভাত ফেরি দিয়ে অনুষ্ঠান সূচনা করে। স্বামী বিবেকানন্দের নানারূপের কাটআউট, শিকাগো ধর্মসভা, বেলুড় মঠ, বিবেকানন্দ রক,- এসব ছবির পাশাপাশি গেরুয়া টুপি পাগড়ি সেইসঙ্গে স্বামীজীর লেখা কবিতা গান নিয়ে বিভিন্ন জনপদ পরিক্রমা করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। অপূর্ব শোভাযাত্রা দেখতে রাস্তার দুধারে মানুষের ঢল নামে। জানালায়, ছাদে,গাছের ডালে উপচে পরা ভিড়, এলাকার সকলে একবাক্যে স্বীকার করে, নতুন হেডমাস্টার আসার পর স্কুলের সবকিছু বদলে গেছে।
শোভাযাত্রা শেষে একদল ছাত্রছাত্রী ফল,মিষ্টি, শুকনো খাওয়ার নিয়ে হাসপাতালে রোগীদের বিতরণ করতে যায়। এদিকে শিক্ষক শিক্ষিকারা ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা ঘরে রিহার্সাল শুরু করে। আজ সকল ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকদের স্কুলেই খাওয়া দাওয়া। সবাই খুব খুশি। একদল ছাত্রকে নিয়ে পলাশ স্যার রান্না শুরু করে দিয়েছে। ছজন রাঁধুনী। মেনুতে ভাত, মাছ, আলুপটলের দোড়মা, বেগুনী, আর শেষ পাতে দরবেস।
অন্যান্য শিক্ষকেরা কমনরুমে গল্পে মশগুল। ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে সকালের শোভাযাত্রা নিমেষে, বিশ্বময় হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ হেডস্যার ঢোকেন। ধুতির উপর সাদা সিপন সুতোর কাজ করা গরদের পাঞ্জাবী ভিজে চুপচুপ।
- আপনারা যখন সকলে আছেন, তখন বিকালের অনুষ্ঠানের হোমওয়ার্ক সেরে ফেলি। তার আগে দীপেনবাবু বলুন, বিবেকানন্দের মূর্তি বসানোর কাজ কমপ্লিট ?
- হ্যাঁ বিতান, তুমি একবার দেখে আসতে পারো।
- না-না ঠিক আছে, আসলে শিক্ষামন্ত্রী আসছেন,সবটাই যেন সুন্দর হয়। পাশ থেকে ইতিহাসের প্রবীণ শিক্ষক অভয় স্যার বলেন, বিতান যাই বলো, শিল্পীর হাতের কাজ খুব সুন্দর আর নিখুঁত। বিশেষ করে চোখ দুটো, শান্ত নির্মল, তেজদীপ্ত, সেই সঙ্গে বৈরাগ্যের অপূর্ব প্রকাশ। একবার তাকালেই মন পবিত্র হয়ে যাবে।
সহ শিক্ষকরাও সকলে সাপোর্ট করে। বিতান স্বস্তি বোধ করে, মুখে এক নির্মল হাসি ফুটে ওঠে। বলে সব কিছুই সম্ভব হয়েছে আপনাদের এবং স্টুডেন্টদের জন্য। অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য প্রায় দু'মাস ধরে আপনাদের পরিশ্রম - কথা শেষ না হতেই বাংলার শিক্ষক সৌমজিৎ বাবু বলেন - তুমি যাই বলো বিতান, তোমার শিক্ষারত্ন পাওয়ার পরই আমাদের আগ্রহটা বেড়ে গেছে। স্কুলের নাম সকলের মুখে মুখে। আদর্শ শিক্ষক না হলে ভালো ছাত্রছাত্রী গড়ে উঠবে কি করে ? তুমি আমাদের গর্ব।
বিতান নিজের নাম শুনে লজ্জিত হয়। বিনয়ের সঙ্গে বলে - আমার পুরস্কারের ষোলআনা কৃতিত্বই আপনাদের, ছাত্র-ছাত্রীদের। পুরস্কারটা প্রধান শিক্ষক রুপে পেয়েছি। যেখানে স্কুলের অসামান্য সাফল্য বড় কথা। ব্যক্তি নয় স্কুলই বড়। অনুষ্ঠান শেষ করে কাল আমরা সকলে বসবো, আগামী একবছরের পঠন- পাঠন ডেভেলপমেন্ট রূপরেখা তৈরী করবো।

সবাই সম্মতি জানায়। জগদীশবাবু বলেন, আমিতো আর ছমাস আছি, তারপর রিটায়ার্ড করবো, শেষ বেলায় এসে তোমাকে প্রধান শিক্ষক রূপে পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত।
বিতান সস্নেহে বলে - স্বামীজীর কথাটা আজ বড় বেশি করে মনে পড়ছে জগদীশবাবু। তিনি বলেছিলেন - সমাজের অনুমোদন ও প্রশংসা পেলে নির্বোধ ব্যক্তিও বীরোচিত কাজ করতে পারে। কিন্তু কারো স্তুতি প্রশংসা না চেয়ে অথবা সেদিকে আদৌ দৃষ্টি না দিয়ে সর্বদা সৎকাজ করাই প্রকৃতপক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ স্বার্থত্যাগ।
অবশেষে পশ্চিমের আকাশ লাল থাকতে থাকতেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। একটু আগেই শিক্ষামন্ত্রী বিবেকানন্দের আবক্ষমূর্তির আবরণ উন্মোচন করে গেছেন। রাজনৈতিক ব্যস্ত মানুষ তবু কথার দাম রেখেছেন। সবুজ প্রশস্ত স্কুল মাঠ। তার উত্তর ও পশ্চিমদিকে সারিবদ্ধ গাছপালা। কৃষ্ণচূড়া, আকাশমণি, শিমুল, কদম, রাধাচূড়া যেন হাত ধরাধরী করে গুডবয়ের মতন দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ কোণে বিরাট স্টেজ তৈরী হয়েছে। সামনে গাদা চেন সাজানো, পিছনের ব্যাক স্ক্রিনে রজনীগন্ধার বিনুনী। মেরুন কাপড়ে ফুলের সমারোহ। রজনীগন্ধার থোকা লাগানো ঠিক মাঝখানে লন্ডনের আলফ্রেড এলিশ স্টুডিওতে ১৮৯৬ তে তোলা গেরুয়া বসন পড়া স্বামীজীর বিখ্যাত ছবি, হাত দুটো সামনে ভাজ করা। নিচে দুটো লাইন - দেশের একটি কুকুর পর্যন্ত যতক্ষণ অভুক্ত থাকবে, ততক্ষণ আমার ধর্ম হবে তাকে খাওয়ানো এবং তার সেবা করা। এই লাইনটা হেডস্যার সিলেক্ট করে দিয়েছে।
মাঠের চারিদিকে বিবেকানন্দের জীবনের নানা মুহূর্তের কাট আউট দাড় করানো হয়েছে, নিচে স্বামীজীর বাণী। স্টেজের সামনে হাজার খানের চেয়ার। সবই ভরে গেছে। অভিভাবকরা মাঠের চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। অতিথিরা একে একে বিবেকানন্দের ক্যানভাসে মালা চড়ায়। ভাব-গম্ভীর পরিবেশ, প্রথমেই স্কুল পরিচালন কমিটির সভাপতি ডা: সৌরেন সেন বিবেকানন্দের মহান আদর্শের কথা তুলে ধরেন। তিনি স্বামীজীর কোমল হৃদয়ের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে একটি গল্প শোনালেন । জনৈক প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ শুনে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ অঝোর নয়নে কাঁদছিন । পাশ থেকে একজন মন্তব্য করলেন, সন্ন্যাসীর পক্ষে শোকপ্রকাশ অনুচিত। তৎক্ষণাৎ স্বামীজী চোখের জল মুছে উত্তর দিলেন, সন্ন্যাসী হইয়াছি বলিয়া হৃদয়টা বিসর্জন দেব? সন্ন্যাসীর হৃদয় বরং বেশি কোমল হওয়া উচিত।
সাথে সাথে ছাত্রছাত্রীরা করতালি দিয়ে উঠলো, সৌরেন সেন এক মুহুর্ত থেকে আবার স্বামীজীর উক্তি শুরু করলেন। যে সন্ন্যাসে হৃদয় পাষাণ করতে উপদেশ দেয়, আমি সেই সন্ন্যাস গ্রহণ করি না।
উপস্থিত অতিথি সকল বাহ ! বাহ ! করে ওঠে। হঠাৎ বিতানের ফোন বেজে ওঠে, হ্যাঁ মা বলো, বাবা আমার অনুষ্ঠানে এসেছে? খুব ভালো, না- না তুমি টেনশন করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা সাবধানে বাড়ি ফিরো। আমার যেতে রাত হবে। শোনো মা, আমি আর মোবাইল ধরতে পারবোনা। রাখছি।
একে একে নাচ গান পুরস্কার বিতরন শেষ করে ঘোষক অবনীবাবু বলেন - সম্প্রতি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিতান বসু রাজ্য সরকারের 'শিক্ষারত্ন' সম্মানে ভূষিত হয়েছেন, সবার প্রিয় হেডস্যারের জন্য সমগ্র স্কুল আজ গর্বিত। স্বামীজীর এই জন্মদিনে বিতানবাবুকে কিছু বলার জন্য মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি ।
বিতান মোবাইল সাইলেন্ট করে লাউড স্পিকারের সামনে আসে, সামনে মাঠভর্তি ছাত্রছাত্রীদের নির্মল সুন্দর কচিকাঁচা মুখ, দুদিকে সারিবদ্ধ অভিভাবক, দূরে সবুজ গাছের ধ্যান মগ্ন রূপ আর চারিদিকে নানারূপে বিবেকানন্দের কাটাআউট দেখে মনের গভীরে একটাই জিজ্ঞাসা, মাত্র উনচল্লিশের এক যুবক বিশ্ববাসীকে যে শিক্ষা দিয়েছিলেন, তিনিই প্রকৃত হেডমাস্টার। তাঁর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বিতান শুরু করে - আমার পিছনে এক মহাসন্ন্যাসী আর সামনে অসংখ্য বিলে যারা কেউ শান্ত, কেউ দুরন্ত তাতে কি? বিবেকানন্দও ঠিক তোমাদের মতোই ছিলেন। বরং একটু বেশি দুরন্ত। তাইতো বিলের মা বলেছিলেন, চেয়েছিলাম শিবকে, পেলাম ভূতকে।
উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা হো-হো করে হেসে ওঠে। মজা পায়। বিতান দুহাত তুলে শান্ত হতে বলে। বিনম্রগলায় আবার বলা শুরু করে - শিক্ষা মানুষকে মনুষ্যত্বের রূপ দেয়। ঈশ্বর আমাদের শরীর দিয়েছেন। বাকি সবাটাই হল জ্ঞান উপলব্ধি যা শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত। তাই তো বিবেকানন্দ বলেছেন - তোমরা তুচ্ছ নও; দুর্বল নও, তোমরা অমৃতের সন্তান, তোমরা আনন্দ শক্তির অধিকারী।
উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবক, শিক্ষক সকলেই চুপ করে শোনে। বিতানের ফর্সা গোল মুখমন্ডল, ছোট করে কাটা চুল, দোহারা চেহারা সেই সঙ্গে দীপ্ত কণ্ঠে- সকলেই যেন হেডস্যারের মধ্যে স্বামীজীর আদর্শকে খুঁজে পায়। মাত্র একবছর এসেই স্কুলের পরিবেশ পঠনপাঠন পাল্টে দিয়েছে। চারদিকে ফুলের গাছ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্কুল, ডিসিপ্লিন, রোজ মেরিটেশন, শরীরচর্চা, এক কথায় তার আদর্শ যেন স্কুলের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীদের শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। স্কুল টাইমের পর দুর্বল স্টুডেন্টদের স্পেশাল ক্লাস নেওয়া, খেলাধুলা, গানবাজনা, নাটক, আবৃত্তি, অভিনয় আলাদা গ্রুপ করে তাদের উৎসাহিত করা এমনকি সন্ধ্যের পর দুঘন্টা অভাব অভিযোগ শোনা - এসব কর্মকান্ড দেখে এলাকার লোকজন এক বাক্যে স্বীকার করে, বাবা দারোগা হলেও ছেলেকে আদর্শবান রূপে গড়ে তুলেছেন ।

পর্ব -৪
রাত্রি দশটা কুড়ি, অনুষ্ঠান অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে। উপস্থিত সকলে বাড়ি চলে গেছে। কমনরুমে বিতান জগন্নাথ বাবু আর ঘন্টা বাজায় সুনীল কথা বলছে। জগন্নাথবাবু তাহলে আপনি রাতে থাকছেন ?
হ্যা বিতান এ ছাড়া উপায় কি ? পায়রাডাঙ্গার শেষ খেয়া দশটায়, তারপর বাস। সুতরাং বাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয়।
ওকে, তাহলে সুশীল, তুমি ল্যাবরেটরী রুমে স্যারের শোয়ার ব্যবস্থা করে দাও ।
সুশীল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
জগন্নাথবাবু বলেন, তাহলে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? চট করে যা। তবু সুশীল দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু একটা বিতানকে বলতে যাবে। বিতান বলে ওঠে - কি, সুশীল কিছু বলবে ?
-রাত হচ্ছে স্যার, মেয়ের কলেজে ভর্তির ব্যাপারটা...
ওহো, কালতো টাকা লাগবে। কত যেন?
-ছ হাজার স্যার ।
- ঠিক আছে, তুমি কাল সকাল আটটায় আমার বাড়ি চলে এসো । আমি না থাকলেও আমার মায়ের কাছে টাকা রাখা থাকবে।
- ঠিক আছে স্যার। ধান উঠলেই - সুশীলের কথা শেষ হয় না। বিতান বলে ওঠে, শোধ কেন ? ওটা তো আমি বনানীকে গিফট করলাম । কতো ভালো রেজাল্ট করেছে। তিনটেতে লেটার মার্কস। আমাদের স্কুলের গর্ব। ওর জন্য এইটুকু করতে পারবো না?
কথা শুনে সুশীল আনন্দে চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত চলে যায়। জগন্নাথবাবু টিপ্পুনি দেয়, বিতান তুমি কিন্তু এইসব শ্রেণীর লোকদের চেনো না। এরা তোমার টাকা কোনদিন শোধ দেবে না।
- সেতো আমি আশা করিনি। আর আমার গচ্ছিত টাকা যদি সমাজের কাজে লাগে, তাতে তো সমাজের মঙ্গল।
- এবার জগন্নাথবাবু বেশ কর্কস স্বরে বললেন, দেখো বিতান অর্থ সাহায্য করে কোনদিন সমাজের উপকার হয় না,তুমি বরং
- আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি কিন্তু যে দেশে ষাট শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে সেখানে অর্থনৈতিক সহযোগিতা একটা বড় দায়। আর টাকাতো পেট চালানোর জন্য দিচ্ছি না শিক্ষার জন্য দিচ্ছি।
- সেকি তুমি দেখতে গেছো ?
- কেন দেখবোনা, ওতো ফর্ম দেখিয়েছে। আর কালনা কলেজের ওয়েবসাইট আমিই দিয়েছি।
জগন্নাথ বাবু হেরে যাওয়া বেড়ালের মতো অন্য দিকে তাকিয়ে ফুসতে থাকে। বলে তোমার টাকা তুমি যা পারো করো। দানছত্র বেশি ভালো না। বিতান আলতো হেসে বলে, জগন্নাথবাবু বিবেকানন্দই বলেছেন - যারা ভালো হতে কিংবা ভালো কাজ করতে চেষ্টা করছে, তাদের সাহায্য কর। জগতের ঘৃণা ও উপহারের দিকে আদৌ লক্ষ্য না রেখে অকুতোভয়ে নিজ কর্তব্য করে যেতে হবে।
হঠাৎ বিতানের খেয়াল হয় মোবাইলটা সাইলেন্ট হয়ে আছে। নরমালে আনে। কিন্তু বাড়ি থেকে আটটা মিসকল, কি ব্যাপার। বুকের ভিতরটা কু ডাক দেয়, বাবা মা কারো শরীর খারাপ হলো? পরক্ষণেই ভাবে না-না রাত হয়েছে আমাকে পায়নি বলে মা বার বার ট্রাই করেছে। জগন্নাথ বাবু বলে, তাহলে বিতান আমি ল্যাবে যাই, তুমি বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও।
বিতান বারান্দায় আসে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাড়িতে ফোন করে। এনগেজড পায়। বাইক বের করে স্টার্ট দেয়। মাত্র দশ মিনিটের পথ। হুস করে চলে আসে। গেটে ঢুকতেই দেখে উঠোনে জটলা, বিপুল কাকা, মধুজ্যাঠা, গুপি সকলে বিতানকে দেখে কাছে আছে। বাইকের শব্দ পেয়ে মা ঘর থেকে ছুটে এসে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তোর বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় আবার চলে গেলো। রাস্তায় কি বিপদ ঘটাবে।
- ঠিক আছে কান্নার কি আছে ? আশে পাশে কোথায় গেছে, চলে আসবে।
- দিব্যি সন্ধ্যেবেলার স্কুলের অনুষ্ঠান দেখছিল। নাচ-গান শুনলো। তোর বক্তৃতা শুরু হতে উঠে পাশে দাঁড়াল। আমি ভাবলাম অতক্ষণ বসে তাই হয়তো দাঁড়িয়েছে। আমি চেয়ারে বসেছিলাম ।
- তারপর। তুমি কখন বুঝতে পারলে ? বিতান জিজ্ঞেস করে।
- তোর কথা শেষ হতেই আমি বেরিয়ে খোঁজাখুঁজি করি। না পেয়ে বাড়ি আসি।
- বিতান ব্যস্ত হয়ে জানতে চায়, বাবা কি বাড়ি এসেছিল?
- হ্যা মনে হয়। কারণ সদর খোলা, গোলঘরে বাবার আলমারিও লন্ডভন্ড। আলনার জামা প্যান্ট এলোমেলো।
পাশ থেকে মধুজ্যাঠা বলে - মাথা খারাপ হলে যা হয়। গুপী,সায় দেয়। আগেই ডাক্তার দেখানো উচিত ছিল ।
বিতান কিছু না বলে মাকে নিয়ে সোজা ঘরে চলে যায়। যেতে যেতে বলে, জ্যাঠা তোমরা একটু দাঁড়াও, আমি আসছি। মা ছেলেতে তিনতলায় যায়। গোলঘরটা একসময় দাদু দিদুন
থাকতো।
দিদুন মারা যাওয়ার পর দাদু একাই থাকতো। কিছু বইপত্র, রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দের বাঁধানো ফটো। আর দিদুনের শখের মেহগুণী কাঠের ড্রেসিং টেবিল। এই ছিল গোল ঘরের আসবা. ব , আর ছিল দাদুর শিকার করা দুটো হরিণের শিং।
বিতান ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে বাবা ঘরে এসেছিল এবং জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করেছে। মা ধপ করে খাটে বসে। বিতান টেবিল, আলমারি আলনা ভাল করে দেখে। কিছু বুঝে উঠতে পারে না। জিজ্ঞাসা করে - মা,বাবার আটপৌরে জামা কাপড় ঠিক আছে?
- হ্যাঁ ঐ তো আলনায়।
- এবার দেখো, আলমারিতে তোলা জামাকাপড় ঠিক ঠাক?
- মা উঠে দেখে বলে, এইতো ছটা সার্টের চারটে আছে। প্যান্ট পাঁচ-ছয়টা ছিল, দুটো আছে, গেঞ্জি গুলো নেই।
- তার মানে বাবা জামাকাপড় নিয়ে কোথাও - কথা শেষ হয় না মা চেঁচিয়ে ওঠে -ও বিতান টুরিস্ট ব্যাগটা সকালে বাবা উপরে আনে, দুপুরে আমি এই খাটের কোনায় দেখেছি এখন নেই।
বিতান খোলা জানালায় চোখ রাখে। বাইরে চারদিক অন্ধকার। দূরে ডাক্তারবাবুদের আমবাগানে বিশাল গাছগুলো দৈত্যাকারে দাঁড়িয়ে। অনুদের বাড়ির কুপির আলো তির তির করে কাঁপছে। রাত জেগে মা বেটিতে বিড়ি বাঁধে। নিতাই গয়লার গাইটা সমানে ডাকছে। বিতানের এই প্রথম মনের গভীরে একটা চাপা ভয় উঁকি মারে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শিশুর মতো কেঁদে ওঠে। শুধু অশ্রুজল বাইরে আসে না। চোখ ভেজে না। ভেজা বসনের মতো ধীরে ধীরে বাষ্পায়িত হয়। হঠাৎ একটা ভাঁজ করা কাগজ দিয়ে বলে, দেখতো বিতান বালিশের নিচে থেকে পেলাম। বিতান ভাঁজ খোলে। বাবারই হাতের লেখা। তবে লাইন বেঁকে গেছে, মা সুধায় বাবার চিঠি জোরে পড়
- শ্রীমান বিতান, আজ স্কুল মাঠে তোমার বক্তৃতা শোনার পর নিজের প্রতি ঘৃনায় স্থির থাকতে পারলাম না। তোমার সততা, শিক্ষার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য এবং শিক্ষারত্ন সম্মান গর্বিত পিতা হিসেবে আমিই ষোলআনা অংশীদার। কিন্তু পরক্ষণেই যখন মনে পড়ল আমার অসৎ পথের উপার্জিত অর্থে তোমার এই গৌরবময় বর্তমান, তখন লজ্জায় ঘৃণায় আমি তোমার সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম না। তাইতো তুমি নর্থ বেঙ্গল থেকে ট্রান্সফার আসার এখানে আসার পরে আমি গোল ঘরে গৃহবন্দি হয়ে গেলাম। জীবনের সব বিলাসিতার পর নিজের মিথ্যে মর্যাদা সম্মান নিয়ে যখনই তোমার সামনে দাড়িয়েছি তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে গেছে। - বিতান থামে

পাশে দাঁড়ানো মা ডুকরে কাঁদছে। বিতান চিঠি পড়ে চলে, আজ বুঝতে পারি, কালো টাকার মিথ্যে বেসাতি করে কোনদিন প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। আর যখন সেই কথাটা মাইকে তুমি সবাইকে বলছিলে, তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম এক মুহূর্তে আর এখানে থাকা যাবে না। প্রথমে ভেবেছিলাম আত্মহত্যা করবো, কিন্তু তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত বদল করলাম। আমি চলে যাচ্ছি বিতান, মাকে দেখো। আমি বেঁচেই থাকবো. কিন্তু আমার খোঁজ কোরো না।
বিতান ধপ করে বসে পরে । মা চোখের জল মুছে বিতানের মাথায় হাত বোলায়। বলে, শরীর খারাপ লাগছে ?
বলেই মা অঝোরে কাঁদতে থাকে। বিতান বাকরুদ্ধ হয়ে যুগনায়কের মুখটা একবার দেখে, বুকের গভীর থেকে জগদ্দল পাথরটা এক নিমেষে সরিয়ে জিজ্ঞেস করে - হে সন্ন্যাসীী, তোমার আদর্শ কেন মায়ের চোখে জল এনে দিল ?
Comments