দুর্গাপুজোর আগেই কেন হয় বিশ্বকর্মা পুজো? অরন্ধনই বা কেন?.. দেশীয় শাকসবজির পুষ্টিগুণ.. নিরামিষে বাজিমাত.. রবিবারের গল্প: চুয়া-চন্দন..
- রোজকার অনন্যা
- Sep 14
- 11 min read
দুর্গাপুজোর আগে কেন হয় বিশ্বকর্মা পূজা? এর সঙ্গে অরন্ধন ও মনসা পূজোর সম্পর্ক কী?

বাংলার ক্যালেণ্ডার ঋতুচক্রের সঙ্গে এক আশ্চর্যভাবে যুক্ত। বৈশাখ থেকে ভাদ্র প্রতিটি মাসের আলাদা আলাদা তাৎপর্য আছে, আর প্রতিটি ঋতুরই উৎসব। ভাদ্র মাসের শেষে যখন বর্ষা ফুরিয়ে শরৎ এসে পড়ে, তখন আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়, পুকুরে ফুটে ওঠে শাপলা-শালুক, গাছতলায় ছড়িয়ে যায় শিউলি, মাঠে দোলে কাশফুল। বাংলার উৎসব জীবনে এই সময়টার আলাদা গুরুত্ব কারণ ভাদ্র সংক্রান্তিতেই পালিত হয় বিশ্বকর্মা পূজা, মনসাপূজা ও অরন্ধনের রান্নাপূজা। আর এই দিন থেকেই শুরু হয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা। হিন্দু পুরাণে বিশ্বকর্মা দেবতাকে বলা হয় দেবশিল্পী বা দেবতাদের স্থপতি। ইন্দ্রপুরী, স্বর্গলোক থেকে শুরু করে দ্বারকা পর্যন্ত সবই তাঁর সৃষ্টির ফল। এমনকি দেবতাদের ত্রিশূল, চক্র, বজ্র সব অস্ত্রশস্ত্র তাঁরই হাতে গড়া। তাই কল-কারখানা, অফিস, ছাপাখানা, গ্যারাজ সবখানেই এই দিন যন্ত্রপাতির আরাধনা হয়। কৃষিনির্ভর বাংলায় ভাদ্র সংক্রান্তি মানেই নতুন ফসল ওঠার আনন্দ, নৌযাত্রা শুরু, নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহার এই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে বিশ্বকর্মা। যন্ত্রের পূজা মানেই দুর্ঘটনামুক্ত, অক্ষয় ও সফল কাজের প্রার্থনা।

বিশ্বকর্মা পূজার দিন স্থির থাকে ইংরেজি ক্যালেণ্ডারের ১৭ই সেপ্টেম্বর বা ভাদ্র সংক্রান্তি। অন্য দেবদেবীর পূজার মতো তিথি অনুযায়ী নয়, এটি নির্ধারিত হয় সূর্যের গতি অনুযায়ী। যখন সূর্য সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে, তখনই হয় ভাদ্র সংক্রান্তি। জ্যোতিষ মতে এ সময় দেবতারা নিদ্রিত অবস্থা থেকে জাগ্রত হন, অর্থাৎ সুপর্বার সূচনা। ফলে বিশ্বকর্মার জন্মদিন, বিশ্বকর্মা জয়ন্তী সবই মিলে যায় এই সময়ে। বিশ্বকর্মা পূজার দিনেই বাংলার দক্ষিণাংশে পালিত হয় রান্নাপূজা বা অরন্ধন। কথায় আছে “ভাদ্রে রান্না, আশ্বিনে পান্না।” অর্থাৎ ভাদ্র সংক্রান্তিতে রান্না হয়, আর আশ্বিনের প্রথম দিনে খাওয়া হয় সেই পান্তা ভাত। বর্ষার শেষে ঋতু পরিবর্তনের সময় শরীরের জন্য ঠান্ডা খাবারের একটি প্রতিরোধক গুণ আছে। সেই সঙ্গে ভাদ্র মাসে ওঠা আউস ধান, ইলিশ মাছ আর মরশুমি শাকসবজি দিয়ে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে এলাহি ভোজের আয়োজন হয়।

অরন্ধন আসলে কৃষি-উৎসবও বটে। কৃষিজীবীরা দেবতাদের কৃতজ্ঞতা জানান আউস ধানের ফসল ওঠার আনন্দে। রান্না হয় ভাত, ডাল, মাছ, কচুশাক, কুমড়ো ঘন্ট, নারকেল দিয়ে তরকারি, ইলিশ, চিংড়ি, পিঠেপুলি, পায়েস ইত্যাদি। রান্নাভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয় দেবীর উদ্দেশে, তারপর ঠান্ডা ভাত ও পান্তা খাওয়া হয় আত্মীয়-প্রতিবেশী মিলে। এ যেন এক সামাজিক মিলনোৎসব। ভাদ্র সংক্রান্তিতে অরন্ধনের পাশাপাশি হয় মনসা পূজা। শ্রাবণ মাস জুড়ে নদীনালা-খালবিলে সাপের প্রাদুর্ভাব থাকে। কৃষক-গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রা ছিল সাপখোপের সঙ্গে মিশে। তাই সর্পদংশন থেকে মুক্তির আশায় ভাদ্র সংক্রান্তিতে ঘরে ঘরে মনসা দেবীর আরাধনা করা হয়। মনসার পুজো মূলত লৌকিক বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। রান্নাঘর ধুয়ে-মুছে নতুন উনুনে ভাত-ডাল-তরকারি রান্না করে দেবীকে নিবেদন করা হয়। ঘরে মনসার ডাল পুঁতে রাখা হয়, সেখানে শাপলার মালা পরানো হয়। নৈবেদ্যে থাকে ভাত, শাক, মাছ, পিঠে, পায়েস সবই নতুন ফসল আর মরশুমি খাদ্যের প্রতীক। এই পুজোতে ধূপধুনো নিষিদ্ধ, বরং থাকে জল, দুধ, কলা ও পান্তাভাত। মনসাকে তুষ্ট রাখলে সাপের উপদ্রব কমে বলে বিশ্বাস।

দুর্গোৎসব আসলে শিল্প ও সৃষ্টির উৎসব প্রতিমা গড়া, প্যান্ডেল নির্মাণ, আলোর সজ্জা, যন্ত্রপাতির ব্যবহার সবকিছুই কারিগরদের হাতে গড়া শিল্প। তার আগে বিশ্বকর্মার পূজা আসলে সেসব শ্রম ও শিল্পের আশীর্বাদ প্রার্থনা। একই দিনে অরন্ধন ও মনসা পূজার মতো গ্রামীণ কৃষি-উৎসব যোগ হয় সৃষ্টির সঙ্গে। ফলে দুর্গাপুজোর আগে এই পূজাগুলি যেন সমাজের সব স্তরের মানুষকে একসূত্রে গেঁথে দেয় কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, কারিগর, শিল্পী সবারই। দুর্গাপুজোর আগে বিশ্বকর্মা পূজা, অরন্ধন ও মনসা পূজা আসলে বাংলার ঋতুচক্র, কৃষিজীবন ও শিল্পচর্চার সম্মিলিত প্রতিফলন। বিশ্বকর্মা পূজায় যন্ত্রের আরাধনা, অরন্ধনে ফসল ও খাদ্যের উৎসব, আর মনসা পূজায় জীবনের সুরক্ষা ও বিশ্বাস সব মিলে এক অনন্য প্রস্তুতি। তাই বলা যায়, এই পূজাগুলি একসঙ্গে মিলেই দুর্গোৎসবের আগমনী ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়, বাঙালির জীবনে সৃষ্টির, কৃতজ্ঞতার ও আনন্দের এক উৎসব-ধারার সূচনা করে।

বিভিন্ন সবজির বীজ ও তৈল বীজের পুষ্টিগুণ এবং রান্নায় ব্যবহার
সুদেষ্ণা ঘোষ
পুষ্টির কথা উঠলেই আমাদের চোখ যায় ফলমূল, শাকসবজি বা মাছ-মাংসের দিকে। কিন্তু আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় এমন কিছু উপাদান আছে, যেগুলো আকারে ক্ষুদ্র হলেও পুষ্টির দিক থেকে দানবের মতো! এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিভিন্ন সবজির বীজ এবং তৈল বীজ। বীজ হচ্ছে একটি উদ্ভিদের প্রাণ, তাই এতে থাকে কেন্দ্রীভূত পুষ্টিগুণ। এই প্রবন্ধে আমরা জানবো এই বীজগুলোর পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং রান্নায় ব্যবহার নিয়ে বিশদ আলোচনা।

সবজির বীজ:
১. মেথি বীজ
পুষ্টিগুণ:
মেথি বীজে থাকে প্রচুর আঁশ, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, কপার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
রান্নায় ব্যবহার:
মেথি বীজ বেগুন ভাজা, ডাল বা শাক রান্নার আগে তেলে ফোড়ন হিসেবে ব্যবহার হয়। কিছু ক্ষেত্রে শুকিয়ে গুঁড়ো করেও মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য দারুণ উপকারী। এছাড়া হজমশক্তি বাড়াতে এবং কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে।
২. ধনে বীজ
পুষ্টিগুণ:
ভিটামিন সি, কে, ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবে কাজ করে।

রান্নায় ব্যবহার:
রোস্ট করে গুঁড়ো করে মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তরকারি, মাংস, এমনকি আচারেও এর ব্যবহার অনন্য।
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
গ্যাস্ট্রিক, কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে এবং মেনস্ট্রুয়াল পেইন উপশমে উপকারী।
৩. কালো জিরা
পুষ্টিগুণ:
ব্ল্যাক সিড বা কালো জিরা হলো একটি সুপারফুড। এতে থাকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, আয়রন, জিঙ্ক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ইত্যাদি।
রান্নায় ব্যবহার:
নানান রকম ভর্তা, আলু ভাজি বা ডাল রান্নার শুরুতে ফোড়ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেকেই পিঠা বা রুটি তৈরির ময়দায় মিশিয়ে থাকেন।

স্বাস্থ্য উপকারিতা:
ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে, হাঁপানি ও ঠান্ডা প্রতিরোধে কাজ করে।
৪. কুমড়োর বীজ
পুষ্টিগুণ:
জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম, প্রোটিন ও ভালো চর্বি সমৃদ্ধ। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎস।
রান্নায় ব্যবহার:
সালাদ, স্মুদি বা দইয়ের সাথে টপিং হিসেবে খাওয়া যায়। শুকিয়ে হালকা ভেজে নাস্তা হিসেবেও উপযোগী।
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
মূত্রনালীর সমস্যা, অনিদ্রা এবং প্রোস্টেট স্বাস্থ্য রক্ষায় উপকারী।
৫. লাউ বীজ
পুষ্টিগুণ:
ফাইবার, ম্যাগনেশিয়াম ও প্রোটিন থাকে। ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিডও বিদ্যমান।
রান্নায় ব্যবহার:
পিঠা তৈরিতে পুর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কেউ কেউ লাউ শুকিয়ে তার বীজ বেছে ভেজে খেয়ে থাকেন।
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
হজমে সাহায্য করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে।

তৈল বীজ: তেলের উৎস, পুষ্টির আধার
১. তিল বীজ
পুষ্টিগুণ:
তিল বীজে থাকে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাট। এছাড়া এটি শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
রান্নায় ব্যবহার:
তিল দিয়ে তৈরি হয় তিলের নাড়ু, পিঠা, বার। কিছু ক্ষেত্রে ভর্তা বা তরকারিতে মিশিয়ে খাওয়া হয়।
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখে, হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
২. সরিষা বীজ
পুষ্টিগুণ:
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, সেলেনিয়াম, এবং ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ।

রান্নায় ব্যবহার:
মাছ, শাক, ডিম ও তরকারিতে ফোড়ন হিসেবে ব্যবহার হয়। এছাড়া সরষে বাটা দিয়ে রান্না করা অনেক বাঙালি খাবার বিশ্ববিখ্যাত।
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
অ্যাসথমা ও বাতের ব্যথা উপশমে সাহায্য করে। হজমে সাহায্য করে ও মেটাবলিজম বাড়ায়।
৩. সূর্যমুখী বীজ
পুষ্টিগুণ:
ভিটামিন ই, বি-কমপ্লেক্স, সেলেনিয়াম ও কপার সমৃদ্ধ। চর্বির পরিমাণ কম এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর।
রান্নায় ব্যবহার:
স্ন্যাক্স হিসেবে, সালাদে, ওটমিল বা গ্রানোলা বার-এ ব্যবহার হয়।
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়, চুলের স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং কোলেস্টেরল কমায়।
৪. ফ্ল্যাক্স সিড
পুষ্টিগুণ:
ওমেগা-৩, লিগন্যানস, প্রোটিন ও আঁশে ভরপুর।
রান্নায় ব্যবহার:
পাউরুটি, বিস্কুট বা স্মুদি তে যোগ করা যায়। কেউ কেউ রুটি বানানোর ময়দায় ফ্ল্যাক্স সিড গুঁড়ো মিশিয়ে থাকেন।
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
হার্টের জন্য ভালো, কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় এবং হরমোন ব্যালান্সে সাহায্য করে।
৫. চিনাবাদাম
পুষ্টিগুণ:
প্রোটিন, মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট, ভিটামিন বি ৩ ও ফলেটে ভরপুর।
রান্নায় ব্যবহার:
চাটনি, সবজি, বা মুড়ি মাখায় চিনাবাদাম যোগ করা হয়। অনেকেই বাদাম ভাজা বা মিষ্টিতে ব্যবহার করেন।
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ব্রেন ফাংশন ভালো রাখে।

স্মার্ট বীজ ব্যবহার: কিছু পরামর্শ
বীজ ভিজিয়ে খাওয়া: অনেকে ধনে বা মেথি ভিজিয়ে খেয়ে থাকেন। এতে তা সহজে হজম হয় এবং উপকারিতা আরও বাড়ে।
বীজের গুঁড়ো ব্যবহার: ফ্ল্যাক্স সিড বা সূর্যমুখী বীজ শুকিয়ে গুঁড়ো করে সংরক্ষণ করুন। প্রতিদিন অল্প পরিমাণ স্মুদি বা রুটিতে মেশাতে পারেন।
কাঁচা না পাকা: কিছু বীজ (যেমন: সূর্যমুখী, তিল, কুমড়ো) হালকা ভেজে খাওয়া নিরাপদ এবং সুস্বাদু। তবে অতিরিক্ত ভাজা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে।
সংরক্ষণ পদ্ধতি: বীজ ঠান্ডা ও শুকনো স্থানে বায়ুরোধী পাত্রে রেখে দিন। সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
বীজ কখনোই ছোট নয় না আকারে, না গুণে। প্রতিটি বীজ আমাদের খাদ্যতালিকায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে, যদি আমরা সঠিকভাবে বুঝে তা ব্যবহার করি। পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ এসব বীজ শুধু আমাদের শরীরকেই সুস্থ রাখে না, আমাদের রান্নাকেও করে তোলে আরও বৈচিত্র্যময় ও সুস্বাদু। তাই আজ থেকেই নিজের খাবারের তালিকায় যুক্ত করুন এই অনন্য বীজসমূহ স্বাস্থ্যের পথ ধরুক স্বাদের রাস্তায়।

নিরামিষে বাজিমাত
বাঙালি রান্নাঘর মানেই মাছ-মাংসের বাহার এই ধারণা এখনও অনেকের মনেই রয়ে গেছে। কিন্তু সত্যিটা হলো, নিরামিষ পদ দিয়েও বাংলার রসনা দুনিয়ায় বাজিমাত করা যায়। আলু-পোস্ত থেকে শুরু করে শুক্তো, চচ্চড়ি থেকে ধোঁকায় ডালনা প্রতিটি পদই স্বাদের একেকটা ভিন্ন দিগন্ত খুলে দেয়। বাঙালির ভাত-ডালের সাথে এইসব নিরামিষ পদ কেবলই পরিপূরক নয়, বরং আলাদা গৌরবের অধিকারী। আজকের স্বাস্থ্য সচেতন প্রজন্ম যেমন নিরামিষ খাবারে ভরসা রাখছে, তেমনই পুরনো দিনের ঐতিহ্যবাহী রেসিপিগুলো নতুনভাবে ফিরে আসছে আধুনিক রান্নাঘরে। স্বাদের সাথে পুষ্টি, আর সাদামাটা উপকরণে অসাধারণ কুলিনারি ম্যাজিক তৈরি করা এই হলো বাঙালি নিরামিষ রান্নার আসল শক্তি। এই সংগ্রহে থাকবে এমন সব পদ, যেগুলো আপনার ডাইনিং টেবিলকে রঙে-গন্ধে ও স্বাদে ভরিয়ে তুলবে। নিরামিষেও যে ভোজন রসনার আসর জমে উঠতে পারে, তার সাক্ষী হোক এই বিশেষ আয়োজন।
মৌরি ছানার রসা
কী কী লাগবে
২০০ গ্রাম পনীর, ১/৪ কাপ মটরশুঁটি, ২ চা চামচ মৌরি, ১ কাপ দুধ, ১ টেবিল চামচ মৌরি গুঁড়ো, ২ চা চামচ আদা বাটা, ১-২ টো তেজপাতা, ৩-৪ টে চেরা কাঁচালঙ্কা, ১ টেবিল চামচ Shalimar's সরষের তেল, ১/৪ চা চামচ চিনি, নুন স্বাদ মতো

কীভাবে বানাবেন
তেল গরম করে নুন মাখানো পনীর হালকা ভেজে তুলে নিন। জলে মৌরি গুঁড়ো ভিজিয়ে রাখুন। তেলে তেজপাতা আর গোটা মৌরি ফোড়ন দিয়ে একে একে আদা বাটা, চেরা কাঁচালঙ্কা, মৌরির পেস্ট, নুন দিয়ে কষুন। মটরশুঁটি, ভাজা পনীর দিয়ে নেড়েচেড়ে গরম দুধ দিন। চিনি মিশিয়ে নামিয়ে নিন।

গন্ধরাজ ঘোল পোলাও
কী কী লাগবে
বাসমতি চাল ২৫০ গ্রাম, নুন স্বাদমত, টকদই ৩ টেবিল চামচ, গন্ধরাজ লেবুর রস ২ চা চামচ, গন্ধরাজ লেবুর জেস্ট ১ চা চামচ, চেরা কাঁচালঙ্কা ২টি, চিনি ২ চা চামচ, ঘি/ Shalimar's sunflower তেল ২ টেবিল চামচ, কাজুবাদাম কিশমিশ, গন্ধরাজ লেবুর পাতা ৪ টি

কীভাবে বানাবেন
চাল ভিজিয়ে রেখে জল ঝরিয়ে রাখুন। ঘি গরম করে কাজু কিশমিশ ভেজে তুলে নিন। টকদই, গন্ধরাজ লেবুর রস আর পরিমান মতো জল মিশিয়ে ঘোল বানিয়ে রাখুন। এবার প্যানে চাল, নুন, চেরা কাচালঙ্কা দিয়ে অল্প নেড়ে ঘোল ঢেলে ঢেকে রান্না করুন। চাল সেদ্ধ হয়ে ঝরঝরে হলে চিনি, ভাজা কাজুবাদাম কিশমিশ, গন্ধরাজ লেবুর জেস্ট আর পাতা দিয়ে আধঘন্টা ঢেকে রেখে পরিবেশন করুন এই একদম ভিন্ন স্বাদের পোলাও।
মুগ ফুলকপির ঘন্ট
কী কী লাগবে
১ টা মাঝারি মাপের ফুলকপি, ১/২ কাপ মুগডাল, ১ চা চামচ Shalimar's chef spices হলুদ গুঁড়ো, দেড় চা চামচ আদা বাটা, ৬-৭ টা চেরা কাঁচালঙ্কা, ৩ টেবিল চামচ Shalimar's sunflower তেল, ১ টেবিল চামচ ঘি, ১/২ চা চামচ চিনি, স্বাদ মতো নুন
কীভাবে বানাবেন
মুগডাল শুকনো খোলায় ভেজে ধুয়ে সেদ্ধ করে নিন। নুন হলুদ গুঁড়ো দিয়ে ফুলকপি ভাপিয়ে নিন। এবার তেল গরম করে বাদামী করে ভেজে তুলে নিন। ঐ তেলে আদা বাটা, চেরা কাঁচালঙ্কা, নুন, হলুদ গুঁড়ো, চিনি, ভাজা ফুলকপি অল্প জল দিয়ে কষুন। সেদ্ধ মুগডাল দিয়ে ঢেকে রান্না করুন। ঘি মিশিয়ে নামিয়ে নিন।

মোচার নিরামিষ পাতুরি
কী কী লাগবে
কুচোনো সেদ্ধ মোচা ২০০ গ্রাম, পোস্ত + সর্ষে বাটা ২ টেবিল চামচ, নারকেল কোরা ২ টেবিল চামচ, Shalimar's সর্ষের তেল পরিমাণমতো, কাঁচালঙ্কা বাটা ১ চা চামচ, নুন চিনি স্বাদ মতো, কলাপাতা, টুথপিক

কীভাবে বানাবেন
সেদ্ধ মোচা শিলনোড়া বা মিক্সিতে বেটে নিন। এর সঙ্গে নুন, চিনি, সর্ষে পোস্ত বাটা ও নারকেল কোরা মিশিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ ঢেকে রাখুন। লঙ্কা বাটা ও সর্ষের তেল মাখিয়ে নিন। কলাপাতার মধ্যে ২ চামচ মোচা বাটা নিয়ে পাতুরির মতো মুড়ে টুথপিক গেঁথে নিন। তাওয়ায় তেল লাগিয়ে কলাপাতা মোড়া মোচা বাটা এপিঠ ওপিঠ করে সেঁকে নিন ভালো করে। গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।

নারকেল মাখা লাউ
কী কী লাগবে
১ টা লাউ ছোট টুকরো করা, ১/২ কাপ নারকেল কোরা, ৩-৪ টে চেরা কাঁচালঙ্কা, ১০ টি থেঁতো করা গোলমরিচ, ১ চা চামচ চিনি, ২ টেবিল চামচ Shalimar's soyabean তেল, স্বাদমতো নুন
কীভাবে বানাবেন
একটি পাত্রে লাউ, নারকেল কোরা, গোলমরিচ, কাঁচা লঙ্কা, নুন, চিনি, সরষের তেল মিশিয়ে নিন। প্যানে এই মিশ্রণ দিয়ে ঢেকে অল্প আঁচে রান্না করুন। মজলে ওপরে আরো কিছুটা নারকেল কোরা আর সর্ষের তেল ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।

নিরামিষ কচুশাক
কী কী লাগবে
কচুশাক পরিস্কার করে টুকরো করে নেওয়া ৫০০ গ্রাম, নুন চিনি স্বাদ মতো, ভেজানো কাঁচা ছোলা বাদাম একমুঠো, নারকেল কোরা আধ কাপ, Shalimar's chef spices হলুদ গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, চেরা কাঁচালঙ্কা ৪-৫ টা, Shalimar's সরষের তেল পরিমাণমতো, ফোড়নের জন্য তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, সাদা জিরে।

কীভাবে বানাবেন
কচুশাক নুন জল দিয়ে ভাঁপিয়ে নিতে হবে। সরষের তেল গরম করে তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, সাদা জিরে ফোড়ন দিয়ে ভাঁপানো শাক ছেড়ে নাড়তে হবে। তারপর একে একে চেরা কাঁচালঙ্কা, বাদাম, ছোলা, নারকেল কোরা, নুন, চিনি, হলুদ গুঁড়ো দিয়ে গ্যাস কম করে বেশ সময় নিয়ে শাক টানাতে হবে। শুকনো হয়ে এলে নামিয়ে নেবেন।

চুয়া-চন্দন
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
১। ধর্মঘট
"কোন স্টেশন এলো বলুন তো!"
গলাটা পেয়ে ওপরদিকে একবার দেখে নিল সমরেশ। সেখানে পর্দার আড়াল ঘুচেছে। সদ্য জ্বলে ওঠা রিডিং ল্যাম্পের আলোয় কম্বলের ফাঁক দিয়ে ঘুমজড়ানো দুটো চোখ।জানালার বাইরে বৃষ্টিভেজা দিন। ময়লা রঙের আলো। সকাল না সন্ধে টের পাওয়া যায় না। দুটো মাত্র প্ল্যাটফর্মের নির্জন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। নেহাতই তুচ্ছ স্টেশন। গুয়াহাটি থেকে কলকাতা যাতায়াত করা এই এক্সপ্রেস ট্রেনের এমন কুলশীলহীন স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়বার কথা নয়। এইবার উঠে বসল সমরেশ। তারপর ঘুমঘুম চোখে খানিক দূরে প্ল্যাটফর্মের শেড-এর খুঁটির গায়ে আটকানো হলদে টিনের চাকতিটার দিকে একনজর তাকিয়ে অবিশ্বাসের গলায় বলল, "শ্রীরামপুর! তার মানে?"

"অসম্ভব। কুড়ি ঘণ্টা একটানা ঘুম..." বলতে বলতেই কম্বলধারিনী উঠে বসেছেন এবারে। হালকা বাসন্তী রঙের শাড়িজড়ানো দুটো পা সেকেন্ড এসির ওপরের বার্থ থেকে সমরেশের সামনের বাতাসে খানিক আত্মবিশ্বাসহীনভাবে দুলছিল। সমরেশেরও একটু অবাক লাগছিল। গুয়াহাটি থেকে ট্রেনে ওঠবার পর সে-ও বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেনি আগের দিন। এই আউট-স্টেশন অ্যাসাইনমেন্টগুলোয় টাকা ভালো পাওয়া যায়, কিন্তু একইসঙ্গে একাধিক ক্লায়েন্টের আগ্রাসী দাবি... তার মতো পেশাদারেরও শরীরে ক্লান্তি আনে। ফলে, সঙ্গে আনা একটা বইতে চোখ বোলাবার খানিক চেষ্টা করে শেষমেশ সে-ও তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাই বলে এত লম্বা ঘুম... আর ঠিক তক্ষুনি স্টেশনের ইংরেজি নামটার তলায় বাংলা হরফে নামটার দিকে চোখ গেল তার। 'র' দুটোর পেট কাটা। তলায় পুঁটুলি নেই।
ভদ্রমহিলা ততক্ষণে নেমে এসে তার মুখোমুখি সিটটায় জানালার ধারে এসে বসেছেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, বানানের বৈশিষ্ট্যটা তাঁরও চোখ এড়ায়নি। নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন, "অ। এই শ্রীরামপুর। এখনও আসাম ছাড়াল না। দমদমের ফ্লাইটটা..."
বলতে বলতেই হাতের ফোনটা তাড়াতাড়ি বের করে এনেছিলেন ভদ্রমহিলা। তারপর তার পর্দার দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, "টাওয়ার নেই। এখন খবরটা ওখানে..."বলতে বলতেই সমরেশের হাতের ফোনটার দিবে উৎসুক চোখ পড়েছিল তাঁর। দেখে সে একগাল হেসে বলল, "একই দশা।" তিনদিনের আউটস্টেশন কল ছিল। ভালো অবশ্য সমরেশের চিন্তার কোনও কারণ নেই।
ক্লায়েন্ট। পরিশ্রম গেছে খুব তা ঠিক, কিন্তু কাল গুয়াহাটি ছাড়বার ঘন্টাখানেকের ভেতর অ্যাকাউরে রেমুনারেশনও ঢুকে গেছে। ফিরে গিয়ে আজকের রাত আর কালকের গোটা দিনটা তার একান্ত নিজের।
"বাইরে কোথাও যাচ্ছেন?"
নিতান্তই নিরীহ প্রশ্ন। কনভার্সেশন স্টার্টার। তদ পেশায় এই প্রাথমিক আইস ব্রেকিং সেশনগুলো খুব ভালো করে শিখতে হয়। ক্লায়েন্টের জড়তা থাকে অনেকরকম। হাজারো রিজার্ভেশন, ইনহিবিশান। আদ্যন্ত পেশাদার সংস্থায় কাজ করে সে। এসব কৌশল কাজেই গোড়াতেই তাদের শিখিয়ে নেয়া হয়েছে।

এ সম্ভবত গুয়াহাটিরই কোনও রইস পরিবারের মেয়ে। বাপ যেভাবে আহ্লাদ করে ট্রেনে এনে তুলে দিয়ে গেল! সিটে এনে বসিয়ে দিয়ে তার পরেও হাত ধরে আছে তো আছেই। সম্ভবত মেয়ে দূরে কোথাও যাচ্ছে।
আড়চোখে মেয়েটার দিঘল চোখের দিকে
একনজর তাকিয়ে দেখে নিল সমরেশ। বাপের মুখের সঙ্গে মিল নেই কোনও। সম্ভবত মাতৃমুখী সমরেশ। চুয়া। মেয়ে। নামটাও ভদ্রলোকের মুখেই শুনে নিয়েছে
মেয়েটার মধ্যে জড়তা নেই বিশেষ। প্রশ্নটা শুনে মুহূর্তের মধ্যে ভাবটাকে মুছে ফেলে গালে টোল একমুহূর্ত সামান্য থতমতই খেয়ে গিয়েছিল তারপর ফেলে হাসল, "হ্যাঁ। আপনি কি কলকাতাতেই..."

"হ্যাঁ," সমরেশ হেসে মাথা নাড়ল।
রাতে যখন ট্রেনে এসে উঠল, মুখটা একেবারে শুকিয়ে বসেছিল মেয়েটা। ভদ্রলোক নেমে যেতে যেন হাঁফ ছেড়ে ওপরের বাঙ্কে উঠে সটান কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। এইবারে ঘুমটুম দিয়ে উঠে বেশ তাজা হয়েছে।
"ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, পড়তে-টড়তে বাইরেকোথাও..."
একঝলক তার দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। সম্ভবত অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলবার বিষয়ে বাড়ি থেকে কিছু বলেটলে দিয়েছে। তারপর আস্তেন্ত আস্তে দ্বিধাজড়ানো ঢঙে মাথাটা ওপর-নীচে নাড়ল একবার।
একটু অস্বস্তি বোধ করছে মেয়েটা। সমরেশ আর কিছু না-বলে উঠে দাঁড়াল। জানালার বাইরে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে চাওয়ালা যাচ্ছে। কাচের ভেতর দিয়ে ডাকলে শুনতে পাবে না। নেমে হাত-পাগুলো একটু নাড়িয়ে নেয়া যাক। ঘড়িতে আটটা বাজছে। এতক্ষণে নিউ কোচবিহার পৌঁছে যাবার কথা ছিল। একটু খোঁজখবরও করে নেয়া যাবে।

২। প্ল্যাটফর্মে
"আসাম সাইডের লাস্ট স্টেশন এই শ্রীরামপুর, বুঝলেন। এই গাঁটটা ছাড়ালেই পনেরো মিনিট বাদে বেঙ্গলের ফার্স্ট স্টেশন জোরাই। এখানে বা ওখানে কোথাও শিডিউল স্টপ নেই অবশ্য। ফকিরাগ্রাম ছাড়বার পর একেবারে সিধে কামাখ্যাগুড়ি। এই শ্রীরামপুর পাস করবার কথা ছিল রাত বারোটা নাগাদ। কিন্তু কপাল...."
চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতেই মোটামতো ভদ্রলোক তাঁর বেঢপ চেহারা নিয়ে খানিক হাঁসফাস করছিলেন। পাশের কুপেতে উঠেছেন নিউ বঙ্গাইগাঁও থেকে। চলেছেন কলকাতায় চিকিৎসা করাতে। পথে এই বিপদ।
সমরেশ চারদিকে একনজর চোখ চালিয়ে দেখল। ভদ্রলোকের উৎকণ্ঠাটা এই মুহূর্তে আর কোনও স্পর্শই করছে না তাকে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নেমেছে তাদের ঘিরে। তীব্র, চোখধাঁধানো অথচ বিষণ্ণ সবুজের বুকে হলদেটে প্ল্যাটফর্ম আর তার গায়ে দেওয়াল তুলে দাঁড়ানো পোড়া লাল রেলগাড়ির জোরালো কনট্রাস্ট...
ভদ্রলোক কথা বলতে ভালোবাসেন খুব। খানিক আগেই নেমে এসে খবরাখবর সব জোগাড় করে নিয়েছেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। বে-হিসেবের স্টেশনে হঠাৎ থমকে যাওয়া গাড়ি। তাকে খাতিরদারি করবার জন্য সামান্য যে কয়েকজন নাছোড় চা-পকোড়াওয়ালা উদয় হয়েছিল তারাই জানিয়েছে।
বিরক্ত মুখে মাথা নেড়ে তিনি ফের গুনগুন শুরু
করলেন, "বেঙ্গলটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে দিনদিন। ল অ্যান্ড অর্ডার বলে আর কিস্যু নেই। নইলে ভাবুন একবার কেবল, পাতি টি-গার্ডেন ওয়ার্কাররা নর্থ বেঙ্গল স্ট্রাইক ডাকল আর তার ভয়ে এক্সপ্রেস ট্রেন অবধি রাত বারোটায় বেঙ্গল বর্ডারে এনে থামিয়ে দিতে। হল। স্টেট গবমেন্ট এইটুকু প্রোটেকশানও দিতে পারে না যে অন্তত ট্রেনটা যেতে পারো ছিল বটে এমার্জেন্সির টাইম। এতক্ষণে পেঁদিয়ে উদ্ধার করে দিত পুলিশে..."
"তা, ছাড়বে কখন, কোনও খবর পেলেন?" "কাল দুপুর বারোটার পর। ফুল থার্টি সিক্স আওয়ার্স বন্ধ।"
"শিওর?"
"শিওর মানে? ঘুম ভাঙতেই চাওলার কাছে স্ট্রাইকের খবরটা পেয়ে নেমে স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক ঘরে তালা এঁটে কোয়ার্টারের দিকে যাচ্ছিলেন। বলে গেলেন, মেসেজ এসে গেছে। উনিও তাই কেটে পড়েছেন। পুরো দেড়খানা দিন ফালতু... কেন যে মরতে ফ্লাইটে না গিয়ে..."
হুমহুমে ভেজা হাওয়ার একটা ঢেউ ছুটে এল হঠাৎ। উত্তরের ভুটান পাহাড়ের অরণ্যভূমি থেকে নেমে এসে দক্ষিণের দিকে ধেয়ে যেতে যেতে মানুষটার ঘষা ঘষা গলার শোকগাথাটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল তা সমরেশের কান থেকে।

একটা আস্ত ছুটির দিন! অথচ একলা ফ্ল্যাটে দুপুর অবধি খাটুনি পোষানো ঘুম নেই, জেগে উঠে জড়তামাখা শরীরে নেটফ্লিক্স, হুইস্কি আর সুইগির ফুডপ্যাকেট নেই। ছুটির দুপুরে শাঁসালো ক্লায়েন্টের আকস্মিক আবির্ভাবের বার্তা নিয়ে ওঝাজির ফোনকল নেই...
ভদ্রলোকের কথাবার্তা থেমে গেছে হঠাৎ। ডাইনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে স্থির হয়ে গেছেন। সমরেশ মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল সেদিকে একবার। চুয়া নামের মেয়েটাও কখন যেন নেমে এসেছে ট্রেন থেকে। ওদিকে দাঁড়িয়ে চাওয়ালার থেকে চায়ের ভাঁড় তুলে নিচ্ছে হাতে। ছুটন্ত হাওয়ায় তার এলোমেলো বাসন্তী রঙের শাড়ির আধো আবডালের দিকে লোকটার অবাধ্য, লোভী, ক্লান্ত চোখদুটো ধরা....
মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল সমরেশ। এখন আর ইনি তার অনুপস্থিতি টের পাবেন না।
বাকী পর্ব পরবর্তী সংখ্যায়..
Comments