top of page

স্বাদে, বৈচিত্র্যে আঞ্চলিক রান্না, বাবা, মা ও বন্ধুত্ব, টিনএজারদের রূপটান, রবিবারের গল্প: সূর্যোদয়..

স্বাদে, বৈচিত্র্যে আঞ্চলিক রান্না

ree

ভারতবর্ষ বৈচিত্র্যের দেশ ভাষা, পোশাক, উৎসব, সংস্কৃতির মতোই বৈচিত্র্য তার খাদ্যাভ্যাসে। প্রতিটি প্রদেশ, প্রতিটি অঞ্চল, এমনকি প্রতিটি জেলারও নিজস্ব রান্নার ধারা আছে। কোনো অঞ্চল ঝাল-মশলার দাপটে জিভে ঝড় তোলে, আবার কোথাও খাঁটি ঘ্রাণ আর সাদামাটা উপাদানে স্বাদের জাদু ঘটে। এদেশের আঞ্চলিক রান্না শুধু পেট ভরানোর উপায় নয়, বরং ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি আর মানুষের জীবনযাত্রার মেলবন্ধন।আজকের প্রবন্ধে আমরা ভারত তথা বাংলার আঞ্চলিক রান্নার বৈচিত্র্য, ইতিহাস, উপকরণ, জীবনধারা, ও খাদ্যসংস্কৃতির গভীরে যাব—স্বাদে, ঐতিহ্যে, অনুভবে। আঞ্চলিক রান্না কোনোদিন বিমূর্ত ধারণা নয় এ তা সমাজের প্রতিচ্ছবি। কোন অঞ্চলে কেমন উপকরণ জন্মায়, জলবায়ু কেমন, মানুষ কেমনভাবে জীবনযাপন করে সেই সব কিছু মিলেই তৈরি হয় বিশেষ রান্নার ধারা।

ree

বঙ্গে নদীমাতৃক প্রকৃতি মানুষকে মাছের স্বাদ শিখিয়েছে, রাজস্থানের মরুভূমি নির্ভর রান্না শিখিয়েছে ঘি, মসলা আর শুকনো উপকরণের ব্যবহার।কোথাও নারকেল, কোথাও সরষে, কোথাও কড়াইশুঁটি, আবার কোথাও গম, জোয়ার-বাজরার আধিপত্য খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্যের ছাপ সর্বত্র। রান্না এখানে ইতিহাসও বটে। মুঘল আমল আমাদের দিয়েছে কোর্মা, বিরিয়ানি, কাবাব; পর্তুগিজরা উপহার দিয়েছে চিজ ও পাউরুটি; ফরাসি-ডাচ প্রভাবও জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন কেক, পেস্ট্রি ও ডেজার্টে। বাঙালির মিষ্টিপ্রেম আর রসনার সূক্ষ্মতা যেন বিশ্বমানের উদাহরণ। বাঙালির রান্নার গল্প শুরু হয় কড়াইতে সরষের তেল ফোঁটানোর সেই স্বাদ থেকে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে বঙ্গভূমির স্বাদ বহুমাত্রিক। নদ-নদী, গঙ্গার পাড়, সুন্দরবন, পাহাড়ি এলাকাপ্রতিটি অঞ্চলই দিয়েছে নিজস্ব খাবারের ঐতিহ্য।

ree

বাঙালি রান্নার স্বাতন্ত্র্য তার মশলার সূক্ষ্ম ব্যবহার ও স্বাদের সূক্ষ্মতায়। এখানে সরষের ঝাঁঝ, পোস্তর মসৃণতা, নারকেলের ক্রিমি টেক্সচার, ধনে-জিরের ঘ্রাণ সব মিলিয়ে তৈরি হয় গভীর ও নিখুঁত স্বাদের জাদু। বাঙালি রান্নায় মশলা অতিরিক্ত চাপিয়ে দেওয়া হয় না; বরং হালকা মশলার মধ্যেই প্রতিটি উপকরণের নিজস্ব স্বাদকে ফুটিয়ে তোলাই প্রধান লক্ষ্য। বাঙালি খাবারের বৈশিষ্ট্য হল সম্পূর্ণতা ডাল-ভাত-তরকারি-ভাজা-চাটনি-মিষ্টি, প্রতিটি অংশের নিজস্ব গুরুত্ব আছে এবং প্রত্যেকটি পদ পরস্পরকে পরিপূর্ণ করে। পাশাপাশি মরিচ ও মশলার নিখুঁত ভারসাম্য বাঙালি রন্ধনশৈলীর একটি বড় বৈশিষ্ট্য, যেখানে কখনও ঝাঁঝালো সর্ষের ঝাল আবার কখনও দুধ-দই-ঘি-নারকেলের মোলায়েম স্বাদ জিভে মোলায়েম অনুভূতি এনে দেয়। স্বাদের এই বহুমাত্রিকতা ও ভারসাম্যই বাঙালি রান্নাকে করে তুলেছে অনন্য, গভীর এবং হৃদয়ের সঙ্গে জড়ানো।

ree

বাঙালির জনপ্রিয় পদগুলির তালিকা যেন স্বাদের এক অন্তহীন যাত্রা প্রতিটি রান্না গ্রামের আঙিনা, নদীর ধারা, উৎসব, পারিবারিক আড্ডা আর মায়ের হাতের উষ্ণতার স্মৃতি বহন করে। যেমন ইলিশ ভাপা ও ইলিশ পাতুরি সরষে বাটা, নুন, কাঁচালঙ্কা, হালকা দই বা নারকেল দিয়ে কলাপাতায় মোড়া ইলিশের ভাপানো সুগন্ধ বাঙালির গর্ব। চিংড়ি মালাইকারির মাখনের মতো নরম টেক্সচার, নারকেল-দুধের মিষ্টি স্বাদ আর গরম ভাতের সঙ্গে তার অপূর্ব সামঞ্জস্য যেন রাজকীয়তার প্রতীক। গরম ভাতে টক দিয়ে শেষ খাবারটা স্নিগ্ধ করে তোলার বাঙালির আবেগ। আলু পোস্তর মতো সহজ অথচ মাধুর্যে ভরা পদ বাঙালি ঘরের দৈনন্দিনতার অংশ, আর চিতল মুড়ো ঘন্ট তার নামেই রয়্যাল পরিচয় বহন করে মশলার জটিলতা আর মাছে-শাকের মিলনে তৈরি স্বাদের সিম্ফনি। কষা মাংস ও মাটন চাপের মতো গভীর রঙ ও ঘন গ্রেভির পদ উৎসব, রবিবার দুপুর ও পরিবারের আনন্দের নিদর্শন।


ভাত, ভাজা, ডাল, শুক্তো বাঙালি থালার পূর্ণতা; শুক্তোর তিতকুটে-ঘ্রাণময় স্বাদ উদরকে সুশৃঙ্খল করে, ভাজা ও ডাল মেলে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। মিষ্টির ক্ষেত্রে রসগোল্লা, মিষ্টি দই ও সন্দেশ এরা শুধু মিষ্টি নয়, আবেগ; জন্মদিন, পুজো, বিয়ে থেকে শুরু করে সাধারণ দিন সব মুহূর্তকে ইকটু বেশি সুন্দর করে তোলে। বাসন্তী পুলাওয়ের হলুদ আভা, ঘি-এ ভাজা চাল ও কিশমিশ-কাশু-র সুগন্ধ উৎসবের আহ্বান মাংস বা রুই-কাতলার ঝোলের সঙ্গে তার যুগলবন্দি অতুলনীয়। অন্যদিকে পাহাড়িয়া বাঙালির খাবারে রয়েছে ডুয়ার্স ও দার্জিলিং অঞ্চলের নেপালি, লেপচা ও তিব্বতি স্বাদের অনন্য মেলবন্ধন মোমো, থুকপা, গুনদ্রুক, চিঁড়ে-চা, বাঁশকোরার তরকারি পাহাড়ের প্রকৃতি, টাটকা সবজি ও হালকা মশলার মাধ্যমে তৈরি করে অন্য রকম আরামদায়ক স্বাদ, যা সমতলের বাঙালি খাবারের সঙ্গে ভিন্ন অথচ সমানভাবে হৃদয় জয় করে। এই সব পদ মিলেই বাঙালির রান্নাঘরকে করেছে বৈচিত্র্যময়, স্মৃতিবহ ও অবিস্মরণীয়। পুষ্টিবিদরা বলেন, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার আসলে অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত। ভাতের সঙ্গে ডাল, শাক-সবজি, মাছ এগুলো সম্পূর্ণ প্রোটিন-ফাইবার-পুষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করে। সরষের তেল ও হালকা মশলার ব্যবহার হার্টের জন্য ভালো, শাকপাতা পেট-যকৃত-চোখ সবকিছুর যত্নে।

ree

ভারতের প্রতিটি প্রান্তের খাবারে যেমন মাটি-মন-মানুষের ছাপ থাকে, তেমনই আঞ্চলিক রান্নার প্রতিটি পদ বহন করে নিজস্ব ইতিহাস ও আবেগ। পাঞ্জাবের উর্বর সমতল ভূমি আর গম-ভিত্তিক কৃষি সংস্কৃতি তৈরি করেছে রুটি, নান, পরোটা-র মতো পুষ্টিকর খাদ্যের ঐতিহ্য। দুধ, ঘি, মাখন ও ছানার অপূর্ব ব্যবহার পাঞ্জাবি খাবারকে দিয়েছে সমৃদ্ধি ও ভারী টেক্সচার লস্যির ঠান্ডা প্রশান্তি, বাটার চিকেনের মাখনগোলা মসৃণতা ও সরসোঁ দা সাগ-মক্কি দি রোটির গ্রাম্য সুগন্ধ যেন পাঞ্জাবি জীবনের আনন্দ, উদারতা ও পরিশ্রমের প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতের স্বাদ একেবারেই আলাদা তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক ও কেরালার রান্নায় ভাত, ডাল, নারকেল, কারিপাতা ও মসলা মিলেমিশে তৈরি করেছে নিখুঁততার শিল্প। দোসা-ইডলির নরম-ক্রিস্প টেক্সচার, সাম্বার-রসমের নিরামিষ গভীরতা, আপ্পাম-পুট্টুর সূক্ষ্ম স্বাদ আর মাছ-নারকেলের কারির দরাজ ঘ্রাণ প্রমাণ করে খাবারের সঙ্গে প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের গভীর সম্পর্ক। রাজস্থানে জলাভাবই সৃষ্টি করেছে রান্নার আলাদা চরিত্র ঘি-সমৃদ্ধ, মশলা-দার, শুকনো উপাদানে ঠাসা দাল-বাটি-চুরমা, গট্টে কি সবজি, লাল মাস ও মরিচের আচার মরুভূমির রূক্ষতার মধ্যেও জীবনের আনন্দকে উদযাপন করে। গুজরাটে তেল-মশলা কম, ভাটে ভাজা হালকা খাবার বেশি; তিল, ছোলা, দই ও নানান ধরনের চাটনি ও মশলার কোমল ব্যবহার ঢোকলা, খান্ডভি, উন্ধিয়ু, ফাফড়া-জলেবিতে তৈরি করেছে টক-মিষ্টি-নোনা-ঝালের দারুণ ভারসাম্য। মহারাষ্ট্র আবার স্বাদের বহুস্তর সাদামাটা কিন্তু পরিপূর্ণ পোহা-বরান ভাত থেকে শুরু করে পুরণপোলির মিষ্টি ঐতিহ্য, পথচলার তীব্র ঝাল-মশলাদার মিসল পাভ ও বিখ্যাত বোম্বে স্ট্রিট ফুড, সব মিলিয়ে মহারাষ্ট্রের খাবার একদিকে ঘরোয়া, অন্যদিকে cosmopolitan আধুনিকতার প্রতীক। ভারতের এই আঞ্চলিক খাদ্য বৈচিত্র্য শুধু পেট পুরিয়ে দেয় না সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আপন স্বাদের গল্প বলেও মানস ভরিয়ে দেয়।।

ree

ঋতুভেদে খাদ্য তালিকা বদলানো ভারতীয়দের ঐতিহ্য। গ্রীষ্মে ছাতু, ঘোল, তেতো শাক; বর্ষায় ইলিশ, পাটশাক, মুগ; শীতে পিঠেপুলির উৎসব এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে খাদ্যের সুর। বাংলার পিঠে-সংস্কৃতি পাটিসাপটা, দুধপুলি, ভাপা পিঠে হাজার বছরের ঐতিহ্য। গ্রামীন বাঙালি রান্নায় উৎকৃষ্ট টাটকা উপাদান মাঠের শাকপাতা, কলমি, পুঁই, কুমরোফুল, গাছপাকা সবজি, ঝোল ঝাল ভর্তা-ভাজা এ যেন স্বাস্থ্যচর্চা। শহরে আধুনিকতায় যুক্ত হয়েছে ফিউশন কুইজিন, থাই-বাংলা, চাইনিজ-বাঙালি রেসিপি, রেস্তরাঁর ধাঁচে রান্না। তবে আজকের দিনে ট্রেন্ড ফার্ম টু টেবিল। অর্থাৎ আবার গ্রামীন খাবারের সহজ স্বাদে ফেরা।

ree

আঞ্চলিক রান্না গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি একটি জাতির সংস্কৃতি, জীবনযাপন ও ইতিহাসকে সজীব রাখে। স্থানীয় রান্না সাংস্কৃতিক পরিচয়কে রক্ষা করে একটি অঞ্চলের ভাষা, গান, পোশাকের মতোই খাবার সেই ভূমির স্বাদ ও আত্মাকে তুলে ধরে। পাশাপাশি আঞ্চলিক রান্না পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে অত্যন্ত উপকারী, কারণ এতে ব্যবহৃত উপকরণ হয় স্থানীয়, মৌসুমি ও স্বাভাবিক খাদ্যপদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী পুষ্টি সরবরাহ করে। ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক রান্নার ভূমিকা অপরিসীম পুরনো রেসিপি, রান্নার পদ্ধতি, উৎসবের খাবার, মশলা সবই প্রজন্মান্তরে গল্পের মতো চলতে থাকে। এ ছাড়া গ্যাস্ট্রোনমি ট্যুরিজম বা খাদ্যভিত্তিক পর্যটন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিরিয়ানি থেকে ইলিশ, দোসা থেকে দুধপি্ঠা এই বৈচিত্র্য দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে, স্থানীয়দের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। আর সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো, আঞ্চলিক রান্না আমাদের মায়ের রান্না, পরিবারের সঙ্গে খাওয়ার স্মৃতি, পাড়ার উৎসব, গ্রামের উঠোন, গল্প সবকিছুকে এক থালায় জুড়ে দেয়। খাবার তাই শুধু স্বাদ নয়, স্মৃতি, ভালোবাসা আর শিকড়ের সঙ্গে আমাদের বন্ধন।

ree

প্রবচন আছে “লোকাল খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।” স্থিতিশীল কৃষি, পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন, স্বাদ সবই মিলে যায়।

আঞ্চলিক রান্না শুধু খাবার নয়, জীবনদর্শন। নদীর গন্ধ, মাটির স্পর্শ, মায়ের হাতের ছোঁয়া, উৎসবের স্মৃতি সব মেশে এক থালায়। ভাতের সঙ্গে ডাল-মাছ, ভাজা-তরকারি আবার কখনো দোসা-ইডলি, কোর্মা-বিরিয়ানি, রুটিপ্রত্যেকটা খাবার বলে একটি গল্প। এই বৈচিত্র্যই ভারতের শক্তি। আর বাংলার ক্ষেত্রে মনে হয়, স্বাদই রসনা নয়, ইতিহাসও জিভে লেগে থাকে। খাবারের থালা আমাদের সংস্কৃতির ক্যানভাস যেখানে প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মশলা, প্রতিটি রান্না একটি কবিতা।

বাবা, মা ও বন্ধুত্ব: জীবনের অবলম্বন

ree

মানুষের জীবনের শুরু হয় মায়ের কোল আর বাবার স্নেহমাখা নিরাপত্তার হাত ধরে। জন্মের পর থেকেই শিশু বুঝে যায় পৃথিবীতে তার প্রথম আশ্রয় মা, প্রথম সহায়ক বাবা। জীবনের প্রথম হাসি, প্রথম কান্না, প্রথম শব্দ, প্রথম হাঁটা সবই হয় বাবা-মায়ের স্নেহ, যত্ন ও ধৈর্যের পরিবেশে। এই ভালোবাসা কখনও শর্তসাপেক্ষ নয়; এটি নিঃস্বার্থ, অমূল্য, আর আজীবন আঁকড়ে থাকার মতো আশ্রয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন আমরা বাড়তে থাকি, পৃথিবী চিনতে শিখি, সম্পর্কের বিস্তার ঘটে, তখন আমাদের জীবনে আরেকটি মহার্ঘ সম্পর্ক যুক্ত হয় বন্ধুত্ব। বাবা-মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে বন্ধুত্ব যোগ হলে মানুষ হয় মানসিকভাবে সমৃদ্ধ, আবেগিকভাবে দৃঢ় এবং সামাজিকভাবে পরিপূর্ণ।

ree

বাবা সন্তানের জীবনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি শুধু পরিবারের কর্তা নন, তিনি একজন দিশারী, নীরব পাহারাদার, সাহসের প্রতীক। জীবনের প্রথম দিকে বাবা বুঝিয়ে দেন সাফল্য ও দায়িত্ব একে অপরের পরিপূরক। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়েও সন্তানের মুখে হাসি দেখলে বাবার সমস্ত দুশ্চিন্তা মুছে যায়। বাবার শাসন অনেক সময় তৎক্ষণাৎ ভালো না লাগলেও, পরে আমরা উপলব্ধি করি প্রতিটি বকুনি আমাদের ভালো ভবিষ্যতের জন্য, প্রতিটি নিয়ম আমাদের শক্তি গড়ার জন্য। বাবার নীরব ত্যাগ কখনও চোখে পড়ে না, তবু তিনি নীরবেই করে যান সন্তানের স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন বানানো, নিজের চাওয়া-পাওয়া ভুলে সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। সন্তানের পতনের মুহূর্তে বাবা হয়ে ওঠেন ঢাল, আর সাফল্যে তিনি থাকেন পেছনের ছায়া হয়ে, গর্বের হাসি নিয়ে। বাবার উপস্থিতি তাই আমাদের জীবনে শৃঙ্খলা, আত্মবিশ্বাস ও নিরাপত্তার প্রতীক।

ree

অন্যদিকে, মা হলেন আবেগের সমুদ্র, মমতার সিঁথি, শান্তির প্রথম ভাষা। পৃথিবীর কোনো সম্পর্কেই মায়ের মতো নিঃস্বার্থতা নেই। সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাতের শেষ শ্বাস পর্যন্ত সন্তানের সুখ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সবকিছু নিয়েই তার অনন্ত ভাবনা। মায়ের কোলে আমরা শিখি প্রথম শব্দ, প্রথম হাসি, প্রথম আবেগ। মায়ের হাতের ছোঁয়া শুধু শারীরিক আরাম নয়, মানসিক শক্তিও দেয়। কখন আদর করতে হবে, কখন বকতে হবে, কখন থামাতে হবে এই মাতৃত্বের বোধ ঈশ্বরপ্রদত্ত। মা শেখান ক্ষমা, সহমর্মিতা, ত্যাগ, ও ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ। তার কাছে জীবন শুধু সংগ্রাম নয় জীবন হলো ভালোবাসা, সম্পর্ক আর রঙের গল্প। শিশু যত বড়ই হোক, তার সাফল্য যত উচ্চই হোক, মায়ের কাছে সে সবসময়ই ছোট। সন্তানের চোখ ভিজে গেলে মায়ের হৃদয় প্রথম কাঁপে; সন্তান হাঁটতে শিখলে মা প্রথম হাত বাড়ান; আর সন্তান গোটা দুনিয়া ঘুরে এলে তার ফিরে আসার প্রথম গন্তব্য হয় মায়ের কোলে। এই সম্পর্ক তাই অনন্ত, অনুপম, অপরিবর্তনীয়।

ree

যখন বাবা-মায়ের স্নেহে বড় হয়ে আমরা সমাজে প্রথম পা ফেলি, তখন শুরু হয় নতুন এক অধ্যায় বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব এমন এক অনুভূতি যেখানে নেই কোনো রক্তের সম্পর্ক, নেই কোনো বাধ্যবাধকতা, তবু থাকে গভীর টান। বন্ধু কখনও ভাইয়ের মতো, কখনও সহযোদ্ধার মতো, কখনও পথপ্রদর্শকের মতো হয়ে ওঠে। শৈশবের কাদা-মাখা মাঠ থেকে কলেজের আড্ডা, প্রথম প্রেমের উত্তেজনা থেকে জীবনের প্রথম ব্যর্থতা সকল মুহূর্তেই বন্ধু থাকে পাশে। তারা শোনে মনখারাপ, ভাগ করে নেয় আনন্দ, সমালোচনা করে সাহস জোগায়, আবার ভুল করলে ঠিক পথ দেখায়। সত্যিকারের বন্ধুত্ব মানুষের মানসিক শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। দুঃসময়ে যখন সবাই দূরে সরে যায়, তখন একজন সত্যিকারের বন্ধু পাশে দাঁড়িয়ে বলে "চিন্তা করিস না, আমি আছি।" এই একটুকু বাক্যেই জীবন ফিরে আসে, শক্তি জন্মায়, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। তাই বন্ধুত্ব কখনও শুধুই সম্পর্ক নয় এটি জীবনের সাহস, আনন্দের উৎস, আর এক বিশেষ মানসিক নিরাপত্তা।

ree

বাবা, মা এবং বন্ধু এই তিন সম্পর্কের মেলবন্ধনেই তৈরি হয় মানুষের চরিত্র, বিবেক, নীতি, দৃষ্টি ও জীবনভাবনা। বাবা শেখান দায়িত্ব ও শৃঙ্খলা, মা শেখান আবেগ ও মমতা, বন্ধু শেখায় আস্থা ও সাহচর্য। জীবনের প্রতিটি মোড়ে আমরা এই তিন সম্পর্কের প্রয়োজন অনুভব করি সাফল্যে, ব্যর্থতায়, সন্দেহে, আশায় ও স্বপ্নে। কেউ বাবা-মায়ের স্থানে আসে না, কেউ বন্ধুর জায়গা নেয় না, কিন্তু তবু তারা তিনজন মিলে গড়ে তোলে আমাদের সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার গল্প। সময়ের সঙ্গে হয়তো দূরত্ব তৈরি হতে পারে পড়াশোনা, চাকরি, সংসারের ব্যস্ততায়; কিন্তু হৃদয়ের ভেতর সবসময়ই থাকে প্রথম স্কুল, প্রথম আদর, প্রথম হাত ধরা, প্রথম আড্ডা যেগুলো আমাদের বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় শিকড়ে।

ree

জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও মানুষ যখন অতীত মনে করে, তখন তার মনে ভেসে ওঠে বাবার হাসি, মায়ের চোখের জল, আর বন্ধুর সঙ্গে কাটানো পাগলাটে দিনগুলো। এগুলোই জীবনের আসল সম্পদ। যাদের জীবনে এই তিন সম্পর্ক পূর্ণতা নিয়ে আসে, তারা ভাগ্যবান। আর যারা হারিয়েছে, তারা স্মৃতিকে হৃদয়ে ধরে রেখে এগিয়ে চলে। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের এই ত্রিভুজই জীবনের স্তম্ভ। তাই আমাদের উচিত বাবা-মাকে সম্মান করা, তাদের ভালোবাসা গ্রহণ করা ও ফিরিয়ে দেওয়া; আর বন্ধুত্বকে সৎ ও প্রাণবন্ত রাখা। কারণ দিনের শেষে সমস্ত সাফল্য, অর্থ, যশ সবই ম্লান হয়ে যায়, কিন্তু সম্পর্ক থাকে, স্নেহ থাকে, স্মৃতি থাকে। এগুলোই মানুষকে মানুষ করে তোলে।

টিনএজারদের রূপটান

ree

কৈশোর জীবনের সেই রঙিন অধ্যায়, যেখানে প্রতিটি দিন নতুন রূপ নিয়ে আসে। টিনএজ মানেই পরিবর্তন মন, শরীর, অভ্যাস, চিন্তাধারা সবকিছুই যেন নতুনভাবে সাজতে শুরু করে। ঠিক এই সময়েই নিজেদের লুক, স্টাইল, সৌন্দর্য, ত্বক ও চুল নিয়ে সচেতনতা বেড়ে যায়। বন্ধুদের মাঝে সুন্দর দেখাতে চাই, স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে নিজেকে আলাদা করে তুলতে ইচ্ছে করে; আবার সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন ট্রেন্ড দেখে নিজেকে সাজাতে চাই। কিন্তু এই বয়সের ত্বক খুবই কোমল ও সংবেদনশীল। তাই সঠিক রূপচর্চা না হলে সৌন্দর্য বাড়ার বদলে সমস্যা বাড়তে পারে। তাই টিনএজ থেকেই নিজের ত্বক ও চুলের যত্ন নেওয়া শিখতে হবে সঠিক উপায়, সঠিক পণ্য এবং সঠিক অভ্যাস নিয়ে।

ree

টিনএজের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে হরমোনে। শরীরে এই সময় যে হরমোনের ওঠানামা হয়, তার প্রভাবে ত্বকে তৈলগ্রন্থি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে অনেকের মুখে বাড়তি তেল জমে, ব্রণ বা পিম্পল বের হয়, ব্ল্যাকহেডস দেখা যায়। কারও আবার ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে রুক্ষ লাগে। এই ত্বকের পরিবর্তন শুধুই বাহ্যিক নয় এটা পুরোপুরিই স্বাভাবিক এবং শরীরের বৃদ্ধি প্রক্রিয়ারই অংশ। তাই সমস্যাকে লজ্জার বা অস্বস্তির বিষয় না ভেবে ধীরে ধীরে যত্ন নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করা জরুরি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টিনএজে খুব বেশি পণ্য ব্যবহার করা চলে না, ত্বক তখনও বেড়ে উঠছে। তাই নরম, রাসায়নিকমুক্ত, অল্প উপাদানের স্কিনকেয়ার রুটিনই সবচেয়ে ভালো।


প্রথম যে অভ্যাসটি গড়ে তুলতে হবে তা হলো মুখ পরিষ্কার রাখা। দিনের পুরোটা সময় স্কুল, টিউশন, খেলা এবং বাইরের ধুলোবালি-ময়লা জমে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দিনে দু’বার মুখ ধোয়া সবচেয়ে বড় নিয়ম। তবে আবার বারবার মুখ ধোয়া ভুল। এতে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট হয়ে যায়, আর তখন ব্রণ আরও বেড়ে যেতে পারে। তাই নিজের স্কিন টাইপ অনুযায়ী হালকা ফেসওয়াশ ব্যবহার করাই উচিত। ফোমিং বা জেল ফেসওয়াশ তৈলাক্ত ত্বকে ভালো কাজ করে, আর ক্রিমি টেক্সচারের ফেসওয়াশ শুষ্ক ত্বকে উপকারী। মুখ ধোয়ার পরে টোনার ব্যবহার করলে ত্বক সতেজ ও ব্যালান্সড থাকে। রোজওয়াটার বা ফুলের জলটাই টিনএজের জন্য সহজ ও নিরাপদ টোনার।

ree

ময়েশ্চারাইজিং স্কিনকেয়ারের একটি অপরিহার্য অংশ। অনেক সময়ই টিনএজাররা ভাবে—যেহেতু ত্বক তৈলাক্ত, তাই ময়েশ্চারাইজারের দরকার নেই। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। ত্বকের জলীয় অংশ রক্ষা করতে এবং হরমোনাল অস্থিরতা সামলাতে হালকা জেল-বেসড বা নন-গ্রিসি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। আর বাইরে বেরোনোর আগে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। সূর্যের রশ্মি শুধু রোদে পোড়া করে না, ত্বকের গভীরে ক্ষতি করে, ভবিষ্যতে পিগমেন্টেশন ও বয়সের ছাপ ফেলতে পারে। তাই ৩০ SPF-এর সানস্ক্রিন প্রতিদিন ব্যবহার করা প্রয়োজন।


টিনএজে মেকআপের প্রতি আকর্ষণ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারী মেকআপ এই কচি ত্বকের জন্য আদৌ ভালো নয়। বরং অল্প সাজেই স্বাভাবিক সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। সামান্য BB ক্রিম, হালকা কমপ্যাক্ট পাউডার, চোখে সামান্য কাজল বা মাশকারা আর ঠোঁটে রঙিন লিপবাম এতটুকুই যথেষ্ট। উৎসব বা অনুষ্ঠানে একটু হাইলাইটার, সামান্য ব্লাশ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দিনের শেষে অবশ্যই মেকআপ পরিষ্কার করে ঘুমাতে হবে। নাহলে রোমছিদ্র বন্ধ হয়ে গিয়ে ব্রণ হতে পারে।

ree

এই বয়সে শুধু ত্বক নয়, চুলেও পরিবর্তন আসে। অনেকের চুল তেলতেলে হয়ে যায়, অনেকের মাথায় খুশকি দেখা দেয়। আবার পড়ার চাপ, স্ট্রেস, অনিয়মিত ঘুম, ফাস্টফুডের অভ্যাস চুল পড়াও বাড়িয়ে দেয়। তাই সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন হালকা শ্যাম্পু আর কন্ডিশনার ব্যবহার করা জরুরি। সপ্তাহে একদিন গরম নারকেল তেল দিয়ে মাথায় ম্যাসাজ করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং চুল মজবুত হয়। এই সময় জেল, হেয়ার স্প্রে বা অতিরিক্ত স্টাইলিং টুল ব্যবহার না করাই ভালো। এগুলো কেমিক্যাল এবং তাপের কারণে চুলের ক্ষতি করতে পারে।


ত্বক বা চুলের যত্ন শুধু বাইরে থেকে নিলেই হবে না, ভেতর থেকেও শরীরকে সুন্দর রাখতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবারই প্রকৃত রূপচর্চার ভিত্তি। প্রতিদিন টাটকা ফল, সবজি, ডিম, দুধ, দই, ডাল, বাদাম খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। ফাস্টফুড, অতিরিক্ত চিনি, সফট ড্রিঙ্ক, প্যাকেটজাত খাবার কম খাওয়া উচিত। পাশাপাশি বাড়িতে রান্না করা খাবার বেশি খেলে হরমোন ব্যালান্স থাকে। পানিও প্রচুর খেতে হবে, কারণ পানিশূন্যতায় ত্বক-চুলের জেল্লা কমে যায়। যথেষ্ট ঘুমাও খুব দরকার রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম মানেই ত্বক সতেজ ও উজ্জ্বল।

ree

আজকের সোশ্যাল মিডিয়া যুগে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা অনেক বদলে গেছে। রিল, ফিল্টার, এডিট করা ছবি দেখে নিজের ত্বক নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা একেবারেই উচিত নয়। ব্রণ হবে, রোদে ত্বক কালচে হবে, একটু দাগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। টিনএজ ত্বক নিখুঁত না হলেও সেটা একেবারেই অপূর্ণ নয়। তাই নিজের ত্বককে ভালোবাসতে শিখো। নিজের স্বভাব, নিজের হাসি, নিজের আত্মবিশ্বাস এগুলোই তোমার আসল সৌন্দর্য। কসমেটিক নয়, স্কিনকেয়ার এটাই ভবিষ্যতের সৌন্দর্য গড়ে।


সবশেষে মনে রাখা জরুরি যে, টিনএজ রূপচর্চা মানেই অতিরিক্ত সাজগোজ নয়, বরং সঠিক অভ্যাস গড়ে তোলা। ত্বক পরিষ্কার রাখা, সানস্ক্রিন ব্যবহার, পর্যাপ্ত পানি পান, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম এসবই প্রতিদিনের রুটিনে রাখলে ত্বক নিজের মতোই উজ্জ্বল ও সুস্থ হয়ে উঠবে। সৌন্দর্য কখনোই শুধু বাহ্যিক নয়; আত্মবিশ্বাস, নম্রতা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন সব মিলেই সত্যিকারের রূপ ফুটে ওঠে। তাই নিজেকে ভালোবাসো, সুস্থ থাকো, প্রাকৃতিক রূপটানকেই ভালবাসো। কারণ সৌন্দর্য মানেই নিজের মতো করে সুন্দর থাকা।

ree

সূর্যোদয়

তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়


--- এ কলকাতার বাইরে না নিয়ে গিয়ে কোন উপায় নেই ।

--- সে আবার কি কথা ! কলকাতার বাইরে নিয়ে যাবি মানে!

--- বাইরে মানে বাইরে , না হলে বাবাকে সুস্থ করা যাবেনা।

--- বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলেই হলো ! সেটা সম্ভব কি করে, বাবা তো সেখানে একা একা থাকতে পারবেনা, সঙ্গে কে যাবে, কে থাকবে বাবার সঙ্গে ?

--- কিছু একটা ভাবতে হবে, কিছু একটা করতে হবে, এভাবে তো ফেলে রাখা যায়না, ঘটনা তো খারাপের দিকেই এগচ্ছে....

--- মানে!

--- মানে আবার কি, কাল তো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়নি ....

--- কি বলছিস !

--- কি আর বলবো , তৈরি হলো, বেরতে যাব, বলল যাবনা , বেরলেই না কি লোকে ছেঁকে ধরবে , ঐ একই প্রশ্ন করবে

--- ঐ একই প্রশ্ন ? কী প্রশ্ন ?

--- ঐ এখন আপনি অভিনয় করেন না কেন...

এবার আর মোবাইলে অপরপ্রান্ত থেকে কোন কথা এলোনা । এপ্রান্ত থেকেও কোন কথা নেই । কয়েক মুহূর্তের বিরতি । তারপর এপ্রান্ত বলল , আমি বললাম গাড়িতে যাবে , গাড়িতে ফিরবে , লোকে তোমায় প্রশ্ন করার সুযোগটা কখন পাবে ! কি বলল জানিস , চেম্বারেও তো কিছু লোক থাকবে , ওরাও তো জিজ্ঞেস করতে পারে , আমি রাগব না হাসব ভেবে পাচ্ছিলাম না , চেম্বারে তারা তাদের পেসেন্ট নিয়ে গেছে তারা থাকবে তাদের চিন্তায় , সেখানে বাবা এখন অভিনয় প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সে নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ তাদের কোথায় ! আমি অনেক বোঝানর চেষ্টা করলাম , কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না , কি বলল জানিস আমি না কি বাবার সমস্যাটা কিছুই টের পাইনা , বাবার দিকে যে চোখটা তাকায় সেই চোখেই না কি ঐ প্রশ্নটা থাকে , তারপর সেই এক কথা , ফিল্মপাড়ার মানুষের এক গভীর চক্রান্ত করছে , ইচ্ছে করে রোল দিচ্ছেনা , এমন কি বাবা যে বেঁচে থাকুক সেটাও চাইছে না , সরাসরি মেরে ফেলতে পারছেনা বলে মানসিক রুগী বানিয়ে দিতে চাইছে ....

ree

ওপ্রান্ত থেকে একটা তীব্র রাগ ভেসে এলো , তুই বললিনা কেন তোমায় মানসিক রুগী বানাতে হবেনা তুমি তো সত্যিসত্যি একজন মানসিক রুগী....

এপ্রান্ত বলল , তুই এইসব কথা শুনেই রেগে যাচ্ছিস আর আমাকে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে এগুলো ফেস করতে হচ্ছে , আমার অফিস আছে , সংসার আছে , ছেলে মেয়ে হ্যাজবেন্ডের জন্য সময় দিতে হয় , আমাকে বাড়ি সামলে অফিস সামলে এখানে এসে বাবাকে দেখতে হচ্ছে , বাবাকে যে আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবো তারও তো উপায় নেই , প্রবাল পরিষ্কার বলে দিয়েছে বাবাকে আমাদের এখানে এনে রাখা যাবেনা , বাবার এখন যা অবস্থা মানে আচরণ তাতে আসপাশের লোক প্রশ্ন করবে আর প্রবালকে এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

--- কথাটা কিছু ভুল বলেনি ।

--- তাহলে বাবাকে সুস্থ করে তুলতে হলে রাস্তা এখন একটাই , কলকাতা থেকে দূরে কোথাও বেশ কিছুদিনের জন্য নিয়ে যাওয়া ।

--- দূরে ?

--- হ্যাঁ এমন কোথাও যেখানে বাবাকে লোকে প্রায় চেনেই না ।

--- না চিনলে সুবিধা কী ?

--- কাল তো বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া গেলনা , তাই রাতে ডক্টর চ্যাটার্জীর সঙ্গে ফোনে কথা বললাম , উনি বললেন আসল সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে জানেন ? উনি তো অত্যন্ত সফল একজন অভিনেতা ছিলেন , একসময় তো ওনার বিশাল সংখ্যক ফ্যান ছিল , তাই যে চোখই ওনার দিকে যে কারণেই তাকাক না কেন উনি মনে করছেন সেই ওনাকে প্রশ্ন করছে উনি এখন অভিনয় করছেন না কেন , আসলে কেউ ওনাকে প্রশ্ন করছেনা , উনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছেন , আর নিজের ভেতর থেকে কোন উত্তর উনি নিজেকে দিতে পারছেন না , কেন ওনার রোল পাওয়া কমে গেল , কেন পরিচালকরা আর আগের মতো ওনাকে ডাকছে না এই নিয়ে কিছু ভাবছেননা , নিজের ভেতরে কোন বিশ্লেষণে যাচ্ছেননা, শুধু মনে করছেন এক সময় উনি যে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন সেটার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে একটা বড়ো রকম চক্রান্ত চলছে , উনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না অথবা চাইছেন না যে এক সময় যেসব চরিত্র উনি পেয়েছেন এখন আর পেতে পারেননা , ওনার পরিচিত বা বন্ধু বলুন এই রকম কয়েকজন অভিনেতার সঙ্গে আমি কথা বলেছি , ওনাকে যে ওনার বয়সের সঙ্গে মানানসই চরিত্রের জন্য ডাকা হয়নি তা নয় , কিন্তু উনি করবেন না , ওনার ধারণা এই সব চরিত্রে তার অভিনয় মানুষ দেখবে না , ওনাকে বোঝানো যাচ্ছে না মানুষ ওনাকে দেখবেনা , চরিত্রটা দেখবে , অভিনয়টা দেখবে , এইসব কথা ওরকম একজন বড়ো মাপের অভিনেতাকে আমি বোঝাই কি করে বলুন তো ! সেটা তো বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ....

ree

একটানা কথা বলে যাওয়ায় দমে একটু ঘাটতি পড়েছিল এই প্রান্তের , তাই ক্ষনিকের বিরতি , তারপর এপ্রান্ত দম টেনে নিয়ে বলল , আমি সব বুঝতে পারছিলাম ডক্টর চ্যাটার্জীর কথাগুলো , আমিও তো কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি , প্রত্যেকে তো ঐ একই কথা বলেছে , বাবার বয়সের সঙ্গে যায় এমন চরিত্রের অফার ওঁরা করেছেন কিন্তু বাবা রাজি নয় , তাই ডক্টর চ্যাটার্জীকে বলেছিলাম এই সব কথা আমি জানি , আপনি সমাধানের কথা বলুন , বলুন কি করলে বাবাকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনা যাবে , উনি বললেন আমি তো আগেই বলেছি , এমন কোন জায়গায় ওনাকে নিয়ে যেতে হবে যেখানে ওনাকে প্রায় কেউই চেনেনা , আমি বলেছিলাম এটা তো আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব , উনি হেসে বললেন দেখুন আপনাদের কি সুবিধা কি অসুবিধা সে তো আপনার বাবার মনোজগৎ জানেনা , এই ক্ষেত্রে যেটা দরকারি সেটাই বললাম , এখন আপনাদের ডিসিশন ....

ওপ্রান্ত খুব চিন্তিত স্বরে কেটে দিলো এপ্রান্তকে , তাহলে....

--- আমি কাল অনেক রাত পর্যন্ত এটা নিয়ে ভেবেছি , তারপর অনেক ভেবে যা পেলাম তা হলো আন্দামান ....

--- আন্দামান ?

--- হ্যাঁ , হ্যাভলক দ্বীপ .....

--- হ্যাভলক ?

--- ওখানে বাবার সিনেমা কেউই দেখেনি এরকমটা নয় , কিন্তু ফ্যান ফলোইং বলে যে ব্যাপারটা থাকে সেটা বাবাকে ফেস করতে হবেনা।

--- কিন্তু বাবাকে ওখানে রাখবি কোথায় ! ওসব জায়গায় তো লোকে বেড়াতে যায় , হোটেলে দু তিনদিন থাকে তারপর চলে আসে , আমরা নয় বাবাকে আরেকটু বেশি রাখলাম , তাই বলে তো মাসের পর মাস রাখা যাবেনা...

--- হোটেলে থাকতে যাব কেন , কতদিন বাবাকে রাখতে হবে তার তো কোন ঠিক নেই , সেটা তো হোটেল সম্ভবই নয় , তা ভাবতে ভাবতে গিরিধারী কাকার কথা মনে এলো।

--- গিরিধারী কাকা ? গিরিধারী ?

--- তোর মনে নেই গিরিধারী কাকাকে ? একাত্তর সালে দোকান ব্যবসা ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন সব ফেলে এপারে চলে এলো , বাবার ছোট পিসির ছেলে....

ree

--- ও হ্যাঁ হ্যাঁ , এপারে এসে বহরমপুরে রিফিউজি ক্যাম্পে ছিল , তারপর দীর্ঘদিন কোথাও পাকাপাকি ভাবে থাকতে পারেনি , তারপর আন্দামানে পুনর্বাসন পেল , সে না কি অনেক জমি ....

--- অনেক জমি কি রে ! সেখানে তো বিশাল রিশর্ট করেছে....

--- শুনেছি অনেক পয়সা করেছে...

--- তা করেছে কিন্তু মানুষটা জীবনে খুব দুঃখ পেয়েছে....

--- দুঃখ কিসের রে , শুনেছি বাংলাদেশে যা ফেলে এসেছিল , তার থেকে অনেক বেশি করে নিয়েছে , সেই সময় না কি

যাদের আন্দামানে পুনর্বাসন দেওয়া হয় তাদের কেন্দ্রের থেকে রাজ্যের থেকে অনেক হেল্প করা হয়েছিল , ফলে প্রতিষ্ঠিত হতে কোন অসুবিধা হয়নি....

এপ্রান্ত ওপ্রান্তকে অধৈর্য হয়ে কেটে দিলো , আমি সেই সব অসুবিধার কথা বলিনি, তোর মনে পড়ে বহরমপুর থেকে গিরিধারী কাকা আমাদের বাড়িতে এলে একটা কথা খুব বলতো .....

--- কী কথা।

--- আমার গাছটাকে তুলে তুলে আর কত নতুন মাটিতে বসাবো , এবার তো শিকড়গুলো পচে যাবে , আর গাছটা থাকবে না ...

--- কি জানি অত মনে পড়ছেনা ....

--- তোর মনে আছে বাবা বলতো এই বাগচী পরিবারের শাখায় শাখায় অভিনয়ের প্রাণ বইছে ...

--- হ্যাঁ বলতো তো।

--- বাবা এই গিরিধারী কাকার সম্পর্কে আমায় অনেক কথা বলেছিলে , গিরিধারী কাকা ব্যবসা সামলেও খুব অভিনয় করতো , ঢাকার প্রফেশনাল মঞ্চেও থিয়েটারে সুযোগ পেয়েছিল , তারপর যুদ্ধ শুরু হলে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসতে হয় , এপারে এসে বহরমপুরে রিফিউজি ক্যাম্পে ওঠে , কোন কাজ নেই , বাজারের বাইরে শাক নিয়ে বসতো , তাও অভিনয় ছাড়েনি , এক পালাগানের দলে যোগ দেয় ,পালা গান গেয়ে রাত দুপুরে ফিরত , আর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ওখানকার এক দীঘির পারে চলে যেত শাক তুলতে , সারাদিন বাজারে শাকের ব্যবসা তারপর দুপুরে একটু ঘুম , বিকেল হতে না হতেই পালাগানের দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তো , বাবা বলতো অবাক লাগে , মানুষ কত রকমের হয় , একজন থিয়েটারে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া লোক পালাগান গাওয়ার জন্য শরীর বিসর্জন দিচ্ছে , তারপর আমাদের কলকাতার বাড়িতে এসে যখন আন্দামানে পুনর্বাসন পাওয়ার কথাটা বাবাকে জানালো মা বলেছিল যাক ভগবান এতো দিনে মুখ তুলে চাইলো , আর রিফিউজি ক্যাম্পে গরু ছাগলের মতো বাঁচতে হবেনা , আমি দেখেছিলাম উত্তরে বাবার ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি , বলেছিল , এতো দিন তো তবু গরু ছাগলের মতো বেঁচে ছিল , এবার তো গিরিধারী আর বেঁচেই থাকবেনা , মা অবাক হয়ে বলছিল সে আবার কি কথা , বাবা বলেছিল একটা কথা বুঝতে পারছনা ! যে লোকটার জীবনে থিয়েটারে অভিনয় বন্ধ হয়ে গেল বলে পালাগান আঁকড়ে ধরলো তার প্রাণ তো বাঁধা আছে মঞ্চে , এই যে এখন আন্দামানে চলে যাচ্ছে ওখানে এইসব পাবে কোথায় ! এখনো সে জায়গা জঙ্গল , কাকে দেখাবে অভিনয় ? কাকে শোনাবে গান ? আর যদি দেখাতেই না পারলো শোনাতে না পারলো একজন শিল্পী মানুষ বেঁচে থাকতে পারে....

ওপ্রান্ত হাসি দিয়ে এবার কেটে দিলো এপ্রান্তকে , তা বাবার কথা কি মিললো , গিরিধারী কাকা তো দিব্যি বেঁচে আছে , শুধু বেঁচে নেই , রমরম করে বেঁচে আছে , বিশাল রিশর্টের মালিক , বহরমপুরের রিফিউজি ক্যাম্পে থেকে , শাকপাতার ব্যবসা আর পালাগান গেয়ে এই জায়গায় পৌঁছতে পারত ...

গভীর শ্বাস ছেড়ে এপ্রান্ত বললো , জীবনে কে যে কোথায় পৌছয় কেউ জানেনা রে দিদি , বাবার কথাই ধরনা , বাবার তো কলকাতায় জন্ম, কলকাতায় বড়ো হওয়া , টালিগঞ্জে প্রতিষ্ঠা , এতো নাম করার পরে তাকে সুস্থ করার জন্য আন্দামানে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে , কেন ? আমাদের পিসিঠাকুমার বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশে , তাই গিরিধারী কাকার জন্ম ওখানে , তাই ওঁর জীবনে এতো কিছু ঘটলো , বাবার তো তা নয় , তবে...

এপ্রান্ত শুধু ওপ্রান্তের জোরে নিঃশ্বাসের শব্দ পেল । কারণ এপ্রান্তের এই যুক্তিকে কেটে দেওয়ার যে কোন জায়গা নেই ওপ্রান্তের। তাই কথার মোড় ঘোরানর জন্য ওপ্রান্ত বলল, তা গিরিধারী কাকার সঙ্গে কি কারুর কোন যোগাযোগ আছে এখন ?

--- তুই ছাড়া এই পরিবারের অনেকের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ আছে , আমার সঙ্গেই আছে , তুই তো ব্যস্ততা দেখিয়ে কারুর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখিস না , আমি তো দশমীর পরে বিজয়া জানিয়ে প্রতিবারই গিরিধারী কাকাকে ফোন করি...

একটা ম্রিয় ' ও ' শুধু ভেসে এলো ওপ্রান্ত থেকে ।

তারপর নীরবতা ।

এপ্রান্ত বললো , ফোন করলেই বলে , তোরা সবাই মিলে আমাদের এখানে কিছুদিন থেকে যা ...

--- তা বেশ ভালো তো , এবার বাবাকে নিয়ে কিছুদিন ওখানে থেকে আয় ....

--- তুই যাবিনা ?

--- তুই আগে যা , তোকে তো ফিরতে হবে , তুই এলে আমি যাবো।

মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে আসার পরে কথোপকথন শেষ হলো । এতক্ষন এপ্রান্ত কথা বলছিল , মানে কলকাতা , স্বামী সংসার নিয়ে রমলা কলকাতায় , আর ওপ্রান্ত মানে পুণা, স্বামী সংসার নিয়ে অমলা সেখানে । সফল অভিনেতা অম্বরীশ বাগচীর দুই কন্যা । অমলা বড়ো , রমলা ছোট । অম্বরীশের স্ত্রী গত হয়েছেন বছর দুয়েক । তাই গল্ফগ্রীনের বিশাল ফ্ল্যাটে অম্বরীশ একা । যদিও কাজের লোক আছে তিনজন । অম্বরীশের স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে মোটামুটি চলছিল । কিন্তু এই মাস ছয়েক ঘটনাটা ঘটার পরে অবস্থা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে । অম্বরীশের কথানুসারে কাজের লোকেরাও তার দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকায় । মানে সেই প্রশ্ন । ফলে রমলার কাজ অনেক বেড়েছে , তার কাজ না বেড়ে যে কোন উপায় নেই । রমলা যে কলকাতায় । অমলার শুধু ফোন , ফোন করে খবর নেওয়া । যেমন আজ করেছিল । আর এদিকে রমলার পাহাড়প্রমাণ ভাবনাচিন্তা ।

আজ এখন এতো ভাবার শেষে সুড়ঙ্গের ওদিকে সরু একটা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে বলে কিরকম একটা স্বস্তি উঠে আসছে রমলার বুকের মধ্যে। দীর্ঘ কথোপকথনের শেষে রমলার আশান্বিত শরীরে দ্রুত ঘুম চলে এলো ।

।। দুই ।।


ree

বাবার সঙ্গে রমলার প্রায় চারদিন কেটে গেছে হ্যাভলকে । এই কদিনে দ্বিপের প্রায় অর্ধেকটা মুখস্ত হয়ে গেছে রমলার l গিরিধারী কাকার এই ' স্বপ্নসুধা ' রিশর্ট হ্যাভলক দ্বীপে রাধানগর বিচের কাছে । রিসর্ট থেকে বেরিয়ে মিনিট পনেরো হেঁটে গেলে সমুদ্রতট । আর ঠিক এর উল্টো দিকে বেশ কিছুটা গেলে গোবিন্দনগর বিচ , বিজয়নগর বিচ , কালাপাত্থর বিচ । ওদিকটায় সমুদ্রের ওপারে মায়নমার , থাইল্যান্ড। কিন্তু রমলার এতো কিছু মুখস্থ হয়ে গেলে হবে কি , এই সব জায়গায় বাবাকে একদিনও নিয়ে যাওয়া যায়নি । রিশর্টের বাইরে বেরতে চরম অনীহা । বাবাকে সরাসরি এই বিষয় কিছু জিজ্ঞেস করেনি রমলা। বুঝেছে সেই পুরনো সমস্যা । গিরিধারী কাকাকে সব বলেছে । উত্তরে গিরিধারী কাকা স্মিত হেসে বলেছে কোন চিন্তা করিস না , এখানে যখন এসে গেছিস সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ।

সমাধান হওয়া তো দূরের কথা কাল থেকে সেটা বেড়ে গেছে । কাল সকালে চা খাওয়ার সময় গিরিধারী কাকা বাবাকে বলেছিল খুব সকলের দিকে তো তুই বাইরে বেরতে পারিস , তখন লোকজন বিশেষ থাকেনা , মানে তুই যে ভয়টা পাচ্ছিস , তুই যে অস্বস্তিতে ভুগছিস , সেটা ঘটার সম্ভাবনা তো কম ....

ব্যাস অম্বরীশের মুখের ওপরে একটা শাটার নেমে এলো । দু চোখে কোন আলো নেই । আলোর আকাশ হটাৎ করে মেঘলা । বাবার কন্ঠস্বর শুনে রমলার মনে হলো পাথর যেন কথা বলছে , বাবা বলল , ভয় ? অস্বস্তি ? তার মানে তুই বলতে চাইছিস এটা ঘটছে না , এটা আমি মনে করছি !

গিরিধারী কাকা স্মিত হেসে পরিবেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো , আমি সেকথা বলিনি , ধরলাম তোর কথাই ঠিক , কিন্তু লোকে একটা প্রশ্ন নিয়ে তোর দিকে তাকাচ্ছে বলে তুই নিজেকে খাঁচায় বন্দী করে ফেলবি ! এই যে চার পাঁচদিন এখানে থাকছিস , একদিনও সমুদ্রের পারে গেছিস ? আর এখন তুই যেখানে আছিস সেখানে এই দেশের কি এই পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে মানুষ আসে এখানকার সমুদ্র দেখবে বলে , এখানকার সূর্যোদয় দেখবে বলে , আর সেখানে তুই ঘর থেকে বেরচ্ছিস না !

রমলা দেখেছিল বাবার অভিব্যক্তি আবার পাথর । কোন উত্তর নেই ।

গিরিধারী কাকা হাল্কা হেসে বলেছিল , মানুষ নয় তোকে প্রশ্ন করছে , কিন্তু এই আকাশ , এই সমুদ্র , এই গাছপালা , এই প্রকৃতি , এরা তো তোকে প্রশ্ন করছে না , এদের কাছে কেন যাচ্ছিস না ? এই ভাবে খাঁচায় নিজেকে বন্দী করলে তুই কিন্তু শেষে একটা খাঁচার প্রাণী হয়ে যাবি....

সেদিন সকালের চাপর্বের পরেও বাবার বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করেনি।উল্টে

সেদিনের পরে দুটো দিন বেশ থমকে ছিল অম্বরীশ । রমলা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। বাবা বাইরে বেরনো বন্ধ করেছে , এখন যদি কথা বন্ধ করে দেয় তবে মানুষটাকে সুস্থ করবে কি করে! জানাই তো যাবেনা ভিতরে কি চলছে ।

আজ সকালে অদ্ভুত ভাবে সমস্যার একটু হলেও সমাধান হয়েছে । আসলে কালকে থেকে একটা অসহ্য নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে এখানে । গিরিধারী কাকা আকাশের দিকে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে বলেছিল আগামী কয়েকটা দিন খুব ভাসাবে । রমলার আন্দামানের আবহাওয়া খুব একটা জানা নেই । তাই ও কথায় খুব একটা চিন্তিত হয়নি । কিন্তু এই ঘন মেঘলা আবহাওয়া তৈরি হওয়ার পর থেকেই একটা অসহ্য গরম লাগছে । আর থেকে থেকেই বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে । এটা লোডশেডিং নয় , গিরিধারী কাকা বলছিল এই আবহাওয়ায় এটা স্বাভাবিক , এই আবহাওয়ায় সোলার প্ল্যান্টগুলো কাজ করেনা , সবাই লাইনের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে , সে যাই হোক বিদ্যুৎ না থাকার সময়টা অসহ্য লাগছে , বিশেষ করে রাতে ঘুমের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরে হটাৎ করে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে যখন , তখন খুব কষ্ট হচ্ছে ।

তেমনি গত রাতে , ঠিক গত রাতে নয় , বলতে গেলে আজই ভোররাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরে কষ্টটা চোখ বুঁজে রমলা নিজের ভেতরে নিয়ে নিচ্ছিল । পাশের খাটে অম্বরীশ তরাক করে উঠে বসে বলল , রোমু একটু বাইরে যাবি , নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ...

রমলা একটা হাল্কা বিস্ময় নিয়ে বলেছিল , বাইরে যাবে...

--- হ্যাঁ ।

রমলা বুঝেছিল কষ্টটা হয়তো বাবার ঠিকই হচ্ছে , কিন্তু বাবা বাইরে যেতে চাইছে কারণ বাইরে আলো এখনো ভালো করে ফোটেনি। কারণটা যাই হোক , সুযোগটা হাত ছাড়া করলে চলবেনা । তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছিল রমলা । অম্বরীশকে তৈরি করে দিতে হয়নি , নিজেই তৈরী হয়ে যায় ।

একটু একটু করে আকাশ ছিঁড়ে আলো এসে পড়ছে এখন চারপাশের ওপরে । দূরে আকাশের গায় আলো নয় , আলোর একটা আভা লেগে আছে । পথের দুপাশে সারি দিয়ে নারকেল গাছ । গাছের পায়ের কাছে ঢাউস হয়ে গুল্ম। বাতাসে ভেসে আসছে হাল্কা একটা সুন্দর গন্ধ। কাছেই কোথাও নিশ্চই ধুপগাছ আছে। গাছটার কথা গিরিধারী কাকার কাছ থেকে জেনেছে রমলা ।

অম্বরীশের দিকে তাকাতে রমলা দেখলো বাবার মুখ খুব স্বাভাবিক । সব সময় অস্বস্তির একটা কুঞ্চন লেগে থাকে তার একটুও নেই এইমুহূর্তে। চারপাশের প্রকৃতি এর কারণ হতে পারে , আবার এখন রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে তার জন্যেও হতে পারে ।

ree

বিচে নেমে এলো দুজন । আর তখনই যেন সবে আলো ধরতে থাকা আকাশ ভেদ করে হয়তো বা পায়ের নীচের সাদা বালির চর ফুঁড়ে বা সামনের ঐ পান্না রঙের উত্তাল সমুদ্র থেকে ভেসে এলো , ' আমার হৃদয় শুধু এক শাসনই জানে , সে শাসন শুধু স্নেহের শাসন ' । এমন জলদগম্ভীর , শ্রবণ ভেদ্য স্বর কখনো শোনেনি রমলা , বাবার মুখের দিকে তাকাতে দেখলো বাবাও চমকে গেছে , কিরকম যেন মোহিত।

' এ কি মাটি থেকে একটা কালো ধোঁয়া আকাশে উঠছে , এ কি সমস্ত আকাশ ছাইবর্ণ রূপ নিলো ! এ কি হচ্ছে ! এ কীসের সংকেত জাহানারা ? '

সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসা উদ্দাম বাতাসের তোড়ে শব্দ যেন মাঝেমাঝে ভেসে যাচ্ছে অন্য দিকে । তখন শোনা যাচ্ছেনা । বাতাসের অভিমুখ পাল্টালে আবার শোনা যাচ্ছে ।

অম্বরীশ শিশুর মত বিস্ময় নিয়ে রমলার দিকে তাকিয়ে বললেন , এ তো দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের ' শাহজাহান ' নাটকের সংলাপ ! এই রাধানগর বিচে কে বলছে এই সংলাপ ! কাকে শোনাচ্ছে ! তুই আমি ছাড়া এখানে তো আর একটা লোকও নেই !

রমলা বলল, হ্যাঁ তা তো ঠিক , তারপর বলল , কন্ঠ কি অসাধারণ না , যেন নাভি থেকে উঠে আসছে , যেমন গম্ভীর তেমন মিষ্টি!

অম্বরীশের কৌতূহল অম্বরীশকে দিয়ে কথা বলাতে পারলনা । কে বলছে এই সংলাপ জানার জন্য পারের বালির ওপর দিয়ে শিশুর মতো পদক্ষেপে টালমাটাল পায়ে দ্রুত এগতে থাকল সামনের দিকে।

একটা ঝুপসি সবুজে আড়াল হয়ে আছে একটু দূরের সামনেটা। সেই আড়ালটা পেরিয়ে যেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল বাবা আর মেয়ে ।

এ কি এ যে গিরিধারী কাকা ! সকলের প্রথম সূর্যের দিকে তাকিয়ে সংলাপ বলে চলেছে ।

অম্বরীশ স্থির থাকতে পারল না। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ধরল গিরিধারীর দুটো হাত । অবাক হয়ে বলল, কাকে শোনাচ্ছিস তোর এই সংলাপ ? কে দেখছে তোর অভিনয় ?

গিরিধারী হাসল , কেউ দেখবে বলে তুই অভিনয় করিস ?

--- মানে !

--- এক সময় তো আমি অনেক অভিনয় করেছি , সে কথা তো তুই জানিস , প্রফেশনাল স্টেজেও তো সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু সকলের তো তোর মতো কপাল হয়না , তোর কলকাতায় জন্ম , কলকাতায় বেড়ে ওঠা , কলকাতায় কাজ , কলকাতায় প্রতিষ্ঠা , আমি তো খড়কুটোর মতো ভেসে বেরিয়েছি, এখানে যখন এলাম তখন নাটক অভিনয় এইসবের কথা ভাববো কি ! ঘরবাড়ি মানুষজনই তো বিশেষ ছিল না , কিন্তু ভিতরে অসম্ভব একটা তেষ্টা পেত , সংলাপ বলার তেষ্টা , আস্তে আস্তে বসতি বাড়লো , লোকজন এলো , যে দুচারজন আমার অভিনয়ের কথা জানতো তারা আমার এই সংলাপ বলা নিয়ে মজা করে বলতো লোকটা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে , মানে আবার স্টেজে ফেরার চেষ্টা , আমি ওদের কোনদিন বলতে পারিনি চেষ্টা নয় , চেষ্টা নয় , এটা একটা তেষ্টা , বুক ফেটে যাওয়া তেষ্টা...

অম্বরীশ কোন কথা বলছে না । মানে পারছেনা । দুটি ঠোঁটের মধ্যে একটা ক্ষীণ ব্যবধান ।

গিরিধারী স্মিত হেসে বলল , তোর তেষ্টা পায়না ?

--- কীসের তেষ্টা !

ree

--- এই যে এখন অনেকদিন অভিনয় করিস না , তোর কাছে রোল আসে , পছন্দ হয়না বলে নিসনা , মনে করিস দর্শক তোকে নেবেনা , ঠিক আছে , তুই প্রতিষ্ঠিথ অভিনেতা তুই এ ভাবে ভাবতেই পারিস , কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো তোর অভিনয় করাটা হলো না , এর জন্য একটা তেষ্টা অনুভব করিস?

এবারেও অম্বরীশ কোন কথা বলতে পারছেনা ।

গিরিধারী তেমনই স্মিত হেসে বলল প্রতিদিন সকালে এসে যখন দেখি সূর্য উঠছে আমি প্রতিদিনই অবাক হই, প্রতিদিন সূর্য সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে আবার পরের সকালে উঠছে , কোন খামতি নেই , উদিত হওয়ার অনন্ত তেষ্টা....

অম্বরীশ অবাক হয়ে তাকাল আকাশের দিকে । প্রথম সূর্য সোনা মাখিয়ে দিচ্ছে আকাশে ।অম্বরীশ এমন ভাবে দেখছে যেন সূর্য এই প্রথম দেখছে।

গিরিধারী অম্বরীশের খুব কাছে চলে এলো , হাল্কা করে হাত রাখল অম্বরীশের কাঁধে , বলল, একটা কথা বলবো , প্রশ্নটা কেউ তোকে করছেনা , প্রশ্নটা তুই নিজেই নিজেকে করছিস , আর উত্তরটা পাচ্ছিস না , উত্তরটা কি জানিস , তোর তেষ্টাটা মরে গেছে...

অম্বরীশ কিরকম যেন ককিয়ে উঠল , সজোরে কেউ যেন তার বুকের মাঝখানে ধাক্কা মেরেছে।

গিরিধারী তেমনি স্মিত হাসল , বলল , রোজ সকালে বিচে আয় , দেখবি তেষ্টাটা আবার জেগে উঠেছে ।


Comments


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page