এ যাবৎ এই মানুষটিকে নিয়ে কম চর্চা হয়নি। দেশ-বিদেশের অসংখ্য গুণী পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ সত্যজিৎ সম্পর্কে সব বলে ফেলেছেন। নতুন কিছু বলার নেই হয়ত বা। কিন্তু বিশ্লেষণ, অনুভব—সে তো অনেক নতুনেরই জন্ম দেয়। তাই এই বড় মানুষদের চর্চা ও চর্যা চলতেই থাকে। তথ্য হয়ত জানা। ভাবনা ও বিশ্লেষণী ধারা বিবরণী ব্যক্তি বিশেষে পালটে যায়। হয়ে ওঠে নতুন আরেক ধারাভাষ্য। নতুন আরেক সত্যজিৎ। আমার সত্যজিৎ। তাঁকে স্মরি বারবার। সমীর চট্টোপাধ্যায়

ওঁর সঙ্গে আমার তেমন অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। উনি যখন এই জাগতিক পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তখনও আমি বানিজ্যিক কোনও পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হতে পারিনি। লিটল ম্যাগাজিন করি। সঙ্গে আঞ্চলিক সাময়িক পত্রের সম্পাদনায় সহযোগী। ফলে সেই সময়কার সংস্কৃতির দাদা ও জ্যাঠামশাইদের হাত ধরে সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে আসা। তেমনই এক সংস্কৃতির দাদা, অভিনেতৃ সংঘের অন্যতম সদস্য সমর মিত্রের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে আসা। অনেক লোকের মধ্যে আমি একজন। লোক নয়, রথী মহারথী। ঠিক উপলক্ষ কী ছিল, আজ আর মনে নেই। সেদিন কাছ থেকে দূরদর্শন ঘটেছিল। পরে যখন ওঁকে চিনেছি, খানিকটা জেনেছি তখন মনে হয়েছে উনি তো একজন সংস্কৃতির বনস্পতি।
যদি এক কথায় প্রশ্ন করা যায়, কে এই সত্যজিৎ রায়? অনেক পরিচিতিতে সমৃদ্ধ সত্যজিৎ রায়।চলচ্চিত্র পরিচালক, সঙ্গীতকার, চিত্রনাট্যকার, আলঙ্কারিক, কবি ও লেখক। সব ক্ষেত্রেই যথেষ্ট প্রশংসিত হলেও সত্যজিৎ রায়ের প্রথম এবং শেষ পরিচয় কিন্তু বাংলা সিনেমার পরিচালক হিসেবে। ভারতের একমাত্র অস্কারজয়ী তিনি। তিনি কী কী করেছেন, তা আমরা প্রায় সবাই-ই জানি। কখনওই তিনি বাণিজ্যকে সর্বস্ব করে সিনেমা তৈরি করেননি। তার সব ছবিতেই ধরা পরে রুচিশীল নান্দনিক ভাবনা।
তিনি মোট আটাশটি পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের ছবি করেছেন। তথ্যচিত্র বানিয়েছেন পাঁচটি।দূরদর্শনের জন্য তিনটি। এছাড়া অন্যের ছবিতে সত্যজিৎ রায় কখনও চিত্রনাট্যকার, কখনওবা ধারাভাষ্যকার হিসেবেও কাজ করেছেন। দুই বিশ্ববন্দিতের মধ্যে ছিল নিবিড় সুসম্পর্ক। রবি ঠাকুরের থেকে সত্যজিৎ রায় ষাট বছরের ছোট। গুরুদেবের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম দেখা। সত্যজিৎ তখন খুবই ছোটো। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতেই উত্তরায়ণে যাওয়া। সে সময় ছোট্ট সত্যজিতের ইচ্ছে হল, অটোগ্রাফ নেওয়ার। বালক সত্যজিৎ ওই বয়সেই জানতেন, রবীন্দ্রনাথ কে। তাই ওঁর অটোগ্রাফ সংগ্রহের খাতায় রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ নেওয়ার ইচ্ছে। বালক সত্যজিৎ রায়কে ‘মানিক’ নামেই চিনতেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবির সামনে কিছুটা ইতস্তত।অটোগ্রাফের খাতাটা নিয়ে দাঁড়ালেন। কবিগুরু দেখলেন। পরম স্নেহে কাছে টেনে নিলেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, খাতা নিয়ে সে কেন এসেছে? ছোট্টো মানিক খাতাটা এগিয়ে দিয়ে তাঁর ইচ্ছের কথাটা জানালেন। কবি তাঁর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর পরম স্নেহে বললেন, ‘এটা থাক আমার কাছে। কাল সকালে এসে নিয়ে যেও।’ বালক সত্যজিৎ মাথা ঝুঁকিয়ে চলে গেলেন।

কবিগুরুর আশীর্বাদ নিতে মানিক পরদিন এলেন উত্তরায়ণে। টেবিলের ওপর চিঠি-পত্র, খাতা-বইয়ের ডায়েরির পাহাড়। তার পেছনে বসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মানিককে দেখতে পেয়েই তাঁর ছোট্টো বেগুনি রঙের খাতাটি বের করে সত্যজিতকে দিলেন। মা সুপ্রভা রায়ের দিকে চেয়ে কবিগুরু বললেন, ‘এটার মানে ও আরেকটু বড়ো হলে বুঝবে।’ খাতা খুলে বালক সত্যজিৎ আট লাইনের একটি কবিতা দেখল। ভুবনজয় করা সেই কবিতা। বিশ্বকবির ঘর থেকে বেরিয়ে উত্তরায়ণের সামনের বিশাল আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে আবৃত্তি করছেন মানিক-
‘বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়েছে সিন্ধু।/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।’
সেই প্রথম সত্যজিতের জীবনে রবির ছটা পড়ল। অদ্ভুত বিষয় হল, সত্যজিৎ রায় যার জন্য জগত খ্যাত, সেই সিনেমা করার প্রেরণা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ। ‘পথের পাঁচালী’ সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি।‘পথের পাঁচালী’ রবীন্দ্র-উত্তর কথা সাহিত্যিক, ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগ্রজ বিভূতিভূষণের কাহিনি। অনেকে বলেন, বিভূতিভূষণের কাহিনিই নাকি সত্যজিতের প্রথম পছন্দ ছিল।কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে চলার পথ দেখিয়েছেন। ইতিহাস বলে সে কথা।
১৯৪৬ সাল। ডি.জে.কিমারে কাজ করছেন তখন। সেই সময়ই তিনি ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। কিন্তু কোনও কারণে সেই ছবি করা সম্ভব হল না। সেই সময় তাঁকে ভাবায় ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বইয়ের অলঙ্করণ। এরই ফলশ্রুতি ‘পথের পাঁচালী’ ছবি।
এই ছবি নিয়েও নানা সমালোচক নানা কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেন, বিভূতিভূষণের উপন্যাসটাই ‘পথের পাঁচালী’ ছবির প্রত্যক্ষ রুপ। অথচ উপন্যাসটা পড়লে অপু-দুর্গার যে অনাবিল স্বপ্নময়তা পাওয়া যায়, সেটা ছবিতে কিন্তু একদম নেই।

সত্যজিৎ সিনেমার প্রয়োজনে যেসব ঘটনা, চরিত্র রাখা প্রয়োজন মনে করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’তে সেটাই রয়েছে। প্রয়োজনে অনেক ঘটনা, চরিত্র সংযোজনও করেছেন তিনি। বাদও দিয়েছেন অনেকটা।‘পথের পাঁচালী’তে সত্যজিৎ মূল উপন্যাসের উনত্রিশ পরিচ্ছেদের কিছুটা পর্যন্ত নিয়েছেন। ছবিতে যতটা নেওয়া হয়েছে, বাদ গেছে তার অনেক বেশি। ইন্দিরা ও দুর্গার ট্র্যাজেডি ধরে অপুর মতো এই ছবিতে অপরাজিত সত্যজিৎও। বিশ্ব চলচ্চিত্রে অনেক বড় বড় পরিচালক এসেছেন, তাঁদের সৃষ্টি মানুষ মাথায় করে রেখেছেন। ফেদেরিকো দোমেনিকো মার্সেলো ফেলিনি, ডেভিড ফিঞ্চার, জেমস ক্যামেরন, পিটার জ্যাকসন, স্টিভেন স্পিলবার্গ, ক্রিস্টোফার নোলান। আপনারা যারা বার্গম্যানের ‘সেভেন্থ সিল’ ছবিটা দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে শেষ দৃশ্যের কথা। মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলার দৃশ্য কিংবা ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’র শুরুর দৃশ্যটিও যেমন ক্লাসিক, ঠিক তেমনই সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’-তে অপু-দুর্গার কাশফুলের বন পেরিয়ে রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার দৃশ্যও আজ ঐতিহাসিক, আইকনিক। কোনও কোনও জায়গায় যেন সত্যজিৎ কোথাও এগিয়ে। আপনাদের আবারও বলি, অনেক পণ্ডিত, ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু আমি আমার উপলব্ধিটা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি মাত্র। আমি পণ্ডিত নই। কিন্তু আমার দেখা, আমার সত্যজিৎ আমার মত। এতে কারোর পছন্দ নাও হতে পারে। নানা বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু কেন উনি সেরা পরিচালক, তা আমার চেতনায় যেভাবে ধরা পড়েছে, তাই-ই বলছি।
‘অপরাজিত’(১৯৫৬)ছবিতেও কিন্তু বিভূতি ভূষণের উপন্যাসের স্বপ্নময়তা নেই। চিহ্নিত হয়েছে সর্বজয়ার সঙ্গে অপুর মধুর অথচ নির্মম সম্পর্কের স্বরূপ। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে ‘অক্রুর সংবাদ’ থেকে ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের নবম পরিচ্ছেদের ঘটনাসমূহ-ই এই ছবিতে স্থান পেয়েছে। পরিমার্জিত হয়েছে, বোর্ডের পরীক্ষার অপু জেলার মধ্যে প্রথম (উপন্যাসে) হলেও সত্যজিৎ রায় দ্বিতীয় করেছেন। কলা নয়, ছবিতে অপু বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে গেল। সর্বজয়ার মৃত্যুর পর মনসাপোতা গ্রামে শ্রাদ্ধ করার পরিকল্পনা করলেও ছবিতে সে দাদুকে জানিয়েছে মাতৃশ্রাদ্ধ করবে কালীঘাটে। দুটো ছবিতেই বিভূতিভূষণ ও সত্যজিতের অপুর মধ্যে বড্ড দুরত্ব লক্ষ করা যায়। তবে হ্যাঁ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সত্যজিৎ রায় খুব জানতেন। কাছ থেকে চিনতেন। ভালো লাগত তাঁর উপন্যাস। তাই তো ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’-তে দুই স্রষ্টার সৃষ্টি ভাবনার খানিক দুরত্ব থাকলেও ‘অপুর সংসার’-এ দুজন যেন মিশে গেছেন এক মোহনায়।
সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’(১৯৫৯)-এ আমরা পেলাম বিভূতিভূষণের অপুকে। অপরাজিত উপন্যাসের শেষাংশ নিয়েই এর চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছিল। এখানেও সত্যজিৎ উপন্যাসের ঘটনাবলীকে অন্যভাবে সাজিয়েছেন। অপুকে তিনি সম্পূর্ণরূপে নগরকেন্দ্রিক করেছেন। ফলে মনসাপোতায় নয়, অর্পণা ও অপুর ঘর সংসারের ছবি দেখতে পাই মূলত কলকাতায়। উপন্যাসের পুলু, ছবিতে কিন্তু বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার। রাজশাহির জেলে থাকার ঘটনা যদি সত্যজিৎ এই ছবিতে রাখতেন, তবে বোধহয় অপুর কাছে পুলুর বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকটাই খাটো হত। অপুর স্কুলে কাজ করার প্রসঙ্গ তো একদমই নেই ছবিতে। তাঁর লেখা উপন্যাসের পাতাগুলোও একে একে মহাকালে বিসর্জন দিয়েছেন সত্যজিৎ| অপু অপর্ণার দাম্পত্য প্রেমের করুণ পরিণতি হলেও জীবনবোধে উজ্জ্বল এই ছবিটি। অপুর বিবাহপর্ব তো বাঙালি জীবনের শাশ্বত অঙ্গ।

রবীন্দ্রনাথ একসময় বলেছিলেন যে, চলচ্চিত্রের একটা নিজস্ব ভাষা দরকার। ‘পথের পাঁচালী’ ছবি থেকেই সেই ভাষা পেল বাংলা সিনেমা। চিত্রনাট্যে সাহিত্য গুণ থাকবে, আবার তা পড়ে সিনেমার স্বাদ পাওয়া যাবে। সত্যজিৎ রায় যখন চিত্রনাট্য রচনা করতেন, তখন সংলাপের পাশেই ছবি আঁকতেন, নোটেশন তৈরি করতেন। ছোট ছোট স্কেচ দিয়ে দৃশ্যপট তৈরি করতেন। খুব কম পরিচালকের চিত্রনাট্যে পাতায় এমনটা দেখা যায়। চিত্রনাট্য তৈরির সময়ই তিনি ছবি তৈরির প্রায় নব্বই ভাগ কাজ সেরে রাখতেন। সেটা চরিত্র, বিষয়, সঙ্গীত—সবক্ষেত্রেই তা হত।
বাংলা সিনেমার বেশিরভাগ পরিচালকদের শৈল্পিকভাবনা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে ভাবাতো। ওই পরিচালকদের শিল্পবোধের অভাব রবীন্দ্রনাথকে পীড়িত করেছিল। এই বিষয়ে নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির অনুজ মুরারী ভাদুড়িকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন তিনি। চিঠিতেই তিনি সিনেমার শিল্পরূপ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।বলেছিলেন, ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ। এই চলমান রূপের সৌন্দর্য ও মহিমা এমন করে পরিস্ফুট করা উচিত, যা কোনও বাক্যের সাহায্য ব্যতীত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে। সুরের চলমান ধারায় সঙ্গীত যেমন বিনা বাক্যেই আপন মাহাত্ম্য লাভ করতে পারে, তেমনই রূপের চলৎপ্রবাহ কেন একটা স্বতন্ত্র রসসৃষ্টিরূপে উন্মোচিত হবে না? হয় না কেবল সৃষ্টিকর্তার অভাব এবং অলস জনসাধারণের মূঢ়তায়, তারা আনন্দ পাবার অধিকারী নয় বলেই চমক পাবার নেশায় ডোবে। রবি ঠাকুরের এই ভাবনারই যেন প্রতিফলন দেখতে পেলাম ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের দীক্ষায় যেন দীক্ষিত হলেন সত্যজিৎ। রাবিন্দ্রিক শিল্পরূপের অত্যাধুনিক পথেই যেন সত্যজিৎ চালিত হলেন।
দেখবেন ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে দারিদ্রতা আছে। কিন্তু কখনওই তা দেখা বা ভাবের জগতে আচমকা আঘাত হানেনি। মানবিক বোধের সহ্যের শেষ সীমাও লঙ্ঘন করেনি। মানবিক রুচির দৈন্য প্রকাশ করেনি। শুধু ‘পথের পাঁচালী’ই বলি কেন, ওঁর সব ছবিতেই, সব কাজেই এই নান্দনিক বোধের প্রকাশ দেখতে পাই।
আরেকটা ছবির কথা প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়। ছবি ‘অশনি সংকেত’(১৯৭৩)। ছবির শুরুতেই প্রকৃতির আনন্দময়তার মধ্যে আকাশজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। সত্যজিৎ যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতাকে ধরতে বিভূতিভূষণের কাহিনিকে ধীরে ধীরে বিকশিত করেছেন। মূলত হাহাকারের তীব্রতাকে ধরতে তিনি রঙের ব্যবহার করেছেন। তাই তো গঙ্গা ও অনঙ্গ ছবির শেষ দৃশ্যে নিজস্ব নিরাপত্তা হারিয়ে মৃত্যু মিছিলের সামনে দাঁড়িয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘অপরাজিত’র মতো এই ছবিতেও সহজ সরল মানুষের দল সহজভাবে বাঁচার জন্যে পথে বেরিয়েছে।

আপনারা যারা ক্রিস্টোফার নোলান-এর ছবি দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ওঁর কাজ একটু অন্যরকম। সাধারণের বুঝতে একটু অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু একই সাথে এটাও বলতে হবে যে, ওঁর ছবিতে অসাধারণ গল্প শৈলী আর ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের মিশ্রণ তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। ভাবুন তো ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এর মতো এমন ছবি কটা হয়েছে? সত্যজিৎ রায়ের কাজ ও তাঁর ভাবনাও খুব সরল পথে হয়ত চলে না বা সাধারণের বুঝতে হয়ত কোথাও একটা অসুবিধে হয়, তথাপি বৌদ্ধিক ভাবনা ও শিক্ষিত দৃষ্টি নিক্ষেপে বোঝা যায়, তিনি আর পাঁচ জনের থেকে কোথায় আলাদা।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি কাহিনি নিয়ে সত্যজিৎ রায় তৈরি করলেন দুটি ছবি। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এই দুটি ছবির আসন পাকা হয়ে আছে। ‘জলসাঘর’(১৯৫৮)ও ‘অভিযান’(১৯৬২)।সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের কাহিনি ‘জলসাঘর’।
তারাশঙ্করের ‘জলসাঘর’ গল্পটি বাঙালি জমিদারদের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে লেখা। গল্পটি পরে সত্যজিৎ বাবুর খুব পছন্দ হয়ে যায়। চিত্রনাট্যও তৈরি করে ফেললেন। কিন্তু সমস্যা হল লকেশন নিয়ে। এ তো যে সে বাড়ি হলে চলবে না। ‘জলসাঘর’-এর আদলে কোনও রাজবাড়ি খুঁজে না পেলে শুটিং হবে কি করে? আর এ তো যে সে পরিচালক নয়! একটা সেট বানিয়ে, বা যেমন তেমন বা ওর কাছাকাছি কোনও বাড়িতেই চিত্রনাট্যের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে ছবিটা বানিয়ে ফেলবেন। তা তো হওয়ার নয়। পেতে গেলে তেমন কিছুই পেতে হবে। অবশেষে মুর্শিদাবাদের নিমতিতার অন্দরমহল দেখে পছন্দ করেছিলেন।
জীর্ণ প্রাসাদের শ্বেত পাথরের সিঁড়ি বেয়ে বৃদ্ধ জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের হাতের কারুকার্য মন্ডিত লাঠিটি গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে এক নব্য উঠতি বিত্তশালী মহিম গাঙ্গুলির বাড়ি থেকে ভেসে আসছে সারেঙ্গীর আওয়াজ।শেষে জলসাশেষে সবাই চলে যেতে একে একে যখন বাতি নিভছে আর অন্ধকার ঘনাচ্ছে তখন দেওয়াল জোড়া বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নায় বিশ্বম্ভর খুঁটিয়ে দেখছেন তাঁর শেষ হাসি হাসা মুখটা।তিনি নিঃস্ব হয়েছেন কিন্তু মহিম গাঙ্গুলির উঠতি বড়লোকি মেজাজকে ঢিট করেছেন।যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে পরিবর্তনশীল সমাজের বৈপরীত্যকে তুলে ধরার জন্য মুর্শিদাবাদের নিমতিতা জমিদারবাড়িকে বেছে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। এখানে সত্যজিৎ রায় ব্যতিক্রম।বাড়িটা বিরাট প্রাসাদের মতো।গঠনে দোতলা হলেও আকৃতিতে অনায়াসে এখনকার চারতলা বাড়ির সমান। বড় বড় থাম আর নক্সাকাটা জাফরি সমন্বিত পুরানো।
কেন সত্যজিৎ রায় এই বাড়ি বাঁচলেন। একসময় জাঁক-জমকপূর্ণ দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হতো এই জমিদার বাড়িতেই। প্রতি বছর উৎসবে যাত্রা থিয়েটারের আসর বসতো নিমতিতায়। কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পী ও সাহিত্যিকদের নিমন্ত্রণ থাকতো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসত পুজো দেখতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে তৎকালীন জমিদার মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ‘নিমতিতা হিন্দু থিয়েটার’ নামে এক নাটকের দল প্রতিষ্ঠা করেন। তৈরি করেন নাট্যমঞ্চও। নিমতিতা মঞ্চের প্রথম নাটক গিরিশচন্দ্রের ‘নল-দয়ময়ন্তী’।পরবর্তীকালে ‘শঙ্করাচার্য’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘চৈতন্যলীলা’. ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘সাজাহান’, ‘নর-নারায়ণ’, ‘ভীষ্ম’, ‘আলীবাবা’ প্রভৃতি প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে। এইসময় নিমতিতা বাংলার সংস্কৃতি ও নাট্যচর্চার এক নতুন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বাড়িটির উঠোনে প্রবেশ করতেই বনেদিয়ানার ছবি যেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে৷ কানে ভেসে আসে শঙ্খধ্বনি, উৎসব, পার্বণে লাল পেড়ে শাড়ি পরা রমণীদের কলকাকলি, আরামকেদারায় বসে রাশভারি গলায় গৃহকর্তার হুকুম জারি- সব, সব কিছু৷ কানে ভেসে এল সারেঙ্গীর আওয়াজ৷ চারিদিকে যেন হৈ হৈ রব৷পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে নিমেষের মধ্যে সে দৃশ্য মিলিয়ে গিয়ে সামনে পড়ে রইল একরাশ ধুলো আর ঝুলে ভরা বারান্দা৷ ঝকঝকে, সাজানো আসবাবপত্রগুলো মুহূর্তের মধ্যে কোথাও যেন উবে গেল৷
এক সময় অর্থাৎ গৌরসুন্দর চৌধুরীর সময় এই জমিদার বাড়িরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল৷ ইটালিয়ান ধাঁচে তৈরী এই বাড়ির ভিতর একসময় পাঁচটি উঠোন, দেড় শতাধিক কক্ষ, নাট মঞ্চ, ঠাকুর দালান ছিল। এখন বাড়িটা জনমানবশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একতলায় বিরাট বিরাট ফোকরগুলো দিয়ে বাইরের ঝাপসা আলো ভেতরে এসে পড়ে। সেদিকে তাকালে মনে হয়, কারা যেন ঘরগুলোর মধ্যে ওঁত পেতে বসে আছে যেকোনও মুহুর্তে তারা ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। ভাবতেও অবাক লাগে এক সময় কত প্রতিথযশা শিল্পীর পদধুলি পড়েছে এই বাড়িতে।গঙ্গাপদ বসু (জলসাঘর ছবিতে জমিদারের প্রতিবেশী মহিম গাঙ্গুলী), বেগম আখতার, উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানদের। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, কাজী নজরুল ইসলাম, অন্নদাশঙ্কর রায়, লীলা মজুমদারও এই বাড়িতে এসেছিলেন। নাচমহলে ঝাড় বাতিটি রাতটাকে দিন করত এক সময়, বাঈদের পায়ের নূপুর রনিত হত, আতরের সুগন্ধে চারদিক ম ম করত। রঙিন জলের ফোয়ারা উড়ত। এমন বাড়িই বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারের যে পছন্দ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিষয়টা জানতে পেরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ফোনেই সত্যজিৎ রায়কে বলেছিলেন, “আরে অদ্ভুত ব্যাপার। আমি নিজে নিমতিতায় কখনও যাইনি। কিন্তু বাঙালি জমিদারদের এক ইতিহাসে চৌধুরীদের কাহিনী পড়েছি। আমার গল্পের মূল চরিত্র তো গান-বাজনা পাগল ওই উপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীকে নিয়েই।”
এমনই দূরদৃষ্টি ছিল পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে ‘অভিযান’ ছবির মূলে আছে ট্যাক্সি চালকের দুঃসাহসিক অভিযান ও তার পরিণতি। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে বিভিন্ন পেশার পুরুষ নারীর প্রসঙ্গ। তবুও প্রতীকী ব্যাপারটা যেন ছবি দেখার শেষেও মনে গেঁথে থাকে। নরসিংহের ক্রাইসলার গাড়ি যেন রূপান্তরিত হয়েছে চরিত্রে, মানবিক সত্ত্বায়। সত্যজিৎ রায় কতটা সেন্স অব হিউমার ছিলেন, সেই কথা বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের দীর্ঘ দিনের সাথি, চিত্রগ্রাহক সৌমেন্দু রায় বলছেন, ‘‘অভিযান’ ছবির শ্যুটিং চলছে। আহত নরসিং মানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে হাওয়া করছেন ওয়াহিদা রহমান। হঠাৎ এক ফালি চুল ওয়াহিদার চোখ ঢেকে দিল। মানিকদা আমাকেই বললেন ওঁর মুখ থেকে চুল সরিয়ে দিতে। আমি সেটা করতেই মানিকদা ফ্লোরের বাকিদের উদ্দেশে বললেন, ‘রায়কে একটা চান্স দিলাম!’
ফ্লোরে ছবির কাজ এগোতে কেউ যদি সাহায্য করেন, তাহলে সেই মানুষটি যেন মানিকদার কাছে অন্ধের যষ্টির মতো হয়ে উঠতেন।’ অন্যকেও যেমন গুরুত্ব নিতে জানতেন, ঠিক তেমনই নিজেও সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতেন না।
আর তিনি তো জহুরি ছিলেন। কোথায় কোনটা লাগবে, কোন চরিত্রে কাকে মানাবে, এমনটা ওঁর থেকে আর কেইবা ভালো বুঝতো। ‘পরশপাথর’(১৯৫৭) ছবির মূল চরিত্র বাছলেন তুলসি চক্রবর্তীকে। উনি জানতেন তুলসিবাবু বাংলা ছবিতে উপেক্ষিত অভিনেতা হলেও উনি কত বড় ক্ষমতাশালি অভিনেতা ছিলেন। তুলসি বাবুও সে সুযোগ পেয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি কত বড় অভিনেতা। আপনারা দেখুন, সত্যজিৎ রায় ছবিকে কীভাবে ভাবতেন! কী অপূর্ব প্রয়োগ দক্ষতা! এই ‘পরশপাথর’ ছবিতে সত্যজিৎ তাঁর বাবার ননসেন্স ছড়াকে সুন্দরভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যার ফলে ছবির প্রধান চরিত্র পরেশবাবুর বলা এই ছড়াটি প্রবাদের মতো হয়ে গেছে...
“হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইট পাটকেল চিৎ পটাং
ধর্মতলা কর্মখালি
মুস্কিল আসান উড়েমালী।”
এদেশে সংস্কৃতি যে টাকা দিয়ে কেনা যায়, সেটা সত্যজিৎ রায় ব্যঙ্গের সঙ্গে পরিবেশন করেছেন। তাই এই ছবিতে বঙ্গ সংস্কৃতি ধারার প্রসঙ্গ শ্লেষে ব্যঞ্জিত।
পরশুরামের কাহিনির চিত্রায়ণ ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’(১৯৬৫)ছবি। মূলত ‘মহাপুরুষ’, অংশেই পরশুরামের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তথ্যচিত্রের ভঙ্গিতে সত্যজিৎ রায় এখানে প্রেমের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি বিরিঞ্চি বাবার আসল রূপও ধরা পড়েছে। তবে সবটাই যেন সাদামাটা ভাবে। ‘কাপুরুষ’ অংশটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাহিনি। এখানে তিনটি চরিত্রের জটিলতা ছবিটিকে অসাধারণ করেছে।
‘দেবী’(১৯৫০)ছবির কাহিনি সত্যজিৎ নিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। নিমতিতার রাজবাড়িতে এই ছবিরও শুটিং হয়েছিল। সত্যজিৎ এখানে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন।শৈল্পিক ভাষায়। ছবির প্রয়োজনে তিনি এখানে নিজের লেখা একটি গানও ব্যবহার করেছেন ‘এ বারে তোরে চিনেছি মা।’ ‘দেবী’ প্রসঙ্গে কথায় কথায় রায়দা বলেছিলেন, ‘‘দেবী’তে একটা দৃশ্যে ছবিদাকে পড়ে যেতে হবে। ছবিদার হাঁপানি ছিল। তাই ওইভাবে শট দিতে তাঁর আপত্তি ছিল। তিনি করলেন কী, শ্যুটিংয়ের দিন গোটা বুকে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে ফ্লোরে চলে এলেন! বললেন, ‘মিস্টার রায়, বুঝতেই পারছেন আমি তো এই শট দিতে পারব না।’ মানিকদা ছিলেন বুদ্ধিমান। বুঝতেই পেরেছিলেন ছবিদা মজা করছেন। তখন ছবিদাকে সুব্রতদা বললেন, ‘আপনি যতটা পারেন শটটা দিন, আমি ঠিক শট কেটে নেব।’ কিন্তু মানিকদাও নাছোড়বান্দা। ঠিক বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবস্থা করলেন। তারপর দুটো শটে ওকে হয়ে গেল। ছবিদা হেসে মানিকদাকে বললেন, ‘আমি নিজেকে চালাক ভাবতাম। কিন্তু আপনি যে আমার থেকে আরও বড় চালাক সেটা আজকে বুঝতে পারলাম।’

এই আমাদের সত্যজিৎ...।
‘তিনকন্যা’(১৯৬১) ছবিতে সত্যজিৎ রবীন্দ্র ভাবনার প্রতিফলন ঘটালেন।‘পোষ্টমাস্টার’, ‘মণিহারা’ ও ‘সমাপ্তি’র তিন নারী রতন, মণিমালিকা আর মৃন্ময়ীই তিন কন্যা। ‘পোষ্টমাস্টার’ পর্বে তো ছবির প্রয়োজনে একটি পাগল চরিত্র নিয়ে এসেছেন সত্যজিৎ রায়।প্রথম থেকেই ছবিতে রতনের সঙ্গে বাবুর সম্পর্কের স্বরূপ ইঙ্গিত করেছেন তিনি।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিতে সে যেন দাসী হয়ে গেছে। মণিহারার মণিমালাকে আপাত দৃষ্টিতে অলংকারলোভী মনে হলেও তার মধ্যে নান্দনিক বোধ আছে। সমাপ্তির মৃন্ময়ী তো নারীত্বের মধুর বিকাশ। কিশোরীর বোধ থেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসেও চঞ্চল থেকে মুক্ত হতে পারেনি সে। শেষে বিরহই তার মনে মধুরতা এনে দিয়েছে।
রবীন্দ্র কাহিনি অবলম্বনে সত্যজিতের আরও একটি ছবি ‘চারুলতা’(১৯৬৪)। ‘নষ্টনীড়’ গল্পে দেখা গেছে চারুর জীবন তৃষ্ণাকে আড়ালেই রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সত্যজিৎ তাকে সকলের সামনে তুলে ধরলেন। গল্পের শুরুতে দেখা গেছে চারু স্বামী সুখ বঞ্চিত, অবহেলিত নারী। ভূপতি কখনও বোঝেনি ভালোবাসারও একটা আলাদা দিক আছে। তাই চারুর কাছে অমল এত প্রিয়। সত্যজিৎ সাহিত্যের এইসব জায়গায় ভাষা দিয়েছেন। ফলত চারু ও অমলের সম্পর্ক দর্শকরা সরাসরি দেখেছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বোঝাতে সত্যজিত একটি নৈশ দৃশ্য এনেছেন। আবার চারু ও অমলের মনের মিল দেখানোর জন্যেই এসেছে বঙ্কিমপ্রীতি(আনন্দমঠ প্রসঙ্গ)। রবীন্দ্রনাথের মতো সত্যজিৎও ভূপতিকে চারু অমল সম্পর্কের এজেন্ট বানিয়েছেন।নারী চরিত্রের শৈশব কৈশোর, তারুণ্য সবই চারুর মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ। প্রেম, বিশ্বাস, নিষ্ঠুরতা, হতাশা সব মিলেমিশে সঙ্গীতের মতো হয়ে গেছে ‘চারুলতা’য়। সত্যজিতের ফিল্মি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের চারুলতা অনেক বেশি জীবন্ত হয়েছে। তাই বোধহয় ‘চারুলতা’ ছবির বিজ্ঞাপনে সত্যজিৎ লে-আউট করে লিখেছিলেন— ‘সত্যজিৎ রায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি’।
রবীন্দ্র কাহিনির আরও একটি সংযোজন ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৪)। ছবিটি স্বদেশী ভাবনার উপরেই চিত্রায়িত। স্বদেশী আন্দোলনের নেতিবাচক দিককে কোনওদিনই সমর্থন করেননি তিনি। ফলে ছবিটির শুরুই হয়েছে আগুন দিয়ে। শেষে বিমলার সিঁদুরের টিপ মুছে গেছে কপাল থেকে, রঙিন শাড়ি পাল্টে হয়েছে সাদা থান। নিখিলেশ কিন্তু তত্ত্ব ঝেড়ে ফেলে মানুষের মধ্যে থেকেই নিজেকে পার করেছে। সত্যজিৎ উপন্যাসকে টপকে নিখিলেশ– বিমলার ঘরে সন্দীপকে নিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ যুগের প্রয়োজনে নিয়ম ভেঙেছে সন্দীপ। তাই ঘরের বউকে বাইরে বের করিয়ে সত্যজিৎ ছবিটিরও নামকরণ করেছেন ‘ঘরে-বাইরে’।
যেখানে যা সুন্দর, তার সবটাতেই আছেন সত্যজিৎ। মিষ্টি ছোট গল্পকার ননামি মানে নরেন্দ্রনাথ মিত্র। ওঁর ক্লাসিক কাহিনি নিয়ে তৈরি সত্যজিতের সেই বিখ্যাত ছবি ‘মহানগর’(১৯৬৩)। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ মূল গল্প। আপনারা যারা মূল গল্পটি পড়েছেন তাঁরা জানেন, গল্পের মূল কাহিনি থেকে অনেকটাই সরে ছবি বানিয়েছিলেন তিনি। গল্পে সুব্রত(স্বামী) ছিল প্রধান চরিত্র। কিন্তু সত্যজিৎ করলেন আরতিকে (স্ত্রী)। ছবিটি কিন্তু মোটেও নারীমুক্তির নয়। বরঞ্চ বাড়ির সকলকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে চলার। তাই একটি সংকটেই শেষ পর্যন্ত আরতি সুব্রত পরস্পর পরস্পরের কাছে এসেছে। মহানগরের(কলকাতা) রাস্তায় দুজনেই বেরিয়েছে কাজের সন্ধানে।“গণশত্রু’র ডাক্তারের মতো আরতির ঋজুতা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। সত্যজিৎ রায় অসম্ভব নিয়মানুবর্তিতায় জীবন কাটিয়েছেন। চিরকাল নিজেও ঋজু থেকেছেন। তাই তাঁর ভাবনা, তাঁর কাজ অন্যরকম। শিক্ষনীয়। আদরের। এবং অবশ্যই সেরার সেরা।
‘চিড়িয়াখানা’(১৯৫৭) ছবিতে প্রচলিত ভাবনা থেকে সরে এলেন সত্যজিৎ রায়।শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা কাহিনি। ব্যোমকেশ বক্সির রহস্য উদঘাটন। এই ছবিতে সত্যজিতের নিজের লেখা একটা গান ‘ভালোবাসার তুমি কি জানো’ ব্যবহার করেছেন তিনি।
নিজের লেখা দুটো গোয়েন্দা কাহিনিতে কিন্তু সত্যজিৎ রায় আরও বেশি সার্থক। ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৮)। দুটি ছবির কাহিনিই গোয়েন্দা গল্প আকারে সন্দেশ-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ফেলু মিত্তির ব্যোমকেশের সার্থক উত্তরসুরি হলেও ফেলুদা জনপ্রিয়তার নিরিখে অনেকটা এগিয়ে। এই ছবি দুটিতে ফেলুদা ব্যোমকেশকে ছাড়িয়ে গেছে কোথায়! সোনার কেল্লা ছবিতে জাতিস্মর তত্ত্বকে টপকে মুখ্য হয়েছে গোয়েন্দার অনুসন্ধান। লালমোহনবাবু অনবদ্য সৃষ্টি সত্যজিৎ রায়ের। এই চরিত্রটি আলাদা মাত্রা এনেছে ছবিতে। একই সঙ্গে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে তো হেঁয়ালি, চুরি, গোয়েন্দাগিরি, খুন-খারাপি সব একাকার হয়ে গেছে। ভারতীয় সংস্কৃতি বিকৃত হচ্ছে। এই ব্যাপারটা সত্যজিৎ একেবারেই মেনে নেননি। তাই ধর্মের আড়ালে গড়ে ওঠা পাপকে ফেলুদা শাস্তি দিয়েছে।

সত্যজিৎ রায়ের একই ঘরানার ছবি মূলত তিনটি।’অরণ্যের দিনরাত্রি’(১৯৭০),’প্রতিদ্বন্দ্বী’(১৯৭০) ও ‘সীমাবদ্ধ ’ (১৯৭১)। প্রথম দুটির কাহিনীকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শেষেরটির শংকর। তিনটে ছবিই সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর নান্দনিক রূপ।
সমসাময়িক জীবন যন্ত্রণা, বিশেষ করে যুবক-যুবতিকে যেভাবে দ্বিধায় ফেলে দেয় তারই বলিষ্ঠ চিত্ররূপ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। উপন্যাস থেকে অনেকটাই সরে এসেছিলেন সত্যজিৎ সিনেমা তৈরির কারণে।সাহিত্য একটা ভুবন। কিন্ত সিনেমা, একেবারে অন্য আরেকটি ভুবন।গল্প চলচ্চিত্রের আধার হতে পারে! এর বেশি কিছু নয়। ভাবনা, দর্শন স্রষ্টা নিজের মতো করে চালিত করবেন। শিল্পের স্বার্থে। যিনি এই মিশেলটা ঠিক ঠিক করে করতে পারেন, তিনিই তো বড় শিল্পী। শ্রেষ্ঠ চিন্তক। এবং সেরার সেরা। উপন্যাসে যুবকদের নিরুদ্দেশ যাত্রাকে সত্যজিৎ চালিত করেছেন অভিষ্ট পথে। আসলে সত্যজিৎ নিজের মেধা দিয়ে সকলকে নিয়ে কাজ করতে ভালবাসতেন। ইউনিটে সবাইকে তার তার মতো করে স্বাধীনতা দিতেন। সৌমেন্দু রায় গল্প করছিলেন, ‘ইউনিটকে স্বাধীনতা দিতেও তাঁর জুড়ি ছিল না। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। পালামৌতে তখন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শ্যুটিং চলছে। প্যাকআপের পর সন্ধ্যায় সৌমিত্র, শুভেন্দু, রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জরা সাধারণত একসঙ্গে আড্ডা মারতেন। একটু আধটু পানাহারও চলত। একদিন সবাই সেরকম আড্ডায় মেতেছেন। একদিন সেখানে হঠাৎই মানিকদা এসে হাজির। সবাই ভয়ে গ্লাস নামিয়ে রেখেছেন। কিন্তু রবি ঘোষ ছিলেন মজার মানুষ। টুক করে গ্লাস তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘মানিকদা, আমরা একটু খাচ্ছি।’ মানিকদা হেসে বললেন, ‘বেশ। খাও। আমি তাহলে যাচ্ছি। তবে কাল কিন্তু এখানেই শ্যুটিং। ভুলে যেও না।’ মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন মানিকদা।
শ্যুটিং প্যাকআপের পরেও মানিকদার সঙ্গে প্রচুর আড্ডা হতো। ছবি নিয়ে কথা হতো। ভালো কোনও বিদেশি ছবি দেখলেই আমাদের সেটা দেখতে বলতেন। আউটডোরে রাতে শ্যুটিংয়ের পর দীর্ঘক্ষণ আমরা একসঙ্গে তাস খেলতাম। কিন্তু লক্ষ করতাম, একটা সময় পর উনি ঠিক উঠে চলে যেতেন। তাড়াতাড়ি ডিনার করে ঘরে গিয়ে চিত্রনাট্যে বুঁদ হয়ে থাকতেন।’ আসলে কতটুকু চলতে হয়, কীভাবে চলতে হয়, তা সত্যজিৎ রায় বেশ রপ্ত করেছিলেন।
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সিদ্ধার্থর লড়ে যাওয়ার গল্প। সত্যজিৎ চিরদিনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু কখনওই ধ্বংসাত্মক দিককে গ্রহণ করেননি। তার ইতিবাচক মন নকশাল আন্দোলনের ভাবাবেগকে স্পর্শ করলেও সত্যজিতের অপূর্ব মুন্সিয়ানায় কলকাতার সবকিছুই যেন রূপান্তরিত হয়েছে। সিদ্ধার্থর প্রতিদ্বন্দ্বী। আর এখানেই ছবিটির সার্থকতা। প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপরীত মেরু যেন সীমাবদ্ধ। কারণ এই ছবির নায়ক শ্যামলেন্দু জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্যে নিজের আদর্শকেও জলাঞ্জলি দিতে চেয়েছে। ন্যায়নীতি, আদর্শ বা আন্তরিকতা নয়, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মানুষের জীবন ভাবনা ছিল চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই শেষ দৃশ্যে শ্যামলেন্দু কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে সিঁড়ি উপরে ওঠার সময় একমাত্র সঙ্গী হয়েছে তারই পায়ের শব্দ। কী সুন্দর ব্যালান্সড কাজ। দুটি পরস্পর ভিন্নধর্মী ভাবনার ছবি, দর্শনের ছবি! অথচ কী সুন্দর ভাবে পরিচালনা করলেন। দুটি ছবিই স্বতন্ত্রে সেরা।
এই পর্বের আরও একটি ছবি ‘জনঅরণ্য’(১৯৭৫)। শংকরের কাহিনি নিয়ে সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি। এখানে যেন সত্যজিৎ নির্মম সমালোচকের ভূমিকায়। ক্ষয়ে যাওয়া কলকাতার নগর জীবনের ছবিকে তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করেছেন। সামনে রেখেছেন সোমনাথকে। এই ছবিতে দুর্ভিক্ষ, হাহাকার, উদ্বাস্তু সবই আছে। কিন্তু সত্যজিৎ দেখাতে চাইলেন কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে আমরা অসাঢ় হয়ে যাচ্ছি, তা ক্রমশই আমাদের জীবনে ভয়াবহতাই নিয়ে আসছে। সত্যজিৎ রায় ছবিতে যেন তারই প্রতিবাদ করলেন। এরই সঙ্গে দুটো ছবি করে নিলেন সত্যজিৎ। একটি মুন্সি প্রেমচাঁদের লেখা ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ী’ (১৯৭৭) এবং অন্যটি ইবসনের কাহিনি অবলম্বনে ‘গণশত্রু’ (১৯৮৯)| প্রথম ছবিটিতে অযোধ্যার ক্রমপতনকে ছবিতে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তাতে সত্যজিৎ ইতিহাসকে চেপে গেছেন বলেই সমালোচকরা মনে করেছেন। এই ছবিতে রাজ বীরত্বের থেকে পুরনো লখনউয়ের ছবি, চমৎকার মনে হয়েছে। দ্বিতীয় ছবিতে তিনি নিপুণভাবে ইবসনের বিদেশিয়ানা খসিয়ে দেশি ইমেজ তুলে ধরেছেন। কারণ মন্দিরের চরণামৃত খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ব্যাপারটা পশ্চিমবাংলারই কোনও গ্রামের ঘটনা। মনে হয়েছে সততার সঙ্গে নোংরা রাজনীতির দ্বন্দ্ব এই ছবিতে স্বচ্ছ। মানবিক অবক্ষয়, ধর্মীয় সংস্কার, বিজ্ঞান বিমুখতা সবকিছুতেই শেষ পর্যন্ত জয়ী ডাক্তার গুপ্ত। আসলে সত্যজিৎ স্বয়ং।
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’(১৯৬৯) এবং ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০)র প্রতিটি ছবিই যেন দর্শকের মনে গাঁথা হয়ে থাকবে। প্রথমটির কাহিনিকার ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। পরেরটি সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। প্রথম ছবিতে সত্যজিৎ অনেক নতুন চরিত্র এনেছেন। আমলকির রাজা, হাল্লার মন্ত্রী, বরফি, ভুতের রাজা প্রমুখ। গুপী ও বাঘা তো এখানে নতুন রূপে উপস্থাপিত। ছবিতে গানের অসাধারণ ব্যবহার সমসাময়িক সমাজজীবনে নতুন মাত্রা এনেছে। সত্যজিৎ এখানে দশটা গান ব্যবহার করেছেন। সবই তাঁর নিজের লেখা। ফলে ভূতে-রূপে-সঙ্গীতে অসাধারণ ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। হীরক রাজার দেশে ছবিতে রাজা সপার্ষদ প্রমুখের অন্তরালে হীরক রাজার শয়তানি ধরা পড়েছে। কারণ তার গান,সমালোচনা, শিক্ষা, কৃষক, শ্রমিক শিল্পী শিক্ষক কাউকেই সে পছন্দ করে না। যে তার স্তুতি করে তাকেই সে ভালোবাসে। আসলে সত্যজিৎ এর, একটা সময়োপযোগী পলিটিক্যাল রূপকেই তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে উদয়ন পণ্ডিতের বিদ্রোহ ও জয়লাভকে দেখিয়েছেন। সত্যজিতের ইতিবাচক ভাবনারই ফল। বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রাখা। সত্যজিৎ বারোটা গান ব্যবহার করেছেন। সবই তার নিজের লেখা। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে তো বাঙালির জয়যাত্রার আবহসঙ্গীত।
নিজের কাহিনি নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘কাঞ্চনজঙঘা’(১৯৬২)। দার্জিলিংয়ের প্রকৃতিকে ভালোবাসার ছবি। পরিচ্ছন্ন ছিমছাম ছবি ‘কাঞ্চনজঙঘা’। লাবণ্যের লিপে ‘এ পরবাসে রবে কে’র প্রয়োগ সত্যি আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। নিজের সত্তা আবিষ্কারের মধ্যেই এই ছবির মহত্ত্ব ধরা পড়েছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার পরে নিজের কাহিনি নিয়ে সত্যজিতের পরের ছবি ‘নায়ক’(১৯৬৬)। অরিন্দম মুখার্জির বিখ্যাত চিত্রতারকা হয়ে যাওয়া ও তার থেকে মুক্তির সন্ধানই ছবির মূল সুর। সাংবাদিক অদিতিই এই ছবিতে অরিন্দমকে বাস্তবের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে। অদিতির সঙ্গে অনেকটাই যেন মিল আছে ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির টুটুলের। শুধু অরিন্দম নয়, মি.বোস, প্রমীলা বসুর চরিত্রের অভাববোধও ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ। ছবির মধ্যে একমাত্র অদিতিই আলাদা। তাই সহজেই বিভিন্ন স্টেশনে নেমে সে আর কারোর বিবেক জাগাতে মিশে গেছে ভিড়ে। অরিন্দম শুধুই চেয়ে থেকেছে।
এক বিদেশি সমালোচক একসময় সত্যজিৎকে বলেছিলেন বৃক্ষ। সত্যি সত্যজিৎ রায় ছিলেন বনস্পতি। তাঁর ছবির টেকনিশিয়ান, শিল্পীরা শাখা-প্রশাখা। সত্যজিৎ রায় শেষের দিকে তৈরি করলেন ‘শাখা–প্রশাখা’(১৯৯০)। পরিবার, মূল্যবোধ নিয়ে গড়া ছবির মধ্যে সেই অসাধারণত্ব না থাকলেও একটা নিপাট পরিচ্ছন্ন ছবি, সে বিষয় কোনও সন্দেহ নেই। মূল্যবোধের সংকট কিভাবে শাখায় শাখায় বিন্যস্ত, সত্যজিৎ যেন তারই মানবিক দলিল তৈরি করলেন। শেষ ছবি ‘আগন্তুক’(১৯৯১) তারই খানিক ছোঁয়া আছে। এটা সত্যজিতের নিজের লেখা গল্প অতিথির সার্থক চিত্ররূপ। সাহিত্যের ভাষা আর চলচ্চিত্রের ভাষা বোঝা যায়। অতিথির বাইরের জগতের আভাস ছবিতে সরাসরি দেখিয়েছেন সত্যজিৎ ‘অতিথি’তে। অপরিচিত আগন্তুককে (শেতলমামা) বিশেষ খারাপ ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু ছবিতে সে(মনোমোহন)সত্যিই মামা কি না, তার প্রমাণে জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে পরিবারের তরফ থেকে। সত্যজিৎ এই ছবিতে প্রথম দিকে সভ্য সমাজের নগ্নতাকে তুলে ধরলেও মানবিকতারই জয়গান করেছেন। নিজের সমস্ত টাকা-পয়সা ভাগ্নিকে দেওয়ার মধ্যেও রয়েছে আত্মিক বন্ধনের টান। আবার নতুন করে মামার নিরুদ্দেশ হওয়ার মধ্যেও রয়েছে দুরের হাতছানি, পথেই নিশ্চয়তা, বিশ্বমানবতার সন্ধান। ফিচার ছবির পাশাপাশি সত্যজিৎ পাঁচটি তথ্যচিত্র করেছেন। পাঁচটিরই চিত্রনাট্য পরিচালনা, সঙ্গীত ও ভাষ্যে তিনি নিজে। সেগুলি ‘রবীন্দ্রনাথ’(১৯৬১),“সিকিম”(১৯৭১), ইনার আই’ (১৯৭৪), ‘বালা’(১৯৭৬) ও ‘সুকুমার রায়’(১৯৮৭)| ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রে বিশ্বমানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথকেই ধরেছেন সত্যজিৎ। ‘সিকিম’ তথ্যচিত্রে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরার পাশাপাশি সত্যজিৎ কি সিকিমের অন্য কোনও অন্ধকার দিক তুলে ধরতে চেয়েছিলেন? ইনার আই তো বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবন নিয়ে তৈরি। ‘বালা’ তথ্যচিত্র দক্ষিণী নৃত্যশিল্পী বালা সরস্বতীর নৃত্যশৈলীর ছবি। আর ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রে সুকুমারের জীবন ও শিল্পকর্ম বিশেষ স্থান পেয়েছে। এর পাশাপাশি সত্যজিৎ তিনটি দুরদর্শনের জন্য ছবি করেছেন। সেগুলি ‘টু’( ১৯৬৪), “পিকু”(১৯৮২)ও ‘সদগতি’ (১৯৮২)। প্রথম দুটির কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সত্যজিৎ স্বয়ং। ‘সদগতি’ মুন্সি প্রেমচাঁদের কাহিনি অবলম্বনে সত্যজিতের পরিচালনা ‘টু’ ছোটদের শৈশব বিষয়ক ছবি। ‘পিকু‘ ছবিতে বাবা–মায়ের প্রেমহীনতা এবং মায়ের সঙ্গে পরপুরুষের অবৈধ সম্পর্কের স্বরূপ ধরা পড়েছে। আর ‘সদগতি’ তো এক অন্ত্যজের শবদেহ সৎকারের কাহিনিরই প্রতিফলন।
এই আমাদের পরিচালক সত্যজিৎ রায়। আজ যদি পৃথিবীর সেরা দশ পরিচালকের নাম করি বা সেরা ছবির একটা তালিকা তৈরি করি তারমধ্যে নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায় থাকবেনই।
ধরুন এই মুহূর্তে পৃথিবীখ্যাত কয়েকটি ভালো ছবির নাম করি, যেমন ধরা যাক, স্টিভেন স্পিলবার্গ-এর ‘জস’, পিটার জ্যাকসন-এর ‘দ্য রিটার্ন অব দ্য কিং’, কোয়েন্টিন টারান্টিনোর ‘জ্যাঙ্গো আনচেইনড’, জেমস ক্যামেরন-এর ‘অ্যাভাটার’ মার্টিন স্করসেসের ‘রেজিং বুল’, রিচার্ড লিঙ্কলেটার-এর ‘হুডবয়’, ডেভিড ফিঞ্চার-এর ‘ফাইট ক্লাব’ উৎকর্ষতায় যে শীর্ষে অবস্থান করছে, সেখানে আমাদের সত্যজিৎ রায় ও তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ কিম্বা ‘জলসাঘর’ কি কোনও অংশে কম যায়। কিম্বা ‘হীরক রাজার দেশে’র মতো কটা ছবি আর তৈরি হয়েছে বলতে পারেন?

সঙ্গীত ও সত্যজিৎ
এতো গেল পরিচালক সত্যজিৎ রায়। উনি যদি পরিচালনার বাইরে মিউজিক নিয়ে কেবল চিন্তা ভাবনা করতেন, তাহলেও তিনি অনেক বড়, সেরা মিউজিশিয়ান হতেন। বোঝা যায় ওঁর ছবিতে সঙ্গীতের প্রয়োগ দেখে। নিজে যখন সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন এক রকম। যখন অন্য কাউকে দিয়ে মিউজিক করিয়েছেন তখনও। সে পণ্ডিত রবিশঙ্করই হন বা আলি আকবর!
সত্যজিতের সঙ্গে রবিশঙ্করের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্যজিৎ তাঁর জীবনের প্রথম ছবিটি করছেন ‘পথের পাঁচালী’, বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের একটি অংশ থেকে। সেখানে বাংলার সুর, গ্রামের সুর দেবেন রবিশঙ্কর। এমনটাই শুরু থেকে তাঁর মাথায় ছিল। রবিশঙ্কর খানিক পরিচিত নাম। কারণ এর মধ্যে বেশ কিছু ছবিতে কাজ করে ফেলেছেন তিনি। সেতারবাদক হিসেবেও পরিচিত হচ্ছেন। সঙ্গীতের মধ্যেই বিভোর থাকেন সবসময়। ঘরে ঢোকার পর সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আলাপের পরপরই রবিশঙ্কর সত্যজিৎকে সরাসরি বললেন, “তোমার ছবির একটি সঙ্গীত রূপ ভেবে রেখেছি।” বলার পরই একটি সুর শোনাতে আরম্ভ করলেন। সত্যজিৎ তো অভিভূত! ঠিক এমনটাই তো চাইছিলেন ‘পথের পাঁচালী’র জন্য। পুরো ছবিতে কোথায় কোথায় সঙ্গীত থাকবে, সেটাও একবার দেখিয়ে নিতে হবে। তারপর মহড়া, রেকর্ডিং ও শেষে এডিটিং।
কিন্তু এটা কী করে হবে? এত সময় কোথায়? আবার পরিচালকের নাম সত্যজিৎ রায়, সে হোক না প্রথম ছবি, তিনি তো তাঁর পরিকল্পনা ও নিখুঁত মহড়া ছাড়া সঙ্গীতের প্রয়োগ করবেন না! ফলে এল প্রথম ও প্রধান মুশকিল! রবিশঙ্কর মাত্র একটা দিন সময় দিতে পারবেন। তার মধ্যেই পুরো সঙ্গীতের কাজ সারতে হবে। ব্যাপারটা রীতিমতো মুশকিলের। আর সত্যজিতের কাছে সম্ভবপর নয়। হার মানার পাত্র সত্যজিৎ নন! তাঁর মাথায়ও গিজগিজ করছে অজস্র ভাবনা। একটা ব্যাপারে রবিশঙ্কর আর সত্যজিতের ভাবনা মিশে গিয়েছিল; এই কাজটি গতানুগতিকের মতো হবে না। দৃশ্যের গভীরে গিয়ে ওই সুর বের করে আনতে হবে। যাই হোক, ওই একটি দিনেই সমস্তটা ব্যবস্থা করা হল। সেইদিনই ছবিটার কিছুটা দেখলেন রবিশঙ্কর। এবার তিনি অভিভূত হলেন। সমস্ত যন্ত্রশিল্পীদের বলে দেওয়া হল স্টুডিওতে চলে আসার জন্য। সেতার, বাঁশি, তারসানাই, চমং আর কাচারি— এ-ই ছিল সরঞ্জাম। বাকিটা, সুরের অনন্ত ক্যানভাস…
এই সিনেমার একটি দৃশ্যের কথা অনেক সমালোচক, পরিচালকেরা বলে থাকেন মাঝেমধ্যে। তখন দুর্গা মারা যায়। হরিহর বাইরে থেকে ঘরে ফিরছেন; সর্বজয়ার দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন শাড়ি। যা দুর্গার নাম করে এনেছিলেন। সেই দৃশ্যে প্রথমে সর্বজয়ার কান্না রেখেছিলেন সত্যজিৎ। পরে মনে হল, এমনটা কি দরকার? সমস্ত কান্নার কি শব্দ হয়? বিষাদের নিজস্ব কিছু সুর থাকে তো! তাহলে এখানে কান্নার পরিবর্তে সুরমূর্ছনা দিলেই তো হয়! সেই সুরও ধরতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ। তিনি আর রবিশঙ্কর একসঙ্গে আলোচনা করছিলেন। ওইদিন, গোটা রাত জেগে চলল রেকর্ডিংয়ের কাজ। ওখানে বসেই তৈরি হচ্ছে স্বরলিপি, চলে যাচ্ছে শিল্পীদের হাতে। অলোক দে’র বাঁশি বেজে উঠছে, রবিশঙ্করের সেতারের ঝংকার...
শেষের বিলাপের দৃশ্যটায় সুর বসিয়েছিলেন সত্যজিৎ নিজে। বাকিটা রবিশঙ্কর আর দক্ষিণামোহন ঠাকুরের জাদু-ছোঁয়া। টানা দু’মিনিট ধরে চলে এই সুর। তারসানাইয়ে সেই বিলাপ তুলেছিলেন দক্ষিণামোহন স্বয়ং। রাগটা ঠিক করে দিয়েছিলেন রবিশঙ্কর নিজেই, পটদীপ।
কিন্তু একটি জায়গায় সুর দেওয়া হয়নি। রবিশঙ্করের ব্যস্ততা তাঁকে বাধ্য করে এখানে থামতে। তবে সেই শেষের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ‘পথের পাঁচালী’র ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র। তিনি যেমন ছিলেন অন্যতম সেরা সিনেমাটোগ্রাফার, অন্যদিকে সেতারেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনিই সেই যাত্রা রক্ষা করেছিলেন। দৃশ্যটি ছিল মিঠাইওয়ালার মিঠাই ফিরি করা। যা হোক, শুধু পথের পাঁচালীই নয়, এই দুই বাঙালির সুরের যাত্রা এগিয়ে গিয়েছিল ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’ ও ‘পরশপাথর’-এর দিকে। দুই স্রষ্টার রসায়নে তৈরি হয়েছিল একের পর এক ম্যাজিক!
আগেই বলেছি সিনেমায় গানের প্রয়োগ-ভাবনায় সত্যজিৎ ছিলেন বরাবরই অন্য ধাঁচের এক রূপকার। ছবির চরিত্রদের কণ্ঠে গানের ব্যবহারই হোক কিংবা প্রয়োজনে ছবিতে স্থানীয় গানকে ঢুকিয়ে দেওয়াই হোক, দু’টি বিষয়েই তাঁর ভাবনা ও প্রয়োগবোধ থাকত সজাগ। ‘সোনার কেল্লা’তে রামদেওরা স্টেশনে রাজস্থানি শিল্পীদের লোকগান সেই প্রয়োগ বোধেরই পরিচায়ক। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির কথা মনে পরে? সেখানে ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা’ গানটির শুটিঙের সময় তিনি খোঁজ পেয়েছিলেন দুই স্থানীয় বংশীবাদক শওকত আলি আর কর্ণর। দুজনের বাঁশিই সিনেমায় ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ। সঙ্গীত সমালোচক অতনু চক্রবর্তী গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, যদিও পণ্ডিত রবিশঙ্করের হাতে ‘পথের পাঁচালী’ ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব সঁপে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ, তবুও নিজের চিন্তার প্রয়োগ তিনি বারবার বুনেছেন এই ছবির সঙ্গীতে। বুনেছেন ছবির স্বার্থেই। সেটা বোঝা যায় চুনিবালা দেবীকে দিয়ে গান করানোর ঘটনায়। পণ্ডিত লেখক সুধীর চক্রবর্তী বলেছিলেন, আলাপচারিতায় সত্যজিৎ রায় একবার তাঁকে বলেছিলেন, “চুনিবালা দেবীকে যে দিন প্রথম তাঁর পাইকপাড়ার বাড়িতে দেখতে যাই, সে দিনকার মনের অবস্থা ভোলবার নয়। ছবির কাজ শুরু হয়ে গেছে। অপু, দুর্গা, হরিহর, সর্বজয়ার ভূমিকা নির্বাচন হয়ে গেছে।... বাকি আছে কেবল ইন্দির ঠাকরুন। চুনিবালা আমাদের হতাশ করলেন না। ‘পঁচাত্তর বৎসরের বৃদ্ধা, গাল তোবড়াইয়া গিয়াছে, মাজা ইষৎ ভাঙিয়া শরীর সামনে দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে’.... বর্ণনার সঙ্গে অমিল হলো না।”
হঠাৎ করেই চুনিবালা দেবীর গানের গলা আবিষ্কার করছেন সত্যজিৎ। কারণ তাঁর মনে হচ্ছে, ছবিতে সেই গলা ব্যবহার করলে ‘মন্দ হয় না’। চুনিবালা ওরফে ইন্দির ঠাকরুন গাইলেন গান।
চাঁদনি রাত। দাওয়ার পশ্চিম দিকে মুখ করে হাতে তাল রেখে ইন্দির ঠাকরুন গান করছেন। এমন দৃশ্য টেক করা হবে, তখন শট নেওয়ার কিছুক্ষণ আগে চুনিবালা দেবী হঠাৎ সত্যজিৎবাবুকে প্রশ্ন করলেন, “ আরেকটা গান শুনবেন?” সত্যজিৎ সম্মতি দিতেই শুরু হল তাঁর গান। ‘হরি দিন তো গেল সন্ধা হল/ পার কর আমারে।’ গানখানি বিশ্ব শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রে অন্য মাত্রা সংযোজিত হল।
শোনা যায়, ‘পথের পাঁচালী’-র শুটিং যখন অর্থাভাবে আটকে আছে, সেই সময় ছবির সম্পাদক দুলাল দত্ত নারায়ণ সাধুখাঁ নামের এক প্রযোজককে নিয়ে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। তিনি বললেন, ছবিতে গান নেই কেন? দুর্গার মুখে গান দিতে হবে। শুনে সত্যজিৎ নাকি রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “পাগল নাকি! বিভূতিভূষণ পড়েননি?” প্রযোজক চলে গেলেন। সেই সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রের স্বার্থে গান গাওয়াচ্ছেন চুনিবালা দেবীকে দিয়ে। এখানেই সত্যজিৎ রায়ের বৈশিষ্ট।
ছবির বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গীতের যোগাযোগ কতটা। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রবন্ধের একটি অংশ উল্লেখ করছি: “চলচ্চিত্রে পরিচালক ছাড়া তার ছবির আবহসঙ্গীত কী হবে, সেটা তার চেয়ে কে বোঝে?” বলা বাহুল্য, সেটা সত্যজিৎ রায় বুঝতেন বলেই তিনি সার্থক, চিরন্তন। এই উক্তিটি যে কত বড় সত্য, কতটা মূল্যবান তা সত্যজিৎ নিজেই প্রমাণ করে দিয়েছেন ‘তিন কন্যা’ থেকে ‘আগন্তুক’ পর্যন্ত। ‘তিন কন্যা’র আগে পর্যন্ত তিনি কোনওরকম আবহসঙ্গীত বা গান তাঁর ছবির জন্য তৈরি করেননি। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সত্যজিৎ প্রমাণ করলেন, আমাদের শেখালেন এক মহামূল্যবান শিক্ষা। চলচ্চিত্র যেমন তার নিজস্ব ভাষা, যা ছাড়া উত্তীর্ণ হতে পারেনা, সে যত বড়ই ক্ল্যাসিক গল্প নির্বাচন করা হোক না কেন, সেটাকে চিত্রনাট্যে রূপ দেওয়ার জন্য তার পরিবর্তন অপরিহার্য। কেননা, সেটাকে চলচ্চিত্রের ভাষায় রূপান্তরিত করতে হবে, অবশ্যই গল্পের মূল বক্তব্য, চরিত্র ও পটভূমিকে বজায় রেখে। ফলে, তিনি, চলচ্চিত্রের নিজস্ব যে ভাষা, তার সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করেই ঠিক চলচ্চিত্রের চাহিদা অনুযায়ী আবহসঙ্গীত রচনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সে ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমটি ঘটালেন তিনিই। ভারতবর্ষ তথা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে এলেন, ছবির স্বার্থে। অপু ট্রিলজি ও ‘পরশ পাথর’-এর জন্য পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ‘জলসাঘর’-এর জন্য বিলায়েৎ খাঁ, ‘দেবী’তে আলি আকবর খাঁকে।
এঁরা সকলেই বিশাল পণ্ডিত আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে। কিন্তু এঁরা যে কাজটা করছেন যে যে ছবির জন্য সে ছবির পরিচালক কে? পরিচালক সত্যজিৎ রায়। তিনি তাঁর ছবির মুড ও সিচুয়েশনের দাবিতে সঙ্গীত আদায় করে নেবেন, কাজে লাগাবেন। এবং লাগিয়েওছেন। তবেই তো তিনি যথার্থ পরিচালক। এই কাজটি তিনি করতে পেরেছেন, কারন, কী প্রাচ্য, কী পাশ্চাত্য—উভয় সঙ্গীত সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণ সত্যজিৎ রায়।
সাহিত্যিক সত্যজিৎ
না, সত্যজিৎ রায় শুধু সিনেমার নন, তিনি শিল্প-সাহিত্যেও সেরা। সিনেমার নতুন ভাষা আবিষ্কার করেছেন তিনি নিঃসন্দেহে। সিনেমা-খ্যাতির শিখরে পৌঁছেও সত্যজিৎ রায় শুধু সেলুলয়েডেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সাহিত্যের প্রতি, বিশেষত ছোটদের সাহিত্যের প্রতি তিনি সৃষ্টি সুখের আনন্দে মেতে থেকেছেন। অলঙ্করণ করেছেন। গল্প লিখেছেন। অন্তরের উৎসারিত ভালোবাসা উজার করে দিয়েছেন। এত কাজের মধ্যেও একটু ফুরসত পেলেই ছোটদের জন্য কলম ধরেছেন। ডুব দিয়েছেন ফেলুদা বা শঙ্কুর গল্পকথায়। সাহিত্যসৃষ্টির পাশাপাশি সমানতালে চলেছে তাঁর ছবি আঁকা! নিজের বইয়ের মলাট ও ইলাস্ট্রেশন সবই করেছেন নিজে। সম্পাদনা করেছেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার। ‘সন্দেশ’-এ ইলাস্ট্রেশনও করেছেন। উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার রায়ের বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘সন্দেশ’ সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় পুনরুজ্জীবিত হয়। ডি-কের সিগনেট প্রেসে চাকরি করার সময় ‘আম আঁটির ভেঁপু’-র ইলাস্ট্রেশন আঁকতে গিয়েই ‘পথের পাঁচালি’ চলচ্চিত্রায়িত করার কথা ভেবেছিলেন তিনি। পার্থজিৎ গাঙ্গোপাধ্যায় ঠিকই বলেছেন, ‘সন্দেশ’কে কেন্দ্র করে চিত্রশিল্পী সত্যজিৎকে যেমন পাওয়া গেল, তেমনই পাওয়া গেল লেখক সত্যজিৎকেও।
সত্যজিতের অসংখ্য গল্প ছাপা হয়েছে ‘সন্দেশ’-এ । ‘ক্লাসফ্রেন্ড’, ‘খগম’, ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ বা ‘বাতিকবাবু’-র মতো বহু আখ্যান সত্যজিৎ এই পত্রিকার কথা ভেবেই লিখেছিলেন। ‘গোলোকধাম রহস্য’, ‘গোঁসাইপুর সরগরম’, ‘ডাঃ মুনসির ডায়েরি’, ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’, ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ বা প্রফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও’— তাঁর এমন কত না ফেলুদা-শঙ্কুর গল্পকথা ‘সন্দেশ’-এ ছাপা হয়েছে! সত্যজিৎ রায় গল্পের ক্যানভাসে দেখেছেন জগৎ ও জীবনকে। নির্মেদ মনোজ্ঞ তাঁর গদ্যভাষা। কোনও কোনও গল্পে অবশ্য হাল্কা হাসির আভাসও আছে। বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, সেই কথাবার্তার ফাঁকফোকরে হাস্যরসের ঝলকানি, যা সহজেই মনে আনন্দ জাগায়—সত্যজিৎ রায় তেমন গল্পও লিখেছেন। সত্যজিতের অনেক গল্পেই অলৌকিকতা আছে। অলৌকিকতা, ভয়-ভীতিও যে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে হয়, তা কোনও কোনও গল্প পড়তে গিয়ে টের পাওয়া যায়। অলৌকিকতায় তাঁর গল্প-ভাবনা ফুরিয়ে যায়নি। বারবার তিনি ফিরে গিয়েছেন বিজ্ঞানের কাছে। বিজ্ঞানই হয়ে উঠেছে অবলম্বন-আশ্রয়। ‘জুটি’, ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ বা ‘টলিউডে তারিণীখুড়ো’র মতো এমন কয়েকটি গল্পে আলো-আঁধারির ফিল্ম-জগৎ পেয়েছে ভিন্নতর মাত্রা। তারিণীখুড়োকে নিয়ে বেশ ক’টি গল্প লিখলেও কোনও গল্পই একঘেয়েমিতার দোষে দুষ্ট নয়। প্রতিটি গল্পই ভিন্নতর।
সিধুজ্যাঠার মতো পণ্ডিত মানুষ যেমন বিরল, তেমনই লালমোহন গাঙ্গুলির দেখা একবারই মেলে। গিরিডির বাঙালি বিজ্ঞানীকে সামনে রেখে সত্যজিৎ ফ্যান্টাসির এক আশ্চর্য জগৎ নির্মাণ করেছেন। পড়তে পড়তে পৌঁছে যাওয়া যায় নানা দেশে। ভ্রমণ-আনন্দের সঙ্গে রয়েছে বিজ্ঞান ও অ্যাডভেঞ্চারের অভূতপূর্ব মিলমিশ। মুগ্ধ হতেই হয়!
ফেলুদার কাহিনি ঘিরেও আছে আমাদের সমান মুগ্ধতা। ফেলুদার রহস্য-আখ্যান পড়তে পড়তেও সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে আমরা বেরিয়ে পড়ি ভ্রমণে। পটভূমির বর্ণনায়, ডিটেলের কারুকাজে সত্যিই তাঁর তুলনা হয় না! কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস নয়, আগাথা ক্রিস্টির এরকিউল পোয়ারোও নয়, নয় ব্যোমকেশও। ফেলুদা অনন্য, তিনি একমেবদ্বিতীয়ম।
ঠিক যেমন অনন্য ও একমেবদ্বিতীয়ম, আমাদের সত্যজিৎ রায়। এই কারণেই তিনি সেরার সেরা। জন্ম শতবর্ষে তাঁকে প্রণাম...

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে নারী চরিত্রের নির্মাণ ও সৃষ্টি, অভিনেত্রী এবং কবিতা বইয়ের প্রচ্ছদ
কমলেন্দু সরকার
সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলি সাংস্কৃতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে দিকনির্দেশক বলে মনে হয়। সাহিত্যের ভাষা এবং সিনেমার ভাষা যে ভিন্ন তা সামান্য হলেও বুঝেছি সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখে।
সাহিত্যের ভাষা আর ফিল্মের ভাষা যে এক নয়, তা সত্যজিৎরায় বুঝিয়েছিলেন তাঁর প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’-তেই (১৯৫৫)। তিনি উপন্যাস বা সাহিত্যের বীজটুকু নিয়ে চলচ্চিত্রের ভাষায় রোপণ করেছিলেন। এটা কেবলমাত্র যে ‘পথের পাঁচালী’র ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা নয়, তিনি যখনই বাংলা সাহিত্য বা উপন্যাস নিয়ে ছবি করেছেন তখনই তা ঘটেছে। কাহিনি কখনওই অতিক্রম করেনি ছবিটিকে। কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম ‘পরশপাথর’ (১৯৫৭)। আসলে তিনি পরশুরাম-এর লেখার মজাটা নষ্ট হতে দেননি। তবে যতটা সম্ভব তিনি সাহিত্যকে পরিহার করার চেষ্টা করে গেছিলেন। তবে একটা কমেডিকে কীভাবে চলচ্চিত্রায়িত করতে হয় তার পাঠ দিয়ে গেছেন ভবিষ্যতের জন্য। কমেডি বা কৌতুক যে ভাঁড়ামি নয়, ‘পরশ পাথর’ তারই পাঠ। সত্যজিৎ রায় পুনরায় বাংলা ছবির দিগন্ত উন্মোচন করলেন, বিস্তৃত করলেন। বাঙালি দর্শকদের ধারণাই বদলে দিয়েছেন কমেডির ব্যাপারে। পরেশচন্দ্র দত্ত (তুলসী চক্রবর্তী)-র স্ত্রী রানিবালার নির্বাচন ছিল অসাধারণ! তাঁর কাছ থেকে চূড়ান্ত অভিনয়টি বার করে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিটি চরিত্র চিত্রায়ণের ক্ষেত্রেও একই কথা। ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৪) ছবিতে বিমলা চরিত্রে স্বাতীলেখা চট্টোপাধ্যায় নির্বাচনটিতে ছিল চমক।
‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে নিখিলেশ মনে করতেন বিমলা এক পূর্ণাঙ্গ এক নারী হিসেবে গড়ে উঠুক। কখনওই যেন ঘরকুনো মেয়েলি না-হয় ওঠে। তাই দেখি, সন্দীপের সঙ্গে বিমলার পরিচয় করিয়ে দেন নিখিলেশ। এসব ব্যাপার বাড়ির অন্যদের মতো মেনে নিতে পারেন না বিধবা-জা গোপা আইচ। নিখিলেশের বউঠান ছিল তাঁরই সমবয়সি। বিমলার এসবের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন ঈর্ষাপরায়ণ বিধবা-জা।
নিখিলেশ-বিমলার ফ্যাশনদুরস্ত আধুনিকতাও বিধবা-জা ভালভাবে মেনে নিয়েছিলেন? প্রশ্ন জাগে। সম্ভবত নয়। তাঁর হাবভাব, ঠেসমারা ইত্যাদির মধ্যেই যা প্রকাশিত। উল্টোদিকে বিধবা জায়ের নিখিলেশের ওপর কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারেন কি বিমলা? এটা একটি পরিবারের অন্দরে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনও স্ত্রীই তাঁর স্বামীর ওপর অন্য কারওর কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারেন না। এখানেও পারছেন না। দু’জনের মধ্যে একটা চোরা রেষারেষি ধরা পড়ে। বিধবা জায়ের ভূমিকায় গোপা আইচের অভিনয় অসাধারণ। তিনি কথা দিয়ে যতটুকু-না নিজেকে উন্মোচিত করেছেন তার চেয়ে শরীরী ব্যবহার এবং চালচলনে অনেকবেশি নিজেকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে, তাঁর হাঁটার মধ্যে অদ্ভুত এক দেমাকি ব্যাপার লক্ষ করা যায়। বাড়ির অন্দরমহলে বিধবাদের একধরনের রাজনীতি থাকে। যদি সেই বিধবার হাতে সংসারের চাবিকাঠি থাকে। তা ব্যাপকভাবে দেখা যায়। সেই রাজনীতির মধ্যে থাকে পরশ্রীকাতরতা, হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই রাজনীতির বাইরে যেতে পারেন না বিমলার বিধবা-জা। পরিচালকও এটা দেখাতে চেয়েছিলেন বলেই তাঁর মূল্য দিয়েছেন গোপা আইচ। তিনি তাঁর অবস্থান, শ্রেণিচরিত্র বুঝেই অভিনয়টা করেছেন। বিধবা জায়ের চরিত্রের প্রতি অত্যন্ত সুবিচার করেছেন গোপা আইচ।
পরিচালক সত্যজিৎ রায় অনেকটাই সরে এসেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ থেকে। সরে আসারই কথা। পরিচালক ‘ঘরে বাইরে’-তেও নারী চরিত্রের নির্মাণ ও সৃষ্টি নিজের মতো করে গড়েছেন। তাই বিমলার বিধবা জায়ের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। সবমিলিয়ে খুবই সুন্দর।
তাঁর প্রতিটি ছবির নারীরাই নিজেদের মতো করে নজর কাড়তেন। সে পরিচালকের হোক বা দর্শকের কিংবা সমালোচক-চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের।
‘মহানগর’-এর আরতি-র কথা ধরা যেতে পারে। সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ ছোটগল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘মহানগর’ (১৯৬৩)। কাহিনিকারের কাছে এই গল্পটি ছিল হয়তো ভূমিকা কিংবা মুখবন্ধ। কিন্তু পরিচালক কাহিনির ভিতর ‘মহানগর’ অবলোকন করেছিলেন।
ষাটের দশকে মেয়েদের বাইরে বেরিয়ে চাকরি করাটা অত সহজ ছিল না। সেইসময় বা তার কিছুটা আগে পূর্ব বাংলা থেকে শরণার্থী হয়ে আসা কিছু মহিলা কাজের জন্য বেরোচ্ছিলেন বটে কিন্তু সেটা সামগ্রিক চিত্র ছিল কি? হয়তো ছিল কিংবা নয়। কিন্তু দূরদর্শী সত্যজিৎ রায় অনেকটা দূর দেখেছিলেন। তাই তিনি আরতিকে ঘরের বাইরে বার করলেন আত্মনির্ভরশীল করার জন্য। মধ্যবিত্ত সংরক্ষণশীল বাঙালি বাড়ির বউ শ্বশুর-শাশুড়ি, শিশুপুত্রকে রেখে সেলসগার্ল বা ক্যানভাসিংয়ের চাকরি করতে যাবে এটা বেশিরভাগ বাঙালি বাড়ির ভাবনার বাইরে ছিল ষাটের দশকের প্রথম দিকে। এখনও একাংশ বাঁকা চোখে দেখেন। এই ধরনের চাকরি বাঙালি মহিলাদের কাছে বেশ সাহসের দরকার ছিল, এখনও বিদ্যমান। তবুও আরতিকে দেখা গেল এমন চাকরি নিতে। কারণ, সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আসবে। দু’জনে মিলে চাকরি করলে সংসারের অসচ্ছলতা দূর করা যাবে। চাকরি করাটা সেইসময়ে একজন গৃহবধূর কাছে ছিল বিশাল মানসিক চাপের। এখনও কিছু কিছু পরিবারে দেখা যায় এমন পরিস্থিতির। এই যে নানারকমের টানাপোড়েন তা পরিচালকের দৃষ্টি এড়ায়নি। তার জন্য প্রয়োজন ছিল মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মতো একজন অভিনেত্রীর মুখ। যার মুখে ভাবপ্রকাশে সবকিছুই খুঁজে পাওয়া যায়। আবার চাকরিরত মহিলার ছাপও তাঁর মুখে পাওয়া যায়। হয়তো তার অন্যতম কারণ হতে পারে মাধবী মুখোপাধ্যায় কিশোরীবেলা থেকেই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হতে শিখেছিলেন। এছাড়াও তাঁর মধ্যে ছিল রোম্যান্টিক অ্যাপ্রোচ এবং আকর্ষণ। তার পুরোটাই মাধবী মুখোপাধ্যায়ের থেকে নিংড়ে বার করেছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। একটা চাপা আকর্ষণ ছিল মাধবীর মধ্যে সেটাও খুবই নির্মল-সুচারুভাবে ব্যবহার করেছিলেন পরিচালক। ‘মহানগর’ ছাড়াও ‘চারুলতা’, ‘কাপুরুষ’-এও।

ষাটের দশকের বাংলা ছবির দর্শকের কাছে পর্দায় লিপস্টিকের ব্যবহারও ছিল আকর্ষণের এক বহিঃপ্রকাশ। ‘কমপ্যাক্টস অ্যান্ড কসমেটিক’ বইয়ের লেখিকা ম্যাডেলিন মার্শ বলছেন, লাল ওষ্ঠরঞ্জনী (red lipstick) হল নারীশক্তির প্রতীক। বটেই তো ‘মহানগর’-এর আরতি নারীশক্তির প্রতীক। ষাটের দশকের কর্মরত কিংবা যাঁরা কাজকর্মের জন্য চেষ্টাচরিত্র করছিলেন যেসব মহিলা তাঁদের অনেকটাই সাহস জোগায় আরতি। প্রতিটি ক্ষেত্রে আরতির প্রতিক্রিয়াগুলোও সুন্দরভাবে গেঁথেছিলেন পরিচালক। ফলে, ছবির পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে উঠেছিল। এরপর ‘চারুলতা’ (১৯৬৪) এবং ‘কাপুরুষ’ (১৯৬৫) ছবিতে চমৎকার ব্যবহার করেছিলেন। ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’ এবং ‘কাপুরুষ’ তিন ছবির তিন মাধবী তিন রকম। সে তো হবেই। ভিন্ন চরিত্র ভিন্ন রকম হবেই। দর্শক হিসেবে কখনওই মনে হয় না তিনটিই একই অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়।
‘কাপুরুষ’ ছবির গভীরতার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে আসে নানাবিধ সামাজিক প্রশ্ন। একজন মহিলার পক্ষে নিজ-সিদ্ধান্ত নিজের নেওয়া কতটা যে ঝুঁকির এবং অসহায় হয়ে ওঠে তা করুণার মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন পরিচালক। করুণাকে চরম প্রতিকূল অবস্থায় দাঁড়ও করান। একজন নারীর বেঁচে থাকার জন্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষকে প্রয়োজন পড়ে। সেই পুরুষটিকে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে৷ সেই পুরুষ পছন্দের হোক অপছন্দের। এটি অবশ্য একরকমের চিরন্তন সত্য। করুণাও তার বাইরে যেতে পারছেন? পারছেন না। যদিও বর্তমানে বহু মহিলা একাকী থাকেন। নিজেদের ইচ্ছামতো জীবন কাটান। তবে এটা সামগ্রিক চিত্র নয়। করুণারা সেইসময়ও ছিলেন, এখনও আছেন। তাঁদের সংসারজীবন কাটাতে হয় পছন্দ-অপছন্দের পুরুষটির সঙ্গেই। তাই করুণার সঙ্গী হয়ে ওঠে ঘুমের ওষুধ। যা একরকমের নেশা। ঘুমই তাঁকে ভুলিয়ে রাখতে পারে কাপুরষ প্রেমিক আর কল্পনা-বোধহীন মদ্যপ স্বামীর থেকে।
ছোট ছোট টুকরো দৃশ্যে অসাধারণ সব চিত্রকল্প ফুটে ওঠে ছবিতে। রেস্তরাঁর কেবিনে অমিতাভের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) সিগারেট ধরানোর ফাঁকে করুণাকে স্পর্শ করা। এই দৃশ্যে মাধবীর চুল বাঁধার স্টাইল, চাউনি এবং দৃষ্টি ছবির মুহূর্তটিকে নিয়ে যায় অন্যমাত্রায়। দর্শকের হাতে ছেড়ে দেন পরিচালক। দর্শকদের ভাবতে দেন করুণা-অমিতাভ আরও একটু ঘনিষ্ঠ হবে? কেননা, ওঁরা বসেছিলেন পর্দাটানা কেবিনে। সেই কলকাতার রেস্তরাঁগুলোতে পর্দাটানা কেবিন থাকত। পুরুষ-মহিলারা প্রেম করার জন্য কেবিনওয়ালা রেস্তরাঁ খুঁজতেন। আরতির মতো করুণাও একজন বাঙালি কিংবা ভারতীয় নারীর প্রতিনিধি।
সত্যজিৎ রায়ের নিজের কথায় ‘চারুলতা’ তাঁর সবচেয়ে নিখুঁত ছবি। তাই তিনি বলেন, “আজও যদি ‘চারুলতা’ আবার করি, ঠিক একইভাবে করব।”
ছবির মতো নিখুঁত ছবির চারু অর্থাৎ অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়। ‘মহানগর’, ‘কাপুরুষ’-এও তিনি ছিলেন খুঁতহীন। সেটাই তো হবে। তিনটি চরিত্রেই তিনি এতটাই স্বাভাবিক, সাবলীল যে কখনওই মনে হয় না একই অভিনেত্রী তিনটি ভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তিনটি ছবির পরিচালক যে সত্যজিৎ রায়। তা সত্ত্বেও অভিনেতা-অভিনেত্রীর একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। সেখানে পুরো কৃতিত্ব মাধবী মুখোপাধ্যায়ের।
‘চারুলতা’য় চারুর নিঃসঙ্গতা চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। অমলের আবির্ভাব ছিল চারুর জীবনে ঝড়ের মতো, তার উচ্ছ্বাস চোখেমুখে ফুটে ওঠে চারুর। অমলের প্রবেশ যে চারুর জীবনে ঝড় ওঠাবে এবং সেই ঝড় যে ভবিষ্যৎ ঘটনার সংকেত দিচ্ছে তার জীবনে তা অসম্ভব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছিলেন মাধবী।
ছবির উপস্থাপনা থেকেই চারুর নিঃসঙ্গতাকে সুন্দরভাবে নিজের ভিতর চারিত করেছিলেন মাধবী। আসলে পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর ভাবনাকে অর্থাৎ তিনি কি বলতে চাইছেন চারুর মধ্যে দিয়ে তা সম্পূর্ণভাবে বোঝাতে সফল হয়েছিলেন। মাধবী তা ঠিকমতো বুঝেওছিলেন। সেই কারণেই চারুর চরিত্রে তাঁর নির্বাচন ছিল মাধবী মুখোপাধ্যায়। ‘মহানগর’ করার সময় বুঝেছিলেন মাধবীকে কোন চরিত্র করানো যায় আর যায় না। তার পরেই ‘কাপুরুষ’-এ করুণা। আরতি, চারু আর করুণা তিনটি নারীই কোথাও যেন এক পঙক্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ তিনজনই কিন্তু নিজ ভূমিকায় স্ব-উজ্জ্বল। এবং তাদের নিজের পরিচয়ে পরিচিত।
চারু-ভূপতির ভিতর যে একটা শৈত্য সম্পর্কের ব্যাপার ছিল, তা বোঝা যায় অমলের আসার পরপরই। অমল আসবার পরই চারুর মানসিকভাবে পুরুষ-স্পর্শ অনুভূত হয়। কোথাও চারুর মধ্যে চাপা আকর্ষণও কাজ করে। তার বহিঃপ্রকাশ কিছুটা হলেও পাই চারু যখন দূরবিনে দেখতে পায় এক মহিলা তার শিশুসন্তানকে আদর করছে। আবার অমলকে দ্যাখেন। আসলে ছবি শুরুর প্রথম কয়েক মিনিট বিনা সংলাপে চারুর নিঃসঙ্গতা বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিচালক তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষায়। শুধুমাত্র শোনা যায় সুর করে চারু বলছেন, ‘ব-ঙ্কি-ম, ব-ঙ্কি-ম’। দর্শকরা বুঝে নেন বিশাল বাড়িতে চারুর নিঃসঙ্গতা। তাই দর্শক-মন সংবেদনশীল হয় চারুর প্রতি।
তিনটি চরিত্রের তিন মাধবী তিনরকম। আসলে মাধবী যখন অভিনয় করেন তখন তিনিই হয়ে ওঠেন ছবির সেই চরিত্র। তিনি অনায়াসেই চরিত্রের গহনে প্রবেশ করতে পারেন। এবং চরিত্রের খুঁটিনাটি বার করে আনতে পারেন। সঙ্গে তাঁর বাঙালি নারীর সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিত্ব অভিনীত চরিত্রটিকে সঙ্গ দেয়। যদিও সেই সৌন্দর্য বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে। সবমিলিয়ে মাধবী তাঁর চরিত্রের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল মন নিয়ে নিরীক্ষণ করেন। তাই আরতি, চারু, করুণার মাধবী, ভিন্ন তিন অভিনেত্রীকে দেখি।
সত্যজিৎ রায় আর এক অভিনেত্রীকে চমৎকার ব্যবহার করেছেন। তিনি শর্মিলা ঠাকুর। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করেছেন। শর্মিলা ঠাকুর ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯)-এ অপর্ণা, ‘দেবী’ (১৯৬০)র দয়াময়ী। এ-ছবিতেও তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রীর ভূমিকায়,
‘নায়ক’ (১৯৬৬)-এর অদিতি সেনগুপ্ত, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৭০)র অপর্ণা, ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১)র সুদর্শনা বা টুটুল।
প্রতিটি ক্ষেত্রে শর্মিলার বুদ্ধিদীপ্ত-সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন দর্শকেরা। যার আবিষ্কারক এবং মূল কারিগর পরিচালক সত্যজিৎ রায়। পাঁচের দশকের শেষে পর পর দু’বছর দু’টি ছবি করছেন, একটি ‘অপুর সংসার’ অন্যটি ‘দেবী’। দু’টি ছবিরই বিষয় ভিন্ন। একেবারে বিপরীত মেরুর ভূমিকা শর্মিলার। অপর্ণা শহুরে দরিদ্র জীবনে স্বামীর সংসারে মানিয়ে নেন। স্বামী অফিস থেকে ফিরলে তার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করেন। কাগজের ঠোঙা ফুলিয়ে ফাটিয়ে। যা ছিল বাল্যকাল, কৈশোরের চমকে দেওয়ার এক খেলা। সিগারেটের প্যাকেটে লিখে রাখেন সিগারেট না-খাওয়ার। অপুকে বাড়তি টিউশনগুলো ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। অপু খেতে বসলে পাশে বসে তাকে বাতাস করেন অপর্ণা। অপু-অপর্ণার দাম্পত্য জীবনের পরিবেশ এবং সংলাপ আর যাপনচিত্র এক শিল্পসৃষ্টি। সেই সৃষ্টির পরীক্ষায় শর্মিলা ঠাকুর কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ। অপু অর্থাৎ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আড়ালে থাকা সত্ত্বেও শর্মিলা ভীষণভাবে উন্মীলন করতে পেরেছেন নিজেকে। সেখানে তাঁর নির্দোষ-সৌন্দর্য কাজে আসে। দর্শক যে-রূপমাধুরী ভালবাসেন।
অপর্ণা যেমন অপুকে বাতাস করেন তেমনই দয়াময়ী মাটিতে বসে তার শ্বশুরমশায় কালীকিংকরের পায়ে তেলমালিশ করেন সন্ধ্যারাত্রে। দয়াময়ী অর্ধ অবগুণ্ঠিতা। কালীকিংকর তাঁর বউমাকে বলেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পর ভেবেছিলেন কোনও কালীতীর্থে কাটিয়ে দেবেন বাকিটা জীবন। কিন্তু দয়াময়ী পুত্রবধূ হয়ে আসবার পর তাঁর সেই ইচ্ছে আর হল না। কালীকিংকর বলছেন, কি তোমার গুণ, রূপ মা, শূন্য সংসারটা আবার ভরে উঠল।
দয়াময়ীর মধ্যে দেবীত্ব আরোপ করা কালীকিংকরের পুরোটাই মনস্তত্ত্বের খেলা। এই খেলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শর্মিলা ঠাকুরের অভিনয় এবং তাঁর অলৌকিক জাদু সৌন্দর্যের ব্যবহার করা এককথায় অনবদ্য। দয়াময়ী এবং দেবী অর্থাৎ মানবী আর দেবী-- দু’টি ভূমিকায় অসাধারণ শর্মিলা। দেবী হয়ে সে ঠুঁটোজগন্নাথ তার কিচ্ছু করার নেই আবার দয়াময়ী শর্মিলার ছবিতে অনেককিছু করার রয়েছে। এই ভয়ানক নাট্যগঠনে চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে যান শর্মিলা ঠাকুর। এখানেই সত্যজিৎ রায়ের হাতে চমৎকারভাবে ব্যবহৃত শর্মিলার বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দরতা। দেবী এবং দয়াময়ীর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব অপূর্ব ফুটিয়ে তোলেন শর্মিলা। বিশেষ করে, একদিন রাতে স্বামীর সঙ্গে পালাতে গিয়েও পারে না। ভাবে সত্যিই যদি সে দেবী হয় তাহলে এভাবে পালালে স্বামী এবং সংসারে অভিশাপ নেমে আসতে পারে। তবে ‘অপুর সংসার’-এ যেমন অপু-অপর্ণার দাম্পত্য মুহূর্ত যেমন মূর্ত হয়ে ওঠে, তেমনটা উমাপ্রসাদ-দয়াময়ীর ক্ষেত্রে হয় না। হয়তো এমনটাই চেয়েছিলেন পরিচালক। এ-ছবিতে হরসুন্দরীর চরিত্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং বাস্তবানুগ অভিনয় করেছেন। এটা অবশ্য তাঁর কাছে আমাদের প্রাপ্যই ছিল। এর আগেও করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দক্ষতা পাই ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ছবিতে। বিশেষ করে ‘অপরাজিত’ ছবিতে তাঁর অভিনয় বেশি মুদ্ধ করে। যখন একাকিত্বের শঙ্কায় রাগে-দুঃখে চড় মারেন তারপর মান ভাঙানো অতিবাস্তব হয়ে ওঠে। আর একটি জায়গায় যেখানে সর্বজয়া বলেন, ‘তোর টাকা দিয়ে আমার চিকিৎসা করাবি তো?’ দেখেন অপু ঘুমিয়ে পড়েছে। এই দৃশ্যে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক্সপ্রেশন আলাদা করে বুঝিয়ে দিতে হয় না। আমাদের বুকে লাগে। আসলে প্রতিটি মা-ই তাঁর সন্তানের কাছে অবহেলা সহ্য করতে পারেন না। আবার উল্টোদিকে মায়ের দুঃখকষ্ট সন্তানদের পীড়া দেয়। যাইহোক, নিজের অসুখের কথা লুকিয়ে এবং মৃত্যু আসন্ন জেনেও ছেলেকে খবর না-দেওয়ার মধ্যে নিজের স্বাধীন ব্যক্তিসত্তা আর তীব্র আত্মসম্মানবোধ প্রকাশ পায় সর্বজয়ার ভিতর। এ-দৃশ্যে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে যে-ভাব প্রকাশ করেন তা দেখে দর্শক-মন গুমরে গুমরে ওঠে। আরও একবার দর্শক ভীষণভাবে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠেন। যখন সর্বজয়া বুঝতে পেরেছেন ছেলে যৌবনে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার বাইরের জগতটা বড় হয়ে উঠছে, চিনছে সে। তাই-ই হয়। অত্যন্ত বাস্তব। তাই মা-ই ক্রমশ নিজেকে সরিয়ে আনেন সন্তানের কাছ থেকে। সর্বজয়াও নিজেকে সরিয়ে আনেন পুত্র অপুর জগত থেকে। কখনও কখনও নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছেন না, এই অন্তর্দ্বন্দ্বে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় অপরাজিতা। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানাবিধ মুডের অভিনয় কিংবা প্রকাশভঙ্গি দৃশ্যের ভাবগভীরতা বাড়িয়েছে। দর্শককে আগাগোড়া মুড়ে রেখেছেন ছবির সঙ্গে। ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘অপরাজিত’ দু’টি ছবিতেই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়া এবং তার সঙ্গে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থাৎ সর্বজয়ার অভিনয় এক অসাধারণ শিল্পচেতনার পরিচয় দেয়।
যাইহোক, ১৯৬০-এর পর ১৯৬৬-তে আবার শর্মিলা ঠাকুরকে ‘নায়ক’-এ অদিতি সেনগুপ্তের চরিত্রে দেখি। এর মাঝে ছ’টি ছবি করেছেন সত্যজিৎ রায়। অদিতির মধ্যে ছিল কমনীয় এবং ঔজ্জ্বল্যময় বুদ্ধির ছাপ। তা ছিল শর্মিলার মধ্যে। নায়ক অরিন্দমের অর্থাৎ উত্তমকুমারের বিপরীতে শর্মিলাই ছিল পরিচালকের একমাত্র পছন্দ। অদিতি অর্থাৎ শর্মিলার অভিনয়ের মধ্যে একটা আপাত নিস্পৃহভাব লক্ষ করা যায়। সেটা পরিচালকের নির্দেশেই করেছিলেন বলে মনে হয়। কেননা, অরিন্দম এবং অদিতির শ্রেণি চরিত্র ভিন্ন। অদিতির মধ্যে ছিল মধ্যবিত্ত এবং সুস্থ মূল্যবোধ। একসময়কার মধ্যবিত্ত অরিন্দম গ্ল্যামার জগতের কল্যাণে সেলিব্রিটি এবং উচ্চবিত্ত বা ধনী।
সেইকারণে শর্মিলার অভিনয়ে দেখা যায় আপাত নিস্পৃহভাব। অদিতির চরিত্রের সঙ্গে খাপ যায়। সাংবাদিকতার অন্যতম একটা লক্ষ্যই হল গ্ল্যামারের মোহে পড়তে নেই। অদিতিরও তাই ছিল না। এই পুরো ব্যাপারটি চমৎকার ফুটিয়ে তোলেন শর্মিলা। তাই তো তাঁর মধ্যে অরিন্দমের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, আছে শুধু তাঁর পত্রিকা ‘আধুনিকা’র জন্য সাক্ষাৎকারের ব্যাপারটা। একজন নামী ব্যক্তিত্বকে হাতের কাছে পেলে কোনও সাংবাদিকই সেই সুযোগ হাতছাড়া করেন না। অদিতিও তাই করতে চাননি। ওইটুকুই আগ্রহ ছিল তাঁর অরিন্দমের প্রতি। অদিতির মধ্যে কি কোথাও একটা উন্নাসিকতাও ছিল? হয়তো ছিল।
সম্ভবত সেই কারণে ট্রেন দিল্লি পৌঁছলে যে হুড়োহুড়ি ছিল’নায়ক’কে ঘিরে। অত হুড়োহুড়ির মধ্যেও অরিন্দম খোঁজার চেষ্টা করেন অদিতিকে। অদিতি কিন্তু ‘নায়ক’-কে পাত্তা না-দিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে যান। অদিতির এমন নিস্পৃহতার যুক্তি এবং মানে উঠে আসে ছবিতে।
‘নায়ক’-এর অদিতি এবং ‘সীমাবদ্ধ’র সুদর্শনা বা টুটুলের মধ্যে অভিনয়ের মধ্যে কোথাও একটি সমান্তরাল লাইন আছে। দু’টি চরিত্রের অভিনয়ের মধ্যে পাওয়া যায় সেই আপাত নিস্পৃহতা। তার কারণও একটা খুঁজে পাওয়া যায় নিরীক্ষণ করলে। ‘নায়ক’-এ যেমন অরিন্দমের সঙ্গে অদিতি একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা ওই করেছেন সবসময়ই। তাই অরিন্দম-অদিতির মধ্যে রোম্যান্স গড়ে ওঠার কারণও থাকে না। ‘সীমাবদ্ধ’র সুদর্শনার জামাইবাবু শ্যামলেন্দুর প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ অনুরাগ ছিল সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেননা, যে-জামাইবাবু বা যে-পুরুষটিকে সুদর্শনা পছন্দ করতেন, ভালবাসতেন তিনি এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুরুষটিকে বা জামাইবাবুকে নয়। শ্যামলেন্দু আরও ওপরে উঠতে চান। সেই স্বপ্ন দেখেন তিনি। সুদর্শনার দিদি দোলনচাঁপা অর্থাৎ পারমিতা চৌধুরীও দেখেন। এটা মেলাতে পারেন না শর্মিলা বা সুদর্শনা। তাঁর কাছে আগের এবং এখনকার জামাইবাবু শ্যামলেন্দু সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মানুষ। সুদর্শনা জানেন কোন বাঁকা পথে জামাইবাবুর এই উত্তরণ। এই ব্যাপারটা তৃপ্ত করে না সুদর্শনাকে। তবুও পরিচালক কখনওই তাঁকে উঁচুগলার প্রতিবাদী করেননি। করানোর কথাও নয়। পরিচালক যে, সত্যজিৎ রায়। সুদর্শনার প্রতিবাদ করেন কখনও মৃদু, কখনও ব্যঙ্গ-পরিহাসে। সুদর্শনার এই যে চরিত্রের রকম, অভিনয়ে তা শর্মিলা পুঙখানুপুঙখ মেনে চলেছেন। মনে হয়, যেমনটি পরিচালক চেয়েছিলেন শর্মিলা ঠাকুর তেমনটিই করেছেন। সেইজন্য মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং শর্মিলা ঠাকুর হলেন একেবারে পরিচালকের অভিনেত্রী।

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র অপর্ণা কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য ছবির নারী চরিত্রগুলো থেকে একেবারে ভিন্ন। ১৯৫৯-এ ‘অপুর সংসার’-এর অপর্ণা আর দশবছর পরের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র অপর্ণা একেবারে দুই মেরুর। ঠিক অপু আর অসীমের তফাত যেমন। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র অপর্ণা কি কিছুটা হলেও অহংকারী? কিছুটা হলেও তেমনই তো তাঁর কথাবার্তায় প্রকাশ পায়। অসীম যখন বলেন, ‘আপনাকে বোঝা গেল না।’ অপর্ণা উত্তর দেন, ‘তার দরকার আছে কি।’ এর মধ্যে অপর্ণার অহং প্রকাশ কি পায় না, পায়। এভাবে অনেকসময় অসীমের কথা বানচাল করেন তিনি। পাশাপাশি মেমোরি গেমের ভিতর দিয়ে পরিচালক তাঁর অর্থাৎ অপর্ণাকে বুঝিয়ে দেন। খেলা শুরুতেই জয়া যখন বলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন বোঝা যায় তিনি খুবই চিরাচরিত ধারার মানুষ। সেটা আমরা বুঝতে পারি যখন তিনি বাড়িতে একাকী থাকবেন জেনে সঞ্জয়কে কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। জয়া সঞ্জয়কে আকর্ষণ করার জন্য বসতে বলে ঘরের ভিতর গিয়ে সেজে আসেন। বেরিয়ে এসে বলেন, ‘কেমন লাগছে আমায় দেখতে বলুন তো?’ সঙ্গে চাপা ইঙ্গিত। ভিতু সঞ্জয় সুযোগ নেওয়া দূরে থাক, ঘেমে-নেয়ে ওঠেন। সঞ্জয় সাড়া দেন না জয়ার ইঙ্গিতে। লজ্জিত হন জয়া। তাই সঞ্জয় যেতে বলেন। ঘরে ঢুকে বন্ধ করেন দরজা।
‘অপুর সংসার’-এ অপর্ণা যেমন তাঁর ভূমিকার প্রতি অবিচার করেননি, তার দশ বছর পর ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র অপর্ণাও করেননি। শর্মিলা ঠাকুরের দুই অপর্ণা অনবদ্য। সত্যজিৎ রায়ের যে-চরিত্রে শর্মিলাকে ঠিক সেই চরিত্রে তাঁকে এনেছেন। এবং এই চরিত্রগুলো শর্মিলা ঠাকুরকে ব্যতীত অন্য কাউকে দিয়ে হত বলে মনেও হয় না। মেমোরি গেমে হেরে যাওয়ার পর শর্মিলা অর্থাৎ অপর্ণার ক্লোজ শটটিতে অভিনেত্রীর এক্সপ্রেশনে সব বুঝিয়ে দেন পরিচালক।
সত্যজিৎ রায় কিশোরী মনস্তত্ত্বর ছবি ‘তিনকন্যা’। ‘মণিহারা’ বাদে। ‘পোস্টমাস্টার’ এং ‘সমাপ্তি’ দু’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছবি পরিচালকের। বিশেষ করে, ‘পোস্টমাস্টার’। এই ছবিতে রতন অর্থাৎ চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বালিকা না-বলে সদ্য কিশোরী বলাটাই বোধহয় সমীচীন। রতনের বাল্যকাল সদ্য গত হয়েছে। তবুও রতনের জগতে আর বাল্যকাল নেই। নেই শিশু রতন, বা বালিকা রতন। প্রাপ্তবয়স্কদের জগতে তার বিচরণ। তার কোনও ভবিষ্যৎ কল্পনাও নেই। থাকার কথাও নয়। কেননা, দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করা কোনও মানুষেরই না-থাকে শৈশব, না-থাকে কৈশোর, কোনও কিছুই থাকে না। সে শুধু জানে কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে। তাই রতনের জীবনে এক পোস্টমাস্টারবাবুর বদলে আর একজন আসে। ‘পথের পাঁচালী’তে অপু-দুর্গার প্রকৃতির সঙ্গে একটা বন্ধন ছিল বা জড়ানো ছিল ‘পোস্টমাস্টার’-এ রতনের তেমন নেই। যদিও রতন ছিল প্রকৃতির কাছাকাছি। কিন্তু পরিচালক রতনের সঙ্গে প্রকৃতির কোনও সম্পর্ক তৈরি করেননি। করার কথাও নয়। তার জীবনটাই গদ্যময়। রতন অর্থাৎ চন্দনা তার অভিনয়ে সেই গদ্যের ভাবপ্রকাশ করেছে। বিশেষ করে, রতনের অসামান্য এক ভাবপ্রকাশ দেখি, যখন পোস্টমাস্টার নন্দবাবু অর্থাৎ অনিল চট্টোপাধ্যায় স্নান করতে যাওয়ার আগে বিড়ি ধরাতে যাবেন এমন সময় হঠাৎ এক পাগলের আবির্ভাব। কলকাতা থেকে আগত পোস্টমাস্টারবাবু ভীত। সেইসময় পোস্টমাস্টারের স্নানের জন্য জল ভর্তি বালতি হাতে রতনের ধমক। বলে, ‘ইনি নতুন বাবু, একে ভয় দেখাবি না।’ পোস্টমাস্টার নন্দবাবুর কাছে বা বলা ভাল দর্শকের কাছে পরিচালক সত্যজিৎ রায় চমৎকার এক প্রস্তাবনা করলেন রতনের। ত্রাতা রতনের প্রতি ভরসা বাড়ল নতুন পোস্টমাস্টার নন্দবাবুর।
নন্দবাবুরও রতনের প্রতি স্নেহ বাড়ে যখন শোনেন রতনের কেউ নেই। তিনি বলেন, ‘তুই পোস্টমাস্টারবাবুদের কাজ করে যাস।’ রতনের মুখে হাসি। এই দৃশ্যে চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায় চমৎকার অভিনয় করেন। ‘পোস্টমাস্টার’-এ বহু সুন্দর দৃশ্য রয়েছে। মানবিক মুহূর্তও আছে। সেসব দৃশ্যে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন চন্দনা।
‘মণিহারা’র মণিমালিকার চরিত্রে কণিকা মজুমদারকে ভাল লাগে। সন্তানহীনা মণিমালিকা তাঁর ভাললাগাকে মিশিয়ে ফেলেন সোনার অলংকারে। তিনি ভোগেন নার্সিসাস কমপ্লেক্সে। মণিমালিকার গুণ যা ছিল সবই ঢেকে গেছে সোনার অলংকারে। কণিকা মজুমদার চমৎকার অভিনয় করেন মণিমালিকার চরিত্রে।
তিনকন্যা’র এক কন্যা ‘সমাপ্তি’। মৃণ্ময়ীর চরিত্রে কিশোরী অপর্ণা সেনের অভিনয় নূতনতর স্বাদ এনেছিল বাংলা ছবিতে। পরবর্তী কালে ‘পিকু’ ছবিতে সীমা বা পিকুর মায়ের ভূমিকায় অপর্ণা সেনের অভিনয়ে আধুনিকতার পরিচয় পাই। যাইহোক, ‘সমাপ্তি’ ছবিতে অপর্ণার বাচনভঙ্গি, আচার-আচরণে নিজস্বতা ছিল। ছবির মজার মুহূর্ত কিংবা হিউমার বিশুদ্ধভাবে অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। অপর্ণা অভিনয় করছেন বলে মনেই হয়নি। বিশেষ করে, ফুলশয্যার রাতে অপর্ণা বা মৃণ্ময়ীর ঘর থেকে পালিয়ে বাইরে প্রকৃতির মাঝে যাওয়ার দৃশ্যটি অসাধারণ! এমন দৃশ্য সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবিতে খুব কম ব্যবহার করেছিলেন। অপর্ণা সেনের পালিয়ে খাঁচায় রাখা কাঠবিড়ালি ‘চরকি’র কাছে ভাললাগা, ভালবাসার প্রকাশ অনবদ্য। এবং তাঁর মধ্যে মুক্তির আনন্দ! এমনটাই আমরা দেখি মফসসল বা গ্রামগঞ্জের কিশোরীদের মধ্যে। সবমিলিয়ে অপর্ণা সেন মুগ্ধ করে আমাদের। ‘পিকু’-তেও যেমন মুগ্ধ করেন অপর্ণা।

সত্যজিৎ রায়ের প্রায় প্রতিটি ছবিরই নারী চরিত্র কিংবা অভিনেত্রীরা নিজের জায়গায় বেশ ক্ষমতাশালিনী৷
যেমন ‘অভিযান’ (১৯৬২)-এ গুলাবি অর্থাৎ ওয়াহিদা রেহমান অসাধারণ। ওয়াহিদা রেহমান গুলাবি হয়ে ওঠেন সাবলীলভাবে। সমান্তরাল এক চরিত্র নীলি বা মেরি অর্থাৎ রুমা গুহঠাকুরতাও বেশ সাবলীল। এবং তাঁকে কখনওই মনে হয়নি এই ছবিতে আর এক বড় অভিনেত্রী ওয়াহিদা রেহমান আছেন। তা থাকারও অবশ্য কথা নয়, ছবির পরিচালক সত্যজিৎ রায়। ওয়াহিদা রেহমান এবং রুমা গুহঠাকুরতা দু’জনকেই আলাদা করে মনে রাখেন দর্শক। যেমন দর্শক মনে রেখেছেন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র মনীষা কিংবা অলকনন্দা রায়কে। মনীষা নিষ্প্রাণ মোটেও নয়, কিন্তু তাঁকে দেখলে তাই মনে হয়। সবসময়ই সুব্যবহার ভদ্রতায় মোড়া। তাঁর বংশমর্যাদা, সামাজিক মর্যাদা এগুলো তাঁকে শিখিয়েছে। মনীষা মেনে নিতে পারেন না প্রণবকে। তার মূল্যবোধকে মেনে নিতে পারে না। মনীষা দেখেছেন তাঁর দিদিকে। দিদি দাম্পত্যজীবনে সুখী নন। বাবার পুরুষের একনায়কতন্ত্র দেখছেন।
মনীষার মা লাবণ্য অর্থাৎ করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সবকিছু মানিয়ে নিতে নিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। তবুও কোথায় যেন আলাদা করে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। পুরনো লাবণ্যর প্রকাশ আমরা দেখি বহুকাল পর। যখন তিনি নিজেকে শামুকের মতো বার করেন। তাই তো তিনি নির্জন অবকাশে অমন করে গেয়ে উঠতে পারেন, ‘এ পরবাসে রবে কে হায়’। এখানে কী কোথাও লাবণ্যের মধ্যে চারুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে! যদিও সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরায় চারু তখনও সৃষ্টি হয়নি। চারু আসে ঠিক দু’বছর পর। হয়তো পরিচালকের ভাবনায় চারু ছিলেন। কিংবা চারুর ভিতর লাবণ্য আসে। লাবণ্য চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
মনীষা পড়ে থাকেন দুই পুরুষের মাঝে। একজন বাবা ইন্দ্রনাথ চৌধুরীর (ছবি বিশ্বাস) স্নেহধন্য উচ্চবিত্ত প্রণব ব্যানার্জি (এন বিশ্বনাথন) অন্যজন অশোক (অরুণ মুখোপাধ্যায়)। অশোক রোম্যান্টিক, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং সরল এক যুবক। সাদামাটা বেশভূষা। সত্যবাদী অশোকের আত্মমর্যাদাবোধ, মূল্যবোধ কোথায় যেন মনীষার মুল্যবোধের সঙ্গে মেলে। এবং কোথায় যেন প্রণব, মনীষা, অশোক এক ত্রিকোণ প্রেমের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এসব জায়গায় বা দৃশ্যে ভীষণ ভাল অলকানন্দা রায়। তাঁর অভিনয়ের পরিবর্তন মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়।
মনীষা এবং লাবণ্যর মিশ্রণ কোথাও একটা খুঁজে পাওয়া যায় ‘আগন্তুক’ (১৯৯১)-এর অনিলা চরিত্রে অর্থাৎ মমতা শঙ্করের ভিতর। দু’টি ছবিই পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের নিজেরই চিত্রনাট্য থেকে করা। তাই হয়তো আসতে পারে লাবণ্য-মনীষা চরিত্রের সংমিশ্রণ অনিলার মধ্যে। অনিলা এবং সুধীন্দ্র বোসের পরিবারে ‘আগন্তুক’ মনোমোহন মিত্র। যিনি বহু বছর আগে বাড়ি ছেড়েছিলেন। হঠাৎ করে আবির্ভাব সুধীন্দ্র বোসের বাড়িতে। মনোমোহন আবার বলেন তিনি অনিলার আত্মীয়। অনিলা মেনে নিলেও সুধীন্দ্র (দীপঙ্কর দে) মানতে রাজি নন। এমনকী সুধীরন্দ্রর উসকানিতে ব্রোঞ্জের দু’টি মূর্তি চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে সরিয়ে ফেলেন, আবার স্বস্থানেই রেখে দেন। মনোমোহনকে চোর বা অসৎ মানুষ বলে মানতে রাজি নন অনিলা। এছাড়াও সুধীন্দ্রনাথের উকিল বন্ধু পৃথ্বীশ সেনগুপ্ত (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) নির্দয়ভাবে জেরা করেন। তিনি জোর করে প্রমাণ করতে চান ‘আগন্তুক’ মনোমোহন ঠগ, জোচ্চর ছাড়া আর কিছুই নয়। দর্শকের ভিতরও দোদুল্যমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কেননা, বাস্তবে এমন ঘটনা কোনও বাড়িতে ঘটলে সেই গৃহকর্তা কি মেনে নেবেন? এ-প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে দর্শক-মনে ওঠে। দর্শকদের মতো টানাপোড়েন তৈরি হয় অনিলা অর্থাৎ মমতা শঙ্করের ভিতর। এখানে মনীষার সঙ্গে অনিলার মিল পাওয়া যায়। সাঁওতাল গ্রামে গিয়ে শহুরে সভ্যতার ধড়াচুড়ো ত্যাগ করে সাঁওতালদের সঙ্গী হয়ে নাচতে শুরু করেন অনিলা বা মমতা শঙ্কর। তখন কী মনে পড়ে না নির্জন অবসরের লাবণ্যকে! মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় দুই পরিবেশে দুই নারীকে। অনিলাও তো নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন লাবণ্যের মতো। কেননা, তিনিও তো নিজেকে প্রকাশ করার মতো কোনও প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছিলেন না। অনিলার ভূমিকায় মমতা শঙ্কর অনবদ্য। শর্মিলা ঠাকুরের মতো মমতা শঙ্করকেও বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। যেমন, ‘গণশত্রু’ (১৯৮৯)-তে ইন্দ্রাণী বা রানুর ভূমিকায়, ‘শাখা প্রশাখা’ (১৯৯০)-য় তপতী চরিত্র। ‘আগন্তুক’-এর অনিলা তো আছেই।
সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০) এবং ‘জনঅরণ্য’ (১৯৭৫) দু’টি ছবিতে নারী চরিত্রগুলির দিন তেমন কিছু করার ছিল না। কিংবা পরিচালক নিজেই তেমনভাবে রাখার জায়গাও রাখেননি বলে মনে হয়। তবুও সুতপার চরিত্রে কৃষ্ণা বসুকে দিয়ে ভাল কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন পরিচালক। কৃষ্ণা বসু বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। আর কেয়ার চরিত্রে জয়শ্রী রায়ের ভাবভঙ্গি এবং দৃষ্টি চমৎকার ব্যবহার করেছিলেন। জয়শ্রী রায়ের মধ্যে একটা আবেদন ছিল। সেই আকর্ষণ ছোট্ট একটি দৃশ্যে অপূর্ব ব্যবহার করলেন সত্যজিৎ রায়। সিদ্ধার্থ (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) হেঁটে যাচ্ছিলেন রাস্তা দিয়ে। তাঁকে ডাকলেন কেয়া (জয়শ্রী রায়)। বলেন, দেখবেন আমাদের বাড়িটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। সিদ্ধার্থ ফিউজ বক্স দেখার জন্য দেশলাই জ্বাললেন। একটা অন্ধকার বৃত্তের মধ্যে দেখা গেল তখনই দেখা গেল কেয়াকে। সেই দৃশ্যে চমৎকার এক্সপ্রশন ছিল জয়শ্রী রায়ের। কেয়ার কমনীয়তাকে বেশ সুন্দরভাবে পেশ করেছিলেন তাঁর অভিনয়ে জয়শ্রী।
জয়শ্রী রায়কে কেয়ার মতো একটি চরিত্রে কত সুন্দর ব্যবহার করেন সত্যজিৎ রায়। সবচেয়ে ভাল লাগে শেফালির লতিকার ভূমিকা। শেফালিকে বাঙালির অন্যভাবে জানলেও দর্শক কুর্নিশ করেছিলেন ছোট্ট ভূমিকায় লতিকাকে।
তবে পরিচালক সত্যজিৎ রায়, অনঙ্গ, ছুটকি, মোতি-- এই তিন নারীকে একেবারে অন্যভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। ছবি ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩)। ববিতা (অনঙ্গ), সন্ধ্যা রায় (ছুটকি), চিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় (মোতি)। তিন নারীরই শ্রেণিচরিত্র একেবারেই ভিন্নরকম। অথচ তিনজনের মধ্যেই ভীষণরকম একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। সে সম্পর্ক হয়তো আর্থসামাজিক পরিস্থিতি আরও কাছাকাছি করে। তারই মধ্যে কোথাও বৈষম্যও দেখি। অনঙ্গকে ‘বামুনদিদি’ ডাকার মধ্যে তার আলাদা একটা জায়গা থাকে। সম্ভ্রম থাকে। সেখানে দাঁড়িয়ে ববিতা অর্থাৎ অনঙ্গ বা বামুনদিদির অভিনয় দর্শকমনে কোথাও একটা ধাক্কা মারে। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে মেয়েদের অবস্থান দেখিয়েছেন বা দেখাতে চেষ্টা করেছেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে মোতি যখন বলে, ‘ছুঁয়োনি বামুনদিদি, নাইতে হবে।’ এই সংলাপ যতটা না আমাদের চমকে দেয়, তার চেয়েও বেশি সম্পর্কের মধ্যে শ্রেণি অবস্থান বুঝিয়ে দেন পরিচালক। বুঝিয়ে দেন দুই অভিনেত্রী তাঁদের অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে। অনঙ্গ এবং মোতি দুই চরিত্রের দুই অভিনেত্রী ববিতা এবং চিত্রা চমৎকার অভিনয় করেন। ছুটকি অর্থাৎ সন্ধ্যা রায় শহরে চলে যাচ্ছেন দেহব্যবসায়। যাওয়ার আগে অনঙ্গকে প্রণাম করে বলেন, ‘নরকে গিয়েও যেন দু’টি খেতে পাই।’ অথচ যখন গ্রামের নির্জন পথে যদুপোড়া কিছুটা চালের বিনিময়ে ছুটকির শরীরের দিকে ইঙ্গিত করে তখন তিরস্কৃত করেন। তারপর ছুটকি শরীর বেচে পেট ভরাতে চায়। ছুটকির দুটো খাওয়ার জন্য যৌনকর্মী হতে বাধা নেই। শহরে যেতে চান। তাঁর মনে হয় যেন, সতীত্ব আসলে একটা কুসংস্কার। ছুটকির এই যে মানসিক পরিবর্তন তা অপূর্ব ফুটিয়ে তুলেছিলেন সন্ধ্যা রায়। খিদে মানুষকে দিয়ে অনেককিছু করিয়ে নিতে পারে। মানুষ তখন ভাল-মন্দর বোধ-বিচার হারিয়ে ফেলেন। খিদে মেটানোয় তার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ছুটকিও ওই পরিস্থিতির মুখোমুখি। সত্যজিৎ রায় দেখালেন দুর্ভিক্ষের মতো সামাজিক বিপর্যয় মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক ভাবনাগুলোকে কীভাবে নষ্ট করে দেয় আদিমবৃত্তি। সে দুর্ভিক্ষ মানুষের তৈরি হোক বা প্রাকৃতিক। ছুটকির চলে যাওয়া পরিচালক যখন অনঙ্গর দৃষ্টিকোণ থেকে ধরেন ক্যামেরায়, তখন গভীর এক বিষণ্ণতা তৈরি হয় অনঙ্গের মধ্যে৷ এই দৃশ্যে চমৎকার ববিতা। গ্রামবাংলার অনঙ্গবউ ববিতাকে মনে হয়, সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘অমাবস্যা’ এবং জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’র মলাটের সেই দুই নারী। চমকে দেন ববিতা তাঁর চরিত্রের ভাবপ্রকাশে।

‘জনঅরণ্য’ (১৯৭৫) ছবি সম্পর্কে শঙখ ঘোষ লিখেছেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের ‘জন-অরণ্য’ থেকে বেরিয়ে আসি মাথা নিচু করে। ভয় হয়, আমাদের তিনি দেখে ফেলেছেন পুরোপুরি’। সোমনাথ (প্রদীপ মুখোপাধ্যায়) যখন দক্ষ দালাল নটবর মিত্র (রবি ঘোষ)-এর সঙ্গে কলগার্ল খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়েন। তখন শঙখ ঘোষের লেখা মনে পড়ে। যাইহোক, সোমনাথ আর নটবর কলকাতার অভিজাত পাড়ার এক বাড়িতে যান। উদ্দেশ্য কলগার্ল খোঁজা। সেই বাড়ির মালকিন বয়স্ক মহিলা মিসেস বিশ্বাস (পদ্মাদেবী)। মিসেস বিশ্বাসের ভূমিকায় পদ্মাদেবীর অভিনয় ছিল অনবদ্য। দর্শক তাঁকে মনে রাখেন।
মিসেস বিশ্বাসের বাড়ি থেকে যুথিকাকে নিয়ে হোটেলে গোয়েঙ্কার কাছে পৌঁছে দিতে ট্যাক্সিতে ওঠেন সোমনাথ। সোমনাথ হোটেলে যাওয়ার পথে ট্যাক্সিতেই চিনতে পারেন কণাকে। বন্ধুর ছোটবোন। তাঁকে নিয়ে হোটেলে গোয়েঙ্কার কাছে পৌঁছে দিতে সোমনাথের মধ্যবিত্ত মানসিকতায় বাধে। ফিরে যেতে চান। কিন্তু কণা ফিরে যেতে চান না, নির্ধারিত গন্তব্যেই চান। কেননা, কণা তো কণা নেই, এখন যূথিকা। কোনও একজন মানুষ কোনও কারণে নিজের নামে আর একটি ভাড়া করা নাম বসান তখন তিনি আর ফিরতে চান না নিজের নামের কাছে। তার কারণ ভাল হোক মন্দ। কণাও তাই চাননি।সোমনাথের মধ্যে আড়ষ্টতা থাকলেও, যূথিকার মধ্যে তা নেই, সে দৃঢ়। এই আর্থসামাজিক অবস্থা কণাদের মতো মহিলাদের শক্ত করে তুলেছে, কঠিন করেছে, বাস্তবটা বুঝতে শিখিয়েছে। এই জন-অরণ্যে বেঁচে থাকার, টিকে থাকার ব্যবস্থা কণারা করে নিয়েছেন, নিজেদের মতো করে। কণার চরিত্রে সুদেষ্ণা দাশ বেশ ভাল। এবং তাঁর অভিনয় বাস্তবানুগ। সুদেষ্ণাকে আলাদা করে চেনায় এই ছবি।
‘সদগতি’ ছবিতে স্মিতা পাতিল (ঝুরিয়া), গীতা সিদ্ধার্থ (ব্রাহ্মণের স্ত্রী), রিচা মিশ্র (ধানিয়া) যেভাবে চরিত্রগুলোকে তুলে ধরেছেন, এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি এঁরা অভিনয় করছেন। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় দেখে মনে হয় পরিচালক অনেকটাই স্বাধীনতা দেন তাঁদের। প্রত্যেকের অভিনয় এবং ছবি দেখার পর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না দর্শকের। দূরদর্শনের জন্য ৫২ মিনিটের ‘সদগতি’ অনেক কথা বলে দেয়।
উপরোক্ত ছবি এবং নারী চরিত্র ছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে আরও অনেক নারীর ভূমিকা আছে, অভিনেত্রীও আছেন। প্রত্যেকেরই একটা ভূমিকা রয়েছে ছবিতে। সেইসব নারী চরিত্র নিয়ে সবিস্তারে আর আলোচনায় গেলাম না। তবে পরিচালক সত্যজিৎ রায় প্রতিটি নারী চরিত্রের সৃষ্টি ও নির্মাণ সুচারুভাবে চিত্রণ করেছেন তাঁর ছবিতে। ঠিক তিনি যেমন করেছেন কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কনের ক্ষেত্রে। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ এবং ‘রূপসী বাংলা’, নরেশ গুহর ‘দুরন্ত দুপুর’, বিষ্ণু দে’র ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ বইয়ের প্রচ্ছদে প্রতিটি নারীরই সৃষ্টি এবং নির্মাণ ভিন্ন। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে এদের ছায়া কোথাও যেন পাই। বিশেষ করে, ‘রূপসী বাংলা’র প্রচ্ছদের সঙ্গে অনঙ্গবউ বা বামুন দিদির মিল পাওয়া যায়। চারুকে খুঁজে পাই সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘অমাবস্যা’য় নাকি ‘দুরন্ত দুপুর’-এ।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট নারী চরিত্রের যে-নির্মাণ করেছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায় সেটা তাঁর পক্ষেই সম্ভব। সেই নারী চরিত্রগুলো সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিই হয়ে উঠেছে। কখনওই মনে হয় না তা রবীন্দ্রনাথের। যেমন-- চারু, রতন। একই চিত্র পেয়েছি যখন তিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর-এর উপন্যাস থেকে ছবি করেন এবং নারী চরিত্রগুলো সৃষ্টি এবং নির্মাণ করেন। ছবি দেখতে দেখতে কখনও মনে হয়নি লেখক এইভাবে তো বর্ণনা করেননি তাঁর নারীদের। সবসময়ই পরিচালকের নারী চরিত্র হয়ে উঠেছে। আসলে সত্যজিৎ রায় নিজে রবীন্দ্রনাথ-সহ অন্যান্য সাহিত্যিকদের নারীর ভূমিকা কীভাবে গ্রহণ করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে সেটাই পাই পরিচালকের ছবিতে। এখানে পরিচালক সত্যজিৎ রায় একশো শতাংশ সফল। আর যেসব ছবি তাঁর নিজেরই চিত্রনাট্য থেকে করেছেন সেখানে তিনি তাঁর মতো করে নারী চরিত্র তৈরি করে বা সৃষ্টি করেছেন। সেখানেও তিনি ভীষণভাবে সফল।
গ্রন্থ ঋণ: চলচ্চিত্র সমাজ ও সত্যজিৎ রায়, অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় এবং দু’একটি টুকরো লেখা।
Comments