ডিভাইস ক্লোজার: সার্জারি ছাড়াই হার্টের ছিদ্র বন্ধ !
- রোজকার অনন্যা

- 4 days ago
- 3 min read
ডাঃ ধৃতব্রত দাশ
এমবিবিএস, ডিসিএইচ, ডিএনবি (পেডিয়াট্রিক্স), ফেলোশিপ ইন পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি (আরটিআইআইসিএস), ফেলোশিপ ইন পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি (আরএএইচসি, অস্ট্রেলিয়া)
সিনিয়র কনসালট্যান্ট পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট, পিয়ারলেস হসপিটাল, কলকাতা

শিশুর জন্মের সময় যদি জানা যায় তার হৃদ্যন্ত্রে ছিদ্র রয়েছে, তাহলে বেশিরভাগ মা–বাবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কিন্তু আজকের দিনে এই ভয় অনেকটাই অমূলক। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এখন জন্মগত হার্টের ছিদ্র খুব সহজেই ধরা পড়ে এবং অধিকাংশক্ষেত্রেই সার্জারি ছাড়াই সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা, সঠিক সময়ে রোগ শনাক্তকরণ এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। চলুন বিস্তারিত জানা যাক—
জন্মগত হার্টে ছিদ্রের কারণ কী?
ডাঃ দাস: অনেক সময় শিশুদের জন্মের সময় হার্টে ছোট বা বড় ছিদ্র থাকে। তবে শুধু ছিদ্র নয়, অনেক সময় এর সঙ্গে হার্টের অন্য গঠনগত সমস্যাও থাকতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ (সিএইচডি)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর নির্দিষ্ট কোনও কারণ পাওয়া যায় না, তবে কিছু ক্ষেত্রে জেনেটিক প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে। এই বিষয়ে এখনও বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে।
কখন ও কীভাবে ধরা পড়ে?
ডাঃ দাস: বর্তমানে গর্ভাবস্থায় ফিটাল ইকোকার্ডিওগ্রাম পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক সময়ই হার্টের ছিদ্র শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তবে সব ক্ষেত্রেই যে এটি প্রেগন্যান্সির সময় ধরা পড়বে, এমন নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জন্মের পরে বা শৈশবে রুটিন চেকআপে বিষয়টি সামনে আসে। অনেক ছোট ছিদ্র নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষেত্রে আবার জন্মের পর থেকেই উপসর্গ দেখা দেয়, চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। অনেক সময় হার্টের ছিদ্র ছোটোবেলায় কোনও সমস্যা না করায়, ধরা পড়ে না। বেশি বয়সে সমস্যা শুরু হলে দেখা যায় হার্টে জন্মগত ছিদ্র রয়েছে, তখনও আমরা এগুলো ডিভাইস ক্লোজার করি।
শিশুর হার্টে ছিদ্র থাকলে সাধারণত কী কী উপসর্গ দেখা দেয়?
ডাঃ দাস: সব শিশুর ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা দেয় না। তবে বড় ছিদ্র থাকলে কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন— ১. ব্রেস্ট ফিডিং বা স্তন্যপানের সময় হাঁপিয়ে যাওয়া বা খাবার খেতে না পারা, ২. সামান্য পরিশ্রমে ক্লান্তি ও দুর্বলতা, ৩. ওজন না বাড়া, ৪. ঘন ঘন বুকে সংক্রমণের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। মূলত খাওয়ার সময়ই সমস্যা বেশি হয়, কারণ তখন হার্টের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।
এর চিকিৎসা কী?
ডাঃ দাস: বর্তমানে জন্মগত হার্টের ছিদ্রের চিকিৎসা দুটি উপায়ে করা হয়—
১. ওপেন হার্ট সার্জারি: এটি প্রচলিত পদ্ধতি, যেখানে বুক কেটে হার্টের ছিদ্রটি বন্ধ করা হয়। এতে রোগীকে পুরোপুরি অজ্ঞান করতে হয় এবং সার্জারির পর কিছুদিন বিশ্রাম দরকার হয়।
২. ডিভাইস ক্লোজার (নন–সার্জিক্যাল পদ্ধতি): এটি আধুনিক ও নিরাপদ পদ্ধতি, যেখানে কোনও কাটাকাটির প্রয়োজন পড়ে না। পায়ের শিরা বা ধমনী দিয়ে একটি ছোট্ট ডিভাইস (যাকে অনেকে ‘আমব্রেলা ডিভাইস’ বলেন) হার্টে প্রতিস্থাপন করা হয়, যা ছাতার মতো খুলে ছিদ্র বন্ধ করে দেয়। এই প্রক্রিয়া অনেকটা অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির মতো। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঘুমের ওষুধ দিয়ে প্রক্রিয়াটি করা হয়, একটু বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অজ্ঞান ছাড়াই করা সম্ভব।

এরপর যত্ন কীভাবে?
ডাঃ দাস: ওপেন সার্জারির ক্ষেত্রে রোগীকে সাধারণত ৩–৪ দিন বা তার বেশি সময় হসপিটালে থাকতে হয়। বুকের ক্ষত শুকাতে কিছুটা সময় লাগে, তাই সাবধানে থাকা জরুরি। কিন্তু ডিভাইস ক্লোজারের ক্ষেত্রে কোনও কাটাকাটি হয় না। ফলে শিশু পরেরদিন থেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। যেমন— হাঁটাহাঁটি, খাওয়া, ঘুম সবই স্বাভাবিকভাবে করা যায়।
‘ডিভাইস ক্লোজার’ ডিভাইসটি সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...
ডাঃ দাস: ডিভাইসটি তৈরি হয় নিটিনল নামের বিশেষ মেটাল অ্যালয় দিয়ে, যা শরীরের সঙ্গে কোনও প্রতিক্রিয়া করে না। ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে শরীরের টিস্যু ওই ডিভাইসকে ঢেকে ফেলে, তখন এটি হার্টের অংশ হয়ে যায়। এমআরআই, খেলাধুলা বা এয়ারপোর্ট স্ক্যানার—কোনও কিছুতেই সমস্যা হয় না।
ডিভাইস ক্লোজার প্রতিস্থাপনের পর জীবনযাপনে কি কোনও বিধিনিষেধ থাকে?
ডাঃ দাস: একেবারে স্বাভাবিক জীবনযাপন। খেলাধুলা, পড়াশোনা বা মেয়েদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্রেগন্যান্সি— সবই সম্ভব। শুধু নিয়মিত কার্ডিওলজিস্টের ফলোআপে থাকা দরকার। আজকের দিনে জন্মগত হার্টের ছিদ্র আর ভয়ঙ্কর কোনও অসুখ নয়। সঠিক সময়ে ধরা পড়লে এবং দক্ষ হাতে চিকিৎসা হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুর হার্ট সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে। তাই উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে শিশু–হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।








Comments