জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঋতুস্রাবজনিত সমস্যার সুলুকসন্ধান!
- রোজকার অনন্যা
- Sep 27
- 4 min read
ডাঃ তনুকা দাসগুপ্ত
এমবিবিএস, এমএস (গাইনি এবং অবস্টেট্রিক্স), ডিএনবি (গাইনি এবং অবস্টেট্রিক্স), এমআরসিওজি (ইউকে), এফএমএএস; কনসালট্যান্ট গাইনেকোলজিস্ট, পিয়ারলেস হসপিটাল অ্যান্ড বি কে রায় রিসার্চ সেন্টার

ঋতুস্রাব বা মাসিক মহিলারদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ঋতুস্রাব যদি অতিরিক্ত বা অনিয়মিত হয়, তাহলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। আজ আমাদের আলোচনার বিষয় বিভিন্ন বয়সে ঋতুস্রাবের সমস্যা ও তার চিকিৎসা..
মাসিক বা পিরিয়ড যখন শুরু হয় তখন অনেকেরই অনিয়মিত বা অতিরিক্ত রক্তপাতের সমস্যা দেখা দেয়। এর কারণ ও চিকিৎসা কী?
৯, ১০ বছর বয়সে যখন মাসিক বা পিরিয়ড শুরু হয় তখন অনেক সময় মায়েরা উদ্বেগের সঙ্গে মেয়েদের নিয়ে গাইনেকোলজিস্টদের কাছে আসেন। অনিয়মিত রক্তপাত হতে পারে তিন–চারমাস অন্তর বা প্রতিমাসে দু’বার করে। কোনওটাই স্বাভাবিক নয়। তবে প্রাথমিকভাবে পিরিয়ড শুরু হবার পর দু থেকে তিনবছর এইচপিও অ্যাক্সিস বা হাইপোথ্যালামিক পিটুইটারি অ্যাড্রিনাল অ্যাক্সিস ম্যাচিওর হবার জন্য এই সময় একটু অনিয়মিত রক্তপাত হতে পারে। সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে আমরা এই বিষয় মা–বাবাদের আশ্বস্ত করি ভয়ের কিছু নেই। আর অতিরিক্ত রক্তপাত হলে তার চিকিৎসায় ওষুধ দিতে হয় যাতে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা না কমে। কমলে নানা শারীরিক সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে। এই সময় আলট্রাসাউন্ডে অনেক মেয়েদেরই পিসিওডি বা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ ধরা পড়ে। সাধারণত ৯ থেকে ২০ বছর বয়সে যে কোনও গাইনেকোলজিক্যাল চিকিৎসা শুরুর আগে খুব ভালোভাবে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে তবেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত। কারণ এই সময় সব কিছু ম্যাচিওর হবার জন্য একটু সময় দরকার। মা–বাবাদের খেয়াল রাখতে হবে সন্তান যেন অতিরিক্ত ওজন বা ওবেসিটিতে আক্রান্ত না হয়। এর জন্য দরকার হেলদি ডায়েট এবং নিয়মিত শরীরচর্চা। ১৮, ১৯ বা ২০ বছর বয়সে পিরিয়ডে অতিরিক্ত ব্যথা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। কারণ ওভারিতে বড় কোনও সিস্ট বা টিউমারের কারণে সেই ব্যথা কিনা সেটা জানা দরকার। আর ব্যথা কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তবেই ওষুধ খাবেন, ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধ কখনই নয়।
অনেক সময় ২৫, ৩০ বছর বয়সেও অনিয়মিত পিরিয়ডের সঙ্গে ওজন বাড়া, ব্রণর সমস্যা, মুড স্যুইং ইত্যাদি দেখা দেয়। এ ধরনের সমস্যায় কী করণীয়?
এ ধরনের সমস্যা হরমোনাল ইমব্যালেন্স বা হরমোনের ভারসাম্যের অভাবে হতে পারে। সেই কারণে এমন কোনও সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এছাড়া কখনও কখনও আলট্রাসাউন্ডে জরায়ুতে ফাইব্রয়েড বা টিউমার এবং ওভারিতে সিস্ট ধরা পড়ে। সিস্টের অনেক রকম প্রকারভেদ রয়েছে। জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে যে সার্জারি করতে হবে এমনটা নয়। তবে এ রকম সমস্যার সম্মুখীন হলে গাইনেকোলজিস্টের পরামর্শমতো চলতে হবে এবং নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে, যাতে পরিস্থিতি জটিল না হয়। অনেক সময় রোগীরা ১২ বা ১৫ সেমি, এমনকি ১৮ বা ২০ সেমির টিউমার নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। একটি ৬ সেমির টিউমার মাইক্রোসার্জারির মাধ্যমে সম্পূর্ণ ঝুঁকিহীনভাবে সহজেই অপসারণ করা সম্ভব হলেও, একটা ১৮ বা ২০ সেমির টিউমার অপসারণে দেখা দিতে পারে জটিলতা, যেটা রোগীর জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। সেই জন্যই টিউমার ধরা পড়লে চিকিৎসকের ফলোআপে থাকাটা খুবই জরুরি। অনেক সময় রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যেতে ভয় পান। এটা কখনোই করবেন না। সচেতন হোন এবং সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অনেক সময় প্রেগন্যান্সির প্রাথমিক পর্যায়ও ব্লিডিং বা রক্তপাত হয়। এই ব্লিডিং কি স্বাভাবিক?
প্রেগন্যান্সির প্রাথমিক পর্যায়ে রক্তপাত অনেক সময় স্বাভাবিক হতে পারে, আবার কখনও সেটা অস্বাভাবিকও হতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আলট্রাসাউন্ড করতে হবে। অস্বাভাবিক অর্থাৎ অনেক সময় ভ্রূণ নীচের দিকে থাকার কারণে ব্লিডিং হতে পারে, আবার কখনও কখনও সেটা মিস ক্যারেজের লক্ষণও হতে পারে, আবার প্ল্যাসেন্টা নীচে থাকলে অনেক সময় ব্লিডিং হয়। বর্তমানে এইসব পরিস্থিতি মোকাবিলার যথেষ্ট ভালো চিকিৎসা রয়েছে। তাই প্রেগন্যান্সির প্রাথমিক পর্যায়ে ব্লিডিং হলে বাড়িতে বসে না থেকে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং ব্লিডিং স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক জেনে চিকিৎসা শুরু করুন।
প্রেগন্যান্সির বেশ কিছুদিন পর অর্থাৎ ধরুন ৩৬ সপ্তাহ পর ব্লিডিং শুরু হলে তখন কী করণীয়?
তখন দেখতে হবে বাচ্চার কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা বা বাচ্চা সময়ের আগেই প্ল্যাসেন্টা থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে কিনা। তাই প্রেগন্যান্সির পর্যায়ে ব্লিডিং হলে একটুও সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
মাঝবয়সে অর্থাৎ ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সে বা মেনোপজের আগে অনেক মহিলারই পিরিয়ডে অতিরিক্ত রক্তপাত দেখা দেয়...
সারাজীবন খুব ভালোভাবে কাটলেও মেনোপজের আগের পর্যায়ে অনেকেরই পিরিয়ডে অতিরিক্ত ব্লিডিং হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলারা ধরে নেন মেনোপজের সময় এগিয়ে আসছে তাই হয়তো ব্লিডিং কখনও কমছে, আবার কখনও বাড়ছে, এটা স্বাভাবিক, চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। হয়তো ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটা ঠিক। কিন্তু বাকি ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে আপনার অজান্তেই জরায়ুতে পলিপ বা ওভারিতে বড় সিস্ট বা জরায়ুর ভেতরে টিউমার দেখা দিতে পারে। তাই চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, এই ধারণার বশবর্তী না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সমস্যা না থাকলে তো ভালো, আর সমস্যা ধরা পড়লে জটিল আকার ধারণের আগেই দরকার তার চিকিৎসা। আধুনিক চিকিৎসায় জরায়ুর টিউমারে শুধুমাত্র টিউমারটি অপসারণ করা সম্ভব, সব সময় পুরো জরায়ু বাদ দিতে হয় না। হিস্টেরোস্কোপি বা হরমোনাল ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে জরায়ু বাদ না দিয়ে টিউমার অপসারণ বা বড় কোনও টিউমারের হাত থেকেও জরায়ুকে রক্ষা করা সম্ভব। তাই সময়ানুবর্তিতা এবং সময়মতো চিকিৎসকের কাছে আসাটা খুবই জরুরি।

মেনোপজে হঠাৎ করে রক্তপাত দেখা দিলে কী করণীয়?
৪৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে সাধারণত যখন বারো মাস টানা পিরিয়ড বন্ধ থাকে, তখন সেটাকে মেনোপজ বলা হয়। মেনোপজে একবছর টানা পিরিয়ড বন্ধ থাকার পর যদি ব্লিডিং বা স্পটিং হয়, অনেক সময় মহিলারা সেটা উপেক্ষা করেন। একজন গাইনেকোলজিস্ট হিসেবে বলব, সেটাকে উপেক্ষা করবেন না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই ব্লিডিংয়ের কারণ কোনও সংক্রমণ। খুব কম ক্ষেত্রে হলেও সেটা ক্যান্সারের লক্ষণও হতে পারে। এখন জরায়ুর ক্যান্সারের ভালো চিকিৎসা রয়েছে এবং রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেন। তবে এর জন্য সবার আগে দরকার আর্লি স্টেজ বা প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়। তাই কোনও উপসর্গকে অবহেলা করবেন না এবং জরুরি নিয়মিত হেলথ চেকআপ। অনেক সময় মধ্যবয়স্ক মহিলাদের সহবাসের পর বা দুটো পিরিয়ডের মাঝখানে ব্লিডিং হয়, সেক্ষেত্রে প্যাপ স্মিয়ার অর্থাৎ জরায়ুর ভেতরে কোনও সংক্রমণ বাসা বেঁধেছে কিনা বা কোনও পলিপ রয়েছে কিনা তার অনুসন্ধান জরুরি। সারভাইক্যাল ক্যান্সার প্রতিরোধে প্যাপ স্মিয়ার বা স্ক্রিনিং এবং ভ্যাকসিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রতি তিনবছর অন্তর স্ক্রিনিং এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নির্দিষ্ট সময় ভ্যাকসিন নিন।
Comments