এম.আই.সি.এস. জটিলকে করেছে সহজ!
- রোজকার অনন্যা
- Jun 28
- 3 min read
ডাঃ প্রিয়দর্শন কোনার
কনসালট্যান্ট কার্ডিওথোরাসিক অ্যান্ড ভাস্কুলার সার্জেন
পিয়ারলেস হসপিটেক্স হসপিটাল অ্যান্ড বি কে রায় রিসার্চ সেন্টার, কলকাতা

চিকিৎসাবিজ্ঞানের হাত ধরে প্রতিনিয়ত আসছে নতুন নতুন সার্জারি বা অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি। তেমনই এক পদ্ধতি হল মিনিম্যালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি (এমআইসিএস)। এতে হার্টের সার্জারি যেমন সহজ হয়েছে, তেমনই রুগির কষ্টও অনেকটাই লাঘব হয়েছে। হার্ট শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আগে ভাবা হতো, হার্টের অসুখ শুধুমাত্র বয়স্কদের অসুখ। এখন সেই ধারনায় বদল এসেছে। বর্তমানে আমাদের জীবনযাপনের ধরন, যে কোনও বয়সেই ডেকে আনছে হার্টের অসুখ এবং অনেক সময় তা এতটাই জটিল আকার নিচ্ছে যে, রুগিকে সুস্থ করতে সার্জারি বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ছে। আর অস্ত্রোপচার শুনলেই সবার মনে একটা আতঙ্ক বা ভয় কাজ করে। সেই ভয় বা আতঙ্ক কাটিয়ে হার্টের সার্জারিকে নিঁখুত ও অনেকটাই জটিলতাহীন করেছে মিনিম্যালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি।
কীভাবে সম্পন্ন হয় এই সার্জারি?
কনভেনশনাল সার্জারিতে হার্টের অস্ত্রোপচারে বুকের সামনের অংশের হাড় অর্থাৎ স্টারনাম বোন কেটে সার্জারি সম্পন্ন করা হয়। ৮ থেকে ৯ ইঞ্চির মতো কাটার প্রয়োজন পড়ে। অন্যদিকে, মিনিম্যালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি (এমআইসিএস)–তে স্টারনাম বোন না কেটে ল্যাটারাল থোরাকোটমির মাধ্যমে বুকের ডানদিক বা বাঁদিকের পাঁজরের দুটি হাড়ের মাঝখানে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি ছিদ্র করে হার্টের সার্জারি সম্পন্ন করা হয়। পাঁজরের হাড়ে কোনও কাটাছেঁড়া করতে হয় না।
হার্টের কোন কোন সার্জারি এমআইসিএস–এর মাধ্যমে করা যায়?
হার্টের অসুখের ধরন, জটিলতা, বয়স এবং বিভিন্ন টেস্ট রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরা ঠিক করেন কার কোন সার্জারি প্রয়োজন। তবে কিছু কিছু হার্টের সার্জারি রয়েছে যেখানে এমআইসিএস অপরিহার্য—
● হার্টের বিভিন্ন ভালভ সার্জারি। যেমন মাইট্রাল, অ্যাওটিক, ট্রাইকাসপিড, পালমোনারি ভালভ সার্জারি। এমআইসিএস–এর মাধ্যমে হার্টের ভালভ রিপ্লেসমেন্ট বা প্রতিস্থাপন, রিপেয়ার অর্থাৎ, ভালভে কোনও সমস্যা থাকলে সেটা ঠিক করা ইত্যাদি করা হয়। হার্টের ভালবের সার্জারির সময় সাধারণত ডানদিকের পাঁজরে ছিদ্র করে সার্জারি সম্পন্ন হয়।
● হার্টে কোনও টিউমার থাকলে ডানদিকের পাঁজরে ছিদ্র করে এমআইসিএস–এর মাধ্যমে সেখান দিয়ে টিউমার অপসারণ সম্ভব।
● হার্টে যদি কোনও ছিদ্র থাকে, সেই ছিদ্র বন্ধ করতে অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট সার্জারিও এমআইসিএস–এর মাধ্যমে করা সম্ভব।
● হার্টের সবচেয়ে প্রচলিত সার্জারি করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং বা সিএবিজি। প্রচলিত কথায় যা পরিচিত বাইপাস সার্জারি নামে। এক্ষেত্রে বুকের বাঁদিকে পাঁজরের হাড় না কেটে, শুধুমাত্র ২ থেকে ৩ ইঞ্চি ছিদ্র করে সার্জারি সম্পন্ন করা যায়।
এমআইসিএস–এর রকমফের
সাধারণত দু’টি উপায় এই সার্জারি করা হয়—
১. থোরাকোস্কোপিক এবং ২. রোবোটিক সার্জারি।
থোরাকোস্কোপিক সার্জারিতে বুকের পাশে ছিদ্রের মাধ্যমে ক্যামেরা সমেত লম্বা একটি টিউব (চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলে থোরাকোস্কোপ) প্রবেশ করানো হয়। টিউবে থাকা ক্যামেরার মাধ্যমে সার্জেন স্ক্রিনে হার্টের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, সার্জারি সম্পন্ন করেন। অন্যদিকে, রোবোটিক সার্জারিতে ব্যবহৃত হয় রোবোটিক আর্ম। বুকের পাশে ছিদ্র করে পাঁজরের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করানো হয় ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। কম্পিউটার স্ক্রিনে বসে রোবোটিক আর্মের নিয়ন্ত্রণ থাকে সার্জেনের হাতে। তিনি যেভাবে নির্দেশ দেন রোবোটিক আর্মও ঠিক সেভাবেই কাজ করে। ব্যয়বহুল এবং পরিকাঠামোগত কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে রোবোটিকের চেয়ে এমআইসিএস থোরাকোস্কোপিক পদ্ধতিতেই বেশি হয়।
এমআইসিএস–এর সুবিধা কী?
● যেহেতু খুব একটা কাঁটাছেঁড়া করতে হয় না, তাই ব্যথা ও রক্তপাত, দুই–ই খুব কম হয়।
● রোগীকে বাইরে থেকে রক্ত দেবার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে। ফলে রক্তবাহিত অসুখের ঝুঁকি নেই।
● স্কার খুব ছোট হয়।
● সংক্রমণের সম্ভাবনা খুবই কম।
● দ্রুত বাড়ি ফেরা যায়। স্টারনাম কাটলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে ৫ থেকে ৬ দিন সময় লাগে। আর এমআইসিএস–এ ৩ দিনের মধ্যেই বাড়ি ফেরা যায়।
● এমআইসিএস–এর পর সপ্তাখানের মধ্যে কাজে যেমন যোগ দেওয়া যায়, তেমনই সপ্তাদুয়েকের মধ্যে সাইকেল, বাইক, গাড়ি চালানো যায়। অর্থাৎ, দৈনন্দিন কাজে দ্রুত ফেরা যায়।
● ডায়াবেটিস থাকলে স্টারনাম কেটে সার্জারিতে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে বা বয়স্কদের অস্টিওপোরোসিস থাকলে অনেক সময় হাড় সহজে জোড়া লাগতে চায় না। এইরকম কোনও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না মিনিম্যালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারিতে।
● স্টারনাম দুর্বল রুগিদের জন্য আদর্শ এমআইসিএস।
এই সার্জারির কি কোনও সীমাবদ্ধতা আছে?
তেমন কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। তবে হার্টে যদি একসঙ্গে অনেকগুলো সমস্যা থাকে, যেমন করোনারি আর্টারি ডিজিজ ও ভালভের সমস্যা একসঙ্গে থাকলে, এমআইসিএস না করাই ভালো। আর ওপেন সার্জারির চেয়ে খরচ একটু বেশি এবং সব হাসপাতালে এমআইসিএস–এর পরিকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। তবে সার্জারির খরচ একটু বেশি হলেও, হাসপাতালে থাকার সময়কে কমিয়ে, থাকার খরচকে অর্ধেক করে দেয় এমআইসিএস। তাই সবদিক বিচার–বিবেচনা করলে, এমআইসিএস–এর সুবিধাই বেশি।

সার্জারির পর কেমন হবে জীবনযাপন?
● বাড়ি আসার পর হাঁটাহাটি ও শরীরচর্চা, অর্থাৎ, ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে হবে।
● শ্বাস–প্রশ্বাসে স্বাভাবিক রাখার জন্য বা কোনও সমস্যা হলে স্পাইরোমেট্রি ব্যবহার করতে পারেন।
● ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
● বেশি তেল, মশলা দিয়ে তৈরি রিচ খাবার, ঘি, মাখন, ভাজাভুজি, কাঁচা নুন এড়িয়ে চলতে হবে।
● থাকতে হবে চিকিৎসকের ফলোআপে। ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ বা স্পাইরোমেট্রির ব্যবহার, সবটাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তবেই করবেন।
দ্রুত সুস্থ জীবনে ফেরা এবং সার্জারি–পরবর্তী জটিলতা কম থাকায় বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় এই মিনিম্যালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি। হার্টের অসুখের কোনও উপসর্গ নজরে এলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। রোগ নির্ণয় দ্রুত হলে রোগের জটিলতা যেমন কমে, তেমনই সুস্থ হয়ে ওঠাও সহজ হয়।
Comments