top of page

বাঙালির আবেগতরুণ মজুমদার ও তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত

‘যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে

সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন অচিনপুরে।।’


প্রথম শুনেছিলাম ঠিক কবে মনে পড়ে না। তবে এইটুকু মনে আছে তখন খুব ছোট। স্কুলের প্রাথমিক গণ্ডী পেরোয়নি তখনও। পাশের জেঠুর বাড়ির সাদাকালো প্যানোরমা টিভিতে বাজছে, ‘দূরে কোথায়, দূরে দূরে...’। জানলার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, একটা টিলার উপর বসে একজন ভদ্রমহিলা গাইছেন, এই গান। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক লোক। পিকনিক হবে বোধহয়। পরে জেনেছি, ওই ভদ্রমহিলার নাম নন্দিনী মালিয়া। পিছনে মা এসে দাঁড়িয়েছেন কখন বুঝতে পারিনি। বুঝলাম স্পর্শ অনুভুতিতে। আমার কাঁধে হাত রেখে মা বললেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সেই মুহূর্তে কি, যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে, সেই বাঁশিটির সুরে সুরে আমার মন ঘুরে বেড়িয়েছিল! জানি না। তবে সেই মুহূর্ত থেকে যে রবীন্দ্রনাথ আমাকে আঁকড়ে ধরলেন, তা বুঝেছি ক্রমাগত। যদিও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয় তো তার আগের থেকেই, সেই যে ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে’... কিম্বা ‘বনে থাকে বাঘ, গাছে থাকে পাখি’—জানার সময় থেকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পরশ তো এইভাবে পাইনি কখনও।

সেদিন থেকেই বোধহয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর গান মিশে গেল আমার আত্মার সাথে। জগৎ সংসারের অনেক কিছু ভালোভাবে বুঝে উঠবার আগে থেকেই ঘটে গেল সে ঘটনাটা। আমার রক্তে মাংসে, মজ্জায়, আমার তন্ত্রীতে মিশে গেল রবীন্দ্র সঙ্গীতের বাণী। আর তার উৎস কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আর সেই দৃশ্য। ‘নিমন্ত্রণ’ ছবির দৃশ্য ছিল সেটা। পরিচালক ছিলেন তরুণ মজুমদার।

রবীন্দ্রনাথের গান যে আমারই মতো প্রতিটি বাঙালির অনুভুতি, চেতনায়, সকল আবেগ ও উপলদ্ধিতে প্রভাব ফেলে চলেছে প্রতিনিয়ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার তো মনে হয়, ওঁর লেখা এক একটি পূজা, প্রেম, প্রকৃতি বা অনুভুতির বাণী আমাদের নিজের। একান্ত নিজের। আমাদের প্রাণের সত্বা, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।

রবি ঠাকুরের গান তো সবার। সবারই যদি হয়, তাহলে তাকে খড়ির গন্ডীতে আঁটকে রাখা কেন? কেনই বা আমজনতার উষ্ণতা বাঁচিয়ে তাকে একটা বিশেষ শ্রেণির সম্পদের অধিকারি করে তোলার চেষ্টা! চলছিল তো নিরন্তর। সে যে অধরা। তাকে আমজনতার দরবারে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সাধারণ মানুষ অমৃতের স্বাদ পেল। সেই মানুষ, তরুণ মজুমদার। হ্যাঁ, চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার।



সিনেমা পাড়ার তনুবাবু, তাঁর ছবিতে অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত হল স্পর্শমণি, যার স্পর্শে সব কিছু সোনা হয়ে যায়৷ সত্যি, তিনি এ কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাঁর উপলব্ধি, সুর ও গানের সঙ্গে এই যে নিবিড় সম্পর্ক, আত্মীয়তা, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া খুব মুশকিল৷ তাঁর অনেক কথা, অনেক না-বলা বানী আকুল হয়ে ব্যক্ত করেছেন এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের নিখুঁত ব্যবহারে। ছবির দৃশ্যগুলি যে এইভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন, তা রবি ঠাকুরের গানের সঠিক প্রয়োগের ফলে, এমনটাই বিশ্বাস ছিল তাঁর৷

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনদেবতা। তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষযাত্রারও সঙ্গী হলেন। তনুবাবু যখন অচিন পুরে যাত্রা করছেন, তাঁর নশ্বর দেহ যখন এসএসকেএম হাসপাতালের পথে, তখন তাঁর বুকের উপর কোনও ধর্মগ্রন্থ নয়, ছিল রবি ঠাকুরের বই! ‘গীতাঞ্জলি’৷ বিশ্বকবির গান যে তাঁর হৃদয়ের কাছের। তাই তনুবাবুর সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল উপস্থিতি।

তরুণ মজুমদারের ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান এসেছে চিত্রনাট্যের অংশ হিসেবে। ‘কাচের স্বর্গ’ ছবিতে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেন তরুণ মজুমদার। কী সুন্দর প্রয়োগ। ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’। ‘কুহেলী’ ছবিতে ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’-এর গানের সঙ্গে শিশুশিল্পী দেবশ্রী রায়ের নাচের দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করে। এই ছবিতেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকরের দ্বৈত কণ্ঠে ‘তুমি রবে নীরবে’-এর আবেশ সত্যই বাঙালি দর্শককে রেখে দেয় সুরের মায়াবী অঞ্চলছায়ায়৷

জুটি নির্ভর বাংলা চলচ্চিত্র। কিছু জুটি যেন স্মরণীয় হয়ে আছে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতো জনপ্রিয় উত্তম-হেমন্ত জুটি। এর পাশাপাশি দীর্ঘ সুরেলা সফর পাড়ি দিয়েছে তরুণ-হেমন্ত জুটিও৷ ২৫ বছর তো হবেই। ২৫ টি ছবিতে একসঙ্গে কাজ। অনবদ্য যুগলবন্দি৷ হেমন্তর কণ্ঠে ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’ আমরা যতবারই শুনিনা কেন, কেদারের মুখটা ভেসে ওঠে নাকি! এখানেই দাদাদের কীর্তির সফলতা। দাদা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দাদা তরুণ মজুমদার। ‘দাদার কীর্তি’-তে কেদারের মতো আপাত-অপ্রতিভ যুবকের গলায় এই গান আমাদের মুগ্ধ করে। আসলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন তরুণ মজুমদারের ঘরের মানুষ৷ দুজনে গানবাজনা করেছেন দীর্ঘদিন। ছবির কাজ না থাকলেও হেমন্তবাবু আসতেন পরিচালক তনুবাবুর কাছে। গান শোনাতে৷ কত স্মৃ্তি! এমন একটি বর্ষণমুখর দিনের কথা তরুণ মজুমদারের মনে গেঁথে ছিল। ভোলেননি জীবনসায়হ্ন পর্যন্ত৷ বৃষ্টি দেখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ইচ্ছে হয়েছিল গান শোনাতে৷ তিনি তীব্র বৃষ্টি উপেক্ষা করে এসেছিলেন পরিচালক তরুণের কাছে৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরুর সময়ের মাঝামাঝি। হারমোনিয়াম নিয়ে হাজির হেমন্ত৷ শুরু হল গান। একটানা গেয়েছিলেন ‘চণ্ডালিকা’-র সবকটি গান৷ বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া সেই মুহূর্ত কোনওদিন অমলিন হয়নি পরিচালকের স্মৃতিতে৷



হেমন্ত-ই তো প্রথম নিয়ে এলেন শিবাজি চট্টোপাধ্যায়কে। নিয়ে এসেছিলেন তরুণ মজুমদারের কাছে। হেমন্তর কথায় তরুণ মজুমদার তখন নবাগত শিল্পী শিবাজি চট্টোপাধ্যায়কে প্লে ব্যাক করার সুযোগ দিয়েছিলেন ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবিতে৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা ঠিক না থাকায় সে ছবিতে গাইতে পারেননি তিনি। শিবাজি চট্টোপাধ্যায় এবং অরুন্ধতী হোম চৌধুরী একাধিকবার কাজ করেছেন তরুণ মজুমদারের সঙ্গে৷ ‘আলো’-তে তাঁরা ছিলেন সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বেও৷

‘দাদার কীর্তি’-তে ‘বঁধু কোন আলো লাগল চোখে’ গানটি তো তরুণ মজুমদার গাইয়েছিলেন অরুন্ধতীকে দিয়েই৷ আবার, ‘পথভোলা’-য় ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গানে গলা মিলিয়েছিলেন শিবাজি চট্টোপাধ্যায় ও সুজাতা সরকার৷ এই ছবিতে ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি’-তে সেই শিবাজি-অরুন্ধতী-সুজাতার কণ্ঠের ত্রিবেণী ধারা বয়ে চলেছিল।

সত্যি, ‘নিমন্ত্রণ’ ছবির কথা ভোলা যায়? এই ছবিতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠমায়ায় ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে’ গানে তন্ত্রীতে বাজে হীরুদার সঙ্গে কুমুর চিরবিরহ৷ আমরাও বিহ্বল হয়ে পড়ি। বিরহ, মিলন বা বিচ্ছেদে প্রেমের এই স্নিগ্ধ অথচ গাঢ় উদযাপন বার বার এসেছে তরুণ মজুমদারের পরিচালনায়৷ আর প্রতিবার সেই উদযাপনে শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের গান৷

মিষ্টি প্রেমের একটা ছবি ‘ভালবাসা ভালবাসা’। এই ছবিতে একগুচ্ছ রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করেছেন তনুবাবু। এ ছবিতেই ছিল ‘তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি’, ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’, ‘হার মানা হার পরাবো তোমার গলে’ ‘এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবি রে’-এর মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত৷ প্রতিটি গানের প্রয়োগ ছবি থেকে আলাদা হয়নি। বা জোর করে আরোপ করা নয়। এ ছবির সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিশে গেছে। মনে হয়েছে এই গানগুলোর প্রয়োজন ছিল। নাচের গান, ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’র কী অপূর্ব ব্যবহার। এখানে গান বিনোদনের উপকরণ নয় শুধু। না বলা অনেক কথা পরিচালক বলেছেন, এই গানগুচ্ছের প্রয়োগে।

আরেকটি অতি প্রিয় গানের কথা মনে পড়ছে। ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে’! কী অসাধারণ এ গানের দৃশ্যায়ন...! সেই সরস্বতীদি’র জ্যোৎস্নাভেজা ছাদবাগানে৷ যেখানে দুই বিরহিনী অমলাবালা এবং সরস্বতী হাত ধরে ঘুরে ঘুরে এই গান গাইছেন ও নাচছেন৷ ওদিকে শ্রীমান পৃথ্বীরাজ তথা রসিকলাল তার নববিবাহিতা স্ত্রীর কাছে যেতে পাঁচিল ডিঙিয়ে, কার্নিশ টপকে ছাদে উঠছে৷ সদ্য কৈশোরের ভাঙা গলায় ‘গলাটা মন্দ নয়’ বলে সে-ই শেষ করেছিল গানটা৷ শুনে জিভ কেটে এক গলা ঘোমটা টেনেছিল অমলা৷ মহুয়া রায়চৌধুরী ও সন্ধ্যা রায়ের কণ্ঠে প্লেব্যাক করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর ও কবিতা কৃষ্ণমূর্তি৷ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মুন্সিয়ানাও অনস্বীকার্য।

ওই যে জুটির কথা বলছিলাম না! তরুন-হেমন্ত জুটি। যে জুটির শুরুর মুহূর্ত তনুবাবুর প্রথম ছবি থেকেই। তনুবাবু প্রথম পরিচালনা করেন, আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে। শচিন মুখোপাধ্যায় ও দিলীপ মুখোপাধ্যায় মিলেই করেছিলেন যাত্রিক গ্রুপ। তাদেরই প্রথম ছবি ‘চাওয়া পাওয়া’। উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন জুটির অনবদ্য অভিনয়। না, সেখানে সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন না। ছিলেন নচিকেতা ঘোষ। সেই সময় উত্তম হেমন্ত জুটির রসায়নের কথা মাথায় রেখে নচিকেতা ঘোষ উত্তমকুমারের লিপে হেমন্তবাবুকে দিয়েই গাওয়ালেন, ‘যদি ভাবো, এ তো খেলা নয়, ভুল সে তো শুরুতেই...।’ সেই প্রথম তনুবাবুর সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আলাপ। হেমন্ত-তরুণের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ওঁদের আড়াই দশক ধরে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগের একটা বড় কারণ। তরুণের সঙ্গীতবোধের প্রতি আস্থা রাখতেন হেমন্ত। বলতেন, ‘তনুবাবুর মতো রবীন্দ্রনাথের গান কোনও পরিচালক বোঝেন না।’ আবার তরুণ মজুমদারের কথায়, ‘হেমন্তবাবু থাকলে আর কিছুই দরকার নেই।’

শেষের দিকে ‘আগমন’, ‘পরশমণি’ ছবিতে তরুণ-হেমন্ত জুটি অবিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু তরুণ মজুমদারের ছবিতে নায়ক-কণ্ঠে তেমনভাবে আর পাওয়া যায়নি হেমন্তকে। ‘আপন, আমার আপন’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রাহুল দেববর্মণ। সেই ছবিতে ছোট্ট একটি দৃশ্যে নিজের চরিত্রে অভিনয়ও করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ‘ঠগিনী’ ছবিতে অনুপকুমার রেকর্ড-প্লেয়ারে ‘যৌবনসরসীনীরে’ গানটি বাজিয়ে ছিলেন। মনে আছে তার আগে কী বলেছিল? বলেছিল ‘হেমন্ত, মাই ফেভারিট!’ চরিত্রের মুখ দিয়ে আসলে কী বলতে চেয়েছিলেন তনুবাবু!

বাংলা সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের গানের প্রথম যখন ব্যবহার হয়, কবি তখন বেঁচে। প্রমথেশ বড়ুয়া প্রথম ব্যবহার করেন। ছবির নাম ‘মুক্তি’। এ তথ্য আমরা সবাই জানি। ‘মুক্তি’ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। পঙ্কজ মল্লিকের পরিচিতি দেওয়া সঙ্গীতপ্রেমী ও পাঠকদের কাছে নিষ্প্রয়োজন। তিনি যে সুগায়ক ও রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন, এটা আমরা প্রায় প্রত্যেকে জানি। এই ছবিতে ব্যবহৃত বিপুল জনপ্রিয় গান, ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ তা তো পঙ্কজবাবুরই গাওয়া। সেই ‘মুক্তি’ থেকে আজ পর্যন্ত অজস্র ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক পরিচালকই চেয়েছেন, তাঁর ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করে ছবিকে জাতে তুলতে। আশাতীত সাফল্য পেতে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সে গান ব্যবহার না করলেও চলত। কিন্তু ব্যবহার হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করবেন বলে ছবির পটভূমি তৈরি করেছেন। কিন্তু তরুণ মজুমদারকে আলাদা করে এই গানের প্রয়োগ নিয়ে ভাবতে হয়নি। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে তখন সেটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

আমরা এও দেখেছি, বড় বড় পরিচালক ক্ষেত্র বিশেষে ভাব অনুযায়ী সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়োগ করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা অসাধারণত্বে পৌঁছে যায়। তেমন প্রয়োগ আমরা দেখেছি ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ কিংবা সত্যজিৎ রায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে ব্যবহার করলেন, ‘এ পরবাসে রবে কে’। ‘জন অরণ্য’ ছবিতে ব্যবহার করতে দেখলাম, ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। আরেক জনপ্রিয় পরিচালক তপন সিংহ, তাঁর ‘অতিথি’ ছবিতে ব্যবহার করলেন, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘হাটে বাজারে’ ছবিতে ‘নদী আপন বেগে পাগলপারা’, অজয় করের ‘মাল্যদান’ ছবিতে ব্যবহৃত হল ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুণগুনিয়ে’। পাশাপাশি প্রভাত মুখোপাধ্যায় একটি চমৎকার ছবি করেছিলেন, ‘বিচারক’ নামে। সেই ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিমির বরণ। কিন্তু পরিচালক শুভ গুহ ঠাকুরতাকে নিয়ে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন ও মৃণাল চক্রবর্তীকে দিয়ে গাওয়ানো রবীন্দ্রনাথের গানগুলি পরিচালনা করার জন্য। রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রয়োগের ক্ষেত্রে কতটা সিরিয়াস ছিলেন, তা সহজেই বোঝা যায়। এমনই অনেক অনেক চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগ এইভাবেই ঘটেছিল।

সিনেমার সময়কালকে বোঝানোর জন্য অনেক সময় বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হয়েছে ছবিতে। মানে ছবির নির্দেশকরা সেভাবেই ব্যবহার করেছেন। যেমন পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত ‘স্ত্রীর পত্র’তে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’তে ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’, ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’-এ ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে’ বা ‘সুভাষচন্দ্র’তে ‘তোমার আসন শূন্য আজি’ ইত্যাদি। আবার সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার করতে দেখি ট্রানজিশান হিসাবে।


সেটা কী রকম?

কাহিনীর গতিকে ব্যাহত না করে তার ছন্দে গানকে ব্যবহার করে কাহিনীর অন্য সূত্রের উত্তরণ ঘটানো। এর সার্থক প্রয়োগ করতে দেখি সত্যজিৎ রায়কে। ‘তিন কন্যা’ ছবিতে ‘বাজে করুণ সুরে’র কী চমৎকার ব্যবহার। এছাড়া এ গানে মূল চরিত্রের বিষাদের সুরটিও ধরা পড়ে। আর দেখি, সিনেমার অলংকার হিসাবেও অনেকে এই রবীন্দ্রনাথের গানকে ব্যবহার করেছেন। এই অনেকের মধ্যে যিনি সেরা, তিনিই তরুণ মজুমদার। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রয়োগ দেখিয়েছেন তরুণ মজুমদার। মানে তনুবাবু। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালবাসা ভালোবাসা’, ‘পথভোলা’ ও ‘আলো’ ছবিতে কী অসাধারণ প্রয়োগ। যে গানটি দিয়ে শুরু করেছিলাম, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিতে ‘দূরে কোথাও দূরে দূরে’, এই গানটির ব্যবহারে তাঁর চিত্রকল্পনা অনবদ্য ব্যঞ্জনা তৈরি করেনি কি! আধুনিক বাংলা গানের এতো বৈচিত্র থাকা সত্বেও, বিশেষ করে সিনেমার গানে কত কত প্রতিভাধর সংগীত পরিচালক বাংলা গানের ডালি ভরে দিয়েছেন, তথাপি বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রসংগীত আজও বিশিষ্ট স্থানে অধীশ্বর। যে রবীন্দ্রসঙ্গীত একসময় কেবল শিক্ষিত, রুচিবান শ্রোতারই আধিপত্য বিস্তারের অধিকার ছিল, আজ তা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত রুচিশীল শ্রোতার অঙ্গন ছাড়িয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। এরজন্য যাঁকে যাঁকে বিশেষ কৃতিত্ব দিতে হয়, তিনি তরুণ মজুমদার এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

তরুণ মজুমদার, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সমার্থক। একই মুদ্রার একই পিঠ। অত্যন্ত নিপুণতায় প্রয়োগ হয়েছে তনুবাবুর ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে পরিচালকের মনস্বিতায়। তনুবাবু শুধু সুর নয়, হেমন্তর ‘ভয়েস’ও ব্যতিক্রম হতে দিতেন না।

একটি জনপ্রিয় চ্যানেলে এই সময়ের সঙ্গীত পরিচালক জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘তরুণ মজুমদারের ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ ছিল চোখে পড়ার মতো। ছবির পরিস্থিতি আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে মেলবন্ধন উনি ছবিতে দেখিয়েছেন, আমার মনে হয় না বাংলা চলচ্চিত্রে এমন কাজ আর কেউ করেছেন। আমি তখন স্কুলে। ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবির গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে বড় হয়েছি। আমরা কমার্শিয়াল ছবির কথা বলি। কিন্তু তরুণ মজুমদার দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, ছবি সবার জন্য বানাতে হয়। আর কী করে রবীন্দ্রনাথের গানকে ব্যবহার করতে হয়। আলংকারিক সৌকর্যে ভরিয়ে তুলতে হয়।’

সত্যি তাই। এটি সর্বৈব সত্য।

সমীর চট্টোপাধ্যায়

 
 
 

コメント


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page