top of page

৩টি জমজমাট গল্প

Updated: Apr 23, 2023

সেবন্তী ঘোষ, অদিতি বসুরায়, দেবযানী মুখোপাধ্যায়

রাত বারোটা সাঁইত্রিশ

দেবযানী মুখোপাধ্যায়

খবরটা এসেছিল গতকাল রাতে।

ডিনার সেরে মিসেস লাহিড়ী আর্থার কোনান পড়ছিলেন। এটা ওঁর বরাবরে অভ্যাস। খাওয়ার পর শুতে যাওয়ার আগে টেস্ট বদল হয় মাঝেমাঝে। কিন্তু আগাথা ক্রিস্ট্রি বা আর্থার কোনার ডয়েল ওঁকে বেশি করে টানে। এখন হাতে আর্থার কোনানের লাইট ইন দ্য ডার্কনেস সিক্স চ্যাপ্টার শেষ করে সেভেনে চোখ ফেলেছেন। মোবাইলটা বেজে উঠল। পাশের ঘরে চার্জে বসানো ছিল বলে প্রথম কলটা শুনতে পায়নি। মেয়ে জর্জ মাইকেলের কেয়ারলেস উইস পার শুনছে বেশ মধ্যমগ্রামে। সেকেন্ড কল বাজতে মেয়ে শ্রীতমাই চিৎকার বলল মম, ইয়োর কল...

মিসেস লাহিড়ী শুনতে পেলেন না।

মালতি, মাকে ফোনটা দিয়ে আয় তো! শ্রীতমা বলল।

মালতি ফোন নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। ‘এই নাও, তোমার ফোন!’

ফোনটা ডান হাতে নিয়ে ‘ডিসপ্লে’ তে দেখলেন, কলিং নির্মাল্য! দেওয়াল ঘড়িটায় একবার চোখ ফেললেন। ১২টা ৩৭! ফোনটা রিসিভ করলেন মিসেস লাহিড়ী।

-হ্যাঁ, নির্মাল্য!

-কাকাবাবু নেই। একটু আগে চলে গেলেন।

একটু স্থবির হলেন। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, কখন?

-১২টা ৩৭!

-ওকে। বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিলেন।

মিসেস লাহিড়ী স্তম্ভিত। ফোনটা এল ১২টা ৩৭-এ। আবার, উনি চলে গেলেন ১২ টা ৩৭!

ফোনটা পাশে রেখে আবার চোখটা ডুবে গেল, লাইট ইন দ্য ডার্কনেস-এ। কতকিছু ভাবনা এল মাথায়। পাশের ঘরে জর্জ মাইকেল ততক্ষণে নীরব হয়েছে। ঘরের আলো নেভেনি। তারমানে শ্রীতমা এখনও জেগে আছে। তারমানে এক্ষুনি চরাও হবে মাতৃরুপেণ সংস্থিতা হয়ে। ‘এখনও ঘুমোওনি। তোমার শরীরটা কিন্তু খারাপ করবে মম। তোমাকে কতবার বলেছি না, যেদিন ঘুম থেকে উঠলে সেইদিনই ঘুমোও, পরের দিন নয়।

মিসেস লাহিড়ীকে কোনও শাসনেই বাগে আনা যায় না। তবু মেয়েকে একটু সমঝেই চলেন। এমনিতে মেয়ের কড়া শাসনকে সম্মান জানিয়ে আজকাল একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। কিন্তু শুলে কি হবে? ঘুম আসেনা কিছুতেই। মেডিসিনের ডাক্তার, অভিজিৎ ঘোষ, দুটো বিদেশি ডিগ্রিও আছে, সে বলেছে, ১১টার মধ্যে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পরতে হবে। আলো নিভিয়ে। শোয়ার জন্য নাকি জুতসই পরিবেশ তৈরি করতে হয়।

এটা ডাঃ ঘোষের বাড়াবাড়ি। ১১ টার সময় সব কিছু শেষ করে ঘুমোতে যেতে হবে! বাড়াবাড়ি মনে হলেও ডাঃ ঘোষের অ্যাডভাইস অনুযায়ী ১১ টার মধ্যে ঘুমোতে গেলেও ঘুম চোখে আসেনি। প্রায় সারা রাত প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে থাকেন। ডাক্তারি পরিভাষায় একে ইনসমনিয়া বলে।

ডাক্তার বাবু বলেছেন, বাঁচতে হলে ঘুমোতেই হবে! ঘুমই হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার চাবিকাঠি। ঘুম আপনার মস্তিষ্ক ও শরীরকে দেয় পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম। যার কারণে আপনি কর্মক্ষম থাকতে পারেন। কিন্তু যাদের রয়েছে ইনসমনিয়া সমস্যা? বিশেষ করে অনিদ্রারমতো ভয়াবহ যন্ত্রণা! তারাই বুঝতে পারেন ঘুমের মূল্য! অনেকে আছে যারা রাতের পর রাত শুয়ে জেগে থাকে, ঘুমানোর চেষ্টা করলেও তাদের ঘুম আসে না। ঘুম এলেও ঘুমানোর পর মধ্যরাতে জেগে যায়। চেষ্টার পরও আর ঘুমাতে পারে না। অনেকে এটাকে খুব সাধারণ ব্যাপার মনে করে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু...! মিসেস লাহিড়ী ইদানিং ঘুমোতে পারেন না। আগাথা ক্রিস্টি বা আর্থার কোনান সঙ্গী। এখন যেমন আর্থারের সঙ্গে গল্প চলে। দিন কতক হল, মিসেস লাহিড়ী লক্ষ করছিলেন, ঠিক ১২টা ৩৭-এ একটা অদ্ভুত শব্দ আসে। শব্দটা খুব বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না। ক্রমশ উত্তরে সরে সরে যায়।

উত্তরেই তো থাকেন মিস্টার বোস। থাকেন না। থাকতেন। খবরটা পাওয়ার পর থেকে মিসেস লাহিড়ীর মনটা একটু বিচলিত।

মিসেস লাহিড়ীর সঙ্গে মিস্টার বোসের তেমন সম্পর্ক ছিল না। নির্মাল্যর কাকা বলেই জানতেন। যেহেতু নির্মাল্য ছাত্র, তাই নির্মাল্য কাকাকে নিয়ে এত কথা বলত, যে মিস্টার বোস তার বেশ পরিচিতও হয়ে উঠেছিলেন।


আজ সাত সকাল উঠে পড়েছেন মিসেস লাহিড়ী। উত্তরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। চারপাশটা চুপচাপ। একটু বেশি নীরব আজ। কেবলই মিত্রদের বাড়ি থেকে হালকা গানের কলি ভেসে আসছে। ‘নীরব করে দাও হে তোমার...’! রবীন্দ্রনাথের গান।

আষাঢ়ের বাদলদিন। আকাশের মুখ কালো। থমে থমে হয়ে আছে। রাতে খানিক বৃষ্টি ঝরেছে। মিসেস লাহিড়ী গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন। মন খারাপের সকালবেলা। মনে কেবলই নানা ফমুলার অ্যালজেব্রা। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা হবে। মনে হচ্ছে রাতের চেয়েও অন্ধকার। একটা ঠাণ্ডা মতো হালকা হাওয়া। বারান্দার ওই কাঠের চেয়ারটায় বসলেন। মাথায় হালকা চুলে হাতদিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। জগতের সব কিছু থেকে আজ বিচ্ছিন্ন। মালতি চা করে নিয়ে এসেছে। সেদিকেও কোনও খেয়াল নেই মিসেস লাহিড়ীর।

মালতি দুতিন বার ডাকল, দিদি, ও দিদি, চা নাও। আবার মালতি বেশ জোরের সঙ্গে বলতেই, মিসেস লাহিড়ী বিরক্ত হলেন। ওঁর দিকে না তাকিয়েই বললেন, ওখানে রাখ না!

-তোমার কি হয়েছে গো...

মালতি কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই মিসেস লাহিড়ী বললেন, যা তুই এখান থেকে।

মালতি মুখটা কাছুমাচু করে ভিতরে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতেই, মিসেস লাহিড়ী বললেন, মালতি তুই নির্মাল্যর কাকাকে চিনতিস না!

মালতি বাসন পড়ার মতো ঝনঝন শব্দে বলে উঠল, নির্মাল্য দাদাবাবুর কাকা তো! চিনি তো! আমার বোনঝি সুলেখা আছে না গো, সেই তো রান্না করে ওখানে। খুব ভালো লোক শুনেছি দিদি। ওই বাড়িতে তো একাই থাকেন। আর একজন লোক থাকে সব সময়। বউ নেই তো। মারা গেছেন অনেক আগে। এক মেয়ে গো দিদি ওনার। সে তো বিয়ে হয়ে গেছে। জামাই দাদাবাবু খুব ভালো শুনেছি। এখানে মাঝে মাঝেই আসে তো গো। শ্বশুরমশায়ের খুব যত্ন করে। খুব ভালোবাসে। শ্বশুরও খুব ভালবাসে।

মিসেস লাহিড়ী মালতির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তোর বোনঝি সব সময় ওখানে থাকতো?

মালতির চট জলদি উত্তর, না গো দিদি। ওই রান্না করে চলে আসতো। দুবেলার রান্নাই করতো তো! আর যেদিন ওনার মেয়ে জামাই আসতো, সেদিন ওকে রাতের দিকেও যেতে হত।

মিসেস লাহিড়ী জানতে চাইলেন, মেয়ে জামাই প্রায়-ই আসে বুঝি?

না , প্রায় আসে না মেয়ে। মাঝে মাঝে তো আসেই। এক নিঃশ্বাসেই মালতির প্রশ্ন, কি হয়েছে গো দিদি!

নির্মাল্য কাকা মারা গেছে। মিসেস লাহিড়ী ঠাণ্ডা উত্তর।

এত কিছুর মধ্যেও মিসেস লাহিড়ী চারপাশটা কেমন দেখতে চাইছেন। নতুন করে দেখছেন যেন। চা পড়ে আছে। মালতির সেদিকে চোখ গেল। বলল, ও দিদি, চা টা যে ঠাণ্ডা সরবত হয়ে গেল গো। একটু গরম করে নিয়ে আসি।

-যা।

চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে বলে চলেছে, ইস ভালো মানুষ ছিল গো। ভালো মানুষরা পৃথিবীতে থাকে না খুব একটা।

মিসেস লাহিড়ী চিনতেন নির্মাল্যর কাকাকে। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকসে বড় চাকরি করতেন। পাশের একটা বহুতলে একাই থাকতেন। মিসেস লাহিড়ী ভাবছেন একবার যাওয়া উচিত। চটজলদি তৈরি হয়ে মিসেস লাহিড়ী বের হলেন। খুব দূরে তো নয়! নিজেই ড্রাইভ করে গেলেন।

বাড়িতে অনেক লোক। সবাইকে মিসেস লাহিড়ী চেনেন না। মেয়ে জামাই আছে। জামাই সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কথা বলছে। সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। মেয়ে শ্রাবণী পাথরের মতো স্থবির হয়ে বসে। কাল থেকে মুখে এক ফোঁটা জলও পড়েনি। বাড়ির সব সময় থাকা অনেক পুরনো লোক হারাধনদা, বারবার এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর চেষ্টা করছেন, কিছু যদি একটু খাওয়ানো যায়।

নির্মাল্য ওখানে নেই। নির্মাল্যর এইসময় এখানেই তো থাকার কথা।

জামাই সুবীর ব্যানার্জিও খুব মুষড়ে পড়েছেন। তিনিই জানালেন, রাত ১২ টা ৩৭-এ বাবা চলে গেলেন। ডাঃ সরকারকে কল করা হয়েছিল। উনি বললেন হার্ট ফেলিওর। ঘুমের মধ্যেই হয়েছে। না, তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি। ডাঃ সরকার ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। তারপর...

গোটা ব্যাপারটা দেখে শুনে মিসেস লাহিড়ী আরও অস্থির হয়ে উঠলেন। বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

এরপর সারাদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। বাড়িতে এসে অনেক কিছু ভেবে চলেছেন। ওনার বারবার মনে হচ্ছে, এর ভিতরে কোথাও একটা অস্বাভাবিক কিছু আছে।

মাথার ভিতরে জটিল অঙ্ক কষেই চলেছেন।

সারাদিন বইতে মুখ গুঁজে ছিলেন। সারাদিন ভালো করে কিছুই খান নি। আর্থার কোনানকে নিয়েই ছিলেন। সারাদিন নির্মাল্যকে ফোন করেননি। নির্মাল্যও না। ও বাড়িতে সহদেব বলছিল, সন্ধ্যেবেলা থেকে নির্মাল্য ও বাড়িতেই ছিলেন। কাকাকে ওষুধ পত্র খাইয়েছেনও নির্মাল্য। রাতে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কাকা প্রায় জোর করেই ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর ১২ টা ৩৭-এ নির্মাল্যই খবর দেচ্ছে, কাকা চলে গেলেন। মিসেস লাহিড়ীর বারবার মনে হচ্ছে, এ কি চলে যাওয়া, না পাঠিয়ে দেওয়া!

আবার এওতো ঠিক। হার্ট অ্যাটাক তো যখন তখন হতে পারে। আবার ভাবছেন, হার্ট ফেলিওরের কিছু সিম্পটম তো থাকবেই। যা দু আড়াই ঘন্টা আগের থেকে বোঝা যাবে। নির্মাল্য ডিনার সেরে বেরিয়েছে রাত ১০টা হবে। মাঝখানে ২ ঘন্টা ৩৭ মিনিট পর, অর্থাৎ ১২ টা ৩৭ মিনিটে কাকার চলে যাওয়ার খবর দিচ্ছে।


মিসেস লাহিড়ীর রাতের ঘুম চলে গেল।

আর্থারের লাইট ইন দ্য ডার্কনেস-এ সেভেন চ্যাপ্টারে চোখ রেখেছেন। মেয়েও আজ খুব একটা মাকে ঘাটায়নি। বুঝতে পারছে মা একটা জটিল আবর্তে আছে। মাকে চেনে তো! এমন পরিস্থিতিতে যতক্ষণ না মায়ের চিন্তার জট খুলছে ততক্ষণ মাকে কিছু বলা যাবে না! মালতিও বোঝে ব্যাপারটা। তবে মিসেস লাহিড়ী ভাবছেন মানে, সমস্যা কোথাও জট পাকিয়েছে। এই জট উনি খুলবেন নি। মিসেস লাহিড়ীকে ছাত্র নির্মাল্যও ভালো করে চেনেন। অসম্ভব জেদি এই ভদ্রমহিলা।

তার বারবার মনে পড়ছে, ওই লাইনগুলো, The darkness isn’t wrong. It’s part of life, a backdrop for the stars at night, the space between what you know. Darkness has a way of reminding you of the light you’ve been given on all those other days. Read these quotes to help you bring darkness to the light, and make it part of the light.


আজকের প্রকৃতি একটু হেসেছে। আষাঢ় গগনে রোদের মেলা। আজও সকালে উঠে মিসেস লাহিড়ী এসে বসেছেন, বাইরে ব্যালকনির ওই কাঠের চেয়ারটিতে। একফালি রোদ এসে লেপটে পড়েছে মিসেস লাহিড়ীর পায়ের কাছে। মালতি কিছুক্ষন আগে চা দিয়ে গেছে। টেমির ফাস্ট ফ্ল্যাশে চুমুক দিতে দিতে দুয়ে দুয়ে চার মেলাচ্ছেন। ফোন করলেন কার্ডিওলজিস্ট অরিন্দম পান্ডেকে। অনেকক্ষন কথা হল। ফোনটা রেখে এক মুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে নিয়েই, ফোন লাগালেন নির্মাল্যকে। নির্মাল্য ধরাতে মিসেস লাহিড়ী বললেন, আমি কি আরেকবার ও বাড়ি যেতে পারি? তুই কি একটু আসবি?

নির্মাল্য মেমকে চেনে। এর আগে কাকতালীয়ভাবে দু দুটো কাজে অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজ করেছে। কিন্তু এখানে মেম আবার নতুন করে কি ঘোঁট পাকাচ্ছেন? কাকার মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু। ওর পিছনে আর কিছুই থাকতে পারে না। মেয়ে মুনিয়া বা ওর বর সুবীরদা যথেষ্ট কেয়ারিং। আর তাছাড়া...

যাইহোক ম্যামের ইন্টিউশনের ওপর বিশ্বাস ও ভরসার পরিচয় পেয়েছে। ফলে খুব স্বাভাবিক লাগছে না ব্যাপারটা নির্মাল্যর। কেঁচো খুঁড়তে দেওয়ার বন্দোবস্ত বানচাল করা উচিত নয় কি! কিন্তু ম্যামের যেতে চাওয়াকে আটকায় কি করে? তাহলে তো সন্দেহের তীরটা আরও প্রকট হতে পারে। যাহোক, ম্যামকে জানাল, ঠিক আছে। আপনি রেডি থাকবেন ম্যাম। আমি ১২টা ৩৭ মিনিটে আপনাকে পিক আপ করব।

ফোনটা রেখে মিসেস লাহিড়ীর মাথায় একটা স্পার্ক খেলে গেল। আরেকটা ১২টা ৩৭। ম্যামের বাড়ি থেকে নির্মাল্যর বাড়ি সাত মিনিট দূরে। ম্যামের বাড়ি থেকে কাকাবাবুর বহুতল বাড়ি ২ মিনিট। ঠিক ১২ টা ৩৭ মিনিটে নির্মাল্য ম্যামকে পিক আপ করে ঠিক টাওয়ারের সামনে গাড়ি পার্ক করে এসে দেখল, ম্যাম কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছেন। এই টাওয়ারের দশ তলাতেই কাকাবাবু থাকেন। কথা শেষ করে নির্মাল্যকে দেখে, ম্যাম বললেন, চল নির্মাল্য।

ওপরে উঠে নির্মাল্য ডোরবেল বাজাল। হারাধনদা দরজা খুলে দিলেন। কেমন যেন বিমর্ষ ভাব হারাধনদার। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। নির্মাল্যকে দেখে একটু চমকেই উঠল। ম্যামকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, আসুন দিদি। ম্যাম ঘরে ঢুকেই এক গ্লাস জল খেতে চাইলেন। চোখের মণি ঘরের চারপাশটায় ঘুরছে। সব যেন এক লহমায় লেন্স বন্দি করতে চান। মেয়ে পাশের ঘরের ছিল। ওখান থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, হারাধনদা, কে এসেছেন গো?

হারাধনের জবাব, নির্মাল্য দাদাবাবু। আর ওই দিদিমণি। পাশের ঘর থেকে মুনিয়া মানে শ্রাবণী এল। ও। বসুন ম্যাম। ম্যাম শ্রাবণী হাত দুটো ধরে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা কি কারও সারা জীবন থাকেন! তোমার হাজবেন্ডকে দেখছি না।

ও একটু বেরিয়েছে। অফিসের কিছু একটা জরুরি কাজে। মুনিয়া বলল।

মিসেস লাহিড়ীর জল খাওয়া হয়ে গেছে। হাতে ফাঁকা গ্লাসটা ধরে আছেন। শ্রাবনী হারাধনদাকে, ডেকে বললেন, হারাধনদা গ্লাসটা নিয়ে যাও।

হারাধন এল। দিন দিদিমণি।

গ্লাসটা বাড়িয়ে দিতে দিতে মিসেস লাহিড়ী জিজ্ঞাসা করলেন, বাবু কখন শুয়ে পরতেন?

হারাধনদা বলল, ঠিক কখন শুয়ে পরতেন তা তো বলতি পারবো নি। এই দিন কতক ধইরে আমি সাড়ে আটটায় সব খাবার টাবার গুছিয়ে বাড়ি চইলে যেতাম। আমার ইস্তিরির স্টোক হওয়ার পর থেইকে। বাবুই জোর করে আমায় পাঠাই দিতেন। কি ভালো মানুষ ছিল গো দিদিমণি! আমি থাকতে চাইলে বাবু বলতেন, হারাধন তুমি বাড়ি যাও। অসুবিধে কিছু লাগলে নির্মাল্য তো আছেই। তো আমি চলে যেতাম। বাবু রাতে খেইয়ে, বই পইড়ে তবে ঘুমোতে যেতেন। মেসেস লাহিড়ী শুনছেন। আর ঘন ঘন মাথায় হাত দিচ্ছেন। নির্মাল্য মিসেস লাহিড়ীর এই মুদ্রা গুলো চেনে। তারমানে ম্যাম মনে মনে দাবার ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। কিছু একটা সমাধান তো বের করবেনই। নির্মাল্য ভাবছে সন্দেহের তালিকায় সে নেই তো!

ভাবতে ভাবতেই নির্মাল্যর দিকে তাকালেন ম্যাম। বললেন, নির্মাল্য তো সেদিন দশটা, সাড়ে দশটা পর্যন্ত ছিলে কাকাবাবুর কাছে?

হ্যাঁ। তারপর আমি...

বলার আগেই মিসেস লাহিড়ী বললেন, সেই রাতে তো, কাকাবাবু চলে গেলেন।

শ্রাবনীর দিকে ঘুরে মিসেস লাহিড়ী প্রশ্ন করলেন, তুমি সেদিন বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলে?

-হ্যাঁ। বলেছিলাম। তার সাড়ে ৯ টায়। বাবাকে বললাম তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।

-তোমার হাজবেন্ড...

-আমাকে বাবা চিরকাল ছোট হিসেবেই দেখে গেলেন। কখনও কোনও ব্যাপারে ভরসা করতে পারতেন না। বিষয় আসয়ের ব্যাপারে বলতেন, যতদিন আমি আছি, তোর সম্পত্তি সামলাচ্ছি। আমি চোখ বুঝলে সুবীরকেই সব দেখতে হবে। তুই এসব সামলাতে পারবি না। আমার হাজবেন্ড বলত, আমি আবার কেন বাবা। আমি হার্ডখোর প্রযুক্তির লোক। আমার পক্ষে কি এসব সামলানো সম্ভব? এর মাঝে একদিন আমাকে আর ওকে ডাকলেন। নির্মাল্য দাদাভাইও ছিল। বাবা বললেন, আমার মৃত্যুর পর তোর এই বিষয় আসয় সুবীরের পক্ষে দেখভাল করা সত্যি সম্ভব হবে না। ও একজন স্কলার মানুষ। কত বড় বড় কাজ করছে। এইসব ঝামেলা পোহাতে ওর আসল কাজগুলোই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই ভাবছি, নির্মাল্য দায়িত্ব দিয়ে যাব। ও তোকে ভালো করে গাইড করতে পারবে। সুবীর লাফিয়ে উঠেছিল। খুব ভালো প্রস্তাব বাবা। এইসব বিষয় আশয় টাকা পয়সা, সামলানো আমার কাজ নয় বাবা। আপনি যে কতটা আমাকে ভার মুক্ত করলেন। আমি বলেছিলাম, আঃ, আমি বুঝতে পারছি না, এখনি এসব কথা বলার মানে কি? সে পরে দেখা যাবে এখন।

বাবা বলতেন, না রে মা! আগের কাজ আগে করে ফেলতে হয়। নাহলে কাজটাই বাকি থেকে যায়। ইচ্ছেটাও পূরণ হয় না। আর সুরক্ষারও অভাব থেকে যায়। আমি সহদেবকে ফোন করেছি। ও বাইরে আছে। ফিরে এসে সব কিছু আইনানুগ করে দেবে।

মিসেস লাহিড়ী জানতে চাইলেন, সহদেব কে?

নির্মাল্য বলল, ব্যারেস্টার আংকেল।

মিসেস লাহিড়ী বললেন, মানে হাইকোর্টের ব্যারেস্টার সহদেব মিত্র? তো সেই মর্মে কি উইল হল?

শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, না। তার আগেই তো হঠাই চলে গেলেন। আমি যখন রাতে খবর পেলাম, তখন তো আমি বাড়িতে একা।

মিসেস লাহিড়ী জিজ্ঞাসা করলেন, কেন সুবীরবাবু?

-না। ওতো অফিসের কারণে অনেক রাতে রাতে বাড়ি ফেরে। কখনও কখনও দুটো, তিনটে বেজে যায়।

-কে খবর দিল? মিসেস লাহিড়ী জানতে চাইলেন।

-দাদাভাই।

নির্মাল্যর দিকে তাকিয়ে মিসেস লাহিড়ী বললেন, আমিও খবর পেয়েছি নির্মাল্যর কাছ থেকেই। আচ্ছা, নির্মাল্য তুমি কী করে খবর পেলে?

নির্মাল্য বলল, হারাধনদা। হারাধনদাই খবরটা দিয়েছেন।

মিসেস লাহিড়ী অদ্ভুত সুরে বললেন, হারাধনদা তো বাড়ি চলে যান সাড়ে আটটায়?

মিসেস লাহিড়ী লক্ষ করলেন, হারাধন এই ঘরে না ঢুকে দরজার ফাঁকে কান দিয়ে আছে। কাঁচুমাচু মুখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে।

নির্মাল্য বলল, না মানে সেদিন হারাধনদা এ বাড়িতেই ছিল।

মিসেস লাহিড়ী নির্মাল্যকে বলল, একবার হারাধনদাকে ডেকে দিতে।

নির্মাল্যর এক ডাকেই হারাধনদা এসে হাজির। যেন একেবারে প্রস্তুত। ও জানতো, এখুনি ওকে ডাকা হবে।

মিসেস লাহিড়ী হারাধনদাকে বললেন, চল তো হারাধনদা দাদাবাবুর ঘরটা একটু দেখে আসি।

ঘরে ঢুকে আবেগ সামলাতে পারলেন না নির্মাল্য। কাকাবাবুর বিছানাটা দেখে চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে লাগল।

শ্রাবনী সেদিনের পর থেকে আর এ ঘরে ঢোকেনি।

বাবাকে হারিয়েছে নির্মাল্য অনেকদিন আগেই। এবার কাকাবাবুও চলে গেলেন। নির্মাল্য একা হয়ে গেলেন। বিয়ে থা হয়নি। ফলে আর কিসের পিছুটান। এখন এই বোনই বাঁচার আশ্রয়। মাও তো ফাঁকি দিয়ে কবেই চলে গেলেন।

ঘরের চারপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ ম্যাম বললেন, হারাধনদা, ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে পর্দাগুলো টেনে দাও।

আজ্ঞা মতো হারাধনদা তাই করলেন।

নির্মাল্য বুঝতে পারল না ম্যাম এগজাকলি কী করতে চাইছেন। ম্যামের এই আচরণ ওর কাছে যেন অদ্ভুত লাগছে।

পর্দা টানার পর ঘর বেশ অন্ধকার। ভারী পর্দা। হারাধন দা লাইট জ্বালাতে যাচ্ছিলেন। বাঁধা দিলেন। আবছা পর্দাগুলো ভালো করে দেখতে লাগলেন।

নির্মাল্যর বিস্ময়ের পারা চরছে। ভাবছে ম্যামের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! এই বাড়িতে এসে পর্দা নিয়ে পড়লেন। কেমন জেরা করার মতো করে সব কিছু জানতে চাইছেন! কাকাবাবুর সঙ্গে তেমন পরিচয়ও তো ছিল না! তাহলে...! তাছাড়া ডক্টরও বলেছেন, এটা ন্যাচেরাল ডেথ। সিম্পল হার্ট ফেলিওর। এখানে অন্য গন্ধ খোঁজার কী আছে? এই গোয়েন্দাগিরির নেশা ম্যামকে পেয়ে বসেছে। আসলে সারা দিনের কাজকর্ম শেষে শরীর ও ব্রেনের বিশ্রাম দরকার হয়। ঘুমের সমস্যা নিয়মিত চলতে থাকলে ক্রনিক হয়ে পরে অসুখে পরিণত হয়। ম্যামের তেমনই হয়েছে। মনে ভাবল, বলেই ফেলি। মুখে এসেও বলতে পারলেন না। এর মধ্যে একটা ফোন এল ম্যামের মোবাইলে। ম্যাম ধরলেন। কয়েক সেকেন্ডের হ্যাঁ, না তে ইঙ্গিত পূর্ণ কথা হল। কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব হল না, কের সঙ্গে কী বিষয়ে কথা বললেন ম্যাম।

মিসেস লাহিড়ী হারাধনদাকে বললেন, এবার ঘরের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দাও।

হারাধনদা ঘরের লাইট গুলো জ্বালিয়ে দিল। মিনিট দুই এদিক ওদিক ঘুরে আবার বললেন, লাইটগুলো নিবিয়ে দাও। বাবু কি কোনও নাইট লাইট জ্বালিয়ে ঘুমোতেন। হ্যাঁ, হালকা একটা লাইট। ওই ওটা... বলে লাইটটা দেখাল হারাধন।

মিসেস লাহিড়ী বললেন, ওই লাইটটা জ্বালিয়ে দাও। আচ্ছা জানলা...

হারাধনদার চটজলদি উত্তর, না খুলেই শুতেন।

এতক্ষণ চুপ করে থেকে নির্মাল্য বলল, ম্যাম আপনি কি অন্য কিছু সন্দেহ করছেন? মানে কাকাবাবুর মৃত্যু হার্ট ফেলিওর নয়? কিন্তু ডক্টর তো তাই বলেছেন।

দক্ষিনের খোলা জানলার দিকে এগিয়ে বললেন, হাতে ভারী পর্দা ধরা। নির্মাল্য, হতেও তো পারে ওর খুব আপনজন বা কাছের কেউ মুখে কিছু চাপা দিয়ে হার্টের ওপর চাপ ফেলে মেরেছে। বা হতেও তো পারে এটা হার্ট ফেলিওর নয়। কোনও পোষ্টমর্টেম তো হয়নি! কি করে নিশ্চিত হচ্ছিস, যে এটা হার্ট ফেলিওর?

নির্মাল্যর মুখটা একটু পাংশু হল। হারাধনদা নার্ভাস। কপালে বিন্দু ঘাম।

মিসেস লাহিড়ী হারাধনদাকে জিজ্ঞসা, বাবু ঘুমোতে যাওয়ার আগে কখনও ঘাম ছিলেন বা বলছিলেন বুকে কোনও ব্যথা হচ্ছে!

হারাধন প্রথমে না বলেও সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলল। না মানে বাবু মাঝে মাঝে বুকে হাত দিচ্ছিলেন।

মিসেস লাহিড়ী স্পস্ট বুঝতে পারলেন, মিসেস লাহিড়ীর পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে নির্মাল্য হাতের ইশারা করছে হারাধনদাকে। তারই প্রতিফলন হারাধনদার ওই উত্তর।

মিসেস লাহিড়ী ঘুরে দাঁড়ালেন। নির্মাল্য, একবার সুবিমলবাবুকে আসতে বল তো! বল আমি বলেছি।

সুবিমলবাবু লোকাল থানার জাঁদরেল ওসি।


ম্যামের নির্দেশ অনুযায়ী কাকাবাবুরই ফ্ল্যাটে আত্মীয় পরিজন সবাইকে ডেকেছেন আগামী কাল বিকেলে।


পরেরদিন ঠিক বিকেল পাঁচটা। ফ্লাটে একে একে উপস্থিত। নির্মাল্য আগেই চলে এসেছে। আছে শ্রাবণী, সুবীরবাবু। চলে এসেছেন ম্যাম। আছে হারাধনদা। সুলেখা। এইমাত্র ঢুকলেন তিনজন অপরিচিত মানুষ, যাঁদের নির্মাল্য এবং ওর বোন চিনতে পারল না। ম্যাম হয়তো ডেকে থাকবেন। ম্যাম বললেন, নির্মাল্য আজ আপনাদের এখানে আসতে বলেছে। ওর কিছু বক্তব্য আছে। ও নিশ্চয়ই বলবে। কিন্তু তার আগে...

নির্মাল্য একটু উসখুস করে উঠল। না মানে... আ..মি

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ম্যাডাম বললেন, হ্যাঁ, তুমি নির্মাল্য! যাহোক, আমরা মনে করছি কাকাবাবুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। তাই আমরা যারা ওঁর আত্মীয় বন্ধু, তারা কি চাই না, আসল ব্যাপারটা কি তা সবার সামনে উন্মোচিত হোক!

সবাই চুপ।

সুবীরবাবু পকেট থেকে ডানহিলের প্যাকেটটা বের করে বললেন ডু ইউ মাইন্ড ইফ আই স্মোক..?

কথাটা যে ম্যাডামকে লক্ষ্য করেই বললেন, তা বুঝতে অসুবিধে হল না মিসেস লাহিড়ীর। ঘাড় ঘুরিয়ে ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি টেনে বললেন, নো, নো! প্লিজ...

সুবীরবাবু ইঞ্জিনিয়র। খুব জেন্টলম্যান। সমাজের কিছু মাথা ওকে মান্যি করে।

সুবীরবাবু সিগারেটটা ধরিয়ে ঘরের এক কর্নারে দক্ষিণের জানলার পাশে দাঁড়ালেন। এই ঘরে আস্ট্রে থাকার কথা নয়। তাই এই দক্ষিণের জানালাটার বাইরে ফাঁকা। সামনে অনেকটা খোলা মাঠ। এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ছাই ফেলতে খুব সুবিধে হবে। তাছাড়া দক্ষিণা হাওয়ায় মনও ভালো থাকে। এখন যে ফেসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ওঁরা! বিশেষ করে মেয়ে এবং জামাই। জামাইবাবাজীবনকে খুব ভালবাসতেন উনি।

সুবীরবাবুর এই বিষয়টা খুব ভালো ভাবে দেখছেন না। মুখে কিছু না বললেও আচরণে খানিকটা বুঝিয়ে দিয়েছেন বটে।

মিসেস লাহিড়ী সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে সুবিমলবাবুকে ফোন করলেন। আমরা সবাই যে এসেগেছি। আপনি...

বলতে বলতে দরজায় বেল। সুবিমলবাবুর প্রবেশ।

প্রাথমিক পর্বের আলোচনার পর মিসেস লাহিড়ী সুবিমলবাবুর সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রায় সবাইকেই সুবিমল বাবু চেনেন। কেবল চিনতে পারলেন না, সুবীর বাবুকে। সে দিকে তাকাতেই মিসেস লাহিড়ী বললেন, ইনি শ্রাবণীর হাজবেন্ড। মেসেস লাহিড়ী উনার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তো স্যার আরোনিটিকাল এঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তো? সুবীরবাবু একটু হকচকিয়ে গেলেন। এটা তো বহু আগের কথা। সে চাকরিও তো ছেড়ে দিয়েছেন বিয়ের আগে। সে কথা তো এঁদের জানার কথা নয়। প্রেমিকের বায়োডাটায় তেমনটা তো বলেনও নি। একটু আমতা আমতা করে বললেন, না, আগে একটা সময় করতাম। ছেড়ে দিয়েছি বহুদিন। এখন অন্য লাইন।

ম্যাম জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কোন লাইনে স্যার?

সুবীরবাবুর স্পস্ট জবাব, এখন গাড়ির ব্যাবসা।

সুবিমল বাবু বললেন, ব্যবসা কেমন চলছে?

নির্মাল্য কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এর সঙ্গে আজকের এই বসার কি সম্পর্ক! ম্যাডাম কি খোশ গল্প করার জন্য সবাইকে ডেকে এনেছেন?

সুবীরবাবু পকেট থেকে সিগারেট বের করে বললেন এখানে আমরা একজনের মৃত্যুর হেতু সন্ধান করতে এসেছি। যদিও আমি মনে করি, এর কোনও কারণই নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট করা! এর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় কেন উঠছে। এটা কমপ্লিট ন্যাচারাল ডেথ। সিম্পল হার্ট অ্যাটাক। তাছাড়া বাবা নাকি কি উইল করে দিয়ে গেছেন, তা পরা হবে। কিন্তু...

নির্মাল্যও কিঞ্চিৎ সায় দিল। কিন্তু উইলের কোথায় আশ্চর্য হয়ে গেল। নির্মাল্য ম্যামের দিকে তাকিয়ে। ম্যাম বললেন, হ্যাঁ, আমি ওনাকে বলেছি উইল পড়া হবে। তাই উনি আসতে পেরেছেন। নাহলে, ব্যবসায়ী মানুষ তো, আসার সময় পাচ্ছিলেন না।

এবার সুবীরবাবু উঠে বললেন, এনাফ ইজ এনাফ। আমার অনেক কাজ আছে। আমাকে একটু বেরিয়ে যেতেই হবে। সরি।

ম্যাম সোজা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না স্যার আপনি বসুন। আপনি আরেকটু পরে যাবেন। হারাধন দা সেদিন যখন কাকাবাবু শুতে এসেছিলেন, তখন কি কাকুবাবু ঘামছিলেন? কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল? বুক ব্যথার কথা বলছিলেন?

হারাধন বাবু বিক্ষিপ্তভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। ম্যাডাম ধমক দিয়ে বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে বলুন। কারও দিকে তাকিয়ে নয়। আমরা জানি, কার কথায় সেদিন আপনি থেকে গিয়েছিলেন?

সুবিমল বাবু, এটা কোনওভাবেই হার্ট ফেলিওর নয়। সাধারণত বুকে ব্যথা হওয়াটা সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ। হঠাৎ করে বুকটা ভীষণ চেপে ধরে। মনে হয় বুকটি ভেঙ্গে পড়ল। অনেক ওজন চেপে গেছে। এটা হয় শুরুতে এবং এর সাথে সাথে অনেকের শরীরে ঘাম হতে থাকে। পাশাপাশি অনেক সময় মাথা ঘুরতে থাকে, বমি হতে থাকে। আবার বমি নাও হতে পারে। তবে বুকে ব্যথা হওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

তার হয়তো আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনো রোগ ছিল, সেখান থেকে হার্ট অ্যাটাক হলো। এগুলোই তার প্রধান উপসর্গ। এর কোনওটাই কাকাবাবুর ছিল না। কাকাবাবুকে খুন করা হয়েছে।

সুবীরবাবু লাফিয়ে ওঠে বললেন, ইন্সপেক্টর, এই খুনি। হারাধনদার দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন। দেখুন এর পিছনে আর কে কে আছে? নিশ্চয় রাতে গলাটিপে মেরেছে হারামজাদা।

বলে সুবীরবাবু দরজার দিকে এগোচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই যে অপরিচিত তিনটি লোক ও সুবিমল বাবু দরজা আঁটকে দাঁড়ালেন। কোথায় যাচ্ছেন সুবীর রায়চৌধুরী! আপনার খেল খতম। আপনি এখানেই থাকবেন।

সুবীরবাবু হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করলেন। আমি একজন ভদ্রলোক! বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন করতে যাবেন, ম্যাডাম গিয়ে মোবাইলটা কেড়ে নিলেন। না মিস্টার রায়চৌধুরী। কাউকে ফোন করা যাবে না এখন।

সুবীরবাবু বললেন, আমার অপরাধ?

সুবিমলবাবু বললেন, ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া ডক্টরের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সেসব স্বীকার করে নিয়েছে।

হারাধনকেও বাড়ি যেতে বারন করা হয়। সেই সঙ্গে বলা হয়, যা যা বলব, তাই তাই করতে। কাউকে না বলতে। বললে একেবারে শেষ করে দেওয়া হবে। তাই তো হারাধন? তাই না...!

হারাধন মাথা নিচু করে থাকে। হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে।

শ্রাবণী অবাক হয়ে ম্যামের দিকে তাকিয়ে। ম্যামকে বলছে, এই লোকটা যদি সত্যি আমার বাবার খুনি হয়, তা হলে ওঁর নিশ্চিত শাস্তি দাবি করি।

আমার ধন্যবাদ তোমাকে জানানো উচিত। আমি সেদিন কিছু না ভেবে দু একটা বিষয় ক্লারিফিকেশনের জন্য তোমাকে ফোন করেছিলাম। তোমার কথাগুলোই আমার সব সমস্যার জট খুলে দিল। আমার কাছে তো তেমন কোনও প্রমাণ ছিল না।

নির্মাল্যর চোখে হাজার প্রশ্ন। তা দেখে ম্যাম বললেন, আরে বাবা, তোর ম্যাম কি অতই বোকা? এটা তোর পরিবারের ব্যাপার মানে আমার পরিবারের ব্যাপার। আমি শ্রাবণী ফোন করি। ও সদ্য বাবাকে হারিয়েছে। আমারও একটি মেয়ে আছে। সেও তাঁর বাবাকে হারিয়েছে। আমি কষ্টটা বুঝি। সেখান থেকেই জানতে পারলাম, ওর বর দ্রোণ নিয়ে প্রচুর কাজ করে। দ্রোণ বানায়। রাতের দিকে তা পরীক্ষামুলক প্রচুর দ্রোণ চালায়। যে কন্ডোমিনিয়ামে তোর কাকাবাবু থাকতেন, সেখান থেকে আমার বাড়ি আর তোর বোনের বাড়ি তিনটেই একটা ট্রায় অ্যাঙ্গেলের মধ্যে পড়ে। তাই জন্য তিনি যখন দ্রোণ চালান, এইসব খবর যখন আমি জানলাম, কাকতালীয়ভাবে গত তিনদিন রাত ১২ টা ৩৭ মিনিটে একটা দ্রোণ আমার বাড়ির উপর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কাকাবাবু বহুতলের ছাতের দিকে ঘোরাঘুরি করছে। এটা কিন্তু পর পর চারদিনেরই ঘটনা। সময় ১২ টা ৩৭।

আমি অনিদ্রার পেশেন্ট। ফলে...

‘There is no denying that there is evil in this world but the light will always conquer the darkness. The dance between darkness and light will always remain...’

অস্বীকার করার কিছু নেই যে এই পৃথিবীতে মন্দ আছে। অন্ধকার আছে। কিন্তু আলো সর্বদা অন্ধকারকে জয় করবে। অন্ধকার এবং আলোর মধ্যে নাচ সবসময়ই থাকবে...।

ম্যাম সুবীরবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, পুলিশের কাজ এটা। পরে বুঝলাম না, তা মোটেই পুলিশের কাজ নয়। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট সুবীরবাবু। অ্যারোনেটিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং-এ খুব কৃতি। বাকি বিষয় জানতে সাহায্য করলেন, আমাদের সবার প্রিয়, সুবিমল বাবু। ওঁকে ডিটেল দেওয়ার তিনদিনের মধ্যে সব খবর বের করে দিলেন। দুঃখের বিষয়, এত ব্রিলিয়ান্ট হয়েও কুসঙ্গে পরে ব্যবসায় কিছুই করতে পারলেন না। প্রচুর ধার। এমন কিছু মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে যে, তারা ক্রমাগত চাপ দিতে শুরু করেছে। ফলে ও যদি এই টাকা না দিতে পারে তাতে সম্মান হানি, সঙ্গে প্রাণের আশংকা। কিন্তু বোকা ছেলেটা এটা বুঝল না, ও যদি নিজে এসে ওর শ্বশুরমশাই, যিনি ওঁকে সন্তানের থেকেও বেশি ভালবাসতেন, তাঁর কাছে বলতেন, তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত কত সহজে। এমন কাজটা আর করতে হত না।

বাকিটা সুবিমল বাবুদের হাতে। ওরাই সব বের করবেন এবার।

সুবিমল বাবু সুবীর রায়চৌধুরীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ইউ আন্ডার অ্যারেস্ট। তদন্তের কারণে আপনাকে আপাতত পুলিশের কাস্টডিতে থাকছে হচ্ছে মিস্টার রায়চৌধুরী।


এর কয়েকদিন পরের এক সন্ধ্যা। কাকাবাবুর শ্রাদ্ধবাসর। বেশ কিছু লোকজন এসেছেন। সব কাজ মিটে যাওয়ার পর শ্রাবণী, নির্মাল্য, সুবিমল বাবু ও মিসেস লাহিড়ী বসে কথা বলছেন। এতদিনে সুবীর সব স্বীকার করে নিয়েছে। ও জানিয়েছে, কীভাবে পুরো জিনিসটা হ্যান্দেল করেছে। সবিমলবাবু, আপনি এবার বলুন। মিসেস লাহিড়ী বললেন।

সুবিমল বাবু বললেন, মিসেস লাহিড়ী না থাকলে, আমরা এটা ভাবতেই পারতাম না, যে এমন ঘটনাও কেউ ঘটাতে পারে। দ্রোণের ব্যাপারটা জানালেন মিসেস লাহিড়ী। আমরাও সুবীর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ছেলেটি খুব সুবিধের নয়। প্রচুর ক্রাইম কেসের অভিযুক্ত উনি। মিসেস লাহিড়ীর তথ্য অনুযায়ী, ৬,৭,৮,৯ এই কদিন ১২ টা ১০ থেকে ১২ টা ৫৫ পর্যন্ত একটা দ্রোণ ঘুরে বেরিয়েছে। ঠিক ১২ টা ৩৭-এ দ্রোণ কাকাবাবুর বাড়ির মাথায় ঘুরত। সেদিন মিসেস লাহিড়ী নির্মাল্য বাবুর কাকার ঘরে দক্ষিনের জানালার পর্দা সরাতে গিয়ে দেখেন জানালার কাঁচে একটা ফুটো। পর্দায় একটা বড় ফুটো। হারাধন বাবুর সঙ্গে কথা বলে মিসেস লাহিড়ী জেনেছিলেন নির্মাল্যর কাকার কল্টফোবিকের সমস্যা ছিল। উনি পর্দা বন্ধ করে ঘুমতে পারতেন না। সেই জন্য পর্দা খুলে উনি শুতেন। এটা জানত গুটি কয়েক লোক। মেয়ে জামাই জানত। জানত হারাধন। দ্রোণের মাধ্যমে পিন লাগিয়ে তাতে একটা স্ট্রেস লেস পয়জন, নাম স্ট্রেস লেস প, খুব শক্তিশালী প্রযুক্তির মাধ্যমে এটা করা যায়। খুব সুহজ নয়। খুব স্বাভাবিক নয়। লাখে একটা হয়। পয়েন্ট থ্রি মিলিমিটার ছিদ্র অত্যন্ত সুচতুরভাবে হার্টের কাছে নিয়ে গিয়ে সেখানে ফোটানো কম কঠিন ছিল না। অসম্ভব দক্ষতার প্রয়োজন। ব্লাড ভেসেল কে কন্টামিনেট করে ব্রেনে অ্যাটাক করিয়েছে, তারপর ব্রেনকে ডেথ করিয়েছে।

সুবিমল বাবু বলে চলেছেন। শ্রাবনী আর কিছু শুনতে পারছে না। একটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দক্ষিনের জানলা দিয়ে যুতদূর চোখ যায়... দূরে... বহুদূরে...।

শূন্য গলায় কে যেন গাইছে।

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।

তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে...


নির্বাসন

সেবন্তী ঘোষ

(ক)

এই পুষ্পবৃক্ষের নাম জানে না বালক। বনের ভিতর এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে সে এই প্রাচীন বৃক্ষটিকে আবিষ্কার করেছিল। এমনই চওড়া গাছ যে অর্ধেক মাত্র বেড় দিতে পেরেছিল। গাছ না আস্ত একটা গ্রাম? রাজ্যের লতাপাতা পরগাছা পোকামাকড় ছোটখাটো বৃক্ষজীবী প্রাণীর বাস সেখানে। সেই বৃক্ষটির শ্যাওলা আচ্ছাদিত কাণ্ডটি জড়িয়ে তার হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করেছিল।

কিশোরীটি এসে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। তার চেয়ে বয়সে বড় বলে কিশোরীর গায়ে জোর বেশি। বালকটি কৈশোরের মুখে কিন্তু কেন জানি মেয়েটিকে দেখলেই ভয় পায়। মেয়েটির এলোমেলো চুলের গোছা সাপের ফণার মতো ঝুঁটি তুলে ছোবল মারতে চায় যেন।

বনের প্রান্তে দলবেঁধে বাস করা মেয়েটির পরিবার-গোষ্ঠীকে গ্রামের লোকেরা এড়িয়ে চলে। চোর বলে। অসাবধানে থাকলে ওরা নাকি ছেলেপুলে ফুঁসলে নিয়ে যায়! এরাই প্রথম এমন দল যারা বাইরের এলাকা থেকে এখানে স্থায়ীভাবে থেকে গেছে। অবশ্য এদের কেউ কেউ অন্য কোথাও চলে না গেলেও মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক উধাও হয়ে যায়। আবার ফিরেও আসে। গ্রামের লোকেরা বলে, ছেলে চুরি করে বাইরে বেচে আসে। যতই দূরে থাকতে বলা হোক বনের উপর নির্ভরশীল বনচারিণী আর প্রকৃতি লোলুপ কৌতূহলী বালকের ঘনঘন সাক্ষাৎ হতে দেরি হয় না।

কিশোরীটি তাকে ফেলে দিয়ে আবার সেই শষ্পশয্যা থেকে এক টানে টেনে তোলে। বলে, বলেছি না এভাবে যেখানে সেখানে ঘুরিস না? চিনিস না কিছু-

সে বালকটির হাত ধরে টানতে টানতে অন্যহাতে লতাগুল্ম সরিয়ে ফেরার পথ ধরে।

(খ)

মাথার উপর জলে ভেজা কলাপাতা রঙের একদল টিয়া খুব কাছ দিয়ে ডানা ঝাপটে যায়। বালক মাথা ঘুরিয়ে দেখার জন্য থামলে তার গাল নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে কিশোরী বলে, ভারী বোকা তুই! কাজও নেই তোর, বুদ্ধিও নেই! নাহলে এই জঙ্গলে কেউ একা ঘোরে?

বালক বলে, তুই জীবজন্তুকে ভয় পাস? তুই? নিজে যে দিনরাত পাখির মতো ডালে মাটিতে চরে বেড়াস তোরও বিপদ হতে পারে।

কিশোরী বলে, দূর জীবজন্তুর পরোয়া কে করে? ওদের ক্ষতি না-করলে ওরাও করে না। জানোয়ার কে ভয় পেতে কে বলল? তুই যে-কোনও গাছের ফল খাস, বাছবিচার করিস না, কত অজানা ফল থাকে, হুঁশ জ্ঞান আছে কি তোর? ওই বড় গাছটার পিছনে জলাশয়। ওখানে জন্তুরা জল খেতে, স্নান করতে আসে। পরিরাও ওদের সঙ্গে খেলতে আসে। সেসব দেখতে নেই আমাদের।

ফল খেলে কী হয়? দেখলেই-বা কী? বালক জোরের সঙ্গে বলে।

কিশোরী বলে, আমার দিদা বলে না-খাওয়াই ভালো।

বালকের হাতে-পায়ে কাঁটা গাছের ঝাপট লাগে। কিশোরীটির হাত ছাড়িয়ে সেই কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, না-খাওয়াই ভালো মানে খাওয়াও যায়, তাই না?

কিশোরী বলে, দিদা বলে, মানুষ মরে ওই কথা না-শুনেই- কথা শোনা ভালো। বুঝলি? হাঁদারাম!

বালকটি হাসে। কিশোরীটিও। কেন তা ওরাই জানে।

(গ)

বালক ও কিশোরী অপেক্ষাকৃত অগভীর চালতা বনের নীচে বড় বড় পাতা কুড়িয়ে তার উপর রসালো কষমাখা চালতার পাপড়ি খুলে খুলে রাখে। পাকা চালতার গন্ধে ম-ম করে চারপাশ। মসৃণ একটা ধারালো পাথর দিয়ে সেগুলি থেঁতো করে কিশোরী। বালকটির জঙ্গলের পাকা ফল বেশি পছন্দ হলেও পাকা চালতার গন্ধে জিভে জল আসা থামাতে পারে না।জল টানে মুখে। কিশোরীর পরিশ্রম ক্লান্ত কপালে স্বেদবিন্দু শালুক পাতার উপর জলের মতো টলটল করে। হাত জোড়া থাকায় তার কোমরে গোঁজা রেশমি রুমাল টেনে বার করার জন্য সে বালকের দিকে ইঙ্গিত করে। তার দিদা শিখিয়েছে, তাই বনের বিষটক তেঁতুল কদবেল জম্বুরা মাখার সময় কিশোরী কথা বলে না। তার ঊর্ধাঙ্গের আর নিম্নাঙ্গের বিচ্ছিন্ন পোশাকের মাঝে অনেকটা জায়গা অনাবৃত। বালক সেই কোমরে গোঁজা রুমাল টেনে বার করার সময় নদীর জলের মতো ঈষদুষ্ণ ত্বকের স্পর্শ পায়। ভারী ভালো লাগে তার। মনে হয় আরেকবার হাত বাড়ায়। অবাক হয়ে দেখে থেঁতো করা থামিয়ে কিশোরী বড় বড় চোখে তাকে দেখছে।

বালকটি তাড়াতাড়ি সেই রুমালের গিঁট খুলে পাথুরে নুনের টুকরো বার করে। বলে, জলদি কর। যে-কোনও সময় ওই ওইকিয়া, একলা হাতি বা ওর ছেড়ে আসা দল চলে আসবে। বাবা বলে, এই চালতা বন ওদের। আমরা চুরি করছি।

কিশোরী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। পাতার উপর রাখা চালতা মাখায় পরম মমতায় নুন মেশায়। মুখে দেয়। আরামের শব্দ তোলে।

বালক ভয় আর লোভের মাঝে দোলে। লোভ জেতে। বিনা বাক্যব্যয়ে চালতা মাখা মুখে ঢোকায়। চোখ ছোট হয়ে আসে টক-মিষ্টি স্বাদে। খানিক চোখ বুজে থাকে।

কিশোরীটি তার কষমাখা দুই হাতের পাতা দেখিয়ে পুনরায় রুমালে রাখা পাথুরে টুকরো গিঁট থেকে তার কোমরে গুঁজে দিতে বলে। বালকটির বুক ঢিপ ঢিপ করে। সযত্নে সে নুনের টুকরোগুলো রুমালে বেঁধে কিশোরীটির কোমরে গুঁজতে যায়। কিশোরীটি উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। তাকে লতার মতো বেড় দিয়ে ধরে বালক। ক্ষীণকায় তখনও অপরিণত শরীরের কিশোরীটিকে ক্ষণিকের জন্য আদি বৃক্ষ মাতার মতো ভারী ও পূর্ণ মনে হয় তার। সে সরে না একটুও। সমস্ত জঙ্গল কাঁপিয়ে বৃংহণ শোনা যায় অকস্মাৎ। সম্বিৎ ফিরে আসতেই একে অপরের হাত ধরে দৌড় লাগায়।

বালকের এক হাতে তখন নুনে ভরা রুমাল, অন্যহাতে চালতার কষে ভরা কিশোরীর হাত ঘাম ও ঘাস কুচিতে মাখামাখি।

(ঘ)

প্রায় গ্রীষ্ম বর্ষা শীত পেরিয়ে বসন্ত আসবার সময়। আজকের দিনটা অন্যরকম। মেঘ ও ছায়ায় মেশামেশি। জঙ্গলের দিক থেকে উড়ে-আসা ফুলের তীব্র মদির গন্ধ মাঝেমধ্যেই নাকে ঝাপটা মারে। খসে পড়া পাতার সরসর শব্দে বাঁশবনে যেন উৎসব শুরু হয়েছে। সদ্য কিশোর ছেলেটি গৃহকর্ম ও পাঠে ব্যস্ত থাকে রোজ। আজ সে আনমনা। পাঠ মানে চাষের মাটিতে হাত দিয়ে অম্লভাব চিনতে শেখা, বীজ ধান সংরক্ষণ, ক্ষেতের উপকারী ও অপকারী কীট পোকা চেনা, রাত জেগে খেত তছনছ করা খরগোশ, শুয়োর নজরে রাখা- এইসব। পরিবারে তার দায়িত্ব বাড়ছে। বাবা আর মামাদের সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে হয়। তার মধ্যেও জঙ্গলের দিকে তার ভয় ও আকর্ষণের টান জেগে থাকে। লোভ দমনের জন্য গোঁজ হয়ে কাজ করে। তবু সে পুরোপুরি সফল হয় না। এই বয়সে ছেলেরা দ্রুত হাত-পা ছড়ায়। নিজের বদলে যাওয়া পরিবর্তন কীভাবে আয়ত্তে আনবে নিজেই বোঝে না। কাজ খানিক হালকা হতেই মনের সঙ্গে লড়াই করে আজ হেরে গিয়ে টুপ করে উঠে দৌড় দেয়।

(ঙ)

পুষ্ট পুষ্পময় বৃক্ষের নীচে শুয়ে থাকে কিশোরীটি। সে এখন যৌবনের দোড়গোড়ায়। অদূরে বৃষ্টির জলে সারাবছর পরিপূর্ণ এক জলাশয় জঙ্গলের প্রাণীদের আদর্শ বিহার স্থান। ক্রীড়া ও জল পানের হুল্লোড়ের মাঝেও বেঁকে যাওয়া জলাশয়ের কিনার ঘেঁষে কীভাবে যেন অনেকটা অংশে পদ্মলতা সপুষ্পে চতুর্দিক আমোদিত করে রেখেছে। বাতাসে এদিকেই, ফলে সেই মৃদু সুঘ্রাণ জোরালো হয়ে নাকে এসে ধাক্কা মারে। মাথার উপর টুপটাপ শুকনো পাতা ও ফুল খসে পড়ে। এই ফুলের নরম রসালো গন্ধে ঝিম ধরে আসে শরীর। আগে থেকে ভূমিতে পড়ে থাকা শুকনো গোটানো পাতা অতীত শরীরের আত্মার মতো হাওয়ায় ভর দিয়ে হেঁটে চলে যেন।

গৃহকর্মের পরেও কি যেন অধরা থেকে যায় মেয়েটির। ভূমির নরম আরামদায়ক পত্র শয্যায়ও সে সতর্ক, জাগ্রত। মনে হয় কি যেন হওয়ার ছিল, কি যেন হয়নি এখনও।

মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার উপুড় হল। দু’ভাবে প্রকৃতি দেখতে ভালো লাগে তার। চিৎ হলে জঙ্গলের সবুজ আচ্ছাদন ভেদ করে সুনীল আকাশে ভেসে যাওয়া মাংসাশী পাখি দেখে মনে হয় উপরিতলের সীমানা ছড়ানো ওই নীলিমা কতো সুদুর, কতো আকাঙ্ক্ষিত, কতো অজানা! উপুড় হলে কাঁচা, আধ কাঁচা, শুকনো পাতা ডাল শ্যাওলা পরজীবী বুনোলতার বনের পথে আগ্রাসী গমন, লাল যোদ্ধা পিঁপড়ের দল, চিত্র-বিচিত্র পোকা, হলুদ সবুজ কমলা রঙা ব্যাঙ, গিরগিটি, সোনা গোসাপ, অরণ্যের ছোটখাটো দৌড়বাজ জন্তু- মনে হয় এই সমগ্র ভূমিতল তার করায়ত্ত, তার আত্মীয়।

উপুড় হতেই আজ মেয়েটি দেখে পদ্মবনের ধার ঘেঁষে ছেলেটি দাঁড়িয়ে।

মেয়েটি হাওয়ার গতিতে উড়ে যায় সেখানে। কিশোর এখন মেয়েটির মাথায় মাথায়। মেয়েটি হাত ধরে টেনে আনে ছেলেটিকে। বলে, শুঁয়োপোকা ভরা ওই পদ্মবন। পশুরা জানে কোথায় পায়ের চাপ পড়বে। তুই তো জানিস না, ভেঙে একেবারে জলে পড়ে যাবি। জায়গায় জায়গায় হাতি ডুবে যায় এমন পাঁক-

কিশোরটি দু’চোখ ভরা অভিমান।

বলে, তোর কি? অ্যাদ্দিন খেয়াল ছিল না? দেখেও না-দেখে চলে যেতিস?

বাইরের ফাঁকা অঞ্চলের তাপ জঙ্গলে কিঞ্চিৎ ম্লান কিন্তু গুমোট ভাব চাপ বেঁধে আছে। সামনে পদ্মপাতায় ছেয়ে থাকা জল যাকে অনায়াসে স্থল বলে ভুল হয়।

আস্ত একটা গ্রামের মতো সেই আদি বৃক্ষমাতার ছায়া, স্থল ভূমির মতো সেই প্রকৃতি সৃষ্ট পুষ্করিণীতে আরও ভ্রম উৎপাদন করে যেন।

মেয়েটি বলে, ইস! আমার জন্য জঙ্গলে আসিস যেন তুই? নিজে চিনিস তো খেতের ওই কচু! শুয়োরে খায় ওসব! আমি চেনাই বলে বনের এতো ফলপাকুড় খেতে পাস!

সদ্য কৈশোরের মুখ ম্লান হয়ে আসে।

বনদেবীর মতো মেয়েটির মুখে তখন করুণা। বলে, লোভী কোথাকার! পদ্মের বীজ খাবি বলে তো জলে নামতে চাস? চল তোকে অন্য এক ফল খাওয়াচ্ছি।

কিশোরীর ক্ষণকাল পূর্বের অভিমানহত মুখ মুহূর্তে সন্দিগ্ধ। বলে, অজানা ফল খাওয়া বারণ মা’র নিষেধ। তুইও তো না-করিস। মেয়েটির উড়ন্ত ফণার মতো চুল ঘামে ভিজে চকচক করে। সারা মুখ, ঘাড়ে, বসনে, কুচি ঘাস, পচাও শুকনো ফুল পাতা। লালচে থেঁতলানো ফুলের পাপড়ি তার সারা গা থেকে নেশার বাস ছড়াচ্ছে। বলে, অতো ভয় তো আমার সঙ্গে আসিস না।

মেয়েটি রওনা দেয়।

কিশোর আর আগের মতো নিঃসংকোচে মেয়েটির হাত ধরতে পারে না। পিছনে পিছনে হাঁটে। পুনর্বার তারা সেই প্রাচীন অথচ ফুল ফলে ভরা চিরযৌবনা নারীর মতো বৃক্ষমাতার নীচে পৌঁছয়।

মেয়েটি উপুড় হয়ে লালচে ফুলে ভরা মাটিতে শুয়ে পড়ে। কিশোর কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। একলহমার জন্য মায়ের সতর্কবাণী মনে পড়ে যায়। অজানা ফল খেলে নাকি মেয়েদের দিকে দেখার দৃষ্টি বদলে যায়!

মেয়েটি হ্যাঁচকা টান মারে। কিশোর পরমানন্দে সেই পুষ্পশয্যায় আছড়ে পড়ে। লালচে ফুলের পাপড়ি চিবোয় মেয়েটি। কিশোরের মুখে ঠুসে দেয়।

কিশোর ভালো করে দেখে নাক সিটকে বলে, এত ঘরের গাই খায়! দুধ দেয় বেশি- মেয়েটি বলে, এই ফুল বনের সব জন্তু খায়। হরিণ ভালুক হাতি এমনকী শুঁয়োপোকাও। খায় আর টলমল করে। খা না। খেয়ে দেখ।

কিশোর এবারে সন্দেহের সঙ্গে চিবুতে চিবুতে বলে, কেমন মজে আসা গন্ধ! তোরা তো চোর। জানুয়ারির খাবার অবধি চুরি করিস! মা দিদি বলে-

মেয়েটির ঠোঁট চাঁদের ফলার মতো বেঁকে যায়। বলে, বেশ করব নেবো। আমাদের যা প্রয়োজন আমরা সেটা নিয়ে নিই। বাঁচতে গেলে যতটুকু দরকার। কমও না, বেশিও না। কিশোর নীরবে বলে, ঠিক এই বনের বাইরে সব মিথ্যুক। হিংসুটে- মেয়েটির ওষ্ঠ ফুলের মাংসল রসে ভেজা টসটসে। চোখ বুজে আসে আরামে। এক প্রস্ফুটিত ফুলের ব্যবধানে থাকা কিশোরের নাকের নীচে গোঁফের রেখা যেন চিতি সাপ। ততক্ষণে দুপুরের ভোঁ রোদ নিবিড়ভাবে উষ্ণ করে তুলেছে ছায়াচ্ছন্নতাকে। কিশোর তার আধ চিবোনো ফুল মেয়েটির মুখে গুঁজে দেয়। উভয় উভয়ের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। ক্রমে সেই চুম্বন দরজা খুলে দেয় এক অজানা খেলাঘরের। সাক্ষী থাকে মস্ত প্রাচীন বৃক্ষ মাতা আর অনবধানে বাঁকের মুখে গড়ে ওঠা মধু গন্ধে ভরা পদ্মবন।

(চ)

গ্রামের পাঁচ মাথার কাছে দু’জনে দু’জনের হাত দৃঢ় মুষ্টি চেপে বলে, কেউ কাউকে খাওয়াইনি, দু’জনেই একসঙ্গে সেই ফুল খেয়েছিলাম। দু’জনেই যেন একসঙ্গে এ নির্বাসন উপভোগ করি। উভয়ের মাথা কামিয়ে চুনকালি দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিলে দু’জনে উন্নত শিরে সেই গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে যা কখনওই মানুষের চেয়ে ভয়াল নয়।


হলুদ পদ্ম

অদিতি বসুরায়

হলুদ রঙের পদ্মফুলের কথা আমি প্রথম জানতে পারি, প্রণবকাকার কাছ থেকে। আমাদের আধা-শহুরে টাউনে হাতেগোনা লোক বেড়াতে যেত তখন। আমাদের মতো নিম্ন মধবিত্তদের দৌড় ছিল তারাপীঠ, দিঘা খুব বেশি হলে পুরী। প্রণবকাকা যেত লাদাখ, ধর্মশালা, উটি, কিন্নর , আরও কত দূরের জায়গায়। বস্তুত প্রণবকাকার নেশা ছিল ঘুরে বেড়ানো। বিড়ি,চা, সিগারেট, মদ – কিছুই ছুঁতো না। ইস্কুলের মাস্টারমশাই ছিল। একা থাকতো। নিজেই রান্না করে খেত। বিয়ে করেনি । মা বলতো, প্রণবকাকা নাকি তার মাসতুতো বোনকে ভালবেসেছিল কলেজে পড়ার সময়। জানতে পেরে, মাসি বাড়ি বয়ে এসে খুব গালিগালাজ করে যাওয়ায় গ্লানিতে প্রণবকাকার মা আত্মহত্যা করে। তারপর থেকেই প্রণবকাকার বাইরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ইস্কুলে পড়াতো বলে ছুটি-ছাটাও পেত। বিশেষ করে গরমের ছুটি এবং পুজোর ছুটিতে। প্রতিবার প্রণবকাকা বাইরে থেকে ফিরে এলে, আমাদের বাড়িতে গল্পের আসর বসতো। অধিকাংশ সময়ে সেটা হত, ইস্কুল খোলার আগের দিন। প্রণবকাকা এসেই হইচই শুরু করে দিত – ‘বউঠান, আজ রান্নাবান্না রাখুন। সুবীরকে বলে দিন, আজ মোগলাই পরোঠা রাতে। আমি অর্ডার দিয়ে এসেছি বুবু কেবিনে।’ আমাদের মফঃস্বলে কোন সেলেব্রেশনই সম্পূর্ণ হতো না মোগলাই পরোঠা ছাড়া। তখন এতো বিরিয়ানির চল ছিল না। রাতের খাবারের বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়ায় মা নিশ্চিন্ত হত। আমাদের বাড়িতে অসময়ে আসা অতিথিকে খাওয়ার পাতে কী দিয়ে বসাবেন – এই ছিল আমার মায়ের অন্যতম টেনশনের কারণ। মায়ের পর্ব মিটতেই আমার ডাক পড়তো – ‘ অ্যাই, টুকি, এখানে এসে বস। বই –পত্তর বন্ধ করে দে। মানালিতে এবার যা হল – উফফ- ভাবলে এখনও গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে’। আমিও ওমনি লাফিয়ে বই বাক্সে তুলে দিয়ে এসে বসতাম বাইরের ঘরের চৌকিতে। মা চা বসাতো। বাবাও এসে দ্রুত পোশাক পাল্টে সামনের ঘরে চা নিয়ে এসে বসত। মা সর্ষের তেল, পেঁয়াজকুচি, চানাচুর দিয়ে মুড়ি মেখে নিয়ে ঢুকলে, প্রণবকাকা বলে উঠত – ‘ বউঠান, কাঁচালঙ্কা দাও একটা।’ জমিয়ে গল্প শুনতাম আমরা। মানালিতে কীভাবে দুই কুলির মারামারির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল কিংবা রাজস্থানে ডাকু মাধো সিংয়ের খপ্পর থেকে কেমন করে রেহাই পেল – এইসব আমরা তিন ছাপোষা প্রাণী অবাক হয়ে শুনতাম। কোথায় বালির ওপর উট চলা রাজস্থান – কোথায়-বা হিমাচলের চুড়োর মানালি !

চিকু আর মুনুকে তোমরা অনেকেই চেনো। ফেসবুকে মাঝে মাঝেই ওদের নানা কাণ্ড-কারখানা আমি লিখি। ওরা যমজ। তবে মুনু ভাবে ও বড়, আবার চিকু ভাবে সে বড়। আর আমি ভাবি ওরা দুজনেই আমার থেকে বুদ্ধিতে বড়। ওদের কাছে আমি সব সময় হেরে যাই। আমি ওদের বোকা বাবা। ওরা একমাত্র জব্দ ওদের মায়ের কাছে। (সেটা অবশ্য আমিও।)

চিকু-মুনু আর তাদের বোকা বাবার গল্প এবার একসঙ্গে এল বই হয়ে।

সঙ্গে রইল সেইসব সাংঘাতিক ঘটনার মজার মজার ছবি।

তোমাদের কেমন লাগল জানিও।

যারা নিজের কপিটি নিশ্চিত করতে চান,

তাঁদের জন্য। ( লিমিটেড এডিশন ) চিরঞ্জীৎ দাস


আমার ‘পথের পাঁচালি’র কথা মনে পড়ে যেত বারবার। সেই যেখানে আছে, সান্যাল মশাই তীর্থ করে ফিরে এসে প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালায় গল্প করতে আসছেন – সেই জায়গাটা আমার প্রতিবারই চোখের সামনে ভেসে উঠতো। আর খুব ইচ্ছে হত – এই বাড়ি, চেনা পাড়া, পরিচিত জনপদ ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে যেতে। আর দূর বলতেই যার কথা মনে আসতো সে হল, পাহাড়। আহা – সেই কোন শিশুকাল থেকে পাহাড় আমাকে চুম্বকের মতো টান দিত– একটু বড় হতে, এই পাহাড় যেন হয়ে উঠল এক রহস্যময় পুরুষ, যার প্রতিটি বাঁকে নানা অজানা রং। অবশ্য এই ঘোর থাকেনি খুব বেশিদিন। আমি তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। ভূগোলে অনার্স। প্রণবকাকা খুব উৎসাহ দিয়েছিল ভূগোল পড়ার জন্যে। আমার তখন উত্তরমেরু থেকে দক্ষিণমেরুর স্বপ্ন – বাবা, মাও খুব আগ্রহ নিয়ে আমার স্বপ্নের সঙ্গে নিজেদের যোগ করেছিল। দিব্যি চলছিল আমাদের ছোট্ট ইউনিট। তবে সুখেরও এক্সপায়ারি ডেট থাকে!

বাবা এক হেমন্তের রাতে বাড়ি ফিরছিল বাজার করে। দুই হাতে দুটো বড় বড় থলি। তাতে সদ্য ওঠা ফুলকপি, গাজর, কড়াইশুঁটি, নতুন আলু এবং দেশি মুরগি। বাবার তাড়া ছিল– অতো ভারী জিনিস নিয়ে হাঁটা– এর মধ্যেই কখন যে শীতঘুমের অভিসারী সাপের গায়ে পা দিয়ে ফেলেছে, বুঝতেও পারেনি। সাপও জমে থাকা বিষ উজাড় করে ঘুমাতে ছুটেছে। তারও সময় ছিল না। ফলে বাবা থলি ছুড়ে ফেলে বাড়িতে ঢুকে চিৎকার করে মাকে যখন ডেকেছে , ‘শান্তি, কোথায় গেলে? শিগগিরি এসো। আমাকে বোধহয় সাপে কামড় দিয়েছে।’ মা ডিম সেদ্ধ বসিয়েছিল সবে। রাতে ডিমের ঝোল আর রুটি করবে। ঠান্ডা পড়লে আমরা সবাই রাতে রুটি খেতে পছন্দ করতাম। বাবার আর্তনাদ শুনে মা কী মনে করে ডিমের পাত্রটা নামিয়ে রেখে ছুটে গেল। আমি টেলিভিশনের ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল খুলে বসেছিলাম। ছুটলাম আমিও। গিয়ে দেখি, বাবার মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরচ্ছে। মা, বাবার মাথাটা কোলে নিয়ে অবিকল সিনেমার মতো বলে চলেছে, ‘এ আমার কী সর্বনাশ হল? ‘টুকি লোক ডাক।’ মায়ের আঁচল মাটিয়ে লোটাচ্ছে।

বাবার শেষ কাজের আগের দিন, বাবার আপিস থেকে সহকর্মীরা এসে মাকে বাবার প্রভিডেন্ড ফান্ড ইত্যাদি সব বুঝিয়ে দিয়ে যায়। এছাড়াও মোটা টাকার জীবনবিমা ছিল বাবার। অর্থের অসুবিধা আমাদের সেভাবে হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পরের গরমের ছুটিতে, আমি প্রথম হ্লুদ পদ্মের কথা শুনি। প্রণবকাকা সেবার কালিম্পং ছাড়িয়ে আরও উঁচুতে ইচ্ছেগাঁও বলে একটা পাহাড়ি নিরালা গ্রামে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে বনের মধ্যে, একদিন ট্রেক করতে করতে পথ হারিয়ে, প্রায় বারো ঘণ্টা পায়ে হেঁটে একটা আশ্চর্য সুন্দর হ্রদের কাছে পৌঁছয়। সেখানেই দেখে, হ্রদের জলে হলুদ রঙের পদ্মফুল ফুটে আছে। অনেক কষ্টে লোকালয়ে ফিরে এসে, যখন স্থানীয় বাসিন্দাদের ওই ফুলের কথা জানায়, তারা নাকি প্রণবকাকাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে, বাইরে ওই ফুলের কথা, প্রকাশ না-করতে। কারণ, ওই ফুলই নাকি এই পাহাড়ের দেবী। বাইরের লোকের সামনে ওরা দেবীকে আনতে চায় না। তাছাড়া যারাই ওই ফুলকে স্পর্শ করে, তাদের জীবন পালটে যায় বলে, ওদের বিশ্বাস। প্রণবকাকার ক্যামেরায় আমি সেই হলুদ রঙের পদ্মের ছবি দেখতে গিয়ে দেখি, আসলে তা একটা কুঁড়ি । রঙও ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। অনেকদূর থেকে তোলা বলে হয়তো ছবিটি খুব পরিষ্কার হয়নি। সময় দ্রুত ছুটতে লাগল। আমার কলেজ শেষ হল। যাদবপুরে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে করতে একটা প্রেম হল। ভেঙেও গেল। মা অসুস্থ হয়ে পড়াতে, আমার এক দূর-সম্পর্কের বিধবা পিসি এসে মায়ের সঙ্গে থাকতে লাগল। মায়ের খুব দুরারোগ্য কিছু নয়, ডায়াবেটিস দেখা দিয়েছিল। সেই সঙ্গে হাই ব্লাড প্রেসার। প্রণবকাকাও খুব দেখাশোনা করতো আমাদের। আগের মতো বছরে দু’বার আর বেড়াতেও যেত না, নিয়ম করে। পর্যটকের বয়স ও সক্ষমতা কমে গেলে, সে কিন্তু মনে মনে গ্লোব-ট্রটারই রয়ে যায়। তাই প্রণবকাকা যেখানে যত ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশিত হয়, কিনে পড়তে শুরু করে। তিনটি ট্রাভেল ম্যাগাজিনের সাবস্ক্রাইবার হয় এবং আমাকে সেইসব ম্যাগাজিন থেকে ভাল লাগা লেখাগুলো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে থাকে। মা’ও দেখি ধীরে ধীরে ওই সব বইয়ের ভক্ত বনে যাচ্ছে। রিসার্চ শুরু করার পর, আমি আর মায়ের পাঠানো টাকা নিতাম না। বরং মায়ের ওষুধ আরো নানা টুকিটাকি কেনার জন্যে খানিক টাকা পাঠাতে শুরু করলাম মাসে মাসে। এই সময়ই, মা একদিন ফোন করল।

-টুকি, কেমন আছিস?

- ভাল মা। শুধু কাজের বড্ড চাপ। বাড়ি যাব সামনের মাসে। তোমার শরীর কেমন ?

- শোন, পুজোর ছুটিতে আমাকে কালিম্পং নিয়ে যাবি এবার?

আমি বেশ অবাক হলাম। বেড়াতে যাওয়ার গল্প পড়লেও, মা এমনিতে ঘরকুনো। তার ওপর এখন এবার বাংলা টিভি সিরিয়ালের নেশায় পেয়েছে। ফলে বাড়ি ছেড়ে বিশেষ নড়তে চায় না।

-হঠাৎ কালিম্পং?

-যাবি কিনা বল!

-যেতে পারি। তাহলে একটা ডেট জানাও। টিকেট কাটতে হবে তো।

-লক্ষ্মীপুজোর পরের পরের দিন কর। আর শোন, প্রণবদাও আমাদের সঙ্গে যাবেন।

আমি বিস্মিত।

-আচ্ছা, তাই হবে। পিসি যাবে না ?

-না। ঠাকুরঝি, ভাইফোঁটা পর্যন্ত মেয়ের বাড়ি গিয়ে থাকবে।

প্রণবকাকা, মাকে নিয়ে যেদিন এনজেপি স্টেশনে নামলাম, তখনও আমরা কেউই আন্দাজ করতে পারিনি কি ঘটতে যাচ্ছে। এনজেপি থেকে কালিম্পং যেতে সময় লাগে ঘণ্টা তিনেক। ধাবাতে রুটি, ডিমের ভুজিয়া আর কফি খেতে আরও মিনিট কুড়ি বেশি লেগে গেল আমাদের। একটা হোমস্টে-তে থাকার ব্যবস্থা। এনজেপি থেকেই মাকে খুব অন্যমনস্ক লাগছিল। চারটে কথার একটা উত্তর দিচ্ছে– বেশিরভাগটাই হুঁ-হাঁ করে সেরে ফেলছে। মা ঠিক এরকমটা নয় বলেই অবাক লাগছিল। এতদিন পরে বেড়াতে এসে, আমার নিজের এতো ভাল লাগছিল যে মাকে নিয়ে বেশি ভাবতে পারছিলাম না সেদিন। দু’দিন কালিম্পং-এ ঘুরে ফিরে– গাড়ি ঠিক করে ইচ্ছেগাঁও যাত্রা। ওখানে এখন দুটো–তিনটে হোমস্টে হয়েছে। আমিই ইন্টারনেট থেকে বুকিং করে রেখেছিলাম। এই সময়টায় পুজোর ছুটির জন্য টুরিস্টের চাপ থাকে। মুশকিল হল– প্রণবকাকা তো পথ হারিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে হলুদ পদ্মের হ্রদের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল। এবার এসে দেখা গেল– বছর চার-পাঁচের মধ্যে এই গ্রামের ভূগোল খানিক পালটে গেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, প্রণবকাকা বনের দিকে গিয়েও কিছুতেই সেই পথ আর খুঁজে পেল না। মধ্যে থেকে পাহাড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মায়ের জ্বর। সর্দি। প্রণবকাকার গলা ব্যথা। আমার কাশি– সবমিলিয়ে একেবারে ঘরবন্দি দশা! এর মধ্যে একদিন মা, বিকেলে আমাকে বলল, যা তোর প্রণবকাকাকে ডেকে আন। কথা আছে।

দু’বছর হল, আমাদের নতুন বাড়ি এই ইচ্ছেগাঁও-এর প্রান্তে। আমরা একটা হোমস্টে চালাচ্ছি। সবজির খামার করেছে প্রণবকাকা। দিব্যি চলে যাচ্ছে দিন। আমার আর থিসিসটা কমপ্লিট করা হয়নি। তাতে কিছু এসেও যায়নি। এখানে এই উদার আকাশ, নিরালা বনভূমি, সরল প্রতিবেশিদের নিয়ে আমাদের সংসার ভালই চলছে। মা হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেয় অসুস্থ মানুষদের। এইসবের ভেতর, সবচেয়ে ভাল আছে প্রণবকাকা। সারাজীবনে ঘরগেরস্থালির স্বাদ না-পাওয়া মানুষটা, সারাক্ষণ ঘর গোছাচ্ছে- শিলিগুড়ি থেকে সুন্দর নকশাকাটা চাদর কিনে আনছে– ফুলগাছ লাগাচ্ছে- চমৎকার সব ক্রকারিতে আমরা খাওয়াদাওয়া করি– প্রণবকাকা বই দেখে দেখে নানা দেশি-বিদেশি রান্না করে– সবচেয়ে অন্যরকম হয়ে গেছে আমার মা। পা পর্যন্ত ঝুলের গাউন এবং সাদা কার্ডিগান পরা মা যখন মাথায় বাহারি স্কার্ফ বেঁধে, টুরিস্টদের দেখাশোনা করতে ছোটাছুটি করে– আমার বুকের মধ্যেটা উছলে ওঠে আলোর মতো। আর মাঝে মাঝে খুব খুব মনখারাপ হয়ে যায় সেই অকালে চলে যাওয়া মানুষটির কথা ভেবে– যাকে আমি এখানে আসার আগে পর্যন্ত আমার জন্মদাতা বলে জানতাম। মা সেই বিকেলে, প্রণবকাকার সামনে আমাকে বলে দিয়েছিল সব। কীভাবে এক ঝড়ের রাতে প্রণবকাকা ও মায়ের অতর্কিত ভালবাসায় আমি এসে গিয়েছিলাম এবং মায়ের আজীবনের অনুতাপ, বাবাকে ঠকানোর জন্য, এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে মা আর ফিরে যেতে চায়নি বাড়িতে। সব শুনে আমিই প্রস্তাব দি থেকে যাওয়ার। প্রণবকাকা আর মায়ের অপরাধী মুখদু’টিতে হাসি ফুটিয়ে, বাঁচাতে চেয়েছিলাম, কারণ– মুহূর্তের ভুলের জন্যে এরা দু’জনেই সারাজীবন কষ্ট পেয়ে, প্রায়শ্চিত্ত করে ফেলেছে। বাকি জীবনটা অন্তত আনন্দে কাটাক– হলুদ পদ্ম নাকি জীবন পালটে দেয়! তাই আমিও রয়ে গেলাম। ভারী ভালো লাগে দুই বয়স্ক মানুষের খুনসুটি দেখতে!

কাজের ফাঁকে, বনে বনে ঘুরে ট্রেক করি- যদি কখনও সেই অলৌকিক ফুলের দেখা পাই- আমার জীবনটারও একটা বদল দরকার। পরিবর্তনহীন বেঁচে-থাকা আসলে ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ের কাপ- প্রণবকাকা আর মায়ের মতো একটা বদল কতজন আর পায়! এও তো এক ধরনের সৌভাগ্য! দেখা যাক। তবে একটা কথা ঠিক , হলুদ পদ্ম কি করতে পারে জানি না এখনও , সত্যি কিন্তু অনেককিছু বদলে দিতে পারে।

Commentaires


Rojkar Ananya New Logo copy.jpg

Your key stats for the last 30 days

Follow us on

fb png.png

©2023 to Debi Pranam. All Rights Reserved

bottom of page