৩টি জমজমাট গল্প
Updated: Apr 23
সেবন্তী ঘোষ, অদিতি বসুরায়, দেবযানী মুখোপাধ্যায়

রাত বারোটা সাঁইত্রিশ
দেবযানী মুখোপাধ্যায়

খবরটা এসেছিল গতকাল রাতে।
ডিনার সেরে মিসেস লাহিড়ী আর্থার কোনান পড়ছিলেন। এটা ওঁর বরাবরে অভ্যাস। খাওয়ার পর শুতে যাওয়ার আগে টেস্ট বদল হয় মাঝেমাঝে। কিন্তু আগাথা ক্রিস্ট্রি বা আর্থার কোনার ডয়েল ওঁকে বেশি করে টানে। এখন হাতে আর্থার কোনানের লাইট ইন দ্য ডার্কনেস সিক্স চ্যাপ্টার শেষ করে সেভেনে চোখ ফেলেছেন। মোবাইলটা বেজে উঠল। পাশের ঘরে চার্জে বসানো ছিল বলে প্রথম কলটা শুনতে পায়নি। মেয়ে জর্জ মাইকেলের কেয়ারলেস উইস পার শুনছে বেশ মধ্যমগ্রামে। সেকেন্ড কল বাজতে মেয়ে শ্রীতমাই চিৎকার বলল মম, ইয়োর কল...
মিসেস লাহিড়ী শুনতে পেলেন না।
মালতি, মাকে ফোনটা দিয়ে আয় তো! শ্রীতমা বলল।
মালতি ফোন নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। ‘এই নাও, তোমার ফোন!’
ফোনটা ডান হাতে নিয়ে ‘ডিসপ্লে’ তে দেখলেন, কলিং নির্মাল্য! দেওয়াল ঘড়িটায় একবার চোখ ফেললেন। ১২টা ৩৭! ফোনটা রিসিভ করলেন মিসেস লাহিড়ী।
-হ্যাঁ, নির্মাল্য!
-কাকাবাবু নেই। একটু আগে চলে গেলেন।
একটু স্থবির হলেন। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, কখন?
-১২টা ৩৭!
-ওকে। বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিলেন।
মিসেস লাহিড়ী স্তম্ভিত। ফোনটা এল ১২টা ৩৭-এ। আবার, উনি চলে গেলেন ১২ টা ৩৭!
ফোনটা পাশে রেখে আবার চোখটা ডুবে গেল, লাইট ইন দ্য ডার্কনেস-এ। কতকিছু ভাবনা এল মাথায়। পাশের ঘরে জর্জ মাইকেল ততক্ষণে নীরব হয়েছে। ঘরের আলো নেভেনি। তারমানে শ্রীতমা এখনও জেগে আছে। তারমানে এক্ষুনি চরাও হবে মাতৃরুপেণ সংস্থিতা হয়ে। ‘এখনও ঘুমোওনি। তোমার শরীরটা কিন্তু খারাপ করবে মম। তোমাকে কতবার বলেছি না, যেদিন ঘুম থেকে উঠলে সেইদিনই ঘুমোও, পরের দিন নয়।
মিসেস লাহিড়ীকে কোনও শাসনেই বাগে আনা যায় না। তবু মেয়েকে একটু সমঝেই চলেন। এমনিতে মেয়ের কড়া শাসনকে সম্মান জানিয়ে আজকাল একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। কিন্তু শুলে কি হবে? ঘুম আসেনা কিছুতেই। মেডিসিনের ডাক্তার, অভিজিৎ ঘোষ, দুটো বিদেশি ডিগ্রিও আছে, সে বলেছে, ১১টার মধ্যে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পরতে হবে। আলো নিভিয়ে। শোয়ার জন্য নাকি জুতসই পরিবেশ তৈরি করতে হয়।
এটা ডাঃ ঘোষের বাড়াবাড়ি। ১১ টার সময় সব কিছু শেষ করে ঘুমোতে যেতে হবে! বাড়াবাড়ি মনে হলেও ডাঃ ঘোষের অ্যাডভাইস অনুযায়ী ১১ টার মধ্যে ঘুমোতে গেলেও ঘুম চোখে আসেনি। প্রায় সারা রাত প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে থাকেন। ডাক্তারি পরিভাষায় একে ইনসমনিয়া বলে।
ডাক্তার বাবু বলেছেন, বাঁচতে হলে ঘুমোতেই হবে! ঘুমই হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার চাবিকাঠি। ঘুম আপনার মস্তিষ্ক ও শরীরকে দেয় পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম। যার কারণে আপনি কর্মক্ষম থাকতে পারেন। কিন্তু যাদের রয়েছে ইনসমনিয়া সমস্যা? বিশেষ করে অনিদ্রারমতো ভয়াবহ যন্ত্রণা! তারাই বুঝতে পারেন ঘুমের মূল্য! অনেকে আছে যারা রাতের পর রাত শুয়ে জেগে থাকে, ঘুমানোর চেষ্টা করলেও তাদের ঘুম আসে না। ঘুম এলেও ঘুমানোর পর মধ্যরাতে জেগে যায়। চেষ্টার পরও আর ঘুমাতে পারে না। অনেকে এটাকে খুব সাধারণ ব্যাপার মনে করে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু...! মিসেস লাহিড়ী ইদানিং ঘুমোতে পারেন না। আগাথা ক্রিস্টি বা আর্থার কোনান সঙ্গী। এখন যেমন আর্থারের সঙ্গে গল্প চলে। দিন কতক হল, মিসেস লাহিড়ী লক্ষ করছিলেন, ঠিক ১২টা ৩৭-এ একটা অদ্ভুত শব্দ আসে। শব্দটা খুব বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না। ক্রমশ উত্তরে সরে সরে যায়।
উত্তরেই তো থাকেন মিস্টার বোস। থাকেন না। থাকতেন। খবরটা পাওয়ার পর থেকে মিসেস লাহিড়ীর মনটা একটু বিচলিত।
মিসেস লাহিড়ীর সঙ্গে মিস্টার বোসের তেমন সম্পর্ক ছিল না। নির্মাল্যর কাকা বলেই জানতেন। যেহেতু নির্মাল্য ছাত্র, তাই নির্মাল্য কাকাকে নিয়ে এত কথা বলত, যে মিস্টার বোস তার বেশ পরিচিতও হয়ে উঠেছিলেন।
২
আজ সাত সকাল উঠে পড়েছেন মিসেস লাহিড়ী। উত্তরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। চারপাশটা চুপচাপ। একটু বেশি নীরব আজ। কেবলই মিত্রদের বাড়ি থেকে হালকা গানের কলি ভেসে আসছে। ‘নীরব করে দাও হে তোমার...’! রবীন্দ্রনাথের গান।
আষাঢ়ের বাদলদিন। আকাশের মুখ কালো। থমে থমে হয়ে আছে। রাতে খানিক বৃষ্টি ঝরেছে। মিসেস লাহিড়ী গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন। মন খারাপের সকালবেলা। মনে কেবলই নানা ফমুলার অ্যালজেব্রা। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা হবে। মনে হচ্ছে রাতের চেয়েও অন্ধকার। একটা ঠাণ্ডা মতো হালকা হাওয়া। বারান্দার ওই কাঠের চেয়ারটায় বসলেন। মাথায় হালকা চুলে হাতদিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। জগতের সব কিছু থেকে আজ বিচ্ছিন্ন। মালতি চা করে নিয়ে এসেছে। সেদিকেও কোনও খেয়াল নেই মিসেস লাহিড়ীর।
মালতি দুতিন বার ডাকল, দিদি, ও দিদি, চা নাও। আবার মালতি বেশ জোরের সঙ্গে বলতেই, মিসেস লাহিড়ী বিরক্ত হলেন। ওঁর দিকে না তাকিয়েই বললেন, ওখানে রাখ না!
-তোমার কি হয়েছে গো...
মালতি কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই মিসেস লাহিড়ী বললেন, যা তুই এখান থেকে।
মালতি মুখটা কাছুমাচু করে ভিতরে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতেই, মিসেস লাহিড়ী বললেন, মালতি তুই নির্মাল্যর কাকাকে চিনতিস না!
মালতি বাসন পড়ার মতো ঝনঝন শব্দে বলে উঠল, নির্মাল্য দাদাবাবুর কাকা তো! চিনি তো! আমার বোনঝি সুলেখা আছে না গো, সেই তো রান্না করে ওখানে। খুব ভালো লোক শুনেছি দিদি। ওই বাড়িতে তো একাই থাকেন। আর একজন লোক থাকে সব সময়। বউ নেই তো। মারা গেছেন অনেক আগে। এক মেয়ে গো দিদি ওনার। সে তো বিয়ে হয়ে গেছে। জামাই দাদাবাবু খুব ভালো শুনেছি। এখানে মাঝে মাঝেই আসে তো গো। শ্বশুরমশায়ের খুব যত্ন করে। খুব ভালোবাসে। শ্বশুরও খুব ভালবাসে।
মিসেস লাহিড়ী মালতির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তোর বোনঝি সব সময় ওখানে থাকতো?
মালতির চট জলদি উত্তর, না গো দিদি। ওই রান্না করে চলে আসতো। দুবেলার রান্নাই করতো তো! আর যেদিন ওনার মেয়ে জামাই আসতো, সেদিন ওকে রাতের দিকেও যেতে হত।
মিসেস লাহিড়ী জানতে চাইলেন, মেয়ে জামাই প্রায়-ই আসে বুঝি?
না , প্রায় আসে না মেয়ে। মাঝে মাঝে তো আসেই। এক নিঃশ্বাসেই মালতির প্রশ্ন, কি হয়েছে গো দিদি!
নির্মাল্য কাকা মারা গেছে। মিসেস লাহিড়ী ঠাণ্ডা উত্তর।
এত কিছুর মধ্যেও মিসেস লাহিড়ী চারপাশটা কেমন দেখতে চাইছেন। নতুন করে দেখছেন যেন। চা পড়ে আছে। মালতির সেদিকে চোখ গেল। বলল, ও দিদি, চা টা যে ঠাণ্ডা সরবত হয়ে গেল গো। একটু গরম করে নিয়ে আসি।
-যা।
চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে বলে চলেছে, ইস ভালো মানুষ ছিল গো। ভালো মানুষরা পৃথিবীতে থাকে না খুব একটা।
মিসেস লাহিড়ী চিনতেন নির্মাল্যর কাকাকে। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকসে বড় চাকরি করতেন। পাশের একটা বহুতলে একাই থাকতেন। মিসেস লাহিড়ী ভাবছেন একবার যাওয়া উচিত। চটজলদি তৈরি হয়ে মিসেস লাহিড়ী বের হলেন। খুব দূরে তো নয়! নিজেই ড্রাইভ করে গেলেন।
বাড়িতে অনেক লোক। সবাইকে মিসেস লাহিড়ী চেনেন না। মেয়ে জামাই আছে। জামাই সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কথা বলছে। সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। মেয়ে শ্রাবণী পাথরের মতো স্থবির হয়ে বসে। কাল থেকে মুখে এক ফোঁটা জলও পড়েনি। বাড়ির সব সময় থাকা অনেক পুরনো লোক হারাধনদা, বারবার এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর চেষ্টা করছেন, কিছু যদি একটু খাওয়ানো যায়।
নির্মাল্য ওখানে নেই। নির্মাল্যর এইসময় এখানেই তো থাকার কথা।
জামাই সুবীর ব্যানার্জিও খুব মুষড়ে পড়েছেন। তিনিই জানালেন, রাত ১২ টা ৩৭-এ বাবা চলে গেলেন। ডাঃ সরকারকে কল করা হয়েছিল। উনি বললেন হার্ট ফেলিওর। ঘুমের মধ্যেই হয়েছে। না, তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি। ডাঃ সরকার ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। তারপর...
গোটা ব্যাপারটা দেখে শুনে মিসেস লাহিড়ী আরও অস্থির হয়ে উঠলেন। বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়লেন।
এরপর সারাদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। বাড়িতে এসে অনেক কিছু ভেবে চলেছেন। ওনার বারবার মনে হচ্ছে, এর ভিতরে কোথাও একটা অস্বাভাবিক কিছু আছে।
মাথার ভিতরে জটিল অঙ্ক কষেই চলেছেন।
সারাদিন বইতে মুখ গুঁজে ছিলেন। সারাদিন ভালো করে কিছুই খান নি। আর্থার কোনানকে নিয়েই ছিলেন। সারাদিন নির্মাল্যকে ফোন করেননি। নির্মাল্যও না। ও বাড়িতে সহদেব বলছিল, সন্ধ্যেবেলা থেকে নির্মাল্য ও বাড়িতেই ছিলেন। কাকাকে ওষুধ পত্র খাইয়েছেনও নির্মাল্য। রাতে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কাকা প্রায় জোর করেই ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর ১২ টা ৩৭-এ নির্মাল্যই খবর দেচ্ছে, কাকা চলে গেলেন। মিসেস লাহিড়ীর বারবার মনে হচ্ছে, এ কি চলে যাওয়া, না পাঠিয়ে দেওয়া!
আবার এওতো ঠিক। হার্ট অ্যাটাক তো যখন তখন হতে পারে। আবার ভাবছেন, হার্ট ফেলিওরের কিছু সিম্পটম তো থাকবেই। যা দু আড়াই ঘন্টা আগের থেকে বোঝা যাবে। নির্মাল্য ডিনার সেরে বেরিয়েছে রাত ১০টা হবে। মাঝখানে ২ ঘন্টা ৩৭ মিনিট পর, অর্থাৎ ১২ টা ৩৭ মিনিটে কাকার চলে যাওয়ার খবর দিচ্ছে।
৩
মিসেস লাহিড়ীর রাতের ঘুম চলে গেল।
আর্থারের লাইট ইন দ্য ডার্কনেস-এ সেভেন চ্যাপ্টারে চোখ রেখেছেন। মেয়েও আজ খুব একটা মাকে ঘাটায়নি। বুঝতে পারছে মা একটা জটিল আবর্তে আছে। মাকে চেনে তো! এমন পরিস্থিতিতে যতক্ষণ না মায়ের চিন্তার জট খুলছে ততক্ষণ মাকে কিছু বলা যাবে না! মালতিও বোঝে ব্যাপারটা। তবে মিসেস লাহিড়ী ভাবছেন মানে, সমস্যা কোথাও জট পাকিয়েছে। এই জট উনি খুলবেন নি। মিসেস লাহিড়ীকে ছাত্র নির্মাল্যও ভালো করে চেনেন। অসম্ভব জেদি এই ভদ্রমহিলা।
তার বারবার মনে পড়ছে, ওই লাইনগুলো, The darkness isn’t wrong. It’s part of life, a backdrop for the stars at night, the space between what you know. Darkness has a way of reminding you of the light you’ve been given on all those other days. Read these quotes to help you bring darkness to the light, and make it part of the light.
৪
আজকের প্রকৃতি একটু হেসেছে। আষাঢ় গগনে রোদের মেলা। আজও সকালে উঠে মিসেস লাহিড়ী এসে বসেছেন, বাইরে ব্যালকনির ওই কাঠের চেয়ারটিতে। একফালি রোদ এসে লেপটে পড়েছে মিসেস লাহিড়ীর পায়ের কাছে। মালতি কিছুক্ষন আগে চা দিয়ে গেছে। টেমির ফাস্ট ফ্ল্যাশে চুমুক দিতে দিতে দুয়ে দুয়ে চার মেলাচ্ছেন। ফোন করলেন কার্ডিওলজিস্ট অরিন্দম পান্ডেকে। অনেকক্ষন কথা হল। ফোনটা রেখে এক মুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে নিয়েই, ফোন লাগালেন নির্মাল্যকে। নির্মাল্য ধরাতে মিসেস লাহিড়ী বললেন, আমি কি আরেকবার ও বাড়ি যেতে পারি? তুই কি একটু আসবি?
নির্মাল্য মেমকে চেনে। এর আগে কাকতালীয়ভাবে দু দুটো কাজে অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজ করেছে। কিন্তু এখানে মেম আবার নতুন করে কি ঘোঁট পাকাচ্ছেন? কাকার মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু। ওর পিছনে আর কিছুই থাকতে পারে না। মেয়ে মুনিয়া বা ওর বর সুবীরদা যথেষ্ট কেয়ারিং। আর তাছাড়া...
যাইহোক ম্যামের ইন্টিউশনের ওপর বিশ্বাস ও ভরসার পরিচয় পেয়েছে। ফলে খুব স্বাভাবিক লাগছে না ব্যাপারটা নির্মাল্যর। কেঁচো খুঁড়তে দেওয়ার বন্দোবস্ত বানচাল করা উচিত নয় কি! কিন্তু ম্যামের যেতে চাওয়াকে আটকায় কি করে? তাহলে তো সন্দেহের তীরটা আরও প্রকট হতে পারে। যাহোক, ম্যামকে জানাল, ঠিক আছে। আপনি রেডি থাকবেন ম্যাম। আমি ১২টা ৩৭ মিনিটে আপনাকে পিক আপ করব।
ফোনটা রেখে মিসেস লাহিড়ীর মাথায় একটা স্পার্ক খেলে গেল। আরেকটা ১২টা ৩৭। ম্যামের বাড়ি থেকে নির্মাল্যর বাড়ি সাত মিনিট দূরে। ম্যামের বাড়ি থেকে কাকাবাবুর বহুতল বাড়ি ২ মিনিট। ঠিক ১২ টা ৩৭ মিনিটে নির্মাল্য ম্যামকে পিক আপ করে ঠিক টাওয়ারের সামনে গাড়ি পার্ক করে এসে দেখল, ম্যাম কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছেন। এই টাওয়ারের দশ তলাতেই কাকাবাবু থাকেন। কথা শেষ করে নির্মাল্যকে দেখে, ম্যাম বললেন, চল নির্মাল্য।
ওপরে উঠে নির্মাল্য ডোরবেল বাজাল। হারাধনদা দরজা খুলে দিলেন। কেমন যেন বিমর্ষ ভাব হারাধনদার। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। নির্মাল্যকে দেখে একটু চমকেই উঠল। ম্যামকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, আসুন দিদি। ম্যাম ঘরে ঢুকেই এক গ্লাস জল খেতে চাইলেন। চোখের মণি ঘরের চারপাশটায় ঘুরছে। সব যেন এক লহমায় লেন্স বন্দি করতে চান। মেয়ে পাশের ঘরের ছিল। ওখান থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, হারাধনদা, কে এসেছেন গো?
হারাধনের জবাব, নির্মাল্য দাদাবাবু। আর ওই দিদিমণি। পাশের ঘর থেকে মুনিয়া মানে শ্রাবণী এল। ও। বসুন ম্যাম। ম্যাম শ্রাবণী হাত দুটো ধরে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা কি কারও সারা জীবন থাকেন! তোমার হাজবেন্ডকে দেখছি না।
ও একটু বেরিয়েছে। অফিসের কিছু একটা জরুরি কাজে। মুনিয়া বলল।
মিসেস লাহিড়ীর জল খাওয়া হয়ে গেছে। হাতে ফাঁকা গ্লাসটা ধরে আছেন। শ্রাবনী হারাধনদাকে, ডেকে বললেন, হারাধনদা গ্লাসটা নিয়ে যাও।
হারাধন এল। দিন দিদিমণি।
গ্লাসটা বাড়িয়ে দিতে দিতে মিসেস লাহিড়ী জিজ্ঞাসা করলেন, বাবু কখন শুয়ে পরতেন?
হারাধনদা বলল, ঠিক কখন শুয়ে পরতেন তা তো বলতি পারবো নি। এই দিন কতক ধইরে আমি সাড়ে আটটায় সব খাবার টাবার গুছিয়ে বাড়ি চইলে যেতাম। আমার ইস্তিরির স্টোক হওয়ার পর থেইকে। বাবুই জোর করে আমায় পাঠাই দিতেন। কি ভালো মানুষ ছিল গো দিদিমণি! আমি থাকতে চাইলে বাবু বলতেন, হারাধন তুমি বাড়ি যাও। অসুবিধে কিছু লাগলে নির্মাল্য তো আছেই। তো আমি চলে যেতাম। বাবু রাতে খেইয়ে, বই পইড়ে তবে ঘুমোতে যেতেন। মেসেস লাহিড়ী শুনছেন। আর ঘন ঘন মাথায় হাত দিচ্ছেন। নির্মাল্য মিসেস লাহিড়ীর এই মুদ্রা গুলো চেনে। তারমানে ম্যাম মনে মনে দাবার ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। কিছু একটা সমাধান তো বের করবেনই। নির্মাল্য ভাবছে সন্দেহের তালিকায় সে নেই তো!
ভাবতে ভাবতেই নির্মাল্যর দিকে তাকালেন ম্যাম। বললেন, নির্মাল্য তো সেদিন দশটা, সাড়ে দশটা পর্যন্ত ছিলে কাকাবাবুর কাছে?
হ্যাঁ। তারপর আমি...
বলার আগেই মিসেস লাহিড়ী বললেন, সেই রাতে তো, কাকাবাবু চলে গেলেন।
শ্রাবনীর দিকে ঘুরে মিসেস লাহিড়ী প্রশ্ন করলেন, তুমি সেদিন বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলে?
-হ্যাঁ। বলেছিলাম। তার সাড়ে ৯ টায়। বাবাকে বললাম তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।
-তোমার হাজবেন্ড...
-আমাকে বাবা চিরকাল ছোট হিসেবেই দেখে গেলেন। কখনও কোনও ব্যাপারে ভরসা করতে পারতেন না। বিষয় আসয়ের ব্যাপারে বলতেন, যতদিন আমি আছি, তোর সম্পত্তি সামলাচ্ছি। আমি চোখ বুঝলে সুবীরকেই সব দেখতে হবে। তুই এসব সামলাতে পারবি না। আমার হাজবেন্ড বলত, আমি আবার কেন বাবা। আমি হার্ডখোর প্রযুক্তির লোক। আমার পক্ষে কি এসব সামলানো সম্ভব? এর মাঝে একদিন আমাকে আর ওকে ডাকলেন। নির্মাল্য দাদাভাইও ছিল। বাবা বললেন, আমার মৃত্যুর পর তোর এই বিষয় আসয় সুবীরের পক্ষে দেখভাল করা সত্যি সম্ভব হবে না। ও একজন স্কলার মানুষ। কত বড় বড় কাজ করছে। এইসব ঝামেলা পোহাতে ওর আসল কাজগুলোই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই ভাবছি, নির্মাল্য দায়িত্ব দিয়ে যাব। ও তোকে ভালো করে গাইড করতে পারবে। সুবীর লাফিয়ে উঠেছিল। খুব ভালো প্রস্তাব বাবা। এইসব বিষয় আশয় টাকা পয়সা, সামলানো আমার কাজ নয় বাবা। আপনি যে কতটা আমাকে ভার মুক্ত করলেন। আমি বলেছিলাম, আঃ, আমি বুঝতে পারছি না, এখনি এসব কথা বলার মানে কি? সে পরে দেখা যাবে এখন।
বাবা বলতেন, না রে মা! আগের কাজ আগে করে ফেলতে হয়। নাহলে কাজটাই বাকি থেকে যায়। ইচ্ছেটাও পূরণ হয় না। আর সুরক্ষারও অভাব থেকে যায়। আমি সহদেবকে ফোন করেছি। ও বাইরে আছে। ফিরে এসে সব কিছু আইনানুগ করে দেবে।
মিসেস লাহিড়ী জানতে চাইলেন, সহদেব কে?
নির্মাল্য বলল, ব্যারেস্টার আংকেল।
মিসেস লাহিড়ী বললেন, মানে হাইকোর্টের ব্যারেস্টার সহদেব মিত্র? তো সেই মর্মে কি উইল হল?
শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, না। তার আগেই তো হঠাই চলে গেলেন। আমি যখন রাতে খবর পেলাম, তখন তো আমি বাড়িতে একা।
মিসেস লাহিড়ী জিজ্ঞাসা করলেন, কেন সুবীরবাবু?
-না। ওতো অফিসের কারণে অনেক রাতে রাতে বাড়ি ফেরে। কখনও কখনও দুটো, তিনটে বেজে যায়।
-কে খবর দিল? মিসেস লাহিড়ী জানতে চাইলেন।
-দাদাভাই।
নির্মাল্যর দিকে তাকিয়ে মিসেস লাহিড়ী বললেন, আমিও খবর পেয়েছি নির্মাল্যর কাছ থেকেই। আচ্ছা, নির্মাল্য তুমি কী করে খবর পেলে?
নির্মাল্য বলল, হারাধনদা। হারাধনদাই খবরটা দিয়েছেন।
মিসেস লাহিড়ী অদ্ভুত সুরে বললেন, হারাধনদা তো বাড়ি চলে যান সাড়ে আটটায়?
মিসেস লাহিড়ী লক্ষ করলেন, হারাধন এই ঘরে না ঢুকে দরজার ফাঁকে কান দিয়ে আছে। কাঁচুমাচু মুখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে।
নির্মাল্য বলল, না মানে সেদিন হারাধনদা এ বাড়িতেই ছিল।
মিসেস লাহিড়ী নির্মাল্যকে বলল, একবার হারাধনদাকে ডেকে দিতে।
নির্মাল্যর এক ডাকেই হারাধনদা এসে হাজির। যেন একেবারে প্রস্তুত। ও জানতো, এখুনি ওকে ডাকা হবে।
মিসেস লাহিড়ী হারাধনদাকে বললেন, চল তো হারাধনদা দাদাবাবুর ঘরটা একটু দেখে আসি।
ঘরে ঢুকে আবেগ সামলাতে পারলেন না নির্মাল্য। কাকাবাবুর বিছানাটা দেখে চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে লাগল।
শ্রাবনী সেদিনের পর থেকে আর এ ঘরে ঢোকেনি।
বাবাকে হারিয়েছে নির্মাল্য অনেকদিন আগেই। এবার কাকাবাবুও চলে গেলেন। নির্মাল্য একা হয়ে গেলেন। বিয়ে থা হয়নি। ফলে আর কিসের পিছুটান। এখন এই বোনই বাঁচার আশ্রয়। মাও তো ফাঁকি দিয়ে কবেই চলে গেলেন।
ঘরের চারপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ ম্যাম বললেন, হারাধনদা, ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে পর্দাগুলো টেনে দাও।
আজ্ঞা মতো হারাধনদা তাই করলেন।
নির্মাল্য বুঝতে পারল না ম্যাম এগজাকলি কী করতে চাইছেন। ম্যামের এই আচরণ ওর কাছে যেন অদ্ভুত লাগছে।
পর্দা টানার পর ঘর বেশ অন্ধকার। ভারী পর্দা। হারাধন দা লাইট জ্বালাতে যাচ্ছিলেন। বাঁধা দিলেন। আবছা পর্দাগুলো ভালো করে দেখতে লাগলেন।
নির্মাল্যর বিস্ময়ের পারা চরছে। ভাবছে ম্যামের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! এই বাড়িতে এসে পর্দা নিয়ে পড়লেন। কেমন জেরা করার মতো করে সব কিছু জানতে চাইছেন! কাকাবাবুর সঙ্গে তেমন পরিচয়ও তো ছিল না! তাহলে...! তাছাড়া ডক্টরও বলেছেন, এটা ন্যাচেরাল ডেথ। সিম্পল হার্ট ফেলিওর। এখানে অন্য গন্ধ খোঁজার কী আছে? এই গোয়েন্দাগিরির নেশা ম্যামকে পেয়ে বসেছে। আসলে সারা দিনের কাজকর্ম শেষে শরীর ও ব্রেনের বিশ্রাম দরকার হয়। ঘুমের সমস্যা নিয়মিত চলতে থাকলে ক্রনিক হয়ে পরে অসুখে পরিণত হয়। ম্যামের তেমনই হয়েছে। মনে ভাবল, বলেই ফেলি। মুখে এসেও বলতে পারলেন না। এর মধ্যে একটা ফোন এল ম্যামের মোবাইলে। ম্যাম ধরলেন। কয়েক সেকেন্ডের হ্যাঁ, না তে ইঙ্গিত পূর্ণ কথা হল। কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব হল না, কের সঙ্গে কী বিষয়ে কথা বললেন ম্যাম।
মিসেস লাহিড়ী হারাধনদাকে বললেন, এবার ঘরের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দাও।
হারাধনদা ঘরের লাইট গুলো জ্বালিয়ে দিল। মিনিট দুই এদিক ওদিক ঘুরে আবার বললেন, লাইটগুলো নিবিয়ে দাও। বাবু কি কোনও নাইট লাইট জ্বালিয়ে ঘুমোতেন। হ্যাঁ, হালকা একটা লাইট। ওই ওটা... বলে লাইটটা দেখাল হারাধন।
মিসেস লাহিড়ী বললেন, ওই লাইটটা জ্বালিয়ে দাও। আচ্ছা জানলা...
হারাধনদার চটজলদি উত্তর, না খুলেই শুতেন।
এতক্ষণ চুপ করে থেকে নির্মাল্য বলল, ম্যাম আপনি কি অন্য কিছু সন্দেহ করছেন? মানে কাকাবাবুর মৃত্যু হার্ট ফেলিওর নয়? কিন্তু ডক্টর তো তাই বলেছেন।
দক্ষিনের খোলা জানলার দিকে এগিয়ে বললেন, হাতে ভারী পর্দা ধরা। নির্মাল্য, হতেও তো পারে ওর খুব আপনজন বা কাছের কেউ মুখে কিছু চাপা দিয়ে হার্টের ওপর চাপ ফেলে মেরেছে। বা হতেও তো পারে এটা হার্ট ফেলিওর নয়। কোনও পোষ্টমর্টেম তো হয়নি! কি করে নিশ্চিত হচ্ছিস, যে এটা হার্ট ফেলিওর?
নির্মাল্যর মুখটা একটু পাংশু হল। হারাধনদা নার্ভাস। কপালে বিন্দু ঘাম।
মিসেস লাহিড়ী হারাধনদাকে জিজ্ঞসা, বাবু ঘুমোতে যাওয়ার আগে কখনও ঘাম ছিলেন বা বলছিলেন বুকে কোনও ব্যথা হচ্ছে!
হারাধন প্রথমে না বলেও সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলল। না মানে বাবু মাঝে মাঝে বুকে হাত দিচ্ছিলেন।
মিসেস লাহিড়ী স্পস্ট বুঝতে পারলেন, মিসেস লাহিড়ীর পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে নির্মাল্য হাতের ইশারা করছে হারাধনদাকে। তারই প্রতিফলন হারাধনদার ওই উত্তর।
মিসেস লাহিড়ী ঘুরে দাঁড়ালেন। নির্মাল্য, একবার সুবিমলবাবুকে আসতে বল তো! বল আমি বলেছি।
সুবিমলবাবু লোকাল থানার জাঁদরেল ওসি।
ম্যামের নির্দেশ অনুযায়ী কাকাবাবুরই ফ্ল্যাটে আত্মীয় পরিজন সবাইকে ডেকেছেন আগামী কাল বিকেলে।
৫
পরেরদিন ঠিক বিকেল পাঁচটা। ফ্লাটে একে একে উপস্থিত। নির্মাল্য আগেই চলে এসেছে। আছে শ্রাবণী, সুবীরবাবু। চলে এসেছেন ম্যাম। আছে হারাধনদা। সুলেখা। এইমাত্র ঢুকলেন তিনজন অপরিচিত মানুষ, যাঁদের নির্মাল্য এবং ওর বোন চিনতে পারল না। ম্যাম হয়তো ডেকে থাকবেন। ম্যাম বললেন, নির্মাল্য আজ আপনাদের এখানে আসতে বলেছে। ওর কিছু বক্তব্য আছে। ও নিশ্চয়ই বলবে। কিন্তু তার আগে...
নির্মাল্য একটু উসখুস করে উঠল। না মানে... আ..মি
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ম্যাডাম বললেন, হ্যাঁ, তুমি নির্মাল্য! যাহোক, আমরা মনে করছি কাকাবাবুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। তাই আমরা যারা ওঁর আত্মীয় বন্ধু, তারা কি চাই না, আসল ব্যাপারটা কি তা সবার সামনে উন্মোচিত হোক!
সবাই চুপ।
সুবীরবাবু পকেট থেকে ডানহিলের প্যাকেটটা বের করে বললেন ডু ইউ মাইন্ড ইফ আই স্মোক..?
কথাটা যে ম্যাডামকে লক্ষ্য করেই বললেন, তা বুঝতে অসুবিধে হল না মিসেস লাহিড়ীর। ঘাড় ঘুরিয়ে ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি টেনে বললেন, নো, নো! প্লিজ...
সুবীরবাবু ইঞ্জিনিয়র। খুব জেন্টলম্যান। সমাজের কিছু মাথা ওকে মান্যি করে।
সুবীরবাবু সিগারেটটা ধরিয়ে ঘরের এক কর্নারে দক্ষিণের জানলার পাশে দাঁড়ালেন। এই ঘরে আস্ট্রে থাকার কথা নয়। তাই এই দক্ষিণের জানালাটার বাইরে ফাঁকা। সামনে অনেকটা খোলা মাঠ। এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ছাই ফেলতে খুব সুবিধে হবে। তাছাড়া দক্ষিণা হাওয়ায় মনও ভালো থাকে। এখন যে ফেসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ওঁরা! বিশেষ করে মেয়ে এবং জামাই। জামাইবাবাজীবনকে খুব ভালবাসতেন উনি।
সুবীরবাবুর এই বিষয়টা খুব ভালো ভাবে দেখছেন না। মুখে কিছু না বললেও আচরণে খানিকটা বুঝিয়ে দিয়েছেন বটে।
মিসেস লাহিড়ী সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে সুবিমলবাবুকে ফোন করলেন। আমরা সবাই যে এসেগেছি। আপনি...
বলতে বলতে দরজায় বেল। সুবিমলবাবুর প্রবেশ।
প্রাথমিক পর্বের আলোচনার পর মিসেস লাহিড়ী সুবিমলবাবুর সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রায় সবাইকেই সুবিমল বাবু চেনেন। কেবল চিনতে পারলেন না, সুবীর বাবুকে। সে দিকে তাকাতেই মিসেস লাহিড়ী বললেন, ইনি শ্রাবণীর হাজবেন্ড। মেসেস লাহিড়ী উনার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তো স্যার আরোনিটিকাল এঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তো? সুবীরবাবু একটু হকচকিয়ে গেলেন। এটা তো বহু আগের কথা। সে চাকরিও তো ছেড়ে দিয়েছেন বিয়ের আগে। সে কথা তো এঁদের জানার কথা নয়। প্রেমিকের বায়োডাটায় তেমনটা তো বলেনও নি। একটু আমতা আমতা করে বললেন, না, আগে একটা সময় করতাম। ছেড়ে দিয়েছি বহুদিন। এখন অন্য লাইন।
ম্যাম জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কোন লাইনে স্যার?
সুবীরবাবুর স্পস্ট জবাব, এখন গাড়ির ব্যাবসা।
সুবিমল বাবু বললেন, ব্যবসা কেমন চলছে?
নির্মাল্য কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এর সঙ্গে আজকের এই বসার কি সম্পর্ক! ম্যাডাম কি খোশ গল্প করার জন্য সবাইকে ডেকে এনেছেন?
সুবীরবাবু পকেট থেকে সিগারেট বের করে বললেন এখানে আমরা একজনের মৃত্যুর হেতু সন্ধান করতে এসেছি। যদিও আমি মনে করি, এর কোনও কারণই নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট করা! এর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় কেন উঠছে। এটা কমপ্লিট ন্যাচারাল ডেথ। সিম্পল হার্ট অ্যাটাক। তাছাড়া বাবা নাকি কি উইল করে দিয়ে গেছেন, তা পরা হবে। কিন্তু...
নির্মাল্যও কিঞ্চিৎ সায় দিল। কিন্তু উইলের কোথায় আশ্চর্য হয়ে গেল। নির্মাল্য ম্যামের দিকে তাকিয়ে। ম্যাম বললেন, হ্যাঁ, আমি ওনাকে বলেছি উইল পড়া হবে। তাই উনি আসতে পেরেছেন। নাহলে, ব্যবসায়ী মানুষ তো, আসার সময় পাচ্ছিলেন না।
এবার সুবীরবাবু উঠে বললেন, এনাফ ইজ এনাফ। আমার অনেক কাজ আছে। আমাকে একটু বেরিয়ে যেতেই হবে। সরি।
ম্যাম সোজা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না স্যার আপনি বসুন। আপনি আরেকটু পরে যাবেন। হারাধন দা সেদিন যখন কাকাবাবু শুতে এসেছিলেন, তখন কি কাকুবাবু ঘামছিলেন? কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল? বুক ব্যথার কথা বলছিলেন?
হারাধন বাবু বিক্ষিপ্তভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। ম্যাডাম ধমক দিয়ে বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে বলুন। কারও দিকে তাকিয়ে নয়। আমরা জানি, কার কথায় সেদিন আপনি থেকে গিয়েছিলেন?
সুবিমল বাবু, এটা কোনওভাবেই হার্ট ফেলিওর নয়। সাধারণত বুকে ব্যথা হওয়াটা সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ। হঠাৎ করে বুকটা ভীষণ চেপে ধরে। মনে হয় বুকটি ভেঙ্গে পড়ল। অনেক ওজন চেপে গেছে। এটা হয় শুরুতে এবং এর সাথে সাথে অনেকের শরীরে ঘাম হতে থাকে। পাশাপাশি অনেক সময় মাথা ঘুরতে থাকে, বমি হতে থাকে। আবার বমি নাও হতে পারে। তবে বুকে ব্যথা হওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তার হয়তো আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনো রোগ ছিল, সেখান থেকে হার্ট অ্যাটাক হলো। এগুলোই তার প্রধান উপসর্গ। এর কোনওটাই কাকাবাবুর ছিল না। কাকাবাবুকে খুন করা হয়েছে।
সুবীরবাবু লাফিয়ে ওঠে বললেন, ইন্সপেক্টর, এই খুনি। হারাধনদার দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন। দেখুন এর পিছনে আর কে কে আছে? নিশ্চয় রাতে গলাটিপে মেরেছে হারামজাদা।
বলে সুবীরবাবু দরজার দিকে এগোচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই যে অপরিচিত তিনটি লোক ও সুবিমল বাবু দরজা আঁটকে দাঁড়ালেন। কোথায় যাচ্ছেন সুবীর রায়চৌধুরী! আপনার খেল খতম। আপনি এখানেই থাকবেন।
সুবীরবাবু হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করলেন। আমি একজন ভদ্রলোক! বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন করতে যাবেন, ম্যাডাম গিয়ে মোবাইলটা কেড়ে নিলেন। না মিস্টার রায়চৌধুরী। কাউকে ফোন করা যাবে না এখন।
সুবীরবাবু বললেন, আমার অপরাধ?
সুবিমলবাবু বললেন, ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া ডক্টরের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সেসব স্বীকার করে নিয়েছে।
হারাধনকেও বাড়ি যেতে বারন করা হয়। সেই সঙ্গে বলা হয়, যা যা বলব, তাই তাই করতে। কাউকে না বলতে। বললে একেবারে শেষ করে দেওয়া হবে। তাই তো হারাধন? তাই না...!
হারাধন মাথা নিচু করে থাকে। হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে।
শ্রাবণী অবাক হয়ে ম্যামের দিকে তাকিয়ে। ম্যামকে বলছে, এই লোকটা যদি সত্যি আমার বাবার খুনি হয়, তা হলে ওঁর নিশ্চিত শাস্তি দাবি করি।
আমার ধন্যবাদ তোমাকে জানানো উচিত। আমি সেদিন কিছু না ভেবে দু একটা বিষয় ক্লারিফিকেশনের জন্য তোমাকে ফোন করেছিলাম। তোমার কথাগুলোই আমার সব সমস্যার জট খুলে দিল। আমার কাছে তো তেমন কোনও প্রমাণ ছিল না।
নির্মাল্যর চোখে হাজার প্রশ্ন। তা দেখে ম্যাম বললেন, আরে বাবা, তোর ম্যাম কি অতই বোকা? এটা তোর পরিবারের ব্যাপার মানে আমার পরিবারের ব্যাপার। আমি শ্রাবণী ফোন করি। ও সদ্য বাবাকে হারিয়েছে। আমারও একটি মেয়ে আছে। সেও তাঁর বাবাকে হারিয়েছে। আমি কষ্টটা বুঝি। সেখান থেকেই জানতে পারলাম, ওর বর দ্রোণ নিয়ে প্রচুর কাজ করে। দ্রোণ বানায়। রাতের দিকে তা পরীক্ষামুলক প্রচুর দ্রোণ চালায়। যে কন্ডোমিনিয়ামে তোর কাকাবাবু থা