উইকএন্ড, IPL আর হেলদি স্ন্যাক্স, সন্তানের বডি শেমিং, ডিটক্সের সাতকাহন, রবিবারের গল্প: জলছবি..
- রোজকার অনন্যা
- Apr 6
- 24 min read
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (IPL) হল ভারতের একটি জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগ, যা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। এটি ২০০৮ সালে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (BCCI) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। লিগটিতে ভারতের বিভিন্ন শহরের ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক দল অংশগ্রহণ করে এবং এটি বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং আকর্ষণীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট।

IPL-এর কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য:
দল: ২০২৫ সালে ১০টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
ফরম্যাট: লীগ পর্বের পরে প্লে-অফ এবং ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়।
তারকা ক্রিকেটার: বিশ্বের সেরা ক্রিকেটাররা এই লিগে অংশ নেন।
উদ্ভাবনীত্ব: DRS, স্ট্র্যাটেজিক টাইম-আউট, ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার ইত্যাদি নিয়ম চালু রয়েছে।
বিনোদন: ক্রিকেটের পাশাপাশি বলিউড, চিয়ারলিডার, স্পন্সরশিপ এবং বিশাল দর্শকসংখ্যার কারণে এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (IPL) ২০২৫ সালে মোট ১০টি দল অংশগ্রহণ করছে। প্রতিটি দলের অধিনায়কের নাম নিম্নে দেওয়া হলো:
চেন্নাই সুপার কিংস (CSK): রুতুরাজ গায়কওয়াড়
দিল্লি ক্যাপিটালস (DC): অক্ষর প্যাটেল
গুজরাট টাইটানস (GT): শুভমান গিল
কলকাতা নাইট রাইডার্স (KKR): অজিঙ্কা রাহানে
লখনউ সুপার জায়ান্টস (LSG): ঋষভ পন্থ
মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স (MI): হার্দিক পান্ডিয়া
পাঞ্জাব কিংস (PBKS): শ্রেয়াস আইয়ার
রাজস্থান রয়্যালস (RR): সঞ্জু স্যামসন
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (RCB): রজত পাতিদার
সানরাইজার্স হায়দরাবাদ (SRH): প্যাট কামিন্স

উইকএন্ড, IPL আর হেলদি স্ন্যাক্স!
ছুটির দিন সন্ধ্যায় সপরিবারে অথবা বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে বসে খেলা দেখার প্ল্যান করেছেন? আর তাদের আপ্যায়নে বাড়িতেই বানাতে চান সুস্বাদু স্ন্যাকস? তাহলে এই রেসিপিগুলো শুধু মাত্র আপনার জন্যই! এবারের উইকেন্ড জমে উঠুক হুল্লোড় আর পার্টিতে। আর পার্টি জমজমাট করতে মজাদার কিছু হেলদি স্ন্যাকসের হদিশ রইল এবারের রবিবারের অনন্যায়।

গ্রিলড প্রন
কী কী লাগবে
৫০০ গ্রাম বড় চিংড়ি (খোলস সহ বা ছাড়া, পরিষ্কার করা)
৩ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল
২ টেবিল চামচ লেবুর রস
৩ কোয়া রসুন (কুচি করা)
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices শুকনো লাল লঙ্কা গুঁড়ো
১ চা চামচ পাপরিকা
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices গোলমরিচ গুঁড়ো
১ চা চামচ লবণ
১ টেবিল চামচ ধনে পাতা কুচি
১ চা চামচ মধু
কীভাবে বানাবেন
একটি বাটিতে অলিভ অয়েল, লেবুর রস, কুচি করা রসুন, মরিচের গুঁড়ো, পাপরিকা, গোলমরিচ, লবণ এবং মধু মিশিয়ে নিন।
চিংড়িগুলো এই মিশ্রণে ভালোভাবে মাখিয়ে নিন এবং অন্তত ১৫-৩০ মিনিট রেখে দিন।
মাঝারি আঁচে গ্রিল প্যান বা আউটডোর গ্রিল গরম করুন এবং তাতে সামান্য তেল ব্রাশ করুন যাতে লেগে না যায়।
প্রতিটি দিক ২-৩ মিনিট গ্রিল করুন যতক্ষণ না এটি গোলাপি ও সামান্য চার হওয়া পর্যন্ত।
উপরে ধনে পাতা ছিটিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন লেবুর টুকরো ও পছন্দের সসের সাথে।
চিকেন রেশমি কাবাব
কী কী লাগবে
৫০০ গ্রাম চিকেন (বোনলেস, ছোট টুকরো)
২ টেবিল চামচ দই
২ টেবিল চামচ ফ্রেশ ক্রিম
১ টেবিল চামচ কাজু বাদামের পেস্ট
১ টেবিল চামচ চিজ (গ্রেট করা)
১ টেবিল চামচ আদা-রসুন বাটা
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices গরম মসলা
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices ধনে গুঁড়ো
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices গোলমরিচ গুঁড়ো
১ চা চামচ লবণ (স্বাদ অনুযায়ী)
১ টেবিল চামচ লেবুর রস
১ টেবিল চামচ Shalimar's Chef Spices কসুরি মেথি (গুঁড়ো করে নিন)
১ টেবিল চামচ মাখন বা ঘি
২ টেবিল চামচ Shalimar's sunflower তেল
কীভাবে বানাবেন
চিকেন টুকরোগুলো ধুয়ে নিন এবং জল ঝরিয়ে ফেলুন।
একটি বড় বাটিতে দই, ক্রিম, কাজু বাদামের পেস্ট, চিজ, আদা-রসুন বাটা, গরম মসলা, ধনে গুঁড়ো, গোলমরিচ, লবণ, লেবুর রস ও কসুরি মেথি দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন।
এতে চিকেনের টুকরোগুলো মিশিয়ে ৩-৪ ঘণ্টা ফ্রিজে রাখুন (সেরা স্বাদের জন্য সারা রাত মেরিনেট করুন)।
গ্রিল/তন্দুর/ওভেন আগে থেকে ২০০°C তাপে প্রি-হিট করুন।
চিকেনের টুকরোগুলো স্কিউয়ারে গেঁথে নিন (না থাকলে সরাসরি গ্রিলে বা প্যানে দিতে পারেন)।
ব্রাশ করে সামান্য মাখন বা তেল দিন।
ওভেনে: ১৮-২০ মিনিট বেক করুন, মাঝে একবার উল্টে দিন।
গ্রিলে: মাঝারি আঁচে ১২-১৫ মিনিট গ্রিল করুন।
তাওয়ায়: হালকা আঁচে কভার দিয়ে ১০-১২ মিনিট রান্না করুন, মাঝে মাঝে উল্টে দিন।
গরম গরম পরিবেশন করুন ধনে পাতা, লেবুর টুকরো ও পুদিনা চাটনি দিয়ে।

এয়ার ফ্রাইড অনিয়ন রিং
কী কী লাগবে
২টি বড় পেঁয়াজ (বড় রিং আকারে কাটা)
১ কাপ ময়দা
১ কাপ ব্রেডক্রাম্ব (সাধারণ বা পাঙ্কো)
১/২ কাপ কর্নফ্লাওয়ার
১ চা চামচ লবণ
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices গোলমরিচ গুঁড়ো
১ চা চামচ পাপরিকা (ঐচ্ছিক)
১/২ চা চামচ রসুন গুঁড়ো
১টি ডিম (বিট করা) বা ১/২ কাপ দুধ (ভেজিটেরিয়ান বিকল্প)
২ টেবিল চামচ Shalimar's sunflower তেল (ব্রাশ করার জন্য)
কীভাবে বানাবেন
পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে বড় আকারে গোল রিং করে কাটুন।
প্রতিটি রিং আলাদা করে নিন।
একটি বাটিতে ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার, লবণ, গোলমরিচ, পাপরিকা ও রসুন গুঁড়ো মিশিয়ে নিন।
আরেকটি বাটিতে বিট করা ডিম রাখুন (বা দুধ ব্যবহার করুন)।
তৃতীয় বাটিতে ব্রেডক্রাম্ব রাখুন।
প্রতিটি পেঁয়াজের রিং ময়দার মিশ্রণে ডুবিয়ে নিন, তারপর ডিমের মিশ্রণে চুবিয়ে নিন, এরপর ব্রেডক্রাম্বে গড়িয়ে নিন যাতে ভালোভাবে কোট হয়।
এয়ার ফ্রায়ার ২০০°C (৩৯২°F) এ প্রি-হিট করুন।
অনিয়ন রিংস এয়ার ফ্রায়ারের বাস্কেটে এক লেয়ারে রাখুন।
উপরে হালকা তেল স্প্রে বা ব্রাশ করুন।
১০-১২ মিনিট এয়ার ফ্রাই করুন, মাঝে একবার উল্টে দিন।
গরম গরম পরিবেশন করুন টমেটো কেচাপ, মায়োনেজ বা র্যাঞ্চ সসের সাথে।

বেকড ফিশ ফ্রাই
কী কী লাগবে
৪টি মাছের ফিলে (বাশা, রুই, কাতলা, স্ন্যাপার বা তেলাপিয়া)
১/২ কাপ ময়দা
১/২ কাপ কর্নফ্লাওয়ার
১ কাপ ব্রেডক্রাম্ব (পাঙ্কো হলে ভালো হয়)
১ টি ডিম (বিট করা)
২ টেবিল চামচ দই
১ চা চামচ আদা-রসুন বাটা
১ চা চামচ লবণ
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices গোলমরিচ গুঁড়ো
১ চা চামচ ধনে গুঁড়ো
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices গরম মসলা (ঐচ্ছিক)
১ চা চামচ পাপরিকা বা Shalimar's Chef Spices কাশ্মীরি লাল লঙ্কা গুঁড়ো (রঙের জন্য)
১ চা চামচ লেবুর রস
১ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল বা মাখন (ব্রাশ করার জন্য)
কীভাবে বানাবেন
মাছের ফিলেগুলো ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিন।
একটি বাটিতে দই, আদা-রসুন বাটা, লবণ, গোলমরিচ, ধনে গুঁড়ো, গরম মসলা, পাপরিকা, লেবুর রস ও এক টেবিল চামচ অলিভ অয়েল মিশিয়ে নিন।
মাছ এতে মেখে ৩০ মিনিটের জন্য ফ্রিজে রাখুন (আরও ভালো স্বাদের জন্য ১ ঘণ্টা)।
একটি বাটিতে ময়দা ও কর্নফ্লাওয়ার মিশিয়ে নিন।
আরেকটি বাটিতে বিট করা ডিম রাখুন।
তৃতীয় বাটিতে ব্রেডক্রাম্ব রাখুন।
মেরিনেট করা মাছ প্রথমে ময়দার মিশ্রণে ডুবিয়ে নিন, তারপর ডিমের মিশ্রণে, এরপর ব্রেডক্রাম্বে গড়িয়ে নিন।
ওভেন ২০০°C (৩৯২°F) তাপমাত্রায় প্রি-হিট করুন।
বেকিং ট্রেতে বাটার পেপার বিছিয়ে মাছ রাখুন।
উপর থেকে হালকা অলিভ অয়েল বা মাখন ব্রাশ করুন।
২০-২৫ মিনিট বেক করুন (মাঝে একবার উল্টে দিন), যতক্ষণ না সোনালি বাদামি রঙ হয়।
২০০°C তাপমাত্রায় ১২-১৫ মিনিট এয়ার ফ্রাই করুন।
মাঝখানে উল্টে দিয়ে সামান্য তেল ব্রাশ করুন।
গরম গরম পরিবেশন করুন ধনে পাতা, লেবুর টুকরো, ও পুদিনা চাটনির সাথে।

চিকেন কিমা কাবাব
কী কী লাগবে
৫০০ গ্রাম মিন্সড চিকেন (কিমা করা মুরগির মাংস)
২ টেবিল চামচ বেসন (ছোলা বাটা)
১টি ডিম (কাবাব নরম রাখার জন্য)
১টি পেঁয়াজ (মিহি কুচি করা)
২টি কাঁচা লঙ্কা (মিহি কুচি)
১ চা চামচ আদা-রসুন বাটা
১ চা চামচ লবণ (স্বাদ অনুযায়ী)
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices গোলমরিচ গুঁড়ো
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices গরম মসলা গুঁড়ো
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices ধনে গুঁড়ো
১ চা চামচ Shalimar's Chef Spices জিরা গুঁড়ো
১ টেবিল চামচ ধনেপাতা কুচি
১ চা চামচ লেবুর রস
২ টেবিল চামচ Shalimar's sunflower তেল (ভাজার জন্য)
কীভাবে বানাবেন
একটি বড় বাটিতে চিকেন কিমা নিন।
এতে বেসন, ডিম, পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা লঙ্কা, আদা-রসুন বাটা, লবণ, গোলমরিচ, গরম মসলা, ধনে গুঁড়ো, জিরা গুঁড়ো, ধনেপাতা ও লেবুর রস দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
মিশ্রণটি ১৫-২০ মিনিট ফ্রিজে রেখে দিন যাতে সেট হয়ে যায়।
মিশ্রণটি হাতে নিয়ে লম্বাটে বা গোল আকৃতির কাবাব তৈরি করুন।
চাইলে কাঠি (স্কিউয়ার) ব্যবহার করতে পারেন।
নন-স্টিক প্যানে সামান্য তেল গরম করুন।
মাঝারি আঁচে কাবাবগুলো প্রতিটি দিক ৪-৫ মিনিট করে ভেজে নিন যতক্ষণ না সুন্দর বাদামি রঙ হয়।
ওভেন ২০০°C তাপে প্রি-হিট করুন।
বেকিং ট্রেতে তেল ব্রাশ করে কাবাবগুলো রাখুন।
২০-২৫ মিনিট বেক করুন (মাঝে একবার উল্টে দিন)।
মাঝারি আঁচে ১৫-১৮ মিনিট গ্রিল করুন, মাঝে মাঝে তেল ব্রাশ করুন যাতে শুকিয়ে না যায়।
গরম গরম পরিবেশন করুন পুদিনা চাটনি, ধনেপাতা চাটনি, বা টমেটো সসের সাথে।
উপরে লেবুর রস ছিটিয়ে নিতে পারেন আরও ভালো স্বাদের জন্য।

চিজ স্টিকস
কী কী লাগবে
২০০ গ্রাম মোজারেলা চিজ (স্টিক আকৃতিতে কাটা)
১/২ কাপ ময়দা
২টি ডিম (বিট করা)
১ কাপ ব্রেডক্রাম্ব (পাঙ্কো হলে ভালো)
১/২ চা চামচ লবণ
১/২ চা চামচ Shalimar's Chef Spices গোলমরিচ গুঁড়ো
১ চা চামচ ওরেগানো / মিক্সড হার্বস
১ চা চামচ চিলি ফ্লেক্স (ঐচ্ছিক)
ভাজার জন্য Shalimar's sunflower তেল (যদি ডিপ ফ্রাই করেন)

কীভাবে বানাবেন
মোজারেলা চিজ আনুমানিক ১/২ ইঞ্চি পুরু এবং ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা স্টিকে কেটে নিন।
একটি প্লেটে ময়দা ছড়িয়ে নিন।
আরেকটি বাটিতে বিট করা ডিম রাখুন।
তৃতীয় বাটিতে ব্রেডক্রাম্ব, লবণ, গোলমরিচ, ওরেগানো, চিলি ফ্লেক্স মিশিয়ে নিন।
প্রতিটি চিজ স্টিক প্রথমে ময়দায় গড়িয়ে নিন।
এরপর ডিমের মধ্যে চুবিয়ে নিন।
তারপর ব্রেডক্রাম্বে গড়িয়ে নিন।
আরও ক্রিস্পি করার জন্য একই প্রক্রিয়া আরেকবার করুন (ডাবল কোটিং)।
চিজ স্টিকগুলো ১৫-২০ মিনিটের জন্য ফ্রিজে রাখুন।
এটি করার ফলে চিজ গলতে গলতে বের হয়ে আসবে না।
কড়াইতে তেল গরম করুন (মাঝারি আঁচে)।
চিজ স্টিক ৩০-৪০ সেকেন্ড ভেজে নিন, যতক্ষণ না সোনালি বাদামি রঙ হয়।
কিচেন টিস্যুর উপর তুলে রাখুন অতিরিক্ত তেল ঝরানোর জন্য।
২০০°C তাপমাত্রায় প্রি-হিট করুন।
চিজ স্টিকগুলো ৮-১০ মিনিট এয়ার ফ্রাই করুন। মাঝখানে উল্টে দিন।
২০০°C তাপমাত্রায় ১০-১২ মিনিট বেক করুন।
গরম গরম পরিবেশন করুন টমেটো কেচাপ, মায়ো-গার্লিক ডিপ বা চিলি সসের সাথে।
সন্তানের বডি শেমিং!

গোলগাল চেহারা, মাথায় চুল কম অথবা শরীরের অন্য কোনো অংশে খুঁত থাকলে এই সমস্যার সন্মুখীন হন কম বেশি সবাই। এমনকি খুদেরাও বাদ পড়ে না এই তালিকা থেকে! বডি শেমিং হলো কাউকে তার শারীরিক গঠন, ওজন, গায়ের রঙ বা বাহ্যিক চেহারার জন্য নেতিবাচক মন্তব্য করা বা অপমান করা। এটি সরাসরি বলা হতে পারে বা পরোক্ষভাবে হাসিঠাট্টার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে। কীভাবে বাঁচবেন রইলো সবিস্তারে আলোচনা।
বডি শেমিং-এর বিভিন্ন ধরন:
1. ওজন ভিত্তিক শেমিং: মোটা বা পাতলা হওয়ার কারণে নেতিবাচক মন্তব্য করা।
2. ত্বক বা রঙ ভিত্তিক শেমিং: গায়ের রঙ বা ব্রণ, দাগ ইত্যাদি নিয়ে কটাক্ষ করা।
3. উচ্চতা ভিত্তিক শেমিং: অতিরিক্ত লম্বা বা খাটো হওয়া নিয়ে উপহাস করা।
4. শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে শেমিং: দাঁতের গঠন, চুলের ধরন বা শরীরের কোনো অংশ নিয়ে অপমান করা।

বডি শেমিং-এর প্রভাব:
আত্মবিশ্বাস কমে যায়
হতাশা ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়
সামাজিক উদ্বেগ বা ডিপ্রেশন হতে পারে
খাওয়ার অভ্যাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে (Eating Disorder)
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
✔ নিজের শরীরকে ভালোবাসা ও আত্মবিশ্বাস রাখা
✔ নেতিবাচক মন্তব্যে গুরুত্ব না দেওয়া
✔ ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা
✔ অন্যদের শরীর নিয়ে অবাঞ্ছিত মন্তব্য না করা
✔ সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক স্ট্যান্ডার্ডের বিরুদ্ধে কথা বলা
বডি শেমিং বন্ধ করতে হলে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে এবং সৌন্দর্যের সংকীর্ণ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সন্তানের বডি শেমিং ও তার ক্ষতিকর দিক:
বডি শেমিং শুধু বড়দের ক্ষেত্রেই নয়, ছোটদের প্রতিও করা হয়, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সন্তানের প্রতি বডি শেমিং-এর সাধারণ কিছু রূপ:
শিশুকে মোটা বা রোগা বলে উপহাস করা
গায়ের রঙ, চুল বা দাঁতের জন্য কটাক্ষ করা
তুলনা করা ("অমুকের মতো সুন্দর হতে পারলি না!")
উচ্চতা নিয়ে হাসাহাসি করা
খাবার নিয়ে কড়াকড়ি করা ("এত খাস কেন? মোটা হয়ে যাচ্ছিস!" বা "এমনিতেই হাড্ডিসার!")
ক্ষতিকর দিক:
১. আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়
শিশুর মনে নিজের শরীর নিয়ে লজ্জা জন্ম নেয়, যা তাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয় এবং সামাজিক মেলামেশায় বাধা সৃষ্টি করে।
২. মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি
বডি শেমিং শিশুর মধ্যে দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন), ও সামাজিক উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে।

৩. খাবার ও স্বাস্থ্য নিয়ে নেতিবাচক প্রভাব
অতিরিক্ত শেমিংয়ের কারণে শিশুর খাওয়ার প্রতি অনীহা বা অস্বাস্থ্যকর খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হতে পারে (Eating Disorder)। অল্প বয়সেই ডায়েটিং বা অনিয়ন্ত্রিত ওজন কমানোর প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
৪. নিজের শরীরের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে পারে
যদি বারবার শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়, তবে শিশুর মনে নিজেকে গ্রহণ না করার প্রবণতা তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে আত্ম-অসন্তুষ্টি বাড়ায়।
৫. সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তন
স্কুলে বা বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে ভয় পাওয়া
নেতিবাচক মন্তব্য এড়াতে নিজেকে লুকিয়ে রাখা
অন্যদেরও শেমিং করার প্রবণতা তৈরি হওয়া
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
✔ শিশুর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা – তার শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কটাক্ষ না করে উৎসাহ দেওয়া।
✔ শরীরের সৌন্দর্যের স্টেরিওটাইপ না চাপানো – প্রতিটি শরীর সুন্দর, এই বার্তাটি শিশুকে বোঝানো।
✔ ভালোবাসা ও ইতিবাচক কথা বলা – "তুমি যেমন, তেমনটাই সুন্দর" এই বিশ্বাস গড়ে তোলা।
✔ শিশুর সামনে নিজের শরীরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা – যাতে তারা নিজেদের নিয়েও গর্বিত হতে পারে।
✔ সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব কমানো – অবাস্তব সৌন্দর্যের ধারণা থেকে দূরে রাখা।

শিশুর শারীরিক গঠন তাদের ভবিষ্যৎ সফলতার কোনো মাপকাঠি নয়। তাই বডি শেমিংয়ের বদলে তাদের মানসিকভাবে শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ডিটক্সের সাতকাহন

ডিটক্স ডায়েট: কী, উপকারিতা ও সতর্কতা
ডিটক্স ডায়েট হলো শরীর থেকে টক্সিন বা বিষাক্ত উপাদান দূর করার জন্য বিশেষ খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা। সাধারণত ফল, শাকসবজি, জল, ডিটক্স ওয়াটার ও প্রাকৃতিক উপাদানভিত্তিক খাবার এই ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
ডিটক্স ডায়েটের মূল উপাদান:
✅ প্রচুর জল পান
✅ সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল
✅ ভেষজ চা (গ্রিন টি, আদা-লেবুর চা)
✅ ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার (চিয়া সিড, ওটস, বাদাম)
✅ প্রাকৃতিক ডিটক্স ওয়াটার (লেবু-জল, শসা-জল)
পরিহারযোগ্য খাবার:
❌ প্রক্রিয়াজাত খাবার (ফাস্ট ফুড, সফট ড্রিংকস)
❌ অতিরিক্ত চিনি ও লবণ
❌ অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন
❌ ভাজাপোড়া ও অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার

ডিটক্স ডায়েটের উপকারিতা:
✔ হজমশক্তি উন্নত করে – ফাইবার ও জল বেশি থাকায় পেট পরিষ্কার থাকে।
✔ ওজন কমাতে সহায়ক – কম ক্যালোরি ও বেশি নিউট্রিশন থাকায় দ্রুত ওজন কমে।
✔ ত্বক উজ্জ্বল করে – বিষাক্ত উপাদান দূর হওয়ায় ব্রণ ও দাগ কমে যেতে পারে।
✔ শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে – প্রাকৃতিক খাবার ও প্রচুর জল পান করলে ক্লান্তি কমে।
✔ ইমিউন সিস্টেম ভালো রাখে – অ্যান্টিঅক্সিডেন্টযুক্ত খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
সতর্কতা ও ক্ষতিকর দিক:
⚠ পুষ্টির ঘাটতি হতে পারে – দীর্ঘদিন করলে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি কমে যেতে পারে।
⚠ খুব দ্রুত ওজন কমানো ক্ষতিকর – হঠাৎ ওজন কমালে তা আবার দ্রুত বেড়ে যেতে পারে।
⚠ মাথা ব্যথা ও দুর্বলতা দেখা দিতে পারে – বিশেষ করে ক্যাফেইন বা চিনি হঠাৎ কমিয়ে দিলে।
⚠ লম্বা সময় অনুসরণ না করাই ভালো – বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন যে এটি ৩-৭ দিনের জন্য যথেষ্ট।
কখন ডিটক্স ডায়েট করা উপকারী?
✔ অতিরিক্ত প্রসেসড ফুড বা জাঙ্ক ফুড খেলে
✔ শরীর ক্লান্ত বা ভারী মনে হলে
✔ ওজন কমানোর প্রাথমিক ধাপে
✔ লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা উন্নত করতে
যারা গর্ভবতী, ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন, তাদের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

ডিটক্স ডায়েটে কী খাবেন?
ডিটক্স ডায়েটে শরীরের টক্সিন বের করে দেওয়ার জন্য সহজপাচ্য, পুষ্টিকর ও প্রাকৃতিক খাবার খেতে হয়। এখানে কিছু উপকারী খাবারের তালিকা দেওয়া হলো:
১. ডিটক্স ওয়াটার ও পানীয়:
✅ লেবু-জল – শরীর পরিষ্কার ও হজমে সহায়ক
✅ শসা ও পুদিনা পানীয় – শরীর ঠান্ডা রাখে
✅ গ্রিন টি – অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ
✅ আদা-লেবুর চা – হজমশক্তি বাড়ায়
✅ ডাবের জল – প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ
২. শাকসবজি:
✅ সবুজ শাক (পালং, কলমি, মুলা শাক) – লিভার পরিষ্কারে সহায়ক
✅ ব্রোকলি ও ফুলকপি – ফাইবার ও ভিটামিন সমৃদ্ধ
✅ গাজর – বেটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ, লিভারের জন্য ভালো
✅ শসা ও লেটুস – শরীর হাইড্রেটেড রাখে
✅ লাউ ও করলা – শরীর থেকে টক্সিন দূর করে

৩. ফলমূল:
✅ লেবু ও কমলা – ভিটামিন C-সমৃদ্ধ, শরীর ডিটক্স করে
✅ আপেল – ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ
✅ পেঁপে – হজমশক্তি বাড়ায়
✅ বেরি জাতীয় ফল (ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, জাম) – অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ
✅ আনারস ও তরমুজ – শরীরের পানি শূন্যতা দূর করে
৪. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার:
✅ ডাল ও মসুর ডাল স্যুপ – হজমে সহায়ক
✅ বাদাম ও চিয়া সিড – ভালো ফ্যাট ও প্রোটিনের উৎস
✅ কাঠবাদাম দুধ বা ওটস মিল্ক – পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য
✅ মাছ (স্যামন, টুনা) – ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ
✅ ডিমের সাদা অংশ – কম ক্যালোরি, বেশি প্রোটিন
৫. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার:
✅ ওটস – পরিপাকতন্ত্র পরিষ্কার রাখে
✅ চিয়া ও ফ্লাক্স সিড – ভালো ফ্যাট ও ফাইবারের উৎস
✅ কাঠবাদাম ও আখরোট – হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী
✅ কাঁচা সবজি (গাজর, শসা, ব্রোকলি) – হজমে সহায়ক
৬. স্বাস্থ্যকর ফ্যাট:
✅ অলিভ অয়েল – শরীরের জন্য ভালো ফ্যাট
✅ অ্যাভোকাডো – ভিটামিন E ও ফাইবার সমৃদ্ধ
✅ নারকেল তেল – হজমে সহায়ক

যা খাবেন না:
❌ ফাস্ট ফুড ও প্রসেসড ফুড
❌ অতিরিক্ত চিনি ও মিষ্টি
❌ গ্যাসযুক্ত সফট ড্রিংকস
❌ অতিরিক্ত লবণ ও মসলা
❌ অ্যালকোহল ও ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়
টিপস:
✔ প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস জল পান করুন
✔ ঘুম ও ব্যায়ামের প্রতি গুরুত্ব দিন
✔ ধীরে ধীরে ডিটক্স ডায়েটে অভ্যস্ত হোন

গ্রিন ডিটক্স স্মুদি
একটি সতেজ ও পুষ্টিকর স্মুদি, যা শরীরকে টক্সিন মুক্ত করতে সহায়ক!
কী কী লাগবে
১ কাপ পালং শাক (অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ)
½ শসা (হাইড্রেটিং ও ডিটক্সিফাইং)
১টি ছোট সবুজ আপেল (প্রাকৃতিক মিষ্টতা ও ফাইবার)
½ লেবু (ভিটামিন C ও লিভার ডিটক্স)
½ ইঞ্চি আদা (প্রদাহ-নিরোধক ও হজমে সহায়ক)
১ কাপ নারকেল (হাইড্রেশন ও ইলেক্ট্রোলাইট)
৩-৪টি বরফের টুকরো (ঐচ্ছিক)
কীভাবে বানাবেন
সমস্ত উপকরণ ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
শসা, আপেল ও আদা ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিন।
সব উপকরণ ব্লেন্ডারে দিয়ে মসৃণ না হওয়া পর্যন্ত ব্লেন্ড করুন।
গ্লাসে ঢেলে সঙ্গে সঙ্গে উপভোগ করুন!
টিপস: সকালে খালি পেটে এই স্মুদি পান করলে সর্বোচ্চ উপকারিতা পাবেন।

ডিটক্স লেবু ও আদার জল
একটি সহজ কিন্তু কার্যকর ডিটক্স পানীয়, যা শরীরকে শুদ্ধ করে ও হজমশক্তি বাড়ায়!
কী কী লাগবে
১ গ্লাস গরম জল
½ লেবুর রস
½ ইঞ্চি আদা (কুচি করে কাটা বা গুঁড়ো করা)
১ চা চামচ মধু (ঐচ্ছিক)
কীভাবে বানাবেন
গরম জল এ আদা দিয়ে ৫ মিনিট ঢেকে রাখুন।
এরপর এতে লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে নিন।
ভালোভাবে নেড়ে নিন এবং সকালে খালি পেটে পান করুন।
চাইলে এতে এক চিমটি দারুচিনি গুঁড়ো যোগ করতে পারেন, যা বিপাকক্রিয়া বাড়ায়।

নিয়মিত ডিটক্স পানীয় গ্রহণ শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে, হজমশক্তি উন্নত করে এবং শক্তি বৃদ্ধি করে। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি এসব পানীয় শুধুমাত্র শরীরকে সুস্থ রাখে না, বরং ওজন নিয়ন্ত্রণ ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক। তবে, সুষম খাদ্যাভ্যাস ও পর্যাপ্ত জল পান করাও ডিটক্সিফিকেশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে প্রতিদিন এক গ্লাস ডিটক্স পানীয় পান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং নিজেকে সতেজ ও প্রাণবন্ত রাখুন!
রবিবারের গল্প:
জলছবি
কল্লোল লাহিড়ী

শিবদাসের মৃতদেহ ভেসে উঠেছিলো সবুজ রঙের কচুপানার পাশে। তার ফুলে ওঠা হ্যাসহ্যাসে সাদা পা দুটো ঘাটে ঠেকেছিলো। হালকা হাওয়ায় জলের তরঙ্গে দুলে দুলে উঠছিলো দেহটা। মাছরাঙা টুপ করে জলে ডুব দিয়ে ধরছিলো ছোটো ছোটো কেঁদে মাছ, আড়চোখে দেখছিলো পুকুর পাড়ে প্রচুর লোকের জমাট বাঁধা ভিড়। সেই ভিড়ে শিবদাসের মায়ের আছাড়ি পিছাড়ি কান্নার শব্দে জলের গভীরে স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলার আস্তরণে ঢুকে পড়ছিলো গৌড়ি গুগলি গুলো। মাঝে মাঝে পুকুরের ওপরের জল গরম হয়ে এস্পকারে উড়ে যাওয়ার সময় নীচের জল উঠে আসছিলো ওপরে। ঠিক এইসব ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ছাড়া পুকুর ছিলো নিশ্চল। মাঝে মাঝে সেই নিশ্চলতার তপোভঙ্গ করছিলো দেহাতি ব্যাঙাচিগুলো। তারা উঠে আসছিলো শিবদাসের জল থৈ থৈ বুকে, মুখে, তার চেয়ে থাকা চোখের কোটবে। আদিম বন্যতায় তারা ঘিরে ধরছিলো মৃতদেহকে।

কতবার যে এই স্বপ্নটা দেখেছে সাগ্নিক এখন আর ঠিক মনে করতে পারে না। ডান হাত তুলতে গিয়ে দেখে স্যালাইনের ভারে হাত তোলা দায়। পাশে বসা আয়ার তখন মাঝ রাত। ঢুলতে ঢুলতে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়লে নির্ঘাত স্পাইনাল কর্ডটা ভাঙবে। সারাক্ষণ শোওয়ার ধকল সামলানোর জন্যে এখন উঠে বসতে ইচ্ছে করছে। আস্তে আস্তে পিঠের সাড় যত ফিরছে ততই যন্ত্রনাটা বাড়ছে। মনে হয় উঠে বসতে পারলে সুস্থ বোধ হবে। কপালের ঘামটাও মোছা দরকার। কিন্তু দু-হাত পাঘরের মতো। অসাড়। নাড়া-চাড়া করতে কষ্ট হচ্ছে। মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা। কারণ খাবলা খাবলা চুল উঠে আসছিলো হাতে। থুতনিতে বান্ডেজ। কিভাবে যে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না সাগ্নিক। এদিকে প্রচন্ড পেচ্ছাপ পেয়েছে। গলা খুশ খুশ করাতে কাশির দমক এলেও কাশতে পারলো না। চোয়ালে খুব বাথা। পৌ পৌ সাইরেন বাজিয়ে একটা এ্যাম্বুলেন্স ঢুকলো। লোকজনের কথাবার্তা, হাঁটাচলা শোনা যাচ্ছে নীচে। কিছুক্ষণের জন্যে রাতের নার্সিংহোম যেন সচল হল। তবুও আয়ার ঘুম ভাঙলো না।
গতকাল কোনো হুঁশ ছিলো না সাগ্নিকের। তাই বুঝতে পারেনি কিছুই। এই নার্সিংহোমে সে আসে না। এবারেই কেন যে মা ভর্তি করলো বুঝতে পারছে না। আয়া না উঠলে জল খাওয়াও হবে না। পেচ্ছাপ হয়তো বিছানাতেই হয়ে যাবে। সেটা বড় ঘেন্নার। সেটা বড় কষ্টের। প্রথমবার মাঠে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে, রাতে বিছানায় যখন চাঁদের আলোর ছড়াছড়ি তখন সাগ্নিক অজান্তেই বিছানা জুড়ে হিসি করে ফেলেছিলো। কি পরিতৃপ্ত লাগছিলো সেদিন নিজেকে। সারা গায়ে হিসি আর জোছনা মেখে শুয়েছিলো সে। মা রাতে খাবার দিতে এসে দেখেছিলেন বিছানায় ছোপ-ছোপ, লাল-লাল দাগ। ইউরিনের সঙ্গে ব্লাড। সেদিন রাতে সেই প্রথম নার্সিংহোমে পাঠানো হলো সাগ্নিককে। ভোরে শিবদাসের স্বপ্ন। যতদূর মনে পড়ে সেদিন আয়া ছিলো না। ছিলো একজন ওয়ার্ডবয়। নাম শুভঙ্কর। মুখটা মিষ্টি। হাসলে ছোটো মাসির মতো গালে টোল পড়ে। ওকে দেখলেই শাদা দেওয়ালের ঘরটা যেন রামধনুর জার্সি পরতো গায়ে। মনে হতো বিশাল স্টেডিয়ামে নরম কচি ঘাসের ওপর পা রাখলো সাগ্নিক, শুকে নিলো ভিজে ঘাসের গন্ধ। আর একটু পরেই রেফারির হুইসেল। গমগম করা স্টেডিয়ামে স্বপ্নের একটা প্ল্যানাটিক কিক।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর চোখ দুটো জড়িয়ে যেতো পিছুটিতে। মুখটা ফুলে উঠতো বিকট। নাম না জানা পাখিটা জানলার ধারে আতা গাছটার ডালে বসে ডাকতো আর সাগ্নিক যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যেত। ভেজা গরম তোয়ালে দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে দিতো শুভঙ্কর। সাদা গরম তোয়ালের ওম পেতে পেতে ছোটোবেলায় মায়ের বুকে মুখ গুঁজে থাকার আনন্দ পেতো সাগ্নিক। সেবার একটু বেশি রকমের বাড়াবাড়ি। হয়েছিলো। কেমো না নিয়েই মাথার চুল খাবলা খাবলা উঠে আসছিলো হাতে। একটু সুস্থ হলে চুল গুলো ছোট ছোট করে ছেঁটে দিয়েছিলো শুভঙ্কর। তখনি কপালের বাঁদিকের কালো রঙের দাগটা ধরা পড়ে। ঘুতনির নীচে যে ব্যান্ডেজ, সেটা কয়েকদিনের। ডাক্তার বলেছেন ক্রমে খুতনিতে স্প্রেড করছে-ইনফেকশানটা। মুখের ভিতরেও। সাগ্নিকের সামনে কিছুই আলোচনা হয়না। তবুও কেউ জানে না, কিভাবে জেনে যায় ও সব কিছু। মা সামনে এলেই মাকে যেন সে পড়তে পারে। বাবার হিল্লা দিল্লী ঘুরে বেড়ানো কাজ, দেশেই থাকে কম। তবুও যখন তখন চলে আসে। দূরে টেবিলের ওপরে কাচের বয়ামে রাখা জেলিফিসটা বাবা এনে দিয়েছে সিঙ্গাপুর থেকে। মাসখানেক হলো। সাগ্নিক যেখানে যায় জেলিফিসটাকে সঙ্গে নেয়। সারাদিন কাচের বয়ামের একদিকে চুপ করে বসে থাকে জেলিফিস। রাতে ঘুরে বেড়ায় বয়ামের আনাচে-কানাচে এদিকে ওদিকে। গুকি শিবদাসকে দেখতে পায়?
পাশের কেবিনে হয়তো কোনো নতুন রোগী এসেছে। একটু হাঁটা চলা, কথাবার্তা, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, দরজা খোলার আওয়াজ এসবই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে সাগ্নিক দেখলো আয়া উঠে পড়েছে। সাগ্নিকের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে কিছু দেখার, বোঝার চেষ্টা করছে। বৃদ্ধার মুখে বয়সের ছাপ। হয়তো হাই প্রেসারের রোগী। একটা গল্প তৈরী করে নিলো সাগ্নিক মনে মনে। এটা তার অভ্যাস। দীর্ঘ রোগ ভোগের শরীরে এটা তার আনন্দের পরিসর। বৃদ্ধার গরম নিঃশ্বাস তার ঠোঁটের ওপরে পড়ছে। তার কপালে জমেছে অল্প অল্প ঘাম। বাড়িতে তিন ছেলের সংসারে একমাত্র রোজগেরে মা। আয়া বা নার্সের প্রাথমিক ট্রেনিং নিতে হয়নি কোনোদিন। বছর চল্লিশ হয়ে গেলো এই লাইনে। অবসর বলে তো কিছু নেই, তবু এখন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু টাকা না নিয়ে গেলে খেতে পাবে না। আঠাশ বছর বয়সে যখন বিধবা হয়েছিলো তখন বড়টার বয়েস চার, মেজোটার তিন আর ছোটোটার দেড়। তিন ছেলেকে বড় করার ঝক্কি একা সামলাতে হয়েছে। ছেলেরা বড় হলেও দুঃখ ঘোচেনি বৃদ্ধার। বড়, মেজোর আলাদা সংসার। ছোটোটার সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু বেশ কয়েক বছর হলো তার পাত্তা নেই। পাড়ার লোকেরা বলে ছেলের নাকি সঙ্গ দোষ ছিলো। ভালো ফুটবল খেলতো ছেলেটা। বেঁচে আছে না মরে গেছে তা এখন আর কেউ বলতে পারে না। সাগ্নিক কথা বলতে যাবে আর ঠিক সেই সময় ঘরের লাইট জ্বলে ওঠে। বৃদ্ধা ফ্লাক্স থেকে জল ঢালছেন। আবার সেই গরম জল। কতদিন ঠান্ডা জল খায়নি সায়িক। শুধু শিবদাসকে যখন দেখতে পায়, পুকুরের ঠান্ডা হাওয়া যেন তার মুখে এসে লাগে। পুকুর পাড়ে যে মহিলা অঝোরে কাঁদছে তার মুখ দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু এতো ভিড়, সাগ্নিক এগোতে পারে না।
গরম জলের সাথে ঠাণ্ডা জল মেশানো হয় তারপর চামচে করে।
সাগ্নিককে খাওয়ান মহিলা। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেন, কপালের ঘামও। ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার বার করে কি যেন ভাবেন, সাগ্নিকের কপালে হাত দেন, থার্মোমিটার ঢুকিয়ে রাখেন। খাটের তলায় নীচু হয়ে দেখেন ক্যাথিটারে পেচ্ছাপ জমা হয়ে আছে। না কোনো ব্লাড নেই বলেই মনে হলো। ক্রিটিকাল পেশেন্ট। অনেক কিছু নজরে রাখতে হয়। ইদানিং কথা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কিম্বা বেশিরভাগ সময়ে ওভারডোজ মরফিনে থাকে আচ্ছন্ন। সব দেখে শুনে তিনি চেয়ারে গিয়ে বসলেন। সাগ্নিক নড়াচড়া করতেই চেয়ার সামনে
এনে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। ছেলেটার ছটফটানি কমলো।
সাগ্নিকের কেমন যেন শীত শীত করতে লাগলো। পায়ের ওপর চাদরখানা টেনে দিয়ে অঙ্কিতা বললো "এতো গরমেও তোর শীত? এক্সকারসানের ছবিগুলো এনেছি। আজ সকালে রূপস এসে দিয়ে গেলো। যা এনজয় করেছি না। খুব মিস করতাম তোকে। দ্যাখ দ্যাখ।" ছবিগুলো এগিয়ে দেয় অঙ্কিতা। মনে হচ্ছে না ইটস রিয়েল টাচ অব ফেসবুকের ওয়াল ভর্তি হয়ে যাচ্ছে রূপস আর অঙ্কিতার ছবিতে। রাজনীতিটা অতটা ভালো না বুঝলেও প্রচুর বিদেশী ছবি দেখে রূপস।। আর বিদেশী ছবির নাম বলে তাক লাগিয়ে দেয় অঙ্কিতাকে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে দুটো মানুষ। ছটফট করতে থাকে সাগ্নিক নিজের মঞ্চে। এদিকে টুর্নামেন্ট এসে পড়ে।
ব্যাকে খেলে সাগ্নিক। খেলাতে তার বেশ নাম-ডাক। খেলতে গিয়েই অঙ্কিতার সাথে তার প্রথম আলাপ। খেলার পর অঙ্কিতা সরাসরি প্রপোজ করেছিলো। সাগ্নিক কোনোদিন ভাবতেও পারেনি। কিভাবে হ্যাঁ বলবে বুঝতে না পেরে, মতি নন্দীর 'স্ট্রাইকার' এর প্রথম পাতায় লিখেছিলো দুজনে বন্ধু হলাম। তারপর দুটো মানুষ খুব কাছাকাছি এসেছে। জীবনে প্রথম চুমু। পিকনিক সেরে অনেক রাতে বাড়ি ফেরা। অনেক অনেক কমিটমেন্ট। তারপর হঠাতই অঙ্কিতার গলায় খালি রূপস আর রূপস। বল নিয়ে ছুটে আসছে বিপক্ষের দল। ব্যাক আগলাচ্ছে সাগ্নিক। কড়ের বেগে ছুটে আসছে ছেলেটা। প্রশান্ত পারলো না, ধনঞ্জয় এগিয়ে এলো সেও পারলো না। এবার সাগ্নিক অবাক হয়ে দেখে কি জাদু ছেলেটার তড়িত চলনে। কি ছন্দ তার বল নিয়ে এগিয়ে আসা শরীরে। আর অপেক্ষা করতে পারে না সাগ্নিক। বলটা ছিনিয়ে নেয়। তড়তড়িয়ে এগিয়ে খেলাতে সে মন দিতে পারছে না কিছুতেই। কারণ সে মনে মনে ঠিক বুঝতে পারছে রূপসকে সহ্য করতে পারছে না। অঙ্কিতার ফেসবুকের ওয়াল ভর্তি হয়ে যাচ্ছে রূপস আর অঙ্কিতার ছবিতে। রাজনীতিটা অতটা ভালো না বুঝলেও প্রচুর বিদেশী ছবি দেখে রূপস। আর বিদেশী ছবির নাম বলে তাক লাগিয়ে দেয় অঙ্কিতাকে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে দুটো মানুষ। ছটফট করতে থাকে সাগ্নিক নিজের মধ্যে।
লাইট? তোর সেই মেঘ ছেঁড়া আলো। সান্দাকফুতে তোলা। এই দ্যাখ... এইটা দ্যাখ... রূপস আর আমি। কি ভীষণ সুইটলাগছে না রূপসকে?
কী হলো? দেখবি না ফটো?" বেশ শীত করছিলো সাগ্নিকের। রোদের দিকে সরে যাচ্ছিলো একটু একটু করে। বেশ কয়েকদিন হলো তার জ্বর হচ্ছে। কয়েকজন ডাক্তার দেখেছেন, কিন্তু কেউ কিছুই ধরতে পারছেন না। কলেজ থেকে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু যাওয়া হয়নি। অঙ্কিতার এখন নতুন বন্ধু রূপস। রূপস ঘোষ। এক বছরের জুনিয়র। ভালো ডিবেট করে। জয় গোস্বামীর বেশ কয়েকটা কবিতা মুখস্থ। রূপস কথায় বাজিমাত করতে পারে। দেখতে ভালো, কিন্তু হাসলে গালে টোল পড়ে না। কলেজের ম্যাগাজিনে নিজের লেখা নিয়ে কথা বলতে এসেছিলো প্রথমদিন। সাগ্নিক, অঙ্কিতার কাছে পাঠিয়েছিলো তাকে। সাহিত্য, কবিতা, সিনেমা ওই দিকে আগ্রহ বেশি অঙ্কিতার। কলেজ ম্যাগাজিনের দায়িত্বেও আছে। সাগ্নিকের আবার ওসব নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই।
কলেজের টুর্নামেন্ট সামনে। খেলতে হবে তাকে। ট্রফিটা এবার কলেজে তোলা চাই। কিন্তু খেলাতে সে মন দিতে পারছে না কিছুতেই। কারণ সে মনে মনে ঠিক বুঝতে পারছে রূপসকে সহ্য করতে পারছে না। অঙ্কিতার যেতে থাকে সেন্টারের দিকে। কিন্তু হঠাৎ একটা ধাক্কা। ভীষণ ধাক্কা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোনো এক আঁধার গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে সাগ্নিক। ফিকে হয়ে আসতে থাকে মাঠের আওয়াজ। ভিজে ঘাসের গন্ধ টেনে নিয়ে যায় তাকে পুকুর পাড়ে। কে ওখানে দাঁড়িয়ে? শিবদাসদা। একটা হাত শুধু কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না।
কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান ফিরেছিলো সাগ্নিকের। পাড়ার লোকরা ধরাধরি করে বাড়ি দিয়ে এসেছিলো। সেদিন অঙ্কিতা খেলা দেখতে আসেনি। রূপসের কবিতা পাঠের আসরে গিয়েছিলো। অনেক রাতে ফোন করেছিলো অঙ্কিতা, "ওমা তুমি পড়ে গেছ্যো প্রশান্ত বললো। লাগেনি তো? শোনো না আজকে দারুণ এনজয় করলাম। রূপস যা কবিতা পড়লো না। সবাই অবাক। আর শোনো। কি শুনছো তো? জয় গোস্বামীর সাথে আলাপ হলো। কি সুইট হ্যালো হ্যালো শুনতে পাচ্ছো? কী হলো? হ্যালো"। সাগ্নিক রিসিভার নামিয়ে রেখেছিলো। একো চাঁদের আলো এলো কোথা থেকে? খাটটা ভিজে যাচ্ছে। গোলপোস্টের বাশে দাঁড়িয়ে কতদিন পরে অমনভাবে শিবদাসদা খেলা দেখছিলো। এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সাগ্নিক বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলো। রাতে যারএসে মা আলো জ্বালালেন। "বাবি...বাবি..."। সাগ্নিক কোনো উত্তর দিলো না। রক্ত পেচ্ছাপে ভেসে গিয়েছিলো চাদরটা। সকালে যখন হুঁশ হলো তখন কোমরে অসহ্য যন্ত্রণা। বিন্দু বিন্দু জল এলিয়ে পড়ছে স্যালাইনের নলে। চোখ মেলতেই শুভঙ্করকে দেখেছিলো। কি অমলিন হাসি ছেলেটার। গালে টোল পড়ছিলো। সাগ্নিকের হঠাৎ ভালো লেগে গেলো সেই সকালটা। চারপাশের সাদা দেওয়াল গায়ে তুললো রামধনু রঙের জার্সি। রেফারির হুইসিল শোনা গেলো। আবার ভিজে ঘাসের গন্ধ এসে লাগলো চোখে মুখে।
তিনতলার নয় নম্বর কেবিনের পেশেন্টের অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তার মুখার্জিকে রাতেই খবর দেওয়া হয়েছিলো। উনি এসে দেখে গেছেন। সাগ্নিক বসু এখন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। মণিমালা সিঁড়ি ভেঙে উঠছিলেন। লিফট খারাপ। ভারী চেহারার মানুষ মণিমালা। ওপরে ওঠার কষ্ট পরতে পরতে বুঝতে পারছিলেন। তিনতলায় ইনটেনসিভ কেয়ার সামনে যখন এলেন তখন শরীরের সমস্ত রক্ত যেন জল হয়ে গেছে। বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ছে। দম নেওয়ার জন্যে হাঁসফাঁস করছেন তিনি। সিঁড়ির মুখটাতে রাতের সেই বৃদ্ধা আয়া দাঁড়িয়ে। মণিমালার কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছিলো। হাঁফাতে হাঁফাতে জিজ্ঞেস করলেন, "কী কী হয়েছে...?" বৃদ্ধা হাত ধরে নিলেন মণিমালার। সিঁড়ির শেষ ধাপটা উঠতে সাহায্য করলেন। "রাতে, শেষ রাতে...হাত-পা সব ঠান্ডা... নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট...কি ঘাম গো তোমার ছেলের।" দরজা ঠেলে এগিয়ে যান মণিমালা। কাঁচের দেওয়ালের বাইরে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অদূরে তাঁর একটি মাত্র ছেলে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। ডাক্তার মুখার্জিও আশ্বাস দিতে পারছেন না। "মা..."। মণিমালা ফিরে তাকান। "কাল কথা বলছিলো খোকা"...। মণিমালা সরে আসেন বৃদ্ধার কাছে। "ওর জিভ... জিভটাতে কোনো সাড় নেই। কথা বলতে পারে না বাবি...। আজ মাস ছয়েক হয়ে গেলো। তোমার রাতে ঘুম হয়নি..."। কিন্তু নাছোড় বৃদ্ধা। "আমি স্পষ্ট শুনেছি মা... শিবদাসের কথা বলছিলো তোমার ছেলে।" মণিমালা এবার একটু বিরক্ত। "কে শিবদাস?" "তা আমি কী করে জানবো মা?... তবে ওই নামে আমার একটা ছেলে ছিলো।... বহুদিন তার কোনো খোঁজ নেই...।” ভাইব্রেশানে থাকা মোবাইল বেজে ওঠে। মণিমালা কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সাগ্নিকের বাবার সঙ্গে। নার্স এসে মণিমালাকে ডাকেন। ডাক্তার সোম কথা বলতে চান। "এখানে যে বয়স্ক এ্যাটেনডেন্স ছিলেন?" মণিমালা বৃদ্ধাকে খোঁজেন। নার্স জানায় চলে গেছে সে। কাল ছুটি। পরশুদিন আসবে।

আকাশে মেঘ করেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামবে। গুমোট গরমের এই বিকেল বৃষ্টি সাগ্নিকের খুব প্রিয়। ছুটে চলে যায় চিলেকোঠার ঘরে। বৃষ্টির ছাঁট লাগছে খড়খড়ি জানলায়, মার তুলসি গাছের টবে, কোন্টিদের বাড়ির টিয়া পাখির খাঁচায়। দূরে আলসের মাথায় একটা কাক মজা করে ভিজছে। এসব চেনা ছবি। এতো আনন্দের মধ্যে এইসব দেখতে আসেনি সাগ্নিক। কানাই ওকে ডেকেছে, বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে মাঠের খেলা দারুণ জমবে। সাগ্নিক যেতে পারবে না বলে ইশারা করে। কানাই তাকে না নিয়ে যাবে না। বৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজতেথাকে। কি মনে হয় সাগ্নিকের ছুটে চলে আসে নীচে। জার্সি শর্টস পরে নেয়। বুট পরতে যাবে, বৃষ্টির দিকে তাকায়, পরে না। পিছনের দরজা দিয়ে কানাইয়ের কাছে চলে আসে চুপি চুপি। হৈ হৈ করে ভিজতে ভিজতে সবে এইট থেকে নাইনে ওঠা দুই বন্ধু মাঠের দিকে ছোটে।
মাঠে তখন খেলা শুরু হয়ে গেছে। শিবদাসদা নিজেই খেলাচ্ছে। না না রনিকে না ওদিকে প্রশান্ত ফাঁকা। এভাবে খেললে কোনোদিন শিখতে পারবি না তোরা। সাগ্নিক আর কানাই পেছনে এসে দাঁড়ায়। শিবদাস ওদের দুজনকে দু-দিকের দলে ঢুকিয়ে দেয়। খেলা চলতে থাকে। বৃষ্টি, কাদা, জলে মাখামাখি হয়ে ছেলেগুলো খেলতে থাকে। শিবদাস চিৎকার করে, "ওখানে ওভাবে নয় কানাই, ওভাবে ট্যাকল করলে চলবে না। সাগ্নিক বলটা নিয়ে উঠতে থাক রণিকে বাড়া। বৃষ্টি ধরে আসে। খেলাও শেষ হয়। কাদামাখা ছেলের দল পুকুরে স্নান করতে নামে। জলে নেমে ঝাঁপাঝাঁপি করে। সাগ্নিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। পুকুরে নামে না। সারা গায়ে লেপটে থাকে কাদা মাখা ছোটো ছোটো ঘাস। চোখ বন্ধ করে ভিজে ঘাসের গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করে। শিবদাস পাশে এসে দাঁড়ায়।" ঠিক এইভাবে খেললে একদিন তুই অনেক বড় হবি। সকালে প্র্যাকটিসে আসছিস না কেনা সাগ্নিকের কাঁধের ওপর হাত রাখে শিবদাস। সাগ্নিক কোনো কথা বলে না। জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব শীত করে তার, খুব শীত। কাঁপুনি লাগে। শিবদাসের হাত ধরতে চায়। কিন্তু কোথায় শিবদাসনা। পুকুরের চারিদিকে শুধু লোকের ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে সাগ্নিক দেখে দুটো পা ঠেকে আছে পুকুরের ঘাটে। শিবদাসদার চোখ দুটো খোলা।
মণিমালা তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলেছেন পুরনো প্রেসক্রিপশানটা প্রথমবার সাগ্নিককে যখন দেখানো হয়েছিলো, তাও প্রায় বছর। তিনেক আগের কথা। কে যেন দেখে ছিলেন? মনে করার চেষ্টা করেন মণিমালা। কিছুতেই মনে পড়ে না। কাজের মেয়ে পুতুল দাঁড়িয়ে ছিল দরজার কাছে। 'কিছু খুঁজছেন দিদি'। মণিমালা না তাকিয়েই উত্তর দেন "বাবির প্রেসক্রিপশান'। পুতুল ঘরের মধ্যে ঢেকে, "সেতো আলমারিতে"। মণিমালা অবাক হয়ে ফিরে হয়ে ফিরে তাকান, "তুই জানলি কী করে?" পুতুল মেঝেতে বসে পড়ে, "বারে সেদিনই তো ফটো টটো তুলে নিয়ে এসে ওই আলমারীতে রাখলেনা। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। সচরাচর যেটা তিনি করেন না, অপছন্দ করেন সেটাই করলেন মণিমালা। চিৎকার করে বললেন, 'সেগুলোতো নতুন। আমি পুরোনোটা খুঁজছি। কাজের সময় বিরক্ত করিস না। নীচে গিয়ে দেখ গ্যাসে কী বসিয়ে এসেছিস পোড়া গন্ধ বেরেছে"।
পোড়া ভাতের গন্ধে গোটা বাড়ি যখন ম.ম করছে তখন মণিমালা চিলেকোঠার ঘরে। অনেকদিনের পুরোনো কাঠের আলমারিটা খোলার চেষ্টা করছেন। একটু জোরে টান দিতেই দরজাটা খুলে গেলো। হুড়মুড় করে পড়লো কাগজের বান্ডিল, ছেঁড়া খাম, কতকগুলো পুরোনো ফাইল। সাগ্নিকের বাবার আলমারি, পরে সাগ্নিক ব্যবহার করতো। দেরাজটা খুলতে পারছেন না। অনেক টানাটানি করেও না। পাশের তাকে রাখা ফাইলের দিকে নজর পড়লো। ফাইল খুলে বসলেন মণিমালা।
কয়েকটি ছবি তাঁর আর সাগ্নিকের বাবা সুবীরবাবুর। বহুদিন আগের লেখা চিঠি: সেসব তো এখন ইতিহাস। কিন্তু এগুলো এখানে এলে ই করে? মণিমালা খুঁজতে থাকলেন যদি আরো কিছু পাওয়া যায়। ছেলের আলমারিতে তাঁদের বিগত প্রেমের চিঠি। এসব কি সাগ্নিক পড়েছে। কং যে এতোবড় হয়ে গেলো ছেলেটা? ভাবেন মণিমালা, এই তো সেদিনের কথা। হাতের কাছেই পেলেন বেশ পুরোনো একটা এ্যালবাম। সাহিতে। ছোটোবেলার ছবি কানাইয়ের সাথে সাগ্নিক, ওদের ফুটবল টিমের গুণ ফটো। শিবুর সাথে সাগ্নিক। "শিবু ছেলেটা বাড়িতে খুব আসতো। বিড়বিড় করেন মণিমালা। "বাবিদের কোচ। রেললাইনের পাশের। কলোনীতে থাকতো। বাবি আর কানাইকে খুব ভালোবাসতো। জলে দ্বার মারা যায়। কেউ বলে সুইসাইড, তবে অনেকের মতে খুন হয়েছিলো শিবু।" পুরো নামটা মনে করার চেষ্টা করেন কিন্তু পারেন না। কানাইট। নেই, বন্ধুদের মধ্যে ওর সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিলো এই বাড়িতে। তি একটা চাকরী পেয়ে মুম্বাইয়ে চলে গেছে। কলিংবেলের শব্দ হয় একবার নয় পরপর দুবার। পুতুল এসে বলে চিঠি এসেছে সই করে নিতে হবে। মণিমালা একটু অবাক হন, সই করে পিওনের কাছ থেকে পান একটাবড়সড় খাম। ওপরে লেখা সাগ্নিকের নাম ঠিকানা। কে পাঠিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। স্লিপে লেখা আসানসোল নামটা শুধু চোখে পড়লো। অন্যসময় হলে তিনি ছেলের জিনিস খুলতেন না, কিন্তু সাগ্নিক আজ বেঁচেও মৃত। তার বাহ্যিক জ্ঞান যেটক ছিলো আজ সকালের পরে সেটাও আর নেই। এই বয়েসে একমাত্র ছেলের মরা মুখ দেখতে হবে। শিউরে ওঠেন মণিমালা। সত্যি এইভাবে ভাবার সময় পাননি। গত তিন বছর তাঁকে শুধু হসপিটাল আর বাড়ি করতে হয়েছে। ছুটতে হয়েছে রাজ্যের বাইরেও। কেউ আশ্বাস দিতে পারেননি। তবুও বুক বেঁধে ছিলেন। কি একটা মনের জোর তাঁকে এক ডাক্তারের চেম্বার থেকে আর এক ডাক্তারের চেম্বারে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াতো। ঘরে ফিরে আসেন মণিমালা। প্যাকেট খোলার চেষ্টা করেন, হাত দিয়ে না পেরে কাঁচির সাহায্য নেন। কাটতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে ভেতরের জিনিসপত্র। মেঝের চারিদিকে ছড়িয়ে যায় অঙ্কিতা আর সাগ্নিকের ছবি। সাগ্নিকের লেখা বেশ কয়েকটা চিঠি। মণিমালা সেগুলো তাড়াতাড়ি তুলে নেন, পাছে পুতুল দেখে ফেলে।

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। শেষ বিকেলের আলো ভালো লাগে অঙ্কিতার। রূপসের ভালো লাগে কিনা সেটা এখন আর বুঝতে পারে না। সারাদিন লেখালেখি তারপর বন্ধুদের সাথে আড্ডা, রাত দুপুরে নেশায় টালমাটাল হয়ে বাড়ি ফেরা। গত দুবছরে বিবাহিত জীবনে এরচেয়ে বিশেষ কিছু পরিবর্তন আসেনি তাদের। কবি হয়েও শেষ বিকেলের আলো কেন যে ভালো লাগে না রূপসের সে কথা ভাবতে ভাবতে ছাদে এসে অঙ্কিতা দেখে সারা আকাশ লালে লাল। হঠাৎ গোধূলীর সেই পরিবেশে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন অনেকদিন পর ফিরে পায়। "আরে তুই এখানে? আর আমি তোকে গোটা বাড়ি খুঁজে মরছি"। অঙ্কিতা ফিরে দেখে সাগ্নিক। "একটু দাঁড়া না"। এগিয়ে আসে অঙ্কিতা। ভীষণ ব্যস্ত সাগ্নিক, "বুঝতে পারছিস না এখনি ক্লাবে যাওয়া দরকার"। আরো কাছে এসে দাঁড়ায় অঙ্কিতা। "আর আমি ডাকছি সেটা দরকারের নয়?" শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে অঙ্কিতার মুখে... বুকে... সারা শরীরে... তার উথলে ওঠা যৌবনে। সাগ্নিক তাকিয়ে থাকে। "কি সুন্দর তুই..."। অঙ্কিতা টেনে নেয় সাগ্নিককে। গোধূলির সেই আলোতে খুব কাছাকাছি দুজনে। খুব ঘনিষ্ঠ। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে তারা ভালোবাসার উষ্ণতা মাপে। এবার অঙ্কিতা লজ্জা পায়। সাগ্নিক আরো কাছে টেনে নিতে চায় তাকে আর ঠিক সেই সময়ে অঙ্কিতা বুঝতে পারে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে সাগ্নিকের।
"জ্বর তোর"।
"তাতে কী?"
"মানে... পাগল হলি নাকি? নীচে চল।"
"না, ভালো লাগছে তোর সাথে থাকতে।"
"আজ আর তুই খেলতে যাস না। রাতে নেট প্র্যাকটিসের দরকার নেই।"
সাগ্নিক যা বলতে চায়নি, এতদিন মনে মনে যা রেখে দিয়েছিলো
তা যেন হঠাৎই বেরিয়ে পড়লো।
"আমাকে ছেড়ে চলে যাবি না তো তুই?"
"কি যাতা বকছিস?"
"তোর সাথে রূপসের বন্ধুত্বটা বুঝতে চাই"।সাগ্নিক দুহাতে তুলে ধরে অঙ্কিতার মুখ।
"ভালোবাসিস তুই রূপসকে?"
অঙ্কিতা চোখ সরিয়ে নেয়।
"পাগলামি করছিস আমাদের নীচে যাওয়া উচিত"।
"কেন?"
"তোর শরীর খারাপ।...আর তোর মতো ছেলের সন্দেহ করা উচিত নয়।"
"জানি আর এটাও জানি আমার শরীর খারাপ... কয়েকদিন হলো জ্বর হচ্ছে, আর এতই যখন চিন্তা আমাকে ফেলে বেড়াতে যেতে ভালো লাগছে?"
"আমাকে যেতেই হবে সাগ্নিক। আমি না গেলে রূপসের যাওয়া হবে না। এই টারটা ওর দরকার। মা মারা যাওয়াতে বেচারা একা হয়ে পড়েছে"।
একটানা বলে যায় অঙ্কিতা। একটানা কর কথা বলতো সেদিনের সেই মেয়েটা। সাগ্নিক কি কিছু বলেছিলো? মনে করার চেষ্টা করে। না কিছু বলেনি নীচে নেমে গিয়েছিলো চুপচাপ। অঙ্কিতাও কি কষ্ট পায়নি তাতে? পেয়েছিলে। কিন্তু অন্য এক বৃত্তে তখন সে ছিলো সংবৃত। রূপস তার শরীরে... মনে ভালোলাগায় ভালোবাসায়... কথায়... বুদ্ধিতে অঙ্কিতাকে নিয়ে গিয়েছিলো সাগ্নিকের থেকে দূরে... বহুদূরে। এবার অঙ্কিতার কেমন শীত শীত করতে লাগলো। এই অসময়ে শীত করার কারণটা ঠিক সে বুঝতে পারলো না। ছাদ থেকে নীচে এলো সে। আজ সকালে শুধু রূপস ঝগড়া করেছে বলেই, শুধু রূপস চাইছে না বলেই সাগ্নিকের সব চিঠি, সব ছবি সে পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু পারেনি। সত্যি পারেনি। রূপস বেরিয়ে যাওয়ার পর সব কিছু পোষ্ট করে দিয়ে এসেছে। সাগ্নিকের যদি মনে নাও থাকে, তাহলেও। আর বিশেষ কিছু ভাবেনি অঙ্কিতা। একটা সম্পর্ক সে যেমন নিজে হাতে শেষ করে আসতে পেরেছে তেমন শেষ চিহ্নটুকু হারাতে কষ্ট হলেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। সেটা অনেকরাতে বাড়ি ফিরে বুঝতে পেরেছিলো রূপস। না আসল ঘটনার সারবত্তা হয়তো কিছুই বুঝতে পারেনি শুধু একটু অনুমান করতে পেরেছিলো তার বউ জ্বরে। বেঁহুশ। টালমাটাল পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলো ফোনের দিকে ডাক্তারকে খবর দেওয়ার জন্যে,। আর অঙ্কিতা তখন জ্বরের ঘোরে খেলার মাঠে। এইমাত্র হারা খেলাটা যে ছেলেটা জিতিয়ে দিলো তার মুখের দিকে না তাকিয়ে সে পারছিলো না। সরাসরি ছেলেটার সাথে কথা বলতে চলে। গেলো। আর ডাক্তারের কথা শুনে রূপস গেলো ওষুধ আনতে। এইমাত্র জানতে পেরেছে সে বাবা হতে চলেছে। আজ তার আনন্দ একটু বেশি।
মণিমালা শুয়ে ছিলেন। পুতুল ঘরের আলো জ্বালিয়ে সন্ধ্যে দেখালো।
পাশের বাড়িতে শাঁখ বাজছে। মণিমালা উঠে বসলেন। মাথা ধরেছে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলেন। আজকাল আর এমনিতে ঘুম আসে না। কাল ভোর রাতে নার্সিংহোম থেকে ফোন আসতে শুরু করেছিলো। আজ আর তেমন কিছুই করার নেই। যেকোনো সময়ে যা কিছু ঘটে যেতে পারে।

হ্যাঁ, সাগ্নিক আর থাকবে না। তারপর মণিমালার কী হবে? সে কথা ভাবতে ভালো লাগছে না এখন। আর ভেবে সত্যিই কিছু করা যায় না। আমরা কিছুই করতে পারি না। অনেক সময় হাতের বাইরে থেকে যায়সব কিছু।
বিছানার মাথার দিকের জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। হাওয়াটা খুব একটা ভালো লাগছে না। আজ সাগ্নিকের বাবার কোনো ফোন আসেনি। হয়তো আসবে না আর। যখন জেনে গেছেন তাঁর একমাত্র ছেলের আর কোনো ভাবেই বাঁচার চান্স নেই তখন যোগাযোগ বা ফিরে আসার কোনো সুযোগ হয়তো নেবেন না। গত দুবছরে সুবীরের সাথে দূরত্ব বেড়েছে। গত দুবছরে সুবীরের ব্যবসা ছড়িয়েছে দেশে-বিদেশে আর মণিমালা হয়ে গিয়েছেন একা। এক বছরের সেপারেশানে আছেন তাঁরা। ছেলে জানেও না। লাল, নীল রঙিন মাছেই সে খুশি। বাবার দেওয়া জেলিফিসটা সে সঙ্গে নিয়েই বেড়ায়। এখন অবশ্য জানলার কোণায়। মণিমালা নিয়ে এসেছেন। নার্সিংহোমের ইনটেনসিভে মৃতপ্রায় মানুষের কাছে তার আর কি মূল্য থাকতে পারে? পরশু থেকে মোবাইল চার্জ দেওয়া হয়নি। চার্জে বসালেন। পুতুল চা দিয়ে গেলো।

অনেক রাতে ঘুমের মধ্যে শিবদাস আর ফিরে এলো না। সাগ্নিকের ঘুম ভালো হওয়ারই কথা ছিলো কিন্তু তার পাশে তখন ডাক্তারদের ভিড়। প্রত্যেকেই একটা ডিসিশান নেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রত্যেকের মুখ গম্ভীর। সাগ্নিক বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে করণীয় কী? তার সমস্ত দেহ ভার। এদিক ওদিক তাকিয়েও বৃদ্ধা আয়া বা জেলিফিস কাউকেই দেখতে পেলো না। শুধু বুঝতে পারলো তার ঘর পরিবর্তন হয়েছে। এই ঘরের মানুষদের সে চেনে না। শুভঙ্করকে দেখতে ইচ্ছে করলো ইচ্ছে করলো শাদা দেওয়ালকে রামধনু জার্সি পরাতে ইচ্ছে করলো ছুটে চিলেকোঠায় যেতে ইচ্ছে করলো ভিজে ঘাসের গন্ধ গেতে ইচ্ছে করলো এমন আরো অনেক কিছুর।
ঠিক মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো মণিমালার। ঝড় উঠেছে... জানলার ভারী পাল্লাটা দড়াম দড়াম করে পড়ছে। ঠিক কটা বাজে বোঝার উপায় নেই। আর সত্যি বলতে কি ইচ্ছেও নেই। মণিমালা পাশ ফিরে শুলেন। কিন্তু পাল্লার বিকট শব্দ আর তুমুল ঝড় মণিমালার বিষন্ন শরীরকে নিশ্চুপ থাকতে দিলো না। আলো আঁধারির মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে খুঁজে পেলেন বেড সুইচ। আলো জ্বলে উঠলো ঘরে। খাট থেকে নামতে গিয়ে দেখলেন ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ছে সকালের ডাকে আসা ছবিগুলো। কিছু উড়ছে, কিছু জলে ভিজে সেঁটে আছে চৌকাঠের ধারে লাল মোমপালিশ মেঝেতে। ভিজছে সাগ্নিক ভিজছে অঙ্কিতা ভিজছে বিগত সময়।
আর ঠিক এই সবের মধ্যে ফোনটা বেজে উঠছে। বাজতে থাকছে.... অবিরাম অবিশ্রান্ত তার বেজে চলা। মণিমালা সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করছেন না। এগিয়ে যাচ্ছেন উড়ন্ত ছবিগুলোর দিকে, আলগোছে হারিয়ে যাওয়া সময়কে ধরতে। বৃষ্টির জলধারা লাগছে তাঁর চোখে, মুখে, ক্লান্ত বিরামহীন শরীরে। আজ এই মূহুর্ত থেকে... পুত্রশোকের, অশৌচের... যে ছোঁওয়া লাগবে তাঁর গায়ে তার ছিটেফোঁটাকেও ধারে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না মণিমালা। বরং ভারী শরীরটা নিয়ে বসে পড়ছেন মেঝেতে। যত্ন করে তুলে রাখছেন সাগ্নিককে, অঙ্কিতাকে, তাদের ভিজে যাওয়া জলছবিকে।
Commenti