top of page

অরণ্য ষষ্ঠী, জামাইষষ্ঠীর খাওয়া দাওয়া, রাজস্থানের রাজকীয় ইতিহাস: মেহরানগড় দূর্গ, সক্রেটিস ও জ্যানথিপি, প্রকৃতির মায়াবী সুগন্ধে বিজ্ঞানের ছোঁয়া, রবিবারের গল্প: সর্ষেক্ষেতে ভূত

অরণ্য ষষ্ঠী: প্রকৃতির কোলে মাতৃত্বের আরাধনা

আষাঢ়ের সকালে যখন প্রকৃতি স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে নরম রোদের আলোয়, পাখির কুজন আর গাছের পাতায় শিশিরের ঝিকিমিকি, সেই সময়েই বাংলার ঘরে ঘরে মােরা প্রস্তুত হন এক প্রাচীন, আবেগঘন ও আত্মিক ব্রত পালনের জন্য। সেই ব্রতের নাম: অরণ্য ষষ্ঠী। ষষ্ঠী মানেই শিশুর মঙ্গলকামনায় নিঃস্বার্থ প্রার্থনা। আর অরণ্য ষষ্ঠী হল সেই প্রার্থনার প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ রূপ। 'অরণ্য' অর্থাৎ বন বা গাছতলা, যেখানে প্রকৃতি ও মাতৃত্বের এক পবিত্র মেলবন্ধন ঘটে। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই ব্রত বাংলার মাটিতে পালিত হয়ে আসছে, যেখানে ষষ্ঠী ঠাকুর, সন্তানদের রক্ষাকর্ত্রী দেবী, তাঁর ভক্ত মােদের কোল ভরে সন্তান দেন, আর সন্তানদের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু বরদান করেন।

ব্রতের আচার ও বিশ্বাস

এই দিনে উপবাসিনী মােরা ভোরবেলায় গাছতলায় যান। বট, অশ্বত্থ বা আমগাছের তলায় ষষ্ঠী দেবীর প্রতিমা বা প্রতিকৃতি স্থাপন করে পূজা দেন ফল, ফুল, সুজি, নাড়ু, স্নান করানো জামাকাপড়, খই ও দধি সহযোগে। কৌথ বা পাটার ওপর আঁকা ষষ্ঠী ঠাকুরের চিত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ মাটির পটেও আঁকেন দেবীকে, যাঁর কোলে শিশু, মাথায় মুকুট, আর আশেপাশে কাঁসর ঘিরে রাখে মায়েরা। এদিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হল ষষ্ঠীর কাহিনি পাঠ। দেবীর মহিমা ও মাতৃত্বের গুরুত্ব বুঝিয়ে এই কাহিনি মােরা ছেলেমেয়েদের শোনান, প্রজন্মান্তরে ঐতিহ্য বয়ে চলে।

প্রকৃতি ও পূজার যোগসূত্র

অরণ্য ষষ্ঠীর অন্যতম তাৎপর্য হল প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা। আজকের দূষিত, যন্ত্রনির্ভর জীবনে এই উৎসব যেন প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার এক অবচেতন প্রচেষ্টা। শিশুদের জীবনে প্রকৃতির ভূমিকা, এবং তাকে রক্ষা করার গুরুত্ব এই পূজার মাধ্যমে অনুধাবন করা যায়।


সমকালীন প্রেক্ষাপটে অরণ্য ষষ্ঠী

আজকের দিনে এই ব্রতের তাৎপর্য আরও গভীর। মাতৃত্বের প্রতি সম্মান, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, এই সব কিছু মিলিয়ে অরণ্য ষষ্ঠী এক সামাজিক বার্তা বহন করে। এই উৎসব নতুন প্রজন্মকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আনতে, তাদের জীবনে শিকড়ের টান ফিরিয়ে আনতেও সাহায্য করে।

দেবী ষষ্ঠীর বাহন পুজোর ইতিহাস ও তাৎপর্য

ষষ্ঠী দেবী হিন্দু লোকবিশ্বাসে সন্তানরক্ষাকারী দেবী হিসেবে পরিচিত। বাংলার ঘরে ঘরে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মা ষষ্ঠীর প্রতি এক গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধা রয়েছে। তাঁর পুজোর সময় শুধু দেবীর নয়, তাঁর বাহন ‘বিড়াল’-এরও পূজা করা হয়। এই প্রথার পেছনে আছে পুরান-নির্ভর এক কাহিনি এবং বহু প্রাচীন সামাজিক বিশ্বাস।


বাহন পূজার সূচনা: পৌরাণিক ভিত্তি

দেবী ষষ্ঠীর বাহন ‘বিড়াল’ (স্থলজ প্রাণী হলেও দেবীর বাহন হিসেবে পূজিত) কে কেন্দ্র করে একটি জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত: এক সময়ের কথা, একটি পরিবারে এক গরিব গৃহবধূ মা ষষ্ঠীর ব্রত করতেন না, বরং প্রতিনিয়ত দেবীর পূজার জন্য রাখা ফল-ভোগ লুকিয়ে খেয়ে ফেলতেন। এমনকি মা ষষ্ঠীর বাহন বিড়ালটির বাচ্চাও মেরে ফেলেন। এতে রুষ্ট হয়ে মা ষষ্ঠী তাঁর সন্তানকে চুরি করে নিয়ে যান। পরে বহু কষ্টে গৃহবধূ দেবীর কাছে ক্ষমা চান এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি প্রতি বছর দেবী ও তাঁর বাহনের পূজা করবেন। সেই থেকেই মা ষষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর বাহন বিড়ালের পূজার রীতি চালু হয়।

লোকবিশ্বাস ও সংস্কৃতি

বিড়ালকে ষষ্ঠীর বাহন হিসেবে পূজা করার মূল তাৎপর্য হচ্ছে মাতৃত্ব, করুণা ও সন্তানরক্ষা। বিড়াল যেমন নিজের বাচ্চাকে নিঃস্বার্থভাবে আগলে রাখে, তেমনি মা ষষ্ঠীও সন্তানের রক্ষাকর্ত্রী। এই বাহন পূজার একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক দিকও রয়েছে। পশুপাখির সঙ্গে সহাবস্থান, তাদের মর্যাদা দেওয়া এটি বাংলার লোকজ সংস্কৃতির একটি পরিচায়ক।


পূজার প্রথাগত রীতি

* ষষ্ঠীপুজোর দিন গৃহিণীরা কাঁচা হলুদের গুঁড়ি, ধান, দুগ্ধ, কলা, চিরতা প্রভৃতি দিয়ে ষষ্ঠীদেবীর প্রতিমা এবং তাঁর বাহন (প্রায়শই মাটির তৈরি বিড়াল মূর্তি) পূজা করেন।

* কিছু এলাকায় বাচ্চাদের সুরক্ষার জন্য বিড়ালের গায়ে আলপনা কাটা বা সিঁদুর পরানোর রীতি প্রচলিত।

* কখনো কখনো বিড়ালের মাটি বা কচি ডাল দিয়ে প্রতীক নির্মাণ করে পূজো করা হয়।

ষষ্ঠী দেবী ও তাঁর বাহন পূজার প্রথা মূলত এক যৌথ বিশ্বাস, যেখানে সন্তান, প্রকৃতি ও মা-সত্তার মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই বিশ্বাস আজও বাংলার সমাজে জীবন্ত, কারণ এতে মিশে আছে মানুষের আশা, প্রার্থনা আর সংস্কৃতির শিকড়। শুধু এক ধর্মীয় আচার নয়, অরণ্য ষষ্ঠী হল এক আবেগ। মা ও সন্তানের মধ্যে এক পবিত্র বন্ধন, যেখানে প্রকৃতিও সাক্ষী হয়ে থাকে। এই পুরনো প্রথাকে আধুনিক মননে ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

জামাইষষ্ঠীর খাওয়া-দাওয়া: পাতেপূর্ণ প্রেম আর পদে পদে আতিথ্য

বাংলার ঘরে জামাইষষ্ঠী যেন শুধুই এক ধর্মীয় আচার নয়, বরং এক আবেগের উৎসব। বছরের এই একদিন শাশুড়ি মা’র ভালোবাসা আর আদর যেন ভরপুরভাবে উজাড় হয়ে যায় জামাইয়ের পাতের পর পাতে। পঞ্চব্যঞ্জন তো বটেই, তার সঙ্গে থাকে জামাইয়ের পছন্দের মাছ, মাংস, মিষ্টি আর নানা রকমের ঘরোয়া পদ। খাবার এখানে শুধু স্বাদ নয়, সম্পর্কের গভীরতাও প্রকাশ করে।

লুচি-আলুর দম: বাঙালির ভালোবাসার শুদ্ধ সকালের নাম

একটা ভাপ ওঠা গরম লুচি, আর সঙ্গে মশলাদার, একটু ঝাল-ঝোল মাখা আলুর দম এ যেন শুধু খাদ্য নয়, বাঙালির আবেগ। কোনও বিশেষ দিনে নয়, যেকোনো সকালে এই জুটি হাজির হলে মনটাই যেন উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। লুচি, সেই সাদা, তুলতুলে ভাজা যা মুখে দিলেই গলে যায়। তার পাশে থাকে আলুর দম টমেটো, আদা, ঘি আর গরম মশলার মেলবন্ধনে তৈরি, এমন এক পদ, যার সঙ্গে চট করে চলে যায় আরও একটা লুচি... তারপর আরেকটা! পুজোর সকালে, জামাইষষ্ঠীতে, বা নিরামিষ রবিবারে লুচি-আলুর দম মানেই ঘরের উষ্ণতা, মা’র হাতের আদর, আর ছোটবেলার সেরা স্মৃতির স্বাদ।


লুচি


কী কী লাগবে

  • ময়দা – ২ কাপ

  • সাদা তেল / ঘি – ২ টেবিল চামচ

  • লবণ – আধ চা চামচ

  • জল – পরিমাণমতো (মেখে নেওয়ার জন্য)

  • সাদা তেল – ভাজার জন্য


কীভাবে বানাবেন

  • একটি বড় বাটিতে ময়দা, লবণ ও ২ টেবিল চামচ সাদা তেল মিশিয়ে নিন।

  • অল্প অল্প জল দিয়ে শক্ত করে মেখে নিন। ১৫–২০ মিনিট কাপড় ঢেকে রাখুন।

  • ছোট ছোট লেচি কেটে বেলে নিন ছোট গোল রুটির মতো (খুব পাতলা নয়)।

  • কড়াইয়ে তেল গরম করে এক এক করে লুচি ছেড়ে দিন।

  • ফুলে উঠলে উল্টে দিন, দুই দিক সোনালি হলে তুলে নিন।


কাশ্মীরি আলুর দম


কী কী লাগবে

  • ছোট আলু – ১০–১২টা (সিদ্ধ করে খোসা ছাড়ানো)

  • টমেটো – ২টি (বাটা)

  • আদা বাটা – ১ চা চামচ

  • শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো – ১ চা চামচ

  • হলুদ – ½ চা চামচ

  • জিরে গুঁড়ো – ১ চা চামচ

  • গরম মসলা – ½ চা চামচ

  • নুন ও চিনি – স্বাদমতো

  • সর্ষের তেল – ২ টেবিল চামচ

  • কাঁচা লঙ্কা – ২টি (ফাটা)


কীভাবে বানাবেন

কড়াইয়ে সর্ষের তেল গরম করে আদা বাটা দিন। তারপর টমেটো বাটা, লঙ্কা গুঁড়ো, হলুদ, জিরে গুঁড়ো দিয়ে কষাতে থাকুন। ভালো করে কষে নিলে সিদ্ধ আলুগুলো দিয়ে দিন। আলুতে মসলা ভালো করে মাখিয়ে দিন। প্রয়োজনে একটু জল দিন। নুন ও চিনি দিয়ে স্বাদ মাফিক ঠিক করুন। ঢেকে ৫–৭ মিনিট রান্না করে ওপরে গরম মসলা ও কাঁচা লঙ্কা ছড়িয়ে দিন। লুচির সঙ্গে কাশ্মীরি আলুর দম বা টক-মিষ্টি আলুর দমও দারুণ যায়।

ভাজা মুগ ডাল আর বেগুন ভাজা: সোনালি রঙে স্নিগ্ধ এক ঘরোয়া স্বাদ

বাঙালি রান্নাঘরের সবচেয়ে শান্ত, স্নিগ্ধ অথচ গভীর স্বাদের একটি পদ হল ভাজা মুগ ডাল। সরষের তেলে ভাজা শুকনো লঙ্কা আর তেজপাতার ফোড়নে যখন সোনালি রঙের মুগ ডাল মৃদু আঁচে ফোটে, তখন সেই গন্ধে ভরে ওঠে গোটা বাড়ি। চটজলদি কিছু নয়, আবার ভারী রাজকীয় আয়োজনও নয় এই ডালের সহজ সরল রূপেই লুকিয়ে থাকে বাংলার রান্নার সত্যিকারের আত্মা। গরম ভাত, লুচি বা খিচুড়ির সঙ্গে এই ডাল এক অনবদ্য জুটি তৈরি করে, আর মনে করিয়ে দেয় মায়ের হাতের সেই পরম যত্নের স্বাদ।


  1. কী কী লাগবে

    • আদা কুচি বা বাটা – ১ চা চামচ

    • মুগ ডাল – ১ কাপ

    • শুকনো লঙ্কা – ১–২টি

    • তেজপাতা – ১টি

    • হলুদ গুঁড়ো – ½ চা চামচ

    • নুন – স্বাদমতো

    • চিনি – ১ চা চামচ (ঐচ্ছিক, বাঙালির রেসিপিতে এটি থাকে)

    • ঘি – ১ চা চামচ (শেষে দেওয়ার জন্য)

    • সর্ষের তেল / সাদা তেল – ১ টেবিল চামচ

    • জল – পরিমাণমতো

    কীভাবে বানাবেন

    প্রথমে মুগ ডাল ভালো করে ধুয়ে শুকনো কড়াইয়ে হালকা ভেজে নিন যতক্ষণ না হালকা সোনালি গন্ধ আসে।

    এবার ওই ভাজা ডাল প্রেশার কুকার বা প্যানে ২.৫ কাপ জল দিয়ে সিদ্ধ করুন (খুব নরম নয়, মাঝারি নরম হলে ভালো)। কড়াইয়ে তেল গরম করে তাতে শুকনো লঙ্কা ও তেজপাতা ফোড়ন দিন। আদা কুচি বা বাটা দিন, নেড়ে নিন। সিদ্ধ ডাল, হলুদ গুঁড়ো, নুন ও চিনি দিন। ৫–৭ মিনিট ফোটান, প্রয়োজনমতো ঘন বা পাতলা করুন। শেষে ১ চামচ ঘি ছড়িয়ে দিন – এইটাই “ঘি দেওয়া ভাজা মুগ ডাল”-এর আসল স্বাদ। পাতে লুচি, বেগুন ভাজা বা আলু পোস্ত থাকলে সঙ্গে এই ডাল জমে ক্ষীর! চাইলে এতে নারকেল কুচি বা কাঁচা লঙ্কাও দিতে পারেন বাড়তি স্বাদের জন্য।

    চিংড়ি মালাইকারি: বাঙালির উৎসবের রাজপদ

    চিংড়ি মানেই বাঙালির ভালবাসা। আর সেই চিংড়ি যখন ঘন নারকেল দুধে স্নাত হয়ে, মৃদু মশলার আস্তরণে রান্না হয়, তখন তা হয়ে ওঠে এক রাজকীয় পদ চিংড়ি মালাইকারি। শুধু স্বাদ নয়, এই পদে আছে ঐতিহ্য, পারিবারিক স্মৃতি আর রবিবার দুপুরের গল্প। পূজা, বিয়ে বা জামাইষষ্ঠী চিংড়ি মালাইকারি ছাড়া যেন উৎসবই অসম্পূর্ণ। গরম ভাতের সঙ্গে তার মোলায়েম ঝোল আর চিংড়ির কোমলতা মিলেমিশে তৈরি করে স্বাদের এক অপূর্ব ধারা।


    কী কী লাগবে

    বড় চিংড়ি (গলদা হলে উত্তম) – ৮–১০টি

    নারকেল দুধ – ১ কাপ (ঘন)

    পেঁয়াজ বাটা – ২ টেবিল চামচ

    আদা বাটা – ১ চা চামচ

    রসুন বাটা – ১/২ চা চামচ

    হলুদ – ১/২ চা চামচ

    লঙ্কা গুঁড়ো – ১ চা চামচ

    গরম মশলা – ১/২ চা চামচ

    তেজপাতা – ১টি

    দারুচিনি, এলাচ – ১–২টি করে

    চিনি – ১/২ চা চামচ (ঐচ্ছিক)

    নুন – স্বাদমতো

    সর্ষের তেল – ৪ টেবিল চামচ

    ঘি – ১ চা চামচ (শেষে, ঐচ্ছিক)

    কীভাবে বানাবেন

    চিংড়িগুলো ভালো করে পরিষ্কার করে হালকা হলুদ ও নুন মাখিয়ে ভেজে তুলে রাখুন। কড়াইয়ে তেল গরম করে তেজপাতা, দারুচিনি, এলাচ ফোড়ন দিন। পেঁয়াজ বাটা, আদা-রসুন বাটা দিয়ে ভালো করে কষান যতক্ষণ না তেল ছেড়ে দেয়। এবার হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, নুন, সামান্য চিনি মিশিয়ে আরও কিছুক্ষণ নাড়ুন। এবার নারকেল দুধ যোগ করে মিশ্রণটা ৫–৭ মিনিট মিডিয়াম আঁচে ফোটান। ভাজা চিংড়ি যোগ করুন। ঢেকে ৫ মিনিট রান্না করুন যেন চিংড়ি পুরোটা সেঁকা হয়। ঝোল ঘন হলে গরম মশলা ও সামান্য ঘি ছড়িয়ে নামিয়ে নিন। গরম সাদা ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন। পাশে কাঁচা লঙ্কা ও লেবু থাকলে স্বাদ আরও বেড়ে যায়।

    সরষে ইলিশ: স্বাদে শঙ্খ, ঘ্রাণে গাঙ্গেয় গর্ব

    বাঙালির রসনার রাজা যদি ইলিশ হয়, তবে তার সিংহাসন নিঃসন্দেহে সরষে ইলিশ। সর্ষে বাটা, কাঁচা লঙ্কা আর সরষের তেলে মাখানো এই পদ শুধু এক রান্না নয় এ এক ঐতিহ্য, নদীমাতৃক বাংলার গর্ব। বর্ষার বৃষ্টিতে ভাতের গরম ভাপে যখন ইলিশের ঘ্রাণ মিশে যায়, তখন জানলা দিয়ে যেন ঢুকে পড়ে পদ্মার ঢেউ। এই পদ শুধুমাত্র স্বাদের নয়, এটা নস্টালজিয়ার, মা’র রান্নার, আর বাঙালির চিরন্তন প্রেমের প্রতীক।


    কী কী লাগবে

    ইলিশ মাছ – ৬–৮ টুকরো

    পেঁয়াজ বাটা – ১ টেবিল চামচ (ঐচ্ছিক)

    সরষে বাটা – ২ টেবিল চামচ (সাদা+কালো ১:১ অনুপাতে)

    কাঁচা লঙ্কা – ৪–৬টি

    হলুদ – ১/২ চা চামচ

    নুন – স্বাদমতো

    সরষের তেল – ৪–৫ টেবিল চামচ

    জল – আধ কাপ (ঝোল পাতলা করার জন্য)

    কীভাবে বানাবেন

    ইলিশ মাছ টুকরোগুলোতে নুন ও হলুদ মেখে ১০ মিনিট রেখে দিন। একটি বাটিতে সরষে বাটা, কাঁচা লঙ্কা বাটা, সামান্য হলুদ, নুন ও জল মিশিয়ে রাখুন। কড়াইয়ে সরষের তেল গরম করে (সুগন্ধ বের হওয়া পর্যন্ত), তাতে মশলার মিশ্রণ দিয়ে হালকা কষে নিন। এবার মাছের টুকরো গুলিকে সরষে মিশ্রণে সাজিয়ে দিয়ে ঢেকে দিন ৭–৮ মিনিট মিডিয়াম আঁচে। মাছ উল্টে দিয়ে আরও ৫ মিনিট রান্না করুন। শেষে কাঁচা লঙ্কা ফালি আর এক চামচ কাঁচা সরষের তেল ছড়িয়ে দিন।

    মাটন কষা: রবিবারের দুপুর, স্বাদের মহারাজা

    মাটন কষা এই দুটি শব্দেই যেন গরম ভাত, বাসনের টুংটাং, আর ঘরভরা গন্ধের এক দৃশ্য ফুটে ওঠে। বাঙালির রবিবারের দুপুর মানেই ছিল দুধে-ভাতে নয়, মাংস-ভাতে। আর সেই মাংস যদি হয় ঘন ঝোলের মোড়কে রান্না করা মাটন কষা, তবে সে তো শুধু খাবার নয়, বরং এক পারিবারিক আবেগ। মায়ের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়া, আদা-রসুন-পেঁয়াজে ধীরে ধীরে কষানো কষা যেখানে প্রতিটি ঝোলের ফোঁটায় লুকিয়ে থাকে এক এক পদের প্রেম, স্মৃতি আর স্বাদ।


    কী কী লাগবে

    খাসির মাংস – ১ কেজি

    পেঁয়াজ – ৫–৬টি (স্লাইস করে কাটা)

    আদা বাটা – ২ টেবিল চামচ

    রসুন বাটা – ১.৫ টেবিল চামচ

    টমেটো – ১টি (সিদ্ধ করে বাটা বা কুচি)

    দই – ১/২ কাপ

    হলুদ – ১/২ চা চামচ

    লঙ্কা গুঁড়ো – ১ চা চামচ

    ধনে গুঁড়ো – ১ চা চামচ

    জিরে গুঁড়ো – ১ চা চামচ

    গরম মশলা – ১ চা চামচ

    তেজপাতা – ২টি

    দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ – ২–৩টি করে

    সরষের তেল – ১/২ কাপ

    নুন ও চিনি – স্বাদমতো

    কীভাবে বানাবেন

    মাংস ধুয়ে দই, হলুদ, নুন, অর্ধেক আদা-রসুন বাটা ও অল্প তেল মিশিয়ে ১–২ ঘণ্টা মেরিনেট করুন।কড়াইয়ে তেল গরম করে তেজপাতা, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ ফোড়ন দিন। পেঁয়াজ কুচি দিয়ে সোনালি করে ভেজে নিন, তারপর বাকি আদা-রসুন বাটা দিয়ে কষান। এরপর টমেটো ও সব শুকনো মশলা দিয়ে ভালো করে কষান যতক্ষণ না তেল ছাড়ে। এবার মেরিনেট করা মাংস কড়াইয়ে দিয়ে মাঝারি আঁচে ধৈর্য ধরে কষাতে থাকুন এটাই "কষা"র আসল রহস্য। প্রয়োজনে অল্প অল্প করে গরম জল দিয়ে আরও কষান। মাংস নরম হলে গরম মশলা ছড়িয়ে ঢাকা দিন কিছুক্ষণ। গরম ভাত, বাসমতী পোলাও, অথবা লুচির সঙ্গে পরিবেশন করুন। পাশে কাঁচা পেঁয়াজ, লেবু ও কাঁচা লঙ্কা থাকলে স্বাদ দ্বিগুণ।

    পটলের দম: নিরামিষে রাজকীয় স্বাদের ছোঁয়া

    সবজি যখন স্নিগ্ধ আর মসলা যখন মৃদু তখন পাতে আসে পটলের দম। অনেকেই পটলকে ‘সাধারণ’ ভাবেন, কিন্তু যখন তাকে ভাজা, পুরভরা কিংবা ঘন মশলার ঝোলে দমে রান্না করা হয় সে তখন হয়ে ওঠে নিরামিষ রসনার এক সেরা প্রতিনিধি। পূজোর ভোগ, নিরামিষ রোববার, বা অতিথি আপ্যায়ন পটলের দম এমন এক পদ, যা সহজ অথচ প্রভাবশালী।


    কী কী লাগবে

    • পটল – ৮–১০টি

    • পেঁয়াজ বাটা – ২ টেবিল চামচ

    • আদা বাটা – ১ চা চামচ

    • টমেটো – ১টি (বাটা)

    • দই – ২ টেবিল চামচ (ঐচ্ছিক, ঘনতা ও স্বাদ বাড়ায়)

    • হলুদ – ১/২ চা চামচ

    • লঙ্কা গুঁড়ো – ১ চা চামচ

    • জিরে গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

    • গরম মশলা – ১/২ চা চামচ

    • তেজপাতা – ১টি

    • দারুচিনি – ১ টুকরো

    • নুন ও চিনি – স্বাদমতো

    • সরষের তেল – ৩ টেবিল চামচ

    কীভাবে বানাবেন

    পটলগুলি খোসা ছাড়িয়ে অল্প লবণ-হলুদ মেখে হালকা ভেজে তুলে রাখুন। কড়াইয়ে তেল গরম করে তেজপাতা ও দারুচিনি ফোড়ন দিন। পেঁয়াজ ও আদা বাটা দিয়ে কষান, এরপর টমেটো ও দই দিয়ে মশলা ভালভাবে কষে নিন। হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, নুন ও চিনি দিয়ে নেড়ে দিন। মশলা থেকে তেল ছেড়ে এলে ভাজা পটলগুলো মিশিয়ে দিন। অল্প জল দিন, ঢেকে ৫–৭ মিনিট "দমে" রান্না করুন। শেষে গরম মশলা ছড়িয়ে গ্যাস বন্ধ করুন।

    রুই পোস্ত: নিরামিষ দিনে মাছের নিরামিষতা

    রুই পোস্ত বাঙালি রান্নার এক সরল অথচ বর্ণময় অধ্যায়। পোস্ত মানেই যেন বাঙালির অমোঘ দুর্বলতা, আর রুই মাছ মানে প্রতিদিনের ভরসা। দু’য়ে মিলে তৈরি হয় এমন এক পদ, যেখানে ঝাঁঝ নেই, নেই অতিরিক্ত মশলা আছে শুধু স্নিগ্ধতা আর পরিমিত স্বাদের নিপুণ ছোঁয়া। রুই পোস্ত আসলে নিরামিষ রান্নার প্রভাব নিয়ে তৈরি এক মাছের পদ—যেখানে মাছ থাকলেও রান্নার ধরন একদম হালকা, প্রায় নিরামিষ ঘরানার। গরম ভাতের সঙ্গে এই পাতলা পোস্তর ঝোল মুখে দিলেই মন জুড়িয়ে যায়।


    কী কী লাগবে

    • রুই মাছ – ৪–৬ টুকরো

    • পোস্ত – ৩ টেবিল চামচ (পেস্ট করে নেওয়া)

    • কাঁচা লঙ্কা – ৩–৪টি (ফালি বা বাটা)

    • কালো সর্ষে বা মেথি – ১/৪ চা চামচ (ঐচ্ছিক)

    • হলুদ – ১/২ চা চামচ

    • নুন – স্বাদমতো

    • সরষের তেল – ৩–৪ টেবিল চামচ

    • জল – ১ কাপ (পাতলা ঝোলের জন্য)

    কীভাবে বানাবেন

    রুই মাছ টুকরো নুন-হলুদ মেখে ভেজে তুলে রাখুন। পোস্ত বাটা, কাঁচা লঙ্কা বাটা আর অল্প জল মিশিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করুন। কড়াইয়ে তেল গরম করে হালকা ফোড়ন দিন (কালো সরষে বা মেথি, যেটা ব্যবহার করছেন)। এবার পোস্তের মিশ্রণটি দিয়ে অল্প আঁচে কষান ৩–৪ মিনিট। এবার ভাজা মাছ দিয়ে দিন, সাথে প্রয়োজনমতো জল। নুন-হলুদ ঠিক করে দিয়ে ৫–৬ মিনিট ঢেকে রান্না করুন যতক্ষণ না মাছ গলে পোস্তর ঝোলে মিশে যায়। একটুখানি কাঁচা লঙ্কা ও সরষের তেল ছিটিয়ে দিলে স্বাদ দ্বিগুণ হয়।

    আম টক: গ্রীষ্মের দুপুরে শীতল ছায়া

    একঢোঁক আম টক মুখে দিতেই যেন পুরোনো দিনের ছেলেবেলা ফিরে আসে গরমের ছুটি, উঠোনের তালগাছ আর দুপুরবেলা মা’র হাতের পাতলা, মিষ্টি-ঝাল-টক এক আশ্চর্য স্বাদ। আম টক শুধু একটা পদ নয়, এটা বাঙালির গ্রীষ্মের স্মৃতি, নিরামিষ ভোজের অপরিহার্য রস, আর ভাতঘোরের শেষ মিষ্টি ছোঁয়া। টক-মিষ্টি এই পাতলা তরল খাবার একদিকে যেমন হজমে সাহায্য করে, তেমনি রসনাতেও দেয় আরাম ও তৃপ্তি।


    কী কী লাগবে

    কাঁচা আম – ১টি মাঝারি (খোসা ও বিচি সহ টুকরো করে কাটা)

    সরষে / সাদা তেল – ১ টেবিল চামচ

    শুকনো লঙ্কা – ১টি

    পঞ্চফোড়ন – ১/২ চা চামচ

    হলুদ – ১ চিমটি

    নুন – স্বাদমতো

    চিনি – ৩–৪ টেবিল চামচ (অথবা স্বাদমতো)

    জল – ২ কাপ


    কীভাবে বানাবেন

    প্রথমে কাঁচা আম ধুয়ে, খোসা ও বিচিসহ কেটে রাখুন। কড়াইয়ে তেল গরম করে শুকনো লঙ্কা ও পঞ্চফোড়ন ফোড়ন দিন। কাটা আম দিয়ে সামান্য নেড়ে হলুদ ও নুন দিয়ে ২ মিনিট কষান। এবার জল দিন ও ঢেকে দিন, আম নরম হওয়া পর্যন্ত ফুটিয়ে নিন। আম সেদ্ধ হলে চিনি মেশান, নেড়ে দিন যতক্ষণ না চিনি গলে টক-মিষ্টি জল তৈরি হয়। ২ মিনিট ফুটিয়ে গ্যাস বন্ধ করে ঠান্ডা হতে দিন। ভাতের শেষে, হালকা ভাপ ওঠা আম টক এক অনবদ্য রিফ্রেশমেন্ট। চাইলে সামান্য কাসুন্দি বা পুদিনা পাতা দিয়ে নতুন স্বাদ আনতে পারেন।


    এই একবেলা শুধু মুখরোচক খাবার নয়, বরং জামাইকে “ঘরের ছেলে” করে তোলার আন্তরিক প্রয়াস। জামাইষষ্ঠীর পাত যেন এক রকম গল্প বলে ভালোবাসার, আপন করার, আর সম্পর্ককে আরও গভীর করে তোলার। এই খাওয়া-দাওয়া শাশুড়ি-জামাইয়ের সম্পর্ককে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। পদে পদে শুধু রন্ধনশৈলী নয়, থাকে শিকড়ে ফেরা, ঐতিহ্যের মর্যাদা রক্ষা আর পারিবারিক উষ্ণতার ছোঁয়া। জামাইষষ্ঠী তাই কেবল একদিন নয় এ এক অনুভব, যা মনেও থাকে, মুখেও।

রাজস্থানের রাজকীয় ইতিহাস, মেহরানগড় দূর্গ

ভারতের মরুপ্রধান রাজ্য রাজস্থানের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা মেহরানগড় দূর্গ একাধারে ইতিহাস, স্থাপত্য এবং সংস্কৃতির এক অনন্য সংমিশ্রণ। যোধপুর শহরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল দুর্গ কেবলমাত্র একটি পর্যটনস্থল নয়, বরং রাজপুত গৌরবের এক জীবন্ত স্মারক।

ইতিহাসের পাতা থেকে

১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রাঠোর রাজবংশের ১৫তম শাসক রাও যোধা প্রাচীন রাজধানী মাণ্ডোর ছেড়ে নতুন ও নিরাপদ রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন যোধপুর, এবং সেইসঙ্গে নির্মাণ করেন মেহরানগড় দূর্গ। দূর্গের নাম এসেছে সংস্কৃত “মিহির” (সূর্য) এবং “গড়” (দূর্গ) শব্দ থেকে—এই সূর্যবংশীয় রাজবংশের দেবতার প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবেই এই নামকরণ।

প্রায় ৪০০ ফুট উঁচু একটি খাড়া পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই দূর্গটি বিস্তৃত ১,২০০ একর এলাকা জুড়ে। দুর্গের দেওয়াল এতই মজবুত এবং উঁচু যে যোধপুর শহরকে এর ছায়ায় রীতিমতো ক্ষুদ্র মনে হয়।

স্থাপত্যশৈলী ও দর্শনীয় স্থান

মেহরানগড় দূর্গ তার অসাধারণ রাজপুত স্থাপত্য ও কারুকাজের জন্য বিখ্যাত। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক চমৎকার প্রাসাদ:


মেহরানগড় দুর্গের মোতি মহল: রাজকীয় গর্বের দীপ্তি

রাজস্থানের মরুভূমির হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক ইতিহাস মেহরানগড় দুর্গ। আর তারই গর্ভগৃহে সযত্নে লুকিয়ে থাকা এক রাজকীয় সৌন্দর্য মোতি মহল। এই হল ঘর নয়, এ এক ইতিহাসের দীপ্ত প্রাসাদ, যা শুধু রাজশক্তির গৌরবই নয়, রঙ, আলো আর মুঘল-রাজপুত স্থাপত্যের নিখুঁত মিলনের নিদর্শন। মোতি’ মানে মুক্তো, আর 'মহল' মানে প্রাসাদ। এই ঘরের নাম মোতি মহল কারণ এটি এমনভাবে তৈরি যাতে ভেতরের দেয়ালে রৌদ্রছায়ার খেলা মুক্তোর মতো দীপ্তি ছড়ায়। ১৭শ শতকে মহারাজা সুর সিংহ নির্মাণ করেছিলেন এই মোতি মহল, যেটি ছিল রাজাদের গোপন সভা, সিংহাসন কক্ষ ও প্রায়শই গোপন পরামর্শের জায়গা। মেহরানগড়ের মোতি মহল যেন এক নীরব ইতিহাসকথক যার দেয়ালে শোনা যায় রাজাদের পায়ের শব্দ, আলো-আঁধারির গল্প আর রাজপুত শৌর্যের প্রতিধ্বনি। এই মহল শুধু পাথরের নির্মাণ নয়, এটি হল রাজস্থানী আত্মার এক দীপ্ত প্রতিচ্ছবি।

ফুল মহল: নৃত্য ও সঙ্গীতের বিলাসবহুল আসর

মেহরানগড় দুর্গের অন্তর্গত ফুল মহল (Phool Mahal) যেন এক জীবন্ত চিত্রকল্প, যেখানে সৌন্দর্য, সুর আর ঐতিহ্যের সমাহার ঘটেছে অভূতপূর্ব নান্দনিকতায়। মহারাজা অভয় সিংহ-এর আমলে নির্মিত এই ঘর ছিল দরবারের সবচেয়ে বিলাসবহুল ও রত্নখচিত অংশ। নাম অনুযায়ী 'ফুল মহল' ছিল সৌরভ, শোভা ও সৃজনের স্থান। সোনার পাতা ও জটিল মুঘল স্টাইলের অলংকরণে আবৃত এই ঘরেই বসত রাজদরবারের সঙ্গীত ও নৃত্য আসর। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ধ্বনি আর রাজন্যবর্গের প্রশংসাসূচক মন্তব্যে এক সময় এই ঘর মুখর ছিল। ঝাড়বাতির নীচে, রঙিন কাঁচে আলো ঝলমল করে উঠত, আর আয়নার প্রতিফলনে প্রতিটি নৃত্যের ভঙ্গিমা যেন বহু গুণে বিভা ছড়িয়ে দিত। এই ঘর ছিল কেবল বিলাসের নয়, রুচির, সৌন্দর্যের এবং শিল্পের আরাধনার এক পবিত্র মঞ্চ।


শীশা মহল: স্বপ্নময় আলোর এক রাজকীয় কাব্য

শীশা মহল নামেই মুগ্ধতা জাগায়। আয়নার অপরূপ কারুকাজে সজ্জিত এই কক্ষটি ছিল রাজকীয় বিলাসিতা ও সৌন্দর্যচেতনার এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি দেয়াল, খিলান ও ছাদের গায়ে খচিত ছিল রঙিন কাঁচ ও আয়নার সূক্ষ্ম কাজ, যা দিনের আলোয় জ্যোতির্ময় এবং রাতের মোমবাতির আলোয় হয়ে উঠত এক স্বপ্নময় জাদুঘর। এই কক্ষে দাঁড়ালে মনে হয়, আলো আর প্রতিফলনের এক আশ্চর্য খেলায় ঢেকে গেছে পুরো রাজ্য। ছোট ছোট কাঁচের টুকরো যেন হাজার রকম গল্প বলছে রাজপ্রাসাদের বিলাস, রাণীর সৌন্দর্য, আর নিঃশব্দ ভালোবাসার ইতিহাস। শোনা যায়, শীশা মহলে রাজারা কখনও একান্ত সময় কাটাতেন, কখনও অতিথিদের জন্য আয়োজন করতেন বিশেষ রাতের আসর যেখানে মোমবাতির আলোয় প্রতিটি আয়না আলোর মালা হয়ে উঠত।

এছাড়াও রয়েছে এক সমৃদ্ধ জাদুঘর, যেখানে রাজকীয় পালকি, হাতির হাওদা, যুদ্ধাস্ত্র, প্রাচীন পোশাক ও চিত্রকলা দর্শকদের মুগ্ধ করে।


উৎসব ও সংস্কৃতির উৎস

প্রতি বছর অক্টোবর মাসে দূর্গে অনুষ্ঠিত হয় “রাজস্থান ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টিভ্যাল (RIFF)”—রাজস্থানের লোকসংস্কৃতি ও সঙ্গীতকে ঘিরে এই উৎসব যেন এক জীবন্ত রঙের মেলা। দেশি-বিদেশি শিল্পীদের অংশগ্রহণে দূর্গ তখন হয়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র।

দর্শনার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য

প্রবেশমূল্য: ভারতীয়দের জন্য ₹২১০০

সময়সূচী: প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

অবস্থান: যোধপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, যেখান থেকে সহজেই পৌঁছানো যায় যেকোনো বাহনে।


মেহরানগড় দূর্গ কেবলমাত্র এক প্রাচীন স্থাপনা নয়, এটি রাজস্থানের হাজার বছরের ইতিহাস, বীরত্ব, শৌর্য এবং শিল্পকলা সংরক্ষণের এক অনন্য নিদর্শন। যোধপুর সফরে গেলে এই দুর্গকে বাদ দেওয়া মানেই রাজপুত ঐতিহ্যের মূলস্বাদকে উপেক্ষা করা। সূর্যোদয়ের আলোয় যখন দূর্গের প্রাচীন প্রাচীরগুলো সোনালি রঙে জ্বলে ওঠে, তখন সেই দৃশ্য যেন অতীতের কোনো রাজসভা থেকে ফিরে আসা এক কিংবদন্তি গল্পের প্রতিচ্ছবি।

সক্রেটিস ও জ্যানথিপি: দর্শনের আড়ালে এক গৃহস্থ জীবনের গল্প

দর্শনের ইতিহাসে যাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা, সেই সক্রেটিস: জ্ঞান, যুক্তি আর প্রশ্নচর্চার এক অবিস্মরণীয় প্রতীক। কিন্তু গ্লোরি আর গভীরতার এই ছবির পেছনে ছিল এক প্রাত্যহিক সংগ্রামের বাস্তব ক্যানভাস। এই মহান দার্শনিকের জীবন যেমন ছিল বুদ্ধিমত্তার আলোয় উদ্ভাসিত, তেমনি ছিল পারিবারিক টানাপোড়েন ও নিদারুণ কৃচ্ছ্রতার গল্পে ভরা।

দুটি বিয়ে, একটি জীবনবোধ

সক্রেটিসের প্রথম স্ত্রী জ্যানথিপি ছিলেন যেমন রূপসী, তেমনি খর মেজাজের। প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যেও জ্যানথিপির মুখরতা ও ক্রোধের চিত্রায়ন আমরা পাই। তাঁদের সংসারে ছিল তিনটি সন্তান, আর ছিল নিরবচ্ছিন্ন আর্থিক অনটন। সক্রেটিস দিনে পর দিন নগরবাসীদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করতেন কিন্তু বিনিময়ে এক পয়সাও নিতেন না। এই অনটনের মধ্যেই তিনি করেন দ্বিতীয় বিয়ে মির্টো নামের এক বিধবা নারীকে। অনেকে বলেন, এই বিয়েটি তিনি করেছিলেন আত্মীয়তার টানে, কেউ বলেন মির্টো’র পারিবারিক সম্পদের কারণে। কিন্তু যা-ই হোক, জ্যানথিপির অসন্তোষ চূড়ান্তে পৌঁছায়।

চড়ুইভাতির বদলে ধ্যান আর দারিদ্র্য

এক রাতে খাবার নেই ঘরে। শিশু সন্তানদের কান্নায় ঘর ভরা। সক্রেটিস বসে আছেন ধ্যানমগ্ন হয়ে। ক্ষুব্ধ জ্যানথিপি শুরু করলেন চিৎকার আর শেষে এক গামলা ময়লা পানি ঢেলে দিলেন তাঁর গায়ে।

সক্রেটিসের প্রতিক্রিয়া? হাসিমুখে বললেন,

“এত গর্জনের পর না হয় একটু বৃষ্টিই হলো।”

এই উত্তরেই ধরা পড়ে একজন দার্শনিকের ধৈর্য, দূরদৃষ্টি আর আত্মসচেতনতা।


জুতোহীন সেই পথচলা

সক্রেটিসের ছিল না বহু পোশাক। একটাই পোশাক ঘুরেফিরে পরতেন তিনি, পায়ে থাকত না জুতো। এই কষ্টকর জীবন কেন বেছে নিয়েছিলেন? একবার কেউ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন:

“আমি এমন জীবন বেছে নিয়েছি, যাতে লোভের কুকুরগুলো বুঝে সত্য, জ্ঞান ও স্বাধীনতা এমন এক সুখ, যার মূল্য দিতে হয় কষ্ট আর ত্যাগ দিয়ে।”

সুখ ও দার্শনিকতা: এক অম্লমধুর বাণী

জীবনের গভীরতম উপলব্ধি থেকে তিনি বলেন

“যদি তুমি ভালো স্ত্রী পাও, তবে তুমি সুখী হবে। আর না পেলে তুমি হয়ে উঠবে দার্শনিক।”

এই কথাটি নিছক কৌতুক নয়, বরং এক জীবনজিজ্ঞাসার রসিক ব্যাখ্যা। সংসার, দুঃখ, ভালোবাসা আর বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম সবকিছুর এক সংমিশ্রিত দর্শন এতে প্রতিফলিত।


সক্রেটিস ছিলেন একাধারে আদর্শ শিক্ষক, সমাজ সচেতন চিন্তাবিদ এবং পারিবারিক অস্থিরতার মাঝেও অটল থাকা এক মানসিক স্তম্ভ। তাঁর ব্যক্তিজীবনের এই অনালোচিত অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বড় মানুষদের জীবনও বিচিত্র, জটিল এবং প্রেরণাদায়ক। আর জ্যানথিপির মতো চরিত্রেরা আজও আমাদের চোখে জল আনে, তাঁর অভিমান, তাঁর ক্ষোভ, তিনিও ছিলেন তো এক নিঃসঙ্গ সত্যের সাথি।

বৃষ্টির গন্ধ: প্রকৃতির মায়াবী সুগন্ধে বিজ্ঞানের ছোঁয়া

বৃষ্টি মানেই শুধু আকাশের কান্না বা কচি পাতার উপর জলরেখা নয় এতে মিশে থাকে এক অসাধারণ গন্ধ, যা মনকে ছুঁয়ে যায় নিঃশব্দে। শিশুদের চোখে এই গন্ধ মানে ছুটির আনন্দ, প্রৌঢ়দের মনে তা জাগিয়ে তোলে শৈশবের স্মৃতি, আর প্রেমিক-প্রেমিকার মনে, প্রথম বৃষ্টির শিহরণ। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই চেনা গন্ধটির পেছনে রয়েছে এক অদ্ভুত বিজ্ঞানের গল্প?


এই মাটির গন্ধের একটি বৈজ্ঞানিক নাম আছে পেট্রিকর (Petrichor)। শব্দটি এসেছে গ্রিক ‘পেট্রা’ (পাথর) এবং ‘ইখর’ (ঈশ্বরদের রক্ত) শব্দ থেকে। ১৯৬৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান দুই গবেষক এই শব্দটি চালু করেন সেই সুবাস বোঝাতে, যা শুকনো মাটিতে প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার পর আমাদের নাকে আসে।

এই গন্ধের উৎস একধরনের ব্যাকটেরিয়া অ্যাক্টিনোমাইসেটিস (Actinomycetes), যারা থাকে মাটির গভীরে। দীর্ঘ সময় শুকনো থাকার পর বৃষ্টি পড়লে, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো জিওসমিন (Geosmin) নামের এক রাসায়নিক নির্গত করে। এই জিওসমিনই তৈরি করে সেই চেনা, আবেগ-জাগানো গন্ধ। বিস্ময়ের বিষয় হল, মানুষের ঘ্রাণেন্দ্রিয় এই জিওসমিনের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল মাত্র এক অংশে দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ জিওসমিনের উপস্থিতিতেই আমরা সেটা অনুভব করতে পারি। বিজ্ঞান বলছে, এই গন্ধের প্রতি আমাদের আকর্ষণ কোনো কাকতাল নয়। অনেক গবেষক মনে করেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেহেতু কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিলেন, বৃষ্টির আগমন ও মাটির গন্ধ তাঁদের কাছে ছিল আশার প্রতীক। সেই আবেগের স্মৃতি আমাদের জিনে আজও বেঁচে আছে।

আজও যখন হঠাৎ ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামে, জানলার পাশে দাঁড়িয়ে মন খোঁজে সেই গন্ধ—যেটা এক মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলোয়। কখনও স্কুল ফাঁকি দিয়ে ভেজা মাঠে ছোটা, কখনও মায়ের হাতে বানানো গরম খিচুড়ির গন্ধ, আবার কখনও শুধুই একাকীত্বে মিশে থাকা পুরোনো ভালোবাসার ছায়া। বৃষ্টি শুধু প্রকৃতির রূপ বদলায় না, বদলায় আমাদের মনের রংও। আর সেই পরিবর্তনের শুরু হয় মাটি ছুঁয়ে আসা সেই রহস্যময় গন্ধ দিয়ে যা একযোগে বিজ্ঞানের বাস্তবতা আর আবেগের কল্পনাকে বেঁধে ফেলে এক সূক্ষ্ম সুতোয়।


পেট্রিকর আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি শুধুই বাহ্যিক সৌন্দর্যে সীমাবদ্ধ নয় তার প্রতিটি পরশে লুকিয়ে আছে গভীর বিজ্ঞান, স্মৃতি, ভালোবাসা আর মানবিক সংবেদনশীলতা। এই মেলবন্ধনেই বৃষ্টির গন্ধ হয়ে ওঠে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা যা বারেবারে টেনে আনে আমাদের প্রকৃতির কাছে, নিজস্ব আবেগের কাছে।

সর্ষেক্ষেতে ভূত

শেখর বসু

ভূতদের সমাজে ঝগড়ু ওস্তাদের খুব কদর। কালোয়াতি গান গেয়ে বেশ নামডাক হয়েছে ওঁর। প্রায়ই এ-পাড়া সে-পাড়ার বটগাছের জলসায় ডাক পড়ে। একক সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। গান ধরেন মাঝরাতে, সে গান চলে ভোরের আলো ফোটার আলো ফোটার আগে পর্যন্ত। কিন্তু ইদানীং কালোয়াতি গানের রসিকের সংখ্যা কমে গিয়েছে বেশ। ছোকরা ভক্তদের রকমসকম আলাদা।ওরা হিট হিন্দি ফিল্‌মি গান শুনতে চায় ওস্তাদের গলায়।


ওস্তাদ ঝগড়ু আর তার সাগরেদরা ভক্তদের নানা ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছে-- ওসব গান ভূতদের সমাজে চলে না। গাইলে নিন্দে হয়। কিন্তু ছোকরা ভক্তদের বোঝানো শক্ত। ওদের একটাই আবদার—ফিল্‌মি হিন্দি গান চাই। ওই সব গানের তালে তালে মানুষরা কী সুন্দর নাচে। মানুষের সমাজ পালটাচ্ছে, ভূতদের সমাজই বা পালটাবে না কেন? ভূতদের সাবেকি নাচগানেরও এবার বদল হওয়া দরকার। হিন্দি গানের তালে তালে ভূতের ছেলেমেয়েরাও নাচতে চায়। ঝগড়ু ওস্তাদের এবার আদ্যিকালের কালোয়াতি ছেড়ে হিন্দি গান গাওয়া উচিত। গাইলে শ্রোতারা শুধু আনন্দই পাবে না, ওই নাচগানে ভর দিয়ে ভূতদের সমাজ আরও অনেকটা এগিয়ে যাবে, সত্যিকারের আধুনিক হয়ে উঠবে।

ভক্তদের কেউ চটাতে চায় না। ভগবান পর্যন্ত ভক্তদের আবদার শুনে থাকেন। অগত্যা ঝগড়ু ওস্তাদ গাছের মগডালে উঠে লতাপাতা দিয়ে ঘেরা জায়গায় বসে হিন্দি গানের চর্চা শুরু করে দিলেন। প্রথম-প্রথম গাইতে খুব কষ্ট হচ্ছিল ওঁর। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না-- কী করে এই সব বিদ্‌ঘুটে গানের মধ্যে মানুষ এত রস খুঁজে পায়! কিন্তু ভক্তদের আবদার মেটানো বলে কথা--। চর্চায় ঢিলটান দিলে চলবে না। তিন মাস ফুরোতে না ফুরোতেই বেশ কয়েকটা হিট হিন্দি ফিল্‌মের গান নিখুঁত ভাবে উঠে এলো ওঁর গলায়।


ব্যস, তারপরেই এক রাতে মস্ত এক গানের জলসা বসল ঝাঁকড়া এক অশ্বত্থ গাছের মাথায়। গাছটা জঙ্গলের এক ধারে। পাশেই মানুষদের বসতি। আকারে খুব বড় বলেই এই গাছে জলসার আয়োজন করা হয়েছিল। ওস্তাদ যেমন ভিড় আশা করেছিলেন, এ ভিড় তার চেয়ে ঢের বড়। আশেপাশের গাঁ-গঞ্জ থেকে ছোকরা ভূতের দল ঝাঁক বেঁধে হাজির হয়েছিল গান শুনতে। দেখতে দেখতে অত বড় গাছের সব ডালপালা নুয়ে পড়েছিল শ্রোতাদের ভারে। গাছে জায়গা না পেয়ে অল্পবয়সী অনেক ভূত গাছতলায় বসে পড়েছিল খড় বিছিয়ে।

ঝগড়ু ওস্তাদ গান শুরু করলেন মাঝরাতে। খুব চালু একটা সিনেমার গানের প্রথম কলি গাইতে না গাইতেই শ্রোতাদের মধ্যে বিরাট হইচই পড়ে গিয়েছিল। বহুকাল ধরে গান গাইছেন ওস্তাদ, কিন্তু গানের শুরুতেই এমন তারিফ এর আগে আর কখনো পাননি। গানের শেষে যে ঝড় উঠল, তেমন ঝড়ও দেখেননি কখনো। আর বাহবা দেওয়ার কী বহর! হাততালি যেন থামতেই চায় না। শুধু হাততালিই নয়, সঙ্গে জোরালো শিস, উত্কট আওয়াজ । কত ভূতের ছানা যে গানের তালে তালে হাততালি দিল, ডিগবাজি খেল, কোমর দুলিয়ে নাচল—তার আর ইয়ত্তা নেই। কট্টর ভূত সমাজে চালু সাবেকি কালোয়াতি ছেড়ে চটুল হিন্দি গান গাইতে হচ্ছে বলে মরমে মরে ছিলেন ঝগড়ু ওস্তাদ, কিন্তু গানের এই বাঁধভাঙা তারিফ নিমেষে ওঁর সব মনোকষ্ট দূর করে দিয়েছিল। গান তো আর শুধুমাত্র গায়কের নয়, রসিক শ্রোতাও চাই। ঝগড়ু ওস্তাদ এমন শ্রোতার ঢল জীবনে পাননি। মন খুলে একটার পর একটা হিন্দি গান গেয়েই চললেন ভোরের আলো ফোটার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। তারপরেও গানের দাবি। কিন্তু ভূতরা তো আর দিনের বেলায় গাইতে পারে না, অগত্যা থামাতে হল জলসা।


জলসা শেষ হল, কিন্তু তার রেশ চলতেই লাগল। সুরে-বেসুরে মুগ্ধ শ্রোতারা ওই সব গান গেয়ে চলল কয়েক দিন ধরে, সেই সঙ্গে উদ্দাম নাচ। মানুষের সমাজে এ ব্যাপারটা প্রায়ই হয়ে থাকে। ওখানে এটা বেশ সহজ ব্যাপার, কিন্তু এখানে নয়। গোঁড়া ভূতেরা ওই সব গান শুনে চটে উঠেছিল। তবে সেটা বড় কোনও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠেনি। সবাই জানে -- আজ রেগেছে, কাল রাগ পড়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা আচমকা ঘুরে গিয়েছিল অন্য দিকে। ভূতদের গলার স্বর খোনা হয়। নাকি সুরের ওই সব গান কানে যেতেই কিছু মানুষ ঠাট্টা জুড়ে দিয়েছিল বিচ্ছি্রি ভাবে। তাদের মধ্যে বিচ্ছু ছেলেছোকরার সংখ্যাই বেশি। ওই ঠাট্টায় চটেমটে কিছু ভূতের ছানা ওই সব ছেলেছোকরার ঘাড়ে চেপে বসে। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। এমন ঘটনা তো মাঝে মাঝেই ঘটে থাকে। কিন্তু গোলমাল পাকালো রঘু ওঝা। পেল্লায় ওই অশ্বত্থ গাছের লাগোয়া গ্রামটাই রঘু ওঝার গ্রাম। ওঝা রেগে গিতে বলল, ‘কী, এত বড় সাহস! আমার গাঁয়ের লোকদের ঘাড়ে চাপা? দেখাচ্ছি তোদের মজা। আন তো কয়েক বাটি সর্ষে, তেল আর সিঁদুর। এমন বাণ মারব যে, ভূতের হাড়ে কালশিটে পড়ে যাবে।’

রঘু ওঝা ভূতদের যম। ওর নাম শুনে ডাকাবুকো ভূতদেরও বুক কেঁপে ওঠে। ওঝার মারণ মন্ত্রের জোর বড় ভয়ংকর। মন্ত্রপড়া তেল-সিঁদুর-মাখানো সর্ষে ভূতে-পাওয়া লোকের গায়ে ছুড়লে আর দেখতে হবে না, বাবাগো মাগো বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সেই ভূতকে মানুষের আরামের ঘাড় ছেড়ে পালাতে হবে। পালিয়েও রেহাই নেই, গায়ের ব্যথা মারার জন্যে গাছের ডালে শুয়ে থাকতে হবে কমপক্ষে দিনদশেক।


ওঝা এবার বেজায় ক্ষেপেছে। বাণ ছুড়েছে পরের পর। জোরালো মন্ত্রপড়া সর্ষের ঘায়ে মানুষের ঘাড়ে-চাপা ছোকরা ভূতরা খাবি খেতে শুরু করেছিল। পালাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু পালাবে কী ভাবে! গা-হাত-পা তো নাড়াতেই পারছে না। মন্ত্রের সে কী জোর, ছোকরা ভূতদের কচি হাড়ে রীতিমত কালশিটে পড়ে গিয়েছিল। শেষে বড় ভূতেরা এসে অতি কষ্টে মানুষের ঘাড় থেকে ওদের নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।


এই ঘটনায় ভূতদের সমাজে হুলস্থূল পড়ে গিয়েছিল রীতিমত। মানুষের ঘাড়ে চাপা তো ভূতদের জন্মগত অধিকার। সেই অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো অন্যায় আর কী হতে পারে! ভূতদের মধ্যে এখন গণতান্ত্রিক চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে খানিকটা। একটা দল তো ভোটাভুটি করে নেতা নির্বাচনের কথা ভাবতে পর্যন্ত শুরু করে দিয়েছিল। গোঁড়া ভূতরা ঝগড়ু ওস্তাদের ওপর ক্ষেপে গিয়েছে। ওস্তাদ কেন ছোকরা ভূতদের আবদার মেটাবার জন্যে হিন্দি গান গাইতে গেল? বিচ্ছিরি ওই সব গান না গাইলে এমন বেয়াড়া একটা গোলমাল তো পাকিয়ে উঠত না!


মরমে মরে গিয়েছিলেন ঝগড়ু ওস্তাদ। ওঁর ভক্ত ভূতদের কষ্টে কষ্ট পাচ্ছিলেন রীতিমত। এর একটা বিহিত করা দরকার। এতকাল গান গেয়ে বিস্তর টাকা রোজগার করেছেন ওস্তাদ। তাছাড়া ওঁর এক যক্ষ দাদুর কাছ থেকে বিস্তর সোনাদানাও পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। ঠিক করলেন, সব টাকা, ধনসম্পদ বিজ্ঞানের সেবায় লাগাবেন। ভূতদের মধ্যে ইদানীং বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়েছে অল্পবিস্তর। নামকরা একঝাঁক বিজ্ঞানী আর গবেষকদের কাছে গিয়ে ঝগড়ু ওস্তাদ বললেনঃ ‘‘আপনারা এবার একটা নতুন ধরনের গবেষণায় নামুন। গবেষণার জন্যে যন্ত্রপাতি যা কেনার কিনুন।গবেষণাগারের আকার বাড়াতে হলে বাড়ান। কোনওরকম কার্পণ্য করবেন না। যত টাকা লাগে, আমি দেব। সর্ষের মধ্যে ভূত ঢোকার কায়দাটা তো আমাদের জানা আছে, ফাঁক পেলে আমরা ঢুকে পড়তে পারি। এতে কাজও হয় দিব্যি। ছোটখাটো ওঝার ভূত তাড়ানোর সর্ষের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে ওদের মন্ত্রপড়া সর্ষেয় তেমন আর কোনও কাজ হয় না। কিন্তু বড় ওঝারা নানা রকম তুকতাক জানে। ওদের মন্ত্রপড়া সর্ষের মধ্যে ভূতরা ঢুকতে পারে না। ওই মন্ত্রপড়া সর্ষের জোর বড় সাঙ্ঘাতিক। গায়ে পড়লে পালাতে হয় সবাইকেই। ওই সর্ষে পালোয়ান ভূতকেও কাত করে ছাড়ে। আপনাদের এবার এমন কিছু একটা আবিষ্কার করতে হবে, যাতে সর্ষের ওই ভূত তাড়াবার ক্ষমতাটাই লোপ পেয়ে যায় একেবারে। এটা আমাদের জাতীয় সম্মানের প্রশ্ন। উঠেপড়ে লাগুন আপনারা। টাকার জন্যে ভাববেন না।”

ভূতদের সমাজে ঝগড়ু ওস্তাদ একজন মানী মানুষ। ওঁর ছোটখাটো বক্তৃতায় কাজ হয়েছিল বেশ। তাছাড়া ওস্তাদ এর সঙ্গে জাতীয় সম্মানের প্রশ্নটাও কায়দা করে জুড়ে দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা বেশ নড়েচড়ে বসেছিলেন।

ভূতদের বিজ্ঞানচর্চায় শুরু হয়ে গিয়েছিল এক নতুন পর্ব। জীববিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার গবেষক ভূতেরা কাজ শুরু করে দিয়েছিল একসঙ্গে। প্রয়োজন যদি খুব জোরালো হয়, টাকাপয়সার জোগানে যদি টান না পড়ে, আর বিজ্ঞানীরা যদি উঠেপড়ে লাগেন—সুফল ফলবেই। এখানেও তাই হল। বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কারে সর্ষের সেই মারণ ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভূত তাড়াবার মস্ত ওঝা রঘু ওঝার মন্ত্রপড়া সর্ষে আর কোনও কাজ করছিল না। তুকতাক, বাণ মারা ব্যর্থ হল। একটা বাচ্চা ভূতও এখন মানুষের ঘাড়ে চেপে দিব্যি দোল খেতে পারে। কোনও ওঝারই মন্ত্রপড়া সর্ষের ওকে তাড়াবার ক্ষমতা নেই।


ভূত-বিজ্ঞানীরা এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন। এখন শুধু সর্ষে নয়, সব সর্ষেক্ষেতেই সদ্য-আবিষ্কৃত অ্যান্টি-ঝাড়ফুক রাসায়নিক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তার ফলে ক্ষেতের সব সর্ষেরই ভূত তাড়াবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ভূতেরা এখন যে-কোনও সর্ষের মধ্যে ঢুকে আরামে বসবাস করতে পারে। মানুষের দুনিয়ায় তাই এখন সর্ষের মধ্যে ভূত কথাটার চল খুব বেড়ে গিয়েছে। এই আবিষ্কারে সব চাইতে খুশি হয়েছেন ঝগড়ু ওস্তাদ। ওর গান শুনে ছোকরা ভূতেরা এখন ইচ্ছেমতো নাচানাচি করতে পারে, সুরে-বেসুরে ওস্তাদের গান তারস্বরে গাইতে পারে। ওরা জানে, মানুষরা এখন ওদের নিয়ে আর ঠাট্টা করার সাহস পাবে না। মানুষরা ভালো ভাবেই জেনে গিয়েছে যে, মন্ত্রপড়া সর্ষে ছুড়ে ভূতদের আর ঘাড় থেকে নামানো সম্ভব নয়।


Kommentare


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page