উপনিবেশ, সংগ্রাম, প্রেম আর প্রেতকথার সাক্ষী এক স্টেশন, কিছুই যায় না ফেলা, সাধারণ নর্তকীর শাসক হয়ে ওঠার কিংবদন্তী, মস্তিষ্ক সব মনে রাখে, ইংল্যান্ডের রহস্যময় স্টোনহেঞ্জ..
- রোজকার অনন্যা
- 18 hours ago
- 19 min read
উপনিবেশ, সংগ্রাম, প্রেম আর প্রেতকথার সাক্ষী এক স্টেশন: ব্যারাকপুর
১৮৬২ সালের হেমন্তকালে যখন শিয়ালদহ থেকে প্রথম ট্রেন এসে থামে বারাকপুর স্টেশনে, তখন কেউ হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি এই নিঃশব্দ শহরতলি একদিন হয়ে উঠবে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পালক। ব্রিটিশ সামরিক ছাউনির যাতায়াতের জন্য গড়ে ওঠা এই স্টেশনই হয়ে উঠেছিল বাংলার প্রথম প্রজ্বলিত বিদ্রোহের ছায়াবাহক।

যখনই বারাকপুর স্টেশনের নাম উচ্চারণ করা হয়, সঙ্গেই উচ্চারিত হয় মঙ্গল পাণ্ডের নাম। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম স্ফুলিঙ্গ যাঁর হাত ধরেই জ্বলে উঠেছিল, সেই বিপ্লবীর পদচিহ্ন রয়ে গেছে এই স্টেশনের আনাচে-কানাচে। মনে করা হয়, বিদ্রোহের আগুন ছড়ানোর আগে বহুবার এই রেলস্টেশনের কাছ দিয়েই হেঁটেছেন মঙ্গল পাণ্ডে। তাঁর ছায়া লেগে আছে স্টেশনের লাল ইটের দেয়ালে, রেললাইনের পাথরের ফাঁকে। কখনও কখনও সন্ধ্যার নির্জনতায়, ট্রেনের শেষ বাঁশির পরে, কানে আসে যেন কারও নিঃশ্বাসের শব্দ এক বিপ্লবীর অদৃশ্য উপস্থিতি যেন আজও রয়ে গেছে এই প্ল্যাটফর্মে। বারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই স্টেশন যেন আজও চুপিচুপি বলে চলে সেই অসমাপ্ত মুক্তির গল্প যেখানে মঙ্গল পাণ্ডের সাহসী বিদ্রোহ ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রথম স্পন্দন।
বারাকপুর স্টেশনের বুকে এক সময় লুকিয়ে ছিল এক গোপন রেলপথ। সেটি সাধারণ যাত্রীদের জন্য নয়, তৈরি হয়েছিল শুধুমাত্র সাহেবদের বিলাসবহুল রেসকোর্স যাত্রার জন্য। প্রতিটি রবিবার সকালে ব্রিটিশ সাহেবরা তাঁদের রাজকীয় পোশাকে, শোভামণ্ডিত কামরায় উঠে পড়তেন সেই ট্রেনে। সোনালী কারুকাজে মোড়া ছিল ভিতরের আসবাব; সুগন্ধে ভরা কামরা, সাদা গ্লাভস পরা পরিবেশকরা চা পরিবেশন করত। সেই ট্রেন ছুটে যেত বারাকপুর রেসকোর্সের দিকে এক অবাধ আনন্দযাত্রা। অন্যদিকে, রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে থেকে সাধারণ ভারতীয়রা সেই ট্রেন দেখতে দেখতে বোঝার চেষ্টা করত, ক্ষমতা আর শ্রেণিবিভেদের সীমারেখা কতটা গভীর হতে পারে। তাঁদের চোখের সামনে দিয়ে চলে যেত এক আলাদা জগতের ঝলক, যেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না উপনিবেশিত জাতির। আজ সেই গোপন রেলপথের ধ্বংসাবশেষ হয়তো ধুলোয় ঢেকে গেছে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তার প্রতিধ্বনি আজও স্পষ্ট উপনিবেশিক শাসনের এক নীরব প্রতীক হয়ে।

বারাকপুর স্টেশনের বুকেই ছিল এক এলিট কক্ষ ‘রয়্যাল ওয়েটিং রুম’। এই ঘরে প্রবেশাধিকার ছিল শুধুমাত্র ইউরোপীয় সাহেব-মেমদের। ভারতীয়দের জন্য সেই দরজা বরাবরই ছিল নিষিদ্ধ, অদৃশ্য এক অনুপ্রবেশের প্রাচীর যেন দাঁড়িয়ে থাকত সবসময়। তবে ইতিহাস গড়ে ওঠে সাহসিকতার ছোট ছোট গল্পে।এক রাতে হঠাৎ করেই এক ভারতীয় যাত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চারপাশে সাহায্যের কেউ নেই। সেই সময় স্টেশনের এক বাঙালি কুলি নাম ইতিহাস হয়তো ভুলে গেছে সমস্ত ভয় উপেক্ষা করে খুলে দেন সেই ‘রয়্যাল ওয়েটিং রুম’-এর নিষিদ্ধ দরজা। সেখানে অসুস্থ যাত্রীকে শুইয়ে দেন সাময়িক আশ্রয়ে। পরদিন সকালে সেই খবর পৌঁছে যায় সাহেবদের কানে। ব্রিটিশরা ক্ষুব্ধ হয়ে ঘোষণা করে, এই ঘর ‘অপবিত্র’ হয়েছে। আর কখনও তারা এই ঘরে পা রাখবে না। ঘরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেই সাহসী কুলির এই ছোট্ট বিদ্রোহ আজও বারাকপুর স্টেশনের বাতাসে বেঁচে আছে। এটি শুধু এক দরজা খোলার গল্প নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর এক নিঃশব্দ সাহসিকতার ইতিহাস।

বারাকপুর স্টেশনের ইতিহাস শুধু রাজনীতি আর বিদ্রোহের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয় এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিস্ময়কর লোককথাও। শোনা যায়, ১৯০৮ সালের turbulent সময়ের এক রাতে, যখন বিপ্লবীরা ইংরেজদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে মরিয়া, তখন এক অদৃশ্য সহায়ক হয়ে ওঠেন এক স্টিম ইঞ্জিন চালক। তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় নেই, তবে গল্পের ভিতর বেঁচে আছেন তিনি। বিশ্বাস করা হয়, সেই চালক বিপ্লবীদের রক্ষার জন্য ব্রিটিশদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই স্টেশন ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন ট্রেন। সেই সাহসিকতার কারণে পরে তাঁকে জীবন দিতে হয়।
আজও মাঝেমধ্যে নাকি রাতের শেষ প্রহরে শোনা যায় এক পুরনো স্টিম ইঞ্জিনের বাঁশির মৃদু সুর। যেন সেই অদৃশ্য ট্রেনচালক এখনও স্টেশনের অন্ধকারে পাহারা দিচ্ছেন বিপ্লবের অসমাপ্ত গল্পগুলো। ইতিহাসের গভীরে চাপা পড়েও তাঁর আত্মত্যাগের সেই কাহিনি আজও রয়ে গেছে বারাকপুরের বাতাসে, প্ল্যাটফর্মের নিস্তব্ধতায়।

বারাকপুর স্টেশনের আনাচে-কানাচে শুধু সংগ্রামের গল্প নয়, রয়েছে এক অপূর্ণ প্রেমকাহিনিও। এক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা, ভারতে আসার পর প্রেমে পড়েন এক বাঙালি কন্যার। তাদের সম্পর্ক ছিল নিষিদ্ধ, সমাজের চোখে অসম। ভালোবাসা যতই গভীর হোক, সেই প্রেম টিকতে পারেনি ঔপনিবেশিক নিয়মের কাঠামোতে। পরিবারের চাপে সেই অফিসারকে বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হয় লন্ডনে। আর প্রেমিকা রয়ে যান বারাকপুরের মাটিতে, একা, অপেক্ষার বুক ভাঙা দীর্ঘশ্বাসে। শোনা যায়, স্টেশনের এক কোণে যে পুরনো লোহালক্কড়ের ঘড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে, সেটি নাকি স্থাপিত হয়েছিল সেই অসমাপ্ত প্রেমের স্মৃতিতে। প্রতিটি টিকটিক শব্দ যেন সেই অপেক্ষারই প্রতিধ্বনি প্রিয় মানুষটির ফিরে আসার, যা কোনোদিন আর পূরণ হয়নি। আজও বারাকপুর স্টেশনে দাঁড়ালে মনে হয় সেই ঘড়ি শুধু সময়ের জানান দিচ্ছে না, দিচ্ছে এক অপূর্ণ প্রেমের, এক দীর্ঘশ্বাসের সুর।

বারাকপুর স্টেশন এখন যেন এক বর্ণময় ছায়া। কিছু অংশে আজও লাল ইটের পুরনো দেয়াল দেখা যায়, রয়্যাল ওয়েটিং রুম বন্ধ, কিন্তু ভেতরে সময় যেন স্থির। রেসকোর্স ও ক্যান্টনমেন্টের পুরনো রেলপথের ধ্বংসাবশেষ এখনও দৃশ্যমান। আধুনিকীকরণ এলেও ব্রিটিশ স্থাপত্যের ছাপ অমলিন। ইতিহাস হয়তো নীরবে চলে যায়, কিন্তু বারাকপুর স্টেশনের দেয়ালে, প্ল্যাটফর্মে, রেললাইনের ফাঁকে ফাঁকে তার পায়ের ছাপ পড়ে থাকে। কেউ যদি মন দিয়ে শোনে, এখনও শুনতে পায় স্টিম ইঞ্জিনের বাঁশি, সাহসী কুলির পায়ের শব্দ, আর এক প্রেমভঙ্গ সৈনিকের দীর্ঘশ্বাস। বারাকপুর স্টেশন শুধু রেলযাত্রার একটি বিন্দু নয় এ এক ঐতিহাসিক দর্পণ, যেখানে অতীত ও বর্তমান একসাথে দাঁড়িয়ে থাকে নীরব শ্রদ্ধায়।

কিছুই যায় না ফেলা! (৬টি লেফ্ট-ওভার রেসিপি)
রান্নার শেষে যদি কিছু থেকে যায়, তাকে আমরা সাধারণত রেখে দিই পরে খাওয়ার জন্য বা কখনও ফেলেও দিই। কিন্তু একটু বুদ্ধি, একটু সৃজনশীলতাই বদলে দিতে পারে সেই ‘বেঁচে যাওয়া’ খাবারের কপাল। পুরনো ভাত হতে পারে ঝরঝরে ভাজা, বেঁচে যাওয়া ডাল রূপ নিতে পারে নরম পরোঠার পুরে, কিংবা গতকালের সবজি হয়ে উঠতে পারে চটপটা কাটলেট। এই সংকলনে রইল তেমনই কিছু ঘরোয়া, সৃজনশীল লেফ্টওভার রেসিপি যা রাঁধুনির কুশলতাও দেখাবে, আবার খাবার অপচয় রুখতেও সহায়ক হবে। রোজকার রান্নাঘরের চেনা উপাদান দিয়ে তৈরি এই পদগুলো আপনাকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে ফেলে দেওয়া নয়, ফেলে রাখা খাবারও হতে পারে পরিবারের প্রিয়তম আহার!

মাংসের পরোটা (বেঁচে যাওয়া মাংস দিয়ে)
রাতের ডিনারের মাংস সকালে একঘেয়ে লাগতেই পারে। সেই একই মাংস যদি গরম গরম পরোটার পুরে ঢুকে পড়ে, তবে সকালের জলখাবারে মেলে এক অভিনব স্বাদ।
কী কী লাগবে
কুচানো রান্না করা মাংস
পেঁয়াজ কুচি
কাঁচা লঙ্কা কুচি
ধনে পাতা কুচি
আটা
লবণ
Shalimar's Sunflower তেল
Shalimar's Chef Spices গোলমরিচ গুঁড়ো
লেবুর রস

কীভাবে বানাবেন
মাংস ভালো করে কুচিয়ে নিন। তার সঙ্গে মেশান পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা লঙ্কা, আর ধনে পাতা। আলাদা করে আটার ডো তৈরি করে নিন। এবার ছোট ছোট লেচি করে প্রতিটি লেচির ভেতরে মাংসের পুর ভরে দিন। সাবধানে বেলে নিন এবং গরম তাওয়ায় সেঁকে নিন দুই পিঠ সোনালি করে। গরম গরম পরিবেশন করুন ধনে-টমেটোর চাটনি বা টক দইয়ের সঙ্গে। চাইলে পুরে সামান্য গোলমরিচ গুঁড়ো বা লেবুর রস মেশালে স্বাদ আরও বাড়বে। এই পরোটাগুলো টিফিনেও দারুণ জমে।

ডালের চিলা (বেঁচে যাওয়া ডাল দিয়ে)
প্লেটে পড়ে থাকা এক বাটি ডাল নতুন রূপে ফিরতে পারে ঝাল ঝাল একটি প্রোটিন-সমৃদ্ধ প্রাতরাশ হিসেবে। এই চিলাকে আপনি ডাল-ভিত্তিক প্যানকেকও বলতে পারেন।
কী কী লাগবে
বেঁচে যাওয়া ঘন ডাল
বেসন
পেঁয়াজ কুচি
কাঁচা লঙ্কা কুচি
ধনে পাতা কুচি
নুন
Shalimar's Sunflower তেল

কীভাবে বানাবেন
ঘন ডালের সঙ্গে প্রয়োজনমতো বেসন মিশিয়ে ঘন ব্যাটার তৈরি করুন। এরপর তার মধ্যে দিন পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা লঙ্কা ও ধনে পাতা। ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। তাওয়ায় অল্প তেল গরম করে ব্যাটার ছড়িয়ে দিন পাতলা করে। দুই পিঠ সোনালি করে সেঁকে নিন। গরম গরম পরিবেশন করুন ধনে-টমেটোর চাটনি বা টমেটো কেচাপ দিয়ে। চাইলে ব্যাটারে সামান্য আদা কুচি বা জিরা যোগ করলে বাড়তি সুগন্ধ আসবে। সকালেরবা সন্ধ্যার টিফিনের জন্য একদম উপযুক্ত।

মাছের চপ (বেঁচে যাওয়া মাছ দিয়ে)
আগের দিনের ভাজা বা ঝোলের মাছ সহজেই রূপ নিতে পারে সন্ধ্যার চায়ের সাথের একটি আকর্ষণীয় পদে। শুধু একটু ভাবনা আর কিছু মশলা খেলিয়ে নিতে হয়।
কী কী লাগবে
বেঁচে যাওয়া মাছ (কাঁটা ফেলে চটকানো)
সেদ্ধ আলু
পেঁয়াজ কুচি
কাঁচা লঙ্কা
গরম মশলা
ব্রেডক্রাম্ব
ডিম
Shalimar's Sunflower তেল

কীভাবে বানাবেন
মাছ ও আলু একসঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে গুঁড়ো করুন। তার মধ্যে পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা, ধনে পাতা ও প্রয়োজনমতো মশলা মেশান। এরপর গোল গোল বা ওভাল চপের আকারে গড়ে নিন। প্রতিটি চপ আগে ডিমে ডুবিয়ে, তারপর ব্রেডক্রাম্বে গড়িয়ে নিন। এবার অল্প তেল দিয়ে প্যানে সেঁকে বা ডিপ ফ্রাই করে সোনালি করে ভেজে তুলুন। সস, কেচাপ কিংবা ধনে-টমেটোর চাটনির সঙ্গে গরম গরম পরিবেশন করুন। সন্ধ্যার জলখাবার কিংবা অতিথি আপ্যায়নে দুর্দান্ত। চাইলে সামান্য লেবুর রস বা গরম মশলার ঝাঁজ দিলে স্বাদ আরও বাড়বে। বেঁচে যাওয়া ইলিশ বা রুই মাছ দিয়েও এই চপ দারুণ হয়।

ভাতের পাকোড়া (বেঁচে যাওয়া ভাত দিয়ে)
শুধু ভাত দিয়ে যে জমাটি জলখাবার বানানো যায়, তা এই পাকোড়াই প্রমাণ করে। বাচ্চারা তো বটেই, বড়রাও মজা করে খাবে এই খুদের ভিন্ন স্বাদের রূপ।
কী কী লাগবে
ঠান্ডা ভাত
পেঁয়াজ কুচি,
কাঁচা লঙ্কা,
বেসন,
ধনে পাতা
Shalimar's Sunflower তেল,
নুন

কীভাবে বানাবেন
ভাতের সঙ্গে পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা, ধনে পাতা, নুন ও প্রয়োজনমতো বেসন মিশিয়ে নিন। মিশ্রণটি ভালোভাবে মেখে শক্ত করে বল বানান। কড়ায় অল্প তেল গরম করে বলগুলো সোনালি রং হওয়া পর্যন্ত ভেজে তুলুন। গরম গরম পরিবেশন করুন ধনে-টমেটোর চাটনি বা টমেটো কেচাপ দিয়ে। বিকেলের জলখাবার বা হালকা টিফিনে একদম উপযুক্ত। চাইলে সামান্য জিরা গুঁড়ো বা লেবুর রস মেশালে বাড়তি ফ্লেভার আসবে। চাইলে চিজ কিউবের ছোট টুকরো ভেতরে পুর হিসেবেও দিতে পারেন।

রুটির উপমা (বেঁচে যাওয়া রুটি দিয়ে)
রাতের রাখা শুকনো রুটিকে যদি নতুন রূপে সাজিয়ে নেন, তবে সকালের জলখাবারে আসতে পারে অবাক করা স্বাদ। রুটির উপমা তারই এক উপহার।
কী কী লাগবে
বেঁচে যাওয়া রুটি (ছোট টুকরো করে কাটা)
পেঁয়াজ
কাঁচা লঙ্কা
টমেটো
সরষের দানা
কারিপাতা
Shalimar's Sunflower তেল
নুন
চিনি
লেবুর রস

কীভাবে বানাবেন
কড়ায় তেল গরম করে সরষে ফোড়ন দিন। কারিপাতা, পেঁয়াজ কুচি ও কাঁচা লঙ্কা দিয়ে হালকা ভেজে নিন। এবার রুটির টুকরোগুলো দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে দিন। তারপর দিন টমেটো, নুন ও চিনি। ভালো করে মেশানোর পরে আঁচ বন্ধ করে লেবুর রস ছড়িয়ে দিন। গরম গরম পরিবেশন করুন সকালের নাশতা বা বিকেলের হালকা জলখাবার হিসেবে। চাইলে সামান্য ঘি ছড়িয়ে নিলে স্বাদ আরও বাড়ে। কারিপাতা না থাকলে ধনে পাতাও ব্যবহার করা যায়।

সবজি স্টাফড টোস্ট (বেঁচে যাওয়া সবজি দিয়ে)
বেঁচে যাওয়া শুকনো সবজি যদি স্যান্ডউইচ বা টোস্টের পুরে ঢোকে, তবে তার রূপ-রস-গন্ধই বদলে যায়। সহজে বানানো যায়, খেতেও লাগে একেবারে টানটান।
কী কী লাগবে
বেঁচে যাওয়া শুকনো সবজি
পাউরুটি
মাখন বা ঘি
মেয়োনিজ
টমেটো সস
Shalimar's Chef Spices গোলমরিচ গুঁড়ো
চিজ (ঐচ্ছিক)

কীভাবে বানাবেন
বেঁচে যাওয়া সবজির সঙ্গে মেয়োনিজ ও সামান্য টমেটো সস মিশিয়ে পুর তৈরি করুন। পাউরুটির এক পাশে এই মিশ্রণ দিন। চাইলে তার উপর চিজের স্লাইসও রাখতে পারেন। রুটির বাইরের দিকে ঘি বা মাখন মেখে নিন। গরম তাওয়ায় দুই পিঠ সোনালি করে টোস্ট করুন। গরম গরম পরিবেশন করুন ব্রেকফাস্ট, টিফিন বা সন্ধ্যার জলখাবারে। সঙ্গে দিতে পারেন সামান্য সস বা চাটনি। চাইলে পুরে সামান্য গোলমরিচ বা অরিগানো মেশালে বাড়তি স্বাদ পাবেন। গ্রিল স্যান্ডউইচ মেকার ব্যবহার করলেও খুব মচমচে হয়।
বেগম সামরু: সাধারণ নর্তকীর শাসক হয়ে ওঠার কিংবদন্তী

১৮ শতকের দিল্লি ইতিহাসের এক অস্থির সময়। মুঘল সাম্রাজ্যের জৌলুশ তখন অনেকটাই ক্ষীণ, চারপাশে অরাজকতা, অভাব আর ক্ষমতার লড়াই। এই সময়েই জন্ম নেন এক সাধারণ মুসলিম পরিবারে ফারজানা জোহরা, যিনি পরে হয়ে উঠবেন ইতিহাসখ্যাত বেগম সামরু। শৈশবেই পিতৃহীন হয়ে পড়ায় ফারজানার পরিবারের আর্থিক অবস্থা নেমে আসে করুণ সীমায়। জীবিকার সন্ধানে কম বয়সেই তাঁকে আশ্রয় নিতে হয় দিল্লির নর্তকী সমাজে। সেই সময়ের সমাজে নর্তকীরা শুধুই বিনোদনের শিল্পী নন, অনেক সময়েই তাঁরা ছিলেন কূটনীতির পরোক্ষ অংশীদার। বিদেশি সৈন্য, মুঘল অভিজাত, ইউরোপীয় বণিক নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তাঁদের ওঠাবসা ছিল। ফারজানার রূপ, বুদ্ধিমত্তা এবং চার্ম সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই নাচের আসরেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে ওয়াল্টার রাইনহার্ড সামরুর ভাগ্য বদলের এক অন্যতম মোড় এখান থেকেই তৈরি হয়।
নাচের আসরে যেমন কখনও কখনও তাল বদলায়, ঠিক তেমনভাবেই ফারজানার জীবনের ছন্দও একদিন বদলে যায়। দিল্লির সেই অভিজাত নাচের মঞ্চে একদিন প্রবেশ করেন ইউরোপীয় ভাড়াটে সেনাপতি ওয়াল্টার রাইনহার্ড সামরু।
ওয়াল্টার ছিলেন ফরাসি-জার্মান বংশোদ্ভূত এক ভাগ্যঅন্বেষী সেনাপতি, যিনি মুঘল সম্রাটের অধীনে কাজ করতেন। ভারতের জটিল রাজনীতির মাঝে তিনি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছিলেন।
ফারজানার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব ওয়াল্টারকে মুগ্ধ করে। ধীরে ধীরে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। সম্পর্ক রূপ নেয় ভালোবাসায়, তারপর বিবাহে। এই বিবাহের মাধ্যমেই ফারজানা হয়ে ওঠেন বেগম সামরু। তাঁর জীবন পায় নতুন পরিচয়, নতুন মর্যাদা ও অনন্য সম্ভাবনার দিগন্ত। এই সম্পর্ক শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ভালোবাসার গণ্ডিতেই আবদ্ধ ছিল না; বরং এর মধ্য দিয়ে বেগম সামরু প্রবেশ করেন রাজনীতি, সামরিক কৌশল এবং প্রশাসনিক বুদ্ধিমত্তার এক জটিল, অথচ চ্যালেঞ্জিং জগতে যা তাঁকে একদিন সরাসরি শাসকের আসনে পৌঁছে দেবে।

১৭৭৮ সালের সেই দিনটা ছিল বেগম সামরুর জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলোর একটি। স্বামী ওয়াল্টার সামরু প্রয়াত হয়েছেন। একজন সাধারণ নারীর পক্ষে এমন সময় নিজেকে সামলে নেওয়াই যেখানে চ্যালেঞ্জ, সেখানে বেগম সামরু সামনে এগিয়ে এলেন সম্পূর্ণ রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নিতে। মুঘল সম্রাট শাহ আলম তাঁকে স্বীকৃতি দিলেন সরন্ধা অঞ্চলের শাসক হিসেবে। সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী শাসকের এমন দায়িত্ব পাওয়া ছিল অভাবনীয়। বেগম সামরু তার প্রাজ্ঞতা, কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসিকতার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তিনি কেবল প্রশাসনের কাগজে-কলমেই শাসক ছিলেন না, সেনানায়কের ভূমিকা নিয়েও যুদ্ধের ময়দানে নামেন। তাঁর ব্যক্তিগত সশস্ত্র বাহিনী ছিল প্রশিক্ষিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ। মারাঠা, রাজপুত, ব্রিটিশ এমনকি নিজস্ব মুঘল সেনাদের সঙ্গেও দাপটের সঙ্গে তিনি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। একের পর এক রাজনৈতিক সংকটে দৃঢ়ভাবে নিজেকে স্থাপন করেন। একজন নর্তকী থেকে পরিণত হলেন এক সার্বভৌম শাসক। এক নারীর দৃঢ় সংকল্পের সাক্ষী হয়ে থাকল সেই সরন্ধা প্রদেশের রাজপ্রাসাদ।

রাজনীতি আর কূটনীতির ময়দানে সফলতার পর বেগম সামরুর জীবনে এল আরেকটি বড় বাঁক। ভারতে ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় প্রভাব যত বাড়তে থাকল, ততই বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরি হতে লাগল। সেই মেলবন্ধনের মধ্যেই বেগম সামরু গ্রহণ করলেন ক্যাথলিক ধর্ম। ১৭৮১ সালে তিনি রোমান ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হন এবং খ্রিস্টীয় নাম নেন জোয়ানা নাবিতা সামরু। তাঁর এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, ছিল কূটনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয়ও। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে তিনি ইউরোপীয়দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করলেন, যা ভবিষ্যতে তাঁর শাসনকে স্থিতিশীল রাখতেও সাহায্য করেছিল। কিন্তু ধর্মান্তরিত হয়েও তিনি কখনও নিজের পূর্ব পরিচয়, সংস্কৃতি বা মাতৃভূমির প্রতি আনুগত্য ভুলে যাননি। বরং তিনি হয়ে উঠেছিলেন দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধনের এক অনন্য প্রতীক। ধর্মান্তরের পরে সরন্ধা নগরীতে তিনি নির্মাণ করেন ভারতের অন্যতম পুরনো ও সুন্দর ক্যাথেড্রাল সাহিবগড় গির্জা। ইউরোপীয় স্থাপত্যে নির্মিত এই গির্জা আজও তার শাসনকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই অনন্য পরিচয়ই বেগম সামরুকে আরও ব্যতিক্রমী করে তোলে এক নারী, যিনি সময়ের থেকে বহু যোজন এগিয়ে ছিলেন চিন্তা-চেতনায় ও কাজে।

১৮৩৬ সালে বেগম সামরুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ের অবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর সরন্ধা রাজ্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কিন্তু সাম্রাজ্যের পতন হলেও বেগম সামরুর নাম মুছে যায়নি।
তিনি ছিলেন এমন এক নারী, যিনি নিজের প্রজ্ঞা, কৌশল এবং সাহসিকতা দিয়ে পুরুষ-শাসিত এক কঠিন সময়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সমাজের প্রচলিত নিয়ম ভেঙে তিনি প্রমাণ করেছিলেন একজন নারী চাইলেই কেবল নাচ-গানের আসরে নয়, সাম্রাজ্যের মসনদেও নিজের জায়গা তৈরি করতে পারে। তারপরও ইতিহাসে বেগম সামরুকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে খুব কম। অথচ তাঁর জীবনকথা শুধু ভারতের ইতিহাস নয়, গোটা বিশ্বের নারী শক্তির লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। সাম্রাজ্যের রাজপ্রাসাদ থেকে সরন্ধার সেই গির্জা সবখানেই আজও যেন প্রতিধ্বনিত হয় তাঁর অনন্য জীবনকাব্য।
বেগম সামরুর জীবন কেবল ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর অধ্যায় নয় এটি এক অনন্য অনুপ্রেরণার গল্প। এক সাধারণ নর্তকী থেকে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক, কূটনীতিক এবং রাজ্যের শাসক হয়ে ওঠার এই পথ চলা দেখায়, প্রতিকূলতা কখনও কারও স্বপ্নের সীমা নির্ধারণ করতে পারে না। নারী হিসেবে, ধর্মান্তরিত একজন শাসক হিসেবে এবং বহুধা সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের প্রতীক হিসেবে বেগম সামরু আমাদের মনে করিয়ে দেন: সাহস, দূরদৃষ্টি আর কঠোর পরিশ্রম এই তিন অস্ত্র থাকলে জীবন বদলে দিতে সময় লাগে না। আজকের নারী সমাজের জন্য তাঁর জীবন এক প্রেরণার বাতিঘর সময়ের অনেক আগে যে নারী নিজের ভাগ্য নিজেই নির্মাণ করেছিলেন।
মস্তিষ্ক সব মনে রাখে..

আমরা কী খাচ্ছি, কতটা ঘুমোচ্ছি, কতটা হাঁটছি এসব প্রশ্ন এতদিন শরীরের সুস্থতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এগুলোর প্রভাব শরীর ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় আমাদের মস্তিষ্কে, এবং তা শুধু আজ নয় আগামী কয়েক সপ্তাহের জ্ঞানীয় পারফরম্যান্সকেও প্রভাবিত করে।

বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন, কিছু অভ্যাস যেমন কয়েকদিনের জন্য মস্তিষ্কের কার্যকারিতা সাময়িকভাবে বাড়াতে পারে, তেমনই ঘুম, ব্যায়াম কিংবা মানসিক উদ্দীপনার মতো অভ্যাস মস্তিষ্কে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে প্রায় ১৫ দিন পর্যন্ত!
অর্থাৎ, আজ আপনি যতটা ফোকাস করতে পারছেন, সেটা কেবল গতরাতের ঘুমের ওপর নির্ভর করে না, বরং গত দুই সপ্তাহের অভ্যাসেরও প্রতিফলন। এই গবেষণার আলোকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ও গুণমানসম্পন্ন ঘুম, এবং মানসিক উদ্দীপনার কাজ যেমন বই পড়া, পাজল সমাধান, নতুন কিছু শেখা নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে মস্তিষ্ক নতুন সংযোগ তৈরি করতে শেখে এবং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ায়।

এছাড়া সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, মননশীল অনুশীলন (যেমন মেডিটেশন), ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য এসবই নিউরনকে রক্ষা করে এবং মানসিক স্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। গবেষকেরা বলছেন, এই অভ্যাসগুলো জ্ঞানীয় অবক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এই গবেষণা ভবিষ্যতের মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার পথ খুলে দিতে পারে। কেবল ওষুধ বা থেরাপির উপর নির্ভর না করে, ব্যক্তি-ভিত্তিক সুস্থ অভ্যাসের মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্থিতিশীলতা এবং কার্যকারিতা দীর্ঘদিন ধরে বজায় রাখা যেতে পারে। আপনার মস্তিষ্ক প্রতিদিন আপনার পছন্দগুলো মনে রাখছে। অভ্যাসের বিন্দুগুলো একত্র হয়ে গড়ে তুলছে এক সুস্থ, স্থিতিশীল মানসিক ভবিষ্যৎ। তাই জ্ঞানীয় সুস্থতা আজ থেকেই শুরু হোক একটি ভালো অভ্যাস দিয়ে।
ইংল্যান্ডের রহস্যময় স্টোনহেঞ্জ..

কখনও ভোরের কোমল আলোয়, কখনও ঝলমলে দুপুরে ইংল্যান্ডের স্যালিসবুরি সমভূমির নীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে স্টোনহেঞ্জ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাথরের এই বৃত্ত যেন সময়ের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। প্রতিটি পাথরের স্তম্ভ একেকটি ইতিহাসের স্তম্ভ। প্রকাণ্ড পাথরগুলি কে রেখেছে, কীভাবে রেখেছে, কিসের উদ্দেশ্যে রেখেছে এই সব প্রশ্ন ঘুরপাক খায় হাজার বছর ধরে। আর প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বারবার মুগ্ধ হয়ে যায় গোটা মানবসভ্যতা।
যেন সময় নিজের ছন্দে ঘুরে ঘুরে সেই পাথরের বৃত্তের মাঝখানে নেচে চলে। প্রতিটি সূর্যোদয়, প্রতিটি ঋতু পরিবর্তন স্টোনহেঞ্জে এসে যেন এক অলিখিত ক্যালেন্ডারে রূপ নেয়। পাথরের ওই চক্র শুধু স্থাপত্যের নিদর্শন নয় এটা এক রহস্যময় ভাষা, যা সময়ের সঙ্গে কথা বলে। আর মানুষ সেই ভাষা বুঝতে চেয়েই যুগের পর যুগ দাঁড়িয়ে থেকেছে তার পাশে।

স্টোনহেঞ্জের দিকে তাকালে আজও বিস্ময়ে থমকে যায় মন। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগেই এই বিশাল পাথরের বৃত্ত কীভাবে তৈরি হলো? সে সময় তো ছিল না আধুনিক যন্ত্রপাতি, ছিল না প্রযুক্তির সুবিধা। প্রতিটি পাথরের ওজন ২৫ থেকে ৩০ টন। এত ভারী পাথর দূরদূরান্ত থেকে টেনে আনা, তারপর নিখুঁতভাবে স্থাপন করা এসব কেবল শক্তি নয়, ছিল অসাধারণ গণনা আর সংগঠনের দক্ষতা। বিশ্বাস করা হয়, কিছু পাথর ওয়েলসের পাহাড় থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূর থেকে আনা হয়েছিল। কীভাবে? কেউ বলেন নদীপথে ভেলায় ভাসিয়ে, কেউ বলেন বড় বড় কাঠের রোলার ব্যবহার করে টেনে নিয়ে আসা হয়েছিল।

তৎকালীন মানুষের জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রকৌশল, ও সাংগঠনিক ক্ষমতার নিদর্শন এই স্টোনহেঞ্জ। মনে হয় তারা সময়ের সঙ্গে কথা বলত, তার ছন্দ বুঝত। আজও প্রযুক্তির উন্নত যুগে দাঁড়িয়ে আমরা যখন তার দিকে তাকাই, তখনও মনে হয় এ এক প্রাচীন বিস্ময়, এক অপূর্ব বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন।
যত দিন গিয়েছে, স্টোনহেঞ্জ ঘিরে তৈরি হয়েছে গল্পের স্তরের পর স্তর। ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গেছে কিংবদন্তি, আর সেই সঙ্গে মানুষের অপার কৌতূহল। অনেকের মতে, স্টোনহেঞ্জ ছিল প্রাচীন ড্রুইড পুরোহিতদের পবিত্র আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্র। পূর্ণিমার আলোয়, সূর্যোদয়ের সময়ে সেখানে ধর্মীয় উৎসব হত। আবার কেউ বলেন, এটি ছিল এক বিশেষ সমাধিক্ষেত্র, যেখানে রাজা-প্রজারা মিলে মৃত্যুর পরে নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করত। কিন্তু শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসেই গল্প থেমে থাকেনি।ষড়যন্ত্রতত্ত্বপ্রেমীরা বলেন স্টোনহেঞ্জ কি তবে পৃথিবীতে এলিয়েনদের আগমনের সাক্ষী? এত নিখুঁতভাবে বিশাল পাথর স্থাপন, সূর্য-চন্দ্রের অক্ষ বরাবর সারি দেওয়া এসব কি মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল? কেউ কেউ একে ভিনগ্রহের প্রাণীদের তৈরি বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন। আবার কেউ বলেন, এই স্থাপনা ছিল এক প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার ল্যাবরেটরি যেখানে আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ আর ঋতুচক্রের হিসাব রাখা হত নিখুঁতভাবে। প্রতিটি গল্পের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিস্ময় আর অজানা এক রহস্যের আমন্ত্রণ। সত্যের খোঁজ করতে করতে মানুষ শুধু নতুন নতুন প্রশ্নই খুঁজে পেয়েছে।

স্টোনহেঞ্জের সবচেয়ে রহস্যময় বৈশিষ্ট্যের একটিই হয়তো এ সূর্য আর পাথরের নিখুঁত মিলন। প্রতিবছর ২১শে জুন, গ্রীষ্মের দীর্ঘতম দিনে, সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মি ঠিক সেইভাবে এসে পড়ে স্টোনহেঞ্জের নির্দিষ্ট দুটি পাথরের মাঝখানে, যা দেখে মনে হয় সূর্য নিজেই যেন সেই পাথরের পথ ধরে পৃথিবীতে অবতরণ করছে। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে, স্টোনহেঞ্জ নির্মাতারা শুধু শক্তিশালী শ্রমিকই ছিলেন না, ছিলেন দক্ষ জ্যোতির্বিদও। সূর্যের গতিপথ, ঋতুচক্র, সময়ের হিসাব সবকিছুকে নিখুঁতভাবে বুঝেই তারা স্থাপন করেছিলেন এই পাথরগুলো। তাদের কাছে সময় ছিল কেবল ঘড়ির কাঁটা নয়, ছিল প্রকৃতির চলমান সুরের ছন্দ। সেই ছন্দের গভীর জ্ঞান থেকেই তৈরি হয়েছিল স্টোনহেঞ্জ যা প্রকৃতি, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের এক অপূর্ব সেতু। আজও হাজার হাজার মানুষ বছরের এই বিশেষ দিনে জড়ো হন স্টোনহেঞ্জে। ভোরের প্রথম রোদ উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখেন সেই প্রাচীন বিস্ময় যাকে ঘিরে হাজার বছরের রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি।

হাজার হাজার বছর কেটে গেছে। সভ্যতা বদলেছে, রাজনীতি পাল্টেছে, প্রযুক্তি অগ্রসর হয়েছে কিন্তু স্টোনহেঞ্জ আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রথম দিনের মতোই স্থির, মৌন, রহস্যময়। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন, ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেছেন, কিন্তু স্টোনহেঞ্জ তার সব রহস্যের দরজা পুরোপুরি খুলে দেয়নি এখনও। সময়ের প্রবাহের মাঝে স্টোনহেঞ্জ যেন এক মস্তিষ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেখানে সমস্ত প্রশ্ন জমা পড়ে থাকে। হয়তো উত্তরও আছে, কিন্তু তা আমাদের ধরা দিচ্ছে না। প্রতিটি সূর্যোদয়ে, প্রতিটি পূর্ণিমায়, প্রতিটি মৌন রাত্রিতে স্টোনহেঞ্জ দাঁড়িয়ে থাকে মানব সভ্যতার কৌতূহলের সামনে। আর আমরা তার দিকে তাকিয়ে শুধু বলি "তুমি অনেক কিছু জানো, কিন্তু বলো না।" সময় জানে, কিন্তু সময় চুপ করে থাকে। ঠিক যেমন স্টোনহেঞ্জ।
কায়াহীনের সংসার
সোমা ব্যানার্জী

সকালে উঠে বাসি কাজ না সেরে তুম্বো মুখে আম গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসেছিল অন্নদা সুন্দরী। আজ দিন কয়েক হল মন মেজাজ বেজায় খারাপ তার। আর হবে নাই বা কেন ! তার এতদিনের সংসারে আগুন ধরেছে । আর ধরিয়েছে কে , না তার এতো দিনের সঙ্গী ওই বুড়ো ! বুড়োর এই বয়েসে কি ভীমরতি ধরলো গা !
একটু বসে মনের জ্বালা জুড়োবে সে জো নেই। খেন্তি ঝি কাজে এসেই অন্নদাকে বসে থাকতে দেখে অবাক । গিন্নী তো এত বেলা পর্যন্ত পা ঝুলিয়ে বসে থাকার লোক নয় বাপু। অন্য দিন কাজে ঢুকতে না ঢুকতেই খেন্তিকে কাজের ফিরিস্তি দেয়।
সে উপরমুখো চেয়ে গালে হাত দিয়ে কইলো , " হাই গো মা এত বেলা হই গেল তুমি এখনও বসে কেনে গো ! "
" মেলা না বকে নিজের কাজ সার তো বাছা। রোজ রোজ তোকে এক কথা বলে আর পারি নে খেন্তি ।" অন্নদা ঝামটে উঠলো।
" ইহ যত দোষ এই খেন্তির। ভালো কইতে গেনু তাতেও মেজাজ দেখো বুড়ির । " গজগজ করতে করতে কাজে লাগলো সে।
অন্নদা গাছের ওপর উদাস মুখে বসেই রইলো। একমাস আগেও যখন ওই জয়শ্রী থুড়ি জ্যাস মেয়েটা এ বাড়িতে এসেছিল নেমন্তন্ন খেতে তখনও কি সে জানতো যে এই মেয়েই তার সংসারে কাল ডেকে আনবে । না হলে সে থোড়াই নেমন্তন্ন করে খাওয়াতো ।
যেদিন কত্তা এসে বললো , "এ পাড়ায় একটা মিষ্টি ফুটফুটে মেয়ে একাই এসেছে , একেবারে নতুন। ওই আম বাগানের পাশের আস শ্যাওড়া গাছটায় মন খারাপ করে একা একাই বসে থাকে বেচারি। এখানে কিছুই চেনে না জানে না। কি খায় কে জানে। বলি গিন্নী একবার বাড়িতে ডাকবে নাকি ! "
সন্তানহীন অন্নদা সুন্দরীর মনটা টনটন করে উঠেছিল , " আহা কার বাছা গো কে জানে এই রাজ্যে হঠাৎ এসে পড়লো। আমরা না হয় দুজনে একসাথেই এসেছিলাম। যাও যাও তুমি আজ রাতেই এখানে খেতে বলে এসো। আমি নিজে রাঁধবো'খন।"
কত্তা তখনই বেরিয়ে পড়েছিলেন। অন্নদা ফের পিছু ডেকে বলে দিলেন , " শোনো তুমি বরং সঙ্গে করেই ওকে নিয়ে এসো।"
তা কত্তা নিয়ে এসেছিলেন । তার মন্দ লাগে নি মেয়েটিকে। অল্প বয়েস , দেখতেও বেশ। দেখ না দেখ মুখে ইংরিজির খই ফুটছে ঠিকই কিন্তু তার সঙ্গে মিষ্টি করে কথা কইছিলো। আর হাসিটি ভারী মন কাড়া। তিনি গল্প করতে করতে ভাবছিলেন , " কার কোল খালি করে এই বয়েসে চলে এলো গো ! মাথা খালি তার মানে বে থা সংসার কিছুই হয়ে ওঠেনি। তা নাই হলো এ রাজ্যে কি পাত্রের অভাব নাকি। আমরাই চারহাত এক করে দেব না হয়।"

যা হোক এর পরেও মেয়েটা যখন তখন এ বাড়িতে আসতো। অন্নদা সুন্দরী আর তার কত্তমশাই আদিনাথের পাতানো নাতি আকাশ নীলের সঙ্গেও বেশ ভাব হয়েছিল তার। আকাশ নীল চমৎকার ছেলে। এম টেক ইঞ্জিনিয়ার ছিল , দেখতেও চমৎকার। দুটিকে গল্প , খুনসুটি করতে দেখে অন্নদা দু চোখ ভরে দেখতেন আর মিটিমিটি হাসতেন। কি ভাবতেন তা অবশ্য কোনোদিন কারো কাছেই খোলসা করে বলেন নি। তবে কত্তা কে বলবেন ভাবছিলেন । তার মধ্যেই তো এই এই দুর্যোগের মেঘ ঘনালো। তিনি অবশ্য প্রথমটা কিছু টের পান নি। জ্যাস এলে প্রতিবেশীরা কৌতূহলী হয়ে পড়ে , কি সব যেন ফিসফাস করে। ও ওদের কাজ না কম্ম ! যখনই দেখো গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে আর পর নিন্দা পরচর্চা করছে। বেঁচে থাকতেও এই করতো বোধ হয় । ওই যে বলে না স্বভাব যায় না মলে ! এই সবই মনে মনে ভাবতেন তিনি।
ভুলটা ভাঙলো দিন সাতেক আগে। আজকাল এই ভুতের রাজ্যে প্রেতবুক আর ঘোস্টঅ্যাপের খুব রমরমা। হবে নাই বা কেন ! মানুষগুলো ওপার থেকে এপারে এসেও ফেসবুক , হোয়াটসঅ্যাপের নেশা মোটেই ছাড়তে পারে না। কেঁদে কেঁদে মরে। তাই জন্যই গুটিকয় সাহেব ভূত এই ফেসবুকের আদলে প্রেতবুক আর হোয়াটসঅ্যাপের আদলে ঘোস্টঅ্যাপ বানিয়ে ফেলেছে। এখন যাকে দেখো তার হাতেই স্মার্টফোন তাইতে মুখ গুঁজে সব যমালয় নেটওয়ার্কিং করে চলেছে। তাকেও কত্তা আদিনাথ একখানা স্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছেন। ঘোস্টঅ্যাপ তিনি ব্যবহার করেন , কারণ পাড়ার কমিউনিটির খবর , খেন্তি কাজে আসবে কি না এসব খবর তাকে রাখতে হয় ওই ঘোস্টঅ্যাপের মাধ্যমেই তবে প্রেতবুক তিনি করেন না।
সেদিন বাজারে গিয়েছিলেন একটু গুগলি কিনবেন বলে , হঠাৎ সুরমার সঙ্গে দেখা বহুকাল বাদে। এটা ওটা কথার পর সুরমা তাকে চাপা গলায় বলে উঠলো , " হ্যাঁ রে অন্ন আদিনাথ দার ব্যাপারটা কি বলতো !"
অন্নদা বুঝতে না পেরে হড়বড় করে বললেন, " ওর আবার কি খবর ! ঠিকই আছে ।"
" তুই যে কবে বুঝবি অন্নদা !" ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সুরমা , " বলি ওই অল্প বয়েসী মেয়েটা কে রে যার সঙ্গে আদিনাথদা গলা জড়িয়ে ছবি দিচ্ছে। আবার কি সব ক্যাপশন ছবির ! বুড়ো বয়সে এসব ! বলিহারি যাই বাপু ! চলি রে অন্ন , একা মানুষ গিয়ে আবার মেলা কাজ আমার ।"
সুরমা বাড়ির পথ ধরার পর অন্নদাও বাড়িমুখো হলেন। মনে মনে ভাবছিলেন , " সুরমাটার ভারী সন্দেহ বাতিক। বেঁচে থাকতে ওর বর ওকে ঠকিয়ে একখানা বিয়ে করেছিল। সেই থেকে কাউকে বিশ্বাস করে না বেচারি।"
গোটা দিন কাজের চাপে মনেও ছিল না কিছু। সন্ধ্যেবেলা আদিনাথ আড্ডা মেরে ফিরে ফ্রেশ হতে যেই গেছেন ফোন পিয়ানোর আওয়াজ করে নোটিফিকেশন ঢুকলো একখানা। হঠাৎ কি মনে হলো ফোনটা হাতে নিলেন অন্নদা। কোনো দিন যা করেন না তাই করলেন। ফোন হাতে নিয়ে আদিনাথের প্রেতবুকখানা খুলে ফেললেন। খুলেই তার চক্ষু ছানাবড়া। ওমাগো , এসব কি ! জ্যাসের সঙ্গে একটার পর একটা ছবি পোস্ট করেছেন আদিনাথ। আর কি সব ছবির শিরোনাম , জশন ই ইসক , জোড়ি নম্বর ওয়ান আরো কি কি সব জানি ! আর লোকেরও বলিহারি তাতে কত কমেন্ট আর লাইকের বন্যা। এমনকি আকাশ নীল পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছবিতে কমেন্ট করেছে ! বিশ্বাসঘাতক সব ! এই বুড়িটার চোখ বাঁচিয়ে সব কটা অনাসৃষ্টি কান্ডতে যোগ দিয়েছে তাহলে !
আদিনাথের গলার আওয়াজ পেতেই ফোন রেখে দিয়েছিলেন। ইচ্ছে হচ্ছিল বুড়োর গলা টিপে দেন। কিন্তু হায় ভূত হলে আর তো মারা যাবে না । তাই মনের রাগ মনেই চেপে রইলেন। ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন আদিনাথ আজকাল সব সময় হাসি হাসি মুখে থাকেন। যখন ইচ্ছে হুটহাট বেরিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি এসে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়াই এখন তার কাজ। অন্নদা যে গুছিয়ে চেপে ধরবেন সে সময়ই হচ্ছে কই। বিছানায় শুয়েই নাক ডাকতে থাকে তার। অন্নদা কাউকেই কিছু বলতেও পারছেন না। দিন কয়েক হলো পাড়ার লোকজন তাকে দেখেই গুজগুজ ফিসফাস করছে তিনি রক্তচক্ষু করে তাকালেই সব ভাল মানুষের মত মুখ করে কাজ মন দেয়। কিন্তু তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন ওরা মুখ চেপে হাসি গোপন করে তাকে দেখে। মাথায় আগুন জ্বলে অন্নদা সুন্দরীর। ওই বুড়োর একদিন কি তার একদিন করেই ছাড়বেন তিনি। গাছের ডালে বসে কি করা যায় তাই ভাবছিলেন । চিন্তার জল ছিঁড়ল খেন্তির গলার আওয়াজে।
" ও গিন্নী মা বলি বসে বসে কি ভাবছো গা ! কত্তা বাবু হেঁশেলে পচা কই আর কাদা চিংড়ি এনে রেখে গেছে । রাঁধবে কখন গা ? পিঁয়াজ রসুন বেটে দিয়ে যাব তো বলো ? এতো বেলা হলো মুখে তো কিছুটি দাও নি। তোমার আবার কি হল ! বলি বসে বসে পা দোলালে হবে ?"

" পিন্ডি খাব ! পিন্ডি এনে দে আমার ! ওসব মাছ টান মারে ফেলে দিগে যা দেখি। জ্বালাস নে আমাকে !"
অন্নদার কথায় গালে হাত দিলো খেন্তি , " ও মা গো মা ! আবার পিন্ডি খাবে কি গো ! পিন্ডি খেয়েই তো এপারে এইয়েছ। তাও পেট ভরেনি ? যা পারো করো বাপু। আমি গরীব লোক। অত কথায় কাজ কি ! এখনও চার ঘরে কাজ বাকি। দাড়ানোর সময় আছে নাকি আমার। ভালো বলতে গেনু তা উনি খ্যারখ্যার করে উঠলেন। আর পারি না বাপু। কবে কে মুক্তি পাব কে জানে। ভূতের নেত্য দেখে দেখে চোখ পচে গেল গা !" গজ গজ করতে করতে চলে গেল খেন্তি।
বসে বসে বেলা প্রায় পড়ে এলো। আদিনাথ আজ বাড়ি ফেরেন নি। বহুবার ফোন করলেও বার বার সুইচ অফ বলছে । এমন তো কোনো দিন হয় না।
অল্প অল্প শীতল বাতাস বইছে। অন্নদা ভাবতে ভাবতে একটু ঝিমোচ্ছিল বোধ হয় চোখ বুজে। টুং করে একখানা মেসেজ ঢুকলো ঘোস্টঅ্যাপে। তন্দ্রা ভেঙে চমকে ফোনখানা কোঁচড় থেকে বের করে চোখের সামনে ধরলো অন্নদা সুন্দরী। অজানা নম্বর থেকে একখানা মেসেজ এসেছে। মেসেজটা খুলতেই যেন শক লাগলো তার । পরিষ্কার বাংলায় লেখা রয়েছে , " চারহাত আজ এক হতে চলেছে। কাদের হাত ? জানতে হলে আজ রাতে রমনার মাঠে গা ছমছম ম্যারেজ হলে আসুন । সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।"
ঘুম ছুটে চোখ থেকে আগুন বের হতে লাগলো। তিনি বুঝতে পারলেন আজ এই কারণেই বুড়োর আজ বাড়ি ফেরা হয় নি। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। ঝপ করে মাটিতে নামলেন অন্নদা। ঘরে গিয়ে একখানা চওড়া ঢালা লাল পাড়ের গরদ পরলেন। এটা ভারী প্রিয় শাড়ি ছিল। একসময় এটা পরে দুর্গা বরণে গেলে সবাই বলতো চোখ ফেরানো যায় না। বড় করে এক খানা সিঁদুরের টিপ আঁকলেন কপালে। ঝনাত করে আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা ঘুরিয়ে পিঠের দিকে ফেলে যখন রমখিলাওনের রিকশায় উঠলেন তখন আঁধার নেমে গেছে। পাড়ার রাস্তাঘাট একটি ফাঁকা আজ। লোকজন বোধ হয় সব ওই বিটলে বুড়োর বিয়ে খেতে গেছে।
রোসো হওয়াচ্ছি চার হাত এক তোমাদের !
….." এ মাইজি কাঁহা জানা হ্যায় ?" রামখিলাওনের গলার আওয়াজে সৎবিত ফিরলো।
….." ওই যে রমনার মাঠে নতুন বিয়ে বাড়ি তৈরি হুয়া ওইখানে যানা হ্যায়। চলো তাড়াতাড়ি । "
….." জ্বী মাইজী "।
রামখিলাওন একটু আশ্চর্য হলো মাইজি আজ একটু অন্যরকম যেন। অন্য দিন দেখা হলেই তার বউ ফুলমতিয়ার খবর নেয় আজ কিছুই বললো না।

রমনার মাঠের কাছে আসতেই চোখে পড়লো গা ছমছম ম্যারেজ হলের বাইরে ঘেঁটু ফুলের সজ্জা। কাছে এসে রামখিলাওন অন্নদাকে নামিয়ে রিকশা সাইড করে নিজেও টুক করে ঢুকে পড়লো। রক্তচক্ষু করে ব্যাপারটা দেখলেন অন্নদা। এলাহী আয়োজন। সাউন্ড বক্সে লো ভলিউমে ব্যাঙের ডাক আর শেয়ালের ডাকের ফিউশন বাজছে। চারিদিকে টুপটাপ আলো। ইউনিফর্ম পরা ক্যাটারিংয়ের লোকজন গ্লাসে বরফ দেওয়া পানা আর কি সব মেশানো সবুজ রঙের সরবত , রক্ত দেওয়া ওয়াইন সার্ভ করে বেড়াচ্ছে হাতে ট্রে নিয়ে। ওদিকে রান্নার খুশবু ভেসে আসছে। পাশের বাড়ির ছেলেপুলেগুলো হাতে সরবতের গ্লাস নিয়ে এদিক পানেই আসছিল হল্লা করতে করতে , অন্নদা কে দেখেই কোথায় সেঁধিয়ে পড়লো।
অন্নদার এবার কান্না পাচ্ছিল। বেঁচে থাকতে পঁচিশ আর মরার পর না হোক আরো পঁচিশ মোট পঞ্চাশ বছর একসাথে থাকা। তারপর ও লোকটা পারলো এমন ধোঁকা দিতে তাকে ! সামান্য নাক টেনে বাড়ির ভিতর দুপদুপ করে পা ফেলে ঢুকলেন তিনি। ভিতরের বাগানে বিয়ের আসর বসেছে। কাছে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে তিনি একখানা বাজখাঁই চিৎকার দিতে যাবেন হঠাৎ তার হাতখানা কে যেন আস্তে করে ধরলো। চমকে চেয়ে দেখেন আকাশ নীল। কি চমৎকার দেখাচ্ছে। জরীর কাজ করা তসর রঙা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরেছে সে। কোথায় এমন সুন্দর নাতির বউ বরণ করবেন তা না অলপ্পেয়ে মিনসে এই বুড়ো বয়সে বিয়েতে বসলো। তিনি চোখ চেয়ে ভালো করে চাইতে পারছিলেন না আকাশ নীলের দিকে। সেই কারণেই বোধ হয় আকাশ নীলের গলার ঘেঁটু ফুলের মালা ঝুলছে খেয়ালই করলেন না তিনি। গুমগুমে গলায় বলে উঠলেন , " তিনি কই , তাকে চাই ।"
তাকে দেখেই চারিদিকে এসে পড়েছে এসে পড়েছে গুনগুন। তার মধ্যে দিয়েই তিনি আকাশের হাত ধরে বিয়ের মণ্ডপের দিকে গেলেন।
বিয়ের মণ্ডপের কাছে গিয়ে তার হাত ছেড়ে আকাশ নীল মণ্ডপের ভেতর ঢুকে পড়লো। ওদিকে কনে কে একদল পিড়িতে চাপিয়ে ঢুকে পড়েছে মণ্ডপে। তার চোখ তখন এদিক ওদিক আদিনাথ কে খুঁজছে। বুড়ো গেল কই। ঠিক ঘাপটি মেরেছে তাকে দেখেই। ওদিকে কারা যেন উলু দিয়ে উঠলো।
হঠাৎ তিনি হতবাক হয়ে দেখলেন জ্যাস আর আকাশ নীল মুখোমুখি দাড়িয়ে একে অপরের গলায় মালা পরিয়ে দিল। পাশে দাড়িয়ে বেম্মদত্তি বলে উঠলেন , কই মেয়েকে কে সম্প্রদান করবেন চলে আসুন।
হঠাৎ পাশ থেকে খুব নরম গলায় আদিনাথ বলে উঠলেন , "কই গো গিন্নী চলো। আমার নাতনি আর তোমার নাতির আজ বিয়ে যে ! বিয়েতে বসি চলো। আমাদের নিজেদের সন্তান সুখ আমরা পাইনি তাতে কি একেবারে নাতি নাতনির জোড়া সুখ। সুদে আসলে কেমন পুষিয়ে দিলুম বলো ।"

অন্নদার তখন চোখ ভর্তি জল। তিনি কি সব ভেবে বসেছিলেন এতো দিন ধরে। সবাই সব জেনে বুঝে মজা দেখছিল তবে। আসেপাশের জমায়েত ভূতেরা সব হো হো করে হেসে উঠলো। পাড়ার চ্যাংড়া ভূতেরা কেউ কেউ এক কাঠি সরেস তারা বললে চলো দাদু দিদা তোমাদের ও আজ আবার বিয়ে হয়ে যাক। অন্নদা সুন্দরী লজ্জায় মরেন আর কি !
বিয়ের পরে ভূতেদের বিরাট বাসর বসলো রমনার মাঠে। ধুতি পাঞ্জাবি পরা আদিনাথ সেই বাসরে অন্নদা সুন্দরীর চারিদিকে ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগলেন , " মন দিলে না বঁধূ , মন নিলে না বঁধূ ……"
অন্নদা সুন্দরী ঘোমটা দাঁতে চেপে জলভরা চোখে একখানা কটাক্ষ হেনে মধুর হেসে বললেন , " আ মরণ !"
Comments