
আমি শ্রী সরোজ মজুমদার, একজন পদার্থবিদ্যার স্কুল শিক্ষক, ভ্রমণ করতে ভালোবাসি । সময় ও সুযোগ পেলে বাইক নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি । এবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম সুদূর হিমাচল প্রদেশের শিমলা, সারাহান; হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র ও উত্তর প্রদেশের বারাণসীর উদ্দ্যেশে ।
বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম ১১ই সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার ও ঘুরে বাড়ি ফিরেছিলাম ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার। আমি আমার প্রতিদিনের যাত্রাপথের কাহিনী নিম্নে বর্ণনা করলাম।

১১ই সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১ম দিন (কলকাতা থেকে উত্তর প্রদেশের গোপীগঞ্জ, ৭৩০কিমি) :
এবারের সেপ্টেম্বরে হিমাচল প্রদেশের শিমলা, সারাহান হয়ে কল্পা, কিন্নর ও স্পিতি ভ্যালি রাইডে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। গতবছর এই সময়ে লাদাখ গিয়েছিলাম। প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু জুলাই মাস থেকে হিমাচলে লাগাতার বৃষ্টি ও তার দারুন ধসের খবর পাচ্ছিলাম । ১লা সেপ্টেম্বর বেরনোর প্ল্যান ছিল। বাইকের সামনের ও পিছনের দুটি চাকাতেই নতুন টায়ার লাগালাম । পুরো অগাস্ট মাস ধরে বৃষ্টি ও বন্যা হিমাচলে তাণ্ডব চালালো। মানালি থেকে কুলু হয়ে মান্ডি পর্যন্ত রাস্তার একটা বরো অংশ ল্যান্ডস্লাইড এর জন্য বিপর্যস্ত হয়ে গেলো। চন্ডিগড় হয়ে শিমলা যাওয়ার রাস্তাও একাধিক জায়গায় ল্যান্ডস্লাইডের জন্য বেহাল হয়ে পড়ল। মন শক্ত রেখে বাইকের সার্ভিসিংটা সেরে নিলাম। রাইডের অন্যান্য প্রস্তূতি সেরে যখন বেরনোর কাউন্টডাউন চলছে ঠিক তখন ৩১শে অগাস্ট মধ্য দুপুরে আমার কর্মক্ষেত্রে পত্রবাহী এক দুঃসংবাদ আমাকে স্তব্ধ করে দিলো । কিছুদিনের জন্য থমকে গেলাম ।
“… আমাকে যে বাঁধবে ধরে, এই হবে যার সাধন / সে কি অমনি হবে …”, ১১ই সেপ্টেম্বর রাত ২টোয় ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে চা ও একটু হালকা খাবার খেয়ে ভোর ঠিক ৩টেয় বেলঘরিয়ার বাড়ি থেকে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হিমাচলের উদ্দ্যেশে । “… গণি গণি দিন খন চঞ্চল করি মন / বোলো না, 'যাই কি নাহি যাই রে …” । ডানলপ, বালি ব্রিজ, ডানকুনি টোল প্লাজা হয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ বা দিল্লী রোড ধরে গুরাপ, পালসিট টোল প্লাজা, শক্তিগড়, বর্ধমান হয়ে দুর্গাপুর পৌঁছাবার একটু আগে দিনের আলো এলো । এরপর রানীগঞ্জ, আসানসোল, কুলটি হয়ে ২২৫ কিমি পথ পেরিয়ে সকাল ৭টায় বরাকরে এসে বরাকর নদীর উপর নির্মিত ‘বরাকর রিভার ব্রীজের’ উপর উঠতেই পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছেড়ে ঝাড়খন্ড রাজ্যে প্রবেশ করলাম ।
ঝাড়খণ্ডে ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ এর দুপাশে অনেক তরোয়াল ও লাঠির দোকান দেখা যাবে । তোপচাঁচি পেরিয়ে সকাল সাড়ে ৮টায় ঝাড়খণ্ডের কুলগোতে এসে ‘শুভম লাইন হোটেলে’ দুটো রুটি সঙ্গে টক-দই আর এক কাপ ব্ল্যাক-টি সহযোগে প্রাতরাশ সেরে নিলাম । এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, আমার এই রাইডেও প্রতিদিনের খাবার মেনু ছিল এইরকম - সকালে দুটো রুটি ও টক দই সাথে ব্ল্যাক টি; দুপুরে ভেজ- ফ্রাইড রাইস, টক দই ও স্যালাড, আর রাতে দুটো রুটি ও টক দই। এছাড়া যাত্রাপথে সকালের দিকে ও বিকেলের দিকে দুটো টি-ব্রেক নিতাম। জামতাড়া, বর্হি, চৌপারন, হয়ে ফল্গু নদির সেতুতে চলে আসতেই ঝাড়খন্ড ছেড়ে বিহার রাজ্যে প্রবেশ করলাম। ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ এর দুপাশ জুড়ে সারা রাস্তায় প্রচুর কাশ ফুল ফুটেছে দেখলাম ।
বিহারের ঔরঙ্গাবাদ, সোন নদী পেরিয়ে দেহরীতে এসে দুপুর ২টোয় ‘টাইগার লাইন হোটেলে’ লাঞ্চ সেরে নিলাম। এর পর শুধু এগিয়ে চলা । বিকেল ৫টায় বারানসিতে গঙ্গা নদীর উপর ব্রিজ পেরিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ ধরে এগিয়ে চললাম গোপীগঞ্জের দিকে। এইসময় থেকেই বৃষ্টির মধ্যে পড়লাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে বর্ধমান থেকে বারানসির আগে পর্যন্ত ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ এর অবস্থা খুবই খারাপ; পুরো রাস্তা জুড়েই ডাইভারশন ও রাস্তার কাজ চলছে।

অবশেষে ৭৩০কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে উত্তরপ্রদেশের বারানসি শহরকে পিছনে ফেলে রেখে সন্ধ্যা ৬:৩০টায়; “আমার দিন ফুরিয়ে” পৌঁছে গেলাম গোপীগঞ্জের, ‘রাজপূত ধাবায়’ যেখানে আমার আজকের রাত্রিবাস। আজকের সারা দিনের মোট অতিক্রান্ত দূরত্ব হলো ৭৩০কিমি। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে, বাড়িতে ফোন করে রাত ৯টায় শুয়ে পড়লাম।
হোটেল : রাজপূত ধাবা; গোপীগঞ্জ, উত্তর প্রদেশ-২২১৩০৩। দূরাভাষ – ০৯৭৯৩৭৭১০২২, ০৯৪১৫৩৬০২১৫.
১২ই সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ২য় দিন (উত্তর প্রদেশের গোপীগঞ্জ থেকে গ্রেটার-নয়ডা, ৭১০কিমি) :
ভোর ৩টেয় মোবাইলে অ্যালার্ম এর আওয়াজে; “নব আনন্দে জেগে” বিছানা থেকে উঠে স্নান সেরে নিয়ে বাইকে লাগেজ চাপিয়ে, হোটেলে চা পান সেরে ভোর ৪:৫৩য় উত্তরপ্রদেশের গোপীগঞ্জ থেকে বেরিয়ে পড়লাম গ্রেটার-নয়ডার উদ্দ্যেশ্যে, ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ ধরে। হান্ডিয়া হয়ে প্রয়াগরাজ শহরকে বাইপাস করে সকাল ৬:৩০এ পৌঁছে গেলাম ধিমিতে গঙ্গা নদির উপর ব্রিজে। সকালের গঙ্গা নদীর রূপ মনোমুগ্ধকর। সকাল ৮:২০তে ফতেপুরের কিছুটা আগে ‘নেতা ধাবা ও রেস্টুরেন্টে’ প্রাতরাশ করে নিলাম। এরপর কানপুর, আউরাইয়া হয়ে ইটাওয়া শহরে এসে বাইকে পেট্রল ভরে নিলাম। পথে হলো দেরি, কারণ মাঝে মাঝে বৃষ্টির মধ্যে পড়তে হলো।

বারানসির পর থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ এর অবস্থা খুবই ভালো। জসবন্তনগর, ‘আগ্রা এক্সপ্রেসওয়ে কাট’ হয়ে আগ্রা-লখনউ এক্সপ্রেসওয়ের টোল বুথে এসে বাইকের জন্য ৮৫ টাকা টোল ফী দিয়ে আগ্রা-লখনউ এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ করলাম, ঘড়িতে সময় তখন দুপুর ১২:৩০। অসাধারণ রাস্তা, বাইক ঘন্টায় ১০০ কিমি বা তার বেশি গতিতে ছোটাতে এখানে কোনো অসুবিধে নেই। তাই; “তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ” করে অতি দ্রুত আগ্রা শহরকে বাইপাস করে চলে এলাম যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে। টোল গেটে বাইকের জন্য ২০৫ টাকা টোল ফী দিয়ে যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে বাইক হাঁকালাম পুরো ১০০তে। দুপুর ২:১৫তে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে ‘ম্যাজিক ফুড জোন’ রেঁস্তোরাতে দুপুরের আহার সেরে নিয়ে আবার চলতে থাকা। আগ্রা-লখনউ এক্সপ্রেসওয়ে এবং যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে বাইক চালানোর অভিজ্ঞাতা অসাধারণ। “পথের শেষ কোথায়” ভাবতে ভাবতে বিকেল ৫:২০তে গ্রেটার নয়ডার “এঞ্জেল এন.আর.আই” হোটেলে পৌঁছে গেলাম। আজকের মোট অতিক্রান্ত দূরত্ব হলো ৭১০কিমি। সন্ধ্যায় আমার হোটেলের অনতিদূরের “জয়পি গ্রিন্স পরি চক” মেট্রো স্টেশন ঘুরে, স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে বাড়িতে ফোন করলাম। প্রতিদিনের ন্যায় রাত ৯টায় শুয়ে পড়লাম।
হোটেল : এঞ্জেল এন.আর.আই হোটেল; পরি চক, গ্রেটার-নয়ডা, উত্তর প্রদেশে-২০১৩১০।
দূরাভাষ – ০৯৮৯৯৫৭২৫৮০.
১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৩য় দিন (গ্রেটার-নয়ডা থেকে হিমাচল প্রদেশের শিমলা, ৩৯০কিমি) :
প্রতিদিনের ন্যায় ভোর ৩টেয় ঘুম থেকে উঠে, সব কাজ সেরে ভোর ৪:৩০এ রাইড শুরু করলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ইস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়েতে। কিন্তু “একি গভীর বাণী এল ঘন মেঘের আড়াল ধরে” টোল গেটে আমাকে জানানো হলো যে এই রাস্তায় এখন আর বাইক এলাও নয়। অথচ গতবছর লাদাখ যাবার সময় আমি ইস্টার্ন পেরিফেরাল এক্সপ্রেসওয়ে দিয়েই গিয়েছিলাম। অগত্যা বাইক ঘুরিয়ে পরি চক হয়ে ‘গ্রেটার-নয়ডা’- নয়ডা এক্সপ্রেসওয়ে ধরলাম। নয়ডা ছাড়িয়ে ভারতের রাজধানী শহর দিল্লিতে প্রবেশ করলাম। ভোর রাতের দিল্লী শহর দেখতে ভীষণ ভালো লাগছিলো। দিল্লী শহর জুড়ে চারিদিকে সদ্য সমাপ্ত শুধু জি-২০ সামিটের হোর্ডিং। শহরের রাস্তার দুপাশের গাছগুলি সুন্দর করে সাজানো আর তাতে সুন্দর আলোর রোশনাইতে ভর্তি যেন “সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি”।
লাল কেল্লার পাশদিয়ে বাইক চালিয়ে যেতে যেতে মনে অন্য একরকম অনুভূতি খেলে গেলো। আস্তে আস্তে দিল্লী শহর কে পিছনে ফেলে হরিয়ানা রাজ্যের সোনিপতে চলে এলাম। ছোট করে একটা চা পানের বিরতি সেরে ন্যাশনাল হাইওয়ে-৪৪ ধরে আবার পথ চলা শুরু করলাম। পানিপত হয়ে কারনাল শহর ছাড়িয়ে ‘নিউ ঝিলমিল ধাবাতে’ সকাল ৮:৫০এ ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। কুরুক্ষেত্র, শাহবাদ, আমবালা হয়ে লোহাগড়ে এসে হরিয়ানা রাজ্য ছেড়ে পাঞ্জাবে প্রবেশ করলাম। এরপর ‘হরিয়ানা স্বর্ণ দ্বার’ হয়ে চন্ডিগড় শহরকে বামদিকে রেখে হিমালয়ান এক্সপ্রেসওয়ে বা ন্যাশনাল হাইওয়ে-৫ ধরে কালকা হয়ে হিমাচল প্রদেশে চলে এলাম। রাস্তায় একাধিকবার বৃষ্টির জন্য যাত্রা ভঙ্গ হলো।
হিমাচল প্রদেশে এসে পাহাড়ের দেখা পেয়ে “ওই গো তোমার আনন্দে” মনটা ভোরে গেলো। দুপুর ১:৩০এ সোলান শহরের ‘শর্মা ভেজেটেরিয়ান ধাবাতে’ মধ্যাহ্ন ভোজ করে নিলাম। জুলাই, অগাস্ট মাস ধরে হিমাচলে বন্যা ও ল্যান্ডস্লাইডের যে তাণ্ডব চলে ছিল তার চিহ্ন রাস্তায় দেখতে পেলাম। কোথাও রাস্তার একটা অংশ পুরো ধসে নেমে গেছে; আবার কোথাও রাস্তার একটা অংশ ধস নেমে ব্লক হয়ে আছে। হিমাচলের সবুজ পাহাড় মনোমুগ্ধকর। শিমলা শহরের দিকে যত এগোচ্ছিলাম সাদা মেঘ এসে পাহাড়ের সবুজকে জড়িয়ে ধরছিল।
মেঘের ঘনত্ব মাঝে মাঝে এতটাই বেড়ে যাচ্ছিলো, যে রাস্তা অন্ধকার হয়ে দৃশ্যমানতা খুব কমে যাচ্ছিলো; তাই “অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে” ভেবে অগত্যা বাইকের হেডলাইট জ্বালিয়ে পথ চলতে থাকলাম। ধরমপুর, সোলান, কান্দাঘাট, শঘি, তাঁরাদেবী, হয়ে শিমলার ওয়েলকাম গেট পেরিয়ে বিকেল ৫:৪০এ শিমলার হোটেলে চেক ইন করলাম । আজকের পথ পাড়ি হলো ৩৯০কিমি। হোটেলে স্নান সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যা ৭টার সময় গেলাম শিমলা কালীবাড়িতে। মন্দিরে তখন সন্ধ্যা আরতি চলছিল। মন্দিরের চত্বর থেকে দেখা আলোয় উদ্ভাসিত রাতের শিমলা শহরের রূপ ভোলার নয়। রাতের বেলাতেও সাদা মেঘ, অতৃপ্তিতে “আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে” ভেবে উড়ে উড়ে এসে, মাকে দেখার জন্য মন্দিরের মধ্যে ঢুকে পরছিল। মন্দিরের ক্যান্টিন থেকে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে শুয়ে পড়লাম।
হোটেল : হোটেল অনুরাগ; সার্কুলার রোড, শিমলা, হিমাচল প্রদেশ-১৭১০০৩। দূরাভাষ – ০৮৫৮০৬২৮৪৩২.
১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৪র্থ দিন (হিমাচল প্রদেশের শিমলা থেকে সারাহান, ১৭০কিমি) :
রাতে শিমলাতে ঠান্ডাটা ভালোই ছিল। ভোর ৪টেয় ঘুম থেকে উঠে, হোটেলের রুমের বাইরে এসে দেখি চারিদিক অন্ধকার, রাস্তার লাইট গুলো, “হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলির” মতো করে জ্বলছে, রাস্তায় পন্যবাহি গাড়ি গুলি সব চলাচল করছে, আর দুস্টু মেঘেরা তখনও ছুঁটে বেড়াচ্ছে। রেডি হয়ে সকাল ৬টায় শিমলা থেকে সার্কুলার রোড দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। সকালের রোদ মাখা সবুজ পাহাড় মায়াবী পরিবেশ তৈরী করে রেখেছিল। কুফরী, ফাগু, মাটিয়ানা হয়ে নারকান্ডায় পৌঁছাতেই রাস্তার দুপাশে অনেক আপেল বাগান দেখতে পেলাম। লাল ও সবুজ দুধরনেরই আপেল গাছ দেখতে পেলাম। অধিকাংশ আপেল গাছই একধরনের সাদা রঙ্গের নেট দিয়ে ঢাকা ছিল। নারকান্ডা থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে-৫ ধরে সকাল ৯:৩০টায় কুমারসেইনে পৌঁছে “শ্রী রাজেস্বরী শুধ বৈষ্ণব ভোজনালায়ে” প্রাতঃরাশ করে নিলাম। লু থেকে শতদ্রু নদী আমার রাস্তার বামদিকের সঙ্গী হলো। রাস্তায় বিপরীত দিক থেকে আসা কলকাতার একজন রাইডারের কাছ থেকে একটি দূসংবাদ পেলাম। জানতে পেলাম যে জিওরির পরে একটি জায়াগায় রাস্তায় ল্যান্ডস্লাইড হয়ে রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে। অতএব জিওরির পর আর এগনো সম্ভব নয়। খবরটা শুনে মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। কিছুটা চলার পরে অপূর্ব সুন্দর শতলুজ ভ্যালিতে এসে দেখলাম দুপাশের দুটি সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে এখানে শতদ্রু নদী বয়ে চলেছে।
বিঠাল, খোপড়ী, ঝাকরি হয়ে দুপুর ২:৩০এ রামপুরের চৌহান ধাবায় এসে মধ্যান্ন ভোজন সম্পন্ন করলাম। পেট্রল পাম্প থেকে বাইকে ফুল ট্যাঙ্ক পেট্রল ভোরে নিলাম। এরপর মলগি, জিওরি হয়ে সারাহানের ‘আল্পিন ভিউ’ হোটেলে পৌছালাম বিকেল ৩:২০তে। হোটেলের পিছন দিকটায় বড় আপেল বাগান আছে কিন্তু গাছে একটিও আপেল নেই। হোটেলে চেক ইন করে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শ্রী ভীম কালি জী মন্দির দর্শনের জন্য। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা একটি অন্যান্য সুন্দর মন্দির। মন্দিরের মধ্যে সুন্দর ফুলের বাগান আছে।
পুরো মন্দিরটি ঘুরে দেখতে অনেকটা সময় লাগলো। মন্দির ঘুরে ফেরার পথে একটি নাম না জানা ছোট্ট পাহাড়ী ঝর্ণা দেখতে পেলাম। হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। হোটেলের লন থেকে রাতের সারাহান শহরটিকে দেখতে যে কি দারুন লাগছিল। বিভিন্ন যাগায় ফোন করে নিশ্চিত হলাম যে জিওরির পর যেখানে রোড ব্লক হয়ে আছে তা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে চালু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অগত্যা স্পিতি রাইড বাতিল করে, সারাহান থেকে পর দিন ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। আজকের সারাদিনের পথচলা ছিল ১৭০কিমি।
হোটেল : ও.ই.ও ৪৫১২৮ আল্পিন ভিউ; জীয়রী-সারাহান রোড, জীয়রী, হিমাচল প্রদেশ-১৭২১০২ ।
দূরাভাষ – ০৯৪১৮৬৬৮০৩১.
১৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৫ম দিন (সারাহান থেকে কুরুক্ষেত্র, হরিয়ানা; ৩৬৩কিমি) :
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভোর ৪টেয় ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে রেডি হয়ে সকাল ৬টায় বাইক নিয়ে শিমলার দিকে ফেরার পথ ধরলাম, ল্যান্ডস্লাইডের জন্য এভাবে ট্যুর অসমাপ্ত রেখে ফিরতে হবে ভাবিনি। সকাল সকাল শতদ্রু নদীর শান্ত জলধারা আর পাহাড়ের মাথায় উদিত সূর্যের প্রথম কিরণ মনে প্রশান্তি আনছিল। সকাল ৮:৩০টায় কুমারসেইনে পৌঁছে “হ্যাপি ভোজনালায়ে” ব্রেকফাস্ট করে নিলাম।
ঝাকড়ি, রামপুর, নাড়কান্ডা, কুফরি হয়ে শিমলায় এসেগেলাম। শিমলা শহরে কিছুটা সময় কাটিয়ে সোলান হয়ে কুমারহাটির 'পিনকি দা ধাবাতে ' এসে দুপুর দুটোর সময় লাঞ্চ সেরে নিলাম। এরপর কালকা, পিঞ্জর হয়ে চন্ডিগড় সিটিকে ডানদিকে রেখে আম্বালা হয়ে হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রে পৌঁছে গেলাম। বিকেল ৪:৩০তে হোটেল ব্লিসে চেক ইন করলাম। হোটেলে একটু বিশ্রাম করে বাইক নিয়ে চলে গেলাম ব্রহ্ম সরোবরে। বিশাল বরো সরোবর, বিপুল জলরাশি। সরোবরের মাঝে মন্দির।
সরোবরের একপাশে শ্রীকৃষ্ণ সারথি সহ অর্জুনের বিশাল বারো রথ আছে। মহাভারতে কথিত আছে যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষ দিনে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দুর্যোধন এই সরোবরের জলের তলায় লুকিয়ে ছিল। সন্ধ্যাবেলায় সরোবরের একটি জায়গায়, সন্ধ্যা আরতি ও লাইট এন্ড সাউন্ড শো হয়। পায়ে হেঁটে পুরো সরোবরটি একবার প্রদক্ষিণ করতে অনেকটা সময় লাগে। সরোবর ঘুরে কল্পনা চাওলা প্লানেটোরিয়ামের সামনে দিয়ে চলে গেলাম জ্যোতিসার তীর্থে। এখানে একটি শিব মন্দির, একটি বরো সরোবর ও একটি বহু পুরানো বট গাছ আছে। জ্যোতিসার সরোবরের এক পাশে শ্রীকৃষ্ণের বিরাট স্বরূপ পূর্ণ মূর্তি আছে যেখানে সন্ধ্যাবেলায় লাইট এন্ড সাউন্ড শো হয়। অসাধারণ সুন্দর লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখে বাইকে পেট্রল ভরে হোটেলে ফিরলাম। আজকের সারাদিনের পথচলা ছিলো ৩৬৩কিমি।
রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে, বাড়িতে ফোন করে শুয়ে পড়লাম।
হোটেল : হোটেল ব্লিস; সেক্টর ২, কুরুক্ষেত্র, হরিয়ানা- ১৩৬১১৮ ।
দূরভাষ – ০৯৪৬৬২৬৫০৭৩.
১৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৬ষ্ঠ দিন (কুরুক্ষেত্র থেকে কানপুর, উত্তর প্রদেশ; ৬৬৫কিমি) :
যথারীতি ভোর ৩টেয় ঘুম থেকে উঠে ভোর ৪:২০তে কুরুক্ষেত্র থেকে যুদ্ধ শুরু করলাম। ন্যাশনাল হাইওয়ে-৪৪ ধরে কার্নাল, পানিপত, সোনিপত পেরিয়ে দিল্লি শহরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। এতো সকালের দিকে দিল্লি শহরের কর্মব্যস্ততা ও যানজট তখনও সেভাবে শুরু হয় নি। নয়ডা, গ্রেটার নয়ডা পেরিয়ে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের টোল গেটে টোল ট্যাক্স দিয়ে আগ্রার দিকে এগিয়ে চললাম।
পথে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে প্রাতরাশ করে নিলাম। আগ্রায় পৌছে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের এক্সিট গেট থেকে বেরিয়ে একটি রেস্তোরাতে চা পান করলাম আর বাড়ির জন্য আগ্রার বিখ্যাত পেঠা মিষ্টি কিনে নিলাম। এবার আগ্রা-লখনউ এক্সপ্রেসওয়ের টোল বুথে টোল ফী দিয়ে ইটাওয়া শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম। ইটাওয়া তে এসে ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ এ উঠে পড়লাম। বাবারপুর, আউরাইয়া, কানপুর পেরিয়ে ভোর থেকে মোট ৬৬৫কিমি রাস্তা অতিক্রম করে শাদীপুরের ‘শিবা হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে’ বিকেল ৫টার সময় চেক ইন করলাম।
হোটেল : শিবা হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট; শাদিপুর, এন.এইচ -১৯, নিয়ার কানপুর, উত্তর প্রদেশ-২১২৬৬৫ । দূরাভাষ –০৮৪২৩৮৯২২৪৩.
১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৭ম দিন (উত্তর প্রদেশের কানপুর থেকে বারানসি; ৩০০কিমি) :
সকাল ৫:৩০এ বারানসির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। ফতেপুর, প্রয়াগরাজ, হান্ডিয়া, গোপীগঞ্জ হয়ে দুপুর ১টার সময় বারানসির আসি ঘাটের কাছে “ওম গেস্ট হাউস” হোটেলে চেক ইন করলাম। “তিওয়ারি ভোজনালায়ে” দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ করে এবং সিয়ারাম ডেয়ারী থেকে বারানসির বিখ্যাত মালাই ল্যাসি খেয়ে, হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে গেলাম শ্রীকাশি বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিতে। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম এই মন্দির। পুজোর উপাচার সংগ্রহ করে পুজো দেবার নির্দিষ্ট লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পুজো দেয়া শেষ করে পুরো মন্দির চত্বর ও মন্দির সংলগ্ন গঙ্গার ঘাটটি পরিদর্শন সেরে মন্দির থেকে বেরিয়ে চললাম কালভৈরব মন্দিরে। কাল ভৈরব মন্দির হল ভারতের বারাণসীতে অবস্থিত প্রাচীনতম শিব মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। ‘কাল’ অর্থাৎ সর্বশক্তিমান সময় এবং ‘ভৈরব’ যার অর্থ ‘ভয়ঙ্কর’ বা ‘ভয়াবহ’। শিবের একটি বিশেষ বা ভয়ঙ্কর রূপকে বলা হয় ‘কাল ভৈরব’। মন্দির দর্শন সেরে চলে এলাম আসি ঘাটে। এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম।
হোটেল : ওম গেস্ট হাউস; লজিং স্ট্রিট, আসি ঘাট, বারানসি, উত্তর প্রদেশ–২২১০০৫ । দূরাভাষ – ০৯৪১৫২৬৩০৮১.
১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৮ম দিন (উত্তর প্রদেশের বারানসি; ৪২কিমি) :
অনেকদিন পর আজ একটু দেরি করে সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠলাম। আজ সারাদিন বারানসিতেই থাকবো। সকাল ৭টায় হেঁটে হেঁটে চললাম আসি ঘাটে। ঘাটে পৌঁছে এক কাপ লেমন টি খেয়ে নিলাম। অনেককেই দেখলাম গঙ্গার ঘাটে সকালে স্নান করতে।
গঙ্গা বক্ষে ভ্রমণের জন্য একটি বোটে চেপে বসলাম। একে একে গঙ্গার পারে অবস্থিত বারানসির সমস্ত ছোট বরো বিখ্যাত ঘাট গুলো দেখতে থাকলাম। মহারাজা হরিশচন্দ্র ঘাট, নারদ ঘাট, দ্বারভাঙা ঘাট,দশাশ্বমেধ ঘাট, মাণিকর্ণিকা ঘাট ইত্যাদি। ১০০টাকার বিনিময়ে ৫০ মিনিট সময়ে এই পুরো ঘাট দর্শন পর্ব শেষ হলো। হোটেলে ফিরে স্নান ও আহার পর্ব সেরে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সারনাথের উদ্যেশে। বারানসির হোটেল থেকে সারনাথের দূরত্ব ১৪কিমি। বারানসির অলিগলি আর ট্রাফিক জামের মধ্যে দিয়ে সকাল ১১টায় সারনাথে পৌছালাম। সারনাথ আশ্রম মোরে বাইক রেখে একজন লোকাল গাইডকে হায়ার করলাম যে আমাকে সারনাথের বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ঘুরিয়ে দেখালো। প্রথমে গেলাম সারনাথ বুদ্ধ মন্দিরে। এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন মৌর্য রাজা অশোক। বৌদ্ধদের জন্য গৌতম বুদ্ধর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত চারটি প্রধান তীর্থস্থানের একটি হচ্ছে সারনাথ। সারনাথে জাপান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, তিব্বত, থাইল্যান্ড, মায়ানমার প্রভৃতি বৌদ্ধ-প্রধান দেশগুলো মন্দির ও আশ্রম তৈরি করেছে। ‘মূলাগন্ধা কুটি বিহার’ মন্দিরটি যেমন বড়ো তেমনি সুন্দর। মন্দিরটিতে প্রবেশের মুখে ডানদিকে ধর্মপালের মূর্তি আছে; আর পিছনের দিকে একটি বিশাল বড়ো ঘন্টা আছে।
এরপর গেলাম ধামেক স্তূপে। এটি সম্রাট অশোক তৈরি করেছিলেন। এটি আকারে নলাকার ও লাল ইট এবং পাথর দ্বারা তৈরি। এটি সেই জায়গাটি চিহ্নিত করে যেখানে ভগবান বুদ্ধ তাঁর প্রথম ধর্মপদেশ প্রচার করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর, তাঁর দেহাবশেষ দাহ করা হয় এবং ছাইকে ভাগ করে আটটি স্তূপের নিচে সমাহিত করা; ধামেক স্তূপ এই আটটি স্তূপের মধ্যে একটি। এরপর “চাইনিস বুদ্ধিস্ট টেম্পল” ঘুরে, চল্লাম ১৬কিমি দূরে গঙ্গার পারে অবস্থিত রামনগর ফোর্ট দেখতে। গঙ্গা নদির উপর মালভিয়া ব্রিজ পেরিয়ে দুপুর ১টার সময় রামনগর দুর্গে পৌছালাম। দুর্গের ভিতরে মিউজিয়াম আছে; টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম। এখানে বহু পুরোনো বিভিন্ন মডেলের গাড়ি রাখা আছে। এছাড়া রাজাদের ব্যাবহৃত পোশাক, পালকি, অস্ত্র ও আরো অন্যান্য জিনিসপত্র রাখা আছে।
দুর্গের লাগোয়া গঙ্গার ঘাটটি এককথায় অসাধারণ; এখানে কিছুক্ষন বসে থাকলে মন ভালো হয়ে যাবে। দুর্গ থেকে বেরিয়ে গঙ্গার উপর ‘লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ব্রিজ’ দিয়ে “তিওয়ারি ভোজনালায়ে” এসে দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে হোটেলে চলে এলাম। বিকেলে আবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বারানসির অলিগলি একটু ঘুরে দেখার জন্য। বৌ বলেছিলো একটি টপ(পোশাক ) নিতে। তাই বারানসির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত বিভিন্ন শপিং মল ঘুরে ওর জন্য একটি টপ নিয়ে, হোটেলে ফিরেএসে চললাম আসি ঘাটে সন্ধ্যার গঙ্গা আরতি দেখতে। আসি ঘাটের দুদিকে দুটি জায়গায় একসাথে গঙ্গা আরতি হয়। দারুন লাগছিলো গঙ্গা আরতি দেখতে। বাড়িতে ভিডিও কল করে বৌকে গঙ্গা আরতি দেখালাম। এরপর রাতের খাবার খেয়ে ‘সিয়ারাম ডেয়ারী’ থেকে বাড়ির জন্য বারানসির প্যারা সহ আরো কিছু মিষ্টি কিনে হোটেলে ফিরলাম। রাতে বাড়িতে ফোন করার পর শুয়ে পড়লাম।

ভোর ৩টেয় ঘুম থেকে উঠে, সব কাজ সেরে ভোর ৪টেতে রাইড শুরু করলাম। বারাণসীর অলিগলি পেরিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ এ এসে উঠলাম। গঙ্গা পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে এগিয়ে চললাম। উত্তর প্রদেশ ছাড়িয়ে বিহারের সাসারামে এসে চা পানের বিরতি নিলাম। এরপর দেহরি, সোন নদি, ঔরঙ্গাবাদ হয়ে ঝাড়খণ্ডের চৌপারনের কাছে এসে ব্রেকফাস্ট করলাম।
রাস্তায় বৃষ্টির জন্য একাধিকবার দাঁড়াতে হলো। ন্যাশনাল হাইওয়ের দুধারে মাঠ ভর্তি কাশ ফুল দেখে দুর্গা পুজোর আনন্দে মন ভরে উঠলো। ঝাড়খণ্ডের তোপচাঁচির কাছে রাস্তার দুপাশের সবুজ পাহাড়ের সারি এক কথায় অনবদ্য। সবুজ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে শ্বেতশুভ্র মেঘের ভেলা - যেনো দেখি নাই কভু এমন তরণী বাওয়া। বরাকর নদী পেরিয়ে ঝাড়খণ্ড থেকে নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এসেগেলাম। বারানসির পর থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে-১৯ এর অবস্থা ভালো নয়। দুপুর ২:৪৫ এ দূর্গাপুরে এসে লাঞ্চ সেরে নিলাম; কিন্তু বৃষ্টির জন্য লাঞ্চের পারে রাইড শুরু করতে অনেকটা দেরি হয়েগেলো। বর্ধমান হয়ে শক্তিগড়ের "ল্যাংচা স্টেশন" থেকে শক্তিগড়ের প্রসিদ্ধ ল্যাংচা বাড়ির জন্য নিয়ে নিলাম। পালসিট টোল প্লাজা, গুড়াপ, ডানকুনি টোল প্লাজা হয়ে গঙ্গার উপর বালি ব্রিজে যখন এলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অবশেষে ৯ দিনের ৪০৪০কিমি রাইড শেষ করে সন্ধ্যা ৭টায় বেলঘরিয়ার বাড়িতে ফিরলাম।
৬-এ ছক্কা
বর্ষার মরশুমে গরমা গরম কিছু না হলে চলেই না। এই ফিশ ফেস্টিভ্যালে তাই অনন্যার হেঁশেল থেকে মুচমুচে ছয়টি মাছের স্ন্যাক্স
মৌরলা মাছের পিঁয়াজি
কী কী লাগবে
মৌরলা মাছ (ভালো করে কেটে ধুয়ে নুন, হলুদ ও লেবুর রস মাখিয়ে ১৫ মিনিট রাখা): ২৫০গ্রাম, হলুদ গুঁড়ো: ১/২ চাচামচ, নুন: ১/২ চা চামচ, লেবুর রস: ১চা চামচ, পেঁয়াজ (মাঝারি আকারের): ২টি, কাঁচা লঙ্কা কুচি:২টি, কালো জিরে: ১/২ চা চামচ, বেসন:৩/৪ কাপ, জল:১/৪ কাপ, তেল: প্রয়োজন অনুযায়ী, নুন: স্বাদ অনুযায়ী।
কীভাবে বানাবেন
মাছের সঙ্গে পেঁয়াজ-লঙ্কা কুচি, কালোজিরে ও বেসন মাখিয়ে প্রয়োজনে সামান্য জল দিয়ে পেঁয়াজির আকারে গড়ে ডুবো তেলে ভেজে নিন। গরম গরম কাসুন্দি আর মুচমুচে মুড়ির সঙ্গে পরিবেশন করুন।
মাছের কচুরি
কী কী লাগবে
ময়দা: ৩ কাপ, বেকিং পাউডার: ২ চা চামচ, জল; প্রয়োজন অনুয়ায়ী, মাছের ফিলে (সেদ্ধ করে কোচানো): ৪টি, পেঁয়াজ কুচি ১টি, আলু (সেদ্ধ করে চটকানো): ১টি, ধনে পাতা কুচি: ১টি, কাঁচা লঙ্কা কুচি:২-৩টি, লঙ্কা গুঁড়ো: ১চা চামচ, জিরে গুঁড়ো: ১চা চামচ, ভাজা মশলা (জিরে, ধনে, শুকনো লঙ্কা ও গোল মরিচ শুকনো খোলায় ভেজে গুঁড়ো করা): ১চা চামচ, গরম মশলা:১ চা চামচ, পাঁচ ফোড়ন:১ চা চামচ, তেল: প্রয়োজন অনুযায়ী, নুন: স্বাদ
অনুযায়ী।
কীভাবে বানাবেন
ময়দা ১ টেবিল চামচ তেল, ১ চা চামচ নুন, বেকিং পাউডার ও জল দিয়ে মেখে ছোট ছোট লেচি কেটে রাখুন। তেল গরম করে কাঁচা লঙ্কা কুচি ফোড়ন দিয়ে সেদ্ধ আলু, মাছ, ও একে একে বাকি সব মশলা ও নুন দিয়ে ভালো করে কষান। শুকনো শুকনো হয়ে এলে নামিয়ে ঠান্ডা করুন। এবার এতে পেঁয়াজ কুচি, ধনে পাতা, লঙ্কা কুচি ও ভাজা মশলা ছড়িয়ে চটকে মেখে রাখুন। এই পুর ময়দার লেচিতে ভরে সাবধানে বেলে ভেজে নিলেই তৈরি মাছের কচুরি।
লইট্যা ভাজা
কী কী লাগবে
লইট্যা মাছ (মাথা, লেজ ও পাখনা কেটে ভালো করে আঁশ ছাড়িয়ে পেট চিরে কাটা বের করে নিয়ে ভালো করে ধুয়ে শুকনো করে রাখা): ৬টি, ডিম: ২টি, কর্নমিল: ১কাপ, তেল প্রয়োজন অনুযায়ী, নুন: স্বাদ অনুযায়ী।
মারিনেশনের জন্য
হলুদ গুঁড়ো: ১/২ চা চামচ, লঙ্কা গুঁড়ো: ১চা চামচ, জিরে গুঁড়ো: ১/২ চা চামচ, ধনে গুঁড়ো: ১চা চামচ, লেবুর রস: ৩ চা চামচ।
কীভাবে বানাবেন
মাছে ম্যারিনেশনের সব মশলা মাখিয়ে ৩০ মিনিট রেখে দিন। তেল গরম করুন। মাছগুলো নুন মেশানো ডিমের গোলায় চুবিয়ে কর্নমিল (চাইলেবিস্কুটের গুঁড়ো ব্যবহার করতে পারেন) দিয়ে কোট করে ডিপ ফ্রাই করে নিন। সস বা ধনেপাতার চাটনির সঙ্গে পরিবেশন করুন।
মাছের চপ
কী কী লাগবে
যে কোন মাছ (ভালো করে কেটে ধুয়ে আদা-রসুন, লঙ্কা ও কারিপাতার সঙ্গে সেদ্ধ করে কাঁটা বেছে চটকে রাখা): ১/২ কেজি, আদা-রসুন (খেতোকরা); ১ টেবিল চামচ, কাঁচা লঙ্কা: ২-৩টি, পেঁয়াজ (মাঝারি): ১টি, গরম মশলা: ১/২ চা চামচ, গোলমরিচ গুঁড়ো: ১ চা চামচ, আলু সেদ্ধ (চটকে রাখা): ১ টি, ডিম (সাদা অংশ, সামান্য নুন দিয়ে ফেটিয়ে রাখা): ১টি, ব্রেড এনাম্ব: ১ কাপ, কারি পাতা কয়েকটি, তেল; প্রয়োজন অনুযায়ী, নুন: স্বাদ অনুযায়ী।
কীভাবে বানাবেন
তেল গরম করে পেঁয়াজ ভেজে নিন। এবার চটকে রাখা মাছ, নুন, গোলমরিচ গুঁড়ো ও গরম মশলা দিয়ে ৫ মিনিট ভেজে সেদ্ধ আলু দিয়ে নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিন। ঠাণ্ডা হলে ভালো করে মেখে ছোট ছোট বলের আকারে গড়ে ডিমের গোলায় চুবিয়ে ব্রেড এনাম মাখিয়ে গরম তেলে ডিপ ফ্রাই করে নিন।
ক্ল্যাসিক ফিশ অ্যান্ড চিপস
কী কী লাগবে
মাছের ফিলে: ৭০০ গ্রাম, ময়দা: ১ কাপ, দুধ: ১ কাপ, গোলমরিচ গুঁড়ো: ১ চা চামচ, আলু (বড় আকারের, স্ট্রাইপ/ লম্বা লম্বা করে কেটে অর্ধেক সেদ্ধ করে ঠান্ডা জলে চুবিয়ে রাখা): ৪ টি, ডিম: ১টি, বেকিং সোডা: ১ চা চামচ, সাদা তেল। প্রয়োজন অনুযায়ী, নুন স্বাদ অনুযায়ী।
কীভাবে বানাবেন
তেল গরম করে আলু মুচমুচে করে ভেজে রাখুন। একটি পাত্রে ময়দা, বেকিং সোডা, নুন, গোলমরিচ, ডিম ও দুধ একসঙ্গে মিশিয়ে ব্যাটার বানিয়ে রাখুন। মাছের ফিলেগুলো এর মধ্যে চুবিয়ে গরম তেলে বাদামি করে ভেজে নিন। আলুভাজার সঙ্গে পরিবেশন করুন।
মাছের ডিমের বড়া
কী কী লাগবে
রুই মাছের ডিম (ভালো করে ধুয়ে রাখা): ১০০ গ্রাম, আদা (কুচি): ১/২ চা চামচ, রসুন (বাটা): ১/৪ চা চামচ, কাঁচা লঙ্কা (কুচানো): ২-৩টি, পেঁয়াজ (কুচানো): ১টি, ময়দা: ১ টেবিল চামচ, সর্ষের তেল:২ চা চামচ, হলুদ গুঁড়ো: ১/২ চা চামচ, চালের গুঁড়ো: ১ চা চামচ, ধনেপাতা ও পাকা লঙ্কা (গার্নিশের জন্য): কয়েকটি, সাদা তেল: প্রয়োজন অনুযায়ী, নুন: স্বাদ অনুযায়ী।
কীভাবে বানাবেন
সব উপকরণ গুলো এক সঙ্গে মেখে নিন। তেল গরম করে বড়ার আকারে গড়ে মুচমুচে করে ভেজে নিন। ওপরে ধনে পাতা ও পাকা লঙ্কা দিয়ে সাজিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।
মাছের তেলের চচ্চড়ি
কী কী লাগবে
মাছের তেল (ভালো করে ধুয়ে, নুন-হলুদ ও লঙ্কা গুঁড়ো মাখিয়ে রাখা): ২০০ গ্রাম, আদাবাটা: ১ টেবিল চামচ, রসুনবাটা:১ ১/২ টেবিল চামচ, কাঁচা লঙ্কা: ৪-৫টি, পেঁয়াজ (কুচানো): ৩টি, বেগুন (কিউব করে কেটে নুন-হলুদ মাখিয়ে ভেজে রাখা): ১টি, আলু (খোসা ছাড়িয়ে কিউব করে কেটে ভেজে রাখা):৩টি, হলুদ গুঁড়ো: ১ চা চামচ, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো: ১ চা চামচ, টোম্যাটো (কুচানো): ২টি, সর্ষের তেল তেল: প্রয়োজন অনুযায়ী, নুন: স্বাদ অনুযায়ী।
কীভাবে বানাবেন
তেল গরম করে পেঁয়াজ ও মাছের তেল একসঙ্গে কিছুক্ষণ ভাজুন। পেঁয়াজ লাল হয়ে এলে আদা-রসুনের পেস্ট ও টোমরটো কুচি দিয়ে কম আঁচে ভালো করে কষিয়ে বাকি সব মশলা ও সবজির টুকরো দিয়ে ১০ মিনিট রান্না করুন। আলু নরম হয়ে তরকারি মাখা মাখা হয়ে তেল বেরিয়ে এলে নামিয়ে নিন। গরম ভাত বা রুটির সঙ্গে পরিবেশন করুন।
Comments