top of page

শ্রীকৃষ্ণ, জন্মাষ্টমী এবং যোগমায়া..একডজন নিরামিষ রান্না..বাংলা সিনেমার ব্যতিক্রমী পরিচালক সুশীল মজুমদার..

বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ অষ্টম অবতার। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জন্ম নিয়ে নিজেই বলেছেন, তাঁর জন্ম-মৃত্যু সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়। তিনি বলেছেন,

‘আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া ও অন্তর্হিত হওয়া-দুটিই আমার অলৌকিক লীলা।’

জন্মাষ্টমী এবং যোগমায়া

বর্ষার রাতে সেই পরম শক্তিশালী মানুষটি যে জন্মগ্রহণ করলেন সেই জন্মাষ্টমীকে পূণ্য তিথি হিসাবে স্মরণ করি আমরা। দেশজুড়ে পালিত হয় কৃষ্ণের জন্মোৎসব। মন্দিরে সেজে ওঠে নন্দলালার মূর্তি। কিন্তু তার পিছনে খুব নিঃশব্দে ঢাকা পড়ে যায় আরেকজনের কথা। আরও একটি শিশু যারও জন্ম এই একই দিনে। তিনি দেবী যোগমায়া।


দেবী যোগমায়া আসলে কে?

বিন্ধ্যবাসিনী, মহামায়া এবং একানংশা নামেও একে পুজো করা হয়। বৈষ্ণব আচারানুষ্ঠানে তাঁকে নারায়ণী উপাধি দেওয়া হয় এবং বিষ্ণুর মায়া শক্তির মূর্তি হিসেবে উপাসনা করা হয়। ভাগবত পুরাণে দেবতাকে দেবী দুর্গার কল্যাণকর দিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। শাক্তরা তাকে মহাশক্তির রূপ বলে মনে করেন। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ্য তিনি নন্দ ও যশোদার কন্যা হিসাবে যাদব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

ভাগবতপুরাণ এবং শ্রী শ্রী চণ্ডীতে যোগমায়ার উল্লেখ আছে। সেখানে যোগমায়া কে দেবী দুর্গা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে বিষ্ণুর ইচ্ছা অনুসারেই যোগমায়া যশোদার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। কংস যখন তাঁর পা ধরে আছাড় মারতে যাচ্ছেন তখন যোগমায়া তাকে নিজের অষ্টভুজা রূপ দেখান। তারপর তিনি চলে যান বিন্ধ্য পর্বতে।


মার্কণ্ডেয় পুরান মতে, তিনি আদ্য শক্তি মহামায়া। তিনিই আবার জন্ম নিয়েছিলেন সীতারূপে। তিনি বিষ্ণুর স্ত্রী, দেবী লক্ষী।


শ্রী শ্রী চণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে ও আমরা পাচ্ছি,


"নন্দগোপ গৃহে জাতা যশোদাগর্ভসম্ভবা

ততস্তৌ নাশয়িষ্যামি বিন্ধ্যাচলবাসিনী।।"


অর্থাৎ যশোদাগর্ভজাত যোগমায়া পরে বিন্ধ্যাচলে আসেন এবং সেখানেই শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক দুই অসুরকে বধ করেন।

কী ঘটেছিল জন্মাষ্টমীর রাতে?

দ্বিতীয়বার হাতবদলের পর দেবকির পাশে শুয়ে থাকা যোগমায়া কে, কারাগারের দেওয়ালে আছাড় মারতে চেয়ে দুই হাতে তুলে ধরলেন মহারাজ কংস। সজোরে নিক্ষেপ করলেন পাথরে। কিন্তু তাকে মারবে সাধ্য কার! তৎক্ষণাৎ সেই কন্যা কংসের হাত থেকে মুক্ত হয়ে উড়াল দিল আকাশে। আট হাতে ধারণ করল ধনুু, শূল, বাণ, চর্ম, অসি, শঙ্খ, চক্র, গদা! ঝলসে উঠল যোগমায়া রূপে। কংসের উদ্দেশ্যে ভেসে এল আকাশবাণী- ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে!’

ব্রজবাসী এবং শ্রীকৃষ্ণ:

নন্দের পুত্র জন্মগ্রহণ করার পর পরমানন্দে নতুন বস্ত্র ধারণ ও তিলক লেপে ব্রাহ্মণকে ডেকে পুত্রের জাত কর্ম করালেন। ব্রজবাসীগণ মহানন্দে নন্দ উৎসব করতে লাগল। ব্রজের গোপগণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। কৃষ্ণের জন্ম সংবাদে আকাশ বাতাস, জল, পশু, পক্ষী, বাগানের পুষ্প সকলেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। গোটা ব্রজবাসীর ঘরে আনন্দের প্লাবন বয়ে গেল। দুধ, দই, মাখনের গন্ধে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা হয়ে গেল। এই ভাবে কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ও নন্দ উৎসব পালনের মধ্যে দিয়ে যুগের ক্রম বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজও মানুষ এই উৎসব পালন করছে।



এবছর শ্রীকৃষ্ণের কততম জন্মতিথি?

১৪৩১ বাংলার (২০২৪ সাল) ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ৫২৫০তম জন্মাষ্টমী। কারণ, বিভিন্ন পুরাণ ও প্রাচীন গ্রন্থ মতে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২৫ বছর প্রকট লীলাবিলাস করেন। ১২৫ বছর ধরাধামে অবস্থান করে বৈকুন্ঠে গমন করেন। মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তিনি ইহধাম ত্যাগ করে অন্তর্ধান করেন। সেই দিনই কলি প্রবেশ করে। সেই দিন ছিল শুক্রবার। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০১ সালে কলিযুগ আরম্ভ হয়। বর্তমান ২০২৪ সাল। তা হলে কলির বয়স ৩১০১+২০২৪=৫১২৫ বছর। শ্রীকৃষ্ণের অর্ন্তধানের দিন কলির আবির্ভাব। শ্রীকৃষ্ণ ১২৫ বছর প্রকট লীলা করেছেন। তা হলে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ৫১২৫+১২৫= ৫২৭০ বছর পূর্বে হয়েছিল।

এবছর জন্মাষ্টমী কবে?

ভাদ্রপদ মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে অর্থাৎ জন্মাষ্টমীতে শ্রী কৃষ্ণের শিশুরূপের পুজো করলে সকল দুঃখ, দোষ ও দারিদ্র দূর হয়। এই বছর, যদি ২০২৪ সালের কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকে, তাহলে এখানে জেনে নিন জন্মাষ্টমীর সঠিক তারিখ।


ভাদ্রপদ কৃষ্ণ অষ্টমী তিথি শুরু ২৬ আগস্ট ২০২৪, ভোর ০৩ টে ৩৯ মিনিটে। ভাদ্রপদ কৃষ্ণ অষ্টমী তিথি শেষ হবে ২৭ আগস্ট ২০২৪, রাত ০২ টো ১৯ মিনিটে। রোহিণী নক্ষত্র শুরু হয় ২৬ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ০৩ টে ৫৫ মিনিটে। রোহিণী নক্ষত্র ২৭ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ০১ টা ৩৮ মিনিটে শেষ হবে।


কীভাবে উপবাস পালন করবেন?

জন্মাষ্টমী উপবাসের একদিন আগে, সপ্তমী তিথি থেকে, রসুন, পেঁয়াজ, বেগুন, মুলা ইত্যাদি তামসিক খাবার ত্যাগ করতে হবে এবং সাত্ত্বিক খাবার খেয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে। জন্মাষ্টমীর দিন সকালে ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে পরিষ্কার পোশাক পরিধান করুন। সারাদিন কৃষ্ণের পুজো করুন। রাত ১২ টায় প্রিয় সব নৈবেদ্য নিবেদন করুন। পরের দিন উপবাস ভঙ্গ করবেন।

কী কী ভোগ দেবেন?

১.শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রিয় হল পনজিরি। এই ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মিষ্টি ময়দা, ঘি, চিনি ও বাদাম দিয়ে প্রস্তুত করা হয়।


২.শ্রীকৃষ্ণের সবচেয়ে প্রিয় যে খাবার, তা হল মাখন ও মিছরি। মা যশোদার ভাঁড়ার থেকে মাখন চুরি করে খাওয়া ছোট্ট গোপালের ছবি আমাদের ঘরে ঘরে শোভা পায়। সেই কারণে কৃষ্ণের আর এক নাম মাখন চোর বা ননী চোরা।


৩.জন্মাষ্টমীতে শ্রীখণ্ড নিবেদন করা অত্যন্ত শুভ। দই দিয়ে তৈরি শ্রীখণ্ড কৃষ্ণের অতি প্রিয় একটি খাবার। মিষ্টি স্বাদের এই খাবার ভারতের পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে গুজরাতে অত্যন্ত প্রচলিত।


৪.রাধার হাতে তৈরি মালপোয়া অত্যন্ত প্রিয় ছিল মূরলীধরের। সেই কারণে জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণকে মালপোয়া নিবেদন করলে প্রসন্ন হন তিনি।


৫.শ্রীকৃষ্ণের আর একটি প্রিয় খাবার হল মোহনভোগ। মনে রাখবেন মোহনভোগ নিবেদন না করলে শ্রীকৃষ্ণের পুজো সম্পূর্ণ হয় না।




 

একডজন নিরামিষ রান্না..

বাঙালি বাড়িতে সপ্তাহে অন্তত একদিন নিরামিষ খাওয়ার রীতি রয়েছে। বাঙালি মাছ প্রিয় হলেও এমন কিছু রান্না আছে যা নিরামিষ তবুও আমিষ রান্নাকে টেক্কা দিতে পারে। অনেকেই ভাবেন নিরামিষ রান্না তেমন সুস্বাদু হয়না, আজকে এমন একডজন নিরামিষ রান্নার রেসিপি দেওয়া হল যা নিরামিষ হলেও বাঙালির অতি পছন্দের এবং স্বাদেও অতুলনীয়।

ধোকার ডালনা


কী কী লাগবে

ছোলার ডাল -১ কাপ, আদা কুঁচি–১ চামচ, চেরা কাঁচা লঙ্কা-৩ টে, গোটা জিরে-১ চা চামচ, ২ চামচ হলুদ গুঁড়ো, তেজপাতা-২টো, এলাচ-৪টে, হিং-১ চিমটি, ঘি -৪ চামচ, প্রয়োজনমতো সরষের তেল, আলু- ২টো, টমেটো- ১টা, জিরে গুঁড়ো-১ চা চামচ, ধনে গুঁড়ো-১ চা চামচ,লঙ্কার গুঁড়ো- হাফ চা চামচ, হাফ চা চামচ, কাশ্মীরি লাল লঙ্কার গুঁড়ো-হাফ চা চামচ, গরম মশলা গুঁড়ো ,সরষের তেল প্রয়োজনমতো ,স্বাদমতো নুন ও চিনি


কীভাবে বানাবেন

ধোকা বানাতে প্রথমে ছোলার ডাল সারা রাত ভিজিয়ে রাখা ছোলার ডালের মধ্যে কাঁচা লঙ্কা, আদা বাটা দিয়ে মিক্সিতে মিহি করে বেটে নিতে হবে। এরপর কড়াইয়ে সরষের তেল গরম করে তাতে গোটা জিরে ফোড়ন দিয়ে মিহি করে বাটা ছোলার ডাল এবং তাতে সামান্য নুন আর হলুদ দিয়ে মিশিয়ে নিয়ে মিশ্রণ টা শক্ত করতে হবে। এর পর একটা বড় থালায় সামান্য তেল মাখিয়ে ডালের মিশ্রণটা রেখে চেপে বসিয়ে ছুরি দিয়ে বরফির আকারে কাটতে হবে। এরপর বরফির আকারে কাটা ডালের টুকরোগুলো কড়াইতে তেল গরম করে তাতে ভেজে নিলে তৈরি হয়ে যাবে ধোকা।

গ্রেভির জন্য টুকরো করে কেটে রাখা আলুর মধ্যে সামান্য নুন আর হলুদ গুড়ো মাখিয়ে কড়াইয়ে তেল গরম করে আলুর টুকরো গুলো হালকা করে ভেজে তুলে নিতে হবে। কড়াইতে সামান্য ঘি গরম করে তাতে এলাচ, তেজপাতা, আদা কুঁচি, ফোড়ন দিয়ে তাতে ধনে, জিরার গুড়ো দিয়ে ভালো ভাবে নাড়িয়ে তার মধ্যে টমেটো এবং লঙ্কার গুড়ো দিয়ে সামান্য জল মিশিয়ে দিন। গ্রেভিটা মাখো মাখো হয়ে এলে তাতে ভেজে রাখা আলু গুলো দিয়ে নুন এবং চিনি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এরপর তাতে ধোকা গুলো ঢেলে মিশিয়ে দিয়ে হালকা আঁচে ১০ মিনিট রান্না করতে হবে। নামানোর আগে সামান্য গরম মশলার গুড়ো দিয়ে ৫ মিনিট আঁচে রেখে পরিবেশেন করুন সুস্বাদু ধোকার ডালনা।

কাঁচা কলার কোপ্তা কারি


কী কী লাগবে

কাঁচা কলা ৩ টে , মাঝারি মাপের আলু ২ টো, বেসন ৩ টেবিল চামচ, গরম মশলা গুঁড়ো হাফ চামচ, ধনে গুঁড়ো হাফ চামচ, জিরে গুঁড়ো হাফ চামচ, আদা বাটা ১ চামচ, রসুন বাটা ১ চামচ, চারমগজ বাটা ১ চামচ, ধনেপাতা কুঁচি ১ টেবিল চামচ, টমেটো ২ টো, লঙ্কা ৪ টে। সাদা তেল, নুন পরিমাণ মতো, সরষের তেল ২ চামচ, ফোড়নের জন্য এলাচ ১ টা, লবঙ্গ ২ টো, দারচিনি ১ টা, হলুদ গুঁড়ো হাফ চামচ, লঙ্কার গুঁড়ো হাফ চামচ, ঘি ১ চামচ।

কীভাবে বানাবেন

কাঁচা কলার কোপ্তা বানানোর জন্য প্রথমে আলু আর কাঁচা কলা সেদ্ধ করে খোসা ফেলে দিতে হবে।কোপ্তা বানানোর জন্য কলা, আলু, বেসন, সামান্য হলুদ গুঁড়ো, লবণ, ধনে গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, গরম মশলা গুঁড়ো, কাঁচা লঙ্কা কুঁচি দিয়ে ভালো করে মেখে নিতে হবে। তেল গরম করে তাতে ওই মিশ্রণ থেকে গোল গোল আকার করে তেলে দিয়ে ভেজে নিলেই তৈরী কোপ্তা। কোপ্তা ভালোভাবে ভাজা হয়ে গেলে তেল ঝড়িয়ে তুলে নিতে হবে। তারপর গ্রেভি তৈরীর জন্য কড়াইতে সরষের তেল গরম হলে তাতে এলাচ, লবঙ্গ আর দারচিনি ফোড়ন দয়ে আদা বাটা, হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো আর চারমগজ বাটা দিয়ে নাড়িয়ে টমেটো কুঁচি দিয়ে, স্বাদমতো নুন দিয়ে কষানোর পর এতে আগে থেকে ভেজে রাখা কোপ্তা গুলো দিয়ে সামান্য জল দিয়ে কিছুক্ষণ ঢেকে রাখতে হবে। নামানোর আগে ধনেপাতা ঘি দিয়ে উপর দিয়ে ধনেপাতা ছড়িয়ে নামিয়ে নিলেই তৈরী কাঁচকলার কোপ্তা কারি।

আলু পোস্ত


কী কী লাগবে

আলু -৩০০ গ্রাম ,পোস্ত – ৫০ গ্রাম,১চা চামচ সরষের তেল পরিমানমতো, স্বাদ অনুযায়ী নুন,কাঁচা লঙ্কা -৪ টি শুকনো লঙ্কা-২টি


কীভাবে বানাবেন

প্রথমে আলুগুলোর খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট করে টুকরো করে কেটে নিতে হবে ধুয়ে রাখতে হবে। এর পর পোস্ত হালকা টেলে বেটে নিতে হবে, তারপর কাঁচা লঙ্কাগুলো বেটে নিতে হবে। এরপর কড়াইতে তেল দিয়ে শুক্ন লঙ্কা ফোঁড়ন দিয়ে দিন। কেটে রাখা আলুর টুকরো গুলো হালকা লাল করে ভেজে নিতে হবে। তারপর মিহি করে বেটে রাখা পোস্ত এবং লঙ্কাবাটা ভাজা আলুর উপর দিয়ে হালকা আঁচে কিছুক্ষণ রান্না করতে হবে। আলুগুলো ভালো করে সিদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে পরিবেশন করতে হবে আলুপোস্ত।

ফুলকপির ডালনা


কী কী লাগবে

বড় ফুলকপি ১ টা, মটরশুটি হাফ কাপ, এলাচ ৪টে শুকনো লঙ্কা ২টো, তেজপাতা ২ টো, ১ চামচ সাদা জিরে, ১ চামচ আদা বাটা, ১ চামচ জিরে গুঁড়ো, ১ চামচ হলুদ গুঁড়ো, ১ চামচ কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, ১ চামচ লঙ্কার গুঁড়ো, হাফ চামচ গরম মশলার গুঁড়ো, টমেটো পিউরি ১ কাপ, স্বাদ অনুযায়ী নুন, পরিমাণ মতো সরষের তেল।


কীভাবে বানাবেন

টুকরো করে কেটে রাখা ফুলকপি এবং মটরশুটি গরম জলে নুন দিয়ে হালকা করে ভাপয়ে নিতে হবে। তারপর কড়াইয়ে তেল গরম করে তাতে ফুলকপি আর মটরশুঁটির দিয়ে তাতে সামান্য নুন, হলুদ, লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে ভালো করে ভেজে তুলে রাখতে হবে।


এবার কড়াইয়ে তেল দিয়ে তাতে এলাচ, সাদা জিরে ,শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে তাতে টমেটো পিউরি দিয়ে ভালোভাবে নাড়িয়ে তাতে আদা বাটা,সামান্য হলুদ, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো দিয়ে ভালো ভাবে মিশিয়ে কিছু ক্ষণ নাড়ানোর পর তেল ছেড়ে এলে ওই মিশ্রণে ফুলকপি আর মটরশুঁটি দিয়ে দিন। এরপর অল্প গরম জল দিয়ে ঢাকনা ঢেকে দিন। নামানোর আগে গরম মশলা দিয়ে নিন। খুব সহজেই তৈরী হয়ে যাবে নিরামিষ ফুলকপির ডালনা।

নারকেল দিয়ে মোচার ঘন্ট


কী কী লাগবে

৩ টি মাঝারি মাপের আলু ,এক বাটি মোচা, ২ টেবিল চামচ নারকেল কোঁড়া, ২ টো তেজপাতা ,১ চামচ গোটা জিরে, ১ চামচ ধনে গুঁড়ো, ১ চামচ জিরে গুঁড়ো ,১ চামচ আদা বাটা , ১ চামচ গরমমশলার গুঁড়ো ,৪ টে কাঁচালঙ্কা, ৮ -১০ কাজুবাদাম, ,৮-১০ টা কিশমিশ ,স্বাদমতো নুন এবং চিনি ,পরিমাণ মতো সরষের তেল


কীভাবে বানাবেন

প্রথমে আলুগুলো ডুমো করে কেটে নিতে হবে, এবং কেটে রাখা মোচা হলুদে মাখিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হবে। তারপর কড়াইতে তেল দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তেল গরম হলে তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে তার মধ্যে ডুমো ডুমো করে কেটে রাখা আলু ভেজে নিতে হবে, এবার আলুর মধ্যে নুন, ধনে গুড়ো, জিরে গুড়ো, লঙ্কা গুড়ো দিয়ে নেড়ে তারমধ্যে আগে থেকে সেদ্ধ করে নেওয়া মোচাগুলো দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর আদা বাটা, কাঁচা লঙ্কা, নারকেল কোঁড়া, দিয়ে আবার কিছুক্ষণ নাড়িয়ে নিতে হবে। তারপর গরমমশলা এবং ঘি দিয়ে ভেজে রাখা কাজু কিশমিশ উপর দিয়ে ছড়িয়ে পরিবেশন করুন সুস্বাদু মোচার ঘন্ট।

পনির বেগম বাহার


কী কী লাগবে

পনির (৬০০ গ্রাম), মাখন (১০ গ্রাম), নুন, ময়দা (৫০ গ্রাম), কর্নফ্লাওয়ার (৩০ গ্রাম), কাঁচালঙ্কা বাটা (৫ গ্রাম), টমেটো পিউরি (৫০ গ্রাম), আদা বাটা (১০ গ্রাম), দুধ (২০০ মিলি), কাজু বাটা (৭০ গ্রাম), জিরে গুঁড়ো (৫ গ্রাম), এলাচ গুঁড়ো (৩ গ্রাম), হট অ্যান্ড সুইট সস (১৫ গ্রাম), ঘি (৫ গ্রাম), ক্রিম (৫০ মিলি), পুদিনার চাটনি (১০০ গ্রাম)।


কীভাবে বানাবেন

পনির সরু সরু করে স্লাইস করে তার মধ্যে পুদিনার চাটনির প্রলেপ দিন। ময়দা আর কর্নফ্লাওয়ার জলে গুলে ব্যাটার বানিয়ে ওর মধ্যে পনিরগুলো ডুবিয়ে ভেজে নিন সাদা তেলে। এবার অন্য একটা পাত্রে তেল গরম করে তাতে আদা আর কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে খানিকক্ষণ রেঁধে টমেটো পিউরি মেশান। এবার কাজু বাটা আর জিরের গুঁড়ো দিয়ে দুধ ঢেলে দিন ওর মধ্যে। এরপর একে একে ক্রিম, ঘি আর মাখন দিয়ে ফুটতে দিন। গ্রেভিতে হালকা লালচে ভাব আসলে পনির দিয়ে নামিয়ে নিন আঁচ থেকে।

নিম ঝোল


কী কী লাগবে

কচি নিমপাতা (১০-১২টি), বেগুন-কাঁচকলা-শিম-ঝিঙে-আলু-মিষ্টি কুমড়ো-পেঁপে (সব সবজি লম্বা ও পুরু করে কেটে নিন), আদা (১ চামচ), সর্বে বাটা (১/৪ চামচ), পাঁচফোড়ন (শুকনো খোলায় ভেজে গুঁড়ো করা) (১ চামচ), নুন, চিনি, উচ্ছে ভাজা, গোটা মৌরি, গোটা শুকনো লঙ্কা।


কীভাবে বানাবেন

তেলে শুকনো লঙ্কা ও মৌরি ফোড়ন দিন। তাতে আদা ও সর্ষে বাটা দিয়ে অল্প কষান। এবারে উচ্ছে ও নিম বাদে সবজি ছাড়ুন। নুন ও চিনি দিয়ে ঢেকে দিন। সব সেদ্ধ হয়ে গেলে নিমপাতা ও উচ্ছে ভাজা ছাড়ুন। জল দিন। কিছুক্ষণ ফোটান। নামানোর আগে পাঁচফোড়নের গুঁড়ো ও ঘি ছড়িয়ে স্ট্যান্ডিং টাইমে রাখুন। এবারে পরিবেশন করুন।

বাঁধাকপির কোপ্তা কারি


কী কী লাগবে

বাঁধাকপি কুচি (১ বাটি), আদা বাটা (২ চামচ), টমেটো (১টি মাঝারি), ধনেপাতা কুচি, লঙ্কা গুঁড়ো (১ চামচ), চালের গুঁড়ো (আধ কাপ), কর্নফ্লাওয়ার (আধ কাপ), পোস্ত (২৫ গ্রাম), কাঁচালঙ্কা (৫টি), সাদা তেল (২৫ গ্রাম), নুন (স্বাদমতো), হলুদ গুঁড়ো (১ চামচ), শুকনো লঙ্কা (১টি), তেজপাতা (১টি), জিরে (আধ চামচ), গরম মশলা (আধ চামচ), চিনি (১ চামচ)।


কীভাবে বানাবেন

বাঁধাকপি সেদ্ধ করে জল ঝরিয়ে রাখুন। এর মধ্যে আদাবাটা ১ চামচ দিয়ে চালের গুঁড়ো, কর্নফ্লাওয়ার, নুন ও ১টি কাঁচালঙ্কা কুচি মিশিয়ে ভাল করে মেখে ছোট ছোট বলের আকারে তৈরি করে নিন। কড়াইতে তেল গরম করে বলগুলো ভেজে তুলুন। এরপর কড়াইতে ২ চামচ তেল রেখে বাকি তেল সরিয়ে নিয়ে তাতে শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, জিরে ফোড়ন দিন। এগুলো ভাজা হলে টমেটো বাটা ভাল করে কষিয়ে নিন। আদা বাটা দিয়ে আবার কষুন। তারপর হলুদ, নুন ও লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে ভাল করে কষিয়ে পোস্ত বাটা দিন। কম আঁচে বসিয়ে রাখুন। এর থেকে তেল ছাড়লে চিনি দিন ও আড়াই কাপ মতো জল দিয়ে ফুটতে দিন। ফুটে উঠলে কোপ্তাগুলো দিয়ে ভাল করে ফোটাতে হবে। মাখা মাখা হয়ে এলে গরম মশলা ছড়িয়ে পাত্রে ঢেলে ইচ্ছেমতো সাজিয়ে পরিবেশন করুন।

ফুলকপির দম


কী কী লাগবে

ফুলকপি (১টি), চিনেবাদাম (৫০ গ্রাম) (গুঁড়ো), কিশমিশ (১০-১২টি), টকদই (আধ কাপ), আদা বাটা (আধ চা-চামচ), হলুদ গুঁড়ো (আধ চা-চামচ), জিরে গুঁড়ো (১ চা-চামচ), লঙ্কা গুঁড়ো (১ চা-চামচ), চিনি (আর চা-চামচ), কাঁচালঙ্কা (২টি), সর্ষের তেল (আধ কাপ), তেজপাতা (২টি), পোস্ত বাটা (২ টেবল চামচ), জিলে (১ চা-চামচ) (গোটা), গরম মশলা (২-৩টি) (গোটা), ক্রিম।


কীভাবে বানাবেন

ফুলকপি ছোট করে কেটে নিন। প্যানে তেল দিয়ে ফুলকপি ভেজে তুলুন। প্যানে আস্ত জিরে ও গরম মশলা দিন। আদা বাটা, পোস্ত বাটা, তেজপাতা, হলুদ, জিরে গুঁড়ো, লঙ্কা, কাঁচালঙ্কা, নুন, চিনি দিয়ে কষুন। এতে দিন ফেটানো টকদই ও বাদাম গুঁড়ো। অল্প জল দিয়ে ঢেকে দিন। এবার দিন ভাজা ফুলকপি। প্রয়োজনে অল্প জল দেবেন। কিশমিশ দিন। নামিয়ে নিয়ে ক্রিম ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।

শাহি ফ্রুটস পোলাও

কী কী লাগবে

সেদ্ধ বাসমতী চাল (১৫০ গ্রাম), ডুমুর (২-৩টি), ড্রাই চেরি (১-২টি), গ্রেটেড আপেল (১ টেবল চামচ), আপেলের টুকরো-আঙুর-বেদানা (১ চামচ করে), দুধ, কেশর, নুন, চিনি, ঘি।


কীভাবে বানাবেন

কড়াইতে ঘি গরম করে তাতে ফলগুলো হালকা ভেজে তুলে রাখুন। কেশর দুধে ভিজিয়ে দিন। ঘিয়ের মধ্যে সেদ্ধ চালটা দিয়ে ভাজা ফলগুলো এবং গ্রেট করা আপেল দিয়ে নেড়েচেড়ে নিন। নুন-চিনি দিন পরিমাণমতো। এবার কেশর ভেজানো দুধটা দিয়ে মিনিটখানেক দমে রাখলেই রেডি শাহি ফ্রুটস পোলাও। চাইলে কাজু, কিশমিশ, গোলাপ জলও দিতে পারেন।

কলমি-কুমড়ো ডাঁটার শুক্তো


উপকরণঃ-কলমি শাকের নরম পাতা ডাঁটা-সহ (১ ইঞ্চি করে কেটে নেওয়া) (১ বাটি), লাউ বা কুমড়োর নরম ডাঁটা পাতা-সহ (আধ বাটি, ১ ইঞ্চি টুকরো করা), গোটা শুকনো লঙ্কা, ছোট বেগুন (সরু করে ৩ ইঞ্চি মতো কেটে নেওয়া), ভাজা বড়ি (৮-১০টা), পাঁচফোড়ন, আদা বাটা (১ চা-চামচ), রাঁধুনি বাটা (১/৪ চা-চামচ), মৌরি বাটা (আধ চা-চামচ), ধনে গুঁড়ো (১/৪ চা-চামচ), নুন, চিনি, তেল।


কীভাবে বানাবেন

প্রথমে লাল করে বেগুন ভেজে নিন। এবারে বেগুন পাত্রে রেখে বাকি তেলে শুকনো লঙ্কা ও পাঁচফোড়ন দিন। এবারে সমস্ত মশলা অল্প জলে গুলে তেলে দিয়ে কষান। এবারে শাক ও ডাঁটা ছাড়ুন। নুন দিয়ে ঢেকে রান্না করুন। কিছুক্ষণ ফুটলে পর বেগুন ভাজা ও বড়ি দিন। নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিন।

লাউয়ের শুক্তো


কী কী লাগবে

লাউ ডুমো করে কেটে নেওয়া, ঘি, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, পাঁচফোড়ন, নারকেল কোরা, সর্ষে-পোস্ত বাটা, রাঁধুনি বাটা, আদা বাটা, নুন, চিনি, তেল, নারকেলের দুধ।


কীভাবে বানাবেন

কড়াইতে তেল গরম করে তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ও পাঁচফোড়ন ছাড়ুন। গন্ধ বেরোলে লাউ দিন। নুন দিন। নাড়াচাড়া করে ঢেকে রান্না করুন। নরম হলে পর নারকেল কোরা, নারকেলের দুধ, খুব অল্প সর্বে-পোস্ত বাটা, ১ চিমটে রাঁধুনি বাটা, আদা বাটা অল্প দুধে গুলে মেশান। নুন, চিনি পরখ করুন। চড়া আঁচে মাখামাখা করে রাঁধুন। হয়ে গেলে নামিয়ে নিন।

 

বাংলা সিনেমার ব্যতিক্রমী পরিচালক সুশীল মজুমদার


কমলেন্দু সরকার


১ ৯২৮। মাসটি জুলাই কি অগাস্ট হবে। শিশির ভাদুড়ি নাট্যমন্দির কিনেছেন। ঠিক হয়েছে 'গিরিশ স্মৃতি সমিতি'র আয়োজনে মঞ্চস্থ হবে 'প্রফুল্ল'। পরিচালক শিশির ভাদুড়ি। যোগেশ চরিত্রটি করবেন গিরিশ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ। অর্থাৎ দানীবাবু। এই নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। রমেশ ভূমিকায় শিশির ভাদুড়ি। কিন্তু সুরেশ? কে করবেন সুরেশ?


এমন সময় একদিন নাট্যমন্দিরে এলেন সুঠাম সুবেশ বছর বাইশ-তেইশের এক যুবক। চেহারায় প্রকাশিত আভিজাত্য। পছন্দ হল শিশির ভাদুড়ির। দানীবাবুও ছিলেন। তিনিও যুবকটিকে দেখে খুশি। যুবকটি অভিনয় করতে চান। অভিজ্ঞতা বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে 'ফাল্গুনী' করেছেন বাল্যকালে। কিন্তু নাটক নিয়ে প্রভূত পড়াশোনা আছে। শিক্ষাগত যোগ্যতাও আছে। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন যাদবপুরের 'কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং'-এ। পরবর্তী কালের 'যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়'। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে করতে হত কারপেনটারির ক্লাস। ওই ক্লাস পছন্দ ছিল না সুশীল মজুমদারের। বিষয়টি আবশ্যিক না-থাকলেও পরীক্ষায় বসতে হলে পার্সেন্টেজের দরকার। এটি ছিল না, তাই পরীক্ষাও দেওয়া হল না সুশীল মজুমদারের। কোনও কালেই তাঁর এসব পড়াশোনা ভাল লাগত না। তিনি বলেছিলেন, "আমিও সুযোগ পেয়ে গেলাম, কেননা বাবা বসন্ত মজুমদার তখন জেলে।"


সবমিলিয়ে যুবকটিকে পছন্দ হয় পরিচালক শিশির ভাদুড়ির। পছন্দদানীবাবুরও। নাম জিজ্ঞেস করাতে যুবকটি বললেন সুশীল মজুমদার। নামধাম সবকিছুই বললেন তিনি। জানা গেল পূর্ব পাকিস্তানের (তৎকালীন) কুমিল্লার জমিদারবাড়ির ছেলে। বাবা বসন্তকুমার মজুমদার স্বাধীনতা সংগ্রামী। জেল খেটেছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ- এর কাছের মানুষ। আর মা হেমপ্রভা মজুমদারও স্বাধীনতা আন্দোলনের মহিলা নেত্রী। তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর খুব প্রিয়জন। হেমপ্রভা ছিলেন তৎকালীন 'বেঙ্গল অ্যাসেম্বলি'র এমএলএ। ছিলেন কলকাতা পুরসভার প্রথম মহিলা অন্ডারম্যান। সুশীল মজুমদারও জড়িয়ে পড়েন অসহযোগ আন্দোলনে। সেকারণে তাঁর কারাবাসও হয়। এসব শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পর। সুশীল মজুমদার শান্তিনিকেতন পড়তে যান মাত্র সাত বছর বয়সে। ১৯১২ থেকে ১৯২১ অর্থাৎ সাত থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তিগতভাবে খুবই পছন্দ করতেন। এবং ভালবাসতেন সুশীল মজুমদারকে। ১৯১৬-তে তিনি যখন শান্তিনিকেতনে 'ফাল্গুনী' মঞ্চস্থ করেন তখন নাটকে রেখেছিলেন সুশীল মজুমদারকে। জানা যায়, তাঁকে দিয়ে গানও গাইয়েছিলেন। সেই শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় থেকেই তাঁর গানের কান তৈরি।

ম্যাট্রিকুলেশন পাশ, কারাবাস থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুশীল মজুমদার চলে যান কাশী বিদ্যাপীঠ। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন সি ডি পান্ডে, যিনি পরে লোকসভায় কংগ্রেস দলের চিফ হুইপ হন। ত্রিভুবননারায়ণ সিং, পরবর্তী সময়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন। আর একবছর সিনিয়র ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। সুশীল মজুমদারের ছিল অভিনয়ে প্রচণ্ড ঝোঁক।


পড়াশোনা ছেড়ে চলে আসেন অভিনয়জগতে। বেছে নেন অভিনয়জীবন। ১৯২৮, ২ অক্টোবর নাট্যমন্দিরে মঞ্চস্থ হল শিশির ভাদুড়ির পরিচালনায় 'প্রফুল্ল'। সুরেশ করলেন সুশীল মজুমদার। দাপিয়ে অভিনয় করেছিলেন দানীবাবু আর শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে। প্রথম অভিনয়ে বাজিমাত করে দিলেন সুশীল 'মজুমদার। যাঁর অভিনয়ের হাতেখড়ি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তাঁর অভিনয়ের ভিত তো পাকাপোক্ত হবেই। বিশ শতকে বিশ দশকের শেষ আর তিরিশের দশকের শুরু, বাংলা সিনেমা প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাঙালির কাছে। মঞ্চের প্রায় প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রী মঞ্চ থেকে চলে আসছেন সিনেমায়। কেউ কেউ সিনেমায় আসছেন সরাসরি। 'প্রফুল্ল'র পর সুশীল মজুমদার আর কোনও নাটক করেছিলেন কিনা জানা যায় না। সম্ভবত করেননি। উনি


সিনেমার অভিনয়ে ঝুঁকলেন। ১৯২৮-এই যোগ দেন 'বেঙ্গল মুভিজ অ্যান্ড টকিজ'-এ। ১৯৩১-এই 'বেঙ্গল মুভিজ অ্যান্ড টকিজ'-এর ব্যানারে 'The Dawn of Life'. যার বাংলা ভার্সান 'জীবন প্রভাত'। এই নির্বাক ছবিতে শুধু অভিনয় নয়, সবরকম কাজ করতে হয় তাঁকে। তিনি বলেন, "... as an actor and General Assistant, where I had to do all sorts of job including assisting of the Director, Cameraman, Make up/ Costume Designer, and of course acting."

সুশীল মজুমদারের কথানুযায়ী তিনি পরিচালক সন্তোষকুমার সিংহকে সাহায্যও করেছিলেন। স্বভাবতই সুশীল মজুমদার ছিলেন এই ছবির সহকারী পরিচালকও। কীভাবে সিনেমা পরিচালনা করতে হয় তা তিনি শেখেন এই ছবিতেই। আসলে প্রথম থেকেই তাঁর অদম্য ইচ্ছা ছিল সিনেমার সমস্তরকম কাজ শেখার, শিখেওছিলেন। 'The Dwan of Life' বা 'জীবন প্রভাত' ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন ডি ডি ডাবকে বা দত্তাত্রেয় দামোদর ডাবকে। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় সিনেমা দাদাসাহেব ফালক- এর 'রাজা হরিশ্চন্দ্র'র (১৯১৩) ক্যামেরাম্যান। তিনি অভিনয়ও করেছিলেন এই ছবিতে। পরে ১৯২৪-এ 'রাজা হরিশ্চন্দ্র'- এর রিমেক হয়। সেই ছবি পরিচালনাও করেছিলেন ডাবকে। হয়তো সেই কারণে'জীবন প্রভাত' বা 'The Dwan if Life'-এর পোস্টারে আলদা করে নাম দেওয়া হত ডি ডি ডাবকে-র।


এ-সম্পর্কে সুশীল মজুমদার বলেছেন, "The Director was Mr SK Hazra and the cameraman was Mr Dabke, who was once assistant of Dada Sa- heb Falke. In those days silent hand-cranking camera was used, 'জীবন প্রভাত' করার সময় সিনেমার সমস্তরকম কাজ শিখেছিলেন তেমনই ডাবকের ক্যামেরা চালনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নজর করেছিলেন সুশীল মজুমদার।

একসময় তাঁর ইচ্ছাও ছিল ক্যামেরাম্যান হওয়ার। তিনি নিজেও এ-কথা বলেছিলেন, "ক্যামেরাম্যান হওয়ার অফার পেয়েছিলাম কিন্তু ডিরেক্টর হলাম। ডিরেক্টর হওয়ার আর একটা কারণ এই যে এতে ক্রিয়েশনের আনন্দ আছে অভিনয়ের থেকেও যেটার বেশি আনন্দ। অভিনেতা তৈরি করা, তাদের দিয়ে নানাভাবে অভিনয় করিয়ে নেওয়া ইত্যাদির যে আনন্দ তা ডিরেক্টর হওয়ার মধ্যেই থাকে। এই সমস্ত কারণেই আমি ছবি পরিচালনায় চলে গিয়েছিলাম।"


'জীবন প্রভাত' ছবিটি মুক্তি পায় দোসরা মে, ১৯৩১, পার্ল প্রেক্ষাগৃহে। সারা শহর জুড়ে পোস্টার পড়ে, 'বাংলার গৌরব! বাঙ্গালীর গৌরব! বৎসরের শ্রেষ্ঠ ফিলম 'জীবন প্রভাত'। এবং পোস্টারে ক্যামেরাম্যান ডি ডি ডাবকে'র নাম আলাদা করে দেওয়া হত। তার কারণ তিনি দাদাসাহেব ফালকে'র ক্যামেরাম্যান। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম জ্বলজ্বল করছে।

যিনি অভিনয় করার জন্য। এসেছিলেন অভিনয়জীবনে, সেই সুশীল মজুমদার হয়ে উঠলেন বাংলা সিনেমার এক ব্যতিক্রমী পরিচালক। কেন! সুশীল মজুমদার বলেছিলেন, "আমি সিনেমায় অভিনয় করতে এসে বুঝতে পারলাম যে সিনেমায়। অভিনেতা হয়ে থাকতে গেলে হিরো হয়ে থাকা ছাড়া কোনও মানে নেই। কিন্তু সমস্যা হল আমার ফিগার ছিল না হিরো হওয়ার মতো, আমার চেহারা ছিল, ফোটোজেনিক ছিলাম কিন্তু হিরো হওয়ার মতো ফিগার না-থাকার দরুন আমি আর হিরো কনটিনিউ করতে পারলাম না যদিও হিরোর অভিনয় করেছি, সুনামও হয়েছে কিন্তু হিরো হওয়ার আইডিয়াটা ছেড়ে দিলাম। আমি হতে পারতাম কমেডিয়ান কিন্তু কমেডিয়ান ব্যাপারটা খুব পছন্দ হয়নি। সেইজন্য আমি অভিনয়ের ব্যাপারটার প্রতি স্ট্রেস না দিয়ে সিনেমার টেকনিক্যাল সাইডে চলে গেলাম।" একটা জায়গায় সুশীল মজুমদার বলছেন, "আমি হতে পারতাম কমেডিয়ান....।" কমেডির প্রতি তাঁর একটা ভাললাগা ছিল। সম্ভবত সেইজন্য সুশীল মজুমদার পরিচালিত প্রথম ছবি 'একদা' ছিল কমেডি ছবি। 'একদা'র বিজ্ঞাপন বা পোস্টারে লেখা হত, 'অতি উজ্জ্বল- হাস্যরসাত্মক নিখুঁত চিত্র'। ছবির কাহিনিকার ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। তাঁর প্রোডাকশনের ছবি 'একদা'। দু'রিলের ছোট ছবি। শোনা যায়, ছবিটি পরে দেবকীকুমার বসুর 'নিশির ডাকা এর সঙ্গে মুক্তি পায় ২৩ এপ্রিল ১৯৩২, চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে। 'নিশির ডাক' পরবর্তী কালে সবাক ছবি হিসেবে মুক্তি পেয়েছিল। সেসব অনেক কথা, পরে আসছি। বিশ শতকের তিরিশের দশক বাংলা চলচ্চিত্রে সুশীল মজুমদারের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাক থেকে বাংলা সিনেমা সবাক হচ্ছে, আলোর ব্যবহারে যুগান্ত সৃষ্টি করছেন প্রমথেশ বড়ুয়া, সেইসময় তিনি জড়িয়ে আছেন বড়ুয়া ফিল্মসে। এই বিষয়ে কিছুটা বলা প্রয়োজন তাহলে সুশীল মজুমদার কীভাবে বাংলা সিনেমার কাজ জানা এক অভিনেতা-পরিচালক হয়ে উঠেছিলেন তা বুঝতে সুবিধা হবে।

প্রমথেশ বড়ুয়া ফ্রান্সের ফক্স স্টুডিয়োতে রোজার্স-এর অধীনে কাজ শিখে কলকাতা ফেরেন তিরিশের দশকের শুরুতেই। প্রমথেশ বড়ুয়া লাইট, ক্যামেরা ইত্যাদি কাজ শিখে আসার পিছনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান ছিল অনেকটাই। এদিকে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন সুশীল মজুমদার। সম্ভবত সেই কারণেই বোধহয় সুশীল মজুমদারের সঙ্গে প্রমথেশ বড়ুয়ার একটা সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৩১-এর শুরতেই তিনি 'বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট' তৈরি করলেন। ঠিকানা হল, ১৪ বালিগঞ্জ

সার্কুলার রোড।


প্রমথেশ বড়ুয়ার ফিল্ম ইউনিটে যোগ দেন সুশীল মজুমদার। বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিটের প্রথম নির্বাক ছবি হল 'অপরাধী'। এই ছবিটিতে ইতিহাস সৃষ্টি হল। এই প্রথম রিফ্লেক্টারের সাহায্যে ১২ ডিসেম্বর, ১৯৩২, রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে। এই ছবির মুক্তির দিন যেমন ইতিহাস সৃষ্টি হয় সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে শুটিং হল। ছবির দৃশ্য গ্রহণ করলেন আলোকচিত্রী কৃষ্ণগোপাল। ব্যবহার করা হয় ফ্লাড লাইট। প্রমথেশ বড়ুয়া তো ছিলেনই, আর ছিলেন সবিতা দেবী যাঁর প্রকৃত নাম আইরিশ গ্যাসপার, শান্তি গুপ্তা, প্রভাবতী দেবী, রাধিকারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (বড়) এবং সুশীল মজুমদার। নির্বাক ছবি 'অপরাধী' মুক্তি পায় ২৮ নভেম্বর, ১৯৩১, চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে।


'বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট'- এর দ্বিতীয় ছবি 'একদা'। দু'রিলের ছবি। কমেডি ছবি। প্রমথেশ বড়ুয়ার কাহিনি। ছবি পরিচালনা করার দায়িত্ব পেলেন সুশীল মজুমদার। প্রমথেশ বড়ুয়ার কাছে ছবি পরিচালনার হাতেখড়ি সুশীল মজুমদারের। 'অপরাধী' ছবিতেই খুব কাছ থেকে সুশীল মজুমদার কাজ দেখেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়ার। নতুন পরিচালক সুশীল মজুমদারের পরিচালনার কাজ দেখে খুশি হন প্রমথেশ বড়ুয়া। তাঁর অভিনয়ও পছন্দ করতেন বড়ুয়াসাহেব। 'অপরাধী'-সহ সেইসময়কার বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিটের প্রায় সব ছবিতেই অভিনয় করেন সুশীল মজুমদার। 'নিশির ডাক' (১৯৩২), 'বাঙলা ১৯৮৩' (১৯৩২)। 'একদা' ছোট ছবি তাই কোনও একটি ছবির আগে-পিছে না জুড়লে ছবির ছটিয়ে মুক্তি ঘটবে না। মুক্তি পায় অবশেষে 'নিশির ডাক' ছবির সঙ্গে। যা আগেই বলা হয়েছে।


'বাঙলা ১৯৮৩' মুক্তি পায় বাংলা সিনেমায়, তেমনই অশান্তি হয় ছবিটি ঘিরে। এর আগের ছবি 'নিশির ডাক'-এর সময় থেকেই সবাক সিনেমার শুরু। এ-ব্যাপারে প্রমথেশ বড়ুয়া সচেতন থাকলেও কিন্তু ছবিটি ছিল নির্বাক। পরে সবাক করা হয় অরোরা যখন বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট কিনে নেয়, তারপর। তাহলে প্রমথেশ বড়ুয়া পারলেন না কেন। সুশীল মজুমদারের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক কী আছে। আসলে, তিনি তখন ভীষণভাবে জড়িয়ে ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়ার প্রোডাকশনে। সৌরেন্দ্রমোহন ঘোষকে সাউন্ড রেকর্ডিং স্টুডিয়ো তৈরির ভার দিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। সাউন্ডের জন্য প্রচুর যন্ত্রপাতি এলো মুম্বই তৎকালীন বোম্বে থেকে। কিন্তু হল না। ১৯৪০-এ 'নিশির ডাক' সবাক হয় অরোরা নিয়ে নেওয়ার পর। সবাক 'নিশির ডাক' মুক্তি পায় ১৬ নভেম্বর ১৯৪০, শ্রী প্রেক্ষাগৃহে। ছবিটি জনপ্রিয় হয় এবং সুশীল মজুমদারের অভিনয়ের খ্যাতিও হয়েছিল বেশ। 'নিশির ডাক'-এ সাফল্য না-পেলেও 'বাঙলা ১৯৮৩' বা 'বেঙ্গল ১৯৮৩' সবাক ছবি করতে মেতে উঠেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। ছবির বিষয়ে ছিল অভিনবত্ব। তিরিশের দশকে দাঁড়িয়ে আশির দশকে বাংলার সামাজিক পরিস্থিতি, অবস্থা কেমন হতে পারে তার ইঙ্গিত করেছিলেন পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া। এই ছবিতেও সুশীল মজুমদারের ছিল গৌরবময় উপস্থিতি। মনে হয়, সুশীল মজুমদারের ওপর খুব ভরসা করতেন প্রমথেশ বড়ুয়া। ছবিতে রতনের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন সুশীল মজুমদার। কিন্তু ছবির মুক্তির দিন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে প্রেক্ষাগৃহে। কারণটা শব্দ। প্রমথেশ বড়ুয়া দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন শব্দ- যন্ত্রের। 'টকির যুগ শুরু হয়ে গেলেও প্রমথেশ তাঁর স্টুডিওতে যে শব্দ যন্ত্রের ব্যবহার করলেন সেখানেও পরীক্ষামূলক মানসিকতার জন্য আরো একটা বড় অঘটন ঘটল।

'প্রচলিত যন্ত্রপাতি বাদ দিয়ে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের আবিষ্কৃত 'সিস্টোফন' শব্দ যন্ত্রকে ব্যবহার করলেন তাঁর নতুন ছবি 'বেঙ্গল ১৯৮৩'- র জন্য। শব্দ স্ফুটন কেমন হল তা ভাল করে যাচাই না করে এই ছবি দিয়ে 'রূপবাণী' চিত্রগৃহের দ্বারোদঘাটন করানো হল রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে। রেকর্ডিং-এ ত্রুটি থাকার জন্য ছবির কোনো কথাই বোঝা যাচ্ছিল না, ফলে উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে ছবি দেখে দর্শকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সিনেমা হলের আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়। হল কর্তৃপক্ষ প্রমথেশের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করলে তিনি আকূল পাথারে পড়েন'। (প্রমথেশ বড়ুয়ার জীবনচরিত,প্রবন্ধ সুব্রত রুদ্র, অরুণা)। একসময় বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। অরোরা কিনে নেয়। প্রমথেশ বড়ুয়া যোগ দেন নিউ থিয়েটার্স-এ। এরপর প্রমথেশ বড়ুয়ার আর কোনও ছবিতে কাজ করেননি সুশীল মজুমদার। তিনি অবশ্য ক্রমশ সরে আসেন অভিনয়জগত থেকে। পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন ছবি পরিচালনায়। কেননা, তাঁকে দেখা যাচ্ছে, অরোরার 'অভিনব' (১৯৩২)-র ৩০ বছর পর পরিচালক নির্মল সর্বজ্ঞর 'আজ কাল পরশু' ছবিতে অভিনয় করতে। এই ছবিতে তিনি ছিলেন অতিথি শিল্পী। অথচ সেই জায়গায় ৩০টি ছবি পরিচালনা করেছেন সুশীল মজুমদার। এই তিরিশটির ভিতর একাধিক যুগান্তকারী ছবি ছিল। 'রিক্তা', 'তটিনীর বিচার', 'অভয়ের বিয়ে', 'যোগাযোগ', 'হসপিটাল' (হিন্দি এবং বাংলা), 'ভাঙাগড়া' 'পুষ্পধনু' ইত্যাদি। এর মধ্যে এক নম্বর 'রিক্তা'। এই ছবিটি সম্পর্কে আসছি। সবিস্তারে। 'রিক্তা' ছবিটি নিয়ে পরিচালক সুশীল মজুমদার বলেছিলেন, "রিক্তা'কেই বলব আমার সবচেয়ে সার্থক ছবি। তবে ভাঙাগড়া, রাত্রির তপস্যা, সর্বহারা, দিগভ্রান্ত ইত্যাদি ছবিও যথেষ্ট সার্থক কিন্তু একথা ঠিকই যদি আমি 'রিক্তা' করে আর কোনও ছবি না-করতাম তাহলে ' ' 'আমার কোনও খেদ বা ক্ষোভথাকত না। আর কোনও ছবি না-করলেও আমি 'রিক্তা'র মধ্যেই বেঁচে থাকব বলে মনে করি।"সেইসময় 'রিক্তা'র প্রশংসাসংবলিত চিঠি ঝুড়ি ঝুড়ি আসত পরিচালকের কাছে।


এমনকী এক ধনী পরিবারের বয়স্কা স্ত্রী চিঠিতে পরিচালক সুশীল মজুমদারকে লিখছিলেন, আমাদের স্বামী-স্ত্রীর দীর্ঘ ২০ বছরের ঝগড়া মিটে যায় 'রিক্তা' দেখার পর'। তিরিশের দশকে এমন ঘটনা বেশ রোমহর্ষর্ক! সেইসময় নিউ থিয়েটার্সের বাইরে কোনও বাংলা ছবির সিলভার জুবিলি ছিল চিন্তাভাবনার বাইরে। কিন্তু রিক্তা' সিলভার জুবিলি করে। রিক্তা' ছিল ফিল্ম কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার ছবি। সুশীল মজুমদারের পরিচালিত বেশিরভাগ ছবিই ছিল এই ব্যানারের। 'রিক্তা'র আকাশচুম্বী সাফল্যের কারণে পদক দিয়ে প্রযোজকের পক্ষ থেকে সম্মানিত করা হয় পরিচালককে। 'রিক্তা'র সাফল্যের কারণ কী ছিল! 'রিক্তা' ছবিতে নায়ক বিকাশের ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরী এবং নায়িকা করুণার চরিত্রে ছায়া দেবীকে নির্বাচন করেন পরিচালক সুশীল মজুমদার। অহীন্দ্র চৌধুরী সেইসময় বাংলা ছবিতে প্রতিষ্ঠিত। ছায়া দেবীর বাংলা সিনেমায় বছর তিনেক। ইতিমধ্যেই তিনি দাপুটে অভিনেত্রী হিসেবে নাম করে ফেলেছেন। অশোককুমারের মতো অভিনেতাও নাকি তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, "বহু বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করেছি, কখনও ঘাবড়ায়নি। কিন্তু ছায়ার সঙ্গে অভিনয় করার সময় বেশ ভয় ভয় করে।" যাইহোক, মাত্র তিন বছরে গোটা দশ ছবিতে কাজ করে ফেলেছেন ছায়া দেবী। তাই শত্রুও জুটেছিল প্রচুর।

এমনকী, পরিচালক সুশীল মজুমদারের কান ভাঙাতেও নাকি চেষ্টা হয়। উনি ছিলেন এককথার মানুষ। তাই কোনও কথায় কান না-দিয়ে অহীন্দ্র চৌধুরীর বিপরীতে নায়িকা ছায়া দেবীই বহাল রইলেন। পরিচালক আগেই ভেবে রেখেছিলেন ছায়া দেবীকে দিয়ে গান গাওয়াবেন। গেয়েও ছিলেন। করুণার চারটি গানই উনি গেয়েছিলেন। আর রমলার গান অভিনেত্রী-গায়িকা রমলা দেবীই গেয়েছিলেন। সুপার হিট হয় রমলা দেবীর কণ্ঠে 'চাঁদ যদি নাহি ওঠে, 'না উঠুক' আর 'আরও একটু সরে বসতে পারো'। এই দু'টি গান সেইসময় লোকের মুখে মুখে ঘুরত। তিরিশের দশকের শেষ এবং চল্লিশের দশকের শুরু। এমনই এক মুহূর্তে 'রিক্তা'র মুক্তি। এবং বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ছবি 'রিক্তা'। বিশ শতকের তিরিশের দশকে পরকীয়া প্রেম সেইসঙ্গে একটি মহিলার লড়াই দেখানো খুব- একটা সহজ কাজ ছিল না। তা কিন্তু করে দেখিয়েছিলেন সুশীল মজুমদার। সেইসঙ্গে সুশীল মজুমদার হয়ে উঠেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে মধ্যবিত্ত বাঙালির পরিচালিক। কি '


সুশীল মজুমদারের ছবি বাঙালি সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তদের ভাল লাগত। পুরুষ, মহিলা উভয়েরই ছিল পছন্দের। এর পিছনে অঙ্ক ছিল? কারণ কী ছিল! রিক্তা' ছবির সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে সুশীল মজুমদার সামগ্রিকভাবে দিয়েছিলেন, "রিক্তা' ছবি নিয়ে সকলেরই প্রশংসা পাই। সবরকম দর্শকের ভাল লাগে 'রিক্তা'। আসলে ওইসময় বাংলা সিনেমার একটা ট্রেন্ড ছিল রোম্যান্টিক এবং শরৎ ও রবীন্দ্র কাহিনি নির্ভর। সেই জায়গায় 'রিক্তা' ছিল সবকিছু বাদ দিয়ে, অন্যরকম। এই পরিবর্তন বাংলা ছবির দর্শকেরা খুব ভালভাবে নিয়েছিল। সেইকারণে, দর্শকের অভাব হয়নি কখনও। তাঁরা প্রেক্ষাগৃহ ভরিয়েছিলেন। তবে সবাই যে উচ্ছ্বসিত ছিলেন তা নয়, বিরুদ্ধ মতও ছিল। তবে অভিনেতা- অভিনেত্রীদের অভিনয়ের প্রশংসা সকলেই করেছিলেন। 'রিক্তা'র যে-দৃশ্যের কথা না-বললেই নয়, সেটা হল, ছবির আদালতের দৃশ্য। ওই দৃশ্যটি টেক করা হয়েছিল মাত্র একটি শটেই! পরবর্তী সময়ে বহু ছবির কোর্ট সিনে এর প্রভাব দেখা গেছিল। 'খাজাঞ্চি' ছবিতেই এমন দৃশ্য নেওয়া হয়েছিল।"

সুশীল মজুমদার ছিলেন ভীষণই দর্শক friend- ly. তাঁর কথায় জানা যায়, "আমি চিরকালই দর্শকদের চাহিদা অনুযায়ী ছবি করায় বিশ্বাসী, কেননা যাদের জন্য ছবি তাদের চাহিদা অনুযায়ী ছবি করা আমি যুক্তিযুক্ত মনে করি। এ ব্যাপারে আমার কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কেননা যাদের জন্য ছবি করা তারাই যদি বুঝতে না-পারে তাহলে সে ছবি করে লাভ কি? আজকাল-অবশ্য শুনি 'আমি আমার জন্য ছবি করি' কিন্তু তা করতে হলে তো নিজের পয়সা থাকা দরকার, প্রডিউসারের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে 'নিজের জন্য ছবি করি' বলাটা কি ঠিক?"


এ-প্রসঙ্গে সুশীল মজুমদার তুলনা টানতেন ফরাসি চলচ্চিত্রকার রেনে ক্লেয়ার- এর। রেনে ক্লেয়ার বলেছিলেন, একজন পরিচালকের কাজই হচ্ছে দর্শককে নিজ-আসনে বসিয়ে রাখা, যদি তা না হয়, তাহলে এটা কখনওই দর্শকের দোষ নয়। কেউ যদি নিজের অহং বা স্বাতন্ত্র্যবোধ পরিতৃপ্ত করতে চান, তাহলে নিজের অর্থ খরচ করে ছবি বানান, নিজের বৈঠকখানায় বসে ছবি দেখুন। তাঁর কোনও অধিকার নেই দর্শককে উৎপীড়িত করার। কেননা, তিনি নিজের কষ্টার্জিত গাঁটের কড়ি ফেলে সিনেমা দেখতে এসেছেন নিজেকে আনন্দ দিতে। রেনে ক্লেয়ার-এর এই ভাষ্যকে বাইবেল মনে করতেন সুশীল মজুমদার। হলিউডের এক জনপ্রিয় এবং সফল প্রযোজকের কথাও তিনি মানতেন। তিনি ছিলেন স্যামুয়েল গোল্ডউইন। যিনি পরিচিত ছিলেন গোল্ডফিশ নামেও। তাঁকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার সাফল্যের মূল কারণ কি? স্যামুয়েল গোল্ডউইন বলেছিলেন, দর্শকদের কথা ভেবে ছবি করি। তাই তিনি

সফল। এঁদের প্রসঙ্গে এসব কথা বলার পর সুশীল মজুমদার বলতেন, "আমার মোদ্দা কথা, যাঁদের জন্য ছবি করি তা যদি তাঁদের পছন্দ না-হয় সে ছবি করে তো কোনও লাভ নেই। রাজনীতি হোক বা শিল্প হোক তা যাঁদের জন্য করি তাঁরা যদি বুঝতে না পারেন, তাঁদের যদি খবর কাগজের রিপোর্টার বা ইন্টারপ্রেটার নিয়ে হল-এ ঢুকতে হয় এবং ছবি দেখে যদি তাঁদের কাছ থেকে জানতে হয় ছবিটার বক্তব্য কি তা হলেও বড় মুশকিল ব্যাপার। আমি তা কোনওদিনই করিনি। আমাদের সময় চাহিদা ছিল ভাল গল্প, ভাল অভিনয়, নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত আর সে চাহিদা দর্শকদের তখনও ছিল আজও আছে।"

সুশীল মজুমদারের ছবিতে কোনওরকম শটের মারপ্যাঁচ থাকত না। এই পরিচালকের সব ছবি তো দেখা সম্ভব নয়, তার কারণ বেশিরভাগ ছবিই নষ্ট হয়ে গেছে। সেই সময়কার পত্রপত্রিকায় নির্দিষ্ট ছবি সম্পর্কে পড়ে যতটুকু ধারণা করা যায় মাত্র। এছাড়া জীবিতকালে পরিচালকের সঙ্গে কথাবার্তায় যতটুকু বেরিয়ে এসেছে তার ওপর ধারণা করা ছবি সম্পর্কে।


যেমন, তিরিশ-চল্লিশের দশকে বেশিরভাগ অভিনেতা- অভিনেত্রীই ছিলেন মঞ্চের। ফলে, তাঁদের অভিনয়ে মঞ্চ- অভিনয়ের একটা ছাপ থাকত। কারওর কারওর মধ্যে সেই প্রভাবটা হয়তো থাকত না। তবে পরিচালকের প্রধান কাজ ছিল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের -অভিনয়ের প্রভাবমুক্ত করা। এর ওপর জোর দিতেন সুশীল মজুমদার। তাই তিনি বলছেন, "আমার মতেই চলতে হত অভিনেতা- অভিনেত্রীদের। ছবিটা আমার। আমি যা বলব তাই হবে। আমি সকলকে আমার মনমতো তৈরি করে নিতাম।


* এমনকী অহীন্দ্র চৌধুরীর মতো বড় অভিনেতাকেও বলতাম, ফিল্ম অ্যাক্টিং করবেন। মঞ্চ- অভিনয় হলেই শুধরে দিতাম। তবে, উনিও বড় অ্যাক্টর ছিলেন, তৎক্ষণাৎ শুধরে নিতেন। আমি প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে সিনেমার উপযোগী অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলাম।"


সুশীল মজুমদার নিজের ছবির চিত্রনাট্য নিজেই লিখতেন। ওইসময় বহু পরিচালকই অন্যের লেখা চিত্রনাট্যে ছবি করতেন। তাই পছন্দসই চিত্রনাট্য হয়তো পেতেন না। এখানে একটা বাড়তি সুবিধাভোগ করতেন সুশীল মজুমদার। তিনি সর্বদাই মধ্যবিত্ত বাঙালিকে মাথায় রেখে চিত্রনাট্য করতেন। তৎকালীন সময়ে বাঙালি দর্শক ছবিতে গান খুব পছন্দ করতেন। তাই সুশীল মজুমদারের ছবিতে গানের একটা বড় ভূমিকা থাকত। তিনি প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে ছবিতে গানের সুপ্রযুক্ত ব্যবহারের ব্যাপারটা ভাল শিখেছিলেন, ভাল জানতেনও। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল কোন গান, কার কণ্ঠে ভাল লাগবে, শ্রুতিমধুর হবে, তা বেশ ভাল জানতেন তিনি। প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে থেকে সুশীল মজুমদার শিখেছিলেন কোন গান কীভাবে, কোথায় ব্যবহার করলে ছবিতে নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত, মুহূর্ত, টেনশন তৈরি হবে। বলা যেতে পারে সুশীল মজুমদারের দিব্যদৃষ্টি ছিল। সেইকারণে, তাঁর ছবির বেশিরভাগ গান লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলেন রায় প্রমুখ গীতিকার। তাঁর ছবিতে সুর করেছেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, শচিন দেববর্মন, কমল দাশগুপ্ত, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়-এর মতো প্রমুখ সুরকারেরা। এইসব গীতিকার এবং সুরকারেরা তৎকালীন সময়ে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বাঙালির ছিল প্রিয়। গানটি চমৎকার বুঝতেন সুশীল মজুমদার। পরিচালকজীবনের প্রথমদিকে রমলাকে দিয়ে বহু গান গাইয়েছিলেন সুশীল মজুমদার। সেইসময় বাংলা ছবির দর্শকদের কাছে রমলা ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। তাঁর গান খুব পছন্দ বাঙালি সংগীত রসিকেরা। এই রমলা দেবী কে ছিলেন? তাঁর প্রকৃত নাম র্যাচেল কোহেন। তৎকালীন বম্বের এক ইহুদি পরিবারে জন্ম। বাবা ছিলেন শিক্ষক। এই ইহুদি পরিবার বম্বে ছেড়ে চলে আসেন কলকাতা। ছোট থেকেই রযাচেল বা রমলার ঝোঁক ছিল গান এবং অভিনয়ের প্রতি। তিনি চৌরঙ্গি এলাকার যে-স্কুলে পড়তেন সেখানে অংশ নিতেন গান-বাজনা, নাটক সহ নানান অনুষ্ঠানে। পরবর্তী সময়ে অভিনয়, নাচ, গান শেখার জন্য তাঁকে আরও দুই বোনের পাঠানো হল কোরিনথিয়ান থিয়েটারে।

একসময় তিনি থিয়েটার থেকে চলে আসেন সিনেমায়। বাংলা সিনেমায় তখন থিয়েটার বা মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভিড়। রমলার আর এক বোন রূপলেখাও সম্ভবত সিনেমা করতেন।রমলা যখন সিনেমা করতে শুরু করছেন তখন প্রেক্ষাগৃহ খুবই কম। সেইসময় ময়দানে তাঁবু খাটিয়েও সিনেমা দেখানো হত। সেকালে বলা হত বায়োস্কোপ। রমলা ছিলেন গায়িকা-অভিনেত্রী। তিনি সুন্দরীও ছিলেন। রমলা প্রথম অভিনয় করেন পরিচালক মধু বসুর 'ডালিয়া' ছবিতে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩। গল্প ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সুশীল মজুমদারের একাধিক ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন রমলা। সুশীল মজুমদার তাঁর চলচ্চিত্রজীবনে ৩৫টি পরিচালনা, ১৮টি ছবিতে অভিনয় এবং পাঁচটি ছবি করার কথা ছিল সেইসব শেষপর্যন্ত আর হয়নি। পাঁচটির ভিতর দু'টি ছবি তুলসী লাহিড়ির লেখা 'পান্থশালা' এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দুর্গেশনন্দিনী' ছিল সুশীল মজুমদারের নিজস্ব প্রোডাকশন। অন্য তিনটির ভিতর প্রেমেন্দ্র মিত্রর লেখা 'হয়তো', নীহাররঞ্জন গুপ্তের 'সুচরিতা' এবং ধনঞ্জয় বৈরাগীর 'কালো হরিণ চোখ'। 'কালো হরিণ চোখ'-এ তিনি প্রধান দুই চরিত্রে নির্বাচন করেছিলেন উত্তমকুমার এবংঅপর্ণা সেন'কে। এর আগে উত্তমকুমারকে নায়ক রেখে একাধিক ছবি করেছিলেন। সেই তালিকায় ছিল- 'মনের ময়ূর' (১৯৫৪), নায়িকা ভারতী দেবী, 'পুষ্পধনু' (১৯৫৯), নায়িকা অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, 'লাল পাথর' (১৯৬৪), নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী এবং 'শুকসারী' (১৯৬৯), নায়িকা অঞ্জনা ভৌমিক।উত্তমকুমার অভিনীত চারটির মধ্যে সবচেয়ে ভাল চলেছিল 'লাল পাথর' ১৪ সপ্তাহ এবং 'পুষ্পধনু' ৯ সপ্তাহ।

সুচিত্রা সেন'কে নিয়ে দু'টি ছবি করেন। একটি 'শুভরাত্রি' (১৯৫৬), নায়ক বসন্ত চৌধুরী, অন্যটি 'হসপিটাল' (১৯৬০), নায়ক অশোককুমার। সুশীল মজুমদার যখন উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনকে ছবি করছেন পঞ্চাশ, ষাটের দশকে তখন ওঁরা কিন্তু বাংলা সিনেমার সবচেয়ে হিট জুটি। অথচ উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনের বিপরীতে নায়িকা এবং নায়ক ভিন্ন। সুশীল মজুমদার পরিচালিত উত্তম, সুচিত্রা অভিনীত ছ'টি ছবি যে খুব খারাপ চলেছিল তা নয়। কিন্তু ওঁদের দু'জনকে নিয়ে কেন ছবি করেননি তা রহস্য রয়ে গেছে। এ-সম্পর্কে পরিচালকও কখনও কোনও উচ্চবাচ্য করেননি।


প্রযোজক-পরিচালক হিসেবে সুশীল মজুমদারের চলচ্চিত্রজীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর ১৯৪৮। এ-বছর ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনে মুক্তি পায় 'সিপাহী কা স্বপনা'। এই ছবিটির প্রযোজনা করেন সুশীল মজুমদার। পরিচালক হিসেবে ছিলেন জি ডি স্বামী এবং সুশীল মজুমদার। রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকার 'নাট্যলোক চিত্রকলা' (রবিবার, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৪৮) বিভাগে লিখছে, 'নেতাজীর জন্মদিনে নেতাজীর উদ্দেশে শ্রদ্ধানিবেদন হিসাবে কলকাতায় আর একখানি ছবি মুক্তিলাভ করিয়াছে। ছবিখানি ভি ডি স্বামী ও সুশীল মজুমদারের নিবেদন। আজাদ হিন্দ ফৌজের সুদূর প্রাচ্যের দুঃখকষ্টবরণ এবং সাহসিকতাপূর্ণ কার্যকলাপকে ভিত্তি করিয়া আলোচ্য ছবিখানি গড়িয়া উঠিয়াছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকগণই এই 'ছবিতে অভিনয় করিয়াছেন এবং ১৯৪৩ সালে নানকিংয়ে নেতাজীর সম্বর্ধনা ও বক্তৃতাদি ইহাতে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। গত শুক্রবার প্রাতে পূর্ণ থিয়েটারে সুভাষ বন্দনা ও ক্যাপ্টেন রাম সিংয়ের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ অর্কেস্ট্রা কর্তৃক আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গীতের পর মেজর জেনারেল শা নওয়াজ 'সিপাহী কা স্বপনা'র উদ্বোধন করেন। শ্রীযুক্তা হেমপ্রভা মজুমদারও বক্তৃতা করেন'। হেমপ্রভা মজুমদার হলেন সুশীল মজুমদারে মাতৃদেবী এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুগামী।


'সিপাহী কা স্বপনা'র মাস ছয় পর মুক্তি পায় ' ২৩ জুলাই, ১৯৪৮। বিজ্ঞাপনে লেখা হত চির-বঞ্চিত, সর্বহারা', এই ছবির , 'যারা চির-উপেক্ষিত, হতভাগ্য সর্বহারার দল মুক্তি সংগ্রামের জয়গানে মুখরিত জাগ্রত ভারতে তাদেরি অধিকারবোধ ও দাবী নিয়ে আবির্ভূত- সর্বহারা' । এই ছবিটি কলকাতার সঙ্গে মুক্তি পায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা, রংপুর ও চট্টগ্রামে।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তি পেয়েছিল কোনও 'সর্বহারা' ছিল সিনেমা। কৃষকদের কথা, গ্রামবাংলা, পাশাপাশি হিন্দু- মুসলিমদের সংহতির কথা। সুশীল মজুমদার যে-ধরনের ছবি করে থাকেন সেখান থেকে বেরিয়ে এসে একেবারে অন্যরকম ছবি করেছিলেন 'সিপাহী কা স্বপনা' এবং সর্বহারা'। বলিউডের নামীদামি প্রতিষ্ঠান 'বম্বে টকিজ'-এর ছবি করলেন দুটি। একটি 'চার আঁখে'(১৯৪৪), অন্যটি 'বেগম'(১৯৪৫)। এর আগে 'তটিনীর বিচার' (১৯৪০), 'প্রতিশোধ' (১৯৪১), 'অভয়ের বিয়ে'(১৯৪২), 'যোগাযোগ' (১৯৪৩),'হসপিটাল' (১৯৪৩/হিন্দি)।

পরিচালক সুশীল মজুমদারের কান তৈরি ছিল। হয়তো শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে এসে কান তৈরি হয়েছিল তাঁর।


এর ভিতর 'যোগাযোগ' এবং 'হসপিটাল' ছিল এমপি প্রোডাকসন্স-এর ছবি। স্বভাবতই ছবির নায়িকা কানন দেবী। 'যোগাযোগ', 'হসপিটাল' দু'টিই মন্মথ রায়ের কাহিনি। দু'টি ছবিরই সংগীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত। 'হসপিটাল'-এর চিত্রনাট্য পরিচালককৃত হলেও 'যোগাযোগ' ছিল প্রেমেন্দ্র মিত্রের। গীতিকারও প্রেমেন্দ্র মিত্র। কেবল কানন দেবীর গাওয়া 'সখিরে, শ্যামলের প্রেম যেন নয়নের জল' গানটি লিখেছিলেন শৈলেন রায়। মোট গান ছিল সাতটি। চারটি গান ছিল কানন দেবীর গাওয়া। দু'টি গান ছিল রবীন মজুমদারের কণ্ঠে। অন্যটি কোরাস। কানন দেবীর গাওয়া চারটি গানই ছিল হিট। বিশেষ করে, সেকালে 'যদি ভাল না লাগে তো দিও না মন' গানটি প্রত্যেকের মুখে মুখে ঘুরত। আজও গানটি বাজলে থমকে যেতে হয়। আগেই বলা হয়েছে, গান সম্পর্কেপরিচালক সুশীল মজুমদারের কান তৈরি ছিল। হয়তো র শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে এসে কান তৈরি হয়েছিল তাঁর।

তিরিশের শেষে ১৯৩৯, বিয়ে করেন আরতি ঘোষকে। ইনি ছিলেন পাটনার ঘোষ পরিবারের মেয়ে। সেইসময় ভারতী দেবী ময়ূর' (১৯৫৪) করে তবু ভয় পাটনার ঘোষেরা ছিল বেশ সম্ভ্রান্ত না' রবীন্দ্রনাথের পরিবার। পাটনা শহরে খুব নাম ছিল এই ঘোষ পরিবারের। আরতি ঘোষ বিয়ের পর সিনেমায় অভিনয় করেন। তবে, শুরুটা সুশীল মজুমদারের ছবিতে নয়, বন্ধু পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের ছবিতে। ছবির নাম 'প্রিয়তমা' (১৯৪৮)। বিয়ের ন'বছর পর। স্বামী সুশীল মজুমদারের ছবিতে প্রথম অভিনয় 'রাত্রির তপস্যা' (১৯৫২)। অর্থাৎ বিয়ের ১৩ এবং প্রথম ছবি 'প্রিয়তমা'র চার বছর পর। 'রাত্রির তপস্যা' সুশীল মজুমদারের পরিচালনা জীবনে একই গুরুত্বপূর্ণ ছবি। তিনি নিজেও তাই মনে করতেন। ধনী- দরিদ্র, শিক্ষক-ছাত্রী প্রেম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ছবি। সেকালের বাংলা সিনেমায় নতুন এক বিষয়। আগের ছবি 'দিগভ্রান্ত' (১৯৫০)- এর পর পরিচালক রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করেছিলেন 'রাত্রির তপস্যা'য়। সেইসময় সিনেমার রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার ছিল বেশ সাহসিকতার পরিচয়। এই ছবিতে তিনি দু'টি রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করেন। একটি 'ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু' এবং 'আজ বারি ঝরে ঝর ঝর ভরা বাদরে'। এছাড়াও ছিল আরও তিনটি গান। করেছিলেন বসুর কাহিনি ময়ূর'ও ভালোবাসার ছবি। নয়, বিনয়-অনসূয়ার ব্রাহ্মণ-কায়স্থর যুগে এই ভালবাসা প্রণয়। ওঁদের প্রচণ্ড আঘাত অনসূয়ার কাকা বিকাশ মুখার্জি। "মেয়ে বিয়ে বাচ্চাকে!" সেকালে ছিল চলে আসেন কাছে। বলেন, " থাকা যাবে না। পালিয়ে গেলেও না। ওঁরা ধরা আরতি মজুমদার চমৎকার অভিনয় করেছিলেন। তাঁর খ্যাতি ছিল স্বাভাবিক অভিনয়ের জন্য। খ্যাতি ছিল সুন্দরী নায়িকা হিসেবেও।


সুশীল মজুমদার পরবর্তী সময়েও ছবিতে ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রসংগীত। উত্তমকুমার-অভিনীত 'মনের ছবিতে 'জয় কেন তোর যায় গানটি ব্যবহার পরিচালক। প্রতিভা নিয়ে 'মনের শিক্ষক-ছাত্রীর প্রেম- শুধু তাই প্রেম ছিল সম্পর্ক। সে- ছিল নিষিদ্ধ সম্পর্কের ওপর আসে। এমনকী ছিলেন উকিল তিনি বললেন, করবে একটা শূদ্রের ভয়ংকর কথা! কিন্তু এটাই স্বাভাবিক। নেমে আসে আঘাত, অত্যাচার। কাউকে কিছু না-জানিয়ে অনসূয়া প্রেমিক বিনয়ের এখানে আর থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। চলো, এলাহাবাদ চলে যাই মামিমার কাছে।" এলাহাবাদ শেষরক্ষা হয় পড়েন পুলিশের হাতে। তিন বছরের কারাবাস হয় বিনয়ের। মধ্যবিত্তের এই সামাজিক সমস্যা ভয়ানকভাবে ছিল সেকালের সমাজে। আজও যে নেই, তা নয় সামাজিক সমস্যা । এমন সব ছবিতে থাকত। পরিচালক সুশীল মজুমদার তাঁর ছবিতে এসব সমস্যা নিয়ে ছবি করতেন। একেবারে অন্যরকম ছবি করলেন 'দুঃখীর ইমান' (১৯৫৪)। এই ছবিটি ছিল গণনাট্য প্রভাবিত। দুই বৈমাত্রেয় ভাই। একজন রঘুনাথ, তাঁর বন্ধকী কারবার। অন্যজন ধর্মদাস।

তিনি খেতমজুর। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মদাস সরল-সাদাসিধা, উদার, নির্লোভ এক মানুষ। আর রঘুনাথ শঠ, অসৎ। রঘুনাথের চক্রান্তে কারাবাস হয় ধর্মদাসের। জেল- মুক্ত ধর্মদাস পুত্রকে মৃত্যুশয্যায় রেখে রঘুনাথের কাছে যান মায়ের গয়না উদ্ধারে। তিনি তখন গ্রাম প্রধান। পঞ্চায়েত সভাপতি। রঘুনাথের চক্রান্তে আবার কারাবন্দি হন ধর্মদাস। এইসময় যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের কারণে গ্রামে নেমে আসে বিপর্যয়। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর গ্রামবাসী। ভেঙে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা। তা বজায় রাখতে তৈরি হয়েছে সংরক্ষণী সমিতি। তাদের দাপটে অস্থির গ্রামবাসী, বিশেষ করে ধর্মদাস। তাঁর পরিচয় এক দাগী চোর। একজন খেতমজুর থেকে চোর। শ্রেণি চ্যুত হন ধর্মদাস। তাঁকে শ্রেণি চ্যুত করেন তাঁর নিজের লোকের সঙ্গে সমাজের বিশিষ্টজনেরা। ধর্মদাসের সান্ত্বনা বলতে স্ত্রী আর তাঁর এক গরিব মাস্টার বন্ধু। ঠিক এমন সময় কলকাতা থেকে আসেন ধর্মদাসের স্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া এক দিদি। তিনি গান গেয়ে, শিখিয়ে কিছু টাকাপয়সা করেছেন। তাঁর প্রতি লোভ- লালসার দৃষ্টি পড়ে জমিদারের। তাঁকে কুপ্রস্তাব দেন জমিদার। ভদ্রমহিলা ফিরে যান কলকাতা। এরপর বহু ঘটনার ঘনঘটা। তবে যে-ঘটনা হল সবচেয়ে মর্মান্তিক, তা হল খিদের তাড়নায় চাল চুরি। ওই চাল চুরির তদন্তে আসেন পুলিশ। চুরির দায়ে ধরা পড়েন গ্রামের এক গরিব চাষি জামাল আর ধর্মদাস। বহু পুলিশি- নির্যাতনেও জামাল তাঁর ইমান বাঁচাতে কখনওই ধর্মদাসের নামবলেন না। ওদিকে ধর্মদাস তাঁর সততা রাখতে চুরির স্বীকারোক্তি দেন। হিন্দু- মুসলমান সম্প্রীতি, সমাজের একাংশের ষড়যন্ত্রের শিকার গরিব চাষাভুষো এবং সাধারণ মানুষ। যে-বিষয় সেকালে দেখা যেত গণনাট্যে, সেই বিষয়কে এড়াননি পরিচালক সুশীল মজুমদার।


'দুঃখীর ইমান' ছবি সম্পর্কে সুশীল মজুমদার বলেছিলেন, "তোমরা সবাই commit- ment-এর কথা বলো, realistic ছবির কথা বলো, পঞ্চাশের দশকে 'দুঃখীর ইমান'-এর মতো ছবি করেছি, ব্যবসায়িক ছবির মধ্যে থেকেও। সেসব ভুলে যেতে চাইছে সবাই।" এসব কথা যখন বলছিলেন তখন চোখের কোণ চিকচিক করে উঠেছিল বর্ষীয়ান পরিচালকের!


এরপর সুশীল মজুমদার করলেন 'ভাঙাগড়া' (১৯৫৪)। প্রথমে 'মনের ময়ূর' এরপর 'দুঃখীর ইমান' তিন নম্বর ছবি 'ভাঙাগড়া'। একই বছরে তিনটি ছবি। তিন রকমের। এবারে প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর 'বিজিতা' অবলম্বনে 'ভাঙাগড়া'। ছবির চিত্রনাট্য পরিচালকের হলেও, সংলাপ লেখেন বাংলা সাহিত্যের এক নামী সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। এ-ছবিতে তিনি নিলেন সহধর্মিণী আরতি মজুমদারকে।


সেকালে মহিলাদের সিনেমায় অভিনয় করাটা খুব-একটা ভাল নজরে দেখত না সমাজ। তবুও বাড়ির বউয়ের সিনেমায় অভিনয় নিয়ে কোনও ছুৎমার্গ ছিল না সুশীল মজুমদারের। যখন তাঁর বন্ধু পশুপতি চট্টোপাধ্যায় 'প্রিয়তমা' ছবিতে নির্বাচিত করলেন তখন কোনও আপত্তি করেননি তিনি। এ-প্রসঙ্গে সুশীল মজুমদার বলছেন, "আমার কোনও আপত্তি ছিল না। আমি নিজের ছবিতে অভিনয় করতে বলিনি তার কারণ আমার শাশুড়ি সিনেমায় অভিনয় করা পছন্দ করতেন না।... 'প্রিয়তমা' ছবিতে অভিনয় ভালই করেছিল। কিন্তু নেগেটিভ রোল থাকার জন্য বদনাম হয়ে যায়। ও তখন আমাকে বলল, 'আমাকে একটা ভাল রোল দাও। একটা ভাল চরিত্রে অভিনয় করতেই হবে।' তখন আমি 'রাত্রির তপস্যা'য় একটা ভাল চরিত্র দিই। বেশ ভালই অভিনয় করেছিল।" সুশীল মজুমদারের ভাল

এবং হিট ছবির একটি 'ভাঙাগড়া'। পরিচালক সুশীল মজুমদার মনে করতেন, ভাঙাগড়া শুধুমাত্র প্রকৃতির ভিতর সীমাবদ্ধ থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে মানুষের জীবনেও। যেমন, অন্ধকারের পর আলো, রাত্রির পর সকাল। তেমনই মানুষের জীবনেও দুঃখকষ্টর পর সুখশান্তি। যোগীন্দ্রনাথের জীবনেও তেমনই। তাঁর সতেরো বছর বয়সে পিতৃবিয়োগের পর তিনি দিশাহারা হয়ে পড়েন। সংসারে তিন ভাই আর বিধবা পিসি। যোগীন্দ্রনাথ স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করেন। মাথায়

কম্বল নিয়ে কলকাতার পথে ফিরি করতে লাগলেন। ক্রমশ তাঁর ব্যবসা জমে ওঠে। একদিন কলকাতা এবং মুম্বই তৎকালীন বঙ্গে শহরে তাঁর ব্যবসা প্রসারিত হয়। ভাইয়েরাও সবাই প্রতিষ্ঠিত। যোগীন্দ্রনাথের স্ত্রীবিয়োগ হলে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। এবং দ্বিতীয় স্ত্রী সুষমা এসেই চমৎকারভাবে সংসারের হাল ধরেন। একটা শ্রী ফেরে সংসারের। যোগীন্দ্রনাথের নিজের হাতে গড়া সংসার ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়েই চলে। এই ছবিটি একেবারে মধ্যবিত্ত মানসিকতার ওপর তৈরি করেছিলেন পরিচালক সুশীল মজুমদার। সম্ভবত সেইকারণে সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে সংলাপ লিখিয়েছিলেন। পাশাপাশি অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনে জোর দিয়েছিলেন অভিজ্ঞদের ওপর। পরিচালক সুশীল মজুমদার তাঁর পরিচালক- জীবনে 'ভাঙাগড়া' একটা গুরুত্বপূর্ণ ছবি বলে মনে করতেন। '


রাত্রির তপস্যা', 'মনের ময়ূর', 'দুঃখীর ইমান' এবং 'ভাঙাগড়া' করার আগে প্রেমেন্দ্র মিত্রর কাহিনি নিয়ে একটি ছবি করেছিলেন সুশীল মজুমদার। ছবির নাম 'দিগভ্রান্ত' (১৯৫০)। ছবিটি কোনও কারণে সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দেয়নি। সেইসময় সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন বিএন সরকার। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন কি কারণে 'দিগভ্রান্ত' ছবিটিকে আটকে দেওয়া হল? সেইসঙ্গে বলেছিলেন, আপনারা প্রবন্ধ বিনাবাধায় ছাড়পত্র দেন বম্বের ছবিকে। কেন আটকালেন 'দিগভ্রান্ত'কে। বলুন। বিএন সরকারের কারণে 'দিগভ্রান্ত' সেন্সরের ছাড়পত্র পায়। 'দিগভ্রান্ত' ছবিতে কী এমন ছিল যে আটকে দেয় সেন্সর! একাধিক বিতর্কিত বিষয় ছিল। ছিল সামাজিক ন্যায়-অন্যায়ের কথা। সামাজিক দুর্নীতির কথাও ছিল।


এবার ফ্ল্যাশব্যাক-এ যাই চল্লিশের দশকে। সুশীল মজুমদার বলিউডের নামীদামি প্রতিষ্ঠান 'বম্বে টকিজ'-এর ছবি 'চার আঁখে' (১৯৪৪) এবং ফিল্মিস্তানের 'বেগম' (১৯৪৫) করেন। 'বেগম' ছবিটি করার সময় পরিচালক সুশীল মজুমদারের সহকারী হয়ে কাজ করেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি অভিনেতা-পরিচালক রাজ কাপুর। তিনি সেই সময় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতেন মুম্বইয়ের রঞ্জিত স্টুডিয়ো এবং বম্বে টকিজে। বম্বে টকিজ থেকে যখন ফিল্মিস্তান স্টুডিয়োয় চলে আসেন শশধর মুখার্জি সেইসময় রাজ কাপুরও চলে আসেন। এসব কথা বলিউডের নামী সাংবাদিক বানি রুবেন লিখেছেন তাঁর 'Raj Kapoor: The Fabulous Showman' বইয়ে। তিনি লিখছেন, 'এস মুখার্জি (শশধর মুখার্জি) নামী বাঙালি পরিচালক সুশীল মজুমদারকে কলকাতা থেকে বম্বের ফিল্মিস্তানে নিয়ে এলেন হিন্দি ছবি করার জন্য। সুশীল মজুমদার পরিচালক হিসেবে বাংলা ছবি করার আগে তিনি ছিলেন বিখ্যাত পি সি বড়ুয়ার (প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া) সহকারী। তিনি একটি বাংলা ছবি করেন 'লাল পাথর', বিশাল হিট হয়েছিল (কিছু বছর পর তিনি শেষ বম্বে আসেন হিন্দিতে 'লাল পাথর' করার জন্য। প্রযোজক ছিলেন এফসি মেহরা। হিন্দি ভার্সানও ছিল বিশাল হিট)। সুশীল মজুমদার ফিল্মিস্তানের জন্য পরিচালনা কিরলেন ' বেগম'। ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন অশোককুমার-নসীম। এবং এই ছবিতে পরিচালক সুশীল মজুমদারের সহকারী ছিলেন কাপুর। তখন তিনি যুবক'।



বানি রুবেন লিখেছেন, 'রাজজি স্মৃতিচারণ করলেন, "মিঃ মুখার্জি (শশধর মুখার্জি) ছবির আউটডোর শুটিং রেখেছিলেন কাশ্মীরে। এই ছবিতে সুশীল মজুমদারের সহকারী হিসেবে কাজ করাতে ছবি পরিচালনার বহুরকম কাজ শিখেছিলাম। কেমনভাবে? কেন? আমাকে প্রচুর স্বাধীনতা দিয়েছিলেন পরিচালক। বলতে গেলে ছবির সবরকম কাজই আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন সুশীলদা। ফলে, সুশীলদার কাছে আমি অনেককিছু শিখেছিলাম, সবকিছুই আমার কাজে লেগেছিল।" সহকারী পরিচালক রাজ ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন। এসবের কারণে তাঁকে পৃথ্বী থিয়েটারে সক্রিয় ভূমিকায় অংশ নিতে দেখা যায়। অভিনয় এবং বাবার (পৃথ্বীরাজ কাপুর) সহকারী হিসেবেও। বলিউডে দু'টি ছবি করলেও পরিচালক সুশীল মজুমদারের খুব একটা ভাল লাগেনি। তিনি নিজেই সেকথা বলেছিলেন, "বম্বে যাইনি তার কারণ বম্বে সুট করেনি আর তাছাড়া বম্বেতে আমার সুনামও হয়নি। তাই আর বম্বে যাইনি।" হিন্দি ছবির দুনিয়ায় তাঁর যে তেমন নাম হয়নি তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন সুশীল মজুমদার। তবুও আরও চ্যালেঞ্জ নিয়ে গেছিলেন বলিউড সত্তরের দশকের শুরুতেই। এফসি মেহরার ডাকে। উত্তম- সুপ্রিয়া অভিনীত 'লাল পাথর' (১৯৬৪) হিট হওয়ায় এর ঠিক সাতবছর পর এফসি মেহরা 'লাল রাজ পাথর'-এর হিন্দি ভার্সান করতে চাইলেন। সুশীল মজুমদার হিন্দি 'লাল পাথর' করলেন রাজকুমার- হেমা মালিনীকে নিয়ে। এবার ছবি সুপার হিট। এরপর আর পরিচালকের চেয়ারে বসতে দেখা যায়নি সুশীল মজুমদারকে। চল্লিশের failure সুশীল মজুমদার সত্তরের দশকে success হন। ১৯৭১-এর পর পরিচালক সুশীল মজুমদারকে বাংলা সিনেমায় দেখা না-গেলেও অভিনেতা সুশীল মজুমদারকে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত ১০টি দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল দুঃস্থ শিল্পীদের জন্য 'শিল্পী সংসদ'-এর 'দুই পৃথিবী'। উত্তম, সুপ্রিয়া, ভিক্টর প্রমুখের সঙ্গে দেখা গেছিল সুশীল মজুমদারকে। পরিচালক পীযূষ বসু।


'মায়ামৃগ' (১৯৬০) বিশ্বজিৎ- সন্ধ্যা রায় জুটির প্রথম ছবি হলে দ্বিতীয়টি সুশীল মজুমদারের 'কঠিন মায়া' (১৯৬১)। 'মায়ামৃগ' চলেছিল ১৮ সপ্তাহ। তবে এ-ছবিতে উত্তমকুমারও ছিলেন। সেই অর্থে বিশ্বজিৎ-সন্ধ্যা রায় জুটির প্রথম ছবি সুশীল মজুমদারের 'কঠিন মায়া'। পরিচালক ছবিটি করেছিলেন একটি রোম্যান্টিক কমেডি।এরপরের ছবি 'সঞ্চারিণী'। সত্যজিৎ রায়ের 'মণিহারা' (তিনকন্যা), মৃণাল সেনের 'পুনশ্চ'-র পরই সুশীল মজুমদারে 'সঞ্চারিণী' (১৯৬২)। কণিকা মজুমদার তাঁর অভিনয়জীবনে যতগুলো উল্লেখযোগ্য চরিত্র করেছিলেন, যেমন-- 'মণিহারা'র মণিমালিকা, 'পুনশ্চ'র বাসন্তী, 'চিড়িয়াখানা'র দময়ন্তী তেমনই ছিল 'সঞ্চারিণীর গার্গী।


এরই মাঝে ষাটের দশকের শুরুতেই বাংলা সিনেমায় একটি কাণ্ড ঘটিয়ে ঘটান পরিচালক সুশীল মজুমদার। ১৯৬০-এ অশোককুমার- সুচিত্রা সেন জুটি করে করলেন 'হসপিটাল'। কেন অশোককুমার? উত্তমকুমার নয় কেন! ১৯৬০-এ দেখা যাচ্ছে উত্তম-সুচিত্রা জুটির একটি ছবিও হয়নি। উত্তমকুমার গোটা নয় ছবি করলেও, সুচিত্রা সেন করছেন মাত্র হাতেগোনা দু'টি ছবি। একটি, সুশীল মজুমদারে 'হসপিটাল' আর যাত্রিক-এর 'স্মৃতিটুকু থাক'। দু'টি ছবিই সেপ্টেম্বরে এক সপ্তাহ আগে-পরে মুক্তি পেয়েছে। দেখা গেল, ১৯৬০- এ দুর্গাপুজোর মুখেই রিলিজ করেছিল দু'টি ছবিই। শোনা যায়, ১৯৬০-এর সময়কালে উত্তম-সুচিত্রার ভিতর নাকি মন কষাকষি হয়েছিল। উত্তমকুমার প্রযোজিত অজয় কর পরিচালিত 'সপ্তপদী' নিয়ে। হয়তো সেই কারণে ১৯৬১-তে উত্তম-সুচিত্রার ছড়ালে গো বন্ধু। আজও এই গানটির

'সপ্তপদী' ছাড়া আর কোনও ছবি মুক্তি পায়নি। যাইহোক, বাঙালি দর্শকের কাছে প্রায় ভুলে যাওয়া অশোককুমারকে সুচিত্রা সেনের বিপরীতে রেখে ছবি করার দুঃসাহস দেখান কিংবা ফাটকা খেলেন পরিচালক সুশীল মজুমদার। ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০-এ ছবিটি মুক্তি পায় মিনার, বিজলী, ছবিঘরে। এছাড়াও একইসঙ্গে শহরতলি এবং মফসসলের গোটা তেরো প্রেক্ষাগৃহে। পুজোর মুখে মুখে 'হসপিটাল' রিলিজ করার কারণে মিনার, বিজলী, ছবিঘর তাদের শো টাইমে পরিবর্তন করে। সুশীল মজুমদারের ঝুঁকি নেওয়া ব্যর্থ হয়নি। ছবি সুপার হিট সেইসঙ্গে গানও। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারে লেখা, অমল মুখোপাধ্যায়ের সুরে গীতা দত্তের গাওয়া 'এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়/একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু/ কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন/মোর অন্তরে জনপ্রিয়তা একইরকম। 'লাল পাথর' এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয় বাংলা সিনেমায়। ইতিহাস আশ্রিত কাহিনি। লেখক প্রশান্ত চৌধুরী। ষাটের দশকে প্রশান্ত চৌধুরীর একটা পরিচিতি ছিল পাঠককুলে। ছবির কাহিনি বেশ জটিল। সম্পর্কের বহুরকম টানাপোড়েন। ঘটনার ঘনঘটাও ছিল। সবকিছু মাথায় রেখে ছবিটি অন্যরকমভাবে তৈরি করেন পরিচালক সুশীল মজুমদার। সেখানে তিনি সফল। সংগীত পরিচালনার ভার দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরীকে। তিনি ছবির মুড এবং বিষয় অনুযায়ী সুর করেন। গুলজারকে দিয়ে দু'টি গানও লেখান। সলিল চৌধুরীর নিজের লেখা গান ছিল তিনটি। একটি রবীন্দ্রসংগীতও ব্যবহার করেছিলেন। 'লাল পাথর' উত্তম-সুপ্রিয়া জুটির অন্যতম সেরা হিট ছবির অন্যতম। 'লাল পাথর'-এর ছিল ঈর্ষণীয় সাফল্য। পরবর্তী সময়ে সত্তর দশকের শুরুতেই এফসি মেহরা হিন্দিতে 'লাল পাথর' (১৯৭১) করলেন। পরিচালক সুশীল মজুমদার। এর আগে চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি দু'টি হিন্দি ছবি করার অভিজ্ঞতা ছিল পরিচালক সুশীল মজুমদারের। হিন্দি ভার্সানে ছিলেন রাজকুমার, হেমা মালিনী, রাখি এবং বিনোদ মেহরা। সুরকার ছিলেন শঙ্কর-জয়কিষেণ। হিন্দি 'লাল পাথর' ছিল পরিচালক সুশীল মজুমদারের শেষ ছবি। যদিও অভিনেতা সুশীল মজুমদারের শেষ অভিনীত ছবি ছিল পরিচালক অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের 'জীবন' (১৯৮৬)। এই ছবিটি ছিল নক্ষত্রখচিত ছবি। তাপস পাল, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী, প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত, উৎপল দত্ত প্রমুখ। 'জীবন' ছিল হিন্দি 'আনন্দ'-এর বাংলা। পরিচালকজীবনে 'শুকসারি' (১৯৬৯) তাঁর কাছে ছিল হয়তো পরাজয়। উত্তমকুমার- অঞ্জনা ভৌমিক জুটি করে ছবিটি করেছিলেন অনেক আশা নিয়ে। এই ছবিতে তিনি সুরকার হিসেবে রেখেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। গান লিখেছিলেন মোহিনী চৌধুরী প্রবন্ধ এবং মুকুল দত্ত। মোট গান ছিল ১৮টি। পরিচালক সুশীল মজুমদার চেয়েছিলেন একটি সংগীতবহুল ছবি করতে। আর এই সময়কালে উত্তম-অঞ্জনা জুটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। ছবিতে দুর্দান্ত সুর করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। 'শুকসারি' নির্মাণে কোনও কার্পণ্য করেননি সুশীল মজুমদার। তবুও ছবিটি বাঁচেনি। খুব বেশি চলেনি। শোনা যায়, 'শুকসারি' পর থেকে মনমরা হয়ে থাকতেন পরিচালক সুশীল মজুমদার। তার কারণ হতে পারে, তিনি সর্বদাই দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী ছবি করতেন। যে-কারণে তাঁর পরিচালিত বেশিরভাগ ছবি ছিল বক্স-অফিস সফল। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন অগ্রদূত-এর 'নায়িকা সংবাদ' (১৯৬৭)-এর মতোই বক্স-অফিস সাফল্য পাবে 'শুকসারি'! বক্স-অফিস সাফল্য না-এলেও 'শুকসারি' কিন্তু ছিল একেবারে অন্যধরনের বাংলা সিনেমা। বাংলা চলচ্চিত্রে একদা কর্মব্যস্ত পরিচালক ছিলেন সুশীল মজুমদার। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী পরিচালক। চার দশক ধরে ধারাবাহিক ছবি করে আসা পরিচালক সুশীল মজুমদারকে প্রায় ভুলতে বসেছিলেন বাঙালি সিনেমাপ্রেমীরা। উত্তম-সুপ্রিয়া জুটির ছবি 'লাল পাথর'-এর পরিচালক সুশীল মজুমদার স্মরণ করিয়ে দেন এখনও বেঁচে আছি। বক্স-অফিস সফল ছবি। যা আগেই বলা হয়েছে। অভিনেতা সুশীল মজুমদারকেও ভুলে গেছিলেন বাংলা ছবির দর্শকেরা। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের 'চিড়িয়াখানা' তাঁকে ফিরিয়ে আনে।

মজুমদারের শুরু নির্বাক ছবি দিয়ে তাঁর জীবনের শেষ প্রায় নির্বাক হয়ে যাওয়া এক মানুষ হিসেবে। থাইরয়েড অপারেশন পর প্রায় নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন সুশীল মজুমদার। অবসরপ্রাপ্ত বিচারক নিশানাথ সেনের চরিত্রে সুশীল মজুমদার তাঁর অভিনেতার জাত চিনিয়ে দেন। অথচ সুশীল মজুমদারের জায়গায় নেওয়ার কথা হয়েছিল অশোককুমারকে। সত্যজিৎ রায়ের সহকারী রমেশ সেন তাঁর 'মানিকদা আর উত্তমদা'য় লিখছেন, 'ব্যোমকেশ উত্তমদা করবেন ঠিক হয়েই আছে। নিশানাথের রোলে প্রথমে ভেবেছিলাম অশোককুমারকে। একদিন মানিকদা বললেন, তোমাদের বাড়ির কাছেই তো দারুণ আর্টিস্ট আছে। সুশীল মজুমদারকে ভাবছ না কেন? সুশীলবাবুর কথা আমাদের মাথাতেই আসেনি। প্রস্তাবটা সবারই খুব পছন্দ হল'। (সহযাত্রীর কথা, রমেশ সেন, অনুলিখন ও সম্পাদনা: জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ)।


সুশীল মজুমদার বাংলা সিনেমার এক সফল পরিচালক এবং অভিনেতা। কেটেছে তাঁর জন্মের ১১৭, মৃত্যুর ৩৫ বছর। অথচ তাঁর নাম বিন্দুমাত্র উচ্চারিত হয় না বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের আনাচকানাচে। তাঁর নামে কোনও পুরস্কারও চালু আছে বলে জানা নেই। অথচ তিনি ছিলেন বাংলা ছবির এক নামী পরিচালক। একাধিক বাণিজ্য সফল ছবি তাঁর ঝুলিতে। অভিনয়ও করতেন। অভিনয় করেছেন সত্যজিৎ রায়ের 'চিড়িয়াখানা'য়। শোনা যায়, তিনি যখন শয্যাশায়ী, মৃত্যুপথযাত্রী, সেইসময় তাঁকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'দাদা সাহেব ফালকে' দেওয়ার কথা আলোচনা হয়। কিন্তু কোন কারণে দেওয়া হয়নি পরিচালক- অভিনেতা সুশীল মজুমদারকে। তা আজও রহস্যময়! তাঁর জীবিতকালেও চলচ্চিত্রে অবদানের জন্যও পুরস্কৃত করা হয়নি। আটের দশকের শেষে তিনি চলে গেছিলেন বড় অভিমান নিয়ে।


সত্যজিৎ রায়ের তত্ত্বাবধানে এবং সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় রেডিয়োতে 'বাক্স রহস্য'-তে কণ্ঠাভিনয় করেন। সেখানেও তাঁর মুনশিয়ানা প্রকাশ পায়। অভিনেতা হিসেবেও সুশীল মজুমদার ছিলেন ব্যতিক্রমী। হিন্দি 'লাল পাথর' করার পর সুশীল মজুমদার কলকাতার ভবঘুরেদের নিয়ে একটি তথ্যচিত্র করেন। এটি ছিল সরকারি কাজ। সময় আশির দশকের মাঝামাঝির আগে পরে হবে। তখন তিনি খুব সুস্থ নন। তাঁর দীর্ঘ দিনের সহকারী অমল সরকার কাজটি শেষ করেন। অমল সরকার পরবর্তী সময়ে মৃণাল সেনের সহকারী হিসেবে দীর্ঘ দিন কাজ করেছিলেন। জানালেন তাঁর পুত্র অনিন্দ্য সরকার।


ঋণ স্বীকার: সাক্ষাৎকার: সুশীল মজুমদার, অবনী ভট্টাচার্য,

শারদীয় 'দর্পণ', ১৯৮৭, দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং Action

Sushil Majumdar edited

by Sanjay Mishra, Simika Publishers.

ছবি সৌজন্য: সঞ্জয় মিশ্র

 

Comments


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page