top of page

গনেশ চতুর্থী স্পেশ্যাল একডজন ভোগের রেসিপি ও পুরাণ কথা..শিক্ষক দিবস..মৃণাল সেনের ছবি, মানুষ এবং কলকাতা..

সুখ ও সমৃদ্ধির দেবতা গণেশের জন্ম হয়েছিল ভাদ্র মাসের চতুর্থী তিথিতে। তাই এইদিন থেকেই শুরু হয় গনপতি উৎসবের। দশ দিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয় অনন্ত চতুর্দশীর দিন। দশম দিনে হয় বিসর্জন।

এই ১০ দিন ধরে চলা উৎসবে তাঁর পছন্দের নানাবিধ পদ বাড়িতে তৈরি করে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। বিশ্বাস করা হয়, পুজোর দিনগুলিতে ভগবান গণেশকে তাঁর প্রিয় খাবারগুলি নিবেদন করলে তিনি খুব খুশি হন। চলুন জেনে নেওয়া যাক, গণেশ পুজোর সময় কোন কোন খাবার ভোগ হিসেবে দিতে পারেন?



তনুজা আচার্য্য

মোদক

লক্ষ্মীপুজোয় নারকেল নাড়ু, জন্মাষ্টমীতে তালের বড়া ছাড়া অসম্পূর্ণ। তেমনই গণেশ পুজোতে মোদক হওয়া চাই-ই-চাই।


কী কী লাগবে

চালের গুঁড়ো: ১ কাপ

কোরানো নারকেল: ১ কাপ

গুড়: ১ কাপ

ছোট এলাচ: ১ চিমটি

নুন: আধ চা চামচ

Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল: ১ চা চামচ


কীভাবে বানাবেন

হালকা আঁচে একটি প্যান বসান। তার মধ্যে কোড়ানো নারকেল দিয়ে দিন। এবার ভাল করে নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিন। অন্য একটি পাত্রে এক কাপ জল ফুটিয়ে নিন। জল ফুটে গেলে গুড় ঢেলে মিশিয়ে নিন। মিশ্রণটি একটু ঘন করে নিন। ঘন হয়ে গেলে এবার ওই মিশ্রণের মধ্যে কোড়ানো নারকেল দিয়ে দিন। তাতে এলাচ গুঁড়ো দিন। একটু থকথকে মিশ্রণ তৈরি হয়ে গেলে গ্যাস বন্ধ করে দিন।


এবার অন্য পাত্রে অল্প Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল ও নুন দিয়ে গরম জলের সাহায্যে চালের গুঁড়ো মেখে নিন। বলের আকারে চালের গুঁড়ো পাকিয়ে নিন। মাঝে গর্ত তৈরি করুন। ওই গর্তের ভিতর নারকেলের পুরটি ঢুকিয়ে মুখ আটকে দিন। এবার গ্যাসে একটি বড় পাত্রে জল বসান। তার ওপর ফুটো ফুটো কোনও পাত্রে চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি বলগুলি রাখুন। ভাপের মাধ্যমে ভাল করে বলগুলি সেদ্ধ করে নিন। ওই চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি বল সেদ্ধ হয়ে গেলেই মোদক তৈরি।

বেসনের লাড্ডু

উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় মানুষদের মধ্যে বিশেষ ভাবে বিখ্যাত এই মিষ্টি। তবে পশ্চিমবঙ্গে কিছু কম সংখ্যক মানুষই এই ধরনের লাড্ডুর কথা জানেন। গনেশ চতুর্থীর দ্বিতীয় দিনে নিবেদন করতে পারেন বেসনের লাড্ডু।


কী কী লাগবে

বেসন ৩০০ গ্রাম, ঘি ১/২ কাপ অথবা Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল, গুঁড়ো চিনি ১ কাপ, এলাচ গুঁড়ো ১ চা চামচ, পেস্তা কুচি পরিমাণমতো।


কীভাবে বানাবেন

শুকনো কড়াইতে প্রথমে অল্প আঁচে বেসন ১০ মিনিট মতো ভাজুন। সুন্দর গন্ধ বেরোতে শুরু করলে অল্প অল্প করে ঘি অথবা Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল মেশান আর নাড়তে থাকুন। ঘি ওপরে ভেসে উঠলে এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে গ্যাস বন্ধ করে চিনি ও পেস্তা কুচি দিয়ে ভালো করে মেশান। হাতে ঘি মেখে অল্প গরম থাকতে থাকতে লাড্ডু গুলো বানিয়ে নিন।

মৌমিতা মিত্র


ভোগের খিচুড়ি

অন্যান্য রাজ্যের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও সমান ভাবে শুরু হয়েছে গনেশ চতুর্থীর। বাঙালি পুজো করবে আর তাতে ভোগের খিচুড়ি থাকবে না! এ ও কি সম্ভব?


কী কী লাগবে

গোবিন্দভোগ চাল ২৫০ গ্রাম, সোনা মুগ ডাল ২৫০ গ্রাম, নুন চিনি স্বাদ মতো, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো ১ চা চামচ, চেরা কাঁচালঙ্কা ৩-৪ টি, কাজুবাদাম কিশমিশ, Shalimar's সরষের তেল ৪ টেবিল চামচ, ঘি ১ টেবিল চামচ, আদাবাটা ২ চা চামচ, Shalimar's গরমমশলা, তেজপাতা ফোড়নের জন্য।


কীভাবে বানাবেন

মুগডাল ভেজে ধুয়ে সেদ্ধ করে নিন। জল গরম হলে চাল, সেদ্ধ মুগডাল, নুন, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো, চেরা কাঁচালঙ্কা ফুটে সেদ্ধ হতে দিন। অন্য একটি কড়াতে Shalimar's সরষের তেল গরম করে তেজপাতা আদাবাটা দিয়ে নেড়েচেড়ে খিচুড়ির মধ্যে ঢেলে দিন। Shalimar's গরমমশলা, কাজুবাদাম কিশমিশ আর ঘি মিশিয়ে নামিয়ে নিন। বেগুনী ও চাটনির সাথে পরিবেশন করুন।

লেমন রাইস

গোয়া, তামিলনাড়ু সহ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গনেশ চতুর্থী পালিত হয়। অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে ওদের ভোগে থাকে লেমন রাইস।

কী কী লাগবে

বাসমতী চাল ২০০ গ্রাম, কালো সরষে ১ চা চামচ, শুকনো লংকা ২টি, নুন ও চিনি স্বাদ মতো, লেবুর রস ১ চা চামচ, চিনেবাদাম ১ টেবিল চামচ, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো এক চিমটি, Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল ২ টেবিল চামচ, কারিপাতা।


কীভাবে বানাবেন

চাল আধঘন্টা ভিজিয়ে রেখে জল ঝরিয়ে রাখুন। Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল গরম করে চিনেবাদাম ভেজে তুলে নিন। ঐ তেলে শুকনো লংকা, কালো সরষে, কারিপাতা ফোড়ন দিয়ে একে একে চাল, নুন, Shalimar's হলুদ, চেরা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে অল্প ভাজা ভাজা করে যতটা চাল তার দ্বিগুণ গরম জল দিয়ে ঢেকে রান্না করুন। জল শুকিয়ে গেলে চিনি, ভাজা বাদাম আর লেবুর রস মিশিয়ে পরিবেশন করুন।


মৌমিতা মুখার্জি

সাবুর খিচুড়ি

কী কী লাগবে

সাবু ১০০ গ্রাম, মুগডাল ৫০ গ্রাম, লেবুর রস ১ চা চামচ, কাঁচালঙ্কা কুচি ১ চা চামচ, গোটা সরষে, কারিপাতা, শুকনো লঙ্কা, নুন চিনি পরিমাণমতো, Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল ২ টেবিল চামচ, ঘি ১ চা চামচ চামচ, রোস্টেড বাদাম একমুঠো, কিউব করে কাটা আলু ১ কাপ।

কীভাবে বানাবেন

প্রথমে সাবু ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিন। মুগডাল ভেজে তুলে নিন। Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেলে সরষে কারিপাতা ফোড়ন দিয়ে কুচোনো আলু দিয়ে ভাজুন। মুগডাল, সাবু, নুন, কাঁচালঙ্কা কুচি নেড়েচেড়ে অল্প জল দিয়ে ধিমে আঁচে ঢেকে রান্না করুন। সেদ্ধ হয়ে ঝরঝরে হলে ঘি, লেবুর রস, রোস্টেড বাদাম মিশিয়ে নামিয়ে পরিবেশন করুন।

সিমুইয়ের পায়েস

পায়েস আদতে একটি ভারতীয় মিষ্টান্ন। দুধ, চিনি এবং চাল দিয়ে তৈরি মিঠাইকেই বলা হয় পায়েস। ফিউশনে দুধের মধ্যে চালের বদলে এসেছে চুষি, লাউ, কুমড়ো, ছানা, সুজি, চিঁড়ে এমনকি চালের গুঁড়ো পর্যন্ত। একটু অন্যরকম পায়েস ভোগে নিবেদন করতে চাইলে বানাতে পারেন সিমুইয়ের পায়েস।


কী কী লাগবে

সেমাই ১ কাপ, দুধ ২ কেজি, চিনি স্বাদমতো, নুন এক চিমটি, খোয়া ক্ষীর ২০০ গ্রাম, ঘি ১ টেবিল চামচ, Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল ১ টেবিল চামচ, এলাচ গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, ড্রাই ফ্রুটস, কেশর।


কীভাবে বানাবেন

দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে নিন। প্যানে Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল গরম করে সেমাই ভেজে দুধের মধ্যে ঢেলে দিন। নুন, চিনি আর গ্রেট করা খোয়া ক্ষীর দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন। অন্য একটি প্যানে ঘি গরম করে ড্রাই ফ্রুটস হালকা ভেজে ওর মধ্যে মেশান। এলাচ গুঁড়ো আর কেশর মিশিয়ে ঠান্ডা হলে পরিবেশন করুন।

মৌমিতা কুন্ডু মল্ল

ইডলি

কী কী লাগবে

আতপ চাল, বিউলি ডাল, মেথি দানা, নুন, Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল


কীভাবে বানাবেন

চাল ও ডাল ভালো করে ধুয়ে ২-৩ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে মেথি ও নুন সহ বেটে নিন। ঘন করে পেস্ট করবেন। মিশ্রণটি ১২-১৪ ঘণ্টা রেখে দিন। তবে সাধারণ তাপমাত্রায় রাখুন। ইডলি মোল্ডে Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল ব্রাশ করে এই মিশ্রণ দিয়ে স্টিম করে নিলেই তৈরী। সঙ্গে দিন সেঙ্গা চাটনি ও সাম্বার।

আমের সন্দেশ

কী কী লাগবে

১ লিটার ফুল ক্রিম দুধ থেকে বানানো ছানা, হিমসাগর আমের পাল্প, এক বাটি মিল্ক পাউডার, ১/২ বাটি চিনি, ২ চামচ Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল অথবা ঘি, কেশর দুধ, ড্রাই ফ্রুটস

কীভাবে বানাবেন

প্যানে Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল গরম করে ছানা ২ মিনিট অল্প আঁচে নেড়েচেড়ে আমের পাল্প, চিনি মিশিয়ে নাড়তে থাকুন। শুকিয়ে এলে গুঁড়ো দুধ, কেশর দুধ আর কুচোনো ড্রাই ফ্রুটস মিশিয়ে ডো মতো হয়ে এলে বুঝবেন তৈরি। আমের মতো আকারে গড়ে নিলেই তৈরী আম সন্দেশ।

মনমিতা কুন্ডু


তিল মৌরি বাটায় ছানার কোপ্তা

কী কী লাগবে

পনির, চিনি, লঙ্কা গুঁড়ো, ময়দা অথবা চাল গুঁড়ো, সাদা তিল, মৌরি, কাঁচালঙ্কা, শুকনো লঙ্কা, Shalimar's জিরে গুঁড়ো, Shalimar's ধনে গুঁড়ো, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো, নুন, টকদই, এলাচ, পাঁচফোড়ন, তেজপাতা, Shalimar's সর্ষের তেল, আদাবাটা, Shalimar's গরম মশলা গুঁড়ো।


কীভাবে বানাবেন

প্রথমে আড়াইশো গ্রাম পনির বা ছানাকে ভালো করে হাত দিয়ে মথে নিয়ে সামান্য নুন চিনি আর খুব অল্প লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে মেখে নিন। এবার এরমধ্যে দু চামচ ময়দা বা চাল গুঁড়ো মিশিয়ে ছোট ছোট ছানার চ্যাপ্টা বল করে ভেজে নিন।

এক বড় চামচ তিল, এক চা চামচ মৌরি, কাঁচালঙ্কা ও একটা শুকনো লঙ্কা একসাথে বেটে নিন। চার চামচ গুঁড়ো দুধ কে সামান্য গরম জলে গুলে একটা মিশ্রণ তৈরি করে রাখুন । ৫০ গ্রাম মতো টকদই কে আগে থেকে ভাজা জিরে ধনে গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো ও গরম মশলা গুঁড়ো দিয়ে ফেটিয়ে নিন।


কড়াইয়ে সর্ষের তেল গরম করে পাঁচফোড়ন, এলাচ তেজপাতা ও শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে তার মধ্যে একটু আদা বাটা কষিয়ে নিন নুন হলুদ দিয়ে। এর মধ্যে ফেটানো টকদই টা দিয়ে আরেকবার কষিয়ে নিন তেল বেরোনো অবধি। এরপর তিল বাটা টা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে একটু ঢাকা দিয়ে রাখুন। যখন তেল ছেড়ে আসবে, সেই সময় ছানার কোপ্তা গুলো দিয়ে, আধ কাপ গরম জল, ও কয়েকটা কাঁচালঙ্কা দিয়ে হাই ফ্লেমে একটু ফুটিয়ে নিন। ঘন হয়ে এলে ওর মধ্যে গুড়ো দুধের মিশ্রণ টা দিয়ে ফুটতে দিন। ছবির মত ঘন হয়ে এলেই কোপ্তা রেডি। ভাজা মৌরি গুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে নিন। মৌরি বাটা ফোটাতে নেই বেশি , তিতো হয়ে যাবে। তাই এই রান্নায় জল টা কম দেবেন, আর অবশ্যই গরম জল দেবেন যাতে অনেকক্ষণ না ফোটাতে হয়। গুঁড়ো দুধের মিশ্রণের বদলে ফ্রেশ ক্রিম ও দিতে পারেন।

ভেন পোঙ্গাল

কি কি লাগবে

১ কাপ পোঙ্গাল রাইস, ১ কাপ মুগডাল, ঘি ৪ টেবিল চামচ, নুন স্বাদ মতো, আদাবাটা ১ চা চামচ, Shalimar's হলুদ ১/৪ চা চামচ, কাজুবাদাম একমুঠো, ফোড়নের জন্য (গোটা গোলমরিচ, গোটা জিরে, হিং, কারিপাতা)


কীভাবে বানাবেন

চাল ও ডাল আলাদা আলাদা আধঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। ১ টেবিল চামচ ঘি গরম করে অল্প আঁচে মুগডাল ভাজুন। এবার ভিজিয়ে জল ঝরানো চাল, নুন, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো দিয়ে নেড়ে পরিমাণ মতো জল দিয়ে ফুটতে দিন। সেদ্ধ হয়ে গলে গেলে নামিয়ে নিন। অন্য একটি প্যানে বাকি ঘি গরম করে ফোড়নের সব উপকরণ দিয়ে নেড়েচেড়ে আদাবাটা আর কাজুবাদাম দিন। বেশ ভাজা ভাজা হলে খিচুড়ির মধ্যে ঢেলে ভালো করে মিশিয়ে পরিবেশন করুন।

সুস্মিতা মিত্র

মতিচুর লাড্ডু


কী কী লাগবে

৩ কাপ ছোলার ডাল, ৩ কাপ চিনি, ১ কাপ ঘি, Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল ভাজার জন্য, ড্রাই ফ্রুটস, চারমগজ, খাবার রং (ঐচ্ছিক), গোলাপ জল, এলাচ গুঁড়ো

কীভাবে বানাবেন

ছোলার ডাল ভিজিয়ে রেখে বেটে নিন। কড়াইতে Shalimar's সানফ্লাওয়ার তেল গরম করে ছোট ছোট বড়া ভেজে তুলে নিন। ঠাণ্ডা করে মিক্সিতে গুঁড়ো করে নিন। মিহি করে বাটবেন না, একটু দানা দানা থাকবে। অন্য কড়াইতে চিনির রস বানিয়ে নিন। যেমন রং প্রয়োজন সেই মতো খাবার রং দিতে পারেন। হলুদ লাল অথবা কমলা। এবার ওর মধ্যে গুঁড়ো করা ডাল দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে উষ্ণ গরম থাকা অবস্থায় ঘি, এলাচ গুঁড়ো, গোলাপ জল, ড্রাই ফ্রুটস কুচি, রোস্টেড চারমগজ মিশিয়ে নিন। হাতে ঘি মেখে লাড্ডু গুলো গড়ে নিন। গরম থাকতে থাকতে খুব তাড়াতাড়ি করে লাড্ডু গুলো পাকিয়ে নেবেন, ঠান্ডা হলে ঝুরঝুরে হয়ে যায়। গড়তে অসুবিধে হলে আরো ঘি দেবেন।

মটর পনির

কী কী লাগবে

পনির ২০০ গ্রাম, আলু চৌকো করে কাটা, মটরশুঁটি ১ বাটি, টমেটো কুচি ১ কাপ, আদা বাটা ১ চামচ, Shalimar's জিরে গুঁড়ো, Shalimar's লঙ্কা গুঁড়ো, শুকনো লঙ্কা, হিং, Shalimar's গরমমশলা গুঁড়ো, Shalimar's সর্ষের তেল, ঘি, নুন স্বাদমতো, দুধ ২ চামচ


কীভাবে বানাবেন

পনিরের টুকরো চৌকো করে কেটে হালকা ভাবে ভেজে তুলে নিন। এবার কড়াইতে Shalimar's সর্ষের তেল গরম করে ওর মধ্যে হিং, আদাবাটা, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে নাড়তে থাকুন। মশলা একটু কষা হলে টমেটো, নুন আর স্বাদমতো চিনি দিন। এবার আলু, মটরশুঁটি মেশান। আলু ভাজা ভাজা হলে পনির, সামান্য Shalimar's হলুদ গুঁড়ো, Shalimar's জিরে গুঁড়ো, Shalimar's লঙ্কা গুঁড়ো দিন। কষানো হলে জল দিয়ে ফুটতে দিন। একটু মাখা মাখা হলে দু চামচ দুধ দিন। সুন্দর গ্রেভি তৈরি হলে উপর থেকে ঘি আর Shalimar's গরমমশলা গুঁড়ো ছড়িয়ে ভালো করে মিশিয়ে নামিয়ে নিন।

গনেশ চতুর্থীর পুরাণ কথা...

পুরাণ অনুসারে, গণেশের সৃষ্টি দেবী পার্বতী করেছিলেন এবং তাঁর দরজা পাহারা দিতে গণেশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন পার্বতীই। শিব গৃহে ফিরে পার্বতীর ঘরে ঢুকতে গেলে গণেশ তাঁকে বাধা দেন। একটি ছোট ছেলের এতো আস্পর্ধা দেখে শিব রেগে যান। শিবের সঙ্গে গণেশের যুদ্ধও শুরু হয়। রাগের মাথায় শিব মাথা কেটে ফেলেন গণেশের। গণেশের মুণ্ডহীন দেহ দেখে পার্বতী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁর সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে বলেন শিবকে। শিব তখন অন্য দেবতাদের নির্দেশ দেন, উত্তর দিকে গিয়ে যার মাথা আগে দেখতে পাবে, সেই মাথাই কেটে নিয়ে আসতে। দেবতারা প্রথমেই একটি হাতি দেখতে পেয়ে তারই মাথা কেটে নিয়ে আসে। সেই হাতির মাথাটিই গণেশের দেহে বসিয়ে দেন শিব। তখন থেকেই তিনি গজানন।

ভিন্ন দেশে গনেশ চতুর্থী..

মূলত মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে আড়ম্বরে গণেশ পুজো হয়। বলিউডের তাবড় তাবড় তারকারাও গণেশ আরাধনায় মেতে ওঠেন। এছাড়াও গোয়া সহ দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোয় মহাসমারোহে গণেশ পুজো হয়। গণেশ পুজো বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। সংস্কৃত, কন্নড়, তামিল ও তেলেগু ভাষায় এই উৎসব বিনায়ক চবিথি বা বিনায়ক চতুর্থী নামে পরিচিত। কোঙ্কনি ভাষায় এই উৎসবের নাম চবথ। আবার নেপালি ভাষায় এই উৎসবকে বলা হয় ঘি চথা।


এবছর গনেশ চতুর্থী কবে?

৬ সেপ্টেম্বর দুপুর ৩ টে ১ মিনিট থেকে শুরু হবে গণেশ চতুর্থীর তিথি। গণেশ চতুর্থীর পুজো শেষের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর। গণেশ চতুর্থীর তিথি শেষ হবে ৭ সেপ্টেম্বর ৫.৩৭ মিনিটে।

এই দিন কী কী উপায় মেনে চলবেন?

১.বিনায়ক চতুর্থীতে চাঁদ দেখা ঠিক নয়। কথিত আছে এটি জীবনে কলঙ্ক নিয়ে আসে। এই দিনে বাড়িতে দূর্বা ঘাস লাগানো খুবই শুভ বলে মনে করা হয়, তাতে গণেশের বাস। ঘরে সুখ আসে।


২.গণেশকে মোদক বা বেসনের লাড্ডু নিবেদন করা উচিত, মনে করা হল এতে সিদ্ধি বিনায়ক খুব খুশি হন এবং সমস্ত কাজ সিদ্ধ হয়।

৩.যদি আর্থিক সমস্যা থাকে এবং শিশু পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে সমস্যা হয়, তাহলে পৌষ বিনায়ক চতুর্থীতে গণেশ চালিসা পাঠ করুন এবং শিশুকে গণপতির গায়ে সিঁদুর লাগাতে দিন। বিশ্বাস করা হয় যে এটি শিশুর বুদ্ধির বিকাশে সহায়তা করে।


৪."ইদম দূর্বাদলম ওম গণপতয়ে নমঃ" এই মন্ত্রটি জপ করুন। এতে দেবতা খুশি হন। বিশ্বাস করা হয় এতে অপূর্ণ থাকা ইচ্ছা পূরণ হবে। এই বিশেষ দিনে দেবতা গনেশকে মোদক নিবেদন করুন।

জানেন কি, বিশ্ব আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস ৫ অক্টোবর পালিত হলেও, ভারতে ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস পালন করা হয় কেন?


"গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু,

গুরু দেব মহেশ্বর।


গুরু সাক্ষাৎ পরম ব্রহ্ম তস্ময়ী শ্রী গুরুবে নমঃ ।।"


গুরু হলেন সেই মানুষ যিনি আমাদের প্রথম শিক্ষার আলো, জ্ঞানের আলো দিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করেন। খুলে দেন পৃথিবীর সঙ্গে মেশার অবাধ দ্বার। সাহায্য করে চলেন প্রতিনিয়ত।


ভারতে ৫ সেপ্টেম্বর, ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনের দিনই পালিত হয় শিক্ষক দিবস। এই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে কারণ তিনি একজন অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ছিলেন। পাশাপাশি একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং স্নেহপরায়ন শিক্ষকও ছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্র, ছাত্রীদের ভীষণ স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন।

প্রখ্যাত পণ্ডিত, দার্শনিক, এবং ভারতরত্ন প্রাপক, ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান ৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চেন্নাইয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। অন্ধ্রপ্রদেশ বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।


বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়েও তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন, ছাত্র ছাত্রীদের উজ্জীবিত করেছেন। ডাক পেয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও। তাঁর ক্লাসে ছাত্র, ছাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়া শুনত। সংস্কৃত শ্লোক কণ্ঠস্থ থাকত সবসময়। ইউনেস্কো গিয়েছিলেন এই দেশের বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইত্যাদিকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁর এই বিপুল জ্ঞানের কারণেই তিনি ইউনেস্কোর এক্সিকিউটিভ বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম সহ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১০ বছর পর, ১৯৬২ সালে ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হন ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান।



১৯৬২ সালে, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর, ছাত্ররা তাঁর জন্মদিন উদযাপনের জন্য অনুরোধ করেন। তিনিই তখন এই দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করতে বলেন। তাঁর কথায় “আমার জন্মদিনকে আলাদাভাবে পালন করার পরিবর্তে, যদি ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয় তবে এটি আমি বেশি আনন্দ পাবো”। তাই, বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস ৫ অক্টোবর পালিত হলেও, ভারতে ১৯৬২ সাল থেকে ৫ সেপ্টেম্বর উদযাপন করা হয় শিক্ষক দিবস।


অন্যদিকে, শিক্ষকেরা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্বের সব শিক্ষকের অবদানকে স্মরণ করার জন্য জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর ডাকে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। বিশ্বের প্রায় ১০০টির মতো দেশ এ দিবসটি পালন করে।

মৃণাল সেনের ছবি, মানুষ এবং কলকাতা

কমলেন্দু সরকার


ঋত্বিক ঘটকের 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'-এর কাঞ্চনের মতো পরিচালক মৃণাল সেনের কাছেও কলকাতা ছিল এল ডোরাডো। তিনি নিজেই সেকথা বলেছিলেন। বিশ শতকের চল্লিশের দশকের শুরু। । তৎকা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর থেকে কলকাতা এলেন ১৭ বছরের যুবক মৃণাল। নেমেছিলেন শিয়ালদা স্টেশনে। সেদিনের কথা মৃণাল সেনের ভাষ্যে, "সে এক অভিজ্ঞতা। একটা আধা শহর, আধা গ্রাম থেকে মহানগরীতে এসে আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেছিলাম। আমার প্রচণ্ড ভয় হয়েছিল। স্টেশনে নেমেই এক প্রচণ্ড ভিড়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম- এক নামহীন, অবয়বহীন জনতা, যাদের কাউকে আমি চিনি না। ফরিদপুরে এ-ব্যাপারটা অকল্পনীয় ছিল-- সেখানে সবাই সবাইকে চেনে, সবাই সবার জন্য ভাবে। আমার মনে হল আমি এক নামহীন শূন্যতার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি। এখানে আমি আগন্তুক।" এই "Outsider" মৃণাল সেন একদিন ক্রমে এই শহরের নাগরিক হয় ওঠেন, একজন হয়ে ওঠেন। সেসব হয়েছিল ছাত্ররাজনীতির কারণে। যার শুরু ফরিদপুরে। সেখানে তিনি হয়েছিলেন স্টুডেন্ট ফেডারেশনের জেলা সম্পাদক। কলকাতায় এসেও ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সময়টা ১৯৪১, কলেজে পড়েন মৃণাল। একদিন হস্টেলে ঢুকে তাঁকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ।


তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। পুরো কমিউনিস্ট দলটিই আন্ডারগ্রাউন্ড। সেই সময় যাঁরা বাইরে থেকে দলের কাজ করতেন আর যাঁরা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে কাজ করতেন, তাঁদের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতেন মৃণাল সেন। এমনই অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। আসলে পুরো ব্যাপারটাই সাজানো ছিল ব্রিটিশ সরকারের। সাতদিন পর জামিন পান তিনি। এ-সম্পর্কে মৃণাল সেন বলেছেন, "আমার বাবার এক বন্ধু আমার হয়ে কেস লড়েছিলেন। ছাড়া পেয়ে দেখি বাবা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, ফরিদপুর থেকে তিনি ছুটে এসেছেন কলকাতায়। সকলের ধারণা আমি কম্যুউনিস্ট আর আত্মগোপনকারী কম্যুনিস্ট নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অপরাধে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করেছে। এই অবস্থায় আমার কংগ্রেসি বাবা... আমার হাতটা চেপে ধরে বললেন, 'Keep it up.' ব্যস, এই একটাই কথা, তার বেশি কিছু নয়।" মৃণাল সেনের এতগুলো কথার অবতারণা করা এই কারণে, তাঁর ছবিতেও দেখতে পরিচালকের পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। 'পদাতিক' ছবির শেষ সংলাপও। পুত্রকে পিতা বলছেন, 'Be Brave. আমার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না।" মৃণাল সেনের ছবিতে যে-কলকাতা দেখতে পাই, যেভাবে দেখতে পাই, যেমনভাবে দেখতে পাই, সবটাই পরিচালকের অভিজ্ঞতা, তাঁর কলকাতাকে দেখার অন্তর্দৃষ্টি। কলকাতা বারবার আকর্ষণ করছে পরিচালক মৃণালক। কেন।

এ-প্রসঙ্গে মৃণাল সেনের কিছু কথা বলা যেতে পারে, "... আমি ধীরে ধীরে কলকাতাকে ভালোবাসতে শুরু করি এবং তারপর একটা সময় আসে যখন আমি হৃদয়ঙ্গম করি যে, কলকাতাকে ভালো না বেসে বাঁচা সম্ভব নয়। তখনই আমি বলতে শুরু করি যে কলকাতা আমার El Dorado..." অর্থাৎ মৃণালের কাছে কলকাতা হল সব পেয়েছির দেশ। আবার তিনি লিখছেন, 'কলকাতার নানা রূপ আমি মুগ্ধবিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখেছি। কখনো সে মহান, কখনো উদার, কখনো নীচ, কখনো দৃঢ়সিদ্ধান্ত, কখনো সংশয়ে আচ্ছন্ন, কখনো কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণকারী, কখনো যন্ত্রণাকাতর, কখনো হাসিতে ঝলমল, কখনো ধীরোদাত্ত, কখনো উদ্দাম। জীবন এখানে অবিশ্বাস্যরকম প্রাণবন্ত, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে ভরা, আবার একই সঙ্গে অসহনীয় রকম গতিহীন। নিত্যবহমান জীবনস্রোত এখানে মাঝে মাঝেই রুদ্ধ হয়ে যায়।...' মৃণাল সেনের কলকাতা সম্পর্কে অনুভূতি, বোধ ইত্যাদি সবই তাঁর ছবিতে পাচ্ছি সেই 'নীল আকাশের নীচে' ছবি থেকেই। তিনি যেভাবে কলকাতা শহরটিকে দেখেছিলেন, ঠিক সেভাবেই কলকাতা প্রতিনিধিত্ব করেছে তাঁর বহু ছবিতে। 'নীল আকাশের নীচে' শুরু বিশ শতকের তিরিশের দশকের কলকাতা। এই দশকের প্রায় শুরু থেকেই উত্তাল সারা দেশ। আইন অমান্য আন্দোলন শুরু। মহাত্মা গান্ধীর ডান্ডি অভিযান। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন। বিনয়, বাদল, দীনেশ তিন অসমসাহসী বাঙালি বিপ্লবী যুবক ইউরোপীয় পোশাক পরে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢোকেন এবং কর্নেল সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। তারপর রাইটার্সের অলিন্দে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে এই তিন বিপ্লবী বাঙালি যুবকের সংঘর্ষ বাধে। খুবই ঘটনাবহুল দশক, বিশ শতকের তিরিশের দশক। স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল কলকাতা।

মৃণাল সেনের কলকাতায় দেখি রাজনীতির কলকাতা, লড়াইয়ের কলকাতা। তিরিশের দশকে কলকাতা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে মুখর। ব্রিটিশের পুলিশের অত্যাচার, পুলিশ ভ্যান ইত্যাদি। তারই ভিতর চিনা ওয়াং লু-র আগমন। তাঁকে দেখেই বোঝা যায় ভাগ্য ফেরাতে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের 'কাবুলিওয়ালা'র কথা মনে পড়ে। সেখানে সে একটি একটি সে ছোট্ট মেয়ের ভালোবাসায় আপ্লুত। এখানে ওয়াং লু এক মহিলার আকর্ষণ অনুভব করেন। তাঁকে মনে হয় তাঁর বাড়ির লোক। এখানে সেই মহিলা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন। তিনি এতটাই স্বদেশি যে, ওয়াং লু-র উপহার চিনা সিল্কের স্কার্ফও নিতে নারাজ। এখানে মৃণাল সেন ব্রিটিশ আর চিনা জিনিসকে এক করে ফেলেন। কেন? অন্যকোনও কারণ নয় বলে মনে হয়। আসলে, স্বদেশিরা খদ্দর ছাড়া কিছু পরতেন না। সেই সময় বিদেশি জিনিস বর্জন এতটাই ছিল তীব্র ছিল ভারতীয়দের মধ্যে তাই চিন আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এক করে ফেলে। অথচ তখন কিন্তু মাওয়ের নেতৃত্বে চিনে বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। আর এখানে চলছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই। তারই ভিতর কলকাতায় আগমন ওয়াং লু-র। তাঁর চোখ দিয়েই কলকাতার মধ্যবিত্ত অলিগলি, মানুষ দেখি। কলকাতা এবং আশপাশের শহরতলি এবং মফস্সলেও বাচ্চাদের মুখে একটা কথা খুব ঘুরত, 'চিনেম্যান চ্যাংচুং, মালাই কা ভাট'।

এর অর্থ কোনওদিন খুঁজে পাইনি। এটা অবশ্য সবাইকে নয়, বলা হত চিনাদের বা চিনাদের মতো চেহারার কোনও লোককে। মৃণাল সেনের দৃষ্টি এড়ায়নি খুঁটিনাটি ব্যাপারটুকুও। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ওয়াং লু'র পিছনে লাগত পাড়ার বাচ্চারা এই বলেই। আসলে এটা ছোটবেলার একধরনের মজা, খেলা বা পিছনে লাগা। বাল্যের সময় কাটানো। মৃণাল কলকাতার বাল্যকাল হারিয়ে যেতে দেননি। ভারত-চিনপ্রবন্ধ যুদ্ধের পূর্বে বহু চিনাকে দেখা যেত পথেঘাটে। এমনকী আমাদের মফস্পলেও দেখতাম চিনাদের ঘুরে বেড়াতে। 'নীল আকাশের নীচে'র ওয়াং লু ঘুরে ঘুরে চিনা সিল্কের শাড়ি বিক্রি করতেন। পঞ্চাশ, ষাটের দশকে মাথায় গাঁটরি চাপিয়ে বহু এদেশীয়রা তাঁতের শাড়ি বিক্রি করতেন পাড়ায় পাড়ায়। ওয়াং লু তাঁদেরই একজন। কলকাতা শহর এখন এসব হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে। 'নীল আকাশের নীচে' ছবিতে স্বাধীনতার উত্তাল কলকাতা যেমন দেখিয়েছেন পরিচালক মৃণাল সেন, ঠিক তেমনই সত্তর দশকের কলকাতা দেখি 'ইন্টারভিউ' (১৯৭০), 'কলকাতা ৭১' (১৯৭২) এবং 'পদাতিক' (১৯৭৩) ছবিতে। পরিচালক মৃণাল সেন অনেকবেশি সোচ্চার- কী রাজনীতিতে, কী শহর কলকাতা নিয়ে। এ-প্রসঙ্গে মৃণাল সেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "কলকাতা মানেই যেন উত্তেজক এক শহর আবার একই সঙ্গে উদ্বেগেরও। শুরুর সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কলকাতা মানেই আবেগ, তারুণ্য, যৌবন, বিপ্লবের শহর।" কাকে বলেছিলেন তা আমার স্মরণে নেই। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী তাঁর কাছে যিনি কথা বলেছিলেন পরিচালকের সঙ্গে। মৃণাল সেন যে-কথাগুলি বলেছিলেন, সেসব কথা থেকে কোনোদিন কখনও সরে আসেননি। তাই তাঁর ছবির কলকাতাকে যেমন রাগী দেখি, তেমনই দেখি আবেগ, তারুণ্য। মৃণাল সেন এক স্বতন্ত্র পরিচালক।

রাজনৈতিক মৃণাল সেন ভীষণভাবে সোচ্চার হলেও কোনও দলের ম্যানিফেস্টো নন। তিনি তাঁর হাঁটাপথে পেয়েছেন, দেখেছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, স্বদেশি আন্দোলন, বিশ্বযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন, সত্তরের নকশাল বাড়ি আন্দোলন- সবকিছু নিয়ে তিনি উত্তাল সময়ের ভেতর দিয়ে নিজে গড়ে উঠেছেন, নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। তাই প্রথম থেকেই তাঁর ছবিতে উত্তাল সময় পাই, কলকাতা পাই। তিনি দেশভাগের কারণে যখন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর ছেড়ে কলকাতায় আসেন, তখন তিনি বছর সতেরোর কিশোর। তখন তাঁর দেখা এবং বোঝার চোখ হয়েছে। তিনি বুঝেওছেন, দেখেওছেন। ফরিদপুরে থাকতেই তিনি যুক্ত ছিলেন বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে। কলকাতায় কলেজে ভর্তির পরও ছিলেন। সেই সময় তাঁর হয়েওছিল হাজতবাস। এমন একজন পোড় খাওয়া মানুষের ছবি তো সোচ্চার হবেই, মানবিক হবেই। তিনি তো শহরকে অন্য চোখে দেখবেনই। তাই তাঁর ছবিতে কলকাতা শহরকে প্রতিবাদের শহর, রাজনৈতিক শহর, মানবিক শহর। আবার পাশাপাশি এমনও দেখি ইংরেজরা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার বিশ-বাইশ বছর কাটলেও শহরের বহু মানুষের, প্রতিষ্ঠানের colonial hangover কাটেনি। এ-সম্পর্কে 'ইন্টারভিউ' ছবির প্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, "আমরা বলতে চেয়েছিলাম যে আমাদের দেশে transfer of power হয়েছে। কিন্তু সেই leg- acy সেই colonial legacy থেকেই গেছে। সেই legacy সর্বস্তরে কাজ করে চলেছে।... 'ইন্টারভিউ' জামাকাপড়ের গল্প নিশ্চয়ই নয়, স্যুটের গল্প নিশ্চয়ই নয়, 'ইন্টারভিউ' ছবিতে বলা হয়েছে পরিবর্তন প্রয়োজন সর্বস্তরেই political, social, economic সর্বস্তরেই।" (রাজনীতি, সিনেমা এবং মৃণাল সেন, সোমেশ্বর ভৌমিক)। 'ইন্টারভিউ' ছবিতে পরিচালক মৃণাল সেন কলকাতার মধ্যবিত্তকে চমৎকার portray করেছেন। নতুন চাকরি পাওয়ার আগেই মা, দিদির সঙ্গে মাইনেপত্তর নিয়ে কথোপকথনে দেখা যায় রঞ্জিত মল্লিক বলছেন, আরও অনেক বেশি টাকা আসবে মাস গেলে। হঠাৎ পরিচালক চলে যান মাছের বাজারে। ক্লোজআপে একটি বিশাল মাপের ইলিশ কাটতে দেখা যায় মাছওয়ালাকে। শহরের বাঙালিদের হাতে পয়সা এলেই বা আসবার সম্ভাবনা থাকলে ভালমন্দ খাওয়ার পরিবর্তন ঘটে। এরপর দেখা যায় উদ্বিগ্ন, ব্যস্ত রঞ্জিত মল্লিককে। নতুন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে। কলকাতায় সেদিন সমস্ত লন্ড্রি- কর্মচারীরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। তাই লন্ড্রি বন্ধ। বন্ধুর কাছ থেকে নেওয়া স্যুটও ফেলে এসেছেন বাসে। শেষমেশ দিদির পরামর্শমতো ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ইন্টারভিউ দিতে যান রঞ্জিত মল্লিক। প্রথমে তিনি রাজি ছিলেন না। রঞ্জিত মল্লিক বলেন, "ওটা সাহেবি অফিস।" সেইসময় রঞ্জিত মল্লিকের মা বলেন, "তুই তো বাঙালি!" খাঁটি কথা। ইংরেজরা দেশ ছেড়ে বহু বছর চলে গেলেও সাহেবিয়ানা রেখে গেছে শহরে। ওই colonial hangover.

সেই এই পুরো ঘটনাটি ছবিতে দেখাতে গিয়ে পরিচালক মৃণাল সেন কলকাতার রাস্তাঘাট, যানবাহন, মিছিল ইত্যাদি দেখিয়েছেন। কে কে মহাজন তাঁর ক্যামেরায় চমৎকারভাবে ধরেছেন রঞ্জিত মল্লিকের মানসিক অবস্থা! সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় রঞ্জিত মল্লিকের ব্যস্ততা, উদ্বিগ্নতা এবং বন্ধুর স্যুট হারিয়ে ফেলার পর তাঁর অসহায়তা। প্রতিটি সিচুয়েশনের সঙ্গে শহরের দৃশ্যাবলি এবং রঞ্জিত মল্লিককে অপূর্ব মিলিয়েছেন ক্যামেরাম্যান কে কে মহাজন এবং পরিচালক মৃণাল সেন!


'ইন্টারভিউ' যেখানে শেষ করছেন পরিচালক ঠিক সেখান থেকেই শুরু করলেন 'কলকাতা ৭১'। শুনশান হাওড়া ব্রিজ। বৃষ্টিভেজা কলকাতার ফাঁকা রাস্তা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনও বনধের দিন। মাঝে একঝলক দেখা গেল 'ইন্টারভিউ' ছবির সেই ম্যানিকুইনটি। তারপর বোমাবাজি। পরের শটেই ব্যস্তকলকাতা। ট্রাম চলছে। আসলে, টুকরো টুকরো শটে মৃণাল সেন দেখিয়ে দিলেন পুরো কলকাতা। যে-কোনও ব্যস্ত নগরী গন্ডগোলের পরই আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, ব্যস্ততা বাড়ে। 'কলকাতা ৭১'-ও তার ব্যতিক্রম নয়। ছবি চলে যায় তিরিশের দশকে, চল্লিশের দশকে, পঞ্চাশের দশকে, সত্তরের দশকে। কলকাতা ৭১-এ। শুনি রেডিওর সেই শুরুর সুর। গুলির শব্দ। এক বছর কুড়ির যুবকের মৃত্যু। যে-মৃত্যুর ঘোষণা ছবি শুরুতেই শুনেছি পরিচালকের কাছে। এবার যুবকটি দেখি সে পালাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত থেকে বাঁচতে। পরিচালক ছবির শুরুই করেছেন তিরিশের দশকে। যে-দশকে কলকাতা উত্তাল ছিল বিপ্লবীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে। তিরিশের দশক ঘটনাবহুল দশক। মৃণাল সেন 'নীল আকাশের নীচে'ও শুরু করেছিলেন তিরিশের দশকেই। 'কলকাতা ৭১'-এ শহরের বস্তিবাসী কিংবা নিম্নবিত্তদের দুর্দশা দেখি। সেই সব মানুষের ঘরবাড়ি শতছিন্ন কাপড়ের মতো। মাথা ঢাকতে গেলে পাছে প্রকাশ পায়, পাছা ঢাকতে গেলে মাথা। গৃহবাসীদের এমনই অবস্থা বৃষ্টির রাতে সর্বত্র জল পড়ছে। এমনসব বাড়ির যুবকেরাই দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন দ্যাখে। স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে। সকলেই চোখেই নতুন দেশের স্বপ্ন। সত্তরের দশকেও একদল যুবক নতুন দেশের স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁদের পথ ভুল নাকি ঠিক ছিল তা বলার দায়িত্ব ইতিহাসের।

কুড়ি বছরের যুবকটি জানায় তার কথা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন, 'বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়/পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,/এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়/এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে'। তাঁর কবিতার শেষ লাইন- 'এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে' বাংলা প্রবাদ হয়ে গেছে। এ-কথা অজানা ছিল না পরিচালক মৃণাল সেনের। এবং সত্তর দশকে নকশাল বাড়ির আন্দোলনে বহু আঠারোর যুবক অংশ নিয়েছিলেন। তাহলে পরিচালক 'কলকাতা ৭১'-এ গুলিবিদ্ধ যুবকটির বয়স কুড়ি করলেন কেন? ছবিটি পুনরায় দেখতে দেখতে প্রশ্ন করি নিজেকেই। কেন কুড়ির যুবক! পরিচালক নিজেও কিছু বলেননি কখনও।

তাহলে কি ধরে নিতে পারি, পরিচালক ভারতীয় সংবিধানকে কুড়ি বছরের যুবক বলতে চেয়েছিলেন। তার কারণ ব্যাখ্যা করা যাক। ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় বলা হচ্ছে-- জীবনের অধিকার। এই অধিকার নিছকই বেঁচে থাকার নয়, সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকার। ১৯৫০, ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয়। এরপর স্বাধীন ভারতের প্রথম লোকসভার জন্য সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫১। স্বাধীন ভারতে ২৫ অক্টোবর ১৯৫১ এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম নির্বাচন। এই নির্বাচনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ৪৮৯টি আসনের মধ্যে ৩৬৪টি আসন লাভ করে সরকার গঠন করে। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। দেশের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন নতুন দেশের। না, মানুষের স্বপ্ন সফল হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়েছেন। মধ্যবিত্ত হয়েছে নিম্নবিত্ত। নিম্নবিত্ত হয়েছে বস্তিবাসী। ঋত্বিক ঘটকের 'নাগরিক'-এ দেখেছি সেই ছবি। মৃণাল সেনের 'কলকাতা ৭১' দেখলাম গৃহহীন হতে। ছবির বছর কুড়ির যুবকটি হাজার বছর ধরে দেখে আসছে দারিদ্রের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস, শোষণের ইতিহাস। আসলে সেও স্বপ্ন দেখেছিল নতুন ভারতের। মৃণাল সেনের 'কলকাতা ৭১'- এর বছর কুড়ির যুবকটি কি স্বপ্ন? সেই স্বপ্ন কি শেষ হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির কাছে? জানি না পরিচালক কি অর্থে কুড়ি বছরের যুবকটিকে ছবিতে! এ-প্রসঙ্গে মৃণাল সেন অবশ্য বলছেন, "একটা কুড়ি বছরের ছেলে ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটে। তার অনন্ত যাত্রাপথের চল্লিশ বছরের চারটে ভিন্ন দশকের একটা করে দিন আমাদের গোচরে আসে। সেই দিনগুলি এক সূত্রে বাঁধ-- দারিদ্র।" (মৃণাল সেন আধুনিক ভারতীয় সিনেমার জনক, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়, চৌরঙ্গি, মাঘ, ১৪২৫)।

মৃণাল সেনের ভাবনায় কলকাতা কেমন ছিল? 'কলকাতা ৭১' দেখার পর প্রশ্ন জাগে। মৃণাল সেন বলছেন, 'কলকাতা। এই নগরীর তারুণ্য এবং প্রাণোচ্ছলতা, এর চাপল্য এবং অস্তিত্বের এক বিয়োগান্ত মাত্রা আমাকে যুগপৎ বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে। এই শহর আমাকে উত্তেজনা দেয়, আমাকে প্ররোচিত করে।... পৃথিবীর অন্যান্য অনেক নগরীর মতো কলকাতাতেও বহু বৈপরীত্য, বহু স্ববিরোধের সন্ধান পাওয়া যাবে। পুরাতন ও নতুনের আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেছে এখানে, যার জন্য কিছুটা দায়ী অবিরাম নগরায়ণের প্রয়াস, কিছুটার কোনো কারণ পাওয়া যাবে না। অন্যান্য অনেক শহরের মতো এ-শহরও মানুষে ঠাসা।' (কথাপুরুষ, দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়)। মৃণাল সেনের কলকাতাকে নিয়ে এই উপলব্ধি, শহরকে দেখা, তার পুরোটাই পায় 'কলকাতা ৭১'-এ।


যাইহোক, 'কলকাতা ৭১'-এর যুবকটি পালাতে না পারলেও, পালাতে পেরেছিল পদাতিক'-এর যুবকটি। আশ্রয়ও পায়।' 'কলকাতা ৭১'-এর যুবকটি যখন পালাচ্ছে তখন কলকাতার অলিগলি চমৎকারভাবে এনেছিলেন পরিচালক। শুধু তাই নয়, আরবান গেরিলাদের নিয়ে আসাটাও চমৎকার উপস্থাপনা। তার বিস্তার পাই 'পদাতিক' ছবিতে।


মৃণাল সেনের কলকাতা ত্রয়ীতে তিন ধরনের কলকাতা দেখি পরিচালকের চোখে আর কে কে মহাজনের ক্যামেরায়। 'ইন্টারভিউ'য়ে রঞ্জিত মল্লিকের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ব্যস্ততার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কলকাতা শহরকে, 'কলকাতা ৭১'-এ অস্থির শহরকে আর 'পদাতিক'-এর পালিয়ে আসা বিপ্লবী যুবকের গোপন আস্তানা বা আশ্রয়ের শহরকে। সেইসঙ্গে 'পদাতিক'-এর কলকাতা। ক্যামেরা দ্রুত এগিয়ে যায়। কখনও বাসে বা ট্রামে। কখনও হেঁটে। যেন মনে হয়, পালিয়ে যাওয়া বিপ্লবী যুবক সবাইকে সন্দেহ করছে। সে দ্রুত গোপন আস্তানায় ফিরতে চাইছে। 'আস্তানা' বলার কারণ বিপ্লবী যুবকের কাছে এটি তাই। তাই যখন সে একটি আশ্রয় ছেড়ে অন্য আর একটি আশ্রয়ে যায় তখন ফ্ল্যাটবাড়ির ন'তলায় উঠে জানলা দিয়ে দ্যাখে কলকাতা শহরের skyline, তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে "অপূর্ব!" তারপর বলে "সাজানো নরক।" তার কমরেড বলে "কেন?" যুবকটি বলে, "আমার কাছে জেলখানাও যা, এটাও তাই।" পরিচালক কলকাতা শহরকে তার চোখ দিয়েই দেখিয়েছেন। তার অনুভব, তার পালিয়ে পালিয়ে গোপন আশ্রয়ে থাকা- এই সবকিছুই।

আবার যখন মায়ের মৃত্যুর খবরে বাড়ি যায় তখন শহর তার ঘরে ঢুকে পড়ে। ষাটের দশকের প্রায় শেষ থেকেই মৃণাল সেন উত্তাল কলকাতা, আন্দোলনের কলকাতা, মিছিল নগরী কলকাতার ছবি তুলে রাখতেন। তাঁর কথায় জানা যাচ্ছে, '১৯৬৮-র শেষের দিকের কথা, কলকাতা তখন আন্দোলন আর মিছিলে উত্তাল। কোনোদিন ছাত্র আন্দোলন, পরের দিন কৃষক আন্দোলন, তার পরের দিন মহিলাদের বিক্ষোভ- এইরকম চলছে। আমি তখন ধারদেনা করে একটা ৩৫ মিলিমিটার মুভি ক্যামেরা আর কিছু র-স্টক জোগাড় করে রেখেছিলাম, যেখানেই এরকম আন্দোলন বা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হত, সেখানে পৌঁছে সব কিছুর ছবি তুলে রাখতাম।' (কথাপুরুষ, দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়)। পরিচালক মৃণাল সেন প্রায় কুড়ি বছর পর গুলি খাওয়া, পালিয়ে যাওয়া অতি বাম যুবকটিকে নিয়ে এলেন 'মহাপৃথিবী' (১৯৯১) ছবিতে। 'পদাতিক'-এর যুবকটির যেমন পরিবারকে দেখি, তেমনই দেখি 'মহাপৃথিবী' ছবিতে। দু'টি পরিবারই মধ্যবিত্ত। এই ছবির যুবকটি আর পালাতে পারে না। পুলিশের গুলিতে মারা যায়। এই যুবকের মৃত্যুর সংবাদ আসে গুলির শব্দে। যেমন, সত্তরের দশকের প্রায় খবর পাওয়া যেত শহর এবং শহরতলি থেকে একাধিক যুবকের মৃত্যু। 'মহাপৃথিবী' ছবিতেও দেখি কলকাতার সেই typical গলি। বোঝাই যায়, এমন গলির বাসিন্দা মধ্যবিত্তেরা। তবে, অন্য ছবিগুলির থেকে 'মহাপৃথিবী' একেবারে ভিন্ন। এখানে কলকাতার রাস্তাঘাটের চেয়ে ক্যামেরাম্যান-সহ পরিচালক বেশি ঘোরাঘুরি করেন বাড়ির অভ্যন্তরই বেশি।

সত্তরের শেষ আশির দশকের শুরু। কংগ্রেসকে পরাজিত করে বামেরা ক্ষমতায় এসেছে। কলকাতা শহরের বিষয় বদলেছে। কিন্তু কলকাতার মধ্যবিত্ত অলিগলি, পুরনো বাড়ির অবস্থা, পরিবেশ একই আছে। মৃণাল সেনের 'একদিন প্রতিদিন' ছবির ক্যামেরা কলকাতা শহরের হয়ে নাটকের সূত্রধরের মতো কাজ করে। অর্থাৎ শহর কলকাতা এই ছবিতে সূত্রধর। ছবির শুরুতেই একদল আদুড়-গা বাচ্চা নিজেদের মধ্যে হইহই করছে। একটি বাচ্চার খেলতে খেলতে মাথা ফেটে যায়। এই বাচ্চাটির পরিবারকে ঘিরেই ছবির কাহিনি। ক্যামেরা যখন তার পিছু নিল তখন বোঝা যায়।


বোঝা যায়, বাড়িটি পুরোনো। এই বাড়িতে একাধিক ভাড়াটিয়া। সূত্রধর দর্শকদের জানায়। সেকথা। সিপাহি বিদ্রোহের বছরে ১৮৫৭ সালে বাড়িটি নবীন মল্লিক তৈরি করেন। বর্তমান মালিক দ্বারিকানাথ মল্লিক। আঠারোটিঘর, এগারোটি ভাড়াটিয়া। তাদেরই একজন হৃষীকেশবাবু। তারই চাকরিজীবী মেয়ে চিনু। সে অফিস থেকে বাড়ি ফেরেনি রাতে। সবাই উদ্বিগ্ন। এখনও কোনও মহিলা রাত করে বাড়ি ফিরলে কিংবা বাড়ি না ফিরলে পাড়াপ্রতিবেশীরা ভাবে দুর্ঘটনা নয়, অন্যকিছুভাবে অর্থ রোজগার করে মেয়েটি। আসলে কলকাতা শহরের cosmetic পরিবর্তন হলেও মানসিকতার বদল ঘটেনি ওই পুরোনো বাড়ির মতো। ছবির পুরো ঘটনাটিই সন্ধের পর থেকে। তাই রাতের শহরে বোঝা যায় সে কতটুকু উদ্বিগ্ন তার নাগরিকদের জন্য। 'কী হল, কী হল!' ভাব আছে। রাতের কলকাতা, ভোরের কলকাতা দেখি। যেমন দেখি, 'পরশুরাম' ছবিতে।

'পরশুরাম', 'একদিন প্রতিদিন' একই সময়ের ছবি। 'পরশুরাম'-এর প্রযোজক তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তখন ক্ষমতায় বামেরা। সেইজন্য মৃণাল সেনের মতো পরিচালকের কিছু যায়-আসেনি। চাষের জমির মালিক ভাগচাষি হয়, পরে শহরের ফুটপাতবাসী। সামান্য চাষের জমির মালিক কিছু টাকাধার করেন মহাজনের কাছে। সুদ-সহ ধারের টাকা শুধতে না পেরে জমি দিয়ে দিতে হয় মহাজনকে। জমির মালিক হয়ে যান ভাগচাষি। এটা গ্রামবাংলার চিত্র। বামেরা ক্ষমতায় এসেও সেই ছবির খুব একটা বদল ঘটেছিল তা নয়। পরিচালক সেই বিষয়েরই বর্ণনা করেছিলেন ছবিতে। একটা জটিল ব্যাপার খুব সহজেই চলচ্চিত্রায়ন করেন মৃণাল সেন। গ্রাম থেকে শহরে আসা এক ভাগচাষির শহরের ফুটপাতবাসীদের সঙ্গে জীবন কাটানোর গল্প 'পরশুরাম'। যে-গল্প আমরা যাওয়া-আসার পথে নিত্য দেখলেও মগজের ফাঁকে গলে যায়। শহরের অবহেলার কাহিনি। কলকাতা এবং প্রান্তিক মানুষগুলো নিয়ে চমৎকার একটি কাহিনি বুনেছিলেন পরিচালক মৃণাল সেন।

'পরশুরাম' ছবিটি নিয়ে মৃণাল সেনের বক্তব্য: আমার এক বন্ধু শুভেন্দু মুখোপাধ্যায় একটি সাইক্লোস্টাইল করা বড় কাগজের পাণ্ডুলিপি একটি ফাইলে করে আমাকে দিলেন যেটি কলকাতার রাস্তার ফুটপাথে যাঁরা বাস করেন তাঁদের ইতিহাস।... এই শহরের ফুটপাতে যাঁরা বাস করেন তাঁরা বেশিরভাগই চাষি। এঁদের কোনও জোত-জমি-জায়গা কিছুই নেই। যখন চাষবাস থাকে না, তখনই তাঁরা ফুটপাতে ভিড় করেন। এঁরা ফুটপাথের অন্ধকারে লড়াই করেন- বাঁচার লড়াই। এ যেন এক শ্যাডো বক্সিং। এই খেলাতে গ্রাম থেকে আসা মানুষটি একটি ক্ষুদ্র জীব, আর কিছুই নয়।" (মৃণাল সেন আধুনিক ভারতীয় সিনেমার জনক, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়, চৌরঙ্গি, মাঘ, ১৪২৫)।

বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন মৃণাল সেন। ছিলেন মানবিক। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। মানুষের কথায় তাঁর ছবিতে এসেছে বারবার। তাঁর শ্রেণিচরিত্র ছিল মধ্যবিত্ত। তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান পরিচালক মৃণাল সেন কোনোদিন ভোলেননি। 'পরশুরাম'-এর অভিনেতা অরুণ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'সময়ের চোখে মৃণাল সেন'-এ লিখছেন, '... মৃণাল সেনকে অনেকটা শান্ত, গেরস্থ, মধ্যবিত্ত বাঙালির মতো মনে হয়।


কিন্তু সৃষ্টির জগতে মোটেই ছাপোষা নন। প্রবলভাবেই প্রতিবাদী এবং আপসহীন'। তিনি লিখছেন, 'কলকাতা এবং মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ-- মৃণাল সেনের অধিকাংশ ছবির বিষয় এদেরকে ঘিরে'। এই শহরকে ভালোবাসতেন পরিচালক মৃণাল সেন। সেকথা বলেওছিলেন। তাই পরিচালক মৃণাল সেনের ছবিতে বারবার এসেছে মানুষ, এসেছে কলকাতা। মৃণাল সেন নিজে মনে করতেন, "কলকাতার জীবনে অবিরাম উত্তেজনা।


 

Comments


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page