এক কাপ ধোঁয়া ওঠা এলাচ দেওয়া ঘন দুধের চা হোক কি লেবু আর বিট নুন দেওয়া লাল চা, পছন্দসই টা' এর আয়োজন না থাকলে পুরো ব্যাপারটাই মাটি! আজ রইলো এমনই কিছু মুখোরোচক স্ন্যাক্সের রেসিপি যা আপনার বৈকালিক আড্ডার টেবিলে ঝড় তুলবেই!
মুচমুচে আড্ডা
(বিকেলের চায়ের সঙ্গে পছন্দসই টা)
স্বাগতা সাহা
লিট্টি চোখা
কী কী লাগবে
লিট্টির জন্য:
আটা ১ কাপ, Shalimar's সাদা তেল ৩ টেবিল চামচ, ছাতু-২৫০ গ্রাম, পেঁয়াজ-১টা বড় (কুচনো), রসুন ৫ কোয়া(কুচনো), আদা ১ ইঞ্চি(বাটা), কাঁচালঙ্কা ১টা(কুচনো), Shalimar's জিরে ১ চা চামচ, জোয়ান ১ চা চামচ, আমচূর পাঊডার ১ চা চামচ, ঘি ২০০ গ্রাম (গলানো), নুন স্বাদ মতো, জল পরিমান মতো।
চোখার জন্য:
বেগুন, টমেটো, আলু, পেঁয়াজ কুচি, আথা রসুন কুচি, ধনেপাতা কুচি, Shalimar's সরষের তেল, নুন।
কীভাবে বানাবেন
আটা ও তেল একসঙ্গে মিশিয়ে পরিমাণ মতো জল দিয়ে ভালো করে মেখে নিন। ঢেকে কিছুসময় রেখে লেচি কেটে নিন। পুরের সব উপকরণ একসঙ্গে জল দিয়ে মিশিয়ে নিন। লেচির মধ্যে আঙুলের চাপে গর্ত করে পুর ভরে গোল বল তৈরি করে নিন অথবা পুর ভরা লেচি ছোট ছোট রুটির আকারে বেলে নিন। নিয়ম অনুযায়ী এইসব বল বা রুটি কয়লার গনগনে আঁচে সেঁকা হয়। সম্ভব না হলে চিমটা দিয়ে ধরে গ্যাসের আগুনেই সেঁকে নিন বা রুটির মতো চাটুতে সেঁকে নিন। সেঁকা হলে লিট্টি ভেঙে মাঝখানে অল্প ঘি দিয়ে চোখা ও ধনেপাতার চাটনির সাথে পরিবেশন করুন।
চোখা বানানোর জন্য:
বেগুন ও টমেটো আঁচে সেঁকে ঠাণ্ডা হলে খোসা ছাড়িয়ে নিন। একটা বাটিতে বেগুন, টমেটো, আলু সেদ্ধ, আদা, রসুন, ধনেপাতা, লঙ্কা ও তেল একসঙ্গে ভাল করে মেখে চোখা বানিয়ে নিন।
নুন দিয়ে জারানো কাঁচালঙ্কা, কাঁচা পেঁয়াজ, টমেটোর চাটনি বা ধনেপাতার চাটনি দিয়ে পরিবেশন করুন গরম গরম লিট্টি চোখা।
মেদু বড়া
কী কী লাগবে
সাদা বিউলির ডাল (খোসা ছাড়ানো) ২৫০ গ্ৰাম, Shalimar's সাদা তেল ৫০০ গ্ৰাম, কাঁচা লঙ্কা ৬ টি, নারকেল কোরানো ৩ টেবিল চামচ, কাজুবাদাম কুচি ৩ টেবিল চামচ, চাল গুঁড়ো ২ চা চামচ, কারিপাতা কয়েকটা, নুন স্বাদ মত, হিং।
কীভাবে বানাবেন
ডাল ভিজিয়ে রেখে জল ঝরিয়ে কাঁচালঙ্কা, কারিপাতা বেটে নিন। ওর মধ্যে হিং, নারকেল কোরা, কাজুবাদাম কুচি, চাল গুঁড়ো একসাথে ফেটিয়ে নিন। রিং এর শেপে গড়ে ডুবো তেলে সোনালী করে ভেজে তুলে নিন। সাম্বার ও চাটনির সাথে পরিবেশন করুন।
পাপিয়া সান্যাল চৌধুরী
মেথি মাঠরি
কী কী লাগবে
হোল হুইট আটা ১.৫ কাপ, বেসন (ছোলার) ১/২ কাপ, কসুরি মেথি ২ টেবিল চামচ, Shalimar's রেড চিলি পাউডার ১/২ চামচ, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো ১/৪ চামচ, জোয়ান ৩/৪ চামচ, তিল ১ চামচ, নুন স্বাদমতো, বেকিং পাউডার ১/৪ চামচ, বেকিং সোডা ১/৮ চামচ, সাদা তেল বা ঘি ১/৩ কাপ, জল ১/২ কাপ, Shalimar's সাদা তেল ভাজার জন্য
কীভাবে বানাবেন
একটি বড় পাত্রে হোল হুইট আটা, বেসন, কাসুরি মেথি, Shalimar's
রেড চিলি পাউডার, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো, জোয়ান, তিল, নুন, বেকিং পাউডার, বেকিং সোডা মিশিয়ে নিতে হবে।
ভালো মতো মেশানোর পর তেল অথবা ঘি মিশিয়ে দু-হাতের তালুর সাহায্যে ভালো করে ঘষে ময়ান দিয়ে নিতে হবে। এবার আস্তে আস্তে জল মেশাতে থাকুন আর হাত দিয়ে মেখে ডো বানিয়ে নিতে হবে। অন্ততঃ ৫ মিনিটের মতো মেখে, ১৫-২০ মিনিটের মতো ঢাকনা দিয়ে রেস্ট করতে দিতে হবে।
এবার লেচি কেটে হাতের তালুতে নিয়ে একটু মোটা করে মাঠরীর আকার দিয়ে নিতে হবে। টুথপিক বা কাঁটা চামচের মতো সাহায্যে ফুটো ফুটো করে নিতে হবে। প্যানে Shalimar's সাদা তেল গরম করে মাঝারি আঁচে ভেজে তুলে নিন।
চীজ স্টাফ্ড আলু বন্ডা
কী কী লাগবে
সেদ্ধ ম্যাশড আলু ৪ টি, প্রসেসড চীজ ১/২ ইঞ্চি করে কাটা টুকরো ৫০ গ্রাম, গোটা সর্ষে ১ চামচ, গ্রেটেড আদা ১ ইঞ্চি, কুচো করে কাটা পেঁয়াজ ১ টি, কাঁচালঙ্কা কুচি ২ টি, হিং ১/৪ চামচ,
Shalimar's হলুদ গুঁড়ো ১/২ চামচ,
ধনেপাতা কুচি প্রয়োজন মতো, Shalimar's সাদা তেল প্রয়োজন মতো
বন্ডা ব্যাটার এর জন্য
বেসন (ছোলার) ১ কাপ,
Shalimar's হলুদ গুঁড়ো ১ চামচ, নুন স্বাদমতো
কীভাবে বানাবেন
একটি ফ্রাইং প্যানে তেল গরম করে গোটা সর্ষে ফোড়ন দিন। পেঁয়াজ কুচি মিশিয়ে মিনিট দুয়েকের মতো সতে করে নিন যতক্ষণ না পর্যন্ত পেঁয়াজ নরম এবং সোনালী রং-এর হয়ে যায়।
এরপর একে একে আদা, কাঁচালঙ্কা, হিং, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো এবং নুন মিশিয়ে দিন। ১ মিনিটের মতো সতে করে নিয়ে তাতে ম্যাশড আলু আর ধনেপাতা কুচি মেশান। ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে আঁচ নিভিয়ে দিন এবং আলুর মিশ্রণ টিকে ঠান্ডা হতে দিন প্রয়োজনীয় সময় দিয়ে। ঠাণ্ডা হলে অল্প করে মিশ্রন নিন, তার মধ্যে চিজ পুরে গোল বলের মতো বানিয়ে নিন। এবার একটি পাত্রে বেসন, Shalimar's হলুদ গুঁড়ো, স্বাদমতো নুন আর জল মিশিয়ে ঘন মিশ্রণ বানিয়ে নিন। বলগুলো এই মিশ্রণে ডুবিয়ে, মাঝারি আঁচে ডুবো তেলে সোনালী করে ভেজে তুলে নিন। ইচ্ছে মতো সাজিয়ে পরিবেশন করুন চিজ স্টাফড আলু বন্ডা।
সুতপা বৈদ্য
ব্রেড পটেটো রোল
কী কী লাগবে
৬ পিস বড় ব্রেড, ২ টো আলু সেদ্ধ, ১ টেবিল চামচ Shalimar's সাদা তেল,
১/৪ চা চামচ গোটা জিরে, ১ টা মাঝারি সাইজের পেয়াজ কুচি, ১/২ চা চামচ আদা রসুন বাটা, ১ টা কাঁচা লঙ্কা কুচি, ১ মুঠো ধনেপাতা কুচি, ১/৪ চা চামচ Shalimar's হলুদ গুঁড়ো, ১/২ চা চামচ Shalimar's জিরে গুঁড়ো, ১/৪ চা চামচ Shalimar's ধনে গুঁড়ো, ১/৪ চা চামচ Shalimar's লঙ্কা গুঁড়ো, ১/৪ চা চামচ চাট মশলা, স্বাদ অনুসারে লবন, ১ টা ডিম, সামান্য গোল মরিচ গুঁড়ো, ১ কাপ বিস্কুটের গুঁড়ো, ভাজার জন্য প্রয়োজন অনুসারে Shalimar's সাদা তেল
কীভাবে বানাবেন
প্রথমে কড়াইতে Shalimar's তেল গরম করে গোটা জিরে দিয়ে, পেঁয়াজ কুচি একটু ভেজে একে একে আদা, রসুন বাটা, জিরে গুঁড়ো, Shalimar's ধনে গুঁড়ো, কাঁচা লঙ্কা, Shalimar's লঙ্কা গুঁড়ো, Shalimar's হলুদ সামান্য জলের সাহায্যে একটু কষিয়ে, হাতের সাহায্যে ভাঙা সেদ্ধ আলু, চাট মশলা, পরিমাণ মতো লবন, ধনেপাতা কুচি দিয়ে সব কিছু মিশিয়ে গ্যাস অফ করে নামিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। ততক্ষণ ব্রেড বেলে চারদিকের ব্রাউন অংশ কেটে, মাঝখানে লম্বা করে আলুর পুর দিয়ে চারপাশে জল লাগিয়ে রোলের আকারে করে আঙ্গুলের সাহায্যে সব দিক আটকে দিতে হবে। এভাবে সব গুলো গড়ে নিয়ে, একটি ডিমে সামান্য লবন ও গোলমরিচ গুড়ো ভালো করে মিশিয়ে, রোলগুলো ডুবিয়ে, গায়ে বিস্কুটের গুড়ো লাগিয়ে ডিপ ফ্রাই করে তুলে নিলেই তৈরি ব্রেড পটেটো রোল।
চিলি পনির স্যান্ডউইচ
কী কী লাগবে
১০০ গ্রাম পনির, ৬ টি ব্রেড, ২ টেবিল চামচ Shalimar's সাদা তেল, ১ টা মাঝারি পেঁয়াজ, ১ টা ছোট ক্যাপসিকাম, ১/২ চা চামচ আদা বাটা, ১/২ চা চামচ রসুন বাটা, ১ টা কাঁচা লঙ্কা, ১/২ চা চামচ লবন, ১ চা চামচ চিলি সস, ১ চা চামচ সয়া সস, ১/২ চা চামচ ভিনিগার, ২ টেবিল চামচ কর্নফ্লাওয়ার, ১ চা চামচ ময়দা, ১ টেবিল চামচ টমেটো সস,
১ টা শশার স্লাইস, প্রয়োজন মতো বাটার
কীভাবে বানাবেন
প্রথমে পনিরের ছোট টুকরো করে নিতে হবে। এবার ১ টেবিল চামচ কর্নফ্লাওয়ার, ১ টেবিল চামচ ময়দা ও স্বাদ মত লবণ পনিরের উপরে ছড়িয়ে হালকা হাতে বা চামচের সাহায্যে একটু মাখিয়ে নিতে হবে। এবার Shalimar's সাদা তেল গরম করে এগুলো শ্যালো ফ্রাই করে তুলে নিতে হবে। তারপর ঐ তেলে পেঁয়াজ নাড়তে নাড়তে একে একে ক্যাপসিকামের টুকরো, আদা রসুন বাটা , কাঁচালঙ্কা, গোল মরিচ গুঁড়ো, সয়া সস, টমেটো সস, চিলি সস, স্বাদ মতো লবন, ভেজে রাখা পনির, ২ চামচ জলে গোলা ১ টেবিল চামচ কর্নফ্লাওয়ার দিয়ে মিনিট খানেক নাড়িয়ে গ্যাস অফ করে দিতে হবে। ব্রেড গুলোতে অল্প অল্প বাটার লাগিয়ে পাতলা শশার স্লাইস দিয়ে উপরে চিলি পনির রেখে অন্য একটি ব্রেড দিয়ে ঢেকে দিন। এভাবে সবগুলো রেডি করে তাওয়ায় একটু চেপে চেপে দু'পিঠ সেঁকে নিলেই তৈরি চিলি পনির স্যান্ডউইচ।
সুমিতা ব্যানার্জী
চিজি প্রন বলস
কী কী লাগবে
চিংড়ি মাছ, কর্নফ্লাওয়ার, ডিম, মোজারেলা চিজ, ক্রাশড পেপার, নুন, বেকিং পাউডার, রসুন কুচি, Shalimar's সাদা তেল
কীভাবে বানাবেন
গরম জলে রসুন কুচি দিয়ে চিংড়ি মাছ গুলো ব্লান্চ করে নিন। ফুড প্রসেসারে চিংড়ি মাছ, কর্নফ্লাওয়ার, ডিম, মোজারেলা চিজ, ক্রাশড পেপার, নুন, বেকিং পাউডার একসঙ্গে মিশিয়ে একটি শক্ত মিশ্রণ বানিয়ে নিন। ছোট ছোট বলের মতো বানিয়ে রাখুন। Shalimar's তেল গরম করে অল্প আঁচে বেশ লাল করে ভেজে তুলে নিন। পছন্দমতো সসের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
চটপটা পালং পকোরা
কী কী লাগবে
পালং পাতা কুচি, পেঁয়াজ কুচি, ওটস, কাঁচালঙ্কা কুচি, বেসন, আমচূর পাউডার, চাটমশলা, ধনেপাতা কুচি,
বেকিং পাউডার, চালের গুঁড়ো, নুন, Shalimar's সাদা তেল, ডিম
কীভাবে বানাবেন
একটি বড় পাত্রে একে একে সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। ছোট ছোট বলের আকারে গড়ে রাখুন। Shalimar's তেল গরম করে মুচমুচে করে ভেজে তুলে নিলেই তৈরী হয়ে যাবে চটপটা পালং পকোরা।
সোমা রায়
কাপ ধোকলা
কী কী লাগবে
১ কাপ বেসন, ১/২ কাপ টক দই, একটি কাঁচা লঙ্কা কুচি, এক চামচ চিনি, ১/২ চামচ আদা বাটা, ১/২ চামচ Shalimar's হলুদ গুঁড়ো, ২ চামচ ফ্রুট সল্ট, ১ চামচ কালো সর্ষে, কারিপাতা, চিনি, Shalimar's তেল, স্বাদ মতো নুন
কীভাবে বানাবেন
প্রথমে ১ কাপ বেসন একটি বড়ো বাটিতে নিয়ে তাতে ১/২ কাপ টক দই, কাঁচা লঙ্কা কুচি, এক চামচ চিনি, ১/২ চামচ আদা বাটা, ১/২ চামচ Shalimar's হলুদ গুঁড়ো, ১ চামচ তেল, স্বাদ মতো নুন দিতে হবে। এরপর ১/৪ চামচ জল দিয়ে ভালো করে মেশাতে হবে। এবার ২ চামচ ফ্রুট সল্ট দিয়ে আবার ভালো করে মেশাতে হবে।
এরপর মিশ্রণটি কাপে ঢালতে হবে এমন ভাবে যাতে কাপে একটু খালি জায়গা থাকে। এবারে ৩ মিনিট হাই তে মাইক্রোওয়েভ মোডে রান্না করতে হবে। ব্যাস। এরপর গ্যাসে প্যান বসিয়ে ২ চামচ Shalimar's তেল দিয়ে তাতে ১ চামচ কালো সর্ষে, কারিপাতা, ১ চামচ চিনি, অল্প জল দিয়ে একটু নেড়ে নিতে হবে আর ধোকলার উপর ছড়িয়ে দিতে হবে। ব্যাস চায়ের সাথে জমে যাবে এই কাপ ধোকলা।
চটজলদি সুজির ইডলি
কী কী লাগবে
১ কাপ সুজি, ১ কাপ টক দই, ক্যাপসিকাম কুচি, টমেটো কুচি, গ্রেট করা গাজর, একটি কাঁচা লঙ্কা কুচি, ধনেপাতা কুচি, ১/২ চামচ আদা বাটা, ১/২ ছোট চামচ ফ্রুট সল্ট, ১ চামচ কালো সর্ষে, কারিপাতা, ১ টেবিল চামচ Shalimar's তেল, স্বাদ মতো নুন
কীভাবে বানাবেন
প্রথমে সুজি আর দই ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে ইডলি ব্যাটার (ঘনত্ব যেন বেশি শক্ত বা বেশি পাতলা না হয়) বানাতে হবে। এরপর ব্যাটারে একে একে সব সবজি কুচি, ধনেপাতা কুচি, কাঁচা লঙ্কা কুচি, আদা বাটা, নুন দিয়ে ভালো করে মেশাতে হবে। এবার দশ মিনিট রেখে দিতে হবে। এরপর একটি তড়কা প্যানে Shalimar's তেল গরম করে তাতে সর্ষে ও কারিপাতা ফোড়ন দিতে হবে আর এই ফোড়ন তেলটি ব্যাটারে দিয়ে ভালো করে মেশাতে হবে।
এরপর ব্যাটারে ফ্রুট সল্ট মেশাতে হবে। এবার মাইক্রোওয়েভ সেফ ছোট ছোট বাটিতে ব্যাটার ঢালতে হবে এমন ভাবে যাতে বাটিতে একটু খালি জায়গা থাকে। এবারে ২-৩ মিনিট হাই তে মাইক্রোওয়েভ মোডে রান্না করতে হবে। এবার তৈরী আমাদের চটজলদি মাইক্রোওয়েভ ইডলি। এরপর পছন্দসই চাটনির সাথে পরিবেশন করতে হবে।
সঙ্গীতা তালুকদার
মুগ পনীর বার্গার
কী কী লাগবে
অঙ্কুরিত মুগ ৮ টেবিল চামচ, পনির ৮ টেবিল চামচ, কুরিয়ে নেওয়া গাজর ৪ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ কুচি ৪ টেবিল চামচ, ধনেপাতা কুচি ২ টেবিল চামচ, চিলি ফ্লেক্স ১/২ টেবিল চামচ, Shalimar's সাদা তেল,
চিজ ২ টেবিল চামচ, লবন স্বাদ অনুযায়ী, আভোকাডো,, লেটুসপাতা পাতা, টমেটোর রিং, ক্যাপসিকামের রিং, পেঁয়াজের রিং, টুথপিক, বার্গার ব্রেড
কীভাবে বানাবেন
প্রথমে মুগডাল মিক্সারে আধা ভাঙ্গা করে নিন। এতে পনির হাত দিয়ে ভেঙ্গে মিশিয়ে দিন। একে একে বাকি সব উপকরণ দিয়ে ভালো করে মেখে নিন। বার্গারের আকারে গড়ে ডুবো তেলে বা ফ্রাইং প্যানে সামান্য Shalimar's তেল দিয়ে ভেজে তুলে নিন।
একটি এভোকাডোর বীজ বের করে এতে সামান্য লবন, চিলি ফ্লেক্স আর সামান্য লেবুর রস মিশিয়ে একটি মিশ্রণ বানিয়ে রাখুন। এবার বার্গার ব্রেড হালকা দু পিঠ সেঁকে নিয়ে এর একদিকে আভোকাডোর মিশ্রন লাগিয়ে একে একে লেটুসপাতা, টমেটো স্লাইস, ক্যাপসিকামের রিং, পেঁয়াজের রিং সাজিয়ে ওপরে রাখুন মুগ পনিরের প্যাটি। বার্গার ব্রেডের অপর টুকরো টি ওপরে রেখে টুথপিক গুঁজে পরিবেশন করুন।
মশলা ফ্রেঞ্চ টোস্ট
কী কী লাগবে
ব্রেড স্লাইস ২ পিস, ডিম ৪ টি, পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ, Shalimar's সাদা তেল,
লঙ্কা কুচি ১ চা চামচ, ধনেপাতা কুচি ১ টেবিল চামচ, ক্যাপসিকাম কুচি ২ টেবিল চামচ, অঙ্কুরিত মুগ ২ টেবিল চামচ,
পোস্ত দানা ২ টেবিল চামচ, লবন স্বাদ অনুযায়ী
কীভাবে বানাবেন
একটি বাটিতে সব উপকরণ মিশিয়ে নিন। ব্রেড স্লাইস গুলো ছোটো টুকরোতে কেটে নিয়ে ডিমের গোলাতে ডুবিয়ে লাল করে ভেজে তুলে নিলেই তৈরী। গরম চা আর টমেটো কেচাপ এর সাথে পরিবেশন করুন এই মশলা ফ্রেঞ্চ টোস্ট।
মন্দির-গায় দেবী দুর্গা এবং পটে পুজো
মন্দির টেরাকোটায় হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি, দেব-দেবী, কৃষ্ণলীলা, রামায়ণ, মহাভারত-এর পাশাপাশি বহু সামাজিক চিত্রও দেখা যায়। কিন্তু দশভুজা দুর্গাপ্রতিমার টেরাকোটা খুবই কম চোখে পড়ে। বর্ধমানের অম্বিকা-কালনার প্রতাপেশ্বর শিবমন্দিরে রয়েছে টেরাকোটার কাজ। আছে মন্দিরের প্রবেশ পথের ওপরে বেশ বড় টেরাকোটার প্যানেলে দুর্গামূর্তি। এখানে আছে রামের অকালবোধন অর্থাৎ শরৎকালের দুর্গাপুজো। এখানে আছে সেই কাহিনি রামের অনুরোধে রাবণের দুর্গাপুজোর কাহিনি। হিন্দুশাস্ত্রমতে সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হলে দেবতারা ঘুমোতে যান। শরৎকাল তাই দেবতাদের ঘুমোনোর কাল। তাই দেবীকে জাগায়ো হয়েছিল অকালে। তাই বলা হয় অকালবোধন।
প্রায় ফুট চারেকের টেরাকোটা প্যানেলে রয়েছে রাম-রাবণ। লক্ষ্মণের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বিভীষণ। আর আছে বানর সেনা। চমৎকার এই টেরাকোটায় দুর্গা পুজোর নিদর্শন আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। গঙ্গার তীরে কালনা। শুধু কালনা নয়, অম্বিকা কালনা। অম্বিকা গ্রামের নামোৎপত্তি সম্বন্ধে আছে জনশ্রুতি। প্রাচীন কালে এখানে এক ঋষি ছিলেন যাঁর নাম অম্বরীষ। তিনি পুজো করতেন দেবী অম্বিকার। অম্বিকাদেবী প্রতিষ্ঠিত ছিলেন একটি পাথরের ওপর। দেবী অম্বিকার নাম থেকেই নামকরণ গ্রামের। আর অম্বিকাই হলেন দেবী দুর্গা।
মন্দির টেরাকোটায় দেবী দুর্গা দেখতে পাওয়া যায় বিষ্ণুপুরের শ্যামরাই এবং জোড়বাংলা মন্দির-গায়। শ্যামরাইয়ের মন্দিরে দেবীর সঙ্গে রয়েছেন তাঁর দুই পুত্র, দুই কন্যাও। তবে একসঙ্গে নয়। সম্ভবত জোড়বাংলা মন্দিরের গায়ে রয়েছে দেবী দুর্গাকে বাজনা শোনানো হচ্ছে।
অম্বিকা-কালনার প্রতাপেশ্বর মন্দিরের গায়ে টেরাকোটা প্যানেলে রামের অকালবোধন দেখে যেমন বিস্মিত হই, ঠিক তেমনই হই বাদামি আর পাট্টাডাকালে দুর্গামূর্তি দেখে। বাদামি, আইহোল, পাট্টাডাকালের স্থাপত্যশিল্পশৈলী অপূর্ব সুন্দর! এখানকার স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন চালুক্য রাজারা। তাঁরা ছয় শতকে রাজধানী গড়ে তুলেছিলেন বাদামিতে। সেখানকার রাজারা পাহাড় কেটে তৈরি করেন গুহামন্দির বা গুহাস্থাপত্য। বেলেপাথরের ঢাল বেয়ে শ'দুয়েক সিঁড়ি উঠলেই ডান হাতে হয়।
শতকের গুহামন্দির। এরই ডানহাতে দেবী দুর্গা বা মহিষমর্দিনী। দেবীর সঙ্গে রয়েছেন পুত্র গণেশ। দুই হাতের গণেশ। ভালভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় দেবীর সঙ্গে তাঁর অন্য সন্তানেরাও ছিলেন। আইহোলের দুর্গামন্দিরে দশভুজা দেবী দুর্গার ভাস্কর্যটি সেকালের এক অপূর্ব নিদর্শন। এখানে দেবী একাকী। অনেকেই বলে থাকেন, এটিই নাকি দেবী দুর্গার সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন। ওডিশার কেওনঝড় থেকে ৪৮ কিমি দূরে খিচিং। অতীতেরময়ূরভঞ্জ রাজাদের রাজধানী। এখানেই রয়েছে ক্লোরাইট পাথরে তৈরি কিচকেশ্বরীদেবীর মন্দির। এই মন্দিরের গায়ে আছে দেবী দুর্গার বিশাল এক ভাস্কর্য। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন দেবী দুর্গার সেই মূর্তি। দুর্গার বিভিন্ন রূপ দেখা যায় মন্দির গায়ে। সেখানে দেবী কখনও চতুর্ভুজা, আবার কখনও দশভুজা, কখনও- বা অষ্টাদশভুজা। জানা যায়, মেদিনীপুরের কানাশোল গ্রামের রাধাদামোদর মন্দিরের গায়ে দেবী দুর্গা হলেন অষ্টাদশভুজা। আবার মুর্শিদাবাদের গোকর্ণ গ্রামে নরসিংহ মন্দিরের গায়ে দেবী দুর্গা হলেন চতুর্ভুজা। এমনও দেখা গেছে মন্দিরের গায়ে দেবী দুর্গাকে এক বেহালাবাদক তার বাজনা শোনাচ্ছে।
পোড়ামাটি হোক বা পাথরের ভাস্কর্যে, দেবী দুর্গাকে শিল্পী রচনা করেছেন শান্ত, স্নিগ্ধ রূপে। তাই কখনও কখনও দেবী দুর্গা হয়ে উঠেছেন বাড়ির কন্যা রূপে, কিংবা পাশের বাড়ির মহিলার রূপে। এখনও গ্রামগঞ্জে বহু বাড়ির দুর্গাপুজোয় দেবীকে দেখা হয় বাড়ির মেয়ে হিসেবে। শুধু গ্রামগঞ্জ কেন, কলকাতা শহরের একাধিক বনেদি পরিবারের পুজোয় দেবীর আগমন হয় বাড়ির মেয়ের পিতৃগৃহে। মন্দির গায়ে দেবী দুর্গাও তাই। বাংলার একটি বহু পুরনো দুর্গাপূজা হল বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পুজো। দেবী মৃন্ময়ী হলেন মল্লভূম রাজ্যের রাজবংশের কুলদেবী। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭-এ এই পুজো শুরু করেন। এই পুজো আচার, পদ্ধতি প্রচলিত দুর্গাপুজোর থেকে অনেকটাই ভিন্ন। এখানে পূজিত হন-- বড়, মেজ এবং ছোট ঠাকুরন। মল্ল রাজবাড়ির পুজোয় তিন দেবীই পূজিত হন পটে। পুজো শুরু চোদ্দো দিন আগে। বাংলার সাধারণ দুর্গাপুজোয় এমন পটের ব্যবহার দেখা যায় না। প্রতি বছরই নতুন দুর্গাপট বানানো হয়। বিষ্ণুপুরের ফৌজদার পরিবার তৈরি করেন এই পট। বর্তমানে গোটা দশ বাড়িতে দেবী দুর্গার পুজো হয় পটে। প্রতিটি পটই আঁকেন ফৌজদার পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের শীতল ফৌজদার। তিনি বললেন, "দুর্গা পট আঁকা শুরু সোজা রথের পুণ্য দিনে।"
বীরভূমের হাটসেরান্দি গ্রামে চট্টোপাধ্যায়দের দুর্গামণ্ডপেও নেই পূজিত হন পটে। বোলপুর কাজেই হাটসেরান্দি গ্রাম। এই বর্ধিষ্ণু গ্রামেও প্রায় গোটা ষোলো বাড়িতে দুর্গাপুজো কয় পড়ে। চট্টোপাধ্যায়দের পুজো শুরুর পিছনে রয়েছে একটি কাহিনি। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ গঙ্গাপদ চট্টোপাধ্যায়ের আর্থিক অবস্থ তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু তাঁর খুব ইচ্ছে দুর্গাপুজো করবেন। মনের ইচ্ছে মনেই থাকে। হঠাৎ এক দিন তিনি দেখেন, তাঁর বাড়ির জবাগাছের নীচে বসে এক কিশোরী। তার বয়স খুব হলে পনেরো-যোলো। সেই কিশোরী গঙ্গাপদকে বলল, 'তোমার দুর্গাপুজো করার ইচ্ছে। তা তুমি ঘটে-পটে পুজো করো। মাটির প্রতিমা আনতে হবে না। অনেক কম খরচে হয়ে যাবে দুর্গাপুজো। গঙ্গাপদকে এই বলে কিশোরী উধাও হয়ে গেল। কিশোরীর কথামতো তাই করলেন গঙ্গাপদ চট্টোপাধ্যায়। সেইসময় গ্রামের এক সূত্রধর বাঁশের কাঠামোর উপর কাপড় সেঁটে পট এঁকে দিয়েছিলেন। আজও সেই সূত্রধর পরিবারের বংশ পরম্পরায় এতে। চলেছেন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপট।
শুধু বাঙালি নয়, প্রতিটি মানুষের কাছে দেবী দুর্গা হলেন পরম ভক্তিময়। দেবী দুর্গাকে আমরা অসুরবিনাশী দেখলেও তাঁর আরেক। রূপ আমরা দেখতে পাই তা হল মমতাময়ী মায়ের। তিনি অন্তভর। প্রতীক অসুর-দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে রক্ষা করেছিলেন দেবকুলকে। সকলের বিশ্বাস, এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অন্যায়- অশুভকে পরাজিত করে জয় হয়েছিল ন্যায় এবং শুভশক্তির। দেবী দুর্গা অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের আশ্রয় দানকারীও।
মোক্ষ
রজতশুভ্র মজুমদার
স্কুল রাতটা মোটেও ভাল কাটেনি নাগর দাশের। সারা রাত মশার কামড়! মশারি কা দিয়েছিল বাবুরা, কিন্তু ষষ্ঠীটা এত কুঁড়ে, কিছুতেই টাঙাতে রাজি হল না। অবশ্য সে নিজেও তো...! আসলে অতটা রাস্তা জার্নি করে ভীষণ ক্লান্ত ছিল নাগর, তাই ষষ্ঠী পুজোর ডিউটিটা কোনওরকমে সেরে, বিছানায় বডি থ্রো করতেই কখন যে ঘুমের দেশে পৌঁছে গিয়েছিল! ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘুম ভাঙল মশকবাহিনীর ডাকে। সারারাত এপাশ-ওপাশ করতে করতেই ষষ্ঠীর কাছে আবেদন রেখেছে বারবার, "ষষ্ঠীদা, ও ষষ্ঠীদা, মশারিটা খাটাও না গো!" ষষ্ঠীধর সাড়া দেবে কোথায়, সে তো মরা মোষের মতো ঘুমিয়েছে সারারাত! মশা কেন, ইনজেকশনের সূচও ওই চামড়া ভেদ করতে পারবে বলে মনে হয়নি নাগরের।
শুধু কি মশার আক্রমণ, সারারাত ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের ভেতরেই বারবার ভয়ের স্বপ্ন দেখে চমকে উঠেছে সে। একটা আতঙ্ক তো ছিলই, সেটা যে এইভাবে স্বপ্নদোষে দুষ্ট হয়ে সারা রাত তাকে তাড়া করে বেড়াবে, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি নাগর। এমনকী জল খেতে গিয়েও মনে হয়েছে, কেউ যেন ধমকের সুরে বলছে, "দাঁড়াও, খাবে না ওই জল! তোমার জল খাওয়ার কোনও অধিকার নেই!" যাঃ বাবা, জল খাওয়ারও অধিকার নেই? নাগর বিছানা থেকে উঠে বসেছে, এপাশ-ওপাশ দেখেছে ভালভাবে। নাঃ, কোথাও কেউ নেই, শুধু ষষ্ঠীদা পড়ে আছে গাছের গুঁড়ির মতো। ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে বোতল প্রায় ফাঁকা করে দিয়েছে নাগর। তারপর আবার শুয়ে পড়েছে পা ছড়িয়ে। চোখটা একটু এঁটে আসতেই ভূতের মতো একটা কালো কুচকুচে লোক হাজির হয়েছেস্বপ্নে। একটা শক্ত মোটা দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে নাগরকে, "চল তোকে পাতালে নিয়ে যাব। ওখানেই দেড় হাজার বছর বন্দি করে রাখা হবে তোকে।"
"দেড় হাজার বছর?" নাগরের গলা শুকিয়ে কাঠ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
-"চল শালা শুয়োরের বাচ্চা।" লোকটার ধমকে পিলে চমকে গিয়েছে নাগরের। ঘুম উড়ে গিয়েছে জানলা দিয়ে। ব্যাগ হাতড়ে ছোট্ট টর্চ লাইটটা বের করে, সেটা জ্বেলেই বসে থেকেছে বেশ অনেক্ষণ। আর শুতে সাহস পায়নি। যদি আবার ঘুম এসে যায়? ওই লোকটা যদি আবার আসে স্বপ্নে?
ভোরের আলো ফুটলে খানিক ঘুমোতে চেষ্টা করেছে নাগর। এবার বাদ সেধেছে ষষ্ঠীধর, "উঠে পড় নাগর, মণ্ডপে যেতে হবে না?"
- "ধুস শালা, ভোরবেলা মণ্ডপে গিয়ে ছিড়ব নাকি?" প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছে নাগর।
"আবার ভোর কোথায়, ওঠ, চোখেমুখে জল দে! সকালের বাজনাটা বাজাতে হবে না?" "এখনই?" নাগরের গলায় বিস্ময়।- "এই
প্রথম দুগ্গাপুজো নাকি তোর? শোন বে, বাবুরা খুব ভাল বলেই আমার এককথায় তুই কাজ পেয়েছিস এখানে। বেশি বোলচাল দিলে না..."
"আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। বলো কী করতে হবে," গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছে নাগর। সত্যিই তো, ষষ্ঠীদার কাছে তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। ষষ্ঠীদা কাজটা জুটিয়ে না-দিলে, কী গতি হত তার? সেই দক্ষিণ ২৪ পরগণার মন্দিরবাজার থেকে এই বীরভূমের নলহাটিতে এসে খেয়েদেয়ে কড়কড়ে সাড়ে চার হাজার টাকা ইনকাম করে ফেলা সম্ভব হত? গত দু'বছর তো কোনও কাজই পায়নি সে। এবার ষষ্ঠীধরকে খুব করে বলে রেখেছিল, "একটু দেখো ষষ্ঠীদা, যদি তোমাদের ওখানে চান্স পাওয়া যায়!"
"ওখানে কাজ পাচ্ছিস না?"
"না।"
"কাঠের ঢাক আছে তো? নাকি পাতের
খোলের?"
"বাবার ঢাকটা ছিল কাঠের গুঁড়ির খোলের ওপর চামড়া দিয়ে তৈরি। নিম কাঠের খোল। ছ'সাত হাজার টাকা দাম। চামড়াটা ফেঁসেছিল। সারালাম। হাজার তিনেক টাকার ধাক্কা। দল, কাঁধি, মোকপাতি, কোঁড়ল- সব নিয়ে এ-মালটার বর্তমান বাজার দর দশ হাজার টাকার বেশি, বুঝেছ?" নাগর ঢোক গিলে বলেছিল, "পাতের খোলের মাল তো হেব্বি সস্তা!"
- "হুঁ। পাতের খোলের বর্তমান দাম আড়াই থেকে তিন। আর ফাইবারের চাদরের দাম পড়ে আড়াইশো থেকে তিনশো টাকা। সবমিলিয়ে একটা পাতের ঢাকের দাম বড়জোর ছ'হাজার।
তাই ঢাকিরা এখন কাঠের বদলে পাতের খোলের ঢাকেই ঝুঁকছে। কিন্তু আমি যে পুজোয় বাজাই, সেখানে পাতের খোল চলে না, তাই জিজ্ঞেস করলাম তোকে।"
"বাবা তো চোখ উলটেই খালাস! এমন মালটা রেখে গেল, শালা ত্রিশ কেজি ওজন। বাজানোর সময় কাঁধে ব্যথা ধরে যায়। তাছাড়া বাইরে বাজাতে যাওয়ার সময়, নিয়ে যাওয়া আসার বাক্কিও কম না।"
"পাতের খোলের ঢাকের তো ওজন অনেক কম! কিন্তু বাজিয়ে কি মন ভরে, বল?"
"মন ভরে কী হবে, পেট ভরলেই হল!" "কাঠের খোলের ঢাকের বোলই আলাদা।
কত্ত গুরুগম্ভীর! আরতি, বলি থেকে শুরু করে ভাসানের বাজনার তারতম্যটা অনায়াসেই ধরা যায়!"
"তোমরা শিল্পী মানুষ, তোমরা বুঝবে ষষ্ঠীদা। আমরা অতশত বুঝি না।"
"না রে নাগর, এখনকার পাতের খোলের ঢাকের বাজনা শুনে পুজোকত্তারা বলেন, কী হে ঢাকি, তোমাদের সবেতেই যে দেখছি, কেমন খাপছাড়া বোল উঠছে! আমরা তো আর বলতে পারি না, হাল আমলের ঢাকের ভারের সঙ্গে বাজনার ধারও খানিক কমে গিয়েছে বাবু! খাজনা
যেমন দেবেন, বাজনা তো তেমনই হবে!" "যা বলেছ!"
"শোন আমি গত দশ বছর ধরে এখানকার ধোপাপাড়ার সিংহবাহিনী পুজোয় বাজাই। বাবুরা খুব ভাল। আমি চেষ্টা করছি সামনের বছর তোকে নিয়ে আসার। দু'জনে খুব মস্তি করব, বুঝেছিস?"
- "হ্যাঁ, তাই করো। আমি যাব।"
বাধ্য ছেলের মতো দ্রুত তৈরি হয়ে নেয় নাগর। ষষ্ঠীধর বলে, "ভাল বাজিয়ে বাবুদের মন জয় করতে পারলে, বছর বছর চান্স পাবি এখানে।"
--" দুগ্গাপুজো এমন একটা উৎসব যেখানে দোলা আনা, আরতি থেকে বিসর্জনে ঢাকের কাঠিতে ফুটে ওঠে ভিন্নমাত্রার বোল।" "হুঁ।"
"এত বৈচিত্র আর কোনও পুজোয় নেই।" "হুঁ।"
"কী হুঁ হুঁ করছিস বল তো!" ষষ্ঠীধর রেগে যায়। নাগর দাশের মন উড়ুউডু। দূর বড় রাস্তার ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাওয়া পুলিশের গাড়ির দিকে নজর তার। নিশ্চয়ই রুটিন টহলে বেরিয়েছে পুলিশ। তবু নাগর দাশের বুক ধক ধক করে। ষষ্ঠীকে কি কিছু বলা উচিত? "নাঃ, থাক," নাগর স্বগতোক্তি করে। তারপর ষষ্ঠীধরের চোখেরেখে বলে, "আমি ভাল বাজাব।" ষষ্ঠীধরের কাছে নাগর শোনে, একটু পরেই ধোপাপাড়ার সুসজ্জিত শোভাযাত্রা বাজনা সহযোগে হাজরাপুকুর থেকে ঘট ভরে আনতে যাবে। এ এক দারুণ উৎসব। পুকুরপাড়ে প্রচুর বাজি ফাটানো হয়। সারা বছর ধরে এলাকার ছেলে-ছোকরারা সপ্তমীর এই সকালটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। "নে, এগুলো তোর জন্য," কয়েকটা বাজির একটা ক্যারি প্যাকেট নাগরের দিকে এগিয়ে দেয় ষষ্ঠীধর।
"আমি... মানে...." নাগর প্রস্তুত ছিল না মুহূর্তটার জন্য।
"শোন, জীবনটা বড্ড ছোট। যে ক'দিন বাঁচবি, হেসে-খেলে আনন্দ করে বাঁচবি। একা আনন্দ করবি না, দশজনে আনন্দ করবি, মা খুশি হবেন," ষষ্ঠীধরের মুখে চওড়া হাসি।-- "ঠিক বলেছ," নাগর অনেক কষ্ট করে হাসে।
- "ঠিক তো বলেছি, কিন্তু তোর মনে এত অশান্তি কেন? কাল থেকে তো একবারটিও হাসতে দেখলাম না!"
"কই, না তো!"
"শোন, দুঃখ-কষ্ট সকলেরই আছে।
তার মধ্যেই আনন্দ নিতে হবে। আনন্দ দিতে হবে। তুই যদি কাউকে কষ্ট না-দিস, কারওর ক্ষতি না-করিস, মা তোর ভাল করবেনই। আমি এই কথাটা খুব বিশ্বাস করি। সারা জীবনে অনেকবার টের পেয়েছি এই সত্যিটা।"
- "হুঁ, আমিও চেষ্টা করি মানুষের ভাল করার।"
- "এই তো কথার মতো কথা। যত দিন বাঁচবি, অন্যকে খুশি রাখার চেষ্টা করবি। জানবি নিজে খুশি থাকার এর চেয়ে ভাল উপায় আর কিছু হয় না," ষষ্ঠীধর নাগরকে জড়িয়ে ধরে, "চল, এবার মণ্ডপে যেতে হবে।"
"চলো।"
নাগরের ঢাকে বোল ফুটছে কই? সে কী করে বাবুদের মন জয় করবে? ষষ্ঠীধর ঢাকে শিল্প ফোটায়, তার পাশে নাগর নিতান্তই ম্যাড়মেড়ে। ঢাকের চুল উড়িয়ে ষষ্ঠীধর ইশারা করল নাগরকে, "নাচ!" নাগর কোনও উত্তর দিল না। সে নাচবে কী করে, তার মন তো পড়ে আছে মন্দিরবাজারে! পাশের বাড়ির অঙ্কিতাটা তাহলে সত্যি-সত্যিই সুইসাইড করল?
সে তো নিজে দেখেনি গলায় দড়ি দেওয়া ঝুলন্ত দেহটা। তা দেখেনি, কিন্তু নিজেরা কানে তো শুনেছে স্পষ্ট! তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। আলো ফুটলেই ষষ্ঠী, বাতাসে পুজোর গন্ধা নাগরের ঘুম পাতলা, অঙ্কিতার মায়ের ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দে তড়াক করে বিছানা থেকে লাফ দিল সে। দু'বাড়ির একটাই পাঁচিল। মুখ বাড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল নাগর। বাড়িতে হালকা জটলা। ওরই মধ্যে নাগর শুনতে পেল, "আর হাসপাতাল নিয়ে গিয়ে কী হবে, ধড়ে তো প্রাণ নেই।" বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা নিরাপদ নয়। ব্যাগ গোছানোই ছিল। মোবাইল থেকে সিম আর মেমরি কার্ডটা বের করে নষ্ট করে ফেলল সে। ঢাকটা কাঁধে তুলে, সকলের নজর এড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। গুটিগুটি পায়ে গলি রাস্তা দিয়ে এগোতে লাগল চোরের মতো। ঘোলাটে অন্ধকারে কালো হয়ে আছে চারপাশ। অঙ্কিতাদের বাড়ি থেকে তখনও ভেসে আসছে কান্নার শব্দ! কেউ একজন কাঁদতে কাঁদতে বলছে, নাগর কান খাড়া করে শুনল, "নতুন বাড়িতে যদি উঠে যেতে তোমরা, আজ এমন কাণ্ড ঘটত না! সবই কপাল, অদৃষ্টের লিখন!" নাগর জানে, ওদের বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে দরমার বেড়া দেওয়া একটা নতুন বাড়ি বানিয়েছে অঙ্কিতার বাবা। বাড়িটা বেশ অনেকদিন ধরেই হচ্ছিল, মাসখানেক হল কাজ শেষ হয়েছে। অঙ্কিতার বাবা ট্রেনের হকার, অভাবের সংসারে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে বাড়িটা বানিয়েছিল। নাগর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কেউ তার পিছু নেয় নি তো! হ্যাঁ, নিয়েছে তো! ও-বাড়ির কান্নাগুলো, কথাগুলো কিছুতেই পেছন ছাড়ছে না তার। বড় রাস্তায় উঠেও সে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, "এইটে ওঠার পরীক্ষায় সব ক'টা 'এ' পেয়েছিল মেয়েটা। কত স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলি মা! আর সেই তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি এইভাবে? আমি এবার কী করে বাঁচব বল?"
"ঈশ্বর এর বিচার করবেন!"
"পুলিশ কখন আসবে গো? এখনও এল না কেন?"
একটু একটু করে আলো ফুটছিল চারপাশে। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল পিচ রাস্তা, ঝাঁপবন্ধ দোকানপাট, কাশফুলগুলো, কাঁধের ব্যথাটা...। তারপর রোদ ওঠা, ইতস্তত ঘোরাফেরা, পেট টুইটুই, গরমকচুরি...। তারপর গাড়ি ভাড়া, ভিড়ের স্টেশন, শিয়ালদা-রামপুরহাট লোকাল ট্রেন, ট্রেন বদল, নলহাটি...! ষষ্ঠীধর আবার ইশারা করল, "শালা, নাচ!" ঢাকের চুল উড়িয়ে ষষ্ঠীদার আদেশ মান্য করার চেষ্টা করল নাগর। কিন্তু সে নাচ এতই নিষ্প্রাণ, জৌলুসহীন যে অনতিবিলম্বেই তার পরিসমাপ্তি ঘটল। ধোপাপাড়ার সুসজ্জিত শোভাযাত্রা এখন তুমুল বাজনা সহযোগে পুকুরপাড়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। পেছনে পেছনে আসছে ছোট বোন এই ছোট বোন হল, নলহাটিরই কামারপাড়ার দুর্গা-মা। নলহাটিতে সিংহবাহিনীর পুজো হয় দুটো ধোপাপাড়ার মা বড় বোন, আর কামারপাড়ার মা ছোট। রাস্তার দু'ধারে বিপুল মানুষ তারা বাজি ফাটাচ্ছে, চিৎকার চ্যাঁচামেচি...। ঢাকের শব্দে কান পাতা দায়। উল্লাসে ফেটে পড়ছে নারী-পুরুষ-শিশু। বছরের এই ক'টা দিন দুটো সিংহবাহিনীর পুজো ঘিরে এলাকার মানুষের মনে আনন্দের ঢল নামে। উৎসবের অপার্থিব আনন্দে জাতি-ধর্ম- বর্ণ-বৈরিতা ভুলে, মানুষ মানুষের কাছে আসে। এই নৈকট্য, এত আনন্দ নাগর কখনও দেখেনি জীবনে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এই বিশাল আনন্দযজ্ঞের দিকে। এত মানুষ একসঙ্গে এইভাবে আনন্দ করতে পারে? আনন্দ তার কাছে রমলা বউদির ভারী নিতম্বের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আনন্দ বলতে সে বুঝত, নির্জন গলির আধো অন্ধকারে আচমকা রমলা বৌদির পথ আটকে এক হ্যাঁচকায় বাঁ হাতটা টেনে ধরে 'আমি সত্যিই তোমাকে ভালবাসি' বলা।
"আর একবার যদি এমন করেছিস, আমি পাড়ার লোক ডেকে তোর গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো করে ছাড়ব।"
"অত বড় বড় কথা বোলো না বউদি, অত দেমাক ভাল না!"
"তুই যাবি এখান থেকে?"
"আজ রাতে দাদা আসবে?"
"তোর কী দরকার সে খবরে?"
"একদিন শুলে কী হবে গো বউদি, মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? দাদা তো প্রায়ই আসে না। তাছাড়া এলেই-বা কী, মালটা তো পুরো নারকোলের ছিবড়া! আর পারে কিছু?"
"তোর লজ্জা করে না শুয়োরের বাচ্চা?"
"লজ্জা কেন করতে যাবে! আমার মতো পুজো করতে ক'জন পারে? এমন ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো করব, তুমি কেন, স্বয়ং মা-দুর্গাও ফিদা হয়ে যাবে! লজ্জা করবে, ফুঃ! লজ্জা তো তোমার ভাতার করবে গো! আমি গর্ব করি, বুঝেছ?" নাগর প্যান্টের পকেটে হাত ভরে কুশ্রী ইঙ্গিত করে তখনকার মতো দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছে। তারপর ঘন্টার পর ঘণ্টা ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করে থেকেছে রমলা বউদির কাপড় ছাড়া দেখবে বলে। ঘরে খিল দিয়ে রমলা বউদি ভিজে কাপড় খুলে বিশাল বুকের ওপর ঘামাচি গেলেছে নিশ্চিন্তে, পাউডার ছড়িয়ে নিয়েছে অনেকক্ষণ ধরে। কখনও জানতেও পারেনি, বিকৃতকাম নাগর দাশ সুকৌশলে সমস্তটা চেটেপুটে খেয়ে, আরও ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে ক্রমশ। ঘুণধরা কপাটের গায়ে নাগরের তৈরি ছিদ্র রমলা বউদিদের অগোচরেই ছিল। নাগর দাশের কাছে আনন্দ ওই ছিদ্রের মতোই সংকীর্ণ, ক্ষুদ্র, অন্ধকারাচ্ছন্ন। হাজার টোপ দিয়েও কোনওদিন রমলা বউদিকে ভোগ করতে না-পেয়ে, তীব্র প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলে ওঠাতেই তার আনন্দ, "দাঁড়া শালি, তোকে দেখাচ্ছি।"
- "তোর ঘরে মা-বোন নেই?" "ওই বেঢপ চেহারার আবার দেমাক! ছিঃ, থুথু
ফেলি।" "তোর মায়ের চেহারা বুঝি আরও ভাল?"
"চুপ মাগি, তোকে এমন শিক্ষা দেব না।"
"তোর মত মিনসেকে আমি গারদে ভরতে পারি রে!" রমলা বউদির কোনওদিন সাহস হয়নি পুলিশে যাওয়ার। মুখে ফোঁস করা ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোনওদিনই কিছু করে উঠতে পারেনি সে। স্বামীকে বলেও কোনও লাভ হয়নি। নাগরের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা সে বেচারি পরামর্শ দিয়েছে, "চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই!"
"হ্যাঁ ঠিকই বলেছ, তুমি ওই ব্যবস্থাই করো। এ-পাড়ায় ওর যতই দাপট থাক, পাড়ার বাইরে নাগর কেঁচো।"
"তুমি খুব সাবধানে থেকো।"
"হ্যাঁগো, ও আমাদের কোনও বড় ক্ষতি করে
দেবে না তো?"
এই মুহূর্তে হাজরাপুকুর পাড় জনসমুদ্রের চেহারা নিয়েছে। বাজির আলোয় ভরে উঠেছে আকাশ। মানুষের বৃহত্তর আনন্দসাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ষষ্ঠীধরের নাচের কাছে, ভাসিয়ে দিচ্ছে মানুষের ক্ষুদ্রতর স্বার্থ, সংকীর্ণ চাহিদা, ছোট ছোট রেষারেষি। ওই আনন্দ- জলেই মঙ্গলঘট ভরে নেওয়া হচ্ছে। ধোপাপাড়ার সিংহবাহিনীর দুর্গা-মা সাংঘাতিক জাগ্রত। অনেক অলৌকিক কাহিনির ইতিহাস আছে এই পুজোর। পুজোর বয়সও তো কম হল না-- নয় নয় করে প্রায় এক হাজার বছর! কথিত আছে, সেইসময় তালপাতার ছাউনি গড়ে মৃন্ময়ী মূর্তির আরাধনা করতেন মুনি-ঋষিরা। বাংলার ১৩৫৭ সনে পুজোর দায়িত্বভার যায় নলহাটির ধরমপুর গ্রামের রাধাশ্যাম ভট্টাচার্যের হাতে। পরবর্তী কালে তিনি গ্রাম থেকে এসে নলহাটিতে মন্দির বানিয়ে পুজো শুরু করেন। আরও পরে অর্থাভাবে পুজো বন্ধ হয়ে যায়। মন্দিরের গায়েই ছিল অভয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের বাস। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। সেসময় তিনি মায়ের কাছে সন্তান চেয়ে মানত করেন। মা তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন, "মন্দির সংস্কার করে ফের পুজো শুরু করলে, পুত্রসন্তান লাভ করবি।” সেই বছরই অভয় বন্দ্যোপাধ্যায় মন্দির পাকা করে পুজো শুরু করেন। পরে তিনি পাঁচ-পাঁচটা সন্তানের জনক হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে পুত্র সন্তানই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই থেকে বহু মানুষ সন্তান লাভের আশায় মা-দুর্গার কাছে মানত করেছেন এবং সফলকাম হয়েছেন। শুধু কি তাই, জনশ্রুতি আছে, একসময় পুজোর সামগ্রী মা নিজেই জুটিয়ে নিতেন। পঞ্চমীর দিন নিষ্ঠা সহকারে পুজোর সামগ্রী চেয়ে হাজরাপুকুরে দেবীর আরাধনা করা হত। ষষ্ঠীর দিন সকালে অলৌকিকভাবে এই পুকুরপাড়েই মিলত পুজোর সামগ্রী। পুজো সারা হলে আশ্চর্যজনকভাবে পাওয়া ওই সামগ্রী পুকুরের জলেই ভাসিয়ে দেওয়া হত। একবার হয়েছিল কী, রাধাশ্যাম ভট্টাচার্যের কাছ থেকে পুজোর রেকাবি চুরি গিয়েছিল! কী আশ্চর্য, ওই ঘটনার পর থেকে আরাধনা সত্ত্বেও আর মিলত না পুজোর সামগ্রী। এইসব গল্প স্থানীয় মানুষই শুনিয়ে দিয়েছে নাগরকে। ষষ্ঠীধরও কিছু কিছু জানে। সে সমর্থন করেছে। সব শুনেটুনে নাগরের মনে ভয় ঢুকেছে, দুর্গা-মা আবার শাস্তি-টাস্তি দেবে না তো তাকে? রাধাশ্যামের রেকাবি চুরির পর আর আরাধনা সত্ত্বেও পুজোর সামগ্রী মিলত না কেন? "দুষ্টের দমনে এই মা ভীষণ সিদ্ধহস্ত, বুঝলি নাগর?" ষষ্ঠীধরের আপাত নিরীহ কথায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে নাগরের। মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে, "বাঃ, দারুণ তো!" আর মনে মনে ভাবে, "এ-কোথায় এলাম রে বাবা, ভালয় ভালয় ফিরে যেতে পারলে হয়!" অবশ্য ফিরে সে যাবেই- বা কোথায়? গেলেই তো পুলিশ ধরবে তাকে! এই নলহাটিতে আসার ব্যাপারটা কাকপক্ষীও জানে না বলেই, এখনও অব্দি পুলিশ টের পায়নি মনে হয়। এমনকী এখানে আসার কথা মা-বোনকেও জানিয়ে আসেনি নাগর, ওরা জানে আশপাশে কোথাও বাজাতে গিয়েছে ছেলে! কী তীব্র মানসিক অশান্তিতে যে এখানে প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে তার!
ঘট ভরে আনা হল, সপ্তমীর পুজো হল, বলিদানের সময় অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল নাগরের। নলাটেশ্বরী মন্দিরে বলিদান পর্ব
সাঙ্গ হলে, সেই খড়গ নিয়ে ঢাক সহযোগে পুরোহিতরা আসেন ধোপাপাড়ার সিংহবাহিনী মন্দিরে। এটাই এখানকার রীতি। বলিদানের সময় নাগরের মনে হল, দেবী যেন ক্রুর চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে। কয়েক সেকেন্ডের সেই দৃষ্টিতেই যেন লেখা আছে মহাধ্বংসের ক্রোধ। নাগরের হাত-পা অসাড় হয়ে আসে ক্ষণিকের জন্য। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। কেউ না-বুঝলেও ষষ্ঠীধর বোঝে, "তোর কি শরীর খারাপ লাগছে খুব?"
"না ঠিক আছি।"
"বলি দেখতে পারিস না বুঝি? রক্ত দেখলে এমন হয়?"
-- "হ্যাঁ ষষ্ঠীদা, তুমি কি করে জানলে?"
"জল খাবি?"
সপ্তমীর সন্ধ্যারতির ঠিক আগে নাগর
ফিসফিস করে ষষ্ঠীধরকে বলল, "কালও বলিদান আছে?"
"সপ্তমী থেকে নবমী, প্রতিদিন এখানে বলিদান হয়।"
"কি হবে তাহলে?" নাগরের গলায় উৎকণ্ঠার সুর।
"তোর চিন্তা নেই, আমি তো আছি।" -
"বাবুরা কিছু বলবে না তো?"
"বলিদানের সময় তোকে থাকতে হবে না, আমি ম্যানেজ করে নেব।"
"ষষ্ঠীদা তুমি সত্যিই..."
অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় আবার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হল নাগর। আরতির বাজনা বাজাতে বাজাতে হঠাৎই ঢাক সমেত মাটিতে আছাড় খেল সে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্ঞানও হারাল। উপস্থিত লোকজনের সেবা-শুশ্রূষায় অবশ্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই উঠে বসল নাগর, "মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল।" মুখে এ-কথা বললেও মনে মনে তো সে জানে, কী ভয়ংকর দৃশ্য দেখে অমন কাণ্ড ঘটেছিল! নাগর দেখেছিল, হ্যাঁ স্পষ্ট দেখেছিল, মা-দুর্গার ভেতর থেকে আরেকটা মা-দুর্গা বেরিয়ে হনহন করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। মুহূর্তে বনবন করে ঘুরতে লাগল পৃথিবী, অন্ধকার হয়ে উঠল চারপাশ। নাগর বুঝতে পারল, তার সারা শরীর বরফের মত ঠান্ডা, চোখের পাতা খুলছে না আর। এরপর যখন জ্ঞান ফিরল, মাথার গোড়ায় অনেক মানুষ, চুল ভিজে আছে জলে ষষ্ঠীধর তখনও বাজিয়ে চলেছে বিরামহীন। কী করবে, সন্ধি পুজোর বাজনা থামানো যায় না যে!
অষ্টমীর রাতেই বাবুরা নাগরকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। সব দেখেশুনে ডাক্তারবাবু বললেন, "ঠিকঠাক ঘুম না-হওয়া আর খালি পেটে থাকার জন্য এমন হয়েছে। চিন্তার কিছু নেই, দুটো ওষুধ দিলাম।" নাগরের জন্য এলাকার মানুষের মনে সহমর্মিতা তৈরি হলেও, ষষ্ঠীধর কিন্তু আঁচ পেল, তল্লাটে কানাঘুষো শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে "আচ্ছা লোকটা পাপী নয় তো?"
"হতেই পারে। নাহলে এরকম ঘটনা ঘটবে কেন?
- "বছর কুড়ি আগে এই মন্দিরেই তো এক পুরোহিত মায়ের রোষে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল।"
- "হুঁ, গল্পটা বাবা-জ্যাঠাদের মুখে আমরাও শুনেছি। পরে জানা গিয়েছিল, লোকটা মাতৃ হন্তারক ছিল।"
এসব শুনে স্বভাবতই ষষ্ঠীধরের মন খারাপ হয়ে যায়। অনেক রাতে লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে, সে নাগরের বিছানায় ঝুঁকে পড়ে বলে, "হ্যাঁরে নাগর, তুই সত্যিই কোনও পাপ করিসনি তো?" নাগর পাশ ফিরে বিরক্তিভরে উত্তর দেয়, "ধুস শালা, মশারিটা খাটাও তো!"
"আমার বড্ড ভয় করে রে।"
"মাঝরাতে নাটক কোরো না ষষ্ঠীদা, আমাকে ঘুমোতে দাও দিকি।"
ঘুমোতে কি পারে নাগর? অঙ্কিতার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কী কুক্ষণেই-না অঙ্কিতার ন্যাংটো ছবির ভিডিও করতে গিয়েছিল সে! মেয়েটা একান্তই বাচ্চা, ছিপছিপে চেহারা, না-আছে পাছার কাজ, না-বুকের! তবুও তিন মিনিট ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে পোশাক বদলের ভিডিও তুলেছিল নিজের মোবাইলে। ওই ভিডিয়োটাই যত কাল হল! শুধু কি ভিডিয়ো তোলা, ওই ভিডিয়ো নিয়ে ব্ল্যাকমেলিং করতেও হাত কাঁপেনি তার। আর এখন ভয় পেলে চলবে? মন শক্ত করে নাগর নিজেকে বোঝায়, "ভয় পেয়ো না নাগর, কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না। দুর্গা হল আসলে মাটির দলা, তাকে ভয় পাওয়ার কিচ্ছুটি নেই। সপ্তমীর দিন বলিদান কিংবা অষ্টমীর সন্ধিপুজোর সময় দেবতার ওই রূপ আসলে তোমারই মনের দুর্বলতা ছাড়া কিছু নয়। ডাক্তারবাবুর ওষুধগুলো ঠিকঠাক খাও আর বীরের মতো বাঁচো!"
বীরের মতো আর বাঁচবে কী করে! দুর্গা- মা কিছু না-করতে পারুক, পুলিশ তো তাকে ধরবেই! শুধু সময়ের অপেক্ষা! যে ভয়ে এতদিন রমলা বউদি পুলিশের কাছে নালিশ করতে পারত না তার নামে, সেই ভয়টাই তো সে ভ্যানিশ করে দিয়ে এসেছে চিরতরে। এর থেকে ব্লান্ডার আর কী হতে পারে? এখন তো রমলা বউদি খোঁচা খাওয়া বাঘিনীর থেকেও ভয়ংকর নিশ্চয়! পঞ্চমীর দিন ভরসন্ধেয় শৌচালয়ে যাওয়া রমলা বউদির পথ আটকে, তীর প্রতিশোধস্পৃহায় সে যখন অঙ্কিতার ন্যাংটো ভিডিয়োটা দেখিয়েছিল তাকে, তখনও কি ভাবতে পেরেছিল এই পরিণতি অপেক্ষা করছে তার জন্য। ভিডিয়োটা দেখে মুহূর্তগানেক। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল রমলা বউদি। হো হো করে হাসতে হাসতে নাগর বলেছিল, "আজ না-শুলে এই ভিডিয়ো আমি ইন্টারনেটে ফাঁস করে দেব। দেখি তুমি কী করতে পারো।" নাগর বুঝতেও পারেনি, ঘরের ভেতর থেকে অঙ্কিতা সব কথাই শুনে নিয়েছিল কান খাড়া করে। তারপর রাত্রি গভীর হলে, সারা পৃথিবী যখন ঘুমের ঘোরে, সে কলঙ্কভাগী তীব্র আবেগে, সন্ত্রাসে ঝুলে পড়াকেই তার একমাত্র মোক্ষ বলে বিবেচনা করেছিল! অষ্টমীর রাতেও একমুহূর্ত ঘুমোতে পারেনি নাগর। এখন নবমী পুজো শুরু হয়েছে। মণ্ডপেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে ঢাকিরা। আরও জনা দশেক ঢাকি আসবে কাল। রাত পোহালেই দশমী। ধোপাপাড়া আর কামারপাড়ার দুই সিংহবাহিনী মন্দিরের দুই দেবীকে নিয়ে বিশাল শোভাযাত্রা বের হবে নলহাটি শহরে। দুই বোনকে নাচাতে নাচাতে গোটা শহর প্রদক্ষিণ করা হবে।
কে কতটা আনন্দ করবে, কার কতগুলো বাজি অবশিষ্ট আছে- এসব নিয়েই সারা শহরে চলছে আলোচনা। শেষে হাজারাপুকুরের দুই পাড়ে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে দুই বোনকে দেওয়া হবে নিরঞ্জন। নাগর একমনে তাকিয়েছিল পুজোর দিকে। এমন সময় হঠাৎই বহু পুরনো মন্দিরের ছাদ থেকে একটা বিরাট চাঙর ভেঙে পড়ল নাগরের মাথায়। ভয়ংকর আর্তনাদ করেই নাগর দেখতে পেল, মা-দুর্গা স্বয়ং তার সামনে উপস্থিত! মূর্তি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নাগরের সামনে দাঁড়িয়েছেন! কিন্তু মুখটা কার? এ তো রমলা বউদির মুখ দুর্গা-মায়ের শরীরে! তাকাতে পারছে না নাগর, পৈশাচিক যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর! মাথার কিছুটা অংশ থেঁতলে মিশে গিয়েছে মাটিতে। ঘিলু বেরিয়ে এসেছে বাইরে। দেবী দুর্গা রমলা বউদির মুখে বলছেন, "নাগর তোর শেষ সময় উপস্থিত। মায়ের শরীরে তুই লোভ করেছিস। আমার একমাত্র সন্তানকে তুই মেরে ফেলেছিস। অঙ্কিতাই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল। তাকেই তুই কেড়ে নিয়েছিস। তোর বেঁচে থাকার আর কোনও অধিকার নেই। পৃথিবীর কোনও শক্তিই আর তোকে বাঁচাতে পারবে না।" নাগর অস্ফুটে উচ্চারণ করল, "ক্ষমা করো, মা।"
মণ্ডপের লোকজন যখন চাঙর সরিয়ে নাগরকে উদ্ধার করল, তখন আর শরীরে তার প্রাণ ছিল না..
সমাদ্দারের খাতির যত্ন
সন্দীপ মুখোপাধ্যায়
"শিয়ালদহ যাওয়ার লাস্ট ট্রেন কখন বলবেন"? ভদ্রলোক মাথা নামিয়ে বসেছিলেন। প্রশ্ন শুনেই তাকালেন।
"এমনিতে সাড়ে নটা। তবে আজকে আর পাবেন না। ডাউন লাইনে কাজ হচ্ছে। ঘোষণা হয়ে গেছে অনেক আগে। আজ সাড়ে নটা ক্যানসেল"।
মাথায় বাজ পড়লো অন্তরার। বাড়ি ফিরবে কি করে? এই বিদঘুটে জায়গায় থাকবেই বা কোথায়? ঘোষণা হয়ে গেছে মানে কি? এটা কি ইয়ার্কি নাকি? এখন উপায়? মোবাইল ফোনে চার্জ যা আছে মেরে কেটে আর মিনিট পনেরো চলবে। কাজটা শেষ করতে এতো দেরী হবে কে জানতো। কোলকাতার আন্দাজে খুব দেরী হয়নি এখনো, কিন্তু এখানে এটা বেশ রাত্রি। খুব মেপে ফোন করতে হবে। একটা বাড়িতে, আরেকটা রাতুল কে। "রাতুল, লাস্ট ট্রেন ক্যানসেল। কি করি বলতো? বেশ ভয় লাগছে রে। কোথায় থাকব এখানে? একদম ভুলভাল জায়গা
তো"।
"ওহ গড। কি বলছিস রে? শোন, স্টেশনে কথা বল। স্টেশন মাস্টারকে খোঁজ। ভুলভাল কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। ভয় পাস না। আমায় যখন খুশী ফোন করিস"।
"তুই একটু মা কে বলে দে তো। আমি কাল ফার্স্ট ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবো। আমার ফোনের চার্জ প্রায় শেষ। দেখি কি করা যায়"।
এক ভদ্রলোক একটি ছোট্ট ঘরে বসে ঢুলছিলেন। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে স্টেশন মাস্টার হলেও হতে পারেন। অন্তরা দু তিন বার 'শুনছেন শুনছেন। বলাতে ধড়ফড় করে উঠে বসলেন।
"শিয়ালদহ যাওয়ার লাস্ট ট্রেন শুনলাম ক্যানসেল। একটু বলতে পারেন এখানে ধারে কাছে কোথায় রাত্রি কাটানো যেতে পারে? এনি আইডিয়া প্লিস"?
ভদ্রলোকের বয়স ষাট এর ধারে কাছে। বেঁটে, একদম রোগাটে গড়ন, মাথায় চুল খুব কম। মুখ দেখলেই বোঝা যায় এই চাকরীতে আর মন নেই ওনার। অন্তরাকে খুব ভালো করে একবার দেখলেন উনি।
এই সময় এতো ঝকঝকে মহিলা এই অঞ্চলে দেখবেন তিনি কল্পনাতেও আনতে। যেতে পারেন কিন্তু। আমার এই
পারেননি বোধহয়। একটু নড়ে চড়ে বসলেন।
"থাকার জায়গাতো এখানে কিছু পাবেন না আপনি সেরকম। হোটেল। নেই কিছু। একটা লজ আছে বটে কিন্তু বেশ কিছুটা দূর। আর একদম থাকার মতো নয়"।
"কতটা দূর? রিকশা পাবো না? একটু যদি সাহায্য করেন দয়া করে"।
এমনিতেই মহিলা দেখলে পুরুষ মানুষরা সাহায্য করতে চান। তাঁর উপর আবার যদি সুন্দরী মহিলা হন, কথাই নেই। তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। আরেকবার অন্তরাকে দেখলেন। সেই দেখায় কোনও পাপ নেই যদিও কিন্তু একটা হাল্কা বাড়তি উৎসাহ আছে।
"আপনি যদি কিছু মনে না করেন,
আপনাকে একটা প্রস্তাব দিতে পারি"? প্রস্তাব? একটু ঘাবড়াল অন্তরা। "না না মনে করবো কেন? বলুন না"।
"এখান থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট পনেরো আমার কোয়ার্টার। বাড়িতে গিন্নি আছেন। আপনি থাকতে পারেন আজকের রাতটুকু নিশ্চিন্তে আমাদের ওখানে"।
তিনবার বিপ বিপ শব্দ করে মোবাইল ফোন দেহ রাখল। অন্তরা কি উত্তর দেবে বুঝে পেলনা। একটা সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা লোক, একটা অপরিচিত মহিলাকে এতো রাতে তাঁর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অফার দিচ্ছে? গ্রামের দিকের মানুষ কি একটু বেশী সরল হয়? উনি কি বুঝলেন না যে ওনার এই অনুরোধ সম্পূর্ণ অন্য মানে তৈরি করতে পারে? হয়ত খুব সরল এঁরা, অন্তরা অনেক জটিল ভাবছে সবটা।
"না না আপনার বাড়ি নয়। একদম উচিত হবেনা আপনাকে বিব্রত করা। আপনি ধারে কাছে কোন থাকার জায়গা থাকলে যদি একটু বলে দেন। আমি চলে যাবো। রিক্সা পাবনা? পেয়ে যাবো নিশ্চয়ই। এমন কিছু রাত হয়নি কিন্তু"।
এবার ভদ্রলোক বেশ বুঝলেন অন্তরা লজ্জা পাচ্ছে। সেটা স্বাভাবিক। চেনে ঘ. জানে না দুম করে কারো বাড়ি যাওয়া যায় নাকি?
আপনি বিনা দ্বিধায় আমার সাথে অভিজ্ঞতা প্রথম নয়। আজ বাইশ বছর করছি এই কাজ। এর আগে কম পক্ষে জনা দশেক মানুষ আমার বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিলেন। শেষ ট্রেন ধরা ব্যাপারটাই খুব রিস্কি এখানে। সুতরাং আপনি চাইলে যেতেই পারেন। আমি কাউকে বলে দিলে আপনাকে হয়তো কোথাও নিয়ে যাবে থাকার জন্য, কিন্তু সেটা খুব নিরাপদ হবেনা। এবার আপনার ডিসিশন"। এই বলে ভদ্রলোক তাকিয়ে রইলেন অন্তরার দিকে।
ভয় ডর পাওয়ার মেয়ে নয় অন্তরা খুব। কি আর হবে? ভদ্রলোক একজন কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। ভরসা করা যেতেই পারে। কোনও বদ মতলব থাকবে বলে মনে হয়না। আর বাড়িতে ওনার স্ত্রী আছেন তো। নেবে কি রিস্ক? যাবে তাঁর সাথে? মেরে কেটে জনা দশেক লোক আছে স্টেশনে। কার ভরসায় রাত কাটাবে এখন?
"আপনি শিওর তো কোনও অসুবিধা হবে না আপনার"? একটু ভদ্রতার পারদ চড়িয়েই বলল অন্তরা। 'আরে অসুবিধা হলে কি আর আমি নিজে বলতাম যেচে? আমার ডিউটি শেষ আর ১০ মিনিট পরে। আপনি দশ মিনিট বসুন, বেরবো এখুনি"। ঘরে আলো খুব কম। অন্তরা বুঝলোনা ভদ্রলোক প্রয়োজনের থেকে একটু বেশী হাসলেন কিনা।
"চলুন ওঠা যাক। আপনি সঙ্গে ব্যাগ আনেননি কোনো?" নিজের আপিসের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
"না। আমি একদম খালি হাতে এসেছি। আমি তো জানতাম বাড়ি ফিরে যাবো। এতো দেরী হবে জানতাম না। খুব বাজে বিপদে পরে গেছি জানেন। মা খুব চিন্তা করবেন"। "স্বাভাবিক। তবে কি করবেন বলুন? প্রফেসানাল জীবনটাই এইরকম। সব দিন হিসেব মেলে না। আজ আপনার নিতান্তই কপাল খারাপ। অল্প পথ, হেঁটেই চলে যাই চলুন। এই বলে ভদ্রলোক তাঁর সাইকেলটা হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চললেন। ঠিক পাশেই অন্তরা পা মেলাল। মিসমিশে কালো বাইরেটা। মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে দুএকটি মোটর গাড়ি বা বাইক যাচ্ছে যখন একটু দৃশ্যমানতা বাড়ছে বটে কিন্তু পর মুহূর্তেই ঝুপ করে সবটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
খুব ছোট রেল কোয়ার্টার। যেরকম হয় আর কি। বাইরের গেট খোলার সাথে সাথেই উঠোনের লাইট জ্বলে উঠলো। একজন বছর পঞ্চাশের মহিলা দরজা খুললেন।
"শোন, ইনি অন্তরা দেবী। আজকে লাস্ট ট্রেন"
"আমি জানি। বলতে হবে না। তোমার সাথে অপরিচিত কেউ এতো রাতে আসা মানেই আন্দাজ করেনি এখন"। একটু মুচকি হাসলেন মহিলা।
"এসো মা। ভেতরে এসো"। বাহ। অসাধারণ তো। এরকম দেখা যায়না শহরে একদম। কি অসাধারণ বোঝাপড়া স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। শহরে এসব ভাবা যায়? রাত দশটায় বর একজন মহিলা নিয়ে বাড়ি ঢুকছেন আর স্ত্রী হাসি মুখে দরজা খুলে
দিচ্ছেন? ঘরে ঢুকেই অন্তরার মনে হল কতদিনের আলাপ এনার সাথে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া সারল অন্তরা। ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, মুরগির মাংস। এতো ভাবনার বাইরে। সব যেন তৈরি ছিল। কিরকম সিনেমা সিনেমা লাগছে সবটা।
"আপনি তো অসাধারণ খাওয়ালেন মাসীমা। ভাবনার বাইরে"। "গতকাল রাতে কিছু অতিথি এসেছিল। রেঁধেছিলাম একটু বেশী করেই। কি ভাগ্য দেখো। কার ভাত কোথায় মাপা থাকে কেউ জানে"? এই বলে বেশ শব্দ করে হাসলেন উনি।
ঘড়ি দেখল অন্তরা। দুটো বাজে। ঘুম আসছেনা। সেটাই স্বাভাবিক। একটা সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায়, অচেনা বাড়িতে রাত কাটানো। ভয় করছে না যদিও একদম, কিন্তু একটা অস্বস্তি থেকেই যায়। সেইটাই হচ্ছে অন্তরার। বেশ গরম লাগছে। একতলা বাড়ি, জানলা খোলা। প্রাঞ্জল বাবু বললেন এখানে কোনও ভয় নেই, নিশ্চিন্তে জানলা খুলে শুয়ে পড়ুন। স্টেশন মাস্টারের নাম বলা হয়নি। প্রাঞ্জল সমাদ্দার। স্ত্রী পূর্ণিমা। কি অসাধারণ দুজন মানুষ। সবটা যে এখনো খারাপ হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ এনারা দুজন। একটু ঘুমনোর চেষ্টা করতে হবে এবার।ভোর পাঁচটা পঞ্চান্নতে ট্রেন। একটু না শুয়ে নিলে শরীর দেবে না আর। চোখটা জোর করে বন্ধ করলো এবার অন্তরা। একটা কুকুর শুরু থেকে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। এখনো থামেনি। প্রাঞ্জল বাবু বললেন নতুন কাউকে দেখলেই এরকম চেঁচায়। আপনাকে অচেনা পেয়েছে যে। "উঠে পরো। তোমার ট্রেন ধরার আছে"। চোখ কখন লেগে এসেছিল টের পায়নি অন্তরা। উঠে বসলো যখন তখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। ডেকে দিলেন প্রাঞ্জল বাবুর স্ত্রী। চটপট তৈরি হয়ে নিলো অন্তরা। এক কাপ চা এলো, সাথে দুটো কড়কড়ে টোস্ট। রূপকথার মতো মনে হল সবটা অন্তরার। একদম হোটেলে আছে মনে হচ্ছে যেন। কি যত্ন। "চলুন। আপনাকে এগিয়ে দি"। প্রাঞ্জল বাবু একদম তৈরি।
"না না। আমার যে কি লজ্জা লাগছে। কিরকম বিপদে ফেললাম বলুন তো। এইটুকু রাস্তা আমি দিব্যি হেঁটে চলে যেতে পারব। দয়া করে আপনি বিশ্রাম নিন"। ভয়ানক এদ্বারাসিং লাগছে অন্তরার।
"আরে এইটুকু পথ যাবো, কিসের অসুবিধা? চলুন চলুন"। রাত্রে কিছুই বোঝা যায়নি। জায়গাটা খুব সুন্দর লাগে সকাল বেলা। একটা দারুণ ঝিল আছে। প্রচুর পাখি। একদম খেয়াল করেনি এটা অন্তরা। টিকিট কাটার জন্য অন্তরা যখন নিজের হাতব্যাগটা তে হাত বাড়ালেন, 'এই নিন' বলে টিকিট বের করলেন পকেট থেকে প্রাঞ্জল বাবু। " রেলের লোকের বাড়ি এসে নিজে টিকিট কেটে যাবেন? তা হয় নাকি?" "এমা! ছি ছি। আপনি কি করছেন বলুন তো? খুব লজ্জা পাচ্ছি বিশ্বাস করুন। আপনাদের মতো ভালো মানুষ আছে জানতাম না জানেন? সবটুকু মনে রেখে দেবো। একবার কোলকাতায় আসতে হবে কিন্তু। আমি মাসীমাকে আমার নাম্বার দিয়ে গেছি। আমার ওখানে আসতেই হবে।
আপনার নাম্বার ও নিয়ে নিয়েছি কিন্তু"। "একদম একদম। দেখা হবে আমাদের আবার। এখানে আবার এলে জানাবেন। এবার কচি পাঁঠা খাওয়াবো"। এই বলে অট্টহাসি দিলেন প্রাঞ্জল বাবু।
দু নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ধ্রু গাড়ি যাবে। আপনারা প্ল্যাটফর্ম থেকে দয়া করে সরে দাঁড়াবেন। একটি মহিলা কন্ঠের ঘোষণা হল। ছোটবেলায় এই গ্ৰু ট্রেন গেলে খুব ভয় লাগতো। গোটা চত্বরটা কিরকম থরথর করে কাঁপে। মনে হয় কোনও
চুম্বক টেনে নিয়ে যাবে বুঝি ওইদিকে। শক্ত করে বাবা বা মার হাত ধরে থাকতো অন্তরা। আজও খানিক ভয় যে লাগেনা তা নয়। তবে হাত ধরার কেউ নেই সেরকম আর। বিকট শব্দ করে ট্রেনটা বেরোল পাশ দিয়ে। কত কি যে উড়ে এলে এদিক সেদিক থেকে। কিরকম লণ্ডভণ্ড করে চলে গেলো যেন। অন্তরা কিরকম চুম্বকের মতো আটকে গেছিল ট্রেনটার দিকে। দেখে। আজও একরকম হয় তার থ্রু ট্রেন দেখলে।
একদম ঘড়ির কাঁটা মেনে অন্তরার ট্রেন এলো। শেষ সৌজন্যটুকু বিনিময় করে উঠলো ট্রেনে। গোটা ব্যাপারটা এতো ভালো ভাবে হবে ভাবেনি অন্তরা। রাতুল কে ফোন করলো। ঘুমোচ্ছে বোঝা গেলো। বেজে গেলো ফোন। স্টেশনে নেমে প্রাইভেট ট্যাক্সি ধরে যখন বাড়ি ঢুকল তখন নটা বাজে। দরজা খুলল বেলা মাসি। 'ঝটপট ভালো চা খাওয়ায় দেখি' বলেই মায়ের ঘরে গেলো অন্তরা। মা কিছু বলার আগেই ঝরঝর করে সবটা বলে ফেলল।
"খুব বাজে কাজ করেছিস তুই। কিছু যদি আপদ বিপদ হতো? এইসব পাকামো কেউ করে"?
"কোনও আপদ বিপদ হয়েছে কি মা? হয়নি তো। তাই এসব ভেবোই না। কিরকম চমৎকার দুজন কে পেলাম বলতও। এদের না দেখলে বিশ্বাস হতো না এখনো মানুষ এতো ভালো হতে পারে। আমি স্নান সেরে আসছি, কিছু খাব মা। খুব খিদে পেয়েছে"।
এবার অফিস বেরবে অন্তরা। খুব ক্লান্ত যদিও। তবুও আজ যেতেই হবে। রাতুল ফোন করলো। সবটা বলল রাতুল কে। এতো খুশী হয়েছে অন্তরা যেন বেশ ভালো হয়েছে গতকাল ট্রেন ক্যানসেল হয়ে। তৈরি একদম অন্তরা। রাতুল বলল ১৫
মিনিটে এসে তোকে পিকআপ করছি। "মাসি আমায় ঝট করে নীচ থেকে পাঁচটা সিগারেট এনে দেবে"?
"দাও টাকা দাও"। ব্যাগে হাত ঢোকাল অন্তরা। একি? টাকা কোথায়? বেশ কিছু টাকা ছিল তো। ব্যাগের মধ্যে ভেতরের চেনেই তো ছিল সবটা। প্রায় হাজার পাঁচেক তো হবেই। কোথায় গেলো? ব্যাগ তো হাতছাড়া করেনি কোথাও। কি হল? পুরো ব্যাগটাকে হুড়মুড়িয়ে উল্টে দিলো অন্তরা। দুটো একশো টাকার নোট খালি। আর অন্য সব হাবিজাবি জিনিষ যা থাকে ব্যাগে। ভালো করে ঝাড়ল আবার ব্যাখ এবার একটা সাদা কাগজ টুপ করে পড়লো খাটের ওপর। কাগজটা খুলল অন্তরা। একটা চিঠি।
অন্তরা দেবী, আশা করি বাড়ি পৌঁছে গেছেন অথবা মাঝ রাস্তায় এই চিঠি পড়ছেন। আমি এই পেশায় আছি প্রায় বাইশ বছর। আমাদের এলাকাটি খুব ছোট। সবাই মিলে মিশে থাকি। যা পাই ভাগ করেনি। এর আগে দুশো কি তিনশো পেয়েছি খুব জোর। একবার সবচেয়ে বেশী। সাতশো। আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম আপনি উচ্চবিত্ত। এতদূরে এসেছেন মানে সাথে টাকা পয়সা আছে নিশ্চিত। আপনি যখন ঘুমচ্ছিলেন, খুব ভোরের দিকে, পূর্ণিমা টাকা গুলো নিয়েছে। পূর্ণিমা আমার পার্টনার। আজে লাইফ না, এই ব্যাবসার। ওই বাড়িটি আমাদের না। যখন কোনও মনের মতো মানুষ পাই, খবর করে দি। বাড়ি খালি হয়ে যায় নিমেষে। পূর্ণিমা দখল নেয় বাড়ির। আর বাকীটা তো আপনি নিজেই দেখলেন। কুকুরটি তার বাড়ির মালিককে না দেখলেই চিৎকার করে। আপনাকে। দেখে নয়, ও কাল আমাদের দেখে চেঁচিয়েছে খুব। আন্তরিক দুঃখিত। ঘুম হয়নি ভালো বলে। কোনও ত্রুটি থাকেনা আমাদের আতিথেয়তার। আমরা প্রথমেই কত আছে ব্যাগে যেনে নিয়ে মেনু ঠিক করি। নিরামিষ, আমিষ, মুড়ি, মুড়কি সব থাকে। একজনের কাছে একবার দুশো ছিল। শুধু মুড়ি মুড়কি পেয়েছিলেন তিনি। আপনি সাক্ষাত মা লক্ষ্মী। তাই এতো আয়োজন ছিল। আমাদের একটাই ভয় ছিল, যদি কখনো ব্যাগ বের করতেন, দেখতেন ভেতরে সব ঠিক আছে কিনা? সেইটুকু রিস্ক আমরা নিয়ে থাকি সবসময়। একটা রাত্রি থাকলেন, খেলেন, আমি ছেড়ে দিয়ে এলাম। এসবের জন্য পাঁচ হাজার খুব বেশী কি? পোস্তর যা দাম আজকাল। আপনার বাড়ি ফেরার জন্য দুটি নতুন একশো টাকার নোট রেখে দিলাম। আর প্রু ট্রেন দেখার সময় আপনার মগ্ন হয়ে থাকার সুযোগে এই চিঠি চালান করে দি আপনার ব্যাগে। ছোটবেলার ট্রেনিং, ভুল হয়না।
পুনশ্চ- আপনি আজ পুলিশ নিয়ে আসতেই পারেন সেই বাড়িতে। এলে বাধিত হবো। এবার সাথে বেশী টাকা আনবেন না দয়া করে। দিনকাল যা খারাপ।
Comments