top of page

কমলালেবুর নতুন ১০ টি রান্না, দুটি হাড় হিম করা ভূতের গল্প..

শীতকাল মানেই নলেন গুড়, পিঠে পুলি, ক্ষীরের মোয়া আর কমলালেবু। শীতের দুপুরে নরম রোদ গায়ে মেখে কমলালেবু খাওয়ার মজাই আলাদা। তবে রোজ রোজ খেতে থাকলে দিনকয়েক পর এই ভালো লাগাও ফিকে হতে শুরু করে। তাই যখনই কমলালেবু একঘেয়ে লাগতে শুরু করবে, তখনই একটু এক্সপেরিমেন্ট করতেই পারেন। এমনই ১০ টি রেসিপি রইলো এবারের সংকলনে..


পাপিয়া সান্যাল চৌধুরী

অরেঞ্জ সিরাপ কেক


কী কী লাগবে

সুজি ২ কাপ, নারকেল কোরা ১ কাপ, ডিম ৩ টি, চিনি ১ কাপ, টক দই ১/২ কাপ, অরেঞ্জ জুস ১ কাপ, অরেঞ্জ জেস্ট ১ টেবিল চামচ, Shalimar's সাদা তেল ১/২ কাপ, বেকিং পাউডার ১ চামচ, ভ্যানিলা এসেন্স ১/২ চামচ, নুন এক চিমটে, পেস্তা গুঁড়ো সাজানোর জন্য, কমলালেবুর টুকরো ১/৪ কাপ

সিরাপের জন্য:

অরেঞ্জ জুস ১ কাপ, চিনি ১ কাপ, জল ১/২ কাপ, লেবুর রস ১/২ চামচ, দারচিনি স্টিক ১ টি

কীভাবে বানাবেন

প্রথমে একটি সসপ্যান এ সিরাপ বানাবার সব উপকরণ দিয়ে ৫ মিনিট ফুটিয়ে ছেঁকে ঠান্ডা করে রাখতে হবে। সুজির সাথে নারকেল মিশিয়ে তাতে অরেঞ্জ জুস ও টকদই মিশিয়ে আলাদা করে রাখতে হবে। ডিম ভালো ফেটিয়ে তার সাথে চিনি গুঁড়ো করে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার তেল, অরেঞ্জ জেস্ট, নুন ও ভ্যানিলা এসেন্স মিশিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে নিতে হবে আবার। এবার সুজির মিশ্রনে ধীরে ধীরে লিকুইড মিশ্রণ মিশিয়ে নিতে হবে। একদম শেষে বেকিং পাউডার দিয়ে বেকিং ট্রে তে ব্যাটার ঢেলে সমান করে দিতে হবে। আধ ঘন্টা এভাবে রেখে দিতে হবে। এবার প্রিহিট করা ওভেন এ কনভেকশন মোড এ ১৮০°তে মিশ্রণটি বেক করে নিতে হবে ৪০-৫০ মিনিট মতো। টুথপিক শুকনো বেরোলে এবং ওপর অংশ বেশ লাল হয়ে গেলে বোঝা যাবে হয়ে গেছে।এবার পছন্দ মতো শেপে কেটে নিতে হবে এবং বেকিং ট্রে তে ওভাবেই রেখে দিতে হবে। গরম অবস্থায় ঠান্ডা করে রাখা সিরাপ ঢেলে দিতে হবে এবং পুরোটা টেনে নেওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে। শেষে পেস্তা গুঁড়ো ও কমলালেবুর টুকরো দিয়ে সাজিয়ে একটু সিরাপ সহ পরিবেশন করতে হবে এই বিশেষ কেক।

চিলি পনির ইন অরেঞ্জ গ্রেভি


কী কী লাগবে

পনির ৫০০ গ্রাম, হলুদ ও লাল বেলপেপার ১ কাপ, কমলালেবুর কোয়া ১০ টি, ফ্রেশ কমলালেবুর রস ১ কাপ, কমলার জেস্ট ১ টেবিলচামচ, কাঁচালঙ্কা ৬-৭ টা, রসুনকুচি ১ চামচ, আদাকুচি ১ চামচ, পেঁয়াজপাতা ১/৪ কাপ, ক্রাশড গোলমরিচ ২ চামচ, লাইট সয়া সস ৪ চামচ, ভিনিগার ১ চামচ, টমেটো কেচাপ ১ টেবিলচামচ, রেড চিলি সস ১/২ চামচ, গোটা শুকনোলঙ্কা ৩-৪ টে, স্টার অ্যানিস ২ টি, তিল ১ চামচ, ময়দা ১/৪ কাপ, কর্নফ্লাওয়ার ১/৪ কাপ, বেকিং সোডা ১/৪ চামচ, Shalimar's সাদা তেল পরিমান মতো, নুন পরিমানমতো

কীভাবে বানাবেন

প্রথমে পনির লম্বা লম্বা করে কেটে নিতে হবে। একটি পাত্রে ২ চামচ লাইট সয়া সস, ১ চামচ গোলমরিচ, পরিমান মতো নুন পনির এর টুকরোর সাথে মিশিয়ে আধ ঘন্টা রাখতে হবে। এবার ময়দা, ৩ টেবিলচামচ কর্নফ্লাওয়ার ও বেকিং সোডা মিশিয়ে অল্প জল দিয়ে ঘন একটি ব্যাটার বানাতে হবে। ম্যারিনেট করা পনির এই ব্যাটারে ভালোভাবে কোট করে ডিপ ফ্রাই করে নিতে হবে। বাকি ১ টেবিলচামচ কর্নফ্লাওয়ার ২ চামচ জলের সাথে মিশিয়ে আলাদা করে রাখতে হবে। এবার কড়াতে ৪ টেবিলচামচ সাদা তেল দিয়ে স্টার অ্যানিস, গোটা শুকনো লঙ্কা, রসুনকুচি, আদা কুচি, পেঁয়াজ পাতা দিয়ে অল্প ফ্রাই করে একে একে বেলপেপার ও কমলালেবুর কোয়া কমলার জেস্ট দিয়ে অল্প নাড়িয়ে নিতে হবে। এবার বাকি সমস্ত সস, গোলমরিচ, নুন, মধু ও কমলালেবুর রস দিয়ে একটু ফুটে উঠলে কর্নফ্লাওয়ার এর মিশ্রণ টা অ্যাড করে ওপর থেকে রোস্টেড তিল দিয়ে পরিবেশন করতে হবে এই পদ।

দেবযানী গুহ বিশ্বাস


অরেঞ্জ সিনামন মাফিন


কী কী লাগবে

১ কাপ আটা/ময়দা, ১ চা চামচ বেকিং পাউডার, ১/২ চা চামচ বেকিং সোডা, ১ চিমটি নুন, ১/২ কাপ অলিভ অয়েল, ৩/৪ গুঁড়ো চিনি, ২ টেবিল চামচ মধু, ২ টেবিল চামচ টক দই, ৩ টেবিল চামচ মিল্কমেইড, ১/২ কাপ কমলালেবুর রস, ১ চা চামচ অরেঞ্জ ফুড কালার, ১ চা চামচ অরেঞ্জ এসেন্স, ১ চা চামচ দারচিনি গুঁড়ো এবং ১/২ কাপ দুধ।


কীভাবে বানাবেন

ওভেন ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে প্রিহিট করুন। একটি বড় পাত্রে সব শুকনো উপকরণগুলো মিশিয়ে নিন, তারপর আরেকটি পাত্রে অলিভ অয়েল ও চিনি ভালো করে ফেটিয়ে নিন। একে একে দই, মধু, কমলালেবুর রস, মিল্কমেইড, ফুড কালার, এসেন্স, দুধ যোগ করুন। মিশিয়ে রাখা সব শুকনো উপকরণ দিয়ে দিন এবং ভালভাবে ফেটিয়ে নিন। এবার সিলিকন মাফিন মোল্ডে ব্যাটার ঢেলে ১৫ মিনিট বেক করে নিন। ঠান্ডা করে ইচ্ছে মতো সাজিয়ে পরিবেশন করুন।

আড় কমলা সুন্দরী


কী কী লাগবে

আড় মাছ ৬-৮ পিস, নুন স্বাদমতো, ১ চা চামচ Shalimar's chef spices হলুদ গুঁড়ো, ৪ টেবিল চামচ Shalimar's সর্ষের তেল, ২টো ছোট এলাচ, ছোট এক টুকরো দারচিনি, এক চিমটে গোটা জিরে, ১/২ চা চামচ Shalimar's chef spices কাশ্মীরি লাল লঙ্কার গুঁড়ো, এক চিমটে চিনি, ২ টেবিল চামচ পেঁয়াজ বাটা, ২ চা চামচ আদা-রসুন বাটা, কাঁচালঙ্কা বাটা পরিমাণ মতো, ২ টেবিল চামচ কাজুবাদাম বাটা, ১/২ কাপ কমলালেবুর রস, ২ টেবিল চামচ ফ্রেশ ক্রিম, এক চিমটে Shalimar's chef spices গরম মশলা গুঁড়ো, কিছু কাজুর টুকরো আর কিশমিশ, জল পরিমাণ মতো।


কীভাবে বানাবেন

প্রথমে মাছগুলো সামান্য নুন আর ১/২ চা চামচ হলুদ গুঁড়ো দিয়ে মেখে নিতে হবে। কড়াইয়ে তেল দিয়ে গরম হলে মাছ গুলো ভেজে তুলে নিতে হবে। এরপর ওই তেলেই গোটা জিরে, এলাচ ও দারচিনি ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ বাটা, আদা-রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়ো, লাল লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে নিতে হবে। মশলা কিছুক্ষণ ভাজা হলে কাঁচা লঙ্কা বাটা, স্বাদমতো নুন, কাজুবাদাম, কিশমিশ ও চিনি দিয়ে আবারও কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে নিতে হবে। এবার কাজুবাদাম বাটা দিয়ে মশলা ভালো করে কষিয়ে নিতে হবে। তেল ছেড়ে এলে গরম মশলার গুঁড়ো ও পরিমাণ মতো জল দিয়ে গ্রেভি করে নিতে হবে। ভেজে রাখা মাছগুলো দিয়ে ১০মিনিট ঢাকা দিয়ে রান্না করে নিতে হবে। সবশেষে গ্রেভি ঘন হয়ে এলে, কমলালেবুর রস আর ফ্রেশ ক্রিম ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে।

দুষ্টু বিশ্বাস

কমলা কাতলা


কী কী লাগবে

কাতলা মাছ ২ পিস, পাঁচফোড়ন ১ চিমটি, আদা বাটা ১/২ চা চামচ, চেরা কাঁচালঙ্কা ২-৩ টে,  Shalimar's chef spices শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো ১/২ চা চামচ,  Shalimar's chef spices হলুদ গুঁড়ো ১/২ চা চামচ,  Shalimar's chef spices জিরে গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, রোস্টেড ধনেগুঁড়ো ১ চা চামচ,  Shalimar's chef spices গরম মশলা গুঁড়ো ১/২ চামচ, উষ্ণ গরম জল ১ কাপ, নুন স্বাদ মত, চিনি ১/২ চা চামচ, কমলা লেবুর রস ১/২ কাপ, খোসা ছাড়ানো কমলা লেবুর কোয়া ৪-৫ টি, Shalimar's সরষের তেল

কীভাবে বানাবেন

কড়াইতে সরষের তেল গরম করে নুন হলুদ মাখানো কাতলা মাছ ভালো করে ভেজে নিতে হবে। ওই তেলে সামান্য চিনি দিয়ে নেড়ে পাঁচফোড়ন আর গোটা গরমমশলা ফোঁড়ন দিয়ে সব বাটা মশলা, গুঁড়ো মশলা এবং সামান্য জল দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিতে হবে। এরপর উষ্ণ গরম জল দিয়ে ফুটিয়ে মাছের টুুুকরোগুলো ঝোলে দিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে মাছ তেল ছাড়া হয়ে এলে কমলালেবুর রস, চেরা কাঁচালঙ্কা, বীজ ও খোসা বাদ দেওয়া কমলালেবুর কোয়া দিয়ে নেড়ে নামিয়ে গ্যাস বন্ধ করতে হবে। কমলালেবুর রস দিয়ে বেশিক্ষণ ফোটালে ফ্লেভার ভালো আসবে না তাই কমলালেবুর ফ্লেভার ধরে রাখতে আঁচ থেকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে গরম ধোঁয়া ওঠা সরু চালের ভাত অথবা ফ্রায়েড রাইসের সাথে পরিবেশন করতে হবে কমলা কাতলা।

কমলালেবুর ক্ষীর


কী কী লাগবে

১ লিটার দুধ, ৪ টেবল চামচ চিনি, কমলালেবুর পাল্প ১ কাপ, ১টি তেজপাতা, খোয়া ক্ষীর ২০০ গ্রাম, এলাচ গুঁড়ো ১/৪ চামচ এবং ড্রাই ফ্রুটস


কীভাবে বানাবেন

প্রথমে দুধ আর তেজপাতা ফুটিয়ে ঘন করে নিন। এবার তেজপাতা ছেঁকে নিয়ে তার মধ্যে খোয়া ক্ষীর, চিনি দিয়ে আরও কিছু সময় ফোটান। ঠান্ডা করে কমলালেবুর পাল্প আর এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে নামিয়ে নিন। ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে সাজিয়ে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন কমলালেবুর ক্ষীর।

সঞ্চিতা দাস

কমলালেবুর পোলাও


কী কী লাগবে

গোবিন্দভোগ চাল ১ কাপ, কমলালেবু ১টা, খোয়া ক্ষীর ২ চামচ, চিনি ১/২ কাপ, নুন ২ চামচ, ছোট এলাচ ৪টে, লবঙ্গ ৪টে, আমন্ড ৮-১০ টা, কাজুবাদাম ১০-১৫ টা, কিশমিশ ১০-১৫ টা, কমলালেবুর রস ১/২ কাপ, Shalimar's সাদা তেল পরিমাণমতো


কীভাবে বানাবেন

চাল ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এবার শুকনো কড়াইতে ২ চামচ ঘি দিয়ে ওর মধ্যে কাজু, কিশমিশ, আমন্ড দিয়ে ভেজে তুলে রাখুন। সাদা তেল দিয়ে তাতে গোটা গরম মশলাগুলো দিয়ে দিন। নেড়েচেড়ে চাল দিয়ে দিন। চাল ভাজা হলে চিনি মিশিয়ে দিন। এবার কমলালেবুর রসের সঙ্গে স্বাদমতো নুন-চিনি মিশিয়ে ঢেলে দিন। এই রস যেন মিষ্টি হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অল্প আঁচে ঢেকে রান্না করুন। ১০ মিনিট পর ঢাকা খুলে খোয়া ক্ষীর, ভেজে রাখা কাজু কিশমিশ মিশিয়ে দিন। আবারও ১০ মিনিট ঢেকে রাখুন। এবার কমলার খোসা উপর থেকে ছড়িয়ে ৫ মিনিট ঢেকে রেখে পরিবেশন করুন।

কমলা পাবদা


কী কী লাগবে

পাবদা মাছ ৪টি, কালোজিরা শুকনো লঙ্কা ফোড়নের জন্য, চেরা কাঁচালঙ্কা ২ টি, নুন চিনি স্বাদমতো, Shalimar's chef spices হলুদ গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, Shalimar's chef spices লঙ্কা গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, Shalimar's chef spices জিরে গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, কমলালেবুর রস ১ কাপ, কমলালেবুর জেস্ট, Shalimar's সাদা তেল পরিমাণমতো।


কীভাবে বানাবেন

মাছগুলো নুন হলুদ মেখে ভেজে তুলে নিন। ঐ তেলে কালোজিরা, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন। একটি পাত্রে অল্প জলে হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো গুলে ওর মধ্যে ঢেলে কষুন। অল্প জল আর কমলালেবুর রস দিয়ে ফুটে উঠলে ভাজা মাছ গুলো দিয়ে ২-৩ মিনিট রান্না করুন। হয়ে গেলে কমলালেবুর জেস্ট আর চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে গ্যাস বন্ধ করে ঢেকে রাখুন পরিবেশনের আগে পর্যন্ত।

বৃষ্টি দাস মল্লিক

কমলা চিকেন


কী কী লাগবে

চিকেনের টুকরো ৪০০ গ্রাম, কমলালেবুর রস ২ কাপ, আদা-রসুনবাটা ২ চামচ, চিনি ১ চামচ, নুন-স্বাদমতো, নুন আন্দাজমত, পেঁয়াজ বাটা ১/২ কাপ, Shalimar's chef spices জিরে গুঁড়ো ১ চা চামচ, Shalimar's chef spices লঙ্কা গুঁড়ো ১ চা চামচ, Shalimar's chef spices গরম মসলা গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, গোটা গরম মশলা তেজপাতা ফোড়নের জন্য, পরিমাণ মতো Shalimar's সাদা তেল।

কীভাবে বানাবেন

মাংস, আদা রসুন বাটা, পেঁয়াজ বাটা, নুন, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, গরমমশলা গুঁড়ো, নুন চিনি মেখে রাখুন একঘন্টা। তেলে তেজপাতা গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিয়ে মাংস ঢেলে কষুন। ঢেকে রান্না করুন, তেল ভাসলে অল্প জল দিয়ে ফুটতে দিন। কমলালেবুর রস দিয়ে ২-৩ মিনিট ফুটিয়ে নামিয়ে নিন। পোলাও বা পরোটার সঙ্গে ভালো লাগবে।

কমলালেবু দিয়ে মাছের ঝাল


কী কী লাগবে

আড় বা বোয়াল মাছ ৪ টুকরো, আদা জিরা বাটা ১ চা চামচ, টমেটো বাটা ১ টেবিল চামচ, নুন স্বাদ মতো, Shalimar's chef spices হলুদ গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, Shalimar's chef spices লঙ্কা গুঁড়ো ১/২ চা চামচ, Shalimar's সরষের তেল পরিমাণমতো, কমলালেবুর রস ১ কাপ, কালোজিরা ফোড়নের জন্য।


কীভাবে বানাবেন

মাছ গুলো নুন হলুদ মেখে ভেজে তুলে নিন। তেলে কালোজিরা দিয়ে একে একে কমলালেবুর রস ছাড়া সব উপকরণ দিয়ে অল্প জলের ছিটে দিয়ে কষতে থাকুন। তেল ছাড়লে অল্প গরম জল আর ভাজা মাছ দিয়ে ফুটতে দিন। কমলালেবুর রস দিয়ে ২-৩ মিনিট রেখে নামিয়ে নিন।

 

কবরের ভিতর থেকে

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদের মাদারিপুর হাইস্কুলে যখন টিচার হিসেবে যোগ দিলেন সন্ন্যাসীস্যার, আমি ক্লাস সিক্স৷ নতুন টিচার এলে সবাই কৌতূহলে চুরচুর থাকি৷ কী জানি কীরকম হবেন মাস্টারমশাই৷ খুব কি রাগী, রেগে গেলে কি লক্ষ্ণণস্যারের মতো চোখ লাল করে তাকিয়ে থাকবেন বহুক্ষণ না কি রতনস্যারের মতো তাড়া করবেন ডাস্টার হাতে নিয়ে

সন্ন্যাসীস্যারের মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল, চুলের রং ঠিক কালো নয়, সামান্য লালচে, চোখে হালকা বাদামি রঙের চশমা, মুখে সর্বদাই হাসির ছোঁয়া৷ ডঁহু, দেখে মনে হল স্যার তেমন খেপচুরিয়াস নন

প্রথমদিকে তিনি আমাদের ক্লাসে আসতেন বাংলা পড়াতে৷ ছোটোরা সাধারণত গম্ভীর মুখের টিচারদের পছন্দ করে না, একটু ভয়ে–ভয়ে থাকে, আর ভয়ে থাকা মানে ব্রেন কাজ করে না৷ সন্ন্যাসীস্যার ছিলেন ঠিক তার ডল্টোটা৷ তাঁর পড়নোর ধরনটা ছিল একেবারেই অন্যরকম৷গল্প করতে করতে পড়াতেন, তার ফলে সেই বয়সে আমরা বেশ মনোযোগী হয়ে ডঠেছিলাম বাংলার ক্লাসে৷

হাসিখুশি মুখের সন্ন্যাসীস্যার খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ডঠেছিলেন ছাত্রদের মধ্যে৷

একদিন তিনি হঠাৎ এসে গেলেন আমাদের ভূগোল ক্লাসে নিতে৷ আমরা যার–পর–নাই খুশি হলাম কেন না ভূগোলের অনাদিস্যার শুধু গম্ভীর হয়ে পড়ান তাই নয়, হঠাৎ কোনও অমনোযোগী ছাত্রের দিকে চোখ পড়লে তার কাছে গিয়ে বলেন, ‘বল তো, কোন পর্যন্ত পড়িয়েছি’ ছেলেটি হয়তো সেই মুহূর্তে চোখ রেখেছিল জানালার বাইরে ডড়তে থাকা অ্যারোপ্লেনের মতো দেখতে একটা ঘুড়ির দিকে৷ ডঠে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল বোকা–বোকা চোখে৷ তাতে ভূগোল স্যার ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে চেঁচাতে থাকেন, ‘স্ট্যান্ড আপ অন দি বেঞ্চ৷ এক পায়ে দাঁড়াবি৷’ ব্যস, বাকি পিরিয়ড তার তাল গাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা৷

সন্ন্যাসীস্যার ভূগোল পড়োবেন দেখে আমরা ডল্লসিত, কিন্তু তিনি বললেন, আমি এসেছি প্রক্সি দিতে৷

প্রক্সি শব্দটা ততদিনে জানা হয়ে গেছে আমাদের৷ কলেজে নাকি একজন ছাত্র না এলে তার কোনও বন্ধু তার মতো গলা করে রোলকলের সময় বলে, ‘ইয়েস স্যার’৷ স্যার নাকি বুঝতে না পেরে সেই অনুপস্থিত ছাত্রের নামের পাশে প্রেজেন্ট লিখে দেন কলেজের হাজার হাজার ছাত্রের ভিড়ে স্যাররা নাকি ধরতেই পারেন না এই কারচুপি

আমরা শঙ্কিত হয়ে ভাবি স্কুলে এরকম করলে তাকে হয়তো ক্লাস থেকে ঘাড় ধরে বার করে দেবেন স্যাররা৷ কিংবা হয়তো রাসটিকেটই করে দেবেন তাকে৷ এখানে সব ছাত্রকেই চেনেন স্যাররা৷

রাসটিকেট শব্দটা তখন নতুন শিখেছি৷ রাসটিকেট হওয়া মানে বাকি জীবনের জন্য সেই স্কুলে পড়তেই পারবে না সে৷

কিন্তু সন্ন্যাসী স্যার জানালেন ভূগোল স্যার অনাদিবাবু আজ স্কুলে আসেননি কোনও কারণে, তাঁর ক্লাস ফাঁকা যাচ্ছে, তাই তিনি এসেছেন যাতে এই ক্লাসের ছাত্ররা চেঁচামেচি করে অন্য ক্লাসের ছাত্রদের ডিস্টার্ব না করে৷ তারপর বললেন, তা হলে এখন কী করা যায়?

অমনি আমরা সমস্বরে বলি, তা হলে একটা গল্প বলুন৷

সন্ন্যাসীস্যারের মুখে একগাল হাসি৷ তাঁর মুখ দেখে মনে হল তিনি এরকম একটি প্রস্তাবের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, তৎক্ষণাৎ বললেন, তবে তাই হোক৷

তার আগে পর্যন্ত সন্ন্যাসীস্যারের কাছে আমরা কখনও গল্প শুনিনি, যদিও বাংলা ক্লাস নেওয়ার সময় তাঁর পড়ানোর ভঙ্গি কিছুটা গল্প বলার মতোই৷

একটু সময় নিয়ে সন্ন্যাসীস্যার বললেন, কী গল্প শুনবে? ভূতের গল্প?

––হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা হলে তো খুব ভালো হয়, সকলের সমবেত স্বর৷

––বেশ তা হলে শোনো, বলে সন্ন্যাসীস্যার চেয়ারের ডপর জুতজাত হয়ে বসলেন, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে, চশমাটা ঠিকঠাক চোখে লাগিয়ে বলতে শুরু করলেন, আসলে কী জানো? ভূতের গল্প আমারও খুব পছন্দের৷ যা ঠিক পুরোপুরি বুঝি না, অথচ ছোটো থেকেই ভূতের একটা অস্তিত্ব কীভাবে যেন ঢুকে যায় মনের ভিতরে, তা নিয়ে চর্চা করা মনের পক্ষে একটা ভালো ব্যায়াম৷

সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করি, স্যার, আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?

সন্ন্যাসীস্যার হাসলেন, জীবনে কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যায় যার কোনও ব্যাখ্যা করা যয় না, তখন মনে হয় এ ঘটনাটা যেন অলৌকিক৷ এরকমই একটা ঘটনা দিয়েই শুরু করি আজ৷ ঘটনাটা কিন্তু আমাদের স্কুলের

––সে কী, স্যার? আমাদের স্কুলের? আমাদের বিস্ময় তখন চরমে৷

––হ্যাঁ, তোমরা হয়তো জানো না, আমিও একদা এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম৷ সেই ছাত্র বয়সেরই একটা ঘটনা বলি৷ তখন আমার বয়স চোদ্দো কি পনেরো৷ ক্লাস টেনে পড়ি৷ সেদিন আমি আর আমার এক সহপাঠী রবিন্দর ঠিক করলাম একটা অ্যাডভেঞ্চার করব৷

––স্যার, রবিন্দর আবার কীরকম নাম?

––সে এক বেশ মজার ঘটনা৷ ওর নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঘটক৷ কিন্তু মা–বাবার দেওয়া নাম ওর পছন্দ হয়নি, বলত, ধুস, অত বড়ো একটা মানুষের নামের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে থাকাটা ঠিক নয়৷ বরং ফিল্মস্টার ধর্মেন্দ্র নামটা যেমন পরিচিত ধর্মেন্দর নামে, আমার নামটা রবিন্দর হলেই মানায়৷

বলে হাসি–হাসি মুখ করে তাকালেন সন্ন্যাসীস্যার, বললেন, সেই রবিন্দর ছিল খুব সাহসী৷ কোথাও ভূতের গল্প শুনলেই সেখানে গিয়ে হাজির হত ভূত দেখবে বলে৷ বহুবার একা একা শ্মশানে গিয়েছে ভূত দেখতে৷ তার নানা অভিজ্ঞতা৷ একবার আমাকে বলল, ‘সন্ন্যাসী, অনেক তো এমনি ভূত দেখলাম, একদিন ঘোড়াভূত দেখি দুজনে৷’ তো আমি বললাম, ‘ঘোড়াভূত আবার কী?’ তখন যা বলল তাতে আমি হতবাক৷ বলল, ‘আমাদের স্কুলের মাঠের এক কোণে দুটো কবর আছে তা খেয়াল করেছিস?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, সে তো রোজই দেখি৷’ রবিন্দর বলল, ওই দুটো কবরের একটা মানুষের কবর, অন্যটা একটা ঘোড়ার৷ আজ রাতে তোতে আমাতে স্কুলের মাঠে আসব৷ দেখবি কী মজা হয়

সন্ন্যাসীস্যার এই পর্যন্ত গল্পটা বলার আমি ডঠে দাঁড়াই, বলি, স্যার, বললেন তো আমাদের স্কুলের কথা তা হলে কোন কবরের কথা বলছেন?

––ওই যে, বলে আঙুল নির্দেশ করে দেখালেন সন্ন্যাসীস্যার, দক্ষিণ–পশ্চিম কোণে দুটো ইঁটের গাঁথনি আছে তা নিশ্চয় তোমরা লক্ষ করে থাকবে৷ এখন ইঁটগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রায় ধ্বংসস্তূপের চেহারা৷ ওই দুটো কবরের কথা বলছি৷ রবিন্দর বলল, ‘ওই দুটো কবরের যেটি বেশি লম্বা সেটি একটি ঘোড়ার কবর, আর যেটি কম লম্বা সেটি একটি যুবকের৷ প্রতি রাতে দুটি কবর থেকে বেরিয়ে আসে দুটি ভূত৷ তারপর––’ বলেই রবিন্দর বলল, না, এর পর কী ঘটল তা মুখে বললে তোর কোনও ইন্টারেস্ট থাকবে না৷ আজ অমাবস্যার রাত৷ এরকম রাতেই ভূতরা চরতে বেরোয়৷ আজ তোতে আমাতে––

সন্ন্যাসীস্যার গল্পটা থামিয়ে একটু হাসলেন মিটিমিটি, বললেন, কী, তোমাদের ইন্টারেস্ট লাগছে তো?

আমরা সমস্বরে বলি, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারপর?

––তারপর রাত্রি ন–টা নাগাদ দুই বন্ধু রওনা দিলাম স্কুলের ডদ্দেশে৷ আমাদের বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় দেড় মাইল দূরত্বে৷ অমাবস্যার রাত৷ ঘুটঘুট করছে চারপাশ৷ রবিন্দরকে বলেছিলাম, ‘একটা টর্চ নিই’, কিন্তু রবিন্দর বলল, ‘টর্চ নিলে আর ভূত দেখার চার্ম থাকবে না৷ ভূত দেখার জন্য চাই নিশুতি রাতের অন্ধকার৷’ তো আমরা সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে চলেছি৷ কাঁচা রাস্তায় কত খানাখন্দ, তাতে পা পড়লে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি, পড়তে পড়তেও সামলে নিচ্ছি৷ মাঝেমধ্যে কোনও ইঁটের টুকরো থাকলে তাতে হোঁচট খাচ্ছি৷ কিন্তু রবিন্দরের কথার মধ্যে এমন চমক ছিল যে, সারা শরীর জুড়ে শিহরন৷ একসময় পৌঁছে গেলাম স্কুলের মাঠটার কাছে৷ আমি কবরটার কাছে এগোতে যাচ্ছি, রবিন্দর বলল, এত কাছে গেলে তো চলবে না৷ আয়, এই আমগাছটার নীচে দাঁড়াই৷

গল্পটা শুনতে শুনতে আমাদের শরীরেও শিহরন৷ আমাদের ক্লাস থেকেই দেখা যায় কবরদুটোর ধ্বংসস্তূপ, গল্পটা শুনছি, আর একটু দূরে হলেও চোখ চলে যাচ্ছে কবরদুটোর দিকে৷ ক্ষয়ে–যাওয়া ইঁটের গাঁথনির কবরদুটো অনেকবার দেখেছি, কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি কখনও৷ তার মধ্যে এত যে গন্ডগোল লুকিয়ে আছে তা তো শুনি নি এতদিন৷

সন্ন্যাসীস্যার তখন বলে চলেছেন, বুঝলে, দুজনে আমতলায় দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কেন দাঁড়িয়ে আছি তা ঠিক জানি না রবিন্দরকে ফিসফিস করে বললাম, ‘কোথায় ভূত’, তাতে রবিন্দর বলল, ‘অত ভূত–ভূত করলে তো আর ভূত এসে বলবে না, ‘এই তো এসেছি আমি’ ভূত দেখতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে৷’ তা আমরা অপেক্ষা করছি৷ অনেক রাত হয়ে গেছে৷ একটু দূরেই বড়ো রাস্তা৷ অন্ধকারে সেই রাস্তাও যেন অদৃশ্য৷ মনে হচ্ছে পড়ে আছে একটা কালো ফিতে৷ গ্রামদেশে একটু রাত হলেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, পথে লোকজন আর চলাচল করছে না৷ সেই নির্জন নিশুতি রাতে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ৷ নিজেদের নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছি তখন৷ ভূত আর আসে না

সন্ন্যাসীস্যার যেমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন,আমরা যারা শ্রোতা তারাও অস্থির হয়ে ভাবছি কখন ভূতেদের দেখা পাবেন ওঁরা

––বোধ হয় এমন ঘন্টাখানেক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, হঠাৎ কোন অলক্ষ্য থেকে শুনতে পেলাম যেন ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসছে৷ আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, রবিন্দর আমার গায়ে ছোট্ট করে চিমটি কাটল যাতে আমি চুপ করে যাই কান খাড়া করে শুনতে থাকি কোথায় যেন একটা ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে টগবগ টগবগ টগবগ––৷ শব্দটার ডৎপত্তি যেন কাছেই, কিন্তু সেই শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে মাঠের মধ্যে৷ সামনে অন্ধকার এতটাই ঘন যে, চোখে  পড়ছে না কিচ্ছু৷ শব্দটা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠের চারপাশে৷ একসময় মনে হল আমাদের ঠিক সামনে দিয়েই ছুটে গেল শব্দটা৷ তখন মাঠের সেই শব্দ যেন ঢুকে পড়ল বুকের ভিতর৷ হূৎপিণ্ডের মধ্যেই যেন শব্দ হচ্ছে টগবগ টগবগ টগববগ৷ ভয়ে, ডত্তেজনায় আমার হাত–পা তখন কাঁপছে৷ মনে হচ্ছে কোনও একজন ঘোড়সওয়ার যেন তার বাহনের ডপর আসীন হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠময়৷
––বোধ হয় এমন ঘন্টাখানেক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, হঠাৎ কোন অলক্ষ্য থেকে শুনতে পেলাম যেন ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসছে৷ আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, রবিন্দর আমার গায়ে ছোট্ট করে চিমটি কাটল যাতে আমি চুপ করে যাই কান খাড়া করে শুনতে থাকি কোথায় যেন একটা ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে টগবগ টগবগ টগবগ––৷ শব্দটার ডৎপত্তি যেন কাছেই, কিন্তু সেই শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে মাঠের মধ্যে৷ সামনে অন্ধকার এতটাই ঘন যে, চোখে পড়ছে না কিচ্ছু৷ শব্দটা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠের চারপাশে৷ একসময় মনে হল আমাদের ঠিক সামনে দিয়েই ছুটে গেল শব্দটা৷ তখন মাঠের সেই শব্দ যেন ঢুকে পড়ল বুকের ভিতর৷ হূৎপিণ্ডের মধ্যেই যেন শব্দ হচ্ছে টগবগ টগবগ টগববগ৷ ভয়ে, ডত্তেজনায় আমার হাত–পা তখন কাঁপছে৷ মনে হচ্ছে কোনও একজন ঘোড়সওয়ার যেন তার বাহনের ডপর আসীন হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠময়৷

আমরাও গল্পটা শুনছিলাম হাঁ করে , জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, এই মাঠে?

––হ্যাঁ৷ কিন্তু অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না, তাই বুঝে ডঠতে পারলাম না শব্দটার ডৎপত্তি কোথায় কিছুক্ষণ পরে শব্দটা আর শুনতে না–পাওয়া যাওয়ায় রবিন্দর বলল, ‘চল্, আজকের অধিবেশন শেষ৷’ আমি তাতে খুব একটা সন্তুষ্ট হলাম না, আবার বাড়ির পথে ফিরে যেতে যেতে বললাম, ‘কিন্তু ভূত কোথায়? এ তো শুধু শব্দ ’ তখন রবিন্দর বলল, ‘তুই এতে একটুও ভয় পাসনি?’ বললাম, ‘শুধু শব্দ শুনে গায়ের মধ্যে শিরশির করছিল ঠিকই, কিন্তু ভূত দেখে চমকে ওঠা যাকে বলে তা হল না’ রবিন্দর বলল, ঠিক আছে, তা হলে তোর সাহস আছে৷ তোকে আসল দৃশ্য দেখাই৷ আর ঠিক দশদিন পরে দশমী তিথি৷ একটু রাত হলেই কানাভাঙা চাঁদ ডঠবে মাথার ডপর৷ তখন একটু একটু জ্যোৎস্না ছড়াবে মাঠের সবুজ ঘাসে৷ সেসময় দেখবি ঘোড়াভূতের আসল রহস্য৷

আমরাও ডৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছি সেই আসল রহস্যের ডৎসের, জিজ্ঞাসা করলাম, আবার এলেন এই মাঠে?

––হ্যাঁ, ঠিক যেরকম বলেছিল রবিন্দর, সেই দশমী তিথি আসতেই বলল, চল, আজ রাতে আর একবার হানা দিই ঘোড়াভূতের সন্ধানে৷ তবে হাতে একটা কালো চাদর নিয়ে আসবি৷ ’ কালো চাদর কেন লাগবে তা বুঝে ডঠতে পারলাম না আমি তো প্রস্তুত হয়েই ছিলাম৷ রবিন্দর এসে ডাকতেই বেরিয়ে পড়লাম কালো চাদর হাতে নিয়ে৷ দেখি রবিন্দরের হাতেও কালো চাদর৷ হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পৌঁছে গেলাম এই মাঠের এক কোণে৷ ঠিক আগের দিন যেমন কবরের কাছে গিয়েছিলাম, আজ তার থেকে একটু দূরে৷ তখন অল্প অল্প জ্যোৎস্না ডঠেছে, মাঠের সবুজের ডপর ছড়িয়ে পড়ছে সেই জ্যোৎস্নার গুঁড়ো৷ একটু দূরে স্কুলটা দেখা যাচ্ছে, স্কুলবিল্ডিংটা ভিজছে জ্যোৎস্নার আলোয়৷ দূর থেকে সেই কবরদুটোর অস্পষ্ট ছায়া চোখে পড়ছে আজ৷ রবিন্দর আমাকে বলল, ‘এবার কালো চাদরটা গায়ে দিয়ে নে৷’ বলে সে নিজেও তার চাদরটা দিয়ে ঢ়েকে নিল শরীর৷ সেই সঙ্গে চাদরের একটা খুঁট তুলে নিয়ে ঢ়েকে নিল তার নাকটাও৷ আমাকেও ইঙ্গিতে বলল সেরকমভাবে নাক পর্যন্ত ঢ়েকে নিতে৷

সন্ন্যাসীস্যার বলছেন, আর ইঙ্গিতে দেখাচ্ছেন কীভাবে চাদর দিয়ে ঢ়েকে নিতে হয়েছিল নাকসুদ্ধ শরীরটায়৷

তাঁর সেই মূকাভিনয় দেখে হেসে ফেলল আমাদের বন্ধু বীরেন৷

আমরা ভেবেছিলাম স্যারের কথায় বীরেন হেসে ফেলেছে, স্যার নিশ্চয় রেগে একশা হবেন, কিন্তু স্যার তখন গল্প বলার মেজাজে, তাঁর মুখে ফুটে ডঠল সামান্য হাসির রেখা, পরের মুহূর্তে আবার নিবিষ্ট হলেন তাঁর গল্প বলায়৷ বললেন, ঠিক আগের দিনের মতোই অপেক্ষা করছি দুজনে, কিন্তু মুহূর্তগুলো যেন আর কাটে না, তবে সেদিন জ্যোৎস্না থাকায় তেমন অস্থির হচ্ছিলাম না আগের দিনের মতো৷ সেই জ্যোৎস্না–ভেজা রাতে দেখছিলাম চাঁদের আলোর রং কীরকম বদলে যায় প্রতি মুহূর্তে৷ এই মনে হচ্ছে রুপো রং, পরক্ষণে যেন তাতে মিশে যাচ্ছে একটুকরো বেগুনি রং৷ আবার কখনও যেন সেই রঙের সঙ্গে মিশছে লালচে রং৷ কখনও এক টুকরো মেঘ এসে চাঁদের মুখটা ঢ়েকে দিচ্ছে, তখন আরও আঁাঁধার হয়ে ডঠছে পৃথিবী, আবার যেই না সরে যাচ্ছে মেঘ, অমনি কী চমৎকার হেসে ডঠছে চারপাশ যেন মেঘের এই আলোছায়া ভারী ডপভোগ করছে প্রকৃতি৷ সেই দৃশ্যের মধ্যে যখন নিমগ্ণ হয়ে আছি, হঠাৎ সেই আগের দিনের মতো ঘোড়ার খুরের টগবগ শব্দ৷ চকিতে সতর্ক হয়ে চোখ রাখি মাঠের চারপাশে, কিন্তু রবিন্দর আমাকে আঙুল দিয়ে দেখাল সেই কবরদুটোর দিকে৷ সেদিকে চোখ রাখতেই নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসে দেখি কি, লম্বা কববরটার ভিতরে থেকে কিছু একটা যেন বেরিয়ে এল, ধোঁয়ার মতো আবছা অবয়ব তার, ভালো করে চোখ পাতলে মনে হবে একটা দশাসই ঘোড়া৷ সেই অবয়বটা গিয়ে দাঁড়াল চৌকো কবরটার সামনে৷ সেখান থেকে বেরিয়ে এল আর একটা ধোঁয়া–ধোঁয়া অবয়ব৷ সেটি দেখতে যেন একজন মানুষের মতো, লম্বা–চওড়ায় সেও ইয়া বড়ো৷

বলতে বলতে হঠাৎ একটু থামলেন সন্ন্যাসীস্যার৷

শুনতে শুনতে আমরা বড়ো বড়ো করে ফেলছি চোখ, সন্ন্যাসীস্যারের চোখমুখও তখন বেশ ত্রস্ত দেখাচ্ছে৷ তাঁর গল্পে যতিচিহ্ণ দেওয়া সহ্য হচ্ছে না আমাদের, অস্থির হয়ে রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করছি, স্যার, তারপর?

সন্ন্যাসীস্যার তখনও যেন বাস করছেন ত্রাসের মধ্যে, বললেন, হঠাৎ দেখি সেই মানুষের মতো অবয়বটা লাফিয়ে ডঠল ঘোড়ার অবয়বটার ডপর, তারপর শুরু করল সারা মাঠ চক্কর দিতে৷

বিস্ময়ভরা গলায় জিজ্ঞাসা করি, দেখলেন সেই ঘোড়সওয়ারকে?

––যেন একটা ছায়ার কুণ্ডলি ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠময়, আর সেই চলমান ছায়ার সঙ্গে শব্দ ডঠছে টগবগ টগবগ টগবগ৷ আমার শরীরের ভিতর কী এক ভয়ংকর ডত্তেজনা৷ কীরকম যেন এক অস্থির অনুভূতি৷ চেপে ধরলাম রবিন্দরের একটা হাত৷ বুঝতে পারলাম আমার হাতটা বরফের মতো ঠাণ্ডা৷ ছায়ার কুণ্ডলিটা তখন চলতে চলতে ওল্টাচ্ছে পাল্টাচ্ছে, কখনও মনে হচ্ছে কুণ্ডলিটা আর নেই, যেন চলে গেছে দূরের দিকে, শুধু শব্দটা শোনা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে, হঠাৎ দেখি কাছেই কুণ্ডলিটা৷ এরকম কতক্ষণ হল তার ঠিক নেই, তারপর একসময় কুণ্ডলিটা সেই কবরদুটোর কাছে গিয়ে থামল, একটু পরে মিলিয়ে গেল হাওয়ার মতো৷

বলতে বলতে সন্ন্যাসীস্যার থামলেন আবার৷ তারপর সামনে রাখা জলের গেলাস তুলে নিয়ে চোঁ চোঁ করে নিঃশেষে খেয়ে একটা বড়ো করে শ্বাস নিলেন৷

হঠাৎ জিজ্ঞাসা করি, স্যার, আপনি তো বললেন অনেকদিন আগের ঘটনা৷ কিন্তু কী ঘটেছিল তা জানতে পেরেছিলেন?

সন্ন্যাসীস্যার ঘাড় নাড়লেন, বললেন, রবিন্দর সব খবর রাখে. বলল, ইংরেজ আমলের ঘটনা৷ এক ইংরেজ সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে নাকি এই রাস্তা দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে, হঠাৎ সামনে একটা গরুর গাড়ি পড়ে যাওয়ায় আর সামলাতে পারেনি৷ প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে সেই সৈন্য আর ঘোড়া দুজনেই স্পট ডেড৷ গরুর গাড়ি আর তার গাড়োয়ানের কী হল তা জানা যায়নি সেই সৈন্য আর ঘোড়া দুজনকেই কবর দেওয়া হয়েছিল এখানে৷ তার পর থেকেই নাকি প্রতি রাতে কবর থেকে সেই ঘোড়সওয়ার বেরিয়ে আসে একই রকম ভাবে ছুটতে থাকে সেই আগের মতো

––কিন্তু এখনও কি সেই ঘটনা ঘটে চলেছে, স্যার?

সন্ন্যাসীস্যার এতক্ষণে হাসলেন, বললেন, কী জানি, তা বলতে পারব না৷ তারপর তো আমি কলেজ পড়তে চলে গিয়েছিলাম এখান থেকে৷ এতদিন পরে ফিরে এসেছি স্কুলের চাকরি পেয়ে৷ এখনও ঘোড়সওয়ারের অস্তিত্ব আছে কি না কে জানে তবে তোমাদের সাহস থাকলে পরখ করে দেখতে পারো আছে কি না

ব্যস, সারা ক্লাস নিস্তব্ধ৷ সবারই জোড়া জোড়া চোখ তখন তাকিয়ে অছে ক্লাস থেকে অনেকটা দূরে সেই কবরদুটোর দিকে৷

হঠাৎ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, তা হলে নিশ্চয় আপনি বিশ্বাস করেন ভূতে?

সন্ন্যাসীস্যার এবার হাসলেন হা হা করে, বললেন, ভূতকে বিশ্বাস করলে ভূত আছে, না করলে নেই৷ তবে ওই যে কথায় আছে না বিশ্বাসে মিলয়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর৷

 

অদৃশ্য পিয়ানো বাদক

শেখর বসু

শমীক বলল, ‘চলো, আজ তোমাকে হলিউডের জাদু-দুর্গ দেখিয়ে আনব।’

অবাক হয়ে বললাম, ‘জাদু-দুর্গ!’

হাসতে হাসতে জবাব দিল শমীক, ‘হ্যাঁ, এই ম্যাজিক-কাসল্‌টার খুব নাম। পৃথিবীর গোটা-চব্বিশেক দেশের বড়-বড় জাদুকররা এই জাদু-দুর্গের সদস্য। এখানকার ছোট-বড় সব জাদুকর এই দুর্গে নিয়মিত হাজিরা দেয়। এটা একটা নাইট ক্লাব। তবে সদস্য ছাড়া আর কেউ এখানে ঢুকতে পারে না।’

‘তাহলে আমরা ঢুকব কী ভাবে?’

‘সদস্য-জাদুকরের অতিথি হিসেবে ঢোকা যায়। লস এঞ্জেলিসের এক জাদুকর হাওয়ার্ড গার্ডনারের সঙ্গে আমার খুব চেনাশোনা আছে, তিনি নাইটক্লাবে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর দুজন গেস্ট আজ ক্লাবে যাবেন। রিসেপশনিস্ট আমার নামও লিখে নিয়েছে। ভদ্রলোক আজ তিনদিনের জন্যে সানফ্রান্সিসকো গেছেন, নাহলে উনিই আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন।’

জাদু-দুর্গের কথা শুনে বেশ উত্সাহিত হয়েছিলাম। ‘কী হয় ওখানে?’

‘গোটা দুর্গ জুড়েই সারা রাত ধরে জাদুর খেলা চলে। জাদু দেখায় জাদুকরেরা, দেখেও জাদুকররা। ওই দুর্গ সম্পর্কে বাইরের লোকের প্রচণ্ড কৌতূহল। এখানেও কেউ-কেউ বিশ্বাস করে, জাদু স্রেফ হাতসাফাই নয়, এর মধ্যে শয়তানেরও কারসাজি আছে। বিখ্যাত জাদুকর হুডিনির নামে ওখানে একটা সেয়াঁস রুমও আছে। সেখানে নাকি প্রেতচর্চা হয়। হতে পারে, তার থেকেই জাদু-দুর্গের সামান্য একটু বদনামও ছড়িয়ে গেছে। কেউ-কেউ মাঝে মাঝে ওখানে নাকি ভূতও দেখে থাকে।’

সন্ধে সাতটানাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম জাদু-দুর্গের উদ্দেশে। গাড়ি চালাতে চালাতে শমীক আমাকে দুর্গের ইতিহাস শোনাতে লাগল। ও বেশ কয়েক বছর ধরে লস অ্যাঞ্জেলিসে আছে, কিন্তু এই দুর্গে ওর কখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে জাদুকর গার্ডনারের সুবাদে ওখানকার অনেককিছু ও জেনে গেছে।

জাদু-দুর্গের ইতিহাস যে-কারও আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। দুর্গের বয়স প্রায় সওয়া-শো বছর। বাড়ির চেহারা ইউরোপের পুরনো আমলের অভিজাতদের বাড়ির মতো। বেশ কয়েকবার সংস্কার হয়েছে বাড়ির, কিন্তু সাবেক সেই দুর্গ- মার্কা চেহারাটা পালটানো হয়নি। এই বাড়ির মানুষরা সেই প্রথম যুগ থেকেই জাদুবিদ্যায় আগ্রহী। জাদুর চর্চা এই বাড়িতে চলেছিল বংশ-পরম্পরায়। ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে এখানে পাকাপোক্ত একটা ক্লাবহাউসের পত্তন হয়। তারপর ধীরে ধীরে গোটা পৃথিবীতেই এই জাদু-ক্লাবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আটের দশকের একেবারে শেষের দিকে এই জাদু-দুর্গটি লস এঞ্জেলিস ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক মনুমেন্টের মর্যাদা পেয়েছে। এখানে জাদুকর-সদস্যের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। নাইট ক্লাবের সদস্য-জাদুকর ও আমন্ত্রিত অতিথিদের বয়েস কমপক্ষে একুশ হতেই হবে। জাদু-দুর্গ পরিচালনার দায়িত্বে আছে দি অ্যাকাডেমি অফ ম্যাজিক্যাল আর্টস। এই সংস্থার প্রধান দায়িত্বের মধ্যে পড়ে জাদুবিদ্যার প্রসার, উন্নয়ন ও ইতিহাসের সংরক্ষণ। যে কেউ ইচ্ছে করলেই এই সংস্থার সদস্যপদ পেতে পারেন না। সদস্যপদ পেতে গেলে কিছু শর্ত মানতে হবে। প্রথম শর্তই হল তাঁকে জাদুকর হতে হবে। হয় পেশাদার, নয় শৌখিন জাদুকর। তবে সদস্যপদ পাওয়ার জন্যে এটুকুই যথেষ্ট নয়, তাঁকে সব শেষে একাডেমির মেম্বারশিপ রিভিউয়িং কমিটির সামনে অডিশনে বসতে হবে। ওই অডিশন পাশ করতে পারলেই মিলবে সদস্যপদ।

জাদু-দুর্গের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শোনাবার পরে শমীক হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, ‘কী, জাদু-দুর্গের মেম্বারশিপ নেবে?’

গম্ভীর গলায় উত্তর দিলাম, ‘নিতে পারি, তবে তার আগে দেশে ফিরে জাদুবিদ্যাটা একটু শিখে নিতে হবে।’

সেপ্টেম্বরের শুরু, বাতাসে খুব হালকা শীতের আভাস। রাস্তায় লোকজন নেই, গাড়ির সংখ্যাও কম। আমাদের গল্পের মধ্যে গাড়ি ছুটছিল দুর্গের দিকে। নাইট ক্লাবে ড্রেস কোড মানা হয়। সেই জন্যেই আমাদের পরনে স্যুট। আমেরিকায় পোশাকআশাকের বিধিনিষেধ বিশেষ মানা হয় না। হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট পরেই যত্রতত্র যাওয়া যায়। জাদু-দুর্গ শতাব্দিপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান বলেই হয়তো ড্রেস কোড মানা হয়। আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম ম্যাজিক-কাসলে। পুরনো দিনের বিলিতি ছবিতে এই ধরনের দুর্গ-মার্কা বাড়ির ছবি দেখা যায়।

দুর্গের প্রধান ফটক থেকে একটা ঘোরানো রাস্তা উঠে গেছে ওপরদিকে। ওই পথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে তিনতলা-সমান উচ্চতায় পৌঁছবার পরে কার-পার্কিং স্পেস পাওয়া গেল।

ওখানে গাড়ি পার্ক করার পরে আমরা সামনের রিসেপশনে গেলাম। যে মেয়েটি রিসেপশনে বসে আছে, শমীক তার কাছে গার্ডনারের নাম বলতেই মেয়েটি এক গাল হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, গার্ডনার আপনাদের কথা জানিয়ে রেখেছেন। ওয়েলকাম, ভেতরে আসুন।’

ভেতরে ঢুকতে এক সাহেবও স্বাগত জানালেন, তারপর বললেন, ‘একটা ছোট্ট ভুল হয়ে গেছে আপনাদের ; নেভার মাইন্ড, এক মিনিট-- ।’ ফিরে এলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। হাতে ছোট্ট একটা বেতের ঝুড়ি। তাতে এক রাশ নেক-টাই। টাই দেখেই আমরা আমাদের ভুল ধরতে পারলাম। আমরা স্যুটেড বুটেড, কিন্তু ফরমাল ড্রেসে একটা খামতি থেকে গেছে, গলায় টাই ঝোলাতে ভুলে গিয়েছি। সাহেবের ঝুড়ি থেকে দুটো টাই বেছে নিয়ে আমরা গলায় বেঁধে নিলাম। সাহেব বললেন, ‘ ভেরি গুড। যান, এবার ওদিক থেকে দুর্গে ঢুকে পড়ুন। ওদিকে দেয়ালের পাশে একটা ছোট কুলুঙ্গি আছে। ওখানে একটা প্যাঁচা বসে আছে। প্যাঁচার কাছে গিয়ে এই মন্ত্রটা বলবেন। মন্ত্রটা শমীকের প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে সাহেব বলে দিলেন।

সাহেবের দেখানো পথ দিয়ে খানিকটা এগিয়ে দেখি সামনে মস্ত এক নিরেট দেয়াল। দরজা কোথায়? দেয়ালের একধারে ছোট্ট এক কুলুঙ্গিতে একটা প্যাঁচা বসে আছে। দেখলে মনে হয় জ্যান্ত প্যাঁচা। একটু ইতস্তত করার পরে প্যাঁচার দিকে মুখ বাড়িয়ে শমীক একটু আগে শেখানো মন্ত্রটা বলল—ওপেন দ্য ডোর সিম সিম। সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মতো একটা ব্যাপার ঘটল। নিরেট দেয়াল দুদিকে সরে গেল। মধ্যিখানে মস্ত দরজা। এ যেন আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গুহার দরজা খোলার কায়দা। মন্ত্র আওড়ালেই গুহার দরজা চিচিংফাঁক।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। সাজানোগোছানো মস্ত বড় একটা ঘর। মধ্যিখানে বিরাট একটা পিয়ানো। সুরের ঝঙ্কার তুলে বেজে যাচ্ছে পিয়ানো। নির্দিষ্ট তালে পিয়ানোর কিবোর্ডের কি-গুলো ওঠানামা করছে, কিন্তু কোনও পিয়ানো বাদক নেই। এটা কী করে হচ্ছে! অবাক চোখে এই কাণ্ডই দেখলাম কয়েক মুহূর্ত। পিয়ানোর সামনে প্রাচীন আমলের বাহারি একটা বসার জায়গা। পিয়ানো-বাদক ওখানে বসেই তো পিয়ানো বাজায়। কিন্তু আসনটি শূন্য। শুধু সুর-তাল-লয়ের সঙ্গে মিল বজায় রেখে ওঠানামা করছে কিবোর্ডের কি-গুলো। হঠাত্ কেমন যেন বিভ্রম হল। মনে হল ছোটখাটো চেহারার একজন মহিলা বাদকের আসনে বসে আছে। তার পরনে ভিক্টোরীয় যুগের গাউন, জামার লম্বা হাতায় ফ্রিল লাগানো। এটা বিভ্রমই। ভালো করে তাকাবার পরে আর তার কোনও চিহ্ন দেখতে পেলাম না। আসলে এমন সাবেক কালের পিয়ানো অমন পোশাক-পরা মহিলারাই বুঝি বাজাত। বুঝলাম একটু আগে শোনা জাদু-দুর্গের শতবর্ষ আগের ইতিহাস আমাকে কিছুটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বাদকহীন পিয়ানো আগের মতোই বেজে যাচ্ছিল।

ওপরে চোখ তুলতেই আর এক চমক। দেয়ালে ঝোলানো অয়েলপেন্টিংয়ের ছুঁচলো গোঁফের মানুষটি আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। না, চিত্রকরের আঁকার বাহাদুরি নয়, ছবির মানুষটির চোখ চারদিকে ঘুরছে। একজন জীবন্ত মানুষ যে ভাবে চারদিকে চোখ ঘোরায়, ভঙ্গিটি অবিকল সেইরকম। দেয়ালে পুরনোদিনের বিশ্ববিখ্যাত জাদুকরদের নানা ভঙ্গির ছবি।

দুর্গের এক ঘর থেকে আর এক ঘরে শুরু হল আমাদের ভ্রমণ। সব ঘরেই বিস্ময়। বিভিন্ন টেবিলে চার-ছ’জনের জমায়েত। সেখানে চলছে নানা ধরনের জাদুর প্রদর্শন। যাঁরা দেখাচ্ছেন তাঁরা জাদুকর, যাঁরা দেখছেন তাঁরাও জাদুকর। আমাদের মতো দলছুট লোকের সংখ্যা নেই বললেই চলে।

আলো-আঁধার মেশানো ঘরগুলো নানা আকৃতির। ছোট-ছোট পানশালা আছে বেশ কয়েকটি। দেয়াল-আলমারিতে সাজানো আছে নানা ধরনের ড্রিংকস। বাঁকানো কাউন্টারের সামনে একটু উঁচু কয়েকটি বসার জায়গা। যাঁরা এখানে বারটেন্ডারের ভূমিকা পালন করছেন, তাঁরাও জাদুকর। মদ বিক্রি করার ফাঁকে ফাঁকে জাদুর খেলা দেখাচ্ছেন। বেশির ভাগই হাতসাফাই বা তাসের খেলা। তবে কোনও খেলাই মার্কামারা নয়, নতুনত্বের চমক আছে। সামনে বসে-থাকা যে মানুষগুলি পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে খেলা দেখছেন, তাঁরা নিছক দর্শক নন, এই ক্লাবের সদস্য-জাদুকর। ম্যাজিক এঁদের কাছে বোধহয় নিছক বিনোদন নয়, নতুন-নতুন উদ্ভাবনও। আমরা যারা আমন্ত্রিত অতিথি, আমাদের কাছে পুরোটাই তো চোখ ও মনের আরাম।

সত্যিই এটা একটা জাদু-দুর্গ। আলো-আঁধারি পরিবেশে শুধুই জাদুর খেলা। কত অসম্ভব কাণ্ড চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য, কিন্তু চোখকে তো বারবার অগ্রাহ্য করা যায় না। খোলা চোখের সামনে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে একটার পর একটা। আমরা বিভিন্ন টেবিলে ঘুরতে ঘুরতে জাদুর খেলা দেখে যাচ্ছিলাম। দু-হাত দূরে জাদুর খেলা। জানি পুরোটাই ফাঁকি, হাত সাফাই ; কিন্তু একটা খেলারও গোপন রহস্য ধরতে পারছিলাম না। রহস্য ধরতে না পারলে বোকা বনতে হয়, কিন্তু এখানে বুঝি বোকা হওয়াটাও উপভোগ্য। খেলা দেখে চমত্কৃত হচ্ছিলাম বারবার।

সময় গড়িয়ে চলেছিল নিজস্ব নিয়মে। মস্ত বড় ঘর। ঘরের মধ্যে ঘর। বাঁকাচোরা বিচিত্র ডিজাইন, কেমন যেন গোলকধাঁধার মতো। কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি, আর বোঝা যাচ্ছে না ; কিন্তু এগিয়েই চলেছি। পরিবেশ সর্বত্র আলোআঁধারি। জাদুরাজ্যে এমন আলোই বুঝি মানানসই। সব জায়গাতেই জাদুর খেলা। সময়ের চিন্তাটাও বুঝি লোপ পাচ্ছিল। এমন সময় অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হল। আচ্ছন্নকর ওই আলোআঁধারির মধ্যে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কে যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমাকে কি? আবছা অন্ধকারে ছোটখাটো চেহারার এক মহিলা। পরনে ঘেরওয়ালা সাদা গাউন, ফুলহাতা সাদা জামা, হাতায় ফ্রিল বসানো। কোথায় যেন দেখেছি! মনে পড়ে গেল পরমুহূর্তেই। এই মহিলাকেই তো সেই অদৃশ্য পিয়ানোবাদকের সিট থেকে উঠে আসতে দেখেছিলাম একবার। সেই মহিলাই কি? ভালো করে দেখার জন্যে এক পা এগোতেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল মহিলা। থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। এও কি জাদু-দুর্গের কোনও এক জাদু! কিন্তু তাই যদি হয়, মেরুদণ্ডের ওপর দিয়ে স্রোতের মতো কী যেন ছুটে গেল কেন?

শমীক বলল, ‘চলো কিছু খেয়ে নিই।’ জাদু-দুর্গে ঘোরার পথে দু-তিনটে ছোট স্ন্যাক বার চোখে পড়েছিল, তারই একটিতে হালকা কিছু খাওয়াদাওয়া সারার পরে আবার আমাদের জাদুর খেলা দেখার পরিক্রমা শুরু হল। মাঝে মাঝেই দুর্গের বাকি ইতিহাস শোনাচ্ছিল আমাকে শমীক, কিন্তু অদ্ভুত ওই ছায়ামূর্তির প্রভাব এখনও আমি বুঝি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বুঝতে পারছিলাম, জাদু-সাম্রাজ্যের বিচিত্র এই পরিবেশ আমাকে একটু চেপে ধরেছে।

জাদু-দুর্গে ছোট-ছোট থিয়েটার আছে বেশ কয়েকটি। এক-একটি মঞ্চের দর্শকসারিতে বড় জোর জনা-পনেরো বসতে পারে। প্রথম সারির দর্শক আর জাদুকরের মধ্যে হাত-দুয়েকের ব্যবধান। হাত বাড়ালে ছুঁয়ে দেওয়া যায় জাদুকরকে। কলকাতায় এক সময় জাদুর খেলা দেখেছি নিউ এম্পায়ার ও মহাজাতি সদনে। খেলা দেখিয়েছেন পি সি সরকার এবং জুনিয়র। বেশ ভালো খেলা। কিন্তু দুটি মঞ্চেই দর্শক আর মঞ্চের মধ্যে অনেকটা ব্যবধান। ব্যবধান থাকলে বোধহয় খেলা দেখানো তুলনামূলক ভাবে সহজ। এখানে ঠিক তার উলটো। দর্শকদের প্রায় গা-লাগানো মঞ্চ। বাইরের পানশালা-সংলগ্ন জাদু দেখানোর জায়গাগুলোর নাম ক্লোজ-আপ গ্যালারি, এগুলো থিয়েটার। আমরা একটি থিয়েটারে ঢুকে পড়েছিলাম। জনা-বারো দর্শক ছিল, আমরা বসেছিলাম তৃতীয় সারিতে।

মঞ্চে যিনি খেলা দেখাচ্ছিলেন তিনি বোধহয় মেক্সিক্যান, চেহারা দেখে তাই অন্তত মনে হচ্ছিল। জাদুকর একটা চারচৌকো রঙিন কাপড় তুলে নিয়েছিলেন টেবিল থেকে। উলটেপালটে, ঝেড়েঝুড়ে দেখালেন ওই কাপড়ের টুকরোয় কিছু লুকনো নেই। তারপর কাপড় চার ভাঁজ, দু-ভাঁজ করলেন। ছোট মঞ্চের এদিক থেকে ওদিক যাতায়াত করলেন কয়েকবার। তারপর ওই কাপড়ের ভাঁজ খুলতেই বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটি খরগোশ। টেবিলের ওপর নামাতেই খরগোশ দু-তিনটে ছোট লাফ দিয়েছিল। জাদুকরের সহকারী এসে চটপট সরিয়ে ফেলেছিল খরগোশটিকে। হাততালি দিয়ে উঁচু গলায় তারিফ জানাতে মার্কিনিদের জুড়ি মেলা ভার। জোর হাততালি উঠেছিল সব দিক থেকে। আমরাও হাততালি দিয়েছিলাম। একেবারে চোখের সামনে তাকলাগানো ভোজবাজি। মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করার পরেই জাদুকর চলে গিয়েছিলেন পরের খেলায়।

আবারও দু-হাতি একটা কাপড়ের টুকরো। জাদুকর আগের মতোই কাপড়টা ঝেড়েঝুড়ে দেখালেন যে, কাপড়ের মধ্যে কিচ্ছু নেই। কাপড় আবার চার ভাঁজ, দু ভাঁজ। ছোট্ট মঞ্চে বার বার-দুতিনেক এদিক-ওদিক করলেন জাদুকর। শূন্য কাপড়ের কোথাও কোনও ফাঁকফোকর নেই—সে সম্পর্কে দর্শকদের ওয়াকিবহাল করলেন নানা ভাবে। শেষে ওই কাপড়ের টুকরোর ভাঁজ খুলতেই বেরিয়ে এলো সাদা-কালোয় মেশানো ফুটফুটে এক কুকুরছানা। জোর হাততালি উঠল দর্শকদের মধ্যে।

প্রথম সারিতে বসেছিলেন তিন মার্কিন সুন্দরী। জাদুকর মঞ্চ থেকে এক পা নেমে বললেন, ‘বিউটিফুল ডগ, একটু আদর করতে পারলে আপনাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।’

উত্তরে মেমসাহেবরা প্রায় একইসঙ্গে বলে উঠেছিলেনঃ ইয়েস, উই লাভ টু-- ।

জাদুকর কাপড়ে জড়ানো কুকুরছানাটি সামনে আনতেই তিন সুন্দরী ঝুঁকে পড়ে আদর করলেন, আর ঠিক তখনই অঘটনটা ঘটে গিয়েছিল। সরু একটা জলের ধারা ছিটকে এসে পড়ল তিন মহিলার মুখে। ওঁরা আঁতকে উঠে বলেছিলেনঃ ওহ্‌! মাই গড!

জাদুকর তখন দাঁত বার করে একগাল হেসে বললেন, ‘না-না ম্যাডাম, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। ওই জলের ধারাটা এসেছে অন্য জায়গা থেকে। এই দেখুন-- ।’

এই না বলে আস্তিন গুটিয়ে ছোট্ট একটা পিচকারি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ঘর ফাটিয়ে হাসির রোল উঠেছিল তখন। এই সব শো-তে শোম্যানশিপ একটা মস্ত ব্যাপার। ভালো জাদুকররা সুবক্তা হন, কথার মধ্যে চমত্কার রসবোধও থাকে। মজাদার কথা শুনে দর্শকরা হাসেন, এবং একটু বোধহয় অন্যমনস্কও হন ; জাদুকরের হাতসাফাই বুঝি সেই ফাঁকেই হয়ে যায়।

মেক্সিক্যানের খেলা শেষ হওয়ার পরে মঞ্চে একজন আমেরিকান জাদুকর উঠেছিলেন। এই মানুষটিও পরের পর দুর্ধর্ষ খেলা দেখিয়ে গেলেন। বেশির ভাগই হাতসাফাইয়ের খেলা। শূন্য থেকে কত কিছু ধরে শুধু টুপি নয়, সামনে রাখা মস্ত এক প্লাস্টিকের বালতি পর্যন্ত ভর্তি করে ফেললেন। তাসের খেলাও দেখালেন নানা ধরনের। এলোমেলো অনেকগুলো সংখ্যা দেখিয়ে দর্শকদের একজনকে বললেন, পছন্দসই যে-কোনও একটি সংখ্যা কাগজে লিখে ভাঁজ করে হাতে রেখে দিন। কাঠের হরফে লেখা সংখ্যাগুলি একটি পাত্রে মিশিয়ে দিলেন জাদুকর। তারপর অবাক কাণ্ড, জাদুকরের হাতের ইশারায় সেই হরফটাই উঠে এলো যেটি দর্শকসারির এক মহিলা লিখে রেখেছিলেন। জোর হাততালি উঠেছিল আবার।

এই থিয়েটার ছেড়ে আরও দুটি থিয়েটারে গিয়েছিলাম। সব জায়গাতেই আশ্চর্য সব ম্যাজিকের খেলা। মধ্যিখানে স্ন্যাক্স বারে ঢুকে আরও কিছু খেয়ে নিয়েছিলাম। আলোআঁধারি জাদুদুর্গে কখন যে রাত আড়াইটে বেজে গিয়েছে, টের পাইনি। নাইটক্লাব ভোর পর্যন্ত খোলা, কিন্তু না, আর নয় ; ফিরতে এবার। আলো-আঁধারে মেশানো জাদু-দুর্গটি অনেকটা বুঝি ভুলভুলাইয়ার মতো। কোন্‌ পথ কোথায় গেছে চট করে বোঝা মুশকিল। ফেরার পথ খুঁজে বার করতে আমাদের বোধহয় একটু সময় লেগে গিয়েছিল। ফেরার পথেও আগের সেই দৃশ্য। জাদুর খেলায় বুঁদ হয়ে আছে জাদুকররা। কিছুটা এগোবার পরে শমীক বলল, ‘তুমি এগোও, আমি একটু টয়লেট থেকে আসছি।’

আলো-আঁধারি পথ ধরে আমি একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাত্ই সামনে ভেসে উঠেছিল সেই মহিলার ছায়ামূর্তি। ছোটখাটো চেহারা, পরনে বড় ঘেরের সাদা গাউন আর ফ্রিল-দেওয়া ফুলহাতা জামা। ছায়ামূর্তি হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমাকে। অদ্ভুত ধরনের আকর্ষণ বোধ করছিলাম। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। ছায়ামূর্তিও পিছিয়ে যাছিল। আমাদের মধ্যিখানের ব্যবধান থেকে যাচ্ছিল একই। বাঁকানো, ঘোরানো পথ ধরে ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করছিলাম আমি। অমোঘ টান তীব্রতর হয়ে উঠছিল। আস্তে আস্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই পিয়ানোর ঘরে। ছায়ামুর্তি দ্রুত কয়েক পা হেঁটে গিয়ে পিয়ানোর সামনের আসনে বসে পড়েছিল। তারপর দু-হাত ছড়িয়ে দিয়েছিল পিয়ানোয়। আঙুল পিয়ানোর কিবোর্ডে । সুরের মূর্ছনায় রীতিমত মোহিত গিয়েছিলাম। অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতা গ্রাস করেছিল আমাকে। ছোটখাটো চেহারার মহিলা বিভোর হয়ে পিয়ানো বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে মুখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছিলেন আমার দিকে, বোধহয় তারিফ পাওয়ার জন্যে। কিন্তু সুরের মূর্ছনা আমাকে বুঝি সম্পূর্ণ অসাড় করে দিয়েছিল, শরীরের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

এই ভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানি না। হঠাত্ কানের কাছে জোরালো শব্দ শুনে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম শমীক। ও বলল, ‘তুমি এখানে চলে এসেছ! আমি তোমাকে ওদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।’ কথা শুনে সম্বিত ফিরে পেয়েছিলাম। মুখ ফিরিয়ে দেখলাম বাদকহীন পিয়ানো আগের মতোই বেজে চলেছে। সাদা গাউনপরা ছোটখাটো চেহারার মহিলার চিহ্নমাত্র নেই। বুঝলাম বিভ্রমের শিকার হয়েছিলাম। কথাটা শমীককে বলতে গিয়েও বললাম না। জাদুদুর্গ থেকে গেস্টহাউসে ফিরে এসেছিলাম ভোর সওয়া-তিনটে নাগাদ।

পোশাকআশাক পালটে মিনিট-পনেরোর মধ্যে শুয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছিলাম। মাথার মধ্যে ভার-ভার। অসাধারণ সব জাদুর খেলা দেখে এসেছি জাদু-দুর্গে, কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছিল ওই বিভ্রম। সাদা গাউন, ফ্রিল-দেওয়া পুরো-হাতা ছোটখাটো চেহারার মহিলাকে এখনও যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। শূন্য থেকে ভেসে উঠে দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে বসে পড়েছিল পিয়ানোতে। পিয়ানোবাদকের আসনে বসে দু-হাত ছড়িয়ে দিয়েছিল কি-বোর্ডে, আঙুলের চাপে ওঠানামা করছিল পিয়ানোর কি-গুলো। দেখার মধ্যে ভুল ছিল না একটুও, কিন্তু আবার মিলিয়ে গিয়েছিল শূন্যে। আসলে দু-তিনটে দিন আমার বেশ ছোটাছুটি হয়ে গিয়েছিল, সেই ধকলের জেরেই বুঝি ওই বিভ্রম—।

শোবার বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়েছি, উঠলাম দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পরে। মাঝখানে আর একটা দিন, পরশুই দেশে ফেরার প্লেনে উঠব। আজ আর কোথাও বেরুব না। কাল সন্ধেয় শমীককে নিয়ে ওয়ালমার্টে গিয়ে সামান্য কিছু উপহার কিনব, ফিরে গিয়ে একে-তাকে দিতে হবে। শমীককে ফোন করে সে-কথা জানিয়েও দিয়েছিলাম।

পরের দিন শমীক আসতেই ওকে নিয়ে ছুটেছিলাম ওয়ালমার্টে। চটপট কেনাকাটা শেষ হতেই শমীক বলল, ‘চলো, সামনের কফিশপে বসে একটু কফি খাই।’

একটু দুরেই একটা কফিশপ। বেশ বড়সড় চেহারার একটা শপ, কিন্তু খদ্দেরের সংখ্যা নামমাত্র। আমরা জানলার ধারের একটা টেবিলে বসার মুখেই ওদিক থেকে হাত তুলল এক সাহেব। ঝলমলে মুখে শমীক বলল, ‘আরে, গার্ডনার! এঁর গেস্ট হয়েই আমরা তো ম্যাজিক-কাসলে গিয়েছিলাম। চলো ওঁর টেবিলেই বসি, উনি একা আছেন।’

সাহেব আপ্যায়ন করার ভঙ্গিতেই ওঁর টেবিলে বসালেন আমাদের। শমীক বলল, ‘এর মধ্যেই সানফ্রান্সিসকো থেকে ফিরে এলেন?’

সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ‘আই হ্যাড আ বিট অব লাক। কাজকর্মগুলো তাড়াতাড়ি মিটে গেল বলেই ফিরে আসতে পারলাম।’

শমীক আমার সঙ্গে গার্ডনারের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাজিক-কাসল আমাদের দুজনেরই খুব ভালো লেগেছে।’

সাহেবের মুখের হাসি চওড়া হয়েছিল। ‘লাগবেই তো। আমাদের কাসল সবারই ভালো লাগে। আমি প্রায়ই যাই।’ কিছু-কিছু সদাহাস্যময় মানুষ আছেন যাঁরা অনর্গল একতরফা কথা বলে যেতে পারেন, সাহেব সেই দলের। বেশির ভাগ কথাই বলে যাচ্ছিলেন জাদু-দুর্গ নিয়ে। ওখানে মেম্বারশিপ নেওয়ার জন্যে চাহিদা এখন খুব বাড়ছে। তবে যাকে-তাকে সদস্য করা হয় না। অডিশনে পাশ করা বেশ কঠিন। জাদু-দুর্গের বয়েস প্রায় সওয়া-শো বছর । প্রাচীন দুর্গ। ওখানকার মানুষজন অনেক কিছু দেখেছে। ভূতও দেখে কেউ-কেউ। আপনি কিছু দেখেননি?’

একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বললাম, ‘আমি... ভূত... শুনি একটু ভূতের গল্প।’

গার্ডনারের বয়েস বোঝা মুশকিল। লম্বাচওড়া চেহারা, গায়ের রঙ লালচে-ফর্সা, মাথায় সোনালি চুল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পরে বললেন, ‘কাসলে ঢুকতেই একটা গ্রান্ড পিয়ানো দেখেছেন তো? পিয়ানোর কোনও বাদক নেই, কিন্তু পিয়ানো বেজে চলেছে নিজের খেয়ালে। কিবোর্ডের কি-গুলো আপনা থেকে উঠছে, নামছে। পাকা পিয়ানো-বাদকের বাজনা। আপনি যদি বিশেষ কোনও সিম্ফনি বা সোনাটা শুনতে চান, শুনিয়ে দেবে। এই পিয়ানিস্টকে নিয়ে একটা গল্পকথা চালু আছে।’

‘গল্পকথা! কীরকম?’

সাহেবের মুখে রহস্যময় একটা হাসি ফুটে উঠেছিল। ‘সব প্রাচীন মহল নিয়েই কিছু গল্পকথা চালু থাকে। সেই মহলটি যদি জাদু-দুর্গ হয়, তাহলে গল্পকথার পরিমাণ একটু বেশিই হবে। শতখানেক বছর আগে এখানে অনেক বাড়িতেই গ্রান্ড পিয়ানো রাখার চল ছিল। সেটি আবার আভিজাত্যের প্রমাণ হিসেবে ধরা হত। তা, প্রাচীন এই দুর্গটিতেও একটি পিয়ানো ছিল। কিন্তু থাকলে কী হবে, গৃহকর্তা একেবারেই সঙ্গীতরসিক ছিলেন না। তবে এ বাড়ির নিয়মিত অতিথি এক মহিলা খুব পিয়ানো-অনুরাগী ছিলেন। মহিলার নাম ইরমা। ওই বাড়িতে গেলেই তিনি এক সময় পিয়ানোয় বসে পড়তেন এবং অনেকক্ষণ ধরে বাজাতেন। ইরমার পিয়ানোর হাত খুব মিষ্টি ছিল, কিন্তু গৃহকর্তার প্রাণে সুর ছিল না তিনি বিরক্ত হতেন। বিরক্তির মাত্রা খুব বেড়ে যাওয়ার ফলে একদিন সাতসকালেই পিয়ানোটিকে তিনি বাড়ির চারতলায় তুলে দিয়েছিলেন। পরদিন ইরমা এসে এই ঘটনায় বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে বলে ওঠেন—এ কি! এ ভাবে এখানে আমার পিয়ানো বাজানো বন্ধ করে দেওয়া হল! ঠিক আছে, আমি মারা যাওয়ার পরে এ বাড়িতে এসে রোজ পিয়ানো বাজিয়ে যাব। দেখি, কে তখন আমাকে আটকায়!’

‘তারপর?’

‘ইরমা খুব বেশিদিন বাঁচেননি। ওই ম্যানসনটি ম্যাজিক-কাসল হয়ে উঠল এক সময়। তখন এই দুর্গের অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছিল। চিলেকোঠায় পড়ে-থাকা গ্রান্ড পিয়ানোটি নিয়ে আসা হয় মিউজিক রুমে। শেষে দুর্গের প্রথম ঘরটিতে। ওই যেখানে আপনারা পিয়ানোটিকে বাজতে দেখেছেন। কথা রেখেছে ইরমা, আজও তার ভূত এসে পিয়ানো বাজিয়ে যায়।’

সাহেবের চোখমুখ রহস্যময় হয়ে উঠেছিল। ঠোঁটে একচিলতে হাসি।

আমি আচমকা জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘আচ্ছা, ইরমাকে কেমন দেখতে ছিল? মানে, ওর চেহারার কোনও বর্ণনা পেয়েছেন?’

সাহেবের কপালে দু-একটা ভাঁজ ফুটে উঠেই মিলিয়ে গিয়েছিল। ‘না, পরিষ্কার কোনও বর্ণনা পাওয়া যায়নি। তবে যারা দেখেছে, তাদের কথার মধ্যে একটু মিল আছে। এই যেমন—ছোটখাটো চেহারা, পরনে বড় ঘেরের সাদা গাউন--।’

থামিয়ে দিয়ে আমি বলে উঠেছিলাম, ‘গায়ে পুরোহাতা জামা, জামায় ফ্রিল?’

সাহেব একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন, ওইরকম জামার কথাই তো শুনেছি।’

কফির টেবিলে সেদিন আড্ডা গড়িয়েছিল ঘণ্টাদেড়েক, তারপর আমরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিই।

পরদিন যথাসময়ে আমি দেশে ফেরার বিমানে উঠে পড়েছিলাম।

 

 
 
 

Comments


ssss.jpg
sssss.png

QUICK LINKS

ABOUT US

WHY US

INSIGHTS

OUR TEAM

ARCHIVES

BRANDS

CONTACT

© Copyright 2025 to Debi Pranam. All Rights Reserved. Developed by SIMPACT Digital

Follow us on

Rojkar Ananya New Logo.png
fb png.png

 Key stats for the last 30 days

bottom of page