সম্পূর্ণ রহস্য উপন্যাস
প্রথম পর্ব
(এক)
প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাজ ইন্ডিয়ার বাইরে ছিল, কলকাতায় ফিরেছে দুদিন আগে। প্রায় তিন মাস ইউ.এস.এ. আর ইউ কে.র নানান জায়গায় থাকতে হয়েছে, অবশ্যই তদন্তের কাজে। একটা স্মাগলিং গ্রুপের সুলুক-সন্ধান বার করার জন্য সিবিআইয়ের চিফ মিস্টার ঠাকুর ওকে অনুরোধ করেছিলেন। ওর কাজ ছিল ইন্ডিয়ার বাইরে থেকে বিশেষত ইউ.এস.এ. আর ইউ.কে. থেকে কীভাবে ড্রাগ ইন্ডিয়ায় ঢুকছে বা কারা এর পিছনে আছে তা বার করা। পুরো গ্যাংটাকে ধ্বংস করা না গেলেও এমন ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়েছে যাতে আগামী বেশ কয়েক বছর অন্তত নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। গত তিন মাস ভয়ংকর পরিশ্রম গেছে তাই ও ডিসিশন নিয়েছে অন্তত এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেবে কোন কেস হাতে নেবে না এবং নিজের স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে কয়েকটা দিন কাটাবে।
রবিবার। বর্ষাকাল। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল দুপুর থেকে এই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ওয়েদার ফোরকাস্ট জানাচ্ছে নিম্নচাপের জন্য এই রকম আবহাওয়া আর বৃষ্টি আরো দুতিন দিন চলবে। রাজ ব্রেকফাস্ট করে কফির কাপ হাতে নিউজ পেপারটা খুটিয়ে পড়ছিল। ওর স্মার্টফোনটা বেজে উঠলো। অচেনা নম্বর তবে ওর ফোনে ট্রু কলার আইডি ইন্সটল করা আছে। ট্রু কলার আইডি জানাচ্ছে বিদিশা দত্ত নামে কেউ একজন ফোন করছেন। রাজ ফোনটা রিসিভ করতেই উল্টোদিক থেকে একজন মহিলার সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল –
- আপনি কি গোয়েন্দা রাজ কথা বলছেন?
গলা শুনে প্রাথমিকভাবে রাজের মনে হল প্রশ্নকর্তার বয়স অল্প, সম্ভবত কিশোরী। রাজের গোয়েন্দা শব্দটাতে আপত্তি আছে, ও প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। উত্তর দিল –
- আমি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাজ কথা বলছি। বলুন, কী দরকার।
- আমরা ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি। আমার বাবা হারিয়ে গেছেন, ওঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি এখুনি একবার আসুন।
- কিন্তু, এখন আমি তো যেতে পারব না। আসলে দুদিন আগে ইন্ডিয়ায় ফিরেছি, প্রচন্ড ক্লান্ত। তাছাড়া, বাইরে এরকম বৃষ্টি হচ্ছে। আগামীকাল সকালের দিকে আপনাদের বাড়িতে যেতে চেষ্টা করব। আপনাদের বাড়ীর ঠিকানা আমার এই নম্বরে হোয়াটস অ্যাপ করে পাঠিয়ে দিন।- আগামীকাল নয়, আপনাকে এক্ষুনি আসতে হবে। বললাম না ভয়ঙ্কর বিপদ। আপনি কীরকম মানুষ! আপনি যা চাইবেন তাই দেব। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মেয়েটি ফোনটা কেটে দিল। রাজ প্রথমে রেগে গিয়েছিল, তারপর হেসে ফেলল। এই মেয়েটি বিয়ে করেছে কিনা জানা নেই। সম্ভবত অবিবাহিত কারণ বাবা-মার কথাই বলল, স্বামীর কথা বলল না। যাঁকে বিয়ে করবে তাঁর কপালে কতটা দুঃখ আছে সেই ভেবেই হাসছিল।
রাজ কোন অগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার জানে না। ওকে অনেকেই অন্তত রিভলভারটা চালানো শিখতে বলেছেন, কিন্তু ও কিছুতেই শিখবে না। সবাইকে বুঝিয়েছে, ওর একটাই অস্ত্র সেটা হল মগজাস্ত্র। তবে, কিছু জিনিস ঠেকে শিখেছে। একটা তদন্তের কাজে দিল্লি দিয়ে ছোরার আঘাতে মরার উপক্রম হয়েছিল। ওকে বাঁচায় মিস্টার ঠাকুরের দেওয়া বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। অত্যন্ত পাতলা আর হালকা, জামার নিচে পড়তে হয়। এটা ও সব সময় পড়ে তারপর বাইরে বেরোয়। জ্যাকেটটা পড়ে যখন জামা পড়ছে তখন বাইরে রাস্তায় গাড়ির হর্ন শুনলো, তারপর কেউ একজন কলিং বেলও বাজালো। ও নিচে নেমে দরজা খুলে দেখল গাড়ির ড্রাইভার ওকে সঙ্গে যেতে বলছে। ও দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল।
(দুই)
গাড়িতে উঠতে উঠতে বৃষ্টির মধ্যেই রাজের যে দুটি জিনিস চোখে পড়লো সেটি হল গাড়িটি চকোলেট কালারের সুইফট ডিজায়ার আর গাড়ির পিছনে কাঁচে আটকানো “সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ” লেখা স্টিকার। এর নিচে আরও একটা স্টিকার লাগানো যাতে লেখা আছে “দেব ট্রাভেলস”। রাজ সিটে হেলান দিয়ে বসে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল –
- এটা কি দেব ট্রাভেলসয়ের গাড়ি?
- হ্যাঁ।
- আপনাদের কোম্পানির অফিসটা কোথায়?
- যাদবপুর সেন্ট্রাল রোডে।
- এখন কি যাদবপুরে যাচ্ছি?
- না। বারুইপুরের একটা ঠিকানায় আপনাকে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে।
- মানে! আপনাকে কে পাঠিয়েছেন?
- দেখুন, এত কিছু জানি না। কেউ একজন মালিককে ফোন করে বলেছেন আপনার বাড়িতে এসে আপনাকে তুলে বারুইপুরের একটা ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আমি তো ভেবেছিলাম আপনিই ফোন করে গাড়ি চেয়েছেন।
রাজ দ্রুত ভেবে যাচ্ছিল। মেয়েটির সঙ্গে ফোনে কথা হল, মেয়েটি নিজের নাম না বলে ফোনটা কেটে দিল। গাড়ি পাঠাবে বলল। তার ঠিক আধঘন্টা বাদে গাড়ি চলে এল! অর্থাৎ, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি যাদবপুরের এই ট্রাভেল এজেন্সিকে ফোন করে ওর ঠিকানায় গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলল। একারণেই গাড়ি আধঘণ্টার মধ্যে চলে এসেছে। গাড়ি বাইপাস দিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। রাজ জিজ্ঞাসা করল –
- মালিক তোমাকে আমার বাড়িতে আসতে কখন বলেছে?
- গতকাল রাতে। টাইমটাও বলেছে, ঠিক সকাল সাড়ে নটা নাগাদ। সঙ্গে এটাও বলেছে, প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে বেশি কথা না বলতে। গাড়ির পেমেন্ট নাকি পার্টি আগেই করে দিয়েছে।
রাজ সবটা শুনে চুপ করে বসে রইল, দ্রুত ভেবে নিচ্ছিল এই মুহূর্তে ওর করণীয় কী। তারপর ডিসিশন নিল খেলাটা শেষ অবধি খেলবে। দেখাই যাক না কী হয়।
গাড়ি বারুইপুরের বাস স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে অনেকটা যাওয়ার পর একটা বিশাল কম্পাউন্ডে ঘেরা বাগান বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। ড্রাইভার হর্ন বাজালেন। একজন বৃদ্ধ মানুষ ছাতা মাথায় দিয়ে এসে গেট খুলে দিলেন। গাড়ি ভিতরে ঢুকে সোজা গিয়ে দাঁড়ালো একটা দোতলা বাড়ির সামনে। বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। রাজ বুঝতে পারছিল ড্রাইভারকে সবরকম ইনস্ট্রাকশন আগে থেকেই দেওয়া আছে। মাঝবয়সী ড্রাইভার রাজকে বললেন –
- স্যার, সোজা ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চলে যান, ওঁরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
“ওঁরা” এই শব্দটা রাজের কানে বাজলো। গাড়ির গেট খুলে নেমে দৌড়ে বাড়ির গাড়ি বারান্দার নিচে চলে এল। একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গেল। সদর দরজা খোলা। দরজার উপরে একটা সিসিটিভি ক্যামেরা ওর চোখে পড়ল। অর্থাৎ, উপরে যাঁরা আছেন তাঁরা ওকে নজরে রাখছেন। একটু ইতস্তত করে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। একটা প্যাসেজ, যেটা গিয়ে শেষ হয়েছে দোতলায় যাওয়র সিঁড়ির সামনে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে খেয়াল করল সিঁড়িতেও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনে একটা বড়ো ঘর সম্ভবত হল ঘর জাতীয় কিছু। দরজা খোলা। গেটে একজন পাহারা দিচ্ছে। তার কোমরে রিভলভার। রাজকে ইঙ্গিতে লোকটি ভিতরে যেতে বলল।
রাজ গটগট করে ভিতরে ঢুকলো কারণ মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছে এসবের পিছনে কারা আছেন। হ্যা, ওর অনুমান সঠিক। বিশাল হলঘরের একদিকে একটা বড়ো টেবিলের পিছনে চারজন বসে আছেন। এঁদের মধ্যে একজন রাজের অত্যন্ত পরিচিত। রাজ এগিয়ে গিয়ে ওঁর উলটো দিকের চেয়ারে বসে হেসে সিবিআই চিফ মিস্টার ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করল –
- এভাবে আমাকে এখানে ডেকে আনার কারণ কী! সোজাসুজি ডেকে পাঠালে কি আসতাম না? আপনি আমাকে যেখানে ডেকে পাঠাবেন সেখানেই যে আমি যাব তা তো আপনি ভালোই জানেন।
মিস্টার ঠাকুর ওঁর লম্বা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে হেসে বললেন –
- একটু মজা করা, এই আর কী। তবে সত্যিই আমাদের তোমার সাহায্য দরকার, বিষয়টা অত্যন্ত জরুরী। পরে সেটা নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করছি। কিন্তু কী করে বুঝলে আমিই তোমাকে এখানে আনার জন্য এসব করেছি?
- গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলেই বুঝতে পেরেছি। এর পিছনে যে আপনি আছেন তা বুঝলেও এখানে এসে আপনার দেখা পাব সেটা অবশ্য আশা করি নি। আপনি নিজেই যখন কলকাতায় চলে এসেছেন তখন বুঝতে হবে বিষয়টা অত্যন্ত জরুরী।
- কী খাবে? চা না কফি? বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিও এখানে লাঞ্চ করে সন্ধ্যার সময় বাড়িতে ফিরবে।
রাজ হেসে বলল –
- ও-কে, কফি দিতে বলুন। ভেবেছিলাম দিন সাতেক বিশ্রাম নেব, নিজের স্ত্রীর সাথে একান্তে কয়েকটা দিন কাটাবো। কিন্তু, আপনার জন্য মনে হয় সেটা বোধহয় হবে না।
- আহা, চটছো কেন! তুমি তো প্রফেশনাল গোয়েন্দা। অবশ্য গোয়েন্দা শব্দটাতে তোমার একটু আপত্তি আছে। সে যাই হোক, তোমার এই সার্ভিসের জন্য ভারত সরকার তোমাকে তোমার উপযুক্ত অনারারিয়াম দেবে। জানি দুদিন আগে ফিরেছ, প্রচন্ড টায়ার্ড। আমাদেরই হেল্প করার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছ। তা সত্বেও তোমাকে ডাকতে হল কারণ এই কাজ তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না।
- তাই! তা কাজটা কী?
- তোমার বান্ধবী স্যরি বউ কেমন আছে? কলকাতায় ফেরত এসে দেখা করেছ?
হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল! দ্রুত ভেবে যাচ্ছিল কারণটা কী হতে পারে। কিন্তু ইতস্তত করে বলল –
- কলকাতায় এসে যাবার সময় পাই নি। গতকাল রাতে ফোনে কথা হয়েছে, ভালই আছে।
- তুমি বিদেশে স্মাগলারদের সুলুক সন্ধানে ব্যস্ত থাকাকালীন তোমাকে না জানিয়ে সত্যসন্ধানী অনামিকা চৌধুরীকে ইন্ডিয়ার বিশেষ করে ওয়েস্ট বেঙ্গলের স্মাগলারদের উইংটাকে ধ্বংস করার কাজে লাগানোতে তুমি আমাদের উপর রেগে গিয়েছিলে। কিন্তু, উপায়ও ছিল না। অনামিকা অতুলনীয়া। অসাধারণ বুদ্ধিমতী, কুংফুতে ব্ল্যাক বেল্ট, সাংঘাতিক ফিজিক্যাল ফিটনেস শুধু নয়, দারুন ভালো ফায়ার আর্মস চালাতেও শিখে গেছে। বহুদিন ধরেই ও আমাদের নজরে ছিল, তাই ওকে তদন্তের কাজে লাগাতে বাধ্য হয়েছিলাম।
- হ্যা, এমনই কাজ যাতে ওর প্রতি মুহূর্তে প্রাণ চলে যাওয়ার চান্স ছিল।
- অস্বীকার করছি না। একসময়ে আমরাও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ওকে তদন্ত বন্ধ করে দিল্লি চলে যেতে বলেছিলাম। ও কিন্তু শোনেনি। একা পুরো গ্যাংটাকে শেষ করে দিয়েছিল। ভীষণ একরোখা মেয়ে, ঠিক তোমারই মতো। তোমরা দুজনেই তো খুব ভালো বন্ধু, ছোটবেলা থেকেই একে অপরকে চেনো, তোমার কি মনে হয় না অনামিকা তোমার লাইফ পার্টনার হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি উপযুক্ত ছিল? তাছাড়া, আমি ভালো করেই জানি অনামিকাও তোমাকে খুবই পছন্দ করে। তাহলে সমস্যাটা কোথায় ছিল?
মিস্টার ঠাকুরের কথায় রাজের মন চলে গেল অতীতে। নানা ঘটনা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল প্রথম শর্মিলার কথা, যাকে ও বাঁচাতে পারে নি। দ্বিতীয় শর্মিলা এল ওর জীবনে, সেও রাজকে ছেড়ে চলে গেল। তারও আগে অনামিকা, যখন অনামিকা সত্যসন্ধানী হয়ে ওঠে নি, এসেছিল ওর কাছে, ওকে জানাতে চেয়েছিল নিজের ভালবাসার কথা। কিন্তু, রাজ ফিরিয়ে দিয়েছিল ওকে। তারপর, রাজেরই জন্য অনামিকা জড়িয়ে পড়েছিল এক জটিল রহস্যের তদন্তে, জন্ম হয়েছিল সত্যসন্ধানী অনামিকা চৌধুরির। রাজ মিস্টার ঠাকুরের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল এসব কথা উনি বলছেন কারণ এমন কিছু বলতে চলেছেন এগুলো যার ভূমিকা মাত্র। হেসে বলল –
- অনামিকার সঙ্গে কোন সম্পর্ক তৈরি হয় নি কারন আমি নিজেকে ওর অনুপযুক্ত বলে মনে করি। আমরা দুজনে খুব ভালো বন্ধু। আমি এক শর্মিলাকে হারিয়েছি, আরেক শর্মিলা ছেড়ে চলে গেছে। তাছাড়া, আর কেউ না জানলেও আপনি তো জানেন আমি বিবাহিত। রোমাকে খুব ভালোবাসি, ওকে হারাতে চাই না। এবারে প্লিজ ভনিতা না করে প্রয়োজনটা কী সেটা বলুন।
- অনামিকাকে সিবিআইতে জয়েন করতে বলেছিলাম কিন্তু তোমার মত অনামিকাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় না, স্বাধীনভাবে নিজের কাজ করতে চায়। আমাদের ডিপার্টমেন্টে ওকে খুব দরকার ছিল। আসলে সিবিআইতে মহিলা গোয়েন্দাই সেরকম নেই, ভালো মহিলা গোয়েন্দা কোথায় পাব! একজনকে অবশ্য পেয়েছি, দারুন, অসাধারণ। মাত্র দু'বছর আগে জয়েন করে তিন তিনটে কেস খুবই ভালো ভাবে ট্যাকেল করেছে। ফিজিক্যাল ফিটনেসও খুবই ভালো।
- তাহলে আপনারা আরেকটা অনামিকা চৌধুরি পেয়ে গেলেন?
- না। অনামিকা একজনই হয়। ওর ধারে কাছে কেউ কখনও পৌঁছতে পারবে না। তবে, আমাদের সমস্যার অনেকটা হাল ধরতে পারবে এই মেয়েটি। এই কারণে, বর্তমানে, এই মেয়েটি আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রিসেন্টলি, কিছু কারণে, আমরা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছি। সিবিআইকে অপদস্থ করবার জন্য কেউ বা কারা সম্ভবত এই মেয়েটিকে খুন করতে চাইছে। আমি চাই তুমি মেয়েটিকে প্রোটেক্ট কর এবং এর পিছনে কে বা কারা আছে তা খুঁজে বার কর।
- আমি! এক্ষেত্রে অনামিকাই তো বেস্ট চয়েস। ওকে বলুন।
- না। অনামিকা প্রোটেক্ট করতে পারলেও তাড়াতাড়ি অপরাধীদের খুঁজে বার করার ক্ষেত্রে কতটা সফল হবে তা জানি না। আমরা কোন রিস্ক নিতে চাই না। তাই, ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা স্যরি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরকে এই কাজে লাগাতে চাই। তুমি মানো আর না মানো, এই মুহূর্তে আমাদের কাছে তুমি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা। প্লিজ, না কোর না।
- ও-কে, আমি চেষ্টা করব। তবে, অনেক প্রশ্ন আছে, অনেক কিছু জানার আছে।
লাঞ্চের পর বাকি কথা হবে বলে উনি রাজকে থামিয়ে দিলেন।
(তিন)
লাঞ্চের পর আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। ঘরে শুধু মিস্টার ঠাকুর আর রাজ। মিস্টার ঠাকুর বলা শুরু করলেন –
- ঘটনার সূত্রপাত দিন দশেক আগে। মেয়েটি আমাদের জানায় ওর বাড়ির প্রতিটি ঘরে লুকানো ক্যামেরা নাকি ও পেয়েছে। ওর ধারণা ওগুলো ওর কার্যকলাপের উপর নজর রাখার জন্য আমরাই নাকি লাগিয়েছি! ওর কথা শুনে আমরা অবাক হলেও ওগুলো যে আমরা লাগাই নি তা না বলে আমরা ওকে জানাই ওর সেফটির জন্য আমরাই ওগুলো লাগিয়েছি। আমাদের সমস্ত গোয়েন্দাদের সেফটির জন্য এটা আমরা করে থাকি। আমরা স্বাভাবিকভাবে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে উঠে এবং নানা জায়গায় আমাদের ইনফর্মারদের কাজে লাগাই। গত পরশু আমাদের কাছে ইনফর্মেশন আসে আমাদেরকে অপদস্ত করার জন্য আমাদের মধ্যে এক বা দুজন গোয়েন্দাকে খুন করার প্ল্যান হচ্ছে। কে বা কারা এর পিছনে আছে তা অবশ্য ইনফর্মার বলতে পারে নি। আমরা এটা শুনে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বুঝতে পারি এই মেয়েটিই সম্ভবত ওদের টার্গেট। কারণ, প্রথমত মেয়েটি দু'বছরে তিন-তিনটি কেস সলভ্ করেছে। একটা স্মাগলিং গ্যাংকে ধরে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই মুহূর্তে এই মেয়েটিই আমাদের মহিলা গোয়েন্দাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ যদিও বয়স খুবই অল্প। আর তৃতীয় ও শেষ কারণটা হল, আমাদের কাছে ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং আমরা ওকে নিয়ে অনেক কিছু প্ল্যান করছি। এত সব যে ঘটেছে তা কিন্তু মেয়েটি জানে না। ওর আত্মসম্মানবোধ অত্যন্ত বেশি, তাই ওকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে কাজে লাগানো হয়েছে শুনলে হয়তো চাকরিটাই ছেড়ে দেবে।
- আমি এখনও আপনার প্রস্তাব অ্যাকসেপ্ট করিনি। যদি আমি তদন্ত শুরু করি তাহলে তা করতে হবে অত্যন্ত গোপনে এবং মেয়েটিকে না জানিয়ে। তাই তো?
- হ্যাঁ। এবং এই কাজের জন্য যদি তোমাকে মেয়েটির ঘনিষ্ঠ হতে হয়, মেয়েটির সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক তৈরি করতে হয়, তাহলে আমরা দুঃখ তো পাবই না বরং খুশি হব। কারণ, আত্রেয়ী তোমার উপযুক্ত লাইফ পার্টনার হতে পারবে। অবশ্য দুটো ছোট্ট অসুবিধা আছে, আত্রেয়ী তোমার থেকে লম্বায় এক ইঞ্চি বেশি আর তোমার বর্তমান বউ রোমা চৌধুরী দুঃখ পেতে পারে। রোমার কেসটা আমরা ম্যানেজ করে দেব।
- হঠাৎ এ কথা বললেন! আপনি জানেন না রোমাকে কতটা ভালোবাসি!
- কারণ, তুমি সিবিআইতে জীবনে জয়েন করবে না। অনামিকাও নয়। তোমাকে আমাদের দরকার। রোমাও সিবিআই ছাড়ার প্ল্যান করছে। সেক্ষেত্রে, আত্রেয়ী গুপ্তের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক তৈরি হলে - আত্রেয়ী তোমার স্বগোত্রীয়, তাই বিয়েতে আটকাবে না।
- কী! প্রথমত, আপনি ভালো করেই জানেন আমি কোন রকম ধর্ম মানি না। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সবাই আমার কাছে সমান। কোনরকম কুসংস্কারও আমার নেই। দ্বিতীয়ত, আমার মনে হচ্ছে প্রধানত এই কারণেই অনামিকাকে কাজের দায়িত্ব না দিয়ে আমাকে দেওয়া হচ্ছে। মানে আপনি নোংরা ঘটকালি করছেন! আর রোমাকে ছাড়া আমি ভাবতেই পারি না। রোমার সঙ্গে আমার বিয়ে, সেও তো আপনার জন্যই হয়েছে। এখন নিজেদের প্রয়োজনে ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছেন! স্ট্রেঞ্জ!
মিস্টার ঠাকুর হেসে বললেন –
- এটা একদমই ঠিক নয়। এই কাজটায় অনামিকার থেকে অনেক তাড়াতাড়ি তুমি অপরাধীদের কাছে পৌঁছতে পারবে - এটাই আমাদের ধারণা। আর রোমাকে কতটা ভালোবাসো তা পরীক্ষা করছিলাম। রোমা আমার মেয়ের মতো শুধু নয় হয়ত তার থেকেও বেশি।
উনি একটা ফাইল রাজের হাতে ধরিয়ে দিলেন। রাজ উল্টে দেখে নিল তাতে আত্রেয়ীর ছবি সহ বর্ণনা, ঠিকানা, ফোন নম্বর, বন্ধু আর আত্মীয়দের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরও আছে। ও ফাইলটা টেবিলে রেখে বলল –
- প্রথমত আত্রেয়ীকে প্রোটেকশন দেওয়া আর অপরাধীদের একই সঙ্গে খুঁজে বার করা সম্ভব নয় কারণ আপনার কথায় যতটুকু বুঝতে পেরেছি অপরাধীরা অত্যন্ত সংগঠিত এবং ভয়ঙ্কর। একটা ভুল মানে আত্রেয়ীর জীবন চলে যেতে পারে। তাই, এই মুহূর্তে শুধু প্রোটেক্ট করার কাজটাই করব। বাকিটা পরে দেখা যাবে। এছাড়া, এই ফাইলটায় কাজ হবে না। আত্রেয়ী গুপ্তের উপর সিবিআই এর নিজস্ব গোপন যে ফাইল আছে তা আমার দেখা দরকার।
- সেটা তোমাকে দেওয়া যাবে না। ওটা অত্যন্ত গোপনীয় একটা ফাইল।
রাজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল –
- স্যরি স্যার, আমাকে ক্ষমা করবেন। এই কেসের জন্য আপনি অন্য কাউকে দেখুন।
রাজ জানে উনি রাজকে কতটা স্নেহ করেন, এই কথা শুনে কতটা আঘাত পাবেন। কিন্তু রাজ জানে ওই ফাইলটাই দরকার কারণ ওর মধ্যেই হয়তো দরকারি সূত্র লুকিয়ে আছে। রাজ মাথা নিচু করে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন মিস্টার ঠাকুর ওর নাম ধরে ডাকলেন। রাজ ঘুরে তাকাতেই উনি জিজ্ঞাসা করলেন –
- ফাইলটা দেখা কি একান্তই দরকার?
- ইয়েস স্যার। আমার মনে হচ্ছে হয়তো ওর থেকে কোন দরকারি সূত্র পেতে পারি।
- এই মুহূর্তে সেটা কীভাবে তোমাকে দেব?
- কেন! আপনার সঙ্গে তো ল্যাপটপ থাকে। ফাইলটা খুলে আমার ইমেইলে পাঠিয়ে দিন। আমি স্মার্টফোনে দেখে নিচ্ছি।
- যদি অন্য কারো হাতে পড়ে?
- আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পাশ করেছি শুধু নয় গোল্ড মেডেলিস্ট ছিলাম সেটা আপনি ভালো করেই জানেন। আমি কথা দিচ্ছি ওই ফাইল কারো হাতে যাবে না। আমার কম্পিউটারের ফাইল হ্যাক করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
- আই নো দ্যাট। ও-কে, পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মিনিট দশেক বাদে রাজের স্মার্টফোন একটা নির্দিষ্ট রিংটোনে জানিয়ে দিল ওর ইমেইলে কোন মেইল এসেছে। ও মেইলটা খুলে প্রথমে মিস্টার ঠাকুরের পাঠানো ফাইলটা ডাউনলোড করে নিল, তারপর পড়া শুরু করল।
ওর মাঝে মাঝে বেশ বিরক্তি লাগছিল, কারণ আত্রেয়ী গুপ্তের পছন্দ অপছন্দ থেকে শুরু করে ওর অন্তর্বাসের মাপ অবধি তাতে আছে। শুধু তাই নয়, এমন সব ঘটনার উল্লেখ আছে যা হয়ত আত্রেয়ীরও জানা নেই। দ্রুত পনেরো পাতার ফাইলটা একবার দেখে নিয়ে বলল –
- দেখে নিয়েছি। বাড়িতে গিয়ে ভালো করে পড়তে হবে।
- ঠিক আছে। এই তদন্তটায় আমরা শুধু নয় ভারত সরকারও খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। তদন্ত কত দিন ধরে চলবে জানা নেই। আপাতত তোমার অ্যাকাউন্টে ইনকাম ট্যাক্স ফ্রি পনেরো লাখ টাকা আগামীকাল জমা পড়বে। এ সংক্রান্ত সমস্ত পেপারস্ তুমি কুরিয়ারে পেয়ে যাবে। টাকাটা অবশ্য আসবে একটা সুইস ব্যাংকের একাউন্ট থেকে। আজ থেকেই তদন্তে নেমে পড়। বেস্ট অফ লাক। অবশ্য, তুমি তো আবার লাক টাক মানো না।
উনি রাজের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রাজ যখন বাগান বাড়ি থেকে বেরোল তখন ও খুবই চিন্তিত। ওদের গাড়িতে নয়, রাজ বাড়ি ফিরল উবের ট্যাক্সিতে।
(চার)
বাড়িতে ফিরে প্রথমেই স্মার্ট ফোনে ডাউনলোড করা আত্রেয়ী গুপ্তের ফাইলটার একটা প্রিন্ট আউট নিয়ে নিল। ওর ইমেইল থেকে সাইন আউট করে সেটাকে যাতে কেউ হ্যাক করতে না পারে তার ব্যবস্থা করল। রাতে ডিনারের পর আত্রেয়ী গুপ্তের প্রথম ফাইল যেটা মিস্টার ঠাকুর প্রথমে দিয়েছিলেন সেটা খুঁটিয়ে পড়ল। মেয়েটি বেশ আকর্ষণীয়া সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা। রাজের হাইট পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। একারণেই মিস্টার ঠাকুর বলেছিলেন আত্রেয়ী ওর থেকে লম্বায় এক ইঞ্চি বেশি। ওর বাড়ির ঠিকানা, বাড়িতে কে কে আছেন, আত্মীয়দের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সবই দেওয়া আছে। আত্রেয়ীর বাড়িতে একটা ল্যান্ডলাইন আছে যাতে কলার আইডি লাগানো আছে। এছাড়া ওর দুটো মোবাইল ফোন নম্বর। সবই ফাইলে আছে। রাজ ফোন নম্বরগুলো ওর স্মার্টফোনে তুলে নিল। এবারে ডাউনলোড করা ফাইলটার হার্ডকপি নিয়ে পড়া শুরু করল। সিবিআইয়ের রিপোর্ট পড়তে পড়তে গা ঘিনঘিন করছিল। ওঁরা যে আত্রেয়ী চাকরিতে জয়েন করার পর এইসব খবর জোগাড় করেছেন তা বোঝা যাচ্ছিল এই কারণে যে চাকরির আগের জীবন সম্বন্ধে ডিটেলস তথ্য নেই। একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম ছিল, যা কেটে গেছে। এই মুহূর্তে ওর কোন বয়-ফ্রেন্ড নেই। রাজ ফাইলগুলো বন্ধ করে ওর আলমারির গোপন লকারে ঢুকিয়ে লক্ করে দিল। তারপর, পরদিন সকালের প্ল্যান ঠিক করে ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়ল।
সকালে ঠিক সকাল ছটায় উঠলো। মর্নিং ওয়াকে যাওয়া সম্ভব নয় কারণ মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বেড টি খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। ঠিক আটটায় উঠে মুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিল। ফোন করল বাড়ির কাছের এক ট্রাভেল এজেন্সির কর্ণধারকে। সারাদিনের জন্য একটা অল্টো গাড়ি ভাড়া করল। এবারে সাজগোজের পালা। অতীতে মাত্র দুবার ওকে ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল। এবারেও নিতে হবে। আলমারি খুলে জিরো পাওয়ারের চশমা বার করল। সঙ্গে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। গামের সাহায্যে দাড়ি বসে গেল সঠিক জায়গায়। চশমাটা পড়ে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে নিল। বাইরে গাড়ির হর্ন শুনে বুঝলো অল্টোটা এসে গেছে। কাঁধের ঝোলা ব্যাগে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে নিল। বুলেট প্রুফ জ্যাকেট আগে পড়লে অস্বস্তি হত, এখন সয়ে গেছে। সদর দরজা খুলে এক দৌড়ে গাড়িতে উঠলো। দেখলো বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে ওকে দেখছেন। বাবাকে চেঁচিয়ে বলে দিল ফিরতে রাত হবে।
ওর প্রথম গন্তব্যস্থল যাদবপুর স্টেশন রোডের একটি ছোট্ট সেলফোনের রিচার্জের দোকান। এই দোকানে চালু সিম কার্ড কিনতে পাওয়া যায়। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। নতুন সিম নিতে গেলে আধার অথেন্টিফিকেশন না করালে সিম চালু হয় না। অর্থাৎ যার নামে সিম কার্ড তার আঙুলের ছাপের দরকার হয়। এই দোকানটি যখন কেউ নতুন সিম কার্ডের জন্য আবেদন করতে আসে তখন তার আঙুলের ছাপ নেওয়ার সময় কায়দা করে অন্য আরেকটা সিমের জন্য আঙুলের ছাপ নিয়ে নেয়। দ্বিতীয় সিমটির ক্ষেত্রে কন্টাক্ট নম্বর দেওয়া থাকে দোকানদারের নম্বর। তাই, ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রেও অসুবিধা হয় না। দ্বিতীয় সিমটি দোকানদার চালু করে চড়া দামে বিক্রি করে। রাজ এটা জানে। এই দোকান থেকে আটশো টাকা দিয়ে এমন একটা সিম কিনলো যার সব ধরনের সমস্ত ফোন কল ফ্রি আর প্রতিদিন দু জিবি করে ডেটা ফ্রি। এটা ওর দরকার হবে। ব্যাগ খুলে একটা পুরানো স্মার্টফোন বার করল। চালু সিমটা তাতে ঢুকিয়ে নিল। এরপর এতে শুধু কলার আইডিই নয় আরো অনেক কিছু ঝটপট ইনস্টল করে নিল। এবারে এই ফোন থেকে নিজের আসল ফোনে ফোন করল। আসল ফোনের কলার আইডি দেখাচ্ছে ডক্টর সঞ্জয় সেন ফোন করছেন। তার মানে ওকে এখন ডক্টর সঞ্জয় সেনের রোলে অভিনয় করতে হবে। এটা অবশ্য একটু কঠিন বিষয়। ডাক্তার না হয়ে অন্য কিছু হলে ভালো হত। ডক্টরেট ডিগ্রিও তো হতে পারে? কারণ, সে বিষয়ে যখন কোন কিছুর উল্লেখ নেই। তাহলে ও এখন ড. সঞ্জয় সেন, কম্পিউটার সাইন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডক্টরেট ডিগ্রিধারী, একটি প্রাইভেট কলেজে অধ্যাপনা করত, ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে ব্যবসা করছে। ফোনটা তুলে ফোন করল মিস্টার জয়ন্ত দাসকে।
জয়ন্ত দাস আত্রেয়ী গুপ্তের মামা হন। জয়ন্তবাবু রাজকে ঘন্টা দুয়েক বাদে ওঁর বাড়ীতে যেতে বললেন। এবারে রাজ চলে এল যাদবপুর সুপার মার্কেটের পাশে একটি প্রাইভেট ব্যাংকের পাশের গলিতে। এই গলিতে একটি ফটোকপি কাম কম্পিউটারের ডিটিপি সেন্টার আছে। এখানে ও পঞ্চাশ কপি ভিজিটিং কার্ড বানানোর অর্ডার দিল। কার্ডে লেখা থাকবে –
- “সঞ্জয় সেন কম্পিউটার সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড”
ড. সঞ্জয় সেন
ডাইরেক্টর
আর নামের নিচে ওর নতুন নেওয়া চালু সিমের ফোন নম্বর আর সদ্য বানানো সঞ্জয় সেনের নামে একটি ফেক জি-মেইল অ্যাকাউন্ট। বাদিকের উপরে কোম্পানীর একটি লোগো। পঞ্চাশ কপি কার্ডের প্রিন্ট নিয়ে কেটে সাইজ করে ওর হাতে চলে এল ঘণ্টা খানেক বাদে। ব্যাস, প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছে।
জয়ন্ত দাসের বাড়ি আনোয়ার শাহ রোডের ডান দিকে একটি মাঠের পাশে থাকা একটি নার্সিংহোমের উল্টো দিকের গলিতে। ভদ্রলোক বয়স্ক, ৬২-৬৩ বছর বয়স হবে। ওঁর এক মেয়ে, পুনেতে পোস্টেড, একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি করে। রাজ সঞ্জয় সেন-এর পরিচয়ে গেছে, তাই প্রথমেই সদ্য ছাপানো ভিজিটিং কার্ড বার করে দিল। উনি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন –
- আপনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার! আমি ছাপোষা মানুষ। আমার সঙ্গে আপনার কী দরকার হতে পারে!
রাজও হেসে বলল –
- আসলে একটা আজব প্রয়োজনে এসেছি। আপনার ভাগ্নি, সম্ভবত আত্রেয়ী গুপ্ত ওঁর নাম, শুনেছি মাঝে-মধ্যেই শিলিগুড়ি যান। আমার কিছু ইম্পর্টেন্ট ডকুমেন্টস শিলিগুড়ি পাঠাতে হবে যেটা কুরিয়ারের বা স্পিড পোস্টে পাঠাতে ভরসা পাচ্ছি না। যদি আপনার ভাগ্নিকে একটু বলে দেন। আমার লোক, যাকে পাঠাচ্ছি ডকুমেন্টসগুলো, সে ওটা স্টেশন বা এয়ারপোর্ট থেকে কালেক্ট করে নেবে।
- ইম্পর্টেন্ট ডকুমেন্ট! কোন মাদক দ্রব্য জাতীয় কিছু নয় তো?
- ছি ছি, একি বলছেন! কিছু দরকারি পেপারস। আপনি বললে আপনার সামনেই সেগুলো খামে ভরে সিল করে দেব।
উনি একটু ভেবে রাজি হয়ে বললেন –
- ও-কে, আমি আত্রেয়ীকে বলব। তবে বাকিটা ওর উপর।
রাজ ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল।
(পাঁচ)
রাজ বাইরে এসে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে দুজনে মিলে কফি খেল। আধঘন্টা বাদে ফোন করল আত্রেয়ী গুপ্তকে। এই ফোনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ আত্রেয়ী গুপ্ত সিবিআইয়ের যখন একজন গোয়েন্দা তখন ধরে নিতে হবে যথেষ্টই বুদ্ধি ধরে। কাজেই খুব সাবধানে কথা বলতে হবে। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরা হল। একজন মহিলার কণ্ঠস্বর –
- হ্যালো।
রাজ নিজের স্বাভাবিক গলাতেই জিজ্ঞাসা করল –
- ম্যাডাম, আত্রেয়ী গুপ্ত আছেন?
- হ্যাঁ, বলছি।
- আমি সঞ্জয় সেন কথা বলছি।
- বলুন।
- আমি আপনার মামা মিস্টার জয়ন্ত দাসের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনি কি কিছু আপনাকে বলেছেন?
- হ্যা বলেছেন।
- আমি কি একটু দেখা করে কথা বলতে পারি?
- হ্যাঁ, চলে আসুন। আমার বাড়ির ঠিকানা জানেন তো?
- হ্যাঁ জানি। আধঘণ্টার মধ্যেই যাচ্ছি।
আত্রেয়ী গুপ্তের বাড়ি ঢাকুরিয়া লেকে ঢোকার মুখে যে প্যাগোডাটা আছে তার পাশে। ওর বাবা বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। একতলা বাড়ি। বাবা-মা আর আত্রেয়ী, এই হল ওদের সংসার। আত্রেয়ী একমাত্র সন্তান। বাবা দরজা খুলে রাজকে নিয়ে গিয়ে ড্রইংরুমে বসালেন। আত্রেয়ী এসে ঢুকলো। রাজর দেখে মনে হল ছবির থেকেও বেশি আকর্ষণীয়া। একদম অ্যাথলেটদের মত ফিগার। মুখ-চোখ বেশ ধারালো, মনে হয় যথেষ্টই বুদ্ধিমতী। সিবিআইয়ের গোপন রিপোর্টেও এর উল্লেখ আছে। আত্রেয়ী হাতজোড় করে নমস্কার করে উল্টো দিকে বসে বলল –
- মামা আমাকে বলেছে কী একটা প্যাকেট শিলিগুড়িতে পাঠাতে চান। প্যাকেটে কী থাকবে?
- কিছু ইম্পর্টেন্ট ডকুমেন্টস্। কুরিয়ার বা স্পীড পোস্টে পাঠানো সম্ভব নয়। প্যাকেটে ভরে সিল করার আগে আপনাকে দেখিয়ে তবেই সিল করব।
- আমি আগামী পরশু ফ্লাইটে যাচ্ছি। মর্নিং ফ্লাইট। সকাল দশটা নাগাদ পৌঁছবে।
- আমি আগামীকাল বিকালে আপনাকে ফোন করে এসে প্যাকেটটা দিয়ে যাব। খোলা অবস্থায় আনবো, আপনাকে দেখিয়ে তবে সিল করব। বাগডোগরা এয়ারপোর্টে আমার বন্ধু যাকে পাঠাচ্ছি সে থাকবে। সে এসে আপনার থেকে নিয়ে নেবে। আপনি যে কি উপকার করলেন, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
রাজ উঠে দাঁড়ালো। আত্রেয়ী জিজ্ঞাসা করল –
- একটুও কিছু খাবেন না? অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যান। প্রথমবার এলেন।
রাজ পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে ওকে দিয়ে বলল –
- এতে আমার ফোন নম্বর আছে। যদি আপনি প্ল্যান চেঞ্জ করেন তাহলে যদি একটু জানিয়ে দেন তাহলে ভালো হয়।
আত্রেয়ী ভিজিটিং কার্ডটা নিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর সেটা টেবিলের উপর রেখে বলল –
- আপনার ফোন নম্বরটা আমি সেভ করে রেখেছি তাই অসুবিধা হবে না।
রাজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বা-বা, মেয়েটি অত্যন্ত ধূর্ত ও বুদ্ধিমতী। বেশিক্ষণ থাকলে হয়তো সন্দেহ করত। ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে আরো সাবধান হতে হবে। মেয়েটি সিবিআই-এর গোপন ফাইলের থেকেও বেশি ভালো, আরো বেশি প্রশংসার যোগ্য। তাহলে কি ওঁরা অনামিকার সমগোত্রীয় কাউকে পেয়ে গেলেন? অনেকদিন অনামিকার সঙ্গে কথা হয় না। সঙ্গে গাড়ি যখন আছে তখন ঠিক করল একবার ঢু মারবে ওর বাড়িতে, ঘন্টাখানেক আড্ডা দিয়ে আসবে।
রাজ ড্রাইভারকে বললো যোধপুর পার্ক বাজারে যেতে। অনামিকার ফ্ল্যাটটা যোধপুর পার্ক বাজারের উল্টো দিকে। নিচে গ্যারেজে অনামিকার গাড়িটা আছে দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। সারপ্রাইজ দেবে বলেই ফোন করে আসে নি। উপরে গিয়ে ওর ফ্ল্যাটের দরজায় লাগানো “অনামিকা চৌধুরি, সত্যসন্ধানী” নেমপ্লেটটা দেখে মুচকি হেসে বেল টিপলো।
দরজা খুলে অনামিকা ওকে দেখে প্রথমে একটু থমকে গেল, তারপর জিজ্ঞাসা করল –
- আপনি কাকে খুঁজছেন?
- আমি একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। একটু দরকার ছিল।
পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে ওকে দিল। অনামিকা একবার চোখ বুলিয়ে অবহেলাভরে সেটা হাতের মুঠিতে নিয়ে বলল –
- ভিতরে আসুন। ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করা যাক।
“গল্প” শব্দটা রাজের কানে বাজলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, অনামিকা মুচকি মুচকি হাসছে। রাজ হেসে জিজ্ঞাসা করল –
- কী করে বুঝলে?
- কী খাবে? রাতে ডিনারের পর ছাড়া পাবে। বহুদিন বাদে এসেছ তো তাই সহজে ছাড়া পাবে না।
- আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না।
- খুব সোজা। প্রথমত, ছদ্মবেশ তোমার ঠিকমতো হয়না। দ্বিতীয়ত, তোমার চোখ। আর তৃতীয়টা হল তোমার কণ্ঠস্বর।
- প্রথম আর তৃতীয়টা বুঝলাম। কিন্তু দ্বিতীয়টা! আমার চোখ!
- ও তুমি বুঝবে না। তোমার চোখ এমনই, মেয়েদের চোখকে ধোকা দেওয়া মুশকিল।
- চোখে এমন কী ত্রুটি আছে যে ধরা পড়ে গেলাম!
- ত্রুটি নয়। এত ধারালো চোখ আমার জানা একজনেরই আছে। কাজেই ধরা পড়ে গেলে। তা হঠাৎ ছদ্মবেশে! আমাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য? না-না, তা নয়। নতুন কেস হাতে নিয়েছ। কিন্তু, এই তো দিন দুয়েক আগে ফিরেছ। তাহলে? মানুষের বিশ্রামের তো দরকার, নাকি?
- তা ঠিক। মাঝে মধ্যে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কিছু কাজ করতে হয়। হরি কাকাকে বল না কফি করতে।
- হরি কাকা বাজারে গেছে, আমি কফি করে আনছি। তারপর দুজনে বসে গল্প করব। বিদেশে তদন্তের গল্প শুনবো।
(ছয়)
ড. সঞ্জয় সেন গাড়ি নিয়ে চলে গেলেও আত্রেয়ী বৃষ্টির ছাট উপেক্ষা করেও দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। একটা খটকা। কিছু একটা ওর অবচেতন মনে ছাপ ফেলেছে। সেটা কী? দরজা বন্ধ করে সেন্টার টেবিলের উপর থেকে ড. সেনের ভিজিটিং কার্ডটা তুলে আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল। কোম্পানির নাম সঞ্জয় সেনের নামে, ফোন নম্বর, ডেজিগনেশন, কোম্পানির লোগো, ই-মেইল অ্যাড্রেস সবই আছে, কিন্তু ঠিকানা নেই। সেটা অবশ্য আজকাল অনেকেই স্টাইল করে দেয় না। ভদ্রলোকের চোখটা? ওরকম অসাধারণ তীক্ষ্ণ, ধারালো, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ও আগে কখনও দেখেনি। তাই কি? ওর মনে হচ্ছে এই চোখ ও আগে কোথাও দেখেছে। কোথায়? ওর মেমারি খুব শার্প, তাও কেন মনে পড়ছে না! এই চোখ যে একবার দেখবে সে জীবনে ভুলতে পারবে না। চোখের গভীরতা কি অপরিসীম! নাঃ, যতক্ষণ না মনে পড়ছে ততক্ষণ শান্তি পাবে না। রান্নাঘরে ঢুকে নিজের জন্য এক কাপ চা বানালো আর বাবার জন্য কফি। মা এ সময়ে কিছুই খায় না।
চা নিয়ে ব্যালকনিতে বসে ডক্টর সেনের কথাই ভাবছিল। কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তাই তো বলেছিলেন মামা। ওর সঙ্গে অবশ্য এ বিষয়ে ডক্টর সেনের কোন কথা হয় নি। আসলে ভদ্রলোকের পার্সোনালিটি ওকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল। ভদ্রলোক যে পরিচয়টা দিয়েছিলেন সেটা সত্যি তো? যদি তা না হয় তাহলে? যদি পুরোটাই অভিনয় হয়? তাহলে এত ভালো অভিনয় ও জীবনে দেখেনি। এত ন্যাচারাল! এটাই ওকে ভাবিয়ে তুলল। চোখ দুটো - এটাই ওকে ভাবাচ্ছে। চোখে চশমা ছিল। চশমাটা অরিজিনাল তো? নাকি ফলস্? জিরো পাওয়ারের চশমা? কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার শুধু নয় ডক্টরেটও করেছে। কম্পিউটার সংক্রান্ত বিষয় না জেনে কেউ নিজের এই পরিচয় দিতে সাহস করবে না, ধরা পড়ে যাবে। তার মানে ভদ্রলোকের নিজের উপর অগাধ কনফিডেন্স আছে যে কম্পিউটার সংক্রান্ত বিষয়ে কেউ ওকে ডাউন করতে পারবে না। ও স্মার্ট ফোনের কলার আইডিতে আসা নামটা চেক করল, এখানেও নাম ডক্টর সঞ্জয় সেন দেখাচ্ছে। যদি নামটা ফলস্ হয়ে থাকে তাহলে উনি অনেক আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন। ফোন নম্বরটা যে সার্ভিস প্রোভাইডারের সেই সার্ভিস প্রোভাইডারের একটা মিনি স্টোর গোলপার্কে আছে। যে তিনটি ছেলে মেয়ে থাকে তারা ওর পরিচিত, বিশেষত মেয়েটি। ও ছাতা মাথায় বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল। মেয়েটিকে ভিজিটিং কার্ড আর ফোন নম্বর দেখিয়ে বলল –
- ভদ্রলোকের থেকে ঠিকানাটা নিতে ভুলে গেছি। বয়স্ক মানুষ তো, তাই ফোন করতে খারাপ লাগছে। আসলে বুঝতেই তো পারছ-।
মেয়েটি জানে আত্রেয়ী পুলিশে চাকরি করে। একটু ইতস্তত করে বলল –
- কাস্টমারদের ইনফর্মেশন দেওয়া বেআইনি। বুঝতেই তো পারছেন দিদি।
আত্রেয়ী হেসে বলল –
- আসলে এমুহূর্তে তোমাকে সবটা খুলে বলতে পারছি না। একটা স্মাগলিংয়ের দল - অফিশিয়াল পারমিশন আনতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। প্লিজ, ওর ঠিকানা আর ছবিটা দেখতে চাই।
মেয়েটি একটু ইতস্তত করে কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ল। ফোন নম্বর দিয়ে ডিটেইলসটা বার করে ফেলল। আত্রেয়ী ঠিকানা ও ফোন নম্বর আর ডক্টর সঞ্জয় সেনের ছবি স্মার্ট ফোনে তুলে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। ইনি বৃদ্ধ মানুষ। ঠিকানা যাদবপুর সেন্ট্রাল রোড। সেকেন্ড ফোন নম্বরটায় ফোন করে জেনে নিল উনি কার্ডিওলজিস্ট। কলকাতাতেই আছেন। চেম্বার ওঁর বাড়িতেই।
বাড়িতে ফিরল চিন্তিত মুখে। লোকটি ছদ্মবেশে এসেছিল এবং ফলস্ লোক, সেটা কনফার্মড্। তাহলে? হঠাৎ মনে পড়লো ওর বাড়িতে সিবিআই থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে গেছে দিন সাতেক আগে। তাতে নিশ্চয়ই ছবি উঠেছে। সিসিটিভি ক্যামেরার ছবি দেখল, ডক্টর সেনের ছবি উঠেছে, দরজা দিয়ে ঢোকা থেকে বেরোনো অবধি সব ছবি আছে। টিভি ডিসপ্লে থেকে ফলস্ ডক্টর সেনের ছবি নিজের স্মার্টফোনে তুলে নিয়ে ফোনে ইনস্টল করা গ্রাফিক্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে ধীরে ধীরে দাড়িটা মুছে ফেলল। তারপর, ধীরে ধীরে চশমাটা ইরেজ্ করল। ইরেজ্ করা অংশ লাইন ড্র করে কমপ্লিট করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এ কী! এই মুখ ওর অতি পরিচিত। সিবিআই দপ্তরে ছবি আছে শুধু নয় সিবিআই চিফ মিস্টার ঠাকুর সুযোগ পেলেই এর গুনগান করেন। ইনি নাকি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা! কত তদন্তের কথা বলেন। ইনি নাকি প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখেন তাঁকে খুন করা হয়েছে। বুক ভরা ব্যথা, ভয়ঙ্কর শোক চেপে তদন্ত করে খুনিকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এই তো উনি প্রায় তিনমাস নাকি বিদেশে থেকে একটা স্মাগলিং গ্যাংকে ধ্বংস করে দিন তিনেক আগে নাকি কলকাতায় ফিরেছেন। সেই প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাজ ওর বাড়িতে এসেছিলেন! তাও ছদ্মবেশে! কেন? ও কি অপরাধী? নাকি অন্য কিছু? বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তলিয়ে ভাবা দরকার।
রাজ কি সম্পূর্ণ নিজস্ব কোন তদন্তের কাজে ওর বাড়িতে এসেছিলেন? মনে হয় তা নয়। তাহলে? সম্ভবত ওকে কোন তদন্তে নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু, ও নিজে তাতে জড়াচ্ছে কীভাবে! মনে পড়ল দিন ১০-১২ আগে বাড়ির প্রতিটি ঘরে লুকানো ক্যামেরার কথা বড়োকর্তাদের জানানোর পর চিফ নিজে ফোন করে বলেছিলেন এগুলো নাকি ওঁরাই লাগিয়েছেন। যদিও ওঁদের কথা শুনে ওর অন্যরকম মনে হয়েছিল। এরপর দিন সাতেক আগে হঠাৎ ওঁরা সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে গেলেন। কেন? যদি আগের ক্যামেরাগুলো ওদেরই হয় তাহলে আবার এগুলো কেন! সোফা থেকে উঠে পড়ে চেয়ারে দাড়িয়ে ঘরের কোনায় লুকানো ওর খুঁজে পাওয়া একটা ক্যামেরাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখল। তারপর হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল। ক্যামেরাটাকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে লেন্সের উপর একটা ছোট্ট স্টিকার লাগিয়ে। তারমানে এগুলো ওঁদের লাগানো নয়, ওঁরা ওকে মিথ্যা কথা বলেছেন। মিথ্যা কথা কেন বললেন! ওর হঠাৎ মনে হল একটা ভয়ংকর কিছু হতে চলেছে, যার খবর ওর জানা নেই। ওঁরা ওকে জানায় নি। তাহলে কি ওঁরাই প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাজকে নিয়োগ করেছেন? ওঁরা মানে ডেফিনেটলি সিবিআই চিফ মিস্টার ঠাকুর। সিবিআইতে কি আর কোন গোয়েন্দা ছিল না! একেবারে গোয়েন্দা রাজ! তার মানে বিষয়টা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে চিফ কোনো রিস্ক নিতে চায় নি। নিজের গোয়েন্দাদের উপর ভরসা করতে পারেন নি। তাই, কলকাতায় ফেরত আসা মাত্র ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা রাজকে নিয়োগ করেছেন। কী এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে রাজকে নিয়োগ করতে হল! ওকে জড়িয়ে কিছু? নাকি সমস্ত কিছুর মধ্যে ও একটা ছোট্ট অংশ মাত্র? হয়তো সে কারণেই ওকে কিছু জানানো হয় নি। তার মানে দাবার বোর্ডের ও একটা ঘুটি মাত্র। ওর মনে দাবার বোর্ডের ঘুটি বোড়ের কথাই মনে এল। তার মানে রাজ সিবিআইয়ের হয়ে তদন্ত করছে। সেক্ষেত্রে, ওর ভূমিকা কী হবে? ওর মনে হল ও যে রাজের পরিচয় জেনে গেছে তা ওঁকে বলা চলবে না। কখনই না। বরং ওঁর তালে তাল মিলিয়ে চলবে। কোথাকার জল কোথায় গড়ায় তা দেখা দরকার। যতদিন না রাজ নিজের থেকে আত্মপ্রকাশ করছে ততদিন ও রাজকে সঞ্জয় সেন হিসাবেই ট্রিট করবে। এই খেলায় শেষ অবধি ও খেলবে। খেলার শেষে কী হবে তা ওর জানা নেই। তবে, এ ধরনের লড়াইয়ে একটা মজা আছে। হঠাৎ ওর মনে হল অনামিকা চৌধুরি কথা। চিফ ওঁরও সাংঘাতিক ফ্যান। ও নাকি অতুলনীয়া। ওকে বারবার বলেন অনামিকাকে আইডল করতে। সিবিআইতে আত্রেয়ীর পজিশন যে বেশ ভালো তা ও ভালই বোঝে। অনুমানে বোঝে ভবিষ্যতে ওর উপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আসতে চলেছে। সেক্ষেত্রে, ওর প্রতি সন্দেহবশে রাজকে নিয়োগ করবে না। হয়তো উল্টোটা। ওকে প্রোটেক্ট করার জন্যই হয়তো রাজকে কাজে লাগানো হয়েছে। অনামিকাকে এ কাজে লাগানো হয়নি কারণ নিউজ পেপারের দৌলতে ও সবার কাছেই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। তাছাড়া, ভিড়ের মধ্যেও ওকে যে কেউ চিনে ফেলবে। এটাই হয়তো সম্ভাব্য কারণ। আত্রেয়ী নিশ্চিন্ত হতে না পারলেও বুঝলো রাতে ঘুমাতে পারবে।
(সাত)
রাজ অনামিকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিস্টার ঠাকুরকে ফোন করল। রাত তখন প্রায় এগারটা বাজে। মিস্টার ঠাকুর ফোন ধরে রাজকে বললেন –
- রাত হলেই তোমার অ্যাক্টিভিটিস বাড়ে! ঘুমাও কখন?
- আপনি ঘুমাচ্ছিলেন?
- না। নানা জায়গায় মেইল পাঠাচ্ছিলাম। বল, এনি প্রবলেম?
- আত্রেয়ীর বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো দেখলাম, সেগুলো কি আপনারা লাগিয়েছেন?
- হ্যাঁ।
- সে কী! করেছেন কী! আপনাদের রিপোর্টে তো এর উল্লেখ নেই!
- না। আসলে এটা বোধহয় মিস হয়ে গেছে।
- মিস হয়ে গেছে! আমি আজ ছদ্মবেশে গিয়েছিলাম। আপনাদের ওই সিসিটিভি ক্যামেরা বোধহয় ডোবালো। আত্রেয়ী অত্যন্ত বুদ্ধিমতি মেয়ে, ঠিক ধরে ফেলবে। তবে কতটা জানতে পারবে সেটা অবশ্য জানি না। একটা কথা বুঝতে পারছি, যে ছদ্মবেশে যে পরিচয়ে গিয়েছিলাম তা আর চলবে না। এত পরিশ্রম এত প্ল্যানিং আপনাদের জন্য বৃথা গেল।
রাজ রেগে ফোনটা কেটে দিল। ওদিকে মিস্টার ঠাকুর মুচকি হাসলেও মনে মনে যথেষ্টই চিন্তিত ছিলেন। ওঁর কাছে খবর এসে গেছে আত্রেয়ী কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কী কী করেছিল। তাই উনি জানেন আত্রেয়ী রাজের পরিচয় জেনে গেছে। এইবারে খেলাটা জমবে। মনে মনে অবশ্য প্রার্থনা করলেন রাজ যেন আত্রেয়ীকে সর্ববিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে, অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারে। তবে রাজকে যদি আত্রেয়ীর সঙ্গে – নাঃ, এক্ষুনি এনিয়ে বেশি ভাববেন না। কেন যে অতীতে রোমার সঙ্গে রাজের ঘটকালি করলেন, জোর করে রাজের গোপনে বিয়ে দিলেন! তবে, এরা সবাই মিস্টার ঠাকুরের খুবই প্রিয় পাত্র, তাই সবার মঙ্গল কামনা করে ইমেইল গুলোতে মনোযোগ দিলেন।
রাজ কিন্তু রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারল না। ওর প্ল্যানিং ঠিক ছিল কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরার কথা না জানা থাকায় পুরোটা ভেস্তে গেল। এবারে সমস্যা দেখা দিল। আত্রেয়ীর উপর কেউ কোনরকম অ্যাটাক করে নি, কিছুই হয় নি। তাহলে অপরাধীদের সন্ধান ও পাবে কী করে! সূত্র কোথায়? কোন সূত্র না পেলে কোথা থেকে শুরু করবে? এ তো প্রায় খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতন অবস্থা। প্রায় ঘন্টাখানেক ভেবেও কোন কূলকিনারা করতে না পেরে টিভি চালিয়ে বসে পড়ল। অবশেষে, রাত প্রায় তিনটে নাগাদ যখন ঘুম পেল তখন শুতে গেল।
আত্রেয়ীর অবশ্য ঘুম তাড়াতাড়ি এসেছিল তবে তার কারণও আছে। ও রাতে ডিনারের পর প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাজকে নিয়ে লেখা সমস্ত বইয়ের পিডিএফ কপি অনলাইনে পেমেন্ট করে ডাউনলোড করে ফেলেছে। এর সঙ্গে উইকিপিডিয়ায় থাকা রাজ সম্বন্ধে তথ্য। ও রাজ সম্বন্ধে অনেকটাই এখন জানে। তাই ও এতটা নিশ্চিন্ত। মনে মনে ঠিক করেছে সঞ্জয় সেন অর্থাৎ রাজকে সকালে ফোন করে বাজিয়ে দেখবে।
রাজের ঘুম ভাঙলো সকাল সাড়ে সাতটায় স্মার্টফোনের অ্যালার্মের শব্দে। নিচে ডাইনিং রুমে এসে দেখল মা ওর চা তৈরি করে বসে আছেন। চা খেতে খেতে নিউজ পেপারটা দেখছিল, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। এটা ওর পুরানো ফোন যেটায় সদ্য চালু সিম কিনে ভরেছে। দেখল আত্রেয়ী গুপ্ত ফোন করেছে। একটু ইতস্তত করে ফোনটা ধরতেই উল্টোদিক থেকে আত্রেয়ীর গলা শুনতে পেল –
- ডক্টর সেন কথা বলছেন?
- হ্যাঁ।
- আপনি আজকে কখন আসছেন?
- আজকে বোধহয় যেতে পারব না। আসলে আপনাকে ঠিক বিরক্ত করতে চাইছিলাম না। অন্য একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি। থ্যাংকস ফর ইউর কোয়াপারেশন।
- সে কী! আপনি আসবেন না! গতকাল আপনাকে চা অবধি খাওয়াতে পারি নি। ভেবেছিলাম চা খেতে খেতে গল্প করব। আপনাকে টাইম হাতে নিয়ে আসতে বলার জন্য ফোন করেছিলাম।
- স্যরি। এবারে হল না। পরে না হয় আরেকদিন যাব।
আবার “গল্প”! এই শব্দটা বড্ড গোলমেলে। ফোনটা কেটে রাজ বুঝলো আত্রেয়ী ওর পরিচয় বুঝে গেছে।
রাজের ফোনটা কেটে দিয়ে আত্রেয়ীও বুঝল রাজ বুঝে গেছে যে আত্রেয়ী ওর পরিচয় জেনে গেছে। তাই, আসবে না। সেক্ষেত্রে, এই নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। পরদিন সকাল ন'টায় বাগডোগরা ফ্লাইট। এয়ার ইন্ডিয়ার এই ফ্লাইটটাতেই ও সাধারণত যাতায়াত করে কারণ এর বাগডোগরা পৌঁছানোর টাইমিংটা এমনই যাতে ওর সুবিধা হয়। অন্যান্য প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটগুলোর টাইমিং ওর পছন্দ নয়। অতীতে এয়ার ইন্ডিয়া ছাড়া অন্য কোন ফ্লাইটে যাওয়ার অধিকার সরকারি চাকুরেদের ছিল না। যদিও সিবিআইয়ের গোয়েন্দাদের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ছাড় আছে তবে উপযুক্ত কারণ দেখাতে হত। বর্তমানে এয়ার ইন্ডিয়ার প্রাইভেটাইজেশন হওয়ায় সরকারি চাকুরেরা যে কোন প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ব্যবহার করতে পারে। শিলিগুড়ি যাচ্ছে তদন্তের কাজে। একটি স্মাগলিং গ্যাং-এর সুলুক সন্ধান করতে। এরা সাধারণত নেপাল হয়ে ভারতে বিশেষত উত্তরবঙ্গে ইলেকট্রনিক্স গুডস্ চোরাপথে সাপ্লাই করে। দিন দশেকের প্রোগ্রাম। সেই অনুযায়ী জামা কাপড়ও গুছিয়ে নিল।
আত্রেয়ী সকাল আটটার মধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। ওর সার্ভিস রিভলভার আর কার্তুজ লাগেজে রয়েছে। লাগেজ স্যুটকেসটা জমা দেওয়ার সময় রিভলভার ক্যারি করার পারমিশনও জমা দিল। এরপর বোর্ডিং পাস নিয়ে হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে এগিয়ে গেল বোর্ডিং করতে। ভাগ্যক্রমে সামনের দিকে জানালার ধারে সিট পেয়ে গেল। এই ফ্লাইটটা ছোট্ট, বেশি যাত্রী ধরে না। ওর সঙ্গে সিবিআইয়ের আর কেউ যাচ্ছেন না। এই অ্যাসাইনমেন্টটা ওকে একাই সামলাতে হবে।
গেটের সামনে এসে দেখল প্রায় জনা তিরিশেক মানুষ ফ্লাইটের অপেক্ষায় চেয়ারে বসে আছেন। সবাই বোর্ডিং-এর অ্যানাউন্সমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। আত্রেয়ী অভ্যাসমতো চারিদিক দেখে, যাঁরা বসে আছেন তাঁদের প্রত্যেকের উপর চোখ বুলিয়ে তারপর চেয়ারে বসল। অবশেষে একজন গ্রাউন্ড হোস্টেস মাইকে সবাইকে আসতে বললেন। বোর্ডিং হল, আত্রেয়ী নিজের সিটে বসার আগে চারপাশে যাত্রীদেরকে দেখছিল। বেশি যাত্রী নেই, পিছনের সিটে একটি বাচ্চা সমানে বকবক করছে। ওর সারির দুটো সারি পরে একজন পাঞ্জাবী, মাথায় পাগড়ী, চোখে সানগ্লাস, স্মার্টফোন হাতে বসে আছেন। একজন এয়ার হোস্টেস এসে ওঁকে ফোনটা ফ্লাইট মোডে নিতে বললেন। ভদ্রলোক চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে ফোনটা খুটখাট করছিলেন। আত্রেয়ীর চোখ গেল ভদ্রলোকের চোখের দিকে। সেই চোখ, এই চোখ আত্রেয়ীর অত্যন্ত পরিচিত। ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
(আট)
প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাজ এই ফ্লাইটে! স্ট্রেঞ্জ! ওর সঙ্গে বাগডোগরা যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে এবং ছদ্মবেশে রয়েছে। কেন? ওকে ফলো করছেন? নাকি অন্য কারণ আছে। আত্রেয়ী চোখ বুজে এটা ভাবছিল। বাগডোগরা পৌঁছতে মিনিট পঞ্চাশেক লাগে। ভাবতে ভাবতে একটা কথা ওর মনে হল, ও যে রাজকে চিনতে পেরেছে তা রাজ বুঝে গেছে বলেই গতকাল ফোন করার পর জানিয়েছিলেন তিনি প্যাকেটটা দিতে আসছেন না, অন্য ব্যবস্থা করেছেন। প্যাকেট ট্যাকেট কিছু নেই, প্রথম দিন ওকে বুঝতে এসেছিলেন। এখন তাহলে সঙ্গে যাচ্ছেন কেন? এর উত্তর জানা নেই। হয়তো সিবিআই চিফ জানেন। ফ্লাইট ঠিক সময়েই বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নামলো। আত্রেয়ী গিয়ে লাইন দিল প্রিপেইড ট্যাক্সি বুথে। রাজকে কিন্তু দেখতে পেল না।
আত্রেয়ী শিলিগুড়ি বাস স্ট্যান্ডের কাছে লিনটন হোটেলে সাধারণত ওঠে। ম্যানেজার ওকে চিনে গেছেন, যথেষ্ট খাতিরও করেন কারণ ও রেগুলার কাস্টমার। আত্রেয়ীর আসল পরিচয় অবশ্যই জানেন না। ও ২০১ নম্বর রুমটা পছন্দ করে কারণ রুমটা দোতালায় একদম কর্নারে প্রধান সিঁড়ি আর লিফ্ট থেকে দূরে। যদিও ওর ঘরের পাশে করিডোরের শেষে, জমাদার নামার সিঁড়ি আছে। ঘরে মালপত্র রেখে সবে সোফায় বসে রিসেপশনে ফোন করেছে, ওর স্মার্টফোনটা বেজে উঠলো। কলার আইডি দেখাচ্ছে এটা প্রাইভেট নম্বর তাই এই নম্বরটা ডিসপ্লেতে আসছে না। আজকাল অনেক বিখ্যাত মানুষ ভক্তদের ভালোবাসা আর অত্যাচার এড়ানোর জন্য সার্ভিস প্রোভাইডারকে টাকা দিয়ে নিজের নম্বরটা প্রাইভেট নম্বর করে নেন। এতে ফোনের মালিকের ইচ্ছা ছাড়া কেউ ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। ফোনটা ধরতেই উল্টোদিকের যে পুরুষ কন্ঠ ও শুনল তা মনে হল ওর পরিচিত। ভদ্রলোক কোনরকম ভনিতা না করে বললেন –
- আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। মন দিয়ে শুনুন। রাতে ওই ঘরে থাকবেন না। ঠিক রাত দশটার সময় ঘর থেকে আপনার লাগেজ নিয়ে ঘর লক করে চাবি দিয়ে চলে যাবেন ২০৫ নম্বর রুমে। রুম খোলাই থাকবে। রুমের চাবি রুমের ভিতর ড্রেসিং টেবিলের ওপর থাকবে। ঘর ভিতর থেকে লক করে দেবেন। পরপর তিনবার দরজায় কেউ নক করলে তবেই খুলবেন। এই ঘরটা আপনার নামে নয় মিসেস লীনা পালের নামে বুক করা আছে। কেউ ফোনে জিজ্ঞাসা করলে এই নামটাই বলবেন।
ফোনটা কেটে দেওয়া হল। এই ফোনটা পাওয়ার পর আত্রেয়ী হকচকিয়ে গিয়েছিল, ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করল। ফোনটা ডেফিনিটলি রাজ করেছিলেন। ওকে ঘর চেঞ্জ করে অন্য ঘরে যেতে বলার উদ্দেশ্য একটাই, ওর বুক করা ঘর ২০১ নম্বরে রাতে কেউ বা কারা অ্যাটাক করতে পারে। তাই, ওকে বাঁচানোর জন্য অন্য ঘরে যেতে বলা হল। অর্থাৎ, ওকে প্রোটেক্ট করার জন্য রাজকে নিয়োগ করা হয়েছে। ও কোমরে গোঁজা রিভলভারটা বার করে একবার ভালো করে চেক করে নিল, সব ঠিক আছে। এরপর প্রচন্ড রেগে গেল, ও তো একাই নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারে, সেরকম শিক্ষাই ওকে দেওয়া হয়েছে। তাহলে? তারপর যখন মাথা ঠান্ডা হল তখন বুঝলো, ঘরে একটা বোমা ফাটালে, ঘরটা উড়িয়ে দিলে, নিজেকে প্রোটেক্ট করবে কীভাবে? তাছাড়া, এ সংক্রান্ত কোন ইনফর্মেশনই তো ওর কাছে ছিল না। কিন্তু, কে বা কারা ওকে মারতে চাইছে? তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন - কেন? ও ভেবে কোন কূল কিনারা পেল না।
ওর ফোন আবার টিং টিং করে উঠলো, এসএমএস এসেছে। সেই একই প্রাইভেট ফোন নম্বর থেকে। লেখা আছে - “বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পড়ে নেবেন, সব সময় সঙ্গে রিভলভার রেডি রাখবেন। কোন গণ্ডগোল দেখলে সোজা গুলি চালাবেন”।
আত্রেয়ী এই এসএমএসটা ভালো করে পড়ে ডিলিট করে দিল। ওর মনে হল এটা করা দরকার। তারপর সিবিআই চিফকে ফোন করল। উনি ফোনটা না ধরে কেটে দিলেন! আত্রেয়ী অবাক হয়ে গেল, এরকমটা উনি কখনই করেন না।
রাজ বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নেমে বাইরে এসে দেখল ওর জন্য একটা টাটা সুমো অপেক্ষা করছে। ও আগে থেকে বুক করে এই অ্যারেঞ্জমেন্টটা করেছিল। আত্রেয়ী যে লিনটন হোটেলে উঠবে তা ও জানে। এমনকী ২০১ নম্বর ঘরে যে উঠবে তাও জানে। এই তথ্য সিবিআই থেকে পেয়েছে। ও ২০২ নম্বর রুমটা নিয়েছে কারণ এটা ২০১ নম্বরের উল্টোদিকের রুম। ছদ্মবেশ যেটা ছিল সেটা খুলে নতুন ছদ্মবেশ নিয়েছে। এবারে ও মুসলিম, চোখে সানগ্লাসটা কিন্তু রেখেছে। ঘরে ঢুকে আর বের হয় নি। হঠাৎ, মিস্টার ঠাকুরের ফোন এল। রাজ অবাক হয়ে ফোনটা ধরলো। মিস্টার ঠাকুরের চিন্তিত গলা শুনলো –
- রাজ, ঐদিকে সব ঠিক আছে তো?
- হ্যাঁ। কেন?
- আত্রেয়ী এইমাত্র আমাকে ফোন করেছিল, আমি ফোনটা রিসিভ করিনি। ভাবলাম হয়তো বিপদে পড়ে ফোন করছে।
- ডোন্ট ওরি স্যার। এদিকটায় আপাতত কোনো গোলমাল নেই। আমি ওর উলটো দিকে রুম নিয়েছি। রাতে যদি কোনো হামলা হয় সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
- তুমি তো ফায়ার আর্মস চালাতে জানো না, যদি সেরকম পরিস্থিতি হয়? আমি কি দুজনকে ওই হোটেলে রাতে পাঠাবো?
- এক্ষুনি কোন প্রয়োজন নেই, যদি দরকার হয় জানাবো। আমি তো আছি, তাছাড়া সি ইজ্ কোয়াইট কমপিটেন্ট। ওর রিভলভার রেডি রাখতে বলেছি।
- ওর সঙ্গে কথা হয়েছে?
- না। এ নিয়ে আপাতত আপনি ভাববেন না। আপনার প্রতিটি কথা আমার মনে আছে। রাখছি।
রাজ ফোনটা কেটে দিয়ে মনে মনে হাসছিল। বিষয়টা ওর কাছে বেশ মজার। দুজনেই দুজনের পরিচয় জানে, আত্রেয়ী হয়তো ওর আসার উদ্দেশ্যটাও বুঝে গেছে। এমনকি প্রাইভেট নম্বরটা যে রাজের তা বোঝার বুদ্ধিও ওর আছে। আত্রেয়ী এই খেলাটা খেলতে চাইছে, শেষ অবধি দেখতে চাইছে। কিন্তু, রাজের দায়িত্ব অনেক অনেক বেশি, আত্রেয়ীকে কালপ্রিটদের হাত থেকে যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে।
(নয়)
রাত প্রায় বারোটা বাজে। আত্রেয়ী না ঘুমিয়ে জেগে থাকাটা বৃথা হবে ভেবে শুয়ে পড়েছিল, প্রচন্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দে ধরমর করে উঠে বসল। ওর ঘুম চটকে গেছে। কীসের আওয়াজ! তারপরই মনে হল শব্দটা বোমা জাতীয় কোনো কিছুর। সঙ্গে সঙ্গে বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা টেনে বার করে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজায় কান লাগিয়ে শুনতে চেষ্টা করল বাইরে কোন আওয়াজ টাওয়াজ হচ্ছে কিনা। একটা মৃদু পোড়া গন্ধ পেল। দরজাটা খুলে ফাঁক করতেই ওই পোড়া গন্ধ ভীষণ বেড়ে গেল। সঙ্গে ধোঁয়া। পুরো করিডোরটা ধোঁয়াতে ভর্তি হয়ে গেছে। করিডরের শেষের ডানদিকের ঘর অর্থাৎ ২০১ নম্বর ঘরের দরজা থেকে আগুনের হল্কা দেখতে পেল। সেই সঙ্গে ঘর থেকে গল গল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। করিডরের আলোতে দেখতে পেল উল্টোদিকের ঘরের দরজার সামনে একজন মুসলিম ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ২০১ নম্বর ঘরের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছেন। এরপর এগিয়ে ২০১ নম্বর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে হাতটা এগোলেন। হাতে একটা লাঠি জাতীয় কিছু, লাঠিটা দিয়ে উনি উবু হয়ে বসে কোন কিছু জ্বলন্ত ঘরের ভেতর দরজার কাছ অবধি টেনে আনতে চাইছেন। হঠাৎ ঘুরে তাকিয়ে ওকে দেখতে পেয়েই দ্রুত উঠে হাতের ইশারায় ওকে ঘরে ঢুকে পড়তে বললেন। মনে হল চিৎকারও করলেন। আত্রেয়ীর মনে পড়ল এসএমএস টার কথা। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সোফায় বসে পড়ল।
বাইরে হই হট্টগোল শুনতে পাচ্ছিল, কৌতুহল হলেও ঘর থেকে বেরোলো না। মিনিট পাঁচেক বাদে দরজায় ঠক ঠক ঠক তিনটে শব্দ হল। আত্রেয়ী একটু ইতস্তত করছিল। আবার তিনবার শব্দ হল। ও রিভলভার বাগিয়ে দরজা খুলেই মুসলিম ভদ্রলোককে দেখতে পেল। উনি ওকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে লক্ করে দিয়ে বললেন –
- প্রথমে একটা পলিথিন প্যাকেট দিন। তারপর ঝটপট প্যান্ট-শার্ট পরে নিন। আমাদের এখুনি বেরোতে হবে।
আত্রেয়ী পলিথিন প্যাকেট আনতে যেতে যেতে দেখল একটানে মুখ থেকে ফলস্ দাড়ি, গোঁফ, চুল আর চশমা খুলে ফেলে ভদ্রলোক ওর দিকে এগিয়ে এলেন। আত্রেয়ী চিনতে পারল, এই হল প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাজের আসল চেহারা। আত্রেয়ীর হাত থেকে পলিথিন প্যাকেট নিয়ে হাতে ধরে থাকা ছোট্ট কালো মতন আগুনে পোড়া কোন কিছু তাতে ঢুকিয়ে প্যাকেটটা বিছানার উপর রেখে ওকে ধমকে বললেন –
- কী হল! ড্রেসটা করুন।
ওকে ইতস্তত করতে দেখে বললেন –
- আমি পিছন ফিরে আছি। ডোন্ট ওরি, তাকাবো না।
আত্রেয়ী ইতস্তত করছিল কারণ ওর পরনের হাত কাটা পাতলা নাইটির নিচে কিছুই পড়া নেই। নাইটিটা খুলে সবে দেহের উপরের অন্তর্বাসটা পড়েছে এমন সময় রাজের গলা শুনলো, সেলফোনে কাকে ফোন করতে করতে ওকে বলছেন –
- বুলেট প্রুফ জ্যাকেটটা অবশ্যই পড়ে নেবেন।
আত্রেয়ী একটু থমকে গেল কারণ জ্যাকেটটা রাজের সামনে টেবিলের উপর আছে আর ওর পরনে শুধু উপরের অন্তর্বাস, বাকি কিছু নেই। রাজের গম্ভীর গলা পেল –
- প্যান্টটা পড়ে তারপর আসুন।
আত্রেয়ী প্যান্ট পড়ে এগিয়ে গেল জ্যাকেটটা আনতে। উনি ওর দেহের উপরের অংশের ড্রেসের কথা ভেবেই বোধহয় মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে ফোনে মন দিলেন। সম্ভবত যাকে ফোন করছিলেন তার লাইনটা পাওয়া গেছে। বলছেন –
- অনুমান মতো অ্যাটাক করেছিল। পার্টি সুস্থ আছে, আমার সঙ্গে। ইমিডিয়েটলি এস্কর্ট করে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুজনকে পাঠান। রুম নম্বর 205-এ আছি। পরপর দুবার নক্ করে গ্যাপ দিয়ে আবার দুবার নক্ করলে তবেই দরজা খুলব।
আত্রেয়ী ততক্ষনে ড্রেস করে ফেলেছে। কোমরে রিভলভার গুঁজে সার্ট পড়ে তৈরি। দেখলো রাজ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবীটা খুলে ফেলতেই ভিতরে প্যান্ট আর শার্ট পরা চেহারাটা বেরিয়ে পড়ল। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন –
- আমি জানি আপনি ঘাবড়ে যাওয়ার মেয়ে নন। এই মুহূর্তে এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের উদ্ধার পাওয়া দরকার। শুধু আপনার একটা রিভলভারে কাজ হবে না, তাই সাহায্য চাইলাম।
এরই মধ্যে আত্রেয়ী ঝটপট ওর স্যুটকেস গুছিয়ে নিয়েছে। রাজ শান্তভাবে একটা সোফায় বসে আছে। বোধহয় কিছু ভাবছেন। দরজায় দুবার নক গ্যাপ আবার দুবার নক হল। রাজ উঠে দরজার কাছে গিয়ে দরজা অল্প খুলে বাইরের দুজনকে দেখে আত্রেয়ীকে ইশারায় আসতে বলল। ওই দুজন ভদ্রলোকের একজন সামনে থাকলেন, তারপর ওরা দুজন আর একদম পিছনে দ্বিতীয় ভদ্রলোক। দুজনেরই হাতে এলএমজি। নিচে নেমে আসার সময় হোটেলের লোকেদের দৌড়োদৌড়ি দেখতে পেল। বাইরে একটা স্করপিওতে ওরা উঠল। সামনে ওই দুই ভদ্রলোকের একজন বসলেন আর পিছনে আত্রেয়ী, রাজ আর দ্বিতীয় ভদ্রলোক। আত্রেয়ী মাঝখানে, দুপাশে দুজন। রাজের শরীরের সঙ্গে আত্রেয়ীর শরীর টাচ করে আছে, এক অদ্ভুত অনুভূতি। আত্রেয়ীর হঠাৎ রাজের স্ত্রীর প্রতি ঈর্ষা হল। যতটুকু রাজকে দেখেছে, কি অসাধারণ পার্সোনালিটি! রাজের বর্তমান স্ত্রী নাকি বুদ্ধিমতী এবং দৃঢ়চেতা। সেও নাকি গোয়েন্দা! যদিও তার নাম জানে না। বড়োকর্তার মুখে শুনেছে। সিবিআই চিফের মতে মেয়েটি রাজের যথেষ্টই উপযুক্ত। মেয়েটিকে ও চেনে না, কিন্তু মনে হল এ যেন বাঁদরীর গলায় মুক্তোর মালা। হঠাৎ রাজের ফোনটা বেজে উঠলো। রাজ ফোনের ডিসপ্লেতে নামটা যখন দেখছে তখন আত্রেয়ীও ঘাড় ঘুরিয়ে নামটা দেখল - মিস্টার ঠাকুর। রাজ ফোনটা ধরে বলল –
- ওকে নিয়ে এখন আমরা গাড়িতে। সব ঠিক আছে।
ওদিক থেকে কী বলা হল আত্রেয়ী শুনতে পেল না কিন্তু তারপর রাজের উত্তরটা শুনলো –
- আপনি আপনার যে সেফ জায়গার কথা বলছেন সেটা কতটা সেফ জানি না তাই সেখানে যাব না। তাছাড়া, আমার মনে হচ্ছে সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে। আপনি আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছেন, একটা কাজের ভার দিয়েছেন, আমি তা ঠিক ভাবেই পালন করব। গাড়ি আমার পছন্দ মতো জায়গাতেই যাবে। এখন থেকে আমার কথা মতোই কাজ হবে। নিশ্চিন্তে থাকুন। স্যার, গুড নাইট।
রাজ ফোনটা কেটে দিয়ে ড্রাইভারকে বলল তিস্তা ব্রিজে যেতে।
আত্রেয়ী রাজকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। অনেক কিছু শেখার আছে। এধরনের একটা ঘটনা কীভাবে শক্ত হাতে ট্যাকেল করছেন! গাড়ি যখন তিস্তা ব্রিজের কাছে তখন রাজ ড্রাইভারকে গাড়ি আস্তে চালাতে বলল। আত্রেয়ী রাস্তার সামনের দিকে নজর করছিল। দেখল সামনে একটা টাটা সুমো বাঁ দিক ঘেষে দাঁড়িয়ে। রাজও গাড়িটাকে দেখেছে। ড্রাইভারকে ওই গাড়ির পাশে দাড়াতে বলল। ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই রাজ লাফ দিয়ে নেমে পড়ে এগিয়ে গিয়ে সুমোর পিছনের দরজা খুলে আত্রেয়ীকে বলল –
- এই গাড়িতে চলে আসুন। কোন ভয় নেই। এটা আমারই গাড়ি।
আত্রায়ী গাড়িতে উঠলো। সঙ্গের ভদ্রলোক দুজন উঠতে যেতেই রাজ ওঁদের আটকে বলল –
- ম্যাডামের দায়িত্ব এবারে আমার। আপনারা ফেরত যান, কোন ভয় নেই। দরকার হলে আপনারা এ বিষয়ে আপনাদের বসের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
রাজ গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল –
- সোজা হোটেলে চলুন। রাস্তায় কোন অবস্থাতেই গাড়ি থামাবেন না।
গাড়িতে একটা ব্যাগ রাখা ছিল। রাজ ব্যাগ থেকে একটা বোরখা বার করে আত্রেয়ীকে দিয়ে সেটা পড়ে নিতে বলল।
আত্রেয়ী অবাক হয়ে দেখল ওরা আবার শিলিগুড়ির দিকেই যাচ্ছে! শুধু শিলিগুড়ি নয়, শিলিগুড়ি বাস স্ট্যান্ড। সামনে হোটেল লিনটন। আত্রেয়ীর মনে একটা প্রশ্ন ছিল, জিজ্ঞাসা করল –
- আপনার পিছনে কি চোখ আছে? তা না হলে –
রাজ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল –
- পিছনে চোখ নয়, সময়ের জ্ঞান আছে। কোন ড্রেস পড়তে কতটা সময় লাগে জানি বলেই বুঝেছিলাম তখন আপনার প্যান্টটা পড়া হয় নি।
আত্রেয়ী ভাবছিল কি অসাধারন ইন্টেলিজেন্ট মানুষ! ওর কথা অর্ধেকটা শুনেই বাকিটা বুঝে গেলেন। গাড়ি দাঁড়ালো লিনটনের ঠিক পাশের হোটেল, হোটেল গ্লোরিতে। এত রাতেও হোটেলের সদর দরজা খোলা। হোটেলটা নিম্নমানের। রাজ রিসেপশনে গিয়ে চাবি চাইল, ঘুমন্ত চোখে কাউন্টারের লোকটি আত্রেয়ীকে দেখে জিজ্ঞাসা করল –
- আপনার মিসেস?
রাজ “হ্যাঁ” বলে চাবিটা নিতেই ভদ্রলোক বললেন – “স্যার, এনজয় দা নাইট”। একথা শুনেই আত্রেয়ী চটে গেল। লোকটি ওকে কলগার্ল ভেবেছে। রাত আড়াইটার সময় কেউ স্ত্রীকে নিয়ে এরকম হোটেলে ঢোকে না।
(দশ)
এত ছোট, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর ঘরে আত্রেয়ী জীবনে থাকে নি। রিসেপশনের লোকটির কথায় চটে ছিল, তার উপর এই ঘর - ওর মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। বলল –
- আপনি নিজেকে কী ভাবেন বলুন তো? রিসেপশনের লোকটি আমাকে কলগার্ল ভেবেছে। সকালে মুখ দেখাবো কী করে! তাছাড়া, এই হোটেলটায় মনে হয় না সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ ভাড়া নেয়।
- আপনি ভয়ঙ্কর রেগে আছেন। মাথাটা ঠান্ডা রাখুন। ক্রাইসিস মোমেন্টে মাথা ঠান্ডা না রাখলে ভুলভ্রান্তি হওয়ার চান্স থাকে। রিসেপশনের লোকটি কি ভবিষ্যতে আপনাকে চিনতে পারবে? আপনি বোরখা পড়ে ঢুকেছেন, আগামীকাল সকালেও বোরখা পরেই বেরোবেন। তারপর আপনি আপনার নিজের চেহারা দেখালেও ওরা কি চিনতে পারবে? এই হোটেলটায় রুম ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া পাওয়া যায়। লোকে এখানে ফুর্তি করতে আসে। এই কারণে এই হোটেলটার বদনামও রয়েছে। কেউ সন্দেহই করতে পারবে না আমি আপনাকে নিয়ে এই হোটেলটায় উঠেছি। আমার মনে হয়েছে, এই হোটেলে রাত কাটানো আপনার পক্ষে সম্পূর্ণ সেফ্। আরেকটা কথা বলার আছে, এরা বিছানার চাদর বদলায় না। আসলে ঘন্টায় ঘন্টায় তো বদলানো সম্ভব নয়, তাই আমার সাজেশন যে ড্রেস পড়ে আছেন তাই পরেই শুয়ে পড়ুন। এতে সুবিধা হচ্ছে দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারবেন। আমি এখন একটু বেরোবো। ঘর ভেতর থেকে বন্ধ করে রিভলভার সঙ্গে রেখে শোবেন। কোনো অবস্থাতেই দরজা খুলবেন না। আমি ফোন করে আপনাকে দরজা খুলতে বললে তবেই খুলবেন। গুড নাইট।
রাজ ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল। আত্রেয়ীর হঠাৎ হাসি পেল। সম্ভবত রাজ ওর সঙ্গে এক ঘরে রাত কাটাবে না বলেই বেরিয়ে গেল। আসলে এই ঘরে একটা ডাবল বেডেড ডিভান রাখার পর হাঁটা চলার জায়গা অবধি নেই। তাই রাজকে ঘরে থাকতে হলে বিছানাতেই বসতে বা শুতে হত, সেকারণেই পালালো। আত্রেয়ী কোমর থেকে রিভলভারটা বার করে পাশে নিয়ে শুয়ে পড়লো। এত রাতে, এত উত্তেজনার পর ঘুম কি আসবে?
আত্রেয়ী ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ ফোনের মৃদু আওয়াজ ওর কানে এল। প্রথমে বুঝতেই পারছিল না ওটা শুনে আওয়াজ, খেয়াল হতেই ধরমর করে উঠে বসলো। বোধহয় ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে রিং হচ্ছে। দেখল রাজ ফোন করেছে। ফোনটা ধরতেই রাজের গলা পেল –
- সকাল আটটা বাজে, এক্ষুনি বেরোতে হবে। আপনি পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিন। আমি দুবার গ্যাপ আবার দুবার নক করলে তবেই দরজা খুলবেন।
রাজ ফোনটা কেটে দিতেই আত্রেয়ী উঠে-পড়ে ঝট করে মুখ ধুয়ে স্যুটকেসটা নিয়ে দরজার কাছে দাড়ালো। দরজায় নকের শব্দ। আত্রেয়ী দরজা অল্প একটু খুলে দেখল রাজ দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে ইশারায় বোরখাটা পড়ে নিতে বলল। রাজ যখন আত্রেয়ীকে নিয়ে হোটেল ছেড়ে বেরোচ্ছে তখন রিসেপশনের লোকটি ওদেরকে সইসাবুদ করতে বলল না বা টাকাও চাইল না। আত্রেয়ী বুঝে গেল রাজ এসব ঝামেলা চুকিয়ে তারপরই ওকে ডেকেছে।
বাইরে সেই টাটা সুমোটাই দাঁড়িয়ে আছে। রাজ আত্রেয়ীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল –
- সোজা তিস্তা ব্রিজে চলুন।
আত্রেয়ী গাড়িতে বসে দেখছিল রাজ বারে বারে পিছন ফিরে কী যেন দেখছে। বোধহয় ওদেরকে কোন গাড়ি ফলো করছে কিনা সেটা দেখছে। হঠাৎ রাজ ড্রাইভারকে গাড়িটা বা দিকের গলিতে ঢুকিয়ে দিতে বলল। ড্রাইভার এই রাস্তাটা চেনে। নানান গলি টলি ঘুরে আবার গাড়ি মেইন রোডে পড়ল। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বাদেই তিস্তা ব্রিজের কাছে পৌঁছে রাজ ড্রাইভারকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল। নিজে নেমে আত্রেয়ীকেও স্যুটকেস নিয়ে নামতে বলল। ড্রাইভারকে বলল গাড়ি ঘুরিয়ে পিছনে ফেলে আসা পেট্রল পাম্পের সামনে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে। গাড়ি চলে গেল। এবারে রাজ ফোনে কাউকে আসতে বলল। একটি চকোলেট কালারের বলেরো ওদের সামনে এসে দাড়ালো। ড্রাইভার একটি অল্প বয়সী ছেলে। আত্রেয়ীর ওদেরকে দেখে আর ওদের কথা শুনে মনে হল ছেলেটি রাজের পূর্বপরিচিত কারণ গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিচে নেমে জিজ্ঞাসা করল –
- ভালো আছেন স্যার? এবারেও কি আগের বারের মতন কাউকে ফলো করতে হবে?
রাজ হেসে জবাব দিল –
- ঠিক উল্টোটা এবারে করতে হবে। সারাক্ষণ তোমাকে খেয়াল রাখতে হবে কেউ আমাদের ফলো করছে কিনা। কেউ ফলো করলে তাকে কীভাবে কাটাতে হবে সেই ভার তোমার উপর।
- স্যার, কোন দিকে যাবেন?
- এখন যাব হোটেল বিনায়ক। ওখানে আমাদের পৌঁছে দাও তারপর বাকিটা বলছি।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের উল্টোদিকে হোটেল বিনায়ক ইন্টারন্যাশনাল। রাজ রিসেপশনে গিয়ে রুম নম্বর ৩০১য়ের চাবি চেয়ে নিল। আত্রেয়ী বুঝলো আগে থেকেই বুক করা আছে শুধু নয় রাজ এসে চেক-ইন করে তারপর চাবি ওদের কাছে জমা দিয়ে গেছে। আত্রেয়ী লিফ্টে উঠতে উঠতে জিজ্ঞাসা করল –
- রুম কী নামে বুক করেছেন?
রাজ এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল –
- আপনি রুমে বিশ্রাম করুন, তবে ঠিক তিন ঘন্টা। তারপর মালপত্র নিয়ে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ব।
- কোথায়?
- কোথায় যাওয়া উচিত সেটা ভেবে বার করুন। হাতে আপনার সময় তিন ঘণ্টা।
রাজ নিচে নেমে হোটেলের বাইরে এসে দেখল বলেরোর ড্রাইভার ছেলেটা গাড়িতে বসে গান শুনছে। রাজ কাছে গিয়ে বলল –
- তপন, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। উপরে ৩০১ নম্বর রুমে ম্যাডাম আছেন। আমি বেরোবো। যতক্ষণ না আমি আসি ততক্ষণ ওই ঘরের উল্টোদিকের ঘরের থেকে দরজা খুলে সবসময় ম্যাডামের ঘর ওয়াচে রাখবে। কোন কিছু সন্দেহজনক মনে হলেই আমাকে ফোন করবে।
- ওই ঘরের চাবি কোথায় পাব?
- কাউন্টারে বলা আছে। সোজা গিয়ে ৩১২ নম্বর রুমের চাবি চাইবে। যা বলেছি তার যেন কোন রকম ভুল না হয়। এক মুহূর্তের জন্যও ওই ঘরের দরজা থেকে চোখ সরাবে না।
রাজ গাড়িটা ক্রস করে এগিয়ে গেল, মোড় থেকে একটা অটোরিক্সা ধরে নিল। এবারে ওর গন্তব্যস্থল লিনটন হোটেল।
(এগারো)
রাজ লিনটন হোটেলে পৌঁছে দেখল হোটেলে তখনও প্রচুর পুলিশ রয়েছে। হোটেলের বাইরে উৎসুক জনতার ভিড়। পুলিশ রাজকে ভিতরে ঢুকতে বাঁধা দিল। রাজ লোকাল থানার ওসির সঙ্গে কথা বলতে চাইল। পুলিশ কর্মীটি ভিতর থেকে ওসিকে ডেকে নিয়ে এলেন। উনি বেশ বিরক্তি সহকারে এসে জিজ্ঞাসা করলেন –
- কী ব্যাপার! দেখছেন ব্যস্ত আছি। এখন কোন রিপোর্টারদের সঙ্গে কথা বলতে পারব না।
রাজ নিজের ভিজিটিং কার্ড ওঁকে দিয়ে বলল –
- আসলে একটা কাজে শিলিগুড়ি এসেছিলাম। এই হোটেলের ঘটনা শুনে চলে এলাম। যদি পারমিশান দেন তাহলে একবার দেখতে পারি। আমার সঙ্গে পুলিশ মহলের সম্পর্ক বেশ ভালো। আমি যা সূত্র পাই তা সব সময় পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে থাকি।
উনি ভিজিটিং কার্ডটা দেখতে দেখতে বললেন –
- আপনার নাম আমি শুনেছি। আপনার বহু তদন্তের কথাও জানি। এখানে আমার দেখে মনে হয়েছে এটা একটা উগ্রপন্থী হামলা। সম্ভবত সন্ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য করা হয়েছে। ঘরে একজন মহিলা বোর্ডার ছিলেন। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে তাঁর দেহ কিন্তু পাওয়া যায়নি! এমনকী তাঁর কোন সন্ধানও আমরা বার করতে পারি নি, কর্পূরের মত উবে গেছেন। সম্ভবত ওই মহিলাই টেররিস্টদের একজন। ঘরে টাইম বোমা ফিট করে কেটে পড়েছেন। ঠিক আছে চলুন, আপনাকে সব দেখিয়ে দিচ্ছি।
রাজকে নিয়ে উনি ২০১ নম্বর রুমের সামনে এসে বললেন –
- এই ঘরেই বিস্ফোরণটা হয়েছে। আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে। আপনি দেখতে চাইলে দেখতে পারেন। আপনার দেখা হয়ে গেলে ঘরটা সিল করে দেওয়া হবে।
রাজ ঘরে ঢুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখা শুরু করল। বিস্ফোরণে সবকিছু ভষ্মিভূত হয়ে গেছে। দেয়ালের পাশে থাকা কাঠের আলমারি, ড্রেসিং টেবিল বা সোফাসেট সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। রেফ্রিজারেটরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। হঠাৎই ওর পাশে একটা চাবির রিং দেখতে পেয়ে তুলে নিয়ে পকেটে ঢোকালো। এই চাবির রিংটা এখানে পড়ে আছে! পুলিশের চোখে পড়ে নি! প্রথম সম্ভাবনা, কোন পুলিশ কর্মীর পকেট থেকেই এটা পড়েছে। তাহলে, এটা থেকে কোন সূত্র পাওয়া যাবে না। আর দ্বিতীয় সম্ভাবনা, বিস্ফোরণের আগেই এটা ঘরে ছিল, বিস্ফোরণে ছিটকে এসে রেফ্রিজারেটরের পাশে চলে এসে এমন জায়গায় পড়েছে যেটা হয়তো পুলিশ কর্মীদের চোখ এড়িয়ে গেছে। এটা অবশ্য একটু কষ্টকল্পিত কারণ এত জন পুলিশ কর্মী ঘরে এলেন অথচ কারো চোখে পড়ল না!
রাজ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিচে চলে এল। রিসেপশনের সামনে সোফায় ওসি বসে হোটেলের কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। ও পাশে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করল –
- রুম থেকে কি জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা হয়েছে?
- তা হয়েছে। হঠাৎ একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?
- না, মনে হল তাই। আগে বোধহয় সার্চ করা হয়েছে, পরে সম্ভবত ফরেনসিকের লোকেরা জিনিসপত্র টানা হ্যাচরা করেছে?
- হ্যাঁ, একদম তাই।
- আমার কাজ শেষ, যদি কোন সূত্র পাই আপনাদের জানিয়ে দেব।
রাজ হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটে গিয়ে তারপর একটা প্রাইভেট গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সোজা গেল সেখানে। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে ওকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছে দিতে বলল। ড্রাইভার যা চাইল তাতে প্রথমেই রাজি না হয়ে দরাদরি করে সেই টাকাটাই কিন্তু দিল। এটা করল কারণ একবারে রাজি হয়ে গেলে ডাইভারের খটকা লাগতো।
হোটেল বিনায়ক ইন্টার্ন্যাশনাল পৌঁছে রাজ লিফ্টে করে থার্ড ফ্লোরে গিয়ে ৩০১ নম্বর রুমের সামনে এল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। উল্টোদিকের ৩১২ নম্বর রুমের দিকে তাকালো, দরজা বন্ধ। ও ঘুরে ৩১২ নম্বর রুমের দরজার সামনে আসতেই দরজা খুলে গেল। তপন দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল –
- কোন দরকার আছে স্যার?
- না। ঠিক আছে। কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখেছ?
- স্যার, আমি সারাক্ষণ দরজার আই হোলে চোখ লাগিয়ে আছি, কাউকে আসতে দেখিনি। শুধু একবার ম্যাডাম দরজা খুলে বাইরে এসে চারপাশ দেখে আবার ঢুকে গেলেন।
- ও-কে, তুমি নিচে গিয়ে গাড়ি রেডি কর। হোটেল ছাড়তে হবে।
রাজ আত্রেয়ীকে ফোন করে দরজা খুলতে বলল। আত্রেয়ী দরজা খুলে রাজকে বলল –
- এভাবে বন্দীদশা কাটাতে কাটাতে হাঁপিয়ে উঠেছি। যারা আমাকে মারতে চায়, কেন মারতে চায় তা অবশ্য জানি না, কিন্তু তাদের মুখোমুখি হতে চাই।
- আপনি তৈরি? আমাদের এখুনি বেরোতে হবে। আপনাকে তিন ঘন্টা সময় দিয়েছিলাম। ঠিক তিন ঘণ্টা বাদেই এসেছি।
- আমি তৈরি। কোথায় যাব এবারে?
- সেটা তো আপনার বলার কথা। সেরকমই তো কথা হয়েছিল। কিছু ঠিক করলেন?
- যা পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে না আপনি আমাকে নিয়ে এখানে থাকবেন। এমন জায়গায় যাবেন যেখানে ওদের পৌঁছনোর চান্স কম। সে ক্ষেত্রে দার্জিলিং, গ্যাংটক বা কালিম্পংয়ে গেলে টুরিস্টদের ভিড়ে মিশে যাবার চেষ্টা করা যেতে পারে। তাতে অবশ্য একটা ছোট্ট নেগেটিভ পয়েন্ট আছে। টুরিস্টদের মধ্যে কে টুরিস্ট আর কে আততায়ী তা আলাদা করা মুশকিল। সেক্ষেত্রে, শান্ত নিরিবিলি আবার টুরিস্টও যায় এরকম জায়গা সিলেক্ট করা ভালো। আমার মনে হয়েছে কার্শিয়াং আইডিয়াল জায়গা।
রাজ হেসে বলল –
- অনেক অ্যানালিসিস হয়েছে এবারে যাওয়া যাক।
আত্রেয়ী নিজের লাগেজ নিয়ে রাজের সঙ্গে যখন লিফ্টে উঠছে তখন রাজের ফোনটা বেজে উঠলো। রাজ ফোন ধরে বলল –
- এভরিথিং ইজ আন্ডার মাই কন্ট্রোল। চিন্তা করবেন না। খেলাটা আমার মতো করে খেলতে দিন। এরপর দরকার হলে আমিই আপনাকে ফোন করব। আপনি ফোন করলে হয়তো রিসিভ নাও করতে পারি। স্যার, গুড বাই।
আত্রেয়ী, রাজ যখন ফোনটা হাতে নিয়ে লাইনটা কাটছে তখন চোখ ঘুরিয়ে ফোনের দিকে তাকালো। এক ঝলক কলারের নাম দেখতে পেল – “মিস্টার ঠাকুর”। আত্রেয়ীর সন্দেহ যা ছিল তাই সত্যি, মিস্টার ঠাকুরই রাজকে নিয়োগ করেছেন। অর্থাৎ, অত্যন্ত গোপনে তদন্ত করার জন্যই এটা করা হয়েছে যার অর্থ উনি নিজের ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দাদেরও ভরসা করতে পারছেন না।
(বারো)
আত্রেয়ী গাড়িতে যখন লাগেজ রাখছে পাশ থেকে রাজ বলল –
- আঢ় চোখে পাশের লোকটিকে কে ফোন করেছে দেখা ঠিক নয়।
এক মুহূর্তের জন্য আত্রেয়ী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল, ও যে এক ঝলক তাকিয়ে দেখেছে সেটাও খেয়াল করেছেন! সত্যিই অসাধারণ। হেসে জবাব দিল –
- এভরিথিং অ্যালাউড ইন লাভ এন্ড ওয়্যার। ইট ইজ আ ওয়্যার। আমিও একজন গোয়েন্দা, যদিও আপনার মত নই। সব দিকে চোখ কান খোলা রাখা কি উচিত না উচিত নয়?
রাজ একবার ওর দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে তপনকে বলল –
- ফাদার পিটার উইলিয়ামসয়ের সেন্ট পিটার্স কলেজ। রাস্তায় কোন কারণেই গাড়ি আমার নির্দেশ ছাড়া থামাবে না। আর পিছন দিকটা খেয়াল রাখবে। কোন গাড়ি ফলো করলে কী করতে হবে তা তোমার জানা। গতকাল সারারাত ঘুমাই নি, এখন আমি ঘুমাবো।
আত্রেয়ীর হঠাৎ রাগ হল, এ কী রকম ব্যবহার! ওর কথার উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করল না! তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবতেই বুঝতে পারলো, কি ভয়ংকর টেনশনে রাজ রয়েছে।
পাশে রাজ ঘুমাচ্ছে। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আত্রেয়ীর অবাক লাগছিল - এরকম ক্ষুরধার বুদ্ধি অথচ ঘুমালে একেবারে শিশুর মতন! কোন হুশ নেই, একেবারে মরার মতন ঘুমাচ্ছে। ও তপনের দিকে তাকালো, একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করল –
- সেন্ট পিটার্স কলেজটা কোথায়?
তপন একটু ইতস্তত করে পিছনে তাকিয়ে রাজকে দেখে বলল –
- ম্যাডাম, বেশিক্ষণ লাগবে না, আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাব।
আত্রেয়ী উত্তর শুনে বুঝতে পারছিল তপনকে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই, কিছুই বলবে না। পাশে হঠাৎ রাজ একটু নড়ে বসে বলল –
- কার্শিয়াংয়ে। এত প্রশ্ন করেন কেন! চোখ বুজে বসে থাকুন, ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
আত্রেয়ী অবাক হয়ে গেল। রাজ তো ঘুমাচ্ছিল! নাকি চোখ বুজে ঘুমের ভান করছে? ওরা তার মানে কার্শিয়াংয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আত্রেয়ীর অনুমান সঠিক। দেখা যাক, এরপর কী হয়।
ঘন্টা দুয়েক লাগলো না, তার আগেই হঠাৎ তপন বলল –
- আমরা এসে গেছি।
আত্রেয়ী আগে কার্শিয়াং এসেছে। গাড়ি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে সেটা কার্শিয়াংয়ের অন্তত ৬-৭ কিলোমিটার আগে। এখানে রাস্তা চওড়া। ডানদিকে একটা সরু পিচ বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার পাশে বড়ো একটা সাইন বোর্ডে লেখা – “সেন্ট পিটার্স রেসিডেন্সিয়াল কলেজ এন্ড হোম ফর অরফ্যানস্”। রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পাশের পাহাড়ের টপে অর্থাৎ চূড়ায়। ওই পাহাড়ের উপরে নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে প্রাচীরে ঘেরা প্রচুর বিল্ডিং। এমনকী একটা চার্চের চুড়াও নজরে পড়ল। রাজ চোখ বোজা অবস্থাতেই বলল –
- তপন সোজা উপরে চল। ফাদারকে বলা আছে।
তপন গাড়ি টার্ন করিয়ে ওই রাস্তায় ঢুকে পড়ল।
উপরে যাওয়ার পথটা খুব সুন্দর। পাহাড়ের চারপাশে ঘুরেঘুরে অনেকটা পথ। গাড়ি গেটের সামনে পৌঁছলে তপন হর্ন বাজালো। বিশাল বড়ো লোহার গেটটা বন্ধ ছিল। ছোট্ট একটা ফোকর দিয়ে কেউ ওদের পরিচয় জানতে চাইল। তপন নেমে গিয়ে কী একটা বলতেই দরজা খুলে গেল। তপন গাড়িতে উঠে গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে।
আত্রেয়ী অবাক হয়ে দেখছিল কি বিশাল কম্পাউন্ড! ভিতরে সমস্ত বিল্ডিংই দোতলা অথবা তিনতলা। দূরে একটা চার্চ। চার্চটা বেশ বড়ো। গাড়ি সোজা গিয়ে থামল চার্চের পাশে একটা ছোট্ট দোতলা সুন্দর সাজানো-গোছানো বাড়ির সামনে। রাজ নেমে আত্রেয়ীকে নিয়ে এগিয়ে গেল গেটের সামনে। একটা ছোট বোর্ডে লেখা – “ডঃ পিটার উইলিয়ামস, প্রিন্সিপাল এন্ড চেয়ারম্যান, সেন্ট পিটার্স রেসিডেন্সিয়াল কলেজ এন্ড হোম ফর অরফ্যানস ট্রাস্টি বোর্ড”। প্রথম ঘরটা ওঁর চেম্বার কাম অফিস – এরকমই আত্রেয়ীর মনে হল। রাজ ঢুকতে ঢুকতে আত্রেয়ীকে বলল –
- একতলায় এপাশের দুটো ঘর নিয়ে ওঁর চেম্বার আর অফিস। পাশে বাকি দুটো ঘর নিয়ে উনি থাকেন। দোতলাটা পুরোটাই গেস্টদের থাকার জন্য। শুধু গেস্ট নয়, স্পেশাল গেস্ট কারণ অন্যদিকে একটা বড়ো গেস্ট হাউস আছে।
রাজ আত্রেয়ীকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আত্রেয়ী দেখল, একজন সৌম্যদর্শন মাঝবয়সী ফাদার টেবিলের পিছনে বসে আছেন। রাজকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন –
- ওয়েলকাম মিস্টার রাজ। পথে কষ্ট হয় নি তো?
- না। আসলে এটা এমন একটা ব্যাপার তাই-
- এইসব নিয়ে তুমি ভাবছ কেন! আমাদের কাছে তুমি অত্যন্ত আপনজন। তুমি না থাকলে এই কলেজ আর আশ্রম কবে রিসোর্ট হয়ে যেত। সব ব্যবস্থা করা আছে। ম্যাডাম আমাদের স্পেশাল গেস্ট, উপরের ঘরে থাকবে। আমি নিজে ওর দেখাশোনা করব। আর দুজনকে দেব যারা সর্বক্ষণ ওর সঙ্গেই থাকবে। তুমি কি এখুনি যাবে?
- হ্যাঁ। তবে আগে আত্রেয়ীকে উপরে সেট করাবো তারপর। মিনিট দশেক বাদে যাব। ফাদার, এনি প্রবলেম?
- না। বেস্ট অফ লাক। আমি নিচে আছি, প্রয়োজন হলে জানিও।
একটি ছেলে আত্রেয়ীর লাগেজ উপরের একটি ঘরে রেখে “চা নিয়ে আসছি” বলে চলে গেল। রাজ হেসে আত্রেয়ীকে জিজ্ঞাসা করল –
- পর্ক, হ্যাঁম, বিফ এসব খাওয়া হয় তো? তা না হলে মুশকিল, ফাদার দুঃখ পাবেন।
- আমি সবই খাই। আপনি থাকছেন না?
- না। আমাকে জরুরী কাজে যেতে হবে। এখানে আপনি সম্পূর্ণ সেফ্। যা দরকার লাগবে বললেই পেয়ে যাবেন। তাছাড়া কম্পাউন্ডের মধ্যে গোটা তিনেক দোকান আছে, সেখানেও পাবেন। কম্পাউন্ডের বাইরে কখনই যাবেন না। আপাতত নয়। এটা আমার রিকোয়েস্ট।
- আপনি কবে ফিরবেন?
রাজ উত্তর দেওয়ার আগেই আত্রেয়ীর স্মার্টফোনটা বেজে উঠল, ভিডিও কল এসেছে, সিবিআই চিফ মিস্টার ঠাকুর ফোন করেছেন। কলটা রিসিভ করতেই উনি বললেন –
- ফোনে রাজকে পাচ্ছিলাম না, পাশে রাজকে দেখতে পাচ্ছি - একটা দুঃসংবাদ আছে। রাজের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
রাজ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল –
- কী হয়েছে?
- তোমাকে কাজের দায়িত্ব দেওয়ার পর আমার মনে হয়েছিল তোমার ফ্যামিলিকে প্রোটেকশন দেওয়া দরকার।
- আমার ফ্যামিলি! বাবা-মা-ভাই সবাই ঠিক আছে তো?
- তোমার বাড়িকে কনস্ট্যান্ট ওয়াচে রাখার জন্য দুজন গোয়েন্দাকে লাগিয়েছিলাম। একই সঙ্গে তোমার দ্বিতীয় বান্ধবী শর্মিলাকে প্রোটেক্ট করার জন্য দুজনকে পাঠিয়েছিলাম।
- ভনিতা না করে আসল কথাটা বলুন।
- প্রত্যেক গ্রুপকে বলা ছিল প্রতি ঘন্টায় হোয়াটস অ্যাপে আমাকে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। শর্মিলার বাড়ি থেকে ঘন্টা চারেক আগে শেষ রিপোর্ট আসে, সবকিছু নর্মাল আছে। তারপর কোনো রিপোর্ট নেই। ঘন্টা তিনেক আগে পরবর্তী রিপোর্ট পাওয়ার কথা, পাই নি। তারপর আরও আধ ঘন্টা ওয়েট করি। ফোনে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।
- শর্মিলার কী হয়েছে?
- এখন আমি শর্মিলার বাড়িতে। তুমি নিজেই দেখ - শুধু শর্মিলা নয়, আমার দুজন দক্ষ গোয়েন্দাকেও হারালাম।
আত্রেয়ী ভিডিওটা দেখে শিউরে উঠলো, তিনটে ছিন্নভিন্ন লাশ একটা ঘরে পড়ে আছে। ওর মধ্যে একজনের শাড়ি পড়া চেহারা দেখে মহিলা বলে বোঝা যাচ্ছে। বাকি দুজন পুরুষের মাথা দেহ থেকে শুধু আলাদা নয় এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে চেনার উপায় নেই। আত্রেয়ী রাজের মুখের দিকে তাকিয়ে শিঁউরে উঠলো – দাঁতগুলো, চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে, চোখ দুটো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে - রাজের এরকম মুখের চেহারা ও আগে দেখেনি। কি ভয়ানক! একটু বাদে রাজের কণ্ঠস্বর শুনল –
- আর ইউ সিওর, ওটা শর্মিলারই ডেড বডি?
- হ্যাঁ। এই মিনিট দশেক আগেই পৌঁছেছি। ডেড বডি পোস্টমর্টেমে এখুনি পাঠাচ্ছি না, তুমি আসবে বলে রেখে দিচ্ছি। তারপর যা ভালো বোঝো করবে। রোমাকেও খবর দিয়েছি।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর রাজের হিংস্র কণ্ঠস্বর আত্রেয়ী শুনতে পেল –
- আপনার কাছে নিশ্চয়ই আগে থেকে এর সম্বন্ধে ইনফর্মেশন ছিল? তাহলে আগে জানান নি কেন? আর রোমাকে এর মধ্যে একেবারেই জড়াবেন না।
- তুমি আমার সন্তানের মতন। আমার নিজের ছেলের থেকেও তোমাকে আমি বেশি ভালোবাসি। বিলিভ মি, এ সম্বন্ধে কোন ইনফর্মেশন আমার কাছে ছিল না। জাস্ট আমার সন্দেহ হয়েছিল তাই দু'জন করে গোয়েন্দা দু জায়গায় সর্বক্ষণ নজরে রাখার জন্য, তোমার ফ্যামিলিকে প্রোটেক্ট করার জন্য পাঠিয়েছিলাম। রোমা আমার কন্ট্রোলে আছে বলে নিশ্চিন্ত ছিলাম। তুমি কখন আসছ?
একটু চুপ করে থেকে রাজ উত্তর দিল –
- আপনি যা বললেন সেটা যেন সত্যি হয়। তা না হলে - আপনি বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিন। আমি যদি প্রয়োজন মনে করি তবেই ফিরবো। কবে কখন ফিরবো তা জানি না, জানলেও বলব না। এর পর থেকে কোন ফোন আমি রিসিভ করব না। ও হ্যাঁ, এটা জানানো দরকার তাই বলছি - এর পিছনে যে বা যারা আছে হয় তারা থাকবে নয়তো আমি থাকব, আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।
রাজ হাত বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দিল। আত্রেয়ী ওর হিংস্র মুখের চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেল। রাজ গট গট করে হেটে চলে গেল ঘরের দরজার কাছে, দরজাটা বন্ধ করে লক করে দিল। তারপর আত্রেয়ীর কাছে এসে গম্ভীর গলায় বলল –
- ঝটপট সব জামাকাপড় খুলে ফেলুন। তাড়াতাড়ি।
- মানে!
- বাংলা বোঝেন না! তাড়াতাড়ি করুন। আমি উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাড়াচ্ছি, তাকাবো না।
আত্রেয়ী হকচকিয়ে গিয়েছিল, এ কি আবদার! এই মানসিক অবস্থায় - মানুষটা কি পশু! সেল্ফ ডিফেন্সের কৌশল ওর ভালোই জানা আছে। ঠিক করে ফেলল, বেগতিক দেখলেই হাত-পা চালাবে। রাজের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল দু-চোখ জ্বলছে, সেই চোখে শুধু অপরিসীম ক্রোধ আর ঘৃণা। আত্রেয়ী পিছন ফিরে সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেললো। পাশে বিছানায় সবগুলো রাখলো। রাজ ওর দিকে একবারও না তাকিয়ে পিছনদিকে হাত বাড়িয়ে জামা কাপড় গুলো টেনে নিয়ে সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, তারপর ওকে সেগুলো একইভাবে পিছনফিরে দিয়ে পড়ে নিতে বলল। এরপর ওকে বসতে বলল। ও বসতেই মুখ খুলে দাঁত দেখাতে বলল। খুঁটিয়ে দাঁত দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করল –
- আপনার কোন দাঁতে কি ফিলিং হয়েছিল?
- না। আমার দাঁত খুব ভালো।
- ও-কে। আপনার সমস্ত ফোনগুলো আমায় দেবেন। দেখব।
স্মার্টফোন দুটো হাতে নিয়ে রাজকে দিয়ে বলল –
- এই দুটোই সবসময় ব্যবহার করি।
রাজ ফোন দুটো নিজের কাঁধের ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল –
- ডোন্ট মাইন্ড, আপনার লাগেজ আমি চেক করব।
ওর কথা শোনার সময় রাজের ছিল না। গিয়ে আত্রেয়ীর লাগেজ মানে ছোট ভিআইপি স্যুটকেসটা খুলে ফেলল। প্রতিটি জামাকাপড় বার করে খুঁটিয়ে দেখে স্যুটকেসটা উল্টে-পাল্টে দেখে অবশেষে পিছনের দিক থেকে একটা ছোট্ট গোল কী একটা টেনে বার করে বলল –
- এটা একটা মাইক্রোচিপ, এতে লোকেশন ট্র্যাক করা যায়। আপনার লোকেশন ট্র্যাক করার জন্য এটা লাগানো হয়েছে। এটাই খুঁজছিলাম। এবারে যা বলব তা রিকোয়েস্ট নয় অর্ডার, অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। আপনার হ্যান্ডব্যাগে একটা ছোট্ট আগের আমলের বেসিক সেলফোন রয়েছে, সেটাও আমাকে দেবেন। আপনার কাছে কোন ফোন আমি রাখবো না। আমি চাইনা ফোন ট্র্যাক করে কেউ আপনার সন্ধান পাক। আপনার কারো সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ করা চলবে না। আপনার বাড়িতে আমি প্রতিদিন নিয়ম করে খবর দিয়ে দেব। আমার সঙ্গে যোগাযোগ না করাই ভালো। যে কোন দরকারে, নিচে অফিস থেকে ল্যান্ডলাইনে ফাদারকে ফোন করবেন। সব রকম সাহায্য পাবেন। কম্পাউন্ডের বাইরে যাবেন না আর আমার সঙ্গে যোগাযোগের যদি খুব দরকার হয় তাহলে নিচের ল্যান্ডলাইন থেকে আমাকে সেলফোনে ফোন করবেন। সেই নম্বরটা দিয়ে দিচ্ছি।
রাজ ওর থেকে তৃতীয় সেলফোনটা নিয়ে ওকে একটা কাগজে একটা ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বেরিয়ে গেল। যখন বেরোচ্ছে আত্রেয়ী রাজের চোখে দু ফোটা জল দেখতে পেল।দ্বিতীয় পর্ব
(এক)
তপন গাড়ি নিয়ে শিলিগুড়ি চলেছে। এটাই রাজের হুকুম। রাজ পিছনে বসে ভাবছিল শর্মিলার কথা। দ্বিতীয় শর্মিলার কথা। শর্মিলার যে এরকম একটা পরিনতি হবে তা কি ও ভাবতে পেরেছিল? কিন্তু, সেরকম একটা কষ্ট হচ্ছে না কেন! যে কোন মানুষের ক্ষেত্রেই এরকম একটা পরিণতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তার উপর সে যদি এককালের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হয়। কিন্তু, প্রথমবার যখন প্রথম শর্মিলাকে হারায় তখন কষ্টে বুক ফেটে গিয়েছিল। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে খুঁজে বার করেছিল অপরাধীকে যাতে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া যায়। অথচ, এক্ষেত্রে তো সেরকম কষ্ট হচ্ছে না! হয়তো রোমাকে গোপনে বিয়ে করার পর ওর রাজের প্রতি ভালবাসাই এরকম পরিবর্তন ঘটিয়েছে। রাজ যুক্তিবাদী মানুষ, নিজের মনেই নিজের অ্যানালিসিস করছিল। প্রথম শর্মিলাকে ও গভীরভাবে ভালবেসেছিল। মনে পড়ে গেল ওদের প্রথম দেখা হওয়ার কথা। তারপর যখন দুজনেই দুজনের প্রেমে পড়েছে তখন হঠাৎ হত্যা করা হল শর্মিলাকে। ঢাকুরিয়া লেকে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কীভাবে বেঞ্চের উপর শর্মিলার মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিল তা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। এখনও প্রতিটি ঘটনা ওর মনে আছে, কিছুই ভুলতে পারে নি। প্রথম শর্মিলার মুখটা মনে পড়ল। অথচ, দ্বিতীয় শর্মিলার মুখ! সেই মুখের জায়গায় বারবার প্রথম শর্মিলার মুখ ভেসে উঠছে কেন! তাহলে কি দ্বিতীয় শর্মিলাকে ও কোনদিনই ভালোবাসতে পারে নি? প্রথম শর্মিলার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর একটা কেসে বছর দেড়েকের মাথায় আলাপ হয়েছিল দ্বিতীয় শর্মিলার সঙ্গে। হয়তো “শর্মিলা” নামটা ওকে আকর্ষণ করেছিল। তা না হলে এরকম হচ্ছে কেন! ওদের আলাপের পর কতদিন শর্মিলার বাড়িতে গেছে? রোমাকে গোপনে বিয়ের আগে বাইরে বা বিদেশে থাকাকালিন মাত্র একবার শর্মিলাকে ফোন করেছিল। ওদের ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে শেষবারের মতো রাজ যখন ফোন করেছিল তখন মাত্র মিনিট পাঁচেক কথা হয়েছিল। তাহলে কি শর্মিলাও ওদের এই সম্পর্কটাকে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল? হয়তো দ্বিতীয় শর্মিলা বুঝতে পেরেছিল রাজ সত্যি সত্যিই ওকে ভালবাসতে পারে নি। সে কারনেই বোধ হয় সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চায় নি। অনেকক্ষণ চোখ বুজে ভাবার পর রাজ এই সিদ্ধান্তে এল, শর্মিলার প্রতি ওর একটা দুর্বলতা থাকলেও সেটা সম্ভবত প্রেম নয়। হয়তো এটা শর্মিলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ওর দুর্বল মানসিক মুহূর্তে দ্বিতীয় শর্মিলার সঙ্গে আলাপ আর এই “শর্মিলা” নামটাই সম্ভবত ওকে দুর্বল করে গিয়েছিল। কিন্তু, তা প্রেম নয় কারণ দ্বিতীয় শর্মিলার সঙ্গে ওর সেরকম কোনও মানসিক যোগাযোগ তৈরি হয়নি। তারপর রোমার সঙ্গে আলাপ সবকিছু উল্টে দিল। রোমা এখন ওর স্ত্রী। তার মানে এই নয় যারা দ্বিতীয় শর্মিলাকে খুন করেছে তাদের ও ছেড়ে দেবে। সর্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে তাদেরকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। হঠাৎ শিঁউরে উঠলো। আততায়ীরা রোমার খবর জানেনা বলেই শর্মিলাকে খুন করে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। ওদের গোপন বিয়ের খবর আততায়ীদের জানা নেই। কিন্তু এই তথ্য কতদিন গোপন থাকবে? অর্থাৎ, রোমার জীবনও সুতোয় ঝুলছে। এটাও ঠিক করল, দ্বিতীয় শর্মিলার নিকট আত্মীয় অর্থাৎ ওর ভাইয়ের সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলবে। ভাগ্যক্রমে, ওর ভাইয়ের ফোন নম্বর ওর কাছে আছে যদিও সেটা চালু আছে কিনা তা জানা নেই। নম্বরটা চালু না থাকলেও শর্মিলার ভাইয়ের ফোন নম্বর জোগাড় করার ক্ষেত্রে রাজের অসুবিধা হবে না।
রাজ ঘুমিয়ে পড়েছিল, তপনের ডাকে ঘুম ভাঙল। তপন জানাল ওরা শিলিগুড়ি পৌঁছে গেছে। রাজ ওকে হোটেল রাজহান্স-য়ে যেতে বলল। হোটেল রাজহান্স নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের কাছে মাঝারি মানের হোটেল। অতীতে বেশ কয়েকবার রাজ এই হোটেলে উঠেছিল। একদম টপ ফ্লোরে একটা ঘর নিল। চেক ইন করে তপনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এবারের গন্তব্য স্থল শিলিগুড়ি মার্কেট। মার্কেট থেকে নিজের জন্য একটা হাফ সোয়েটার আর একটা জ্যাকেট কিনল কারণ কোন গরম জামাকাপড় সঙ্গে আনে নি। তপনকে ইনস্ট্রাকশন দিল ওকে শিলিগুড়ির লিনটন হোটেলে নামিয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা ওর বাড়িতে যেতে। বাড়ি থেকে তিন চারদিন পাহাড়ে থাকতে হতে পারে এটা বুঝে জামাকাপড় নিয়ে আসতে।
তপন রাজকে অনেকক্ষণ আগে লিনটন হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গেছে। রাজ লিনটন হোটেলের ম্যানেজারকে নিজের পরিচয় দিয়ে আত্রেয়ীর রুমে যেদিন বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল সেদিনকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশেষত ওই ফ্লোরের সিসিটিভি ফুটেজ দেখল। তারপর চিন্তিত মুখে হোটেল রাজহান্সে ব্যাক করল। নিজের রুমে ঢুকে দ্রুত ভেবে নিল এরপর কী করবে। শর্মিলার ভাইকেও ফোন করে একবার কথা বলে নিল। এরপর নিজের স্মার্টফোনে ইন্টারনেট খুলে ঝটপট বেশ কিছু বুকিং করে ফেলল এবং অনলাইনে তার পেমেন্টও করে দিল। ঘড়ি দেখল, সন্ধ্যা সাতটা বাজে। তপনকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করল সারা রাত গাড়ি চালাতে পারবে কিনা। তপন যদিও বলল ওর কোন অসুবিধা নেই, রাজ ডিসিশন নিল পরদিন সকালে খুব ভোরে রওনা দেবে কারণ তপনের বিশ্রাম দরকার। ওকে জানিয়ে দিল পরদিন ভোর পাঁচটায় রওনা দেবে, ১৫-১৬ ঘন্টা গাড়ি চালাতে হতে পারে তাই সে রকম প্রস্তুতি নিয়ে যেন আসে। রাতে ফাদারকে ফোন করে আত্রেয়ীর খবর নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। ঘুম কিন্তু এল না।
পরদিন ভোর সাড়ে চারটের সময় স্মার্টফোনের অ্যালার্মে ওর ঘুম ভাঙলো। রেডি হয়ে জামা কাপড় গুছিয়ে ঠিক পাঁচটার সময় নিচে নামল। চাবি রিসেপশনে ইচ্ছা করেই জমা দিল না কারণ ওর তিনদিনের রুম রেন্ট আগাম দেওয়া আছে। বাইরে এসে দেখল তপন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। গাড়িতে উঠে তপনকে সোজা শিলং যেতে বলল। প্রায় চৌদ্দ ঘন্টার জার্নি। শিলং পৌছতে রাত সাতটা-আটটা বেজে যাবে। সকাল আটটা নাগাদ রাস্তার ধারে একটা ধাবায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দুজনে ব্রেকফাস্ট করে নিল। ব্রেকফাস্ট করতে করতেই শিলংয়ে হোটেল লেক ভিউ ইন-এ একটা রুম বুক করে ফেলল। গতকাল রাতে সাইটটা না খোলায় বুকিং করতে পারে নি। এই হোটেলটা পুলিশ বাজারের কাছে ওয়ার্ডস্ লেকের পাশে। গাড়ি রাখার যেমন ব্যবস্থা আছে তেমনই ডাইভারের থাকার ব্যবস্থাও ওরা করে।
শিলং পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা বেজে গেল। রাজ এই আশঙ্কাই করেছিল। শিলংয়ে ওর কোন কাজ সেভাবে নেই। যে দু-একটা জায়গায় যাওয়া দরকার তা ফেরার সময় গেলেই হবে। এত রাতে কিছুই করা যাবে না। শিলং শহরটা অদ্ভুত। বৃষ্টি হলে বেজায় ঠান্ডা পড়ে। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে তাই বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। রাজ চেক ইন করে নিজের রুমে ঢুকে কম্বল গায়ে দিয়ে টিভি চালিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘরে রুম হিটার থাকলেও চালালো না। এই রুমটা বেসমেন্টে বলে সম্ভবত ঠান্ডাটা একটু কম। তপনেরও থাকার ব্যবস্থা একই ফ্লোরে হোটেলের কর্মচারীদের সঙ্গে হয়েছে। রাজের ডিনার ওর ঘরে দিয়ে যাবে কারণ রাজ সেরকম ইনস্ট্রাকশনই দিয়েছে। রাজ মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে কী করবে। একেবারে প্রথম থেকে শুরু করা দরকার। প্রথম থেকে মানে আত্রেয়ীর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট থেকে। আত্রেয়ীর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ডাবল ডেকার রুট ব্রিজে। যেখানে ও চোরাচালানকারীদের ধরেছিল। এরা দু-দুটো খুনও করেছিল। ও সেখানে যাবে, যদি কোন সূত্র পাওয়া যায়। এতদিন বাদে সূত্র পাওয়া খুব কঠিন, তাও একটা চেষ্টা করা। আগামীকাল ওর গন্তব্যস্থল, চেরাপুঞ্জি হয়ে মওশামক গ্রামের কাছে থাকা ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ।
(দুই)
শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি হয়ে মওশামক গ্রামে যখন রাজেরা পৌঁছলো তখন সকাল প্রায় দশটা বাজে। এখান থেকে ওদের যেতে হবে ডান দিকের রাস্তা ধরে নিচের দিকে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ। রাস্তা শেষ হয়েছে ত্যারনা গ্রামে। গ্রাম মানে পাহাড়ের গায়ে সাত-আটটা ঘর। অবশ্য একটু নিচে ঢালে আরও বেশ কিছু ঘর আছে। এই গ্রাম থেকে নেমে গেছে সিঁড়ি, বহু নিচে ডাবল ডেকার রুট ব্রিজে। এই রুট ব্রিজ দেখতে বহু ট্যুরিস্ট যায়, এতটাই নিচে পাথরের খাড়া খাড়া সিঁড়ি ভেঙে নামতে হয় যে ট্যুরিস্টরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই, রুট ব্রিজের আশে পাশে কয়েকটা খাবার দোকান যেমন আছে তেমনই সেসব দোকানের সঙ্গে লাগোয়া ঘরে রাতে থাকার ব্যবস্থাও আছে। এরকমই একটি দোকানের ঘরে রাতে আত্রেয়ী ছিল এবং ওর ঘরে থাকা বাকি দুজন বিদেশীনিকে খুন করা হয়েছিল। রাজ এই ঘটনা জানে। তপনকে গাড়ি পার্ক করতে বলে রাজ ওকে ওর সঙ্গে আসতে বলল।
রাজ যদিও তপনকে নিয়ে মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নিতে নিতে নেমেছে তা হলেও যখন নিচে ডাবল ডেকার রুট ব্রিজের কাছে পৌঁছল তখন বিধ্বস্ত অবস্থা। ঘড়িতে দুটো বেজে দশ মিনিট। কোনরকমে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে গেল সেই দোকানটায় যেখানে আত্রেয়ী এসে উঠেছিল। এখানে সব দোকানের মালিকই খাসি মহিলা। দোকানের মালকিনের বয়স বেশি নয়। আত্রেয়ী যে ঘরে ছিল সেই ঘরটাই রাজ নিল। ঘরে তিনটে বেড, রাজ তিনটে বেডের ভাড়াই দিয়ে দিল। লাঞ্চে খাসি খাবার ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। ভাতের সঙ্গে চিকেন। ভাত, ডাল, একটা আলুভাজা জাতীয় সবজি, পুদিনার চাটনি আর চিকেন। রাজের খেতে মোটেই ভাল লাগছিল না, কিন্তু খেয়ে নিল। এখানে সব দোকানে এই খাবারই পাবে।
খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তপনের ডাকে ঘুম ভাঙলো। তপন এই ঘরেই অন্য একটা খাটে শুয়েছিল। কেউ একজন দরজা ধাক্কাচ্ছে। রাজ একটু অবাক হল। উঠে দরজা খুলে দেখল মালকিন মেয়েটি। মেয়েটি একটু ইতস্তত করে ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করল –
- আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল, আপনি কি ব্যস্ত আছেন?
রাজ ঘরের ভেতরটা একবার দেখে নিয়ে বলল –
- না। চলুন, আপনার দোকানে বসে কথা বলা যাক।
দোকানে গিয়ে রাজ বসতেই মেয়েটি ওর কর্মচারীকে খাসি ভাষায় কী একটা বলল। কর্মচারীটি এক কাপ চা এনে রাজের সামনে রাখলো। মেয়েটি হেসে বলল –
- এইটা আমার তরফ থেকে। আমার একটা প্রশ্ন ছিল। আপনারা কতদিন থাকবেন? আগামীকাল সকালেই নিশ্চয়ই ঘর ছেড়ে দিচ্ছেন?
রাজ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল –
- সেটা এক্ষুনি বলতে পারব না। পায়ে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। তাছাড়া, এই জায়গাটা, ব্রিজটা খুব সুন্দর। হয়তো আগামীকাল থেকে পরশু সকালে ফিরব।
- আসলে আমার এই একটি ঘর। সব ট্যুরিস্টরা এসে এখানে শুধু রাতটুকুই থাকে। পরদিন সকালে ঘর ছেড়ে চলে যায়। আপনি এসে যখন ঘর চাইলেন তখন ভেবেছিলাম আপনি আগামীকাল সকালেই ঘর ছেড়ে দেবেন। সবাই যা করে। আসলে আগামীকাল সকাল থেকে তিন-চার দিনের জন্য বুকিং রয়েছে।
- কিন্তু, তা কী করে হয়! আমি ঘর ভাড়া নিয়েছি, পেমেন্টও করে দিয়েছি। যদি আপনি তিন-চারদিনের ভাড়া চান, আমি না থাকলেও তা দিয়ে দিতে পারি। তাহলে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হবে না?
- আসলে আপনারা ট্যুরিস্টরা সবাই ফ্লায়িং কাস্টমার। আপনি আজকে এসেছেন ভবিষ্যতে হয়তো আর কোনদিন আসবেন না। যিনি ঘরটা বুক করেছেন তিনি আমাদের রেগুলার কাস্টমার। প্রতি মাসে আসেন, তিন-চারদিন থেকে চলে যান। তিনি এলে আমার এখানেই ওঠেন, অন্য কোনো দোকানে থাকেন না।
- প্রতি মাসে তিন-চার দিনের জন্য আসেন! কোন কাজে আসেন? নাকি বেড়াতে?
- উনি সরকারের খুব বড়ো একজন গোয়েন্দা। ওঁর সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলা বারণ আছে। উনি বারণ করেছেন। এতে নাকি ওঁর কাজের অসুবিধা হবে।
- উনি কি কোন তদন্তে আসেন?
- তদন্ত! না- না। আসলে বর্ডার পাশেই। সম্ভবত সেসব নজরে রাখার জন্য আসেন। জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলেন না। তবে, মাঝে মাঝে ওঁর লোক এসে এখান থেকে হ্যাভারস্যাকে ভরে মাল নিয়ে যায়।
- কী মাল?
- জানি না। তাহলে কি আপনি আগামীকাল সকালে ঘরটা ছেড়ে দিচ্ছেন?
- আপনি যখন এত করে বলছেন, ছাড়তে তো হবেই। আপনিই তা হলে আশে-পাশে বলে একটা ব্যবস্থা করে দিন যাতে আরো দু-এক দিন এখানে থাকতে পারি।
মেয়েটি রাজি হয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। রাজ নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল। ডিসিশন নিয়ে ফেলেছে, এখানে আরো দু-এক দিন থাকবে। একটু বাদে কর্মচারীটি এসে জানিয়ে গেল মালকিন ওকে জানাতে বলেছে ঠিক পাশের দোকানটাতেই ওর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। দোকানে দুটি ঘর আছে। ছোট ছোট, একজন করে থাকতে পারে। ওরা যেন সকালে ওই দুটি ঘরে শিফ্ট করে। রাজ কর্মচারীটিকে বলল ও ঘর দুটি দেখতে চায়। কর্মচারীটি ওকে নিয়ে পাশের দোকানে গেল। খাসি মালকিনের বয়স মাঝারি, রাজকে নিয়ে গেল ঘর দেখাতে। একটি ঘর একদম পাশের দোকানে রাজেরা যেই ঘরে আছে তার লাগোয়া। ওই ঘরের জানালাটা বন্ধ ছিল, রাজ খুলতেই দেখতে পেল ওরা যে ঘরে আছে তার ভিতরটা দেখা যাচ্ছে। তপনকেও দেখতে পেল কারণ ঘরের জানালাটা খোলা, রাজ ওই দোকানের ঘরে প্রথম ঢুকেই জানালাটা খুলে দিয়েছিল। রাজ মালকিনকে দু-তিন দিন থাকবে জানিয়ে তিনদিনের জন্য দুটো ঘরের টাকা অগ্রিম দিয়ে দিল। বেরিয়ে এল খুশিমনে। আজকাল খুব কম স্মোক করে। পকেট থেকে ফিল্টার উইলস্ নেভির কাটের প্যাকেটটা বার করে একটা সিগারেট ধরালো। আগামী পরশু ঠিক করেছিল কলকাতায় ব্যাক করবে, সেটা সম্ভবত হবে না। গতকাল বাগডোগরা-কলকাতা ফ্লাইটের টিকিট দেখতে গিয়ে দেখেছিল মাত্র দুটো ইকোনমি ক্লাসের টিকিট আছে। ভাগ্যিস বুক করেনি, তাহলে ক্যানসেল করতে হত। রাজ জানে, প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটা ওয়াটার ফলস আছে। তপনকে নিয়ে সেখানে একবার যেতে হবে। জায়গাটা দেখা দরকার।
(তিন)
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে রাজ তপনকে নিয়ে ওই দোকানের ঘর ছেড়ে পাশের দোকানে শিফ্ট করল। রাজ নিজে আগের দিন দেখা লাগোয়া ঘরটা নিল। জানালা খুলে দিতেই একরাশ আলোয় ঘর ভরে গেল। ঘরটায় আলো হওয়া প্রচুর। ভেবেছিলো আগের দোকানের মালকিন মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আত্রেয়ী যখন এসেছিল সেই সময়ে ওই ঘরে প্রচুর গুলিগোলা চলেছিল। মালকিনের নিশ্চয়ই সেসব মনে আছে। হয়তো প্রশ্ন টশ্ন করে কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু, পরে ডিসিশন চেঞ্জ করল। এখনই কিছু জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না। ওকে ভাবিয়ে তুলেছিল এই গোয়েন্দা ভদ্রলোক। কোথাকার গোয়েন্দা? সিবিআই? নাকি রাজ্য সরকারের? সিবিআইয়ের হলে ওকে মিস্টার ঠাকুর নিশ্চয়ই জানাতেন। তাহলে, রাজ্য সরকারের হতে পারে। আরেকটা সম্ভাবনা আছে। সরকারি গোয়েন্দা সেজে এখানে কোনরকম অনৈতিক বেআইনি কাজ কর্ম চালাচ্ছে। যেটাই হোক, ওকে অত্যন্ত সাবধানে সব কাজ করতে হবে।
রাজের অসীম ধৈর্য। ও জানে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে অনেক সময় ভালো ফল পাওয়া যায়। নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে কেসটা নিয়ে নানান কথা ভেবে চলল আর একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করতে থাকল। মাঝে মাঝে হাঁক দিয়ে অবশ্য ঘরে চা পাঠাতে বলছিল। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হল। সাড়ে বারোটা নাগাদ ওই ঘরে তিনজন ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন। একজন মাঝবয়সী। অন্য দুজনের বয়স অল্প, সম্ভবত উনিশ-কুড়ি বছর বয়স। তিনজন তিনটে খাটে গিয়ে বসল। কর্মচারীটি ওদের মালপত্র দিয়ে গেল। একটি ছেলে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। মাঝবয়সী ভদ্রলোক ছাড়া আর কাউকে জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল না। ভদ্রলোক জ্যাকেটটা খুলে যখন বিছানার ধারে রাখছেন তখন রাজ ভদ্রলোকের কোমরে গোঁজা রিভলভারটা দেখতে পেল। অর্থাৎ, ভদ্রলোক পুরো সাবধানতা নিয়ে এসেছেন। এখন প্রশ্ন একটাই - ওঁর আসল পরিচয়টা কী? এটা রাজকে জানতেই হবে। হয়তো এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র।
রাজ ঠিক দুটোর সময় তপনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্যস্থল এক কিলোমিটার দূরের পাহাড়ী ঝোড়া আর ওয়াটার ফলস্। সঙ্গে গাইড হিসাবে একটা বাচ্চা খাসি ছেলেকে নিয়ে নিল। এটা অবশ্য মালকিন মহিলার কথায়। রাস্তাটা নাকি দুর্গম এবং ওদের পক্ষে চেনা একটু মুশকিল হতে পারে। পথে যেতে যেতে রাজ ভাবছিল - এটা রাস্তা! পাহাড়ী পাকদণ্ডী, রাস্তা অত্যন্ত খারাপ, বোল্ডারের উপর পা ফেলে ফেলে যেতে হচ্ছে। আগের দিনের পায়ের ব্যথা এখনও কমে নি। তপনেরও একই অবস্থা। ছেলেটা অত্যন্ত ভালো, রাজের ভীষণ অনুগত। যা বলা হয় মুখ বুজে করে। রাজের মনে একটা ছোট্ট ইচ্ছা আছে, এই তপন ছেলেটাকে ভবিষ্যতে কলকাতায় নিয়ে যাবে। এরকম অনুগত, ভালো গাড়ি চালাতে জানে, একজনকে ওর দরকার। ও জানে তপনকে বললে এক কথায় রাজি হয়ে যাবে কারণ ওর বহুদিনের সাধ কলকাতায় গিয়ে কিছু একটা করার।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক বাদে ওরা পাহাড়ী ঝর্ণার কাছে পৌঁছল। সামনেই জলপ্রপাতটা। প্রায় শ'খানেক ফুট ওপর থেকে জল এসে পড়ছে নিচে। যার জন্য নিচে একটা বড়ো জলাশয়ের মতো তৈরি হয়েছে। এই জল পাহাড়ী ঝোড়া হয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহু দূরে। রাজ জলপ্রপাতের সামনে একটা বড়ো পাথরের চাতালের উপর বসে সিগারেট ধরালো। দেখল তপন হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল সামনে। ও চেঁচিয়ে তপনকে বলে দিল চোখ কান খোলা রাখতে। রাজ স্মার্টফোনটা বার করে দেখল ওখানে ফোনের টাওয়ার আছে। দেখল তিনটে মিসড্ কল বলে ফোনে শো করছে। দুটো নম্বর অচেনা। তৃতীয়টি মিস্টার ঠাকুরের কল ছিল। এখানে কানেকশন টু-জি শো করছে, ফোর-জি নেই। অর্থাৎ, এখানে হোয়াট্স অ্যাপ চলবে না। শুধু ফোন করা যাবে আর এসএমএস পাঠানো যাবে। টাওয়ার আছে তবে মাত্র দুটো দাগ। অর্থাৎ, দুর্বল কানেকশন। হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠল, তপন ফোন করছে। ফোনটা ধরতেই তপনের ফিসফিসিয়ে উত্তেজিত গলা শুনতে পেল। কথা কেটে কেটে যাচ্ছিল তাই ও কী বলছে রাজ বুঝতে পারছিল না। শুধু বুঝতে পারল সামনে অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখতে পেয়ে ও ফোন করেছে। রাজ উঠে পড়ল। বাচ্চা ছেলেটা দূরে জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে। ইচ্ছে করেই ওকে ডাকলো না। এগিয়ে চলল দ্রুত সামনের দিকে তপন যেদিকে গেছে সেদিকে। সরু পায়ে চলা পথটা ডান দিকে বেঁকে ঢুকে গেছে দুটো পাহাড়ের মাঝখানে। রাজ অত্যন্ত সতর্ক হয়ে এগিয়ে চলল। ওর ভয় হচ্ছে তপন কোনরকম বিপদে পড়ে নি তো? রাস্তাটা বাদিকে ঘুরে গেছে। বাদিকে ঘুরেই তপনকে দেখতে পেল, একটা পাথরের পিছনে মাথা নিচু করে উবু হয়ে নিজেকে লুকিয়ে বসে আছে। ওকে দেখতে পেয়ে ইশারায় সাবধানে আসতে বলল। রাজ প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ওর কাছে পৌঁছে ও যেদিকে দেখালো সেদিকে তাকালো। অনেকটা নিচে একটা ফ্ল্যাট পাথরের চাতালের উপর সারি দিয়ে এলএমজি আর রিভলভার সাজানো রয়েছে। রাজ গুনে দেখল, দশটা এলএমজি আর দশটা রিভলভার। পাশে একটা কাঠের বাক্স। ঢাকনা খোলা। সম্ভবত ওই বাক্স থেকে অস্ত্রগুলোকে বার করা হয়েছে। রাজ দ্রুত চিন্তা করে যাচ্ছিল। রুট ব্রিজ থেকে কাউকে এখানে আসতে হলে এই পথেই আসতে হবে, আর কোন পথ সম্ভবত নেই। সেক্ষেত্রে ওদের দেখে ফেলবে। তাই, এ মুহূর্তে এখান থেকে কেটে পড়াই ভালো। তপনকে নিয়ে দ্রুত ফিরে চলল জলপ্রপাতের দিকে। জলপ্রপাতের সামনে পৌঁছে দেখলো ছেলেটি দুজন ফরেনার মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। ওই মহিলা দুজন সম্ভবত সদ্য এসেছে।
রাজ এগিয়ে গেল ওঁদের কাছে। জিজ্ঞাসা করে জানল ওঁরা অস্ট্রেলিয়ান। ভারতে এসেছে মাসখানেক আগে। ওরা নাকি রিসার্চ ফেলো! ইন্ডিয়ান ট্রাইবালসদের নিয়ে গবেষণা করছে। ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ ওঁদের দেখার লিস্টে আছে কারণ এটা নাকি এখানকার ট্রাইবালসদের এক আশ্চর্য সৃষ্টি। আসলে লোকাল ট্রাইবালসরা ঝোড়ার উপর ব্রিজ তৈরি করার জন্য দড়ি বা বাঁশ টাশ বেঁধে গাছের শিকড়কে তার উপর দিয়ে যেতে সাহায্য করে। এতে কালক্রমে তৈরি হয় সম্পূর্ণ ন্যাচারাল রুট ব্রিজ। একেকটা ব্রিজ তৈরি করতে নাকি ৭০-৮০ বা ১০০ বছরও লেগে যায়। এসব রাজের জানা তথ্য তাও ওঁদের মুখে শুনতে ভালো লাগছিল। রাজ ওঁদেরকে বলল –
- এই জায়গাটায় সন্ধ্যার পর থাকাটা খুব একটা সেফ নয়। নানা রকম বন্য জন্তু জল খেতে আসে। আমরা আপনাদের জন্য আরো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করছি, তারপর একসঙ্গে ফিরব। আমাদের সঙ্গে গাইড আছে তাই সন্ধ্যা হয়ে গেলেও খুব একটা অসুবিধা হবে না।
মেয়ে দুটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে রাজের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। রাজেরা যখন ফিরছে তখন মাঝপথে ওই গোয়েন্দা ভদ্রলোক তার দুজন সঙ্গীকে নিয়ে নিচে নামছেন দেখতে পেল। ভদ্রলোক ওদের দেখে দাড়িয়ে পড়লেন। রাজকে উদ্দেশ্য করে বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন –
- শুনলাম আপনি বাঙালি। এখানে এই প্রথম এলেন?
রাজ হেসে জবাব দিল –
- হ্যাঁ। জায়গাটা দারুণ। বিশেষ করে রুট ব্রিজ। এত ভালো লেগেছে যে ঠিক করেছি আরো দুদিন থাকবো। আপনিও কি প্রথম?
- না-না, আমি মাঝে মধ্যেই আসি। আসি অবশ্য কাজে। আমার জায়গাটা দারুণ লাগে। আসুন না আমার ঘরে আজ রাতে, গল্প টল্প করা যাবে।
- কখন?
- এই রাত দশটা নাগাদ।
- অত রাতে হবে না। আসলে রাতে দশটা নাগাদ শোওয়া আমার অভ্যাস। আগামীকাল সকাল ন'টা নাগাদ কি সম্ভব?
- আসুন। আমি থাকবো।
উনি সঙ্গীদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন। রাজ চিন্তিত মুখে তপনকে বলল –
- রাতে খুব সাবধানে থাকবে। কেউ দরজা নক করলে খুলবে না। আগামীকাল সকালে নটার সময় তোমাকে নিয়ে যাব, তৈরি থাকবে।
রাজেরা রুট ব্রিজের সামনে এলে মেয়ে দুটি চলে গেল। ওরা কাছেই একটা দোকানে রাতে থাকবে। একটি মেয়ে পুরো রাস্তা রাজের সঙ্গে গল্প করতে করতে এসেছে। মেয়েটির নাম অ্যালিস। অ্যালিস কথাবার্তায় অত্যন্ত স্মার্ট। রাজের ওর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লেগেছে। মেয়েটি অনেক খবর রাখে।
(চার)
রাজ রাতে ঠিক নটার সময় ডিনার করে ঘরে চলে এল। ঘরের দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে জানালাটা খুলে দিল। ঠান্ডা হাওয়া আসছে। একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে জানালার থেকে একটু দূরে খাটে বসে পড়ল। এবারে ওকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। ঠান্ডায় স্মোক করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু করল না। সামনের ঘরের জানালা খোলা, ঘরে কেউ একজন আছে কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না। টিউব লাইট নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালানো হল। রাজ চুপ করে দেখে যাচ্ছে। হঠাৎ সামনের ঘরের দরজায় কেউ নক করল। নাইট-ল্যাম্পের আলোয় ঘরের ভেতরটা দেখা গেলেও খুব ভালো বোঝা যাচ্ছে না। ঘরে যিনি ছিলেন উঠে গিয়ে আলোটা জ্বালালেন তারপর দরজা খুলে কাউকে ভিতরে আসতে বললেন। যে ঢুকলো সে একজন মহিলা। মাথায় একটা স্কার্ফ বাধা যার জন্য মুখটা ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটি খাটে বসে মৃদু স্বরে কথা বলছে। লোকটি'ও তাকে কী সব বলছে। এবারে, লোকটি কথা বলছে, মেয়েটি শুধু শুনছে আর মাথা নাড়ছে। এরপর মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। একবার ওদের ঘরের জানালার দিকে তাকালো। রাজ এবারে মুখটা দেখতে পেল, একটু অবাকই হল কারণ অ্যালিসকে দেখবে ভাবে নি। অ্যালিস ঘর থেকে বেরোতেই লোকটি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর, নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। রাজের সিক্সথ্ সেন্স বলছে কোথাও কিছু একটা গন্ডগোল আছে, সাবধান হওয়া দরকার। উঠে জানালাটা বন্ধ করে খাটে কান খাড়া করে বসে রইল।
রাত প্রায় এগারোটা বাজে। রাজ খাটে তখনও চুপ করে বসে আছে। ওর ঘরের সামনে কার পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপর দরজায় নক করার শব্দ। রাজ কোন সাড়া দিল না। আবার নক করল কেউ। এবারেও রাজ কোন সাড়া দিল না। একটু বিরতি। এরপর বেশ জোরে কেউ নক করল। রাজ ঠিক করেই ফেলেছিল কী করবে। ঘুম ভেঙে মানুষ যেরকম আচরণ করে ঠিক সেভাবে ঘুম জড়ানো স্বরে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল –
- কে! কী চাই?
একটি মেয়ের গলা –
- আমি অ্যালিস। প্লিজ দরজাটা খুলুন।
- এত রাতে! আপনি কাল সকালে আসুন, তখন কথা বলব।
- আমি একটা সমস্যায় পড়েছি, আপনার সাহায্য চাই।
- এত রাতে কোন কিছুই সম্ভব নয়।
- প্লিজ দরজাটা খুলুন।
রাজ বিছানা ছেড়ে উঠলো। জব্বর ঠান্ডা পড়েছে। বিছানার চাদর, কম্বল সব এলোমেলো করে দিল। তারপর উঠে গিয়ে দরজার ছিটকিনিটা খুলে অল্প একটু ফাঁক করে দেখে নিল, অ্যালিস একাই দাঁড়িয়ে আছে। পরণে একটা বোরখা। দরজাটা খুলতেই ঘরে ঢুকে বলল –
- আমি কি একটু বসতে পারি?
রাজ একটু কড়া গলায় বলল –
- আমি আনম্যারেড এবং ব্যাচেলার। এত রাতে আমার ঘরে এভাবে আসাটা আপনার ঠিক হয় নি। কী সমস্যা বলুন।
- আমার ফ্রেন্ড, আপনি তো ওকে দেখেছেন?
- হ্যাঁ। ওঁর কী হয়েছে?
- জেনির কিছু হয়নি। আসলে ও লেসবিয়ান। ওকে সঙ্গ দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। আমি ওর মত নই, নর্মাল। তাই, তোমার কাছে চলে এলাম। আই ওয়ান্ট ইউ। এই মুহূর্তে এখানে তোমার মতো হ্যান্ডসাম কেউ নেই। তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে।
রাজ কড়া ভাষায় উত্তর দিতে যাচ্ছিল, দেখল অ্যালিস উঠে দাঁড়িয়েছে। পরনের বোরখাটা এক টানে খুলে ফেলে দিল, ভিতরে কোন কিছু পড়া নেই। রাজ ওর দেহটা তাকিয়েও দেখল না। উঠে গিয়ে মেঝে থেকে বোরখাটা তুলে ওর পায়ের কাছে মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে বলল –
- গত পরশু আমার বান্ধবীর মৃত্যু হয়েছে। আমার মানসিক অবস্থা ভালো নয়। তাছাড়া, আমাদের হিন্দু ধর্মে, বাঙালিদের মধ্যে একটা সংস্কার আছে, যতদিন না শ্রাদ্ধ হচ্ছে ততদিন কোন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা যায় না। তুমি যখন ভারতীয় মানুষদের নিয়ে গবেষণা করছ তখন আশা করা যায় এটা তুমি জানো। তাই, প্লিজ গো টু ইওর রুম। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
রাজের ছুড়ে দেওয়া বোরখাটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে অ্যালিস সেটা পড়তে পড়তে বলল –
- আমার জীবনে তুমিই প্রথম মানুষ যে আমাকে রিফিউজ করল। ও-কে, আই উইল ওয়েট। তবে, যা বললে তা যদি সত্যি না হয় - আমি তোমাকে ছাড়বো না।
অ্যালিস গটগট করে বেরিয়ে যেতেই রাজ ঘরের দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে জানালাটা খুললো।
উল্টোদিকের ঘরের জানালা বন্ধ হয়ে গেছে। একটু বাদে মৃদু দরজায় নক করার শব্দ পেল। এরপর দরজা খোলার শব্দ। আসলে এত রাতে নিস্তব্ধতার জন্যই রাজ এটা শুনতে পেল। তারপর মিনিট দুয়েক বাদে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেল। রাজ নিশ্চিন্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ওর মনে হল এত রাতে আর কোন উপদ্রব হয়তো হবে না।
পরদিন সকালে ঠিক নটার সময় তপনকে নিয়ে পাশের দোকানে গিয়ে শুনলো ওই গোয়েন্দা ভদ্রলোক নাকি সকাল আটটার সময় ঘর বন্ধ করে বেরিয়ে গেছেন, কোথায় গেছেন তা বলে যায় নি। রাজ দ্রুত চিন্তা করে যাচ্ছিল, সম্ভবত ভয়ংকর কোন বিপদ আসতে চলেছে। ওর মন বলছে, আজকেই কিছু একটা ঘটবে। সেক্ষেত্রে, তপনকে সেই বিপদের মুখে ফেলাটা ঠিক হবে না। তপনকে সেফ জায়গায় পাঠানো দরকার। ওকে একা চলে যেতে বললে কিছুতেই যাবে না। রাজকে বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ উদ্ধার করতে হবে। তপনকে বলল –
- ইমিডিয়েটলি রেডি হও আমরা উপরে উঠব। আমাদের এখুনি বেরিয়ে পড়তে হবে।
রাজ তপনকে নিয়ে উপরে ওঠা শুরু করল। পথে ও যথেষ্টই সতর্ক ছিল কিন্তু কোন সমস্যা হল না। ওদের গাড়ি ত্যারনা গ্রামের কাছে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফাঁকা জায়গায় পার্ক করা আছে। রাজ পুরো গাড়ি ভালো করে চেক করল, তারপর তপনকে চেক করতে বলল। এমনকী সামনের ডালা খুলেও দেখতে বলল। তপন গাড়ির ডিকি সহ সবকিছু ভালো করে চেক করে দেখে গাড়ির নিচে ঢুকে পড়ল। একটু বাদেই তপনের চিৎকার শুনলো –
- স্যার, চেসিসে টাই রড আর সাসপেনশনের মাঝে কেউ কিছু একটা তার দিয়ে বেঁধে রেখেছে। কী করব?
রাজ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, বলল –
- এক্ষুনি বেরিয়ে এস, কোনভাবেই ওতে হাত দিও না। আমি দেখছি কী করা যায়।
রাজ নিজের স্মার্টফোন থেকে ফোন করল মিস্টার ঠাকুরকে। বিষয়টা শুনেই উনি জানালেন সাহায্য পাঠাচ্ছেন। রাজ ফোনটা কেটে দিয়ে চিন্তিত মুখে তপনকে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে ঢুকলো।
(পাঁচ)
সাহায্য আসতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। একটা স্করপিওতে ড্রাইভার বাদে পাঁচ জন সশস্ত্র গোয়েন্দা। এঁদের তিনজন রাজের পরিচিত। এই তিনজন সম্বন্ধে রাজের ধারণা খুব ভালো। বাকি দু'জনকে অবশ্য চেনে না তবে সাবধানতা আগে। মিস্টার ঠাকুরকে ফোন করে বাকি দুজনের সম্বন্ধে সবকিছু জেনে নিল। এঁরা দুজনেই অত্যন্ত সৎ এবং বহু বছর ধরে সিবিআইতে কাজ করছেন। এই দুজনের একটা বিশেষ গুণের জন্য ওঁদেরকে পাঠানো হয়েছে। ওঁরা দুজনেই বোমা কিভাবে নিষ্ক্রিয় করতে হয় সেটা ভালই জানেন, ট্রেনিংও নেওয়া আছে। সিবিআইয়ের হয়ে যদি কখনও এ ধরনের প্রয়োজন হয় তখন ওঁদের পাঠানো হয়। দুজনেই গাড়ির নিচে ঢুকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিস্ফোরক বা বোমাটাকে বার করে জানালেন ওটা নাইট্রোগ্লিসারিন জাতীয় বিস্ফোরক। গাড়ি চললে কোথাও একটু জারকিং হলেই ফেটে যাবে এরকম ভাবে লাগানো হয়েছিল। বিস্ফোরকটিকে অত্যন্ত সাবধানে তার খুলে নিষ্ক্রিয় করে নিজেদের গাড়ির ভিতরে অবহেলা ভরে রেখে দিলেন।
পরবর্তী কাজটা একটু গোলমেলে। রাজ ওই দুজনের সঙ্গে তপনকে থাকতে বলে বাকি তিনজনকে ওর সঙ্গে যেতে বলল। এবারের গন্তব্যস্থল আবার নিচে, ডাবল ডেকার রুট ব্রিজের সেই দোকান কাম থাকার জায়গা। রাজেরা যখন নিচে পৌঁছলো তখন রাজের বিধ্বস্ত অবস্থা। উপরে উঠে আবার নিচে নেমেছে। ঘড়ি দেখল, বিকাল পাঁচটা বাজে। প্রথম দোকানে ঢুকলো চা খাবার জন্য। চা আর আলুর পকোড়া জাতীয় একটা ভাজা খেতে খেতে অল্পবয়সী খাসি মালকিন মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল –
- ওই গোয়েন্দা ভদ্রলোক ফিরেছেন?
- না। কেন বলুন তো?
- আসলে পাশের হোটেলের ঘরটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না, বড্ড ছোট। যদি উনি ছেড়ে দিয়ে থাকেন তাহলে এখানে শিফ্ট করব। সকালে ন'টা নাগাদ উনি আমাকে যেতে বলেছিলেন অথচ আপনি সকালে বললেন যে উনি সকাল আটটাতেই বেরিয়ে গেছেন! স্ট্রেঞ্জ! ওঁর কোন বিপদ-আপদ হয় নি তো?
- মনে হয় তো না।
- আচ্ছা, ওই ফরেনার মানে অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে দুটো চলে গেছে? গতকাল অ্যালিস বলে মেয়েটার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। মেয়েটা বেশ ভালো আর মিশুকে।
- ওরা দুজন আগামীকাল সকালে যাবে। ওদের তো দুপুর থেকেই দেখছি না, বোধহয় ওয়াটার ফলস্- এর দিকে গেছে।
রাজ চা খাওয়া শেষ করে পাশের দোকানে গেল। নিজের ঘরে ঢোকার আগে বাইরেটা ভালো করে দেখে যখন নিশ্চিন্ত হল কোথাও কিছু লাগানো নেই তখন দরজার চাবি দিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে সঙ্গের গোয়েন্দা তিনজনকে ইশারায় বলল কোন কথা না বলতে আর বাইরে থাকতে। ভিতরে ঢুকে প্রথমেই নিচু হয়ে মেঝেতে এক কোণে পড়ে থাকা ছোট্ট একটা মাউথ ফ্রেশনারের প্যাকেট হাতে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মেঝেতে ফেলে পায়ের জুতো দিয়ে চিপে ধরে ঘষে দিল। গতকাল অ্যালিস বোরখা খুলে যখন ওর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তখন রাজের কথায় রাজের ছুড়ে মেঝেতে ফেলা বোরখাটা তুলে যখন পড়ছিল তখনই রাজ খেয়াল করেছিল বোরখার পকেট থেকে এটা ও বার করে মেঝেতে ফেলে বোরখা পড়েছিল। গত রাতে বা আজ সকালে ইচ্ছা করেই কিছু করে নি যাতে বিরোধীপক্ষ বুঝতে না পারে ওর প্ল্যান। এ কারণে রাতেও ঘর থেকে কোন ফোন করে নি। এবারে মেঝে থেকে চিউইংগাম জাতীয় মাউথ ফ্রেশনারের প্যাকেটটা ছিড়ে ভিতরে থাকা মাইক্রোফোনটা বার করে দেখে নিল সেটা অকেজো হয়ে গেছে কিনা। যখন নিশ্চিত হল সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে গেছে তখন অবহেলা ভরে ছুরে দূরে ফেলে দিয়ে গোয়েন্দা তিনজনকে বলল –
- ভিতরে চলুন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। গতকালই মাইক্রোফোনটাকে দেখেছিলাম, ইচ্ছা করেই তখন কিছু করি নি। আমার শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ। আপনাদের কী অবস্থা? ওয়াটার ফলস অবধি যেতে পারবেন?
একজন একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলেন –
- ওটা কত দূরে?
- প্রায় এক কিলোমিটার। রাস্তাও খুব খারাপ। যাওয়াটা জরুরী। সঙ্গের রিভলভার লোডেড এবং রেডি অবস্থায় রাখতে হবে। যে কোন সময় অ্যাটাক হতে পারে।
- আমাদের যা দৈহিক অবস্থা, এতটা নামার পর-
রাজ হেসে বলল –
- আমি সকাল নটার সময় উপরে উঠবার পর ঘণ্টা খানেক বাদে আপনারা এলেন। তারপর, আবার আপনাদের সঙ্গে নিচে নামলাম। আমিও তো যাবো আপনাদের সঙ্গে। এরা ভয়ঙ্কর ক্রিমিনাল, মানুষ খুন করতে একমুহূর্তেও ওদের হাত কাঁপে না। আসলে খালি হাতে ওদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আর, সম্ভবত আজকেই ওরা এখান থেকে হাওয়া হয়ে যাবে। এবারে আপনারা ঠিক করুন। সঙ্গে আগের বারে গাইড হিসাবে একটি ছেলেকে নিয়েছিলাম। এবারে কাউকে নেব না কারণ রাস্তাটা আমি চিনে নিয়েছি।
চারজনে ট্যুরিস্টের মতো গল্প করতে করতে ওয়াটার ফলস-এর দিকে এগোলেও প্রত্যেকের কান ও দৃষ্টি ছিল সজাগ কারণ যে কোন মুহূর্তে আশপাশ থেকে গুলি ছুটে আসতে পারে। প্রত্যেকের রিভলভার যেকোনো রকম অবস্থার জন্য তৈরি। ওয়াটার ফলস্ অবধি কোনো সমস্যাই হল না, চারপাশে এত শান্ত যে রাজের মনে হচ্ছিল কোন লোকজনই নেই, পুরো চত্ত্বর জনমানবহীন। শুধু দূরে একটা পাখি পিক পিক করে ডেকেই চলেছে। এই পাখির ডাকটা রাজের পরিচিত। রাজের দেহটা হঠাৎই কী মনে হওয়াতে শক্ত হয়ে গেল, বাকিদের ইশারায় ওর পিছনে আসতে বলল।
রাজ প্রথমেই ওয়াটার ফলস-এর কাছে গেল না, একটা পাথরের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখল। কোথাও কেউ নেই, কোন আওয়াজও নেই। শুধু পাখিটা পিক পিক করে ডেকেই চলেছে। পিছনে বাকি তিনজনও এসে প্রত্যেকেই এক একটা বড়ো পাথরের পিছনে নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলেছে। রাজ একটু ইতস্তত করে পাথরের পিছন থেকে দেহের অর্ধেকটা বার করল। পাখির ডাকটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। রাজ দ্রুত দেহটা পাথরের পিছনে নিয়ে ফিসফিস করে বাকি তিনজনকে বলল –
- রিভলভার রেডি রাখুন, যেকোন মুহূর্তে আক্রমণ হতে পারে। এখানে একাধিক লোক আছে। বি কেয়ারফুল, পাথরের পিছন থেকে বেরোবেন না।
একজন আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন –
- এখানে তো কেউ নেই, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তাহলে আপনি এটা বলছেন কী করে!
- পাখির ডাকটা থেমে গেল, খেয়াল করেছেন? এই পাখির ডাকটা আমি চিনি। এটা ইন্ডিয়ান স্কিমিটার ব্যাবলার বলে এক ধরনের ছাতারে পাখির ডাক। এই পাখিটিকে পূর্ব হিমালয়ান টিরেনে বা উত্তর-পূর্ব ভারতে দেখতে পাওয়া যায় না। ডাক বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে এখানে লোক এসেছে। অর্থাৎ, ওরা বুঝে গেছে আমরা এসেছি। তাই, গুলিগোলা চলতে পারে ভেবে সাবধান করলাম।
- এখন কী করনীয়?
- চুপচাপ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা। ওরা কোন ভুল করলে সেটার সুযোগ নেওয়া।
প্রায় আধ ঘন্টা হয়ে গেছে, সবাই চুপচাপ নিজের জায়গায় সজাগ হয়ে বসে আছেন। বিপদটা কোন দিক থেকে আসবে বোঝা যাচ্ছে না। রাজ শুধু সামনের ওয়াটার ফলস-ই দেখছে না, পিছনটাও বারবার তাকিয়ে দেখছে। রাজের ইনস্ট্রাকশন মতো সঙ্গের তিনজনের একজন পিছনটা দেখছেন, একজন সামনেটা দেখছেন। আর তৃতীয়জনের কাজ হল দুপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নজরে রাখা। আক্রমণ যে কোনো দিক থেকেই হতে পারে তাই এই ব্যবস্থা। হঠাৎ, পাশের সঙ্গী আঙুল তুলে সামনের দিকে কিছু একটা দেখালেন। ওয়াটার ফলস্-এর ডান দিকের পাথরের পিছন থেকে একটা ছোট্ট লাঠি জাতীয় কিছুর মাথা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ, দূরে কোথাও একটা কোকিল ডেকে উঠলো। অন্য একটা কোকিল সেই ডাকে সাড়া দিল। রাজ মনে মনে হাসলো বটে তবে আরও সাবধান হয়ে গেল। কোকিলের ডাক মানে ওরা নিজেদের মধ্যে ডাকের মাধ্যমে কথা আদান প্রদান করছে। সেলফোন ব্যবহার করলে রাজেদের কানে সেই শব্দ যেতে পারে বলে এই ব্যবস্থা। রাজ ইশারায় সবাইকে ধৈর্য ধরে চুপ করে বসে থাকতে বলল। রাজ প্রথম থেকেই একের পর হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ পাঠিয়ে যাচ্ছে। যে নম্বর থেকে পাঠাচ্ছে সেটি নতুন সিম, সার্ভিস প্রোভাইডারের হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ পাঠানোর মত টাওয়ার আছে। নিজের ফোনটাকে সাইলেন্ট করে রেখেছে যাতে কোন মেসেজ এলে তার কোন শব্দ না হয়।
রাজেরা নিচে নামার পর প্রায় ঘণ্টা দেড়েক কেটে গেছে। চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। খুবই অল্প আলোয় দূরের জিনিস দেখতে বেশ অসুবিধাই হচ্ছে। হঠাৎ, পিছন দিক থেকে পরপর দুটো ফায়ারিংয়ের আওয়াজ হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। রাজ মিনিটখানেক ওয়েট করে হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ পাঠালো – “NOW”। এবারে পিছন থেকে পরপর বেশ কয়েকবার ফায়ারিংয়ের আওয়াজ হল। খুব অল্প আলোতে রাজের মনে হল পাঁচ-ছয় জন বা তারও বেশি মানুষ দ্রুত দৌড়ে চারপাশে আড়ালে চলে গেল। রাজ হেসে সঙ্গের তিনজনকে বলল –
- সাহায্য এসে গেছে। আপনারা যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। আমাদেরকে ভুল করে গুলি করে দিলে মুস্কিল।
এবারে পিছন থেকে একটা মাইকের সাহায্যে কেউ চেঁচিয়ে বলল –
- আপনারা কে কোন পক্ষের জানি না তাই সবাই হাতের অস্ত্র ফেলে দুহাত তুলে সোজা সামনের ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ান। তা নাহলে গুলি চালাতে বাধ্য হব। এই পুরো অঞ্চলটাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। এখান থেকে উপরে যাওয়ার একটাই পথ আর সেটা এই মুহূর্তে বি.এস.এফ. এর জওয়ান আর আমাদের কন্ট্রোলে। এছাড়া যেহেতু আর কোনো পথ নেই তাই পালিয়ে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেও লাভ নেই। আমি দশ অবধি গুনবো, তার মধ্যে না বেরোলে নির্বিচারে গুলি চালানো হবে।
রাজ ফিসফিস করে সঙ্গের তিনজনকে বলল –
- এক্ষুনি বেরোবেন না। আপনারা বেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় এলে মিত্ররা গুলি না চালালেও শত্রুরা গুলি চালাবে। তাই, অপেক্ষা করে দেখুন কী হয়।
দশ অবধি গোনা হল, কেউ বেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় এল না। শুরু হল দু'পক্ষের গুলিবর্ষণ। রাজ বুঝতে পারছিল ওর সামনে থাকা দুষ্কৃতকারীরা নিজেদের বাঁচানোর জন্য, লড়াই চালু রাখার জন্য, ওরা যে অস্ত্র শস্ত্রগুলো চোরাচালানের জন্য রেখেছিল সেগুলো ব্যবহার করছে। কারণ, এত রাউন্ড গুলি গোলা চলেছে যে ওদের গুলির অর্থাৎ কার্তুজের স্টক শেষ হতে বাধ্য। অর্থাৎ, রাজেদের এখন ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে।
(ছয়)
প্রায় ঘন্টা দুয়েক বাদে রাজদের সামনে থেকে গুলিবর্ষণ বন্ধ হল। হয় দুষ্কৃতকারীদের গুলি গোলা শেষ অথবা ওরা অন্য কোন প্ল্যান করেছে। এক্ষেত্রে, চুপচাপ বসে থাকাটাই শ্রেয়। এটা ওর সঙ্গী তিনজনকে ফিসফিস করে বলে সঙ্গে এটাও বলল, ওঁদের রিভলভারের গুলি খরচ না করে রেখে দিতে, পরে কাজে আসতে পারে।
পিছন থেকে নানা রকম মুভমেন্টের আওয়াজ। আকাশ মেঘে ঢাকা তাই চাঁদের আলোও নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে রাজের মনে হল ওদের পিছনের দল যতটা নিঃশব্দে এগোনো সম্ভব ততটা নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ-ই একসাথে রাজদের ঠিক পিছন থেকে পাঁচ খানা তীব্র সার্চ লাইট জ্বলে উঠল। সার্চ লাইটের আলোয় সামনের সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। জলাশয়, ওয়াটার ফলস্ থেকে পাথরের চাতালের ওপর বন্দুক বাগিয়ে শুয়ে থাকা তিনজন মানুষ, সবকিছুই পরিষ্কার দেখতে পেল। তিনজন মানুষের তিনটি বন্দুক থেকে তিনটি গুলি বেরোল যার মধ্যে একটি গুলি একটি সার্চলাইটকে অকেজো করে দিল। এবারে গুলি চললো রাজদের পিছন থেকে, একসঙ্গে অনেকগুলো। তিনজন আততায়ীকে সার্চ লাইটের আলোয় রাজ লুটিয়ে পড়তে দেখল। অনেকগুলো বুট জুতোর আওয়াজ। রাজের পাশে একজনকে জিজ্ঞাসা করতে শুনলো –
- মিস্টার রাজ, আপনি কোথায়?
রাজ হাতটা তুলে ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলল –
- আমার তিন সঙ্গী ওই পাথরটার পিছনে রয়েছে। ওঁরা তিনজনেই সিবিআইয়ের গোয়েন্দা।
রাজের গলার আওয়াজ পেয়ে পাথরের আড়াল থেকে ওই তিনজনও বেরিয়ে এলেন। রাজ অবাক হয়ে দেখল বেশ কিছু মানুষ, সংখ্যাটা কম করে কুড়ি-বাইশ হবে, ফায়ার আর্মস হাতে পিছন থেকে এসে বিভিন্ন পাথরের আড়ালে পজিশন নিচ্ছেন। আলো ওঁদের পিছনে থাকায় ওঁদের স্বরূপ ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। তবে মাথার টুপি জাতীয় কিছু এবং পোশাক দেখে মনে হল বিএসএফয়ের জওয়ান। একজন এগিয়ে এসে রাজকে বললেন –
- আপনি আমাদের সঙ্গে পিছনে আসুন, এখানে থাকবেন না। আমরা চাই না, আপনার গায়ে গুলি টুলি লাগুক। অলরেডি দুজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলার ডেডবডি নামার সময় সিঁড়ির পাশে পেয়েছি। সম্ভবত, ওদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে প্রমান লোপ করার জন্য খুন করে রেখে গেছে। উপরে, ত্যারনা গ্রামে পাঁচজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এদের আমরা বহুদিন ধরেই খুঁজছিলাম কিন্তু ট্রেস করতে পারছিলাম না। এটা সিবিআইয়ের সঙ্গে একটা জয়েন্ট অপারেশন ছিল। আপনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যা করেছেন তা অসাধারণ। আমরা আপনার এই অবদানের কথা চিরকাল মনে রাখব।
রাজ ভদ্রলোকের সঙ্গে যেতে যেতে দ্রুত ভেবে যাচ্ছিল। পুরো ঘটনা, আত্রেয়ীকে প্রোটেকশন দেওয়ার নামে সিবিআই চিফের ওকে বারুইপুরে ডেকে নিয়ে যাওয়া থেকে পরপর সমস্ত ঘটনা, এক এক করে অ্যানালিসিস করা শুরু করল। অনেকগুলো খটকা ওর মনে ছিল যা এতদিন প্রকাশ করেনি। এখন এই মুহূর্তে ভদ্রলোকের কথায় সব প্রশ্নের উত্তর ও পেয়ে গেছে। আত্রেয়ীকে একা ফাদারের আশ্রমে রেখে আসার ডিসিশনটা সঠিক ছিল। তখনই ওর মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, তাই পুরো খেলাটা বোঝার জন্য ওই ডিসিশন নিয়েছিল। ক্রমশ রাজের মুখ আর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।
নিঃশব্দে ওই দু'জন ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর আরো কয়েকজন অস্ত্রধারী মানুষ সার্চলাইট নিয়ে ওদের কাছে এসে ওদের সঙ্গে যেতে বললেন। রাজ জানে ওকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর সেখানে কাঁরা ওর অপেক্ষায় রয়েছেন।
ডাবল ডেকার রুট ব্রিজের কাছে দোকানগুলোর সামনে প্রচুর মানুষের জটলা। জায়গাটা আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। একটা বড়ো দোকানের ভিতরে বেশ কয়েকজন বসে আছেন যাঁদের অনেকেই রাজের চেনা। রাজ গটগট করে ভিতরে ঢুকে বসে থাকা সিবিআই চিফ মিস্টার ঠাকুরকে দেখেও সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাসি মুখে বসে থাকা আত্রেয়ীর দিকে তাকিয়ে বলল –
- হাই। আমি আপনাকে এখানেই এক্সপেক্ট করেছিলাম। দেখতে পেয়ে ভালো লাগছে। আশাকরি মিস্টার ঠাকুর আপনাকে এখানে নিয়ে আসার ভালোমতোই ব্যবস্থা করেছিলেন, আপনার কোন সমস্যা হয় নি।
সিবিআই চিফ মিস্টার ঠাকুর রাজের আত্রেয়ীকে করা “মিস্টার ঠাকুর” সম্বোধনটা শুনে একটু অবাক হলেন কারণ রাজ কখনও এ ধরনের সম্বোধনে কথা বলে না। পরমুহূর্তেই হেসে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে আত্রেয়ীকে বললেন –
- ও-হো, হি নোজ্ এভরিথিং। এই কারণেই সবসময় বলি, হি ইজ দ্যা বেস্ট। ওর তুলনা হয়না। একা, ফায়ার আর্মস্ চালাতে না জেনেও, পুরো একটা দলকে রাজের ভাষায় “মগজাস্ত্রের দৌলতে” ফিনিশ করে দিল।
রাজের দিকে ফিরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, রাজ ওঁকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল –
- আমি এই কারণে আপনি বারবার বলা সত্ত্বেও সিবিআইতে জয়েন না করে স্বাধীনভাবে গোয়েন্দাগিরি করছি। আমার মনে হয় কারো হাতের পুতুল হয়ে বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া ভালো। আপনার অনেক কথা এতদিন শুনে এসেছি, এবারে আমি বলব আপনারা শুনবেন। যেখানে ভুল হবে শুধরে দেবেন।
রাজ টেবিলের উপর রাখা মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে একটা বোতল তুলে নিয়ে সিল ভেঙে জল খেয়ে বোতলটা অবহেলা ভরে টেবিলের উপর রেখে শুরু করল –
- আমার ধারণা এই ঘটনার শুরু বেশ কিছুদিন আগে অন্তত এক মাস আগে তো বটেই। আমি তখন বিদেশে, সিবিআই চিফের বিশেষ অনুরোধে একদল ড্রাগ পাচারকারীদের সুলুক-সন্ধান বার করার চেষ্টা করছি। সিবিআই থেকে ভারতে ড্রাগ পাচারকারী এবং চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো হচ্ছিল। এই ঘটনা আমি জানি কারণ মিস্টার ঠাকুর নিজেই আমাকে বলেছেন। সিবিআই-এর কাছে খবর এল এই সমস্ত চোরাচালানকারীরা সিবিআই-এর জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টা করছে। এবং ওরা সিবিআইয়ের দু-তিনজন গোয়েন্দাকে সিলেক্ট করে তাঁদেরকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাতে মানুষের চোখে সিবিআইয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় আর সেই সঙ্গে সংস্থার কাজকর্মও বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফর্চুনেটলি, বিদেশে বসেও আমার ইনফর্মারের কাছ থেকে এই তথ্য আমি পেয়েছিলাম। ওদের তালিকায় প্রথম নামটি ছিল সিবিআইয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহিলা গোয়েন্দা আত্রেয়ী গুপ্তের নাম। এরই মাঝে আত্রেয়ী এসব কোন কিছু না জেনেই সিবিআইকে জানালো ওর সন্দেহ ওর বাড়িতে লুকানো ক্যামেরা আছে। সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা সেটি দেখার নামে সেগুলিকে অকেজো করে নিজেরাই সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে এল। একই সঙ্গে চলছিল অন্য খেলা। আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে তাই বিদেশ থেকে কলকাতায় ফেরত আসবো ঠিক করে ফেলেছি। সিবিআই চিফ সে কথা জানতেন। আর এটাও জানতেন, সে সময়ে আবার আরেকটি তদন্তের ভার আমি নেব না কারণ আমি বিবাহিত এবং আমার স্ত্রীর সঙ্গে একান্তে কিছুদিন সময় কাটাতে চাইব। ভারত সরকারের ডিফেন্স মিনিস্ট্রি নাকি অন্য কোন মিনিস্ট্রি, অথবা প্রাইম মিনিস্টারের অফিসও হতে পারে, কাঁর অনুরোধে আমাকে জড়ানোর এরকম নোংরা প্ল্যান বানানো হল সেটা অবশ্য জানা নেই। চিফ হয়তো জানেন।
মিস্টার ঠাকুর একটু ইতস্তত করে বললেন –
- আসলে প্রাইম মিনিস্টারকে যখন সব জানানো হল তখন উনি স্পেশালি তোমাকে নিয়োগ করতে বলেছিলেন। তাই আর কি - আসলে তুমি ফিরোজ শাহ কোটলার কেসটা মাত্র চৌত্রিশ ঘন্টায় সলভ্ করার পর তোমাকে উনি একটু অন্য চোখে দেখেন। তাই, বাধ্য হয়ে-
রাজ উত্তেজিত হয়ে বলল –
- তাই বাধ্য হয়ে এরকম একটা নোংরা, বাজে প্ল্যান বানালেন!
মিস্টার ঠাকুর উত্তেজিত হয়ে বললেন –
- নোংরা, বাজে প্ল্যান কেন বলছ!
- নোংরা, বাজে প্ল্যান নয়? আমার স্ত্রী রোমাকে প্রোটেক্ট না করে আমার বাবা-মা-ভাইয়ের প্রোটেকশনের জন্য লোক পাঠালেন সেটাও মেনে নেওয়া যায় কারন রোমাকে হয়তো আপনারা কোন সেফ জায়গায় রেখেছেন। কিন্তু, আমার প্রাক্তন বান্ধবী শর্মিলা! হঠাৎ তাকে কোন যুক্তিতে প্রোটেকশন দিতে গেলেন! আর তারপর ভিডিও কল করে সাজানো একটা দৃশ্যের ছবি দেখালেন যাতে দেখা যাচ্ছে বোমা বিস্ফোরণে শর্মিলা আর আপনার দুই গোয়েন্দার দেহ পুড়ে খাঁক হয়ে গেছে। প্রথমে বুঝতে পারি নি কিন্তু যখন আপনি জিজ্ঞাসা করলেন আমি বডি দেখতে যাব কিনা তখন সন্দেহ হল। এই মুহূর্তে শর্মিলার ফোন নম্বর আমার কাছে না থাকতে পারে কিন্তু ওর কোন আত্মীয়ের ফোন নম্বরও তো আমার কাছে থাকতে পারে এইটা আপনাদের মাথায় এল না! ওটা যে কোন ফিল্ম স্টুডিওতে তৈরি করা সাজানো দৃশ্য তা বুঝতে পেরেছিলাম পরের দিন যখন শর্মিলার আসল খবরটা পেলাম। সেই কারণে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি নি। এবারে আমি কেন নোংরা প্ল্যান বলেছি সেটা এক্সপ্লেইন করছি। শিলিগুড়ির লিনটন হোটেলে আত্রেয়ীকে রুম চেঞ্জ করতে বলেছিলাম সাবধানতা নেওয়ার জন্য। সেদিনই রাতে বোমা বিস্ফোরণে ওই ঘরটাকে উড়িয়ে দেওয়া হল! অর্থাৎ আত্রেয়ীকে মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে এটা বোঝানো? উল্টোদিকের ঘরে আমি ছিলাম। বিস্ফোরণের পর দুই একটা জিনিস ঘর থেকে উদ্ধার করে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য, যেই রিপোর্ট আমার ধারণা এখনও তৈরি হয়নি। অর্থাৎ, বিষয়টা যতটা গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত ছিল তা আপনারা দেখেন নি। আমার পরের দিন সন্দেহ হওয়ায় লিনটন হোটেলে যাই এবং সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে চমকে উঠি। আপনার লোকেরাই ওই ঘরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে! কিন্তু, আপনারা জানলেন কী করে আমি আত্রেয়ীকে অন্য রুমে রাতে শিফ্ট করতে বলেছি? আত্রেয়ী যে বলেনি তা আমি জানি। তার মানে হোটেলে আপনার লোক ছিল এবং পুরোটা তারা নজরে রাখছিল। আমার প্রথম মনে হয়েছিল কেন এরকমটা করা হচ্ছে! পরে যখন ওয়াশিংটন থেকে আমার ইনফর্মার আমাকে জানালো যে ওখানকার ড্রাগ ডিলাররা ভারতে ড্রাগের ব্যবসা নিশ্চিত করার জন্য আর সিবিআইকে বড়োসরো আঘাত দেওয়ার জন্য ওদের এক-দুজন গোয়েন্দাকে সত্যি সত্যিই হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছে তখন ধীরে ধীরে পুরো ছবিটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আপনাদের নোংরা খেলাটা ও বুঝতে পারলাম। আত্রেয়ীর বাড়িতে লুকানো ক্যামেরা বসানোর কাজটা হয়তো ওরা করেছিল। আত্রেয়ী যখন এটা আপনাদের ইনফর্ম করল তখনই সম্ভবত আপনার মাথায় এই প্ল্যানটা এল। আমাকে দিয়ে আত্রেয়ীকে প্রোটেক্ট করাই শুধু নয় ওদের দলটাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই আপনারা এইসব করেছেন। আপনারা ভাল করেই জানেন আমি কোন তদন্তে নামলে তার শেষ দেখে ছাড়ি। আমিও খেলাটা খেলব বলে ঠিক করলাম, তবে আমার মতো করে। আত্রেয়ীর গার্মেন্টসের ট্র্যাকিং ডিভাইস নষ্ট করে আপনাদের ট্র্যাক করা বন্ধ করার পর প্রথমেই যেটা আমার করার কথা তা হল আত্রেয়ীকে নিয়ে কার্শিয়াংয়ের ফাদারের আশ্রম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। কারন, ট্র্যাকিং ডিভাইসের মাধ্যমে আপনারা তো জেনেই গেছেন আত্রেয়ীকে কোথায় রাখা হয়েছে। তা না করে আত্রেয়ীকে ওখানে রেখে আমি একা চলে গেলাম! আপনাদের সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। আসলে আশ্রমে যাওয়ার পথটা নিচ থেকে রাস্তা ঘুরে ঘুরে উপরে আশ্রমে পৌঁছেছে। ওই রাস্তা আশ্রমের লোকেরা ছাড়া কেউ ব্যবহার করে না কারণ ওখানে কোনো ঘরবাড়ি নেই। তাছাড়া, ফাদারও রাস্তাটা পরিষ্কার রাখার সব সময় চেষ্টা করেন। সেই রাস্তায় সিগারেটের টুকরো, বিস্কিটের বা পান পারাগের প্যাকেট পাওয়া আশ্চর্যজনক নয়কি? সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম আপনাদের লোকেরা পুরো পাহাড় ও আশ্রমটাকে পাহারায় রেখেছে। নাটকীয়ভাবে আত্রেয়ীকে ডেকে জামাকাপড় খুলিয়ে ট্র্যাকিং ডিভাইসটা বার করে নষ্ট করে ওকে ওখানে রেখে চলে গেলাম কারন আমি নিশ্চিন্তে ছিলাম আপনার লোকেরা ওর ঠিকই দেখভাল করবে। সঙ্গে এটাও বুঝেছিলাম, ড্রাগ ব্যবসায়ীদের টার্গেট লিস্টে আমার নামটাও ঢুকে গেছে। আমি আমাকে নিয়ে ভাবি না, কিন্তু একটি বিশেষ কারণে মনে হল গ্যাংটাকে শেষ করে দেওয়া উচিত। আপনাদের গোয়েন্দারা যে কতটা অদক্ষ তা বুঝতে পারলাম ডাডেকারুটব্রিজেগিয়ে। যে জায়গাটায় আপনাদের সবার প্রথমে যাওয়া উচিত, যেখানে আত্রেয়ী একটা পুরো দলকে ধরতে সাহায্য করেছিল, সেখানে আপনারা তদন্ত করতে যাওয়া প্রয়োজন মনে করেননি! স্ট্রেঞ্জ! যাই হোক, আমার গাড়িতে বিস্ফোরক লাগানোতে বুঝতে পারলাম সঠিক পথে এগোচ্ছি। বাকি সবটাই আপনাদের জানা। আমি প্রফেশনাল গোয়েন্দা। আপনারা আমাকে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ করেছিলেন আত্রেয়ীকে প্রোটেক্ট করবার জন্য, তা করেছি। কিন্তু, পুরো গ্যাংটাকে ধরে দেওয়ার একটা ফি অর্থাৎ পারিশ্রমিক আছে। কাইন্ডলি আমার একাউন্টে টাকাটা জমা করে দেবেন। ও হ্যাঁ, আপনাদের কী মনে হয় হঠাৎ কেন পুরো দলটাকে নিজের জীবন বিপন্ন করে ধ্বংস করতে এগিয়ে এলাম? আপনারা কী ভাবছেন যদি বলেন।
মিস্টার ঠাকুর একটু ব্যাজার মুখ করে বললেন –
- অতীতে যে কারণে করেছ সেই একই কারণ। যা করেছ তা দেশের জন্য করেছ। আমি জানি তুমি কতটা দেশকে ভালোবাসো।
- স্যরি, এবারে ভুল করেছেন। অতীতে দেশের কথা ভেবেই সব করেছি কিন্তু এবারে নয়। আমার স্ত্রী রোমাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। আমার সন্দেহ হয়েছিল ওরা রোমার খবর জানতে পারলে রোমাকে টার্গেট করবে। আমি যা করেছি রোমাকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য করেছি, রোমাকে বিপদমুক্ত করার জন্য করেছি। বোঝাতে পেরেছি?
রাজ উঠে গটগট করে ত্যারনা গ্রামে যাবে বলে সিঁড়ির দিকে এগোল। শুনলো পিছনে সিবিআই চিফ বলছেন –
- রাজ, স্যরি, যা হয়েছে তা ভুলে যাও। এত রাতে কোথায় যাবে? আগামীকাল সকালে আমরা সবাই একসঙ্গে যাব।
রাজ সিবিআই চিফের এই কথার কোন উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেল। মনে মনে ভাবছিল কীভাবে তাড়াতাড়ি রোমার কাছে পৌঁছানো যায়।
ওজন কমানোর জন্য হোক কি চটজলদি হেলদি ডিনার ভরসা এই স্যুপ। আবার কনকনে ঠান্ডায় একগাদা জল ঘেঁটে কমপ্লিট কোর্স থালি বানাতে ইচ্ছে না করলেও ঝটপট করে একটা স্যুপ বানালে মোটামুটি কাজ চলে যায়। এমনই ৬টি স্যুপের রেসিপি রইলো আজ।
Comments